০২. আশ্চর্য দৃশ্য

আশ্চর্য দৃশ্য

বরফের পর বরফের পাহাড়!

কিন্তু এদের পাহাড় না বলে বলা উচিত প্রকৃতির তুষারে গড়া দুর্গ-নগরী! কোথাও যেন সুদূর বিস্তৃত প্রাকার, কোথাও যেন সুগভীর পরিখা, কোথাও যেন মেঘচুম্বী গম্বুজওয়ালা প্রাসাদ, কোথাও যেন মন্দির-চূড়া বা প্রশস্ত অঙ্গন! সমস্তই করছে সাদা ধবধব। যেখানে ছায়া পড়েছে সেখানেও কালিমা নেই। যেখানে সূর্যের আলো পড়েছে সেখানে চোখ অন্ধ করে জ্বলছে যেন পুঞ্জীভূত বিদ্যুৎ!

দৃষ্টিসীমা ও আকাশ প্রান্ত জুড়ে বিপুল এই দুর্গ-নগরী, কিন্তু সে যেন মৃতের শহর, তার কোথাও জীবনের কোনও লক্ষণই চোখে পড়ে না। আমি যেন এক পৌরাণিক ও পরিত্যক্ত দানব-রাজধানীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি—একদা এর সিংহদ্বার খুলৈই যেন অসুরসৈন্যদল হিমালয় কাপিয়ে বেরিয়ে আসত দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গপুরীর দিকে যাত্রা করবার জন্যে।

চিন্তার কোনও মূর্তি আছে কি না জানি না, কিন্তু দানবের কথা মনে হতেই চোখের সুমুখে জাগল এক আশ্চর্য ও কল্পনাতীত দৃশ্য!

আকাশ-প্রান্তে আঁকা সেই বিরাট দুর্গ-নগরীর তলায় রয়েছে প্রকাণ্ড এক তুষার প্রান্তর। তার ধু ধু শূন্যতার মধ্যে শুভ্রতা ছাড়া আর কোনও রঙেরই খেলা নেই।

আচম্বিতে সেই শুভ্রতার এক কোণে ফুটে উঠল যেন একটা কালির বিন্দু! সে বিন্দু হয়তো আমার চোখেই পড়ত না। কিন্তু বিন্দুটা ছিল চলন্ত!

নিশ্চলতার রাজ্যে এই সচল জীবনের লক্ষণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সবিস্ময়ে দূরবিনটা তুলে নিয়ে যা দেখলুম, তাতে আরও বেড়ে উঠল আমার বিস্ময়।

একজন মানুষ বরফের ওপর দিয়ে হন হন করে এগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু নানা, সেটা কি মানুষের মূর্তি? তার আশেপাশে গাছগাছড়া থাকলে তুলনায় মূর্তিটার উচ্চতা সম্বন্ধে কতকটা ঠিক ধারণা করতে পারতুম, কিন্তু সেই অসমোচ্চ তুষারমরুক্ষেত্রের কোথাও সামান্য ঝোপঝাড়ের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

তবে এইটুকু আন্দাজ করতে পারলুম, মূর্তিটা মোটেই সাধারণ মানুষের মতন নয়— এমনকি মাথায় সে যে-কোনও অসাধারণ দীর্ঘ মানুষেরও চেয়ে ঢের উঁচু! একালে অতিকায় দৈত্যদানবের অস্তিত্ব কল্পনা করাও অসম্ভব, কিন্তু আকারে সে হয়তো উপকথায় কথিত দৈত্য, দানব বা রাক্ষসের মতোই ভয়াবহ!

স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, মূর্তিটা হঠাৎ একটা বৃহৎ তুষার-স্কুপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কী দেখলুম? চোখের ভ্রম, অপচ্ছায়া? না সত্যিকার কোনও মনুষ্যমূর্তি? কিন্তু এই চিরতুষারের মৃত্যু-রাজ্যে কোনও মানুষ যে একাকী ভ্রমণ করতে পারে, এটা কিছুতেই সম্ভবপর বলে মনে হল না।

এমন সময়ে নীচে থেকে আমার সঙ্গী মালবাহী লোকজনদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম। তারা চিৎকার করে আমাকে ডাকছে।

তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে দেখি, তাদের সকলেরই মুখ ভয়ে কেমনধারা হয়ে গিয়েছে।

ব্যাপার কী জিজ্ঞাসা করাতে তারা উত্তেজিতভাবে বরফের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল।

তুষার-কর্দমের ওপরে রয়েছে অদ্ভুত কতকগুলো পায়ের ছাঁচ!

সেগুলো দেখতে অবিকল মানুষের পায়ের দাগের মতন, কিন্তু প্রত্যেকটাই সাধারণ মানুষের পায়ের ছাপের চেয়ে ঢের বেশি বড়ো! …যার পায়ের ছাপই এমন বড়ো, তার মাথায় উচ্চতা যে কতখানি, সেটা ভাবতেও মন শিউরে ওঠে!

তবে কি এই পায়ের দাগ তারই, একটু আগে তুষার-প্রান্তরে যাকে অদৃশ্য হতে দেখেছি?

পাছে আমার লোকজনরা ভয় পায়, তাই মুখে কিছু ভালুম না, কেবল বললুম, এটা কোনও পাহাড়ে-জন্তুর পদচিহ্ন, এ নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। সূর্য পশ্চিম দিকে নামছে, আজ এইখানেই তাঁবু ফেলবার ব্যবস্থা করো।

তারা আশ্বস্ত হল বলে মনে হল না, তবে আর কোনও গোলমাল করলে না।…

পরের দিন সকালে তাঁবুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। কী ভীষণ কনকনে শীতের হাওয়া বইছে, জামার ওপর জামা পরেছি, হাতে পুরু চামড়ার দস্তানা, পশুচর্মের ব্যাপারে সর্বাঙ্গ ঢাকা, দুই চক্ষে ইলি-চশমা—শীতে তবু ঠকঠক করে কাঁপছি। যারা দার্জিলিঙে বেড়াতে গিয়েই শীতে কেঁপে মরে তারাও এখানকার শীতলতার মর্ম বুঝতে পরবে না। এখানকার তুলনায় দার্জিলিঙ হচ্ছে প্রায় গ্রীষ্মপ্রধান জায়গা।

দূরে হঠাৎ দেখা গেল, তুষার-প্রান্তরের ওপরে এক মনুষ্যমূর্তি!

কালকের দৃশ্য ভুলিনি। প্রথমটা চমকে উঠলুম। তারপর ভালো করে লক্ষ করে বুঝলুম, না, এ মূর্তিটাকে সাধারণ মানুষেরই মতন দেখতে।

লোকটি এগিয়ে আসছিল মাতালের মতন টলমল করতে করতে। দুই-একবার পড়ে গেল, তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। খানিকদূর এসেই আবার পড়ে গেল।

আমি দৌড়ে তার কাছে গিয়ে যখন দাঁড়ালুম, তখন সে আবার ওঠবার চেষ্টা করছে।

তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলুম।

রক্তহীন মুখের স্তিমিত দৃষ্টি আমার দিকে ফিরিয়ে সে বলল, মশাইকে মনে হচ্ছে আমারই মতন বাঙালি। আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন জানতে পারি কি?

প্রায় মৃত্যুকবলগ্রস্ত এই ব্যক্তির মুখে প্রথমেই এমন প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়ে বললুম, আমি হচ্ছি পর্যটক। চলেছি তিব্বতের দিকে।

তার পথশ্রান্ত শীতাক্ৰান্ত ভেঙেপড়া দেহ আবার সিধে হয়ে উঠল। আনন্দিত স্বরে সে বললে, ভগবানকে ধন্যবাদ! আমিও তাহলে আপনার সঙ্গী হতে চাই!

তার হিমস্তম্ভিত হাত-পা-মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে বললুম, সে শক্তি কি আপনার আছে?

লোকটি মৃদু হেসে বললে, আমার দেহ দুর্বল বটে, কিন্তু আমার মনের শক্তি আছে। দেহ তো মনের দাস।

বললুম, সবসময়ে নয়।

হঠাৎ উদভ্রান্ত স্বরে সে বলে উঠল, হা—সবসময়েই—সবসময়েই! দেহ তো অর্নেকদিন ধরেই, আমাকে বহন করতে রাজি নয় কিন্তু আমার মনই তাকে এত দূরে চালনা করে নিয়ে এসেছে! দুর্বল আমার দেহ, কিন্তু প্রবল আমার মন!

তার উত্তেজনা দেখে প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে তাড়াতাড়ি আমি বললুম, আপনার নাম বলতে আপত্তি আছে?

তখনই শান্ত হয়ে সে বললে, একটুও নয়। আমার নাম অজয়কুমার চৌধুরি।

নিবাস?

হালিশহরে। কিন্তু এখন আমি ভবঘুরে।

উঃ, কী চেহারা অজয়বাবুর! মানুষের দেহ যে এমন শীর্ণ, এমন রক্তহীন হতে পারে আগে আমার সে ধারণা ছিল না। কেবল দুটি সতেজ চক্ষু তার মানসিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছিল।

বললুম, আমার তাঁবুর ভেতরে আসুন। আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে মনের জোরেও আপনি বাঁচতে পারবেন না।

যা ভেবেছিলুম তাই! তাঁবুর ভেতরে এসেই অজয়বাবু অচেতন হয়ে পড়লেন। দৈবগতিকে আজ যদি আমি এখানে উপস্থিত না থাকতুম, তাহলে হিমালয়ের তুষার সমাধির মধ্যেই। তার সমস্ত অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যেত।

এই রহস্যময় লোকটিকে দেখে মনে বড়ো কৌতূহল জাগল। কে ইনি? এই মৃত্যুর দেশে কেন তিনি এসেছেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *