০১. সুন্দরবাবুর কথা

আগের কথা

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হচ্ছে একখানি প্রসিদ্ধ ইংরেজি উপন্যাস এবং আধুনিক চলচ্চিত্রের দৌলতে তা অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ খানি রচনা করেছেন মেরি ওলসট্রোনক্রাফট শেলি। তিনি গত শতাব্দীর অমর কবি শেলির সহধর্মিনী।

মেরি তার স্বামী শেলি ও কবি লর্ড বাইরনের সঙ্গে তখন চিরতুষারময় পার্বত্য প্রদেশে বাস করেছিলেন। বাইরে অন্ধকারকে সমাচ্ছন্ন করে ঝরছে। আর ঝরছে তু্যার বাদল, কেঁদে কেঁদে বইছে তুষার ঝটিকা, চারিদিকে বোবারাত্রির নির্জনতা। এই ভূতুড়ে আবহ সকলকেই করলে অভিভূত। বাইরন, শেলি ও মেরি স্থির করলেন, কোনও অবাস্তব ঘটনা নিয়ে তারা প্রত্যেকেই এক একটি কাহিনি রচনা করবেন। সেই সংকল্প থেকেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনর জন্ম। এবং এই একখানি মাত্র পুস্তকই মেরির নামকে আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। বাইরন ও শেলির সংকল্প কার্যে পরিণত হয়নি।

বাঙালি পাঠকদের উপযোগী করবার জন্যে আমি ঘটনা, স্থান ও পাত্রপাত্রীদের নাম পরিবর্তিত করতে বাধ্য হয়েছি এবং সর্বত্রই মূল রচনার অনুসরণ করতে পারিনি।

ইতি—হেমেন্দ্রকুমার রায়
২৩০/১, আপার চিৎপুর রোড
বাগবাজার, কলিকাতা।

 

—————–

সুন্দরবাবুর কথা

তুষার, তুষার, তুষার। ওপরে অনন্ত নীলিমার উচ্ছ্বাস, নীচে অনন্ত শুভ্রতার উৎসব। আকাশছোঁয়া শিখরের পর শিখরের নৈবেদ্য সাজিয়ে বিরাট হিমাচল নিশ্চল-নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে যোগাসনে, কোনও পরম দেবতার উপাসনায়। এই আশ্চর্য তুষার-সমারোহের একমাত্র দর্শক হচ্ছি আমি। আমার সঙ্গীরা এখনও পাহাড়ের অনেক নীচে পড়ে আছে।

আমি বাঙালি। কিন্তু ঘরমুখো বাঙালি বলে প্রবাদে যাদের কুখ্যাতি আছে, আমি তাদের দলের লোক নই। দৈত্যকুলের প্রত্যাদের মতন আমি বাঙালি হয়েও ঘরছাড়া পথের পথিক।

ছেলেবেলা থেকেই আমার আদর্শ হচ্ছেন ডা. লিভিংস্টোন, ন্যানসেন, রবার্ট পিয়ারি ও কাপ্তেন স্কট প্রভৃতি দুঃসাহসী মহাজনরা-নতুন-নতুন বিপদসঙ্কুল অজানা দেশে নতুননতুন অভিযানে বেরিয়ে যাঁরা অকাতরে প্রাণদান করেছেন বা বিপদজয়ী হয়ে ফিরে এসেছেন। সুখশয্যাশায়ী বিলাসীকে আমি ঘৃণা করি, আমার শ্রদ্ধা জাগে কণ্টকশয্যাশায়ী হঠযোগীকে দেখলে।

পিতামাতার পরলোক গমনের পর প্রথম যখন স্বাধীন হলুম তখনই স্থির করলুম, এতদিন ধরে যে দিবাস্বপ্নের সাধনা করে আসছি সর্বাগ্রে তাকেই সফল করে তুলব।

পৈত্রিক সম্পত্তির অভাব ছিল না। মস্ত জমিদারের ছেলে আমি, আমাদের বংশে কেউ গতরে খেটে পেটের ভাত জুটিয়েছেন বলে শুনিনি। আমার কাছে টাকা হচ্ছে সবচেয়ে সুলভ জিনিস।

পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই প্রাথমিক শিক্ষার দরকার। প্রথমভাগ বর্ণ পরিচয়ের পরই আরম্ভ হতে পারে দ্বিতীয় ভাগের পাঠ। শনৈঃ পর্বতলজ্জন। অতএব স্থির করলুম, সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে কোনও দূর দুর্গম দেশে যাত্রা করার আগে ভারতবর্ষেরই কোনো বন্ধুর প্রদেশের যাত্রী হয়ে নিজের শরীর ও মনকে তৈরি করে তুলতে হবে।

ভাবতে ভাবতে প্রথমেই মনে পড়ল হিমালয়কে। হিমালয় হচ্ছে বাংলার প্রতিবেশী এবং বিপুল ভারতবর্ষের বিরাট মুকুট। কিন্তু আমরা তাকে হাতের কাছে পেলেও সে সহজলভ্য নয়। যে-দেশের লোক আকাশ ও পাতাল এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরুকে জয় করেছে, হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখর আজও আছে তাদের নাগালের বাইরে।

প্রথমেই হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরের দিকেও দৃষ্টিপাত করতে চাই না। আপাতত মানস সরোবর পার হয়ে তিব্বতের দিকে এগিয়ে নিজের সামর্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।

যাত্রার তোড়জোড় আরম্ভ করলুম।

অল্পবয়সে পিতার অগাধ সম্পত্তির অধিকারী হয়েছি, কাজেই বন্ধু নামে খ্যাত অনেকগুলি লোক আমার চারপাশে এসে জড়ো হয়েছিল। হাতের শিকার ফসকে যায় দেখে তারা সচমকে বললে, সর্বনাশ! তুমি পাগল হয়েছ নাকি?

শুভানুধ্যায়ী আত্মীয়েরা নানাবিধ উপদেশ দিয়ে বললেন, ডানপিটের মরণ গাছের আগায়। অমন কাজও কোরো না।

এখনও বিবাহ করিনি। কাজেই অন্তঃপুরের অশ্রুনদীতে আর সাঁতার কাটতে হল না।

কারুর মানা না মেনে বেরিয়ে পড়লুম।

 

মানস সরোবর পিছনে রেখে এগিয়ে চলেছি।

এ চলার আনন্দ যে কত গভীর, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কোনও কবিও আজ পর্যন্ত এ আনন্দ ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারেননি। এ আনন্দ প্রকাশ করবার নয়, উপলব্ধির জিনিস। এ আনন্দের মর্যাদা বুঝেছিলেন বুদ্ধদেব, শঙ্করাচার্য ও চৈতন্য প্রভৃতি মহাপুরুষরা, সংকীর্ণ ঘর তাই তাদের বন্দি করে রাখতে পারেনি।

আমি বুদ্ধদেবও নই, চৈতন্যও নই। কিন্তু এ আনন্দ আমাকেও মাতিয়ে তুললে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *