উপন্যাস
গল্প

১১. ব্ল্যাক হোল

১১.

পাঁচ বছর পরের কথা।

ব্ল্যাক হোল তার আকর্ষণ হারাচ্ছে।

দ্বিতীয় কাপ ইনফিউশন অর্ডার দেওয়ার পর ভাবল শংকর, প্রায় দশটা বাজতে চলল, কোনও মক্কেলের দেখা নেই। সেই কলেজজীবন থেকেই কফি হাউসের আড্ডা শুরু, যেটা এখন শুধু রবিবারের সকালে এসে ঠেকেছে। আড্ডার আকর্ষণ আর কালো কফির আসক্তি মিলিয়েই ওরা কয়েক বন্ধু আজও কফি হাউসকে এই নামেই ডাকে।

অজয়কে ঢুকতে দেখে হাঁপ ছাড়ল শংকর। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কেউ না এলে সে উঠে পড়ত।

ব্যাপারটা কী! এত দেরি?

দেরি মানে, তুই সাড়ে নটা থেকে বসে আছিস নাকি?

 তা তো আছিই।

 যাঃ বাবা। কোনও মানে হয়! জানা কথাই তো, আজ সাড়ে দশটার আগে কেউ দেখা। দেবে না।

তা তো জানি না। অবশ্য আগের দুটো রবিবার আমি মিস করেছি। কিন্তু আসরের টাইম টেবুলে এরকম পরিবর্তন… এ তো ভাবাই যায় না। আজ অবধি…

তুই বেজায় বেরসিক। কিসসু খবর রাখিস না। কোনও কিছুতেই ইন্টারেস্ট নেই। আজ সকালে ন-টার টিভি প্রোগ্রাম কেউ মিস করে! জানি, এখনই বলবি কী আবার প্রোগ্রাম?

হ্যাঁ, মানে যত দূর জানি, মহাভারত সিরিয়ালটা তো শেষ হয়ে গেছে। তা তো গেছে, কিন্তু ওই স্লটে যে তার চেয়েও ফ্যান্টাস্টিক সিরিয়াল শুরু হয়েছে, তার খবর রাখিস? এই তো

সুবীর আর প্রদীপ একসঙ্গেই ঢুকল দু-জনে। বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। অজয় আর শংকরের অস্তিত্ব যেন টের পাচ্ছে না। চেয়ারে টেনে বসতে বসতেও আলোচনার বিরাম নেই।

পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে অজয় বলল, সত্যি বলতে ডক্টর লাহিড়ীকে যদি না চিনতাম তাহলে হয়তো একটু সন্দেহের চোখেই দেখতাম ব্যাপারটাকে। ডক্টর লাহিড়ীর মতো ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমিশিয়ান যদি তাজ্জব হয়ে যান, ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমতা আমতা করেন…

শুধু ডক্টর লাহিড়ী কেন? ডক্টর দেবরায়, ডক্টর গুপ্ত! ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি তিন পণ্ডিতই অগাধ জলে। অথচ তিনজনই নিজের নিজের ফিল্ডে সেলেব্রিটি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি

শংকর হেসে বলে, ওহে! এই অজ্ঞান বালককে কিঞ্চিৎ দয়া করো।

আজ দেখিসনি প্রোগ্রাম?

দুর–আজকে কেউ মিস করে!

তোরা যা-ই বল, শংকরের কিন্তু প্রথম থেকেই টিভি-র নাম শুনলে সেই যে অ্যালার্জি হয়, সেটা আর গেল না!

শংকর আপত্তি করে, বাজে কথা বলিসনি। ফুটবল, ক্রিকেট দেখি না?

তা জানি না, তবে আজকের সকালের প্রোগ্রাম মিস করাটা… তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই জানিস না। আরে বাবা, আজই তো গোবিন্দ দ্য ওয়ান্ডার-বয় শুরু হল। ডক্টর দিব্যেন্দু রায় প্রেজেন্টস। ন্যাশনাল হুক-আপ। এত দিন ধরে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে–এই নিয়ে কত হইচই, কোথায় বাস করিস?

শংকর বলে, না, না, আসলে ক-দিন জামশেদপুরে গিয়েছিলাম। সায়েন্স ক্লাবের একটা অনুষ্ঠান ছিল, খুব ব্যস্ত ছিলাম। ব্যাপারটা একটু খুলে বল তো।

গোবিন্দ নামে আশ্চর্য ক্ষমতার তেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে টিভি প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার আগে থেকেই জল্পনা শুরু হয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিল, বিজ্ঞাপনে যতই সত্য কাহিনি বলে প্রচার করুক, এ-ও নিশ্চয় স্পাইডারম্যান-জাতীয় চমক। কিন্তু প্রোগ্রামের শুরুতেই তিন বাঘা বাঘা প্রফেসারের আবির্ভাব এবং প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন যে, টিভি প্রোগ্রামের আগে থেকেই তাঁরা নানাভাবে গোবিন্দকে পরীক্ষা করেছেন। তার যে আশ্চর্য কিছু ক্ষমতা আছে, সে বিষয়ে তাঁরা নিঃসন্দেহ। যদিও এই আশ্চর্য ক্ষমতার চরিত্র তাঁদের কাছে এখনও অজানা। এই তিন বিজ্ঞানীর সার্টিফিকেট পাওয়ার পরই টিভি প্রোডিউসাররা গোবিন্দর কীর্তিকলাপের স্পনসরড সিরিয়াল প্রদর্শনে রাজি হয়েছে।

প্রদীপ বলল, ডক্টর দিব্যেন্দু রায় আর গোবিন্দ-কম্বিনেশনটাও জমেছে ভালো। কাকা ভাইপো বললে কী হবে, দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। ভাইপো কাকার চেয়ে এখনই ফুটখানেক লম্বা। চকচকে টাক, গোল গোল চোখ–ডাক্তারকে দেখলেই মনে হয় জোকার। আর ছেলেটা তেমনই অ্যাট্রাক্টিভ। ছিপছিপে, চটপটে, পাতলা ঠোঁট, চাপা হাসি। বয়সের তুলনায় অনেক ম্যাচিয়োর্ড…

শংকর বাধা দেয়, এ তো ফিল্মস্টারের বর্ণনা চলছে। আসল ব্যাপারটা এখনও জানতে পারা গেল না।

সুবীর বলল, আজ যেটা দেখিয়েছে বলি। গোবিন্দর চোখে ঠুলি এঁটে বসিয়ে দিল। তারপর কয়েকটা রঙিন কার্ড একে একে তার হাতে দেওয়ামাত্র সে তার ওপর আঙুল বুলিয়েই রং বলে দিতে লাগল।

শংকর টেবিলের ওপর দমাস করে থাপ্পড় মেরে হাসতে শুরু করে। এতেই সবাই কুপোকাত! আরে ভাই, এটা কোনও আশ্চর্য ক্ষমতা নয়। স্রেফ ম্যাজিক!

ম্যাজিক!

 তুই না দেখেই বুঝে ফেললি?

আর আমরা সবাই দেখেও কিছু বুঝলাম না, তিনজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী…

 বিজ্ঞানীদের পক্ষেও সবসময় ম্যাজিকের ছলাকলা বোঝা সম্ভব হয় না। যে-কোনও ভালো ম্যাজিশিয়ানকে জিজ্ঞেস কর, সে বুঝিয়ে দেবে, কীভাবে চোখে ঠুলি আঁটলেও নোজ-পিকিং নামে এক কায়দায় নাকের পাশ দিয়ে উঁকি মারা যায়।

এবার হাসির পালা সুবীর, প্রদীপ আর অজয়ের। ডক্টর দিব্যেন্দু রায় নিজেই সে কথা অনুষ্ঠানের মধ্যে কবুল করেছেন এবং ব্যাপারটা নোজ-পিকিং নয় বোঝাবার জন্য চোখে টুলি-আঁটা গোবিন্দর ঠিক পিঠের দিকে এক-এক করে কার্ডগুলো রেখেছেন। মাথার পেছনে চোখ না থাকলে কারও পক্ষে চুরি করে তা দেখা সম্ভব নয়। শংকর তবু হাল ছাড়ে না। বিভিন্ন রঙের কার্ডের আকারের তারতম্যে বা রাখার সময়ে বিভিন্ন কোণে বেঁকিয়ে রাখার কৌশলেও গোবিন্দকে জানিয়ে দেওয়া সম্ভব…

আবার প্রবল আপত্তি। অনুষ্ঠানের মধ্যেই এসব সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, নেওয়া হয়েছে উপযুক্ত ব্যবস্থাও।

অজয় বলে, দেখ শংকর, তুই যদি বলিস পুরো ব্যাপারটা ধাপ্পা তাহলে বলতে হবে, ডক্টর দিব্যেন্দু রায় আর গোবিন্দর সঙ্গে তিনজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী টিম করে…

শংকর ঘাড় নাড়ে, তোরা জানিস না, এই ডার্মোপারসেপশন ক্ষমতা, আঙুল বা ত্বকের সাহায্যে দর্শনের অনুভূতিলাভের ক্ষমতা–এ কোনও নতুন ব্যাপার নয়। রাশিয়ার রোজা নামে এক মহিলার…

বলেছে, বলেছে। এটা কিছু নতুন কথা নয়। রুশ সংবাদপত্র ইজভেস্তিয়ার কাটিং দেখিয়েছে।

কিন্তু রোজার বুজরুকি ধরা পড়ার খবরও যে রুশ কাগজে প্রচারিত হয়েছে, সেটা কি…

না, তা বলেনি। কিন্তু তুমি কি দেখাতে পারবে সেটা? মুখে বললেই তো আর হবে না।

সুবীর বলে, তা ছাড়া এটা একেবারেই অভিনব কোনও ক্ষমতা–অপার্থিব ব্যাপার বলে ভাবারও তো সুযোগ নেই। কে না জানে, জাপানে এক ধরনের গোল্ডফিশ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায়, ছটফট করতে শুরু করে। মাইগ্রেটরি পাখি এক বছর অন্তর হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে একই জায়গায় এসে জড়ো হয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করার মতো ইন্দ্রিয় আছে তাদের। আর সব ছেড়ে দিলেও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বাদুড়ই তো দেখিয়ে দিচ্ছে যে, চোখ ছাড়াও চলাফেরা করা যায়। আলট্রাসনিক শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি ও কানে যা শোনা যায় না, সেই শব্দ উপলব্ধি করার মতো ইন্দ্রিয় সত্যিই তো তাদের আছে।

মানুষ তো আর বাদুড় নয়।

অজয় বেজায় চটে গিয়ে বলে, এ শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক। তুই নিজে কিছু দেখলি না, জানলি না, তবু পুরো ব্যাপারটাকেই ধাপ্পা বলে তৎক্ষণাৎ উড়িয়ে দিতে একটুও…।

না, দ্বিধা করছি না, কারণ তোরা যেরকম সব কিছু বিশ্বাস করার জন্য উদগ্রীব, আমার মনে হয় দু-একজনের অন্তত সেটাকে ব্যালান্স করার জন্য…

অবিশ্বাস নিয়েই শুরু করা উচিত।

 প্রদীপের ব্যঙ্গটাকে গায়ে মাখে না শংকর।

সুবীর বলে, দেখ ব্যাটা সবজান্তা, তোর কথাটা ইতালির সেই দার্শনিকের মতো শোনাচ্ছে। গ্যালিলিও বললেন, আপনারা আমার টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়েই একবার দেখুন-না, বৃহস্পতির চাঁদ স্বচক্ষে দেখতে পাবেন। কিন্তু দার্শনিকরা কেউই টেলিস্কেপের ধারেকাছে ঘেঁষল না। ঘেঁষবে কেন, বৃহস্পতির যে চাঁদ নেই, সে তো জানা কথা!

সুবীর খুব টাইমলি ছেড়েছে জোকটা। শংকর এবার সত্যিই খেপেছে, তোদের বক্তব্যটা কী?

এলিমেন্টারি। তিনজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং আমাদের মতো অসংখ্য নির্দোষ মানুষকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দেওয়ার আগে প্রমাণ–প্রমাণ করতে হবে যে, গোবিন্দ জোচ্চুরি করছে। শুধু অনুমান আর থিয়োরি দিয়ে চলবে না–

.

১২.

সেলিমপুর সায়েন্স ক্লাব।

মিহির চক্রবর্তীর উৎসাহে বছর দুয়েক আগে তারই বাড়ির একটা ঘরে প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল। এখন পাশের বাড়ির পরিত্যক্ত একটা গ্যারাজ পেয়েও কুলোচ্ছে না। সপ্তাহে একদিনের জায়গায় বর্তমানে তিন দিন বৈঠক।

তবু শংকর সন্তুষ্ট নয়। আর আজ তো কথাই নেই। গজগজ করতে করতেই ঢুকেছে।

 কী হল শংকরদা? অপু জিজ্ঞেস করে।

 না, বলছি, জোচ্চোরদের টিকে থাকার সেরা উপায় হল নিজেদের গোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়িয়ে যাওয়া। দলেবলে পুষ্ট হওয়া। কাকে ছেড়ে কাকে ধরবি? কার অত সময় আর সুযোগ আছে যে, নিজের কাজকর্ম ছেড়ে জোচ্চুরি ধরে বেড়ায়!

তা তুমি হঠাৎ খেপলে কেন? আমরাই বা কী করলাম?

কিছুই করছিস না বলেই তো খেপে যাচ্ছি। এই তো, সব কটা মাথাই দেখতে পাচ্ছি সোলডার-আয়রন হাতে ইলেকট্রনিক সার্কিট বানাবার কাজে একেবারে আত্মহারা!

পবন বলে, না শংকরদা, আমার কিন্তু এরোমডেল।

 বস্তাপচা। হবি সেন্টারে ওই কিট বোধহয় কুড়ি বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে।

রীতা বলে, প্লিজ শংকরদা, তোমার মুড খারাপ, বুঝতেই পারছি। কিন্তু এভাবে ডিসকারেজ কোরো না। আর দু-সপ্তাহ পরেই অল ইন্ডিয়া সায়েন্স ফেয়ার।

শংকর রীতার হাত ছাড়িয়ে সিগারেট ধরায়। সায়েন্স ফেয়ারের কম্পিটিশনে যোগ দিলে বছরে কিছু টাকা গ্রান্ট পাওয়া যায়। সেটাকে অস্বীকার করার মতো সচ্ছল নয় সায়েন্স ক্লাব। ছেলেমেয়েদের দোষ দিয়ে লাভ কী, যদি বিদেশি ম্যাগাজিনের পাতা উলটে সার্কিট দেখে দেখে যন্ত্রাংশ জুড়ে যে যত কমপ্লিকেটেড ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বানাবে, তাকেই উদ্যোক্তারা পুরস্কৃত করেন।

শংকর প্রথম থেকে জোর দিয়ে আসছে সহজ, সাদাসিধে, পরীক্ষামূলক ব্যাপারের ওপর, যেখানে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের একটা বড় ভূমিকা থাকে।

অজু বলে, শংকরদা, দু-সপ্তাহ বাদে আবার আমরা খাদ্যের সঙ্গে মেশানো রং নিয়ে। ইনভেস্টিগেশন শুরু করব। কটা দিন আমাদের…

মিহির কখন ঢুকেছে, শংকর খেয়াল করেনি। শংকরের পিঠে হাত রেখে বলল, আমাদের অনুসন্ধান একেবারে আনসাকসেসফুল বলব না। দুটো মিষ্টির দোকানের এখনই টনক নড়েছে। ওরা তো রীতিমতো ক্যাম্পেন শুরু করেছে যে, আমাদের ক্লাবের কাজই হল শুধু বাগড়া দেওয়া। এই টিউবওয়েলের জল খারাপ, রাস্তায় বিষাক্ত গ্যাস–কিন্তু নিজেরা তার প্রতিকারের জন্য কিছু করবে না।

হ্যাঁ শংকরদা, এটা কিন্তু আমাদের ভাবা দরকার। আমাদের ইনভেস্টিগেশনের সব রেজাল্টই নেগেটিভ।

বেশ তো একটা পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা আছে, এরকম একটা প্রোজেক্ট যদি হয়…

আমি আছি।

আমিও।

সদস্যদের ছ-জন সঙ্গে সঙ্গে রাজি।

শংকর সংক্ষেপে কফি হাউসের ঘটনার কথা বলল। বেশি বকতে হয়নি, কারণ ওরা সবাই টিভি শো দেখেছে।

শংকর বলল, দ্যাখো, আমি আগেই বলে দিচ্ছি, একটা সুস্থ অবিশ্বাসের জায়গা থেকে যদি আমরা অনুসন্ধান শুরু করতে না পারি, তাহলে এ কাজ টেক আপ না-করাই ভালো। একটা অলৌকিক কিছু সহজেই বিশ্বাস করে নেওয়ার পেছনে সাধারণ মানুষের জীবনের অনেক দিক জড়িত–ক্লান্তি, একঘেয়েমি ইত্যাদি। আর তারই সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর সব দেশেই কিছু কিছু লোক নানারকম ব্যাবসা চালিয়ে আসছে বহুকাল ধরে। তবে এ যুগের বৈশিষ্ট্য হল এইসব অলৌকিক কাণ্ডকে একটা সায়েন্টিফিক ফ্লেভার দেওয়া। একটু বিজ্ঞান পাঞ্চ করা।

প্রতিম বলল, কিন্তু টিভি-তে এখনও সেরকম কিছু শোনা যায়নি।

 রীতা জানায়, বলেনি, কিন্তু বলবে না, তার কি কোনও মানে আছে?

শংকর বলে, শোনো, শোনো, আমি তোমাদের চোখ বুজে কিছু করতে বলছি না। যদি সত্যিই দেখা যায় আমাদের অবিশ্বাস ভিত্তিহীন, নিশ্চয় মেনে নেব আমরা। কিন্তু তার আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার। শুধু ওই টিভি-শো দেখেই নৃত্য জুড়লে হবে না।

অনিন্দ্য বলে, আমার মনে হয় ওই তিনজন বিজ্ঞানীকে নিয়েই আমাদের ইনভেস্টিগেশন শুরু করা উচিত। ওদের ইন্টিগ্রিটি নিয়েই তো আমার সন্দেহ আছে। আর ওরা ওইভাবে নিজেদের জড়িত না করলে গোবিন্দর ব্যাপারটাকে নেহাত গল্পের বেশি গুরুত্ব হয়তো কেউই দিত না।

শংকর ওর প্রস্তাবটা পুরোপুরি মেনে নেয় না। শুরু তোমরা যেখান থেকে খুশি করতে পারো। কিন্তু আমার মনে হয় এই তিন বিজ্ঞানীকে এখনই ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। যত দূর জানি, এঁরা গুণী লোক। জেনে-শুনে এর মধ্যে আছেন বলে মনে হয় না। এঁদেরই তো ঠকানো সবচেয়ে সহজ। বরং…

.

১৩.

রোল্যান্ড রোড। লোহার প্লেট বসানো দু-পাল্লার ভারী গেটটার মাথায় বোগেনভেলিয়ার ঝাড়টাকে বাদ দিলে ডক্টর দিব্যেন্দু রায়ের দোতলা বাড়িটার আর কোনও শোভা নেই। গেটের Beware of dog লেখা পাল্লাটা ভোলাই আছে।

দু-বার ফোনে চেষ্টা করেও কোনও সুবিধে হয়নি। খবরের কাগজের এক চেনা রিপোর্টারকে বলে-কয়ে রাজিও করিয়েছিল, যাতে একটা ইন্টারভিউয়ের নাম করে অন্তত…। কিন্তু দিব্যেন্দু রায়ের পিএ-র গণ্ডিও পেরোতে পারেনি। জানা গেছে, টিভি শো এর পর অনেক খবরের কাগজের পক্ষ থেকেই যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তারা হার মেনেছে।

সীতাকে রাস্তার এপারে দাঁড়াতে বলে প্রতিম গেটের সামনে এসে দেখল, ভেতরে ছোট্ট একটা চত্বর পেরিয়ে মোজেক-করা দু-তিন ধাপ সিঁড়ি উঠেই গ্রিল-লাগানো বারান্দা। প্রায় দশ-বারোজন লোক সেখানে, কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে।

পেশেন্ট। মনে মনে ভাবল প্রতিম।

বারান্দায় পা দিতেই একটা ছোকরা টুল থেকে উঠে তার কাছে এসে দাঁড়াল, বলুন।

ডক্টর রায়ের চেম্বার?

 হ্যাঁ, বলুন। কী দরকার?

আমি একটু দেখাতে চাই। হার্টের…

উনি তো রোগী দেখেন না।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হবে?

 বললাম তো, উনি রোগী দেখেন না।

 বারান্দায় যারা অপেক্ষা করছিল, প্রতিম তাদের দিকে তাকাচ্ছে দেখে ছোকরা এবার রীতিমতো ধমকে উঠল, শুনতে পান না নাকি?

ঠিক ধরেছ। মাঝে মাঝে আমি কম শুনি।

প্রতিম আর পেছন ফিরে তাকায়নি।

রীতাকে প্রতিম বলল, রহস্যটা ঠিক বোঝা গেল না।

 এক কাজ করলে কেমন হয়? রীতা বলে, একটু সরে ওই গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াই। কেউ-না-কেউ তো বেরোবেই কিছুক্ষণের মধ্যে। এখান থেকে লক্ষ রাখা যাবে। তাদের দু একজনের সঙ্গে একটু জমাতে পারলে! তবে দেখ, মাথা গরম করবি না। তাতে কাজ হয় না। এমন একটা কাণ্ড করে এলি, দিব্যেন্দু রায়ের বাড়িতে তোকে আর কোনও দিন…

আরে এদিকে দেখ! রীতার হাত ধরে টান দেয় প্রতিম।

বছর দশেকের একটি মেয়ের হাত ধরে এক ভদ্রলোক সবে দিব্যেন্দু রায়ের গেট পেরিয়ে ফুটপাথে পা দিয়েছেন। ভদ্রলোক বোধহয় অসুস্থ, খুব সন্তর্পণে ফুটপাথ থেকে। রাস্তায় নামলেন। পরনে ধুতি আর পুরোনো স্টাইলের মাথা-গলানো শার্ট। হাত দুটোয় বোতাম লাগানো নেই।

মিনিট দু-তিন অপেক্ষা করার পর রীতা পা চালিয়ে ওদের ধরে ফেলল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বার দুয়েক ফিরে তাকাতেই ভদ্রলোকের দৃষ্টি পড়ল, কিছু বলছ মা?

পেছন থেকে প্রতিমও শুনতে পায়।

না, কিছু না। রীতা হেসে বলে, আপনারাও বুঝি ডক্টর রায়ের চেম্বারে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, কিন্তু তুমি? ভদ্রলোক যেন একটু অবাক হয়েই রীতার মুখের দিকে তাকান।

আমি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইতে এসেছিলাম। আমার মায়ের হার্টের প্রবলেম!

 কিন্তু যত দূর জানি, উনি তো প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন।

 তা-ই বলুন। সেই জন্যই আমায়… তাহলে আপনার কোনও…

ভদ্রলোক ম্লান হেসে এক হাত দিয়ে মেয়েটিকে দেখান। মুখে কিছু বলেন না।

রীতা চমকে ওঠে। মেয়েটি অন্ধ। সেই জন্যেই ভদ্রলোক অত সাবধানে হাঁটছিলেন? আসলে কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যায় না মেয়েটি দৃষ্টিহীন।

রীতাকে প্রশ্ন করতে হয় না। ভদ্রলোক নিজেই বাকিটুকু বলে যান। সেই নৈহাটি থেকে বড় আশা করে এসেছিলেন। কিন্তু বলতে গেলে নিরাশ হয়েই ফিরতে হচ্ছে। এই একটিমাত্র সন্তান তাঁর। জন্মান্ধ। ডাক্তাররা বলেই দিয়েছে করার কিছু নেই। কিন্তু গত রবিবারে টিভি প্রোগ্রাম দেখে হঠাৎ যেন নতুন আশার আলো দেখেছিলেন। চোখ বাদ দিয়েও যদি দেখার বা পড়ার… কিন্তু দেখাই তো হল না। বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখার পর জানিয়েছে… বাড়িতে চিঠি যাবে।

তার মানে নাম-ঠিকানা সব লিখে নিয়েছে?

 সব, সব। নাম, ঠিকানা, পেশা, সংসারে কে কে আছে, কেস হিস্ট্রি–সব।

তাহলে আর কী? চিঠি নিশ্চয় পাবেন।

কী জানি! মনটা বলছে, পাব না। কয়েকজনকে তো, আমার পরে এসেছিল তারা, ডেকে পাঠাল। হয়তো আমার কোনও গতি নেই বুঝেই আর…

রীতা বলল, ওখানে যারা ওয়েট করছে, সবাই তাহলে চোখের ব্যাপারেই।

সবাই। কে না চান্স নিতে চায় মা? যদির কথা তো বলা যায় না। অবশ্য এ কথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে যে, ডক্টর রায়ের দু-জন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রথমেই সবাইকে বলে দিচ্ছে, গোবিন্দর যে ক্ষমতা আছে তা সবার থাকা সম্ভব নয়। এমনকী, সেই ক্ষমতার পুরো ব্যাখ্যাও জানা নেই। কাজেই ডক্টর রায় কারও কোনও উপকারে লাগতে পারবেন, এমন গ্যারান্টি দিতে মোটেই রাজি নন। এইসব জেনেও কেউ যদি চায় তো ডক্টর রায় একবার টেস্ট করতে পারেন।

বাস স্টপ পর্যন্ত এগিয়ে ওদের দুজনকে তুলে দেবার পরে রীতা এক গাঁট্টা কষাল প্রতিমকে, তুই একটা বুন্ধু। খামোখা ঝগড়া করে এলি। না হলে তোর অন্ধ বোন সেজে আজই ঠিক ঢুকে পড়তাম। যাক গে, কাল এলেই হবে…।

সেই ভালো। একটা গাড়ি ম্যানেজ করতে পারিস তো নাথিং লাইক ইট। মনে হচ্ছে শাঁসালো পার্টি, না হলে…

.

১৪.

ঠিক ন-টার সময় হ্যাঁরিংটন স্ট্রিটে এসে থামল ট্যাক্সিটা। ভিআইপি ব্যাগ তিনটে যে বেশ ভারী তা দরজা দিয়ে টেনে নামাবার সময়েই বোঝা গেল।

নার্সিং হোমের রিসেপশন রুমে ঢুকে সোফার একপাশে দুটো ব্যাগ নামিয়ে রাখল সন্তর্পণে। তারপর রিসেপশনিস্টের সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়াল দু-জন। ওরা একটা ব্যাগ টেবিলের ওপরে রেখেছে।

নমস্কার।

রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা সামান্য ঘাড় নাড়লেন কি না বোঝা গেল না। মুখে কথা নেই।

খটখট শব্দে লক খুলে কয়েকটা মাঝারি আকারের সুদৃশ্য কাচের শিশি সন্তর্পণে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে নিজের পরিচয় দিল সেলসম্যান। বলল, আমরা কিছু ফ্রি গিফ্ট নিয়ে এসেছি। শ্যাম্পু। ফ্রি মানে ফ্রি-ই, এর সঙ্গে এটা নিলে ওটা ফ্রি–ওইসব ঝামেলা নেই।

এটা নার্সিং হোম। এখানে—

 বলতে বলতেই ভদ্রমহিলা একটা শিশি হাতে তুলে নিয়েছেন।

 নার্সিং হোম জেনেই তো এসেছি। আমাদের টার্গেটই হল ওয়ার্কিং উইমেন।

আপনার কন্টেনারে কোনও লেবেল নেই কেন?

না। ভুল করে বাদ পড়েনি। ইচ্ছে করেই রাখা হয়নি, এই দেখুন, কোনওটাতেই নেই।

আশ্চর্য! ভদ্রমহিলা ছিপি খুলে গন্ধ শুঁকছেন।

 এই অবাক করতে পারাটাই তো আমাদের ক্যাপিটাল মিস…

সরকার।

সব কোম্পানিই তো বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তার লেবেলকে জনপ্রিয় করার জন্য, যাতে লেবেল, ছবি আর স্লোগান দেখে লোকে জিনিস কেনে। আমরা ঠিক তার উলটো পথ দিয়ে যাব। আমাদের জিনিস একবার ব্যবহার করলে আর লেবেল দরকার হবে না। দি ওনলি শ্যাম্পু উইদাউট এ লেবেল।

পাশ থেকে সহকারী সেলসম্যান হেসে যোগ করল, ওয়ান দ্যাট হ্যাঁজ ডিসপেন্সড উইথ লেবেলস! আমরা আজ কিছু স্যাম্পল এনেছি। আপনাদের বিরাট নার্সিং হোম। জানি না সবাইকে দিতে পারব কি না–সিস্টারদের…।

এখন পনেরোজনকে পাবেন। সব মিলিয়ে আরও বেশি।

 ওঃ, তাহলে তো ঠিকই আছে।

ইতিমধ্যেই দু-জন সিস্টার অন্য কাজে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। নমস্কার করে তাঁদের হাতে একটা করে গিট তুলে দিয়েছে।

রিসেপশনিস্ট বললেন, আপনারা আমাকেও দিয়ে যেতে পারেন, ডিস্ট্রিবিউট করে দেওয়ার জন্য।

থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। বুঝতে পারছি, কাজের সময় একটু অসুবিধে সৃষ্টি করছি! কিন্তু

একটা চামড়ায় বাঁধানো ছোট্ট ডায়েরির মতো খাতা খুলে সেলসম্যান বলল, এই কষ্টটুকুই শুধু দেব আপনাদের। নিজের হাতে নাম, ঠিকানা আর এই নার্সিং হোমে কত দিন আছেন, যদি দয়া করে বেশিক্ষণ লাগবে না।

রিসেপশনিস্ট ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন, দশটায় ডক্টর আসবেন ভিজিটে।

তার আগেই আমরা চলে যাব। যদি শেষ না হয়, বাকিগুলো আপনার হেপাজতেই থাকবে। পরে আর-একদিন—

দু-তিনজন করে সিস্টার একসঙ্গে আসেন। প্রত্যেকেই খুশি। রিসেপশনিস্টের ডেস্ক ছেড়ে এখন সোফায় এসে বসেছে দুই সেলসম্যান।

নাম লিখতে লিখতে মিসেস নাগ জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কাছে এতসব রঙের শ্যাম্পুর বটুল রয়েছে, কিন্তু আমাদের সবাইকে শুধু সবুজটা দিচ্ছেন কেন?

আমরা ছ-টা সিজনের জন্যে ছ-রকম শ্যাম্পু মার্কেট করব। কয়েকটা দিন যাক, টিভি তে আমাদের প্রোগ্রাম দেখবেন। শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ গোবিন্দ দ্য ওয়ান্ডার-বয় ঢুকে পড়ে…

মিসেস নাগ সামনে ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে বললেন, জানেন, ওই যে গোবিন্দ, ডক্টর দিব্যেন্দু রায়ের ভাইপো৷

পাশ থেকে মিস বোস বললেন, এই নার্সিং হোম ডক্টর রায়ের। অবশ্য এখন আর উনি দেখাশোনা করেন না।

দু-জন সেলসম্যানই গোবিন্দর নাম শুনে যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল, গোবিন্দকে তাহলে আপনারা চেনেন? এখানে প্রায়ই আসে বুঝি? আচ্ছা, একবার দেখা করিয়ে দিতে পারেন? এই প্রোগ্রাম দেখার পর থেকেই আমরা…

আমরা কী করে দেখা করাব! ডক্টর রায়কে তো চেনেন না। যদি জানতে পারেন, তা ছাড়া গোবিন্দ আসে, ডক্টর রায়ের সঙ্গেই আসে। কিন্তু তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। তিন-চার মাস অন্তর। তা-ও সোজা ডক্টর রায়ের সঙ্গে আসে, কিছুক্ষণ ভেতরে থাকে, তারপর চলে যায়। কারও সঙ্গে ওকে মিশতে দেন না।

মিস বোস যোগ করেন, ওকে তো স্কুলেও পাঠানো হয় না। বাড়িতে কোচিং।

অদ্ভুত ব্যাপার তো!

তা তো বটেই। ওই গোবিন্দর আশ্চর্য ক্ষমতা জানতে পারার পরেই ডক্টর রায় প্র্যাকটিস পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে একেবারে মেতে রয়েছেন…

তাতে আমাদের পক্ষে ভালোই হয়েছে। যা মেজাজ, আগে তো এখানে কেউ বছরখানেকের বেশি টিকত না।

কেন, গোবিন্দও বেঁচেছে। আগে তো ছেলেটাকে চাকরের মতো খাটাত বাড়িতে।

 গোবিন্দ ডক্টর রায়ের ভাইপো বললেন যে?

ওই নামেই ভাইপো। এক জ্যাঠতুতো দাদা থাকত বোদরায়। হঠাৎ মারা যাবার পর সেই বউদি কোনও উপায় না দেখে কাকুতিমিনতি করে ছেলেটাকে কলকাতায় রেখে গিয়েছিল।

সে যা-ই হোক, গোবিন্দর ক্ষমতা নিয়ে নিশ্চয়…

 গোবিন্দর ক্ষমতা তো আছেই, না হলে ডক্টর রায়ের মতো লোক…

 মাঝপথে কথাটা থামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিস বোস।

ডক্টর রায়ের মতো এমন নামকরা সার্জন অথচ আপনারা দেখছি তাঁর সম্বন্ধে…

মিসেস নাগ উঠতে উঠতেই বললেন, তা-ও তো পরের মুখের কথা শুনেই আমাদের এই। যারা বছর পাঁচেক আগে ডক্টর রায়ের আন্ডারে এখানে কাজ করেছিল, তাদের সঙ্গে কথা বললে তো আপনারা…

মিসেস নাগ হেসে বলেন, মিসেস সেনের সঙ্গে যদি কখনও দেখা হয়, একবার জিজ্ঞেস করবেন। আপনারা তো নানা জায়গায় ঘোরেন। অ্যালেনবেরি মেডিক্যাল সেন্টারে গেলে দেখা পাবেন।

শ্যাম্পু বিতরণ শেষ করে দুই সেলসম্যান রাস্তায় বেরিয়েই ট্যাক্সি পেয়ে গেল। অপু আর পবনের ডেস্টিনেশন এখন শংকরদার বাড়ি। তারপর ঠিক হবে নেক্সট প্ল্যান–বোদরা না অ্যালেনবেরি।

.

১৫.

নো প্রোগ্রেস!

উত্তেজনার আগুনে স্রেফ জল ঢেলে দিল শংকর।

 তার মানে?

তোরা খেটেছিস খুব, চেষ্টা করেছিস, অনেক খবর সংগ্রহ করেছিস, সবই ঠিক। কিন্তু তাতে হলটা কী? আমরা কী জানতে পেরেছি এ পর্যন্ত? ডক্টর দিব্যেন্দু রায়ের ক্যারেকটার! বদমেজাজি, স্বার্থপর, অর্থের লোভ–এই তো?

রীতা বলে, কেন? গোবিন্দর আশ্চর্য ক্ষমতা ভাঙিয়ে বাড়িতে বসে ব্যাবসা শুরু করেছে, সেটা বুঝি কিছু নয়?

বললাম তো, এর থেকে তাঁর ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশি নয়। আমাদের আসল লক্ষ্যটাই তোরা ভুলে যাচ্ছিস। শুধু তা-ই নয়, রীতা যে খবর এনেছে, তাতে বরং গোবিন্দর আশ্চর্য ক্ষমতার কথাই সমর্থিত হচ্ছে।

সায়েন্স ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে রীতাই একমাত্র অন্ধ মেয়ে সেজে তার এক দাদার হাত ধরে দিব্যেন্দু রায়ের এবং গোবিন্দর দর্শন পেয়েছে। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পায়নি। অভিনব পদ্ধতিতে গোবিন্দর মতো আঙুল দিয়ে দৃষ্টিশক্তিলাভের কোনও গ্যারান্টি তিনি দেননি৷ কিন্তু তারপরেও কেউ যদি ট্রিটমেন্ট (ডক্টর রায় অবশ্য বলেছিলেন। ইনভেস্টিগেশন) করতে চায়, তিনি রাজি। কারণ এটা তাঁর গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তারপরে তিনি চার্জের উল্লেখ করেন। পার সিটিং সাতশো টাকা। শুনতে হয়তো একটু বেশি। কিন্তু উপায় কী? এত লোক ভিড় জমাচ্ছে, কী করে ট্যাকল করবেন তিনি! হ্যাঁ, মানুষ বিপদে পড়েই আসছে। কিন্তু গোবিন্দর কথাটাও তো ভাবতে হবে। সে ছেলেমানুষ। এবং তাকে বাদ দিয়ে তো কোনও ইনভেস্টিগেশনই সম্ভব নয়। তার কীরকম ধকল যাবে… রীতা এবং তার দাদার অনেক অনুরোধে ডক্টর রায় শেষে গোবিন্দকে ডেকে পাঠান এবং সে শুধু না দেখে রং চেনাই নয়, খবরের কাগজের হেডলাইন এবং রীতার দাদার আঁকা দুটো স্কেচের ওপর আঙুল বুলিয়ে সব ঠিক ঠিক বলে দেয়। শংকর ওদের ভালো করে শিখিয়ে পাঠিয়েছিল, কীভাবে ধাপ্পা দিতে পারে, কোন কোন দিকে নজর রাখতে হবে। কিন্তু ফিরে এসে ওরা স্বীকার করেছে, কিছু বুঝতে পারেনি। গোবিন্দর পক্ষে কোনও কৌশলেই ছবি বা লেখা দেখা সম্ভব ছিল না।

তবে বোরা আর অ্যালেনবেরিতে অনুসন্ধানের রিপোর্ট এখনও পায়নি ওরা। চারজন বোদরা যাবে কাল। পরের সপ্তাহে মিসেস সেনের সঙ্গে মিহির নিজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে তার একটা সুবিধে আছে।

সময় হয়ে গেছে, খুলে দে!

শংকর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিহিরকে বলল, আজ ওরা একসঙ্গে গোবিন্দ দ্য ওয়ান্ডার বয়ের দ্বিতীয় কিস্তি দেখবে বলে মিহিরের বাড়িতে জড়ো হয়েছে। একই সঙ্গে গত সপ্তাহের কাজকর্মের আলোচনাটাও সেরে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল।

বিজ্ঞাপনের কসরত শেষ হতেই স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠল গোবিন্দর ক্লোজ-আপ। চোখে ফেট্টি বাঁধা। নানা কোণ থেকে টিভি-ক্যামেরা ঘুরে-ফিরে দর্শকদের সন্দেহ দূর করে, চোখ বাঁধার মধ্যে কোনও কারসাজি নেই। এরপর ক্যামেরা একটু পিছিয়ে আসে, ঘোষকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, আর যদি এর মধ্যে কারসাজি থাকেও, তবুও গোবিন্দর পক্ষে কি এই খবরের কাগজের কোনও অংশ দেখতে পাওয়া সম্ভব? খবরের কাগজটা রয়েছে গোবিন্দর পিঠের দিকে। গোবিন্দ পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে আঙুল বোলাচ্ছে, আর হেডলাইন পড়ছে।

এবারে লং শটে টিভি-স্টুডিয়োর দৃশ্য। তিনজন বিজ্ঞানীর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে গোবিন্দ ঘোষক এবং ডক্টর দিব্যেন্দু রায়।

কাট। ক্লোজ-আপে ডক্টর রায় বলে, আগের প্রোগ্রামেরই জের হিসাবে গোবিন্দ এতক্ষণ প্রমাণ করে দিচ্ছিল যে, আঙুলের সাহায্যে শুধু রং চেনা নয়, অক্ষর বা হরফও সে নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পারে।

দিব্যেন্দু রায় পর্দা থেকে মুছে যায়। তিনজন বিজ্ঞানী একে একে দর্শকদের আশ্বস্ত করার জন্য সংক্ষেপে জানিয়ে দেন, খবরের কাগজটা তাঁরাই নিয়ে এসেছেন এবং গোবিন্দর আশ্চর্য ক্ষমতার কোনও ব্যাখ্যা তাঁদের জানা না থাকলেও বিশেষ ক্ষমতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাঁরা নিঃসন্দেহ।

আবার বিজ্ঞাপনের হিজিবিজি।

শংকর বলে, একটা জিনিস লক্ষ করছি। গোবিন্দ যখন খবরের কাগজ পড়ছিল, তখন দিব্যেন্দু কিন্তু স্ক্রিনে ছিল না। এটা খুব সিগনিফিক্যান্ট। কী করছিল তখন?

রীতা বলল, ডাক্তার একেবারে চেন-স্মোকার। একের পর এক ধরিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানেও লক্ষ করেছি। সারাক্ষণ হাতের মুঠোয় রনসন লাইটার।

প্রোগ্রামের দ্বিতীয় অংশ শুরু হয়।

ডক্টর দিব্যেন্দু রায় একটা কাশ্মীরি ছুরি নাড়ছে লক্ষ লক্ষ টিভি-দর্শকের নাকের গোড়ায়। ছুরির ফলায় ঝিলমিল করছে স্টুডিয়োর চোখধাঁধানো আলো।

কবজির এক মোচড়ে ছুরিটাকে তিনি ছুঁড়ে দিলেন গোবিন্দর সামনে রাখা ভেলভেট জাতীয় লাল কাপড়-মোড়া কাঠের চৌকো একটা টেবিলের ওপর। ছুরির ফলাটা গেঁথে গেল কাঠে। বাকি অংশটা থরথর করে কাঁপছে।

অপু বলল, লোকটার ভাবভঙ্গি দেখলেই তো গা শিরশির করে। দেখে একবারও মনে। হয় যে, একটা নামকরা ডাক্তার কখনও…

চুপ কর এখন।

দিব্যেন্দু রায় গোবিন্দর চোখের বাঁধন খুলে দিল। শোনা গেল তার কণ্ঠস্বর, দেখুন, গোবিন্দ এবার মনঃসংযোগ করছে ছুরিটার ওপর। গোবিন্দ, তুমি ছুরিটাকে দেখছ? শুধু ছুরি–শুধু ছুরির ফলাটার ওপর দৃষ্টি রাখো তোমার চোখ থেকে আর সব কিছু মুছে যাক–তোমার সমস্ত মন ওই ছুরির ফলার ওপর

একাগ্রচিত্তে গভীর মনঃসংযোগ নিয়ে গোবিন্দ তাকিয়ে আছে ছুরিটার দিকে। স্টুডিয়োর উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক করছে ফলাটা।

দিব্যেন্দু রায়ের কথা হঠাৎ ছিন্ন করে ঘড়ির টিক টিক শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে!

এ যে সাসপেন্স মুভি! হিচকক! মিহির বলে ওঠে।

শংকর ঘর কাঁপিয়ে হাসতে আরম্ভ করে।

 আরে শংকরদা, তুমি কি দেখতে দেবে না নাকি?

 বন্ধ কর। শিগগির বন্ধ কর। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। একটু বাদেই গোবিন্দ মানসিক ক্ষমতার জোরে ছুরিটাকে বেঁকিয়ে দেবে। এই আমি এখনই বলে দিলাম। দিস ইজ টু মাচ।

শংকরের কথা সত্যি প্রমাণিত হল। ধীরে ধীরে বেঁকতে শুরু করল ছুরিটা। প্রায় যখন সেটা ধনুকের আকার নিয়েছে, ক্যামেরা চোখ ফেরাল গোবিন্দর দিকে। গোবিন্দর মুখ, তারপর চোখ, তারপর শুধু কপাল, বিন্দু বিন্দু ঘাম।

কী রে, বুঝলি তো ব্যাপারটা? শংকর বলল।

অনিন্দ্য বলল, জলের মতো। মনঃসংযোগ না কচু। এ তো বাইমেটালিক স্ট্রিপের খেল। দুটো ভিন্ন ধাতুর পাত, যেমন লোহা ও তামা একসঙ্গে জুড়ে তপ্ত করলেই সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে যায়। একই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে লোহার পাত যতটা প্রসারিত হবে, তামার পাত তার চেয়ে বেশি। ফলে পাত দুটো জোড়া থাকলে…

রীতা জানতে চায়, কিন্তু এখানে পাত দুটোকে তপ্ত তো করা হয়নি।

কে বলল হয়নি? টিভি-স্টুডিয়োর ওই প্রখর আলো থেকেই যা তাপ পেয়েছে…

শংকর বলল, অনিন্দ্য ইজ অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট। তবে এক্ষেত্রে বাইমেটালিক স্ট্রিপটা লোহা ও তামার কম্বিনেশন নয়। অন্য ধাতু ব্যবহার করছে। না হলে অত তাড়াতাড়ি বেঁকত না।

অপু বলল, শংকরদা, এবার কিন্তু তোমাকে স্বীকার করতে হবে যে, ওই তিনজন বিজ্ঞানী, যাঁরা সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন যে…

রীতা বলে উঠল, উঁহু, উঁহু। এই খেলাটার পরে তো ওঁরা কোনও সার্টিফিকেট দেননি, কাজেই…

শংকর বলল, আমাদের দুটো কাজ এখনই করা দরকার। প্রথমেই প্রত্যেকের চিঠি লেখা দরকার টিভি সেন্টারে এবং বিভিন্ন খবরের কাগজে। আর আমাদের সায়েন্স ক্লাবের তরফ থেকে এখনই একই ধরনের খেলার আয়োজন করে পাড়ার লোকজনকে অন্তত…