আফ্রিকার জঙ্গলে দস্যু বনহুর

আফ্রিকার জঙ্গলে দস্যু বনহুর

মীরা থ’ মেরে গেছে, কি আনন্দে অধীর হবে তা নয়, আড়ষ্ট হয়ে গেছে সে। আশ্চর্য নয়নে তাকাচ্ছে ওদের দু’জনার মুখে।

কিন্তু প্রদীপ কুমার আর নিশ্চুপ থাকতে পারলো না। ছুটে গেলো সে, আবেগ ভরা কণ্ঠে ডাকলো– মীরা!

মীরা কোনো জবাব দিতে পারেনা, সে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

বনহুর শান্ত-মিষ্টি কণ্ঠে বলে–মীরা, তোমার সম্মুখে যে দাঁড়িয়ে, সে-ই তোমার আসল প্রদীপ কুমার; আর আমি নকল। আমার পরিচয় জানতে পারবে তোমার প্রদীপের মুখে। মীরা, আশীর্বাদ করি, তোমরা সুখী হও– কথা শেষ করেই পাশের মুক্ত জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো দস্যু বনহুর।

মীরার মুখে কোনো কথা নেই, সে তাকিয়ে আছে যে পথে প্রদীপ কুমার অদৃশ্য হয়েছে।

প্রদীপ কুমার মীরাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললো–মীরা, যে চলে গেলো সে তোমার প্রদীপ নয়–

কে তবে?

বিশ্ববিখ্যাত দস্যু বনহুর।

দস্যু বনহুর!

হা মীরা, এতোদিন দস্যু বনহুর নাম শুনলে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করতাম কিন্তু আজ আমার অন্তর ভরে তাকে শ্রদ্ধা করি। দস্যু বনহুর শুধু আমার রক্ষক নয়– আমার প্রাণদাতা।

মীরা অবাক হয়ে প্রদীপের কথাগুলো শুনছিলো, বললো এবার প্রদীপ, তুমি রাতের অন্ধকারে আমাকে না বলে কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলে?

আমি রাতের অন্ধকারে কোথাও যাইনি বা পালাইনি। যাকে তোমরা প্রদীপ বলে এতোদিন আঁকড়ে ধরে রেখেছিলে সে আমি নইদস্যু বনহুর।

তুমি নও?

না।

কিন্তু?

আমি সব শুনেছি। দস্যু বনহুর আমাকে সব বলেছে। মীরা, তুমি পবিত্র, তুমি নিষ্পাপ– নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে প্রদীপ মীরাকে।

মীরা প্রদীপের বাহুবন্ধনে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। অসীম আনন্দে আপ্লুত হয়ে যায় ওরা।

*

জাহাজের ডেকে রেলিংএ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দস্যু বনহুর। চোখে তার পুরু কালো চশমা, ঠোঁটের ফাঁকে ধূমায়িত সিগারেট। আনমনে তাকিয়ে আছে সে সম্মুখের সীমাহীন জলরাশির দিকে।

বনহুর কান্দাই এর পথে ফিরে চলেছে।

আগের চেয়ে আজ তার মন অনেকটা হাল্কা। মন্থনার রাজ কুমার প্রদীপকে সদ্য-মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে সে, এ আনন্দ তার কম নয়। প্রদীপ কুমারকেও শুধু সে মৃত্যুর কবল থেকেই রক্ষা করেনি, মীরার পাশে তাকে ফিরিয়ে এনে দিতে পেরেছে। বনহুরের হাসি পেলো শেষ পর্যন্ত তাকে বিচারকের ভূমিকাও পালন করতে হলো। কিন্তু সবচেয়ে বনহুর বেশি আশ্চর্য হয়েছে প্রদীপের সঙ্গে তার নিজের চেহারার হুবহু মিল দেখে। মীরার কি অপরাধ আর তার নিজেরই বা দোষ কি! মীরা তাকে সচ্ছ মন নিয়ে গ্রহণ করেছিলো, নিজেকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলো তার প্রদীপের মধ্যে। বনহুর নিজেও জানতোনা তার নিজের পরিচয়। মীরার ভালবাস তাকে মোহগ্রস্ত করে ফেলেছিলো। মীরার সান্নিধ্য তার সমস্ত হৃদয়কে করে ফেলেছিলো আচ্ছাদিত। নিজের অজান্তে বনহুর কখন যে মীরাকে ভালবেসে ফেলেছিলো, নিজেই বুঝতে পারেনি। কিন্তু বনহুর সংযত রেখেছিলো নিজেকে, মীরার পবিত্রতা সে নষ্ট করেনি কোনোদিন। আজ মীরা ফিরে পেয়েছে তার আসল প্রদীপ কুমারকে, আর বনহুর সরে এসেছে দূরে।–কিন্তু মনের কোণে একটা ব্যথার ছোঁয়া খচ্‌ খচ করছিলো তার।

হঠাৎ বনহুরের চিন্তাধারায় ব্যাঘাত ঘটলো, সুমিষ্ট একটি কণ্ঠস্বর– আপনি কোথায় যাবেন?

ফিরে তাকালো বনহুর, কালো চশমার ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। একটু আশ্চর্য হলো সে। সুন্দরী একটি যুবতী তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। এক নজরে দেখে নিলো বনহুর যুবতীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত। আধুনিক সাজে সজ্জিত যুবতী, হাতে কুমীরের চামড়ার ভ্যানিটী। পায়ে লম্বা হিলওয়ালা লেডিস সু। খোঁপাটা মাথার উপরে উঁচু করে বাঁধা। চোখে কাজলের রেখা, ললাটে কুমকুমের টিপ্। সরু দু’খানা ঠোঁটে পুরু করে লিপষ্টিক লাগানো। গাড়ির রঙ বনহুরের চোখে ধরা পড়লো না কারণ তার চোখে সবই গভীর নীলাভ দেখাচ্ছে। একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো বনহুর কান্দাই যাবো।

মেয়েটি যেন খুশি হলো বনহুরের কথায়, বললো– যাক, ভালই হলো, শেষ অবধি আপনি আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। আমরাও কান্দাই যাবো।

বনহুর যুবতীর সচ্ছভাব লক্ষ্য করে একটু অবাক হলো। সাধারণতঃ বাঙালি মেয়েরা হঠাৎ কোনো পুরুষের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে পারেনা। বনহুর হস্তস্থিত সিগারেটটা সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

যুবতী আবার বললো আমার আব্বা কান্দাই পুলিশ বিভাগে কাজ করেন। আমি ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মন্থনা দ্বীপে মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছিলাম। আমার মামাও মন্থনার পুলিশ ইন্সপেক্টার।

কালো চশমার আড়ালে দস্যু বনহুরের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো বিপুল আগ্রহে। একটু হেসে বললো বনহুর–কান্দাই যাচ্ছেন, বেশতো। আমিও পুলিশ বিভাগে কাজ করি, আপনার আব্বার নামটা জানতে পারলে হয়তো চিনতে–

আপনিও পুলিশের লোক, যা নিশ্চিন্ত হলাম। আমার আব্বার নাম বললে নিশ্চয় তাকে চিনতে পারবেন– পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ জাফরী।

বনহুর হো হো করে হেসে উঠলো– মিঃ জাফরীর কন্যা আপনি! তিনি আমার অত্যন্ত বন্ধু লোক।

সত্যি, আপনাকে আমাদের সঙ্গে পেয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা রইলো না।

 কেন, দুশ্চিন্তা কিসের?

আপনি পুলিশ বিভাগে কাজ করেন অথচ বলছেন দুশ্চিন্তা কিসের? দস্যু বনহুরের অত্যাচারে দেশের কোনো শান্তি আছে নাকি? এই যে জাহাজে চলেছি, সব সময় মনে হচ্ছে–কখন না জানি দস্যু বনহুর–

হামলা করে বসে, তাই না? যুবতীর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললো বনহুর।

এমন সময় একটি পনেরো-ষোল বছরের বালক দূর থেকে যুবতীটিকে দেখতে পেয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে– বড় আপা, ওখানে কি করছো?

যুবতী হাত তুলে ডাকে– চলে আয় মঞ্জুর।

বনহুর সিগারেট কেস বের করে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে।

মঞ্জুর একরকম প্রায় ছুটেই আসে– তুমি এখানে, আর আমি তোমাকে খুঁজে ফিরছি সমস্ত জাহাজময়। আচ্ছা মেয়ে তুমি, একটু যদি ভয় থাকতো তোমার হৃদয়ে।

কেনরে কিসের ভয়?

দস্যু বনহুরের।

দস্যু বনহুর– দস্যু বনহুর, বলি এ জাহাজে সে আসবে কি করতে! শোন ভয় পাবার কিছু নেই; ইনিও পুলিশের লোক আমাদের সঙ্গেই কান্দাই পর্যন্ত যাবেন, তাছাড়া আব্বার বন্ধু-জন।

বালকটি হাস্যউজ্জ্বল মুখে তাকালো বনহুরের দিকে, আদাব দিয়ে বললো– যাহোক, আপামনিকে ধন্যবাদ, এতোবড় জাহাজটায় বেছে বেছে পুলিশের লোককে আবিষ্কার করে নিতে পেরেছেন।

বনহুর বালকটিকে লক্ষ্য করে বললো– তোমার নাম মঞ্জুর, ওর মুখে ডাক শুনেই জেনে নিতে সক্ষম হয়েছি। এবার বলোতো মঞ্জুর, তোমার আপামনির নামটা কি?

ওঃ, এতোক্ষণ শুধু আলাপই হচ্ছিলো, আসল ব্যাপারটা এখনও বাকি আছে। হাঁ শুনুন, আমার আপামনির নাম মিস সুইটি। বড়ড় মিষ্টি কিন্তু আমার আপামনি, দেখবেন আবার খেয়ে ফেলবেন না যেন।

বনহুর ছেলেটির কথা-বার্তায় বুঝতে পারলো, যেমন সুচতুর বাবা তেমনি তাঁর সন্তান। হাসলো বনহুর– তোমার আপা যেমন মিষ্টি, তুমি কিন্তু তেমনি টক–

এক সঙ্গে ওরা তিনজন হেসে উঠলো।

প্রথম পরিচয়েই এতো অল্পসময়ের মধ্যেই মিস সুইটি ও মঞ্জুরের সঙ্গে দস্যু বনহুরের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলো।

সুইটি বললো– যদিও বয়সে আপনি আমাদের চেয়ে অনেক বড় তবু একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো, মনে কিছু করবেন না নিশ্চয়ই?

মোটেই করবোনা, বলুন? বললো বনহুর।

আপনার নামটা–

ওঃ বলতে ভুলেই গেছি– তোমরা জিজ্ঞাসা করবার পূর্বেই আমার বলা উচিৎ ছিলো। আমার নাম আলমগীর চৌধুরী।

হাঁ, আমি আব্বার মুখে আপনার নাম অনেক বার শুনেছি। বিজ্ঞের মত বললো মঞ্জুর, সত্যিই যেন সে তার পিতার মুখে এ নাম অনেক বার শুনেছে।

মিঃ আলমগীর চৌধুরীকে পেয়ে মিস সুইটি ও মঞ্জুর খুশি হলো অনেক। যাহোক একটা ভরসা। পেলো ওরা মনে। পুলিশের লোক জেনে সাহসটা ওদের দশগুণ বেড়ে গেছে।

বনহুরের অবস্থাও তাই সে অবশ্য ভয়ে নয়, এই বিরাট জাহাজটায় প্রায় এক সপ্তাহকাল নিঃসঙ্গ একা কাটাতে হতো, একদিনেই মনটা কেমন হাঁপিয়ে উঠেছিলো মিস সুইটি আর মঞ্জুরকে পেয়ে ভালো হলো, তবু গল্পে-সল্প সময় কাটবে।

বনহুর প্রথমেই যুবতীর কথা-বার্তায় আশ্চর্য হয়েছিলো, কারণ যুবতী তার সঙ্গে যেভাবে আলাপ করছে তাতে মনে হচ্ছে সে যেন তার কত পরিচিত।

এবার বনহুরকে আরও অবাক করে দিয়ে বললো মিস সুইটি আজ আমাদের ক্যাবিনে আপনার চায়ের দাওয়াত রইলো।

বনহুর প্রথমে আপত্তি তুলতে যাচ্ছিলো কিন্তু মঞ্জুর বনহুরের হাত চেপে ধরলো আপনাকে ছাড়ছিনে।

বিপদে ফেললে দেখছি তোমরা। বরং আমার ক্যাবিনে তোমাদের দু’জনার দাওয়াত রইলো, বয়কে বলে দিচ্ছি।

হেসে বললো মঞ্জুর–বয়ের হাতে চা খাওয়ার চেয়ে আমার আপামনির হাতে একবার টেষ্ট করে দেখবেন। একবার যদি খান তবে আবার আপনা-আপনি দাওয়াত চেয়ে নেবেন।

তাই নাকি! বেশ, দাওয়াত কবুল করলাম। কিন্তু এখন নয়, বিকেলে।

কারণ? বললো মঞ্জুর।

বনহুর এতোটুকু বালকের কাছেও কথায় যেন টিকে উঠতে পারছিলোনা, মৃদু হেসে বললো– চা নাস্তা পর্ব শেষ করে তবেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।

তখনকার মত আর বেশি কথাবার্তা হলোনা, বনহুর ওদের দুটি ভাই-বোনের কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে এলো নিজ ক্যাবিনে।

ক্যাবিনেও কোনো কাজ নেই।

অলস দেহটা ক্যাবিনের সোফায় এলিয়ে দিয়ে টেবিল থেকে পত্রিকাখানা হাতে তুলে নিলো বনহুর। অনিচ্ছা সত্বেও দেখতে লাগলো পাতাগুলো নেড়েচেড়ে। হঠাৎ মীরা ও প্রদীপের ছবিতে নজর . পড়তেই চমকে উঠলো সে। দৃষ্টি তার স্থির হলো নীচে লেখা রয়েছে–

মন্থনার রাজ কুমার প্রদীপ গত
রাতে মন্থনায় ফিরে এসেছেন।
আগামী পূর্ণিমায় প্রদীপ কুমারের
সঙ্গে মীরা দেবীর বিয়ে সুসম্পন্ন হবে।

বনহুর ধীরে ধীরে আনমনা হয়ে যায়, প্রদীপ ফিরে পেলো তার মীরাকে, মীরা পেলো প্রদীপকে– আর বনহুর কি কোনোদিন ফিরে পাবে তার বনকন্যা নূরীকে! মৃত্যুর অসীমে যে বিলীন হয়ে গেছে, আর কি কোনোদিন পাবে সে তার সন্ধান! কোনোদিন বনহুর আর নূরীকে ফিরে পাবেনা। হাতের পত্রিকাখানা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্যাবিনের মুক্ত গবাক্ষে এসে দাঁড়ালো, সেখান থেকে সম্পূর্ণ সাগরবক্ষ দেখা যাচ্ছে। শুধু জল আর জল– এতোটুকু সবুজের চিহ্ন কোথাও নেই। এমন কি আকাশে কোনো উড়ন্ত পাখিও নজরে পড়ছেনা, কারণ সাগরবক্ষ থেকে তীর কত দূরে কে জানে।

বনহুর পিছনে হাত রেখে উদাস দৃষ্টি মেলে গভীরভাবে নূরীর কথা স্মরণ করছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ফিরে তাকাতেই, বয় টেবিলে কফি রেখে গেলো।

বনহুর আবার ফিরে এসে টেবিলের পাশে সোফায় বসে পড়লো, বড় নিঃসঙ্গ একা লাগছে। খেয়ালী বনহুরের এমন নিশ্চুপতা বড় অসহ্যনীয়। সময়গুলো যেন আর কাটতে চায়না।

বনহুর সবেমাত্র কফির পেয়ালা হাতে তুলে নিয়েছে–ঠিক ঐ মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো মঞ্জুর; পিছনে মিস সুইটি। মঞ্জুরের হস্তে একখানা পত্রিকা।

মিস সুইটি ও মঞ্জুর ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই বনহুর অনুমানে বুঝতে পারলো পত্রিকায় প্রদীপের ছবি দেখে ওরা ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসেছে। বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো– ব্যাপার কি?

মঞ্জুর পত্রিকাখানা মেলে ধরলো বনহুরের সম্মুখে আপনি আমাদের মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন। আপনি মন্থনার রাজকুমার প্রদীপ।

মিস সুইটি বললো– পাশের মেয়েটি বুঝি আপনার মীরা?

বনহুর হেসে বললো– প্রদীপের সঙ্গে আমার চেহারার হুবহু মিল আছে বটে, কিন্তু আমি মন্থনার রাজকুমার নই।

আপনার চেহারাটা কিন্তু রাজকুমারের মতই দেখতে।

 মঞ্জুরের কথায় বললো বনহুর– তাই নাকি?

সত্যি! কথাটা বললো সুইটি।

 হাসলো বনহুর।

 এ-কথা সে-কথার পর বিদায় গ্রহণ করলো মঞ্জুর আর সুইটি।

বনহুরও উঠে পড়লো দ্বিপ্রহরের গোসলটা সেরে নিতে হবে।

মিস সুইটি আর মঞ্জুর চলে যাবার সময় আবার স্মরণ করিয়ে দিলো বিকেলে চা-পর্বটা তাদের ওখানে সারতে হবে।

*

চায়ের টেবিলে বনহুর, মঞ্জুর আর সুইটি চা পান করতে করতে হাসি-গল্পে মেতে উঠেছে।

পাশের টেবিলে ট্রানজিস্টার রেডিও একটি ইংলিশ গান পরিবেশন করছিলো।

সুইটি নিজ হস্তে চা বানিয়েছে এ নিয়েই গল্প হচ্ছিলো। প্রথম প্রথম একবার নাকি সে তার আব্বার কয়েকজন বন্ধুকে চা তৈরি করে খাওয়াচ্ছিলো। আব্বা খুব প্রশংসা করছিলেন সুইটির, ওর হাতে চা। নাকি অমৃতের চেয়েও সুস্বাদু। সুইটি পিতার মুখে নিজ প্রশংসা শুনে গর্বে স্ফীত হয়ে উঠছিলো। খুশি মনে চা তৈরি করছিলো সে।

বয় ভুল করে চিনির পাত্রটা না এনে এনেছে লবণের বোয়াম। অবশ্য বয়ের কোনো দোষ ছিলোনা, কারণ সুইটির আম্মা কাশ্মীর গিয়ে দুটো কাশ্মীরী পট এনেছিলেন একই রকম দেখতে। সুন্দর পাত্র দুটি–তিনি একটিতে চিনি অপরটিতে লবণ ব্যবহার করতেন। বয় যে সেদিন চিনির পাত্র ভেবে লবণের পাত্রটা এনে হাজির করবে এটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। সুইটি খুব আনন্দিত মনে চায়ে চিনির পরিবর্তে লবণ মিশিয়ে এগিয়ে দিয়েছিলো তার আব্বার বন্ধুদের সামনে। আর পরের কাহিনী বলতে গিয়ে মিস সুইটি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলো, এবার শুরু করলো মঞ্জুর আব্বার বন্ধুগণ খুশি হয়ে মিস সুইটি রাণীর তৈরি চা পান করতে গিয়ে যেমন এক চুমুক মুখে দিয়েছেন অমনি হা- প্রত্যেক জনই থু-থু করে মুখের চা মেঝের গালিচায় ঢেলে ফেললো। আব্বা তো একেবারে থ মেরে গেছেন, ব্যাপার কি!–

আবার একটা হাসির হুল্লোড় উঠলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে রেডিওতে ঘোষণা শুরু হলো, মন্থনা দ্বীপ থেকে যে জাহাজ কান্দাই অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছে, সেই জাহাজে ফিরে যাচ্ছে দস্যু বনহুর। যাত্রীদের সবাইকে সাবধান হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সরকার। সম্মুখে আরাকান বন্দরে পুলিশ ফোর্স অপেক্ষা করছে। বনহুর এবার ধরা পড়তে বাধ্য হবে–

ঘোষণাটা প্রচার হবার সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের মুখোব পরিবর্তন হলো।

মিস সুইটি আর মঞ্জুরের মুখ কালো হয়ে উঠলো। মুহূর্তে ওদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। সুইটি ভীতভাবে বললো সর্বনাশ! যে ভয় করেছিলাম, সেই ভয়ই গ্রাস করলো।

মঞ্জুর প্রায় কাদো কাঁদো সুরে বললো– মিঃ চৌধুরী, আপনি কিছুতেই আমাদের ছেড়ে যেতে। পারবেন না। এখানেই থাকতে হবে আপনাকে।

বনহুর বললো– ভয় কি, তোমাদের সঙ্গে পুলিশ তো রয়েছে, আর রয়েছে তাদের রাইফেল।

তবু ভয় হচ্ছে। সত্যি বলতে কি, দস্যু বনহুর যখন এই জাহাজে আছে তখন আর কারো রক্ষা নেই।

বনহুর একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো– কেন, সে বাঘ না ভলুক? সেও তো মানুষ তোমার আমার মতই একজন।

হোক সে মানুষ কিন্তু সে সাধারণ মানুষের মত নয়। সে কাউকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

তা হয় তো করে না, তাই বলে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তিকে সে হত্যা করতে যাবে কেন?

সুইটি ধরে বসলো তাদের ক্যাবিনেই থাকতে হবে আলমগীর সাহেবকে; বিশেষ করে মঞ্জুরের বিছানায় শুতে হবে তাকে।

তখনকার মত থাকবে বলে কথা দিয়ে বিদায় গ্রহণ করলো বনহুর।

কিন্তু ক্যাবিনে ফিরে সে পায়চারী শুরু করলো, পুলিশ কি করে সন্ধান পেলো। তাহলে কি প্রদীপ জানিয়ে দিয়েছে ব্যাপারটা? না, সে কিছুতেই একথা কাউকে জানাবে না প্রদীপ প্রাণ রক্ষা পেয়েছে তার জন্য। তবে কি মীরা বলেছে ভাবীস্বামীর মুখে তার পরিচয় জানতে পেরে? বিশ্বাস কি, মীরাই হয়তো ভুল করে কাউকে ব্যাপারটা বলে ফেলেছে। তাই হবে না হলে মন্থনার কোনো প্রাণী জানে না একথা।

 বনহুরের চিন্তাধারা একেবারে অমূলক নয়, মীরাই কথাটা বলেছিলো তার এক বান্ধবীর কাছে। মীরা জানতো না– তার বান্ধবী কোনো এক গোয়েন্দা পুলিশ অফিসারের ভগ্নী।

ভগ্নীর মুখে এই রহস্যপূর্ণ কাহিনী শুনে গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার নিজেকে আয়ত্বে রাখতে পারেননি, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন মন্থনার পুলিশ অফিসে সব কথা।

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ মহল জানতে পেরেছে যে জাহাজখানা গত প্রভাতে মন্থনা বন্দর ত্যাগ করে কান্দাই অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছে সে জাহাজেই দস্যু বনহুর মন্থনার রাজকুমার প্রদীপকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে এবং তৎক্ষণাৎ রেডিও-খবরে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে সমস্ত দেশ হতে দেশান্তরে। এমন কি সর্বপ্রথম জাহাজখানা যে বন্দরে নোঙ্গর করবে, সেই আরাকান বন্দরেও জানানো হয়েছে সংবাদটা ওয়্যারলেসে।

মীরা জানতো না ব্যাপারটা এতোদূর গড়াবে। “দেওয়ালেরও কান আছে” কথাটা আজ মর্মে মর্মে অনুভব করে মীরা, কেন সে ভাল ভেবে কথাটা বলেছিলো তার বান্ধবীর কাছে? কেন সে এতোবড় একটা ভুল করেছিলো? দস্যু বনহুর তার কত বড় মঙ্গল সাধন করেছে, আর তারই কিনা সর্বনাশ হবে! মন্থনায় বসে ভাবে মীরা তার নকল প্রদীপের কথা– নিশ্চয়ই সে এখন ফিরে যাচ্ছে, হয়তো বা। রেডিও-সংবাদ তার কানেও পৌঁছে গেছে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। কি ভয়ঙ্কর, কি অশোভনীয় ব্যাপার! মীরা নিজের ভুলের জন্য বিদগ্ধ হয়।

*

মীরা যখন তার নকল প্রদীপকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে, তখন মডেল’ জাহাজের একটি ক্যাবিনে দস্যু বনহুর পায়চারী করছে আর ভাবছে আরাকানে জাহাজ পৌঁছবার পূর্বে তাকে গা ঢাকা দিতে হবে। কিন্তু জাহাজে অবস্থান করা কিছুতেই সমীচীন হবে না। আরাকান পুলিশ সমস্ত জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখবে, তাছাড়া তাকে সনাক্ত করার উদ্দেশ্যে কান্দাই থেকে হয়তো কয়েকজন বিশিষ্ট পুলিশ-বন্ধু প্লেনযোগে এসে হাজির হয়েছেন, তারা তাকে সাদর অভিনন্দন জানাবার জন্য আরাকান বন্দরে পুষ্পমাল্যের পরিবর্তে লৌহ-শিকল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কাজেই আরাকান পর্যন্ত এ জাহাজে টিকে থাকা আর কিছুতেই সম্ভব হবে না।

বনহুর সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চললো। তাদের জাহাজ মডেল’ এখন আফ্রিকা জঙ্গলের প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আরাকানে পৌঁছতে এখন এক রাত্রি ও একটি দিন লাগবে। আজ রাতেই তাকে সরে পড়তে হবে জাহাজ থেকে। বনহুর মনে মনে স্থির করে নিলো, এবার তার ভাগ্য পরীক্ষা হবে আফ্রিকার জঙ্গলে। তাদের জাহাজ এখন সম্পূর্ণ আফ্রিকার জঙ্গল এরিয়ার পাশ দিয়ে চলেছে।

সমস্ত জাহাজময় একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, দস্যু বনহুর এ জাহাজেই কোথাও আত্মগোপন করে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাত্রীদের মধ্যে একটা ভীতিকর ভাব জেগে উঠেছে। সবাই কেমন যেন নিশ্চুপ বনে গেছে, ভালোয় ভালোয় আরাকানে পৌঁছতে পারলে হয়।

যতই বেলা শেষ হয়ে আসতে লাগলো ততই জাহাজে একটা ভীতিভাব মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। সবার হৃদয় দুরু দুরু করে কাঁপছে। না জানি রাতের অন্ধকারে দস্যু বনহুর কার না কার উপর হামলা করে বসবে।

‘মডেলে’ বিভিন্ন জাতীয় যাত্রী ছিলো– সবাই নিজ নিজ স্বজাতীর সঙ্গে একত্র হয়ে নিজেদের অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে রইলো।

মিস সুইটি ও মঞ্জুর ধরে বসলো বনহুরকে, তাদের ওখানে রাত্রে থাকতেই হবে।

বনহুর শেষ পর্যন্ত রাজি না হয়ে পারলো না।

গভীর রাত।

বনহুর শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, পাশে মঞ্জুর ঘুমাচ্ছে; ওদিকের শয্যায় মিস সুইটি নিদ্রায় মগ্ন। দস্যু বনহুরের ভয়ে দুটি ভাই-বোন কুঁকড়ে গেছে যেন। মায়া হলো বনহুরের, সত্যি ওরা বড় অসহায়। ইচ্ছা করলে মিঃ জাফরীর প্রতিশোধ নিতে পারে সে এই দুটি তরুণ-তরুণীর উপর। কিন্তু সে এতো বড় নিঃসংশয় হৃদয়হীন নয়। দস্যু বনহুর কোনো দিন অসহায়ের প্রতি অবিচার করে না।

বনহুর অতি সন্তর্পণে মিস সুইটির বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। তাকিয়ে আছে সে তার ঘুমন্ত মুখের দিকে। হঠাৎ টি-পয়ে ধাক্কা লেগে এ্যাসট্রেটা পড়ে গেলো মেঝেতে।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেলো মিস সুইটি ও মজুরের। মঞ্জুর ভয়বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠলো– মিঃ আলমগীর সাহেব, উঠুন উঠুন, দস্যু বনহুর এসেছে, দস্যু বনহুর এসেছে!

মিস সুইটি আর্তনাদ করে উঠলো–মিঃ চৌধুরী– উঠুন– উঠুন

বনহুর সুইচ টিপে আলো জ্বাললো।

মিস সুইটি বলে উঠলো– আপনি!

হাঁ, আমি দেখছিলাম বাইরে কাউকে, মানে দস্যু বনহুরকে দেখা যায় কিনা। কারণ বাইরে কারো পদশব্দ আমি শুনতে পেয়েছি।

সর্বনাশ, ভাগ্যিস আপনি জেগেছিলেন, নাহলে দস্যু বনহুর আমাদের সব লুট করে নিতো। জিনিসপত্র নিক ক্ষতি নেই কিন্তু আমার যত ভয় আপামনির জন্য–

কেন? দস্যু বনহুর তোমার আপামনির কি ক্ষতি করবে বা করতে পারে?

মিঃ আলমগীর সাহেব, আপনি জানেন না, দস্যু বনহুর যদি কোনো মেয়েকে দেখে, তাকে যেমন করে হোক চুরি করে তবে ক্ষান্ত হয়।

এ কথা কে বললো তোমাকে? দস্যু বনহুর মেয়ে দেখলেই তাকে চুরি করে নিয়ে যায়?

আব্বার মুখে আমরা শুনেছি। বললো মিস সুইটি।

তাই নাকি! তাহলে এই জাহাজে দস্যু বনহুর আছে তবুও আপনি এখনও দিব্যি আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন, কই সে তো আপনাকে কোনো রকম উপদ্রব করছেনা?

মঞ্জুর বলে উঠলো আপনি দেখছি পুলিশের লোক হয়েও দস্যু বনহুরের সম্বন্ধে গুড় আইডিয়া পোষণ করেন।

না করে যে পারিনে, সত্যিই দস্যু বনহুর অতোখানি হৃদয়হীন নয়। যাক, আপনারা শুয়ে পড়েন, আমি যতক্ষণ রয়েছি, দস্যু বনহুর আপনাদের কিছু করতে পারবেনা।

বনহুর শয্যায় এসে শুয়ে পড়লো।

রাত বেড়ে আসছে।

জাহাজের একটানা ঝক ঝক্ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছেনা। সমস্ত জাহাজ নীরব– নিস্তব্ধ।

জাহাজের সার্চলাইট সম্মুখে আলো নিক্ষেপ করে বিরাট জলজন্তুর মত সাগরবক্ষ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো।

সবাই নিদ্রায় মগ্ন।

কয়েকজন পাহারাদার গুলীভরা রাইফেল নিয়ে সজাগ পাহারা দিচ্ছিলো।

 বনহুর বেরিয়ে আসে ক্যাবিন থেকে, ব্যস্তভাবে এগিয়ে যায় পাহারাদারগণের দিকে।

পাহারাদারগণ জানে, ইনি পুলিশের লোক। তাই বনহুরকে দেখামাত্র সেলুট করে দাঁড়ায়।

বনহুর বললো– দেখো, তোমরা সবাই সম্মুখ-ডেকে গিয়ে সর্তক দৃষ্টি রাখো, সামনের তিন নম্বর ক্যাবিনে যে ভদ্রলোক থাকেন তাকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। এ জাহাজে আসার পর তার গতিবিধি আমার ভাল মনে হয়নি।

পাহারাদারদের একজন বললো স্যার, তিন নম্বর ক্যাবিনে পুলিশ ডাক্তার কিবরিয়া থাকেন।

হাঁ, ঐ ভদ্রলোকটির কথাই বলছি, তিনি যে সত্যি ডক্টর কিবরিয়া– তা নাও হতে পারেন। দস্যু বনহুরের চাতুরী বোঝা মুস্কিল, কিবরিয়ার ছদ্মবেশে সেই হয়তো আত্মগোপন করে আছে। তোমরা এই ক্যাবিনের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। আমি নিজে পিছন ডেকে নজর রাখছি। কথা শেষ করে বনহুর দ্রুত চলে যায় পিছন ডেকের দিকে।

পাহারাদারগণ বনহুরের কথামত রাইফেল বাগিয়ে ধরে ডক্টর কিবরিয়ার ক্যাবিন পাহারা দিতে লাগলো।

বনহুর পিছন ডেকে গিয়ে দাঁড়ালো, চারদিকে একবার দেখে নিয়ে ডেকের রেলিং এ ঝুলানো একটি মোটর-বোটের রশি খুলে কৌশলে একাই সে নামিয়ে ফেললো সাগরবক্ষে।

এ সব বোট বিপদকালের জন্য সর্বক্ষণ জাহাজের পিছন ডেকে মজুত করে রাখা হয়ে থাকে।

চলন্ত জাহাজের পিছন অংশে উচ্ছল ঢেউএর বুকে বোটটা যেন আছাড় খাচ্ছিলো। বনহুর টর্চের আলো ফেলে বোটটা একবার ভাল করে দেখে নিলো, তারপর অতি কৌশলে রশি বেয়ে নামতে লাগলো। নিচে। হঠাৎ যদি হাতটা ফসকে যায় তাহলেই ছিটকে গিয়ে পড়বে একেবারে সাগরবক্ষে, তখন রক্ষা থাকবেনা আর। অথৈ জলরাশির বুকে কতক্ষণ সাঁতার কেটে টিকে থাকতে পারবে। হয়তো বা কোনো ভয়ঙ্কর জীবজন্তু নিমিষে তাকে গ্রাস করে ফেলবে।

জাহাজের পিছনে জলরাশি ভীষণভাবে আলোড়িত হচ্ছিলো। দুদিক থেকে ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছিলো মোটর-বোটখানার গায়ে। তরঙ্গের বুকে একটা কুটার মত দুলছিলো বোটখানা। বনহুর রশি বেয়ে অতি সাবধানে নেমে আসছিলো জাহাজ থেকে মোটর-বোটটার দিকে।

থর থর করে কাঁপছে রশিটা। কারণ রশির একটা দিক বাঁধা রয়েছে মোটর-বোটখানার সঙ্গে; অপরদিক রয়েছে জাহাজের রেলিং এ।

বনহুর যখন ঠিক মোটর-বোটখানার অতি নিকটে পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎ তার একখানা হাত খসে গেলো রশি থেকে। শিউরে উঠলো বনহুর কিন্তু তার ভাগ্য ভাল বলতে হবে, একেবারে রশি থেকে ছিটকে গিয়ে পড়লো সে মোটর-বোটখানার মধ্যে।

বনহুরকে নিয়ে বোটখানা তরঙ্গের বুকে প্রচণ্ডভাবে আছাড় খেতে লাগলো। নিজেকে সামলে নিতে বেশিক্ষণ লাগলো না বনহুরের। বোটের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, যদিও তার পা থেকে সমস্ত শরীর ভীষণভাবে দুলছে।

বনহুর কোমরের বেল্ট থেকে ছোরাখানা বের করে নিলো। সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা, অতি সাবধানে কেটে ফেললো রশিটা। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘুরপাক খেয়ে মোটর-বোটখানা জাহাজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাত দূরে সরে গেলো। বনহুর তাকিয়ে দেখলো তাদের জাহাজ মডেল’ বহুদূরে অন্ধকার একটা কালো পাহাড়ের মত লাগছে। মজবুত হস্তে মোটর-বোটের হ্যাণ্ডেল চেপে ধরলো বনহুর।

জাহাজে মোটর-বোটগুলো সর্বক্ষণের জন্য তৈরিই থাকে। কাজেই কোনো অসুবিধা হলোনা। বনহুর মোটর-বোটে এবার স্টার্ট দিয়ে চালু করে নিলো।

জাহাজের ঝক ঝক শব্দে মোটর-বোটের শব্দ ক্ষীণ শোনালো। বনহুর জাহাজের বিপরীত দিকে মোটর-বোটের মুখ ফিরিয়ে নিলো।

জাহাজের আলো বনহুরের চোখে মোহময় মনে হলো। ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে জাহাজখানা। বনহুর ভাবছে– ঐ জাহাজের একটি ক্যাবিনে এখনও ঘুমিয়ে রয়েছে মিস সুইটি আর মঞ্জুর। ভোরে। ঘুম ভেঙে আর তারা খুঁজে পাবেনা তাদের আলমগীর সাহেবকে! ওরা যাতে ওকে ভুল না বোঝে তাই বনহুর একখানা চিঠি লিখে রেখে এসেছে সুইটির বালিশের নিচে। বনহুর লিখেছে–

“মিস সুইটি, সত্যিকারের আলমগীর সাহেব আমি নই। আপনারা যাকে ভয় করেছিলেন, যার ভয়ে আলমগীর সাহেবকে আপনাদের রক্ষক হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, আমি সেই লোক। আপনার পিতা মিঃ জাফরীকে আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাবেন। শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারলাম না, সেজন্য দুঃখিত।” আপনাদের শুভাকাঙ্খী।
—দস্যু বনহুর

 ঐ চিঠিখানা রাখতে গিয়েই বনহুরের পায়ে আঘাত লেগে টেবিল থেকে এ্যাসট্রেটা পড়ে গিয়েছিলো, তখনই জেগে উঠেছিলো মিস সুইটি আর মঞ্জুর। চিঠিখানা তখন না রাখতে পারলেও অন্যবার সে সফলকাম হয়েছিলো।

বনহুর ভাবে– মিস সুইটি জেগে উঠে তার সন্ধান করবে। হয়তো বেশ ঘাবড়ে যাবে কিছু সময়ের জন্য। জাহাজে তাকে নিয়ে একটা আলোড়ন শুরু হবে, কিন্তু যখন তার চিঠিখানা পাবে তখন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। হয়তো আতঙ্কে শিউরে উঠবে তাদের ক্যাবিনেই রাত যাপন করেছে স্বয়ং দস্যু বনহুর!

কিন্তু ঐ সব চিন্তা করার সময় এখন বনহুরের নেই। ফিরে আসে সে নিজের উপস্থিত পরিবেশে। এখন সে মাঝ-সমুদ্রে, বাঁচতে হলে তাকে সংগ্রাম করতে হবে।

মোটর-বোটখানা এখন কোন দিকে চলেছে কে জানে। হয়তো বা তীরের দিকে নয়–তীর ছেড়ে আরও মাঝ-সাগরে। বোটের হ্যাণ্ডেল চেপে ধরে বসে আছে বনহুর। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছে না। এতোক্ষণ তবু জাহাজের আলোটার একটা ক্ষীণ রশ্মি তার দৃষ্টি শক্তিকে আকর্ষণ করছিলো, এবার জাহাজখানা সম্পূর্ণ দৃষ্টির আড়ালে অন্তর্হিত হয়েছে।

বনহুর তাকিয়ে আছে সীমাহীন অন্ধকারের দিকে। সাগরবক্ষ শান্ত হলেও একেবারে নীরব নয়। উচ্ছল জলরাশি গর্জন করে ছুটে চলেছে কোন অজানার পথে। বনহুর মোটর-বোটের হ্যাণ্ডেল চেপে ধরে নিশ্চুপ বসে রইলো। যতক্ষণ না ভোরের আলো ফুটেছে ততক্ষণ তাকে ধৈর্য ধরে বসে থাকতেই হবে। কিন্তু বনহুর গভীরভাবে চিন্তা করে ঘাবড়ে গেলো। তীর যদি সীমানার মধ্যে না হয় তাহলে মস্ত বিপদ, সূর্যের জ্বালাময় তীব্র আলো সহ্য করাই হবে মুস্কিল। ক্ষুধা সহ্য করা তার অভ্যাস আছে। যত কষ্ট হোক নীরবে বহন করতে পারবে, কিন্তু প্রখর সূর্যের তাপ কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে সে!

যত চিন্তাই করুক বনহুর তাকে নিয়ে বোটখানা, দিকহারা ভাবে একদিকে ছুটে চললো।

বনহুর যখন জাহাজ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে তখন সে পরিচ্ছদের নিচে তার দস্যুবেশ। লুকিয়ে রেখেছিলো। সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরা, রিভলভার, কিছু গুলী নিয়েছিলো সে চোরা পকেটে। বনহুর জানতো এ অঞ্চল অতি ভয়ঙ্কর স্থান, তাই সে বিপদ মুহূর্তেও কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়েছিলো সঙ্গে।

এক সময় পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে এলো। এতোক্ষণে বনহুর দিক নির্ণয় করে নিতে সক্ষম হলো। ভালভাবে সাগরবক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো। শুধু জল আর জল, তীরের কোনো চিহ্ন নেই। বনহুর বোট থামিয়ে ফেললো, কোন দিকে যাবে সে। কোন দিকে এগুলো তীরের দিকে যেতে পারবে কে জানে।

বনহুর ভ্রুকুঞ্চিত করে দেখতে লাগলো। আকাশে কোনো পাখিটি পর্যন্ত নজরে পড়লোনা। বনহুর বুঝতে পারলো– একশত মাইলের মধ্যে তীরের কোনো চিহ্ন নেই।

বনহুর আবার স্টার্ট দিলো তার মোটর-বোটে। যা ভাগ্যে থাকে হবে, চুপ থাকার জন সে নয়। যতক্ষণ বোটের ইঞ্জিনে শক্তি আছে ততক্ষণ তীরের সন্ধানে ছুটবে সে!

কিন্তু বনহুর সমস্ত দিন অবিরাম বোট চালিয়েও তীরের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলোনা। আকাশে আজ ভাঙা ভাঙা মেঘের আনাগোনা থাকায় সূর্যের তাপ তেমন প্রখর ছিলোনা, কাজেই খুব কষ্ট তার হয়নি এখনও। তবে ক্ষুধার জ্বালা তাকে বেশ চঞ্চল করে তুলেছিলো– গোটা একটা দিন কেটে গেছে, মুখে কুটো যায়নি। পিপাসায় জিহ্বা শুকিয়ে আসছে, যদিও সে প্রচুর জলরাশির বুকে ভাসছে তবুও এক ফোঁটা জল মুখে দিবার জো নেই, বিষময় লবণাক্ত জল।

বনহুর ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছে, তার দুঃসাহসী প্রাণ আশঙ্কায় দুলে উঠছে, আরও কদিন সে তীরের সন্ধান পাবে না তাই বা কে জানে।

সমস্ত দিন কেটে গেলো, মোটর বোটের ষ্টার্ট ধীরে ধীরে কমে আসছে, কারণ পেট্রোল নিঃশেষ হয়ে এসেছে। বনহুর এবার গভীর চিন্তায় পড়লো। সাগরবক্ষে সন্ধ্যার অন্ধকার জমাট বেঁধে আসছে। আজ দুদিন এতোটুকু ঘুমায়নি সে, বনহুরের চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো।

পেট্রোল নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় মোটর বোটখানা অচল হয়ে পড়েছে। সাগরের ঢেউ-এর টানে আপন মনে ভেসে চলেছে এক দিকে। বনহুর এবার গা থেকে সার্টটা খুলে মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়লো মোটর-বোটের মেঝেতে, পা দুখানা রাখলো বোটের আসনে।

ঘুমিয়ে পড়েছে বনহুর।

আকাশে অসংখ্য তারার মালা, কালো সামিয়ানায় জরির বুটিগুলো যেন চক চক করছে।

 সাগরবক্ষ আজ স্থির!

ঝিরঝিরে বাতাসে দোল খেয়ে খেয়ে বোটখানা ভেসে চলেছে। অঘোরে ঘুমাচ্ছে বনহুর, দুদিনের অনিদ্রায় শরীরটা তার ক্লান্তি আর অবসাদে ভরে উঠেছিলো, শোবার সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রাদেবী আশ্রয় নিয়েছিলো তার আঁখিদ্বয়ে।

এমন চিন্তাহীন মনে কতদিন বনহুর ঘুমায়নি। আজ সে পরম নিশ্চিন্ত। বাতাসে কোঁকড়ানো চুলগুলো উড়ছে। সুন্দর মুখমণ্ডলে নেই কোনো দুঃচিন্তা বা ক্লান্তির ছাপ। বলিষ্ঠ বাহু দুটি বুকের উপর রয়েছে। বুট পরা পা দুখানা তখনও তোলা হয়েছে বোটের আসনে।

*

এক নিদ্রায় রাত ভোর হয়ে যায়।

 সূর্যের আলো চোখে লাগতেই উঠে বসলো বনহুর। একি, তার বোটখানা আর নড়ছে বলে মনে হলোনা! বনহুর ধড়ফড় উঠে দাঁড়ালো, অবাক হয়ে দেখলো একটা ছোট্ট গোলাকার দ্বীপের সঙ্গে তার বোটখানা আটকে গেছে।

আশায়-আনন্দে বনহুরের মনটা নেচে উঠলো। তাহলে এবার মাটির সন্ধান পাওয়া গেলো যা হোক। বনহুর খুশি হয়ে বোট থেকে এক লাফে নেমে পড়লো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট দ্বীপটা দুলে উঠলো। যেন। বনহুর ভাল করে লক্ষ্য করবার পূর্বেই দ্বীপটা চলতে শুরু করলো, তারপর আস্তে করে তলিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলো। বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে পুনরায় লাফিয়ে উঠে বসলো নিজের মোটর বোটখানায়। আর একটু হলেই হয়েছিলো আর কি, বনহুরের বোটখানা যে ছোট্ট দ্বীপটায় আটকে পড়েছিলো আদতে সেটা কোনো দ্বীপ বা ঐ ধরনের কিছু নয়–একটা বিরাট কচ্ছপ, তারই পিঠের উপর সে লাফিয়ে নেমে দাঁড়িয়েছিলো।

বনহুর তাকিয়ে দেখলো বিরাট কচ্ছপটা ধীরে ধীরে ডুবে গেলো সাগরের নোনা জলে!

বনহুরের বোট তখন ভেসে চলতে শুরু করেছে।

আজকের দিনটাও বনহুরের এ ভাবেই কেটে চললো। প্রখর সূর্যের তাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো বনহুর। ক্ষুধা-পিপাসায় কণ্ঠ শুকিয়ে আছে। বনহুর ভেবে পায়না আর কতক্ষণ এ ভাবে জীবন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে সে।

*

সমস্ত জাহাজে সাড়া পড়ে গেলো, মিঃ আলমগীর সাহেব গেলেন কোথায়! জাহাজের ক্যাপ্টেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন? সকলেরই ধারণা দস্যু বনহুর তাকে কৌশলে জাহাজ থেকে উধাও করেনি তো। পুলিশ ডাক্তার কিবরিয়ার উপর কড়া নজর রেখেছে পাহারাদারগণ।

বিশেষ করে মিস সুইটি আর মঞ্জুর ঘাবড়ে গেলো। ভদ্রলোক তাদের কক্ষেই ছিলো সে রাতে এবং তাদের অনুরোধেই ছিলো। হঠাৎ আলমগীর সাহেবের অন্তর্ধানে একেবারে মুষড়ে পড়লো তারা। মঞ্জুর তো প্রায় কেঁদেই ফেললো, কারণ অত্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন আলমগীর সাহেব, তাছাড়া তিনি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার।

গোটা জাহাজ অনুসন্ধান চালানো হলো, জাহাজের প্রত্যেকটা জায়গা তন্ন তন্ন করে দেখা হলো– আলমগীর সাহেবের কোন খোঁজই পাওয়া গেলোনা।

সম্পূর্ণ দুটো দিন পর তাদের জাহাজ ‘মডেল’ আরাকান বন্দরে পৌঁছে গেলো।

বন্দরে সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন ও আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার।

জাহাজ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জাহাজটা পুলিশ ফোর্স ঘিরে ফেললো। মিঃ জাফরী সর্বপ্রথম পুত্র-কন্যার মঙ্গল সংবাদের জন্য ছুটে গেলেন জাহাজে। দস্যু বনহুর তাদের কোনো ক্ষতি সাধন করেছে কিনা এই তার সন্দেহ। কিন্তু তিনি যখন জানতে পারলেন তার পুত্র এবং কন্যা সুস্থ ভাবে জাহাজে অবস্থান করছে তখন তিনি আশ্বস্ত হলেন।

মিস সুইটি এবং সকলের মুখে এক আশ্চর্য খবর তিনি জানতে পারলেন– পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আলমগীর সাহেব নাকি এ জাহাজে আসছিলেন, কিন্তু পথের মধ্যে তিনি কোথায় জাহাজ থেকে উধাও হয়ে গেছেন। মিঃ জাফরী কথা শুনে অবাক হলেন–কারণ আলমগীর সাহেবকে তিনি সশরীরে কান্দাই পুলিশ অফিসে রেখে এসেছেন।

মিস সুইটি আরও জানালো–আব্বা, মিঃ আলমগীর সাহেব বড় মহৎ এবং ভাল লোক। তিনি সব সময় আমাদের খোঁজ-খবর রাখতেন। আমাদের যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয় সেজন্য তার সতর্ক দৃষ্টি ছিলো। যেদিন রাতে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন, সেদিন দস্যু বনহুরের ভয়ে তাকে আমাদের ক্যাবিনেই রেখেছিলাম কিন্তু ভোরে উঠে দেখি তিনি নেই।

মিঃ জাফরী আরও অবাক হলেন যখন ডক্টর কিবরিয়ার ক্যাবিনে গিয়ে দেখলেন, পাহারাদারগণ তাঁকে কড়া পাহারায় রেখেছে, এমনকি ডক্টর কিবরিয়াকে বাইরে পর্যন্ত বের হতে দিচ্ছেন তারা। মিঃ জাফরীকে দেখে তিনি প্রায় কেঁদে ফেললেন– তিনি প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পুলিশ হসপিটালে সার্জনের কাজ করছেন, কোনো দিন এমন অপদস্থ হননি আর আজ কিনা বৃদ্ধ বয়সে তিনি হলেন ছদ্মবেশী দস্যু বনহুর!

মিঃ জাফরী হাসবেন কি কাঁদবেন ভেবে পাননা, পাহারাদারগণ এমনভাবে একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে নাজেহাল করে তুলেছে দেখে তিনি ভীষণ রেখে গেলেন।

কিন্তু কি করবেন ওয়্যারলেস সংবাদে দস্যু বনহুর এ জাহাজে আছে জানতে পেরে জাহাজময় যখন একটা ভীষণ আতঙ্ক সৃষ্টি হয় তখন মিঃ আলমগীর তাদের এভাবে ডক্টর কিবরিয়ার উপর কড়া নজর রাখার নির্দেশ দেন, কারণ তার গতিবিধি নাকি সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছিলো।

মিঃ জাফরী সব শুনে গম্ভীর হলেন, তিনি বুঝতে পারলেন- ঐ মিঃ আলমগীর বেশি ব্যক্তিই দস্যু বনহুর। সে জাহাজের লোকের চোখে পুলিশ অফিসার বলে থোকা দিয়ে নিজে আত্মগোপন করেছিলো এবং সুযোগ বুঝে অন্তর্ধান হয়েছে। মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন সবার হয়ে ডক্টর কিবরিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন।

সমস্ত জাহাজ তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালালেন পুলিশ বাহিনী, প্রতিটি ব্যক্তিকে সনাক্ত করা হলো কিন্তু দস্যু বনহুরকে পাওয়া গেলোনা।

মিস সুইটির বিছানা উঠাতে গিয়ে চাকর ছোকরা একটি ভাঁজ করা কাগজ হাতে ছুটে এলো– স্যার, আপামনির বিছানায় বালিশের তলায় এটা পেয়েছি।

মিঃ জাফরী চিঠিখানা হাতে নিয়েই বুঝতে পারলেন এ-চিঠি দস্যু বনহুরের ছাড়া কারো নয়। তারপর চিঠি পড়া শেষ করে তিনি আশ্বস্ত হলেন, তার ধারণা অমূলক নয়। যার সন্ধানে প্লেনযোগে তারা আরাকানে এসে হাজির হয়েছেন– সে মাঝ সাগরে উধাও হয়েছে।

মিঃ জাফরী রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়লেন, দস্যু বনহুর তাকে বার বার এমনভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে। শুধু তাকেই নয়, সমস্ত পুলিশ বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়েছে, দস্যু বনহুরকে কেউ আয়ত্ত্বে আনতে পারছেনা।

দেশব্যাপী শুধু দস্যু বনহুর আর দস্যু বনহুর!

‘মডেলে’ যখন দস্যু বনহুরকে নিয়ে নানা রকম কথার আলোচনা চলছে তখন দস্যু বনহুর তার মোটর-বোটে সাগরবক্ষে ভেসে চলেছে, কোথায় কোন অজানার পথে।

বনহুর ক্ষুধার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে প্রখর রৌদ্র যখন অগ্নি বর্ষণ করে। বনহুর শুধু পুরুষই নয় সে লৌহমানুষ। তাই তার সুন্দর দেহ রাঙা হয়ে উঠলেও কালো হয়ে গেলোনা বা অবশ শিথীল হয়ে পড়লোনা।

তৃতীয় দিনে বনহুর দেখলো আকাশের দক্ষিণ কোণে জমাট কালো মেঘ ভেসে উঠেছে। বনহুর জানে এ মেঘ কত ভয়ঙ্কর! বিশেষ করে সাগরবক্ষে অতি মারাত্মক এ মেঘ। সাইক্লোন ঝড়ের পূর্বলক্ষণ।

বনহুর ভীত হলোনা, একটা আশা তার মনকে সবল করে তুললো। সাইক্লোন বা ঝড়-তুফান যা হয় হোক, তাহলে তার বোটখানা নিশ্চয়ই এ ভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হবেনা। প্রচণ্ড ঝড়ে সাগরবক্ষে জাগবে ভীষণ ঢেউ, বনহুর মোটর-বোটের হাল যদি ঠিকভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়, তাহলে হয়তো কোন তীরের দিকে পৌঁছেও যেতে পারবে সে।

বনহুর যা ভেবেছিলো হলো তাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ছেয়ে গেলো কালো মেঘে। বাতাস। ভীষণ ঝড়ের আকার ধারণ করলো। সাগরবক্ষ কেঁপে-ফুলে দশ হাত উঁচু হয়ে উঠলো। প্রচণ্ড প্রচণ্ড ঢেউ তীরবেগে ছুটে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো। বনহুর মোটর-বোটের হাল চেপে ধরে শক্ত হয়ে বসে রইলো দক্ষ মাঝির মত।

প্রবল ঝড়ের দাপটে এবার তীরবেগে বোটখানা ছুটতে লাগলো দিশেহারার মত।

সেকি ভীষণ ঝড়!

অবশ্য বনহুরের কাছে এ ঝড় নতুন নয়; সে আরও দু’বার সাগরবক্ষে সাইক্লোনের কবলে পড়েছিলো, কিন্তু এমনভাবে নয়; সে হলো জাহাজের উপর। আর আজ এ সম্পূর্ণ ক্ষুদ্র একটি জলযানের উপর, বনহুর তবু এতোটুকু বিচলিত হলোনা।

ঝড়ের মধ্যেই শুরু হলো প্রবল বৃষ্টিপাত।

বনহুর ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর ছিলো, ঠাণ্ডা-শীতল বৃষ্টিধারা পান করার জন্য সে লালায়িত হয়ে উঠলো। হাতে নিয়ে বৃষ্টির জল পান করার কোনো উপায় ছিলোনা। কারণ বলিষ্ঠভাবে হাল ধরে সে বোটখানাকে বাঁচিয়ে নিচ্ছিলো। বনহুর আকাশের দিকে হা করে বৃষ্টিধারা পান করতে লাগলো।

এতো বিপদেও বনহুরের হাসি পেলো, চাতক পাখির মত আজ তার অবস্থা হয়েছে, কিন্তু এখন কোনো কথা ভাববার বা চিন্তা করবার সময় নেই। এতোটুকু ভুল হলেই তার বোট ঢেউ-এর তলায় নিমজ্জিত হবে।

সেকি ভীষণ অবস্থা। সাগরবক্ষ যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। পাগলা হাতির মত ঢেউগুলো ছুটছে এদিক থেকে সেদিকে। বনহুরের শরীরে ঝড়ের ঝাপ্টা তীরবেগে এসে লাগছে। দুর্বল কোন মানুষ হলে কখন কুটোর মত উড়ে যেতো কোথায় কে জানে।

বনহুর জীবনে বহু প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।

হাঙ্গর কুমীরের সঙ্গেও সে লড়াই করেছে, বাঘ-ভল্লুক-সিংহ শাবক ছিলো তার ছোটবেলার খেলার সাথী। কত হিংস্র জীবজন্তু যে বনহুরের হাতে জীবন দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

আজ বনহুর লড়াই করে চলেছে ঝড়ের সঙ্গে, ঝড় নয় প্রচণ্ড সাইক্লোনের সঙ্গে। বনহুর দেখতে চায় কে জয়ী হয়– সে না সাইক্লোন। যত ঝড়ের বেগ বাড়তে থাকে, ততই বনহুর তটস্থ হয়ে উঠে। প্রচণ্ডবেগে প্রকাণ্ড ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে বনহুরের দেহে। কিন্তু অতি কৌশলে বনহুর তার মোটর বোটখানাকে বাঁচিয়ে নিতে লাগলো।

শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো বনহুর।

ভয়ঙ্কর সাইক্লোন তার বোটখানাকে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হলোনা। এক সময় ধীরে ধীরে ঝড়ের দাপট কমে এলো। আকাশও সচ্ছ হয়ে এলো অনেক। সাগরের উন্মত্ততাও কমে এলো আস্তে আস্তে। এবার বনহুর আশ্বস্ত হলো, যা এ যাত্রা সে পরিত্রাণ পেলো।

বনহুর ভিজে কাপড়-চোপড় ভাল করে নিংড়ে আবার পড়ে নিলো, কিছুক্ষণ পূর্বে সেই আকাশ বাতাসের রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে গেলো। কে বলবে এ প্রকৃতি একটু আগে কি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিলো। সচ্ছ আকাশ, সাগরের প্রচণ্ড ঢেউগুলো এখন শান্ত ছেলের মতই নীরব নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে।

বনহুর পূর্বের চেয়ে এখন অনেক সুস্থ্য বোধ করছে। কদিন তার গোসল ছিলোনা, শরীরটা জ্বালা করছিলো ভীষণভাবে। এখন আর শরীরে তেমন কোন জ্বালাময় ভাব নেই। আংগুল দিয়ে বনহুর চুলগুলো আঁচড়ানোর মত করে নিলো।

কিছু সময়ের মধ্যে তার শরীরের ভিজে জামা কাপড়গুলো শুকিয়ে এলো। বনহুর এবার তার ক্লান্ত অবশ দেহটা এলিয়ে দিলো মোটর-বোটের আসনে।

সিগারেট আর নেই– নিঃশেষ হয়ে গেছে কবে। খাবার না পেলো তবু যদি এ সময় সিগারেট পেতো দু’চারটে তাহলেও এতোটা খারাপ লাগতোনা তার।

আপন মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বনহুর– এমন সময় হঠাৎ পাখি দেখতে পেলো আকাশে উড়ছে। তড়িৎ গতিতে বনহুর উঠে বসলো, ভাল করে লক্ষ্য করতেই আনন্দে আপ্লুত হলো। পাখিটি সাধারণ একটি মাছরাঙা পাখি। বনহুর বুঝতে পারলো তার বোটখানা তীরের অত্যন্ত নিকটে এসে পড়েছে। নাহলে এমন ছোট পাখি আকাশে উড়তে দেখা যেতোনা।

যা ভেবেছিলো বনহুর, ভালভাবে তাকাতেই সে দেখলো–পশ্চিম দিকে কালো রেখার মত কিছু। নজরে পড়ছে। বোটের মধ্যে ছোট্ট একটি বৈঠা ছিলো, বনহুর সেই বৈঠা হাতে তুলে নিয়ে পানি টানতে শুরু করলো।

জানে বনহুর সামান্য বৈঠার টানে এই বিশাল সাগরবক্ষে অগ্রসর হওয়া কতটুকু সম্ভব। তবু সে আপ্রাণ চেষ্টায় পানি টানতে আরম্ভ করলো।

বনহুরের অসাধ্য বুঝি কিছু নেই, সে বেশ কয়েক ঘন্টার অবিরাম পরিশ্রমের পর তীরের সন্নিকটে আসতে সক্ষম হলো। সেকি ভয়ঙ্কর জঙ্গল, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষরাজি জমাট বেঁধে যেন দাঁড়িয়ে আছে সাগর তীরের সন্নিকটে। বনহুরের দৃষ্টি সে জঙ্গলে প্রবেশে সক্ষম হলোনা। অদূরে নজর পড়তেই বনহুর অবাক হলো, এক দল হরিণ সাগরতীরে পানি পান করছে।

বনহুরের বোটখানা দেখতে পেয়ে ছুটে পালালো হরিণদল। একটি ছোট্ট হরিণ শিশু তখনও পালাতে সক্ষম হয়নি, সকলের পিছনে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিলো। বনহুর সেই হরিণশিশু লক্ষ্য করে রিভলভার উঁচু করে ধরলো, কিন্তু পর মুহূর্তে নামিয়ে নিলো রিভলভারখানা। কি হবে ওটাকে হত্যা করে, সামান্য একটা হরিণশিশু! সঙ্গে ম্যাচবাক্স থাকলে তবু না হয় আগুন জ্বেলে ওটাকে উদরস্থ করা যেতো, কিন্তু সে রকম কোনো উপায় নেই।

বনহুর তার বোটখানা তীরে লাগিয়ে নেমে পড়লো। কিছুক্ষণের জন্য মৃত্তিকায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো। ক’দিন অবিরত সাগরবক্ষে থাকায় মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিলো, বোটের দোলাটা যেন এখনও তার শরীরে দোল জাগাচ্ছিলো, বনহুর তার বোটখানা টেনে তুলে নিলো ডাঙ্গায়।

এবার সে তাকালো গহন বনের দিকে। ক্ষুধা-পিপাসায় বুকটা শুকিয়ে উঠেছে। অত্যন্ত শক্তিশালী বলেই বনহুর এখনও চলতে পারছে। কিন্তু আর বেশিক্ষণ এভাবে চলা তার সম্ভব হবে না।

বেলাও আর বেশি নেই।

সূর্যাস্তের শেষ রশ্মি সাগরবক্ষে আবির ছড়িয়ে দিয়েছে যেন। বনহুর আর বিলম্ব না করে গহন। বনে প্রবেশ করলো। সেকি ভয়ঙ্কর ভীষণ বন, চারদিকে নানারকম বৃক্ষ লতাগুল্ম জমাট বেঁধে আছে। বনে প্রবেশ করতেই একটা গর্জন শুনতে পেলো সে, প্রকাণ্ড কোনো হিংস্র জন্তুর গর্জন।

বনহুর সচকিত হয়ে তাকালো, বনের মধ্যে বেলা শেষের অন্ধকার তখনও ঘনীভূত হয়ে উঠেনি। যদিও তবু বেশ ঝাপসা হয়ে এসেছিলো। সম্মুখে তাকাতেই দেখতে পেলো– ঝাপসা অন্ধকারে দুটো আগুনের গোলা জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। বনহুর মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো, প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভার বের করে অগ্নিগোলাদ্বয় লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লো। সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার করে লাফিয়ে পড়লো একটি বিরাট ব্যাঘ্র। বনহুর নিমিষে সরে দাঁড়ালো, ব্যাঘ্রটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। তারপর আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি ছিলোনা, কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। বারকয়েক একটা গোঁ গোঁ শব্দ করে নীরব হয়ে গেলো ওর দেহটা।

বনহুর এগিয়ে এলো, ভাল ভাবে লক্ষ্য করে দেখলো বিরাট একটি চিতাবাঘ সে হত্যা করেছে। এমন বাঘ তার নজরে আজ পর্যন্ত খুব কমই পড়েছে, কিছুক্ষণ স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে দেখলো বনহুর বাঘটাকে। ভাগ্যিস তার নিকটে রিভলভার ছিলো, না হলে এই দণ্ডে তার মৃত্যু ঘটতো।

বনহুর দু’পা অগ্রসর হয়েছে অমনি একটা কিছু তার পায়ে জড়িয়ে ধরলো, চমকে উঠে পায়ের দিকে তাকাতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলো বনহুর কালো মত কিছু একটা তার পা দুখানা জড়িয়ে ধরেছে। কি এটা! বনহুর আর চলতে পারছে না। নিশ্চয়ই কোনো জীব হবে। বনহুর ভাল ভাবে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো– জীবই বটে। একটা জোক তার পা দু’খানাকে লেপটে ধরেছে।

বনহুর বুঝতে পারলো–ওটা আফ্রিকার জঙ্গলের জোক। তার পায়ে ভারী বুট থাকায় জেঁকটা চাক্তি বসাতে পারছেনা। অনেক চেষ্টা করলো বনহুর কিন্তু জোকটাকে সে কিছুতেই পা থেকে সরিয়ে নিতে পারলোনা। এখন উপায়, বনহুর এবার তার কোমরের বেল্ট থেকে সূতীক্ষ্ণধার ছোরাখানা খুলে নিলো, তারপর দ্রুতহস্তে সেঁকটাকে দুই খণ্ড করে ফেললো।

এবার তার পা দুখানা মুক্ত হয়ে এলো। তাকালো বনহুর চারদিকে, অগ্রসর হবে কিনা ভাবছে। সে জানে, এটা কত বড় ভয়ঙ্কর মারাত্মক স্থান। পৃথিবীর সবচেয়ে সাংঘাতিক বন এই আফ্রিকার জঙ্গল। এ জঙ্গলে প্রবেশ করা মানে সানন্দে মৃত্যুকে বরণ করা। কিন্তু উপায় কোথায়, পিছনে সীমাহীন সাগর আর সম্মুখে গহন বন। বনহুর এখন কোন দিকে যাবে, রিভলভারে মাত্র কয়েকটা গুলী এখনও জমা রয়েছে। কতক্ষণ ঐ গুলী কটি তাকে রক্ষা করবে, ভেবে পায়না সে।

ক্ষুধা-পিপাসায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে উঠেছে, নাড়ী-ভুড়ি হজম হবার জোগাড় প্রায়। বনহুর ক্লান্ত অবশ দেহটা টেনে নিয়ে আরও কিছুটা অগ্রসর হলো, হঠাৎ সম্মুখে কয়েকটা বেল ফল পড়ে থাকতে দেখে। আনন্দে অধীর হয়ে উঠলো। সুমিষ্ট বেলগুলো বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আছে, কতগুলো দু’খণ্ড হওয়া। বনহুর দুটি বেল হাতে তুলে নিয়ে নাকে ধরলো। সুন্দর সুমিষ্ট গন্ধ বেল দুটি হাতে করে বনহুর দ্রুত বেরিয়ে এলো বন থেকে।

সাগরতীরে তখন অন্ধকার হয়ে গেছে।

সাগর-তরঙ্গের গর্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বনহুর একটা পাথর খন্দ্রে উপরে চেপে বসে বেল দুটির একটি ভেঙে ফেললো। তারপর পরম আনন্দে গোগ্রাসে গলধঃকরণ করলো।

একটি বেল খেয়েই বনহুরের ক্ষুধা-পিপাসা লাঘব হয়ে গেলো। অন্যটি পাশে রেখে ভাবলো এবার একটু নিশ্চিন্ত জায়গায় প্রয়োজন, কিন্তু এখানে তেমন নিরাপদ স্থানের আশা দুরাশা মাত্র। হিংস্র জীবজন্তু পরিপূর্ণ এ জঙ্গলে প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে অতীব ভয়ঙ্কর।

বনহুর ভাবলো, তার মোটর-বোটখানা আবার সাগরে ভাসিয়ে রাতের মত নিশ্চিন্ত হতে পারে, কিন্তু সাগরের ঢেউ-এর স্রোতে আবার যদি তাকে সাগর মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাহলে উপায় কি হবে!

রাতের মত তাকে আশ্রয় করে নিতেই হবে।

বনহুর এবার একটা বুদ্ধি আটলো মাথায়। তার মোটর-বোটখানা উঁচু করে নিচে যদি শুয়ে পড়ে তাহলে হয়তো নিশাচর হিংস্র জন্তুর কবল হতে রক্ষা পেলেও পেতে পারে। বনহুর এবার পাথর খণ্ডটার উপর থেকে নেমে এগিয়ে গেলো তার মোটর বোটটার পাশে। অল্পক্ষণের চেষ্টায় বোটখানা বনহুর উঁচু করে ফেললো, কিন্তু এখন ভিতরে প্রবেশের উপায় কি? বনহুর হতাশ হবার বান্দা নয়, বোটখানার পাশে বালির মধ্যে একটা গর্ত করে ফেললো– তারপর সেই সুড়ঙ্গ মুখ দিয়ে প্রবেশ করলো সে ভিতরে। যাক, রাতের মত আশ্রয় হলো তার।

পরম নিশ্চিন্ত মনে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো বনহুর। কদিন তার দেহের উপর দিয়ে ভীষণ যুদ্ধ চলেছিলো, শুধু দেহেই নয় মনটাও দুশ্চিন্তায় ভরে ছিলো, কারণ সাগরবক্ষ থেকে তীরে পৌঁছতে পারবে কিনা সন্দেহ ছিলো তার।

বনহুর ঘুমিয়ে পড়েছে, কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই হঠাৎ মনে হলো তার শরীরটা যেন পানিতে ভাসছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গেলো কিন্তু মাথায় আঘাত লেগে তন্দ্রা ছুটে গেলো মুহূর্তে। স্মরণ হলো, সে সাগরতীরে মোটর-বোটের নিচে শুয়ে ছিলো।

জোয়ার আসায় তার বোটের তলায় পানি এসে গেছে।

বনহুর আর বিলম্ব না করে তার বোটের পাশের সুড়ঙ্গ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে দু’খানা বাহু তাকে জড়িয়ে ফেললো বলিষ্ঠভাবে। অন্ধকারে বনহুর কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তবু অল্পক্ষণেই সে। বুঝে নিলো শুধু দুটি বাহু নয়; বেশ কয়েকটি শক্ত বলিষ্ঠ বাহু তাকে মজবুত করে বেঁধে ফেলেছে। নিঃশ্বাস ফেলতে তার কষ্ট হচ্ছে। এবার সে বুঝতে পারলো– এ বাহুগুলো কোনো মানুষ বা ঐ ধরনের। জীবের নয়। অক্টোপাশের কবলে পড়েছে সে, এই তার জীবনের শেষ মুহূর্তে। একে অন্ধকার বনহুরের দেহটাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে অক্টোপাশটা, একটুও নড়তে পারছে না সে। সেকি ভীষণ প্রচণ্ড শক্তি অক্টোপাশের দেহে।

অক্টোপাশটা মানুষের রক্তের গন্ধ পেয়ে উঠে এসেছে এই স্থানে। তাছাড়া সাগরের জলরাশিও আছাড় খেয়ে খেয়ে পড়ছে বনহুর আর অক্টোপাশটার শরীরে।

বনহুর মরিয়া হয়ে উঠেছে। কোনো ক্রমে ছোরাখানা সে কোমরের বেল্ট থেকে খুলে নিতে পারছেনা। একবার যদি কোনো ক্রমে ছোরাখানা বেল্ট থেকে খুলে নিতে পারতো তাহলে সে দেখে নিতো– কে জয়ী হয়। মৃত্যু হলেও সে সান্ত্বনা পেতো শেষ চেষ্টা সে করেছে।

বনহুর যখন নিজের কোমরের বেল্ট থেকে ছোরাখানা খুলে নেওয়ায় চেষ্টা করছিলো তখন তার গলায় অক্টোপাসের একটি বাহু এমনভাবে বেষ্টন করে ধরে ছিলো বনহুর কিছুতেই আর দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হচ্ছিলো না। পড়ে গেলো সে ভূতলো অক্টোপাসের সঙ্গে বনহুরের যে অদ্ভুত লড়াই পৃথিবীর আলো দেখলোনা। রাতের অন্ধকারে দুর্ধর্ষ বনহুর আর ভয়ঙ্কর অক্টোপাশে চলেছে লড়াই।

হঠাৎ বনহুর তার দক্ষিণ হাতখানা কোমরের কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো। কৌশলে সে খুলে নিলো সূতীক্ষধার ছোরাখানা। এবার সে হয়ে উঠলো দুর্দান্ত, জীবন-মরণ পণ করে সূতীক্ষ ছোরা দিয়ে অক্টোপাশের বাহুগুলো ঘ ঘর্চ করে কেটে ফেলতে লাগলো। যদিও অক্টোপাশের বাহুগুলো ভয়ানক শক্ত। ছিলো তবু বনহুরের ছোরার কাছে টিকতে পারলো না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অক্টোপাশের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে সক্ষম হলো দস্যু বনহুর।

বালির মধ্যে বসে পড়ে ভীষণভাবে হাপাতে লাগলো। সমস্ত দেহটা যেন থেতলে একাকার হয়ে। গেছে। জীবনে বহু রকম বিপদের কবলে পড়েছে, কিন্তু আজকের মত বিপদ বুঝি তার জীবনে কোনোদিন আসেনি। কি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ঐ অক্টোপাশটা।

এক সময় রাত ভোর হয়ে গেলো, বনহুর বালির মধ্যে শুয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের। জেগে উঠতেই প্রথম তার নজরে পড়লো তার অনতিদূরে বালির মধ্যে ছিন্নভিন্ন একটি অক্টোপাশ পড়ে আছে। তার কতগুলো বাহু টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। এদিক সেদিকে। বনহুর জানে, তার ছোরার আঘাতেই অক্টোপাশটির মৃত্যু ঘটেছে। ছোরাখানা না থাকলে আজ তার জীবনলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো তাতে সন্দেহ নেই। বনহুর তার রক্তমাখা ছোরাখানা সাগরের পানিতে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিলো। নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে, তার সুন্দর শরীরের স্থানে স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। যেমন ভীষণ আঘাত পেলে মানুষের দেহে জখমের দাগ হয়, অক্টোপাশটির বাহুর বন্ধনে বনহুরের দেহেও তেমনি দাগ হয়ে গিয়েছিলো।

বনহুর জামাটা খুলে পরিষ্কার করে নিলো, মেলে দিলো তার মোটর-বোটটার গায়ে।

বেলা বাড়ছে ক্ষুধা বাড়ছে বনহুরের, ওদিকের পাথর খণ্ডটার উপরে কালকের সেই পাকা বেলটা তখনও পড়ে রয়েছে। বনহুর পাথরখণ্ডটার উপর থেকে বেলটা তুলে নিয়ে ভেঙে ফেললো, তারপর তৃপ্তি মিটিয়ে খেলো।

বেলগুলো যথেষ্ট বড় এবং সুমিষ্ট, তাই বনহুর প্রাণভরে ভক্ষণ করে নিলো।

অনেকটা সুস্থ বোধ করলো বনহুর।

এবার সে আবার প্রবেশ করলো বনের মধ্যে। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অগ্রসর হলো, দিনের আলোয় বনের মধ্যে বেশ পরিস্কার সব নজরে পড়ছে। মানুষের সাড়া পেয়ে অনেক রকম ছোটোখাটো জীবজন্তু ছুটে পালাতে লাগলো। কোনো কোনো জায়গায় হরিণ হরিণী মনের আনন্দে ছোট ছোট গাছের পাতা ভক্ষণ করছিলো। কোথাও গাছের গর্তে শিয়ালী তার বাচ্চাদের নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে বসে বিশ্রাম। নিচ্ছিলো। কোথাও বা জেব্রা তার লম্বা গলা বাড়িয়ে উঁচু কোনো ডাল থেকে কচি ডগাটা ভেঙে নেবার চেষ্টা করছিলো। বনহুরের পদশব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে নিলো, কিন্তু নড়লোনা– যেমন গাছের ডগা অন্বেষণ করছিলো তেমনি করতে লাগলো। বনহুর এদের নির্ভীক আচরণে মুগ্ধ হলো।

আরও কিছুদূর অগ্রসর হতেই দেখলো– একটি বাঘিনী তার কতগুলো বাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্ত আরামে নাক ডাকাচ্ছে। হয়তো মানুষের আগমন সে বুঝতেই পারেনি।

বনহুর ব্যাঘ্র-গৃহিণীর নিদ্রায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে বিপরীত দিকে চলতে লাগলো। কিছুটা এগুতেই দক্ষিণ পাশের ঝোপের মধ্যে একটা ঘোঁৎ ঘোৎ আওয়াজ তার কানে প্রবেশ করলো। তৎক্ষণাৎ বনহুর ফিরে দাঁড়ালো, দক্ষিণ হস্তে তার রিভলভার ধরাই ছিলো। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নজরে পড়লো– একটি বন্যশুকর তীব্র বেগে ছুটে আসছে, মাথাটা নিচু করে!

বন্যশূকরটি যে তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে তাকে কোনো ভুল নেই। বনহুর দ্রুত একটি গাছের গুঁড়ির আড়ালে আত্মগোপন করে রিভলভার উঁচু করে ধরলো। অব্যর্থ লক্ষ্য তার, বনহুরের গুলী সোজা গিয়ে বিদ্ধ হলো শূকরটির মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে শূকরটি ঘুরপাক খেয়ে পড়ে পেলো ঝোপটার মধ্যে, বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ আর তার হলোনা।

বনহুর আবার অগ্রসর হলো, দক্ষিণ হস্তে সব সময় গুলী ভরা রিভলভার উদ্যত রয়েছে।

এটা আফ্রিকার জঙ্গল, প্রতিমুহূর্তে হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সমস্ত দিন ধরে বনহুর বনময় ঘুরে বেড়ালো, ইতিমধ্যে আরও দুটো গুলী তাকে ব্যয় করতে হয়েছে।

শেষ বেলা বনহুর চিন্তিত হয়ে পড়লো, দিনের আলোয় জঙ্গলটা তবু দেখতে পাচ্ছিলো, কিন্তু রাতের অন্ধকারে নিজেকে রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন হবে। তার মোটর-বোটটা সেই সাগর-তীরে পড়ে আছে, সেখানে ফিরে যাবার আর কোনো উপায় নেই।

বনহুর একটা বৃক্ষে আরোহণ করে রাত্রিযাপন করবে মনে স্থির করেছিলো, কিন্তু সবগুলো বৃক্ষই তার জন্য নিরাপদ বলে মনে হলোনা। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কোন্ বৃক্ষটায় আরোহণ করলে রাতের মত নিশ্চিন্ত হতে পারে।

কিন্তু আশেপাশে তেমন কোনো ছোটখাটো বৃক্ষ নজরে পড়লো না, সবগুলো প্রায় বিরাট বিরাট বৃক্ষ। বনহুর আরও কিছুটা এগিয়ে গেছে– হঠাৎ তার নজরে পড়লো, দূরে একটি আলোকরশ্মি দেখা যাচ্ছে। আলোটা কিসের বোঝা যাচ্ছে না, তবু বনহুরের মনে সন্দেহ জাগলো নিশ্চয়ই কোনো মানুষ এ জঙ্গলে প্রবেশ করেছে। নিকটবর্তী একটি বৃক্ষে আরোহণ করে চুপচাপ বসে রইলো।

বৃক্ষটির উপর হতে আলোটা আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এবার বনহুর বুঝতে পারলো আলোটা ছোট খাটো নয়, বেশ বড়; কোনো অগ্নিকুণ্ড হবে, বহুদূরে বনের মধ্যে জ্বলছে বলে অমন ছোট মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই কোনো মানুষ এ জঙ্গলে এসেছে, কিন্তু সে মানুষ সভ্য জগতের না অসভ্য জংলী কিংবা কোনো ডাকাত বা দস্যু দল। যাই হোক রাত ভোর না হওয়া পর্যন্ত তাকে ধৈর্য ধরে থাকতেই হবে, কাল সকালে সে ওদের সঙ্গে মিলিত হবার চেষ্টা করবে।

বনহুর বৃক্ষশাখায় হেলান দিয়ে ঐ অগ্নিশিখাটাই লক্ষ্য করছিলো। প্রথমে মশালের আলো বলেই ভ্রম হয়েছিলো তার কিন্তু এবার তার সে ভুল ভেঙে গেলো কারণ অন্ধকার যতই গাঢ় হচ্ছে ততই আলোক রশ্মিটা স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে উঠছিলো। এখন আলোটা মস্ত বড় বলে মনে হলো।

রাত বাড়ছে।

বনহুরের সাহসী প্রাণেও একটা আতঙ্ক জেগে উঠছে। এমন গহন বনে, একা সত্যি ঘাবড়াবার কথা। কিন্তু বনহুর ভয়ে কুঁকড়ে যায়নি, একটু ভীতিভাব জাগলেও সেটাকে কিছুতেই সে প্রশ্রয় দিচ্ছিলোনা। বৃক্ষতলে গাঢ় জমাট অন্ধকার বনের কোনদিকে এখন আর নজর চলছেনা, শুধু হিংস্র জীবজন্তুর ভয়ঙ্কর গর্জন আর মারামারি ধস্তাধস্তি চলেছে। সেকি উৎকট তীব্র হুঙ্কার। বনহুর আজ রাতের অন্ধকারে উপলব্ধি করছে আফ্রিকার জঙ্গলের আসল রূপ।

গোটা রাত হিংস্র জীবজন্তুর লড়াই-এর শব্দ শুনতে শুনতে রাত ভোর হয়ে গেলো। গাছে গাছে পাখির কলরব জেগে উঠলো, পূর্ব আকাশে দেখা দিলো সূর্যদেব।

বনহুর এবার বৃক্ষ থেকে নেমে দাঁড়ালো নিচে। রাত্রিতে এখানে কি ভয়ঙ্কর লড়াই না হয়ে গেছে, ওদিকে লক্ষ্য করতেই বনহুর চমকে উঠলো, বিরাট একটা লোমশ দেহ পড়ে আছে ঝোপঝাড় আর আগাছার মধ্যে। সেদিকে অগ্রসর হলো বনহুর, জীবটা মৃত না জীবিত। জীবিত হলে নিশ্চয়ই ওভাবে পড়ে থাকতোনা।

নিকটে পৌঁছে দেখলো বিরাট এক গরিলা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, মরে শক্ত হয়ে গেছে ওর দেহটা। কিন্তু বনহুর আশ্চর্য হলো গরিলার দেহে কোথাও আঘাত বা ক্ষতচিহ্ন নেই। হঠাৎ গরিলাটা মারা পড়লো কেনো, রাতে মেঘ গর্জনের মত একটা হুঙ্কার তার কানে এসেছিলো, সেটা যে ঐ গরিলার কণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ এখন সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো।

হঠাৎ বনহুরের নজর চলে গেলো গরিলার হাতের মুঠায়। বিস্মিত হলো সে, অবাক হয়ে দেখলো গরিলার দক্ষিণ হস্তের মুঠায় একটি সাপ জড়িয়ে আছে, সাপটার অর্ধেকটা পড়ে আছে তার বাম হস্তের পাশে। বিরাট কালনাগ সাপ ওটা। বনহুর এবার বুঝতে পারলো সর্পদংশনে গরিলাটার মৃত্যু ঘটেছে। ক্রুদ্ধ গরিলা সর্পরাজকে দু’খণ্ড করে ফেলেছে বটে, কিন্তু তার পূর্বেই সর্পরাজ দংশন করেছিলো গরিলা মহারাজকে।

বনহুর এবার অগ্রসর হলো– গত রাতে যেদিকে সেই আলোক রশ্মিটা দেখা গিয়েছিলো। সেদিকে। দিনের আলোয় বনটা হালকা আলোতে ভরে উঠেছে, কোথাও বা ঘন জমাট অন্ধকার। কারণ বনটা যেখানে বেশি নিবিড় সেখানে অন্ধকার গাঢ়। বনহুর দক্ষিণ হস্তে রিভলভার ঠিক রেখে সতর্কভাবে চলতে লাগলো।

বনহুর কিছুটা এগুতেই হঠাৎ তার নজরে পড়লো একটা সিগারেটের খালি বাক্স পড়ে আছে শুকনো পাতার মধ্যে। বনহুর সিগারেটের বাক্সটা হাতে তুলে নিলো। নিশ্চয়ই সভ্য সমাজের মানুষের পদার্পণ হয়েছে। একটা আশার আলো উঁকি দেয় বনহুরের মনে। যা হোক তবু এই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে সঙ্গী পাওয়া যাবে। আরও কিছুটা অগ্রসর হতেই দৃষ্টি পড়লো গহন জঙ্গলের মধ্যে, একটি অগ্নিকুণ্ডের চিহ্ন দেখে বনহুর বুঝতে পারলো এ অগ্নিকুণ্ডের আলোকরশ্মি গত রাতে বৃক্ষশাখায় বসে সে দেখেছে। আশেপাশে লক্ষ্য করে আরও বুঝতে পারলো সেখানে কোনো একটি তাবু গাড়া হয়েছিলো। কতগুলো বিস্কুটের এবং লজেন্সের খালি প্যাকেট বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে। সিগারেটের বাক্স, অর্ধদগ্ধ। সিগারেটের অংশ, কমলালেবুর খোসা এমনি আরও কত রকম উচ্ছিষ্ট বস্তু পড়ে রয়েছে সে স্থানে। বনহুরের ধারণা সত্যি বলে মনে হলো। কিন্তু এরা কারা, এই আফ্রিকার জঙ্গলে কি উদ্দেশ্যেই বা। আগমন হয়েছে তাদের?

এখন বনহুর তাদের সন্ধানে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠলো। শত্রু হোক আর মিত্র হোক, সেই সভ্য সমাজী মানুষদের সঙ্গে তাকে পরিচয় করে নিতে হবে

বনহুরের চিন্তাধারায় বাধা পড়লো, তার দৃষ্টি চলে গেলো ও- পাশে কয়েকটা কমলালেবুর খোসার পাশে ছোট্ট একটা রুমাল পড়ে আছে। বনহুর সরে এসে রুমালখানা তুলে নিলো হাতে। লেডিস রুমাল, রুমালের এক কোণে ইংলিসে লিখা আছে “শ্যালন”, তাহলে কি দলটায় নারীও আছে? তাই হবে, নাহলে এ লেডিস রুমাল আসবে কি করে। পকেটে রাখলো রুমালখানা। বনহুর সমস্ত দিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালো। কতগুলো হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে হলো। প্রতি মুহূর্তে তাকে সজাগ হয়ে চলতে হচ্ছিলো। বেলা শেষ হয়ে আসছে, বনের মধ্যে ক্রমেই অন্ধকার নেমে আসছে বনহুর তবু অগ্রসর হচ্ছে।

হঠাৎ একটা নারীকণ্ঠের আর্তচিৎকার তার কানে এসে পৌঁছতেই সজাগ হয়ে উঠলো। বনের মধ্য থেকেই আর্তনাদটা আসছে, বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে ছুটে চললো। খানিকটা অগ্রসর হতেই সে দেখতে পেলো একটি গরিলা জাতীয় জীব একটি যুবতীকে ধরে ফেলেছে। যুবতীর দেহে শিকারীর ড্রেস, মাথায় ব করা ছোট চুল, পায়ে বুট, হাতের মুঠায় তখনও ধরা রয়েছে একটা বন্দুক।

বনহুর কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে জীবটিকে লক্ষ্য করে তার রিভলভার উঁচু করে ধরলো, কিন্তু যুবতীটি এখন ঐ ভয়ঙ্কর গরিলা জাতীয় জীবটার বাহুর মধ্যে আবদ্ধা।

জীবটা বনহুরকে দেখতে পেয়ে বিরাট বিরাট তীক্ষ্ম দাঁতগুলো বের করে অদ্ভুত শব্দ করলো।

বনহুর বুঝতে পারলো, এটা এক ধরনের ভয়ঙ্কর গরিলা জাতীয় জীব। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটিকে সে হত্যা করে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সেকি ভয়ঙ্কর চেহারা জীবটির, মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়ছে।

 বনহুর আর বিলম্ব করতে পারে না, গরিলা জাতীয় জীবটার পা লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে একটা উৎকট শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলো জীবটা। কিন্তু তার হাতের মুঠায় তখনও ধরা রয়েছে যুবতীটি।

বনহুর এবার তার ছোরাখানা মুক্ত করে নিয়ে লাফিয়ে পড়লো জীবটার দেহের উপর।

জীবটা এবার যুবতীটিকে ছেড়ে দিয়ে বনহুরকে আক্রমণ করলো। বনহুরের হস্তে সূতীক্ষ্ম ধার ছোরা আর গরিলার দেহে অসীম শক্তি, নখগুলো ভীষণ ধারালো দাঁতগুলোও তেমনি মারাত্মক তীক্ষ্ম।

কিছুক্ষণ চললো ভীষণ ধস্তাধস্তি, কিন্তু বনহুরের ছোরার আঘাতে জীবটি বেশিক্ষণ যুদ্ধ করতে সক্ষম হলো না। বনহুরের ছোরা তার বক্ষে গেঁথে গেলো সমূলে।

জীবটা তীব্র চিৎকার করে বনহুরকে জাপটে ধরে ফেললো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার বলিষ্ঠ লোমশ বাহু দুটো শিথিল হয়ে দুপাশে খসে পড়লো।

বনহুর টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। ফিরে তাকাতেই দেখলো একদল লোক যুবতীটিকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সকলেরই দৃষ্টি বনহুর ও জীবটার দিকে। সকলেরই মুখ ভয়ার্ত ফ্যাকাশে।

বনহুরকে উঠে দাঁড়াতে দেখে কয়েকজন ছুটে গিয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়ালো, দু’জন ধরে ফেললো তাকে। বনহুরের কপালের এক পাশে কেটে রক্ত ঝরছিলো।

শিকারীদল বনহুরকে তাড়াতাড়ি এক জায়গায় বসিয়ে তার সেবায় আত্মনিয়োগ করলো।

যুবতীর দেহে তেমন কোনো আঘাত বা ক্ষত হয় নি, তবে ভয়ে একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে।

একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক যুবতীটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ-মাউ করে কাঁদছে, হয়তো লোকটির কন্যা হবে যুবতী। প্রৌঢ় বিলাপ করে বলছিলেন– কেন তুই এলি মা? কেন তোর এমন সখ চেপেছিলো? হায় হায়! ওনি যদি তোকে বাঁচিয়ে না নিতেন তাহলে এতোক্ষণ তোর অবস্থা কি হতো বল দেখি?

বৃদ্ধ যখন কন্যাকে ফিরে পেয়ে নানা রকম সান্ত্বনা লাভের চেষ্টা করছিলেন, তখন অন্যান্য লোকজন বনহুরের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে।

বনহুর একটু সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে নিয়ে ওরা বনের মধ্যে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটা সমতল প্রশস্ত জলাভূমির পাশে গিয়ে হাজির হলো। বনহুর দেখলো একটি তাঁবু খাটানো রয়েছে। বনহুরকে সে তাবুর মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো, এবং একটি বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় ব্যাণ্ডেজ করে দেওয়া হলো। তাবুতে সব রকম জিনিসপত্র রয়েছে, এমন কি ঔষধপত্র সব রয়েছে তাদের সঙ্গে।

বনহুর অল্প সময়ে সুস্থ হয়ে উঠলো।

সুস্থ হয়ে সে জানতে পারলো, এরা একটি আবিষ্কারক দল। বয়স্ক ভদ্রলোক প্রফেসার ম্যাকমারা আর যুবতী তার কন্যা মিস শ্যালন– যার রুমাল সে কুড়িয়ে পেয়েছিলো কমলালেবুর খোসার পাশে। অন্যান্য লোকজন প্রফেসার ম্যাকমারার ছাত্র ও কয়েকজন তাদের দেহরক্ষী। ছাত্র হলেও দলের অনেকেই বেশ বয়স্ক ছিলো, সবগুলো মিলে প্রায় পনেরো জনের মত লোক তাদের দলে। মেয়েদের মধ্যে শ্যালন একা, শ্যালনও যে তার পিতার ছাত্রী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বনহুর বুঝতে পারলো– এ দলের সন্ধানই সে পেয়েছিলো সেদিন। এদের আলোক রশ্মিই তার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিলো অগ্নি শিখারূপে। বনহুর আশ্বস্ত হলো এবার।

 প্রফেসার ম্যাকমারা জীবনে বহু কিছু আবিষ্কার করেছেন বিশেষ করে নতুন এবং অজানা জীবজন্তু আবিষ্কার করাই তার নেশা। আজ পর্যন্ত তিনি বহু রকম জীবের সন্ধান পেয়েছেন এবং তাদের ফটো সংগ্রহ করেছেন। এবার তিনি দলবল নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে আবির্ভাব হয়েছেন, নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হয়েও তিনি অবিরত অদ্ভুত জীব-জন্তুর ফটো গ্রহণ করে চলেছেন।

আজও তিনি দূরে এক টিলার আড়ালে আত্মগোপন করে ঐ গরিলা জাতীয় জীবটার ছবি নিচ্ছিলেন। ক্যামেরার সাহায্যে। হঠাৎ গরিলাটা তাদের তাবুর দিকে ছুটে আসে এবং দ্রুত হস্তে ধরে ফেলে মিস শ্যালনকে। শ্যালনকে ধরবার সঙ্গে সঙ্গে গরিলা জাতীয় জীবটা গর্জন করতে করতে ছুটে পালায় গহন বনের দিকে। অতি দ্রুত গতিতে জীবটা তাদের চোখের আড়ালে চলে যায়, কাজেই দল-বল সহজে জীবটা ও শ্যালনকে খুঁজে পায় না। ওরা গুলী করার অনেক চেষ্টাও করেছে কিন্তু সফলকাম হয়নি। বন বাদার ভেঙে অগ্রসর হতে গিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছিলো প্রফেসার ম্যাকমারার দলবল।

বনহুর হঠাৎ শ্যালনের চিৎকার শুনতে পেয়ে ওকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তাই রক্ষা। জীবটাকে হত্যা করার পর প্রফেসার ম্যাকমারা ও তার দল-বল গিয়ে পৌঁছেছিলো সেখানে।

প্রফেসারের দল বনহুরকে দেবতার মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে শুরু করলো। সবাই মিলে বনহুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো। প্রফেসার নিজে শ্যালনকে বনহুরের সেবায় নিয়োজিত করে দিলো।

বনহুর বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলো, সে কারো সেবা গ্রহণে ইচ্ছুক নয়, হেসে ধন্যবাদ জানালো সবাইকে।

ম্যাকমারা বনহুরের পরিচয় জানতে চাইলেন– আপনার পরিচয় যদি জানান তবে আরও খুশি হবো।

বনহুর বললো– জাহাজডুবি হয়ে আমি এ জঙ্গলে এসে পড়েছি। প্রথমে তীরে এসে উঠি, তারপর এই গহন বনে। আজ প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো আমাদের জাহাজডুবি হয়েছে। আমার নাম আলম। আমাদের নিজস্ব মালবাহী জাহাজে আমি জম্বুর বন্দরে যাচ্ছিলাম।

প্রফেসার ম্যাকমারা খুশি হলেন, আপনি আমার কন্যার জীবন রক্ষা করেছেন, আপনি এখন থেকে আমাদেরই একজন।

যাক বনহুর এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে তবু সঙ্গী-সাথী পেলো। প্রফেসার ম্যাকমারা বনহুরকে অত্যন্ত স্নেহ করতে লাগলেন। তিনি জাতিতে ক্রীশ্চান, তবু তার চালচলন ছিলো ঠিক বাঙালিদের মত। বনহুরের ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ হলেন।

বনহুরও প্রফেসার ম্যাকেমারার একজন অনুগত ছাত্রের মতই হয়ে পড়লো। প্রফেসার নিজে তাকে তার ব্যবহারী দ্রব্যাদি বের করে দিলেন। অনেক কয়টা দিন পর বনহুর পেট পুরে খেলো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি জন্মেছিলো, শেভ করে ফেললো। বনহুরের যে রূপ ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো আবার তা আত্মপ্রকাশ পেলো।

বনহুরের সুন্দর চেহারা দেখে সবাই মুগ্ধ বিস্মিত হলো। প্রফেসার দুহিতা শ্যালন আরও বেশি বিমুগ্ধ হলো, বনহুরকে ওর ভাল লেগেছে প্রথম থেকেই, সোজা সে বাবাকে বললো মিঃ আলমকে আমি বিয়ে করবো, বাবা।

কথাটা অতি স্বাভাবিক সচ্ছ ভাবেই বলেছিলো শ্যালন, কারণ তাদের মধ্যে বিয়েটা তেমন কোন লজ্জাকর ব্যাপার নয়। যাকে যার পছন্দ হবে তাকেই সে গ্রহণ করতে পারবে। কাজেই শ্যালনের কথায়। যদিও বনহুর হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো প্রথমে, পরক্ষণেই সামলে নিয়েছিলো নিজকে। ভয়ঙ্কর গহনে বনে, মৃত্যুর মুখোমুখি বসে এমন একটা উক্তি তার কঠিন মনকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলো, হেসেছিলো আপন মনে।

বনহুর আরও জানতে পারলো ম্যাকমারার একজন বিশিষ্ট ছাত্র ইতিমধ্যে বন্যশূকরের কবলে প্রাণ হারিয়েছে। একজন কোনো এক গণ্ডারের ছবি তোলাকালে ভীষণ আহত হয়েছিলো এখন সে সুস্থ হয়েছে।

জঙ্গলের এ জায়গাটা প্রফেসার ম্যাকমারার কাছে বেশ পছন্দনীয় মনে হওয়ায় এখানেই ক’দিন কাটিয়ে আরও কিছু ফটো সংগ্রহ করবেন বলে মনস্থির করে নিয়েছেন।

জায়গাটা জঙ্গলে পরিপূর্ণ হলেও বেশ হাল্কা। মাঝখানে খানিকটা জলাভূমি, ঠিক একটা হদের মত। আশেপাশে সমতলভূমি, ফাঁকা ফাঁকা গাছপালা। সূর্যের আলো প্রবেশে এখানে তেমন কোন। অসুবিধা নেই। আফ্রিকার জঙ্গল হলেও জায়গাটা মনোরম। এক জায়গায় ক্যামেরা রেখে দূরদূরান্তের ফটো তুলে নেওয়া যায়।

বনহুর অবাক হয়ে এ সব ফটো তোলা লক্ষ্য করতে লাগলো। বহুদূরের বস্তুও এসব ক্যামেরার সাহায্যে একেবারে নিকটে এসে পড়ে হয়তো বা কোনো ব্যাঘ্র তার বাচ্চাদের নিয়ে অনেক দূরে বসে বসে খেলা করছে, প্রফেসার ম্যাকমারার ক্যামেরার দ্বারা তার বাচ্চাকাচ্চাসহ ফটো তুলে নিলো। হয়তো বা একদল হরিণ অনেক দূরে ছুটে পালাচ্ছে বা কোন ঝরণায় পানি পান করছে, ক্যামেরায় তার ছবি স্পষ্ট ধরে নেয়া হলো। ভয়ঙ্কর জীবজন্তু যেগুলোর নিকটে যাওয়া সম্ভব নয়, সে সব জীবের ফটোও অতিসহজে উঠিয়ে নিচ্ছিলেন ম্যাকমারা।

এসব ক্যামেরা চালাতে বেশ কিছু লোকের প্রয়োজন হচ্ছিলো। ম্যাকমারার ছাত্রগণ হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলো তাকে সাহায্য করতে। কারণ কখনও ক্যামেরাটাকে উঁচুতে তুলে নিয়ে নিচের ছবি নেওয়া হচ্ছিলো, কখনও বা নিচ থেকে উপরের ছবি। হয়তো বা কোনো বৃক্ষের শাখায় বিরাট একটি অজগর সাপ ভীমরাজের মত বিশ্রাম করছে ম্যাকমারা তার ফটো নেবেন। কোনো গাছের ডগায় বসে আছে। অজানা কোনো অদ্ভুত পাখি। ম্যাকমারা তার ফটোও উঠিয়ে নিতে ছাড়বেন না। এসব ছবি বা ফটো সংগ্রহ করতে তাঁকে ভীষণ পরিশ্রম করতে হচ্ছিলো, তবু বৃদ্ধের চোখেমুখে এতোটুকু ক্লান্তির ছাপ নেই। প্রফেসার ম্যাকমারা অবিরাম খেটে চলেছেন।

বনহুর নিশ্চুপ থাকতে পারেনা, সেও যোগ দেয় ম্যাকমারার ছাত্রদের সঙ্গে সাহায্য করতে।

 খুশি হন ম্যাকমারা।

বিশেষ করে বনহুরের ব্যবহার এবং কার্যকলাপ তাকে মুগ্ধ করেছিলো। বনহুরকে তিনি সবার চেয়ে বেশি ভালবেসে ফেললেন, এতে ম্যাকমারার কয়েকজন ছাত্রের মধ্যে ঈর্ষা দেখা দিলো।

ম্যাকমারা যখন ক্যামেরা চালান তখন নানা রকম হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণ হবার সম্ভাবনা থাকে, কোনো কোনোদিন ব্যাঘ্র হামলা করে বসে, কোনোদিন বা দাঁতওয়ালা বন্য শূকর। কোনোদিন তার চেয়েও কোনো ভয়ঙ্কর জীব হানা দেয়। পাহারাদারগণ সামলে উঠতে পারেনা, বনহুর এ কদিনে অনেকগুলো হিংস্র জীব হত্যা করেছে। বনহুরের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। শুধু ম্যাকমারাই নয় সবাই স্তম্ভিত হতবাক হয়ে যেতো, মিস শ্যালন তো এক মুহূর্তে বনহুরকে ছেড়ে থাকতে পারতোনা।

বনহুর নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও শ্যালন সব সময় তার পাশে ছায়ার মত লেগে থাকতো। ওকে ছেড়ে থাকতে নাকি ওর মোটেই ভাল লাগেনা।

আফ্রিকার জঙ্গলে, মৃত্যু ভয়ঙ্কর মুহূর্তে শ্যালনের মত একটি শ্বেতাঙ্গিনী যুবতীকে পাশে পেয়ে বনহুর বিব্রত হয়নি বরং সে খুশিই হয়েছে। শ্যালনের সরল-সহজভাব বনহুরকে মুগ্ধ করেছে।

শ্যালনের মধ্যে ছিলোনা কোনো সঙ্কোচ বা দ্বিধা। সে এমন ভাবে বনহুরের সঙ্গে মিশতো, যা সভ্যসমাজের যে কোনো লোকের চোখে অশোভনীয়।

বনহুর এখন সম্পূর্ণ প্রফেসার ম্যাকমারার লোক বনে গেছে। ম্যাকমারা যখন তখন বনহুরকে নিয়েই তার কঠিন আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করলেন অবশ্য তার অন্যান্য ছাত্রগণও তখন সঙ্গে থাকতো।

বনহুর সেদিন তাবুর বাইরে বসে রাইফেলটা পরিষ্কার করছিলো, এমন সময় মিস শ্যালন এসে বসলো তার পাশে। বনহুরের কাঁধে মাথা রেখে বললো– মোটেই ভাল লাগছে না আলম।

বনহুর যেমন রাইফেলটা পরিষ্কার করছিলো তেমনি করতে করতে বলে- হঠাৎ ভাল না লাগার কারণ?

তুমি চলে এলে আমাকে তাবুতে একা ফেলে, তাই।

এই সামান্য কারণে তুমি—

আলম, তোমাকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্ত বাঁচবোনা। শ্যালন বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে।

বনহুর তাকালো এদিক-সেদিকে; কেউ দেখে ফেললো নাকি!

শ্যালন তখন বনহুরের গণ্ডে চুম্বন দিতে শুরু করেছে। অদ্ভুত এ মেয়েটির কবল থেকে বনহুর নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেনা। ওর কোঁকড়ানো রাশিকৃত চুলে বনহুরের মুখমণ্ডল ঢাকা পড়ে যায়।

বনহুর বলে–ছিঃ, শ্যালন, একি হচ্ছে?

 কেন তোমার ভাল লাগছেনা?

 বনহুর কোনো জবাব দিতে পারেনা।

শ্যালন পুনরায় বলে– আলম, তুমি বড় সেকেলে। তোমার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। বেরসিক তুমি। খিলখিল করে হেসে উঠে মিস শ্যালন।

বনহুর শ্যালনকে তুমি বলে ডাকতো, শ্যালনও ওকে তুমি বলে সম্বোধন করতো। শ্যালনের যেমন প্রথম থেকেই বনহুরকে ভাল লেগেছিলো, তেমনি বনহুরেরও ভাল লেগেছিলো ওকে– তাই বলে বনহুর ওকে তো গ্রহণ করতে পারেনা। শ্যালনের সান্নিধ্য ভাল লাগতো এই যা।

গহন জঙ্গলে শ্যালন এক নতুন উন্মাদনা জোগালো বনহুরের হৃদয়ে। চঞ্চল হরিণীর মতই ছিলো শ্যালন। সব সময় বন্দুক নিয়ে ছুটতো এদিক-সেদিকে। আবার ভয়ও পেতো, সেদিনের ঘটনার পর; একা যাওয়া তার হোতনা। যখনই সে বন্দুক হাতে শিকার করতে বের হতো তখন বনহুরকে সে কিছুতেই ছাড়তোনা। ওকে টেনে-হিঁচড়ে তবুও সঙ্গে নিতো।

বনহুরের নিঃসঙ্গ জীবন উজ্জ্বল হয়ে উঠতো, শ্যালনের সঙ্গ তাকে মোগ্রস্ত করে ফেলতো। বনহুরের জীবনে বহু নারী এসেছে, কিন্তু বনহুর কাউকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে পারেনি একমাত্র মনিরা আর নূরীকে ছাড়া। এ দুটি নারীকেই বনহুর গ্রহণ করেছে অন্তর দিয়ে, উজাড় করে দিয়েছে সে সমস্ত সত্ত্বা। শ্যালনকে বনহুরের ভাল লাগে, কিন্তু ভালবাসতে পারে না সে।

শ্যালন যখন তার সুকোমল শুভ্র বাহু দুটি দিয়ে বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে তখন সে হারিয়ে ফেলে নিজেকে, তার মধ্যে জেগে উঠে পৌরুষত্ব মনোভাব, কিন্তু সাবধানে সে নিজেকে সংযত রাখে। সে পুরুষ কিন্তু ব্যাভিচারী নয়।

শ্যালন বলে– আলম, আমি তোমাকে কত ভালবাসি আর তুমি আমাকে একটুও ভালবাসো না।

কে বলে আমি তোমাকে ভালবাসি না?

 সত্যি তুমি আমাকে ভালবাসো?

 হাঁ শ্যালন।

তবে তুমি আমাকে ধরা দাও না কেনো?

 সব সময় তো তোমার কাছে রয়েছি। তুমি আমাকে এক রকমই ধরেই রেখেছ সর্বক্ষণ।

 আলম!

বলো?

 দেশে ফিরেই আমাদের বিয়ে হবে।

 আনমনা হয়ে যায় বনহুর।

 শ্যালন ওকে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে বলে– আলম, তুমি কথা বলছো না কেনো?

উ।

আলম, বলো রাজি আছো আমাকে বিয়ে করতে?

 বনহুর কি জবাব দেবে ভেবে পায় না।

 শ্যালন করুণ কণ্ঠে বলে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না আলম, আমি মরে যাবো–

বনহুরের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে একটি মুখ, সেও বলেছিলো– হুর, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা হুর– একটা দীর্ঘশ্বাস বনহুরের বুক চিরে বেরিয়ে আসে।

শ্যালন ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে থাকে, অসহায় করুণ সে আঁখি দুটি। এক রাশ ঝকড়া সোনালী চুলের ফাঁকে তীব্র ঘোলাটে দুটি চোখ।

বড় মায়া হয় বনহুরের, মিথ্যা বলতে দোষ কি। জীবনে সে লোকের মঙ্গলের জন্য বহু মিথ্যা বলেছে, আজও না হয় শ্যালনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিলো– ক্ষতি কি তাতে। কিন্তু একটা অবলা নির্বোধ মেয়েকে এতোবড় মিথ্যা আশ্বাস সে চট করে দিতে পারলো না। বনহুর ওকে টেনে নিলো নিবিড় করে।

শ্যালন ভুলে গেলো বিয়ের কথাটা।

বনহুরের বাহু-বন্ধন থেকে শ্যালন যখন মুক্তি পেলো তখন তার শ্বেত গণ্ডদ্বয় রাঙা হয়ে উঠেছে।

শ্যালনের চোখে-মুখে খুশির উৎস।

*

তাবুর বাইরে অগ্নিকুণ্ড দপ দপ করে জ্বলছে। কয়েকজন পাহারাদার রাইফেল কাঁধে সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছে তাবুর বাইরে নয় ভিতরে। এ জঙ্গলে রাতে বাইরে থাকা কিছুতেই নিরাপদ নয়। একজন পাহারাদার বাঘের কবলে প্রাণ হারিয়েছে কদিন আগে রাতে বাইরে বেরিয়েছিলো পায়খানা করতে।

এরপর তাবুর বাইরে বের হওয়া কারো সম্ভব নয়।

রাতে জেগে জেগেই প্রায় সময় কাটিয়ে দেয় সবাই। ঘুম কম, জেগে থাকাই বেশি। তবু একদল ঘুমায় আর একদল জেগে থাকে।

শেষ রাতের দিকে বনহুর ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। তাবুর বাইরে মেঘ গর্জনের মত হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। সে হুঙ্কারের শব্দে মাটি যেন থর থর করে কেঁপে উঠছে।

বনহুর উঠে বসলো তার বিছানায়, দক্ষিণ হস্তে চেপে ধরলো তার রিভলভারখানা। সে বুঝতে পারলো কোন ভয়ঙ্কর জীবের গর্জন এটা। ব্যাঘ্র বা সিংহের হুঙ্কার নয়। এ শব্দটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। তাবুর সকলেই জেগে উঠেছে। এমনকি শ্যালন পর্যন্ত জেগে তার পিতার পাশে বসে থর থর করে। কাঁপছে।

প্রফেসার ম্যাকমারা চাপা কণ্ঠে বনহুরকে তাঁর পাশে ডেকে নিলেন, তারপর বললেন– এটা কিসের আওয়াজ বলে তোমার মনে হয়?

বনহুর একটু ভালভাবে শুনে নিয়ে বললো- স্যার, এটা বাঘ-ভলুক বা সিংহের কণ্ঠের আওয়াজ নয়, নতুন কোন জীব। জীবটা যে অতি ভয়ঙ্কর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বনহুর ও প্রফেসার ম্যাকমারার অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে তাকে স্যার বলেই সম্বোধন করতো।

বনহুরের কথায় বললো মিস শ্যালন– আমার বড় ভয় করছে আলম, তুমি আমার পাশে এসো।

ম্যাকমারা বলে উঠলেন– কোনো ভয় নেই মা, আমাদের তাবু অত্যন্ত মজবুত ভাবে তৈরি। কোনো রকম জীব-জন্তু এ তাবুর মধ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না, কিন্তু জীবটার ফটো নেবো আমি

ম্যাকমারার কথা শেষ হয় না, তাবুর এক ধারের পর্দা নড়ে উঠে ভীষণভাবে, সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে যায়। তাবুক খানিকটা অংশ। একখানা লোমশবাহু প্রবেশ করে তাবুর ছেঁড়া অংশ দিয়ে।

মিস শ্যালন বাহুটার দিকে তাকিয়ে তীব্র চিৎকার করে ঢলে পড়ে শয্যায় উপরে।

প্রফেসার ম্যাকমারা ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হতে যাচ্ছিলেন, কন্যাকে ঢলে পড়তে দেখে তিনি ক্যামেরা রেখে ছুটে এলেন- মা শ্যালন! মা শ্যালন–

লোমশ বাহুটা তখন তাবুর মধ্যে চক্রাকারে ঘুরে ফিরছে।

স্যার ম্যাকমারা আর বনহুর ছাড়া সবাই ভীত ভাবে আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। তাবুর মধ্যে সবাই ছুটোছুটি করে এ ওর গায়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ছে। লোমশ বাহুটা লক্ষ্য করে বনহুর গুলী ছুড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে হাতখানা অদৃশ্য হলো তাবুর বাইরে।

বনহুর ব্যস্তকণ্ঠে সবাইকে বললো–আপনারা তাবুর দক্ষিণ দিকে চলে আসুন, চলে আসুন শীগগীর–

উঠি-পড়ি করে সবাই তাবুর ভাল অংশে চলে এলো, কিন্তু সকলেরই চোখে মুখে ভীত-কম্পিত ভাব। প্রায় অনেকেই আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। বনহুরের পিছনে সবাই এসে জড়ো হলো, কেউ কেউ সাহস করে রাইফেল বাগিয়ে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে। প্রফেসার ম্যাকমারা ক্যামেরা ও কন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তিনি কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

বাইরে গর্জনটা এবার আরও ভয়ংঙ্কর মনে হলো। জীবটা তার আহত হাতখানা নিয়ে বুঝি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েছে। কিন্তু পর মুহূর্তেই সম্পূর্ণ তাবুটা দুলে উঠলো। বাইরে যেন ভীষণ ঝড় শুরু হয়েছে।

বনহুর রিভলভার উদ্যত করে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য সবাইকে বললো তাদের নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকতে।

আশ্চর্য! আবার একখানা হাত বেরিয়ে এলো পূর্বের সেই ছেঁড়া অংশ দিয়ে। বনহুর অবাক হয়ে দেখলো এটা সেই হাত, যে হাতে বনহুর একটু পূর্বে গুলী বিদ্ধ করেছিলো। লোমশ বাহু দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। হাতখানা এবার দ্রুত কিছু অন্বেষণ করে ফিরছে বলে মনে হলো।

*

তাবুর মধ্যে আবার একটা আর্ত চিৎকার জেগে উঠলো, গুলী ছোঁড়া তো দূরের কথা, সবাই নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য এ-ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো।

বনহুর পর পর গুলী ছুঁড়তে লাগলো।

দক্ষিণ হাতখানা বুঝি এবার অকেজো হলে গেলো জীবটার, তাই সে গর্জন করে বাম হস্ত প্রবেশ করিয়ে দিলো তাবুর মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলো মিস শ্যালনের সংজ্ঞাহীন দেহটা। পরক্ষণেই তাবুর ফাঁকে ভেসে উঠলো একখানা বিশাল মুখ।

বনহুর এবং অন্যান্য সবাই দেখলো একটা বিরাট আকার রাক্ষসের মুখ। বুঝতে বাকি রইলো না, জীবটা অন্য কিছু নয় গরিলা।

বনহুর এবার গুলী ছুঁড়তে পারলো না চট করে, কারণ গরিলা মহারাজের হাতের মধ্যে মিস শ্যালনের সংজ্ঞাহীন দেহটা রয়েছে। অন্য কাউকে না নিয়ে মিস শ্যালনকে নেবার মতলব দেখে বনহুরের চক্ষুস্থির হলো। ততক্ষণে গরিলা মহারাজ বিরাট পা ফেলে হুম্ হুম্ আওয়াজ তুলে গহন বনে। অদৃশ্য হয়েছে।

 প্রফেসার ম্যাকমারার আর্তনাদে তাবুর অভ্যন্তর ভরে উঠলো, বাঁচাও! বাঁচাও! আমার কন্যাকে তোমরা বাঁচাও–

শুচিভেদ্য অন্ধকারে কিছু আর দৃষ্টিগোচর হলোনা। শুধু শোনা গেলো পাশের জঙ্গলের মধ্যে। মড়মড় শব্দে ডালপালা ভেঙে পড়ার শব্দ।

বনহুর কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলোনা, একটা অব্যক্ত বেদনা তার অন্তরটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেললো। শ্যালনের সরল সহজ মুখখানা তার মানস পটে ভেসে উঠতে লাগলো স্পষ্ট হয়ে। গরিলা মহারাজ তখন চলে গেছে অনেক দূর। বনহুর পাথরের মূর্তির মত থ’হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রফেসার ম্যাকমারা বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরে করুণ কণ্ঠে বলে উঠলেন–আলম, তুমি একবার আমার শ্যালন মাকে রক্ষা করেছিলে, এবার কেনো তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো? যাও, যাও আলম আমার মাকে রক্ষা করে নিয়ে এসো।

বৃদ্ধের আর্তকণ্ঠে বনহুরের মন ভেঙে পড়ছিলো, রাতের অন্ধকার না হলে বনহুর এতোক্ষণ ছুটে। যেতো ঐ গরিলা রাজের পিছু পিছু, কিন্তু এখন সে উপায়হীন, এতোটুকু আলো নেই কোথাও, তাছাড়া এটা যা-তা বন নয় আফ্রিকার জঙ্গল। বনহুর জীবনের মায়া করেনা, কিন্তু গরিলার কবল থেকে। শ্যালনকে রাতের অন্ধকারে গহন বনে উদ্ধার করে নিয়ে আসা কিছুতেই সম্ভব নয়।

কিন্তু ম্যাকমারার ব্যাকুলতা বনহুরকে আরও উদ্ভ্রান্ত করে তুললো।

আলম, আমার মাকে রক্ষা করো। রক্ষা করো আলম। আমি শ্যালনকে হারিয়ে বাঁচতে পারবোনা। আমার শ্যালন মা শ্যালন–

বনহুর আর স্থির থাকতে সক্ষম হলোনা, একটা ফুল পাওয়ার টর্চ ও গুলী ভরা রিভলভার নিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে পড়লো।

অন্যান্য সবাই হায় হায় করে উঠলো।

প্রফেসার ম্যাকমারা নিজেও ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বনহুর অন্যান্যদের লক্ষ্য করে বললো স্যারকে ধরে রাখুন, আমি চেষ্টা করে দেখি কিছু করতে সক্ষম হই কিনা। বনহুর বেরিয়ে গেলো। ম্যাকমারাকে ধরে ফেললো অন্যান্য ছাত্রগণ।

বনহুর টর্চের আলো ফেলে ছুটতে শুরু করলো। গরিলাটি শ্যালনকে নিয়ে এত দ্রুত সরে পড়েছে। যে বনহুর ছুটেও তার সন্ধান করতে পারলো না। টর্চের আলোতে সে দেখতে পেলো এক পাশের ঝোপ ঝাড় আর জঙ্গল থেতলে গুঁড়িয়ে কোনো বন্য হস্তী যেন চলে গেছে।

বনহুর সেই পথে অগ্রসর হলো।

একটু পূর্বে গরিলা-রাজ ঐ পথে গেছে বলে অন্যান্য হিংস্র জীব-জন্তু সব সরে পড়েছিলো এবং সে কারণে এখন পর্যন্ত বনহুর সম্মুখে তেমন কোনো জন্তু দেখতে পেলো না।

গাঢ় অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে চারদিকে ভালভাবে লক্ষ্য করে বনহুর এগুতে লাগলো। দুঃসাহসী প্রাণ দস্যু বনহুর এতোটুকু ভরকে গেলো না বা তার হৃদয় কম্পিত হলো না। যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে শ্যালনকে। এতো বিপদেও শ্যালনের একটি কথা বার বার মনে পড়ছে–আলম, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না– শ্যালন ভালবেসেছিলো বনহুরকে, মাত্র ক’দিনের পরিচয়েই সে এতো আপন করে নিয়েছিলো, যা বনহুরের প্রাণেও রেখাপাত করেছিলো।

সবচেয়ে বনহুরের বেশি ভাল লেগেছিলো শ্যালনের সরলতা, সহজ মনোভাব। বনহুরের সঙ্গে মিশতে সে এতোটুকু দ্বিধা বোধ করতো না বা সঙ্কোচিত হতো না। উচ্ছল মনোভাব নিয়ে সে নিজেকে বিলিয়ে দিতো বনহুরের মধ্যে।

আজ এই ভয়ঙ্কর বিপদসংকুল মুহূর্তে শ্যালনের মায়াময় মুখখানা গভীরভাবে আকর্ষণ করছে। বনহুরকে। বনহুর ভুলে গেছে তার চারদিকে হিংস্র জীব-জন্তুর অস্তিত্ব, ভুলে গেছে নিজের জীবনের মায়া। শ্যালনকে তার রক্ষা করতেই হবে। মৃত্যুভয়ে ভীত নয় সে, নির্ভীক সাহসী মন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে প্রফেসার ম্যাকমারার কন্যা উদ্ধারে।

বনহুরের ভয় হচ্ছে, গরিলা মহারাজ শ্যালনকে তো হত্যা করে ফেলেনি! শ্যালনকে যদি নিহত করে থাকে, একটি সুন্দর ফুলের মত জীবন অকালে ঝরে পড়বে এই গহন জঙ্গলে, ইস কি ভয়ঙ্কর মর্মান্তিক সে পরিণতি–

হঠাৎ বনহুর চমকে উঠে, তার সম্মুখে কিছুটা দূরে সাদা কিছু দেখা যায়। দ্রুত টর্চের আলো ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায় বনহুর। সাদা জিনিসটার নিকটে পৌঁছে দেখতে পায় সেটা শ্যালনের ওড়না।

বনহুর ওড়নাখানা হাতে নিয়ে দেখে, বুঝতে পারে এ দিকেই চলে গেছে গরিলাটা শ্যালনকে নিয়ে। বনহুর বন-জঙ্গল ভেদ করে অগ্রসর হলো সম্মুখের দিকে।

কিছুটা এগুতেই ঝোপের মধ্যে প্রায় মাটির সঙ্গে লাগানো দুটো বাল্বের মত জ্বলন্ত গোলক তার চোখে পড়লো। বনহুর টর্চের আলো ফেলতেই শিউরে উঠলো, ভয়ঙ্কর একটি অজগর সাপ পথ রোধ করে মাটিতে পড়ে আছে। বাল্বের মত অগ্নি গোলক দুটি অজগরের চোখ। সাপের চোখ যে অন্ধকারে এতো তীব্র আলোর মত মনে হয় বনহুর এর আগে এমন করে দেখেনি।

সর্পরাজ বনহুরকে দেখে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো, মাঝে মাঝে তার মুখের মধ্যে থেকে জিক্টা লিক্ লিক্ করে বেরিয়ে আসছে, সে কি তীক্ষ্ণ ছোরার মত লম্বা জিভ!

বনহুর বিলম্ব করতে পারে না।

সর্প রাজের দেহটা বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে বিস্তার করছিলো। শীঘ্র সরে যাবার কোনো লক্ষণ নেই, বনহুর সর্পরাজের দেহের উপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটা বিপদ ওৎপেতে ছিলো তার জন্য। একটি সিংহী তার শাবক নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলো, কোনো শিকারের সন্ধানেই বুঝি বেরিয়েছে সিংহীরাণী। বনহুরের উপর নজর পড়তেই গর্জন করে উঠলো। সে কি ভয়ঙ্কর শব্দ! গোটা বনভূমি যেন প্রকম্পিত হয়ে উঠলো।

থমকে দাঁড়ালো বনহুর। দক্ষিণ হস্তে উদ্যত রিভলভার।

সিংহীরাণী সম্মুখে লোভাতুর শিকার দেখে খুশি হয়েছে বলে মনে হলো। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আবার গর্জন করে উঠলো। এবার সে আক্রমণ করে বসবে বনহুরকে। বনহুর বিলম্ব না করে সিংহীকে লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লো। মাত্র একটি গুলী–সিংহীর মাথাটা ফুটো করে গুলীটা বেরিয়ে গেলো ঘাড়ের পাশ দিয়ে। একটু নড়তে পারলো না, মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো তার বাচ্চাগুলোর পাশে।

বনহুরের মায়া হলো, এতোগুলো বাচ্চাকে সে মা-হারা করলো। কিন্তু উপায় ছিলো না। আবার চললো সম্মুখ পানে।

তাদের তাবু ছেড়ে অনেক দূর চলে এসেছে বনহুর। এতোক্ষণ তাবুর সম্মুখের অগ্নিকুণ্ডটা তবু দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো। এখন তাও সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়েছে।

গভীর রাতে আফ্রিকার জঙ্গলে দস্যু বনহুর নির্ভীকচিত্তে অগ্রসর হচ্ছে। সুন্দর মুখমণ্ডলে কঠিন সংকল্পের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলিষ্ঠ হস্তদ্বয়ের মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে–যে কোন হিংস্র জন্তুকে সে এই মুহূর্তে কাবু করবে তাতে কোনো ভুল নেই।

কিন্তু এতো করে সন্ধান চালিয়েও বনহুর গরিলা এবং শ্যালনের সন্ধান পেলো না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলো সে তাবুতে ফিরে আসতে।

সমস্ত রাত্রিটা নানা রকম আলোচনায় কেটে গেলো। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে বনহুর দলবল নিয়ে বের হলো। শ্যালনের সন্ধান তাকে করতেই হবে। বনহুর জানে সত্যিকারের গরিলা মানুষ ভক্ষণ করে না, তারা মানুষকে হত্যা করে পিষে থেতলে মেরে ফেলে। আবার কতগুলো গরিলা আছে যারা মেয়েছেলে দেখলে পুতুল মনে করে খেলার জন্য হরণ করে নিয়ে যায়, হত্যা করে না। শ্যালনকেও গরিলা পুতুল মনে করে নিয়ে গিয়ে থাকবে। নিশ্চয়ই তাহলে তাকে হত্যা করবে না সে কিছুতেই।

প্রত্যেকের হস্তেই গুলী ভরা রাইফেল। কারো কারো হস্তে রিভলভার বা পিস্তল। বনহুর রিভলভার এবং ছোরা সঙ্গে নিয়েছে।

গত রাতে যে পথে বনহুর গরিলার সন্ধানে অগ্রসর হয়েছিলো আজও তারা সে পথ ধরে অগ্রসর হলো। বেশ কিছুদূর এগুনোর পর সবাই অবাক হয়ে দেখলো–একটি মৃত সিংহীর পাশে কতগুলো সিংহ শাবক ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বা মায়ের বুকের দুগ্ধের সন্ধান করছে, কেউ বা দেহের উপর চড়ে মায়ের নিদ্রা ভঙ্গের চেষ্টা করছে।

বনহুর বললো স্যার, কাল রাতে বাধ্য হয়ে আমি ঐ বাচ্চাগুলোকে মা-হারা করেছি। চলুন, এখানে বিলম্ব করা উচিৎ হবেনা।

সবাই আবার চলতে শুরু করলো।

সে কি গহন বন!

প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য তারা প্রস্তুত হয়ে নিলো। কারণ চারদিকে ক্রুদ্ধ হিংস্র জন্তু যে কোনো সময়ে লাফিয়ে পড়তে পারে তাদের ঘাড়ে।

প্রফেসার ম্যাকমারার মুখে এতোদিন যে জানার উন্মাদনা পরিলক্ষিত হতো, আজ তা সমূলে অন্তর্ধান হয়েছে। কন্যার এই বিপদে ভদ্রলোক একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। মুখখানা তার কালো হয়ে গেছে অমাবস্যার অন্ধকারের মত। একটি কথাও তার কণ্ঠ দিয়ে বের হচ্ছেনা। তিনি কাষ্ঠ-পুত্তলিকার মত দলবলকে অনুসরণ করছেন মাত্র।

বহুদূর অগ্রসর হয়েও গরিলা বা শ্যালনের সন্ধান পাওয়া গেলোনা। বেলা গড়িয়ে আসছে, ক্ষুধায় সকলের পেটে আগুন ধরে গেছে। তাবু থেকে কিছু পাউরুটী আর মাখন ওরা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো, চলতে চলতে কেউ খেয়ে নিচ্ছিলো তারই দু’একটা।

বনহুরের ক্ষুধা তৃষ্ণা যেন উবে গিয়েছিলো, তার মনে সদা উদয় হচ্ছে গরিলা আর শ্যালন।

বড় পিপাসা বোধ করায় বনহুর ফ্লাক্স থেকে পানি ঢেলে পান করে নিলো, এবার অনেকটা শান্তি পেলো সে। ক্ষুধা সহ্য করা বনহুরের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো, কারণ সে দস্যু–তাকে সব সময় নানা ভাবে কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, খাবার সময় তার কোথায়।

সিদ্ধ জিনিসের চেয়ে ফলমূল ছিলো বনহুরের প্রিয় খাদ্য। তার আস্তানায় বনহুরের জন্য সব রকম ফল সংগ্রহ করে রাখা হতো। দেশ-বিদেশ থেকে ফল আসতো। সর্দারের খাদ্যের ফল সংগ্রহের জন্যই দূর দূর দেশে তার অনুচর ছিলো, এরা সব সময় বিদেশ থেকে ফল আমদানি করতো।

বনহুর আফ্রিকার জঙ্গলের ফল খেয়ে তৃপ্তি লাভ করতো। ক্ষুধা পেলেই নানা রকম ফল পেড়ে খেতো সে। ছোট বেলা হতে এটা ছিলো বনহুরের অভ্যাস।

আজ বনহুর ফল ভক্ষণের নেশাও ত্যাগ করেছে।

ফ্লাক্স থেকে পানি পান করে ফিরে দাঁড়াতেই বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো একটা গাছের পাশে, একখানা লেডিস্ সু’পড়ে আছে। বনহুর দ্রুত গিয়ে লেডিস্ সুখানা হাতে তুলে নিলো।

ততক্ষণে দলবল সবাই এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে।

ম্যাকমারা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো–এ যেন আমার শ্যালনের জুতা। হায়! হায়! মাকে আমার হত্যা করে ফেলেছে গরিলাটা–

বনহুর সান্ত্বনা বাক্যে বললো-স্যার, আপনি বিচলিত হবেন না। শ্যালন নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। আপনি বরং কয়েকজনকে নিয়ে তাবুতে ফিরে যান। আমি এদের নিয়ে আপনার শ্যালনের সন্ধান করে দেখছি।

অন্যান্য সবাই বনহুরের কথায় সায় দিলো, কয়েকজন রাজি হলো বনহুরের সঙ্গে শ্যালনের সন্ধানে যেতে।

অগত্যা প্রফেসার ম্যাকমারা কয়েকজনকে নিয়ে ফিরে চললেন তাবুতে।

বনহুর অগ্রসর হলো সামনের দিকে।

 বনহুর মাত্র পাঁচজন বলিষ্ঠ ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছিলো তাকে সাহায্যের জন্য।

বেলা যখন শেষ প্রহর তখন বনহুর সঙ্গীদের নিয়ে উপস্থিত হলো এক পাহাড়ের মত উঁচু ঢিবির পাশে। সেই স্থানটা আরও ঘন বনে আচ্ছাদিত। বিরাট বিরাট শাল আর সেগুন গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরও কত রকম অজানা গাছের সমারোহ।

উঁচু পাহাড়ের মত ঢিবিটার আশে পাশে বহু জলাভূমি নজরে পড়লো। হঠাৎ বনহুর চমকে উঠলো–জলাভূমির নিকটে ভিজে মাটিতে কয়েকটি পায়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে, সেই ভয়ঙ্কর গরিলা মহারাজের পদচিহ্ন বলেই মনে হলো–তবে অন্য কোনো গরিলাও হতে পারে। তবু বনহুরের হৃদয়ে। একটা আশার আলো উঁকি দিয়ে গেলো।

বনহুর তার পঞ্চসাথীকে লক্ষ্য করে বললো–এ পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমরা অগ্রসর হবো।

বিলম্ব না করে ওরা উঁচু ঢিবি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। বিরাট পদচিহ্ন ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। বনহুরের সঙ্গীগণ কিছুটা ভীত আশঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে মনে হলো।

বনহুর তাদের পিঠ চাপড়ে সাহস দিলে বললো–ভয় কি মৃত্যু যখন একদিন হবেই, তখন না। হয় দু’দিন আগেই মরলেন। ঘরে রোগে ধুকে মরার চেয়ে বীরের মত মরবেন।

বনহুরের কথা শুনে আবার তাদের সাহস হলো, নব উদ্যমে পাহাড়টার গা বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। প্রত্যেকের হস্তেই গুলী ভরা রাইফেল। বনহুরের হস্তে রিভলভার পিঠে বাঁধা আছে রাইফেল। কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরা। সম্পূর্ণ কালো ড্রেস তার শরীরে।

বেশ কিছুটা উপরে উঠার পর তারা লক্ষ্য করলো–পদচিহ্ন বামদিকে বাঁকা হয়ে চলে গেছে। ওদিকে জঙ্গলটা বেশ ফাঁকা বলে মনে হলো। কিন্তু অল্প কিছুটা এগুনোর পর সম্মুখে দেখা গেলো প্রকাণ্ড একটা সুড়ঙ্গ মুখ। সুড়ঙ্গ মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, কারণ সুড়ঙ্গ মুখে অনেকগুলো ডালপালা স্তূপাকার করে রাখা হয়েছে। কিন্তু বনহুর পদচিহ্ন লক্ষ্য করে এগুতে লাগলো, তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে একটা আনন্দদ্যুতি। নিশ্চয়ই এ গুহাটা সেই গরিলা মহারাজের। এখানেই হয়তো পাওয়া যাবে শ্যালনকে।

বনহুর ও তার দল বল গুহাটার নিকটে এসে উপস্থিত হলো। গুহার মুখে এমন ভাবে আগাছা আর ডালপালা রাখা হয়েছে, গুহার মধ্যে প্রবেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়।

বনহুরের সঙ্গীগণ ভয় পেয়ে গেছে বলে মনে হলো, ওরা আর এগুতে রাজি নয়। বনহুর অগত্যা। নিজেই ডালপালা সরাতে শুরু করলো।

অন্যান্য সকলে তাকে সাহায্য করলো বটে, কিন্তু কেউ সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করতে সাহসী হলোনা। অনেক চেষ্টায় খানিকটা ফাঁকা করে নিয়ে সেই পথে বনহুর সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করলো।

বনহুরের সঙ্গীগণ এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো, সকলেরই মুখ ভয়ে বিবর্ণ হলো। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, সুড়ঙ্গ মধ্যে কি বিপদ যে ওৎপেতে বসে আছে কে জানে।

সুড়ঙ্গ মুখটা ছিলো বিরাট, অনায়াসে একটি হস্তী এ সুড়ঙ্গে প্রবেশে সক্ষম হবে। বনহুর সঙ্গে একটি টর্চ এনেছিলো, সে টর্চটি এ মুহূর্তে তার কাজে এলো। সুড়ঙ্গ মধ্যে ঘন অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠেছিলো। বনহুর টর্চের আলো ফেলে অগ্রসর হলো। সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করে মাটিতে টর্চের আলো ফেলতেই আশ্চর্য হলো সে, মাটিতে এখন কোনো পদচিহ্ন নেই শুধু গোলাকার গর্তের মত দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে রয়েছে। ভাল করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলো বনহুর, গোলাকার দাগগুলো অন্য কিছু নয়–গরিলাটি এ সুড়ঙ্গ মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রবেশ করতে পারে না, তাই সে হামাগুড়ি দিয়ে এর মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। গরিলার হাটুর দাগ ব্যস হস্তীপদ চিহ্নের আকার ধারণ করেছে।

বনহুর বুঝতে পারলো– গরিলা মহারাজ হামাগুড়ি দিয়ে এ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে থাকে। এ সুড়ঙ্গটাই তার বাসস্থান। অল্প কিছুটা অগ্রসর হতেই বনহুরের কানে একটা করুণ কান্নার শব্দ এসে পৌঁছলো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনলে মানুষের কণ্ঠ বলেই মনে হলো তার–তবে কি শ্যালনের কণ্ঠ? নিশ্চয়ই তাই হবে, না হলে এই নির্জন পাহাড়িয়া অঞ্চলে মানুষ আসবে কোথা হতে।

বনহুর শব্দ লক্ষ্য করে দ্রুত অগ্রসর হলো।

কিন্তু বেশিদূর তাকে এগুতে হলোনা, অন্ধকারে গুটিশুটি মেরে সাদা মত কিছু নজরে পড়লো। টর্চের আলো ফেলতেই বনহুরের মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হলো।

শ্যালনও আলো দেখে চোখ তুলে তাকালো, বনহুরকে দেখে প্রথমে চমকে উঠলো–তারপর ছুটে এসে জাপটে ধরলো–আলম, তুমি এসেছো–আলম–আলম–

বনহুরকে আঁকড়ে ধরে শ্যালন থর থর করে কাঁপছে।

বনহুর শ্যালনকে বাম হস্তে কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠে–ভয় নেই শ্যালন! চলো, শীঘ্র এখান থেকে পালাতে হবে।

আলম, গরিলাটা আবার এসে পড়বে না তো?

জানিনে, তবে তুমি শীঘ্র চলো।

বনহুর শ্যালনকে নিয়ে দ্রুত সুড়ঙ্গ মধ্য হতে বেরিয়ে আসতে লাগলো। সম্পূর্ণ দুটো দিন অনাহারে কাটানোর পর শ্যালন বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিলো, বনহুর ওকে বলিষ্ঠ হাতে ধরে রাখলো শক্ত করে।

সুড়ঙ্গ মুখে বেরিয়ে আসতেই একটা হুঙ্কার বনহুর আর শ্যালনের কানে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে দিলো।

শ্যালন বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো, পরক্ষণেই বনহুরের হাতের উপর ঢলে পড়লো।

গরিলা মহারাজ তখন একেবারে প্রায় এসে পড়েছে। বনহুর এ মুহূর্তে কি করবে ভেবে পায়না, সংজ্ঞাহীন শ্যালনের দেহটা হাতের উপর তুলে নিয়ে দ্রুত সরে দাঁড়ালো পাশের একটা ফাটলের মধ্যে।

গরিলার হুঙ্কার তখন আরও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে, তীব্র আর্তনাদ শোনা গেলো সুড়ঙ্গ মুখের বাইরে থেকে। বোধ হয় প্রফেসার ম্যাকমারার কোনো ছাত্র গরিলা রাজের হস্তে প্রাণ বিসর্জন দিলো। বনহুরের এখন অন্য কথা চিন্তা করার সময় নেই। গরিলার হাত থেকে নিজে বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে শ্যালনকে।

বনহুর শ্যালনের দেহটা কাঁধে ফেলে দক্ষিণ হস্তে রিভলভার উদ্যত করে দাঁড়ালো। সমস্ত শরীর তার ঘেমে চুপসে উঠেছে। সুড়ঙ্গ মধ্যে একটা ভ্যাপসা গরম, তারপর শ্যালনের সংজ্ঞাহীন দেহটা তখন তার কাঁধে। বনহুর রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতিক্ষা করছে গরিলা মহারাজের।

এবার বনহুর লক্ষ্য করলো সুড়ঙ্গ মুখ থেকে ডালপালা সব সরিয়ে ফেলেছে গরিলাটা, ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে সব এদিক-সেদিকে। একরকম গর্জন শোনা যাচ্ছে, ঠিক যেন মেঘের ডাক।

বনহুর আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারে তাকে মোটেই দেখা যাচ্ছেনা।

গরিলা এবার প্রবেশ করলো সুড়ঙ্গ মধ্যে। একটা পাগলা হাতি যেন হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। নিশ্বাসটা যেন ঠিক ঝড়ের মত মনে হলো।

বনহুর রিভলভার ঠিক রেখে প্রতিক্ষা করতে লাগলো। শ্যালন কাঁধে না থাকলে সে নিজেকে এতোটা বিপন্ন মনে করতোনা। শ্যালনের জন্যই তার যত চিন্তা হচ্ছিলো।

গরিলার দেহটা সুড়ঙ্গ মধ্যে হস্তির দেহের মত গড়িয়ে গড়িয়ে এগুচ্ছে। একটা উৎকট ফোঁস ফোঁস শব্দ ক্রমান্বয়ে নিকটবর্তী হচ্ছে বনহুরের। ওটা গরিলা-রাজের নিশ্বাসের শব্দ বলেই মনে হলো তার।

সুড়ঙ্গ মধ্যে এতোক্ষণ তবু কিঞ্চিৎ আলোক রশ্মি প্রবেশে সক্ষম হচ্ছিলো, এবার গভীর অন্ধকার জমাট হয়ে এলো। বনহুর লক্ষ্য করলো তার সম্মুখে মেঘের মত একটা গাঢ় অন্ধকার থ’ মেরে দাঁড়িয়ে পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ভোটা গন্ধ। গরিলা-রাজের দেহের গন্ধ বেশ অনুভব করলো বনহুর। ফাটলের মধ্যে যতদূর সম্ভব নিজেকে গোপন করে দাঁড়িয়ে রইলো।

গরিলাটা আরও কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হলো, এবার বোধ হয় সে শ্যালনকে খুঁজে চলেছে, বাম হস্ত দিয়ে গরিলা হাতড়াচ্ছে সুড়ঙ্গ মধ্যে।

বনহুরের পাশ দিয়ে চলে গেলো বার কয়েক হাতখানা। বনহুর ফাটলের মধ্যে এমনভাবে আত্মগোপন করে রইলো যাতে একটুও দেখা না যায়। এখনও বনহুরের কাঁধে শ্যালনের অজ্ঞান দেহটা পূর্বের মতই ধরা রয়েছে।

গরিলা মহারাজ এবার হুঙ্কার ছাড়ে, সমস্ত সুড়ঙ্গ মধ্যে থরথর করে কেঁপে উঠে। বনহুর বুঝতে পারে–শ্যালনকে খুঁজে না পেয়ে সে এমন করছে। _ রুদ্ধ নিশ্বাসে বনহুর প্রতিক্ষা করছে, না জানি আজ তার এবং শ্যালনের জীবনে এই শেষ মুহূর্ত কিনা।

গরিলা বার বার হাতড়ে ফিরছে, অন্ধকারে সে দেখতে পাচ্ছেনা বটে, কিন্তু হাত দিয়ে সে অনুভব করে দেখছে মেয়েটিকে। সে যেখানে রেখে গেছে সেখানে আছে কিনা। ক্রমেই গরিলার রাগ চরমে উঠলো। পিছু হটে সে সুড়ঙ্গ মধ্য থেকে বেরিয়ে গেলো বাইরে।

বনহুর এবার হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

শ্যালনের সংজ্ঞাহীন দেহটা কাঁধের উপর থেকে নামিয়ে নিলো দু’হাতের উপর, তারপর শ্যালনকে কোলের উপর শুইয়ে দিয়ে বসে পড়লো।

বাইরে তখন গরিলা মহারাজ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে, সুড়ঙ্গ মুখের বাইরে যেন ভীষণ ভাবে ঝড় শুরু হয়েছে। গাছপালা ভেঙে পড়ার মড় মড় শব্দ, বড় বড় পাথর ছুঁড়ে ফেলার গুম্ গুম আওয়াজ আর তার সঙ্গে গরিলার কণ্ঠের গর্জন। দুর্বল হৃদয় মানুষ হলে এতোক্ষণ সে শ্যালনের মতই অজ্ঞান হয়ে পড়তো।

বনহুরের হৃদয় কঠিন, লোহার চেয়েও শক্ত তার মনসামান্যে ভীতু হবার বান্দা সে নয়। সে জানে, গরিলা মহারাজ আর ফিরে গুহামধ্যে আসবেনা। মনে পড়লো সঙ্গী-সাথীদের কথা প্রফেসর ম্যাকমারার অন্যান্য ছাত্রদের কথা। না জানি বেচারীদের অবস্থা কি হয়েছে। সুড়ঙ্গ মুখেই ওরা অপেক্ষা করছিলো–

হঠাৎ বনহুরের চিন্তাধারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শ্যালন নড়ে উঠে ধীর মৃদু কণ্ঠে বলে –কে–কে তুমি?

বনহুর শ্যালনের হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বলে–শ্যালন আমি। আমি আলম।

 শ্যালন বনহুরকে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে–গরিলাটা কোথায়?

ভয় নেই শ্যালন, গরিলা মহারাজ বাইরে চলে গেছে।

ও কিসের শব্দ? সুড়ঙ্গ মুখ থেকে তখন ভীষণ আওয়াজ আসছিলো। সে আওয়াজ শুনে শ্যালন কম্পিত কণ্ঠে কথাটা জিজ্ঞাসা করলো বনহুরকে।

বনহুর শ্যালনের হাতখানা দক্ষিণ হস্তে ধরে বললো–গরিলাটা সুড়ঙ্গ মধ্যে তোমাকে না পেয়ে ক্ষেপে গেছে।

তাহলে উপায়?

আর আসবেনা বলেই মনে হচ্ছে।

কিন্তু আমার বড় ভয় হচ্ছে, আবার যদি আসে–

ভয় করোনা শ্যালন, আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তোমার কোনো চিন্তা নেই। গরিলা তোমাকে স্পর্শ করতে পারবেনা।

আলম, তুমি আমার বন্ধু।

হাঁ শ্যালন, আমাকে বন্ধু বলেই মনে করো।

শ্যালন বনহুরের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো তার গণ্ডদ্বয়, আবেগ ভরা গলায় ডাকলো–আলম! বন্ধু!

বনহুরের শিরায় শিরায় জেগে উঠলো তার পৌরুষত্বভাব, কিন্তু সে নিজেকে পাষাণের মত সংযমী করে রাখলো। যদিও তার হৃদয়ে একটা উন্মত্ত উন্মাদনা ভীষণভাবে আলোড়ন জাগাচ্ছিলো তবু সে এতোটুকু বিচলিত হলোনা। ধীরস্থির গম্ভীর গলায় বললো–শ্যালন, এর বেশি তুমি আমার কাছে কিছু পাবে না।

বনহুরের কথাটা শ্যালন ঠিক বুঝলো কিনা সন্দেহ, তার মুখে ভাবের কোনো পরিবর্তন এলো কিনা তাও দেখা গেলোনা গাঢ় অন্ধকারে।

বাইরে তখন গরিলা মহারাজের প্রচণ্ড দাপট থেমে এসেছে। বোধ হয় গরিলাটা চলে গেছে তার ছোট্ট মেয়েটির সন্ধানে।

বনহুর বললো–শ্যালন, গরিলা মহারাজ বোধ হয় সরে গেছে। চলো এবার পালাই।

আমার কিন্তু বড় ভয় করছে। বাইরে বেরুলেই যদি আবার সে আমাকে ধরে ফেলে?

অবশ্য শ্যালনের কথাটা মিথ্যা নয়, আরও কিছুটা সময় তাদের অপেক্ষা করা উচিৎ এখানেই। যদিও বনহুরের কাছে এই মুহূর্তগুলো অত্যন্ত অপ্রতিভ মনে হচ্ছিলো তবু বাধ্য হলো সে কিছু সময় এই অন্ধকারে আত্মগোপন করতে।

*

বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পর বনহুর আর শ্যালন সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়ে এলো। সুড়ঙ্গমুখ এখন ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ঢাকা নেই। গরিলা সব ডালপালাগুলো ক্রুদ্ধ হয়ে দূরে নিক্ষেপ করেছে।

হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো অদূরে, বিস্ময়ভরা চোখে দেখলো–অদূরে একটা গাছের গুঁড়ি পাশে পড়ে আছে তাদেরই দলের একজন যুবক।

বনহুর শ্যালনকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বললো–শ্যালন দেখো।

 শ্যালন ওদিকে তাকিয়ে ছুটে গেলো–সর্বনাশ! আমাদের লোক!

বনহুরও ততক্ষণে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে যুবকের দেহটার পাশে। যুবকটার মাথা থেতলে চ্যাপটা হয়ে গেছে। মুখ দেখে চিনবার জো নেই। দেহের বহুস্থানে ক্ষত, তখনও তাজা রক্ত ঝরছে মৃতদেহটা থেকে।

শ্যালন দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো।

 বনহুর বললো–হতভাগ্য গরিলার হস্তে জীবন দিয়েছে।

শ্যালন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বনহুর বুঝতে পারলো–শ্যালনের কোমল মনে আঘাত লেগেছে। এ দৃশ্য সে সহ্য করতে পারছেনা। তাড়াতাড়ি শ্যালনকে নিয়ে সরে এলো বনহুর, অন্যান্য সঙ্গীদের অন্বেষণ করতে লাগলো।

বেশ কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করতেই পাঁচ জনের মধ্যে তিন জনকে আবিষ্কার করে ফেললো বনহুর। ভয়ে সবাই আড়ষ্ট হয়ে লুকিয়ে ছিলো ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে। একজনের মৃত্যু হয়েছে, আর একজনকে পাওয়াই গেলোনা। বনহুর শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন চার নম্বর ব্যক্তির সন্ধান পেলোনা তখন আর বিলম্ব করা উচিৎ মনে করলোনা। তিন জন সঙ্গীসহ শ্যালন আর বনহুর ফিরে চললো তাদের তাবুতে।

অতি সতর্ক এবং সাবধানে ওরা চলছে, না জানি আবার কোন দণ্ডে তাদের সম্মুখে কোনো বিপদ এসে পড়বে। কিংবা গরিলা মহারাজা এসে হামলা চালাবে। শ্যালন বনহুরের পাশে পাশে চলতে লাগলো।

প্রফেসার ম্যাকমারার ছাত্রদ্বয় এমনভাবে চলছে তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝা যাচ্ছেনা। ওদের মুখ কালো বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। দু’দজন সঙ্গীকে হারিয়ে মনের অবস্থা অত্যন্ত মর্মান্তিক।

পথে তেমন কোনো বিপদে আর পড়লোনা।

বেলা শেষে বনহুর ফিরে এলো শ্যালন ও সঙ্গীদ্বয়কে নিয়ে।

প্রফেসার ম্যাকমারা সেই ভোর হতে একটিবার আসন গ্রহণ করেন নি, সদা বিলাপ করে। চলেছেন। শ্যালন তার জীবনের চেয়েও বেশি আদরিণী। একমাত্র কন্যা শ্যালনকে হারিয়ে তিনি উন্মাদ প্রায় হয়ে পড়েছেন।

শ্যালনকে ফিরে পেয়ে প্রফেসার আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেলেন। কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে শপথ করলেন। আমার জীবনের এই শেষ আবিস্কার চেষ্টা। আর কোনোদিন আমি নতুন কোনো জীবের সন্ধানে গহন বনে প্রবেশ করবোনা।

তাবুর অন্যান্য সবাই মরিয়া হয়ে উঠেছে, আর একটি দিনও তারা আফ্রিকার জঙ্গলে কাটাতে রাজি নয়। প্রফেসার ম্যাকমারার সখও মিটে গেছে ভালভাবে। ম্যাকমারা আফ্রিকার জঙ্গল ত্যাগ করার বাসনা প্রকাশ করলেন।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, রাত্রিটা তাদের এখানেই কাটাতে হবে। কিন্তু ভয়–গরিলা তার ছোট্ট মেয়েটির সন্ধানে আবার তাবুতে হানা দিয়ে বসবে না তো?

প্রফেসার ম্যাকমারা বললেন কাল ভোরেই আমরা আফ্রিকা জঙ্গল ত্যাগ করে চলে যাবো। জঙ্গলের দক্ষিণ অঞ্চলে বাইরে সাগরবক্ষে ম্যাকমারার জাহাজ অপেক্ষা করছে।

কিন্তু আজ রাতটা কাটবে কি ভাবে কে জানে!

ম্যাকমারা কন্যাকে নিয়ে বেশি চিন্তায় পড়লেন। বনহুরকে তিনি কি ভাবে যে কৃতজ্ঞতা জানাবেন ভেবে পাচ্ছেন না। একবার নয় দু’বার মৃত্যুর মুখ থেকে শ্যালনকে রক্ষা করে এসেছে আলম।

ম্যাকমারা কন্যাকে ছেড়ে দিলেন আলমের হাতে; তিনি বললেন –আলম, আমার শ্যালন তো তোমার। ওকে রক্ষা করেছো তুমি। বার বার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছো। আজ রাতেও আমি শ্যালনকে তোমার জিম্মায় দিলাম। বাবা আলম, তুমিই ওকে যদি বাঁচাতে পারো।

বনহুর কোনো জবাব দিতে পারেনা।

 কিন্তু রাতের বেলায় বাধ্য হলো বনহুর শ্যালনকে নিজের বিছানায় আশ্রয় দিতে।

প্রফেসার ম্যাকমারা ভয়ানকভাবে ভয় পেয়ে গেছেন। দলের একটি নয়, দুটি নয়, তিন তিনজনকে হারিয়েছেন তিনি। নতুন আবিস্কারের স্বপ্ন তার অন্তর থেকে উধাও হয়েছে জন্মের মত। রাত ভোর না হওয়া পর্যন্ত তার সান্তনা হচ্ছেনা। অস্থির চিত্ত নিয়ে তিনি তাবুর মধ্যে পায়চারী করছেন।

অন্যান্য সকলে বসে বসে ঝিমুচ্ছে, সকলের মধ্যেই একটা ভীত আতঙ্কভাব ভাব ফুটে উঠেছে। কারো মুখে কোন কথা নেই, সমস্ত তাবুর মধ্যে বিরাজ করছে একটা নিস্তব্ধতা।

বনহুর তার বিছানার এক কোণে বসে আছে, পাশে পড়ে রয়েছে গুলীভরা রিভলভার। সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে শ্যালন। একরাশ সোনালী চুলের ফাঁকে শ্বেত পঙ্খীর মত শুভ্র সুন্দর একখানা মুখ।

বনহুরের দৃষ্টি এক সময় তার অজ্ঞাতেই চলে গেলো ঘুমন্ত শ্যালনের মুখে। চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারেনা সে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকে। সিগারেটটা দূরে নিক্ষেপ করে সে, তারপর দক্ষিণ হাতখানা রাখে শ্যালনের কোমল নরম চিবুকের উপর। চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে দেয় আঙুল দিয়ে।

আবার ফিরে তাকায় সে তাবুর একপাশে যেখানে ভীত দুর্বল ছাত্রগণ জড়োসড়ো হয়ে। গুমটোমেরে শুয়ে আছে। বড় অসহায় বলে মনে হয় ওদেরকে।

রাত গম্ভীর হতে গভীরতর হয়ে আসছে।

 তাবুর বাইরে নানা রকম জীব-জন্তুর কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসছিলো।

আজ কদিন প্রফেসার ম্যাকমারার চোখে ঘুম নেই। গত দুদিন তিনি সব সময় কন্যার জন্য কাঁদা কাটা করেছেন। আজ তিনি বড় ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছেন, তবু হুসিয়ারীর সঙ্গে পাহারা দিচ্ছেন। যাতে কোন ক্রমে তার কন্যা বিপদগ্রস্ত না হয়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাকমারা আর পারলেন না, নিদ্রা দেবী তার দু’চোখে এসে ভর করলেন। তিনি তাবুর সঙ্গে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ালেন, চোখ দুটো ধীরে ধীরে মুদে এলো।

সমস্ত তাবু জুড়ে একমাত্র জেগে রয়েছে বনহুর।

প্রফেসার ম্যাকমারা তাবুর সঙ্গে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলেন, কিন্তু কতক্ষণ এভাবে ঘুমাবেন এক সময় বসে পড়লেন মাটির মধ্যে এবং তাবুতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

বনহুর লক্ষ্য করলো ম্যাকমারা নিদ্রার কোলে হেলে পড়লেন। তাবুর অন্যান্য সবাই ঘুমাচ্ছে। তার পাশে ঘুমিয়ে রয়েছে মিস শ্যালন। বনহুর উঠে দাঁড়ালো দক্ষিণ হস্তে রিভলভারটা শক্ত করে ধরে পায়চারী করতে লাগলো। এক সঙ্গে সবাই ঘুমালে চলবে না, জেগে তাকে থাকতেই হবে। যদিও বনহুরের দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছিলো, তবুও সে সজাগ হয়ে পাহারা দিতে লাগলো।

বার বার হাই উঠছে, বনহুর শ্যালনের উদ্ধারের জন্য দুদিন যা পরিশ্রম করেছে তা অবর্ণনীয়। পা দু’খানা ক্লান্তি আর অবসাদে যেন নুয়ে পড়ছে।

বনহুর একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ শ্যালনের তীব্র চিৎকারে চমকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রফেসার ম্যাকমারা এবং অন্যান্য সবাই জেগে উঠলো।

বনহুর ফিরে তাকাতেই দেখলো বিরাট একখানা হাতের মুঠায় শ্যালনের দেহটা চোখের পলকে অদৃশ্য হলো।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে তাবু থেকে বেরিয়ে পড়লো, কিন্তু অন্ধকারে তখন অনেক দূরে চলে গেছে গরিলাটা শ্যালনকে নিয়ে।

হতাশ হয়ে বনহুর ফিরে এলো তাবুর মধ্যে।

ম্যাকমারা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন মাটি, ধুলো, বালির মধ্যে কণ্ঠ দিয়ে তার কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। অন্যান্য সবাই ভয়ে বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারো কিছু করবার উপায় নেই।

আজ বনহুর নিজেও হতবাক হয়ে পড়েছে। কি বলে সে সান্তনা দেবে প্রফেসার ও তার ছাত্র দলকে।

ম্যাকমারা বনহুরকে স্নেহ করতো বলে প্রথম প্রথম দলের সবাই বনহুরকে ঈর্ষা করতো, কিন্তু এখন সবাই তাকে সমীহ করে। বনহুরই যেন এখন ওদের ভরসা।

ভোর হলেই তারা রওয়ানা দেবে ভেবেছিলো কিন্তু হলোনা, সব পণ্ড হয়ে গেলো। প্রফেসার ম্যাকমারা আর দাঁড়াতে পারলেন না। তিনি মাটির মধ্যে পড়ে গড়া গড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

কিছু সময় কেটে গেলো, কারো চোখে ঘুম নেই।

হঠাৎ একটা খক্‌ খক্ শব্দে সবাই আবার সচকিত হয়ে উঠলো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অস্ত্র বাগিয়ে ধরলো।

শব্দটা ঠিক কোন লোক যেন খক্‌ খক্ করে কাশছে সে রকম বলে মনে হলো। অদ্ভুত এ শব্দ। বনহুর তাবুর বাইরে যাবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করতেই প্রফেসার ম্যাকারা তাকে জাপটে ধরলেন– যেওনা বাবা আলম, ওটা ভয়ঙ্কর জীব। আমি ঐ জীবের ছবি নিয়েছি, আর সে ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার পুত্র সমতুল্য একমাত্র তার হস্তে নিহত হয়েছে।

কথাটা শুনে বনহুরের আরও ইচ্ছা জাগলো জীবটাকে দেখার, কিন্তু কি উপায়ে দেখবে বা দেখতে পারবে।

বনহুর তাবুর একটি ফাঁকে চোখ রেখে তাকালো, যদিও বাইরে ঘন অন্ধকার তবুও বোঝা গেলো জীবটা অদ্ভুত দেখতে। বিরাট উঁচু বলে মনে হলো। মাথাটা কুমিড়ের মাথার মত লম্বাটে। সম্মুখে দুটো হাত আছে। পিছনের পা দু’খানার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে জীবটা। বোধ হয় তাবুর মধ্যে মানুষের গন্ধ পেয়েছে।

বনহুর তাবুর ফাঁকে জীবটাকে লক্ষ্য করে রিভলভার উদ্যত করে ধরলো।

ম্যাকমারা উঠি পড়ি করে চেপে ধরলেন বনহুরের হাতখানা, চাপা কণ্ঠে বললেন–সর্বনাশ করোনা আলম।

বনহুর বললো–কেনো?

ও জীব অতি সাংঘাতিক, রিভলভারের গুলী ওর শক্ত চামড়া ভেদ করতে পারবেনা। বরং ক্রদ্ধ হয়ে আমাদের তাবু ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। প্রফেসার ম্যাকমারা তাবুর মধ্যের সমস্ত আলো নিভিয়ে ফেলার জন্য নির্দেশ দিলেন।

কয়েক জন মিলে চট পটু তাবুর মধ্যের মশালগুলো বালি চাপা দিয়ে নিভিয়ে ফেললো।

জীবটা তখনও অদ্ভুত কাশির মত শব্দ করে চলেছে।

এবার আলোগুলো নিভে যেতে জীবটা যেন একটু ভড়কে গিয়েছে বলে মনে হলো।

প্রফেসার ম্যাকমারা বললেন–ঐ জীবটা অন্ধকারে একেবারে চোখে দেখেনা। দিনের বেলা আলো ছাড়া ও বাইরে বের হয়না।

বনহুর বললো–ভুল করে হয়তো বাইরে এসে পড়েছে। কিন্তু অতো বড় একটা জীব থাকে কোথায়?

প্রফেসার ম্যাকমারা জবাব দিলেন–মাটির নিচে বিরাট গর্ত তৈরি করে ঐ সব জীব বাস করে।

জীবটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে বলে মনে হলো, কতকটা আশ্বস্ত হলো তাবুর সবাই।

এক সময় ভোর হলো।

তাবুর বাইরে বেরিয়ে আসতেই বনহুর লক্ষ্য করলো তাবুর আশে পাশে ভিজে মাটিতে অদ্ভুত এক ধরনের পায়ের ছাপ। গরিলার পদচিহ্নের কাছাকাছি এলোমেলো ভাবে ফুটে রয়েছে। বনহুর আশ্চর্য হলো, এমন পদচিহ্ন সে কোনোদিন দেখেনি।

কিন্তু এখন তাদের যে অবস্থা তাতে তার চিন্তা করার বা কিছু ভাববার সময় নেই। বনহুর আজ দলবল নিয়ে অগ্রসর হলো না, সে একাই রওয়ানা দিলো।

প্রফেসার ম্যাকমারা হতাশভাবে চেয়ে রইলেন, অন্যান্য সকলে আজ কেউ সাহসী হলোনা বনহুরের সঙ্গে গমন করতে।

সবাই ভীত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, আর এক মুহূর্ত কেউ থাকতে রাজি নয়। বনহুর বললো– আমি ফিরে না আসা অবধি আপনারা তাঁবুতে অপেক্ষা করুন।

তাঁবুর খাদ্যও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো, যা কিছু অবশিষ্ট ছিলো তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পাউরুটি, শুকনো মাংস, প্যাটিজ সবগুলোরই প্রায় এক অবস্থা। একে বন্য হিংস্র জন্তুর ভয়, অন্যদিকে খাদ্যদ্রব্য সব অখাদ্য হয়ে উঠেছে। ছাত্রগণ ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এমন সময় বনহুর আবার বেরিয়ে পড়লো মিস শ্যালনের উদ্দেশ্যে।

বনহুর গতকাল যে পথে অগ্রসর হয়েছিলো আজও ঠিক সে পথেই অগ্রসর হলো, যদিও সে বুঝতে পেরেছে আজ শ্যালনকে নিয়ে গরিলা আগের দিনের সেই গুহায় যায়নি। অবশ্য বনহুরের সন্দেহ গরিলা পূর্বের দিনের সাবধানতার চেয়ে আজ অন্যভাবে সে সতর্ক হয়েছে। কিন্তু বনহুর গরিলার চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত। গরিলার জন্ম জঙ্গলে, আর বনহুরও মানুষ হয়েছে জঙ্গলে। জঙ্গল দেখলেই বনহুরের মনে আনন্দ হয় বেশি। হিংস্র জীব-জন্তু বনহুরের যেন সহচর। ভয়ের চেয়ে ওদের বেশি ভালবাসে সে, মনে হয় ওরাই যেন তার আপন জন।

আবার ওদের সঙ্গেই হয় তার লড়াই, এতে বনহুর দুঃখের চেয়ে বেশি তৃপ্তিবোধ করে, বড় বড় হিংস্র ব্যাঘ্র বা সিংহের সঙ্গে লড়াই করার পর যখন সে তাদের পরাজিত করে ঘর্মাক্ত কলেবরে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তখন সে রাজ্য জয়ের মত আনন্দ উপভোগ করে।

অদ্ভুত চরিত্র বনহুরের। সে মানুষের মত মানুষ–পুরুষের মত পুরুষ।

বনহুর শপথ গ্রহণ করেছে শ্যালনকে সে উদ্ধার করবেই করবে। বন জঙ্গল ভেদ করে সে অগ্রসর হচ্ছে। চারদিকে তার নিপুণ দৃষ্টি। বাম হস্তে টর্চ ও দক্ষিণ হস্তে রিভলভার, কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ্ণ ধারাল ছোরা।

দেহে মজবুত শিকারীর ড্রেস, পায়ে বুট, মাথায় ক্যাপ; মাঝে মাঝে প্যান্টের পকেট থেকে দূরবীণ বের করে চোখে লাগিয়ে দেখছিলো সে।

তাদের তাবু ছেড়ে বেশ অনেক দূরে চলে এসেছে বনহুর।

একটা উঁচু মত জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখে দূরবীণ লাগিয়ে দূরে লক্ষ্য করছিলো, হঠাৎ তার পিছনে বিরাট কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলো, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে দাঁড়ালো বনহুর, কিন্তু ফিরে দাঁড়িয়েই সে অবাক হলো। বিরাট একটা অজগর তার দেহটা সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে ধরেছে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই একটা অজগর বনহুরের পিছন থেকে তাকে আক্রমণ করে ফেলেছে। টিলাটার পাশেই জঙ্গলে ছিলো সে, বনহুর একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো সে সুযোগে সর্পরাজ সুযোগ করে নিয়েছেন।

অজগর বনহুরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যে একটু নড়তে পারছে না। বনহুরের হাত দুখানাও সর্পরাজের দেহের আবেষ্টনীতে আটকা পড়ে গেছে।

অল্পক্ষণেই বনহুর পড়ে গেলো মাটিতে।

অজগর আর বনহুরের মধ্যে চললো ভীষণ ধস্তাধস্তি। বনহুর তার দক্ষিণ হাতখানা বের করে নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু অজগরটা পূর্বের সেই অজগরের চেয়ে দ্বিগুণ আকার : হবে। তার দেহেও ছিলো অসীম বল। বনহুর যেন আর পেরে উঠছিলো না।

ঠিক সেই মুহূর্তে অদ্ভুত একটা আওয়াজ তার কানে এলো। যেন ডিজেল ইঞ্জিনের হুস হুস শব্দের মতই মনে হলো। বনহুর আর সর্পরাজ তখনও সমানে লড়াই করে চলেছে। বনহুরের ইচ্ছা থাকলেও দেখবার উপায় নেই, যুদ্ধ করছে বটে কিন্তু কান তো আর বন্ধ নেই। বনহুর শুনতে পাচ্ছে শব্দটা ক্রমান্বয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে, সে কি ভীষণ শব্দ! সত্যিই কি তবে কোনো ডিজেল ইঞ্জিন পথ ভুল করে আফ্রিকার জঙ্গলে প্রবেশ করেছে।

শব্দটা অতি নিকটে মনে হলো। বনহুরের কানে যেন তালা লেগে আসছে। সে কি ভীষণ আওয়াজ।

আচমকা একটা অনুভূতি অনুভব করলো বনহুর, সর্পরাজের নাগপাশ থেকে সে মুহূর্তে মুক্তিলাভ করলো। সর্পরাজ ট্রেনের হুইসেলের মত একটা তীব্র আওয়াজ করে ফিরে দাঁড়ালো।

বনহুর তখন ভীষণ হাঁপিয়ে পড়েছে, সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার নির্ভীক প্রাণ শিউরে উঠলো। অদ্ভুত একটা জীব তার বিরাট দেহ নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসছে। জীবটার পা বলতে কিছু নেই, হাতও নেই, দেহটা একটা মস্তবড় শাল বৃক্ষের গুঁড়ির মত গোলাকার লম্বায় প্রায় দু’শো হাতের বেশি হবে। মুখ বা মাথাটা একটা জালা বা ড্রামের মত; দু’পাশে দুটো সাদা ধপধপে সূতীক্ষ্ণ দাঁত বেরিয়ে আছে, আগুনের গোলার মত দুটো চোখ, মাথাটা চ্যাপটা ড্রামের তলার মত সেকি অদ্ভুত জীব, নাকের দুটো ছিদ্রি যেন দুটো উনুনের গর্ত। সেই বিরাট চোঙ্গের মত ছিদ্র দিয়ে ডিজেল ইঞ্জিনের মত শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গরম হাওয়া বের হচ্ছিলো।

সর্পরাজ বনহুরকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পালাতে গেলো, কিন্তু অদ্ভুত জীবটা সর্পরাজের পিছন দিকটা তার জালার মত মুখে চেপে ধরলো।

বনহুর কিছুদূর দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে, সে আশ্চর্য হলো অদ্ভুত জীবটার কার্য কলাপ দেখে। সর্পরাজের

লেজটা চেপে ধরার সঙ্গে সঙ্গে সাপটা আর একচুলও এগুতে পারলোনা, ছটফট করতে লাগলো। সাপটা। বনহুর বুঝতে পারলো–সর্পরাজের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি রাখে জীবটা তার দেহে। আরও অবাক হলো বনহুর জীবটা ক্রমান্বয়ে সর্পরাজকে মুখের মধ্যে টেনে নিচ্ছে।

সর্পরাজ জীবন রক্ষার জন্য ভীষণভাবে ছটফট করতে লাগলো। জীবটার নিশ্বাসে বনহুরের মনে হলো আশে পাশে ভীষণ ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে কানফাটা ডিজেলের শব্দ।

বনহুর হতবুদ্ধির মত এই অদ্ভুত জীব দুটির কার্য লক্ষ্য করতে লাগলো। একটু পূর্বে যে সর্পরাজ তাকে গ্রাস করার জন্য কি সংগ্রামই না শুরু করে ছিলো, এখন তাকেই গ্রাস করতে চলেছে আফ্রিকার জঙ্গলের এক অজানা ভয়ঙ্কর জীব।

বনহুরের হৃদপিণ্ড ধক ধক করছে, সে দুর্দান্ত হতে পারে কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর সাংঘাতিক জীব সে কোনোদিন দেখেনি। একটা ঘন ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বনহুর দেখছে শেষ পর্যন্ত সর্পরাজের ভাগ্যে কি হয়।

বিস্ময়ের ধাপ আরও চরমে উঠলো বনহুরের, যখন সে নিজের চোখে দেখলো সর্পরাজের সমস্ত দেহটা অদ্ভুত জীবটার উদর মধ্যে প্রবেশ করেছে। সেকি ভীষণ মুখ গহ্বর! সর্পরাজের দেহটা যেন কোথায় উড়ে গেলো।

জীবটা এবার একটু ঝাঁকুনি দিয়ে নড়ে উঠলো, বোধ হয় সর্পরাজের বিরাট দেহটাকে তার উদর মধ্যে গুছিয়ে গোলা করে নিলো।

বনহুরের দুচোখে রাজ্যের বিস্ময়, জীবটা আবার গড়াতে গড়াতে চলে গেলো গহন বনের মধ্যে। জীবটার নাসিকার ডিজেল ইঞ্জিন ধরনের শব্দ সমস্ত বনভূমিকে কম্পিত করে তুলেছে।

জীবটা অদৃশ্য হতেই বনহুর ঝোপের মধ্যে হতে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাঁফ ছেড়ে যেন নিশ্বাস নিলো। অদ্ভুত জীবটাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলো সে।

বনহুর হাতঘড়িটা দেখে নিলো, সর্পরাজের কবল থেকে নিজেকে সে আজ উদ্ধার করতে পারতো কিনা সন্দেহ। এসবে তার প্রায় তিন ঘন্টা কেটে গেছে, বনহুর আবার দক্ষিণ হস্তে রিভলভার চেপে ধরে অগ্রসর হলো।

*

সন্ন্যাসী বাবাজী ওর পিঠে হাত রেখে শান্ত কণ্ঠে বললো–মা, আজও তুই তোর পরিচয় আমাকে জানালিনা? জানিনা কে তুই, কোথায় তোর ঘর–

বাবাজী, তুমি আমাকে মা বলে ডাকো–এই তো আমার পরিচয়। তোমার মত পুত্রের মা হবার সৌভাগ্য কি আমি আমার তুচ্ছ নামের আড়ালে ঢাকা ফেলতে পারি।

বেশ তুই যা ভাল মনে করিস তাই হবে। তবে জানিস মা আমার মত বুড়ো ছেলের মা হয়ে চিরদিন কাটাতে পারবিনা।

কেন, কেন বাবাজী?

এই কচি নতুন বয়স, বুড়ো ছেলের মা হয়ে নষ্ট করে দিবি?

বাবাজী, তুমি তো জানো–আমি বয়সে কচি হলেও মন আমার কচি নয়। এ বয়সে আমার জীবনে এসেছে কত পরিবর্তন, কত ব্যবধান। আমি নামে মাত্র বেঁচে আছি, জীবনে আমি মৃত।

মা!

বলো, আমায় মা বলে ডাকো বাবাজী।

মা, আর তোকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে মনঃকষ্ট দেবোনা। বেশ, তুই তোর বুড়ো ছেলের মা হয়েই থাক। চলে গেলো সন্ন্যাসী বাবাজী।

যুবতী হঠাৎ আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দু’চোখে নেমে এলো অশ্রুর বন্যা।

এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ালো আশ্রমের এক যুবক, নাম ওর কেশব। কেশব ডাকালো-ফুল!

চোখ তুলে তাকালো যুবতী–কেশব ভাই!

 ফুল, কান্নাই কি তোমার সাথী?

 হাঁ, কেশব ভাই।

 অতো কাঁদলে তুমি বাঁচবে কি করে ফুল?

 কাঁদতে পাই বলেই বেঁচে আছি আজও।

 ফুল, বাবাজী তোমাকে কি বললেন?

আমার পরিচয় তিনি জানতে চান।

হাঁ, তোমার পরিচয় শুধু তিনি নন, আমরাও জানার জন্য সর্বক্ষণ উৎসুক হয়ে রয়েছি। কিন্তু জানি নে, তোমার পরিচয় কেন তুমি গোপন রাখো?

আমার কোনো পরিচয় নেই। আর যে পরিচয় আছে তা বলে আমি নিজকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না।

ফুল, সব সময় তুমি শুধু হেঁয়ালী ভরা কথা বলো। তোমার কথা কিছুই আমরা বুঝতে পারি নে। কে তুমি, কোথায় তোমার ঘর, কি তোমার পরিচয়?

কেশব ভাই!

না, আমি তোমার কেশব ভাই নই। ফুল, আমাকে তুমি শুধু কেশব বলে ডাকবে।

আশ্চর্য হয়ে তাকায় ফুল কেশবের মুখে।

কেশব বলে চলে–ফুল, আমি তোমাকে ভালবাসি—

 কিন্তু জানো না আমাতে তোমাতে কত প্রভেদ।

আমি জানতে চাইনে কোন কথা। ফুল, আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে আমি বিয়ে করবো!

তা হবার নয়।

 আমিই তোমাকে খুঁজে পেয়েছি, আমিই তোমার জীবন রক্ষা করেছি

তবুও সম্ভব নয়।

ফুল!

 হাঁ।

কিন্তু কতদিন তুমি আমার কাছ থেকে সরে থাকতে পারবে?

যতদিন তোমার মন সচ্ছ না হবে।

 ফুল!

 জানি তুমি কি চাও কেশব ভাই।

আবার তুমি আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করছো?

তুমি আমার জীবন রক্ষা করে আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছে, কাজেই তোমাকে আমি কোনোদিন অশ্রদ্ধা করতে পারবোনা।

তাই বুঝি?

হাঁ, আমার অন্তরের শ্রদ্ধা দিয়ে তোমাকে ভাই-এর আসনে প্রতিষ্ঠা করেছি। কেশব ভাই, তুমি—

 ভাই-ভাই-ভাই–ও শব্দ আমি শুনতে পারিনে। আমাকে তুমি কিছু বলে ডেকোনা।

তুমিও আমাকে ফুল বলে আর ডেকোনা। যদি ডাকো বোন বলে ডেকো। ফুল আমার নাম নয়।

ফুলের মত তুমি সুন্দর, তাই আমি তোমাকে ফুল বলে সম্বোধন করেছিলাম, কিন্তু—

কিন্তু কি? কি বলতে চাও তুমি?

কিন্তু সে নামের মর্যাদা তুমি রাখলেনা।

আমি ফুল নই, কাজেই ফুলের মর্যাদা আমি চাইনে।

এমন সময় সন্ন্যাসী বাবাজীর আবির্ভাব হয়, ডাকে সে-মা।

 বাবাজী!

তোমাদের আবার কি হলো মা?

কেশব দ্রুত চলে যায়।

সন্ন্যাসী বাবাজী বলেন–আমার কাছে লুকোসনে মা। জানি কেশব তোকে ভালবেসে ফেলেছে, তাই সে–

বাবা!

 মা, সে যদি আজ তোকে না রক্ষা করতো তাহলে জীবনে বেঁচে থাকতে পারতিস্ নে।

বাবাজী–

জানি, সব জানি, কিন্তু কেশবকে তুই বিমুখ করতে পারিসূনে। সে পুরুষ–তুই নারী। মা, আমি তোর সন্তান, তবু বলছি, বলতে বাধ্য হচ্ছি তোদের উভয়েরই প্রয়োজন উভয়কে।

বাবাজী–বাবাজী।

জানি তোর লজ্জা, আমি সন্ন্যাসী আজীবন নারী জাতিকে আমি মায়ের আসনে স্থান দিয়ে এসেছি। তবু আমি বলছি, তোরা দু’জন দু’জনাকে বিয়ে করে সুখী হবি।

তা সম্ভব নয় বাবাজী। তা সম্ভব নয়—

কেন মা?

বাবাজী।

বসো মা, কথা আছে তোমার সঙ্গে।

 যুবতী বসলো সন্ন্যাসীর পাশে।

সন্ন্যাসী বাবাজী ইতোপূর্বে আসন গ্রহণ করেছিলেন, এবার তিনি বললেন–মা, আজ প্রায় বছরের বেশি হয়ে এলো তুই এসেছিস আমার আশ্রমে, কিন্তু আজও তুই মনের কথা আমাকে খুলে বলিস নি। আমিও তেমন করে জানতে চাইনি, কারণ যখনই তোকে তোর পরিচয় জানাতে বলেছি বা চেয়েছি। তখনই তোর চোখে-মুখে আমি দেখেছি এক গভীর বেদনার ছাপ তাই আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস আমার হয়নি। একটু থেমে পুনরায় বললেন সন্ন্যাসী জানিনে কে মা তুই? কোথা হতে এসেছিলি? কি করেই বা তোর এ অবস্থা হয়েছিলো?

বাবাজী আজ আমি সব তোমাকে খুলে বলবো, কিন্তু তারপর তুমি আমাকে আর এক তিল এখানে রাখবেনা।

ছিঃ মিছেমিছি ওসব চিন্তা করছিস কেন মা?

 বাবাজী, আমি বড় অসহায়!

তাইতো তোকে আমি আমার মায়ের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি।

তাহলে কেন তুমি বার বার ঐ কেশবের কথা বলো বাবাজী?

মা–এই কচি বয়স, সুন্দর ফুলের মত একটি জীবন এভাবে নষ্ট করে দিবি? তাছাড়া কেশব মন্দ ছেলে নয়। তার বংশ মর্যাদা, তার আত্ম-পরিচয়, তার সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারা, তার পৌরুষোচিত স্বভাব। সবই যে কোনো নারীর কামনার বস্তু। তাই আমি বলেছিলাম ওকে স্বামী বলে গ্রহণ করে তোরা সুখের সংসার বাঁধবি। জীবনে আমি যা পাইনি তা থেকে আমি কাউকে বঞ্চিত করতে চাইনে।

বাবাজী, তুমি যা বলছো আমি সব বুঝতে পেরেছি, কিন্তু তা হবার নয়।

একই কথা আর কতদিন শোনাবি মা?

যতদিন আমি নিজের মনকে শান্ত করতে না পারবো।

মা, আজ তোকে বলতেই হবে।

কি বলবো বাবাজী?

তোর পরিচয়।

আমিতো বলেছি আমার কোনো পরিচয় নেই।

তা হয়না; মানুষ হয়ে জন্মেছিস অথচ পরিচয় নেই–এ কখনও হতে পারে!

অতি অশোভনীয় আমার পরিচয়–

আমি তোর পিতৃস্থানীয়, আমার কাছে এতো সঙ্কোচ কেন মা? জানিস্ মা, এই নির্জন গহন বনে আমি কি করে এলাম?

না বাবা, আমি জানিনে।

 তবে আমার পরিচয়টা আগে শুনে রাখ।

 যুবতী অবাক হয়ে শুনতে থাকে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বাবাজীর কথাগুলো।

সন্ন্যাসী বাবাজী বলেন–মা, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে আমি আরাকান শহরের একজন নাগরিক ছিলাম। ধনকুবের শিবাজী রঘু নামে আমি শহরে পরিচিত ছিলাম। আমার কাজ ছিলো বাণিজ্য করা। দেশ-বিদেশ থেকে আমার মাল আসতো, আর নিজের দেশের মাল চালান দিতাম। আমি বিভিন্ন দেশে সওদাগর বা বণিক হিসেবে আমি লোকের কাছে পরিচিত হলেও আসলে সওদাগরি নামটা ছিলো আমার খোলস মাত্র; আসলে আমার ব্যবসা ছিলো পরের ধন লুটে নেয়া। জাহাজে আমার যে সব মাল দেশ-বিদেশে যেতো সেগুলো সত্যিকারের মাল থাকতো না আজে বাজে জিনিসে জাহাজ ভর্তি থাকতো। আর তার মধ্যে থাকতো আমার বিশ্বস্ত অনুচরগণ।

বাবা।

হাঁ মা, কিন্তু আজ আমি আর সেই তিরিশ বছর আগের শিবাজী রঘু নই– হাঁ কি বলছিলাম মা? হাঁ, জাহাজ ভর্তি আমার অনুচর থাকতো, তাদের সঙ্গে থাকতো মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্র। জল পথে আমার বাণিজ্য চলতো, কোনো যাত্রীবাহী জাহাজ দেখলেই আমার ইংগিতে আমার অনুচরগণ তৈরি হয়ে নিতো। তারপর সেই জাহাজটিকে আক্রমণ করে, যাত্রীদের করা হতো নির্মমভাবে হত্যা, আর তাদের মালপত্র সব লুটে নেয়া হতো। ঐ সব মালপত্র আমার খালি জাহাজ ভর্তি হয়ে উঠতো। তারপর ফিরে চলতাম স্বদেশে। লোকে জানতো–সওদাগরি করে ফিরে এলাম–

যুবতীর চোখে-মুখে বিস্ময়, একটি কথাও তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা। নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সে সন্ন্যাসী বাবাজীর মুখের দিকে।

সন্ন্যাসী বাবাজী বলে চলেন– একদিন একটা জাহাজ লুট করে নেবার সময় আমার অনুচরগণ একটি মহিলাকে হত্যা করে তার সন্তানটিকে কেড়ে নেয়, তারপর সে শিশুটিকে সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করে তামাসা দেখবে বলে প্রস্তুত হয়ে নেয়। আমি সে মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত হই, হৃদয়হীন পাষাণ হলেও এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারিনি। আমার অনুচরটির হাত থেকে শিশু সন্তানটিকে ছিনিয়ে নেই, শিশু আমাকে জড়িয়ে ধরে। মনে হয় সে আমর বুকে আশ্রয় পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। আমি তাকে হত্যা করতে পারিনে, নিয়ে আসি আমার আস্তানায়। পরে জানতে পারি, সে শিশুটি আরাকানের রাজবংশের ছেলে। কিন্তু আর তাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি, তার মাকে আমরা হত্যা করেছি কার কাছেই বা ফিরিয়ে দেবো। সে শিশুই আমার জীবনে আনে পরিবর্তন।

থামলেন সন্ন্যাসী বাবাজী, দু’চোখে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি বহুদিন আগের দৃশ্যগুলো স্মরণ করে চললেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন মা, বলতে যখন শুরু করেছি তখন সব। বলবো। শিশুটিকে পেয়ে ভুলে গেলাম আমি আমার পাপ-কার্য। আমার অনুচরগণ আমার মধ্যে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লো। আমি তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে আশংকিত হলাম। আমার ভয় হলো, শিশুটিকে ওরা হত্যা করে না বসে। দল থেকে সরে রইলাম, গোপনভাবে শিশুটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু দলের সমস্ত অনুচর আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করলো, তারা নতুন দলপতি বানিয়ে আমাকে পর্যন্ত নিহত করবার মতলব আটতে লাগলো।

যুবতীর মুখে কোনো কথা নেই, সে স্তব্ধ হয়ে শুনছে সন্ন্যাসী বাবাজীর কথাগুলো। অস্ফুট কণ্ঠে বললো সে–তারপর বাবাজী?

হাঁ মা, তারপর আমি শিশুটিকে বাঁচাবার জন্য উতলা হয়ে উঠলাম, তার সঙ্গে নিজেকেও বাঁচাতে হবে। আমি একা আর আমার বিদ্রোহী অনুচরগণ প্রায় একশতেরও বেশি। শুধু সংখ্যায় তারা বেশি বলে নয়, তাদের আচরণ অতি নৃশংস, দয়া-মায়া বলে তাদের প্রাণে কিছু ছিলো না। যে কোনো মুহূর্তে আমাকে ওরা হত্যা করতে পারে। শিশুটিকে বাঁচাতে চাই বলেই তাদের কাছে আমি এতোবড় দূর্বল। মনের সঙ্গে অনেক দ্বন্দ্ব করলাম, ভাবলাম কি হবে একটা শিশুর নাগপাশে বন্দী হয়ে। জীবনে। কোনোদিন কাউকে ভালবাসিনি–বাসতে পারিনি, অর্থের লালসা আমাকে উন্মাদ করে তুলেছিলো, অর্থই আমাকে দিয়ে ছিলো প্রাণ। তবু পারলামনা শিশুটির মায়ার কাছে আমি পরাজিত হলাম। অর্থ ঐশ্বর্য সব সরে গেলো, সব মোহ কেটে গেলো আমার শিশুটিকে বুকে পেয়ে। মা, বিয়ে আমি জীবনে করিনি। নারীকে আমি প্রথম জীবন থেকেই শ্রদ্ধা করতাম। মায়ের আসনে আমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম তাদের, তাই নারীকে ভালবেসেও আমি গ্রহণ করতে পারিনি। শিশুটিই আমার সব আশা পূর্ণ করেছিলো। ওর মধ্যেই আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার জীবনের সব পাওয়া। মায়ায় আকৃষ্ট হয়ে আমি ভুলে গেলাম আমার পাপ জীবন। আমি আমার পাপ কাজ উপার্জিত সব ঐশ্বর্য ত্যাগ করে একদিন নিরুদ্দেশ হলাম। আমার সঙ্গী শুধু সেই শিশু সন্তান আর মাত্র কিছু খাবার। মা, সেই হতে আমি এ গভীর জঙ্গলে পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করে রইলাম। গাছের ফল আমার ক্ষুধা নিবারণ করে, আর ঝরণার পানি আমার পিপাসা নিবারণ করে। সে শিশুই আমার জীবনে এনেছিলো পরিবর্তন। আমি সন্ন্যাস-ধর্ম গ্রহণ করে সেই হতে এই গভীর জঙ্গলে বাস করছি। আমার সঙ্গী-সাথী এবং আমার অনুচরগণ আমার সন্ধান করেও আর আমাকে খুঁজে পায়নি।

যুবতী বলে উঠলো –সেই শিশু এখন কোথায় বাবা?

তিরিশ বছর আগের সেই শিশু আজও কি শিশু আছে মা। সে এখন যুবক, তার আগের সে কচি রূপ এখন আর নেই, সে হয়েছে একজন বলিষ্ঠ সুন্দর সবলদেহী পুরুষ।

তবে কি?

হ্যাঁ, মা সেই শিশুই আমার আজকের এই কেশব।

বাবাজী, আপনি সত্যিই অপরূপ মানুষ। আপনার মহৎ হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে আমি ভাষা হারিয়ে। ফেলেছি–

মা, তাই আমি তোর কাছে একটা দাবি জানাই। আমার কেশবকে গ্রহণ করে ওকে সার্থক কর মা, ওকে সার্থক কর।

বাবা, জানো না, তা কিছুতেই সম্ভব নয়।

কেন, কেন তা সম্ভব নয়? আমার কেশব কোনো হীন বা নীচু ঘরের সন্তান নয়। আমার কেশব অমূল্য সম্পদ।

বাবা, আমি আপনার কেশবের যোগ্য নই।

কেন, কিসে তুই যোগ্য নস মা?

আমার পরিচয় যদি জানতে তাহলে আমাকে তুমি কিছুতেই একথা বলতে না।

মা, তুই মানুষ–এইতো তোর বড় পরিচয়। এর বেশি আমার জানতে হবে না। তাছাড়া কেশব তোকে চায়–মা, আমি যে কেশবের জন্য সব মেনে নিতে পারি।

বাবা, আমি মুসলমান, একথা জেনেও–

সন্ন্যাসী বাবাজীর চোখ দুটো ধক্ করে জ্বলে উঠলো, পর মুহূর্তে বললেন তিনি একথা তুমি এতোদিন বলোনি কেন?

হয়তো আপনি আমাকে—

ত্যাগ করবো এই ভয়ে, না?

হ্যাঁ, আমি যখন জানতে পারলাম আপনারা ব্রাহ্মণ জাতি তখন আমার ভয় হলো আমি মুসলমান কন্যা, আপনি ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী। মাথা গুজবার একটু স্থান তবু পেয়েছি তাও যদি হারিয়ে যায়, তাই–

তাই তুমি গোপন করে আসছো তোমার পরিচয়?

হা।

কিন্তু একথা জানো না সন্ন্যাসীদের কোনো বিশিষ্ট ধর্ম বলে কিছু নেই। তাদের কাছে সবাই সমান হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সব এক। তুমি মুসলমান বেশতো, তোমার ধর্ম তুমি মেনে চলবে, কেশব তার নিজের ধর্ম মেনে চলবে, তাতে কোনো দোষ নেই। আমি এখনই কেশবকে ডেকে তার মতামত জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি। এবার উচ্চ-কণ্ঠে ডাকলেন সন্ন্যাসী বাবাজী–কেশব–কেশব!

কক্ষে প্রবেশ করলো কেশব–বাবা!

কেশব তুমি বসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে।

বাবা, আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। আমার জীবন ইতিহাস থেকে ফুলের জাতি ধর্ম সব শুনেছি।

সন্ন্যাসী শব্দ করে উঠলেন –সব শুনেছো?

হ্যাঁ বাবা। আমি কে, কি আমার পরিচয়–তুমি আমার কে, সব শুনেছি। বাবা–আমি জানতাম তুমি আমার পিতা, কিন্তু তুমি আমার পিতা নও, তবু তুমি আমার রক্ষক পিতার চেয়েও বড় তুমি–

কেশব!

বাবা, এতোদিন তুমি আমার কাছে সব গোপন রেখে ভালই করেছো।

জানি নে ভাল করেছি কি মন্দ করেছি। অনেকদিন ভেবেছি তোর পরিচয় তোকে জানিয়ে তোর আত্মীয়-স্বজনের কাছে তোকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো। কিন্তু তোর মায়া আমাকে সব কাজ থেকে বঞ্চিত করেছে, তোকে আর ফিরিয়ে দিতে পারিনি।

এটাই তুমি ভাল করেছো বাবা! তোমার স্নেহময় বন্ধনে আমি মানুষ-জীবন লাভ করেছি। আমি খুঁজে পেয়েছি আমার জীবনটাকে। তোমার অনেক আপত্তি সত্ত্বেও আরাকানে আমি গিয়েছি। দেখেছি। শহরের মানুষ নামের জীবগুলোকে। যাদের মানুষের মত সব আছে–নেই মানুষের মত প্রাণ। রাজবংশের ব্যক্তিদের সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটেছে–কিন্তু আমি তাদের আচরণে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। রাজবংশের জীব বলে তাদের যে অহঙ্কার, সে অতি সাংঘাতিক। মানুষকে তারা মানুষ বলে মানে না, তারা সবাইকে নগণ্য ঘূণ্য জীব বলে মনে করে। অর্থ আর নারী পিপাসা তাদের অন্ধ করে ফেলেছে। বাবা আমি ওদের মনের পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠেছি, পালিয়ে এসেছি তাদের সংশ্রব থেকে। কি জঘন্য, কি সাংঘাতিক ওদের মনোবৃত্তি!

সন্ন্যাসী বাবাজীর চোখে মুখে বিস্ময়, অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তিনি তাকিয়ে আছেন কেশবের মুখের দিকে! কথাগুলো বলতে গিয়ে কেশবের সুন্দর মুখমণ্ডল রক্তাভ হয়ে উঠেছে, ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে ওর। বললেন সন্ন্যাসী বাবাজী–ধন্য কেশব, ধন্য তুমি! আমার সাধনা সার্থক হয়েছে।

বাবা!

কেশব, তোমার আত্ম-পরিচয় পেলাম, এবার তোমার হৃদয়ের পরিচয় চাই। ফুলকে তুমিই গহন বন হতে কুড়িয়ে এনেছিলে। তোমার প্রচেষ্টায় সে জীবন লাভ করেছে। তুমিই ওকে বাঁচিয়েছো, কাজেই আমি ফুলকে তোমার হাতেই সঁপে দিয়ে নিশ্চিত হতে চাই। কিন্তু তার জাতি ধর্ম তোমার। স্বজাতি নয়–সে মুসলমান কন্যা।

আমি সে কথাও শুনেছি–একটু পূর্বে ফুল যখন আপনাকে তার কথা জানাচ্ছিলো।

সে মুসলমান জেনেও তাকে বিয়ে করতে চাও?

 হা।

 খুশি হলাম তোমার কথা শুনে কেশব।

মানুষ মানুষই তার আবার জাতি ধর্ম কি?

*

ফুল, আর কতদিন আমাকে এভাবে বঞ্চিত করবে?

কেশবের কথায় চমকে উঠলো ফুল, বললো আমি তোমার আশাকে কোনোদিন পূর্ণ করতে পারবো না। কেশব ভাই, আমি তোমার কাছে ঋণী…কিন্তু সে ঋণ শোধ করবার মত আমার কিছু নেই।

আমি শুধু তোমাকে চাই। ফুল, আমি আর কিছু চাই নে। বাবা বলেছেন তোমার-আমার বিয়ে। হবে তাতে কোন বাধা নেই। তবে কেন, কেন তোমার এতো আপত্তি?

কেশব ভাই একটা কথা আমি আজ তোমাকে বলবো?

বলো?

কেশব ভাই, আমি জানি তুমি আমাকে রক্ষা না করলে হয়তো এতদিন আমি মিশে যেতাম মাটির বুকে। আমার কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। আমার জন্য তুমি অনেক কষ্ট করেছো একথা আমি কোনোদিন অস্বীকার করবোনা বা করতে পারবোনা।

কিন্তু…

বলো-থামলে কেন?

বিয়ে আমি কোনোদিন করতে পারবোনা।

কেন?

কেশব ভাই, আমি বিবাহিত…

ফুল!

হাঁ, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

কোথায় তোমার স্বামী? কে তোমার স্বামী?

জানিনে সে এখন কোথায় জানিনে তার সন্ধান।

 কে–কে তোমার স্বামী, ফুল? বলো, বলো কে তোমার স্বামী?

আজ নয়, বলবো–আরও পরে বলবো তার পরিচয়।

 কেন কিসের জন্য তোমার স্বামীর পরিচয় তুমি গোপন রাখতে চাও?

তা ও জানাবো পরে।

কিন্তু ফুল, বিয়ের নাম করে তুমি আমাকে ফাঁকি দিতে পারবেনা। যদি সত্যিই তুমি বিবাহিত হও তবু তোমাকে আমি গ্রহণ করতে রাজি আছি।

তা হয়না।

ফুল, কেন তুমি নিজেকে এভাবে বিনষ্ট করছো? যাকে তুমি হারিয়েছে তাকে আর কোনোদিন ফিরে পাবে কিনা সন্দেহ। সে এখন জীবিত না মৃত তাই বা কে জানে।

কেশব ভাই, ও কথা বলোনা। আমার মন বলছে সে জীবিত আছে।

ফুল, মনের কাছে তোমার এ দূর্বলতা শোভা পায়না। যদি সে জীবিতই থাকে ক্ষতি কি, সেতো আর এখানে ফিরে আসবেনা কোনোদিন। ফুল, এসো আবার আমরা নতুন করে ঘর বাধি? এই সুন্দর আকাশ, সুন্দর বাতাস, এই গহন বনের নিস্তব্ধতা, পাখির গান, ঝরণার কল কল ধ্বনি। সব আমরা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করি। বাবা এতে খুশি হবেন, আশীর্বাদ করবেন আমাদের দুজনাকে। ফুল…

কেশব ফুলের হাতখানা ধরে ফেলে।

ফুল ওর বলিষ্ঠ হাতের মধ্য থেকে হাতখানা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বলে–কেশব ভাই, তোমাকে আমি শ্রদ্ধা করি সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে…

না না শ্রদ্ধা আমি চাইনে, আমি চাই তোমাকে। ফুল, আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই চাইনে। তুমি মুসলমান; আমি হিন্দু ব্রাহ্মণ সন্তান, তবু আমি তোমাকে কোনো সময় ভিন্ন মনে করিনি। তুমি বিবাহিত জেনেও আমি তোমাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবোনা, তুমি আমার নয়নের আলো।

কেশব ভাই, ছেড়ে দাও–ছেড়ে দাও আমার হাত।

 আগে কথা দাও তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

 যা সম্ভব নয় কি করে তা হবে বলো, কেশব ভাই?

কেন কিসের জন্য সম্ভব নয়, তুমি বিবাহিত আর আমি অবিবাহিত, তাই?

না। আমি এর জবাব দিতে পারবোনা। ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে…ফুল কেশবের হাতের মুঠা থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যায়।

কেশব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ফুলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে।

কেশব কোনোদিন মেয়ে মানুষ দেখেনি, সে আজীবন এই গহন বনে পবর্তের গুহায় সন্ন্যাসী রঘু বাবাজীর আশ্রয়ে মানুষ। তার জীবনে ফুল নতুন এক সৃষ্টি। ফুলকে সে যখন প্রথম দেখলাৈ তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলো ভীষণভাবে। তার আর ফুলের মধ্যে সে তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করেছিলো পার্থক্যটা। ফুলকে সে আবিষ্কার করেছিলো এক নতুন আস্বাদ নিয়ে।

ফুলকে সে শিকার করতে গিয়ে বনের মধ্যে তীরবিদ্ধ অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়েছিলো। অজ্ঞান ফুলকে কাঁধে বয়ে নিয়ে এসেছিলো সে আশ্রমে। প্রথমে ওকে মৃত মনে করেছিলো কিন্তু আশ্রমে নিয়ে আসার পর সন্ন্যাসী বাবাজী ওকে পরীক্ষা করে বলেছিলো–ওর মৃত্যু হয়নি, এখনও সে জীবিত। সন্ন্যাসী বাবাজী এবং কেশবের অক্লান্ত সেবা-যত্নে ফুল জীবন লাভ করেছিলো।

ফুলকে বাঁচাতে গিয়ে কেশব অনেক কষ্ট স্বীকার করেছে।

সন্ন্যাসী বাবাজীর কথা মত তাকে বন হতে বনান্তরে গাছ-গাছড়া হতে ঔষধ সংগ্রহ করতে হয়েছে। ফুলের শরীর থেকে অত্যন্ত রক্তপাত হওয়ায় তাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছিলো। হতাশ হয়ে পড়েছিলেন সন্ন্যাসী বাবাজী।

কিন্তু কেশব হতাশ হয়নি, সন্ন্যাসী বাবাজী যা বলেছেন সে ভাবে সে কাজ করে গেছে। গহন বনে একরকম ফুল পাওয়া যায়। সে ফুল ভক্ষণ করলে শরীরে রক্ত জন্মে। কিন্তু সে ফুল সংগ্রহ করা অতি মারাত্নক ব্যাপার। রক্তপায়ী বৃক্ষেই জন্মে সে ফুল। কেশব মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সে ফুল সংগ্রহ করে আনতো, আর সন্ন্যাসী বাবাজী সে ফুলের রস তৈরি করে খাওয়াতো যুবতীকে।

এভাবে যুবতীর দেহে রক্ত সৃষ্টি করলো তারা। একদিন সত্য সত্যই যুবতী আরোগ্য লাভ করলো। কেশব ওকে অবাক হয়ে দেখতো, ভাল লাগতো ওর।

তারপর যুবতীর সান্নিধ্য কেশবকে নতুন এক জীবন দান করলো। সে নিজের মধ্যে অনুভব করলো পৌরুষচিত মনোভাব। যুবতীর নাম কেশবই রেখেছিলো ফুল। কারণ ফুলের রস খেয়েই ও বেঁচে উঠলো।

কিন্তু যুবতী বেঁচে উঠলেও সে তার পরিচয় জানালোনা সন্ন্যাসী বাবাজী বা কেশবের কাছে।

কেশবের মনে দাগ কাটলো ফুল। কেশব ওকে ভালবেসে ফেললো অত্যন্ত গভীরভাবে।

সন্ন্যাসী বাবাজী বুঝলেন, তিনি বাধা দিলেন না কেশবকে। কারণ তিনি নিজেও নিজের জীবনটাকে বিফল করে ফেলেছেন। কেশব যাতে তার জীবনটা শুস্ক মরুর মত করে না তোলে সেজন্য তিনি লাগাম ছেড়ে দিলেন।

কেশব ইচ্ছামত ফুলের সঙ্গে মিশতো।

কেশব মিশতে চাইলেও ফুল সরে থাকতো কেশবের কাছ থেকে। কিন্তু কেশবের অবুঝ অন্তরের কাছ হতে সরে যেতে পারতোনা। সে জোর করে ওকে টেনে নিয়ে আসতো সন্ন্যাসী বাবার পাশ থেকে।

হাসতেন সন্ন্যাসী বাবাজী, ভাবতেন দোষ কি মিশতে একদিন ওদের বিয়ে দেবেন মনস্থির করে। নিলেন।

ফুল যখন জ্ঞান লাভ করেছিলো তখন সে প্রথম দেখেছিলো ছায়ার মত একটি বলিষ্ঠ পুরুষকে। তার মন ভরে উঠেছিলো আশায়, আনন্দে, হাত বাড়িয়ে তার হাতখানা ধরেছিলো, বুকে মাথা রেখে শান্তি লাভ করেছিলো। কিন্তু যে মুহূর্তে সে তার কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলো– বাবা, এ এমন করছে কেন। গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে সরে গিয়েছিলো ফুল। তারপর আর কোনোদিন ওর বুকে মাথা রাখেনি সে। দৃষ্টিশক্তি সচ্ছ হলে সে দেখেছিলো–যাকে সে পরিচিত আপনজন বলে মনে করেছে–এ সে নয়। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো ফুল সেদিন।

*

তারপর কেটে গেছে বেশ কিছু মাস, ফুল নতুন জীবন লাভ করেছে। সেদিনের সেই বলিষ্ঠ পুরুষটিকে স্পষ্ট করে দেখেছে, জেনেছে তাকে সে তার কামনার-সাধনার সেই লোক নয়। এ হলো তার জীবন-রক্ষক কেশব।

কেশব ওকে বাঁচিয়ে তুলেছে, ওর কাছে ঋণী সে সর্বতোভাবে। তাই বলে তাকে ভালবাসা যায় না।

ফুল কেশবকে শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে, কিন্তু ওকে বিয়ে করতে পারেনা।

ফুল ওকে বিয়ে করতে না চাইলে কি হবে, সন্ন্যাসী বাবাজীও ফুলকে নির্জনে ডেকে বললেন কেশবকে বিয়ে করো। ওকে বিয়ে না করলে আমার তপস্যা নষ্ট হয়ে যাবে।

চমকে উঠলো ফুল–বাবা!

হাঁ মা, আমার জীবনের জীবন হলো ঐ কেশব। ওকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে আমি আমার সর্বস্ব ত্যাগ করে সন্ন্যাসী সেজেছি, শুধু ঐ কেশবকে জীবিত রাখার জন্যে…

বাবাজী, আমি যে বিবাহিতা!

শুনেছি, কেশব আমাকে সেকথা বলেছে।

কি করে আমি কেশব ভাইকে স্বামী বলে গ্রহণ করবো, বাবাজী? এক নারীর কি দুই স্বামী থাকতে পারে?

কেন পারে না মা? তোমাদের মুসলমান ধর্মে না থাকলেও আমাদের হিন্দু ধর্মে চলে।

বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলে উঠে ফুল–কোনোদিন তো এমন দেখিনি!

হা দেখোনি, কিন্তু শুনে থাকবে। আমাদের দ্রৌপদীর পঞ্চপতি ছিলো।

বাবাজী!

 মা, আমার কেশবের মুখ চেয়ে ওকে তোর বিয়ে করতেই হবে। তাছাড়া তোর স্বামী বেঁচে আছে না নেই, তাও তো জানিসনে। আর আপত্তি করিসূনে মা।

ফুল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বাবাজীর কথার কোনো জবাব দিতে পারেনা, চলে যায় সেখান হতে। কুঠির মধ্যে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় মাটির বিছানায় খেজুর পাতার চাটাই বিছিয়ে নিদ্রামগ্ন কেশব। পাশের জানালা দিয়ে বেলা শেষের সূর্যাস্ত কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেছে। সে আলোকে কেশবের মুখখানা বড় করুণ বলে মনে হলো, বড় ম্লান বড় অসহায় সে মুখ।

নির্বাক নয়নে ফুল তাকিয়ে আছে কেশবের ঘুমন্ত মুখের দিকে। মনে পড়ে তার আর একখানা। মুখের কথা, না জানি সে মুখ আর জীবনে সে দেখতে পাবে কিনা। ফুলের চোখের সামনে মিশে যায় কেশবের মুখ, তার মানসপটে আঁকা মুখখানা স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে। কেশব অদৃশ্য হয়, জেগে উঠে তার হারানো জন।

ফুল নিজের অজ্ঞাতে গিয়ে বসে কেশবের শিয়রে, হাত রাখে ওর মাথার চুলে। ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে চলে সে।

হঠাৎ নিদ্রা টুটে যায় কেশবের, চোখ মেলে তাকায়।

সঙ্গে সঙ্গে পালাতে যাচ্ছিলো ফুল।

 কেশব পথ রোধ করে দাঁড়ায়–থামো।

না না, আমাকে যেতে দাও কেশব ভাই! আমাকে যেতে দাও।

তবে কেন এসেছিলে বলো? ফুল, জানি তুমি আমাকে ভালবাসো, কিন্তু কেন তোমার এতো দ্বিধা?

না না, আমি তোমাকে ভালবাসিনে। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি।

ফুল!

পথ ছাড়ো কেশব ভাই?

না, আমি তোমার পথ ছাড়বো না।

কেন?

ফুল, নারী কি বস্তু আমি জানতাম না। নারী সম্বন্ধে আমার কোনো উত্তেজনা ছিলো না। কিন্তু তুমি–তুমিই আমার চোখে নারীর রূপ তুলে ধরেছে। আমার হৃদয়ে তুমিই জাগিয়েছো পৌরুষত্ব ভাব। আমার ধমনীতে তুমিই…

থামো থামো কেশব ভাই, দয়া করে থামো।

 ফুল!

গভীর বেদনা ভরা দৃষ্টি নিয়ে এগুতে থাকে কেশব ফুলের দিকে ফুল, আমার হৃদয় তুমি শুস্ক মরুভূমি করে দিও না। যদি তাই করতে চাও, তবে কেন এসেছিলে আমার পাশে। কেন আমার মাথায় তুমি হাত রেখেছিলে? বলো বলো ফুল?

আজকের মত আমাকে মুক্তি দাও।

মুক্তি! ফুল, তুমি আমার কাছ থেকে কোনোদিন মুক্তি পাবে না। আমার সাধনা তুমি। কেশব ওর হাতখানা ধরে ফেলে চট করে। আবেগ ভরা কণ্ঠে ডাকে–ফুল!

কেশবের বলিষ্ঠ হাতের মুঠায় ঘেমে উঠে ফুলের নরম কোমল হাতখানা। নিজেকে বাঁচিয়ে নেবার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলে। কিন্তু কেশবের হাতের মুঠা থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিতে পারে না ফুল।

এমন সময় বাবাজীর কণ্ঠ শোনা যায়–কেশব! কেশব!

কেশব ফুলকে মুক্ত করে দিয়ে বেরিয়ে আসে কুঠির হতে, বলে–বাবা, তুমি ডাকছো?

হাঁ। শোন কেশব, রাজবংশের ছেলে হলেও তুমি আজ আমারই সন্তান। সন্ন্যাসী-পুত্র হয়ে কোনো অসংযত কাজ করা অন্যায়। ফুলকে তুমি ভালবাসতে পারো কিন্তু স্পর্শ করতে পারো না।

বাবাজী, আমাকে ক্ষমা করুন।

যাও, আজ হতে সাবধান থাকবে, বুঝলে?

কেশব নতমস্তকে বেরিয়ে গেলো সেখান হতে।

*

অদ্ভুত জীবটা যে পথে চলে গেলো বনহুর ঠিক সে পথেই অগ্রসর হলো। সে জানে, ঐ ভয়ঙ্কর সাংঘাতিক জীবটা যে রাস্তায় চলে যাবে সে পথে সহজে কোনো হিংস্র জন্তু আসবে না।

বনহুর বেশ কিছুটা অগ্রসর হলো। এদিকে ক্রমান্বয়ে ডিজেল-ইঞ্জিনের মত শব্দটা মিলিয়ে যেতে লাগলো। বনহুর তবু চলেছে। হঠাৎ একটা গাছের ডালে দৃষ্টি চলে গেলো তার। মস্ত বড় একটা শালগাছ। উঁচু একটা ডালে সাদা ওড়নার মত কিছু ঝুলছে বলে মনে হলো। বনহুর ভালভাবে লক্ষ্য করতেই বেশ বুঝতে পারলো–উঁচু ডালের একটি ফাঁকে মিস শ্যালনকে রাখা হয়েছে। আশে-পাশে কোথাও গরিলা মহারাজ আছে কিনা দেখে নিয়ে বনহুর গাছটার গুঁড়ির নিকটে এসে দাঁড়ালো।

বিরাট উঁচু গাছ। গাছের গুঁড়িটা প্রায় চল্লিশ হাত প্রশস্ত হবে। নিচের দিকে কোনো ডালপালা না থাকায় বনহুর খুব চিন্তায় পড়লো। গাছে উঠা তার সমস্যা হবে না, কিন্তু শ্যালনকে নিয়ে নামাটা মুস্কিল হবে। সুচতুর গরিলা তার খেলনা মেয়েটিকে এবার গুহায় না নিয়ে গিয়ে রেখেছে গাছের ডালের ফাঁকে, যেখান থেকে সে নিজেও নামতে পারবে না বা কেউ তাকে চুরি করেও নিয়ে যেতে পারবে না।

বনহুর শাল-বৃক্ষের অদূরে আর একটা মাঝারি বৃক্ষ বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে গেলো, এবং কৌশলে সে চলে এলো পাশের বিরাট বৃক্ষটায়।

বনহুর সতর্ক কণ্ঠে ডাকলো–শ্যালন, শ্যালন…

কোনো সাড়া নেই। আবার ডাকলো বনহুর-শ্যালন…

 এবার করুণ ভয়ার্ত একটি কণ্ঠস্বর–আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও…

শ্যালন…শ্যালন…

আলম! আলম…

আমি এসেছি, শ্যালন ভয় নেই আমি এসেছি। বনহুর অতি কৌশলে শাখা বেয়ে এগুতে লাগলো শ্যালনের দিকে। অনেক চেষ্টায় কিছুক্ষণের মধ্যে বনহুর পৌঁছে গেলো শ্যালনের পাশে। সুউচ্চ শাখার দুটি ডালের ফাঁকে একটু চওড়া জায়গায় শ্যালনকে রেখেছে গরিলা। জানে, এখানে কেউ তার পুতুল মেয়ের সন্ধান পাবেনা। তাই বুঝি নিশ্চিন্ত মনে দূরে কোথাও ঘুরতে গেছে।

বনহুর নিকটে পৌঁছতেই শ্যালন তাকে জড়িয়ে ধরলো–আমাকে বাঁচাও আলম। আমাকে বাঁচাও…

ভয় নেই শ্যালন। তুমি সাহস নিয়ে আমার সঙ্গে নামতে চেষ্টা করো।

কিন্তু আমি তো গাছে উঠতে জানিনে, নামতেও জানিনে, কি করে নামবো? আমি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দেবোনা।

তাহলে তোমাকে নিয়ে নামবো কি করে? তুমি বরং আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো, আমি এ গাছ। থেকে ও গাছে যাবো। ঐ গাছটা তবু খাটো আছে, এবং ডালপালা বেশ উঁচু নীচু আছে। নামতে তেমন কষ্ট হবেনা।

শ্যালন তার হাত দু’খানা দিয়ে বনহুরের কাঁধটা বেশ করে ধরে আস্তে আস্তে এগুতে লাগলো। ওকে বাম হস্তে ধরে রাখলো এঁটে।

বনহুরের প্রচেষ্টায় অল্পক্ষণেই শ্যালন নেমে এলো নিচে। আনন্দ আর ধরেনা শ্যালনের, বনহুরের গণ্ড সে চুমোয় চুমোয় ভরে দিলো।

বনহুর হেসে বললো–আগে চলো তাঁবুতে। এখানে বিলম্ব করা আমাদের এক মুহূর্ত উচিৎ নয়। কারণ তোমার সেই প্রিয় নায়ক মহাশয় এসে যেতে পারেন।

সত্যি, তুমি না হলে ওর হাত থেকে কেউ আমাকে রক্ষা করতে সক্ষম হতোনা। আবার শ্যালন বনহুরের কণ্ঠ তার সরু দুটি বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে।

বনহুর এবার তার জবাব দেয়, শ্যালনের কোমল নরম গণ্ডে কঠিন দুটি ওষ্ঠের ছাপ পড়ে। কিন্তু বনহুর আর দেরী করেনা, শ্যালনের হাত ধরে দ্রুত অগ্রসর হয় সে তাঁবুর দিকে।

*

তাঁবুতে ফিরে আসতেই প্রফেসার ম্যাকমারা কন্যাকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর অনেক রোদন। করলেন। বনহুরকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবেন, ভাষা খুঁজে পেলেন না।

বনহুর বললো–ধন্যবাদ জানাবার সময় এখন নেই, এখানে বিলম্ব হলে আবার সে আক্রমণ করতে পারে, কাজেই তাড়াতাড়ি সরে পড়তে হবে। বনহুর নিজেও তাবু গুটাতে ওদের সাহায্য করলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা রওয়ানা দিলো।

*

প্রফেসার ম্যাকমারা তার দলবল নিয়ে ফিরে চলেছেন, কিন্তু মনে তার পূর্ণ আনন্দ নেই। আসার সময় তারা এসেছিলেন যতগুলো কিন্তু ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের মধ্যে কয়েক জনকে বিসর্জন দিয়ে। বড় বেদনা, বড় দুঃখ এটাই প্রফেসারের সবাই মিলে ফিরে যেতে পারলেন না।

পথে তেমন কোনো বিপদের সম্মুখীন আর হলোনা তারা। তবু একটা আশঙ্কা ছিলো–না জানি কোন মুহূর্তে আবার সেই গরিলা মহারাজ হামলা চালিয়ে বসে। কিন্তু গরিলা মহারাজ আর তাদের আক্রমণ করলোনা। হয়তো সে তার ছোট্ট মেয়েটার জন্য বনে, জঙ্গলে হাতড়ে ফিরছে।

জাহাজে উঠে তবে সবাই নিশ্বাস নিয়ে বাঁচলো।

বনহুরকে তারা এ গহন জঙ্গলে একা ছেড়ে দিলোনা, তাকেও প্রফেসার ম্যাকমারা তাদের জাহাজে সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ জানালেন।

রাজি না হয়ে কোনো উপায়ও ছিলোনা বনহুরের।

আফ্রিকার জঙ্গল ত্যাগ করে জাহাজ সাগরবক্ষে ভাসলো।

জাহাজে সবার মনেই আনন্দের বান বয়ে যাচ্ছে, আফ্রিকার জঙ্গল হতে প্রাণ নিয়ে ফেরা–এ কম কথা নয়!

মিস শ্যালনের আনন্দ সবচেয়ে বেশি, প্রাণ নিয়ে ফেরার আনন্দের চেয়ে তার আনন্দ অনেক বেশি, কারণ আফ্রিকার জঙ্গলে সে খুঁজে পেয়েছে তার সাথী–তার কামনার জনকে। বনহুর শ্যালনের জীবনে পরম এক সম্পদ।

শ্যালন সব কিছু কষ্ট-ব্যথা ভুলে গেলো, খুশিতে সে আত্নহারা আলম তার সঙ্গে আছে। সে ভাবতেও পারেনি, আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে এমন একটি ব্যক্তিকে সে সাথীরূপে খুঁজে পাবে।

রেলিংএর ধারে পাশা পাশি বনহুর আর শ্যালন দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। বনহুর তাকিয়ে ছিলো দূরে সরে যাওয়া কালো রেখার মত দাগটার দিকে। দাগটা আসলে অন্যকিছুই নয়, আফ্রিকার জঙ্গলটা ক্রমে দূরে সরে গিয়ে একটা রেখার মত মনে হচ্ছিলো।

বনহুর তাকিয়ে ছিলো সে দিকে, প্রায় সপ্তাহ কাল তাকে এ জঙ্গলে কাটাতে হয়েছে, প্রতি মুহূর্তে তাকে মৃত্যুর সঙ্গে বোঝা পড়া করে চলতে হয়েছে। আজ সে জঙ্গল ত্যাগ করে সে চলেছে…আফ্রিকার জঙ্গলের সঙ্গে রয়ে গেলো তার এক গভীর সম্বন্ধ।

শ্যালন বনহুরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে–কি এতো ভাবছো, আলম?

বনহুর ফিরে তাকায় শ্যালনের উজ্জ্বল দীপ্তময় সরল মুখখানার দিকে, হেসে বলে–ভাবছি। আফ্রিকার জঙ্গলটা কেন ত্যাগ করলাম।

উ! কি সাংঘাতিক মানুষ তুমি!

কেন?

আফ্রিকার জঙ্গলের মায়া এখনও তুমি ত্যাগ করতে পারোনি! আমি কিন্তু আর কোনদিন ঐ মৃত্যুভয়াল আফ্রিকার জঙ্গলে যাবোনা।

শ্যালন, মৃত্যুকে তুমি খুব ভয় করো, না?

তোমার বুঝি মৃত্যুকে ভয় নেই?

না শ্যালন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আমার আনন্দ।

 তাই তো তুমি ঐ মৃত্যুভয়াল জঙ্গলটাকে এতো ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু জানো, আমি তোমাকে। আর কোনোদিন ঐ জঙ্গলে যেতে দেবোনা। আলম, তোমাকে পেয়ে আমি কত যে খুশি হয়েছি কি বলবো!

মনে মনে হাসে বনহুর কত নারীর মুখে সে এ কথা শুনেছে, কিন্তু শ্যালনের মুখে যত মিষ্টি লাগছে তেমন করে বুঝি আর লাগেনি। বনহুর ভাবে–শ্যালন আর তাদের মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। শ্যালন ফুলের মত সুন্দর-পবিত্র, যেন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা।

বনহুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শ্যালনের মুখের দিকে।

শ্যালন বলে- কি দেখছো?

 শ্যালন!

 বল আলম?

শ্যালন, আমাকে পেয়ে তুমি খুশি হয়েছে সত্য কিন্তু আমি তো তোমাকে খুশি করতে পারবো না কোনোদিন।

তার মানে?

 যাক, পরে তার মানে বলবো।

না, এখনই তোমাকে বলতে হবে।

চলো তোমার ক্যাবিনে যাই।

এবার শ্যালন খুশি হলো, বললো–চলো, সত্যি এতোক্ষণ তোমাকে আমার ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিলো। বাবাটা যেন কি, কোথায় যে কি কাজ নিয়ে মেতে আছেন কে জানে।

যাক, উনি ব্যস্ত আছেন।

বনহুরকে নিয়ে শ্যালন নিজের ক্যাবিনে আসে।

সেখানে পৌঁছতেই প্রফেসার ম্যাকমারাকে দেখতে পেলো ওরা। ম্যাকমারা বললেন–হ্যালো আলম আমি তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। এসো আলম, এসো তোমরা। বসো। ম্যাকমারা হাত দিয়ে পাশের আসন দুটো দেখিয়ে দিলেন।

বনহুর আর শ্যালন আসন গ্রহণ করলো।

ম্যাকমারা সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেট অগ্নি সংযোগ করে একমুখ ধোয়া ছাড়লেন, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন–আলম, আমরা কোথায় চলেছি এখনও তোমাকে জানানো হয়নি। শ্যালনও শোনেনি।

শ্যালন বলে উঠলো–আমরা হাঙ্গের শহরে আমাদের দেশে ফিরে যাচ্ছি।

না মা, দেশে ফিরে যাচ্ছিনে।

 তবে কোথায় যাচ্ছে বাবা?

 সে এক নতুন দেশে। এবার কথা বললো বনহুর–নতুন দেশ!

 হা। বাংলাদেশে যাবো এবার।

 শ্যালন ও বনহুর এক সঙ্গে উচ্চারণ করলো বাংলাদেশ!

আমরা বাঙানি হয়েও আজও বাংলাদেশ চোখে দেখিনি। বাংলাদেশের কাহিনী শুনে আমাদের মনে কত কথা জেগেছে, বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য নাকি মানুষকে অভিভূত করে ফেলে…একটু আনমনা হয়ে যান ম্যাকমারা।

প্রফেসার ম্যাকমারার কথাগুলো বনহুরের মনেও আঁচড় কাটে। সত্যি, সেও তো বাঙালির ছেলে, অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় নেই। বনহুর মায়ের মুখে শুনেছে, তাদের পূর্ব-পুরুষের একজন বাংলাদেশ থেকে কান্দাই চলে আসেন কোনো কার্যোপলক্ষে। তারপর তিনি আর ফিরে যান নি। স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে কান্দাই শহরের বাইরে একটি ভাল জায়গা দেখে ঘর বাঁধেন। কিন্তু চৌধুরী বংশের অমর্যাদা করেননা। কান্দাই শহরেও তিনি ঘরবাড়ি তৈরি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন, বহু জমি জায়গা তিনি সন্তান-সন্ততিদের জন্য ক্রয় করেন, এবং কান্দাই শহরে চৌধুরী পরিবার রূপে পরিচিত হন। বনহুরের পিতা এই চৌধুরী বংশেরই সন্তান।

ম্যাকমারার কথায় বনহুরের ধমনীতে জেগে উঠলো এক নতুন উন্মাদনা। বাংলাদেশের স্বপ্ন সে দেখেছে কিন্তু বাংলার আস্বাদ সে পায়নি। নূরীকে হারিয়ে বনহুর ভেবেছিলো বাংলায় যাবে কিন্তু ভাগ্য বিপর্যয়ে তা হয়ে ওঠেনি। মনে মনে খুব খুশি হলো বনহুর।

ম্যাকমারা বলতে শুরু করলেন–আফ্রিকার জঙ্গল আমার মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার পরিপূর্ণ আশায় আমি বাংলায় যেতে চাই। জানিনে, সেখানে আমি সম্পূর্ণ শান্তি ফিরে পাবো কিনা। আলম, তুমি যদি আমাদের সঙ্গে থাকো তবে আমি অনেক খুশি হবো।

শ্যালন বলে উঠলো-উনি তো আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন।

বনহুর বললো–কিন্তু আমার একবার কান্দাই যাওয়া দরকার ছিলো।

কান্দাই! চমকে উঠে কথাটা বললেন ম্যাকমারা।

 হ, কান্দাই আমার দেশ।

শ্যালন ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো–দস্যু বনহুরের নাম তাহলে জানা আছে তোমার?

কান্দাই যখন আমার বাড়ি তখন নিশ্চয়ই তার সঙ্গে আমার জানাশোনা থাকতে পারে।

বলো কি আলম! বললেন ম্যাকমারা।

হাঁ, দস্যু বনহুর আমার পরিচিত ব্যক্তি।

আশ্চর্য তো! বললেন ম্যাকমারা। আচ্ছা আলম, তুমি তাকে দেখেছো?

 বললাম তো সে আমার পরিচিত জন।

 সত্যি বলছো?

হাঁ শ্যালন।

এমন সময় ক্যাপ্টেন এসে ডাকলেন–প্রফেসার, একটু আসুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

 ম্যাকমারা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন।

 শ্যালনের চোখের বিস্ময় কাটেনি তখনও, বললো সে কেমন দেখতে দস্যু বনহুর?

তোমার কেমন মনে হয়?

বলোনা, দস্যু বনহুর কেমন দেখতে?

 তাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?

না না, তাকে দেখতে চাইনে….

 কেন?

 দস্যু বনহুর নাম শুনলেই আমার বুকটা ধক ধক্ করে।

 তাহলে তার চেহারার বর্ণনা শুধু শুনতে চাও?

 হ।

 যদি বলি ঠিক আমার মত।

যাও ঠাট্টা করোনা…শ্যালন বনহুরের সোফার হ্যাণ্ডেলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে–তোমার মত সুন্দর হবে দস্যু বনহুর, কি যে বলো!

তাহলে ধরো তোমার সেই গরিলা মহাশয়ের মত।

যাও ও কথা বলোনা, গরিলাটার কথা মনে হলে এখনও আমার প্রাণ শুকিয়ে যায়।

আর দস্যু বনহুরের কথা শুনে কেমন হয়?

উঃ! কি সাংঘাতিক দস্যু সে; গরিলা তবু ভাল! তার চেয়েও অতি ভয়ঙ্কর ঐ দস্যু বনহুর। দিনে দুপুরে লোকের বুকে ছোরা বসাতে এতোটুকু কুণ্ঠা বোধ করেনা।

কিন্তু শ্যালন, তুমি জানোনা–সে আমার বন্ধু।

তোমার বন্ধু, আশ্চর্য!

আশ্চর্য হবার কিছু নেই শ্যালন, দস্যু বলে সেকি মানুষ নয়? যাক সে তো আর এ জাহাজে আসছে, তার কথা শুনে কোনো লাভ নেই।

না, তোমাকে আরও বলতে হবে। তুমি যখন দস্যু বনহুরের বন্ধু, তাহলে তাকে আমি ভয় করিনে, তোমার সঙ্গে থাকলে সে আমাকে নিশ্চয়ই কিছু বলবেনা।

হাঁ, তাকে ভয় পাবার কিছু নেই, সেও মানুষ–তুমিও মানুষ।

আচ্ছা আলম, তোমার দস্যু-বন্ধু নাকি মস্ত বড় শক্তিমান?

তার সম্বন্ধে আর কি শুনেছো?

অনেক কথাই শুনেছি। দস্যু বনহুর শুধু দস্যুতাই করেনা–সে নাকি মেয়েদের চুরি করে নিয়ে যায়, তাদের জোর করে…

মিথ্যে কথা শুনেছো শ্যালন, তোমরা শুনেছো আর আমি তাকে দেখেছি। কোনো মেয়েকে সে কোনোদিন কু’অভিসন্ধি নিয়ে চুরি করেনি। কারণ আমার বন্ধু অসৎচরিত্র নয়।

খুব তো বন্ধুর প্রশংসা করছো?

 সত্যি যা তা না বলে তো পারছিনে।

 আচ্ছা আলম, সত্যি তোমার বন্ধু ঐ দস্যুটা?

হা।

কেমন দেখতে বলোনা ঠিক করে?

 যদি বলো আমি তাকে তোমার পাশে নিয়ে আসতে পারি।

এই জাহাজে?

 হ্যাঁ, এই জাহাজে।

এ তুমি কি বলছো আলম?

সত্যি কথা বলছি। জানো দস্যু বনহুর যাদু জানে? তুমি তাকে দেখবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে, এ কথা সে জানতে পেরেছে।

বলো কি?

সে আরও জানতে পেরেছে–তুমি তাকে নারী হরণকারী বলে দোষ দিয়েছ।

 মিছে কথা।

মোটেই নয়। যাক্, চলো বাইরে ডেকের ধারে গিয়ে দাঁড়ানো যাক।

 সে সময় ফিরে এলেন ম্যাকমারা, বললেন–আলম, এসো তোমার ক্যাবিনটা তোমাকে দেখিয়ে দিই।

উঠে দাঁড়ালো বনহুর–চলুন।

শ্যালনও উঠে পড়লো।

শ্যালনের ক্যাবিনের কায়েকখানার পরই দস্যু বনহুরের ক্যাবিন। এ ক্যাবিনটা অন্যান্য ক্যাবিনের চেয়ে সুন্দর–পরিস্কার ঝক ঝকে।

একদম রেলিং এর ধারেই ক্যাবিনটা, পাশের শার্সী দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় সমুদ্রের ফেনিল জলরাশি।

বনহুর এ শার্সীর পাশে দাঁড়িয়ে সীমাহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে কত কথা। জীবনের সমস্ত ঘটনা এক এক করে ভেসে উঠে চোখের সম্মুখে। তার এই বত্রিশ বছর বয়সের ঘটনা। মা, বাবা, দস্যু কালু খাঁ, রহমান, নূরী, মনিরা, শিশু নূর-সবাই তার মনকে চঞ্চল করে তোলে। ফিরে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠে। আস্তানার সবাই কেমন আছে, কে কি করছে, সব জানার বাসনা জাগে তার মনে।

কিন্তু সব কথা তলিয়ে আজ বার বার মনে পড়ে নূরীর কথা। নূরীর স্মৃতি তাকে আনমনা করে তোলে। নূরীকে হারিয়ে বনহুর হারিয়েছে তার মনিরাকে। ভয় হয় মনিরার পাশে যেতে, হঠাৎ যদি নূরীর স্মৃতি মনিরার কাছে তাকে দুর্বল করে তোলে। মনিরা তার বাস্তবের রাণী আর নূরী তার কল্পনা। ক্ষণিকের জন্য নূরীকে বনহুর পেয়েছিলো, একান্ত আপন করে পেয়েছিলো, কিন্তু সে পাওয়া শুধু বেদনাই দিয়ে গেলো–আনন্দ নয়।

নূরীকে ভুলতে গিয়ে বনহুর ভুলে গেছে তার জীবনের সব কিছু। নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছিলো–এমন দিনে সে পেয়েছিলো মীরাকে, মীরা তার জীবনে একটা ধ্রুবতারার মত জ্বলে উঠেছিলো, কিন্তু মীরা তার মানসপটে আসন গাড়তে পারেনি। বনহুরের বুকে যখন একটা তীব্র বেদনা খা খা করে ফিরছে, তখন সে পেলো শ্যালনকে। শ্যালনের সচ্ছ সুন্দর স্বভাব তার মনকে আকৃষ্ট করলো। শ্যালনের মধ্যে বনহুর খুঁজে ফিরতে লাগলো তার নূরীকে।

হঠাৎ ক্যাবিনে প্রবেশ করলো শ্যালন, বনহুরকে অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করতে দেখে পা টিপে টিপে অগ্রসর হলো। পিছন থেকে বনহুরের চোখ দুটো টিপে ধরলো সে।

বনহুরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেলো, তার বলিষ্ঠ হাত দু’খানা দিয়ে শ্যালনের হাত দু’খানা ধরে ফেললো, শান্ত মিষ্ট কণ্ঠে বললো–শ্যালন!

খিল খিল করে হেসে উঠলো শ্যালন–আলম, কি ভাবছিলে?

বনহুর শ্যালনকে মুক্তি না দিয়ে গভীরভাবে আকর্ষণ করলো। হেসে বললো–তোমার কথা। মুখটা ওর নূয়ে এলো শ্যালনের সুন্দর সরু দুটি ঠোঁটের উপর।

শ্যালন বনহুরকে বাধা দিলোনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *