উপন্যাস
গল্প

৬. টেলিফোনটা ঝনঝন করে উঠল

০৬.

ভোর পাঁচটায় টেলিফোনটা ঝনঝন করে উঠল।

হ্যালো

গুড মর্নিং স্যার। হোটেল রিসেপশন থেকে রোজার বলছি। ঠিক ছ-টার সময় হেলিকপ্টার আসছে। হোটেলের সামনের মাঠেই হেলিপ্যাড আছে। আপনাদের ব্রেকফাস্টটা কি পাঠিয়ে দিতে বলব?

ব্রেকফাস্ট ঘুমন্ত পিয়েরের দিকে একবার তাকিয়েই সুজন বলল, এই পনেরো মিনিট বাদে পাঠাতে বলল, কেমন? সো ভেরি কাইন্ড অব ইউ টু রিমাইন্ড ইন টাইম। থ্যাংক ইউ রোজার। রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সুজন।

পাশের বিছানাটা ফাঁকা। বারান্দার দিকে তাকাতেই দেখল, ড. সেনশর্মা মাথা গুঁজে রয়েছেন টেবিলের ওপর। পিয়ের কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। সুজনের মুখে হাসি ফোটে। এই ক-দিনের পরিচয়েই পিয়েরের প্রতি ওর একটা দুর্বলতা জমেছে। বয়সে পিয়ের সুজনের চেয়ে ছোটই হবে। ওর সবচেয়ে বড় গুণ সারল্য। যা মনে হবে, সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলতে না পারলে, পিয়েরের যেন শ্বাসকষ্ট হয়। সুজন প্রথমটা ভয়ে ভয়ে ছিল। ফরাসিদের অনেক পাগলামির গল্প শুনেছে। সুজনের সেই ভয়টা কালই কেটে গেছে। আসলে পিয়েরের একটা রোমান্টিক মন আছে। আর তার সত্যিকার আসক্তি এবং হয়তো একমাত্র আসক্তি প্যারির প্রতি। কাল রাতে কত প্যারির গল্প শুনিয়েছে অথচ তার মধ্যে গুণকীর্তন ছিল না। এইটাই সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে সুজনকে। সুজনের কলকাতার প্রতি ভালোবাসা যেন নৈতিক সমর্থন পেয়েছে পিয়েরের প্যারি-প্রেম থেকে।

পিয়েরের পিঠে হাত রেখে আলতো আলতো ঠেলা দেয় আর হাসতে হাসতে বাংলায় বলে, ওঠো বাছা–আসল কাজটাই যে ভুলে যেতে বসেছ!

দু-একবার নড়াচড়া করে পিয়ের উঠে বসে। চোখ পিটপিট করতে করতে ভুরু কুঁচকে তাকায়। হোয়াট ডিড ইউ সে?

সুজন বাছা শব্দটার সোজা অর্থ আর তার পেছনের স্নেহমিশ্রিত ভর্ৎসনার কথা বুঝিয়ে বলতেই হো হো করে হেসে ওঠে পিয়ের। ড. সেনশর্মা বারান্দা থেকে উঠে আসেন। কী হে, সক্কালবেলায় এত হাসাহাসির কী হল?

সুজন বলে, আর দশ মিনিটের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট এসে যাবে। সবাই তৈরি হয়ে নিন। ছ-টায় হেলিকপ্টার আসছে।

আমি তো কখন রেডি। শুধু বইপত্তরগুলো যা ভরা বাকি। ড. সেনশর্মা বললেন।

আমিও রেডি। পিয়ের বলল।

তার মানে?

 তার মানে আবার কী? ফরাসি মানুষদের নোংরা বলে একটা দামি সংস্কৃতি আছে, জানো?

যাক, তাহলে সবাই রেডি আমি ছাড়া! সুজন হাসতে হাসতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।

পিয়ের বাইরে থেকে চেঁচায়, প্লিজ, তাড়াতাড়ি করো। বেশ বুঝতে পারছি, ক-দিন তোমাদের সঙ্গে থেকে আমারও অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে।

তাহলে তুমি এবার ভারতীয়দের মতো সংযম অভ্যেস করো। জানো তো, শাস্ত্রে ধৈর্য আর প্রতীক্ষা– ডক্টর সেনশর্মা মুখ টিপে হাসেন।

ও-ইউ টু ডক্টর।

এবার ডক্টর সেনশর্মাও পিয়েরের সঙ্গে হাসিতে যোগ দেন।

.

 কমিলগ কোম্পানির পেটমোটা সিকোরস্কি হেলিকপ্টারটা ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। মালপত্র যা ছিল, আগেই তুলে নিয়েছে। রোজার পিয়ের, ডক্টর সেনশর্মা আর সুজনকে ঢাউস পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতেই তার টার্বো জেট ইঞ্জিন গর্জে উঠল। মুহূর্তের জন্য ভাইব্রেশনে থরথর করে উঠল ধাতব পাখির শরীর। ইঞ্জিন পূর্ণ শক্তিতে আবর্তন করতে শুরু করেছে। পাইলনে লাগানো সুদর্শন চক্রের মতো তিনটে হাওয়া-কাটা রোটর-পাখার গতি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আশপাশের গাছের পাতাগুলো হাওয়ার ধাক্কায় উথালপাথাল। ধুলোর ঝড় উঠেছে ঘূর্ণি হাওয়ায়। ল্যাজের পেছনে ছোট্ট টেল-রোটার চাকাটাও হাওয়া কাটছে। সিকোরস্কির ল্যাজটা মাটি ছেড়ে একটু উঠে প্রথমে দেহটাকে সোজা করে নিল, এবার আকাশে উঠতে শুরু করেছে। শ-পাঁচেক ফুট আরোহণ করে তারপর রোটর ব্লেডের পিচ পালটে সিকোরস্কিটা সামনের দিকে ধেয়ে যায়।

শহরের মাথা থেকে পরিষ্কার দেখা যায় সমুদ্রের কিনারে সারি সারি তাল গাছ আর আম্রকুঞ্জ। সমুদ্রটা দেশের মধ্যে অনেকটা ঢুকে এসেছে। আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক জলাজমি ও বাদা।

সিকোরস্কিটা দক্ষিণ-পূর্বদিকে এগিয়ে চলেছে। শহর অঞ্চল ছাড়তেই সবুজের সমুদ্র ক্রমশ ঘন হতে শুরু করে। গাছের মাথায় আরও উঁচু হয়ে সেই সমুদ্রে জোয়ার এনেছে আর পাতায় পাতায় জড়িয়ে একেবারে অস্বচ্ছ করে তুলেছে সবুজ জলরাশিকে। দৈত্যের মতো গাছগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে রোজার বলে, ওকোউমি গাছ। এরই গুঁড়ি দেখেছিলেন কাল সমুদ্রে ভাসতে।

এখানে কি শুধু ওকোউমিই হয়? পিয়ের প্রশ্ন করে।

না, তা নয়। চিরবর্ষার অরণ্য তো–আবলুস গাছ হয়, ওমবেগা গাছও হয়। আপনারা যাকে বলেন মেহগনি। জানেন তো, ওকোউমি গাছকে আগে লোকে জাল মেহগনি বলত। ওকোউমি অনেক ধরনের হয়। তা ছাড়া রোজ উড, কোরাল উড, আয়রন উড–গ্যাবনের বনে গাছের ছড়াছড়ি।

সবুজ গালচেটার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার এগিয়ে চলে একঘেয়ে আর্তনাদ করতে করতে। এই একটানা সবুজের একঘেয়েমি তো চোখকে রেহাই দেবার জন্যেই যেন বৈচিত্র্য হিসেবে হঠাৎ-দেখা দুটো নদী। অরণ্যের বুক চিরে নীল ফিতের মতো এঁকেবেঁকে খাঁড়ির মুখে সমুদ্রে এসে মিশেছে।

রোজার জানাল, উত্তরদিক থেকে যে নদীটা এসেছে, ওটা এমবাই নদী আর দক্ষিণ থেকে কোমো। দুটো নদীই অবশ্য পরপর দু-বার বাঁক নিয়েছে উত্তরদিক বরাবর। এদের উৎপত্তি দক্ষিণ অঞ্চলের ক্রিস্টাল পর্বতে!

সুজন অবাক হয়। যে দেশ এত উর্বর, সেখানে এতটা পথ অতিক্রম করল অথচ একটাও কৃষিক্ষেত্র চোখে পড়ল না। রোজারকে প্রশ্ন না করে পারে না সুজন।

আপনি ঠিকই ধরেছেন। সেই অর্থে গ্যাবনে চাষবাস হয় না বললেই চলে। এখানকার অধিবাসীদের প্রধান খাবার ট্যাপিওক নামে এক ধরনের গাছের শিকড়। খুব রসালো। অনেক জায়গায় কাসাভা নামে পরিচিত। তা ছাড়া কলাও অন্যতম প্রধান খাদ্য। তিন বছর অন্তর বন সাফ করে কলার চাষ করে এখানে। কাটা গাছের গুঁড়ি ও পাতা পুড়িয়ে তৈরি হয় সার। নদীতে মাছও প্রচুর পাওয়া যায়। কমলালেবু, পাইনঅ্যাপল ইত্যাদি ফলেরও কিছু কিছু গাছগাছড়া দেখবেন গ্রামের আশপাশে।

আর বন্য পশুর মাংস? সুজন জানতে চায়।

না, পশু শিকারের ব্যাপারটা গহন বনে তেমন সোজা ব্যাপার নয় কিন্তু। পশু এখানে প্রচুর আছে, কিন্তু তাদের মারা বড় শক্ত। এমন ঘন বোন–তার ওপরে আছে জলাজমি আর সবচেয়ে মুশকিল করে লতাপাতারা। দুর্ভেদ্য যাত্রাপথ। কোনওক্রমে যদি বা পথ করা যায়, ততক্ষণে বন্য পশুরা হাওয়া। তৃণভূমি ছাড়া পশু শিকার করা প্রায় অসম্ভব।

কী আশ্চর্য! ভাবতেই পারা যায় না।

রোজার হাসতে হাসতে বলে, অনেকটা অসীম সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে জলের অভাবে তৃষ্ণায় মরার মতো। এখন অবশ্য নানা জায়গায় কোকো আর কফির চাষ হচ্ছে। অল্পস্বল্প ধানও ফলছে কোথাও কোথাও।

ডক্টর সেনশর্মা জানতে চান, এখানে কারখানা কিছু হয়েছে কি?

হ্যাঁ, অল্প অল্প করে গড়ে উঠছে। সিমেন্ট কারখানা, কাচের বোতল আর সেলুলোজ কারখানা আছে। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে স-মিল। কাঠচেরাইয়ের কল। তা ছাড়া মোউনানায় একটা ইউরেনিয়াম মিল আছে।

ইউরেনিয়াম মিল! ডক্টর সেনশর্মা অবাক।

আজ্ঞে হ্যাঁ, এখানে ইউরেনিয়াম আকরগুলো পেষাই হয় শুনেছি। পরীক্ষা করার পর আকরে যদি ইউরেনিয়ামের পরিমাণ ঠিকমতো আছে দেখা যায়, তাহলে সেগুলো ফ্রান্সে রফতানি হয়। তা ছাড়া সম্প্রতি গাম্বা নামে একটা জায়গায় পেট্রোলিয়াম পাওয়া গেছে। সেখানেও কাজ চলছে।

সুজন বলল, আমার বারবার মনে হয়, অনুন্নত দেশগুলোয় খনিজ পদার্থ আবিষ্কার হওয়ার চেয়ে না-হওয়াটাই বোধহয় বাঞ্ছনীয়। কী লাভ বলুন তো আফ্রিকার ছোট্ট একটা রাজ্যে একটা তেলের খনি আবিষ্কার হলে? তেল উঠবে, কিন্তু রিফাইনারি বসবে না। কাঁচা তেলটা যাবে উন্নত দেশের রাক্ষুসে সভ্যতার খিদেকে আরও বাড়িয়ে তুলতে। আরও গাড়ি ছুটবে, আরও এরোপ্লেন…

পিয়ের বলে উঠল, আর তাঁদের নিজেদের তেলের ভাঁড়ার যেমন ছিল, তেমনি থাকবে। তাতে হাতও পড়বে না। যত দিন না আর সবার সম্পদ ফুরোচ্ছে নিজেদের

ঠিকই বলেছেন আপনারা। আস্তে আস্তে বলল রোজার। তার চোখ দুটো ক্লান্ত বিষঃ দেখাচ্ছে। জানেন তো, আফ্রিকার বুনো লোকদের দারুণ বদনাম ছিল কুঁড়ে বলে? সভ্য দুনিয়ার লোকেরা আমাদের দেশে এসে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমাদের কুঁড়েমির জন্য কিছুতেই ব্যাবসা ফাঁদতে পারছিল না তারা। কাকে দিয়ে কাজ করাবে? এই ধরুন–এই যে বিশাল বন, কোটি কোটি টাকার কাঠের ব্যাবসা করবার আশা নিয়েই তো তারা এখানে এসেছিল। কিন্তু কে গাছ কাটবে, কে নদীতে বয়ে নিয়ে যাবে–লোক কোথায়? কেউই খাটতে রাজি নয়। এরকম মুশকিলে তারা কখনও পড়েনি। তখন অবধি আমরা প্রয়োজন বলতে কী বোঝায়, জানতাম না। কোনও দিন অনুভব করিনি। খিদে মেটাতে পারলে আর শরীরটাকে প্রাকৃতিক আক্রমণ থেকে মোটামুটি রক্ষা করতে পারলেই খুশি। যাদের কোনও প্রয়োজন নেই, লোভ নেই, তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেবারও উপায় নেই। এইরকম ফ্যাসাদে পড়ে তারা শেষ পর্যন্ত কোমর বেঁধে লাগল আমাদের প্রয়োজন সৃষ্টি করার জন্য। জামা এল, প্যান্ট এল, জুতো এল, নিত্যনতুন জিনিস এল–আমরা আস্তে আস্তে সেগুলো ব্যবহার করতে শুরু করলাম, অভ্যস্ত হলাম, তারপর একদিন দেখা গেল, সেগুলো ছাড়া আমাদের আর চলছেই না। সাদা মানুষের সভ্যতা আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসল। আমরা খাটতে শুরু করলাম তাদের জন্য, তাদেরই সৃষ্টি-করা প্রয়োজন। মেটাতে। এখন আমাদের কুঁড়ে বদনামটা বেশ কিছুটা ঘুচেছে।

সবাই একমনে শুনছিল রোজারের কথা। হঠাৎ ডক্টর সেনশর্মা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে একবার তাকিয়েই লাফিয়ে ওঠেন, দেখো, দেখো

সবুজের সমুদ্রের ঢেউ এসে ধাক্কা খেয়েছে নিচু নিচু পাহাড়ের সারির গায়ে। এবড়োখেবড়ো লালচে ল্যাটেরাইটের পাথুরে জমির প্রান্তে এসে থমকে গেছে গাছেরা। তারপর শুরু হয়েছে পাহাড়ের ঢাল। সবুজের দুনিয়ায় পোড়ামাটি রঙের কিন্তু এতটুকু বেমানান নয়।

রোজার বলে, গ্যাবিনের পশ্চিমে সমুদ্রের পার থেকে চিরবর্ষার অরণ্য ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তার মধ্যে কিছু পাহাড়ি অঞ্চলও আছে–একটা লম্বা শিরা যেন উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। তবে কোনও পাহাড়ই মাথায় খুব উঁচু নয়। আমরা এখন মিকিঙ্গো পর্বতমালার ওপর দিয়ে যাচ্ছি। আরও দক্ষিণে ওগোওয়ি নদীর অপর পারে রয়েছে গ্যাবনের সবচেয়ে বড় পাহাড় ইবাউন্ডজি। অবশ্য তারও উচ্চতা মাত্র পাঁচ হাজার ফুটের মতো।

কোথায় যে নদীর কিনারা শেষ হয়ে ডাঙা শুরু হচ্ছে, বোঝাই দুষ্কর। দৈত্যের মতো সব গাছের জট-পাকানো মোটা মোটা শেকড় একেবারে জলের ওপর অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। লতাপাতারা আবার শেকড়গুলোকে জড়িয়ে ধরে নানা রঙের ফুল ফুটিয়ে বসে আছে। খেজুর গাছের সারি, ঝাঁকড়ামাথা বড় বড় পাতাওয়ালা গাছের বন, মাঝেমধ্যে এক-আধটা ঢ্যাঙামাথা পাইন আর ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে মাথায় মানুষের সমান উঁচু প্যাপিরাসের খেত। প্যাপিরাসের এক-একটা পাতা যেন এক-একটা হাতপাখা। আর উজ্জ্বল সবুজের এই মহাসমারোহের মধ্যে থেকে বারবার আচমকা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় জলের আয়না। সূর্যকিরণ ঠিকরে আসে। হেলিকপ্টারটা ওদের দেখবার সুযোগ করে দিতেই যেন আরও নীচে নেমে এল। অসংখ্য নদী ও শাখানদীর হিজিবিজি জটলা বনের মধ্যে। নদীর বাঁকে বাঁকে নিত্যনতুন শাখানদী এসে মিশেছে। মূল জলধারাটি আবার মাঝে মাঝে বিরাট এক-একটা হ্রদে গিয়ে পড়েছে, তারপর হ্রদের আরেক প্রান্ত থেকে শুরু করেছে নতুন যাত্রা। হঠাৎ হেলিকপ্টারের পাশ দিয়ে দুটো ভীত পাখি উড়ে পালাল। সিন্ধু-ইগল।

স্টিমার না? সুজন নীচের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল।

 স্টিমারটা নদীর কূলে দাঁড়িয়ে অল্প অল্প ধোঁয়া ছাড়ছে।

কাঠকুটো বোঝাই করছে। এখানে তো কয়লা পাওয়া যায় না। কাঠের আগুনেই চলে। রোজার জানাল।

অদ্ভুত ধরনের স্টিমার তো! পেছনদিকে দুটো বিরাট চাকা।

অদ্ভুত কিছু নয়। ওগুলো জল কাটার জন্যে প্যাড়ল হুইল। এই ধরনের স্টিমার অগভীর নদীতে চলার উপযোগী। কেন সুজন, দেখোনি? কলকাতা ও বাংলাদেশের মধ্যেও তো এইরকম সার্ভিস এখনও চালু আছে। ডক্টর সেনশর্মা বলে ওঠেন।

ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিন্তু তার প্যালগুলো তো দু-পাশে থাকে দেখেছি।

এখানে নদী দিয়ে কাঠ ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই জন্যেই এগুলো পেছনে লাগানো থাকে। পাশে থাকলে ধাক্কা লাগার ভয় বেশি। রোজার বুঝিয়ে দেয়।

এরকম স্টার্ন হুইলার স্টিমার আমাদের দেশেও আছে। যদি কোনও দিন বিহারে যাও তো রাজমহলের কাছে দেখতে পাবে। সেনশর্মা আবার বলেন।

স্টিমারটাকে পেছনে ফেলে নদীটাকে অনুসরণ করে আরও এগিয়ে চলে হেলিকপ্টারটা। নদীর বুকে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে নীল-সাদা পাখিরা। একটা বক কষ্টেসৃষ্টে নদীর পাড় থেকে ডানা ঝাঁপটে উড়ে গিয়ে বসল একটা মরা গাছের গুঁড়ির ওপর। সবুজ বন আর হলদে নদীর লুকোচুরি খেলার আর শেষ নেই। আরও কিছু দূর এগোতেই দূরে নদীর তীরে কয়েকটা জন্তুর নড়াচড়া চোখে পড়ল। মোষের পাল নাকি?

দেখুন–দেখুন–জলহস্তী! বলে উঠল রোজার।

হেলিকপ্টারটা আরেকটু এগোতেই কেঁদো চেহারাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। দু-তিনটে দাঁড়িয়ে আছে পারে, কয়েকটার মাথা দেখা যাচ্ছে জলের ওপর। গা ডুবিয়ে রয়েছে। এ চেহারা ভুল করার নয়। হেলিকপ্টারটার ব্লেডের সোঁ সোঁ ঝোড়ো হাওয়ায় আশপাশের গাছের পাতায় পাতায় কাঁপন লাগছে, গর্জনও কিছু কম নয়। হিপোর দল পারে দাঁড়ানোর ভরসা পেল না। দুদ্দাড়িয়ে জলের মধ্যে নেমে গা-ঢাকা দিল।

ওগোওয়ি নদীতে ভীষণ জলহস্তীর উপদ্রব। যারা নাও নিয়ে যায়, এমনকী স্টিমারের চালকরাও এদের খুব ভয় পায়। কখন যে জলের তলা থেকে চাগিয়ে উঠবে, কেউ বলতে পারে না।

হেলিকপ্টারটার নীচেই এবার ছোট্ট একটা নদী পড়ে। বনের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে। হঠাৎ বনের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানলার কাচের সঙ্গে প্রায় চোখ ঠেকিয়ে বসে আছে সকলে। পৃথিবীর সবুজ চুলওয়ালা মাথাটার মধ্যে এই জায়গাটায় যেন টাক পড়ে গেছে। ভালো করে ঠাহর করতেই বোঝা যায় এটা একটা গ্রাম। বিরাট জায়গা জুড়ে গাছের বাগান আর তার পাশেই আট-দশটা চালাঘর যেন একটা কাল্পনিক বৃত্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দেখবার আরও সুযোগ করে দেবার জন্যেই সিকোরস্কিটা বোধহয় আস্তে আস্তে নীচে নেমে এল। গ্রামের পাশ দিয়েই গেছে সরু একটা খাল, তার দু-পারে অজস্র বাঁশবন। ছোট ছোট গাছপালা লতায়-পাতায় জড়িয়ে রহস্যময় গোলকধাঁধা তৈরি করেছে জলাজমির ওপর। কুটিরগুলোর চারপাশে অতিকায় গাছের বদলে রয়েছে ফলমূলের গাছ। বিশেষ করে অনেকটা কলা গাছের মতো দেখতে অজস্র গাছ চোখে পড়ে। এক-এক কাঁদিতে অগুনতি লালরঙা ফল ধরেছে।

অনেকটা কলা গাছের মতো লাগছে না? ডক্টর সেনশর্মার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সুজন।

 রোজার বলে ওঠে, এগুলো কলা গাছই তো।

 তা-ই নাকি! সুজন অবাকও হয়, খুশিও হয়।

ডক্টর সেনশর্মা বলেন, বাংলাদেশে লাল রঙের কলা দেখা যায় না, কিন্তু আমি ব্যাঙ্গালোরে দেখেছি, সেখানে দোকানে দোকানে লাল রঙের কলার কাঁদি ঝোলে।

আচ্ছা ডক্টর–দেখুন, ওদের ঘরগুলো আমাদের গ্রামের বাড়ির মতোই মাটি দিয়ে তৈরি না? সুজন বলে।

রোজার জানায়, হ্যাঁ-বাঁশ দিয়ে আগে একটা খাঁচার মতো করে নিয়ে তারপর মাটি লেপে দেয়। ছাতে দেখুন তালপাতার ছাউনি। এখানে দেখছেন তো বাড়িগুলো চৌকো চৌকো, অনেক জায়গায় কিন্তু একেবারে গোলাকার বাড়িও হয়।

হঠাৎ বিপ বিপ শব্দে সবাই জানলা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সামনেই ককপিটে ঢোকার দরজার মাথায় লাল আলোটা দপ দপ করছে। নো স্মোকিং প্লিজ লেখাটা জ্বলে উঠেছে। মাইক্রোফোনটা সরব হয়ে ওঠে, প্লিজ ফাসন ইয়োর সিট বেল্টস।

ঘটনার আকস্মিকতা সবার মুখের কথা কেড়ে নেয়। নীরবে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। প্লেন নামা বা ওঠার সময়েই এরকম নির্দেশ আসে। কিন্তু হঠাৎ এখানে নামার কী কারণ হতে পারে? সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল জানলার বাইরে চোখ পড়তেই। অতিকায় গাছের সারি তেড়ে আসছে। গ্রামের মাথায় ফাঁকা জায়গাটা শেষ হতেই আবার শুরু হয়েছে বন। হেলিকপ্টারটার আরও অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়া উচিত ছিল ইতিমধ্যে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবুজের ঝাপটা লাগবে সিকোরস্কির ধাতব গায়ে। আতঙ্ক তার অবিশ্বাসের টানাপোড়েনের মধ্যেই পিয়েরের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শোনা যায়।

কুইক। সেফটি বেল্ট লাগিয়ে নিন।

চাবুকের মতো কাজ করে পিয়েরের নির্দেশ। রোবটের মতো সবাই মুহূর্তের মধ্যে টেনে নেয় বেল্টগুলো। বেল্ট বাঁধা শেষ করতে না করতেই একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে হেলিকপ্টারটা বাঁদিকে কাত হয়ে যায়। সুজনের দেখে মনে হয়, হাত বাড়ালেই বোধহয় সামনে ঝাঁকড়া গাছের পাতায় হাত রাখতে পারবে। ইঞ্জিনের গর্জনে আর এরোফয়েলের হাওয়ায় গাছের পাতার শান্ত আশ্রয় ছেড়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে অনেক রংচঙে লম্বা লম্বা ঠোঁটওয়ালা পাখি পালিয়ে যাচ্ছে। সিকোরস্কিটা যদি চট করে বাঁদিকে কাত হয়ে পড়ে মোড় না নিত তাহলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অবধারিতভাবে ওকোউমিদের ডালপালার জালে জড়িয়ে পড়ত! কিন্তু দিক পরিবর্তন করেও কি রেহাই পাবে? প্লেনটা যেন কিছুতেই আর ওপরে উঠতে পারছে না। গোল হয়ে ঘোরবার চেষ্টা করছে গ্রামের মাথার ফাঁকা জায়গাটার মধ্যে। ডানদিকের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, হেলিকপ্টারটা বাঁদিকে কাত হয়ে রয়েছে বলেই তার মাথার বিরাট পাখাটার ডান ধারটা কয়েক ইঞ্চির জন্যে বোধহয় গাছের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেছে এখনও। কিন্তু গোল হয়ে ঘুরেও রক্ষা পাওয়া মুশকিল। হেলিকপ্টারটার গোল হয়ে ঘুরতে যতটা জায়গা লাগে, তার তুলনায় ফাঁকা জায়গাটা আকারে ছোট। সবুজ দানবেরা আবার এগিয়ে আসছে। সুজন চোখ বুজে ফেলে। সিটের হাতল দুটোর ওপর ডক্টর সেনশর্মার হাতের মুঠো ক্রমশ আরও চাপ সৃষ্টি করে। একমাত্র পিয়েরেরই কোনও দুশ্চিন্তা নেই বোধহয়। রোজারের পেটে খোঁচা মেরে বলে, এই দেখো, আর ভাবনা নেই, অনেকটা উঠে পড়েছি। ওঠ বাবা, ওঠ–

পিয়েরের কথার খেই ধরেই বোধহয় সিকোরস্কিটা আবার একটা ঝাঁকুনি মেরে আরও কাত হয়ে পড়ল। সুজন লক্ষ করে, সত্যিই খানিকটা উঁচুতে উঠতে পেরেছে এতক্ষণে। তবে এখনও অনিশ্চিত, গাছের হাতছানি শেষ পর্যন্ত এড়াতে পারবে কি না। বুকের মধ্যে যেন গুমগুম করে হৃৎপিণ্ডটা দামামা বাজাচ্ছে। পারবে কি শেষ পর্যন্ত? দেড় পাক ঘুরে আবার বনের প্রান্তে এসে পড়েছে হেলিকপ্টারটা। আর কাত হয়ে এড়াতে পারবে না। হয় ওপর দিয়ে যাবে, নয়তো…। যন্ত্রের পাখি সিকোরস্কির গায়ের ডুরঅ্যালুমিনিয়ামের ঝকঝকে হালকা ধাতুর চামড়ার ওপর গাছের ডালপালার মুখ দিয়ে আঁচড় কাটছে এবার। কিন্তু যতটা ক্ষতবিক্ষত করতে পারবে ভেবেছিল, পারেনি। সিকোরস্কি তার নিজের ক্ষমতায় না হোক, চালকের বুদ্ধির জোরে কোনওক্রমে তাদের অশুভ হাতছানি থেকে অব্যাহতি পেয়ে বনের মাথা ছাড়িয়ে উড়ে চলেছে। তবু দম-আটকানো শ্বাসটা যেন ছাড়া আর যায় না। অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে গাছেদের সঙ্গে চোর-চোর খেলায় ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলেছে, নিশ্চিন্ত হবার মতো নিরাপদ দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না কিছুতেই।

পিয়ের ভুরু কুঁচকে বলে, কী ব্যাপার রে বাবা! ব্যাটা ওপরে ওঠে না কেন! হঠাৎ ভার বেড়ে গেল নাকি!

রোজার মন্তব্য করল, আমার মনে হচ্ছে, কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে।

ডক্টর সেনশর্মা আর সুজন প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, দেখো–দেখো—

সঙ্গে সঙ্গে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল জানলার ওপর। সামনেই দেখা যাচ্ছে বনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা। মরুভূমিতে পথহারা অভিযাত্রীরা মরূদ্যান খুঁজে পেলেও বোধহয় এতটা স্বস্তি বোধ করে না। সিকোরস্কিটা সুযোগ পেয়েই আস্তে আস্তে নীচে নামতে করে দিয়েছে।

মাইক্রোফোনটা খন খুন করে উঠল, সরি ফর ইনকনভিনিয়েন্স। যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য আমরা ফোর্স ল্যান্ডিং করছি। আশঙ্কার কোনও কারণ নেই, মনে হয়, দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই ডিফেক্ট সারিয়ে নেওয়া যাবে। আমরা যাত্রীদের অনুরোধ করছি, তাঁরা যেন হেলিকপ্টার থেকে না নামেন। এয়ারকন্ডিশনার চালু থাকবে, তাই কোনও অসুবিধা ভোগ করতে হবে না।

পিয়ের উত্তেজিতভাবে এগিয়ে বসে ডক্টর সেনশর্মার হাত ধরে বলল, ডক্টর, দিস ইজ ইম্পসিবল। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে কেমন গোলমেলে ঠেকছে। ওরা কি আমাদের এই বনের মধ্যে প্লেনের ভেতর আটকে রেখে দিতে চায় নাকি! মতলবটা কী?

ডক্টর সেনশর্মা ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, উত্তেজিত হোয়ো না পিয়ের। ওরা হয়তো ভয় পাচ্ছে আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই…

না–না–আমরা ছেলেমানুষ নই। নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করতে পারব। কে বলতে পারে, পুরো ব্যাপারটাই আমেরিকানদের কোনও চাল কি না। গহন অরণ্যে হেলিকপ্টারটাকে উধাও করে সমস্ত অভিযানটা বানচাল করে দেবার মতলবও তো হতে পারে! পিয়ের বলল।

কিন্তু-খবরটা তো আর চেপে যেতে পারবে না! সুজন বলল।

না, তা পারবে না। কিন্তু সমস্ত দুনিয়ার লোক জানবে, দুর্ঘটনায় পড়ে আমরা শেষ হয়ে গেছি। তারপর আবার যত দিনে নতুন কোনও অভিযাত্রীর দল আসবে, তার মধ্যে ওরা ওদের সব অপকর্মের নিদর্শন লোপাট করে ফেলবে। আই অ্যাম দ্য লাস্ট পারসন টু টলারেট দিস। পিয়ের উঠে দাঁড়াল।

হেলিকপ্টারটা মাটি স্পর্শ করছে। ইঞ্জিনের গর্জন হালকা হয়ে একেবারে স্তব্ধ হতেই পিয়েরের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর ইন্টারকমের সামনে ধ্বনিত হল, লিসন ক্যাপটেন, ইমিডিয়েটলি আমাদের নামবার ব্যবস্থা করুন, না হলে আই উইল ফোর্স দ্য ডোর ওপন!

পিয়ের হাওয়াই শার্টের তলা থেকে প্যান্টের কোমরে গোঁজা ছোট একটা ঝকঝকে অস্ত্র টেনে বার করেছে। পেছনের দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় নেই, এটা শুধু আত্মরক্ষার জন্যেই ব্যবহার করা হবে।

সুজন উঠে দাঁড়াল, ডোন্ট বি হেস্টি পিয়ের!

ডোন্ট ইউ ওরি! পিয়ের পা বাড়ায় ককপিটের বন্ধ দরজাটার দিকে। দু-পা এগোতেই দরজা খুলে যায়। সাড়ে ছ-ফুট ঢ্যাঙা ইয়াঙ্কি ক্যাপটেন আর তারই দোসর কো-পাইলট, দু জনেই বেরিয়ে এসেছে। পিয়েরের হাতে বিপদের শাসানি দেখেই তারা থমকে দাঁড়ায়। যন্ত্রচালিতের মতো তাদের হাত দুটো মাথার ওপর উঠে যায়। পিয়ের কিছু বলার আগেই ক্যাপটেন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, আপনি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছেন স্যার। আমাদের কোনও ইভিল উদ্দেশ্য নেই।

ও.কে., আপনি আমাদের নামবার ব্যবস্থা করুন। তাহলে আপনাকে বিশ্বাস করতে কোনও অসুবিধা হবে না। পিয়ের রিভলভারের মুখটা লক্ষ্য থেকে সরায়নি।

নিশ্চয়। আসুন এদিকে। বিশ্বাস করুন, আমরা এইসব জঙ্গলে ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়ার অনেক গল্প শুনেছি। কখন যে কী ঘটে, কেউ বলতে পারে না। কমিলগ কোম্পানিরই একটা হেলিকপ্টারের পাইলট ও কো-পাইলট একবার ফোর্স ল্যান্ডিং করেছিল উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে একটা বনের মধ্যে। জানেন, পিগমিদের হাতে তাদের প্রাণ যায়। বেশি দিনের কথা নয় কিন্তু, সেই জন্যই…

পিয়ের, সুজন ও ডক্টর সেনশর্মা আর সবার পর রোজার হেলিকপ্টারের সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নীচে নেমে আসে। রোজার হিমশিম খায় কাঁধে চড়ানো বিরাট এক হ্যাঁভারস্যাকের ভারে। পিয়ের নীচে দাঁড়িয়ে বলে, রোজার, আগে বললে না কেন, অত ভারী হ্যাঁভারস্যাকটা…

ক্যাপটেন বলে, কী দরকার ছিল এসব নামাবার? আমার মনে হয় না, দু-ঘণ্টার বেশি ডিটেড হতে হবে বলে…

আমরা অত্যন্ত সিনিক, ক্যাপটেন। আমাদের সারাজীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের শুধু অবিশ্বাসী হবার শিক্ষাই দিয়েছে। আপনারা এটাকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে মনে করবেন না। সুজন কথাগুলো বলতে বলতেই ভাবে, তার বাঙালিয়ানার অসুখ কোনও দিন যাবে না। ভুল করেও কাউকে আঘাত দিতে অত্যন্ত নারাজ সে।

পিয়ের বলে, আমাদের ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতে এইরকম পরিস্থিতিতে অবিশ্বাস নিয়ে চলাটাই আমরা কর্তব্য বলে মনে করি। যা-ই হোক, এরকম ফোর্স ল্যান্ডিং এর কারণটা কী?

ক্যাপটেন বলল, কিছুতেই মেন রোটারের লিট বাড়ানো যাচ্ছে না। কোনওক্রমে রক্ষা পাওয়া গেছে। নিশ্চয় একটা কিছু ফেঁসে গেছে।

পিয়ের বলল, কালেকটিভ পিচ স্টিকের লিংকে কোথাও কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?

ক্যাপটেন রীতিমতো অবাক। আপনি, আপনি হেলিকপ্টার মেকানিজম জানেন?

 অল্পস্বল্প। পিয়ের এড়িয়ে গেল প্রশ্নটা।

না–পিচ স্টিকে কোনও গণ্ডগোল নেই। আমার মনে হয়—

 মনে হওয়ার কিছু দরকার নেই। পাইলটের কাছে যন্ত্রপাতি থাকে যদি, সোয়াশ প্লেটটা পরীক্ষা করুন। ওখানেই কিছু জ্যাম হয়েছে। বেয়ারিং ইত্যাদি…।

ক্যাপটেন উৎফুল্ল হয়ে হাঁক দেয়, স্টিফেন

ইয়েস ড্যান!

উই আর রিয়ালি ভেরি লাকি! দেখো, ইনি তোমাকে সাহায্য করতে পারবেন।

 পিয়ের বলল, সাহায্য করতে পারব কি না জানি না, তবে বুঝতে পারব, ডিফেক্টটা সারানোর মতো কি না আর ঠিকমতো কাজ করা হচ্ছে, না ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে…

ও.কে.চলুন তাহলে। পিয়েরের চোখা বাক্যবাণ গায়ে মাখে না ক্যাপটেন।

 পিয়ের ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। মনে হয় না দু ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে।

ডক্টর সেনশর্মা ইতিমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা দূরে চলে গিয়েছিলেন। রোজার তার পেছনে ছায়ার মতো লেগে আছে। সুজন দেখে, ডক্টর সেনশর্মা নিচু হয়ে মাটিতে কী যেন লক্ষ করছেন।

কী দেখছেন ডক্টর?

 কাটা গাছের গুঁড়ি দেখে বুঝতে চেষ্টা করছি, কত দিন আগে কাটা হয়েছে।

এতক্ষণে সুজন খেয়াল করে, বনের মধ্যে এই জায়গাটা থেকে গাছ কাটা হয়েছে।

সুজন পিয়েরকে বলে, তুমি যাও, উড়োজাহাজ সারও, ততক্ষণে আমরা বরং বনের মধ্যে থেকে একবার ঘুরে আসি।

ড্যান সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায়, ও নো, নেভার–ভীষণ বিপজ্জনক।

ডক্টর সেনশর্মা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন, না–না–অত ভয় পাবার কিছু নেই। এমন সুযোগ জীবনে সহজে আসে না। আমি যাবই। রোজার, তুমি কী বলল শুনি।

রোজার বলে, এখানে পিগমিদের কোনও ভয় নেই। ওরা থাকে গ্যাবনের দক্ষিণ-পূর্বে গহন জঙ্গলে। তবে সাপখোপ, বড় বড় বিছের ভয় তো সব বনেই আছে।

ড্যান বলে, পিগমি নেই? তাহলে অবশ্য… আচ্ছা, এক মিনিট দাঁড়ান। স্টিফেন, আমাদের রাইফেলটা এনে দাও। আপনারা চালাতে পারেন তো?

রোজার বলল, আমি পারি।

বেশ তাহলে আর চিন্তার কী! সুজন হাত বাড়িয়ে রোজারের কাঁধ থেকে হ্যাঁভারস্যাকের ভারটা সরিয়ে নিতে চায়। এবার ও রাইফেলের বোঝা বও।

স্টিফেন মুহূর্তের মধ্যে রাইফেলটা এনে দেয়। তবু পিয়েরের হাতের ঝকঝকে বিপদটা এখনও খাড়া হয়ে রয়েছে।

ডক্টর সেনশর্মা বলেন, কী হে পিয়ের, ওরা বিশ্বাস করে এত বড় অস্ত্রটা তুলে দিল, আর তোমার খুদে জিনিসটা তুমি নামাতে পারছ না?

পিয়ের হেসে বলে, যতক্ষণ না গন্তব্যস্থলে পৌঁছোচ্ছি, ওসব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সেন্টিমেন্ট আমায় ছোঁবে না। পৌঁছে যাবার পর অবশ্য ড্যান আর স্টিফেনকে আমি খাঁটি ফরাসি কনিয়াক খাওয়াব।

রোজার বলল, আপনারা বরং প্যান্টগুলো মোজার মধ্যে খুঁজে নিন। সে নিজেও নিচু হয়ে মোজা ফাঁক করে প্যান্টের তলাটা আঙুলে করে ঠেলে ঠেলে গুঁজে দিচ্ছে।

ডক্টর সেনশর্মা জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার বলো তো?

এখানে খুব পোকামাকড়ের উপদ্রব। তা ছাড়া বিষাক্ত বিছেরও ভয় আছে। প্যান্টটা গোঁজা থাকলে কোনও পোকা পায়ে উঠলেও দেখা যাবে। না হলে, কখন প্যান্টের তলায় ঢুকে যাবে নজর এড়িয়ে, কেউ বুঝতেও পারবে না।

রোজারের কথা থেকেই বোঝা গেল, তার বনেজঙ্গলে চলাফেরার অভিজ্ঞতা আছে। একদিক দিয়ে স্বস্তি বোধ করে দু-জনেই। গহন বনের আকর্ষণে মাদকতা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তা বলে যেচে বিপদের মুখে পড়ায় কোনও বাহাদুরি নেই। প্যান্ট খুঁজে বনের সীমানার দিকে এগোতেই নজরে পড়ে একের পর এক কাটা গাছের গুঁড়ি গুঁড়িগুলো প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে ঘন সবুজ শ্যাওলায় আর বুনো ফার্নের এলোমেলো ডালপাতায়। তাই দূর থেকে দেখলে বোঝার কোনও উপায় নেই। চারধার জুড়েই অসংখ্য চারাগাছ যেন হু হু করে বেড়ে চলার প্রতিযোগিতা জুড়ে দিয়েছে। সুজন বলে, ডক্টর, আমার তো মনে হচ্ছে না গাছগুলো খুব বেশি দিন আগে কাটা হয়েছে বলে।

রোজার বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন। খুব বেশি দিন আগে কাটা হলে এত দিনে এখানে এমন ঝোঁপজঙ্গল হয়ে যেত যে, এক পা এগোনো সম্ভব হত না।

বনের প্রান্তে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় সকলে। চিররহস্যের এক অজানা আদিম জগতে পা রাখার আগে সভ্য মনটাকে যেন তৈরি করে নিতে হয়। সুজনের বারবার মনে হয়, প্রত্যেক মানুষের একবার গহন বনে আসা উচিত। নিজেকে যেন নতুন করে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে অরণ্য প্রকৃতি। অসীম সমুদ্রের তীরে একা দাঁড়িয়ে আর উদ্ভিদজগতের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে মানুষ বোধহয় তার প্রাণের ইতিবৃত্তের হদিশ পায়। পরম শ্রদ্ধায় অপ্রত্যাশিতকে দু-চোখ ভরে দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বনের প্রথম দু তিন সারি মহিরুহ পার হয়ে ভেতরে ঢোকে ওরা। অসম আর উত্তরবঙ্গের বনে ঘোরার অল্পস্বল্প অভিজ্ঞতা আছে সুজনের। কিন্তু তার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পায় না। ওকোউমি গাছগুলো খাড়া উঠে গেছে আকাশের দিকে। কম করে দু-শো-তিনশো ফুট তো হবেই। মানে কুড়ি-পঁচিশতলা বাড়ির সমান। গাছের নীচের দিকে তেমন ডালপালা নেই। একশো ফুটের মতো সোজা উঠে গিয়ে তারপর ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে। ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, গাছের ওপরে আরও দুটো ডালপাতার তাক রয়েছে। তার মধ্যে একেবারে ওপরেরটা একটা বিরাট ছাতার আকারে অনেকখানি জায়গা জুড়ে পাতার ছাউনি বিছিয়ে রেখেছে। মানুষ হাতের সমান মোটা মোটা রাক্ষুসে লতা আর পাতায় পাতায় গায়ে গায়ে জড়িয়ে সেখানে এমন এক সবুজ জাল তৈরি হয়েছে যে, বিষুবরেখার মধ্য গগনের সূর্যও তার তীব্র রশ্মি দিয়ে তাকে ক্কচিৎ ভেদ করতে পারে। বনের মধ্যে যত এগিয়ে চলেছে, অন্ধকারও তত গাঢ় হচ্ছে। একটা সোঁদা ভ্যাপসা গন্ধ ক্রমশ জড়িয়ে ধরছে ওদের। বনের মধ্যে স্যাঁতসেঁতে ভিজে হাওয়া, তাপ অনেক কম, কিন্তু সারা শরীর ঘামে জবজব করছে। জামাগুলো জড়িয়ে গেছে গায়ের সঙ্গে।

অজানার স্বাদ গ্রহণ করবার জন্যে সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠেছে, যাতে কোনও শব্দ,বর্ণ বা গন্ধের লেশমাত্র তাদের ফাঁকি দিতে না পারে।

রোজার ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটা গাছের গুঁড়ির দিকে দেখুন–কীরকম অদ্ভুত চেহারা।

সত্যিই দেখবার মতো। গুঁড়ির তলার দিকটায় মাটির পাঁচ-ছ-ফুট ওপর থেকে কতকগুলো মোটা মোটা পাখনা বেরিয়েছে। তারপর পাখনাগুলো ক্রমশ চওড়া হয়ে মাটির ভেতরে ঢুকে গেছে।

রোজার বলে, গাছগুলোর যত বয়স বাড়ে, মাথায় ততই লম্বা হয়। আর সেই সঙ্গে তাদের এইরকম ডানা গজায়।

ডক্টর সেনশর্মা গাছের গুঁড়ির ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, প্রকৃতির চেয়ে বড় বিজ্ঞানী আজও জন্মায়নি। এই গাছগুলো এত লম্বা যে, এই মোটা মোটা গুঁড়িও তাদের সিধে হয়ে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এটা তাই তাদের ভারসাম্যরক্ষার অতিরিক্ত ব্যবস্থা। আমাদের বাড়িঘরের ভিতের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে তুলনা করা যেতে পারে। কে বলতে পারে, মানুষ হয়তো এইসব গাছপালার শিকড়বাকড়ের রকমসকম দেখেই প্রথম বাড়ির ভিত তৈরির আইডিয়া পেয়েছে। যে গাছ যত বড়, তার শেকড়ও তত মাটির গভীরে চলে যায়। তা ছাড়া বট গাছ তো আবার থাম নামিয়ে দেয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর কী জানো, গুঁড়ির এই তেকোনা পাখনাগুলো দেখো-এর এই তেকোনা আকারটা ইঞ্জিনিয়ারিং শাস্ত্র অনুসারে নিখুঁত। একাধারে শক্তিশালী এবং আয়তনেও বেশ ছোট। এগুলো এরকম না হয়ে… উফ…

রোজারের এক ধাক্কায় ডক্টর ছিটকে গিয়ে পড়েন মাটিতে। সুজন লাফ মেরে এগিয়ে আসে। রোজার রাইফেলের বাঁট দিয়ে কী যেন একটা পিষছে।

লেগেছে ডক্টর? সুজন টেনে তোলে।

নাঃ–মাটিতে তো পচা পাতার গালচে বিছোনো। কিন্তু, আমার চশমাটা কোথায় পড়ল?

সুজন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখতে পায়, রোজার একটা কাঠিতে করে প্রায় দশ ইঞ্চি লম্বা একটা তেঁতুলে বিছেকে ঝুলিয়ে আনছে।

ওরে বাবা–কী সাংঘাতিক চেহারা, অ্যাঁ? সুজন প্রায় আঁতকে ওঠে।

ডক্টর সেনশর্মা চশমা নাকে দিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়েন, বুঝলে–আমার চোখটা খারাপ বলেই কাছের জিনিস দেখতে একটু অসুবিধে হয়।

খুব বেঁচে গেছেন। উফ–জানো রোজার, আমাদের দেশেও এইরকম বিছে দেখা যায়, কিন্তু তা বলে এত বড়! আকারে বড়জোর এর অর্ধেক।

রোজার বলে, গাছপালার গায়ে হাত না-ঠেকানোই ভালো। এখানকার অনেক পোকামাকড়ই আকারে বিরাট এবং বিষাক্ত। স্থানীয় লোকেরা টোটকা ওষুধ জানে বলে তাদের কিছু হয় না। ওই দেখুন–ওই দেখুন

রোজারের আঙুল বরাবর তাকাতেই দেখা যায়, সবুজ রঙের বিকট চেহারার একটা পোকা গাছের গুঁড়ির গায়ে ডিঙি মেরে বসেছে। লম্বায় প্রায় ফুটখানেক হবে বোধহয়। একেবারে কাঠখোট্টা চেহারা।

ঠ্যাংগুলো দড়া দড়া আর শরীরটা যেন চার-পাঁচ ভাঁজে তেড়েবেঁকে রয়েছে। সরু কাঠির মতো শরীরের একেবারে সামনে চোখ দুটো নড়বড় করছে। গা-টা শিরশির করে। সুজন কল্পনায় প্রাগৈতিহাসিক যুগে পিছিয়ে গিয়ে স্পষ্ট দেখে, আজকের এই বিচিত্র প্রাণীটিই। আকারে দশ-বারোগুণ বড় হয়ে উঠেছে। তখনও হয়তো এই গাছেরই আদিম পিতৃপুরুষের আশ্রয়ে সে দিনযাপন করত।

রোজারের কণ্ঠস্বর কানে আসে, এগুলোকে ম্যাটিস বলে শুনেছি। মাংসাশী। পোকামাকড় খায়।

ডক্টর সেনশর্মা বলেন, জানো সুজন–এইটুকু দেখেই মনে হচ্ছে, এই আদিম অরণ্যের অনেক অনেক রহস্য আজও আমাদের অজানা থেকে গেছে। খুব আপশোশ হচ্ছে বটানির বা জুলজির কিছু জানি না বলে। আচ্ছা, বলতে পারো-ইস্কুল-কলেজে বসে বইয়ের পাতায় গাছগাছড়ার ছবি দেখে কতটুকু শেখা যায়! শিখতে যদি হয় তাহলে শেখার ইচ্ছেটা চাই সর্বপ্রথম, আর তার জন্যে আসতে হবে এইসব জায়গায়। মিশে যেতে হবে এদের সঙ্গে। সত্যি বলছি, আমি বেশ টের পাচ্ছি, এই জগতের নিজস্ব একটা ভাষাও আছে। যারা এদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবে, তারা নিশ্চয় সে ভাষাও আয়ত্ত করতে পারবে।

সুজন অবাক হয়ে তাকায়। প্রবীণ কাজ-পাগল মানুষটার এ এক অন্য মূর্তি। রসিক হলেও স্বল্পভাষীরূপেই তাঁর পরিচয় পেয়েছে সুজন। রসিকতার জাল বুনে তিনি প্রথম সুযোগেই নিজের জগতের মধ্যে ঢুকে পড়েন। আজকে এই সুযোগ না এলে তাঁর স্পর্শকোমল মনটা বিদগ্ধতার পেছনেই লুকিয়ে থাকত, সুজন তার পরিচয় পেত না।

ওরা আবার এগোতে শুরু করে।

আঁধার বনের মধ্যে বুনো পথ ধরে এগোতে কিন্তু তেমন অসুবিধা হয় না। ছোটখাটো গাছপালা ও ঝোঁপঝাড় প্রায় নেই বললেই চলে। মোটা মোটা থামের মতো বিশাল গাছগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে শুধু লতা আর লতা–অক্টোপাসের বাঁধন। অর্কিড জাতীয় এক ধরনের লতায় ফুটে রয়েছে ভারী সুন্দর গন্ধওয়ালা ভ্যানিল ফুল। ঝরাপাতায় ছাওয়া মাটির ওপর গোল গোল সাদা ছোপ সৃষ্টি করেছে সূর্যরশ্মি। কিন্তু এইটুকু আলো ছোটখাটো গাছপালার প্রাণ বাঁচানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। সুদীর্ঘ সবলের দুনিয়া এটা। তবে শ্যাওলা, ফার্ন, অর্কিড় ও লতা আবেষ্টনী আর গুল্মের অন্ত নেই। বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন আকারের ঝুরি আর শেকড় ঝুলছে। এদের মধ্যে কিছু যেমন ঝুলন্ত শেকড় দিয়ে বাতাস থেকেই সংগ্রহ করছে তাদের খাদ্য, তেমনি কিছু আবার জড়িয়ে ধরেছে তাদের প্রাণদাতা মহিরুহদের। কিছুটা উঁচুতে পাতার শিবিরে যেখানে কিছুটা সূর্যের আলো পত্রকুলের শাসন এড়িয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে, সেখানে বেগুনি রঙের অজস্র ফুল ফুটে গাছের গুঁড়িগুলোর বাহার বাড়িয়ে দিয়েছে। অসংখ্য রংবেরঙের প্রজাপতিদের সেখানে অবিরাম ঘোরাঘুরি। হঠাৎ মাথার ওপর থেকে একটা কর্কশ চিৎকার শোনা গেল। পরক্ষণেই আরেকটু দূর থেকে যেন আরও কর্কশ কণ্ঠে আরেকজন তারই জবাব দিল। ফাটা লাউডস্পিকারের মাইক্রোফোনে একেবারে মুখ জুড়ে কারা যেন ক্যারুর-ক্যারুর করে চিৎকার করছে। সবাই চমকে ওপরদিকে তাকায়। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ে না। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি কণ্ঠ যোগ দিয়েছে কর্কশ বাগবিতণ্ডায়। রোজার বলে, ভয় পাবার কিছু নেই। মনে হচ্ছে হর্নবিল পাখি।

রোজারের কথা শেষ হতে-না হতেই কড়মড় খড়খড় করে ডালপালা ভাঙার শব্দ কানে এল। হঠাৎ যেন পাতার রাজ্যের বিশেষ একটা জায়গায় ঝোড়ো হাওয়া হামলা বাধিয়েছে। এবার দেখা গেল মূর্তিমানদের। একপাল বাঁদর এ গাছ থেকে ও গাছে পলায়ন করল। সঙ্গে সঙ্গে ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল বেশ কিছু সবুজরঙা বড় বড় পাখি। তার মধ্যে একটা বেশ নিচু দিয়েই গেল। ল্যাজটা সাদা-সবুজে মেশানো। লাল টকটকে চোখ। গলায় সাদা রোঁয়ার ওপর সবুজের আঁচড় আর মাথার পেছন দিকে বাবরি-করা চুল। তবে সবচেয়ে দেখবার মতো ঠোঁটখানা। যেমন পুরু, তেমনি লম্বা আর সামনেটা ইগল পাখির মতো বেঁকানো। ঠোঁটের ঠিক গোড়াতে মাথার ওপর হলদে রঙের একটা খঙ্গ। এই থেকেই। নিশ্চয় হর্নবিল নামটা এসেছে।

রাশি রাশি স্যাঁতসেঁতে পাতা আর ভিজে শ্যাওলার ওপর পা ফেলে ওরা এগিয়ে চলে। জায়গায় জায়গায় এত পিছল যে, গাছের গুঁড়িতে হাত ঠেকাতে না পারলে টাল সামলানোই মুশকিল হয়ে পড়ে। মিনিট দশেক এগোবার পর বেশ কিছুটা দূর থেকে একটা খরর খর শব্দ কানে আসে। রোজার আঙুলের ইশারা ওদের চুপ করে দাঁড়াতে বলে। ভুরু কুঁচকে কান খাড়া করে শুনছে। শব্দটার মধ্যে একটা ছন্দ আছে। কর কর আওয়াজগুলো যেন মাপ-করা সময়ের ব্যবধানে ধ্বনিত হচ্ছে। হঠাৎ থেমে যায় শব্দটা।

কীসের শব্দ বলো তো রোজার? সুজন ফিশফিশ করে প্রশ্ন করে।

 ঠিক বুঝতে পারছি না। চলুন–কোনও শব্দ না করে এগোনো যাক। রোজারের হাতে। উদ্যত রাইফেল। সামনে রোজার, রোজারের পেছনে ডক্টর সেনশর্মা আর সবার শেষে সুজন। সারি বেঁধে পা টিপে টিপে শব্দ অভিমুখে এগিয়ে চলেছে। আশঙ্কা আর উত্তেজনা থমথম করছে। নিঃশব্দে পা ফেলে এগোতে অবশ্য তেমন সতর্কতার প্রয়োজন হচ্ছে না। এখানে গাছের শুকনো পাতাও মাটিতে পড়ামাত্র ভিজে যায়, তাই পায়ে পায়ে খড়খড় শব্দ সৃষ্টি হয় না। শুধু সতর্ক থাকা দরকার, যাতে দড়িদড়ার মতো লতা বা গাছের শেকড়ে পা লেগে হোঁচট খেয়ে পড়তে না হয়। খরখর শব্দটা ক্রমেই বাড়ছে। রোজারের একেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সুজন বলল, আর এগোনো কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

রোজার উত্তর্ণ হয়ে কী যেন শোনবার চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ থেকেই। বিশেষ করে শব্দটা যখনই থেমে যাচ্ছে। আরেকটু এগিয়ে দেখা যাক, আমার মনে হচ্ছে…

আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ নীরবে অতিক্রম করে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রোজার। একগাল হেসে বলল, এবার শুনতে পেয়েছেন?

সুজন ও ডক্টর সেনশর্মা দু-জনেই ঘাড় নাড়ল।

রোজার মুখের কাছে দু-হাত চোঙার মতো করে জোরে চেঁচিয়ে উঠল, হো-ও-হো-ও

তার চিৎকার মেলাতে-না মেলাতেই উলটোদিক থেকে ঠিক একই রকম চিৎকার ভেসে এল।

সে বলল, সামনেই বনের মধ্যে কাঠুরেরা নিশ্চয় কাঠ কাটছে। করাতের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আসলে হাওয়াটা বোধহয় ওইদিক থেকেই বইছে।

ডক্টর সেনশর্মার দিকে তাকিয়ে সুজন আবার বলল, আর এগোনো কি ঠিক হবে? ফিরতে দেরি হয়ে যাবে না তো?

অন্তর্নিহিত অর্থটা ধরতে ডক্টর সেনশর্মার একটুও অসুবিধা হয় না। না হে না, আমার জন্যে চিন্তা করতে হবে না। আমি এখনও পুরো ফিট আছি। সময় থাকলে আরও চার ঘণ্টা আমি স্বচ্ছন্দে ঘুরতে পারতাম।

সামনের দিকে বনের অন্ধকার ক্রমশ হালকা হয়ে আসে। তারপর ঝলমলে নীল আকাশের ঘেঁড়াখোঁড়া অংশ চোখে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা বনভূমির বাইরে একটা ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসে। বেশ কিছুটা অঞ্চল জুড়ে গাছ কাটা হয়ে গেছে। সামনেই একটা ডালপাতা ছাড়ানো গাছের গুঁড়ি তিন-চার টুকরো হয়ে পড়ে আছে। এত লম্বা একটা গাছকে আস্ত স্থানান্তরিত করা অসম্ভব। প্রথমটায় কোনও লোকজন চোখে পড়ে না। তারপর আবার সেই খরখর শব্দ কানে যেতেই তারা বাঁদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। একটা গাছের চারধারে বাঁশের মাচা বেঁধে মাটি থেকে প্রায় পনেরো-বিশ ফুট ওপরে টানা করাত হাতে ছ-জন কাঠুরে কাজ করছে। করাতের এ প্রান্তে তিনজন, ও প্রান্তে তিনজন। একদল টানছে, একদল ছাড়ছে। ওরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল গাছটার দিকে। ওদের দিকে। নজর পড়তেই লোকগুলো কাজ থামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। রোজার এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে তাদের মৌনতা ভঙ্গ হল। ওরা কী যেন জিজ্ঞেস করছে। রোজার পিছু ফিরতে কাঠুরে হাত তুলে হাসিমুখে ওদের অভ্যর্থনা জানায়। ডক্টর সেনশর্মা ও সুজনও ওদের অনুকরণ করে। ওরা কেউ কারও ভাষা বোঝে না। গ্যাবনের দুর্গম অরণ্যের অধিবাসীদের সম্মুখীন হবার অভিজ্ঞতা হয়তো কোনও বাঙালিরই আজ অবধি হয়নি, তবু কত স্বচ্ছন্দে তারা ভাব আদান-প্রদান করছে। নির্দ্বিধায় পরস্পরকে শুভাকাঙ্ক্ষী বলে বিশ্বাস করে নিয়েছে। অথচ আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা এই দেশেরই এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছোবে, যেখানে সভ্য মানুষের ক্রুরতা, নীচতা, ক্ষমতার লালসা ও বিশ্বাসঘাতকতার দগদগে ঘা গায়ে নিয়ে প্রকৃতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

রোজার ফিরে এসে জানাল, ওরা প্রথমটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল আমাদের দেখে। তার ওপর হাতে রাইফেল। একটু ওদিকে দেখতে পাবেন, ওগোওয়ি নদীর তীরে ভেলায় কাঠ বোঝাই হচ্ছে।

ডক্টর সেনশর্মা সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ান। চলো রোজার

সুজন কোনও আপত্তি না জানিয়ে তাঁকে অনুসরণ করে। বনের ও প্রান্তে দু-তিন সারি গাছ পেরোতেই জলের শব্দ কানে আসে। হঠাৎ ডক্টর সেনশর্মা দাঁড়িয়ে পড়েন। একটা গাছের ওপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

কী দেখছেন ডক্টর? রোজার জানতে চায়।

ওই দেখো! সুজন, এদিকটায় এসো। দেখছ, দেখতে পাচ্ছ?

এবার সুজনের অবাক হবার পালা। বিশাল ওকোউমি গাছের অনেকটা ওপরে ডাল থেকে চার-পাঁচটা ফুলকপি ঝুলছে।

ওখানে ফুলকপি রাখল কে? সুজন হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে।

 ফুলকপি রাখবে কেন? ওখানে তো ফুলকপি হয়। রোজার হাসতে হাসতে জানায়।

সত্যি। আশ্চর্য হবারও একটা সীমা থাকা উচিত। গাছের মগডালে ফুলকপি! ডক্টর সেনশর্মা বলেন।

আর এই ফুলকপির চাষ করার জন্যে আমাদের কত কসরত করতে হয় ভাবুন।

সুজনের কথা শুনে রোজার বলে, আপনাদের দেশে ফুলকপি হয়?

হয়, কিন্তু অনেক মেহনত করে। তোমাদের মতো এরকম বনেজঙ্গলে পাওয়া যায় না। ডক্টর সেনশর্মার কথা শেষ হতে-না হতেই রোজার ব্যগ্রকণ্ঠে ডাকে, শিগগির আসুন একবার–

রোজারের ডাক শুনে দু-জনেই তাড়াতাড়ি এগোতে চেষ্ট করে, কিন্তু নদীর পারে জলাজমি আর আগাছায় পা জড়িয়ে যায়। রোজার বলে, হালকা করে পা ফেলুন। পুরো পায়ের পাতাটা যেন একসঙ্গে মাটির ওপর এসে পড়ে, তাহলে আর অসুবিধে হবে না।

কোনওক্রমে নদীর পার অবধি ওরা এগিয়ে আসে। রোজার একটা বাঁশঝাড়ের পাশে আঙুল বাড়ায়। সামনেই নদীর জলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে একটা জংলি গাছের ডাল। প্রায় জল ছুঁইছুঁই করছে। ডালটার নীচের দিকে বিরাট এক থোকা সাদা ফেনা জমে রয়েছে।

রোজার বলে, ওই যে দেখছেন, ওটা ব্যাঙের বাসা। আফ্রিকার সবচেয়ে ধেড়ে ব্যাংবাবাজি এইরকম বাসা করে। বিশাল চেহারা হয় এইসব ব্যাঙের। ছোটখাটো প্রাণী ধরে খায়। নিশ্চয় ব্যাটা আশপাশেই কোথাও আছে।

রোজারের কথা শেষ হতে-না হতেই সুজন আবিষ্কার করে ব্যাং মহাপ্রভুকে। দেখেই ব্যাঙের হাতিকে লাথি মারার গল্পটা মনে পড়ে যায়। এই ব্যাং দেখলে কেউ আর ও গল্প লিখত না। কম করে তিন ফুট লম্বা তো হবেই। আর কী গোদা চেহারা! পেছনের ধুমসো পা দুটো তো তবু দু-ভাঁজ করে গোটানো। লাফ মারার সময় নিশ্চয় সাড়ে চার ফুট লম্বা হয়ে যাবে। ড্যাব ড্যাবা পাথরের মতো চোখ।

সুজন কোনও কথা না বলে আঙুল তুলে ব্যাংবাবাজিকে দেখায়। রোজার হঠাৎ হাসতে শুরু করে। ব্যাংটা সঙ্গে সঙ্গে ঝপাস করে খসে পড়ে নদীর জলে।

ডক্টর সেনশর্মা বলে, তুমি হঠাৎ হাসলে কেন? এমন আড়তদার মার্কা চেহারার ব্যাং দেখার সৌভাগ্য কি আমাদের আর হবে?

রোজার বলে, কেন যেন এগুলোকে দেখলেই আমার হাসি পায়। জানেন ডক্টর, ব্যাং বলেই নয়, খুব মোটা লোক দেখলেও আমার হাসি পায়। আমার মনে হয়, ওদের সব বুদ্ধি চর্বি হয়ে গেছে।

রোজারের কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে দু-জনে। ডক্টর সেনশর্মা বলেন, তুমি যা বলেছ না রোজার, ভাববার কথা। গবেষণার পক্ষে এটা একটা খুব ভালো সাবজেক্ট। বলা যায় না, এই নিয়ে কেউ ডক্টরেটও পেয়ে যেতে পারে।

রোজার বলে, তাহলে ডক্টর, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। যদি কেউ এরকম ডক্টরেট পায় তাহলে যেন আমার আর রানা গলিয়াথের নামটা উল্লেখ করতে ভুল না করে।

রানা গলিয়াথটা আবার কে?

বাঃ-রানা গলিয়াথকেই তো এখুনি আমরা দেখলাম।

ওই ব্যাংটার নাম রানা গলিয়াথ?

হ্যাঁ–উনি স্বনামধন্য।

 হাসতে হাসতে নদীর ধার দিয়ে কিছুটা এগোবার পর ডান ধারের বনটা মনে হল হালকা হয়ে এসেছে। সেই জমাট-বাঁধা অন্ধকার ভাবটা যেন অনেক আবছা এখানে। আরও তিরিশ গজ এগোতেই দেখা গেল, নদীর ডান ধারেই রয়েছে বিরাট একটা পুকুর–পুকুর না বলে হ্রদ বলাই ভালো। গাছের অজস্র গুঁড়ি ভাসছে হ্রদটায়। এক-একটা বারো থেকে পনেরো ফুট লম্বা। কয়েকজন কালো মানুষ জলের মধ্যে নাওয়ে করে আনাগোনা করছে। নাওটাও দেখবার মতো। মোটাসোটা গাছের গুঁড়ির মাঝখানে খোঁদল করে বসবার জায়গা করে নেওয়া হয়েছে। একটু লক্ষ করতেই বোঝা গেল, ভাসন্ত গুঁড়িগুলোকে ওরা মোটাসোটা লতার দড়ি দিয়ে বাঁধছে। দু-সারিতে প্রায় সত্তর-আশিটা ভাসন্ত গুঁড়ি বেঁধে তৈরি করেছে বিশাল এক ভেলা। চওড়ায় প্রায় পঁচিশ ফুট আর লম্বায় একশো-সওয়াশো ফুট হবে। এই বিশাল ভেলাকে মজবুত করার জন্য আবার ওপরদিকে আড়াআড়িভাবে তক্তা বিছিয়ে সেগুলোকেও বেঁধেছে। বাঁশ আর গাছের পাতা (রোজার বলল, রাফিয়াপাতা) দিয়ে ভেলার মাথায় তৈরি হয়েছে ছইদাঁড়িমাঝিদের ঘর।

এরা করছেটা কী? সুজন প্রশ্ন করল রোজারকে।

আর কয়েক মাস পরে যখন খুব বৃষ্টি হবে, নদীর জল বেড়ে এই পুকুরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। তখন এই ভেলা নিয়ে যাত্রা শুরু করবে এরা। এই কাঠ নিয়ে ওরা পৌঁছোবে কেপ লোপেজে। সেখানে জাহাজে কাঠ তুলে দিয়ে তারপর ওদের ছুটি। প্রায় পনেরো বিশজন করে লোক যায় এক-একটা ভেলায়। খাবারদাবার সব সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। তার ওপর কেপ লোপেজের প্রায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল আগে থেকেই নদীর জল এত নোনা যে, মুখে দেওয়া যায় না। তার জন্যে আবার আগে থেকে পানীয় জল মজুত করতে হয়। তা ছাড়া এখানে জোয়ারভাটা এত জোর হয় যে, ভাটার সময় ছাড়া এগোনো অসম্ভব হয়ে পড়ে। রোজার হাসতে হাসতে বলল, গ্যাবনের বনে গাছের মেলা দেখে কেউ ভাবতেও পারবে না যে, এখানে বনের গাছকে ব্যাবসার কাঠ করে তুলতে কী মেহনত করতে হয়। ওই দেখুন–ভেলার ওপরে একটা জায়গায় ওরা মাটি লেপছে। ওখানটায় রান্না হবে। উনুন। গড়বে।

ওরা আবার খোলা জায়গাটায় এসে পড়ে। ওদের দেখেই কাঠুরের দল আবার হাত নেড়ে আপ্যায়ন জানায়। কী যেন বলছে ওরা।

রোজার জানায়, ওরা আমাদের ডাকছে।

 চলো–দেখি কী বলছে। ডক্টর সেনশর্মার পেছনে পেছনে দু-জনে এগিয়ে চলে। একটা কাটা গুঁড়িকে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে তার ওপরে লাফ মেরে উঠেই সুজন বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে রোজার বুঝতে পারে, কিছু একটা ঘটেছে। সে একছুটে গুঁড়ি থেকে লাফিয়ে নেমেই রাইফেল বাগিয়ে ধরে। পরমুহূর্তেই অরণ্য প্রান্তর সচকিত হয়ে ওঠে রাইফেলের গর্জনে আর প্রচণ্ড ফোঁস ফোঁস শব্দে। চমকে ঘুরে দাঁড়ান ডক্টর সেনশর্মা। কাঠুরের দল মাচা ছেড়ে তড়বড় করে নীচে নেমে আসে।

সুজন রোজারের পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রায় সাত ফুট লম্বা বিশালদেহী একটা সাপ তখন মৃত্যুযন্ত্রণায় ওলটপালট খাচ্ছে। সুজনে এর চেয়ে অনেক লম্বা পাইথন সাপ দেখেছে চিড়িয়াখানায়, কিন্তু এত মোটা কোনও সাপ দেখেনি। ফণাটাও কী বিরাট আর পুরু। সারাটা গা জুড়ে বেগনি, বাদামি আর লালরঙা আয়তক্ষেত্র ও ত্রিভুজের বাহারি নকশা। কাচের মতো চোখ দুটো যেন মার্বেলের গুলির মতো অর্ধেকটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।

রোজার বন্দুকটা নামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ল্যাজের দাপানি কমে আসতে সুজনের হাত ধরে রোজার বলল, উফ–ভয়ংকর কাণ্ড হত! জানেন–এই সেই বিখ্যাত গ্যাবন ভাইপার। আমিও কোনও দিন এমনভাবে মুখোমুখি পড়িনি৷

ইতিমধ্যে কাঠুরেরা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করছে। রোজারও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সুজন কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারে না মরা সাপটার দিক থেকে।

ডক্টর সেনশর্মা রোজারকে ডেকে বলেন, রোজার–এবার ফেরা যাক। অনেক হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, আসল যার জন্যে আমাদের আসা, তা-ই পণ্ড না হয় শেষ পর্যন্ত। চলো –ওরা কী বলছে?

রোজার বলে, ওরা বলছে, ক-দিন আগে আরেকটা গ্যাবন ভাইপারের কামড়ে একজন কাঠুরে প্রাণ হারিয়েছিল। সেটাকে ওরা বধ করেছিল, কিন্তু তার জোড়াটাকে ধরতে পারেনি বলে খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। এইটাই সেই জোড়াটা। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কী জানেন, ওরা বলছে, যে গাছে ওরা প্রথম সাপটাকে মেরেছিল, এই কাটা গুঁড়িটাও সেই গাছেরই।

ডক্টর সেনশর্মা মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, আমাদের দেশেও সাপেদের এমনি নানা গল্প চালু আছে।

হঠাৎ দূর থেকে একটা শব্দ কানে আসে। সবাই ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায়। দু-এক মিনিটের মধ্যেই কমিলগ কোম্পানির নাম-লেখা সিকোরস্কিটা নজরে পড়ে।

রোজার চেঁচিয়ে ওঠে, ওরা কি আমাদের ফেলেই পালাচ্ছে নাকি? ডক্টর সেনশর্মা বাধা দেবার আগেই রোজারের হাতের রাইফেলটা আকাশের দিকে মুখ তুলে ধমকে ওঠে।

কী করছ তুমি? ওরা নিশ্চয় গুলির আওয়াজ পেয়ে আমাদের খোঁজেই বেরিয়েছে। ডক্টর উত্তেজিত কণ্ঠে বাধা দেন।

রোজার হাসতে হাসতে বলে, ঠাট্টা করছিলাম ডক্টর। চঁসিয়ে পিয়ের যতক্ষণ আছেন, ওদের সাধ্য নেই পালায়। গুলিটা এমনিই ছুঁড়েছি, যাতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

দেখতে দেখতে হেলিকপ্টারটা মাথার ওপরে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়, তারপর আস্তে আস্তে নামতে শুরু করে। কাঠুরের দল এতক্ষণ চুপ করে লক্ষ করছিল, মাথায় হাওয়ার ঝাপটা লাগতেই তারা চোঁ চোঁ দৌড় লাগায়। রোজার বলে, ওরা নিশ্চয় ভয় পেয়েছে।

সিকোরস্কিটা মাটিতে পা রেখে স্থির হতে-না হতেই পিয়ের আবির্ভূত হয়। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাকুলভাবে দু-হাত নাড়াচ্ছে। ওরাও হাত নাড়তে নাড়তে পা বাড়ায়। ডক্টর সেনশর্মাকে আগে উঠিয়ে দিয়ে সুজন ওঠে, তারপর রোজার। রোজার সবে একটা পা ভেতরে রেখেছে, নীচে থেকে সমবেত কণ্ঠের কোলাহল কানে আসে। রোজার মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে আবার কোলাহল। ভেতর থেকে ডক্টর সেনশর্মা বলেন, কী হল রোজার?

রোজার বলে, কাঠুরেরা বলছে, ওরা বিদেশি বন্ধুদের কিছু উপহার দিতে চায়।

পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ক্যাপটেন। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, দুর–ছাড়ন তো! এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ও নো-নেভার– এই প্রথম ডক্টর সেনশর্মার ক্রুর কণ্ঠস্বর শুনল সুজন। ওদের উপহার গ্রহণ না করে আমি কিছুতেই যাব না। একটুও গলা না চড়ালেও ডক্টর সেনশর্মার দৃঢ়তা তাঁর কথাগুলোকে অত্যন্ত ধারালো করে তুলেছে। তাঁর ব্যক্তিত্বকে এই মুহূর্তে অস্বীকার করার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই হবে। সুজন বলে, ডক্টর, আপনি আর নামবেন না। আমি যাচ্ছি।

ইয়েস–ইউ মাস্ট। এটা আমাদের কর্তব্য। এটা ওদের আন্তরিক ভালোবাসার দান।

সুজনকে নামবার জায়গা করে দিতে রোজার ওপরে উঠে আসে। ডক্টর সেনশর্মা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বিপুল উৎসাহে হাত নাড়তে থাকেন। অর্ধনগ্ন কালো মানুষগুলো মুখরিত ওঠে আনন্দ কোলাহলে। সুজন মাটিতে পা দিতেই তারা ওকে ঘিরে ধরে। বুনো ফুলের বিরাট একটা তোড়া তুলে দেয় ওর হাতে। এরই মধ্যে কখন ওরা অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ওদের হর্ষধ্বনির মধ্যে সুজন ফুলের গোছা হাতে আবার হেলিকপ্টারে উঠতে শুরু করে।

সিকোরস্কিটা যতক্ষণ না দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে যায়, ওরা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আর হাত নেড়ে চলে।

মহা উৎসাহে রোজার পিয়েরকে তাদের অভিযানের গল্প শোনাতে শুরু করে। ক্লান্ত হয়ে ডক্টর চোখ বুজে সিটে মাথার ঠেস রেখেছেন। সুজন ভাবছিল, এই সরল কালো মানুষগুলো আজ খুব খুশি, আমরা যে তাদের হাতের উপহার গ্রহণ করেছি। আমাদের সম্বন্ধে, সভ্য মানুষদের সম্বন্ধে তাদের ধারণা হয়তো পালটে গেছে। কিন্তু ওরা কতটুকু জানে? সভ্য মানুষদের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলে আমরা কি আজ ওদের কোনও মঙ্গল করলাম?