২. ভৌতিক কামান

০২. ভৌতিক কামান

নিলয়ই পরিচয় করিয়ে দিল, মাস্টারমশাই। এঁর কথাই বলছিলুম তোকে।

লোকটাকে শুধু শুধু রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে নিলয়।

–আপনি এই রাস্তায় না দাঁড়িয়ে তো…।

–সে কী, আমি বলিনি নাকি! উনি কিছুতেই রাজি নন।

 মাস্টারমশাই অল্প হেসে বললেন, সত্যি বলতে, ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত যে, নিজের কাছেই অনেক সময় অবিশ্বাস্য ঠেকে। তাই নিলয়বাবুকে সাক্ষী মেনেছি। আমি যে পাগল নই, সেটা অন্তত উনি জানেন। ওঁর এক সহকর্মী এককালে আমাদের গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়িয়েছিলেন। সেই সুবাদেই মিস্টার সেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য….

-ঝন্টুমামাকে আপনি চেনেন?

–চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি, কিন্তু বাসন্তী ও গোসাবার ওদিকে কে-না ওঁর নাম শুনেছে! একবার রাতদুপুরে সরকারি স্পিডবোট চুরি করে নিজে চালিয়ে একজন কলেরা রুগিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। শোনেননি সে কথা?

আমি নিলয়ের দিকে তাকালাম। ঝন্টুমামাকে লেখক বানাবার অপচেষ্টার পর মাত্র মাসখানেক আসিনি, তারই মধ্যে ঝন্টুমামার কত কীর্তি মিস করেছি কে জানে।

ঝন্টুমামার ঘরে পা দেওয়ার আগেই চোখে পড়ল, আদিদাস আসছে। তার হাতে ট্রে-র ওপর চার কাপ চা।

জিজ্ঞেস করলাম, কে এসেছে হে? চা নিয়ে যাচ্ছ?

–আপনারা এসেছেন।

আদিদাসের মুখভরা হাসি। নিলয়ের দিকে তাকিয়ে সে যোগ করল, আপনাদের লেট কামিং হয়েছে। স্যার হারি করছেন। অন্য কাজ আছে।

আড়চোখে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকালাম। আদিদাসের ইংরেজি শুনে অপরিচিত কেউ হেসে ফেললে তার কপালে বিপদ আছে। না, মাস্টারমশাই নিজের চিন্তাতেই মগ্ন।

নিলয় বলল, তার মানে আমাদের আসতে আরও দশ মিনিট দেরি হলে–

–ঢকঢক করে কোল্ড চা খেতে হত!

আদিদাসের হাসি দেখে গা জ্বলে গেল। খেতে হত না, তোর মাথায় ঢালতাম! বুঝলি! নে, চল এখন।

ঝন্টুমামা ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের উপস্থিতির কথা জানানোর পরে আমাদের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। আমরা ভাঙা ব্যাটারির টুল টেনে বসে পড়েছি, মাস্টারমশাই বসেছেন গদিওয়ালা সিটে।

পরিচয়পর্ব শেষ হলে চায়ের কাপ হাতে মাস্টারমশাই শুরু করলেন তাঁর কাহিনি। ক্যানিঙের লঞ্চঘাট থেকে স্টিমারে ঘণ্টাখানেকের পথ। নৌকোতেও যাওয়া যায়, তবে সময় লাগে বেশি। মানে সুন্দরবন এরিয়ার ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রায় পা ঘেঁষে একটা ছোট্ট বসতি। রিফিউজিরাই প্রথম আস্তানা গাড়ে। তা-ও দেখতে দেখতে বছর কুড়ি হয়ে গেল। নাম দিয়েছে নিশ্চিন্তিপুর। না সেই পথের পাঁচালীর নিশ্চিন্তিপুর নয়। চিন্তার হাত থেকে রেহাই না পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের বহু জনবসতিই নিজেদের নাম দিয়েছে নিশ্চিন্তিপুর। গত কুড়ি বছর ধরে এলাকাটায় শুধু উদ্বাস্তুরাই বাস করছে ঠিকই, কিন্তু বহুকাল আগে এখানে যে লোকের বসবাস ছিল, তার প্রমাণ আছে। বেশ জমকালো প্রমাণ। প্রায় দেড় দুশো বছরের পুরানো জরাজির্ণ একটা প্রাসাদ। হ্যাঁ, বাড়িটা একতলা হলেও, প্রাসাদই বলতে হবে। তিনমহলা বাড়ি, চারধারে গোলাকার থাম আর খিলান সমেত বারান্দা। প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু এক-একটা দরজা। অবশ্য দরজা-জানলার পাল্লার কাঠ বহু আগেই চুরি গেছে। বাড়িটার আরেকটি দেখবার মতো জিনিস তার প্রবেশপথের ধারে একটি কামান। মাটি থেকে প্রায় পনেরো ফুট উঁচু ভিতের ওপর থেকে প্রধান সিঁড়িটা নিচে নামতে নামতেই ক্রমেই প্রসারিত হয়ে তারপরে দু-ধারে যেন কুণ্ডলীর মতো গুটিয়ে গেছে। সেইখানে একপাশে একটা স্তম্ভের সামনে আছে কামানটা। দেখলেই বোঝা যায় কামানটিকে খুঁড়ে তোলার জন্য অনেকবার বৃথা চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা এমনভাবে গেঁথে বসানো যে সহজে তোলা সম্ভব নয়। সত্যি বলতে উদ্বাস্তুরা প্রথমে এই পোডড়া বাড়িটিতেই আস্তানা গেড়েছিল। তারপর বছর দশেক আগে বাড়ির একটি অংশ হঠাৎ ধসে পড়ে। তিনজন মারা যায়। তখন বাড়ি ছেড়ে প্রায় পনেরো-কুড়িটা পরিবার ওই জমিদার বাড়িরই প্রাঙ্গণে ভাঙা পাঁচিলে পিঠ ঠেসিয়ে জোড়াতালি দিয়ে এক-একটা মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে। কালক্রমে আরও অনেক লোক এসেছে। বর্তমানে সেখানে কম করে চল্লিশটি পরিবারের বাস।

ঝন্টুমামা প্রশ্ন করলেন, এই জমিদার বাড়ির চত্বরের মধ্যেই সবাই গাদাগাদি করে আছে কেন? ছড়িয়ে-ছিটিয়ে…

মাস্টারমশাই বললেন, মিষ্টি জলের পুকুর। একটামাত্র মিষ্টি জলের পুকুর আছে ওই বাড়ির লাগোয়া অঞ্চলে। আর সবই নোনা জল…

মাস্টারমশাই মূল কাহিনিতে ফিরে এলেন, মাসখানেক আগের কথা। সেদিন রবিবার। সকালবেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ হঠাৎ প্রচণ্ড এক গর্জনে শিউরে উঠল সবাই। তারপরেই চিৎকার, আতনাদ, কান্না–ভয়ে দিশাহারা মানুষ বুঝতেই পারছে না কী থেকে কী হল! জমিদার বাড়ির গেটের ঠিক উলটো দিকে আধভাঙা পাঁচিলের সঙ্গে লাগোয়া মাধবদের ঘরের একটা দেওয়াল পুরো উড়ে গেছে। পুরানো পাঁচিলেরও একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। বিস্ফোরণের কারণ ও উৎস ধরা পড়ার পর উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেল। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলল, ওই পুরানো কামানটা হঠাৎ গর্জে উঠেছিল। কথাটা যে মিথ্যে নয় তা কামানের নলে হাত রেখে ও গন্ধ শুঁকেও সকলে বুঝতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচামিচি শুরু হয়ে গেল, এ নিশ্চয় জীবনময়ের কাণ্ড। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে সকলে ভিন্ন ভিন্ন দলে ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। জীবনময় বা তার কোনও শাগরেদ নিশ্চয়। আছে ধারেকাছেই কোথাও। হাঁটা পথে ছাড়া এ অঞ্চল থেকে পালাবার কোনও উপায় নেই। অন্তত মাইল তিনেকের আগে তো নয়ই। কিন্তু তবু সকলের দৃঢ় ধারণা–এর পেছনে জীবনময় আছে। সন্দেহ করার কারণও যে নেই তা নয়। এই বাড়ি ও জমির আইনমাফিক মালিক ওই জীবনময়। জীবনময়েরা দু-পুরুষ এই বাড়ি বা জমির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখলে কী হয়, উদ্বাস্তুদের ঘাঁটি গাড়ার প্রথম খবর পাওয়ামাত্রই সে তার মালিকানা জাহির করার চেষ্টা করেছিল। জনা কুড়ির এক ভাড়াটে লেঠেলদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধও একবার হয়েছে। তা ছাড়া এই বাড়ির ছাত ধসে পড়ে কয়েকজনের মৃত্যুর জন্যও লোকে জীবনময়কে দায়ী করে। বাড়ির মেরামতির কাজ করবে, বাড়িতে নিজে বসবাস করবে ইত্যাদি বলে সে নাকি মিস্ত্রিদের দিয়ে কী সব কারসাজি করেছিল। তারই ফলে ছাত ভেঙে পড়ে। এবারেও নাকি কামান গর্জে ওঠার দিনকয়েক আগে জীবনময় একদিন এসেছিল। ক্যানিঙের পুলিশকর্তা মিস্টার সিনহার কাছে স্বয়ং মাস্টারমশাই দেখা করেছিলেন। মানুষটি বিবেচক। জীবনময় সম্পর্কে তার ফাইলের রিপোের্টও ভালো নয়। কিন্তু একটা লোক একটা দেড়শো বছরের পুরানো কামানের কাছে ঘোরাফেরা করেছে, তার জন্যে সাত দিন বাদে সেই কামানটা গর্জে উঠেছে–এমন অভিযোগ তো আর টেকে না। তবু সব শুনে মিস্টার সিনহার নির্দেশমতো জীবনময়কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হয় বউবাজার থানায়। ওইখানেই এক ভাড়া বাড়িতে বাস করে জীবনময়। থানা লক-আপে এক রাত কাটায় জীবনময়। প্রথম কামান গর্জনের দশ দিন পরে বেলা আড়াইটে নাগাদ, জীবনময় তখনও বউবাজার থানায়, আরেকবার গর্জে উঠল সেই কামানটা। হ্যাঁ, সেই আগের কামানটাই। ভাগ্য ভালো যে কেউ সামনে পড়েনি। বলাই বাহুল্য যে, এরপরে আর জীবনময়কে আটকে রাখার কোনও মানে হয় না। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, প্রথমবারের কামান গর্জনের পর থেকেই নিশ্চিন্তিপুরের বাসিন্দারা দল বেঁধে পালা করে নিশিদিন পাহারা দিচ্ছে। জীবনময় দূরের কথা, একটিও অপরিচিত লোক ওই কামানটির ধারেকাছে ঘেঁষেনি। তাহলে আপনা হতে কামানটা আবার গর্জে উঠল কী করে? দলে দলে লোকে তল্পিতল্পা বেঁধে ঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করল। তাদের মতে ওই ভৌতিক কামান আবার যে কোনও সময়ে গর্জে উঠতে পারে। এর মধ্যে অপদেবতার হাত আছে। কিছু লোক বোঝাবার, বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। পাঁচ-সাত ঘর ছাড়া সবাই উঠে গেছে। এরাও কতদিন থাকতে পারবে বলা শক্ত। কারণ, জীবনময় সুযোগ বুঝে আবার হামলা শুরু করে দিয়েছে।

মাস্টারমশাই থামলেন।

আমরা ঝন্টুমামার দিকে তাকালাম। এসব কুসংস্কারঘটিত ব্যাপার নিয়ে ঝন্টুমামা কি সময় নষ্ট করতে চাইবে? শুনে তো গাঁজাখুরি গল্প বলেই মনে হচ্ছে।

ঝন্টুমামা খইনির মতো তামাক দলে কাগজের মধ্যে ভরে সিগারেট পাকিয়ে জিবের সামনে মাউথ অর্গান নাড়ার মতো এক টানে ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, কাল সকাল আটটায় ক্যানিং স্টেশনে থাকবেন। নিজে একবার দেখে আসতে চাই।

ঝন্টুমামার গামবুট পরা দেখে আমরা দুজনেই মনে মনে হেসেছিলাম। কিন্তু ক্যানিঙের দু-নম্বর লঞ্চঘাট থেকে জল-ভটভটি চড়ে আমাদের যাত্রা যে এমন জায়গায় এসে থামবে, কে জানত?

ঘাটটাট কিছু নেই?–জানতে চাইলাম।

-ঘাট আবার কী? যেখানে নৌকো ভেড়ে, সেখানেই ঘাট।–ঝন্টুমামা থকথকে কাদা ভেঙে পাড়ে উঠতে উঠতেই বললেন। কাদাতে যদি এতই ভয় তাহলে নৌকোতেই অপেক্ষা কর।

অগত্যা প্যান্ট গুটিয়ে জুতো খুলে রেখে নামতেই হল।

যেতে যেতেই নিলয় বলল, এখানকার নদীনালাগুলো যেন বউবাজারের গলি যুঁজির মতো। সেখানে নীল-লাল নাইলনের জাল হাতে চিংড়ির পোনা ধরার জন্য তোক নেই শুধু এই যা, না হলে বর্ষার দিনে….

মিনিট দশেক হাঁটার পর চোখে পড়ল, ফাঁকা মাঠের ধারে তিনটে সিটবিহীন মাল-টানা সাইকেল রিকশা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। মাস্টারমশাই আমাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। নিলয়ের সঙ্গে আমি একটাতে চড়ে বসলাম। অবশ্য একে বসা বলা ঠিক নয়। ঠ্যাং ছড়িয়ে একপাশে কাত হয়ে বসা। রিকশা চলতে আরম্ভ করল। পেছনে তাকিয়ে দেখি ঝন্টুমামার চোখের সামনে ক্যামেরা। মুখটা ঘুরিয়ে নিতে যাব, তার আগেই ছবি উঠে গেল।

–দেখলি নিলয়, কাণ্ডটা!

–আমার তো মনে হচ্ছে, ঝন্টুমামা এই রিকশায় উঠবে না।

 –তাহলে আমরাও নেমে পড়ি, কী বল?

ভাড়া মিটিয়ে রিকশা বিদায় করে সকলে মিলে হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম তোপওয়ালা বাড়িতে। নিশ্চিন্তিপুর বললে যারা চিনতে পারে না, তারাও নাকি তোপওয়ালা বাড়ি বললেই জোরসে বার তিন চার মাথা নেড়ে ফেলে।

অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ল, একটা টিলার মাথায় ভাঙাচোরা দুর্গের মতো একটা অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে। আরও কয়েক পা এগতেই বাড়ির ছাতের মাথায় একটা গম্বুজাকার ঘর দেখা গেল, তার আশপাশ দিয়ে বেশ কিছু গাছ গজিয়েছে, সেই গাছগাছালির শিকড়ের সুবাদেই ছাতে-ওঠা সিঁড়ির মাথার এই ঘরটা এখনও ঘাড় নোয়াননি। আমরা উত্তর মুখে এগচ্ছিলাম। বাড়ির মূল ফটকের দিকে।

নিলয় হঠাৎ প্রশ্ন করল, আচ্ছা, সেই কামানটা যদি হঠাৎ এই মুহূর্তে আবার গর্জে ওঠে?

-তাহলে আমরা সবাই এই মুহূর্তেই স্পট ডেড। মাস্টারমশাই হাসতে হাসতেই বললেন। তবু কেন যেন শরীরের মধ্যে শিরশির করে উঠল।

মাস্টারমশাই আবার বললেন, প্রথমবারের আচমকা কামান দাগার পর থেকেই কেউ আর এই পথটা ব্যবহার করছে না। সেই জন্যেই এতক্ষণে কোনও লোকের দেখা পাননি। অবশ্য অনেকেই রাতারাতি ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এই যে, এই দেখুন

হঠাৎ মাস্টারমশাইয়ের শান্ত কণ্ঠেও উত্তেজনা ধরা পড়ে। তিনি আঙুল তুলে মাটির ওপর একটা গর্ত দেখান, যেখানে গোলা এসে পড়েছিল। পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেছে।

কম করে ছ-পাউন্ডের গোলা তো বটেই–বিড়বিড় করে বলেন ঝন্টুমামা।

দূর থেকেই রেডিয়ো বাজার শব্দ পেয়েছিলাম। এবার জনা চারেক বাসিন্দারও সাক্ষাৎ পেলাম। দু-চারটে প্রশ্ন শুরু হতেই মাস্টারমশাই তাদের বারণ করলেন। এখন কাজের সময়। যা বলার, সে তো মাস্টারমশাই বলেছেন। মাস্টারমশাইয়ের ওপর সকলেরই আস্থা আছে।

তারা সবাই দশ-বারো পা পিছিয়ে দাঁড়াল। ট্রানজিস্টার রেডিয়োটাও বন্ধ করে দিয়েছে।

ঝন্টুমামা কামানটাকে নিরীক্ষণ করছেন। আমরা পাশে এসে দাঁড়ালাম।

কামানের মুখের কাছে উঁকি মেরেই ঝন্টুমামা আমার কাছে টর্চ চাইলেন। টর্চের আলো পড়তেই ঝন্টুমামা বলে উঠলেন, অপূর্ব!

আমরাও সকলেই মাথা নিচু করে দেখলাম। অপূর্ব কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না।

মাস্টারমশাই বললেন, মিস্টার সেনের চোখে কি অস্বাভাবিক কিছু পড়ল?

-না, অস্বাভাবিক নয়, তবে অপ্রত্যাশিত।

 ঝন্টুমামা কিটব্যাগ থেকে একটা ছুরি বার করে কামানের গা-টা চাঁচতে শুরু করলেন। মিনিট তিনেকের মধ্যেই ওপরের কালো পরদার তলায় হলদে আভা চোখে পড়ল।

–পেতলের কামান!

বলেই ভয়ে ভয়ে তাকালাম ঝন্টুমামার দিকে। না, বোধহয় শোনেননি। কারণ তিনি এখন হামাগুড়ি দিচ্ছেন পায়ের কাছে। আর মাঝে মাঝে বিভিন্ন ভঙ্গিতে কামানের দিকে তাকাচ্ছেন, তার গায়ে হাত বোলাচ্ছেন।

–এক টুকরো কাগজ দাও!

ঝন্টুমামা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে আদেশ করলেন। ভুরু কুঁচকে মাটির দিকেই চেয়ে আছেন।

কাগজের টুকরো হাতে নিয়েই ঝন্টুমামা হাঁটুর ওপর ভর রেখে বসে পড়লেন মাটির উপর। নিচু হয়ে দেখি, ভাঙা ভাঙা গুঁড়ো গুঁড়ো কাচের টুকরো তুলছেন। আমাদের দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়ে বললেন, তোমরা মাস্টারমশাইয়ের সাহায্য নিয়ে কামানটাকে সাফ করার চেষ্টা কর। চেচে, চেচে।

বুঝলাম, ঝন্টুমামা আপন মনে থাকতে চান। অবশ্য কামান পরিষ্কার করার ব্যাপারে আমাদের পরিশ্রম করতে হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দারাই মহা উৎসাহে ছুরি, খুরপি নিয়ে কাজে লেগে পড়ল।

আধ ঘণ্টা পরের কথা। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি কারুকার্য করা একটা পিতলের কামানের দিকে। সারা গায়ে লতাপাতার নকশা। কামানের মুখের কাছটা একটা দানবের মাথা, যার কানগুলো সুচালো আর ঠোঁটগুলো কুমিরের মতো। কামানের কিছু লেখাও ছিল, কিন্তু হরফগুলো বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে একধারে একটা নামের অংশ শুধু পড়া গেল, কিশোর দাস দে কর্মকার।

ঝন্টুমামাকে ডেকে দেখাতে যাব, তার আগে তিনিই হাঁক পাড়লেন, এদিকে এসো– আসুন–আয় সবাই।

নেপোলিয়নের মতো ডান হাতটা পেটে কলিক পেন ওঠার জায়গার ওপর চেপে ধরে তিনি গোঁফ দিয়ে হাসিকে ফিলটার করছেন। দেখলেই পিত্তি জ্বলে যাবে।

ভাঙা কাচের টুকরোগুলো তিনি কাগজের ওপর সাজিয়ে রেখেছেন। চশমার কাচের মতো গোলাকার আকৃতি ধারণ করেছে সেটা, যার কেন্দ্রীয় অংশটি চারপাশের তুলনায় বেশি পুরু।

ঝন্টুমামা বললেন, তোপের গর্ভে অগ্নিসংযোগ করেছিল এই বস্তুটি।

 আমরা এ ওর মুখের দিকে চাইছি।

ঝন্টুমামা বললেন, কামানের পেছন দিকে যে অংশে বারুদ পোরা হয়, তাকে বলে গর্ভ। গর্ভর সামনের দিকে থাকে নালি। যা-ই হোক, এই যে এখানে দেখছ, এটি একটি উত্তল লেন্স। এর সাহায্যে সূর্যরশ্মিকে ঘন করে বারুদে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল।

তার মানে আতসকাঁচ দিয়ে যেমন আমরা কাগজে আগুন ধরাই। তা-ই না?

আমার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাটাকে কোনও পাত্তা না দিয়েই ঝন্টুমামা বলে চলেন, এখন নিশ্চয় ব্যাপারটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার? জীবনময় বা তার শাগরেদরা কোনও একসময়ে এখানে এসে কামানের মধ্যে বারুদ ভরে, গোলা ভরে, তারপরে ঠিক জায়গামতো, লোকচক্ষুর আড়ালে লেন্স ফিট করে পালায়। তারপর, একদিন সূর্যের আলো ঘন হয়ে ঠিকমতো জায়গায় একটা বারুদ মাখা পলতেকে জ্বালিয়ে দিল। পলতেটা পুড়তে পুড়তে কামানে অগ্নিসংযোগ করল। তখন কিন্তু জীবনময়রা বহু দূরে। এমনও হতে পারে যে, ঠিক কবে বা কখন কামান গর্জে উঠবে, তা বোধহয় জীবনময়ও জানত না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, জীবনময়ের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান…।

মাস্টারমশাই বলে উঠলেন, উনি তো পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন।

-তাহলে তো মিলেই যাচ্ছে।

–কিন্তু মিস্টার সেন, আপনি বলছেন বটে, সবই মানছি, কিন্তু এই কামানটা দ্বিতীয়বার তাহলে কী করে গর্জে উঠল? বিশ্বাস করুন, প্রথমবার কামানটা গর্জে ওঠার পর আমরা সকলে মিলে পালা করে দিবারাত্তির পাহারা দিয়েছি। পুলিশও ছিল কয়েকদিন। তার মধ্যে কাকপক্ষীর পক্ষেও তো কামানের ধারেকাছে ঘেষার…

–ঘেঁষেনি। কেউই ঘেঁষেনি। জীবনময় বা যে-ই এসে থাক, একবারই এসেছিল। তখনই যা বারুদটারুদ ভরার কাজ সেরে গেছে। এদিকে আসুন, দেখিয়ে দিচ্ছি। তখন যে অপূর্ব বলেছিলাম, মনে আছে? এই যে–এই জিনিসটা দেখে। বুঝতে পারছেন? হ্যাঁ– এটা দোনলা তোপ। খুবই দুর্লভ একটি কামান। এর ভেতরে দুটি নল আছে, যা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। প্রত্যেকটা নলের সঙ্গে সংযুক্ত একটি করে গর্ভ, যাতে বারুদ ঠাসা হয়। জীবনময় দুটি গর্ভেই বারুদ ঠেসেছিল এবং দুটি গর্ভের জন্য দুটি লেন্স ফিট করে রেখেছিল। কিন্তু লেন্স দুটি ফিট করা হয়েছিল ভিন্ন কোণে, যাতে প্রথম লেন্সটির সাহায্যে অগ্নিসংযোগ করার কিছুদিন পরে দ্বিতীয়টি নির্দিষ্ট স্থানে সূর্যের আলোকে ঘনীভূত করে।

সুর্যের পরিবর্তনশীল অবস্থানকে কাজে লাগানো আর কী। আপনারা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন প্রথমবার কামান গর্জনের পর। না হলে ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে নিশ্চয় কামানের তলায় ওই ভাঙা স্তম্ভের পাশটিতে উত্তল লেন্সটিকে আবিষ্কার করতে পারতেন।

আচ্ছা, লেন্সগুলো ভেঙে গেল কী করে?–নিলয়ের প্রশ্নটা বেশ বুদ্ধিমানের মতো।

–আমার ধারণা, সে ব্যবস্থাও জীবনময়ই করেছিল। লেন্সটাকে সে এমনভাবে কোনও ফ্রেমের মধ্যে আটকেছিল, যাতে কামান গর্জে উঠলেই সেই ফ্রেমটার ভাইব্রেশনের ফলে…

তার মানে প্রথমবার কামান গর্জনের পরে একটা লেন্স ভেঙেছিল। তারপরে দ্বিতীয়বারের কামান গর্জনের পর দ্বিতীয় লেন্সটাও…

-হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।

–তাহলে মিস্টার সেন, এখন আমাদের কি করণীয়?

–আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলে দেখি, কীভাবে জীবনময়ের বিরুদ্ধে আইনসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আপনারা কিন্তু আগের মতোই পালা করে পাহারা বসিয়ে রাখুন, কামানটার ওপর নজর রাখা দরকার।

নিলয়ে বলে উঠল, পেতলের জিনিস যখন…

–না। পেতলের জিনিসের চেয়েও এটা মূল্যবান। এটা সম্ভবত নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর আমলে তৈরি হয়েছিল। বাঙালি কারিগর ব্রজকিশোর দাস দে কর্মকারের এমনই আরেকটা অষ্টাদশ শতাব্দীর কামান আছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। অবশ্য সেটা দোনলা নয়।