ছোড়দার রেকর্ড

ছোড়দার রেকর্ড

একজন হিমশিম খাচ্ছে আর আরেকজন চরকিপাক মারছে। যে চরকিপাক মারছে, সে মুখ বুজে আছে, কারণ তার মুখ নামক অঙ্গটি নেই। কিন্তু আমার কেসটা তো আর তার নয়। আসলে ও-ই যে লোকটা তক্তপোশের ওপর উপুড় হয়ে রয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত ওই আমার ছোড়দা। ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে রয়েছে, কিন্তু ওটা তো ভান। আসলে দৃষ্টি রয়েছে আমার ওপর… যাক গে, কিন্তু আমি ভাবছি, দুনিয়ায় কত রকমের পাগলই না দেখা যায়। না, ছোড়দার কথা বলছি না। তবে পাগলদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে খারাপ জাতের, যারা অন্যদেরও পাগল করে ছাড়তে পারলে বেজায় খুশি হয়। বুদাপেস্টের রুবিক সাহেব নিশ্চয় এই ধরনের লোক। বাপ রে, কী বিদঘুটে জিনিসটাই না বানিয়েছে। শুধু ঘোরাচ্ছি আর ঘোরাচ্ছি–এপাশ, ওপাশ, সেপাশ, ছ-পাশ– একবার একটা পিঠের সব ক-টা খোপই পুরো নীল হয়ে গিয়েছিল দেখে আনন্দে প্রায়। লাফিয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু তারপরেই রুবিক কিউবটা ঘুরিয়ে দেখি অন্য পাঁচটা পিঠেই রঙেরা একেবারে লন্ডভন্ড। এমন বেয়াড়া হালচাল। তুমি কর দেখি, বলে ছোড়দাকে চ্যালেঞ্জ করতেও ভরসা হচ্ছে না। এসব ব্যাপারে ওর মাথাটা বেশ পরিষ্কার, কিন্তু তা বলে ওর এ কথাটা বলা উচিত হয়নি–রুবিক কিউব নিয়ে লড়ে যা। বুদ্ধি ধারালো হবে। অবশ্য যা নেই, তাতে কখনও ধার দেয়া যায় না…

কলিং বেলের শব্দটা যে কত মিষ্টি লাগতে পারে, এখন বুঝতে পারছি। ভাবতেও পারিনি, রবিবার দুপুরে এই অসময়ে কেউ আমায় উদ্ধার করতে আসতে পারে।

দরজা খুলে অবাক। পেল্লায় লম্বা লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি! মাঝবয়সি, মাথার চুলগুলো কদমছাঁট, গায়ের রং-টা তামাটে না হয়ে কালো হলে নিগ্রো মনে হত। আমায় কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটা একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। শুধু তা ই নয়, নিজের হাতে দরজাটাও টেনে দিয়েছে। ঘটনাটা রাত্তিরের দিকে ঘটলে নিশ্চয় ভয় পেতাম।

আই ওয়ান্ট টু মিট মিস্টার মানটু সেন।

কথা বলছে না তো যেন চোখ পাকিয়ে শাসানি দিচ্ছে। সাউথ ইন্ডিয়ান হতে পারে বলে মনে হয়েছিল, উচ্চারণ শুনে বুঝলাম তা নয়।

আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে ডেকে আনলাম। ছোড়দা তখনও তক্তপোশে। কালো সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, মিস্টার সেন–দেয়ার লাইয়িং।

ছোড়দা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে উঠে এল। নিশ্চয় ইংরিজি উচ্চারণে কোনও ভুল খুঁজে পেয়েছে।

সাহেব হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। আমার সঙ্গে এমন তেরিয়া মেজাজ দেখিয়ে এখন…।

ভালো ইংরিজি বলতে না পারি, বুঝি সব। কালো সাহেবের নাম রিচার্ড রোজ। এসেছে সিলোন থেকে। ছোড়দার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। প্রাইভেট।

রিচার্ড আমার দিকে তাকাল। কিন্তু ছোড়দা না বললে আমি নড়ছি না। তুমি কে হে… সঙ্গে সঙ্গে রুবিক কিউবটা হাতে নিয়ে মশগুল হয়ে গেলাম। স্বীকার করতেই হবে, রুবিক কিউব বুদ্ধি বাড়ায়। এতক্ষণে মনে পড়ল, লোকটাকে কোথায় দেখেছি!

আসছি! আচমকা হাঁক ছেড়ে পাশের ঘরে উঠে এলাম। ছোড়দা নিশ্চয় বুঝবে যে, আসলে কেউই আমায় ডাকেনি। ছোড়দা আসছে দেখে আরও দু-পা সরে এলাম।

কী রে?

ছোড়দা, এই লোকটাকে বুক ফেয়ারে দেখেছি। সেই যে দোকানটায় দাদার বই বিক্রি হচ্ছিল। দাদার বইটা হাতে দিয়ে কী সব খোঁজ নিচ্ছিল। যেই জিজ্ঞেস করেছি, আপনি মিস্টার সন্তু সেনকে চেনেন, বাস–চোখ পাকিয়ে বইটা একেবারে ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিচিরমিচির করে কী সব বলেওছিল–কত চেষ্টা করলাম বলবার যে, সন্তু সেন। আমার দাদা, কে কার কথা শোনে।

খুব ইন্টারেস্টিং! চল দেখা যাক ব্যাপারটা কী। থ্যাঙ্কস-ট্যাঙ্কস দেওয়া ছোড়দার ধাতে নেই।

ঘরে ঢুকে দেখি, রিচার্ড পায়চারি জুড়েছে। হাত দুটো কোমরে পেছনে, আঙুলে ফাঁস লাগানো। আমাদের ঢুকতে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আমি আর দশ মিনিটের বেশি কিছুতেই থাকতে পারব না। প্লিজ–

ছোড়দা মাফ চেয়ে রিচার্ডকে বসতে অনুরোধ করল।

চেয়ারের সামনের দিকে ঝুঁকে বসেছে রিচার্ড। চোখ দুটো ছোট হয়ে এসেছে, কপালে চিন্তার রেখা।

আপনার দাদা মিস্টার সেন কেপ টাউনে গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। প্লিজ ডোন্ট পুট কোয়েশ্চেনস, ট্রাই টু বিলিভ মি।

রিচার্ড আমাদের চমকে দিল। আমাদের চোখ-মুখের অবস্থা দেখে রিচার্ড মুহূর্তের জন্য থামতেই ছোড়দা বলে উঠল, ও কি সাদা-কালোর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে?

ঠিক তা-ই। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?

আপনি তো জানেন, দাদা ডিস্ট্রিক্ট সিক্স নামে অ্যালবার্ট রাইভের একটা উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করেছেন। উপন্যাসটা বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার অ্যাপার্টথেড নীতির জন্য যেরকম কুখ্যাত। কিন্তু দাদা তো কখনও রাজনীতির মধ্যে।

রিচার্ড বাধা দিল, মিস্টার সেন, এটা রাজনীতির প্রশ্ন নয়। কোনও বিবেকবান মানুষের পক্ষে কখনও দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে সমর্থন করা সম্ভব নয়। রাজনীতি করলে আপনার দাদা নিশ্চয় ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি নিয়ে কেপ টাউনে আসতেন না। বা, এলেও, কখনও রাইভের উপন্যাস অনুবাদ করতেন না। শুনলে অবাক হবেন, ওঁকে গৃহবন্দি রাখার কারণ মাত্র একটি। ওই অনুবাদটাই ওঁর বিপদ ডেকে এনেছে। রাইভ বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী সাংস্কৃতিক কর্মী, বর্তমানে দেশছাড়া। এই উপন্যাসটা অনূদিত হয়েছে জানতে পেরে শ্বেতাঙ্গ সরকার সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। আপনার দাদার সঙ্গে ওখানকার রাজনৈতিক কর্মীদের আদৌ কোনও যোগাযোগ নেই। ভালো লেগেছিল তাই অনুবাদ করেছেন। কিন্তু বড় একরোখা মানুষ উনি। গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের একটিও প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি। আরও মুশকিল হল, আমাদের নিজেদের লোকেরা যখন ওঁর কাছে কোনও প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছে, উনি তাদেরও বিশ্বাস করতে পারছেন না। চেনেনই না তো

দাদা তো গভর্নমেন্ট চ্যানেলে চাকরি নিয়ে গেছে। বিদেশমন্ত্রকের সাহায্যে ছোড়দা কথা শেষ করার সুযোগ পেল না।

রিচার্ডের হাসিটা দারুণ তেতো–আপনি দক্ষিণ আফ্রিকার হালচাল জানেন না। কোনও লাভ হবে না। কেউই প্রমাণ করতে পারবে না যে, ওঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট সিক্স-এর গল্পটা মনে আছে? ওটাকে গল্প না বলে সত্য বলা উচিত। কেপ টাউনের অশ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা সত্যিই ডিস্ট্রিক্ট সিক্স নামে একটি নরককুণ্ডে বাস করে।

হ্যাঁ রে, বাবাকে ডেকে আনব নাকি?–আমি ছোড়দাকে বললাম।

 রিচার্ড জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ হি সেয়িং?

ছোড়দা আমার পরিচয় দিল।

রিচার্ড হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়াং ম্যান, সেদিন তুমি আমাকে প্রায় ডুবিয়েছিলে। মনে আছে, বুক ফেয়ারে দেখা হয়েছিল? তোমাদের ঠিকানা তো ওখান থেকেই জোগাড় করেছি। দীর্ঘ চার বছর আমি দেশছাড়া। বিশেষ নির্দেশ পেয়ে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এসেছি। ঘুণাক্ষরেও…

আপনি কি বাবার সঙ্গে…।

না, কী দরকার? তাঁর নিশ্চয় বয়স হয়েছে, দুর্ভাবনা বাড়বে।

ছোড়দা বলল, শারীরিক নির্যাতনের ভয় আছে নাকি? মানে তেমন কিছু…

হ্যাঁ–মাস তিনেক পরে কেপ টাউনে আমরা একটা বড় আন্দোলন শুরু করব। তার আগে আমরা আমাদের সমর্থক বিদেশি বন্ধুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিতে চাইছি। ইতিমধ্যে অনেকেই চলে গেছেন।

তার মানে দাদা যদি আপনাদের ওপর নির্ভর করতে রাজি হয়–

তিন দিনের মধ্যে তাঁকে কলকাতা পৌঁছে দেব। আমাদের সংগঠন খুব ভালো। এমনকী যে ছ-জন পুলিশ ওঁকে সারাক্ষণ পাহারা দেয়, তাদের মধ্যেই আমাদের একজন লোক আছে। পালাবার প্রস্তাবও রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, উনি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।

চিঠি দিলে কি পৌঁছাবে? দিন সাতেক আগেও আমরা ওর একটা ছোট্ট চিঠি পেয়েছি।

 খুব কড়া সেন্সর। যদি এতটুকু সন্দেহজনক মনে হয়—

বাংলা পড়ারও লোক আছে তাহলে? আমি জানতে চাইলাম।

সার্টেনলি!

আচ্ছা, বাবার শরীর খুব খারাপ বলে যদি টেলিগ্রাম পাঠানো যায়? বা, ভারতীয় দূতাবাসের সাহায্যে যদি সে খবরটা আমি পথ খোঁজার চেষ্টা করি।

রিচার্ড মাথা নাড়ে, খুব একটা সুবিধে হবে না। চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

ছোড়দা বলল, নাঃ-বাবাকে রাজি করানো শক্ত। বাবা রাজনীতি করার বিরোধী, কিন্তু ঠিক বলবেন, দাদা নিজে যখন প্রোটেস্ট করছে, তখন এভাবে মিথ্যে কথা লিখে

রিচার্ড উঠে দাঁড়াল, আমি আর আজ দেরি করতে পারব না। চলি। আপনারা ভালো করে চিন্তা করে দেখুন এমন একটা উপায় বার করা যায় কি না, যাতে উনি আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন। ধরুন, এমন কোনও নাম বা শব্দ, যেটা আমাদের লোকের মুখে শুনলেই উনি বুঝতে পারবেন–

আচ্ছা, আপনাদের যে লোকটি পাহারাদারদের দলে আছে, তার নাম জানেন? ছোড়দা জানতে চাইল।

জর্জ লেম। একটা আইডিয়া এসেছে মনে হচ্ছে?

 না, ঠিক তা নয়। একটু ভেবে দেখি। আপনার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হবে?

ঠিক সাত দিন পরে, নেক্সট রবিবার সকাল সাতটায় আমি ফোন করব। ফোন যদি না পাই তাহলে আসব। আমি কিন্তু তার পরের দিনই ক্যালকাটা থেকে চলে যাব। যা করার, এরই মধ্যে। এখানে বেশি দিন থাকা আমার পক্ষে সেফ নয়।

দরজার কাছে পৌঁছে রিচার্ড বলল, আপনারা আর আমার সঙ্গে এগবেন না। চলি, গুড বাই!

ছোড়দা ঘরে ঢুকে আবার তক্তপোশে লম্বা হল। ঘাড়ের পেছনে দু-হাত রেখে সেই খ্যাতিমান কড়িকাঠের কাছ থেকে নিশ্চয় বুদ্ধি ভিক্ষা চাইছে। দেখে কেমন কষ্ট হল। একটু হেল্প করার জন্যে বললাম, বুঝলে ছোড়দা, একটা লিস্ট করা যাক–এমনিতেই তো আমরা বড়দার কাছে মাঝে মাঝে জিনিসপত্র পাঠাই, এই ধর টিনে ভরা রসগোল্লা, বইটই, আমসত্ব–

রুবিক কিউবের প্রবলেম সলভ হয়ে গেছে?

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করলাম যে, ভবিষ্যতে আর কখনও মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করব না।

তাতেও রেহাই নেই। ঘণ্টাখানেক বাদে হঠাৎ হুকুম এল, গীতাঞ্জলিটা নিয়ে আয় তো শিগগির।

অবাক হয়েছি, কিন্তু প্রশ্ন করিনি। অবাক তো হতেই হবে। দেবব্রত বিশ্বাসের গান হলেও যে মুখের সামনে থেকে ইলেকট্রনিক্সের বই নামায় না… নিশ্চয় কোনও মতলব এঁটেছে। এমন কোনও গানের রেকর্ড পাঠাতে চায় নিশ্চয়, যেটা শুনে বড়দা… তা ছাড়া এ-ও ঠিক যে আমরা প্রায়ই বড়দাকে রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড পাঠাই।

গীতাঞ্জলি এনে দিলাম, কাগজ-কলম এনে দিলাম, তবু ছোড়দা স্পিকটি নট। মাঝে মাঝে খসখস করে কী লেখে, একটু ভাবে, তারপরে আবার পাতা ওলটায়।

বাস–এতেই হবে। ধুলো ঝাড়ার মতো সশব্দে বই বন্ধ করে ছোড়দা উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে কাগজের ফালিটা চার ভাঁজ করে পকেটে পুরে ফেলেছে। কয়েক মিনিট বাদেই পাশের ঘর থেকে ওর গলা শুনতে পেলাম। কান খাড়া করতেই বুঝলাম, অবনীকাকুর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। লাকিফোন রেকর্ডিং কোম্পানির মালিক অবনীকাকু। বাবার ছোটবেলার বন্ধু। বুঝলাম, কিছু ভুল করিনি। একটা রেকর্ডই নিশ্চয় পাঠাবে বড়দার কাছে।

রাত্তিরে সবে এসে শুয়েছি, ছোড়দা বলল, ওরে, বড় ভুল হয়ে গেছে। অ্যালার্মটা দিয়ে রাখতো, ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে।

ক-টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট অবনীকাকুর সঙ্গে?

ছ-টায়। কিন্তু সেই বেলঘরিয়ায় যেতে হবে।

অ্যালার্মের চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলাম, তা বেলঘরিয়া না ছুটে মেলোডির দোকান থেকে কিনে নিলে হত না?

ও রেকর্ড পাওয়া যায় না।

কী গান সিলেক্ট করলে শুনি!

 ওই তো, লিখে রেখেছিলাম কাগজটায়। দেখ না। ও কী রে, এতক্ষণ ধরে দম দিচ্ছিস কেন! ওহ হো–এটার তো অ্যালার্মের স্প্রিংটা কাটা।

ঠিক বলেছে। একেবারে মনে ছিল না। ঘড়ি নামিয়ে রেখে কাগজের টুকরোটা হাতে নিলাম।

তাহলে কী হবে? ঘুমকাতুরে ছোড়দার হাহাকার কানে এল। পরমুহূর্তে আমাকে আক্রমণ, তুই যা কুম্ভকর্ণ

আমি না-হয় কুম্ভকর্ণ, তুমি কী?

আমি ঘুমাই অত্যধিক চিন্তা করতে হয় বলে, তুই ঘুমাস অকারণে। যাক গে, তিন গেলাস জল নিয়ে আয়।

কী?

 জল, জল। এইচ-টু-ও। তিন গেলাস পেটে ভরে নিলে সময়মতো বিপদসংকেত আসবে–

ছোড়দা জল গিলে পাশ ফিরে শুতে কাগজটা খুললাম। দুটো রবীন্দ্রসংগীত পুরো কপি করেছে। একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে/ সাথে সাথে কে চলে মোর নীরব অন্ধকারে এবং যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি/ ঝড় এসেছে, ওরে, এবার ঝড়কে পেলেম সাথী।

কী মিথ্যুক! এই গানের রেকর্ড কিনতে পাওয়া যায় না!

.

অনেক চেষ্টা করেও ছোড়দার মুখ দিয়ে কথা বার করতে পারিনি। শুধু এইটুকু জানতে পেরেছি যে, অবনীকাকুর ওখান থেকে একটা নতুন রেকর্ড করে আনতে প্রায় হাজারখানেক টাকা জলে দিয়েছে। ওর মতে, সেটাও নাকি খুব সস্তা। এখনও বড়াই করে চলেছে যে, বড়দা ফিরলেই তার কাছ থেকে সুদে-আসলে সব আদায় করে নেবে। গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। আমি নিজে তো শুনেছি রেকর্ডটা। যতই বুদ্ধি করে লুকিয়ে রাখুক। ওই গান শুনে কী বুঝবে বড়দা?

তবু রিচার্ডের ফোন আসার তক্কে ছিলাম। পরের রবিবার, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাতটা, ফোনটা ঝনঝন করে উঠল।

রিসিভার তুলে ছোড়দা বলল, মিটার রোজ-ব্যবস্থা একটা হয়েছে। মনে হয়, কাজ হবে। দাদার কাছে আমরা একটা রেকর্ড পাঠিয়েছি এয়ার মেলে। আপনাকে এবার একটা কাজ করতে হবে। ওখানে মিস্টার লেম বলে যিনি আছেন, তাঁর কাছে খবর পাঠাতে হবে, তিনি যেন দাদাকে রিকোয়েস্ট করে বলেন, ওই নতুন রেকর্ডটা শুধু লেফট চ্যানেলে শোনার জন্য। খুব গোপনে বলতে বলবেন কিন্তু। হ্যাঁ–লেট চ্যানেলে। না না, একেবারে প্লেন অ্যান্ড সিম্পল টেগোরের রেকর্ড। আচ্ছা! আচ্ছা–ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ!

আমার দিকে ফিরে ছোড়দা বলল, এখনও বুঝলি না? সেদিন তো খুব লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছিলি রেকর্ডটা!

এবার ছোড়দার মধ্যে জ্ঞান বিতরণ শুরু করার সিম্পটমগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। হলও তা ই। চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে ঝাড়া আধটি ঘণ্টা কাটিয়ে দিল স্টিরিয়ো রেকর্ড করার কায়দাকানুন সম্বন্ধে বক্তৃতা ঝেড়ে।

দুটো মাইক্রোফোনের সাহায্যে স্টিরিয়ো রেকর্ড করা হয়। সে রেকর্ড বাজানোও হয়। দুটো অ্যামপ্লিফায়ার ও লাউডস্পিকার দিয়ে। স্টিরিয়ো রেকর্ডের যে খাঁজ বা গ্রুভের মধ্যে শব্দগুলোর স্পন্দনের আকৃতি ধরা থাকে, তার দুটো কিনারা আছে। একটা কিনারাকে বলা হয় লেফট চ্যানেল আর অন্যটাকে রাইট চ্যানেল। লেফট চ্যানেলে থাকে বাঁ দিকের মাইক্রোফোনের শব্দ আর রাইট চ্যানেলে ডান দিকের মাইক্রোফোনেরটা। রেকর্ড বাজবার সময়েও ঠিক এইভাবেই একটা স্পিকারে লেফট চ্যানেলে রেকর্ড করা শব্দগুলো বাজে আর অন্য স্পিকারটায় রাইট চ্যানেলের শব্দগুলো। স্টিরিয়ো রেকর্ড চালাবার সময় দুটো চ্যানেলই একসঙ্গে বাজে। মানে, দুটো স্পিকার থেকেই শব্দ বেরয়। এই অবধি শুনেই তিনবার হাই উঠেছিল। নিশ্চয় সেটা চোখে পড়েছিল ছোড়দার। দুম করে টেবিলে ঘুষি মেরে বলল, এখনও বুঝলি না? তোর দ্বারা কিসসু হবে না। রবীন্দ্রসংগীত দুটো রেকর্ড করবার সময় লেফট চ্যানেলে শুধু বেছে বেছে কয়েকটা শব্দ রাখা হয়েছে, বাকি সব বাদ। রাইট চ্যানেলে পুরো গানটা আছে। এমনিতে শুনলে, মানে দুটো চ্যানেলই যখন বাজছে, পুরো গানটাই শোনা যাবে। তুইও তো বাজিয়েছিলি, কিছু ধরতে পারিসনি তো! কিন্তু ডান দিকের স্পিকারটা বন্ধ করে শুধু বাঁ দিকের স্পিকার অন করে রাখলেই শোনা যেত —লেম… তোমার… সাথে সাথে… চলে। এটা কোন গান বল তো?

একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে/ সাথে সাথে কে চলে মোর গভীর অন্ধকারে। হলেম-এর হ-টা বাদ দিয়ে লেম বানানো হয়েছে।

যাক। বুদ্ধিমানের মাথায় ঢুকেছে তাহলে। টিকটিকি বাবাজিরা হাজার চেষ্টা করলেও ধরতে পারবে না, কী বল? ভাগ্যিস আমাদের দেশেও এখন স্টিরিয়োফোনিক সাউন্ড রেকর্ড করা শুরু হয়েছে, না হলে কি আর দাদার কাছে রবীন্দ্রসংগীতের ফাঁকে ফাঁকে এইভাবে গোপন সংবাদ পাঠানো যেত! এবার তুই বল তো, দ্বিতীয় গানটা থেকে ঠিক এইভাবে কোন কোন শব্দ লেফট চ্যানেলে রাখা হয়েছে?

আমার বুদ্ধির প্রশ্ন তুলেছে তাই পরীক্ষায় নামতেই হল। গান-লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে তাচ্ছিল্যভরে মুহূর্তের মধ্যে ক-টা শব্দের নিচে দাগ দিয়ে ছোড়দার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।

যেতে যেতে একলা পথে/ নিবেছে মোর বাতি/ ঝড় এসেছে, ওরে, এবার ঝড়কে পেলেম সাথী। (পথে এবার লেম সাথী)।

ছোড়দাঁ বোধহয় ভাবেনি, এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস, কলম্বাস একবার একটা ডিম হাতে নিয়ে বলেছিল, আপনাদের মধ্যে কেউ কি এটা সোজা করে বসাতে পারবেন? কেউ পারল না। তখন কলম্বাস যেই এক ঠোক্করে ডিমটাকে থেঁতলে বসিয়ে দিল, সবাই হইহই করে উঠল, এ আর এমন কী! যা যা, শিগগির রুবিক কিউব নিয়ে বসে যা। তোর মগজখানার অবস্থা যা,

এই ঘটনার এক মাস পরে মিস্টার লেমের সাহায্যে বড়দা বাড়ি ফিরে এসেছে। দারুণ একটা পেন দিয়েছে আমায়। কিন্তু সবচেয়ে ভালো জিনিসটা, ক্যামেরাটা বাগিয়ে নিয়েছে মিস্টার কলম্বাস।

[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮২ পূজাবার্ষিকী]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *