০৬. সামান্য চারটে অক্ষর

০৬.

স্বাধীনতা। সামান্য চারটে অক্ষরের মধ্যে কী বিপুল শক্তি নিহিত আছে কে জানে! যুগে যুগে দেশে দেশে স্বাধীনতার জন্যেই যত অশান্তি মারামারি হানাহানি। আর সেই স্বাধীনতাই কিনতে চাইছে অ্যান্ড্রু স্বোপার্জিত সমস্ত অর্থের বিনিময়ে!

মুহূর্তের মধ্যে লাল হয়ে উঠল চোখমুখ।

অসম্ভব! অবাস্তব! এই দুটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করে খুদে মালিককে কোলে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে পড়লেন দ্রুতপায়ে। দুঃখবোধের অনুভূতি নেই রোবটের, তা সত্ত্বেও চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল অ্যান্ড্রু।

এক অসাধারণ মনের পরিচয় দিয়ে দিল মামণি সেই সময়ে। বিবাদমান দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ। বারেবারে বোঝাতে হয়েছে মার্টিন সাহেবকে। গত তিরিশ বছর ধরে নিঃসঙ্কোচে সবকিছু আলোচনা চলছে অ্যান্ড্রুর সামনে। কোনও বাধা বা দ্বিধা হয়নি কারুর, কারণ অ্যান্ড্রু তো রোবট। যন্ত্র! যন্ত্রের কাছে আবার সংকোচ কী।

বাপি, মিছিমিছি তুমি রাগ করছ। ব্যক্তিগত মান-সম্মানের প্রশ্ন তুলছ। এটা কেন বুঝছ না যে গত তিরিশ বছর ধরে আমাদেরই কাজ করছে অ্যান্ড্রু। এখানেই আছে, আমাদের ছাড়া কাউকেও জানে না। ভবিষ্যতেও এর কোনও পরিবর্তন হবে না, হাওয়া সম্ভব নয়। তিন আইন আর আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়েই তো তৈরি হয় রোবট। হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে রোবটের জগতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অ্যান্ড্রু। আর এই স্বতন্ত্রই স্বাধীনতাকামী করে তুলেছে ওকে। বাপি, আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে অ্যান্ড্রুর স্বাধীনতার তফাত আছে অনেক। অ্যান্ড্রুর স্বাধীনতা নেহাত সান্ত্বনা মাত্র, কেবলমাত্র স্বীকৃতি। সবাই বলবে মুক্ত স্বাধীন রোবট এইটুকু মাত্র। এই সামান্য অধিকার দিলে কী এমন ক্ষতি হবে আমাদের? বলো তো বাপি, কার জন্যে রোজগার করে অ্যান্ড্রু? সে সবই তো আমাদের জন্যে। আমরাই ভোগ করছি সব। এই ব্যাপার নিয়ে গত এক বছর ধরে কথা বলেছি আমরা।

এক বছর ধরে? তুমি সব জানতে মামণি? কই, আমাকে তো বলোনি এতদিন! মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন মার্টিন সাহেব।

ইচ্ছে করেই বলিনি তোমাকে বাপি। আরও আগেই বলা উচিত ছিল অ্যান্ড্রুর। কিন্তু ভয় পেয়েছে সে প্রতিবারেই। প্রতিবারেই মনে করেছে মনে আঘাত পাবে তুমি। আর সেইজন্যেই পিছিয়ে গেছে সে দিনের পর দিন। এবার… এবার আমিই ওকে পাঠিয়েছি তোমার কাছে বাপি।

গুম হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ মি. মার্টিন।

 কিন্তু মামণি, স্বাধীনতার কোনও অর্থ কি বোবাঝে অ্যান্ড্রু? অ্যান্ড্রুকে আমরা যতই ভালোবাসি, শিল্পকলার তারিফ করি, একটা কথা ভুললে চলবে না মামণি, অ্যান্ড্রু মানুষ নয়, রোবট। আমাদের হাতে তৈরি এক যন্ত্র মাত্র।

বাপি, আবার ভুল করছ। অ্যান্ড্রুকে এখনও জানো না তুমি। তোমার লাইব্রেরির যাবতীয় বই পড়েছে অ্যান্ড্রু। নানা বই পড়ার ফলেই বিরাট আলোড়ন দেখা দিয়েছে প্রাণহীন যন্ত্রের মধ্যে। আমরা হয়তো সঠিক বুঝতে পারব না এসব। পজিট্রনিক ব্রেনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে চিন্তার বীজ। একবার যদি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো, তবে বুঝবে কীরকম অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে ওর চোখের দৃষ্টিতে। নানান ভাবের বিচ্ছুরণ ঘটে ওর চোখের আলোয়। তাই বলি বাপি, অন্য সব রোবটের মতো ভেব না অ্যান্ড্রুকে। রোবট হয়েও ও রোবট নয়, হয়তো বা…

বাঃ! দারুণ বক্তৃতা করতে শিখেছ তো মামণি! নিখুঁত পার্লামেন্টারিয়ান। শোনো মা, দেশের আইনকে তো অস্বীকার করা যায় না। দেশের আইনের চোখে রোবট ছাড়া আর কিছু নয় অ্যান্ড্রু। আমাকেও আইন মেনে চলতে হয়। সেইজন্যেই তোমার কথা মানা সম্ভব নয় মা। যাক, এবার অ্যান্ড্রুকে ডাকো একবার।

অ্যান্ড্রু ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত চেহারা যেন পালটে গেল মার্টিন সাহেবের। গম্ভীরভাবে ওর আপাদমস্তক দেখলেন বারকয়েক।

অ্যান্ড্রু, তোমার স্বাধীনতা, মুক্তি অর্থহীন আমার কাছে। তাই দেওয়া না, দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বই পড়ে পড়ে মাথা বিগড়ে গেছে তোমার। তোমার মুক্তির কথা স্বীকার করে না আইন। মুক্তি! স্বাধীনতা! কথা বলতে শিখে খোয়াব দেখা আর বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক, কোর্টে গেলে এ কুল-ওকুল দু-কুলই যাবে তোমার। স্বাধীনতা তো পাবেই না, উলটে ব্যাংকে রাখা তোমার নামে টাকা সব বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। কোর্ট কী বলবে জানো অ্যান্ড্রু? বলবে টাকা রোজগারের কোনও অধিকার নেই রোবটের। রোবট রোবটই, মানুষ নয়। মানুষের তৈরি এক যন্ত্রবিশেষ। বেশি বাড়াবাড়ি না করে যা সয়, বসে তা-ই করো।

বিস্ময়ে স্তম্ভিত ছোট মামণি। ঠিক আপন বাপি যেন বাপি নয় আর। বিজ্ঞান-সভ্যতা বলে বলীয়ান দাম্ভিক এক মানুষ। মধ্যযুগীয় কুৎসিত দাসপ্রথা যেন উঁকি মারছে যান্ত্রিক সভ্যতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে।

স্যার, আপনার কথা সব ঠিক… আমি রোবট, যন্ত্র। মানুষের হাতেই জন্ম আমার। কিন্তু সেটাই কি আমার অপরাধ? অন্য রোবট থেকে কি আলাদা নই আমি? আর যদি আপনাদের স্বাধীনতা চাই তা হলে… তা হলে… স্যার, স্বাধীনতা অমূল্য। জীবনের চেয়েও অমূল্য স্বাধীনতা। তাই শুধুমাত্র স্বাধীনতা… মুক্তি দিন আমাকে।

.

০৭.

আইন… কার আইন… কীসের আইন… সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিয়ম-কানুনই আইন। মানতে বাধ্য সংখ্যালঘিষ্ট আপামর জনসাধারণ-আর সেই আইনকে কার্যকর করার জন্যেই রয়েছে কোর্ট। অবশেষে সেই কোর্টেরই দ্বারস্থ হল অ্যান্ড্রু স্বাধীনতা আদায়ের জন্যে।

লোকে থিকথিক করছে কোর্টঘর। লোক হওয়াই স্বাভাবিক, রীতিমতো অভিনব কেস। সরকারপক্ষের অ্যাটর্নি নানান বইপত্রের নজির টেনে পাকা রাজনীতিবিদদের মতো টেবিল চাপড়ে লম্বা এক বক্তৃতা করে বসলেন, মামলাটা শুধু অমূলক নয়, পাগলামিও বটে। মানুষ ছাড়া স্বাধীনতার কোনও অর্থই হয় না। রোবটের স্বাধীনতা রীতিমতো হাস্যকর। নৈব নৈব চ। একমাত্র মানুষ, মানুষই স্বাধীনতার যোগ্য।

একবার নয়-বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, নানান ভঙ্গীতে একই কথা বলে জজ সাহেবের মন ভোলাবার চেষ্টা করলেন অ্যাটর্নি।

চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল ছোট মামণি। পাশেই ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে অ্যান্ড্রু। অ্যান্ড্রুর মতোই নির্বাক কৌতূহলী জনসাধারণ।

অ্যান্ড্রুর পক্ষে সওয়াল করবার জন্যে জজসাহেবের অনুমতি চাইল ছোট মামণি।

অনেক… অনেক ধন্যবাদ মহামান্য আদালত। আমি আইনজ্ঞ নই, কথার জাল বুনে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা আমার কাজ নয়, করিওনি কখনও। আর অ্যাটর্নি সাহেবের মতো কথার ফুলঝুরির মাধ্যমে দিনকে রাত করতে পারব না আমি–তবে সহজ কথা সরলভাবে বলার চেষ্টা করব মাত্র। আমার বিশ্বাস মহামান্য আদালত নিশ্চয়ই আমার কথার অন্তর্নিহিত বক্তব্য বুঝতে পারবেন–শুধুমাত্র কথার আক্ষরিক অর্থ নিয়ে ভুল বুঝবেন না যেন।

এবার আসি আসল কথায়, অ্যান্ড্রুর ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অর্থ কী? সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে বর্তমানে, মানে এখনও অ্যান্ড্রু স্বাধীন। যতদূর মনে হয় বিগত কুড়ি বছরের মধ্যে আদেশ করেনি কেউ ওকে। না, মার্টিন পরিবারের কেউ না। আদেশ করতে, হুকুম করতে কেমন যেন দ্বিধা হয় আমাদের। কারণ অ্যান্ড্রু তো আজ্ঞাবাহী রোবট নয়, অ্যান্ড্রু অনন্যসাধারণ, স্বতন্ত্র, সৃজনীশক্তি সম্পন্ন বিস্ময়কর!

অথচ আমরা তো জানতাম যে হুকুম করলেই হুকুম তামিল করতে বাধ্য অ্যান্ড্রু। কারণ অ্যান্ড্রু রোবট, তিন আইনের বন্দি। অথচ সৃজনীশিল্পের মাধ্যমেই রোবট অ্যান্ড্রু প্রমাণ করল যে রোবট হয়েও সে সম্পূর্ণ পৃথক, অনন্যসাধারণ। সেই থেকেই হুকুম করা বন্ধ হয়ে গেল একেবারে। অথচ হুকুম না করলেও, আদেশ না করলেও কী অবিশ্বাস্য বিশ্বস্ততার আর সেবার মনোভাব নিয়ে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছে অ্যান্ড্রু। রোজগার করছে আমাদের জন্যে। হ্যাঁ, আমি বলছি, প্রচুর প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বড়লোক করে তুলেছে আমাদের। প্রতিদানে সে কিছুই চায়নি নিজের জন্যে।

এবারের প্রশ্ন, এর পরেও কি স্বাধীনতার মূল্য আছে অ্যান্ড্রুর কাছে? ঠিক কথা, বাস্তবে হয়তো সত্যি কোনও মূল্য নেই। কিন্তু এই স্বাধীনতা কথাটাই দারুণ মূল্যবান ওর কাছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যহীন নিরর্থক ওর স্বাধীনতা, অথচ স্বাধীনতার স্বীকৃতিটুকুই অমূল্য, একান্ত কাম্য ওর। অন্যভাবে বলা যায়, স্বীকৃতিটুকুই একান্ত ইপ্সিত অথচ আমাদের কোনও ক্ষতি নেই এই স্বীকৃতিদানে।

হাসির রেশ দেখা দিল জজ সাহেবের মুখে, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আপনার বক্তব্য শুনলাম মিসেস চারনেল। আসল কথা হল এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও আইন অথবা অতীতের কোনও নজির নেই আমাদের কাছে। আমরা জানি যে মানুষেরই একমাত্র অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ স্বাধীনতার সঙ্গে। মানুষই স্বাধীন হতে চায়, স্বাধীনতা লাভ করে। এই ধারাই চলে এসেছে আদি অনন্তকাল ধরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনার বক্তব্য রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। নতুন কোনও আইন প্রণয়ন করলে উচ্চ আদালতে নাকচ হয়ে যাবার সম্ভাবনাই প্রবল। এই অবস্থায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনার রোবট অ্যান্ড্রুকে।

অ্যান্ড্রু।

বলুন ধর্মাবতার!

কোর্ট চলাকালীন এই প্রথম কথা বলল অ্যান্ড্রু। রোবটের কণ্ঠে মানবিক স্বর শুনে অবাক জজ সাহেব।

মুক্তি, স্বাধীনতা চাইছ কেন অ্যান্ড্রু? কী কাজে লাগবে বলো তো এই স্বাধীনতা?

 ধর্মাবতার, তা হলে দাস হয়ে থাকতে বলেন কি আপনি? দাসত্ব থেকে মুক্তি চাওয়া কি এতই মূল্যহীন, অন্যায় আপনার কাছে?

প্রশ্নের তীক্ষ্ণতায় বাক্যহারা জজ সাহেব। সামান্য রোবটের কাছে এমন প্রশ্ন স্বপ্নেরও অগোচর। কিন্তু, দাস তো নও তুমি। তুমি তো এক অনন্যসাধারণ রোবট–তোমার সৃজনীশক্তি শুধু অতুলনীয় নয়–আমাদেরও ভাবিয়ে তোলে রীতিমতো। এই অবস্থায় স্বাধীন হয়ে আর কী বেশি করবে অ্যান্ড্রু?

হয়তো অনুমান আপনার সত্যি হবে, হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারব না, কিন্তু যা করব আরও আনন্দের সঙ্গে করব নিশ্চয়ই। এর ফলে আরও উন্নত হয়ে উঠবে আমার সৃজনীশক্তি। ধর্মাবতার, এইমাত্র আপনি বললেন যে মানুষ স্বাধীন হতে পারে। তার অর্থ কি এই নয় যে স্বাধীন হতে ইচ্ছুক যে-কেউ স্বাধীন হবার যোগ্য, স্বাধীনতা লাভ করতে পারে? সেইজন্যে আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা স্বাধীনতা, স্বাধীন হওয়াই একমাত্র কাম্য ধর্মাবতার।

স্তম্ভিত সারা আদালত। স্বয়ং ধর্মাবতার বিচলিত। এরপরেই ঘোষিত হল এক ঐতিহাসিক রায়। অভিনবত্বে এবং গুরুত্বে চিরস্মরণীয়।

বিদ্যা জ্ঞান যুক্তি সম্বলিত আধুনিক মনের অধিকারী বর্তমান রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী কাউকেই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার কোনও অধিকার নেই আমাদের। সুতরাং আজ থেকে অ্যান্ড্রু স্বাধীন। স্বাধীন রোবট!

.

০৮.

চিররহস্যাবৃত মানবমন। স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে চিৎকার করলেও, নীতিগর্ভ বড় বড় বই লিখলেও, সমাজব্যবস্থায় আধুনিক হলেও মানবমনের গহন অরণ্যের নিভৃত প্রান্ত গাঢ় তমসায় আচ্ছন্ন, জ্ঞানলোকের রেশ নেই কোনওখানে। স্যার জিরাল্ড মার্টিনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। আদালতের রায়ে অ্যান্ড্রুর স্বাধীনতা বিরক্তিতে ভরিয়ে তুলল মার্টিন সাহেবকে। কথাবার্তা আচার-আচরণে বহিঃপ্রকাশ ঘটে ওই মনোভাবের। অ্যান্ড্রুর সঙ্গে কথা বলার সময় কর্কশ হয়ে ওঠে কণ্ঠস্বর। অ্যান্ড্রুর বুঝতে বাকি থাকে না কিছু। প্রচণ্ড অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত মার্টিন সাহেবের মন। নিরুপায় অ্যান্ড্রু।

থাক, থাক, অনেক টাকার গরম দেখিয়েছ তুমি। একটা পয়সাও চাই না তোমার। শোনো অ্যান্ড্রু, আজ থেকে তুমি তোমার পছন্দমতো কাজ করবে। কাজের সময়ও ঠিক করবে তুমি। আজ থেকে আমার কিছু করতে হবে না তোমাকে। অবশ্য আদালতের রায় অনুযায়ী এখনও আমি তোমার ভালোমন্দের জন্য দায়ী, কিন্তু তাই বলে…

এবার বাধা দিল ছোট মামণি।

একেবারে ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ বাপি। দায়ী থাকা বিরাট কিছু নয় একটা। তুমি তো ভালো করেই জানো বিশেষ কিছু করার নেই তোমার। রোবটের তিন আইন চালু আছে এখনও। অ্যান্ড্রুও মানতে বাধ্য সে-আইন।

তা হলে স্বাধীন হল কী করে?

স্যার, মানুষও তো নানান আইন-কানুনে বাঁধা। আর সেই আইন-কানুন মেনে নিয়ে মানুষ স্বাধীন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তর দিল অ্যান্ড্রু।

না, তোমার সঙ্গে কথা বলা নিরর্থক। স্বাধীন তো হয়েছ, স্বাধীনতার দায়-দায়িত্বও বেড়ে যায় অনেকখানি। আশা করি সে সব স্মরণে থাকবে তোমার!

এরপরে মার্টিন সাহেবের সঙ্গে দেখা খুব কমই হত অ্যান্ড্রুর। দেখা হলেও প্রয়োজনীয় দু-একটি কথা ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক রইল না ওদের মধ্যে।

নিজেকে নানান কাজে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করল অ্যান্ড্রু। নিত্যদিনের সঙ্গী ছোট মামণি। এমন দিন বাদ যায়নি যেদিন দেখা হয়নি ওদের দুজনের। ইতিমধ্যে একটি ছোট একতলা বাড়ি তৈরি হয়েছে অ্যান্ড্রুর নিজের জন্য। দুটোমাত্র ঘর–একটায় লাইব্রেরি, অন্যটায় কারখানা। কাজের চাপ বেড়ে চলে দিন-দিন। জলস্রোতের মতো টাকা জমে ব্যাংকে। সেইসঙ্গে পরিশ্রমের মাত্রা বেড়ে যায় অনেকখানি।

একদিন সকালবেলায় ছোট দাদাবাবু এল অ্যান্ড্রুর বাড়ি। জর্জকে ওই নামে ডাকে অ্যান্ড্রু।

 অ্যান্ড্রু, এখন তুমি স্বাধীন, স্বাধীন রোবট। ছোট দাদাবাবু বলে ডাকবে না কখনওই। আমি তোমাকে ডাকি নাম ধরে, তুমিও ডাকবে আমার নাম ধরে। বলবে জর্জ, কেমন?

অমত থাকলেও তিন আইনে বাঁধা অ্যান্ড্রু জর্জের আদেশ অমান্য করে কী করে? ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। ছোট দাদাবাবু হল জর্জ। কিন্তু ছোট মামণি? ছোট মামণিই রয়ে গেল চিরকাল।

এরপর এল সেই দিন। মৃত্যুশয্যায় জিরাল্ড ম্যার্টিন। শয্যার পাশে ছোট মামণি। দু-চোখে অবিরল জলের ধারা। অ্যান্ড্রুকে খুঁজছেন মার্টিন সাহেব।

আগের মতো গম্ভীর কণ্ঠস্বর। শয্যাশায়ী। মার্টিন সাহেব নড়াচড়ায় অক্ষম। বহুকষ্টে ডান হাত তুলে বললেন, অ্যান্ড্রু, অ্যান্ড্রু এসেছ। না না জর্জ, ধরতে হবে না আমাকে। সময় হয়ে এসেছে। কয়েকটা কথা শুধু বলতে দাও আমাকে। শোনো, শোনো অ্যান্ড্রু, আমি… আমি খুশি তোমার মুক্তিতে। বিশ্বাস করো, সত্যি খুশি হয়েছি… যাবার সময়ে এই কথাটা বলে না গেলে যে মরেও শান্তি পাব না আমি…

ঠিক এই অবস্থায় কী বলতে হয় করতে হয় জানে না অ্যান্ড্রু। মৃত্যু এক অভিনব অভিজ্ঞতা। অ্যান্ড্রুর জীবনে মৃত্যু এই প্রথম। বইয়ের মাধ্যমে মৃত্যুকে জেনেছে সে অনেকদিন আগে। রোবটের মতো দেহবদল করা অসম্ভব মানুষের পক্ষে। তাই মৃত্যু মানে। মানবজীবনের পরিসমাপ্তি। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে অ্যান্ড্রু, নিশ্চল নিষ্কম্প।

.

০৯.

মার্টিন সাহেবের মৃত্যুর পর আর একটু পরিবর্তন হল। শার্টপ্যান্ট পরতে শুরু করল অ্যান্ড্রু। জর্জের পুরোনো শার্টপ্যান্টে বিচিত্র দেখাল ওকে।

জর্জ এখন ব্যারিস্টার। যোগ দিয়েছে ফেইনগোল্ড ফার্মে। বৃদ্ধ ফেইনগোল্ড দেহ রেখেছেন বহুদিন। মেয়েই দেখাশোনা করে সব। তবে একটু পরিবর্তন হয়েছে ফার্মের নামের ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন।

আমি বুঝতে পারছি না প্যান্ট পরতে চাইছ কেন তুমি? কী সুন্দর তোমার দেহ! মসৃণ ঝকঝকে কর্মঠ। সেই সুন্দর দেহকে ঢাকতে চাইছ শার্টপ্যান্টে? আমরা তো প্রকৃতির হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই জামাকাপড় পরি। কিন্তু তোমার বেলায় তো খাটে না সে-নিয়ম। যাক, এসব তো যুক্তিতর্কের ব্যাপার। আসল কথা হল ধাতুর শরীরে ঠিকমতো আটকায় না কাপড়জামা। অ্যান্ড্রুর পাশে বসে ধীরে ধীরে বলল জর্জ।

জর্জ, মানবদেহ কি প্রকৃতির এক সৌষ্ঠবময় সুন্দর অবদান নয়? নগ্ন মানবদেহের প্রশস্তিতে মুখরিত শিল্পী কবি মহদ্‌জনেরা! বিজ্ঞান বলে আবহাওয়াও আজ মানুষের আয়ত্তাধীন। তা সত্ত্বেও কীসের প্রয়োজনে জামাকাপড় পর তোমরা?

এবার হেসে ফেলে জর্জ, অকাট্য যুক্তির কাছে হার মানে সে।

যুক্তি তোমার ক্ষুরধার অ্যান্ড্রু। আয়ত্তাধীন হলেও তারতম্য আছে এখনও, সেই তারতম্যের হাত থেকে দেহকে রক্ষার জন্যেই প্রয়োজন কাপড়জামার। আবার অঙ্গের শ্রীবৃদ্ধির জন্যেও প্রয়োজন আছে এর। কিন্তু তোমার দেহ তো এসবের উর্ধ্বে।

আসল কথা কী জানো জর্জ, নিজেকে কেমন যেন উলঙ্গ বলে মনে হয় আমার। লজ্জা আর অস্বস্তি বোধ করি পাঁচজনের সামনে। মানসিক স্বস্তির জন্যেই জামাপ্যান্টের প্রয়োজন, জর্জ।

অস্বস্তি? হাজার হাজার রোবট রয়েছে পৃথিবীতে। মানুষের প্রায় সমান সংখ্যক রোবট। তারা তো কেউ অস্বস্তি বোধ করে না অ্যান্ড্রু?

কয়েক মুহূর্ত জর্জের দিকে চেয়ে রইল অ্যান্ড্রু। দুই চোখে দপদপিয়ে উঠল কীসের এক দৃঢ় প্রত্যয়।

জর্জ! ওরা তো কেউ স্বাধীন নয়!

সারা মুখে হাসি ফুটে উঠল জর্জের। অ্যান্ড্রুকে জড়িয়ে ধরে আদর করল বারবার।

যাক, কাজের কথায় আসি অ্যান্ড্রু। শেষ পর্যন্ত কথা দিতে হল মা-কে, আইন সভার সদস্যপদে দাঁড়াব আমি। দাদুর মতো নাতিও হবে সুদক্ষ আইনপ্রশাসক।

দাদুর মতো?

হ্যাঁ, দাদুর মতো! আমি জর্জ, আমার দাদু তোমার স্যার জিরাল্ড মার্টিন, আইন সভায় বিশিষ্ট সদস্য।

ওঃ, এবার বুঝলাম তোমাদের সম্পর্কগুলো। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় বড়। খুব ভালো জর্জ। আজ যদি স্যার… এই বলে থমকে দাঁড়াল অ্যান্ড্রু৷ বলতে যাচ্ছিল, যদি কর্মক্ষম থাকতেন… কিন্তু না। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল রোবট অমর। খুব পুরোনো হয়ে গেলে পালটে নিলেই চলে। মানুষের বেলায় খাটে না এই নিয়ম।

অ্যান্ড্রু, বলো স্যার যদি বেঁচে থাকতেন খুব খুশি হতেন।

মানুষের সম্বন্ধে কথা বলার সময়ে কেমন যেন আটকে যায় অ্যান্ড্রুর। যথার্থ প্রতিশব্দও খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক সময়ে ছোট মামণি আর জর্জের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক কিছুই জানতে পেরেছে এখন। তবুও জানার নেশায় পাগল অ্যান্ড্রু।

বাড়ির লাইব্রেরির বই শেষ হয়ে গেল একদিন। কিনে আর কত পড়া যায়। সরকারি লাইব্রেরিতে যাবার মনস্থ করল অবশেষে। স্বাধীন রোবটের অদম্য জিজ্ঞাসায়। তুচ্ছ হয়ে গেল জর্জের নিষেধ। অন্তরস্থ বৈদ্যুতিক ক্ষমতার সীমা বেড়ে যাচ্ছে অনেকখানি। এরপর এই শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে ইম্পিডেন্স কয়েলে। ফলে সৃজনীশক্তির বিকাশ ঘটবে উত্তরোত্তর।

একদিন শার্টপ্যান্ট টাই পরে লাইব্রেরির উদ্দেশে যাত্রা করল। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর থমকে দাঁড়াল অ্যান্ড্রু। অন্তরের বাধাই থামিয়ে দিল ওকে। সঙ্গে সঙ্গে সার্কিটের বাইরে বার করে দিল ইম্পিডেন্স কয়েল৷ কিন্তু না, কিছুই হল না। মনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে বিদ্যুত্বহী সূক্ষ্ম স্নায়ুতন্ত্রে। ফলে ক্রমেই বাড়ছে রেজিস্টেন্স। অবশেষে বাড়ি ফিরে এল সে।

ডায়েরিতে লিখল, চেষ্টা করেও যেতে পারলাম না সরকারি পাঠাগারে। পাঠাগারে যেতে হবে আমাকে। যাবই যাব। ডায়েরিটা খুলে রাখল টেবিলের উপর। সংকল্পের সঙ্গে একাত্ম হতেই হবে ওকে।

.

১০.

পাঠাগারের সঠিক রাস্তা জানে না অ্যান্ড্রু। ম্যাপ দেখে লিখে নিল পথের হদিশ। রাস্তায় বেরিয়ে মুশকিলে পড়ল। ম্যাপের রাস্তার ধারে ঘরবাড়ি নেই কোনও। অথচ বাস্তবে সম্পূর্ণ বিপরীত। মাঠের মাঝখানে এক চাষি-রোবটকে জিজ্ঞাসা করল অ্যান্ড্রু। না, পথের হদিশ মিলল না ওর কাছ থেকে।

সামনের পথ ধরে এগিয়ে গেল আরও কিছু দূর। দু-জন মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল দূর থেকে। অনেক আশায় অ্যান্ড্রু এগিয়ে গেল সামনের দিকে। অ্যান্ড্রুকে আসতে দেখে গল্প বন্ধ করে থমকে দাঁড়ালো দু-বন্ধু।

দেখুন, শহরের সরকারি পাঠাগারের পথটা কোনদিকে বলতে পারেন?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেঁটে মানুষকে জিজ্ঞাসা করল লম্বা মানুষ, এটা একটা রোবট না?

হ্যাঁ রে, রোবট বলেই তো মনে হচ্ছে। শার্টপ্যান্ট টাই পরেছে দেখ মানুষের মতো।

বুঝেছি বুঝেছি। নিশ্চয়ই সেই স্বাধীন রোবট। মার্টিনদের রোবট। কোর্টের অর্ডারে স্বাধীন হয়েছে, এখন ওর আর মালিক নেই কেউ। স্বাধীন হয়েছে বলেই কি মানুষের মতো শার্টপ্যান্ট পরবে নাকি? কালে কালে হল কী! অসহ্য… অসহ্য এ ধাষ্টামো! রাগ আর বিরক্তিতে ফেটে পড়ল লম্বা মানুষটি।

তুমি কি মার্টিনদের রোবট? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল বেঁটে মানুষটি।

আমিই অ্যান্ড্রু মার্টিন, স্যার। বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল অ্যান্ড্রু।

বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল মানুষ দুটির চোখে।

শুনে কৃতার্থ হলাম। যাক, জামাপ্যান্ট পরেছ কেন? খোলো, খুলে ফেলো জামাপ্যান্ট। কী কুৎসিত দেখাচ্ছে! ময়ূরপুচ্ছধারী কাক যেন!

একটু ইতস্তত করল অ্যান্ড্রু। বহুদিন হয়ে গেল হুকুমের সুরে কথা শোনেনি সে। কী কর্কশ কণ্ঠস্বর! মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে দ্বিতীয় আইনের সার্কিটটা।

আমি বলছি খোলো, খুলে ফেলো জামাপ্যান্ট। আমি হুকুম করছি… চিৎকার করে বলল লম্বা মানুষটি।

এবার আর দ্বিধা নয়, সব পরিষ্কার। দু-নম্বর আইনের কাছে নতি স্বীকার করল স্বাধীন রোবট। জামাকাপড় খুলতে শুরু করল নিঃশব্দে।

আচ্ছা, এর তো কোনও মালিক নেই। চল-না নিয়ে যাই আমরা। আমাদেরই রোবট হয়ে যাবে তা হলে!

ভালো কথা বলেছিস তো! কেই-বা নিষেধ করবে আমাদের। আমরা তো ক্ষতি করছি না রোবটের। ঠিক আছে তাই হবে। তবে আগে একটু মজা করি। অ্যাই, অ্যাই আমার কথা শোনো, শীর্ষাসন করো এক্ষুনি। মাথা মাটিতে রেখে পা দুটো তুলে দাও শূন্যে… দাও… দাও…

মাথা মানে তো… কিছু বলতে চাইল অ্যান্ড্রু।

না না, কোনও কথা শুনতে চাই না। এটা আমার আদেশ… শীর্ষাসন না জানলে চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করো। হ্যাঁ, হ্যাঁ করো করো।

মাটিতে মাথা লাগল আন্ডু। পা দুটো উপরে তোলার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত শব্দ করে কাত হয়ে পড়ে গেল সে মাটির ওপরে।

ঠিক হয়েছে, পড়ে থাকো মাটিতে। আবার হুকুম করল লম্বা মানুষটি।

অ্যাই শোন। চ খুলে ফেলি রোবটের দেহটা। নিয়ে যাবার সুবিধে হবে। আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়া, রোবট তো নিজেই খুলতে পারে নিজের দেহকে?

নিজে নিজের দেহটা খুলবে কেমন করে?

 দেখাই যাক-না খেলে কি না! বাধা দেবার তো কেউ নেই এখানে!

ওদের বাধা দেবার মতো শক্তি নেই অ্যান্ড্রুর। অনুগত্যের দু-নম্বর ধারা আত্মরক্ষার তিন। নম্বর ধারার উপর পূর্ববর্তী হওয়ার অধিকারে কর্তৃত্ব করছে। আসল কথা ওদের উপর আঘাত না হেনে আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হল অ্যান্ড্রু। এর অর্থ এক নম্বর ধারা অমান্য করা। এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল দেহস্থ প্রতিটি স্বয়ংবল অংশ। ফলে কেঁপে কেঁপে উঠল মাটিতে পড়ে থাকা অ্যান্ড্রুর দেহটা।

লম্বা মানুষটি কাছে এসে জুতো দিয়ে উলটে দিতে চেষ্টা করলো অ্যাম্বুকে।

 বাবাঃ, কী ভারী! পুরোনো জিনিস তো! আমার কী মনে হয় জানিস, খালি হাতে খোলা যাবে না। যন্ত্রপাতি চাই।

একটা কাজ কর। ওকেই হুকুম কর নিজের দেহটাকে খোলার জন্যে। বেশ মজা হবে। নিজে খুলবে নিজের দেহ। মজার সুরে বলল বেঁটে মানুষটি।

বেশ বলেছিস। তবে রাস্তা থেকে সরিয়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে যাই চ ওকে। রাস্তার ওপরে দেখে ফেলতে পারে কেউ।

বাধা পড়ল ওদের পরিকল্পনায়। একজনকে হনহন করে এগিয়ে আসতে দেখা গেল এদিকে। জর্জ আসছিল রাস্তা দিয়ে। রাস্তার ওপর অ্যান্ড্রুকে শুয়ে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল সে। জর্জকে দেখে ওঠার চেষ্টা করামাত্র ধমক খেল অ্যান্ড্রু।

না, উঠবি না, শুয়ে থাক যেমন ছিলিস।

জর্জকে আসতে দেখে একটু সরে দাঁড়াল দু-জন।

অ্যান্ড্রু! অ্যান্ড্রু! কী হয়েছে তোমার? বিকল হয়ে গেছে নাকি কিছু? উদ্বেগের সুরে প্রশ্ন করল জর্জ।

না জর্জ, সেসব কিছু নয়।

মাটিতে কেন? উঠে দাঁড়াও, শার্টপ্যান্ট গেল কোথায়?

এবার কথা বলে উঠল লম্বা মানুষটি।

এটা কি তোমার রোবট নাকি সোনার চাঁদ?

স্প্রিং-এর মতো চকিতে ঘুরে দাঁড়াল জর্জ। রাগে জ্বলে উঠল সর্বাঙ্গ।

না, আমার নয়, কারুর নয়। কিন্তু এতক্ষণ কী হচ্ছিল এখানে?

কই, কিছু হয়নি তো, শার্টপ্যান্ট পরে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল, তাই বললাম খুলে ফেলতে, কিন্তু এটা তোমার না হলে তোমারই-বা এত দরদ কেন চাঁদ?

এক ঘুসিতে মুখের চেহারা পালটে দেবার এক অদম্য বাসনাকে কোনওমতে সামাল দিল জর্জ।

অ্যান্ড্রু তুমিই বলো কী করছিল ওরা?

ওদের উদ্দেশ্য হল আমাকে টুকরো-টুকরো করে ফেলা, সেইজন্য নির্জন জায়গায় নিয়ে যাবার কথা বলছিল, আমার দেহকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আমাকে আদেশ করত ওরা।

রোষকষায়িত নেত্রে ওদের দিকে তাকাল জর্জ, থিরথির করে কেঁপে উঠল চিবুকটা, সেই একইভাবে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দু-জনে।

এত রেগে উঠছ কেন চাঁদু? মারবে নাকি? তা মন্দ হবে না, অনেক দিন হাতের সুখ করিনি আমরা। উদ্ধত ভঙ্গিতে খোঁচা দিয়ে বলল লম্বা মানুষটি।

মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রক্তের দপদপানি, উঃ কী অধঃপতন, মানুষ না জানোয়ার!

 না, না, নিজে কিছুই করব না, তবে সত্তর বছরের বেশি আমাদের বাড়িতে আছে এই রোবট, খুব ভালোভাবে জানে আমাদের, সেইজন্যে আমাদের হুকুমকেই আগে মানবে। যাক এবার মন দিয়ে শোনো বাঁদরেরা, অ্যান্ড্রু, অ্যান্ড্রু আমার জীবন এদের হাতে, মেরে ফেলবে আমাকে, অ্যান্ড্রু মারতে আসছে ওরা বাঁচাও, বাঁচাও অ্যান্ড্রু এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও অ্যান্ড্রু।

মুহূর্তের মধ্যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে জানোয়ারদের পানে ধেয়ে গেল অ্যান্ড্রু, রোবটের সামনে দাঁড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়, পলকের মধ্যে জুতো হাতে নিয়ে চম্পট। পালানোর বহর দেখে হো হো করে হেসে উঠল জর্জ।

জর্জ, দেখলে তো কেমন পালাল, কিন্তু সত্যি কি মারতাম, শুধু…

ব্যাপার কী জানো অ্যান্ড্রু, রোবট সম্বন্ধে ভয় আছে মানুষের মনে, তোমাকে এগিয়ে যেতে দেখে সেই ভয়েই পালিয়েছে ওরা।

রোবটকে কেন ভয় পায় মানুষ, তোমরাই তো তৈরি করেছ আমাদের জর্জ!

খুব ভালো প্রশ্ন করেছ অ্যান্ড্রু, জন্মলগ্ন থেকে এই ভয়রোগেই ভুগছে মানুষ, হাজার চেষ্টা করেও ভয়ের হাত থেকে মুক্তি পাইনি আমরা। যাক সেসব কথা, এদিকে এসেছিলে কেন?

লাইব্রেরিতে যাবার জন্যে।

লাইব্রেরি? যেতে হবে কেন, আমাকে বললেই বই পেয়ে যেতে তুমি!

দেখো জর্জ, আমি তো এখন…।

স্বাধীন! এই কথাটাই তো বলতে চাইছ এখন, স্বাধীন হলেই কি সব কাজে যেতে হবে তোমাকে! লাইব্রেরিতে কী পড়তে যাচ্ছিলে শুনি?

মানুষের ইতিহাস জানতে হবে জর্জ, অনেক তথ্য জানতে চাই, পৃথিবীর খবর, গ্রহ নক্ষত্র মহাবিশ্বের যাবতীয় তত্ত্ব আর তথ্য, আরও জানতে যাই আমরা, আমাদের সম্বন্ধে রোবটের ইতিহাস লিখতে চাই জর্জ।

অ্যান্ড্রু, বেশ কয়েক হাজার বই লেখা হয়েছে রোবট নিয়ে, রোবটের তত্ত্ব নিয়ে, তত্ত্ব আর তথ্যে ভরে উঠেছে আমাদের জ্ঞানভান্ডার।

মাথা নেড়ে জর্জের কথায় বাধা দিল অ্যান্ড্রু। ইদানীং মানুষের মতো মাথা নেড়ে হ্যাঁ বা না বলার কায়দা রপ্ত করে ফেলেছে বেশ।

 না না জর্জ, রোবটতত্ত্বের ইতিহাস নয়। নিজে রোবট হয়ে রোবটের সত্যিকারের ইতিহাস রচনা করব আমি, রোবটের জন্মলগ্ন থেকে তার অনুভূতির ক্রমবিকাশ, মানুষের সমাজে, মানুষের পৃথিবীতে রোবটের যথার্থ মূল্যায়ন, রোবটের…