মন্ত্র মাহাত্ম্য

মন্ত্র মাহাত্ম্য

বেহালার বীরেন রায় রোড ইস্টে ঢুকে দশ মিনিট পায়ে হেঁটে এগতে হবে বলেছিল। কিন্তু ইট বার করা ভাঙা মন্দিরটা কোথায়? ডান দিকে পড়বার কথা। এই তো গাছের আড়ালে। বোঝা যাচ্ছিল না। তাহলে এই বাঁ দিকের রাস্তাটা দিয়েই ভেতরে ঢুকতে হবে।, পথ ভুল হয়নি। পানাপুকুরটার উত্তর দিকের রাস্তাটা ধরে এগলেই বাঁ দিকের মোড়ে… এই তো গেটটা। কাঁটাতার লাগানো মানুষসমান উঁচু পাঁচিলের সঙ্গে মানানসই বিরাট লোহার পাল্লা। জায়গা চিনতে ভুল হয়নি দেবাশিসের। ওপরেই বিরাট হরফে লেখা– সত্যসাধন দেবায়তন। কিন্তু গেটটা তো ভেতর থেকে বন্ধ। কী করে ডাকা যায়! কোনও কলিং বেলও তো দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য, লোকে ঢোকে কী করে?

হঠাৎ কানের কাছে একটা শব্দ শুনে চমকে গেল দেবাশিস। কাকে চাইছেন? ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না।

আবার কণ্ঠস্বর কানে এল, বাঁ দিকে তাকালেই দেওয়ালের গায়ে মাইক্রোফোনের মুখ দেখতে পাবেন। ওখানে কথা বলুন।

এতক্ষণে দেবাশিসের চোখে পড়ে। গেটের পাশে কংক্রিটের থামের গায়ে এমনভাবে লুকানো রয়েছে স্পিকারটা, না জানা থাকলে চোখে পড়ার কথা নয়।

দেবাশিস স্পিকারের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, আমি মহান্তজির দর্শনপ্রার্থী।

উনি শুক্রবার সকাল ছ-টা থেকে ন-টা অবধি শুধু সাক্ষাৎ করেন।

কিন্তু আমি জানি, কালই একজন ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিল।

 একমাত্র আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই সেটা সম্ভব।

শুনুন–আমার খুব জরুরি দরকার। আমার মামা–সৌরেনবাবু ওঁর শিষ্য। কালই উনি এসেছিলেন। একটা বিপদে পড়ে…

বললাম তো, শুক্রবার ছাড়া উনি দেখা করেন না। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইতে পারেন। সকাল দশটা থেকে বারোটার মধ্যে।

খট করে একটা শব্দ হল স্পিকারে। দেবাশিস মাইক্রোফোনে একেবারে মুখ লাগিয়ে ডাকতে লাগল, হ্যালো, শুনছেন, হ্যালো

কোনও শব্দ নেই। হতাশ হয়ে দেবাশিস এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে। বিশাল দেয়ালের বাধা পেরিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করা অসম্ভব। পিছু ফিরে সবে দু-এক পা এগিয়েছে, ঘড়ঘড় করে গেট খোলার শব্দ শুনেই সে ঘুরে দাঁড়াল। একটা গাড়ি বেরবে বলে গেট খুলছে। একছুটে গেটের কাছে এসে হাজির হল দেবাশিস। পুরো গেটটা এখনও খোলেনি। দারোয়ানকে একবার অনুরোধ করবে বলে ভেতরে এক পা দিতে না দিতেই পেছন থেকে নিঃশব্দে কে যেন তার কাঁধের কাছে জামার কলারটা মুঠো করে ধরে এক হ্যাঁচকায় বাইরে টেনে নিয়ে এল। প্রায় উলটে পড়েছিল। কোনওক্রমে টাল সামলে খাড়া হতেই একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর কানে এল, জবরদস্তি ঢোকবার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। আগেই বারণ করা হয়েছিল।

দেবাশীষ দেখল, গেরুয়া লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা একটা নেড়ামাথা যণ্ডামার্কা লোক ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। গাড়িটা গেট গলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেবাশিস চেঁচিয়ে উঠল, ডাক্তারবাবু-ডাক্তারবাবু।

গাড়িটা থামতেই দেবাশিস এগিয়ে গিয়ে পেছনের জানলায় কনুইয়ের ভর রেখে মাথা নিচু করে বলল, ডাক্তারবাবু, চিনতে পারছেন? আমি দেবাশিস।

হ্যাঁ, মুখটা চেনা চেনা লাগছে। মাঝবয়সি ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকান।

আমার মামার দাঁত বাঁধাবার সময় আপনার কাছে এসেছিলাম। মনে পড়ছে– সৌরেনবাবুর…।

ওহ্ হো, তা-ই বল। তুমি তো আমাদের পাড়ার ছেলে। তা এখানে কী ব্যাপার?

 আমি একটু মহান্তজির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, কিন্তু…

সে কী হে, তুমি মামাকে আগে জিজ্ঞেস করনি কেন? উনি তো আজ দেখা করেন না। বাড়ি ফিরবে তো, চল আমার সঙ্গে।

ডাক্তারবাবু, আপনি যদি একটু বলে দেন। আমার খুব দরকার ছিল দেখা করার। ডাক্তারের ইঙ্গিতে ড্রাইভার সামনের সিট থেকে হাত বাড়িয়ে পেছনের দরজাটা খুলে টেনে ধরল।

ওঠ, ওঠ, আজ দেখা হবে না।

দেবাশিস উঠে পড়ল। গাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, গেটের লোহার পাল্লা বন্ধ হয়ে গেছে।

ডাক্তারবাবু, আপনি একটু বলে দিলে নিশ্চয় দেখা হয়ে যেত। দেবাশিস আবার বলে।

ডাক্তারবাবু হাসেন। কিছুতেই হত না। আমি ডাক্তার বলে আসতে পেরেছি। এমনিতে আর আমার সঙ্গে কতটুকু পরিচয়। বরং তোমার মামাকে বললে–

না ডাক্তারবাবু, মামাকে কিছু বলবেন না। দেবাশিস বাধা দেয়।

কেন বল তো?

আপনি জানেন না মামাবাবু… দেবাশিস কথাটা শেষ না করেই ভাবে, ডাক্তারের দিকে তাকায় কথাটা বলা কি ঠিক হবে? ডাক্তারও কি মহান্তজির শিষ্য? মুহূর্তের মধ্যে দেবাশিস ঠিক করে ফেলে, না বলাই ভালো। শিষ্য হোক বা না হোক, মহান্তজির কৃপায় ডাক্তারের পসার যে বেড়েছে–এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। ডাক্তারখানাটা আগে খাঁ খাঁ করত। পাড়ার ছেলেরা বলত ডাক্তার মালাকার ঘোড়ার দাঁত বাঁধায়। কিন্তু এখন ভিড়ের চোটে সাত দিন আগে থেকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতেই হয়। রুগিরা সবাই আসে মহান্তজির কাছ থেকে। মামাবাবুর মুখেই শুনেছে, মহান্তজি নিজে মুখে ডাক্তার মালাকারের প্রশংসা করেন। যে মহান্তজির এককথায় লোকে ঘরবাড়ি বেচে দিতে পারে…

কী হল দেবাশিস? ডাক্তারবাবু ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্ন করেন।

দেবাশিস হঠাৎ চুপ করে যাওয়াটাকে চাপা দিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, মোহিনী অ্যাভিনিউটা এখানে না? অনেকদিন আগে একবার এসেছিলাম। আমার এক বন্ধু থাকত।

ঠিক বলতে পারছি না।

থাক গে। দেবাশিস কথা ঘুরিয়ে নেয়। আপনি কিন্তু মামাকে কিছু জানাবেন না। দেবাশিস হাসে। মানে, জানেন তো, আমি চিরকালই নাস্তিক ছিলাম। মামার সঙ্গে অনেক কথা কাটাকাটিও করেছি এই নিয়ে। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ মনে হচ্ছে, আমি বোধহয় এতদিন ভুল করেছি। মহান্তজি সত্যিই মহাপুরুষ…

ডাক্তারবাবু সিট থেকে একটু এগিয়ে বসে দেবাশিসের হাঁটুর ওপর হাত রেখে বলেন, শুধু মহাপুরুষ নয় হে, এমন ভবিষ্যদ্রষ্টা তুমি দুটো পাবে না। জান, বিহারে পুরুষোত্তম দাস নামে এক ব্যবসায়ী আছে। মহান্তজির বাণী পেল সে একদিন। তার বসতবাড়িটা দু দিনের মধ্যে বিক্রি করে দিতে বললেন তিনি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই তাকে এমন বারণ করল যে, অর্থের লোভে বাড়িটা সে বেচতে পারল না। তারপর কী হল জান? এক মাসের মধ্যে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্পে… কী হল দেবাশিস?

ডাক্তারের প্রশ্নে দেবাশিসের চটকা ভেঙে যায়। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। মামাবাবুর মুখেও সে একই গল্প শুনেছে। হ্যাঁ, এটাকে সে গল্প ছাড়া কিছু মনে করতে রাজি নয়। মামাবাবু তাঁর অত বড় কারখানাটা বেচে দেবেন, ঠিক করে ফেলেছেন। অশোক দেবাশিসের মামাতো ভাই, সে-ও কত বুঝিয়েছে তার বাবাকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হবার নয়। মামাবাবু স্বপ্নে বাণী পেয়েছেন। ওই বিরাট কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে নাকি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটবে তিন মাসের মধ্যে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, দেবাশিসের মা প্রথমে অনেক বারণ করেছিল। তারপর হঠাৎ মা-ও মত পালটে ফেলেছে। মা দেবদ্বিজে বিশ্বাস করতে শুরু করবে, দেবাশিস ভাবতেই পারে না। মহান্তজির কাছে যাওয়া-আসা শুরু করার পর থেকেই মা-ও বলেছে যে, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটবে।

কী হল দেবাশিস? কী ভাবছ?

অ্যাঁ? ও না… ডাক্তারবাবু। আজকাল মাঝে মাঝে কেমন যেন উদাস হয়ে যাই। কানের কাছে কে যেন গুঞ্জন করে… মা এবং মামার মুখে শোনা কথাটাকে চালিয়ে দেয় দেবাশিস।

গুঞ্জন? হঠাৎ যেন চাবুকের আঘাতে ডাক্তার চমকে ওঠে।

 দেবাশিস আশ্চর্য হয়ে যায়। হঠাৎ গুঞ্জন শুনে ডাক্তারের অবাক হবার কী হল?

কেন তা আপনি শুনতে পান না? আমার মা, মামা সবাই তো…

 ডাক্তারবাবু একটু হেসে ঠেস দিয়ে বলেন, তা-ই বল, মহান্তজির শিষ্য-শিষ্যাদের কথা বলছ।

কেন শিষ্য-শিষ্যারা ছাড়া কেউই তাঁর আশীর্বাণী পাবে না? আমার তো মনে হয়, কে যেন গুনগুন করে কানে কানে বলছে–তুই এখুনি মহান্তজির সঙ্গে গিয়ে দেখা কর।

ডাক্তারের ভুরুটা আবার কুঁচকে যায়। কী যেন চিন্তা করছেন।

 সত্যি শুনতে পাও?

হ্যাঁ–পাই তো। দেবাশিস নজর রাখে ডাক্তারের মুখের দিকে।

দেবাশিস দৈববাণী শুনতে পায় শুনলে তো ওঁর খুশি হবার কথা। সেই জন্যেই তো আজ ছুটে এসেছিলাম। গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি অথচ নির্দেশগুলো ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি যেভাবে হোক আমাকে একবার মহান্তজিকে দর্শনের ব্যবস্থা করে দিন ডাক্তারবাবু। দেবাশিস আকুলভাবে ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরে। মহান্তজির আশ্রমের ভেতরে ঢোকার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

ডাক্তার মালাকার হঠাৎ নাকে হাত চাপা দিয়ে মুখটা সরিয়ে নিলেন। তোমার কি পায়োরিয়া আছে?

পায়োরিয়া! দেবাশিস অবাক।

হ্যাঁ। তোমার মুখে বিশ্রী গন্ধ। দেখি তো, হাঁ কর একবার।

দেবাশিস চিন্তা করার আগেই মুখ হাঁ করে ফেলল।

 এই তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ডাক্তার আপন মনে বলেন, লেট আপার জ-এর ফার্স্ট মোলারটা।

দেবাশিস মুখ বন্ধ করতে ডাক্তার বললেন, দাঁতে ব্যথা হয়?

 কই, না তো।

ভাগ্য ভালো। দু-এক দিনের মধ্যেই পোকা-দাঁতটা তুলিয়ে নাও। না হলে একবার যদি যন্ত্রণা শুরু হয়, খুব কষ্ট পাবে।

দেবাশিস বলল, তাহলে আপনার কাছেই যাব। কবে যাব বলুন? যা ভিড় থাকে।

ভিড়ের জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না। কালই বিকেলের দিকে চলে এসো।

দেবাশিসের মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো খেলে যায়। মা দাঁত বাঁধাবার পর থেকেই মহান্তজির অন্ধভক্ত। মামাবাবুর দাঁত বাঁধিয়েছে ডক্টর মালাকার। এবার দেবাশিসেরও দাঁত বাঁধাবার…

অত ভাবার কী আছে? সামান্য ব্যাপার। ভয়ের কোনও কারণ নেই।

 দেবাশিস হেসে বলল, তা নয় ডাক্তারবাবু। আসলে কাল শুক্রবার তো, মহান্তজির সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত যেন শান্তি পাচ্ছি না।

বেশ তো তাহলে শনিবার এসো। দুপুর দুটোর সময়।

 গাড়িটা আশুতোষ কলেজের সামনে আসতেই দেবাশিস বলে উঠল, আমি একটু এখানে নামব।

ড্রাইভার! দাঁড়াও।

আমি তাহলে শনিবার আসছি। দেবাশিস নেমে দরজাটা টেনে দিল। গাড়িটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল দেবাশিস। মহান্তজির সব শিষ্যই কি দাঁতের রোগে ভুগছে? আশ্চর্য ব্যাপার তো। কোথায় যেন মনের ভেতরটা খচখচ করে। একটা কোনও রহস্য আছে এর মধ্যে। কিন্তু সেটা কী? এখন কী করবে? এমন একটা লোক নেই, যার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যায়। ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস করে না এমন লোকের অভাব নেই। কিন্তু তা হলেও যদি বলে, কাকাবাবুর কারখানা বিক্রির পেছনে মহান্তজির হাত আছে, কেউ বিশ্বাস করবে না। বলবে, প্রমাণ কোথায়! ঠিকই তো, কোনও অভিযোগ আনতে গেলে প্রমাণ তো চাই। কাকাবাবু অন্ধবিশ্বাসের জন্য নিজেই যদি নিজের ক্ষতি করেন, তার জন্যে মহান্তজিকে তো ষড়যন্ত্রকারী বলা যায় না। তার ওপর এখন আবার এই দাঁতের রোগ। নাঃ–মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে। হঠাৎ দেবাশিসের মনে পড়ে যায় হাজরার মোড়ে রঞ্জনের দাদার চেম্বার। উনিও তো দাঁতের ডাক্তার। দেবাশিস পেছন ফিরে সাহস করে হাঁটতে শুরু করে।

চার-পাঁচজন পেশেন্ট বসবার ঘরে অপেক্ষা করছিল। বেয়ারাটা বসতে বলল দেবাশিসকে। কিন্তু সে সটান স্যুইং ডোর ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। অঞ্জনদা–অঞ্জন প্রেসক্রিপশন লিখছিল। ডাক শুনে ঘাড় ফেরাল, কী রে,তুই হঠাৎ?

আর বলো না। দাঁতের ব্যথায় যা কষ্ট পাচ্ছি না। চট করে একবার দেখে দেবে। এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে। দেবাশিস হাত দিয়ে চোয়াল চেপে ধরে।

অঞ্জন উঠে দাঁড়ায়। কই দেখি–কোনখানটায়?

দেবাশিস আঙুল দিয়ে দেখায়, ওপরে পাটির বাঁ দিকটায় বোধহয় কশের দাঁতে।

অঞ্জন পেনসিল টর্চের আলো বুলিয়ে বলে, দূর–কিসসু হয়নি। নিশ্চয় খুব আইসক্রিম সাঁটিয়েছিস। যা যা–ও কিছু নয়।

অঞ্জন গিয়ে আবার প্রেসক্রিপশন লিখতে শুরু করে।

অঞ্জনদা–কী বলছ, এত ব্যথা করছে! নিশ্চয় পোকাটোকা লেগেছে।

 আরে না রে বাবা। একেবারে মুক্তোর মতো দাঁত তোর। আমার দাঁতও বোধহয় তোর মতো ভালো নয়।

ঠিক বলছ অঞ্জনদা? হ্যাঁ

 রে–হ্যাঁ–আগামী দশ বছরেও তোর কিছু হবে না? বুঝলি?

 থ্যাঙ্ক ইউ অঞ্জনদা। চলি—

দেবাশিস বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সন্দেহটা তার অমূলক নয়। ডাক্তার মালাকার মিথ্যে কথা বলেছেন। তার দাঁতের কোনও রোগ নেই। কিন্তু কেন? পয়সা কামাবার ধান্দা! আর মহান্তজিও কি তাঁর প্রিয় শিষ্য বলেই ডাক্তার মালাকারের কাছে সবাইকে পাঠিয়ে দেন? ভেবে লাভ নেই কোনও। শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। তবে সবচেয়ে আগে সত্যসাধন। দেবায়নের উঁচু পাঁচিলের পেছনে কী আছে, সেটা দেখা দরকার। আজই ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখতে হবে।

অ্যাপয়েন্টমেন্টমতো ঠিক সকাল ন-টার সময় সত্যসাধন দেবায়তনের সামনে পৌঁছে গেল দেবাশিস। একজন লোক সবে ভেতর থেকে বেরিয়েছে। একনজরেই মনে হল, ভদ্রলোকের পয়সাকড়ি আছে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েই দেখল তার অনুমান মিথ্যে নয়। রাস্তার মোড়ে একটা কালো অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ড্রাইভার আসতে দেখেই নেমে পড়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোকের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেবাশিস বলে উঠল, ইস, এত সুন্দর ফিগার, কিন্তু তবু দাঁতের রোগে ধরেছে।

কথাটা দেবাশিস আপন মনে বলার মতো করে বললেও বেশ জোরেই বলেছিল। ভদ্রলোক চমকে ঘুরে তাকালেন। দেবাশিস বুঝল, তার দাওয়াই ঠিক জায়গায় পড়েছে। সে মুখ ফিরিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। মাইক্রোফোনে নিজের নামটা ঘোষণা করে পেছনে তাকিয়ে দেখল, ভদ্রলোক তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। বড় গেটের মধ্যে ছোট একটা দরজা খুলে গেল। মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে গেল দেবাশিস।

গেরুয়াধারী নেড়ামাথা একটি অল্পবয়সি ছেলে বলল, এদিকে আসুন। কথাটা দেবাশিসের কানেই ঢুকল না। বিশাল প্রাঙ্গণের চারপাশ ঘিরে পাঁচিলের সঙ্গে লাগোয়া একতলা ঘরের সারি। মাথায় টালির চাল। সামনে একফালি করে বারান্দা। বিশাল একটা পুকুর রয়েছে জায়গাটার ঠিক মাঝখানে। বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িটার মুখে একটা কাঠের ডান্ডার মাথায় ফলক লাগানো রয়েছে–নমর্দা কুণ্ড। ঘাটের ঠিক ডান ধারে ছোট্ট একটা পাকা ঘর জলের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। পুকুরের মধ্যে নেমে গেছে তার দুটো কংক্রিটের পা। ঘরের ঠিক মাঝখানে ঝকঝক করছে শ্বেত-মার্বেলের একটা নিচু সিংহাসন।

গেরুয়াধারী এবার ডাকল, চলুন–আমাদের ওই পুকুরের পেছনের বাড়িটায় যেতে হবে। মহান্তজি ওখানেই সাক্ষাৎ করেন।

দেবাশিস এগতে এগতেই বলল, কী সুন্দর পরিবেশ। মনটা স্নিগ্ধ হয়ে যায়। টলটল করছে পুকুরের জল। আর এত গাছ–অপূর্ব। আচ্ছা, এটা কী?

ঘাটের ধারের ঘরটার দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করে দেবাশিস।

 এটা ধ্যানমন্দির। মহান্তজি এখানে আহ্নিক করেন।

 দেবাশিস আবার প্রশ্ন করে, ওই ছোট বাড়িগুলোয় কারা থাকে?

ওগুলো শিষ্যদের বাড়ি।

 শিষ্যদের? তার মানে বাইরে থেকে অনেক শিষ্য আসে বুঝি?

না, না–বাইরে থেকে আসবে কেন! এঁরা আশ্রমের চিরকালীন শিষ্য।

 তার মানে?

এঁরা এখানেই বসবাস করেন।

দেবাশিস মুহূর্তের জন্যে কী চিন্তা করে দারুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, সত্যি, যত দেখছি, শ্রদ্ধায় আমার মন ভরে যাচ্ছে। আজকালকার দিনে গরিব-দুঃখীদের তো কেউ দেখে না। তবু এরা এখানে যে এমন সুন্দর জায়গা পেয়েছে।

গেরুয়াধারী বলে, এরা যে সবাই গরিব-দুঃখী তা নয়। অনেক নামকরা লোক, বিত্তবান মানুষও আছে। মহান্তজির আশীর্বাদে এঁরা এঁদের সমস্ত সম্পত্তি দান করে দিয়ে এই সেবাকুঠিতে সাধন-ভজন নিয়ে রয়েছেন।

তা-ই নাকি! চমৎকার তো! জানেন, আমার কাকাও বোধহয় এখানে আসবেন।

কী নাম বলুন তো?

শ্রীসৌরেন্দ্রনাথ রায়।

ওঃ হো-বুঝেছি। ওই দেখুন। আপনার ডান ধারের ওই ৪৭ নং সেবাকুঠিটা ওঁর জন্যে ঠিক করা হয়েছে।

দেবাশিস বলল, আচ্ছা ভাই–আমি যদি আপনার মতো এখানে সেবা করতে চাই তাহলে কী করতে হবে?

ছেলেটি হাসল। আপনি শিষ্য হন আগে। তারপর যদি মহান্তজি আশীর্বাদ করেন, চিরশিষ্য হয়ে আসবেন। চিরশিষ্য হয়ে সাধন-ভজনে মহান্তজিকে তুষ্ট করতে পারলে নিশ্চয় গুরুভাই হতে পারবেন।

গুরুভাইরা বুঝি গেরুয়া পরে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এখানে আপনার মতো ক-জন গুরুভাই আছেন?

এখন দশজন। আরও দু-জনের আসার কথা আছে। আমরা এসে পড়েছি, জুতোটা এখানে রাখুন। এই ঘরটায় ঢুকে যান, দেখবেন, ধুতি রাখা আছে। জামা-প্যান্ট ছেড়ে ধুতি পরে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।

দেবাশিস মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ধুতিটা লুঙ্গির মতো জড়িয়ে বেরিয়ে এল।

 এ কী, গেঞ্জি ছাড়েননি?

 গেঞ্জিও ছাড়তে হবে?

নিশ্চয়। সেলাই করা কোনও জিনিস পরনে রাখা চলবে না।

দেবাশিস গেঞ্জিটা খুলে বলল, কিন্তু মেয়েরা কী করবে?

গেরুয়াধারী দেবাশিসের দিকে তাকাল, কেন? শুধু শাড়ি গায়ে যাবে। এটা পবিত্র ধাম। জাগতিক মালিন্য এখানে কাউকে স্পর্শ করে না। চলুন।

গেরুয়াধারী গুরুভাই তাকে নিয়ে লম্বা একটা দালান পেরিয়ে একটা হলঘরে গিয়ে ঢুকল। অন্ধকার ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা চৌবাচ্চার মতো। তাতে কাঠের আগুন জ্বলছে। অগ্নিকুণ্ডের ঠিক সামনে পদ্মাসনে বসে আছে এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি। পরনে তারা সাদা সিল্কের আলখাল্লা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মুখে বিড়বিড় করে কী বলছে আর মাঝে মাঝে ওং স্বাহা বলে ঘি ছিটিয়ে দিচ্ছে অগ্নিকুণ্ডে। অমনি চড়বড় শব্দে আগুনের কয়েকটা শিখা দপ করে লাফিয়ে উঠে তারপর মূল আগুনের শিখা থেকে নিজেকে যেন ছিঁড়ে নিয়ে ওপরে পালিয়ে যাচ্ছে।

গুরুভাইয়ের নির্দেশ অনুসারে হাতজোড় করে বসে পড়ল দেবাশিস। মিনিট পাঁচেক বাদে উঠে দাঁড়ালেন মহান্তজি। গেরুয়াধারী সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে যেতেই তিনি এক পা পিছিয়ে গেলেন।

স্পর্শ করো না–যজ্ঞ সাঙ্গ হয়নি।

গেরুয়াধারী দূর থেকেই প্রণাম সেরে পিছিয়ে দাঁড়াল। দেবাশিসও পদস্পর্শ না করে প্রণাম করল। মহান্তজির নির্দেশে গেরুয়াধারী একটা তামার কুশি থেকে হোমের ফোঁটা পরিয়ে দিল দেবাশিসের মাথায়।

যা বেটা, আজ যা। পরে তোকে ডেকে নেব।

 কিন্তু মহান্তজি, আমি যে পরশু দিন হাওড়া চলে যাচ্ছি। কলেজ খুলবে…

হাঃ হাঃ হাঃ। হাসির দমকে ঘরটা যেন কেঁপে ওঠে। হাওড়া কেন রে, তুই জাহান্নমে থাকলেও তোকে আমি এই স্বর্গধামে টেনে আনব। কোনও চিন্তা নেই তোর–যা! কালই ভাব পাবি, বুঝলি?

মহান্তজি আবার যজ্ঞাসনে বসতেই গেরুয়াধারীর নির্দেশে দেবাশিস তার পিছুপিছু নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।

জানেন, এইটুকু দর্শনে প্রাণ যেন ভরল না। দেবাশিস গুরুভাইকে বলল।

মহান্তজি কাউকেই দু-মিনিটের বেশি সময় দেন না। অপেক্ষা করবেন না–ওঁর সান্নিধ্যে পাঁচ সেকেন্ডও যথেষ্ট।

তা ঠিক। দেবাশিস বলে। তবে, আজ একদম ভিড় ছিল না, এটা আমার ভাগ্য বলতে হবে। কী বলুন।

গুরুভাই ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলে, এটাই ওঁর রীতি। একসঙ্গে দু-জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না।

গেটের কাছে দেবাশিসকে পৌঁছে দিয়ে গেরুয়াধারী বিদায় নিল। দেবাশিস পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে। গেট পেরিয়ে দু-পা যেতে না যেতেই ধবধবে সাদা একটা বিদেশি গাড়ি আসছে দেখল দেবাশিস। সে একপাশে সরে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এলেন অপূর্ব সুন্দরী এক ভদ্রমহিলা। কপালে গোল করে পরা সিঁদুরের টিপ। সিঁথিতে সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। পরনে লালপেড়ে গরদের শাড়ি। গাড়ি থেকেই নামতেই ড্রাইভার তাঁর হাতে শ্বেতপাথরের নৈবেদ্যের থালা তুলে দিল। ভদ্রমহিলা থালা হাতে গেটের ভেতরে অদৃশ্য হবার আগেই দেবাশিস দেখল, তিনি সদ্য স্নান করে এসেছেন। ভিজে চুলের রাশি কোমর অবধি ছড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল, মহান্তজিকে দর্শন করার সময় গায়ে কোনও সেলাই করা পোশাক রাখা যায় না। সারাটা শরীর তার ঘৃণায় শিরশির করে উঠল। দেবাশিস একটু সরে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে পড়ল। ধীরেসুস্থে দু-বার চা খাবার পর ভদ্রমহিলাকে বেরতে দেখল দেবাশিস। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, প্রায় তিরিশ মিনিট তিনি দেবায়তনে ছিলেন। গেরুয়াধারী বলেছিল, মহান্তজি কাউকে দু মিনিটের বেশি সময় দেন না।

অনেক চিন্তাভাবনা করেও কোনও পথ দেখতে পেল না দেবাশিস। একরকম বাধ্য হয়েই কাঁচা দাঁতটা তোলবার জন্যে হাজির হতে হল ডাক্তার মালাকারের চেম্বারে। প্রথমে ভেবেছিল, সঙ্গে কাউকে নিয়ে আসবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিন্তাটা ত্যাগ করতে হয়েছে। সত্যিই যদি মহান্তের সঙ্গে ডাক্তারের কোনও যোগসাজশের ব্যাপার থাকে তাহলে ওরা সতর্ক হয়ে যাবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। বড়জোর পনেরো মিনিট। এর মধ্যে সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছে আশপাশ। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়েনি। এমনকী অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার পরও নয়। ডাক্তার মালাকার সাদা অ্যাপ্রনটা গায়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন। কী ভয় করছে? কোনও ভয় নেই। কই, হাতটা দেখি। বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিতেই ফ্যাকাশে হলদে রঙের একটা তরল ছুচের ফুটো দিয়ে তার কনুইয়ের ওপর দিকে একটা শিরার মধ্যে চালান করে দিলেন তিনি।

এরপর ঘণ্টা চারেকের কথা দেবাশিসের মনে নেই। টেবিলে শুয়ে মাথার ওপর বিরাট বাটির মতো আলোটাকে দেখতে দেখতেই একসময় অ্যানিস্থেশিয়ার সৌজন্যে তার জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তাকাল দেবাশিস। পাশেই অপেক্ষা করছিল নার্স। জ্ঞান ফিরছে দেখেই সে কাচের কাপে আইসক্রিম নিয়ে এল। এটা খেয়ে নিন। অল্প অল্প করে খাবেন।

দেবাশিস উঠে বসল। মাথার পেছন দিকটা টনটন করছে। একটু গা-বমি বমি ভাব। এক চামচ আইসক্রিম মুখে তুলেই তার মনে পড়ে গেল, দাঁত তোলবার জন্যে তো পুরোপুরি অজ্ঞান করে না! মাড়ির মধ্যে শুধু একটা ইনজেকশন দেয় শুনেছে। নার্সের দিকে মুখ তুলে দেবাশিস প্রশ্ন করল, আমাকে কি পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়েছিল?

মৃদু হাসল নার্স। হ্যাঁ। আপনি যা ভিতু।

দেবাশিসের ভুরু কুঁচকে যায়। উত্তর একটা জিবের ডগায় এসেছিল, কিন্তু চেপে গেল। ভিতুদের বুঝি অজ্ঞান না করে করা যায় না?

না। হঠাৎ যদি ঘাবড়ে যায় তাহলে মুশকিল। ওটা আমরা লোক বুঝে করি।

 দেবাশিস আর কথা বাড়ায় না। আইসক্রিম খেতে খেতেই ভাবতে শুরু করে। ওকে অজ্ঞান করে ডাক্তার মালাকার কী করল? একটা আস্ত দাঁত তোলার জন্য ডাক্তারের এত ইচ্ছে কেন, তার রহস্য এখনও ভেদ করা যায়নি। দাঁত তোলার নাম করে অজ্ঞান করাটাই কি আসল উদ্দেশ্য ছিল? কিন্তু অজ্ঞান অবস্থায় এমন কী করতে পারে–হিপ্নোটাইজ– ব্রেনওয়াশ–কোনও সিদ্ধান্তটাই মনে ধরে না।

দেবাশিস বলল, আর কতক্ষণ বাদে যেতে পারব?

 ঘণ্টাখানেক বসুন। ডাক্তারবাবু এলে যাবেন।

নাঃ–আমি বরং এখনই চলে যাই।

নার্স কোনও বাধা দিল না। যদি শরীর খারাপ না লাগে, যেতে পারেন। তেমন কোনও ব্যাপার নয় তো।

তাহলে আমার বিলটা দিন।

বিল তো ডাক্তারবাবু না এলে হবে না। বিলের জন্য চিন্তা কী, পরে পাঠিয়ে দেব।

.

বাড়ি ফিরে বারান্দায় রেলিং-এর ওপর পা তুলে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিল দেবাশিস। মা-বাবা কেউ বাড়িতে নেই এখন। এইটাই সবচেয়ে সুবিধে। সবাই মামার বাড়িতে রয়েছে। মামাবাবুর কোম্পানি বেচে দেবার কথা শোনার পর থেকেই মামিমার মাথায় একটু গোলমালের মতো দেখা দিয়েছে। দেবাশিস একদিনই দেখতে গিয়েছিল। আর তার যাবার কোনও ইচ্ছে নেই। মা এবং মামাবাবু নাগাড়ে মামিমার পেছনে লেগে আছেন, একবার মহান্তজির ওখানে চল। সব ঠিক হয়ে যাবে। মামিমা কিন্তু অসম্ভব জেদি। কারও কথা শুনতেই রাজি নয়। ভাগ্যিস বাবা এখনও মহান্তজির দলে ভেড়েনি, না হলে বোধহয় জোর করেই মামিমাকে টেনে নিয়ে যেত। হঠাৎ দেবাশিসের মনে পড়ে গেল মা ক-দিন আগে বাবাকে বলছিল, তোমার মুখে এত দুর্গন্ধ কেন? এ কথার মানে একটাই। বাবাও ক-দিনের মধ্যে ডাক্তার মালাকারের কাছে যাবে দাঁত তোলাতে। আর তারপর…

কে? দেবাশিস উঠে দাঁড়াল। কানের কাছে কে যেন মোটা গলায় ওর নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু বারান্দায় তো কেউই নেই। ঘরের মধ্যে এসেও কাউকে দেখতে পেল না। আশ্চর্য ব্যাপার। এইমাত্র পরিষ্কার শুনতে পেল, কে যেন তাকে ডাকল। আবার বারান্দায় বেরিয়ে এল। রেলিং-এ কনুইয়ের ভর রেখে দাঁড়াতেই আবার সেই কণ্ঠস্বর কানে এল। মোটা ভারী গলায় স্পষ্ট উচ্চারণ, দেবাশিস! দেবাশিস ঝুঁকে দেখল রাস্তায় কেউ নেই। সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে এল ঘরের মধ্যে। নিশ্চয় কেউ লুকিয়ে আছে। প্রথমেই বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। যদি কেউ থাকে, বেরতে পারবে না। ঘরের মাঝখানে টেবিলের ওপর থেকে পেতলের ফুলদানিটা তুলে নিয়ে শক্ত করে ধরল। কিন্তু কেউই তো নেই। হঠাৎ কাঠের আলমারিটার দিকে চোখ পড়ে। হ্যাঁ, ওটার মধ্যে কারও লুকিয়ে বসে থাকা অসম্ভব নয়। দেবাশিস দু-পা এগিয়ে এসে জোরে চেঁচিয়ে উঠল, বেরিয়ে আয় শালা শয়তান। এবার আর তোর রেহাই নেই। আমি তিন গুনব, তার মধ্যে যদি না বেরস… দেবাশিস দাঁতে দাঁত চেপে গুনতে শুরু করে, এক-দুই-তিন কিন্তু কেউই বেরিয়ে এল না। একলাফে এগিয়ে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে আলমারির পাল্লাটা খুলতেই দড়াম করে তার গায়ের ওপর খসে পড়ল কালোমতো কী যেন একটা। শিউরে উঠে পেছনে সরে এল দেবাশিস। তারপরেই চোখে পড়ল, পশমের তৈরি তার ছেলেবেলার কালো ভালুকটা মাটিতে পড়ে আছে। কয়েক মিনিট সময় লাগল দেবাশিসের ধাতস্থ হতে। পাখাটা চালিয়ে দিয়ে তার তলায় মোড়াটা টেনে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আবার কানে এল সেই গলা, তুমি খুব ভাগ্যবান দেবাশিস। স্বয়ং মহান্তজির আত্মার সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে।

এবার আর চমকে যায় না দেবাশিস। চুপ করে বসে থাকে। ঘরের মধ্যে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে না, কিন্তু কণ্ঠস্বর এই ঘরের মধ্যে থেকেই আসছে। কী হতে পারে? কোথাও কি কোনও মাইক্রোফোন লুকানো আছে? থাকতেও পারে, কিন্তু সেটা খুঁজে বার করা মুশকিল। এত জিনিসপত্রের মধ্যে–সব ভেঙেচুরে দেখতে হবে। আবার সেই কণ্ঠস্বর শোনা যায়, শোন দেবাশিস, কাল প্রভাতে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় তোমার মামিমাকে নিয়ে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। দেবাশিসের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে আমার সঙ্গে মানে মহান্তজির সঙ্গে।

দেবাশিস দু-হাতে মাথা চেপে ধরে। এটা ভয় পাবার ব্যাপার নয়, কিন্তু ভাবতে ভাবতে পাগল হবার উপক্রম হয়েছে তার। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা। এখন বুঝতে পারছে, কেন মা, মামাবাবু–এরা সবাই মহান্তজির অন্ধ-ভক্ত হয়ে পড়েছে। দেবাশিসও যদি সরল মনে মেনে নিতে পারত যে, এটা মহান্তজির দৈবশক্তির ব্যাপার তাহলেই পুরো ব্যাপারটা সহজ হয়ে যেত।

দেবাশিস টেলিফোনটার কাছে এগিয়ে যায়। প্রদীপ যদি বাড়ি থাকে, ওদের ওখানে চলে যাবে। একা একা বাড়িতে থাকা অসম্ভব। তা ছাড়া ঘরের মধ্যে যদি মাইক্রোফোন লাগানো থাকে তাহলে বাইরে বেরলে ওই ভৌতিক কণ্ঠের হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে!

হ্যালো। কে মাসিমা? দেবাশিস বলছি। প্রদীপ আছে… দিন না একটু… প্রদীপ বলছিস? এই শোন, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোদের ওখানে যাচ্ছি। একটা বিশেষ দরকার আছে। কী? না… না–গিয়েই বলব। খুব জরুরি ব্যাপার। হ্যাঁ-হ্যাঁ–এক্ষুনি। ছাড়ছি তাহলে।

ট্যাক্সিতে প্রদীপের বাড়িতে যাবার পথেও বার তিনেক ভৌতিক কণ্ঠস্বর তাকে আহ্বান করেছে। বক্তব্য মোটামুটি একই, দেবাশিস যেন ঈশ্বরের জ্ঞানে মামিমাকে নিয়ে সত্যসাধন দেবায়তনে কাল ভোরে সাড়ে পাঁচটায় হাজির হয়। না হলে কলেজের পরীক্ষায় সে কৃতকার্য হতে পারবে না। দেবাশিস বুঝল, ঘরের মধ্যে মাইক্রোফোন ফিট করার আইডিয়াটাও ধোপে টিকল না।

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে একরকম ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি ভেঙে সে প্রদীপের ঘরে এসে ঢুকল। স্টিরিয়োতে শচীন দেববর্মন চাপিয়ে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বসে ইলেকট্রনিক ওয়ার্ল্ড এর পাতা ওলটাচ্ছিল প্রদীপ। দেবাশিস ঢুকতেই তার চেহারা দেখে সে চমকে গেল। এ কী রে! কী হয়েছে। বস বস–প্রদীপ উঠে দাঁড়াল। শরবত খাবি?

দেবাশিস সজোরে হাত নেড়ে বাধা দিল। আগে তুই বস–অনেক কথা আছে।

প্ৰদীপ একটা মোড়া টেনে নিয়ে দেবাশিসের কাছ ঘেঁষে বসে পড়ল। দেবাশিস একেবারে মামাবাবু ও মা-র মহান্তজির শিষ্যত্ব গ্রহণ থেকে শুরু করল। একটিও প্রশ্ন করেনি প্রদীপ। প্রায় মিনিট পনেরো নাগাড়ে বকে গেল দেবাশিস। শুনলি তো? এবার বল্। তুই নিশ্চয় এটুকু বিশ্বাস করবি যে, আমি কানের কাছে সত্যিই মহান্তজির গলা শুনতে পেয়েছি? আমি তো আর মহান্তজির শিষ্যসংখ্যা বাড়াবার ব্যবস্থা করছি না। কিন্তু এই রহস্যের কূলকিনারাও যে পাচ্ছি না। আমি যদি তোর জায়গায় থাকতাম তাহলে আমার পক্ষেও বিশ্বাস করা কঠিন হত।

প্রদীপ বুঝতে পারে, দেবাশিস ভয় পাচ্ছে যে, ও হয়তো তার কথা বিশ্বাসই করবে না। প্রদীপ বলে, শোন–ওসব কথা থাক। আমি শুধু ক-টা জিনিস মেলাবার চেষ্টা করছি। মহান্তজি একটা ভণ্ড। সে লোকের ঠাকুর-দেবতার ওপর ভক্তির সুযোগ নিয়ে তাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। এ অবধি কোনও অসুবিধে নেই। তারপর আসছে ডাক্তার মালাকার। সব শুনে বোঝা যাচ্ছে, ডাক্তার মালাকার মহান্তজির অ্যাসিস্ট্যান্ট। শুধু তা-ই নয়, বোধহয় সে-ই নাটের গুরু। কারণ তার কাছে দাঁত তোলাবার জন্য না গেলে কেউ মহান্তজির অন্ধ-ভক্ত হতে পারে না। তুই বলছিস, দাঁত তুলিয়ে আসার পর থেকে স্পষ্ট কানের কাছে মহান্তজির কথা শুনছিস। ন্যাচারালি এটা যদি সাধারণ কোনও মানুষের বেলায় ঘটে তাহলে সে হয়তো মহান্তজির নির্দেশে নিজের গলাও কেটে ফেলতে দ্বিধা করবে না।

ঠিক তা-ই।

 কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, কী করে এমন হচ্ছে, তা-ই তো? ডাক্তার মালাকার দাঁত তোলার নাম করে কী করে? প্রদীপ ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।

প্রদীপ! চিৎকার করে ওঠে দেবাশিস। শুনতে পাচ্ছিস?

সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায় প্রদীপ। ভুরু কুঁচকে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে।

 দেবাশিস বলে, শুনতে পাচ্ছিস না?

প্রদীপ একেবারে দেবাশিসের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়।

দেবাশিস বলে, বাস–শেষ। শুনতে পাসনি? দেবাশিস দেবাশিস বলে দু-বার ডেকে তারপর শাসানি দিল। কাল ভোরবেলায় মামিমাকে নিয়ে হাজির না হলে কী কী অমঙ্গল হবে, তার ফিরিস্তি।

প্রদীপ ঘাড় নেড়ে জানাল, সে কিছুই শুনতে পায়নি। দেবাশিস উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, তবে কি তুই বলতে চাস, পুরোটাই আমার মনের বিকার! মরুভূমিতে মরীচিকা দেখার মতো!

প্রদীপ দেবাশিসের পিঠে হাত রাখে। আমি কি একবারও সে কথা বলছি? অত অধৈর্য হলে চলবে না। আমি শুনতে না পেলেই তুই শুনতে পাবি না এমন কোনও কথা আছে কি?

কিন্তু তা কী করে সম্ভব? এত কাছে রয়েছি দু-জনে।

কেন? ইয়ারপ্লাগ লাগিয়ে যখন কেউ রেডিয়ো শোনে, অন্য লোকে কি বুঝতে পারে?

তা ঠিক। কিন্তু ইয়ারপ্লাগ—

হঠাৎ প্রদীপ দেবাশিসের হাত ধরে টান লাগায়। এই, এদিকে আয় তো একবার।

ঘরের ইলেকট্রিক আলোটার তলায় দেবাশিসকে দাঁড় করিয়ে সে হাঁ করতে বলে। নিজে একটা মোড়ার ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে। পকেট থেকে ডট পেনটা বার করে সে মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে বলে, তোর এই দাঁতটা তুলেছে না?

হ্যাঁ।

দাঁড়া একটু। টুল থেকে লাফিয়ে নেমেই প্রদীপ হাঁক লাগায়, মা–ও মা-শিগগির বাবার সন্নাটা নিয়ে এসো তো। ও মা–

কী হল রে? হাঁকডাক লাগিয়ে দিলি কেন? মাসিমা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।

সন্নাটা এনেছ? কই দাও?

 সন্না কী হবে রে?

 মায়ের কথার জবাব না দিয়েই প্রদীপ দেবাশিসের মুখের মধ্যে সন্না পুরে দেয়।

 উঃ- দেবাশিস কাতরে ওঠে।

প্রদীপ সন্নাটা টেনে বার করে নিয়েছে। হুঃ–ডাক্তার মালাকার শুধু তোর দাঁতই তোলেনি–ফিলারও বসিয়েছে।

ফিলার? দেবাশিস অবাক।

এই দেখ। সন্নাটার মুখটায় একটা ছোট্ট টুকরো রয়েছে। দেখল দেবাশিস।

প্রদীপের মা জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে রে…

চুপচুপ হঠাৎ প্রদীপও চেঁচিয়ে ওঠে। সন্না সমেত হাতটা কানের কাছে তুলে আনে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!

দেবাশিস প্রদীপের পাশে আসতেই সে সন্নাটা ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। দেবাশিস সন্নাটা হাতে নিয়েই চমকে যায়। এ কী রে, এটা এরকম কাঁপছে কেন?

প্রদীপ বলে, কাঁপছে না, বাজছে। ভাইব্রেশন খুব অল্প তাই বুঝতে পারছিস না। তোর মহান্তজি কথা বলছে তোর সঙ্গে।

তার মানে?

খুব সোজা। ওটা ফিলার নয়, একটা ক্রিস্টাল রেডিয়ো।

রেডিয়ো? প্রদীপের মা এক পা এগিয়ে আসেন। সে কী রে! দাঁতের মধ্যে রেডিয়ো কী রে?

দাঁড়াও–দাঁড়াও বলছি। মহান্তজি আর মালাকারের শ্রীঘরবাস এবার আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।

দেবাশিস উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, কিন্তু প্রদীপ, ওদের অনেক শিষ্যরই তো এমনি দাঁতের মধ্যে রেডিয়ো লাগানো আছে। আমার নাম করে ডাকলে তো সবাই সেই একই কথা শুনতে পাবে। তাহলে তো আর…

তা কেন? প্রদীপ বাধা দেয়। যখন রেডিয়োর বিবিধ-ভারতী শুনিস, তখন কেউ হয়তো কলকাতা-ক শুনছে বা কলকাতা-খ। এ-ও ঠিক তেমনি। তোর জন্যে যে নির্দেশ, সেটা শুধু তুই-ই শুনতে পাবি। এই সেটগুলো ওরা সেইভাবেই টিউন করে রেখেছে। ট্রান্সমিটার থেকে বিশেষ বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বার্তা পাঠায়।

তার মানে তুই বলতে চাস, ওদের ট্রান্সমিটিং স্টেশনও আছে? দেবাশিস প্রশ্ন করে।

আলবত–নিশ্চয় আছে।

প্রদীপের মা সব কথা না শুনলেও খানিকটা আন্দাজ করে নিয়েছে এর মধ্যেই। তিনি ভীত হয়ে ওদের কাছে এগিয়ে আসেন। ফিসফিস করে বলেন, তোরা একটুও চেঁচামেচি করিসনি এখন। সব জানাজানি হয়ে গেলে মুশকিল। প্রদীপ, আমি তোর বাবাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সব আলোচনা করে যা ব্যবস্থা নেবার নিস।

প্রদীপের মা বেরিয়ে যেতেই দেবাশিস বলল, মাসিমা ঠিকই বলছেন। বেটাদের হাতেনাতে ধরতে হবে। একেবারে ট্রান্সমিটার সমেত। সাবধান! না হলে পাখি উড়ে যাবে।

[প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাস্টিক, ১৯৭৯ সেপ্টেম্বর]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *