অ্যাস্ট্রো-স্কুলের ছাত্র

অ্যাস্ট্রো-স্কুলের ছাত্র

 ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের অফিসার কম্পিউটার থেকে নীল কার্ডটা টেনে নিয়ে সুদীপের দিকে এগিয়ে দিলেন। পাসপোর্ট সাইজের ফোটোগ্রাফের ডানদিকে নাম-ঠিকানার নিচে সুদীপের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। অ্যাস্ট্রো-স্কুলের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্টের প্রি-টেস্টের প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরির জন্য এক্সপিডিশনে বেরনোর স্পেশাল পারমিট।

ম্যাপ খুললেই দেখা যাবে, সৈকত থেকে আন্দাজ পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে একটা খালের ধারে সমুদ্রমুখ গ্রামে এসে পাকা রাস্তাটার ওপর ফুলস্টপ পড়েছে। কিন্তু সুদীপকে থামতে হল আরও তেতাল্লিশ কিলোমিটার আগে। তাতে অবশ্য সে খুশিই হয়েছে। এক বছর অন্তর কার্টোগ্রাফাররা আসে নতুন ম্যাপ বানাতে। কিন্তু তার জন্য প্রকৃতিদেব তো আর অপেক্ষা করে বসে নেই।

সুদীপের লগ-বুকে প্রথম এন্ট্রি আঞ্চলিক চেহারায় পরিবর্তনের হিসেব। পথ অনেকটা বেড়ে গেল জেনেও সুদীপ ঘণ্টাখানেক খরচ করল মাপজোক সারতে। হয়তো দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত এটাই হবে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার।

কিন্তু এক্সাইটমেন্টের মুখে একটা ভুল করেছে। ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়েলে লেখা আছে, গাড়ি চলার রাস্তা শেষ হলেই নিরাপদ জায়গা খুঁজে বার করে মিনি ট্রাক পার্ক করার ব্যবস্থা করতে হবে।

অবশ্য সমুদ্রমুখে তিন ঘর লোক আর একটা পুলিশ থানা আছে ভেবেই গাড়ি পার্কিং এর কথা লেখা হয়েছিল। এই পরিত্যক্ত গ্রামে গাড়ি ফেলে যেতে হবে ভেবে নার্ভাস লাগে সুদীপের। কাজ সেরে ফিরতে চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা তো লাগবেই। চুরির আশঙ্কাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? গাড়ি চুরি হলে ফেরার সময় কতটা পথ হাঁটতে হবে, তার চেয়েও বড় চিন্তা, গাড়িটা ইনশিয়োর করা নেই। সোলারকার-মার্ক সিক্সের চেয়ে পুরানো কোনও মডেল ইনশিয়োর করা যায় না। সুদীপের তিন বছরের পুরানো এই গাড়িটা ভিনটেজ মডেল হতে পারে, কিন্তু সে শুধু চেহারায়। তার বাবা যেভাবে মেন্টেন করেন, তাতে… গাড়ি চুরি হলে সবচেয়ে অসুবিধেয় পড়বে বাবা।

ফাইবার গ্লাস-ব্রিকের আবর্জনার মধ্যে একটা ভাঙা দেওয়ালের পাশে তিনটে তোবড়ানো গাড়ি তিনদিকে মুখ ফিরিয়ে পড়ে আছে। যেন প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের আড়ি। এককালে এখানে বোধহয় গ্যারেজ ছিল। হোভারক্র্যাফ্টটা নামিয়ে নিয়ে মিনি ট্রাকটাকে ভাঙা গাড়িগুলোর মধ্যেই এক ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটা চাকা রিমসুষ্ঠু খুলে তুলে নিল হোভারক্র্যাফটে। তাতেও মন ভরল না। বাকি চাকা ক-টার হাওয়া বার করে দিল।

পেছন থেকে মোটা গলায় কে কে ডাক শুনে চমকে গেল সুদীপ। মুখ ফিরিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। এখানে যদি লোকজন থাকে, যদি লুকিয়ে তার ওপর নজর রাখে, তাহলে তো এসবই পণ্ডশ্রম। সুদীপকে আর ভাববার সুযোগ না দিয়ে কে-কে ডাকটা তারই সামনে উড়ে এল।

দাঁড়কাকটাকে দেখে বিশ্রী লাগে সুদীপের। এমন পালক-খসা শির বার-করা পাখি কখনও দেখেনি। সন্তর্পণে পায়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে এল হোভারক্র্যাফটের কাছে। সুদীপ চায় না কাকটা পালাক। হ্যাঁচ খুলে ড্রাই ফুডের পলিথিন-প্যাক থেকে চিকেন বিস্কুট বার করেছে। অকারণেই সতর্ক হয়েছিল সুদীপ। খিদের চোটে কাকটা মানুষকেও আর তেমন ভয় পাচ্ছে না। ভালো করে বোধহয় ওড়ারও ক্ষমতা নেই। অসুস্থ কাকটা তুড়ক-তুড়ক। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল খাবারের গন্ধে। সুদীপ কাঁধের ব্যাগ থেকে মিনি গাইগারকাউন্টার বার করল। তার সন্দেহই ঠিক। কাকটা তেজস্ক্রিয়তার শিকার। তবে মিটারের হিসেব অনুসারে সেটা বিপদসীমার নিচে। এবার বুঝতে পারছে এ অঞ্চলের কেন এই অবস্থা।

ধারে-পাশেই নিশ্চয় কোথাও বেআইনিভাবে গোপনে পারমাণবিক শক্তিচালিত রকেট নিক্ষেপের পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তিন বছরে নন-টা পারমাণবিক রকেট ব্যর্থ হওয়ার পর আন্তর্জাতিক শান্তি সংস্থা এই পরীক্ষাকে অমানবিক ঘোষণা করেছে। তা বলে সেই নিষেধ পুরোপুরি মানা হচ্ছে, ভাবার কারণ নেই। এই নিয়ে কয়েকটা রিপোর্ট তো খবরের কাগজেও ছাপা হয়েছে।

কাকটার কয়েকটা রেডিয়েশন ফোটোগ্রাফ তুলল সুদীপ। প্রমাণ। তারপর স্যাম্পল ব্যাগে ভরে নিল কিছুটা মাটি। হোভারক্র্যাফট নিয়ে অনুসন্ধানে বেরলে হয়তো অ্যাটমিক রকেট নিক্ষেপের লঞ্চিং প্যাডটার হদিশ মিলতে পারত। কারণ যতই সেদিকে এগনো যাবে, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়বে আর গাইগারের কাঁটা টিকটিক শব্দ তুলে হেলতে থাকবে।

দু-হাতে হোভারক্র্যাফটের মাথায় কচ্ছপের খোলের মতো স্বচ্ছ ফাইবার গ্লাসের ঢাকনি তুলে মুখ ঢুকিয়ে ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকাল সুদীপ। না, সম্ভব নয়। এক সপ্তাহ ধরে টানা চার্জে রাখার পরেও ব্যাটারির মতিগতি ভালো ঠেকছে না। কিছুটা রাস্তা ডিজেল ইঞ্জিনের ওপর ভরসা করতেই হবে। তারপরে সোলার ইঞ্জিনে সুইচ ওভার। চার ঘণ্টার মতো পথ চলার ডিজেল সংগ্রহ করতেই প্রায় ফতুর হয়ে গেছে। সত্যি বলতে, এই জন্যেই মিনি ট্রাকের পিঠে তুলে এত দূর বয়ে আনতে হয়েছে হোভারক্র্যাফ্টটাকে। না হলে জোকা থেকেই সে সোজা হোভারক্র্যাফটে চড়ে পাড়ি দিতে পারত।

কাকটা বিরক্তিকরভাবে ভাঙা গলায় এখনও ডাকাডাকি করছে। সুদীপ পুরো বিস্কুটের প্যাকেটটাই উপুড় করে দিল।

এখন মনে হচ্ছে, ট্রাকের চাকা-টাকা খোলাখুলি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। এই বিপজ্জনক জনশূন্য এলাকায় কোনও গাড়ি আসারই সম্ভাবনা নেই, তো তা আর চুরি করবে কে?

হোভারক্র্যাফটের ডানদিকের গায়ে লাগানো আংটায় পা রেখে হুড তুলে ড্রাইভারের সিটে এসে বসল সুদীপ। সেলফ স্টার্টারে হাত দেওয়ার আগে চেক করে নিল স্লিপিং ব্যাগ, হ্যাঁভারস্যাক আর জলের ক্যান্টিন। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে নড়েচড়ে বসল। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধে হয়ে যাবে।

ডিজেল ইঞ্জিনটা গরগর করছে। আশা আছে, ঘণ্টাখানেক চললেই ব্যাটারি চার্জ হয়ে যাবে। হোক বা না হোক, সে দেখা যাবে। শুধু ব্রেকডাউনের ভয়েই মাঝপথ থেকে ফিরে যাওয়ার পাত্র নয় সুদীপ।

ডিমের আকারের টু-সিটার হোভারক্র্যাফটের তলার অংশে চারদিক ঘিরে রয়েছে একটা সিন্থেটিক ঘাগরা। হাওয়া জমে সেটা ফুলে উঠছে, আস্তে আস্তে ভেসে উঠছে হোভারক্র্যাফ্ট। মাটি থেকে ছ-ইঞ্চি ক্লিয়ার হওয়ার পর ক্রুজিং প্রপেলার চালু হল। ড্রাইভার কেবিনের পেছনে উলটোদিকে মুখ করে গোল ফ্রেমের মধ্যে ঘুরছে ব্রেডগুলো। এগতে শুরু করেছে। কন্ট্রোল লিভার বাঁ-দিকে ঠেলে মুখ ফেরাল সুদীপ।

একা হোভারক্র্যাফট চালাবার সুযোগের জন্য দু-বছর ধরে সে অপেক্ষা করছে। লাইসেন্স লাভের পরীক্ষার দিন মাত্র মিনিট পনেরোর কথা বাদ দিলে সবসময়েই ট্রেনার থাকত পাশে। তা ছাড়া শহরের ধারেকাছে তেমন জায়গাই বা কোথায়? একমাত্র গঙ্গা পার হওয়া। সে তো কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

স্পিডোমিটারের কাঁটার দিকে নজর রেখে ফুল থ্রটল দিল। প্রপেলারের গতি আর বাড়বে না। কিন্তু ঘণ্টাপিছু তিরিশ কিলোমিটারও এগচ্ছে না সুদীপ। বাবাকে জানাতে হবে, ভাড়া নেওয়ার সময়ে গ্যারেজের মালিক কনফিডেন্টাল গুল দিয়েছিল, হেসে-খেলে চল্লিশে চালাতে পারবেন। বেটা জানত, শহরের মধ্যে তো আর সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট করে দেখতে পারবে না।

বাবা বারণ করে দিয়েছিলেন বেশি গাছপালার মধ্যে যেন কেরামতি করার চেষ্টা না করে। কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যে গাছ দূরের কথা, বড়সড় ঝোঁপঝাড়েরও দেখা মেলেনি। সত্যি বলতে একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে এবার। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে সেকালের ন্যাশনাল হাইওয়ের অংশবিশেষ একেবারে লোপাট। কিন্তু মোটের ওপর রাস্তাটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে অসুবিধে হচ্ছে না।

ডানদিকে মুখ ফেরালেও পশ্চিমের সূর্যটার আর চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ঘড়ির দিকে তাকানোর কোনও কারণ নেই জেনেও মাঝে মাঝে চোখ পড়ছে আর উত্তরটা মুখস্থ হয়ে গেছে, তবু হিসেব করছে, পৌঁছাতে ক-টা বাজবে।

কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ঘরবাড়ি, খেতখামারের চিহ্ন নেই, মানুষজন দূরের কথা। একটা পাখির ডাক অবধি কানে আসেনি। সুদীপের সন্দেহ হল, তেজস্ক্রিয়তার উৎসের দিকে এগচ্ছে না তো? চারধারে এরকম পতিত জমি কেন? মরুভূমির মতো বালি ছড়ানো নেই, পাথুরে জমিও তো নয়। প্রথম থেকেই রেডিয়েশনের মাত্রাটা মাপতে মাপতে এগনো উচিত ছিল।

গাইগার যন্ত্র অবশ্য আশ্বস্ত করল। বিপদের মুখে পড়ার ভয় নেই। কিন্তু তবু থামতে হল সুদীপকে। ন্যাশনাল হাইওয়ের ধ্বংসাবশেষও আর ঠাহর করা দুষ্কর। একটা ছোট্ট নদীর এপার অবধি যেটার স্পষ্ট নিদর্শন, ওপার থেকে সেটা বিলকুল বেপাত্তা।

হোভারক্র্যাফট দাঁড় করিয়ে নেমে এল। বড় ম্যাপটা যদি সাহায্য করতে পারে। যদি এই নদীটাকে খুঁজে বার করা যায় তো… নাঃ। ম্যাপটা ভাঁজ করতে করতেই নদীর উজানে বেশ কিছুটা দূরে কী যেন একটা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

সুদীপ মহা উৎসাহে হাত নাড়তে নাড়তে চিৎকার জুড়ে দিল। একটা নয়, দু-দুটো লোক। খালি গা, হাঁটু-জলে দাঁড়িয়ে কী করছে ওরা?

লোক দুটো চমকে গেছে। জল ছেড়ে তীরে উঠেই দৌড় লাগিয়েছে। পালাতে চায়। সুদীপও ছুটতে শুরু করে। শোন, শোন!

পরনে নেংটির মতো একটা করে গামছা ছাড়া আর কিছু নেই। ভূত দেখার মতো দৌড়াচ্ছে কেন? সুদীপের সঙ্গে এঁটে ওঠার আশা নেই জেনেও মরিয়া হয়ে ছুটছে। আর হাঁপাচ্ছে।

হলটা কী? শুধু শুধু ছুটছ কেন? সুদীপ বলে।

শেষ পর্যন্ত একজন হার স্বীকার করে। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে ওর দু-হাত চেপে অনুনয় জানায়, ধরিয়ে দিয়ো না বাবু। ধরিয়ে দিয়ো না। কোনও উপায় থাকলে আসতুম না বাবু…

দ্বিতীয়জন এখনও ছুটছে দেখে সুদীপ বলল, ওকে দাঁড়াতে বল না।

প্রাণের ভয় বাবু, বললেও কি শুনবে?

মহা মুশকিল, খালি ভয় ভয় করছ, ভয়টা কীসের? সেটা বল।

পুলিশ, বাবু, পুলিশ। আর কার। বিশ্বাস কর, খিদের জ্বালায় মাছ ধরতে এসেছি। প্রায় তিন দিন পেটে কিছু পড়েনি। কমপক্ষে পাঁচ ক্রোশ হেঁটেছি আজ।

সুদীপ অনুমান করে, তেজস্ক্রিয় এই অঞ্চলে চলাফেরার ওপর নিশ্চয় নিষেধাজ্ঞা আছে। মাছ ধরা তো নিশ্চয় গর্হিত অপরাধ।

লোকটা এবার কিঞ্চিৎ সাহস পেয়েছে। জানতে চাইল, দেখে তো পুলিশের লোক মনে হচ্ছে না। তা বাবুর কোথায় যাওয়া হবে? এই মড়ার দেশে…

সমুদ্রের ধারে একটা শহরে। খুব দূর নয় এখান থেকে।

 শহরে?

 মানে এককালে শহর ছিল। শুনেছি, ছুটির দিনে বহু লোক বেড়াতে আসত।

 লোকটা এবার রীতিমতো অভিভাবকের সুরে আপত্তি জানায়, না, না। ওসব জায়গায় যেতে নেই। কেউ যায় না। এক কুড়ি বছরে কেউ পা দেয়নি।

কে পা দিয়েছে বা দেয়নি, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না।

তা বলে সন্ধের মুখে যাবে? পৌঁছাতে ক-টা বাজবে খেয়াল আছে? জায়গা কোথায় থাকার?

বিরক্ত হয়ে পেছন ফেরে সুদীপ।

শোন বাবু, সত্যিই যেতে হয় তো সকালে যেয়ো না-হয়। আমরা পথও দেখিয়ে দেব।

তার দরকার নেই। পথ চেনার অসুবিধা হবে না।

লোকটা সুদীপের হাত চেপে ধরল পেছন থেকে, ঠিক আছে, যাবেই যদি, আমাদেরও সঙ্গে নাও। একা যাওয়ার চেয়ে…

সুদীপ হেসে ফেলল এবার। ঘাড় নেড়ে বলল, তার তো উপায় নেই। গাড়িতে জায়গা হবে না।

লোকটার মুখে হতাশ ভাব দেখে সুদীপ বলল, কিন্তু হঠাৎ তুমি যেতে চাইছ কেন?

লোকটা যেন ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জা পেয়েছে। মুখ নিচু করে বলল, ভাবলুম বাবুর সঙ্গে যাব, দুটো খাওয়া কি আর জুটবে না!

লোকটাকে হোভারক্র্যাফটের কাছে ডেকে আনল সুদীপ। একটা টিন-ফুড বার করে এনে বলল, একজনের দু-দিনের মতো খাওয়া চলে যায়। অল্প খেলেই পেট ভরে। একসঙ্গে বেশি খেয়ো না যেন।

একটা টিন-কাটারও দিল ওকে সুদীপ।

এবার অটোপাইলট নির্ভর করে এগতে হবে। গন্তব্যের ল্যাটিচুড-লঙ্গিচুড আগে থেকেই ফিড করা আছে নির্দেশক যন্ত্রের ইলেকট্রনিক স্মৃতিতে। সুদীপের কাজ হবে অটোপাইলটের ডায়ালের কাঁটাটার ওপর নজর রাখা আর গাড়িটাকে এমন দিক বরাবর চালানো, যাতে লাল ভি-দাগটা ছেড়ে কাঁটাটা এপাশ-ওপাশ সরে না যায়। দিক ভুল হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই, তবে মুশকিল হচ্ছে, আস্তে আস্তে এগতে হবে। সময় লাগবে আরও বেশি। সাধারণত এভাবে গাড়ি চালাবার সময়ে চালককে সাহায্য করার জন্য একজন নেভিগেটরও থাকে।

হোভারক্র্যাফটের ইঞ্জিন চালু হলে মুখ ফিরিয়ে দেখল, লোকটা খাবারের টিনটা দু-হাতে বুকের সঙ্গে চেপে একই জায়গায় মর্মরমূর্তির মতো তখনও দাঁড়িয়ে। কেবিন থেকে কথা বললে শুনতে পাবে না, ইশারায় জানতে চাইল, খাচ্ছ না কেন?

লোকটার উত্তর কানে পৌঁছায়নি, কিন্তু যেদিকে আঙুল দেখাল, বোঝা যাচ্ছে, ওর সঙ্গীর কথা বলছে। ওইদিকেই পালিয়েছে লোকটা। ওকে বাদ দিয়ে একা বোধহয় খেতে চায় না।

অটোপাইলটের ডায়ালে চোখ রাখল সুদীপ।

.

সূর্যাস্তের প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে পৌঁছাল সুদীপ। এতক্ষণের এত উৎকণ্ঠার পর এখন পুরো ব্যাপারটা একটা ঠাট্টার মতো লাগছে। সারাটা রাস্তা, মানে অটোপাইলটে ড্রাইভ শুরু করা অবধি কী টেনশন গেছে। আর অদ্ভুত ব্যাপার, ঠিক সেই সময় থেকেই যেন যেখানে সেখানে কাঁটাঝোঁপগুলোও গজাতে শুরু করেছিল। বেজায় বিরক্তিকর।

থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার ফুল মুন! থ্যাঙ্ক ইউ বাপি! জোরে জোরেই বলল সুদীপ।

জোর করে তিন দিন যাত্রা পিছিয়ে দিয়েছিল সুদীপের বাবা। তখন অবাক হয়েছিল সুদীপ। এরকম সন্দেহও উঁকিঝুঁকি মেরেছিল যে, বাবাও কি শেষে ট্যারট কম্পিউটারের ভাগ্যগণনা আর তিথিতন্ত্রের প্রভাব এড়াতে পারল না?

অন্ধকারে অজানা দেশে পৌঁছাতে হবে ভেবে মিথ্যেই ভয় পেয়েছে। জোছনার আলো অবশ্য সমুদ্রের উপকূলে এই মৃত্যুপুরীর রক্তশূন্যতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অন্ধকারের আশ্রয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার সুযোগ পায়নি একটি কোনও ভাঙা দেওয়াল, পাতা-ঝরা গাছের কঙ্কাল, লন্ডভন্ড পরিত্যক্ত সৈকত-নগরী। শুধু দুরন্ত কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর সামুদ্রিক তুফানের কল্পনা জুড়েও শহরের এই বর্তমান অবস্থার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। এতটা পথ প্রায় সমতলভূমি পেরিয়ে আসার পর মনে হচ্ছে, এখানে বুঝি পৃথিবীর অতল থেকে কোনও রাগী বিস্ফোরণ এলোমেলো ছুঁড়ে দিয়েছে রাশি রাশি বালি আর পাথর। পুরো জায়গাটা ছেয়ে অজস্র উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো টিপি আর পাহাড়।

বার তিনেক ধ্বংসস্তূপের কেন্দ্র ঘিরে টহল দিয়েছে সুদীপ। রিপোর্ট অনুসারে দুটো একতলা বাড়ি অক্ষত থাকার কথা। তারই একটাতে রাত কাটাবে। কিন্তু একটাকেও খুঁজে পেল না সুদীপ। তবে তিনতলা একটা বাড়ি রয়েছে। রিপোর্টটা সে সম্বন্ধে যতই ভয় দেখাক, সারারাত হোভারক্র্যাফটে বসে কাটাতে সে রাজি নয়। এতদিন টিকে আছে আর সুদীপ পা দেওয়ামাত্র হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।

বাড়ির সামনে সবচেয়ে উঁচু বালির ঢিপির ওপর হোভারক্র্যাফট নামাল। স্লিপিং ব্যাগ ও হ্যাঁভারস্যাক হাতে তুলে নিল।

চাঁদের আলোয় হাড় জিরজিরে বাড়িটা তার একতলার সব কটা দরজার পাল্লা অবধি বিসর্জন দিয়ে উদার অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সুদীপের চোখে পড়ল, তিনতলার কয়েকটা জানালা চিকমিক করে জানাতে ভুলছে না, এখানে কয়েকটা কাঁচ এখনও আস্ত।

একতলার মেঝের ওপর বালি জমে দরজার আধখানা প্রায় ঢেকে ফেলেছে। টর্চের আলোয় সিঁড়িটা যা হোক ধরা দিতে দেরি করেনি। কয়েক পা উঠে থমকে দাঁড়াল। সামনের কয়েকটা ধাপের অবস্থা কাহিল। রেলিংটা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া তারের মতো বেঁকে রয়েছে। ওঠার সময়ে বাধা না পড়লেই হল। দরকার হলে দড়ি টাঙিয়ে নামতে অসুবিধা হবে না।

ঘরটা তার দিব্যি পছন্দ হয়েছে। খাট থেকে নাড়িভুড়ি বার-করা গদিটাকে নামিয়ে দিলে ওখানেই শোয়া যায়। টর্চের আলোটা ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ভাঙা ড্রেসিং টেবিলের আয়না।

সুদীপ আয়নার সামনে এসে দেখল, ডানদিকের কিনারায় ছোটবড় কয়েকটা ফোঁটার মতো কী যেন লেগে আছে। হাত দিয়ে ঘষতেই একটা খসে এল, দু-আঙুলের চাপে ময়লা সরে যেতেই সেটা একটা লাল টিপ হয়ে গেল। সুদীপের বোন নিনা এইরকম নানা রঙের টিপ পরতে ভালোবাসে।

এই প্রথম ভয় পেল সে। এই ঘরে একদিন লোকে বাস করত, মনে হতেই তার গা শিরশির করে উঠল।

আর নয়! এ লং ডে অ্যাহেড। সংক্ষিপ্ত ভোজনপর্ব সেরে স্লিপিং ব্যাগে সেঁধিয়ে গেল। স্লিপিং ব্যাগ থেকে মাথা বার করে তাকিয়েই চোখ বুজে ফেলল সুদীপ। ঘুম ভাঙা আর চোখ ধাঁধানোটা ঘটে গেছে একই সঙ্গে। খাটের ওপর থেকেই দেখতে পাচ্ছে, দূরে বিন্দু বিন্দু অসংখ্য সূর্যে পরিণত সমুদ্রটা থিরথির করছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠল। দক্ষিণের বারান্দার দরজাটা ভেঙে বেমক্কা ঝুলে পড়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারলে হত, কিন্তু সেখানে বেরবারই উপায় নেই। জানলার সব কটা কাঁচ আস্ত নেই, কিন্তু গলে বেরতে গিয়ে হাত-পা কাটতে পারে।

সিঁড়িটা বিট্রে করেনি। নির্বিঘ্নে নিচে নেমে এল সুদীপ। একতলায় বালি-ঢাকা মেঝেয় পা দিয়েই মনে হল ভিজে ভিজে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল, বাইরে হোভারক্র্যাফটের চিহ্ন নেই।

একসঙ্গে অনেকগুলো সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে। সামনের ওই উঁচু ঢিপিটার ওপরেই। যে কাল রাত্তিরে ওটা পার্ক করেছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কী হতে পারে?

সুদীপ ঢিপিটার ওপর এসে হাঁপ ছাড়ল। কিন্তু হোভারক্র্যাফ্ট ওখানে গড়িয়ে পড়ল কী করে?

দৌড়ে নেমে গেল। স্রেফ লাকই বলতে হবে! গাড়িটা যদি একেবারে উলটে যেত, একা সুদীপের সাধ্য হত না টেনে সোজা করা। বালির স্তূপের গায়ে কাত হয়ে রয়েছে। সুদীপ দু-হাতে একটা কিনারা ধরে ঝুলে পড়তেই খাড়া হয়ে দাঁড়াল। এখান থেকে চালিয়ে বার করে নিয়ে যেতে অসুবিধা হবে না।

সিটে বসতেই পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল। রাত্তিরে জোয়ারের জল বেড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কতটা জল উঠেছিল? কমপক্ষে ওই বাড়িটার দেড়তলা সমান নিশ্চয়? আর ভাবতে চায় না সুদীপ। এখন বড় প্রশ্ন, গাড়িটা চালু হবে কি না।

ইগনিশন অন করে ফুয়েল গেজের দিকে তাকিয়ে দেখল ট্যাঙ্ক খালি। পুরো ডিজেলটা পড়ে গেল! ব্লান্ডার! গ্রেট ব্লান্ডার! বেজায় ভুল করেছে। এতক্ষণে মনে পড়েছে, কাল যাত্রা শুরু করার সময়ে সেই যে ডিজেল ইঞ্জিন চালিয়েছিল, সোলার ড্রাইভে আর সুইচ-ওভার করেনি। সারাটা পথ তেল পুড়িয়েছে। অথচ উচিত ছিল, ব্যাটারি চার্জ হয়ে গেলেই… পুরানো ব্যাটারিটা যদি এখন বিট্রে করে! রীতিমতো ভয়ে ভয়েই সুইচ দেয়।

যাক। ব্যাটারি ডোবায়নি। আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সুদীপ। ব্যাটারির আয়ু চেক করে নিতে হবে। ড্যাশবোর্ডের নব ঘুরিয়ে দেখল একশো চুয়াত্তর অ্যাম্পিয়ার আওয়ার। তার মানে দিনের আলোয় সোলার সেলগুলো যদি কাজ না-ও করে, তবু ঘণ্টা চারেক চালানো যাবে।

তার মানে আধ ঘণ্টার মধ্যেই ঘোরাঘুরি শেষ করে ফেরার পথ ধরতে হবে। হোভারক্র্যাফট এগিয়ে চলল উপকূলের দিকে। ভাটার টান সমুদ্রকে সরিয়ে দিয়ে সুদীপের পরিক্রমার সুবিধার জন্য মসৃণ ভিজে বালির একটা পাড় বানিয়ে রেখেছে।

আধ ঘণ্টা কেন, মাত্র দশ মিনিট বাদেও সুদীপ যদি ফেরার পথ ধরতে বাধ্য হত, তেমন কিছু মিস করত না। যত দূর চোখ যায় একই দৃশ্যের বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি। বালিয়াড়ি আর সমুদ্রের মধ্যে ভিজে চিকচিকে মসৃণ তটে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে নানা আকারের ও আকৃতির অজস্র মরা মাছের কঙ্কাল। জ্যান্ত মাছ কি ঝিনুক অবধি যেন অঞ্চলটাকে এড়িয়ে চলে। কঙ্কাল দেখে মাছ চেনার বিদ্যে সুদীপের নেই। শুধু কয়েকটা হ্যাঁমার-হেড হাঙর চিনতে পেরেছে। ছবি তুলেছে।

মিনিট পনেরো বাদে একটা জায়গা দৃষ্টি আকর্ষণ করল। পরপর কয়েকটা কাঠের খুঁটি পোঁতা আছে। কাছে গিয়ে মনে হল, বোধহয় বিরাট দাঁড়িপাল্লা গোছের কিছু ছিল। আন্দাজটা ভুল নয়, কারণ তারই আশপাশে স্তূপাকার হয়ে রয়েছে মাছের কঙ্কাল আর বিভিন্ন ভঙ্গিতে মুখ থুবড়ে পিঠ উলটে পড়ে আছে জেলে-ডিঙি। সম্ভবত এখানে ফিশিং হ্যামলেট ছিল। কেনাবেচার আসর বসত।

আবার দু-তিনটে ছবি।

 ফেরার পথে সুদীপের মন আরও খারাপ করে দিল ছোট্ট একটা হালকা বেগনিরঙা ফুল। প্রায় কুড়ি মিনিট ঘোরার পর একমাত্র প্রাণের নিদর্শন তাকে খুশি করেনি। জংলি লতাটা দুঃসাহসিকভাবে দূষিত পরিবেশের সঙ্গে লড়াই চালিয়েছে, কিন্তু তার অবশিষ্ট চারটি পাতার তিনটিই এখন প্রায় হার স্বীকার করতে বসেছে। বিবর্ণ চেহারা। ধুতরোর আকৃতির ছোট্ট ফুলটাও বোধহয় তাই সে কথা টের পেয়েই মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।

ক্যান্টিন বার করে জল ঢালতে গিয়েও ঢালল না। বালিতেই যার চোদ্দোপুরুষের আস্তানা, অভাবটা তার জলের নয় নিশ্চয়।

পথের নানা বিঘ্ন সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে মাত্র ঘণ্টা চারেক দেরি হয়েছে। কিন্তু তারই মধ্যে মা অধৈর্য হয়ে বাবাকে বারবার তাগাদা শুরু করেছিলেন, কেন এখনও ওয়্যারলেসে খবর পাঠাচ্ছে না।

মোড়ের ওপার থেকেই সুদীপ হর্নটা একটানা চেপে রেখেছিল।

বাড়ি ফেরাটা বেশ সগর্জনে ঘোষণা করতে চায়।

বাবা-মা-কে রাস্তায় অপেক্ষা করতে দেখে অবাক হয়নি। কিন্তু হিংসুটে নিনাটা কেন? একটা হ্যাঁচকা ব্রেক আর স্টিয়ারিং-এর পাকা মোচড়, বেশ গ্যাংস্টারের মতো দাঁড় করাল। গাড়িটা। বাবা নিশ্চয় অ্যাপ্রিশিয়েট করবেন। চাকা আর কার্বের মধ্যে পাঁচ মিমি-র বেশি ফাঁক নেই।

ধাঁই করে দরজা বন্ধ করে নেমেই সুদীপের চোখে পড়ল, বাবার পুরানো কোটটার সামনের একটা বোম নেই।

সুদীপ বলল, হোভারক্র্যাফ্টটা ফেরত দিয়ে এলাম। বাবা, ওটা কিন্তু স্লাইটলি ড্যামেজ হয়েছে। বলল, সাতাত্তর ডলার অ্যাডিশনাল বিল হবে। বিশ্বাস কর, আমি…

বাবা ঠোঁট টিপে হেসে সুদীপের হ্যান্ডশেক করলেন। সুদীপ নিশ্চিন্ত হয়। মা এখনও রাগী মুখ করে ভুরু কুঁচকে করেছেন। নিনার গাল টিপে মনে হল ভুল করল। একটি চাঁটি প্রাপ্য। মহা শয়তান। তোর অমন গম্ভীর ভান করার কী হয়েছে?

আধ ঘণ্টা বাদে চায়ের-টেবিলে বসে মা বললেন, তোমরা যা-ই বল, এ স্রেফ গরিবের ঘোড়া রোগ। কোনও দরকার ছিল না অ্যাস্ট্রো স্কুলে ভরতি করার। ওখানে না পড়লে কি আর…

নিনা হেসে বাধা দিল। মায়ের দেখছি দুশ্চিন্তা কমার সঙ্গে রাগ বাড়ার ইনভার্স রিলেশন।

চুপ কর। এই আমি বলে দিচ্ছি, ঝুঁকি নিচ্ছ ভালো কথা, কিন্তু তবু দেখবে, শেষরক্ষা হবে না।

বাবা বললেন, শেষরক্ষা আবার কী? প্রি-টেস্ট তো ধর হয়েই গেল। ঝামেলার মধ্যে বাকি শুধু ফাইনাল কুইজ। তারপরে তো স্কলারশিপের ওপর দিয়েই যাবে।

মা তবু ছাড়তে রাজি নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। সেই যখন ওকে চাঁদেই পাঠালে না…।

পাঠালাম না বলো না। বলো পাঠাবার উপায় ছিল না। দু-হাজার ডলার কোত্থেকে…।

তা বলছি না। চাঁদে না গিয়েও যদি পরীক্ষায় বসার সুযোগ পায়, তবে এইভাবে বিপজ্জনক জায়গায় না গেলে বা কী ক্ষতি ছিল?

ক্ষতি মানে! যেতে তো হতই। ওদের প্রসপেক্টাসে লেখা আছে, ভেকেশনে একটা সত্যিকারের দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে যেতে হবে। তার ওপর রিপোর্ট জমা না দিলে পরীক্ষায় বসতে পারবে না। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, সবাই ধরেই নিয়েছে, অ্যাডভেঞ্চার ট্রিপ বলতেই মহাশূন্যে পাড়ি বোঝায়। আর কিছু না হোক, চাঁদে তো যাবেই। বিশেষ করে অ্যাস্ট্রো–স্কুলের ছাত্র যখন।

এ-ও তো একরকম ঠকানো।

কক্ষনো নয়। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, সুদীপের বন্ধুদের দল বেঁধে স্পেস ট্রাভেল করে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, ওর তার চেয়ে কিছু কম হয়নি।

সুদীপ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, জান বাবা, আমি প্রমাণ নিয়ে এসেছি যে, ওই অঞ্চলে বেআইনিভাবে কিছুদিনের মধ্যে নিউক্লিয়ার রকেট টেস্ট করা হয়েছে।

আচ্ছা! কিন্তু সেটা তোমার রিপোর্টের মধ্যে উল্লেখ না করাই ভালো। ওর অন্য ইমপ্লিকেশন আছে। রাজনৈতিক হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে লাভ নেই। আমি বরং একটা মজার জিনিস দেখাই।

মায়ের দিকে চেয়ে বাবা বললেন, অ্যালবামটা রাখলে কোথায়?

এতক্ষণে মায়ের মুখে হাসি। মা অ্যালবামের পাতা উলটে একটা ছবি বাড়িয়ে দিলেন।

 সুদীপ ও নিনা ঝুঁকে পড়ল।

এ তো তোমাদের ছবি।

 হ্যাঁ, কোথায় তোলা জানিস? দিঘায়। তুই যেখান থেকে ঘুরে এলি।

 সে কী!

নিনার হাত থেকে অ্যালবাম টেনে নিল সুদীপ। মা বললেন, আমাদের বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে। নিজেদের তো ক্যামেরা ছিল না। তোলানো হয়েছিল। এটা হোটেলের সামনে। সমুদ্রের ধারের ছবিটা খুঁজে পেলাম না। কত যে লোক তখন বেড়াতে আসত। জমাট ট্যুরিস্ট-স্পট। ক-বছরের মধ্যে কী যে ঘটে গেল! এখন বেড়ানো বললেই স্পেসে ছোট!

সুদীপ চেঁচিয়ে উঠল, আমি তো এই বাড়িটাতেই কাল রাত্তিরে ছিলাম। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই দেখ, ছবিতে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে–টুরিস্ট লজ। যে ঘরটায় কাল শুয়েছিলাম, তার মধ্যে একটা ড্রেসিং টেবিলের কোণে ইংরিজি হরফে লেখা ছিল টি.এল.। এই সেই তিনতলা বাড়ি।

সুদীপের মুখ থেকে দু-দিনের পুরো বিবরণ শোনার পর বাবা বললেন, তোমার যা অভিজ্ঞতা, তাতে দেখছি তিন হাজার কেন, পাঁচ হাজার শব্দের রিপোর্ট লিখতে বললেও অসুবিধে হত না।

সুদীপ বলল, রিপোর্টের শেষ প্যারাগ্রাফটা কী হবে তা-ও ভেবে ফেলেছি। ব্যাপারটা খুব মজার। ফেরার পথে খড়াপুরের কাছাকাছি তখন, হঠাৎ দেখি সামনে একটা গাড়ি, ইন ফ্যাক্ট, এই প্রথম গাড়ি দেখলাম। কীরকম পাগলের মতো লাগল। ওভারটেক করেই ব্রেক মেরে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পেছনের গাড়ির ড্রাইভার অবাক হয়ে দরজা খুলে নেমেছে, কিন্তু কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই জোরসে বার তিনেক হ্যান্ডশেক করে আর গুড আফটারনুন বলে আমি গাড়িতে ফিরে এলাম, আর কোনও কথা নেই। নিশ্চয় ভাবল, আস্ত পাগল। ও তো আর জানে না, চোদ্দো ঘণ্টা বাদে একটা মানুষের মুখ দেখার পর কীরকম হয়।

বাবা বললেন, বুঝতে পারছ, অ্যাস্ট্রনটদের যখন মাসের পর মাস একা অরবিটাল স্টেশনে বা…

ঠিক সেই কথাটাই তো লিখব ভেবেছি–এ স্মল টাচ অব থিংস টু কাম।

যাক, এসব থাক্‌ এখন। প্রি-টেস্টে অ্যালাও হওয়া নিয়ে তো আর সমস্যা নেই। কিন্তু সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। তুমি জান, তোমার সব বন্ধুই ফাইনাল টেস্টের মুন-কুইজে বসার সঙ্গে চাঁদে পাড়ি দেবে। হয়তো অনেকে কয়েকবার ঘুরেও এসেছে এরই মধ্যে। তুমি কিন্তু সে সুযোগ পাবে না।

ওহ্ সে তো আমি জানি। গত পাঁচ বছরের লুনার এক্সপিডিশনের সমস্ত রিপোর্ট আর ম্যাপ তো তুমি জোগাড় করেই দিয়েছ। চাঁদের তিনটে আর্টিফিশিয়াল কলোনির যে কোনওটাতে আমি এই কলকাতার চেয়েও সহজে চলাফেরা করতে পারি। ছবির মতো দেখতে পাই চোখের সামনে।

সুদীপ কনফিডেন্ট। টেস্টে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। তবে এটাও ঠিক যে, একবারও স্পেসে ট্রাভেল না করে সত্যিই যদি সে সফল হয়, সেটা অ্যাস্ট্রো–স্কুলের ইতিহাসে প্রথম।

.

মুন-কুইজ টেস্টে শুধু উতরে গেল না সুদীপ, সারা বছরের পারফর্মেন্সের বিচারে প্রথম স্থান পেয়েছে। স্কুলের অ্যাস্ট্রনট-টিচাররা কিন্তু আজও জানেন না, সে পৃথিবীর বাইরে কখনও পা দেয়নি।

স্কুলের অরগানাইজড ট্রিপেই সবাই রকেট পাড়ি দেয়, তা নয়। প্রাইভেট সার্ভিসের সাহায্য নিতেও বাধা নেই। সেই জন্যেই ধরার উপায় ছিল না।

রেওয়াজমতো যথাসময়ে সুদীপের কাছেও টিভি সেন্টার থেকে আমন্ত্রণ এল। অ্যাস্ট্রো স্কুলের এ বছরের সেরা ছাত্রের ইন্টারভিউ প্রচারিত হবে। পনেরো মিনিটের লাইভ প্রোগ্রাম।

স্কুলজীবন সম্বন্ধে দু-চার কথার পরেই প্রশ্নকর্তা চাঁদ নিয়ে পড়লেন। এ-ও যেন আর এক কুইজ, তবে এখানে প্রশ্নকর্তাই বেশি ব্যস্ত নিজের জ্ঞান জাহির করতে। সেই নিষিদ্ধ প্রশ্নটা কিন্তু এবার উঠল শেষ পর্যন্ত, চাঁদে তো গেছই, স্পেসে আর কোথায় গেছ?

সুদীপ বলল, কোথাও যাইনি।

কোথাও যাওনি। দ্যাটস গ্রেট!

কিন্তু এখানেই থামলেন না প্রশ্নকর্তা: চাঁদে ক-বার গেছ?

একবারও না।

বলছি, চাঁদে ক-বার গেছ?

বলছি তো…।

 টিভি সেটটা হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল। সুদীপের বাকি কথাগুলো শোনা গেল না। তারপরেই স্ক্রিনে হিজিবিজি রেখার দৌড়াদৌড়ি।

মা ছুটে গেলেন, ঠিক সময়েই সেটটা বিগড়াল। আশ্চর্য!

 বাবা বললেন, উঁহু, টিউনিং-এর ব্যাপার নয়। চলে এসো। সেট ঠিকই আছে। গন্ডগোলটা টিভি স্টেশনেই।

তা-ই নাকি!

হ্যাঁ। তুমি বুঝতে পারছ না? সিম্পল সেন্সর থেকে আটকে দিয়েছে। ওরা চায় না, স্পেস ট্রাভেল না করেও একজন অ্যাস্ট্রনটের ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে–এরকম উদাহরণ প্রচারিত হোক।

এবার টিভি স্ক্রিনে পরিচিত ঘোষকের ফরসা মসৃণ মুখটা ভেসে উঠেছে: টেলিকাস্টের যান্ত্রিক গোলযোগের দরুন এই আকর্ষণীয় ইন্টারভিউয়ের বাকি অংশ প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। সরি ফর দ্য ইন্টারাপশন!

[প্রথম প্রকাশ: আনন্দমেলা, ২ মার্চ ১৯৮৮]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *