অমানুষিক সাগর-মানুষ

অমানুষিক সাগরমানুষ

হ্যাঁ।

না।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ।

 না না না…

 পায়ের তলায় মাটিটা কেমন যেন দুলে উঠল না? সে দিকে নজর দেওয়াতে মৌসুমীর কথায় প্রতিবাদ করতে বেশ দেরি হয়ে গেল। আমার মাথাটাই ঘুরে উঠল না কি? কিন্তু এরকম তো আগে কখনও হয়নি। তবে! লোকে বলে লো ব্লাড… আর কিছু ভাববার আগেই মৌসুমী কথা বলে উঠল,

কী, কী হল! হঠাৎ কী ভাবতে শুরু করলে?

 না। কিছু ভাবছি না। তবে…

ও সব কোনও কথাই শুনতে চাই না। সামনের মাসে বাবার কাছে যাবই যাব।

 না না, আমি সে কথা ভাবছি না। পায়ের তলাটা কেমন যেন দুলে উঠল বলে মনে হল। তুমি কিছু বুঝতে পারলে না? আমার মাথাটাই ঘুরে গেল, না ভূমিকম্প কিছুই বুঝতে পারলাম না।

কই না তো, আমি তো কিছু বুঝতে পারলাম না। ও বুঝেছি। বাপের বাড়ি যাবার নামেই বুঝি ভূমিকম্প হতে শুরু হল! আর গেলে না জানি…

মৌসুমীর কথা শেষ হল না। তার আগেই সমস্ত ঘরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। টেবিলের ওপর রেডিয়োটা ভোলা ছিল। কিছুক্ষণ আগেই ন-টার ইংরেজি খবর হয়ে গেছে। কী একটা গান হচ্ছিল এখন। কড় কড় আওয়াজ করে রেডিয়োটা বন্ধ হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে ধড়মড় করে উঠে পড়ল মৌসুমী। আমিও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটা আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। চকিতের মধ্যে মাথাটা সরিয়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

বোধহয় মুহূর্তের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। মৌসুমীর ঠেলাতে চমক ভাঙল। মনে হল ছোট ভেলায় যেন সাগর জলে ভাসছি। বড় বড় ঢেউয়ের দোলায় ভেলার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যেন উঠছি আর নামছি। অসহ্য যন্ত্রণায় পৃথিবীর অভ্যন্তর যেন দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে উঠছে। যন্ত্রণার অনুভূতি প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। পায়ের সামনে সিমেন্ট বাঁধানো ঘরের মেঝেটা আস্তে আস্তে দু-ফাঁক হয়ে গেল। মাথার মধ্যে কেমন যেন করে উঠল। এ কী দেখছি! বেশ বুঝতে পারলাম আমার হাত ধরে টানছে মৌসুমী। পায়ের তলাটা এখনও টলমল টলমল করছে। আবার প্রচণ্ড জোরে ঘরবাড়ি সমস্ত কেঁপে উঠল। হুড়মুড় করে আমরা দু-জনে ধ্বংস্তূপের মধ্যে পড়ে গেলাম।

শেষ কম্পন যে কত তীব্র এবং ভয়াবহ হয়েছিল তা তখন আমরা সঠিক উপলব্ধি করতে পারিনি। কারণ সমুদ্রতীর থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব বেশ কিছুটা। নয়তো প্রবল জলোচ্ছ্বাসে কে কোথায় ভেসে যেতাম কে জানে! তবে যতটুকু অনুভব করতে পেরেছিলাম তাই আমাদের কাছে যথেষ্ট। চতুর্দিকের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল হ্যারিকেনের বা টাইফুনের কবলে পড়ে একটা বিরাট জাহাজ যেন পাহাড়ের গায়ে আছড়ে ভেঙে পড়েছে।

অবশ্য বাবার কাছে বিহারের ভূমিকম্পের প্রচণ্ডতার কথা শুনেছিলাম। কার্য উপলক্ষে বাবা তখন মুঙ্গেরে ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জ্বলন্ত বর্ণনা বহুবার শুনেছিলাম। আবার সরকারি অর্থানুকূলে বিদেশ সফরের সময়ে চিলি, জাপানের বীভৎসতম ভূমিকম্পেরও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু ভূমিকম্পের এরকম প্রচণ্ডতা বুঝি আর কোনওদিনও অনুভূতি হয়নি।

খোলা জানালাটা বন্ধ করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু শিকগুলো এমনভাবে বেঁকে গেছে যে, আমার সকল চেষ্টাই বিফল হল। দরজাটাও হুমড়ি খেয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজার একটা পাল্লা খুলে মৌসুমীকে বার করে আমিও রাত্রির অন্ধকারে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

চাপ চাপ কুয়াশায় রাত্রির অন্ধকার মসীময় হয়ে উঠেছে। আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত কুয়াশার স্তর পড়ে আছে। এ ধরনের কুয়াশা এখানে নতুন নয়। বেশ কয়েকদিন ধরে এই রকম কুয়াশা থাকবে। হাতখানেক দূরের জিনিস দেখা যায় না। তবুও অন্ধের মতো সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। কয়েকবার হোঁচট খেল মৌসুমী। হাত ধরে টেনে তুলে নিলাম ওকে।

হঠাৎ এক উৎকট দুর্গন্ধে সমস্ত গা গুলিয়ে উঠল। ভালো করে অনুভব করার চেষ্টা করলাম কোন দিক দিয়ে গন্ধ আসছে। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম চতুর্দিকেই এই দুর্গন্ধ আচ্ছন্ন। সমুদ্রের তলাকার দুর্গন্ধময় পাঁক তুলে কেউ যেন চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে, সমুদ্রের তলায় জমা নানান জান্তব পদার্থের পচা-গলা দুর্গন্ধে রাত্রির কুয়াশাঘেরা অন্ধকার ভারী হয়ে উঠছে। দমকা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধটাও তীব্র থেকে তীব্রতম হচ্ছে। দূরে সমুদ্রের মধ্যে বয়াগুলো ঢেউয়ের ধাক্কায় ধাক্কায় পাগলের মতো বেজে চলেছে। আওয়াজের ধরণ দেখে বুঝতে পারলাম, চেন ছিঁড়ে তীরে এসে ভিড়েছে বয়াগুলো।

না, যাই; অন্ধকারে বেশি দূর যাওয়া বোধ হয় উচিত হবে না। তাই পায়ে পায়ে আবার আমাদের ভাড়া বাড়িতেই ফিরে এলাম। সামনের ঘরটা ভেঙে পড়েছে বটে, তবে পেছনের ঘরগুলো এখনও অক্ষত আছে। আর তা ছাড়া যাবই বা কোথায়? এই দ্বীপে আমার বাড়িটাই সবচেয়ে মজবুত। আর বেশির ভাগই তো ছোট-বড় কুঁড়ে ঘর। সুতরাং ভাগ্যের ওপরে নির্ভর করে নিজের বাড়িতে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখলাম না।

বাড়ি ফেরার আর একটা কারণ ছিল। কেন জানি না, মনে হল সমুদ্র-রক্ষীরা বেতার মারফত কোনও সংবাদ দিতে পারে। তাই রেডিয়ো খুলে নির্দিষ্ট মিটার টিউন করে রাখলাম। আমার অনুমান মিথ্যে হল না। একটু পরেই সমুদ্র-রক্ষীদের কথা শুনতে পেলাম। ওদের প্রাথমিক রিপোর্টে যা বুঝলাম তাতে ভূমিকম্পের ভয়াবহতাই আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠল। ভূমিকম্প ছাড়াই সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছ্বাসে তীরবর্তী সমস্ত কিছুই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। যতদূর দৃষ্টি যায় সমস্ত তটভূমি রিক্ত নিঃস্বের রূপ ধারণ করেছে। তবে জীবনহানির কোনও সংবাদ পেলাম না।

কিছুক্ষণ পরে আরও সংবাদ পেলাম। প্রথম কম্পনের উৎপত্তি স্থান এখান থেকে ৭০-৮০ মাইল উত্তরে! কিন্তু দ্বিতীয় প্রচণ্ড কম্পনটির উৎসস্থল আমাদের খুব কাছেই ছোট্ট একটি দ্বীপের পাশে সমুদ্রের মধ্যে। সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল সমুদ্রের ঠিক ওই স্থানের গভীরতা অতলস্পর্শী। কেন জানি না মনে হল ওই সীমাহীন গভীরতাই দ্বিতীয় কম্পনের কেন্দ্রস্থল।

পুরো তিন দিন তিন রাত কুয়াশায় ঢাকা পড়ে রইলাম আমরা। এই কুয়াশা আমাদের কাছে নতুন নয়। তাই কুয়াশা অগ্রাহ্য করেই পরের দিন সকালে শহরে আমার অফিস অভিমুখে রওনা দিলাম। কিন্তু সেখানেও এর বেশি খবর পেলাম না। পাহারাদার প্লেনগুলো কুয়াশার জন্যে উড়তে পারছে না। কুয়াশা হালকা হওয়ার মুহূর্ত গুনছে তারা। প্লেনগুলো আকাশে উড়লেই সঠিক খবর পাওয়া যাবে। এমনকী সমুদ্রের তলদেশ পরিবর্তনের হদিশও পাওয়া যেতে পারে।

সামুদ্রিক শ্যাওলা ঝাঁঝি আর পচা মাছ, শামুক-ঝিনুকের গন্ধে চতুর্দিক ম ম করছে। যেদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় এই একই অবস্থা। সুতরাং এই গন্ধ থেকে পার পাওয়া একরকম অসম্ভব।

বুধবার দুপুরে কুয়াশা অনেক পরিষ্কার হয়ে গেল। সামনেই সমুদ্রের যে দৃশ্য ফুটে উঠল তা সত্যিই অবিশ্বাস্য অভূতপূর্ব। দুধের মতো সাদা সমুদ্র জল। সূর্যাস্তের পরে সেই সাদা জল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। সমুদ্র জলে ফসফরাসের ভাগ অত্যধিক বেড়ে যাওয়াই একমাত্র কারণ। এত ফসফরাস এল কোথা থেকে! সমুদ্রের তলায় আবার কি কোনও একটা আগ্নেয়গিরি ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।

দ্বীপের সমস্ত তটভূমি জুড়ে ভাঙাচোরা নানান জিনিসের যেন হাট বসেছে। জাহাজ নৌকার ভাঙা টুকরো কাঠ লোহা, ধ্বংসপ্রাপ্ত বয়ার অংশগুলো সামুদ্রিক গাছগাছড়া, ঝিনুক, প্রকাণ্ড বড় বড় মরা মাছ, কাঁকড়া, দেড় হাত লম্বা লম্বা চিংড়ি, আরও কত কী! একটা ভেটকির ওজন তো ছ-মণ হল। দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আমরা সবাই সামুদ্রিক জীবের মৃতদেহগুলোকে মাটি চাপা দিতে শুরু করলাম।

রাত্রিবেলায় যেন মন্ত্রবলে উধাও হয়ে গেল কুয়াশা। কালিমামুক্ত নির্মেঘ আকাশ চাঁদের আলোয় উপছে পড়ল। সাগর-পাহারাদার বিমানগুলো একে একে আকাশে উঠতে শুরু করল। পুরো তিনদিন পরে আবার নিয়মিত পাহারা শুরু হল।

পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে চোখ মেলতেই দেখি এক ঝলক নরম সূর্যালোক আমার ঘরে লুটিয়ে পড়েছে। সূর্যকে অনেক দিনের না-দেখা বন্ধু বলে মনে হল। কী মিষ্টি নরম রোদ্দুর!

বাইরে বেরিয়ে এলাম, একটু দূরেই সমুদ্র! তার নয়ন জুড়ানো নীলাভ রূপ এখনও ফিরে আসেনি। এখনও খড়ি-গোলা সমুদ্র জল। দু-একটা কালো কালো কোনও কিছুর ধ্বংসাবশেষ ঢেউয়ের দোলায় দোলায় ভাসছে। প্রখর সূর্যালোকে চারদিক ঝলমল করছে।

আরও দূরের সমুদ্র দেখার জন্যে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দূরবীনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠে পড়লাম। কিন্তু যে কে সেই। এক রূপ এক দৃশ্য। বয়াগুলোর চিহ্ন নেই কোনওখানে। প্রবল জলস্রোতে কোথায় ভেসে গেছে কে জানে। কয়েকদিন পরে অবশ্য নোঙর ছেঁড়া একটা বয়াকে পাঁচমাইল দূরে এক খাঁড়ি-পথে পাওয়া গেছিল।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে সমুদ্রবক্ষে যেন সাদা মেঘ জমতে শুরু করল। অবাক হয়ে ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, না ওগুলো মেঘ নয়–হাজার হাজার লাখ লাখ দুধ সাদা সমুদ্র-চিল ভীড় করেছে ওখানে। সমুদ্রের মধ্যে সেই ছোট্ট দ্বীপটার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওরা। এমন সময় দক্ষিণ দিক থেকে প্লেনের মৃদু গর্জন শোনা গেল। বুঝলাম, চিল-রহস্য ভেদ করার জন্যে একটি পাহারাদার বিমান এগিয়ে আসছে। দূরবীন দিয়ে দেখলাম, একটা নয়–দুটো প্লেন চক্রাকারে দ্বীপের ওপর ঘুরছে। বেশ কিছু সময় দূরে প্লেন দুটো ঘুরতে লাগল। মাঝে মাঝে কয়েকবার ছোঁ-মারার ভঙ্গিতে নিচে নামবার চেষ্টাও করল। কিন্তু কী জানি কী কারণে একটি প্লেনও দ্বীপের ওপর নামতে পারল না। ছাদ থেকে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম। এক্ষুনি অফিসে যেতে হবে। রেডিয়ো মারফত ওরা অবশ্য আমাকে খবর দেবে। তা সত্ত্বেও মৌসুমীকে আমার বাইরে যাবার পোশাক আনতে বললাম। ওদের মুখ থেকেই শুনতে হবে। দ্বীপের অজানা রহস্য আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগল।

দ্বীপের অধিকাংশ লোকই অফিসের চারদিকে ভীড় করেছে। সামনেই একখানা প্লেন দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি ওইদিকে এগিয়ে গেলাম আমি। আমাকে আসতে দেখে পাইলট নীলাদ্রি ককপিট থেকে নেমে এল। প্লেনটাকে ঘিরে চার-পাঁচজন উত্তেজিত স্বরে কী যেন আলোচনা করছে ওদের মধ্যে থেকে তড়িৎ আমাকে দেখে বলে উঠল, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, স্যার। আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারছি না। কী বলল না তোমরা। বলো না নীলাদ্রি কী দেখেছ?

নীলাদ্রি বলল, আপনারা যাই বলুন না কেন, আমি বলছি এ এক অসম্ভব ব্যাপার। সামুদ্রিক কোনও জীবই নয় ওটা!

কী, কী জীব নয়। ব্যাপার কী? সব খুলে বলো? আমার কণ্ঠে উত্তেজনার স্পর্শ।

অশেষ এখানকার সবচেয়ে পুরোনো পাইলট। সে এবার আমার সামনে এগিয়ে এসে বলল, নীলাদ্রি অনেক ওপরে ছিল বলে মনে হয় সবটা দেখতে পায়নি। প্রথমে মনে হয়েছিল একখানা জাহাজ বুঝি চড়ায় আটকে ভেঙে পড়েছে। এই ভেবে প্লেনটাকে আরও নিচে নামিয়ে ছিলাম। দ্বীপটা তো খুব ছোট, তা ছাড়া ওই জীবটাতেই প্রায় সবটা জুড়ে গেছে। তাই ল্যান্ড করতে পারিনি। কিন্তু নিচে নেমে কী দেখলাম জানেন? না, জাহাজ নয়। এমনকী আমাদের জানাশোনা কোন জীবও নয়!

মেজর চিন্তাহরণ মজুমদার কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সম্পর্কে আমার নিকট আত্মীয়। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথা জোড়া টাক। বেঁটেখাটো মানুষ।

মেজর মজুমদার বলে উঠলেন, যত সব গাঁজাখুরি গল্প। অন্যখানে এসব গল্প বলতে পার কিন্তু আমার কাছে নয়। আর তা ছাড়া আমার দেখতাই তো দু-দুবার এরকম হল। দুটো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তিমি এসে ভীড়েছিল ওই দ্বীপটায়। বেশ তো, আমার কথায় বিশ্বাস না হলে অফিসের রেকর্ডই দেখো না। তাই এবারেও ওটা তিমি ছাড়া আর কিছু নয়। তা নয় তো হবেই বা কী?

মেজর মজুমদারের কথায় কান না দিয়ে আমি বললাম, আচ্ছা, নীলাদ্রি তোমার কী মনে হয়?

কিছুক্ষণ মাথা চুলকালে নীলাদ্রি। কী বলবে ভেবে ঠিক করতে পারছে না। অনেকক্ষণ পরে বলল, হ্যাঁ, মজুমদার মশাইয়ের কথা সত্যি হতেও পারে। তবে ওটা যদি তিমি হয়, তবে বলতেই হবে এক অদ্ভুত তিমি। একেবারে সৃষ্টিছাড়া।

নীলাদ্রির কথা শেষ হতে না হতে অশেষ বলল, আমিও সঠিক করে কিছু বলতে পারব না। পাকা আমে মাছি বসার মতো সামুদ্রিক চিলে থিক থিক করছিল। প্লেনের গর্জনও ওদের নড়াতে পারেনি। তা সত্ত্বেও আমি বলব সচরাচর দেখা তিমির চেয়ে এ একেবারে ভিন্ন। তা ছাড়া লম্বায় প্রকাণ্ড এবং ধবধবে সাদা।

আরে, আমি তো আগেই বলেছি এটা একটা সাদা তিমি। তিমি কি সাদা হয় না নাকি?

তাহলেও এরকম কিম্ভুতাকৃতি বিশাল তিমি…।

থামো থামো হে ছোকরা! বলি মবি ডিকের নাম শুনেছো? নাম শুনেছ তিমি শিকারী হারপুনার নেডের। তাই বলি অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মতো সাদা তিমিও হয়। তোমাদের শেখার এখনও অনেক বাকি আছে। আমার স্থির বিশ্বাস অনেক বছরের তিমি ওটা।

অশেষ বলল, বুড়ো কী ছোকরা তা বলতে পারবো না, তবে তিমি কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।

মনে মনে বললাম, শুধু মজুমদার মশাই নন, আরও অনেকে এক কথাই বলবে। তা ছাড়া এখনও এখানে অনেক পাকা তিমিশিকারী আছে। তারা হয়তো ওটাকে তিমি বলেই চুপচাপ বসে থাকবে। কিন্তু সত্যি কি তিমি ওটা? অশেষ বা নীলাদ্রি তো ছেলেমানুষ নয়। তারা কি তিমি চিনতে ভুল করবে? আমার মনের মধ্যে রহস্যের দানা বাঁধতে শুরু করল। মনে হল এক্ষুনি একবার ছুটে যাই। তাই তাড়াতাড়ি অশেষ আর নীলাদ্রিকে ডেকে অফিসে চলে এলাম। আজকে বোধহয় হবে না, কিন্তু কালকেই ওই দ্বীপে যেতে হবে।

নীলাদ্রিকে জিজ্ঞাসা করলাম, প্লেন নামানো না যাক, স্টিমার বা বোট তো যেতে পারবে দ্বীপে। আমাদের বনরাণীকে প্রস্তুত থাকতে বল। কাল সকালেই ওখানে যেতে হবে।

কিন্তু স্যার, বনরাণী তো এখনও ডকে পড়ে আছে। ইঞ্জিনের কয়েকটা পার্টস চেঞ্জ করতে হবে।

এখনও হয়নি! দু-মাস তো হতে চলল। যাক বোট দুটো তো আছে!

না স্যার, তাও নেই। একটা তো ইনস্পেকটর সাহেব নিয়ে গেছেন। আর একটা একেবারেই অকেজো হয়ে গেছে।

উঃ অসম্ভব! অসম্ভব! কাজকর্ম সব ডকে তুলে দিতে হবে দেখছি। কাকে বলে বোট নিয়ে গেছে ইনস্পেকটর?

কেন স্যার, আপনি তো বলেছিলেন বোট নিতে!

ওঃ ওঃ তাই নাকি! তাহলে তো ভালোই হয়েছে। কিন্তু এখন যাই কী করে!

এত ভাবছেন কেন স্যার, মেজর সাহেবের তো তিন-তিনটে বোট আছে। আপনি চাইলেই…?

ব্যাস। যে কথা সেই কাজ। মেজরও বোধ হয় ঠিক এই কথাই ভাবছিল। সামনের লনে একটা ইজিচেয়ারে বসে মোটা চুরুট টানছিল। আমাকে দেখেই মেজর বলে উঠল, কী, এতক্ষণে মনে পড়ল? তুমি তো জানোই যে আমার তিনটে তিমি শিকারের বোট আছে। ইঞ্জিন থেকে আরম্ভ করে মায় যাবতীয় কিছু একদম নতুন। তা ছাড়া তিমি শিকারের প্রয়োজনীয় সব জিনিসই মজুত আছে।

মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সুতরাং আর কী! ভোর রাতে বেরতে হবে ঠিক হল। বেছে বেছে বেশ কয়েকজনকে খবর দেওয়া হল।

সত্যি, বেশ করিতকর্মা লোক মেজর মজুমদার। বোট তিনটে একেবারে নতুন। তিমি শিকারের হাতিয়ারগুলো ঝক ঝক করছে। দড়িদড়া সব প্রস্তুত। বোটে হাল বইঠারও বন্দোবস্ত আছে। ইঞ্জিন বিকল হলে হালের দ্বারাই বোট চালানো যায়। তিনটের মধ্যে দুটো বোট যাত্রার জন্য প্রস্তুত। আমি আর মেজর দু-জনে দুটো বোটে উঠলাম।

তীর থেকে দু-মাইল যেতে না যেতেই ভোর হয়ে গেল। প্রকাণ্ড বগী থালার মতো রক্ত লাল শিশু সূর্য দিগন্তের কোল ঘেঁষে সমুদ্রের মধ্যে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে আকাশে উঠতে শুরু করল। কেউ যেন মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে দিল সমুদ্রজলে। লালে লাল হয়ে উঠল চতুর্দিক।

ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন রোমাঞ্চ লাগছে সর্বশরীরে। সমুদ্রের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউয়ের দাপাদাপিও কমে আসছে। বোটের সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক মাছ চলেছে। একটু দূরে একটা ডলফিন আমাদের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে কোন অতলে ডুব দিল। আকাশ নির্মেঘ। দূর আকাশে শুকতারা এখনও জ্বলজ্বল করছে। জলের দিকে তাকালে মনে হয় বোট দুটো গতিহীন। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেজরের বোটের দিকে তাকালাম। ভোরের আলোয় কয়েকজনের হাতে রাইফেলের নল চকচক করে উঠল। ডাক্তার বিমল ঘোষ এবং মেজর মজুমদার তন্ময় হয়ে কী যেন আলোচনা করছে।

ছোট বিন্দুর মতো ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে দ্বীপটা। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধে ভোরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। সামুদ্রিক চিলের কর্কশ স্বরে চতুর্দিকে শান্ত নীরবতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পচা গন্ধ সন্দেহ নেই, কিন্তু তিমি পচা গন্ধের মতো মনে হল না। সমুদ্রের তলাকার বহু বছরের পাঁক পচা গন্ধের কথাই মনে পড়ল। আর কেন জানি না সমুদ্রের তলার কথা মনে পড়তেই বিরাট বিরাট সাপ অক্টোপাস এবং আরও কত জীবজন্তুর কথা মনে পড়ল।

বোধহয় সমস্ত সামুদ্রিক চিল জড়ো হয়েছে এখানে। দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রজল সাদা দেখাচ্ছে ওদের জন্যে। এত ভীড় জমেছে যে ভালো করে কেউ উড়তেই পারছে না। তা সত্ত্বেও তীরের কাছে পড়ে থাকা জীবটাকে একেবারে ঢেকে ফেলেছে ওরা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাখির পালকে তৈরি বিরাট একটা কিছু পড়ে আছে যেন। জীবটা যে কী তা কিন্তু মোটেই বুঝতে পারলাম না। কোনও অনুমানও মাথায় এল না। জানা-অজানা নানান জীবজন্তুর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, কোনও মিল খুঁজে পেলাম না। কিন্তু যা-ই হোক না কেন জীবটা যে একেবারে সৃষ্টিছাড়া অদ্ভুত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না।

আমার বোটটা প্রথমে ছিল। তিন দিক ঘুরে ভালো একটা জায়গা দেখে বোট ভেড়ানো মনস্থ করলাম। দ্বীপটার চতুর্দিকে বড় বড় সামুদ্রিক ঘাসের বন। এক-এক জায়গায় ঘাসগুলো এত লম্বা এবং ঘন যে একটা মানুষ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। ঘাসের বনের মধ্যে দিয়ে একটানা হাওয়া বয়ে যাওয়ায় অনবরত সর সর করে আওয়াজ হচ্ছে। একেবারে কাছে না আসা পর্যন্ত চিলেরা উড়ল না। কিন্তু ওরা উড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এ আমি কী দেখলাম! এ কি স্বপ্ন! আমি জেগে আছি তো! দু-হাতে চোখ দুটোকে রগড়ে নিলাম একবার।

দ্বীপটার চড়ার ওপর এক বিশাল মানবদেহ উবু হয়ে পড়ে আছে। একদিন ধরে চিলদের ঠোকরানি সত্ত্বেও মানুষের দেহ বলে চিনতে একটুও অসুবিধা হল না। হ্যাঁ, মাথা থেকে পা পর্যন্ত যথার্থভাবেই মানুষ। লম্বায় ষাট ফুটের কম হবে না। দুই কাঁধের বিস্তৃতি কম করেও পনেরো ফুট! সমস্ত শরীর পুরু চর্বিতে ঢাকা। চর্বির তলায় ধূসর রঙের গায়ের চামড়া দেখা যাচ্ছে। একটু অন্যমনস্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোটটা মৃতদেহের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। ফলে জলের ওপর ভেসে থাকা থামের মতো মোটা প্রকাণ্ড হাতটা বোটটার গায়ে এসে ঠেকলো। সমস্ত হাতটা পচে ফুলে উঠেছে। হাতের পাঁচটা আঙুল ব্যাঙের মতো পুরু মোটা চামড়া দিয়ে জোড়া। ধারাল অস্ত্রের মতো তীক্ষ্ণ লম্বা লম্বা নখগুলো।

ঠিক এই সময়ে মেঘের আড়ালে ক্ষণিকের জন্যে ঢাকা পড়ে গেল সূর্য। চতুর্দিক কেমন যেন বিষণ্ণ আবছায় ভরে উঠল। একটা দমকা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। পচা দুর্গন্ধে সমস্ত গা গুলিয়ে উঠল। মনে হল নিঃশ্বাস বোধহয় বন্ধ হয়ে এল। হাজার হাজার সামুদ্রিক চিলের কর্কশ চীৎকার অসহ্য মনে হল। সমস্ত পরিবেশটা কেমন যেন ছমছমে। মনের মধ্যে কেউ যেন কু গেয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি মৃতদেহ থেকে বেশ কিছু দূরে সমুদ্রের মধ্যে চলে এলাম।

ঝাঁকে ঝাঁকে চিল দেহটার ওপর বসছে আর উঠছে। লম্বা লম্বা তীক্ষ্ণ ঠোঁটের ঠোকরে সমস্ত শরীর জুড়ে গর্ত হয়ে যাচ্ছে। চর্বি ফুটো করে ধূসর রঙের চামড়ার নিচে থেকে লাল মাংস ঠুকরে ঠুকরে তুলে নিচ্ছে ওরা।গর্তগুলোর চারপাশে চর্বির ওপর লাল লাল ছোপ লাগছে। মাংসের টুকরো নিয়ে নিজেরাও কাড়াকাড়ি মারামারি করছে।

পায়ের পাতা দুটো আর মাথাটা জলের ওপর ভাসছে। শরীরের নিম্নভাগ দেহের তুলনায় অনেক বড় এবং বলিষ্ঠ। বিরাট চওড়া পায়ের পাতা। হাত দুটো যেমন লম্বা তেমনি পেশিবহুল এবং কর্মক্ষম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পায়ের আঙুলগুলোও হাঁসের মতো পুরু মোটা চামড়া দিয়ে জোড়া। বিরাট গোলাকৃতি মাথা। শক্ত স্টিলের তারের মতো লম্বা লম্বা মাথায় চুলগুলো ঢেউয়ের দোলায় দোলায় জলের ওপর ভাসছে। চুলগুলোতে এখনও গভীর সমুদ্রের কালচে শ্যাওলায় মাখামাখি। কানের কোনও চিহ্ন নেই কোনওখানে। কানের জায়গা দুটো পাতলা লাল চামড়া দিয়ে ঢাকা। চিবুকের ঠিক নিচে গলার কাছে কানকোয় ঢাকা লাল ফুলকো দেখা যাচ্ছে। মৃতদেহ পচে যাবার জন্যে ফুলকোর রংটাও মেটে মেটে হয়ে উঠেছে। তাও আবার চিলেদের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত।

অতলস্পর্শী গভীর সমুদ্র থেকে ছিটকে পড়া এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য মানুষ ছাড়া এ আর কিছু নয়। সমুদ্রে গভীর অভ্যন্তর মানুষের কাছে এখনও রহস্যাবৃত। চির অন্ধকারময় রাজত্বের কোনও পরিচয় আমাদের জানা নেই। ভূমিকম্পের প্রচণ্ড আলোড়নেই মানুষরূপী এই জীবটা দ্বীপের উপর এসে পড়েছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সমুদ্র যেন তার অন্তরের বহুমূল্য বিস্ময়কর এক সন্তানকে পৃথিবীর কাছে উপহার পাঠিয়েছে। সমুদ্রের গভীরতার ছাপ ওর সর্বাঙ্গে। কিন্তু শরীরে দু-পাশে এবং বাঁ পায়ের দাবনার ঠিক ওপরে ও কীসের দাগ? হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। খুব ভালো করে চিনি ওগুলোকে। শুধু আমি কেন, এখানে যারা আছে প্রত্যেকের কাছে পরিচিত ওই ক্ষতচিহ্ন। একবার যে দেখেছে, জেনেছে। সে কোনওদিনও ভুলতে পারবে না। প্রতিটি তিমির দেহেই প্রায় এই রকম ক্ষতচিহ্ন থাকে। ক্র্যাকেরাই যে এর জন্য দায়ী সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। গভীর সমুদ্রের অন্ধকার ঠান্ডা জলের এক বিশেষ দৈত্যাকৃতি সাদা স্কুইডদেরই নাম ক্র্যাকেন। একমাত্র তিমি ছাড়া আর কোনও প্রাণীই অত গভীরে যেতে পারে না।

হঠাৎ মেজর মজুমদারের চীৎকারে চিন্তাজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। চেয়ে দেখি মৃতদেহের দুই কাঁধের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মেজর চিন্তাহরণ মজুমদার। ওর পেছনে প্রদোষের মুখখানা দেখা যাচ্ছে। শুধু প্রদোষ নয়, আরও দু-জনকে দেখতে পেলাম। আমিও বোট নিয়ে তীরের দিকে এগিয়ে যাব ভাবছি, ঠিক এমনি সময়ে আবার মেজরের আর্ত চীৎকার ভেসে এল। নিজের অজান্তে বোটের ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দিলাম। দ্বীপটার দক্ষিণ দিকে এক বিরাট এলাকা জুড়ে সমুদ্র জল তোলপাড় হচ্ছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওই দিকে চেয়ে রইলাম। মেজর মজুমদার আর প্রদোষ সান্যাল এখনও দেহটার ওপরে দাঁড়িয়ে। এখনও কেন নেমে আসছে না ওরা? কী দেখে চীৎকার করে উঠল মেজর।

ও কী! সেই প্রচণ্ড আলোড়নের মধ্যে থেকে এক প্রকাণ্ড হাঁড়ির মতো মুখ ভেসে উঠল। মাথা ভরতি তারের মতো শক্ত লম্বা লম্বা চুলগুলো সারা মুখ বেয়ে জলের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। মুখের ওপর চুল পড়া সত্ত্বেও কালো ড্যাবডেবে গোলাকৃতি চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। দুটো চোখের মাঝে নাকের কোনও অস্তিত্ব নেই। তার বদলে দুধ-সাদা থলথলে মাংস ঝুলছে। ঠিক তার নিচেই প্রকাণ্ড এক মুখগহ্বর। ছুরির মতো তীক্ষ্ণ মুক্তোর মতো দাঁতগুলো সূর্যালোকে ঝকঝক করে উঠল। গলার কাছে কানকোটা খপ খপ করে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। জল থেকে মাথাটা আরও ওপরে উঠল। এবার হাঁ করে নিঃশ্বাস নিল জীবটা। হাঁ করবার সময় স্পষ্ট দেখলাম, একহাত লম্বা জীবটা লক লক করে উঠল।

আস্তে আস্তে দ্বীপটির কাছে অগভীর জলের মধ্যে এসে দাঁড়াল জীবটি। আমার থেকে ওর দূরত্ব বোধহয় পঞ্চাশ গজ হবে। মনে হল, ওর কাছ থেকে আরও কিছু দূরে সরে যাওয়া উচিত। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। গ্যাস লিভারটি টেনে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু দূরে চলে এল বোটটা। কিন্তু আমাদের দিকে ভুলেও তাকাল না জীবটি। জলের সীমারেখা এখন ওর বগল পর্যন্ত। এবার কোমর পর্যন্ত জলের বাইরে জেগে উঠল। সর্বাঙ্গে দৃষ্টিপাত করতেই বুঝতে পারলাম যে, দ্বীপের চড়ায় পড়ে থাকা মৃত মানুষটিরই প্রণয়িণী এ। নিজ দয়িতের খোঁজে সমুদ্রের অন্তঃস্থল থেকে পৃথিবীর ওপরে উঠে এসেছে মানবীটি।

মেজর আর প্রদোষ উলটোদিক থেকে বোটে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। দেখলাম, মেজর বোটে উঠে পড়ল কিন্তু পা পিছলে ঝপাং করে জলে পড়ে গেল প্রদোষ। ওদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়াল মানবীটি। হাঁটু পর্যন্ত এখনও জলের তলায়। লম্বায় চওড়ায় মৃত মানুষটিরই সমকক্ষ ও। বড় বড় গোলাকার চোখ দুটো কয়েক মুহূর্তের জন্য মৃতদেহটির ওপর স্থির হয়ে রইল। তারপর অস্থির হাতে মৃতদেহের দু-কাঁধ ধরে সজোরে ঝাঁকুনি দিল।

হঠাৎ মেজর মজুমদারের বোটের দিকে ফিরে দাঁড়াল ও। প্রদোষ এখনও জলের মধ্যে হাঁকপাঁক করছে। বোটটাও ওকে তুলে নেবার জন্যে এখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জলের অগভীরতার জন্যে আরও কাছে এগিয়ে আসতে পারছে না বোটটা। ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। মনে হল এই বুঝি আক্রমণ করল। কয়েকটা অবশ্য রাইফেল আছে আমাদের, কিন্তু ওই দেহের তুলনায় রাইফেল তো শিশু। অন্য অস্ত্রের মধ্যে কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল অফিসে। কিন্তু এই অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির কথা কে আগে কল্পনা করতে পেরেছিল?

কিন্তু না, আক্রমণ করল না। আবার মৃতদেহটির দিকেই ফিরে তাকাল। ওর ব্যবহারে মনে হল যে ওর কাছে একমাত্র সত্যি ওই মৃতদেহ। আমাদের উপস্থিতি নগণ্য। কিন্তু শিকারের প্রবৃত্তি বোধ হয় মানুষের জন্মগত। ক্ষতি করুক বা নাই করুক, সময় সুযোগ পেলেই মানুষ হত্যার আনন্দে মেতে ওঠে। বিচার করে না এই হত্যায় তার কী লাভ? হারপুন ছুঁড়তে ওস্তাদ নিখিলেশ তিরের মতো বেগে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চক্ষের পলকে দেখলাম তিমি শিকারের ভারী কুড়লটা ওর হাতে চকচক করছে। আমি বাধা দেবার আগেই কুড়ুলটি সামনের দিকে সজোরে নিক্ষেপ করল নিখিলেশ। মুহূর্তের মধ্যে সাগর-মানবীর মাংসল নগ্ন কাঁধের উপর আমুল বিঁধে গেল। সঙ্গে সঙ্গে লাল রঙের ফোয়ারা উঠল। শ্বেত শুভ্র দেহের ওপর দিয়ে লাল রক্তের ধারা এসে মিশল সমুদ্র জলে। যন্ত্রণায় সাগর-মানবী এক দুর্বোধ্য ভাষায় চীৎকার করে উঠল। যন্ত্রণার চীৎকারের বোধহয় কোনও ভাষা নেই। সে চীৎকার শুনলেই বোঝা যায় কী করুণ মর্মান্তিক তার আবেদন। তারপর ডান হাত দিয়ে অবলীলাক্রমে কুড়লটা খুলে ফেলল ও।

কিন্তু তবুও আমাদের আক্রমণের কোনও চেষ্টা করল না সে। পরন্তু নিচু হয়ে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল মৃতদেহটাকে। নিজের কাঁধের রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল মৃতদেহটি।

ইতিমধ্যে মেজরের বোটের কাছাকাছি সমুদ্রটা উত্তাল তরঙ্গে ফুলে উঠে হঠাৎ কী রকম যেন সাদা হয়ে গেল। একটা বিশাল মোটা লম্বা শুড় জলের ওপর ভেসে উঠল। কেউ কোনও কিছু বোঝবার আগেই শুড়টা মেজরের বোটের গলুইটা আঁকড়ে ধরল। কয়েক ইঞ্চির জন্য বেঁচে গেল চিন্তাহরণ মজুমদার।

বোধহয় কয়েক মুহূর্ত হবে। তারপর এক দৈত্যাকৃতি বীভৎস সাদা দেহ সমুদ্রের ঢেউ ভেদ করে জেগে উঠল। তীব্র জিঘাংসায় জ্বলজ্বল করে উঠল টেনিস বলের মতো কালো কালো চোখ দুটো। টিয়া পাখির মতো কোনো সাদা ঠোঁটটা ছুরির মতো ঝিকিয়ে উঠল। দেহটার চারপাশে অনেকগুলো দুধ-সাদা কুৎসিত লম্বা লম্বা গুঁড়গুলো কিলবিল করতে শুরু করল।

আমি চীৎকার করে উঠলাম, ক্র্যাকেন। ক্র্যাকেন। গভীর সমুদ্রের শয়তান!

কেমন এক কটু জান্তব গন্ধে চতুর্দিক আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। সাগর-মানবীও কয়েক মুহূর্ত এই গন্ধ অনুভব করার চেষ্টা করল। তারপর বুক থেকে মৃতদেহটা নামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে সাগর-মানবীর বিরাট দেহটা ধনুকের মতো বেঁকে সমুদ্রে জল স্পর্শ করল। ক্র্যাকেনের গোল গোল চোখ দুটোও ওর দিকে স্থির হয়ে দাঁড়াল। সাগর-মানবীর সর্বাঙ্গে ভয়ের কোনও চিহ্ন নেই। কী এক অজানা উত্তেজনায় সমস্ত দেহটা ফুলে ফুলে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্যামুক্ত ধনুকের মতো লাফ দিয়ে উঠল বিরাট দেহটা। সঙ্গে সঙ্গে ক্র্যাকেনের লম্বা লম্বা শুড়গুলো একসঙ্গে সজোরে জড়িয়ে ধরল ওকে। প্রচণ্ড চাপে সাগর মানবীর সাদা দেহে মাংস কেটে বসে গেল শুড়গুলো।

ওঃ, কী প্রচণ্ড শক্তি ধরে সাগর-মানবী! ক্র্যাকেনের রবারের মতো শরীরটা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরল ও। দুই হাতের এবং নগ্ন পিঠের মাংসপেশিগুলো ফুলে ফুলে উঠল। প্রকাণ্ড বড় হাঁ করে একবার নিশ্বাস নিল সাগর-মানবী। তারপরেই দৈত্যাকৃতি ক্র্যাকেনের দেহটা চড় চড় করে ছিঁড়ে ফেলল। ক্র্যাকেনও কিন্তু মরণ-কামড় দিতে ছাড়ল না। শুড়ের ডগায় সাকিং প্যাডগুলো শরীরের যেখানেই স্পর্শ করল সেখানেই চাপ চাপ মাংস তুলে নিল। একটা শুড় তখনও ওর কোমর বেষ্টন করে রইল। আর একটা সাকিং প্যাড ওর রক্ত-লাল ফুলকোর ওপর চেপে বসার জন্য ইতস্তত দুলতে লাগল।

এবার দু-পা ফাঁক করে দাঁড়াল সাগর-মানবী। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য বিশাল উন্নত নগ্ন স্তন দুটো হাপরের মতো ওঠা নামা করতে লাগল। সমস্ত শরীরটা ঋজু হয়ে চাবুকের মতো একটু পেছনে বেঁকে গেল। দু-পায়ে দাবনার কাছের মাংসপেশিগুলো মোটা দড়ির মতো ফুলে উঠল। তারপর চোখের নিমেষে টেনিস বলের মতো ক্র্যাকেনের চোখ দুটো গায়ের সমস্ত শক্তিতে দু-হাতে চেপে ধরল ও। সঙ্গে সঙ্গে চোখের মণি দুটো সশব্দে গলে গেল। তখন চোখ ছেড়ে ডান হাত দিয়ে টিয়া পাখির মতো ঠোঁটটাকে উপড়ে ছিঁড়ে নিয়ে এল সাগর-মানবী। মৃত্যু যন্ত্রণায় সমস্ত গঁড়গুলো দাপাদাপি করতে শুরু করল। সাগরজলের তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে আস্তে আস্তে ক্র্যাকেনের ছিন্নভিন্ন দেহটা শান্ত হয়ে এল।

জয়ীর মতো দৃপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটু অবধি জলের মধ্যে মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল সাগর-মানবী। দু হাতের মধ্যে এখনও কয়েকটা শুড় অল্প অল্প করে নড়ছে। কিছুক্ষণ ভালো করে দেখে দূর সমুদ্রের মধ্যে ছুঁড়ে দিল ওগুলোকে। গোল গোল চোখ দুটো এবার আমাদের দিকে স্থির হয়ে দাঁড়াল। সুতীব্র প্রতিহিংসায় ধক ধক করে জ্বলছে যেন। আমার বোটের কয়েকজন এই দৃশ্য সহ্য করতে পারল না। তাড়াতাড়ি দু-হাতে চোখ চাপা দিল তারা। আর আমাদের রক্ষা নেই। কাঁধের ক্ষত দিয়ে এখনও রক্ত গড়াচ্ছে। ডান হাতটা ক্ষতর ওপর চেপে ধরে চোখের সামনে রক্তমাখা হাতটা মেলে ধরল সাগর-মানবী। তারপর আমার বোট লক্ষ করে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিল।

আমার সামনে সমুদ্রজলের মধ্যে ওর চওড়া কাঁধটা ভেসে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে আমার বোটের ইঞ্জিনঘরটা শক্ত করে ধরে এক টান মারল! সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই ছিটকে জলের মধ্যে পড়ে গেলাম। পরক্ষণেই মড় মড় করে বোট ভাঙার আওয়াজ পেলাম। ঘাড় উঁচু করে দেখলাম বোটের কোনও অস্তিত্ব নেই। শুধু কয়েকটা কাঠের টুকরো ঢেউয়ের দোলায় দোলায় ভাসছে। সাগর-মানবীর চোখ দুটো জলের মধ্যে আমাদের খুঁজে ফিরতে লাগল। দ্রুম! দ্রুম। দ্রুম! নীলাদ্রির রাইফেল গর্জে উঠল। মেজর মজুমদারের বোটে ছিল নীলাদ্রি। দেখলাম, একা ও নয়, আরও জনাতিনেক রাইফেল নিয়ে দ্বীপের ওপর নেমে পড়েছে। আমাদের ছেড়ে পাগলা হাতির মতো দ্বীপের দিকে ছুটে গেল সাগর-মানবী। পরমুহূর্তে নীলাদ্রিকে বেড়াল-ছানার মতো ওর হাতে দুলতে দেখলাম। কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সমুদ্রের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলে ওকে। বাকি তিনজন এই অবসরে সমুদ্রতীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে গিয়ে এক নাগাড়ে গুলি করতে শুরু করল। সাগর-মানবীর সমস্ত শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। রক্তের বন্যা নামছে সর্বাঙ্গে। কিন্তু তবুও সাগর-মানবী প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

আর প্রতিশোধের চেষ্টা নয়। মৃত প্রণয়ীকে অবলীলাক্রমে বুকের মধ্যে তুলে নিল সে। রাইফেলগুলো নিরবিচ্ছন্নভাবে গর্জন করে চলেছে। প্রতিটি শব্দ এক-একটি নতুন রক্ত বন্যার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই ওর।

কিন্তু এ কী দেখলাম! মৃত প্রণয়ীর মুখের ওপর নিজের মুখটা চেপে ধরে সাগর মানবীর প্রকাণ্ড কুৎসিৎ দেহটা কোন এক অবরুদ্ধ আবেগে ফুলে ফুলে উঠতে শুরু করল। অবরুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়েছে এই গ্রহের এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়। আমি যেন কীরকম হয়ে গেলাম। মৌসুমীর কাজল কালো জলভরা চোখ দুটো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। এক নিমেষেই পৃথিবীর সমস্ত ব্যথা-বেদনার সমভাগী হয়ে পড়লাম। দু-হাত তুলে চিৎকার করে ওদের গুলি করতে নিষেধ করলাম। হয় আমার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বের হল না, নয়তো হাওয়ার বিপরীতে থাকায় শুনতে পেল না ওরা। মুহুর্মুহু অগ্নিবর্ষণ করে চলেছে রাইফেল তিনটে। সাগর-মানবীর নগ্ন দেহ জুড়ে অজস্র ধারায় রক্তের বন্যা নামছে। কান্নার আবেগে থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে সর্বাঙ্গ। মৃতদেহ বুকে আঁকড়ে ধরে সমুদ্রের গভীরে নেমে যেতে শুরু করল ও। ধীরে ধীরে সাগর জল বুক ছাপিয়ে উঠল। দেহের রক্তে সমুদ্রের জল লাল হয়ে উঠছে। তারপর আস্তে আস্তে ঢেউয়ের তলায় তলিয়ে গেল দেহ দুটো। মৃত প্রণয়ীকে বুকে নিয়ে কোন অতলে তলিয়ে গেল কে জানে!

এক সময়ে তটভূমি স্পর্শ করেছিল বোটটা। কেমন এক বিষাদাচ্ছন্নতায় আমি মগ্ন হয়ে ছিলাম। মানস চক্ষে ভেসে উঠছিল চির অন্ধকারময় সুগভীর সাগরতল মানবীর বুক ভাঙা কান্নায় যেন ফুলে ফুলে উঠছে! দুমড়ে মুচড়ে উঠছে সমস্ত বিশ্ব। আর সেই হৃদয় মথিত হাহাকারই যেন সাগরের ঢেউ হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। কোনও এক অবরুদ্ধ আবেগে কঠিন শক্ত বেলাভূমির ওপর আছড়ে পড়ছে ঢেউগুলো।

ডাক্তারের ডাকে তন্ময়তার ঘোর কেটে গেল।

কী হল সেন সাহেব! এখনও যে ঘোর কাটেনি দেখছি!

 ন্-না তা নয়। তবে কী জানেন, মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। আমাদের তো প্রথমে কোনও ক্ষতি করেনি। তাই কেবলই মনে হচ্ছে গুলি করে ভালো করিনি আমরা। গুলি না করলেই বোধহয় ভালো হত।

তা মন্দ বলনি। তবে উত্তেজনাই সব নষ্টের মূল কিনা। যাক, আজ সন্ধেবেলায় আমার বাড়িতে আসুন না। কিছু গল্পগুজব করা যাবে।

সন্ধেবেলায় ডাক্তারের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। দেখলাম, শুধু আমি একা নই, আরও অনেক এসেছেন। সকলের মুখেই বিচিত্ৰদৰ্শন সাগর-মানবীর কথা।

কী ব্যাপার। ডাক্তার কোথায়? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

আসুন স্যার, আসুন। ডাক্তারবাবু ল্যাবরেটরিতে রয়েছেন। একটু বসতে বলেছেন আমাদের। খুব সহজভাবে বলল নীলাদ্রি। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। চাকর রঘু এক প্লেট কাজু আর কফির পট নামিয়ে রাখল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে ডাক্তার ঘরে ঢুকল।

অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের বসিয়ে রেখেছি বলে আমি ক্ষমা চাইছি। একটা বিশেষ কাজে আটকে পড়তে হয়েছিল।

তাতে কী হয়েছে। বসুন, বসুন।

সকলের মুখের দিকে একবার তাকাল ডাক্তার। তারপর কী যেন চিন্তা করতে করতে বলল, আচ্ছা, আজ সকাল যে জীবটাকে আমরা দেখেছি ওটার সম্বন্ধে কেউ কিছু ভেবেছেন আপনারা? কোথা থেকে এল, মানুষের মতো দেখাতেই বা হল কেমন করে?

না, সেরকম করে কিছু ভাবিনি। তবে আমার তো মনে হয় সাগরের তলায় অনেক না জানা জীবদেরই একজন।

অশেষ বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল শিলাকান্থ মাছ আজ থেকে বহু লক্ষ বছর আগেই পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই তো কয়েক বছর আগে প্রথম একটা শিলাকান্থ মাছ ধরা পড়ায় বিজ্ঞানী মহলে সাড়া পড়ে যায়। তারপরে তো বেশ কয়েকটাই ধরা পড়েছে। এটাও হয়তো সে রকম কিছু হবে।

নীলাদ্রি বলল, আরে না না। শিলাকান্থ নাম তো বইতে ছিল। কিন্তু এ তো একেবারে নতুন। অবশ্য এও হতে পারে এই জীবগোষ্ঠী হয়তো বিজ্ঞানীদের নজরের বাইরে ছিল। আমার কিন্তু অন্যরকম মনে হয়। কোনও এক পাগলা বিজ্ঞানীর কাণ্ড এটা। আইল্যান্ড অব ডক্টর মোরোর মতো ব্যাপার আর কী! হয়তো তিমি এবং মানুষ জুড়ে এক নতুন অভিনব জল-মানব সৃষ্টি করার চেষ্টার ফল এটা। এখন তো এখানে ছোটখাটো জঙ্গল ঘেরা দ্বীপের অভাব নেই।

বাঃ! বেশ সুন্দর কথা বলেছ তো হে। প্রফেসর মিত্র তারিফ করে উঠলেন, আমরা তো এ লাইনে কেউ চিন্তাও করিনি। হ্যাঁ, তাহলে আশপাশে দ্বীপগুলো খুঁজলেই সব কারসাজি বেরিয়ে পড়বে।

আরও অনেকে অনেক রকম সম্ভাবনার কথা বলল। ডাক্তার এ পর্যন্ত কোনও কথা বলেনি। একপাশে বসে নির্বিকারভাবে একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলেছেন। মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে বিচিত্র এক হাসির রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি বললাম, অনেকে তো অনেক কথাই বললে। এবার ডাক্তার তুমি কিছু বলো।

সবাই একবাক্যে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। ঠিক বলেছেন।

 ডাক্তার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। হাতের আধপোড়া সিগারেটটা ছাইদানিতে খুঁজে দিয়ে নির্বিকারভাবে নতুন একটা সিগারেট ধরাল।

হ্যাঁ, এইবার আমি এমন কিছু বলব যা শুনে আপনারা ভাববেন হয় আমি পাগল, নয়তো সুযোগ পেয়ে এক আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসেছি। তবে যা সত্যি বলে জেনেছি, তার ওপর ভিত্তি করেই এই অনুমানে আসতে বাধ্য হয়েছি আমি। প্রথমে নিজের মনকেই অবিশ্বাস হয়েছিল। কিন্তু দেখলাম, এখনও অনেক জানার বাকি আছে আমাদের।

আমরা তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম। আমার মন এই বুক এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়েরই আশংকা করছিল।

হ্যাঁ, এইবার আসল কথায় আসি। তোমরা শুনে আশ্চর্য হবে যে প্রথমেই ওই প্রকাণ্ড মৃতদেহের ওপরে উঠে সবার অলক্ষ্যে এক টুকরো মাংস কেটে নিয়েছিলাম। কেন জানি না মনে হয়েছিল যে এক টুকরো মাংস ল্যাবরেটরিতে অ্যানালিসিস করলে হয়তো কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে। মাংস টুকরোটুকুর কেমিকেল অ্যানালিসিস করেছি। সেল স্ট্রাকচার, মলিকিউলার স্ট্রাকচার এমনকী সেলের নিউক্লিয়াস, ক্রোমোজম, জিনস প্রভৃতিও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছি। প্রতিটি বিশ্লেষণই এক কথাই বলে। বলে আমাদের মানব-গোষ্ঠীদের সঙ্গে ওই সাগর-মানবদের শরীর গঠনে বিশেষ কোনও তফাত নেই। আমাদের মতোই ওরাও মানুষ।

যাক, সিদ্ধান্তের কথায় পরে আসছি। তার আগে এক অদ্ভুত কথা বলি। মাংস টুকরোটুকুর সঙ্গে যে চামড়া লেগেছিল তাতেও ক্র্যাকেনের ক্ষতচিহ্ন ছিল। আবার ক্র্যাকেনদের শরীরেও অনুরূপ অনেক ক্ষতচিহ্ন আছে। এই দেখে মনে হয় ক্র্যাকেন আর সাগর-মানবরা পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। মানে, পরস্পর পরস্পরের দেহস্থিতি মাংস খেয়েই জীবন ধারণ করে। কারণ সমুদ্রে অত গভীরতায় চির অন্ধকারময় রাজত্বে আর অন্য কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। কেবলমাত্র তিমিরাই মাঝে ওই গভীরে চলে যায়।

ডাক্তার কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করল। সমস্ত ঘরে এক নির্বাক নিস্তব্ধতা। সকলে সব অসম্ভবের সীমারেখায় দোলায়মান।

ডাক্তার সকলের মুখের দিকে চেয়ে আবার বলতে শুরু করল।

 মাংস আর চামড়াটা মানবদেহেরই শুধু তাই নয়, রক্তটাও একেবারে আমাদের রক্তের মতো৷ কেবল সমুদ্রজলে থাকার ফলে সমতা বজায় রাখার জন্যে নুনের ভাগটা একটু বেশি। আচ্ছা, আপনারা একটু বসুন। আমি এক্ষুনি আসছি।

আমাদের বসিয়ে রেখে দ্রুতপায়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। প্রফেসর মিত্র বললেন, না, এ যে দেখছি সব ধোঁয়া ধোঁয়া। কিন্তু এও কি সম্ভব? আমাদের সঙ্গে সমুদ্র-মানুষের কোনও তফাত নেই। রক্ত মাংস এমনকী সেলের গঠন রীতিও অবিকল এক!

কেউ কোনও কথা বলল না। সবাই যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সকলের মনেই এক চিন্তা এক ভাবনা। এও কি সম্ভব?

একটা মোটা বই নিয়ে ডাক্তার ঘরে ঢুকল। বইটা আমার সামনে টেবিলের ওপর রেখে বলল, বইয়ের চিহ্ন দেওয়া জায়গাটা খুলুন তো! দেখুন, ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারেন কি না!

তাড়াতাড়ি বইটা খুলে ফেললাম। বইটা কাল্পনিক কিছু ফসিলের ছবি দিয়ে প্রাণী জগতের বিবর্তনবাদ সম্পর্কে আলোচনা। আমি যেখানটা খুললাম সেটা দু-পাতা জোড়া এক কাল্পনিক ছবি। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর আগের পৃথিবী চারিদিকে কিম্ভুতকিমাকার জীবজন্তু। এদের কিছু কিছু নাম আমার জানা। ছবির ঠিক মাঝখানে আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে থেকে আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষ ডাঙায় উঠে আসছে। কিন্তু এর সঙ্গে সাগর-মানবের সম্পর্ক কী? সাগর- মানবের উৎপত্তির রহস্য কি আছে কোনওখানে?

আপনারা জানেন যে আমাদের এই গ্রহে প্রথম সেলের জন্ম বা প্রাণের বিকাশ হয় সাগরের জলে। প্রাণ সূচনার শুভ মুহূর্ত থেকে বহু যুগ কেটে গেছে। তারপর বিবর্তনের ধারায় এক দুর্লভ মুহূর্তে জল ছেড়ে ডাঙার দিকে যাত্রা শুরু করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষ। তার ফলেই তিন ভাগ জলের মধ্যে একভাগ স্থলভূমির উপর শুরু হয়েছিল প্রাণের লীলাচাঞ্চল্য। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি শাখা ডাঙায় উঠে সাগরের জলের অতল গভীরে অভিযান শুরু করেছিল। স্থলভূমির ওপর বিবর্তন ধারার সঙ্গে সঙ্গে গভীর সাগরে চির অন্ধকার জগতেও বিবর্তনের বিস্ময়কর অবিশ্বাস্য লীলা শুরু হয়েছিল। স্থলভূমির ওপর জীবন ধারণের প্রয়োজনে প্রাণীদের যে সমস্ত দৈহিক পরিবর্তন এবং পরিবর্জন হয়েছে, সাগর-মানবেরও সমুদ্রের গভীরে অন্ধকার বক্ষে বসবাসের উপযোগী শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে। তাই এত গভীরে জলের অকল্পনীয় চাপ এবং শৈত্যের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যেই সাগর-মানবদের দেহ বিশাল প্রকাণ্ড হতে হয়েছে এবং চামড়ার ওপর পুরু চর্বির আস্তরণের সৃষ্টি হয়েছে। মহাকাশের দিকে হাত বাড়িয়েছি আমরা। চাঁদে নামব, না মঙ্গলে নামব সেই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নক্ষত্রলোক জয়ের পরিকল্পনা করছি। কিন্তু আমাদের সামনে যে অসীম জলরাশি রয়েছে, তার কতটুকু খবর রাখি আমরা? সমুদ্রের আর এক নাম তো রত্নাকর। কিন্তু এত জেনেও সমুদ্র সম্বন্ধে গবেষণা আজও পিছিয়ে আছে। পিছিয়ে আছে বলেই জীবজগতের এক মহামূল্যবান বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত আজও সমুদ্রের গভীরে ঢাকা পড়ে আছে। তাই মনে হয়, আর কয়েকদিন বাদে আমাদেরও এই ঘটনাকে কেমন যেন অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। অন্য লোকেরা তখন হয়তো আমাদের পাগল বলেই উড়িয়ে দেবে। অভূতপূর্ব অবিশ্বাস্য এক জীবনধারাও অপরিচয়ের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাবে।

ডাক্তারের কথা শেষ হলেও শেষ রেশটুকু সারা ঘরের মধ্যে গমগম করতে লাগল। আমরা নির্বাক হয়ে ডাক্তারের স্লান মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ছাইদানী থেকে একটা সরু ধোঁয়ার রেখা তালগোল পাকিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল।

[প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!
 জুন ১৯৬৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *