পরমমানবিক যুদ্ধে ঝন্টুমামা

পরমমানবিক যুদ্ধে ঝন্টুমামা

একটা হাত তুলে আধখানা নমস্কার। কুর্নিশ নয়, স্যালুটও নয়, শুধু বাঁ হাত তুলে নমস্কার জানিয়েছে ঝন্টুমামাকে।

তারপর থেকেই আমরা ঝন্টুমামার আশ্রিত। মানে ঝন্টুমামা চক্রবেড়িয়া স্ট্রিটের নিজের বাড়ি ও গবেষণাগার ছেড়ে আমাদের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছেন। সত্যি বলতে ঝন্টুমামাকে কাছে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ওঁর মতো হাই ভোল্টের মাথা খুব কম লোকেরই আছে। এই অতুলনীয় মাথাটাকে আমাদের ধার দেবার জন্যেই উনি মাঝে মাঝে এখানে চলে আসেন। চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে বসে থাকেন তিনি আর আমরা অনর্গল শুনিয়ে যাই বিজ্ঞান ও কারিগরি জগতের খবরাখবর। স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানের পাঠ নেননি তিনি। আমরা দু-চারটে ডিগ্রির লেজ জুড়েছি বটে, কিন্তু মগজগুলো একেবারেই মজে গেছে। আমাদের বিদ্যা এখন ঝন্টুমামার মাথার মতো একটি গভীর সরোবরকে পেয়েছে বলেই যেটুকু নড়েচড়ে খেলা করে। এই তো মাসকয়েক আগে একদিন কথা প্রসঙ্গে তাঁকে স্প্রিং-এর K, অর্থাৎ স্টিফনেস ফ্যাক্টরের হিসেব বাতলে দিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি, স্প্রিং-এর K-ছাত্ব জানতে পেরেই তিনি ভারোমিটার নামে এমন একটা কলের নকশা বানিয়ে ফেলবেন যে, রিকশাওয়ালারা তাঁকে ধন্য ধন্য করবে। এইখানেই ঝন্টুমামার সঙ্গে আমাদের তফাত। সাধে কি উনি আমাদের মাঝে মাঝে আদর করে কণিষ্ক বলে ডাকেন (প্রত্নতাত্ত্বিকরা কণিষ্কের যে অপূর্ব মূর্তিটি উদ্ধার করেছেন, তার মধ্যে খুঁত বলতে অতি সামান্য-মূর্তির মাথাটা নেই, এই যা)।

কিন্তু পরশু দিন ওই আধখানা নমস্কারের কথা বলেই ঝন্টুমামা মুখ বুজেছেন। আগের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি এ অবস্থায় প্রশ্নরা পাওয়ারলেস। আমরা তাই ডিউটি পালন করছি। পদার্থ ও রসায়নবিদ্যা আর বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে এলোমেলো আওড়ে যাচ্ছি, কিন্তু ক্লিক করছে না কিছুতেই। ঝন্টুমামার মাথায় এখনও কোনও আইডিয়া সরবরাহ করতে পারিনি। আমরা অন্ধ বলেই অবশ্য অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়তে দ্বিধা করি না।

নিলয় বলল, বেলা তো হয়েছে, একটু খেয়ে নিলে হত না?

ঝন্টুমামা চোখ না খুলেই বললেন, না না, সামান্য একটু প্রোটিন ছাড়া অযথা এখন পেট ভারী করার কোনও মানে হয় না।

প্রোটিন, প্রোটিনই তো। চিকেন স্যান্ডউইচ।

 ঝন্টুমামার দোষ নেই। জাতে কুলীন হলে প্রোটিনদের হদিশ পাওয়ার জন্যে চোখ পাকিয়ে তাকাতে হয় না। সেদিক থেকে চিকেন স্যান্ডউইচ একটা ব্যতিক্রম।

চার টুকরো স্যান্ডউইচ খাবার জন্যে ঝন্টুমামা যা সময় নিলেন, তাতে সাধারণ মানুষ হলে তাকে রীতিমতো ক্ষুধার্ত মনে করতাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঝন্টুমামা আমাদের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, কখনও জোর করে খাবে না, বুঝলে? শরীরের যতটুকু প্রয়োজন, তার বেশি নয়।

তা বলে আপনার মতো গপগপ করে… বেফাঁস বেরিয়ে গিয়েছিল কথাটা।

তোমরা গপগপ বলতে কী বোঝ জানি না। কিন্তু আমার থিয়োরি অনুসারে খাদ্য সংগ্রহের কাজটিই শুধু চ্যালেঞ্জিং, গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ভক্ষণ, সে তো নেহাতই জান্তব প্রক্রিয়া। তার জন্যে আমি সময় নষ্ট করতে চাই না।

ঝন্টুমামা পকেট থেকে সিগারেট মিক্সচারের মোড়ক আর কাগজ বার করছেন দেখে তাড়াতাড়ি চারমিনারের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরলাম। সবে উনি মুখ খুলেছেন, মানে একটা কঠিন পদার্থ তরলে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে মামুলি সিগারেট পাকানোর কাজে সময় নষ্ট করলে পুরো প্রক্রিয়াটাই আবার উলটো দিকে মোড় নিতে পারে।

তোমাদের ওই সিগারেটে আমার জুত হয় না। চারমিনারটা ধরিয়ে ঝন্টুমামা বললেন। খইনির মতো তামাক ডলা, কাগজে পাকানন, তারপর জিবের ডগায় চুঁইয়ে কাগজের ধারটাকে চিটিয়ে নেওয়া–মৌজই আলাদা। কিন্তু চারমিনার কোম্পানি লকআউট না-হওয়া অবধি আমার পকেটে সিগারেটের প্যাকেট থাকবেই, আর ঝন্টুমামাকেও কষ্ট করে ভালোবাসার দান…।

কিন্তু ঝন্টুমামাকে আধখানা নমস্কারের প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে সাইকেল বা মোটর সাইকেলেরই বেশি মিল। প্যাডেল উলটো দিকে ঘোরালেও সাইকেল পিছায় না। আর মোটর সাইকেলে তো ব্যাক গিয়ারেরই বালাই নেই। এই ডিজাইন ডিফেক্টের জন্যেই আলোচনাটা নিলয়ের সঙ্গে শুরু করলাম। অনেকটা জায়গা পেলে যদি ঘুরে ঘুরে ফিরে আসেন…

তুই যা-ই বলিস নিলয়, কোনও জিনিসেরই আধখানা ভালো নয়।

ভালো নয়! বলছিস কী? বল–সাংঘাতিক! নিলয় যেন শিউরে উঠেছে। ধর, ধর–কেউ তোকে সিনেমা দেখাবে বলে আধখানা টিকিট দিল। অ্যাঁ? কিংবা বিয়েবাড়িতে কনে দেখে বেরিয়ে এসে দেখলি, তোর আধখানা চটি শুধু পড়ে রয়েছে।

আড়চোখে দেখলাম, চারমিনারের স্বাদ ও গন্ধের মান নিম্নমুখী কি না বোঝার জন্যে ঝন্টুমামা এখনও চেষ্টা করছেন। কাজেই নিলয়ের সঙ্গে মতে মিলতে পারলাম না। টিকিট ও চটি ছেড়ে গালের ওপরে চলে আসতে হল।

আধখানা মুখের দাড়ি কামানোটাই কি কম অপমানজনক? কিংবা ক্ষুর টেনে শুধু আধখানা মাথার শাঁস বার করে দেওয়া? ভাবা যায় না! না, ঝন্টুমামা-আধখানা নমস্কারকে আপনি যতটা লাইটলি নিয়েছেন…

প্যারাবোলা!-ঝন্টুমামা দু-আঙুলের ঝটকায় সিগারেটের শেষ অংশটুকুকে বারান্দার রেলিং পার করে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তারপর ইজিচেয়ারে ঠেস দিয়ে বললেন, তোমাদের উপমাগুলো শুনেই বোঝা যায়, সাহিত্যও পড়নি, বিজ্ঞানও বোঝ না।

ঝন্টুমামার আক্রমণ আমাদের দিশেহারা করে না। উলটে ঝড়ের পর দু-চার ফোঁটা বৃষ্টির আশা থাকে। নিলয় আমতা আমতা করে, ঠিকই বলেছেন। আমারও কেমন মনে হচ্ছিল, কোনওটাই খোলতাই হচ্ছে না। আসলে আধখানা নমস্কারের ইতিহাসটা না জেনেই…

আধখানা নমস্কারের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে শুধু আধখানা মইয়ের। হ্যাঁ মই– ভারতীয় মই!

মই! আধখানা নমস্কার ইকুয়াল টু আধখানা মই?

 ইকুয়াল টু নয়, ইকুইভ্যালেন্ট টু। কাউকে মাথায় তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষে আধখানা মই তুলে ধরার মানে বোঝ? ভারতীয় মই বাঁশের তৈরি, তাই তার আধখানা মানে একটি বাঁশ। একটি লম্বা তেল বাঁশ। কাজেই সেটা তুলে ধরা কার্যত

ঝন্টুমামার কথাটা নিলয়ের মুখেই শেষ হল, বাগিয়ে ধরা বা খুঁচিয়ে দেওয়া।

আদিদাস তো শুধু গার্গল করা আর জষ্ঠি মাসে কম্ফোর্টার জড়াতে দেখেই ফায়ার। কিন্তু আমার কাছে ওই আধখানা নমস্কারের একটা জুতসই আধখানা উত্তর দেওয়াটাই এখন…

আচ্ছা ঝন্টুমামা, এমনও তো হতে পারে যে লোকটার ডান হাতটা, মানে ইনসাল্টিং হাতটা, সেটা হয়তো অকেজো? মানে প্যারালিসিসটিসিস নিলয়ের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধির ঢেউ খেলেছে। না হলে, আমি তো ভাবতেই পারি না যে আপনাকে কেউ…

হোমো স্যাপিয়েন্স কুলেই আইনস্টাইনের জন্ম, আবার হিটলার-আইখম্যানও তা-ই। সেটাও তো অকল্পনীয়। তা-ই না?

ঝন্টুমামা যা-ই বলুন, এখন আমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঠে নামার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। বললাম, আচ্ছা ঝন্টুমামা, থিয়োরেটিক্যালি এই আধখানা নমস্কারের সাচ্চা জবাব কী হতে পারে?

দুটো পথ আছে। একটা দৈহিক–আদিদাসকে বললেই হত। আধপাটি দাঁত ফেলে দেওয়া। কিন্তু তোমরা তো জান, আমি বিজ্ঞানকে ভালোবাসি। ব্রেক সিলিন্ডারের আধখানা খালি করে গাড়িতে চড়িয়ে ছেড়ে দিতাম। আমাদের মুখের অবস্থা দেখে আরেকটু বুঝিয়ে বলতে হল, ব্রেক সিলিন্ডারের তেল পুরো বেরিয়ে গেলে তো ফেল। ডেথ। কিন্তু অর্ধেক বেরিয়ে গেলে–অ্যাক্সিডেন্ট। জখম। আধমরা।

ঝন্টুমামার বৈজ্ঞানিক প্রতিশোধের ভয়াবহ পরিণাম চিন্তা করে চমকে ওঠার আগেই জানতে পারলাম, ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। তাত্ত্বিক উপমা দিলাম। তবে হ্যাঁ, সত্যিকার শাস্তি যা দেব, এর চেয়েও বেশি জখম করবে। গুঁড়িয়ে দেবে। ঠুনকো কাচের মতো চুরচুর।

কী গুঁড়িয়ে দেবেন ঝন্টুমামা?

গর্ব। গর্ব। দেমাক।

আধা নমস্কারের বিভীষিকা মর্মে মর্মে টের পেয়েছি, কিন্তু তার ইতিহাস বা ভূগোল এখনও অজানা। একটিমাত্র ক্ল পাওয়া গেছে–আদিদাস। আদিদাসের কাছ থেকে নিশ্চয় কিছুটা জানা যাবে।

বছরকয়েকের মধ্যে চম্পককুমারকে যারা দেখেনি, চমকে যাবে। মানুষের এমন পরিবর্তনও ঘটে! ভবানীপুরশী, ব্যায়ামবীর, বছরকয়েক আগের ডাকসাইটে মস্তান সেই চম্পককুমারকে ঝন্টুমামা এখন আদিদাস বলে ডাকেন। এবং সেই ডাকে সে গলে গিয়ে সাড়া দেয়। ঝন্টুমামার কাছে কাজ শেখার জন্যে দিনরাত ঘুরঘুর করে। আমরা বোতলপর্বের কাহিনিটা জানি তাই, না হলে এই রহস্যের বই মেলা ভার হত। সামান্য একটা ছিপি–একটা স্বচ্ছ কাচের বোতলের মুখে ঘষা-কাচের ছিপি–সেইটাকে টেনে ফাঁক করতে পারেনি এ যুগের ঘটোৎকচ। তারপর থেকেই চম্পককুমার ওরফে আদিদাস নাড়া বেঁধেছে ঝন্টুমামার কাছে; তবে শুনেছি, সে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক কর্মে ঝন্টুমামাকে সাহায্য করতে শুরু করেনি, এখনও তার এম সংশোধন-এর পর্ব চলছে। প্রচলিত শব্দের ওপর সবসময় ভরসা রাখতে পারেন না ঝন্টুমামা। এম সংশোধন তাঁর সৃষ্টি করা শব্দের মধ্যে অন্যতম। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাউস অভিধান হাতের কাছে থাকলেই কি বানানের ভুল ঠেকানো যায়? ভুলটাকে ভুল বলে চিনতে পারলে তবে তো শুধরে নেবার প্রশ্ন। এম সংশোধন তাই ভ্রম সংশোধনের নিষ্ফল অথচ খাঁটি সদিচ্ছা।

মানুষে মানুষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ইতিহাসে কোনওদিন এত অগণিত মানুষ কখনও এত মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কাছে এতখানি ঋণী হয়নি। ঝন্টুমামার বজ্রকণ্ঠ ঘোষণা চমকে দিল। সব শ্রান্তি-ক্লান্তি-ভাবনা ছুঁড়ে ফেলে তিনি পায়চারি করতে করতে আমাদের দিকে মাঝে মাঝে জ্বলন্ত দৃষ্টি হানছেন। সিংহের কেশরের মতো চুলের ঝালরের নিচে তাঁর ডান চোখের আধখানা ঢাকা পড়েছে।

বিশে আগস্ট। হ্যাঁ–বিশে আগস্ট এই কথা যখন বললেন–এত বড় প্রশংসা–তখনও তো সত্যি বলতে নরক গুলজার শুরুই হয়নি। পরপর–একের পর এক সাতান্নটা রাত ধরে আকাশ ছিঁড়ে জাহান্নম থেকে ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে যন্ত্রের পাখি। গড়ে প্রতি রাতে দুশোটা। হাজার হাজার লোহার ডিম ফেলে যাচ্ছে লন্ডনের ওপর। সাতই সেপ্টেম্বর থেকে তেসরা নভেম্বর–একটা রাতের জন্য বম্বিং থামেনি।

কী বলছেন ঝন্টুমামা? লন্ডনের আর তাহলে রইল কী? সব তো ভেঙেচুরে… অথচ এত বড় একটা খবর আমরা কিছুই জানি না? অর্ধেক নমস্কারের জের হিসেবে শেষে লন্ডন ধ্বংস হয়ে গেল….

হবেই তো। এ তো শুধু তথ্য সংগ্রহের ভুল নয়। কমিউনিকেশন খামতি। মানব-চরিত্র সম্বন্ধে অজ্ঞ হলে এই হয়। আরে, অস্ত্র শুধু উন্নততর আর সংখ্যায় বেশি হলেই কি যুদ্ধ জেতা যায়! মূর্খ বলেই ভেবেছিল, তামাম ব্রিটেনের শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে…।

এতক্ষণে দম ফেললাম, যাক, তাহলে বলুন, ক্ষয়ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি। শুধু চিন্তাভাবনার মধ্যেই আছে ব্যাপারটা।

চিন্তাভাবনার মধ্যে মানে? হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তবু শহর ছেড়ে পালাননি। মৃত্যুকে ককপিটে নিজের পাশে বসিয়ে কত বীর পাইলট টহল দিয়েছে ইংলিশ চ্যানেলের ওপর। তবে না প্রত্যাহার করে নিল অপারেশন সি-লায়ন।

সি-লায়নের পরিচয় খুঁজে বার করার ভার আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে ঝন্টুমামার পায়চারি শুরু হতেই নিলয় ছুটল সর্দারজির দোকানে। এমন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় লস্যিই সহায়…

সতেরোই সেপ্টেম্বর বাতিল হয়ে গেল অপারেশন সি-লায়ন। অবশ্য লন্ডনের ওপর বিমানহানা তখনও থামেনি। তা-ও থামল একদিন, না থামিয়ে তো আর উপায় ছিল না।

লস্যির গেলাসটা ঝন্টুমামার হাতে খুঁজে নিলয় বলল, কিন্তু ক্ষতি যা হবার তো

হ্যাঁ, ক্ষতি হয়েছিল। তবে ধ্বংস ও মৃত্যুর কথা স্বীকার করে নিয়েও এ কথা বলতে হবে, ইংল্যান্ডের পাইলটরা ওদের নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছিল। সেই চোট আর কোনওদিন সামলাতে পারেনি লুটভাফে। মানে হিটলারের বিমানবাহিনী।

নিলয়ের মুখের দিকে তাকালাম। ঝন্টুমামা তাহলে এতক্ষণ ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনের ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন! নিলয় ফিসফিস করে জানিয়ে দিল, উপাখ্যানের শুরুতে ঝন্টুমামা যে উদ্ধৃতিটি দিয়েছিলেন সেটা নাকি চার্চিলের। ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ারফোর্সের স্পিটফায়ার আর হারিকেন বিমানদের গৌরবময় অভিযানের কাহিনি ঝন্টুমামার মুখস্থ। লস্যিতে টান দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনি জার্মানদের ফাইটার বিমান টুইন প্রপেলার ME110 আর স্টুকা বহুবারদের দুর্বলতারও হদিশ দিয়ে দিলেন। তুচ্ছ আধখানা নমস্কারকে পেছনে ফেলে কত সাগর, মহাসাগর, মহাদেশ পার হয়ে গেছি।

লস্যি শেষ হল, ঝন্টুমামা শান্ত হলেন। চেয়ারে বসেছেন, চোখ বন্ধ, আঙুলের ফাঁকে চারমিনার জ্বলছে। দক্ষিণের বারান্দায় রোদ্দুরের ঝাঁজ থেকে বাঁচাবার জন্যে আমরা তাঁকে চেয়ার সমেত ফুট চারেক সরিয়ে এনেছি। ঝন্টুমামা যেন আপন মনে কথা বলছেন। আরও কাছে ঘেঁষে আসতে হল।

তাই তো ভাবছি, বিজ্ঞানীরা কী করছিল তখন? ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা? ওই তাজা ফুটফুটে রয়্যাল এয়ারফোর্সের তরুণ নির্ভীক পাইলটদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য কী করেছিল? জার্মানদের গুলির আঘাতে বিমান যখন…

কেন, প্যারাশুট?–নিলয়টা এমন গাড়লের মতো চেঁচিয়ে উঠল, যেন ঝন্টুমামা এই বস্তুটির নাম শোনেননি।

প্যারাশুট! নাঃ, হবে না। এটাকে একটা ট্র্যাজেডিই বলতে পার। প্যারাশুটের মতো উপকারী জিনিসও তাই সবসময় কাজে লাগে না। পৃথিবীর তিন ভাগের দু-ভাগ জুড়ে যে জলেদের রাজত্ব। তা ছাড়া সমুদ্র ঘিরে রেখেছে ইংল্যান্ডকে। আর সেইটাই আমার জিজ্ঞাস্য–এরোপ্লেন থেকে প্যারাশুটে করে ঝাঁপ দিয়ে সমুদ্রে এসে পড়ার পর কিভাবে। প্রাণ বাঁচাত পাইলটরা? কীরকম লাইফবোট ব্যবহার করত? তার গঠন প্রক্রিয়া বা কার্যধারাটা আমার জানা নেই। দেখ যদি ফাঁকিবাজির গাফিলতিতে হঠাৎ কোনও তথ্য আবিষ্কার করতে পার। তাহলে হয়তো আধখানা নমস্কারের উত্তরটা দিতে পারব।

যত দূর জানি, নিলয় ও আমাকে ছাড়া ঝন্টুমামা তৃতীয় কোনও ব্যক্তিকে ফাঁকিবাজিতে গাফিলতি দেবার জন্য কখনও প্রশংসা করেননি। বিরল সম্মান। বুদ্ধি খাঁটিয়ে ভেবেচিন্তে আমরা ঝন্টুমামাকে নতুন আইডিয়া দিতে পারি না। কিন্তু কথা প্রসঙ্গে আমাদেরই সরবরাহ করা তথ্য যে তাঁর কাজে লাগে, সেটা তিনি এইভাবেই স্বীকার করেন।

ওহে, আমার ক্যামেরার ব্যাগটা একটু নিয়ে এসো তো!

হয়ে গেল। সলিলসমাধি। এত আয়োজন সব বৃথা। ক্যামেরা নিয়ে বসা মানেই মৌনী পর্ব। পরিষ্কার টার্কিশ তোয়ালের ওপর এখন লেন্সরা মিষ্টি রোদ আর হাওয়া খাবেন। নিশ্চয় ঝন্টুমামার মনে হয়েছে, আজকে সকালের রোদে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম। সবচেয়ে বিরক্তিকর হচ্ছে, যে বস্তুটির জন্যে এই আলোচনায় ছেদ পড়ল, সেটি প্রায় অচল। আর ক্যামেরা যত অচল হয়, ততই নাকি বেশি মনোযোগ দাবি করে। শাটারের গতি বাড়িয়ে-কমিয়ে ঝন্টুমামা এখন তাদের এক্সারসাইজ করাবেন। এক-একবার বোতাম টিপবেন আর ক্যামেরাটাও গলা পালটে খটখট খুর খুর, নানারকম আওয়াজ ছেড়ে প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে। ঝন্টুমামা বলেন, ছবি তোলার শখ আছে এমন কোনও দুর্বল হৃদয়ের মানুষের কাছে ডাক্তাররা নাকি এই ক্যামেরার নাম উচ্চারণ করতে বারণ করেন। হাসেলব্লাড। হ্যাঁ জানি, এই ক্যামেরা হাতে নিয়েই মানুষ প্রথম চাঁদের পিঠে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিল, কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টিকারী যন্ত্রটিও এখন আমাদের কোনও সান্ত্বনা দিতে পারছে না।

 কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি আর এইভাবে সকাল না পেরতেই ছুটিটার অপঘাতে মৃত্যু? ঘরে ঢুকে নিলয়কে জামা পালটাতে দেখে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল। আরেকটু হলেই ভেগেছিল। চললি কোথায়?

কেন, ন্যাশনাল লাইব্রেরি। ঝন্টুমামা কী বললেন, শুনিসনি? পাইলটদের রেসকিউ করার… নিলয়টা এমন গাঁক-গাঁক করে উঠল যে, নিচের তলার লোকও শুনতে পাবে। কোনও মানে হয়! তুই তো বাবা পৌঁছাতে চাস ওই বারান্দা অবধি।

কিন্তু তোর দৌড় তো পদার্থবিদ্যার বেড়ায় গিয়ে আটকাবে। না বলে আর পারলাম না, রসায়নবিদরা কী করেছিল জানতে হলে আমাকেও… একসঙ্গে বেরলেই হত না?

তাহলে বল ঝন্টুমামাকে। দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা তো…

বারান্দা থেকেই উত্তর দিলেন ঝন্টুমামা, সাড়ে বারোটায় তড়কা-রুটি। যাবার সময় মোড়ের ধাবাতে অর্ডার দিয়ে যেয়ো। পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি হাত চালাও, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে কাজটাই মাটি হবে।

ভাবছি, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এক ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে; আবার তাড়া এল, নাঃ, তোমরা দেখছি, আজ আর আদিদাসের দেখা পাবে না।

আরেকটু হলেই হাত থেকে জলের গেলাসটা খসে পড়ত। আরও ক্রিটিক্যাল অবস্থা নিলয়ের। প্যান্টের মধ্যে জামাটা খুঁজছিল। তার হাতে বেল্টটাকে এখন গোরু চোরের দড়ি মনে হচ্ছে। তার মানে, নিলয়ও যাবার পথে আদিদাসের সঙ্গে দেখা করার মতলব ভেঁজেছিল। আর আমাদের মতো বেতনভুক আধাবিজ্ঞানীদের মাথায় কোনও চক্রান্ত যদি জন্ম নেয়, ঝন্টুমামা তার হদিশ পাবেন না, তা-ও কি হয়?

বেরিয়ে পড়েছি, কিন্তু অজানাকে জানার আনন্দের ওপর গোবর-ন্যাতা লেপে দিয়েছেন ঝন্টুমামা। এখন রোদটাকে বেখাপ্পা চড়া মনে হচ্ছে। কলকাতায় বাস-ট্রামের ভিড়ের সঙ্গে বিছুটিপাতার সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছি। মহাবিশ্বের পার্সপেকটিভে আমাদের অস্তিত্ব যে কতটা অকিঞ্চিত্বর, বুঝতে আর বাকি নেই। তবু দীনবুদ্ধি, হীনশক্তি দুটি মানুষ যাবতীয় দার্শনিক উপলব্ধি ও তামাম জগতের ওপর নিদারুণ ক্ষোভ সত্ত্বেও এমন একটা রুট ধরে এগিয়ে চলেছে যে, আদিদাসের সঙ্গে দেখা না হয়ে যায় না।

নিলয়কে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করল, মন খারাপ করিসনি, বুঝলি! হাজার বাধাবিঘ্ন, উপেক্ষা, গ্লানি তুচ্ছ করেও রহস্যভেদ করার তীব্র বাসনা থেকেই মানুষ মানুষ হয়েছে।

চক্রবেড়িয়া স্ট্রিটে বাড়িটার সামনে এসে পড়েছি। বাড়িটা যে একদিন ২২১ নম্বর বেকার স্ট্রিট বা ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের খ্যাতিকেও বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে ছাড়িয়ে যাবে, সেটা তার নম্বরেই মালুম দিচ্ছে। ৩৭ নম্বর বাড়ি। যে কোনও রাস্তায় নিদেনপক্ষে সাঁইত্রিশটা বাড়ি থাকলে একটার নম্বর সাঁইত্রিশ হতে বাধ্য। কলকাতায় ৩৭ নম্বরধারী বাড়ির সংখ্যাও নিশ্চয় অগুনতি। তা বলে বাড়ির গায়ে এমন একটি ফলক আর কোথাও নেই–

ঝন্টু সেন

(৩২+৭২)– (৩*৭) চক্রবেড়িয়া স্ট্রিট

পেতে হিসেব করলে ৩৭-ই হয়। ৩৭ সংখ্যাটির আরেকটি গুণপনার কথা শুনেছি ঝন্টুমামার কাছে। ৩৭ দিয়ে ৩ আর ৭-এর যোগফলকে গুণ দিলে যা হয়, ৩-এর ঘনর সঙ্গে ৭-এর ঘনকে যোগ দিলেও তা-ই। তিন আর সাতকে নিয়ে এই মন-মাতানো সাঁইত্রিশের টানেই একদিন পৈতৃক ভিটে ছেড়ে ঝন্টুমামা উঠে এসেছিলেন দিদি জামাইবাবুর বাড়ি। মামা খেতাবটা ভাগনে পরেশের ডাকাডাকির সুবাদেই। পরেশের মা বাবা বাড়ির নিচের তলাটা বিজ্ঞানের স্বার্থে ত্যাগ করে এবং নিজেদের খরচায় একটা টেলিফোন বসিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। ডায়ালের ওপর মোটা ফেল্ট পেন দিয়ে লেখা আছে–১০১ এবং ২৪-২২২২। ফায়ার ব্রিগেডের ফোন নাম্বার। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বেশি তেতে উঠলে এটা হয়তো সামান্য কাজে লাগলেও লাগাতে পারে, তাই আপত্তি করেননি ঝন্টুমামা।

বেল টিপলাম। মানে, সত্যিকার পাঁচ আঙুলে পাকড়ে মুঠোয় ভরে টিপুনি দেওয়া। এটা ইলেকট্রিক ঘণ্টির শৌখিন পুঁচকে সুইচ নয়। হাওয়াই ঘণ্টা। ট্যাক্সিতে লাল রবারের বল লাগানো প্যাঁচালো নলওলা যেরকম ভেঁপু দেখা যায়, তারই দীর্ঘতর, বৃহত্তর, উন্নততর সংস্করণ। একই সঙ্গে একতলা ও দোতলাকে সচকিত করে। শুধু লোডশেডিং-এর সময়ে সিস্টেমটাকে চালু রাখার জন্যে এই ব্যবস্থা ভাবলে ভুল হবে। বিপদ-আপদে অজ পাড়াগাঁ থেকেও লোকে আসে ঝন্টুমামার কাছে। ইলেকট্রিক কলিং বেলের চেয়ে এটা তাদের কাছে অনেক বেশি চেনা। তা ছাড়া রাত্তিরে সদর দরজায় ওই একরত্তি সুইচের হদিশ দেওয়ার জন্য আবার কত বাড়িতে আলো জ্বেলে রাখতে হয়। শক্তির অপচয়। হর্নটাকে তাই ফ্লুরোসেন্ট রং মাখিয়ে দিয়েছেন ঝন্টুমামা।

দরজা খুলে একটা দৈত্য এসে দাঁড়াল। পরনের টি-শার্টটার দিকে তাকালেই আদিদাস নামকরণের হেতু বোঝা যায়। বুকপকেটের ওপর লেখা, সাবুর পাঁপড়ের মতো কড়কড়ে ইংরেজি হরফগুলোকে জিবে একটু ভিজিয়ে নরম করে নিলেই হবে।

ঘরে ঢুকে কথাটা পাড়তে গিয়ে ইতস্তত করছিলাম। এটা ঠিক যে, শ্রদ্ধাভক্তির স্কেলে ঝন্টুমামার ঠিক নিচেই আমাদের ও জায়গা দেয়, তবু বলা তো যায় না, যদি ভাবে, লুকিয়ে কোনও কথা জেনে নিতে এসেছি… বীজ ফেলার আগে মাটিতে একটু সার ছড়িয়ে নেওয়া দরকার। সিগারেটের প্যাকেটটা বাগিয়ে ধরে বললাম, নাও, খাও খাও। এখন ঝন্টুমামা আসবে না।

খাই তাহলে! অ্যাঁ?–একগাল হেসে হাত বাড়াল আদিদাস। আর বলবেন না, সেই সকাল থেকে ডেভেলপিং-এর কাজ…

সবে একটা টান দিয়েছে ফোনটা বেজে উঠল।

 হ্যালো?–হ্যালোর রেশ মেলাবার আগেই দেখি, আদিদাস রিসিভার হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। সিগারেটকে বাঁ হাতের তালুর খোপে বন্দি করেও শান্তি হয়নি। হাতসুদ্ধ পেছনে কোমরের দিকে চালান করে অ্যাটেনশন। ঝন্টুমামার কানও যে দেখতে পায়, তার মোক্ষম প্রমাণ।

বার দশেক হ্যাঁ আর আচ্ছা বলে ফোন ছাড়ল আদিদাস। এখন লজ্জিত মুখে ঘাড়ের ওপর হাত বোলাচ্ছে। হবে না, অত ফোর্সে ঘাড় নড়লে খ্যাঁচকা তো লাগবেই।

কী বললেন ঝন্টুমামা?

 আপনারা এসেছেন কি না জানতে চাইছিলেন। বললেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব শুনেটুনে নিতে। না হলে ন্যাশনাল লেব্রেটরি না কোথায় যেন যাওয়ার কথা, সেখানে লেটার হয়ে যাবে।

বিজ্ঞানকর্মী ঝন্টুমামার চেলার হাতে লাইব্রেরি না-হয় লেব্রেটরি হল, কিন্তু লেটারটা কী? ইংরিজিচর্চায় আদিদাসের স্বদেশি উদ্যোগ ধাঁধায় ফেলে দেয় মাঝে মাঝে।

ওই তো, মানে লেট আর কী! বেশি লেট হলে লেটার হবে না!

ভালো ড্রিবলিং জানে নিলয়। হাসিটাকে কাটিয়ে গেছে। কিন্তু চান্স পেলে আবার ওভারটেক করতে পারে।

রিস্ক নেওয়াটা ঠিক নয়। সরাসরি আধখানা নমস্কারের কথা পাড়লাম।

বরের মাথায় টোপর, সভাপতির গলায় গোড়ের মালা আর মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর উৎসবে-অনুষ্ঠানে ঝন্টুমামা। এবারেও অ্যানুয়াল ফাংশনে ঝন্টুমামার স্নেহধন্য আদিদাসকে শিখণ্ডী খাড়া করে পাড়ার ছেলেরা এসেছিল। এগারোজোড়া মোজা ও বুট পায়ে এগারোটা হাফপ্যান্ট ও ঘামে ভেজা জার্সি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ৩৭ নম্বরের ফটকের সামনে। প্র্যাকটিস সেরেই সটান মাঠ থেকে চলে এসেছে। তা এত পরিশ্রম, রোদে পুড়ে, কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে কীসের লোভে পাড়ার ফুটবল টিম জানপ্রাণ কবুল করে তৈরি হচ্ছে? সে তো ওই নেত্যকালী স্মৃতি-চ্যালেঞ্জ ট্রফির জন্যেই। ঝকঝকে বার্নিশ করা পাঁচকোনা কাঠের বরফির ওপর সাঁটা রুপোর পাতে বুটের ডগায় একজন ফুটবল নাচাচ্ছে। ট্রফির উলটো পিঠের ওপর খোদাই করা গত দশ বছরের চ্যাম্পিয়নের নাম। এমন ট্রফি এলেবেলে সভাপতির হাত থেকে গ্রহণ করা যায় না।

সেন্টার হাফ গবলাই তো বলেই বসল, ঝন্টুমামা সভাপতি হলে ম্যাডেক্স সমিতিকে গুনে গুনে দুখানা ঢোকাবেই।

আদিদাসও ওকালতি করার সুযোগ ছাড়েনি, ঝন্টুমামা সভাপতি মানেই গবলাই স্কোর টু নিল। আর নেত্যকালীও উইন।

ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ওদের বক্তব্য শোনার পর ঝন্টুমামা বললেন, বেশ বেশ। ফুটবল খেলা খুব সায়েন্টিফিক। আমি ভালোবাসি। সভাপতি আমি হতে পারি, কিন্তু তার আগে আমার কটা প্রশ্ন আছে। না না, তেমন কিছু নয়। এই–এই ফুটবল নিয়েই। মাত্র চারটে প্রশ্ন, যে কোনও একটার উত্তর দিতে পারলেই হবে! কী বল, প্রশ্ন করব?

সত্যিই ছোট্ট চারটে প্রশ্ন। এক–ফুটবলের ব্যাস কত? দুই-তার ওজন কত? তিন–যে ফালিগুলো জুড়ে ফুটবল তৈরি হয়, সেগুলো পাঁচকোনা না ছ-কোনা? চার–এরকম ক-টা ফালি লাগে একটা ফুটবলে?

বৈজ্ঞানিক প্যাঁচে সভাপতি ধরার জাল কেটে বেরিয়ে গেল ঝন্টুমামা। কিন্তু রেহাই দিল না খেলোয়াড়দের দাদা গ্রুপটা। পাড়ার সিনিয়ররা ঠিক করেছে, অ্যানুয়াল ফাংশনে জলসা নাইট করবে। সন্ধের মুখে না-হয় ক্লাবের সভাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও পৃষ্ঠপোষকদের কাচ্চাবাচ্চারা কিচিরমিচির করে ম্যানেজ করল। কিন্তু তারপর?

কিশোর কি হেমন্তকুমার ধরাছোঁয়ায় বাইরে। এখন উদীয়মান শিল্পী শিখিভূষণই ভরসা। সবাই এসে ধরল ঝন্টুমামাকে। তাঁকে একবার কষ্ট করে শিখিভূষণের সামনে দাঁড়াতে হবে। গুণী মানুষ শিখিভূষণ! দেবব্রত বিশ্বাসের মতো ভারী দরাজ গলায় উদ্দীপনাময় গান গেয়ে আমেরিকাতেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। ভারতের একমাত্র আলোগ্রাফার ঝন্টু সেন ছাড়া আর কে ফেস করবে তাঁকে। দক্ষিণায় কিছু ঘাটতি পড়লেও সে না বলতে পারবে না, কারণ ফোটোগ্রাফার ভারতে গুচ্ছের, কিন্তু আলোগ্রাফার এই একজন। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন খানদানি ম্যাগাজিনও তাঁর তোলা আলো ছাপতে পারলে কৃতার্থ হয়।

ঝন্টুমামা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, শিখিভূষণের গাওয়া একটা গানের বর্ণালি বিশ্লেষণ করে আগে দেখে নিলে হত না? পাড়ার দাদাদের বয়স হয়েছে বোঝা গেল। ফুটবল খেলোয়াড়দের মতো সব কথা তারা শুনতে পায় না।

অগত্যা ঝন্টুমামাকে নিয়ে ক্লাবের সেক্রেটারি আড্ডিদা আর আদিদাস একদিন সকাল ন-টার সময়ে এসে পৌঁছালেন শিখিভূষণের বাড়ি। কলিং বেলের সুরেলা টুংটাঙের সঙ্গে অ্যালসেশিয়ানের বেয়াড়া ধমক শুনেই ঝন্টুমামার ভুরু কুঁচকে গেল, তোমরা বলছ বটে উদীয়মান, কিন্তু ঠিক কতখানি উদয় হয়েছে…।

সন্তর্পণে বারান্দার দরজা খুলে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, বলুন– বোঝা গেল, রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা বলতে হবে।

আড্ডিদা হেসে বললেন, আজ্ঞে আমরা ভবানীপুরের মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর তরফ থেকে আসছি। অ্যানুয়াল ফাংশনের–আচ্ছা, তার আগে এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। শ্রীঝন্টু সেন। নাম শুনেছেন–

ডেটটা কবে?

ঝন্টুমামার তোয়াক্কা করেনি লোকটা। আচ্চিদা আড়চোখে ঝন্টুমামার দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে জানালেন, সতেরো তারিখে। ও মাসে।

দাঁড়ান। ভদ্রলোক বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।

ঝন্টুমামা আড্ডিদার দেওয়া সিগারেট ধরিয়ে বললেন, মধ্যগগনে। উদীয়মান নয়, উদিত!

অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ফিরে এসে পাতা উলটে লোকটা বলল, খালি আছে। বারোটায় শ্রীরামপুরের প্রোগ্রামটার আগে হতে পারে। পুরোটা অ্যাডভান্স করবেন, না… জানেন নিশ্চয়, পাঁচ হাজারের নিচে স্যার প্রোগ্রাম করেন না। তিন হাজারের কমে বায়না হয় না।

এতক্ষণের অশিষ্টতার নায়ক শিখিভূষণ নয় জেনে আডিড়দা যেন আবার আলো দেখলেন, দয়া করে একবার শিখিবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন যদি…

অসম্ভব। তা ছাড়া তাতে রেট কমার কোনও চান্স নেই। টাকাকড়ির ব্যাপারে ওঁর সেক্রেটারি হিসেবে যা বলার…

একটা রিকোয়েস্ট রাখুন ভাই! শুধু বলুন, ঝন্টু সেন দেখা করতে এসেছেন। বলেই দেখুন না।

লোকটা আধো অবিশ্বাস নিয়ে ঝন্টুমামার দিকে তাকাল। তরুণ কৃষ্ণচূড়ার গুঁড়ির মতো যার গায়ের রং, চৌকো ডিম্বাকৃতি (সুপার-ইলিঙ্গ) মুখে করমচা-চোখ, অথচ বেগুন গাছে আঁকশি দেবার মতো উচ্চতা। চুলের ঝরনা, জলদস্যুর মতো জুলফি বিস্তার ও গড়িয়ে নামা গোঁফ–এই তিনটি ধারা মিশেছে গালের ওপর। ঝন্টুমামাকে শেষ পর্যন্ত অবহেলা করতে পারল না।

পায়ে বিদ্যাসাগরি আওয়াজ তুলে শিখিভূষণ এলেন। সিল্কের রামধনু-লুঙ্গি, খালি গায়ে পইতে ঝুলছে ও গলায় কম্ফোর্টার। মুখটা আকাশের দিকে তুলে রেখেছেন। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া আর গরগরানি। প্রায় মিনিটখানেক বাদে গাৰ্গলের জল ফেলে দিয়ে তিনি শ্বাস নিলেন!!

ইস–ফেলে দিন, ফেলে দিন। কী মড়া-পোড়া গন্ধ!–আড্ডিদার সিগারেটের দিকে আঙুল তুলে তিনি ধমকে উঠলেন। ব্যাপারটা কী? যা বলার আমার সেক্রেটারি তো বলেইছে। সাড়ে চারশো টাকা মাইনে দিয়ে রেখেছি ওকে। সবতাতে আপনারা যদি আমাকে টানাটানি করেন… আরে মশাই, একটু বোঝার চেষ্টা করুন। এই যে গার্গল করছিলাম, জানেন, ওই এক শিশি ওষুধের কত দাম? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জ জোগাড় করে আনাতে হয়। তা ছাড়া রেট এমনই একটা জিনিস যা একবার কমালে আর বাড়ে না।

না না, আমাদেরই ভুল হয়েছে। এখন বুঝতে পারছি। আচ্ছা, নমস্কার। আড্ডিদাকে আর কথা বলার সুযোগ দেবার ইচ্ছে ছিল না বলেই ঝন্টুমামা ইতি টানতে চেয়েছিলেন। নমস্কারের উত্তরে শিখিভূষণের বাঁ হাতটা নাক অবধি উঠেছিল। এবং সেই মুহূর্তে তার সর্বনাশের ডঙ্কা বেজে গেছে। ঝন্টুমামা সবার অজান্তে নিঃশব্দে পরমমানবিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কোনও বুল টেরিয়ার, ম্যাস্টিফ বা সেন্ট বার্নার্ড যদি আধখানা নমস্কারের আধখানা জ্বালা টের পেত তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে লোকটাকে।

সেদিনও ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে ফিরে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছিলাম। সাত দিন ধরে এই চলেছে। আমাদের নোটবইয়ের বিশেষ কোনও লাইনের ওপর ঝন্টুমামার চোখ যদি একটু দাঁড়ায়–অমনি ঝুঁকে পড়ব। আমাদের সারাদিনের ঘাড় বেঁকানো খাটুনির ওপর চোখ বোলাতে অবশ্য ঝন্টুমামার পাঁচ মিনিট আঠেরো সেকেন্ড লাগে।

কাল থেকে আর তোমাদের পণ্ডশ্রম করতে হবে না। বাতিল করা নোটবইটা হঠাৎ পকেটে গুঁজে উঠে দাঁড়ালেন ঝন্টুমামা। এ কী কাণ্ড! যতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি যে, তিনি পাশুপত অস্ত্রের হদিশ পেয়ে গেছেন। নোটবইটা তিনি হাতিয়ে না নিলেও অবশ্য তেমন কোনও সুবিধা হত না। হাত ফসকে খড়ের গাদায় ছুঁচ পড়ে গেছে। আমার জিনিস বলে চেঁচালেই কি আর উদ্ধার করা যাবে! তবে বিদায়। নেবার আগে ঝন্টুমামা কথা দিয়ে গেছেন, সময়মতো স্মরণ করবেন আমাদের।

তা বলে চার মাস পরে ডাক পড়বে ভাবিনি। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় ইংরিজিতে গোঁত্তা মারার অপমানকেও এতদিন জিইয়ে রাখা যায়নি। তাই ভেবেছিলাম, শিখিভূষণের অশিষ্টপনাও এতদিনে কালের সমাধিতলে বেশ খানিকটা তলিয়ে গেছে। তা ছাড়া শিখীর শিখা তো এখন টিমটিম করছে। কথাটা অবৈজ্ঞানিক জেনেও বলতে ইচ্ছে করে-ধর্মের কল একটি দারুণ উইন্ডমিল, হাওয়া দিলেই নড়ে। তার অমন সাধের গলাটি কিছুদিন যাবৎ মালিকের সঙ্গে বেইমানি করছে। বিদেশি তরলের বদলে নুন-জলে গার্গল করলে, নেমকহারামির একটা হাই ক্লাস দৃষ্টান্ত হত। টেবিলের ড্রয়ার খুঁজলে কম করে সাত আটটা খবরের কাগজের কাটিং পাওয়া যাবে, যার মধ্যে কোনও সংগীত সমালোচক বলছে, শিখিভূষণের উচিত আরও রেওয়াজ করা। কেউ বলছে, সুর তাকে ত্যাগ করেছে। আবার কেউ কেউ রেখে-ঢেকে কথা বলা পছন্দ করে না, লোকের পয়সা এবং সময় কি এতই সস্তা যে, কবে কে কোনকালে দু-ফোঁটা নাম করেছিল বলে আজও আসরে বসে ইঁদুরের গান শুনে ধন্য হতে হবে!

কাটিংগুলো ঝন্টুমামাই পাঠিয়েছিলেন। বিজ্ঞানী মানুষ তিনি, এরপরেও মড়ার ওপর ঘা দিয়ে খাঁড়ার ক্ষতি করবেন ভাবতে পারিনি। কিন্তু ইডেন গার্ডেনসে আসন্ন অখিল পশ্চিমবঙ্গ-আধুনিক-সংগীত-নাইটের দুটো অতিথি ছাপ-মার কার্ড পেয়ে হিসেবটা গুলিয়ে গেল। সঙ্গে একটা তিন লাইনের চিঠি শিখিভূষণের গান শুনতে এসে। ইন্ডিয়া ডিস্টার্বড কাগজের তরফে আলোগ্রাফার হিসেবে এ বছর আমি আধুনিক গানের আসরের ছবি তুলছি। ন-টার মধ্যে আসন গ্রহণ করবে।–Jhons.

ঝন্টুমামাকে না চিনলেও Jhons–এই স্বাক্ষরটি চেনে না এমন কোনও ফোটোরসিক নেই। কিন্তু তা বলে জলসার ছবি তুলতে ঝন্টুমামা? এই তো গেল বছর প্রধানমন্ত্রীর কলকাতা সফরের ছবি তোলার ডাক পেয়েই তিনি পড়িমরি করে তেলিপাড়ায় উধাও হয়ে গেলেন। ফেরার পর জানা গেল, বানারহাটের সন্ধানী বিজ্ঞানচক্র থেকে কৃষ্ণপদ কুণ্ডুর চিঠি এসেছিল। ওখানে মরাঘাট টি-গার্ডেনের বড়কাঝোরায় নাকি এমন সব মাথামোটা ও লেজ-ঝোলা বেঙাচির খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, যারা বর্ষাকালের তোয়াক্কা না করে সেপ্টেম্বরে, মানে ঘোর শরঙ্কালেই বংশবৃদ্ধি করছিল। এরপরেও ঝন্টুমামা না গিয়ে পারেন! কাজেই শিখিভূষণকে শিক্ষাদানের মতলব না থাকলে জলসার ছবি তুলতে…

সাত নম্বর গেটের মুখে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে হাততালির শব্দ কানে এল। স্টেডিয়ামে নিশ্চয় তিলধারণের ঠাঁই নেই। করিডরে পা দিতেই দেখি সামনেই ঝন্টুমামা। গলায় ক্যামেরা, কাঁধে ঝুলছে ফ্ল্যাশলাইটের ব্যাটারি। কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। প্রেক্ষাগৃহের দরজাটা ফাঁক হতেই কানে এল পরবর্তী শিল্পীর নাম ঘোষণা–এবার আপনাদের সামনে আসছেন শিখিভূষণ। এবার কিন্তু হাততালি জমাট বাঁধেনি।

ঝন্টুমামা, চলুন।–নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলাম।

যাক, এসে পড়েছ। তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। ঝন্টুমামা পাশের ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, শালিগ্রাম মুখুজ্জে। ইন্ডিয়া ডিস্টার্বড-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট জয়েন্ট অ্যাক্টিং সাব-এডিটর।

ভদ্রলোক কোনওরকমে সৌজন্য রক্ষা করে আবার ঝন্টুমামাকে নিয়ে পড়লেন, যা বলছিলাম, ফোটোগ্রাফার হিসেবে আপনার বিশ্বজোড়া খ্যাতির পেছনে মেন রিজনটা কী আপনার মতে?

উচ্চতার অভাব।

অ্যাঁ?

হ্যাঁ। এই যে আমাকে দেখে লোকে বেঁটে ভাবে, তা নয় কিন্তু। এটা শুধু উচ্চতার অভাব। সেই জন্য জন্মাবধি আমার দৃষ্টিটা একটা নিচু অ্যাঙ্গল থেকে পৃথিবীর ওপর নজর রাখছে। ভিউপয়েন্টটা নিচু হওয়ায় আমার ছবির মধ্যে, আলোগ্রাফে, একটা অন্য ডাইমেনশন বা নতুন মাত্রা থাকে। সেটাকে বৈশিষ্ট্যই বলুন বা সাফল্য। যা ইচ্ছে। আচ্ছা, চলি তাহলে, পরে কথা হবে।

আমরা অডিটোরিয়ামে ঢুকেছি। ঝন্টুমামা গ্রিনরুমে।

শিখিভূষণের নজরুলসংগীত বেশ জমেছে, না হলে দেরি করে ঢোকার জন্যে লোকে বিরক্তি প্রকাশ করত না। সিটে বসামাত্র একটা চেনা গলা কানে এল। আবছায়ায় আদিদাসকে দেখতে পাইনি।

আমিও আছি। আড্ডিদা জানান দিলেন। শিখিভূষণকে সামনের মাসে ক্লাবের ফাংশনে আসার জন্য আজ কথা বলব?

সামনের সারির শ্রোতারা বারবার ঘাড় ফিরিয়ে চাইছে। ইচ্ছে থাকলেও কথা বলার উপায় নেই। গানের মধ্যে তলিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। বেশ ভালোই তো গাইছে। তবলচিকে দিয়ে বেশ মেহনত করিয়ে নিচ্ছে। সারেঙ্গিওয়ালার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তার ডান হাত এবং ছড়টা আরও ফুটখানেক লম্বা হলে তবে বোধহয় করুণভরা টান মেরে তার মন ভরত। শিখিভূষণ নিশ্চয় গলা ফিরে পেয়েছে, না হলে এত বড় আসরে বাঘা বাঘা শিল্পীর সঙ্গে এক মঞ্চে বসার সাহস পেত না। আজকের আসর তার কাছে নাম উদ্ধার করার একটা বড় সুযোগ। গজল শেষ হতেই হাততালির দমকে ইডেনের আশপাশের বেশ কিছু গাছে কাক-চিলেদের ঘুম ভেঙে গেল।

মাথা নিচু করে বার তিনেক প্রণাম ঠুকে হাসিমুখে একটা রিডের ওপর আঙুল চেপে ধরল। তবলচির টুকুর টুকুর শেষ হয়েছে। গানের প্রথম কলিই মাতিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। শিখিভূষণের ভরা দরাজ গলায় গানটি বড় ভালো খুলেছে। ছেড়ে দাও কাচের চুড়ি বঙ্গনারী–মনোমোহন চক্রবর্তী রচিত মুকুন্দদাসের গাওয়া এই স্বদেশি গানের আবেদন এখনও অটুট। ছবি তোলার আইডিয়াল টাইম মিস করেননি ঝন্টুমামা। মঞ্চে উঠে জ্বলন্ত ধূপ-গাঁথা রজনিগন্ধার গুচ্ছের পাশে দাঁড়িয়ে ফোকাস করছেন। ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল। এবার অন্য একটা অ্যাঙ্গল থেকে, হাঁটু গেড়ে বসে। দুটো ছবি তুলে ঝন্টুমামা উইংসের পেছনে অদৃশ্য হলেন।

শিখিভূষণ লম্বা একটা টান ধরেছে। তোমাদের অঙ্গে সাজেনার না-কে নিয়ে ইলেকট্রিক ট্রেনের মতোই অনায়াসে ধেয়ে যাচ্ছিল স্বরটা। হঠাৎ ভারী গলাটা যেন চিহি চিঁহি রবে ককিয়ে উঠল।

এ হে হে–গেছে গেছে। ফিশপ্লেট চুরি।–নিলয় হাহাকার করে ওঠে।

কী বললি?

 গলার ফিশপ্লেট চুরি। সুর ডিরেল্ড।

কিংবা ভরাডুবিও বলতে পারিস। নয়তো গলাডুবি।

প্রাচীন শ্রোতারা ঠোঁট বেঁকিয়ে বেজার ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ছে, অর্বাচীনরা শিখিভূষণের পরিবর্তিত কণ্ঠের সঙ্গে কার মিল বেশি, বোঝাবার চেষ্টা করছে। কুকুর, বেড়াল ও ইঁদুরের ডাকে কান পাতা দায়। শিখিভূষণ হারমোনিয়ামের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা চাইছে। ঝড়ের বেগে তার আঙুল নাচ জুড়েছে রিডের ওপর। হারমোনিয়ামের বেলো তো নয়, কামারশালার হাপর। সারেঙ্গি, তবলা–সবাই জানপ্রাণ কবুল করছে, সময় নিচ্ছে, শিখিভূষণের গলাকে সামলে ওঠার সুযোগ দিচ্ছে। শ্রোতাদের হল্লার ঠেলায় শিল্পী আবার মুখ খুলল এবং আবার নির্ভেজাল মিকি মাউসের কাঁউমাঁউ।

হাততালি। উলু। সিটি।

কয়েকটা ছেলে মঞ্চের দিকে বিপজ্জনকভাবে এগচ্ছে।

বাদ্যযন্ত্রের মায়া ত্যাগ করে শিখিভূষণ অ্যান্ড পার্টি ভ্যানিশ হয়ে গেল।

উদ্যোক্তারা সময়মতো পরবর্তী শিল্পী লোকসংগীত গায়ক মজনুকুমারের নাম ঘোষণা না করলে লঙ্কাকাণ্ড ঠেকানো যেত না।

আড্ডিদা ও আদিদাসের কথামতো আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। আড্ডিদা জানালেন, ঝন্টুমামা বলে রেখেছেন, শিখিভূষণের গান শেষ হলে, গ্রিনরুমে চলে আসতে।

শুনলেন তো গানের ছিরি। এরপরেও বায়না? নিলয় বলল।

বিনি পয়সার বায়না তো। পয়সা চাওয়ার মুখ আছে নাকি? ডাকবে কে?

পয়সা নেবে না বলে বেচারাকে আবার অপদস্থ করার জন্য… মৃদু আপত্তি করলাম। যথেষ্ট শিক্ষা তো হয়েছে।

আমিও সে কথা বলেছিলাম। কিন্তু ঝন্টুমামা জোর দিয়ে বলছেন, শিখিভূষণ আমাদের প্রোগ্রামে নাকি দারুণ গাইবে।

আদিদাস ফোড়ন কাটল, স্যারের কথা ভুল হতে পারে না।

 মর্মান্তিক দৃশ্য চোখে পড়ল গ্রিনরুমের পেছনের দরজায়। ঝন্টুমামার দু-হাত ধরে কেঁদে ফেলেছে শিখিভূষণ। বাজনদারদের কাছে যখন মুখ দেখাবার উপায় নেই, দরজায় পুলিশ দাঁড় করিয়ে তাকে পালাবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে–এমন সময় দেবদূতের মতো ঝন্টুমামার উদয়। পরের মাসে পাড়ার জলসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

আপনি বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস করুন–আমার এই দুঃসময়ে আপনি যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এ আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না। আশপাশের জটলা উপেক্ষা করে ধরা-ধরা গলায় বলে চলেছে শিখিভূষণ। এখন কিন্তু তার গলাটা মিকি মাউসের মতো শোনাচ্ছে না।

ওসব ছেঁদো কথা ছাড়ুন। ইনভাইট করছি ঠিকই, তবে একটা পয়সা অ্যাডভান্স নয়। গান শুনিয়ে খুশি করতে পারেন যদি

লাগবে না–কোনও দরকার নেই। আপনি কত বড় সুযোগ দিচ্ছেন, জানেন না। যে করে থোক, যেভাবে হোক–আমি নিশ্চয়, নিশ্চয়–

হ্যাঁ, আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। কিন্তু গর্ব করবেন না। আর বিনি পয়সায় গান গেয়ে আমাদের কৃতার্থ করার কথাও ভাববেন না। গাইতে যদি পারেন-ন্যায্য পাওনা যা তা-ই পাবেন–পাঁচশো টাকা। স্বদেশি, দেশাত্মবোধক গান গেয়ে এর চেয়ে বেশি চাওয়াটা তো গেরুয়া পরে ডাকাতি!

.

এক মাস পরের কথা।

মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর জলসায় শিখিভূষণের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে দেখি, বারান্দায় আলো জ্বলছে। ঝন্টুমামা এলেন কখন?

তোমাদের জন্যেই বসে আছি। ছাড়তে চাইছিল না, তাই না?

কী বলছেন ঝন্টুমামা?

 বলছি, শিখিভূষণকে শ্রোতারা ছাড়তে চাইছিল না। ঝন্টুমামা কিন্তু জলসার ধারকাছ মাড়াননি, আহা, অবাক হবার কী আছে! আমি না জানলে, জানবে কে! আমিই তো ওর গলা থেকে গান কেড়ে নিয়েছিলাম।

তার মানে? গান কেড়ে…।

 ওই হল। সুর কেড়ে নেওয়া মানেই তো গানের দফারফা।

নিলয় হাঁটু গেড়ে ঝন্টুমামার পায়ের কাছে বসে সবিনয়ে আরজি পেশ করল, প্লিজ ঝন্টুমামা, ওই সুর কেড়ে নেওয়ার পদ্ধতিটার একটু ডিটেল যদি জানান…

জলে ভাসাব ভেলা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ–ভেলা। তখন ইংলিশ চ্যানেলের ওপরে আকাশে চলেছে তুমুল লড়াই। জার্মান দস্যুদের গুলিবিদ্ধ স্পিটফায়ারটা লটপট করে মুখ গুঁজে পড়ল জলে। পাইলটের সলিলসমাধি অবধারিত বুঝে জার্মান প্লেনটা উড়ে গেল। কী এবার ধরতে পারছ?

উত্তর পাবেন জানলে কি আর ঝন্টুমামা প্রশ্ন করতেন?

ব্রিটিশ পাইলটের কাছে ছিল মোক্ষম দাওয়াই। একটুখানি লিথিয়াম হাইড্রাইট। জলের সংস্পর্শে আসতেই মুহূর্তের মধ্যে লিথিয়াম হাইড্রাইট থেকে রাসায়নিক ক্রিয়ায় তৈরি হল হাইড্রোজেন। ফুলিয়ে তুলল চোপসানো ভেলা, মানে প্রাণ বাঁচানো লাইফবোট আর সংকেত জারি করার বেলুন। মাত্র এক কেজি লিথিয়াম হাইড্রাইটের মধ্যে আটাশশো লিটার হাইড্রোজেন থাকে। কী মনে পড়ছে?

মনে না-পড়ার কোনও সংগত কারণ থাকতে পারে না। এ তথ্য আমরাই সংগ্রহ করেছি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসে। কিন্তু তাতে কোনও সমস্যার সুরাহা হল! নিলয় বলে উঠল, জল শোষণ করার অদ্ভুত ক্ষমতার জন্যই লিথিয়ামের যৌগগুলো সাবমেরিনের হাওয়া পরিস্রুত করার জন্যে বা এয়ারকন্ডিশনারেও ব্যবহার করা হয়, কিন্তু…

অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক। ওটা আলোচ্য বিষয় নয়। তাহলে ধরে নিতে পারি যে, লিথিয়াম হাইড্রাইট ডুবন্ত পাইলটকে ভাসিয়ে তুললেও শিখিভূষণের গলাকে কী করে ডোবাল, সেটা বুঝতে পারনি! ঝন্টুমামা চোখ বুজলেন।

আঙুলের ফাঁকে চারমিনার খুঁজেও কোনও লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সদয় তিনি হলেন, কিন্তু জানি না সেটা আমাদের করুণ মুখ দেখে, না রুটি-তড়কার গুণে।

গত কয়েক মাস ধরে তিনি প্রেস ফোটোগ্রাফার হিসেবে বিভিন্ন জলসায় শিখিভূষণের ছবি তোলার নাম করে স্টেজে উঠেছেন। ছবিও তুলেছেন। কিন্তু এ কথাটা কেউই জানত না যে, তাঁর বাঁ কাঁধে ঝোলানো ফ্ল্যাশলাইটের ব্যাটারির বাক্সের মধ্যে আসলে দুটো খোপ ছিল। তার একটাতে থাকত লিথিয়াম হাইড্রাইট, অন্যটাতে জল। আসল ফ্ল্যাশলাইটা থাকত ক্যামেরার সঙ্গেই লাগানো। গায়কের মুখের কাছে এগিয়ে এসে ফোকাস করার সময় ছোট্ট একটা সুইচ টিপলেই জল এসে মিশত লিথিয়াম হাইড্রাইটের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে হুসহুস করে বেরত হাইড্রোজেন। ব্যাটারির তারটার বদলে তিনি জুড়ে নিয়েছিলেন একটা পেঁচানো ফাঁপা নল। তারই মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসত গ্যাস। তবে হ্যাঁ, যতক্ষণ হাইড্রোজেন বেরত, দম আটকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত ঝন্টুমামাকে। না হলে নিশ্বাসের সঙ্গে হাইড্রোজেন গ্রহণ করা মানে ঝন্টুমামার গলা থেকেও শিখিভূষণের মতো উঁদুরে ডাক বেরত।

ঝন্টুমামার কাছেই জানলাম, বেশি মাত্রায় হাইড্রোজেন যদি গলা দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে তাহলে যমরাজের গলাও বাচ্চা ছেলের মতো প্যানপ্যানানি জুড়বে। আসলে অত্যন্ত হালকা এই গ্যাসটা স্বরতন্ত্রীকে উত্তেজিত করে, ফলে তার স্বাভাবিক কম্পনাঙ্ক বেড়ে যায়।

ইজিচেয়ারে শরীরটাকে টানটান করে ছড়িয়ে ঝন্টুমামা মাথার পেছনে দু-হাত রেখে বিষণ্ণ সুরে বললেন, ভালো লাগে না। বিজ্ঞানকে এরকম রহস্যময় ম্যাজিকের মতো ব্যবহার করতে আমি ভালোবাসি না। কিন্তু এরকম সংকটে পড়লে পরমমানবিক যুদ্ধ ঘোষণা না করেই বা উপায় কী! তা ছাড়া সত্যিকার উপকৃত যদি কেউ হয়ে থাকে, সে স্বয়ং শিখিভূষণ। এতদিনে সে গান শিখল। সত্যিকার গান। তোমরাই বল, যে লোকটা মানুষ হবারই শিক্ষা পায়নি, সে কি গায়ক হতে পারে?

ঝন্টুমামা না বললেও এ কথা বুঝতে আমাদের একটুও অসুবিধে হচ্ছে না যে, আধখানা নমস্কার তো কোন ছার, পারমাণবিক শাসানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এই একটিমাত্র পথ। পরমমানবিক যুদ্ধ ঘোষণা।

[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮৩ পূজাবার্ষিকী]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *