অধিক শহরের তামাশা

অধিক শহরের তামাশা

 দপদপ করে বারবার জ্বলে উঠছে মাল্টিসিটি।

বিভিন্ন উচ্চতার ও আকারের সুদীর্ঘ ত্রিভুজাকৃতি স্তম্ভের বুকে, মাথায় বা কোমরে গেঁথে দেওয়া ছোট-বড়-মাঝারি নানা রঙের গোলক-ঘর। পলিভিনাইল ফাইবারের সৌজন্যে নন করোসিভ আর্কিটেকচার। অক্ষয় স্থাপত্য।

মাল্টিসিটির কৃত্রিম ও নিচু আকাশে ভাসছে অসংখ্য অক্ষিবলয়। তাদের এলোমেলো বিচ্ছুরণের হিল্লোলে রঙিন তরঙ্গের জোয়ারভাটা। সারা শহর মুহুর্মুহু ডুবছে আর ভাসছে।

মাল্টিসিটির থ্রি পয়েন্ট সেভেন স্টোরি। পাঁচ নম্বর ব্যাবসায়িক উপকেন্দ্র। সবে অ্যান্টিসেপটিকের ঝিরঝিরে বৃষ্টি থেমেছে। সেরামিক টালি বাঁধানো পথ থেকে তখনও চটচটে সবুজ আভা মেলায়নি।

নবাগত ছাড়া এখন কেউ রাস্তায় নামে না। সেই জন্যেই ঘটনাটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেলসম্যানদের।

গালিপিটের ঢাকনা খুলে প্রায় একই সঙ্গে কিন্তু বিভিন্ন স্থান থেকে রাস্তা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে চারজন। চার কোম্পানির চারজন সিটি এজেন্ট। প্রত্যেকেই সাবসিডাইজড সেলোফেন-চাদরে আবৃত। পয়ঃপ্রণালী ব্যবহার করলে চলাফেরার খরচা লাগে না।

নবাগতকে ঘিরে ধরল এজেন্টরা। সম্ভাব্য কাস্টমার।

এজেন্ট-১: মশাই, ভেগাসে বেড়াতে যাবেন নাকি? সিশিয়াম অ্যাটমিক রকেট ফোর কোম্পানির মতো…

এজেন্ট-২: স্যার, আমাদের রকেট অ্যাটমিক পলিউশন ফ্রি। তিন লক্ষ সাত ছয় পাঁচ নট তিনজন চড়েছে গত…

এজেন্ট-৩: শুনুন না, আমাদের স্পেসশিপে কিন্তু ফাইভ নোভা ফেসিলিটি..

এজেন্ট ৪: তিন বেলা ভাত পাবেন হুজুর। রকেট কোম্পানি তো কতই আছে, আমাদের মতো রাইস-ক্যাটারিং রকেট ট্রিপ ওই একটাই। ভেগাস, ফোবোস কি অ্যান্ড্রোমিডা ফাইভ এক্স-এর তিন নম্বর চাঁদে যদি যেতে চান….

অন্য তিনজন এজেন্ট এবার জোট বেঁধে শেষ এজেন্টের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে।

মিথ্যে কথা। অসত্য। বুজরুকি।

এজেন্ট-৪: তবু একই কথা বলে চলে, ইমিটেশন কলাপাতায় খাঁটি ভাত…

 ভাঁওতায় একেবারে ভুলবেন না। ভাতের নামে সিন্থেটিক চালাবে। সাড়ে তিন কেজি চাল এবারের উৎপাদন–মিনেস মাইক্রোবুক অব রেকর্ড-এর শেষ খণ্ডটা চালিয়ে মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন, মিথ্যে বলছি কি না। কোথা থেকে দেবে ভাত?

মন্থরগতি ডানা ঝাপটানো ফ্ল্যাপারে চড়ে ট্যুরে বেরিয়েছিল ডায়ালগ মিউজিয়ামের কিউরেটর। ফ্ল্যাপারের ডানা মুড়ে নেমে এসেছিল। বাঁ হাতে ইলেকট্রো-প্যাড। এ অবধি যতগুলো কথা রেকর্ড করেছে, সবই বৃথা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলতে হয়েছে ডান হাত দিয়ে। মোছারও পরিশ্রম আছে। তিনবার উপবৃত্তাকারে পথে পুরো রেকর্ড করা অংশটার ওপর হাতের তালু ঘষতে হবে। কিন্তু এইসব ব্যাকডেটেড সত্য-মিথ্যা মিথ্যা সত্যর তর্ক দিয়ে প্যাড নষ্ট করার মতো গ্রান্ট পায় না মিউজিয়াম। বিরক্ত হয়ে ফ্ল্যাপারের ডানার ক্লিপ খুলে দেয়। গজগজ করে বলে, মাল্টি-মর্নিংটায় এতক্ষণে মাত্র একটা ডায়ালগ পাওয়া গেল। বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এত কমে যাচ্ছে… অবশ্য আজকের সংগ্রহ একটা হলেও অসাধারণ:

প্রাচীনকালে প্রত্যেক পিতার একটি অন্তত সন্তান থাকত, যেমন পাতাদের থাকত গাছ, যেমন লেজেদের থাকত গোরু, মোষ, কুকুর বা বেড়াল ইত্যাদি।

ফ্ল্যাপারে চড়ে কিউরেটর ডায়ালগটা প্লেব্যাক করে শুনিয়ে দিয়ে ঘোষণা করল, কথা যদি খরচ করতেই হয়, এরকম কিছু বল।

এজেন্টরা কিছুই শোনেনি বোঝা যাচ্ছে।

এজেন্ট-৪ আবার শুরু করল: খাঁটি ঝরঝরে আতপ চালের ধোঁয়া-ওঠা ভাত তিন বেলা। কালার ডিটেক্টরে ধরলে দেখবেন, সাদা কাঁটা ঝুলে পড়েছে–এত পরিষ্কার। আরও আছে। ফিরে আসার পর পাবেন কোম্পানির নামের তেলছবি-মারা সত্যিকার কাচের গেলাস। পড়ে গেলেই ভেঙে যাবে, কিছুতেই আর জুড়তে পারবেন না। ইচ্ছে করলে তার গুড়োগুলো আরও গুড়ো করতে পারেন। তারপর মিলিয়ে যাবে… কোনও ট্রেস থাকবে না। বিষ দেবার পক্ষে আইডিয়াল। কোনও ফরেনসিক পরীক্ষাই… এই দেখুন, টিকিটে সব লেখাই আছে। রিয়্যাল ট্রখ… সত্যিকার সত্যি…

রাইস ক্যাটারিং-এর এজেন্টকে জাপটে ধরল বাকি তিনজনে। মাল্টিসিটির পথে সেকেলে শহুরে লোক দেখেই জালিয়াতি শুরু করে দেবে, এসব চলবে না।

এজেন্ট-১ বুক চাপড়ে হেঁকে উঠল, সব মিনি কাউন্টারে টেপ করে নিয়েছি।

 চমৎকার! এজেন্ট-২ ভাবতেই পারেনি, এত দামি জিনিস কোনও রাস্তার এজেন্টের কাছে থাকতে পারে! বলল তবে তো স্যাটার্নের ডাবল কোয়ার্টার ম্যাজিস্ট্রেট পুরো ঠুকে দেবে। স্পেশ স্টেশনে পাঁচ দফা ফোর্সড লেবার!

হু হু শব্দে হাসতে লাগল তারা।

কিন্তু তাদের কাস্টমার হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করেছে। ভ্যাকাম কাপ পায়ে দিয়ে দৌড়? এ-ও সম্ভব? তারপরেই তারা খেয়াল করল নবাগতের খালি পা। শহুরে লোকেদের পক্ষেই এটা সম্ভব। কোনওমতেই আর ওদের পক্ষে কাস্টমারকে ধরা সম্ভব নয়।

এজেন্ট-৪ লেজার পিস্তল তাক করে হেঁকে উঠল, তোরা আমার কাস্টমার ভাগিয়েছিস। শিয়োর একটা…

পিস্তলের দিকে তাকিয়েই বাকি তিনজন এজেন্ট বুঝল, একঘর অস্ত্র। তা-ও অটো কিলার প্রসেসর নেই… একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে। বড়জোর একজনকে মারতে পারবে।

হট-রোলার চালিয়ে যাচ্ছিল নীল ডোরা ক্লিকার। রেট্রো চেপে ধরল। অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি করে গাড়ি আকাশে ঝুলিয়ে ছুটে এল।

স্টপ ইট! দাঁড়ান দাঁড়ান। এভাবে নয়।

 ক্লিকারের কথা শুনে চমকে গেল পিস্তলধারী এজেন্ট। ক্লিকারের হাতে ওয়াটারগান। এর সামনে কোনও জারিজুরি চলবে না।

ক্লিকার আদেশ দিল, যে যেমন রয়েছেন, নো চেঞ্জ। শুধু সরে আসুন। ওনলি লেগুলার মুভমেন্ট। মুভ–ওই সেন্ট গোয়েবলস উপাসনা সৌধের রেলিং-এ পিঠ দিয়ে দাঁড়ান। আপনারা তিনজন।

তারা নির্দেশ পালন করল। তিনজন এজেন্টের সামনে আগেকার দূরত্ব বজায় রেখেই হাতে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চতুর্থজন।

বাঃ। ঠিক যা চাই। রাইট ফর্মেশন। ভারী ফোটোজেনিক।

-নীল ডোরা খুশি। পকেট থেকে সোলার মাইক্রোফোন বার করে ফ্রিকোয়েন্সি মডিউলেটেড ঘোষণা শুরু করে দিয়েছে:

লেজার পিস্তলের সামনে তিনজন। অটো ব্যবস্থা নেই পিস্তলে। কিন্তু কে মরবে? এক– দুই–না তিন? বেটিং বেটিং বেটিং

পিস্তলধারীর পোশাকের সাউন্ড রিসিভারে মুখ ঠেকিয়ে নীল ডোরা বলল: পয়েন্ট নট নট ওয়ান পার্সেন্ট প্রফিট তোমার। রাজি?

পিস্তলধারী কিছু বলার আগেই তার দু-চোখে ফোম স্প্রে করে ঠুলি এঁটে দেওয়া হল। রাজি না হলে নিশ্চয় তা করত না।

বাকি তিনজন এজেন্টও খুশি। নীল ডোরা তাদের নিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে ঘোষণা করে চলেছে:

যে মরবে, দশ হাজার লুনার স্টিক। দারুণ অফার–সকলেই মরতে চায়। তাদের হার্টবিট রেকর্ড থেকেই সম্মতি পাওয়া গেছে। যে দু-জন বেঁচে যাবে, তারাও পাবে দু হাজার করে স্টিক। বেটিং-বেটিং

আকাশ থেকে, গালিপিট থেকে, ওয়াটারলাইন থেকে, কম্প্রেসড ভেপার সুপারওয়ে থেকে প্রাণীরা আসতে শুরু করেছে।

ফ্রিজার গান চালিয়ে চারজন এজেন্টকেই নিশ্চল করে দেওয়া হয়েছে।

এখন আর কেউ আধ মিমি নড়বে না। লেজার পিস্তলধারীর কবজিটা শুধু ১.৬৮ ডিগ্রি আর্কেলের মুখে নাড়াতে পারবে, যাতে কেউ না কেউ অবশ্যই মরতে পারে। এটাই বেটিং-এর প্রাথমিক শর্ত।

বাজি ধরার জোর সুযোগ। মোবাইল টিভি ভ্যান এসে গেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে মিনি হেলি আসছে। প্রিক্যাব ইনকর্পোরেশনের রোবটের দল মাচা বাঁধার সময় পাচ্ছে না। যতটুকু তৈরি হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ভরে যাচ্ছে।

টিভি ক্যামেরা রিলে শুরু করে দিল।

থার্টি-ফিফথ টিভি চ্যানেলের ভাসমান সেন্টার।

রিলে রিসিভ করেছে তারা। এখুনি প্রচার শুরু করা প্রয়োজন। বহু দূরে বসেও দর্শকরা যাতে খেলার সুযোগ পায়, তার জন্যে রিমোট বেটিং-এ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। না হলে জনপ্রিয়তা হারাবার ভয়! কিন্তু হ্যাঁলির কমেট অভিমুখে যাত্রীবাহী স্পেসফ্লোটার-এর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করার কনট্রাক্ট নিয়ে বসে আছে থার্টি-ফিফথ চ্যানেল। একসঙ্গে দুটো কাজ করার মতো যান্ত্রিক সংগতি তো তাদের নেই। এখন উপায়?

স্টেশন ডিরেক্টরের চেম্বার। একসঙ্গে কথা বলছে সবাই। কোনও কথাই তাই বোঝা যাচ্ছে না। আইডিয়ার স্বাভাবিক স্ফুরণ বন্ধ করা যেমন উচিত নয়, তেমনই প্রত্যেকের কথা শোনা দরকার।

ডিরেক্টর ভয়েস ফিলটারের বোম টিপে দিলেন। এবার ওয়ান বাই ওয়ান শোনা যাবে…

প্রাচীনতম কর্মীর কথা সবসময়েই এরকম ট্র্যাশ হয়।

নিউ ব্লাড তিন নম্বর ভালো বলছে, মানে শুধু বলছে না, সাজেস্ট করছে। সেটাই দরকার।

ভয়টা কীসের? কম্পেনসেশনের তো? কিন্তু তার জন্য আমরা এত বড় একটা ন্যাচারাল বেটিং-এর, এমন একটা অকারেন্স–এই খেলা দেখাবার সুযোগ আমরা টিভি ছাড়া করতে পারি না।

কিন্তু সুযোগ বলতে কী বোঝায়? সি হিয়ার–ক্যারুসেল হ্যাঁন্ডি কম্পেনিয়ন থেকে প্রোজেক্ট করছি…

ডিরেক্টর শেষ বক্তাকে থামিয়ে দিলেন… অনেকে দেখছি, এখনও আমাদের মানুষের মতো নির্বোধ ভাবে! থার্টি-ফিফথ চ্যানেলেও এরকম আবর্জনা জমছে শুনতে পাচ্ছি।

নিউ ব্লাড-৩ আবার শুরু করল: সুযোগ মানে প্রফিট। কম্পেনসেশনের অ্যামাউন্ট যতই হোক, তারও চেয়ে বেশি যদি আমরা…

–ডিসিশন টাইম! ডিসিশন! এবার তবে ডিসিশন নেওয়া হক।

 সবাই গলা মিলিয়েছে।

–কম্পিউটার বোলাও। ওয়ান, টু, থ্রি–ফায়ার!

কলিং গান তিনবার গর্জে উঠল। ঘরের মাঝের অংশে ছাতের উত্তলতা ক্রমেই বাড়ছে। এবার মেঝের কাছে সে নামিয়ে দিয়েছে হিসাবরক্ষক, আইনজ্ঞ আর পরিসংখ্যানিবদকে। তিনজনকে ঝুলিয়ে রেখে ছাত তার নিজের জায়গায় ফিরে গেছে।

–হিসাবরক্ষক! ফান্ড পজিশন–কুইক—

 হিসাবরক্ষকের গ্রাফোপ্রিন্টার থেকে তিন মিমি চওড়া ফিতে বেরচ্ছে।

লম্বা। বেশ লম্বা ফিতে–এখনও বেরচ্ছে। না না, সংখ্যার দরকার নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমরা সলভেন্ট।

ডিরেক্টর তলব করলেন পরিসংখ্যানবিদকে। স্পেসফ্লোটারের (অপারেশন হ্যাঁলির) যত যাত্রী–অ্যাস্ট্রো–কসমোনটদের সম্বন্ধে যাবতীয় পার্সোনাল ডসিয়ের–সব খবর টেনে বার করতে হবে ফ্লপি চাকতি থেকে।

..ছ-জন পুরুষ, পাঁচজন মহিলা, সাতাশজন অ্যান্ড্রোয়েড স্পেসফ্লোটারের যাত্রী।

–ইনশিয়োরড লাইফ। টোটাল ভ্যালু… পাঁচ একর আলুর জমি, তিনটে আমবাগান…

–টু মাচ! এত আমরা দিতে পারব না। ডিরেক্টর পরিসংখ্যানবিদকে থামিয়ে দিল।

আইনজ্ঞ নীল স্ক্রিনে উপদেশ দিল, স্পেসযাত্রীদের পরিবারের খবর দিতে বলুন। কল ব্যাক স্ট্যাটিস্টিশিয়ান!

পরিসংখ্যানবিদকে এবার কোলে তুলে নিয়েছে ডিরেক্টর। স্কিন কনট্যাক্টে তাড়াতাড়ি কথা সারার জন্য। সব খবর দরকার নেই। দরকার যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট পরিবার যে ক-জনের, তাদের নমিনিদের পরিচয়।

তিনজনের মাত্র একজন করে নমিনি। বাকিদের হিসেব জটিল। সাতাশজন অ্যান্ড্রয়েডই এক বৃদ্ধের সম্পত্তি। বৃদ্ধের উত্তরাধিকারী এক নাইটি-ফিফথ জেনারেশন হিউম্যানয়েড কিন্তু সে এখনও নাবালক। আরও দশ হাজার ন-শো ছ-মিনিট উনচল্লিশ সেকেন্ড বাদে তবে সে দাবি করার অধিকার পাবে…

ডিরেক্টরের নির্দেশে প্রিন্টার ছেপে দিল তিনজন নমিনি ও বৃদ্ধের নাম। কম্যান্ডো লিডার হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছে।

–এনি প্রবলেম? ডিরেক্টর জানতে চাইল।

-তিন মিনিট তেরো সেকেন্ড লাগবে। মাইক্রোপ্রসেসরে হিসেব করে জানাল কম্যান্ডো লিডার।

ইনকুডিং হিউম্যানয়েড?

–নো সার।

 –কিন্তু হিউম্যানয়েডকেও ধ্বংস করা চাই।

 মাইক্রোপ্রসেসর নিয়ে আবার নাড়াচাড়া। পিপ পিপ-কম্যান্ডো লিডার মাথা ঝাঁকাল। ইনডিটারমিনেট প্রবলেম স্যার। অনির্দিষ্ট সমাধান। হিউম্যানয়েড আর আমাদের অ্যাকশন স্কোয়াডের কম্পিউব্রেন–দুটোই ইউ-সা প্রোডাক্ট। শুধু তা-ই নয়, দুটোরই সেম জেনারেশন। কে কাকে এবং কতক্ষণে অ্যানিহিলেট করবে, জানা যাবে না।

তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াল? স্ট্যাটিস্টিশিয়ান! পিপ পিপ নেট প্রফিট! পিপ পিপ নেট প্রফিট! তিনজন নমিনি খুনের খরচ প্লাস হিউম্যানয়েডের ফিফটি ফিফটি চান্স ধরলে…

–ইডিয়ট! গর্জে উঠল ডিরেক্টর, হিউম্যানয়েড বেঁচে গেছে ধরে হিসাব কর।

 –পিপ পিপ নেট প্রফিট। নেট প্রফিট।…

কম্যান্ডো লিডার স্যালুট ঠুকে পকেট ফ্ল্যাগ বার করে নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল। অ্যাকশন টাইম।

ডিরেক্টর হাইড্রলিক লিভারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফাইভ মিলিগ্রাম প্রেশারই যথেষ্ট। তাহলেই পুরোপুরি ব্ল্যাক আউট। স্পেসফ্লোটার মহাশূন্যে বোবা-কালা অন্ধের মতো ছুটতে শুরু করবে। কারও সঙ্গে কোনও যোগ থাকবে না। বন্ধ হয়ে যাবে শক্তি সরবরাহ, কম্পিউটার অচল, তিন মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ডের বেশি কোনওমতেই যাত্রীরা… ততক্ষণে কম্যান্ডোরা…

ডিরেক্টরের স্কাল ক্যাপ হঠাৎ আলট্রাসনিক সাইরেনে কেঁপে উঠল। ডিরেক্টর ভ্যাকাম কাপ-বুট ঠুকে গোড়ালিতে গোড়ালি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে। ডান হাত সিধে রয়েছে, শরীরের সংস্পর্শে টানটান। বাঁ হাতও কনুই অবধি সেরকম। শুধু কনুইয়ের পরবর্তী অংশ ভাঁজ হয়ে ঊর্ধ্বমুখী। মুষ্টিবদ্ধ। স্যালুট।

ঘরের যারা ছিল, সকলেই প্রস্তুত। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত। ডিরেক্টরের পিঠে ঝোলানো বিরাট ডিমের মতো প্লাস্টিক বেলুনটা ঘন ঘন ফুলে উঠছে। উত্তেজনা। বেশ ভালো পরিমাণেই কাউজেন গ্যাস পোড়াচ্ছে।

নিউমেটিক ভিআইপি ট্র্যাপডোর ঠেলে নিঃশব্দে প্রবেশ করল মেগা-ডিরেক্টর পিগমি।

ডিরেক্টর দু-হাত তলপেটের ওপর রেখে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দু-বার গোড়ালি উঁচু করে অভিবাদন জানাল।

ডিরেক্টরের অদৃশ্য এয়ারকুশন দখল করে পিগমি দোল খেতে শুরু করেছে।

অন্যেরা একে একে ছোট ট্র্যাপডোর দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

 পিগমির আগমন মানেই গোপন বৈঠক। এরকম ঘটনা অবশ্য খুবই বিরল।

পিগমির কথা বোঝার জন্য আলট্রাসনিক সংকেত ভাষায় অনুবাদ করার যন্ত্র চালু করে দিল ডিরেক্টর।

পিগমি বলল, কতদূর এগল?

-কম্যান্ডো রওনা হয়ে গেছে–তিন-চার মিনিটের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে লাইভ ব্রডকাস্টিং। গ্রেটেস্ট বেটিং ইভেন্ট…

–কল ব্যাক কম্যান্ডো। এতগুলো রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া প্রচুর খরচ হচ্ছে আর…

–কিন্তু… বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল ডিরেক্টর। পিগমির কাছে কিছুই যখন অজানা নেই…

সাব-অ্যাটমিক ওয়্যারলেসে কনট্যাক্ট কর এক্স লাইন বিডি সিক্স থ্রি!

–ইয়েস স্যার!

ব্লিপ ব্লিপ। অসিলোস্কোপও সংযোগ স্থাপিত হওয়ার তথ্য জানিয়ে গ্রাফ আঁকতে শুরু করেছে।

স্পিকারের সুইচ দিয়ে দিল ডিরেক্টর।

পিগমি দুর্বোধ্য কোড-এ কিছু বলল। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। এবার শোনা যাচ্ছে ও প্রান্তের কথা।

–ওল্ডার নট ফাইভ। ওল্ডার নট ফাইভ। ওভার।

থার্টি-ফাইভ চ্যানেল! থার্টি-ফাইভ চ্যানেল। ওভার

–প্রসিড।

–স্পেসফ্লোট হ্যালির ডিজাইনারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

–বলছি। সিক্রেসি মেন্টেন সুইচ অন। ওভার।

অদ্ভুত কতকগুলো শব্দ শোনা গেল। অসিলোস্কোপের সবুজ রেখা এলোমেলো। এরপরে যা কথাবার্তা হবে তা ডুবে থাকবে বৈদ্যুতিক কোলাহলে। সিক্রেসি মেন্টেন সুইচ টিপে ধরলে তবেই তার অর্থ বোঝা যাবে, কিন্তু কোনওভাবেই তাকে রেকর্ড করা যাবে না– বাগিং অসম্ভব।

স্পেসফ্লোটার হ্যালি ধ্বংস করতে চাই। চেক উইথ ল্যান্ড এজেন্ট। তিনটে প্রাকৃতিক কমলালেবুর বাগান আপনার নামে বুক ট্রান্সফার করা হয়েছে। ওভার।

–আননেসেসারি। আমার সহযোগিতা ছাড়াও আপনারা স্পেসফ্লোটার হ্যাঁলি ধ্বংস করতে পারেন। স্পেশাল প্রোটেকশন নেওয়া হয়নি…

–কিন্তু ইনশিয়য়ারেন্স? ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি আমাদের ট্রেস করতে পারবে…

–ইনশিয়োরেন্স পে না করে ধ্বংস? অসম্ভব। অসম্ভব।

–আরেকবার ভাবুন। তিনটে অরেঞ্জ গার্ডেন… সেই রসালো ফল, যার রং কমলা… কমলাবাগান… বাগান… তিনটে খেত…

–কিন্তু…

–আপনি ভুলে যাচ্ছেন, ওই স্পেসফ্লোটে কিন্তু গ্রেট রিপার আছে… হ্যালো… হ্যালো…

কিছুক্ষণের নীরবতা।

–আপনি ভুল করছেন না তো?

–কোনও ভয় নেই। জানি শুধু আমি আর আপনি। অবশ্য জানলেও প্রমাণ করতে পারব না। অ্যাডমিট করছি আপনি জিনিয়াস। না হলে পঞ্চান্ন কেজি ওজনের লাইফ কনভিক্টকে লুকিয়ে স্পেসফ্লোটারে তুলে মহাকাশ পার করিয়ে দেওয়া… এমনকী অ্যাস্ট্রনটরাও টের পাচ্ছে না, পাবেও না… রিয়্যালি এ এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফিট… পরে আলোচনা করব, কীভাবে পে লোড বাড়ালেন অথচ ফুয়েল..

–আমায় কী করতে বলেন?

–একটা স্বাভাবিক বিশ্বাসযোগ্য ঘটনার আয়োজন

আমাদের শেষ দুর্ঘটনা ঘটেছে আটাত্তর বছর আগে। আনঅ্যাকসেপ্টেবল প্রস্তাব।

 –দুর্ঘটনা বলতে বোঝাতে চাইছি হাইজ্যাকিং।

–ও! গ্রেট রিপারকে দিয়ে আপনি…

–কারেক্ট। গ্রেট রিপার অ্যাটাক করবে–হাইজ্যাকিং-এর চেষ্টা–স্পেসফ্লোটার নিজের কোর্স থেকে সরে আসবে–অনিয়ন্ত্রিতভাবে দু-তিন সেকেন্ড চললেই ঢুকে পড়বে সিরিয়ে অপ্টিকার ফিল্ডে। টার্গেট।

-কারেক্ট। সিরিয়ো অপ্টিকার ফিল্ডে স্পেসফ্লোটার শত্রুপক্ষের স্কিনে বিপজ্জনক বস্তু! টার্গেট।

–গ্রেট রিপারকে দিয়ে এ কাজ করাতে পারবেন?

 –অসম্ভব নয়। আমার সঙ্গে স্পেশাল যোগাযোগ আছে। তা ছাড়া হি ইজ ক্যারিয়িং এক্সপ্লোসিভ। ধরা পড়ার ভয় দেখালে রিপার ফেরোশাস হয়ে উঠবে।

–পুরো ব্যাপারটাই আপনারা রেকর্ড করে রাখবেন নিশ্চয়?

–রিপারকে পাঠানো আমার ভুল খবরটুকু ছাড়া!

–নিশ্চয়–তিনটে কমলালেবু বাগানে কত ফল ভাবুন একবার!

থ্যাঙ্ক ইউ! নিশ্চিত থাকতে পারেন, আই উইল টেক নো চান্স।

-রিপারের সঙ্গে কসমো অ্যাস্ট্রনটদের লড়াইয়ের মধ্যেই আমি স্পেসফ্লোটারের কম্পিউটারে ফ্রিকোয়েন্সি সার্কিট এবার ছুঁড়ে দেব! বিভ্রান্তি। এই ব্যবস্থাটা আমি করেই রেখেছিলাম। এখন কাজে দেবে… স্পেসফ্লোটার আর ফিরে আসছে না…

-ইনশিয়োরেন্সও কিছু ক্লেম করতে পারছে না আমাদের কাছ থেকে, তা-ই না?

–কারেক্ট।

-ল্যান্ড এজেন্ট কনট্যাক্ট করবে আপনাকে উইদিন এ সেকেন্ড। দু-মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে থার্টি-ফিফথ চ্যানেল থেকে আমরা ওই মহাকাশযানটি সরিয়ে দিতে চাই।

–ডান। ওভার।

–আহা, তিনটে কমলালেবুর বাগান! ওভার।

ডিরেক্টর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেই ঘুরে দাঁড়াল। তার প্লাস্টিক ফেস মাস্কে জলীয় বাষ্প জমেছে। ওয়াইপারের সুইচ টিপেই বলে উঠল, কিন্তু কম্যান্ডো তো ইতিমধ্যেই নমিনিদের সাবাড় করার জন্য…

–কল ব্যাক!

–উপায় নেই। উপায় নেই-হি ইজ অন হিজ ওয়ে। তা ছাড়া অ্যাকশন টাইমে আপনি জানেন দে আর ডেফ। সেইভাবেই ওদের তৈরি করা হয়েছিল। আপনারই নির্দেশে…

হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারই নির্দেশে। আমি জানি। কারণ এরকম কম্যান্ডোকে খুব সহজেই বিভ্রান্ত করা যায়। আমাদের নির্দেশকেই বাঁকিয়ে দিয়ে আমাদের ধ্বংস করে দেওয়া যায়।

–তাহলে…

–তাহলে, একটাই উপায়। স্ট্রাইক দেম অফ আওয়ার রোলস। আজ থেকে আমাদের চাকুরেদের তালিকায় ওদের আর নাম পাওয়া যাবে না।

-কিন্তু আজ তো ফ্লপি অ্যাটেন্ডেন্সে ওদের হার্টবিটস-এর হাজিরা রয়েছে…

–ফ্লপি বাতিল করে দিয়ে নতুন একটা ফ্লপি–দু-নম্বর ফ্লপি খোল। প্রথম ফ্লপি থেকে বাকি সবার রেকর্ডটা তুলবে শুধু কম্যান্ডোদের বাদে।

–ক্লিয়ার? এ তো খুব সোজা। কম্যান্ডোরা যদি আমাদের পে-রোলে না থাকে, তাদের কাজের জন্য আমাদের নিশ্চয় কৈফিয়ত দিতে হবে না। আর সময় নেই, কাজ শুরু করে দাও। এখন বলতে পার, থার্টি-ফিফথ চ্যানেল সত্যিই সব রকমের বাঁধনমুক্ত। বেটিং লাইভ বেটিং–আর দু-মিনিট একত্রিশ সেকেন্ড পরেই আমাদের চ্যানেলের মারফৎ কোটি কোটি লোক এই বেটিং-এ অংশ নেবে… আহা প্রফিট…

.

গোয়েবলস, উপাসনা সৌধের রেলিং।

কৃত্রিম আকাশ থেকে কৃত্রিম আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাল্টিসিটি সংলগ্ন স্পেস স্টেশনে এখন রকেট ছাড়ার সময়। ক্ষণে ক্ষণে রকেটগুলি তীব্রবেগে মহাকাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে আর তারই জ্বালানি-পোড়া আলোয় কৃত্রিম আকাশ বারে বারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে বিভিন্ন রঙে। কাছে-দূরে মিলিয়ে সময়ে কোনও ছেদ নেই যখন আকাশ রকেটের আলো পায় না। তফাত হয় শুধু উজ্জ্বলতায় আর রঙে। বেটিং-এর পক্ষে সময়টা আইডিয়াল।

প্রিফ্যাব স্টেডিয়ামের একাংশ ভেঙে পড়েছিল। তিন-চারশো ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি হোভার-মোটরে হাজির। সচল বিচারালয়ও স্থাপিত হয়েছে সাতটা। একের পর এক মামলা উঠছে–প্রিফ্যাব কোম্পানি কোনওটাই জিততে পারেনি। প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে।

প্রিফ্যাবের চিফ ইঞ্জিনিয়ারও কাঠগড়ায় উঠেছে। মাল্টিসিটির প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত না মেনে আর উপায় রইল না। দু-হাজার বাহাত্তর টন ওজনের পলি ইউরিথিন ফোমের রকেটের মতো চেহারার সিলিন্ডার আসছে সাতশো চাকার নিউক্লিয়ার লরি চেপে। ওই সিলিন্ডারের মুখ থেকে এখুনি শুরু হবে ফোম ইনজেকশন। গ্যালারির যত ফাঁপা নলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। মুহূর্তের মধ্যে জমে গিয়ে কাঠামোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। তারপর আর গ্যালারি ভেঙে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কয়েকশো বেটিং কোম্পানি স্টল খুলেছে। স্বচ্ছ ছাতার মতো তাদের প্রত্যেকের ক্যানপির ওপর ফ্লুরোসেন্ট বেলুন ভাসছে। কোম্পানির নাম লেখা তাতে। মাইক্রোপ্রসেসর নিয়ে কাউন্টারে শুয়েও কেরানির তাল রাখতে পারছে না। প্রত্যেক কাউন্টারের মাথাতেই ফ্লোটিং গান বেঁধে একের মাথায় আরেকজন ভেসে আছে। দু-তিনশো করে প্রাণীর লাইন। আকাশের দিকে ক্রমে বেড়েই চলেছে লাইনের লেজ।

ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট অবিরাম প্রিন্ট আউট বিতরণ করেও সামলাতে পারছে না। ঘুঘু বেটাররা প্রথমেই চারজন এজেন্টের শারীরিক বিবরণ সংগ্রহ করতে চায়। যে তিনজন পিস্তলের সামনে দাঁড়িয়ে, তাদের উচ্চতা ও বেধ জানা দরকার। একেবারে নিখুঁত হিসেব চাই মাইক্রনে। তাদের হার্টবিটের মনিটরিং দরকার। এসবের ওপরেই নির্ভর করবে প্রবাবিলিটির গণনা। তা ছাড়া গুলি যে ছুড়বে, তারও প্রতিটি অঙ্গের শারীরিক ক্রিয়ার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে অবিরাম।

মেডিক্যাল আর্কাইভ বিভাগের দপ্তর খুলতে দেরি হয়েছে। এর জন্য তার ডিরেক্টরকে অবশ্যই বদলি করা হবে। এত বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনার সময়ে যারা গাফিলতি করে, তারা সম্পূর্ণ অযোগ্য। আর্কাইভের পেছনে মাল্টিসিটি সরকার তো এই বাজিধরদের উপার্জনই ব্যয় করছে। বাজি ধরতে গেলে এই চারজনের প্রত্যেকের মেডিক্যাল হিস্ট্রি জানা দরকার। জানা দরকার তাদের পেডিগ্রি।

কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। দশ…

আকাশে মাছির মতো ভনভন করছে হেলি-কার। নামার জায়গা নেই, অনুমতি নেই।

নয়…

এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের হোত ক্লিকার এতক্ষণ কোথায় ডুব মেরেছিল, কেউ দেখেনি। ক্লিকারই বোধহয় একমাত্র প্রাণী যে বেট ধরেনি।

আট….

চারজন এজেন্ট এখন ফ্রিজার মিক্সারের প্রভাবে ধাতব স্ট্যাচুর মতো অচল। শূন্য মুহূর্তে যুগপৎ তারা প্রাণ ফিরে পাবে–বাঁচবার জন্য প্রত্যেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পালাবার চেষ্টা করবে (কে কীভাবে কী করতে পারে, তার জন্যই তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস কনফিডেনশিয়াল ফাইল সংগ্রহ করা দরকার হচ্ছে)। এবং সেই মুহূর্তে জ্বলে উঠবে লেজার পিস্তল। একটিমাত্র শট এবং শুধু একজনেরই মৃত্যু হবে।

সুপার ক্রাইওভ্যাক-এর টেস্ট হাউসের সার্টিফিকেটও পাওয়া গেছে। বেটিং-এর প্রাথমিক শর্ত, শুধু একজনের মৃত্যুর গ্যারান্টি দিয়েছে তারা। বাজি যারা ধরেছে, তারা নিঃসন্দেহ যে, এর মধ্যে কোনও জালিয়াতি নেই।

কয়েকটা বেটিং কাউন্টারের মাথায় ঝগড়া বেঁধেছে। বেটারদের কথা চিন্তা করেই স্টলের লাগোয়া আকাশে তিন-চারটে ক্যাটারিং সার্ভিস বিভিন্ন মাল্টিফুডের ধোঁয়া ছেড়ে গিয়েছিল। ধূম্রখাদ্যের ওড়না ছিঁড়েখুঁড়ে ক্ষুধার্তরা শেষ করে দিয়েছে, কিন্তু বিল মেটাবার সময়ে নানা ওজর তাদের।

সবচেয়ে ভালো ব্যাবসা করেছে সৌভাগ্য-সামগ্রী বিপণন। প্রত্যেক বেটিং স্টলের মালিক তাদের কাছ থেকে ফাইবার গ্লাসের সুতোয় গাঁথা একটি করে অতিকায় আকারের পাতিলেবু ও ছ-টি করে লংকা কিনেছে। ইমিটেশন হলেও প্রত্যেকটিতে দশ হাজার-X শক্তির প্রাকৃতিক গন্ধের ছিটে আছে। আর-একটা বিশেষ সুবিধা হল, এগুলি ভাসিয়ে রাখার জন্য কোনও গ্যাসজাতীয় পদার্থের দরকার নেই।

সাত….

ক্লিকারকে এবার দেখা যাচ্ছে সেন্ট গোয়েবলস সৌধের মাথায়। টেলিস্কোপিক ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য ব্যাপার-সাড়ে তিনশো বছরের পুরানো এই ক্যামেরা সে পেল কোত্থেকে? আর তার প্লেটই বা জোগাড় করল কীভাবে? অবশ্য ক্লিকার বর্তমানে সেরা চিত্র-সাংবাদিক, তার পক্ষে সবই সম্ভব।

ছয়… পাঁচ…

 ক্লিকার তার মুখের কাছে মাইক্রোফোনে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে। তার মানে তার পুরো স্টুডিয়োর টিম উপস্থিত। ওই তো সামনেই আলট্রাসনিক টিভি-গান চালাচ্ছে একজন। ওদিকে ইনস্ট্যান্ট হলোগ্রাম টিল ক্যামেরা নিয়ে আরেকজন।

চার… তিন…

বোঝা যাচ্ছে, ক্লিকার এই ঘটনার চাক্ষুষ প্রমাণ লিপিবদ্ধ করার সোল রাইট কিনে নিয়েছে।

দুই… এক…

এক নম্বর এজেন্ট লাফ মেরেছিল।

দুই নম্বর এজেন্ট নিজেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল সেরামিক রাস্তার ওপর।

তিন নম্বর এজেন্ট নড়েনি। দুই নম্বর এজেন্ট স্পটডেড।

মৃত্যু-মুহূর্তে থেমে গিয়েছিল সমস্ত কোলাহল। শব্দ-বিধ্বংসী টাইম বোমটা একসময়েই কাজ করেছে।

শব্দটা ফিরে আসার আগেই নিঃশব্দে তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। বেটিং কোম্পানিরা আর কয়েক সেকেন্ড দেরি করলেই লুট হয়ে যেত। অগুনতি মিলিটারি কম্যান্ডোরাও থামাতে পারছে না আনন্দ আর শোকের তাণ্ডব।

তারই মধ্যে লেডি অব দ্য ডেড-কে চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্লভ দুর্মূল্য হাইড্রোজেন গ্যাসভরা আকাশ ছোঁয়া সাতরঙা বেলুনের বেতের ঝুড়িতে। মৃত দ্বিতীয় এজেন্টের ভাগ্যবতী পত্নী এই মুহূর্তে সবচেয়ে ধনী মহিলা। তাঁর বক্তৃতা শুরু হয়েছে, আমি জানতাম, ও-ই মরবে। আমি কোনও কম্পিউ-এর সাহায্য নিইনি কিন্তু। প্রাইজের টাকা ছাড়াও আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন, আমি ওর মরার ওপর পঁচিশে-এক বাজি ধরেছিলাম। আমি জিতেছি, কারণ ও মরেছে। ও না মরলে যে আমি জিততে পারতাম না।

লেডির কাছে বিবাহের অজস্র প্রস্তাব আসতে শুরু করে দিয়েছে। লেডি হাসছেন–বাঁ হাত নাড়ছেন। ডান হাত দিয়ে তিনি সিন্থেটিক বস্ত্রের জিপার-মোটরের সুইচ টিপলেন। মুহূর্তে তাঁর নগ্ন দেহের ওপর এসে স্থির হল ইনফ্রারেড লাইট। তাঁর উষ্ণতা রক্ষা করবে।

লেডি ঘোষণা করলেন, দেখুন আমি কী সুন্দর! আমার লাভার নিশ্চয় আমার মতোই। সুন্দর হবে। আমি কি শুধু অর্থেই স্যাটিসফায়েড হব? লেডি ভঙ্গি করলেন। আহ্বান। কিন্তু সবার জন্য নয়।

লেডির মেডিক্যাল হিস্ট্রির সচিত্র প্রিন্ট আউট বিতরণ শুরু হয়ে গেছে। বিনামূল্যে। ক্রমেই উন্মাদনা কমে আসছে। একে তুষ্ট রাখার মতো শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী বিরল।

লেডি হাসছেন। আহ্বান করছেন।

দর্শকদের চিৎকারে সাড়া দিতেও কুণ্ঠা নেই তাঁর। সবাই জানতে চায়, তিনি স্টিফেনের স্প্রে ব্যবহার করে চিরযৌবনা কি না।

লেডির নির্দেশে স্টিরিয়ো স্কাই থেকে চিকচিক করে বেজে উঠল নৃত্যের বোল থেকে এক্সসার্পট।

তারই তালে তালে লেডি প্রত্যঙ্গে হিল্লোল তুলে দেখিয়ে দিলেন তাঁর শরীরের অকৃত্রিম নমনীয়তা। খাঁটি রূপজীবী।

.

সেন্ট গোয়েবলস স্মৃতিসৌধ থেকে নেমে এসেছে ক্লিকার। কিন্তু

সবার কাজ শেষ হবার পরেও তার কাজ ফোরায়নি।

স্টুডিয়োর ছাতে গোপনে অপেক্ষা করছে মধ্য মহাকাশের সেকসলস গ্রহ থেকে আগত মিনি ক্যাপসুল। স্টুডিয়োর কাজ প্রায় শেষ। এখুনি বিদায় করতে হবে সেকসলসকে। যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়তে পারে আরও দু-জন শ্রোতা।

মহাবিশ্বের সেরা (আন্ডারগ্রাউন্ড) পর্নোগ্রাফিক মার্কেট সেকসলস-এ। প্রবল ধর্মীয় দাপটে নগ্নতার ছবি সেখানে যেমন দুর্লভ, তেমনই দুমূল্য। বিশেষ করে লক্ষ প্রাণীর সামনে বেলুনারোহী নগ্ন লেডির প্রাকৃতিক আহ্বান!

ছবি সংগ্রহ করে সেকসলসের দিকে রওনা হয়ে গেল মিনি ক্যাপসুল। ক্লিকারকে তারা বিশ্বাস করে। একবার চেক করে দেখাও প্রয়োজন মনে করেনি। তাদের এখন সিকিয়োরিটি এড়িয়ে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তা।

এবার আসবে দ্বিতীয় মহাকাশযান। তবে তারা গোপনচারী নয়। মাল্টিসিটির মতো পুরানো সভ্যতার বর্বরতা সম্বন্ধে প্লেকসাসবাসীকে সচেতন করার জন্যই তারা এসব ছবি কিনবে। ক্লিকারকে তারা ঘৃণা করে, কিন্তু ক্লিকারের পাওনা মিটিয়ে দেবে।

সবার শেষে আসবে সবচেয়ে বড় কাস্টমার। সোলেকস থেকে। অ্যান্টিক ডলার। তারই জন্য প্রাচীন টেলিফোটো লেন্সযুক্ত ক্যামেরায় প্রাচীন প্লেট ভরে ছবি তুলেছে ক্লিকার। এইসব প্লেটের প্রিন্টগুলি কেমিক্যাল বিশ্লেষক যন্ত্রে পরীক্ষা করলেও তাদের নবীনত্ব ধরা পড়বে না। এই অ্যান্টিক ডিলারের তিনজন ক্রেতা আছে। তিন ঐতিহাসিক। তাদের মধ্যে অকশান হবে গোপনে। পুরাতত্ত্ব আবিষ্কারের গৌরবের পরিবর্তে ঐতিহাসিক পাওনা মিটিয়ে দেবে অ্যান্টিক ডিলারের এবং ডিলার তার আগেই ক্লিকারের পকেট ভরে দেবে।

ক্লিকার জানে, আরও এরকম দুটো ঘটনা যদি কভার করতে পারে, তবে ইন্টার স্পেশিয়াল কাস্টমারদের সৌজন্যে তার রিটায়ার্ড লাইফে অকৃত্রিম আতপ চাল দু-বেলা জুটবেই ছুটবে।

 [প্রথম প্রকাশ: ফ্যান্টাসটিক, ১৯৮৯ সেপ্টেম্বর]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *