ইন্সমাউথের ইশারা

ইন্সমাউথের ইশারা (THE SHADOW OVER INNSMOUTH)

[ লাভক্র্যাফটের সেরা লেখাগুলির মধ্যে এই গল্পটিতে নিউ ইংল্যান্ডের একটি অখ্যাত গ্রামে অজানা জাতির অমর জীবদের গল্প বলা হয়েছে। লাভক্র্যাফটের নিজের লেখা থেকে পরে জানা যায় গল্পের কথক রবার্ট ওল্মস্টেডের জীবন কীভাবে এক ভয়ংকর অতীতের ছায়ায় অচেনা অন্ধকারে ডুবে যায়। ভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে মিলনে লাভক্র্যাফটের ঘোর আপত্তি থাকলেও গল্পে সেটা ছাপিয়ে মানুষের লোভ ও অমরত্বের লালসাই প্রধান হয়ে উঠেছে।]  

০১.

১৯২৭-২৮ সালের শীতটা মনে আছে আপনাদের? ওই বছর ম্যাসাচুসেটসের পুরোনো বন্দর ইঙ্গমাউথে একটা রহস্যময় অপারেশন চালিয়েছিল ফেডারেল এজেন্সিগুলো। ব্যাপারটা সামনে আসে ফেব্রুয়ারি মাসে। ব্যাপক হারে ধরপাকড়, সমুদ্রের লাগোয়া অতগুলো বাড়িকে শুধু জ্বালানো নয়, একেবারে ডিনামাইট দিয়ে ওড়ানো… এগুলো অনেকেরই মনে আছে। লোকে ভেবেছে, এগুলো বেআইনি মদের ভাঁটি ভাঙা বা চোরাচালানের আড্ডা ভেস্তে দেওয়া ছাড়া কিছু না। তবে হ্যাঁ, এত লোক গ্রেফতার হল, অথচ কাউকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হল না– এটা ভাববার মতো, তাই না?

ওখানে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। বোঝেনই তো, সব অপরাধীকে তো আর আইনের সামনে আনা যায় না, কোর্টে দাঁড়িয়ে মিলর্ড বলে চ্যাঁচানোর সুযোগও দেওয়া যায় না। তাদের জন্য আর্মি আর নেভির কিছু ব্যবস্থা থাকেই। ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের ডেরা হয়েছিল সেই জায়গাগুলোই। সে জন্যই তো শহরটা এখনও প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। এমনকী প্রেসের লোকেরাও ইসমাউথে ঠিক কী হচ্ছিল, বা কারা সেখানে ছিল– এগুলো জানার পর কেসটা চেপে দেয়। তবে কিছু খবর তো বেরিয়েই যায়। এক সাংবাদিক দাবি করেছিল, নেভির সাবমেরিন থেকে নাকি ডেভিলস রিফের পাশের গভীর খাতটায় টর্পেডো ফায়ার করা হয়েছিল ওই সময়। সেটাকেও তখন নেভির এক্সারসাইজ বলেই চালিয়ে দেওয়া হয়। তারপর একটু একটু করে সব কথা সমুদ্রের নোনা হাওয়া আর বালির তলায় চাপা পড়ে যায়।

ঠিক কী হয়েছিল ওখানে, সেটা খুব কম লোকই জানতে পেরেছিল। আশপাশের এলাকায় যারা থাকে, তারা বাইরের লোকের সামনে মুখে তালা দিলেও নিজেদের মধ্যে বিস্তর গজগজ করেছিল। তবে তারা নিজেরাও সত্যিটা পুরোপুরি জানত বলে মনে হয় না। ডাঙার দিকে জলাজমি আর রুক্ষ পাথুরে এলাকা ইঙ্গমাউথকে আশপাশের এলাকা থেকে আলাদা রেখেছিল অনেক দিন। শহরটা, আর সেখানে যারা থাকে, দুটোকেই এড়িয়ে চলার একটা অভ্যাস ম্যাসাচুসেটসের পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল।

তবে আমি জানি, কী হয়েছিল ওখানে। যা জানি, সেটা লিখছি। এর চেয়ে বেশি জানতে চাইবেন না, কারণ সেটা আপনাদের পক্ষেও বিপজ্জনক হতে পারে।

১৬ জুলাই ১৯২৭ আমিই ইন্সমাউথ থেকে পালিয়েছিলাম। আমারই কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রথমে কয়েকজন, তারপর একটা সংস্থা, শেষে সেনাবাহিনী ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করে। এত দিন মুখ বন্ধ করে ছিলাম অনেক কারণে, তবে এখন সেগুলো অর্থহীন।

তাহলে বলি?

পড়াশোনা সেরে বড় হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়েছি তখন। ঠিক করলাম, নিউ ইংল্যান্ডের একটু কম-জানা, কম-চেনা জায়গাগুলোয় ঘুরতে যাব। স্রেফ ঝাঁকিদর্শন নয়, বরং স্থানীয় ইতিহাস, সমাজ, আচার-ব্যবহার– এসব দেখা-বোঝাও আমার লক্ষ্য ছিল। সমস্যা হল পয়সাকড়ি নিয়ে। বুঝতেই পারছেন, তখন আমার সংগতি কেমন ছিল। ট্রেন, বাস, ছোটখাটো কোচ– এসবের ভরসাতেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছিলাম আমি। ঠিক করেছিলাম, ট্রেনে চেপে নিউবারিপোর্ট থেকে আর্কহ্যাম যাব। টিকিটের ভাড়া শুনে চোখ কপালে উঠল। স্টেশন এজেন্ট ভদ্রলোক বোধহয় স্থানীয় নন। আমার অবস্থা দেখে একটু ইতস্তত করে তিনি বললেন, আপনি পুরোনো বাসটা নিতে পারেন।

পুরোনো বাস?

 হ্যাঁ। সেইরকম দ্বিধাভরেই ভদ্রলোক বললেন, তবে বাসটা ইন্সমাউথের মধ্য দিয়ে যায়। এখানকার কেউ, এমনকী আর্কহ্যামের কোনও বাসিন্দাও ওটাতে চড়ে না। প্রায় ফাঁকাই দেখেছি ওটাকে। শুধু ইসমাউথে কারও নামার থাকলে সে-ই চড়ে ওতে। বাসটা চালায়ও জো সার্জেন্ট বলে একজন ইন্সমাউথের লোক।

বাসটার ভাড়া কি খুব বেশি? মানে ফাঁকা থাকে বলে জানতে চাইছি।

আরে না না! ভদ্রলোক হেসে বললেন, একেবারে লজঝড়ে জিনিস। ওর টিকিটের দর খুব কম। হ্যামন্ডের দোকানের সামনে থেকে বাসটা দিনে দু-বার ছাড়ে। সন্ধে সাতটায়, আর সকাল দশটায়। ওতেই যান বরং।

আমি সেই প্রথম ইন্সমাউথের নাম শুনলাম। ভাবলাম, আর্কহ্যাম যাওয়ার পথেই যখন পড়ে, তখন ওখানে থেমে জায়গাটা একটু দেখে-শুনে যাব কি না। এজেন্টের কাছেই জায়গাটা নিয়ে জানতে চাইলাম। টিপিক্যাল শহরের লোক যেভাবে গ্রামের বর্ণনা দেয়, সেভাবেই ভদ্রলোক একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিলেন।

ইন্সমাউথ? মানুক্সেট নদীর মোহনায় একটা এঁদো শহর ওটা, বুঝলেন। ১৮১২ সালের যুদ্ধের আগে বেশ বড় বন্দর ছিল বলে শুনেছি, তবে তারপর সব গেছে। রেললাইন ওদিকে যায়নি। এমনকী রোলি থেকে যে ব্রাঞ্চ লাইনটা ছিল, ওটাও তুলে দেওয়া হয় পরে। তাই অন্য কোনও ব্যাবসাবাণিজ্যও গড়ে ওঠেনি। শুধু মাছ আর চিংড়ির কারবার এখনও হয়। আর একটা গোল্ড রিফাইনারি আছে। ওই রিফাইনারিটা কিন্তু সলিড জিনিস। মার্শ, মানে ওটার মালিক, বিশাল ধনী, এমনটাই শুনতে পাই। ভদ্রলোকের কিছু একটা চর্মরোগ হয়েছে বলে উনি লোকচক্ষুর সামনে আসেন না। উনি ক্যাপটেন ওবেদ মার্শের নাতি। ওবেদ মার্শ এই ব্যাবসাটা শুরু করেছিলেন। লোকে বলে, মার্শ নাকি দক্ষিণ সমুদ্রের কোনও এক দ্বীপের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। এখানকার লোকজনের মন এত ছোট, কী বলব! ভাবুন তো, এক বিদেশিনিকে ঘরে আনার অপরাধে ক্যাপটেন মার্শের পরিবার তো বটেই, গোটা ইন্সমাউথের কোনও পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না এখানকার লোকজন।

শুধু ওই একটা বিয়ের জন্য? আমি জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম।

 না। তা অবশ্য নয়। মেনে নিলেন ভদ্রলোক, লোকে আরও হাজারটা ভুলভাল কথা বলে ক্যাপটেন মার্শের সম্বন্ধে। আমি স্বকর্ণে শুনেছি, ওরা বলে, ক্যাপটেন মার্শ নাকি শয়তানের সঙ্গে কী সব চুক্তি করেছিলেন। কারা যেন ইন্সমাউথে এসে থাকা শুরু করেছিল। তাদের মাধ্যমে ওখানে শয়তানের উপাসনা, আর আরও সব ভয়ংকর ভয়ংকর প্রথা নাকি শুরু হয়েছিল। ১৮৪৫ সালে নাকি এগুলো সামনেও এসেছিল। জানি না মশাই, আমি নিজে ভারমন্ট থেকে এসেছি অনেক পরে। কিন্তু এইসব হাবিজাবি এরা প্রায় শ খানেক বছর ধরে কানাকানির মতো করে বলে চলেছে।

আচ্ছা, এই যে ইসমাউথে কারা এসে থাকছিল বললেন, আমার মাথায় কৌতূহলের পোকাটা নড়েচড়ে উঠেছিল ততক্ষণে, এরা কোত্থেকে এসেছিল? ওই দক্ষিণের সমুদ্র বা সেখানকার দ্বীপ থেকে?

উঁহু। এই এতক্ষণে ভদ্রলোকের হাবভাবে আমি একটা সিরিয়াস ভাব খুঁজে পাই, আপনি এদিককার ভূগোলটা জানলে একটা বিশেষ জায়গার নাম শুনবেন। একটা প্রবাল প্রাচীর আছে ইন্সমাউথ থেকে কিছুটা দূরে। জায়গাটার নাম ডেভিলস রিফ। বেশির ভাগ সময় ওটা জলের ওপরেই থাকে। বেশ কয়েকটা গুহার মতো গর্ত আছে ওতে। ওর পাশেই একটা বেশ গভীর খাত আছে সমুদ্রের তলায়। ওই জায়গাটাকে নাবিকরা এড়িয়ে চলে।

সে তো যাবেই। ওটুকু আমিও বুঝতে পেরে বলি, ওখানে জাহাজের নীচটা ধাক্কা খেয়ে ফেঁসে গেলে?

ওসব নয়। ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হন, লোকে বলে, জলের নীচ থেকে উঠে এসে কারা যেন ওখানে প্রায়ই থাকে। বিশ্রাম নেয়। আরও অনেক কিছু করে। আর ক্যাপটেন মার্শের বিরুদ্ধে লোকেদের এত কথার উৎস হল ওই জায়গাটা।

মানে?

 ওবেদ মার্শ নাকি রাতবিরেতে ওখানে যেতেন। তাঁকে নামিয়ে দিয়ে নৌকো ফিরে আসত। আবার তাঁকে নিয়ে আসত অনেক পরে। সাধারণ ব্যাখ্যা হল, যে সোনা নিয়ে মার্শের কারবার শুরু, সেগুলো আসলে পুরোনো আমলের জলদস্যুদের লুকিয়ে-রাখা মাল। ওই জায়গার নানা গুহায় ওগুলো হয়তো ছিল। কিন্তু লোকে এই সহজ ব্যাখ্যাটা মানে না। বরং মার্শের সঙ্গে ওখানকার বাসিন্দাদের মেলামেশা নিয়েই তাদের সমস্যা।

তা এই বহিরাগতরা এখন আর ইন্সমাউথে থাকে না? আমি জানতে চাই।

 বলা মুশকিল। ভদ্রলোক ঠোঁট বেঁকালেন, ১৮৪৬ সালে ওখানে কিছু একটা মড়ক হয়েছিল। ঠিক কী হয়েছিল বলা মুশকিল। কেউই কিছু বলতে চায় না, হয়তো জানেও না। তবে শহরটা প্রায় সাফ হয়ে যায় ওতেই। এখন ওখানে মেরেকেটে শ-চারেক লোক আছে হয়তো।

কিন্তু এখানকার লোকেরা জায়গাটা এড়িয়ে চলে কেন? আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না, ম্মানে এখনও নিশ্চয় সেই মড়কের প্রভাব থাকবে না।

তা হয়তো নেই, তবে অন্য কিছু আছে। এজেন্ট ভদ্রলোক বললেন, হয়তো ক্যাপটেন মার্শের তিনটে জাহাজের সব কটাতেই নাবিকেরা অন্য জায়গায় বিয়েশাদি করেছিল। হয়তো বাইরে থেকে যারা এসেছিল, তারা অন্যরকম ছিল। মোদ্দা কথা হল, ওখানকার বাসিন্দাদের দেখলে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। আপনি সার্জেন্টকে দেখবেন বাসে উঠে। ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের কারও মাথা সরু, নাক চ্যাপটা, অথচ ফোলা ফোলা বিশাল সাইজের চোখ। ওদের চামড়াও কেমন যেন খসখসে, আঁশ-আঁশ টাইপের। এমনকী গলার পাশের অংশটা রুক্ষ, ভাঁজ-পড়া। ওদের চুলও পড়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। সবচেয়ে বড় কথা হল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের চেহারা আরও বিকট হয়ে যায়। বাঁচোয়া এই যে, ইন্সমাউথের কোনও বাসিন্দা খুব বেশি বুড়ো হয়েছে, এমন আমি দেখিনি। বেচারিরা বোধহয় বেশি দিন বাঁচেও না!

তাহলে তো… আমার একটু চিন্তা হয় ব্যাপারটা ভেবে, ওই ইনফেকশন বা অসুখটা খুব মারাত্মক ছিল বলতে হবে। নইলে এত দিন ধরে এরকম প্রভাব ফেলা তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাহলে এই জন্যই এখানকার লোকে ওদের এড়িয়ে চলে।

শুধু লোক নয় মিস্টার। জানোয়াররাও। গম্ভীর গলায় বলেন ভদ্রলোক, ঘোড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় জানোয়ার ওদের অপছন্দ করে। এই এলাকায় ওরা আসত-যেত ট্রেনে চেপে, আর তারপর হেঁটে। ব্রাঞ্চ লাইনটা উঠে যাওয়ার পর থেকে ওদের জন্যই ওই বাসটা চলে।

তার মানে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাখাও…? প্রশ্নটা শেষ করি না আমি, তাহলে ওদের চলে কী করে?

মাছ। গম্ভীরভাবে বলেন ভদ্রলোক, যখন সমুদ্রের কোথাও মাছ পাওয়া যায় না, তখনও ইন্সমাউথের জেটিতে নৌকো মাছের ভারে টলমল করে।

মাছেরা ওদের পছন্দ করে বলছেন? আমি হেসে বলি, তা, ওখানে রাত কাটানোর মতো কোনও জায়গা পাওয়া যাবে?

ওখানে গিলম্যান হাউস বলে একটা হোটেল আছে বটে। ব্যাজার মুখে বলেন ভদ্রলোক, তবে ওখানে থাকাটা… তার বদলে আপনি কাল সকাল দশটার বাস ধরে ওখানে যান, আবার ওখান থেকে রাত আটটার বাস ধরে এখানে ফিরে আসুন।

কেন বলুন তো? ভদ্রলোকের মুখ-চোখ দেখে আমার অস্বস্তি হয়, ওখানে কি কোনও গোলমাল আছে? মানে বাইরের লোক গেলে ঝামেলা হতে পারে?

বছর দুয়েক আগের কথা, বুঝলেন। ভদ্রলোক থেমে থেমে বললেন, এক ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর ওই গোল্ড রিফাইনারি দেখার চক্করে ওখানে গিয়েছিলেন। তারপর গিলম্যান হোটেলেই ছিলেন রাতে। ভদ্রলোক রাতে পাশের ঘরগুলো থেকে কয়েকটা গলা শুনেছিলেন। মানে… গলাগুলো ঠিক… মানুষের গলার মতো নয়। ওঁর মনে হয়েছিল, যেন কোনও জন্তু বা সরীসৃপ টাইপের কিছু কথা বলছে। ভাষাটাও ছিল একেবারে দুর্বোধ্য। তবে সব মিলিয়ে ভদ্রলোক দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। রাতভর চলেছিল ওইসব কথাবার্তা। উনিও না শুয়ে, একেবারে কাঠ হয়ে ছিলেন। ভোর হতেই ভদ্রলোক এলাকা ছাড়েন। ভদ্রলোকের নাম কেসি। আমার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল ওঁর। কেসি ওই রিফাইনারি ইন্সপেক্ট করতে গিয়ে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলেন, কারণ ওখানে সোনা কোত্থেকে আসত, আর সেগুলো কোথায় যেত, তার কিছুই বুঝতে পারেননি উনি। এককালে ওটা একটা পুরোনো মিল ছিল। মানুক্সেটের মুখেই বাড়িটা। কেসিও এখানকার লোকেদের মতো ভেবেছিলেন, ক্যাপটেন মার্শ ভিনদেশি বন্দর বা দ্বীপে গিয়ে গয়নাগাটি জোগাড় করতেন। সেগুলোই তারপর জাহাজে করে চালান করা হত অন্য কোথাও, তারপর সেখান থেকে গয়না হয়ে বা টাঁকশালে সেগুলো তলিয়ে যেত।

ভিনদেশি বন্দর? কিন্তু সেখান থেকে ওগুলো জোগাড় করতে গেলেও তো কিছু দিতে হবে বিনিময়ে, তাই না? টাকাপয়সা বা অন্য কিছু।

ঠিক বলেছেন। যেহেতু ক্যাপটেন মার্শ শহরগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে কাচের পুঁতি, দানা, এমনই আরও অনেক সস্তা কিন্তু মনোলোভা জিনিস কিনতেন, লোকে এটাই ভাবত যে, উনি এইসব দিয়ে কোনও দ্বীপের সরল বাসিন্দাদের ঠকাচ্ছেন।

কোন দ্বীপ, সেটা জানা গিয়েছিল?

 নাহ্। ভদ্রলোকের হতাশ মাথা নাড়া দেখে বুঝি, এ ব্যথা কী যে ব্যথা! তবে ওই সোনা যাতে থাকত, সেই জিনিসগুলো স্থানীয় নয়, এমনকী চেনাজানা দেশেরও নয়। কিছু নাবিক বা ওই রিফাইনারির লোক চোরাগোপ্তা পথে কয়েকটা জিনিস এদিক-ওদিকে বেচেছিল। সেগুলো দেখে লোকেদের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। মানে ওগুলো যদি গলায় পরার হার হয়, তাহলে সেই গলা…।

কিন্তু ক্যাপটেন মার্শ তো মারা গেছেন, তা-ই না?

 কমপক্ষে ষাট বছর আগে। কোনও জাহাজও মানুক্সেট মোহানা দিয়ে বেরোয়নি গত ষাট বছরে। কিন্তু… ভদ্রলোক আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলেন, ইন্সমাউথের লোকেরা এখনও কাচের পুঁতি, খেলনা– এসব কিনছে। কাদের জন্য?

বুঝলাম। কিছুই না বুঝেও আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লাম, তাহলে ওখানে যাব না বলছেন?

জায়গাটা সুবিধের নয়। লোকগুলো আরও গোলমেলে। ভদ্রলোক আমাদের দীর্ঘ আলাপচারিতায় ইতি টানতে উদ্যোগী হলেন, আমি সেন্সাস ডিপার্টমেন্ট আর আরও কয়েকটা সরকারি বিভাগের কথা শুনেছি, যাদের কর্মচারী ওখানে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। একজন তো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে ড্যানভার্স-এ আছে এখন। এই অবস্থায় আপনি ওখানে একদিন একটু ঘুরতে গেলে তা-ও ঠিক আছে। কিন্তু ওখানে থাকা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

এরপর আর কী করার থাকতে পারে? সেই সন্ধেটা আমি নিউবারিপোর্ট পাবলিক লাইব্রেরিতেই কাটালাম। তার আগে স্থানীয় লোকেদের ইন্সমাউথ নিয়ে জিজ্ঞেস করে হতাশ হয়েছিলাম। দোকান, গ্যারেজ, দমকল– এসব জায়গায় কথা বলতে গিয়ে মনে হল, একটা অস্পষ্ট কুসংস্কার গোছের জিনিস রয়েছে জায়গাটা নিয়ে। যেন জায়গাটা নিয়ে বেশি কৌতূহল দেখালে বিপদ হতে পারে। আবার ওয়াইএমসিএ, যেখানে আমি উঠেছিলাম, সেখানে আমাকে স্রেফ বলা হল, অমন একটা রদ্দি, পিছিয়ে-পড়া জায়গায় গিয়ে যেন আমি দিনটা বরবাদ না করি। তাই লাইব্রেরিই ভরসা।

এসেক্স কাউন্টির ইতিহাস নিয়ে লেখা বইগুলো পুরোনো। তবে সেগুলো থেকে আমি কাজের জিনিস খুব একটা পেলাম না। ইন্সমাউথ শহরটা ১৬৪৩ সালে পত্তন করা হয়েছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ওখানে জাহাজ তৈরি হত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জায়গাটার দারুণ আর্থিক উন্নতি হয়। কিন্তু ১৮৪৬-এর মড়ক আর দাঙ্গা নিয়ে খুব কম কথা খরচা করেছিল বইগুলো। তারপরেই ইন্সমাউথের আর্থিক বিপর্যয় হয়। গৃহযুদ্ধের পর মার্শ রিফাইনিং কোম্পানির মাধ্যমে সোনা জোগাড় করা, আর বাট তৈরি করে সেগুলো বেচা, এ ছাড়া ইন্সমাউথে আর কোনও শিল্প বা কলকারখানার কথা পাইনি বইগুলোয়। মাছ থেকে রোজগার কম হলেও ইন্সমাউথে মাছের অভাব কখনওই হয়নি, তাই মাছ ধরে এখনও হয়তো বেশ কিছু মানুষের পেট চলে।

শহরটায় বাইরের লোকজন খুব একটা স্বাগত নয়। একেবারে স্পষ্ট করে বলা না হলেও কয়েকটা জিনিস পড়ে মনে হল, পোল্যান্ড আর পোর্তুগাল থেকে আসা কিছু অভিবাসী ওই শহরে বসতি গড়ার চেষ্টা করেছিল। তার পরিণাম ভালো হয়নি।

তবে হ্যাঁ, বইগুলোতে আমি একটা খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস বুঝতে পারলাম। ইন্সমাউথের সঙ্গে কিছু বিশেষ ধরনের অলংকারের কথা জড়িয়ে আছে। হয়তো এগুলো থেকেই সোনাটুকু বের করে নেওয়া হত ওই রিফাইনারিতে। কিন্তু তার যে কটা নমুনা জোগাড় করা গিয়েছিল, সেগুলো আর্কহ্যামের মিসকাটোনিক ইউনিভার্সিটি আর নিউবারিপোর্ট হিস্টরিক্যাল সোসাইটির মিউজিয়ামে জায়গা পেয়েছে। ম্যাড়মেড়ে ভাষায় সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে গয়নাগুলো নিয়ে কিছু মনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার মনে হল, ওগুলোতে কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এই অনুভূতিটা এতই তীব্র ছিল যে, আমি সেই রাতেই অন্তত একটা গয়না দেখতে চাইলাম। বইপত্রে জানলাম, একটা বিচিত্র গড়নের জিনিস, যেটাকে কেউ কেউ টায়রা ভেবেছেন, এই শহরেই আছে। লাইব্রেরিয়ানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করার পুরস্কার পাওয়া গেল। মহিলা স্থানীয় সোসাইটির কিউরেটরের উদ্দেশে একটা নোট লিখে আমার হাতে দিলেন।

কিউরেটর মহিলার নাম মিস অ্যানা টিলটন১৬১। আমার কাতর আবেদন আর ওই নোটের সাঁড়াশি আক্রমণে তিনি সদয় হলেন। সোসাইটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবে খুব একটা রাত তখনও হয়নি। তাই তিনি বেশ কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে ওখানে নিয়ে গেলেন। সেই প্রথমবার আমি ইন্সমাউথের কিছু দেখলাম!

প্রথম দৃষ্টিতে জিনিসটাকে এমন কিছু আহামরি মনে হয়নি। কোণের কাবার্ডে রাখা একটা বিটকেল ডিজাইনের জিনিস আলোয় ঝলমল করছে, স্রেফ এটুকুই মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপর, একটু একটু করে গয়নাটার সৌন্দর্য আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার দুর্বল লেখনী সেই সৌন্দর্যের রহস্য, তার ব্যাখ্যাতীত জটিলতা বোঝাতে পারবে না। শুধু এটুকুই লিখি, এটা যদি টায়রা হয়, তবে যে মাথার জন্য এটা বানানো, তার শরীরের কল্পনাও করা কঠিন।

জিনিসটা কী দিয়ে বানানো ছিল? আমার তো দেখে সোনা বলেই মনে হল। তবে একটা মসৃণ, হালকা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল পুরো গয়নাটায়, যা থেকে মনে হয় যে, ওই সোনায় অন্য কিছু মেশানো হয়েছিল। কিন্তু উপাদান যা-ই হোক-না কেন, জ্যামিতিক মোটিফের সঙ্গে সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণীর চেহারার বৈশিষ্ট্য মিশিয়ে গয়নাটা এমন অসাধারণ কৌশলে আর যত্নে বানানো হয়েছিল যে বলার নয়!

গয়নাটার দিকে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল। প্রথমে ভাবলাম, এমন একটা অজানা অচেনা ডিজাইন বলেই হয়তো জিনিসটা এত আকর্ষণীয় ঠেকছে। তারপর বুঝলাম, কারণটা অন্য। গয়নাটার গঠন যে জ্যামিতিক প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে, সেটা অঙ্ক বইয়ে পড়ানো জিনিসের থেকে একেবারে আলাদা। গয়নার গায়ে খোদাই-করা বা উঁচু-হয়ে-থাকা মাছ, সরীসৃপ, উভচর এমন নানা প্রাণীর চেহারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল সেই প্যাটার্নগুলো। ফলে চোখ হয়ে মনে এমন কিছু অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিল, যা একই সঙ্গে ভয় আর লালসার জন্ম দেয়।

আমার কথাগুলো যত রোমান্টিক শোনাচ্ছে, গয়নাটার খাতায়-কলমে ইতিহাস ততটাই কেঠো শোনাবে। মিস টিলটন বললেন, ইন্সমাউথের এক বাসিন্দা ১৮৭৩ সালে গয়নাটা যাচ্ছেতাইরকম কম দামে বন্ধক রেখেছিল। মাতলামি করার ফলে সে তার একটু পরেই ঝামেলায় পড়ে, শেষে খুনই হয়ে যায়! সোসাইটি জিনিসটা প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করে তারপর। কিন্তু ওটার উৎস যে কী হতে পারে, সেই নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত নন। গয়নাটা ইন্দো-চায়নার হতে পারে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় হতে পারে, এমনকী পূর্ব ভারতের কোনও অজানা জায়গারও হতে পারে! তবে মিস টিলটনের বক্তব্য, নিউ ইংল্যান্ডে এই জিনিস এসে পৌঁছোতে পেরেছে স্রেফ ক্যাপটেন ওবেদ মার্শের জন্য। ওই মানুষটি জলদস্যুদের কোনও একটি লুকোনো ভাণ্ডারের সন্ধান না পেলে এমন বস্তু এখানে আসা অসম্ভব। যুক্তি হিসেবে টিলটন এ-ও বললেন যে, গয়নাটার কথা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে মার্শ পরিবার ওটা কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

বাড়িটা তালাবন্ধ করে বেরোবার সময় মিস টিলটনের কথা শুনে বুঝলাম, ইন্সমাউথ ওঁর কাছে একটা পিছিয়ে-পড়া, কুসংস্কারাচ্ছন্ন শহর ছাড়া আর কিছু না, যেখানে আমার যাওয়া উচিত হবে না। কারণটা উনি অতি সংক্ষেপে, কাটা-কাটা গলায় বলেই দিলেন।

শ-খানেক বছর আগে ইন্সমাউথে মাছ পাওয়াই যেত না। তারপর ক্যাপটেন মার্শ ফিরে এলেন, আর শহরের ভোলও বদলে গেল! শুধু জলদস্যুদের ভাণ্ডার থেকে পাওয়া সোনাদানাই নয়। মার্শ ইসমাউথে একটা অদ্ভুত ধর্মীয় বিশ্বাস বা প্রথাও তৈরি হতে সাহায্য করেন। যারা ওটা মানে, তারা নিজেদের ডেগন দেবতার দল বলে পরিচয় দেয়। তারাই এখন দলে ভারী। আর পাঁচটা ধর্মীয় বিশ্বাস এখন ওই শহরে কোণঠাসা। এই নিয়ে কিছু বলার নেই, কারণ এখন ওরা সত্যিই মাছ পায়। এত মাছ পায়, যা আশপাশের বন্দরগুলো ভাবতে পারে না! তবে ওইরকম একটা জায়গায় একজন তরতাজা, শিক্ষিত তরুণের গিয়ে লাভ নয়, বরং ক্ষতি হবে বলেই আমার ধারণা।

মিস টিলটন ভালোই চেয়েছিলেন। কিন্তু এই বিচিত্র ইতিহাস, আর তার আড়ালে লুকিয়ে-থাকা অনেক না-বলা কথার আভাস আমাকে চুম্বকের মতো শহরটার দিকে টানছিল।

.

০২.

পরদিন দশটার আগেই আমি পুরোনো বাজারের বাইরে হ্যামন্ডের ওষুধের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সঙ্গে ছিল শুধু নিজের ছোট্ট ব্যাগটা। ইন্সমাউথের জন্য বাসটা আসার সময় যত এগিয়ে এল, ততই দেখলাম, আশপাশটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম, স্টেশনের ওই এজেন্ট ভদ্রলোক বাড়িয়ে বলেননি। এখানকার লোকজন ইন্সমাউথ তো বটেই, এমনকী বাসটাকেও এড়িয়ে চলতে চায়।

একটু পরেই দেখলাম, একটা লজঝড়ে মোটর-কোচ আসছে। সেটার আসল রং যে কী ছিল, তা এখন ময়লা আর চলটা-পড়া গা থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব। নোংরা কাচের ওপর প্রায় অপঠ্য অক্ষরে লেখা ছিল : আর্কহ্যাম-ইন্সমাউথ-নিউবারিপোর্ট। বাহন উপস্থিত হলেও তার চেহারা দেখে মুষড়ে পড়লাম।

বাস থেকে তিনজন লোক নামল। উশকোখুশকো চেহারা, নোংরা পোশাক, বদমেজাজি টাইপের মুখ-চোখ, কম বয়স। তাদের গলায় তফাত যাও! লেখা কোনও সাইনবোর্ড ঝোলানো ছিল না বটে। কিন্তু লোকজন তাদের যেভাবে এড়িয়ে গেল, সেটাই যথেষ্ট শিক্ষাপ্রদ। স্টেট স্ট্রিট ধরে, কেমন একটা চোর-চোর ভাবে, তারা কোথায় যেন চলে গেল। তারপর বাস থেকে নামল ড্রাইভার। সে ওষুধের দোকানে ঢুকল কিছু একটা কিনতে। আমি বুঝলাম, এই নির্ঘাত জো সার্জেন্ট।

লোকটা দোকান থেকে বেরোলে আমি ওকে খুঁটিয়ে দেখলাম। প্রায় ছ-ফুট লম্বা, রোগা, সামনে ঝুঁকে-পড়া লোকটা জীর্ণ, সিভিলিয়ান পোশাকে ছিল। মাথায় একটা গল্ফ ক্যাপ ছাড়া লোকটার পোশাকের আর কিছুই নজর কাড়ে না। তারপর একে একে চোখে ধরা পড়ে লোকটার লম্বা আর চ্যাপটা ঠোঁট, কয়েক গাছি লোম ছাড়া মুখে আর কোনও গোঁফ দাড়ি না-থাকা, প্রায় লেপটে-থাকা কান, গালের জায়গায় জায়গায় অনেকটা চর্মরোগীদের মতো করে ছাল উঠে আসা… তবে এমন সব মনোহর জিনিসের পরেও লোকটার গলার দু-ধার দেখে আমি চমকে উঠলাম। সেখানে এমনভাবে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছিল, যা আমরা খুব বেশি বয়স ছাড়া অন্য কারও ক্ষেত্রে ভাবতেই পারি না। অথচ লোকটার বয়স কিছুতেই অত বেশি হতে পারে না! তারপর কিম্ভুত লাগল লোকটার হাতের আঙুলগুলো। কেন যেন মনে হল, ও চাইলে বোধহয় আঙুলগুলো গুটিয়ে মস্ত বড় তালুর মধ্যেই ঢুকে যাবে। হাতের রংও কেমন হলদেটে নীল টাইপের!

লোকটা নিশ্চয় কোনও মাছের বাজারে কাজ করে, কারণ ওর সর্বাঙ্গ থেকে একটা আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছিল। তার চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, লোকটার এমন চেহারা কী ধরনের বর্ণসংকরায়ণের ফলে হতে পারে, সেটা ভাবতে গিয়েই আমি ঘেঁটে যাচ্ছিলাম। এমন একজনের সঙ্গে একটা লম্বা সফর করতে হবে ভেবেই দমে যাচ্ছিলাম। সেটা আরও বেড়ে গেল, যখন দেখলাম, আমি ছাড়া আর কেউ ওই কোচে চড়বে না। বাধ্য হয়ে আমি লোকটার পিছুপিছু বাসে উঠলাম, আর গন্তব্য হিসেবে ইন্সমাউথ বলে এক ডলারের একটা নোট বাড়িয়ে ধরলাম। জো আমাকে যথেষ্ট কৌতূহলের সঙ্গে শুধু দেখল না, প্রায় মাপল। তারপর চল্লিশ সেন্ট ফেরত দিল, আর কোনও কথা বলল না। আমি ওর দিকেই, কয়েকটা সিট পেছনে বসলাম, যাতে সমুদ্র দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা চলতে শুরু করল। পথেঘাটে থাকা লোকেরা দেখলাম বাসটার দিকে তাকাচ্ছেই না। বুঝলাম, কুসংস্কার হোক বা অন্য কিছু, নিউবারিপোর্টের সাধারণ মানুষের কাছে ইন্সমাউথের মতো এই বাসটাও পরিত্যাজ্য। হাইস স্ট্রিট হয়ে, পুরোনো কলোনিয়াল দালানকোঠা ছাড়িয়ে পার্কার নদী পেরিয়ে আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম।

দিনটা রোদ-ঝলমলে ছিল। কিন্তু বালি, আধমরা শুকনো ঘাস আর ক্ষয়টে চেহারার ঝোপ… এসব দেখে আমি ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছিলাম। দূরে সমুদ্রের নীল দাগটা দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু পরেই রোলি আর ইউইচের বড়রাস্তা ছেড়ে আমাদের কোচ একটা সরু রাস্তায় ঢুকল। রাস্তার হাল দেখে বেশ টের পাচ্ছিলাম, খুব কম গাড়িই এই পথে যাতায়াত করে। কিছু দূর পর পর যে টেলিফোন পোলগুলো কাত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলোতেও ছিল মোটে দুটো তার। কিছুক্ষণ পর পরই সরু সরু খাঁড়ি পড়ছিল। কাঠের জীর্ণ ব্রিজের ওপর দিয়ে সেগুলো পার হতে হতে বুঝতে পারছিলাম, ডাঙা আর সমুদ্র দুটোই ইন্সমাউথকে আলাদা করে দিয়েছে আশপাশ থেকে।

মাঝেমধ্যে গাছের কাটা গুঁড়ি আর ভাঙাচোরা দেওয়াল নজরে পড়ছিল। লাইব্রেরিতে পড়েছিলাম, ১৮৪৬-এর মড়কের আগে এই এলাকা রীতিমতো সমৃদ্ধ আর সবুজ ছিল। কিন্তু তারপরেই সব কিছু মরে যায় এখানে। আসলে মড়ক নয়, এদিকের জঙ্গল সাফ করে দিয়েছিল লোকজন। ফলে সমুদ্রের বালি উড়ে এসে মাটি অনুর্বর করে দেয়। তারপরেই এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়।

একটা বাঁক নেওয়ার পর প্লাম আইল্যান্ড আমার নজরের আড়ালে চলে গেল। কিন্তু আটলান্টিক তার অনন্ত নীলিমা নিয়ে আমার বাঁদিকে রইল। দেখতে পাচ্ছিলাম, খানাখন্দে ভরা রাস্তাটা একটু একটু করে উঁচু হয়ে যাচ্ছে। মনে হল, যেন অদ্ভুতদর্শন ওই চালকের হাতে গাড়িটা আমাকে রাস্তা ধরে নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কি মাটির নিরেট ভাবটা আর পাব আমি? নাকি তার বদলে সেখানে থাকবে আকাশের শূন্যতা আর সমুদ্রের অতল রহস্য?

একটু পরেই গাড়িটা ওই উঁচু জায়গাটা পেরিয়ে নীচে নামতে শুরু করল। অনেক দূরে কিংসপোর্টের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। ওর উত্তরেই ম্যানুক্সেট কেপ অ্যানের দিকে বাঁক। নিয়ে সমুদ্রে মেশে। কিন্তু ওদিকে নয়। আমার নজর আটকে ছিল সামনে ছড়ানো জায়গাটার দিকে।

ইন্সমাউথ!

অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো ছিল শহরটা। বাড়ির সংখ্যা, প্যাঁচালো রাস্তাঘাট… এসব দেখে মনে হয়, শহরটায় অনেকে থাকে, বা থাকত। এখন কিন্তু শহরটা দেখে সবচেয়ে আগে একটাই কথা মনে হয়।

এখানে কি আদৌ কেউ থাকে?

 বাড়িগুলোর চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছিল না। সমুদ্রের দিকের দিগন্তে মাথা তোলা তিনটে বিশাল উঁচু শিখরের মধ্যে একটা তো প্রায় পড়ো-পড়ো চেহারায় ছিল। অন্যগুলোতেও জানলা বা ঘড়ি যেখানে থাকার কথা, সেই জায়গাগুলোয় অন্ধকার গর্ত আর জীর্ণ ইট ছাড়া কিছু দেখলাম না। ভাঙাচোরা টালির সমুদ্র, ঝুঁকে-থাকা ছাদ, পচা কাঠের ফ্রেম… সব কিছু একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল শহরটার পোকায় কাটা দশাটা।

রাস্তাটা নিচু হচ্ছিল। আমি দেখলাম, এমনকী একদা প্রাসাদোপম বাড়িগুলোতেও ছাদ ধসে পড়েছে। রেললাইনে ঘাস গজিয়েছে। টেলিগ্রাফ পোলে তার নেই। সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থা তো সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলোয়। তবে সেখানেও ভাঙাচোরা আর প্রায় বালিতে ডুবে-যাওয়া ঘরের মাঝে একটা বেশ উঁচু আর মজবুত বাড়ি দেখলাম। বাড়িটার মাথায় সাদা রঙের একটা ঘণ্টাঘর দেখে সেটাকে কোনও পুরোনো কারখানা বলেই মনে হল।

একটা পুরোনো পাথুরে দেওয়ালের পেছনে থাকা বন্দটার বালিতে প্রায় বুজে গেছে দেখলাম। সেখানে কয়েকজন জেলে বা ওইরকম লোক বসে ছিল বোধহয়। তাদের পাশে ভাঙাচোরা কয়েকটা ঘর, জং-ধরা নোঙর, চিংড়ি ধরার পাত্র– এগুলো দেখে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এখানকার লোকজন কি মাছ-টাছ আদৌ ধরে এখন? জায়গাটার শেষ প্রান্তে একটা পরিত্যক্ত বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। ওই কারখানার পাশে যেখানে নদীর একটা শাখা সমুদ্রে এসে পড়েছে, সেই মোহানাতেই কিছুটা গভীর জল আছে বলে মনে হল।

এখানে-সেখানে ভাঙাচোরা জেটি দেখা যাচ্ছিল। সেগুলো ছাড়িয়ে গভীর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা কালো রেখা দেখতে পেলাম। মনে হল, জলের সামান্য নীচেই যেন একটা লম্বা পাহাড় রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। বুঝলাম, এই হল ডেভিলস রিফ। জায়গাটা আমাকে যুগপৎ বিকর্ষণ আর আকর্ষণ করছিল। কেন… তখন বুঝিনি।

রাস্তায় কাউকে দেখলাম না। বেশ কিছুটা চলার পর কয়েকটা বাড়ি দেখলাম, যেগুলো পোডড়া বাড়ির বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করা চলে। জরাজীর্ণ দশা, ভাঙা জানলায় কাচের বদলে কাপড় গোঁজা, উঠোনে মরা মাছ ছড়ানো, মৃতপ্রায় গাছ আর আগাছায় ভরা বাগান, পেছনে মেছো গন্ধ আর নোংরায় ভরা সাগরতটে কিছু লোকের নিষ্প্রাণ খোঁড়াখুঁড়ি…! তবে হ্যাঁ, বাড়িগুলোর দশার চেয়েও ভয়ানক ছিল তাদের বাসিন্দারা। নোংরা-মাখা যে বাচ্চাগুলো খেলছিল আশপাশে, তাদের মুখের মধ্যে একটা বাঁদুরে ভাব ছিল। যারা বড়, তাদের চালচলন দেখেও প্রবল অস্বস্তির ভাব জাগছিল। সব মিলিয়ে… আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না বোধহয়… এমন একটা ছবি মনে ফুটে উঠছিল, যেটা আমি কোথাও, হয়তো কোনও ভয়ের বইয়ে দেখেছি।

মোটামুটি সমতল একটা জায়গায় আসার পর মূল শহর শুরু হল। বাড়িগুলোর ঘনত্ব আর আয়তন দুইই বাড়ল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল, বাড়িগুলো পরিত্যক্ত। অব্যবহারে আর অযত্নে ধসে গেছে চিমনি, ভেঙে গেছে টালির ছাদ, দেওয়াল বেঁকে বাড়িটাই কোথাও মুখ থুবড়ে পড়েছে সামনে! রাস্তা, ফুটপাথ, সবই নোনা হাওয়ার নিষ্করুণ আদরে ফুটিফাটা হয়ে আছে। আর এইসব ভরে আছে একটা বিশ্রী মেছো গন্ধে।

কয়েকটা মোড় পেরোল আমার বাহন। তারপর যে বাড়িগুলো দেখলাম, সেগুলো নিঃসন্দেহে একদা বড়লোকদের নিবাস ছিল। এই বাড়িগুলোতে আমি মানুষের বসবাসের কিছু চিহ্ন দেখলাম। জানলায় পর্দা, তোবড়ানো গাড়ি, সামনে মোটামুটি চলনসই রাস্তাঘাট –এসবই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এটা ইন্সমাউথের সমৃদ্ধ অংশ (ছিল?)। বাড়িগুলো কম-সে-কম সওয়াশো বছরের পুরোনো। বিশ্রী আঁশটে গন্ধ, আর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে-থাকা একটা অস্বস্তিকর ভাব ছাপিয়েও বাড়িগুলোর প্রাচীনত্ব আমাকে আকর্ষণ করছিল। তবে ওই নিয়ে বেশি ভাবার আগেই একটা অন্য জায়গায় এসে পড়লাম।

কোচটা যেখানে দাঁড়ায়, তার আগেই একটা খোলা জায়গা আছে। তার দু-পাশে দুটো গির্জা আছে। সামনে আছে একটা আধমরা ঘাসে ছাওয়া জায়গা। তার আগেই ডান হাতে একটা বড় বড় থামওয়ালা বাড়ি পড়ল। বাড়িটার রং এককালে সাদা ছিল, এখন সব উঠে গেছে বা জ্বলে গেছে। তাতেও বাড়ির নীচের ধাপে কালো আর সোনালি অক্ষরে ডেগন দেবতার দল লেখা ছিল। বুঝলাম, একদা নামকরা একটা প্রতিষ্ঠানের এটিই সাম্প্রতিক চেহারা। দেওয়ালে লেখা অন্য কথাগুলো পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করছিলাম। তখনই বাঁদিক থেকে একটা ঘণ্টার কর্কশ ধ্বনি ভেসে এল।

তাকিয়ে বুঝলাম, আওয়াজটা একটা পাথরের গির্জা থেকে আসছে। বাড়িটা অপেক্ষাকৃত নতুন। জবরজং গড়ন, খুব উঁচু বেসমেন্ট, বন্ধ জানলার সারি– এগুলো একে একে আমার চোখে ধরা পড়ল। বাড়ির মাথায় থাকা ঘড়ির কাঁটাগুলো বোধহয় ভেঙে পড়েছিল। তবু বুঝলাম, এগারোটা বাজছে। ঠিক তখনই আমি এমন একটা কিছু দেখলাম, যেটা এক মুহূর্তের জন্য অন্য সব কিছুকে ভুলিয়ে দিল।

কী দেখলাম আমি?

 বেসমেন্টের দরজাটা খোলা ছিল। বাইরের আলো-ঝলমলে দিনের তুলনায় দরজার ওপাশটা ঘন অন্ধকার ঠেকছিল। কিন্তু তার মধ্যে আমি একটা অদ্ভুত চেহারা দেখলাম। বিশ্লেষণ নয়, বরং প্রথম দর্শনেই আমার মনে এমন একটা ভয় দানা বেঁধেছিল যে, আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তারপর খেয়াল হল ব্যাপারটা কী, আর তখন নিজেকে প্রভূত গালাগাল দিলাম। বুঝলাম, ওই চেহারাটা নিঃসন্দেহে এই গির্জার প্রধান যাজক বা পুরোহিতের। ডাগনের উপাসনার অঙ্গ হিসেবেই নিশ্চয় তাঁর মাথায় কিছু একটা পরানো ছিল… অনেকটা ওই মিউজিয়ামে দেখা টায়রাটার মতো! কিন্তু আমার মাথায় প্রথম দর্শনে সেসব আসেনি। বরং আলোছায়ায় দেখা চেহারাটা তার উচ্চতা, অলংকার এবং আলখাল্লার আড়ালে থাকা চেহারার আভাস নিয়ে আমাকে রীতিমতো আতঙ্কিত করেছিল।

কেমনধারা লোকজন তাদের যাজকের মাথায় ওই বিচিত্ৰদৰ্শন টায়রা বসায়?

ওসব আর ভাবার সময় পেলাম না। আশপাশে দাঁড়িয়ে জটলা-করা গোমড়ামুখো, কুদর্শন কিছু যুবককে দেখলাম। ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর চেনা দৃশ্য ছাপিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই একটা জলপ্রপাতের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। এবার সেটা খুব জোরালো হয়ে উঠল। দেখলাম, একটা গভীর খাতের সামনে এসে গেছি। তার ওপরের ব্রিজটা পেরোবার সময় দূরে, শহরের প্রান্তে কয়েকটা কারখানা গোছের বাড়ি দেখলাম। দু-পাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়া জলপ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। সেই জায়গাটা পেরোতেই একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি খোলা জায়গায় এসে থেমে গেল কোচ। তাকিয়ে দেখলাম, ডানদিকে একটা উঁচু, পুরোনো মডেলের, সর্বাঙ্গে কালের কলঙ্ক লেপে-থাকা হলদেটে বাড়ির সামনে এসে গেছি। ভাঙাচোরা কার্নিশের গায়ে লেখা বাড়ির নামটা পড়া যাচ্ছিল।

গিলম্যান হাউস।

ঝটপট বাস থেকে নেমে হোটেলে গেলাম।

.

হোটেলের নোংরা লবিতে একটা বুড়োটে চেহারার লোক আমার নাম-ঠিকানা লিখে ঘরের চাবি দিল। ওর মুখ-চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, এর মধ্যে সেই ইসমাউথীয় ব্যাপারটা নেই, অর্থাৎ এ স্থানীয় নয়। তা-ও লোকটাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমি বেরিয়ে পড়লাম স্বচক্ষে শহরটা দেখব বলে। যে জায়গায় বাস আমাকে নামিয়েছিল, সেখানেই গেলাম। তারপর চারদিক যথাসম্ভব খুঁটিয়ে দেখলাম।

পাথর দিয়ে বাঁধানো জায়গাটার উত্তরদিক দিয়ে নদী বয়ে গেছে। অন্যদিকে, মানে দক্ষিণে রয়েছে একশো বছরেরও বেশি পুরোনো একঝাঁক বাড়ি। তাদেরই মধ্য দিয়ে সরু সরু বেশ কয়েকটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে দক্ষিণে, দক্ষিণ-পূর্বে, দক্ষিণ-পশ্চিমে। রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে আলোর সাইজ দেখে বুঝলাম, অন্ধকার নামার আগে এখান থেকে বিদায় নেওয়াই ভালো, সে চাঁদ উঠুক বা না উঠুক।

বাড়িগুলোর চেহারা বাইরে থেকে ঠিকঠাকই লাগল। ডজনখানেক দোকান বা অফিসঘর নজরে পড়ল। একটা বেশ নামকরা সংস্থার দোকান, একটা লজঝড়ে রেস্তরাঁ, ওষুধের দোকান, এক মাছ ব্যবসায়ীর অফিস… আর একেবারে পূর্ব কোণে এই শহরের একমাত্র কারখানা, অর্থাৎ মার্শ রিফাইনিং কোম্পানির অফিস। সব মিলিয়ে গোটা দশেক লোক, আর খান তিনেক গাড়ি আর লরি, ব্যাস! দূরে একদিকে সমুদ্রের নীল আভাস, অন্যদিকে মার্শ রিফাইনারির সাদাটে চিমনি এ দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম, এই জায়গাটাই ইন্সমাউথের বাণিজ্যিক এলাকা বলা চলে।

মনে হল, ওই নামকরা সংস্থার দোকানটায় একবার ঢু মারি। ভেবেছিলাম, ওরকম জায়গায় কাজ করার জন্য স্থানীয় কারও বদলে কোনও বহিরাগতের উপস্থিতিই স্বাভাবিক। গিয়ে দেখলাম, ধারণাটা ঠিক ছিল। একটা সতেরো-আঠেরো বছর বয়সি ছেলে ওই দোকানটা চালাচ্ছে। ছেলেটা হাসিখুশি। ও যে এখানে কথা বলার মতো কাউকে পায় না, সেটাও কিছুক্ষণের মধ্যে স্পষ্ট হল। ছেলেটার বাড়ি আর্কহ্যামে। ইন্সউইচ থেকে আসা একটা পরিবারের সঙ্গে এখানে থাকে ও। ওর বাড়ির লোক চায় না ও ইসমাউথে থাকে। কিন্তু চাকরির দায়ে একরকম বাধ্য হয়ে ওকে এই আঁশটে গন্ধ আর গোলমেলে লোকে ভরা শহরে থাকতে হচ্ছে!

বড়রাস্তা, যেখানে বাস থামে, সেটা ফেডেরেল স্ট্রিট। বলল ছেলেটা, তার পশ্চিমে বেশ কয়েকটা পুরোনো আমলের চওড়া রাস্তা আছে– ব্রড, ওয়াশিংটন, লাফায়েত, অ্যাডামস…। পূর্বদিকে, মানে নদীর তীর বরাবর রয়েছে ঘিঞ্জি বস্তি। ওখানে কয়েকটা পুরোনো চার্চ আছে বটে, তবে এখন পরিত্যক্ত। ওসব এলাকায় না-যাওয়াই ভালো।

কেন? আমি জানতে চাইলাম।

ওখানকার লোকজন একটু… ছেলেটা ইতস্তত করে বলল, বিপজ্জনক। বেশ কয়েকজন বাইরের লোক ওদিকে গিয়ে তো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে!

এরকম প্রবেশ নিষেধ এলাকা আর কটা আছে? একটু হতাশ হয়েই জানতে চাইলাম আমি। আসলে শহরটা দেখে যে অ-ভক্তি জন্মেছিল, সেটা ছেলেটার কথা শুনে বাড়ছিল বই কমছিল না।

মার্শ রিফাইনারি! স্পষ্টভাবে বলল ছেলেটা, আর যে চার্চগুলোয় এখনও কেউ যায়, সেগুলো, বিশেষ করে ডেগন দেবতার দল যেখানে উপাসনা করে, সেটা।

আচ্ছা… আমার মাথায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে যে প্রশ্নটা ঘুরঘুর করছিল, কিন্তু বেরোতে পারছিল না, সেটাই করে ফেললাম, এখানে চার্চে ঠিক কী হয়?।

জানি না। ছেলেটা এবারও স্পষ্টভাবে বলল, তবে ইন্সমাউথের বাইরের কোনও চার্চ এদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখে না। এগুলোতে এমন সব প্রথা আর পোশাক বা… মানে এই চার্চে উপাসনার নামে যা হয়, সেটা ঠিক ধর্মাচরণ নয়। আমি ওগুলোকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলি।

ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। তবে চার্চের এমন অদ্ভুত বিকৃতি কি এমনি এমনি হতে পারে? হয়তো লোকজনের চাপেই এমনটা হয়েছে। তাই আমার পরের প্রশ্নটা ছিল এখানকার লোকজনকে নিয়েই।

এখানকার লোকেদের ব্যাপারস্যাপার আমি বুঝি না। বিরক্তি, হতাশা আর কিছুটা ভয় ফুটে উঠল ছেলেটার গলায়, এদের দেখলেই প্রবল অস্বস্তি হয়। আর গলার আওয়াজ! আপনি থাকলে বুঝতেন, ওদের চার্চে যে দু-দিন বড় পরব, সেই ৩০ এপ্রিল আর ৩১ অক্টোবর ওই উকট গলার আওয়াজে তো প্রাণপাখি উড়ে পালাতে চায়।

অন্য সময় লোকগুলো কী করে?

 মাঝেমধ্যে মাছ ধরে। বাকি সময় হয় বেআইনি মদ গিলে ঝিমোয়, নয় ছোট ছোট দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। ওদের ভাবসাব দেখে আমার মনে হয়, এই পৃথিবীতে থাকার বদলে ওরা যেন অন্য কোথাও যেতে পারলেই বাঁচে। সেটা কোথায়, বলতে পারব না। তবে এরা যা জল ভালোবাসে, তাতে সমুদ্রের তলায় থাকতে পারলেই বোধহয় লোকগুলো বেশি খুশি হত!

বুড়ো হলে অনেকেরই এরকম ভাবসাব হয়। আমি বলে ফেললাম।

বুড়ো? চোখ কপালে তুলল ছোকরা, কাদের আপনি বুড়ো বলছেন? যাদের রাস্তাঘাটে দেখা যায়, তারা হল সব কমবয়সি জনতা! বুড়োদের আপনি এখানে দেখতেই পাবেন না।

সে কী? এবার আমিও অবাক হলাম, কই, আমার হোটেলের ক্লার্কই তো বেশ বুড়ো।

আরে, আমি স্থানীয় লোকেদের কথা বলছিলাম! অধৈর্য কণ্ঠে বলে ছেলেটা, ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের বয়স বাড়লে তাদের আর দেখতে পাওয়া যায় না। তাদের আয়ু কম, নাকি তারা দেখতে এতই খারাপ যে, সামনে আনাই যায় না, এ শুধু এখানকার লোকেরাই বলতে পারবে। খারাপ মানে কী বলছি, বুঝছেন তো? তাদের দেখলেই মনে হয়, এদের রক্তে অন্য কোনও জাতি… বা আরও খারাপ কিছু মিশে গেছে। আমি শুনেছি, সরকারি লোকজন এলে নাকি সেইসব লোককে লুকিয়ে রাখা হয়।

লুকিয়ে রাখা হয়! কোথায়?

সমুদ্রের তীর থেকে শহরের পুরোনো বাড়িগুলোর নীচে নাকি বহু সুড়ঙ্গ আছে। সেখানেই তেমন লোকেদের লুকিয়ে রাখা হয়। সবই শোনা কথা, তবে যেসব ভিনদেশির সঙ্গে মেলামেশার ফলে ইন্সমাউথের লোকেদের এই চেহারা হয়েছে, তারা নাকি এখনও ওই পথেই যাতায়াত করে।

বলো কী! একটা ভয়মিশ্রিত উত্তেজনা আমাকে পেয়ে বসছিল, আচ্ছা, এই শহরটার ইতিহাস-ভূগোল নয়, বরং এখন এখানে কী হয়, এটা জানতে গেলে কাকে ধরতে হবে?

কেউ মুখ খুলবে না। ঠোঁট বেঁকাল ছেলেটা, তবে এখানকার গরিবখানায় এক বুড়ো থাকে। জাডক অ্যালেন। লোকটা দাবি করে, ওর বয়স নাকি ছিয়ানব্বই বছর! হতেই পারে। জাড়কের মাথায় একটু গোলমাল আছে। ও এমনিতে চোরের মতো থাকে। মুখ খোলা তো দূরের কথা, বরং সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে, যেন কেউ ওকে ধরে ফেলবে। তবে একবার মদ গিললে ওর মুখও খুলে যায়। তখন ও যা বলে…!

কী বলে? আমি কৌতূহলী হলাম।

যা বলে, তার প্রায় সবটাই অবিশ্বাস্য, ভয়াল-ভয়ংকর সব গল্প। মাতাল বুড়োর কথা বলে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু… ছেলেটা ইতস্তত করে আবার মুখ খুলল, এখানকার লোকেরা চায় না, বাইরের কেউ জাকের সঙ্গে কথা বলুক। ইন ফ্যাক্ট, ওর গল্প শুনতে গিয়ে লোকে বিপদে পড়েছে। সে জন্যই মনে হয়, ও যা বলে, তার সবটাই মাতালের খোয়ব নয়।

আহা, শুনিই না, কী বলে জাডক। আমি তোয়াজের সুরে বললাম, তারপর না-হয় সত্যি-মিথ্যের ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

ওই আর কী। বুঝতে পারলাম, ছেলেটা হয় কিছু জানে না, নয়তো বলতে চাইছে না। জাডক এক ভয়ংকর দানবিক প্রাণীর কথা বলে। বহিরাগতরা সত্যিই নাকি মাঝেমধ্যে ওইরকম একটি প্রাণীকে রাতের ইন্সমাউথে দেখেছে। মুশকিল হল, রাতে এখানকার রাস্তাঘাট ঘোর অন্ধকার থাকে বলে এমনিতেই বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। ফলে কে যে কী দেখেছে, তা বলা কঠিন।

এখানে মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু হয়? নিজের টেনশন চাপা দিয়ে, বোর-হওয়া গলায় জানতে চাইলাম।

মার্শ রিফাইনারি! ছেলেটা সোৎসাহে বলল, তবে মার্শের সঙ্গে আপনার দেখা হবে না।

আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ, তায় ট্যুরিস্ট। কাঁধ ঝাঁকালাম আমি, দেখা হওয়ার কারণ থাকবেই বা কেন?

সে জন্য নয়। ছেলেটার মুখে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল, বয়স হয়ে যাওয়ার পর থেকে ওঁকেও আর দেখতে পাওয়া যায় না। শুধু উনি নয়, ওঁর ছেলেমেয়েদেরও এখন আর প্রকাশ্যে দেখা যায় না। শুনেছি, ওঁদের সবার স্বাস্থ্যই নাকি ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে ইদানীং। মার্শের এক মেয়ের বীভৎস চেহারার বর্ণনা শুনে তো গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তবে সেই মহিলা বাইরে বেরোলে অদ্ভুত গড়নের নানা গয়না পরেন। এখানে যে আজব টাইপের চার্চ জনপ্রিয়, তার যাজকরাও শুনেছি ওইরকম উদ্ভট গয়না আর পোশাক পরেন। এই গয়নাগুলোই বোধহয় মার্শ রিফাইনারিতে ঢুকে বাট হয়ে বেরোয়।

প্রথমে চেহারা, আর তারপর স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার এই অসুখটা তো গোটা শহরেই আছে বলে মনে হচ্ছে। আমি চিন্তিত গলায় বলি, এটা ছোঁয়াচে নয় তো?

না বোধহয়। ছেলেটা বলল, যারা অনেক দিন ধরে এখানে আছে, কিন্তু এখানকার লোকেদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক গড়েনি, তাদের মধ্যে আমি এমন কিছু দেখিনি। তবে এটাও সত্যি যে, শুধু মার্শ নয়, গিলম্যান, ইলিয়ট বা ওয়েটসদের মতো সব কটা বনেদি পরিবারই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে।

এরপর আর কথা বলার মতো কিছু ছিল না। শহরটার অধিকাংশ আলো কাজ করে না, রাস্তার নাম-লেখা ফলকগুলোও নেই। তাই ছেলেটাই আমার জন্য একটা মোটামুটি স্কেচ ম্যাপ এঁকে দিল। রেস্তরাঁটা দেখে ভক্তি হয়নি। দুপুরের খাবার হিসেবে একগাদা চিজ ক্র্যাকার আর ওয়েফার কিনে আমি ইন্সমাউথ-পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লাম।

আমার প্ল্যান ছিল সরু গলি এড়িয়ে যথাসম্ভব বড়রাস্তায় ঘোরা, কোনও বহিরাগতকে দেখতে পেলে তার সঙ্গে গল্প জমিয়ে শহরটা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া, শেষে রাত আটটার কোচটা ধরা। সেইমতো বেরিয়ে আমি আগে ব্রিজ পেরিয়ে রিফাইনারির দিকেই এগোলাম। একটা কারখানা বলতেই যে পরিমাণ আওয়াজ বা হট্টগোলের কথা আমরা ভাবি, তার কিছুই শুনতে পেলাম না। ওর চেয়ে বেশি আওয়াজ তুলে মানুক্সেট নীচে, সমুদ্রের দিকে লাফিয়ে পড়ছিল। ওখানে একটা খোলা জায়গার চারপাশে রেডিয়াল প্যাটার্নে বেশ কয়েকটা রাস্তা দেখলাম। মনে হল, টাউন স্কোয়্যার তৈরি হওয়ার আগে ওটাই বোধহয় শহরের প্রধান জায়গা ছিল।

বড়রাস্তা ধরেই এগোলাম। ব্রিজ পেরোনোর পর শহরের যে অংশটায় ঢুকলাম, সেটা পুরোপুরি পরিত্যক্ত বলে মনে হল। বাড়িগুলোর শুধু ছাদ ঢালু হয়ে নীচে নামেনি, আস্ত বাড়িগুলোই পড়ো-পড়ো হয়ে আছে। এর সঙ্গে যোগ করুন সারি সারি খোলা, ফ্রেম-ভাঙা জানলার সারি। কয়েকটা বাড়ির একতলায় লোক থাকে বলে মনে হল, কিন্তু সেগুলোর জানলা একেবারে তক্তা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেখলাম। সব মিলিয়ে, রাস্তা ধরে যেতে যেতে অব্যাখ্যাত একটা ভয় আমার ওপর চেপে বসছিল। মনে হচ্ছিল, শহরটা অজস্র অন্ধ চোখ মেলে আমাকে দেখছে আর গিলে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে!

বড়রাস্তা থেকে ফিশ স্ট্রিট। ফাঁকা হলেও তার দু-ধারের বেশ কিছু গুদাম আর বাড়িঘরের অবস্থা বেশ ভালো দেখলাম। ওয়াটার স্ট্রিটের অবস্থাও তথৈবচ। পুরো এলাকায় কয়েকজন জেলে ছাড়া আমি কাউকে দেখতে পাইনি। মানুক্সেটের আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া কিছু শুনতেও পাচ্ছিলাম না। স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়ছিল। ওখানে আর বেশিক্ষণ থাকতে ভরসা পেলাম না। ফিশ স্ট্রিট ব্রিজ ভাঙা, এমনটাই এঁকেছিল ছেলেটা। তাই আমি বড়রাস্তার ব্রিজ ধরেই নদীর উত্তরদিকে এগোলাম। তার মধ্যেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে হচ্ছিল, কেউ আমার পিছু নিয়েছে কি না!

নদীর উত্তরে মনে হল, লোকজন থাকে। ওয়াটার স্ট্রিটের কয়েকটা গুদামে লোকেদের মাছ প্যাক করতে দেখলাম। চিমনি থেকে ধোঁয়াও বেরোচ্ছিল কোনও কোনও বাড়িতে। আলোছায়ায় ভুলও দেখতে পারি, তবে সরু গলিতে কিছু কিছু চেহারাকে চলতে-ফিরতেও দেখলাম। হ্যাঁ, তাদের দেখে আমার মনে হল, অসুখই হোক বা রক্তের দোষ, ইন্সমাউথ লুক বলতে যে জিনিসটা আমি বুঝেছি, সেটার প্রাদুর্ভাব শহরের এই অংশে আরও বেশি। কিন্তু আমার কাছে পরিবেশটা অস্বস্তিকর হচ্ছিল কিছু শব্দের জন্য। শব্দগুলো খুবই সাধারণ, ঘষটানো, দ্রুতপায়ে কারও সরে যাওয়া, ভারী গলায় কিছু দুর্বোধ্য শব্দ…! এমনিতে এগুলোতে আমার কিছুই মনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শব্দগুলো আসছিল এমন সব বাড়ি বা গুদাম থেকে, যার জানলা-দরজা সব একেবারে বোর্ড দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে!

আমার হঠাৎ মনে হল, এই চলাফেরার আওয়াজ যাদের, তাদের গলার আওয়াজ কেমন হবে? তখনও অবধি আমি কারও গলা শুনিনি। শোনার ইচ্ছেও ছিল না, এটাই সত্যি।

বড়রাস্তা আর চার্চ স্ট্রিটে দুটো একদা সুন্দর, এখন স্রেফ ধ্বংসস্তূপ হয়ে থাকা চার্চ পেছনে ফেলে আমি এলাকাটা থেকে বেরিয়ে এলাম। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বুঝলাম, ভেতরে ভেতরে কতটা টেনশন জমে উঠেছিল আমার মধ্যে! এরপর ভাবলাম, এখানকার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় জমায়েতের জায়গা নিউ চার্চ গ্রিন-এ টু মারি। কিন্তু দোকানের ছেলেটা বলেছিল যে ওটা এখন ডাগনের দলবলের আচ্ছা, তাই বহিরাগতদের পক্ষে বিপজ্জনক। তা ছাড়া ওই বাড়ির বেসমেন্টেই আমি ভয়ানক চেহারাটা দেখেছিলাম। যাজকমশাইয়ের অমন চেহারা বিশেষ গয়না পরার ফলেই হোক বা কোনও শিরস্ত্রাণ পরার ফলে, ওখানে যেতে আমার সাহসে কুলোল না।

চার্চটাকে এড়িয়ে আমি আবার ফেডারেল স্ট্রিট ধরে শহরের বনেদি জায়গাটায় ঢুকলাম। কাউকে দেখতে না পেলেও মনে হল, শহরের এইদিকের বাড়িগুলোয় বোধহয় কিছু লোক থাকে। অবহেলা আর নির্জনতা অধিকাংশ বাড়িকে গিলে ফেললেও জায়গাটার মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমান্স আছে, মানতেই হবে। বাড়িগুলোর পুরোনো গড়নের খুঁটিনাটি, হাড়-বের করা রাস্তার দু-ধারে গাছের ঝিমন্ত সারি– এসব দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম। ওয়াশিংটন স্ট্রিটে পরপর গোটা চারেক বাড়ি দেখলাম, যারা শক্তপোক্ত অবস্থাতেই আছে। তাদের মধ্যে একটা বাড়ি বিশাল জায়গা জুড়ে বানানো। সেটা দেখতে সুন্দর, তার সবুজ লন আর সযত্নলালিত চেহারা দেখে মনে হল, মার্শ রিফাইনারির মালিকের বাড়ি এটাই হতে পারে।

লোকজন না দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম ততক্ষণে। কিন্তু আমার তাজ্জব লাগছিল এটা ভেবে যে, গোটা শহরে কোনও কুকুর-বেড়াল দেখতে পাচ্ছি না কেন? তা ছাড়া সব বাড়িতে, এমনকী যেগুলোর অবস্থা বেশ ভালো, তাতেও তিনতলা আর ছাদের ঘরগুলো দেখলাম একেবারে সিল করার মতো বন্ধ হয়ে আছে। এর কোনও ব্যাখ্যাও আমি খুঁজে পেলাম না।

গোটা শহরটায় মৃত্যুর এমন একটা ছায়া পড়েছিল, যে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি বন্ধ জানলার পেছন থেকেই হয়তো বহু চোখ আমায় দেখছে। তখনই বড় ঘড়িতে তিনটে বাজল। সেই শব্দে, আর তার চেয়েও বেশি করে ওই ঘড়ি যে চার্চে আছে, তার কথা ভেবে আমার একেবারে পিলে চমকে গেল!

ওয়াশিংটন স্ট্রিট ধরে নদীর ধার দিয়ে হেঁটে আমি শহরের আরও একটা একদা ব্যস্ত, এখন পরিত্যক্ত এলাকায় এলাম। কারখানাগুলো ভেঙে মাটি আর বালিতে মিশে যাচ্ছে। রেললাইনে মৃতপ্রায় ঘাসেরা দুলছে। রেল স্টেশনের কয়েকটা টুকরো শুধু পড়ে আছে। রেল ব্রিজটার গায়ে বড় বড় করে সাবধান লেখা থাকলেও আমি কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই সেটা পার হলাম। ওপাশে, মানে নদীর দক্ষিণ তীরে আমি আবার কিছু মানুষ দেখলাম। কিন্তু তাদের নিশ্চুপ চলাফেরা, আমাকে আড়চোখে দেখা… এসব আর নিতে পারছিলাম না। ঠিক করে ফেললাম, পেইন স্ট্রিট ধরে আমি হোটেলে নিজের ঘরে ফিরে যাব, আর রাত আটটায় ওই বদখত কোচ আমাকে এই যাচ্ছেতাই শহর ছেড়ে কত তাড়াতাড়ি নিয়ে যাব, তার অপেক্ষায় থাকব। সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, ডানদিকে একটা জরাজীর্ণ দমকল দফতর। সেখানে রংচটা উর্দি-পরা দু-জন দমকলকর্মীকে দেখলাম, যাদের চেহারা অগোছালো হলেও তাতে ইন্সমাউথ-সুলভ কিছু নেই। তারা এক লালমুখো, দাড়িওয়ালা, ঘোলা চোখের বুড়োর সঙ্গে খোশগল্প করছিল।

বুঝতে পারলাম, ভয়াল-ভয়ংকর গল্প আর শোনা কথার ভাণ্ডারী, মাতাল ও অতি-প্রাচীন জাডক অ্যালেনের সন্ধান পেয়ে গেছি!

.

০৩.

ভাগ্য? নিয়তি?? ওরকম কিছু একটাই সে দিন আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল। মন চাইছিল স্কোয়্যারে ছুটে গিয়ে বাসটার জন্য অপেক্ষা করতে, যাতে ওই যাচ্ছেতাই জায়গাটা ছেড়ে চলে যাওয়া যায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু আমি থেমে গেলাম ওই বুড়োকে দেখে। জানতাম, লোকটা যা বলবে, তার প্রায় সবটাই নেশাগ্রস্ত মগজ আর জরাজীর্ণ স্মৃতির ফসল। এ-ও জানতাম যে, লোকটার সঙ্গে কথা বলছি দেখলে স্থানীয় লোকজন রেগে যাবে। তবু মনে হল, একসময়ে গমগম-করা ইন্সমাউথের আজকের এই দশা হওয়ার কারণটা বুঝতে গেলে আমার জাডক অ্যালেনের সঙ্গেই কথা বলা দরকার। শুনেছিলাম, সবচেয়ে ভয়ংকর বা রং-চড়ানো গল্পগাছার পেছনেও একটা সত্যের বীজ থাকে। তাতেই লুকিয়ে থাকে ইতিহাস। তাই মনে হল, অ্যালেনের সেই গল্পগুলো শোনা যাক। হয়তো সত্যিটা আমি বুঝে, বা খুঁজে নিতে পারব।

ওখানে লোকটার সঙ্গে কথা বলতে গেলে দমকলকর্মীদের সঙ্গে ঝামেলা হতে পারে– এটা ভেবে আমি একটা প্ল্যান করলাম। দোকানের ছেলেটা আমাকে বলেছিল কোথায় মদ কিনতে পাওয়া যায়। ঠিক করলাম, মদের একটা বোতল জোগাড় করে এই জায়গাটার আশপাশে অলসভাবে ঘোরাঘুরি করব। পাঁড়মাতাল জাডক যদি বোতলের টানে আমার সঙ্গে ভাব জমায়, তাহলে নিশ্চয় কারও কিছু বলার থাকবে না।

ইলিয়ট স্ট্রিটের একটা নোংরা দোকান থেকে এক বোতল মদ জোগাড় করলাম। দোকানদারের মধ্যে ইন্সমাউথের চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো সবে দেখা দিতে শুরু করেছিল। হয়তো আমার মতো অনেক বাইরের লোক-এর সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় বলেই লোকটির আচরণ বেশ ভদ্র ছিল। কপাল ভালো বলতে হবে, কারণ বোতল হাতে বেশি ঘুরতে হল না। পেইন স্ট্রিটের বাইরে গিলম্যান হাউসের এক কোণেই জাডক অ্যালেনের শীর্ণ, লম্বা, টলমলে চেহারাটা দেখতে পেলাম। বোতলটা হাতে ধরে ওয়েইট স্ট্রিটের দিকে বাঁক নিতেই বুঝলাম, কাজ হয়েছে। চুম্বকের টানে আলপিনের মতো অ্যালেন আমার পিছু নিয়েছে।

নকশাটা মাথায় রেখে হাঁটছিলাম আমি। আমার লক্ষ্য ছিল দক্ষিণদিকের জেটি আর রাস্তাগুলো, যার ওপাশেই সমুদ্র। ওইদিকটা যে একেবারে নির্জন– এটা ভেবেই ঠিক করেছিলাম, অ্যালেনের সঙ্গে আলাপ ওখানেই সারব। মেইন স্ট্রিট অবধি পৌঁছোনোর আগেই পেছন থেকে ফাঁসফেঁসে গলায় একটা শুনছেন? ও মশাই! আওয়াজ পেলাম। চুপচাপ দাঁড়ালাম। জাডক এসে, একেবারে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো আমার কাছ থেকে বোতলটা নিয়ে নিল। হাঁটতে হাঁটতে ওর চুমুক দেওয়া, আর আমার হালকা-পলকা প্রশ্নমালা চলতে থাকলেও ও সাড়া দিচ্ছিল না। অবশেষে, ওয়াটার স্ট্রিট পেরিয়ে একটা ঘাসজমি দেখলাম। ওটার একদিকে ভাঙাচোরা নিচু দেওয়াল, অন্যদিকে সমুদ্র, আর সামনে থেকে শহরটার দিকে নজর রাখা যায়। ওখানে কয়েকটা শ্যাওলা-ধরা পাথরও ছিল। মাছের আঁশটে গন্ধ আর জায়গাটায় লেগে-থাকা মৃত্যুর আবহ আমার মাথায় চেপে বসছিল। তবু ঠিক করলাম, ওখানেই জাডক অ্যালেনের গুপ্তকথা শুনব।

রাত আটটার কোচ ধরে আর্কহ্যামের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে আমার হাতে ঘণ্টা চারেক সময় ছিল। বুড়োর মুখ খোলানোর জন্য ওকে মদ খাওয়াতে গিয়েও আমাকে খেয়াল রাখতে হচ্ছিল, যাতে বেশি খেয়ে ও ঘুমিয়ে না পড়ে। বুড়ো বকবক করছিল, তবে দুনিয়ার অন্য সব কিছু নিয়ে। এইভাবে প্রায় দু-ঘণ্টা কাটলে আমার চিন্তা শুরু হল। মনে হল, এই এক বোতল মদে বোধহয় বুড়োর গলা আসল কথা বলানোর মতো ভিজবে না। ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটল।

সমুদ্রের দিকে পিঠ দিয়ে আমি বসেছিলাম। আমার মুখোমুখি বসেছিল জাডক। তীর থেকে অনেকটা দূরে হলেও জলের ওপর ভেসে-থাকা ডেভিলস রিফকে তখন একদম স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। দৃশ্যটা জাড়কের পছন্দ হয়নি। নিচু গলায় ও গাল পাড়তে শুরু করল। খানিকটা ঝোঁকের মাথায় ও আমার কোটের হাতা ধরে সামনে এগিয়ে এল। তারপর বলল, ওই যে! শয়তানের জায়গা! ওখান থেকেই গভীর জল শুরু। এত গভীর জায়গাটা, যে কোনও তলই পাওয়া যায় না ওখানে। তবে একজন তল পেয়েছিল। ওবেদ মার্শ।

ঘড়ঘড়ে গলায় বলা কথাটা সেই কমে-আসা আলোয় আমার হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। কিন্তু একটা কথাও না বলে আমি মুখ বন্ধ করে রইলাম। আমি জানতাম, জাডক অ্যালেনের মুখ খুলে গেছে।

সময়টা তখন বড় খারাপ ছিল, বুঝলেন। ব্যাবসাপত্তর লাটে উঠেছে। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এক-এক করে। এখানে জাহাজের কারবার যারা করত, সে আইনি হোক বা বেআইনি, সবাই ১৮১২-র যুদ্ধে খুব ঝাড় খেয়ে আর মাথা তুলতে পারেনি! তখন এই শহরে ব্যাবসা করার মতো দম ছিল শুধু ক্যাপটেন ওবেদ মার্শের। ওঁর তিনটে জাহাজ ছিল, ব্রিগ্যান্টাইন কলাম্বি, ব্রিগ হেটি আর বার্ক সুমাত্রি কুইন। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর সঙ্গে ব্যাবসা করতেন মার্শ। হয়তো ওখানেই ওঁর মতিগতি বিগড়ে গিয়েছিল। নইলে ওইরকম কথা কেউ বলে?

কীরকম কথা? নিচু গলায় প্রশ্নটা করলাম।

অসহায় হয়ে যারা ক্রিশ্চান মিশনে সাহায্য চাইত, মার্শ তাদের ব্যঙ্গ করতেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল জাডক, উনি বলতেন, লোকেদের উচিত অন্য দেবতার উপাসনা করা। এমন কোনও দেবতা, যে কথা শুনবে। যে ওদের দেওয়া উপচার আর উৎসর্গ গ্রহণ করে ওদের ভালো রাখবে।

চুপ করে রইলাম। জাডক জড়ানো গলায় বলে চলল।

 মার্শের ফার্স্ট মেট ছিল ম্যাট ইলিয়ট। ওর একটু বকবক করার স্বভাব ছিল। ওর কাছে শুনেছিলাম, নাবিকরা নাকি ধর্মের নামে উলটোপালটা কাজ করছে। আর এই ব্যাপারটা হয়েছে জাহাজগুলো একটা বিশেষ দ্বীপে যাওয়ার পরেই। দ্বীপটার কাছে একটা আগ্নেয়গিরি আছে। তবে আসল জিনিস ছিল ওই দ্বীপের ধ্বংসস্তূপ! সেগুলোর নাকি বয়সের গাছপাথর নেই। ম্যাট বলছিল, তাতে বিশাল বিশাল সব মূর্তি আছে, প্রাসাদ আছে, আর সেসবের গায়ে এমন সব কারুকাজ আছে, যা দেখলে রাতের ঘুম উড়ে যায়। কিন্তু সব কিছুই দেখে মনে হয়, যেন দ্বীপটা অনেক অনেকদিন জলের তলায় ছিল।

সে তো অনেক জায়গা দেখেই মনে হয়। আলতো করে বললাম, নাবিকরা তারপর বদলে গেল কেন?

ম্যাট বলেছিল, ওই দ্বীপে যারা থাকে, তাদের নাকি মাছের কোনও অভাব হয় না। মানে ব্যাপারটা ভাবুন! প্রায় পাশের দ্বীপে যারা থাকে, তারাও মাছ খুঁজে হয়রান হয়, কিন্তু ওই দ্বীপে মাছের ভারে জাল ভেঁড়ার জোগাড়। আর শুধু কি মাছ? দ্বীপে যারা থাকত, তারা আজব ডিজাইনের গয়না পরত। আজব… মানে তাতে যেসব নকশা থাকত, ওই জিনিস আপনি আর কোথাও দেখবেন না। মাছ আর ব্যাঙের মাঝামাঝি অনেক প্রাণীর চেহারা নকশা করে বসানো থাকত ওই গয়নাগুলোতে। কোত্থেকে ওই গয়নাগুলো পাওয়া যায়, এই নিয়ে ওখানকার লোকেদের যতই জিজ্ঞেস করা হোক, তারা বলত না, বা বলতে পারত না।

ওবেদ মার্শের চোখে আরও দুটো জিনিস ধরা পড়ে ওই দ্বীপে থাকার সময়। প্রথমত, ওখানে বুড়ো লোকেদের দেখা পাওয়া যেত না। কমবয়সি যাদের দেখা যেত, তাদের চেহারা ওই তল্লাটের অন্যান্যদের থেকে… আলাদা। দ্বিতীয়ত, দ্বীপের কমবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে কেউ-না-কেউ প্রতি বছরেই উধাও হয়ে যেত। ওদের ভেতরের ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক নয়, কিন্তু জিনিসটা মার্শ খেয়াল করেছিলেন।

আর কেউ এই জায়গায় কী করত জানি না, কিন্তু মার্শের ধৈর্য আর বুদ্ধি, দুটোই গড়পড়তা লোকের চেয়ে বেশি ছিল। ওই দ্বীপের বাসিন্দাদের নেতার নাম ছিল ওয়ালাকিয়া। ওর সঙ্গে কথা বলে মার্শ জানতে পারেন, কাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে ওই গয়নাগুলো। হাহ্ সেসব কি আর কেউ বিশ্বাস করবে! তবে হ্যাঁ, আপনি করলেও করতে পারেন। আপনার চোখজোড়া ক্যাপটেন মার্শের মতোই ধারালো ঠেকছে। তাই আপনাকে বলা যায়।

কানাকিয়া, মানে ওই দ্বীপে যারা থাকত, সেই উপজাতির লোকেরা এক বিশেষ ধরনের দেবতার পুজো করত। গয়নার গায়ে নকশাগুলো মনগড়া নয়, সেগুলো নাকি ওইসব দেবতার চেহারা। তাদের পুজো মানেও খুব সহজ ব্যাপার। দ্বীপের কমবয়সি ছেলেমেয়েদের ওই দেবতাদের কাছে বলি দিলেই তাঁরা তুষ্ট হয়ে গয়না, অঢেল মাছ এসবের ব্যবস্থা করেন। ওই দেবতারা জলের নীচে নানা শহরে বাস করেন। ওই দ্বীপটাও নাকি জলের তলা থেকেই উঠে এসেছে ভূমিকম্পের ফলে। আশপাশের দ্বীপ থেকে যখন লোকে এই দ্বীপে আসে, তখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ওই দেবতাদের কাউকে কাউকে তারা দেখতে পায়। তারপর একটু একটু করে ভাবের আদানপ্রদান হয়। শেষে এই ব্যবস্থা চালু হয়।

ওই দেবতা বা প্রাণীরা নরবলি জিনিসটা খুব পছন্দ করত। এককালে নাকি মানুষ ওদের কাছে নরবলি দিত, কিন্তু সে বহু যুগ আগের ব্যাপার। বলি পেলে ওরা গোটা সমুদ্রের মাছ নিয়ে আসবে ওই দ্বীপের কাছে এই শর্ত দেওয়া হল। তখন ওই দ্বীপের বাসিন্দাদের আপত্তি করার মতো অবস্থা ছিল না। তারা রাজি হল।

প্রথমদিকে কানাকিয়ারা ওই আগ্নেয় দ্বীপটার কাছে নৌকো করে যেত বলি হিসেবে ছেলেমেয়েগুলোকে রেখে আসতে, আর ওই প্রাণীদের তরফে উপহার হিসেবে পাওয়া গয়না নিয়ে আসতে। পরে ওই প্রাণীরা মূল দ্বীপেও আসতে থাকে। তারপরেই ওরা…!

জাডক অ্যালেন চুপ করে যাওয়ায় আমার প্রথম চিন্তা হল, মদ কি শেষ? বোতলে তখনও জিনিস আছে দেখে আমি লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। ওর মুখে ঘেন্না আর ভয়ের এমন একটা মিশ্রণ ফুটে উঠেছিল, যেটা আমি বোঝাতে পারব না। একটু চুপ করে থেকে ও আবার বলতে শুরু করল।

তারপরেই ওরা বলে, দ্বীপের মানুষদের সঙ্গে ওরা মেলামেশা করতে চায়। মানে শরীরী মেলামেশা! শুনে কানাকিয়ারাও ভড়কে গিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই। তবে ওই প্রাণীরা ওদের বোঝায়, সৃষ্টির একেবারে আদি যুগে সবরকম প্রাণই তৈরি হয়েছিল জলের গর্ভে। তাই চেহারায় সামান্য কিছু অদলবদল করে নিলে ব্যাপারটা নাকি অসম্ভব কিছু নয়। তা ছাড়া…

আমার গা গোলাচ্ছিল। তবু যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তা ছাড়া?

তা ছাড়া, ওইরকম… মেলামেশার ফলে যেসব সন্তানসন্ততি জন্মাবে, তাদের কিছু বিশেষত্ব থাকবে। জন্মের পর থেকে একটা বয়স অবধি তাদের চেহারা থাকবে মানুষেরই মতো। তারপর তারা ক্রমেই বদলে গিয়ে ওই প্রাণীদের মতো হয়ে যাবে। তখন জলের অতলে হারিয়ে-যাওয়া শহর, দেশ, মহাদেশ… এগুলোই হবে তাদের বাসস্থান। সবচেয়ে বড় কথা কী জানেন? সেই সন্তানদের স্বাভাবিক মৃত্যু হবে না, যদি না কেউ তাদের মেরে ফেলে।

নিজের না হলেও, সন্তানের অমরত্ব… এই জিনিসের টান কতটা ভাবতে পারছেন?

আমার চোখে অবিশ্বাসের ভাবটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলে জাডক একটু থতিয়ে গেল। তারপর আবার বলতে শুরু করল দুলে দুলে।

এইসব কথা কি আর সহজে মানা যায়? ওবেদ মার্শও মানেননি। কিন্তু দিনের পর দিন ধরে দ্বীপের লোকজনের সঙ্গে সহজভাবে, সাবধানে কথা বলে মার্শ বোঝেন, ওয়ালাকিয়া মিথ্যে বলেনি। সত্যিই ওই দ্বীপের সব্বার শিরায় ওইসব প্রাণীর রক্ত বইছে, কম বা বেশি মাত্রায়। একটা বয়সের পর চেহারা পালটে যায় ওদের। যারা জলে যেতে পারে, তারা চলে যায়। মাঝেমধ্যে নিজের বংশজদের সঙ্গে দেখা করার জন্য তারা ফিরেও আসে, এমনকী কয়েকশো বছর পরেও, কারণ তাদের মৃত্যু নেই। যারা জলে যেতে পারে না, তারা থেকে যায় ডাঙাতেই, তবে তাদের দেখে মানুষ বলে চেনার উপায় থাকে না। কিন্তু জলে হোক বা স্থলে, ওদের মৃত্যু হয় শুধু অন্য দ্বীপবাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ে, বলি হিসেবে, আর নয়তো বাইরে থেকে আসা কোনও মানুষের দ্বারা বাহিত রোগজীবাণুর আক্রমণে।

অন্য কেউ এইরকম অবস্থায় কী করত? বলা কঠিন, তবে ওবেদ মার্শ বিস্তর ভেবে সিদ্ধান্ত নেন, দ্বীপবাসীরা যা করেছে, তার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। অবশ্য জলের নীচ থেকে আসা সেই আদিম প্রাণীদের দেখা পাননি মার্শ। তবে ওয়ালাকিয়াকে বিস্তর চাপ দিয়ে উনি কয়েকটা মন্ত্র শিখে নিয়েছিলেন, আর পেয়েছিলেন একটা ধাতুর টুকরো। ওয়ালাকিয়া মার্শকে বলেছিল, যেরকম জায়গায় ওইসব প্রাণী থাকতে পারে, তেমন কোথাও ওই ধাতুর টুকরোটা ফেলে দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করলে তারা উঠে আসে। তারপর তাদের সঙ্গে বোঝাঁপড়ায় আসা… সেটা মার্শের দায়িত্ব।

ম্যাট, মানে ওবেদের ফার্স্ট মেট ওই দ্বীপের ত্রিসীমানায় থাকার পক্ষপাতী ছিল না। কিন্তু ক্যাপটেন ওর কথা শোনেননি। ওবেদ বুঝে গিয়েছিলেন, ওই গয়নাগুলো সরাসরি বেচতে গেলে লোকে ভড়কে গেলেও ওগুলো গলিয়ে-পাওয়া সোনা বেচে ভালো রোজগার করা যায়। উনি নিজের বাড়ির মহিলাদের কিছু গয়না পরতে দিতেন। আর কিছু নাবিক, তাদের বারণ করা সত্ত্বেও কিছু গয়না বাজারে বেচে দিত। তবে এই কারবার ১৮৩৮ অবধি চালানো গিয়েছিল। ওই বছর দ্বীপে পৌঁছে জানা যায়, দ্বীপে আর কেউ বেঁচে নেই। খোঁজ নিয়ে মার্শ জানতে পারেন, অন্যান্য দ্বীপের বাসিন্দারা খবর পেয়েছিল, ওই দ্বীপে কী হচ্ছে। তারাই নাকি আক্রমণ করে দ্বীপের প্রতিটি প্রাণীকে নিকেশ করেছিল! শুধু প্রাণীই নয়, মূর্তি, প্রাসাদ, ধ্বংসস্তূপ হয়ে-থাকা দালানকোঠা, সবই প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তারা।

তারপর? আমার মুখ থেকে প্রশ্নটা আপনা থেকেই বেরোল।

ওবেদ মার্শের কারবার মার খেয়ে গেল। ওঁর নিজস্ব জাহাজি ব্যাবসায় তখন মন্দা চলছিল। তা-ও, যদি এটা শুধু ওঁর ব্যাবসার লাভ-লোকসানের কথা হত, তাহলে ব্যাপারটা ওইদিকে বাঁক নিত না।

কোন দিকে?

আরে বাবা, মার্শের ব্যাবসার ওপর তো সরাসরি বা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে গোটা ইন্সমাউথ নির্ভর করত। অন্যান্য ব্যাবসাবাণিজ্য সবই তো প্রায় লাটে উঠেছে তখন। মাছ নেই, কারখানা বন্ধ, আর ওই বছরের পর সোনার কারবারও বন্ধ। কী অবস্থা হল শহরটার, ভাবতে পারেন?

অধিকাংশ মানুষ ভাগ্যের কাছে নিজেকে ছেড়ে দিল। তখনও এই শহরে কিছু কিছু ক্রিশ্চান মিশন ছিল। লোকে পেটের টানে সেখানেই হাত পাতল, সপরিবারে।

কিন্তু ওবেদ মার্শ সেটা করেননি! উনি অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন। উনি সরাসরি বলেন, চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করে কোনও লাভ নেই। বরং উনি এমন দেবতাদের কথা জানেন, যারা প্রার্থনায় সাড়া দেয়, এনে দেয় মাছ আর… সোনা! ওঁর জাহাজগুলোয় যারা কাজ করত, তারা তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলে, মার্শ কী বলতে চাইছেন। কিন্তু ওরা কথাগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও, শহরের বাকি লোকেদের সেই ইচ্ছে বা উপায় ছিল না।

এই অবধি বলার পর জাডক অ্যালেন চুপ করে গেল। ও বারবার আশপাশে তাকিয়ে দেখছিল। মনে হল, ও আশঙ্কা করছে, কেউ আমাদের এই কথাগুলো শুনছে। আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। এইসব কিংবদন্তির গভীরেও একটা সত্যি থাকে। এখানেও নিশ্চয় সুদূর কোনও দ্বীপ থেকে নিয়ে-আসা একটা চর্মরোগ বা আরও গুরুতর অসুখের কথাই বলা হয়েছে। সঙ্গে মিশে গেছে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু গোছের উপদেশ। কিন্তু জাড়কের গল্পে এমন একটা আতঙ্কের ভাব ছিল, যেটা নীতিকথার সঙ্গে মেলানো যাচ্ছিল না। তা ছাড়া নিউবারিপোর্ট মিউজিয়ামের সেই টায়রা গোছের গয়নাটা তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তাহলে…?

জাডককে বোতলটা দিলাম। একেবারে শেষ বিন্দুটা গলায় না-গড়ানো অবধি ওটাকে ও মুখেই ধরে রইল। লোকটা এতটা মদ, তা-ও একেবারে নির্জলা, খেল কীভাবে? তবে ওসব জিজ্ঞেস করিনি আমি। ওর জড়ানো গলায় বলা কথাগুলোর মানে বোঝার জন্য আমাকে লোকটার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছিল। কিছুক্ষণের চেষ্টায় জাডক অ্যালেন নিজের গলার আওয়াজ খুঁজে পেল, তারপর বলতে শুরু করল।

ম্যাট চেষ্টা করেছিল। শহরের লোকেদের ও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কেন ওইসব দেবতা মোটেই সুবিধের জিনিস নয়। কিন্তু কী হল? কিসসু না! মেথডিস্ট, ব্যাপটিস্ট… অন্য যা কিছু চার্চ ছিল তখন এখানে, সেগুলো ফাঁকা হয়ে গেল। যারা ওদের হয়ে প্রচার করত, তারা হয় শহর ছাড়ল, নয় স্রেফ গায়েব হয়ে গেল। ঈশ্বরের নামের বদলে শহরের বাতাসে ভাসল অন্য অনেকগুলো শব্দ– ডেগন, আশতরেথ, বেলিয়াল, বিইলজেবাব! কানান আর ফিলিস্তিনের সেইসব ভুলে-যাওয়া, ভয়ংকর দেবতারা…!

জাডকের চোখ বুজে এসেছিল। আমার ভয় হল, অতখানি তরলের চাপে ও বোধহয় এবার ঘুমিয়েই পড়েছে। লোকটার কাঁধ ধরে আলতো ঝাঁকুনি দিতেই ওর চোখ খুলে গেল। একদম স্পষ্ট গলায় ও বলে উঠল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তা-ই তো? তাহলে বলুন তো, ক্যাপটেন ওবেদ মার্শ আর তাঁর সঙ্গে এই শহরের জনা কুড়ি লোক ওই ডেভিলস রিফ-এ গিয়ে কী করতেন? ওখানে যেদিকটায় সমুদ্র এত গভীর যে, আজ অবধি তল পাওয়া যায়নি, সেখানে ওরা বস্তায় ভরে কী… বা কাদের ফেলত? সেই ধাতুর টুকরোটা দিয়ে কী করেছিলেন ওবেদ মার্শ? বছরের বিশেষ বিশেষ তিথিতে ওখানে গিয়ে কোন মন্ত্র পড়া হয়? সবচেয়ে বড় কথা, নতুন-হওয়া এই চার্চগুলোয় যাজকরা কেন কাপড়, ওবেদের আনা ওই গয়নার মতো অলংকার, আর বিশেষ ধরনের শিরস্ত্রাণে নিজেদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখে?

লোকটার গলায় এমন একটা হিংস্রতা ফুটে উঠেছিল যে, আমি কিছুটা পিছিয়ে গেলাম। সেই দেখে বিশ্রীভাবে হেসে উঠল জাডক। তারপর আবার কথা শুরু করল।

ভয় পাচ্ছেন? শুধু আমার কথা, আমার এই গল্প শুনেই ভয় পাচ্ছেন? তাহলে আমি যা দেখেছি তা দেখলে কী করতেন? আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে আমি অনেক কিছুই দেখতাম। আড়ি পেতে ওবেদ মার্শের ব্যাবসা আর জাহাজের সঙ্গে যুক্ত লোকেদের অনেক কথাই শুনতাম। তবে সেগুলো যে সত্যি, সেটা বুঝলাম নিজের চোখে ওদের দেখে।

কাদের?

ডেভিলস রিফ থেকে যারা উঠে আসে, তাদের। কী করে দেখলাম জানেন? আমার বাবার একটা নৌকো ছিল। সেটা নিয়ে চুপিচুপি মার্শের নৌকোর পিছু নিয়েছিলাম। মেঘলা রাতেও বুঝতে পারছিলাম, রিফের ওপরে থিকথিক করছে কারা যেন। চাঁদ উঠল। ওই প্রাণীগুলো ঝপাঝপ জলে নেমে পড়ল, কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না! আমি দেখেছিলাম, ওরা মানুষ নয়। ওরা কথা বলে, তবে ইশারায়। আর সেই ইশারা…!

জাডকের কথাগুলো ক্রমেই অসংলগ্ন হয়ে উঠছিল। তবু আমি বুঝতে পারছিলাম, ও কী বলতে চাইছে।

একরাতে আপনি দেখলেন, ওখানে কিছু ফেলা হল। পরদিন সকালে আপনি জানলেন, আপনার তরতাজা জোয়ান বন্ধুটি হারিয়ে গেছে। আপনি দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারবেন না? বিশেষ করে যখন ওবেদ মার্শের কপাল খুলে গেল, ঠিক সেই সময়েই! ওঁর পরিবারের মেয়েদের গায়ে নতুন ডিজাইনের গয়না উঠল। ওঁর রিফাইনারির চিমনি দিয়ে আবার ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। নিউবারিপোর্ট, আর্কহ্যাম, বস্টন– এমন নানা বন্দরে আবার শুরু হল জিনিস পাঠানো। আর এল মাছ! এত মাছ, ইন্সমাউথের মানুষ জীবনে দেখেনি।

আশপাশের জায়গার লোকেদের চোখ টাটাল। কিংসপোর্ট থেকে ক-জন এখানে মাছ ধরতে এল বটে, তবে তারপর তাদের কী হল, কেউ জানে না। কিন্তু সেই নিয়ে কে ভাববে? তত দিনে শহরের লোকেদের হাতে পয়সা আসছে। ব্রাঞ্চ রেললাইন বসেছে। ওই সময়েই মার্শ আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা এসোটেরিক অর্ডার অব ডেগন নামে একটা নতুন ধর্ম চালু করেন। সেই ডাগনের দলবল প্রথমেই ক্যালভারি কমান্ডারির লাগোয়া ম্যাসনিক হল কিনে নিজেদের চার্চ বসায়।

ম্যাট একে ম্যাসন ছিল, তায় এই ব্যাপারটা ও কিছুতেই সহ্য করেনি। এবার ও একেবারে রাস্তায় নেমে ওবেদ মার্শ এবং তাঁর চালু করা নতুন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। তারপর ওকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি! আমি বলছি না যে, মার্শ সরাসরি এতে জড়িত ছিলেন, তবে সোনা আর মাছের লোভ যে কী জিনিস…!

এভাবেই চলল বেশ ক-বছর। তবে ১৮৪৬-এ একটা ঘটনা ঘটল। সেই সময় শহরের সুস্থ মস্তিষ্কের লোকেদের মগজে অবশেষে বোধবুদ্ধি গজাল। কমবয়সি ছেলেমেয়েদের নিরুদ্দেশ হওয়া, ডেভিলস রিফ-এ গিয়ে কিছু লোকের রহস্যময় কাজকারবার, এবং অন্য সব চার্চ বন্ধ হয়ে ডাগনের প্রতিপত্তি বেড়ে যাওয়া এই জিনিসগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, এটা অনেকেই তখন বুঝে ফেলেছিল। একদিন যখন ওবেদের নৌকো ডেভিলস রিফ গেছে, তখন তাদের পিছু নিয়ে অন্য বেশ কয়েকটা নৌকোও যায় সেদিকে। প্রথমে গুলিগোলা, তারপর একটা বিরাট ধরপাকড় চলে। প্রায় শ-দেড়েক লোক গ্রেফতার হয়, যাদের মধ্যে ওবেদ মার্শও ছিলেন। কিন্তু এই উত্তেজনায় কী হয়েছিল, জানেন?

কেউ খেয়াল করেনি, কিন্তু প্রায় এক মাস ডেভিলস রিফ-এ কাউকে বলি দেওয়া হয়নি!

সেই রাতে আমি ছাদের টালির ফাঁকে লুকিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওই অদ্ভুত না-মানুষ, না-মাছ, না-ব্যাং চেহারাগুলোকে আমি উঠে আসতে দেখি সমুদ্র থেকে। ওরা প্রথমে দরজার কড়া নেড়েছিল। যারা খুলেছিল, তাদের সেখানেই…! নয়তো কারও রান্নাঘরে ঢুকে, কাউকে শোয়ার ঘরে, কাউকে রাস্তায় মেরে ফেলেছিল ওরা!

জেলের দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছিল সেই রাতে। চারদিকে আর্তনাদ, চিৎকার, কান্না, গুলির শব্দ। রাত ভোর হলে দেখেছিলাম, শুধু ক্যাপটেন ওবেদ মার্শ আর তার সঙ্গী বা অনুগামীরা বেঁচে আছে। বাকি গোটা শহর জুড়ে শুধু লাশের স্তূপ। টাউন স্কোয়্যার, রাস্তা, ঘর… সর্বত্র শুধু রক্ত। মার্শের সঙ্গীরা রটিয়ে দিল, শহরে অজানা রোগের থেকে মড়ক হয়েছিল। সেই মড়কেই বাকিদের সঙ্গে আমার বাবাও…!

থরথর করে কাঁপছিল জাডক। আমার কাঁধ শক্ত করে ধরে ও নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, তবে সেটা অন্য কারণে। ততক্ষণে জোয়ার এসেছে। আমার পেছনের পাথরে ছলাৎছল আওয়াজ তুলছিল সমুদ্রের ঢেউ। কিন্তু আঁশটে গন্ধটা কমছিল না, বরং বাড়ছিল।

পরদিন সকালে সব সাফ করা হল, কিন্তু রক্তের দাগ কি সহজে মোছে? ক্যাপটেন মার্শকে দেখে বুঝলাম, ওঁর মাথা খারাপ হতে আর বিশেষ বাকি নেই। আমাদের উদ্দেশে চিৎকার করছিলেন উনি। বলছিলেন, যারা আমাদের সোনা আর মাছ দেয়, তাদের পাওনা মেটাতেই হবে। অন্য কারও নয়, শুধু তাদেরই পুজো করতে হবে আমাদের। আমাদের এই মর্মে শপথ করতে হল। বলা হল, আমরা যেন বাইরের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা না করি। কেউ কিছু জানতে চাইলে যেন মুখ না খুলি। ব্যাস!

সমুদ্রের লাগোয়া কয়েকটা বাড়ি আলাদা করে দেওয়া হল, যেখানে ওই দেবতারা এসে মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করবেন। কথাগুলো না মেনে আমাদের উপায় ছিল না। শুধু লোভ নয়, ভয়টাও কাজ করছিল যে। আগের রাতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, ডেভিলস রিফ-এর তলায় ওইরকম প্রাণীদের সংখ্যা খুব খুব বেশি। ওদের বিরুদ্ধে লড়ব কী নিয়ে? কানাকিয়ারা এমন কিছু মন্ত্র জানত, বা ওই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিছু থেকে শিখে নিয়েছিল, যা দিয়ে ওদের ঠেকিয়ে রাখা যায়। আমরা সেগুলো কীভাবে জানব, বলুন?

আমি যা দেখেছি, যা জেনেছি, সেগুলোর জন্য অনেক আগেই ওরা আমাকে মেরে ফেলত। নেহাত শপথ নিয়ে রেখেছি। তাই যতক্ষণ না ওরা প্রমাণ করতে পারছে যে, আমি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে বাইরের কারও কাছে এই নিয়ে মুখ খুলেছি, ততক্ষণ ওরা আমাকে কিছু করবে না। এসব কথা বাইরে বেরোলে যে ওদের খুব অসুবিধে হবে। ওরা সবাই একসঙ্গে প্রার্থনা করে ওই ডেগনের চার্চে–ওদের বাচ্চারা নাকি আর মরে না, ফিরে যায় সমুদ্রে মা হাইড্রা আর বাপ ডেগনের কাছে। ওরা গান গায় –লা! লা! কথুলু ফ্যাগন! ফ্যাগলুই ম্যাগলনফ কথুলু রেলিওয় ওয়াহ-নাগল ফ্যাগন –

লোকে এসব কথা বিশ্বাসই করবে না। আমি বলতে বাধ্য হলাম, তা ছাড়া সোনা এমনই জিনিস যে, গালগল্প ছড়ালে ওই ব্যাবসায় লোকসান নেই, বরং লাভ আছে। তাহলে ভয়টা কীসের?

ভয়টা খানপানের নয় স্যার, বরং খানদানের। ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল জাডক, লোকে। ভাবে, ইন্সমাউথ থেকে বেরোনো সোনার উৎস হল জলদস্যুদের লুটের মাল। সোনা কোত্থেকে আসছে– এটা নিয়ে তারা ভাবতেই রাজি নয়। কিন্তু ইন্সমাউথের লোকেদের চেহারা এরকম হওয়ার কারণটা তারা বুঝলে কী হবে, ভাবতে পারছেন? ওই দেবতাদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে যারা জন্মায়, তাদের অনেকেই গৃহযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা যখন ফিরে আসে, তখন তাদের চেহারা বদলাতে শুরু করেছে। বাইরের লোকে ভাবে, এটা সেই মড়কের ফল, বা নাবিকদের সঙ্গে অন্য দেশের মেয়েদের…! কিন্তু আসল ব্যাপারটা এখন আন্দাজ করে শুধু অবলা প্রাণীরা। ঘোড়া, খচ্চর –এমন প্রাণীরা ইন্সমাউথের লোকেদের কছে এলেই অস্থির হয়ে ওঠে। গাড়ি আসার পর সেই ঝামেলাটা মেটে, কিন্তু তদ্দিনে শহরের অবস্থা আবার খারাপ হচ্ছে। বন্দরটা বালি আর পলিতে বুজে আসছে বলে জাহাজগুলো আর ভিড়তে পারত না। কারখানা বন্ধ হল। রেললাইনটাও উঠে গেল। কিন্তু ওই দেবতাদের আসা বন্ধ হল না! মেলামেশাও বন্ধ হল না। একটা একটা করে বাড়ির জানলা বোর্ড দিয়ে, পেরেক ঠুকে বন্ধ করে দেওয়া হল, যাতে সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকতে না পারে। সবাই চলে যেতে শুরু করল… নীচে, মাটির নীচে, তারপর জলের নীচে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করল জাডক। কিন্তু আমার মাথায় ততক্ষণে অন্য একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে।

এই মেলামেশা কারা করত? মানে নাবিকরা বা রিফাইনারির কর্মীরা? নাকি…?

 ঘোলাটে চোখে আমাকে দেখল জাডক। তারপর আবার কথা শুরু করল।

 ১৮৪৬ সালে ওবেদ মার্শ আবার বিয়ে করেন। লোকে বলে, ওঁর ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু এ-ও নাকি সেই ধর্মের অঙ্গ। সেই বউকে কেউ দেখেনি। তাঁর গর্ভে ওবেদের তিন সন্তান হয়। দু-জন কম বয়সেই নিখোঁজ হয়ে যায়। তবে একজন, একটি মেয়ের চেহারা একেবারে স্বাভাবিক ছিল। তাকে ইউরোপে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়ানো হয়। তারপর ভুলিয়ে ভালিয়ে আর্কহ্যামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়েও দেওয়া হয়, এমনটাই শুনেছি।

মার্শের প্রথম পক্ষের বড় ছেলের বউকেও কেউ দেখেনি। শুনেছি, সে-ও নাকি ওই দেবতাদের একজন ছিল। তার ছেলে, মানে ওবেদের নাতি বার্নাবাস মার্শ এখন রিফাইনারির মালিক। শুনেছি, ওর চেহারাও এখন নাকি একেবারে বদলে গেছে। ওবেদ মারা যান ১৮৭৮-এ৷ ওঁর প্রথম পক্ষের ছেলেরাও কেউ বেঁচে নেই। বার্নাবাসও প্রায় বছর দশেক ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে আছে। হয়তো আর কিছু দিনের মধ্যেই ওকে জলে চলে। যেতে হবে! মার্শ বংশের আর কেউ আছে কি? মনে তো হয় না।

জোয়ারের দাপট তখন ক্রমেই বাড়ছে। জলের ছিটে আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি দেখছিলাম, কীভাবে জলের আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল জাড়কের পাগলাটে ভাবসাব।

কিছু বলছেন না যে? অ, আমার কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না, তা-ই তো? হবে, হবে। থাকুন-না এই মরা শহরে, সব বিশ্বাস করবেন আপনি। যখন বুঝবেন, বন্ধ জানলার ওপাশে যার পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন, সে মানুষ নয়, বরং একটা নরকের কীট, তখন বুঝবেন! যখন চোখের সামনে দেখবেন, কার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে আপনার মেয়েকে, তখন মানবেন আমার কথাগুলো।

সবজান্তার মতো আমার দিকে চেয়ে থাকবেন না, বুঝলেন! আমি যা দেখেছি তা দেখলে আপনি এতক্ষণে ল্যাজ গুটিয়ে পালাতেন এই নরক থেকে। কী দেখেছি আমি? জানতে চান, কী দেখেছি আমি? আমি দেখেছি, ওই দেবতারা আর জলের নীচে থেকেই। খুশি নন। সমুদ্রের লাগোয়া বাড়িগুলো এখন ওদের মেলামেশার জায়গাই শুধু নয়, ওদের আড়া। ওরা আসছে! অসংখ্য, অগুনতি! আর তারপর ওরা কী করবে, বুঝতে পারছেন আপনি?

জাডকের শেষদিকের কথাগুলো চিৎকার ছাপিয়ে আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছিল। আমি উত্তর দিতে গিয়ে দেখলাম, ওর মুখ বেঁকে যাচ্ছে। ভাবলাম, এটা কি মৃগী বা মদ্যপানের ফল? পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম, নিঃসীম আতঙ্কে প্রায় দিশেহারা হয়ে গেছে জাডক অ্যালেন। আর সেই আতঙ্কের উৎস রয়েছে আমার পেছনেই!

আমি পেছনে ঘুরে ঢেউ ছাড়া কিছু দেখতে পেলাম না। কিছুটা দূরে যেখানে ব্রেকারগুলো আছে, তার কাছে কিছু একটা ছিল কি?

জাডকের দিকে ঘুরে দেখলাম, ভয়ে লোকটার মুখ থেকে ফেনা বেরোনোর জোগাড় হয়েছে। চিৎকার করে আমাকে বলল বুড়ো, বেরোও এখান থেকে! এক্ষুনি! এই মুহূর্তে। ওরা জেনে গেছে যে, আমি তোমাকে সব বলে দিয়েছি। যাও!

একটা বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ল ভাঙা পাঁচিলের পাথরগুলোর ওপর। জলের গুঁড়োয় ঝাপসা বাতাস একটু পরিষ্কার হলে দেখলাম, প্রাণপণে উত্তরদিকে হাঁটছে… না, প্রায় দৌড়োচ্ছে জাডক অ্যালেন। আশপাশে আর কিছুই বা কাউকে দেখলাম না। চুপচাপ হাঁটা দিলাম। ওয়াটার স্ট্রিটে পৌঁছে আবার এদিক-ওদিক দেখলাম, কিন্তু লোকটাকে আমি আর দেখতে পেলাম না।

.

০৪.

দোকানের ছেলেটা বলেছিল বটে, কিন্তু জাডক অ্যালেনের গল্পগুলো যে কতটা ভয়ানক, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম। ঘড়ির কাঁটা বলছিল, সওয়া সাতটা বাজে। মাতালের প্রলাপ হলেও জাড়কের কথাগুলো আমাকে প্রবল অস্বস্তিতে ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল, মাছ আর মৃত্যুর গন্ধ-মাখা এই জীর্ণ শহরটা ছেড়ে যেতে না পারলে খুব বড় বিপদ হবে। তবে আমি দৌড়োইনি। নিজের মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য বাড়িগুলোর স্থাপত্যশৈলী দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু মার্শ স্ট্রিট ধরে হাঁটতে গিয়েই বুঝলাম, কিছু একটা গোলমাল আছে। এতক্ষণ ফাঁকা-থাকা রাস্তাগুলোয় জটলা দেখছিলাম। ছোট ছোট দলে যারা জমা হচ্ছিল, তাদের চেহারায় ইন্সমাউথের লক্ষণ ফুটে উঠছিল স্পষ্টভাবে। আমার দিকে কয়েকজন ইশারা করল। আমার ইচ্ছে করছিল দৌড়োতে, কিন্তু কষ্ট করে হলেও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখলাম। গিলম্যান হাউসের কাছে পৌঁছে বুঝলাম, এই দলগুলোর লক্ষ্যও ওই বাড়িটা। ওরা যখন হোটেলটাকে ঘিরে ফেলছে, আমি তখন শান্তভাবে নিজের ব্যাগ নিয়ে হোটেল থেকে চেক-আউট করছি।

আমি শান্তভাবেই স্কোয়্যারে গিয়ে কোচের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে গিলম্যান হাউসের ভেতরে ঢুকে লোকগুলো কিছু একটা করছিল বা বলছিল। কোচ আটটার একটু আগেই এসে গেল। ওখান থেকে ড্রাইভার, মানে ওই সার্জেন্ট নেমে একটা চিঠির বান্ডিল, আর কয়েকটা খবরের কাগজ ছুঁড়ে দিল বাইরে, তারপর হোটেলে ঢুকল। সকালে যে তিনজন লোক নিউবারিপোর্টে নেমেছিল, তারাই এবার বাস থেকে নামল। ফুটপাথে দাঁড়ানো একটা নোংরা চেহারার লোকের সঙ্গে তারা কী ভাষায় গুজগুজ-ফুসফুস করল, তা আমি জানি না। তবে আমার আর কিছু দেখার ধৈর্য ছিল না। চুপচাপ কোচে উঠে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম শহরটা ছেড়ে যাওয়ার জন্য।

তখনই সার্জেন্ট হোটেল থেকে বেরিয়ে আমার কাছে এল। ওর নিচু, জড়ানো, অনেকটা ঘোঁত ঘোঁত-করা আওয়াজে বলা কথার মানে বোঝার পর আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল।

কোচ আজ রাতে ছাড়বে না। তাতে গণ্ডগোল ধরা পড়েছে। না, অন্য কোনও যানবাহনও পাওয়া যাবে না, যা আমাকে আজ রাতে আর্কহ্যাম, নিউবারিপোর্ট, ইন্সউইচ বা অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারে। তাই আজ রাত্তিরটা আমাকে গিলম্যান হাউসেই কাটাতে হবে। যাতে আমার জন্য স্পেশাল রেট দেওয়া হয়, সেটা সার্জেন্ট নিশ্চিত করবে। সে অত্যন্ত দুঃখিত… ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই অবস্থায় কিছুই করার থাকে না। আমি কোচ থেকে নেমে হোটেলে ঢুকলাম। ক্লার্ক চোখ কুঁচকে আমাকে দেখল, তারপর জানাল, ৪২৮ নম্বর ঘরটা আমাকে দেওয়া যাবে। ঘরটায় জলের সাপ্লাই নেই, তবে ওটা বেশ বড়। ভাড়া পড়বে মাত্র এক ডলার। আমি পেমেন্ট করে রেজিস্টারে সই করলাম। তারপর মাথা নিচু করে, আরেক বিষবদন অ্যাটেন্ডেন্টের পিছুপিছু ধূলিধূসর সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে গেলাম। ঘরটা যাচ্ছেতাই, আসবাবগুলো সস্তা এবং জঘন্য, এমনকী জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে একটা নোংরা উঠোন আর দূরে জলাজমি ছাড়া কিছু দেখা যায় না। ঘরের বাইরে, করিডরের শেষ প্রান্তে একটা দুর্গন্ধযুক্ত, মলিন, নিবু নিবু আলো-জ্বলা টয়লেট।

থাকার এমন ব্যবস্থা দেখে মুষড়ে পড়াই স্বাভাবিক। নিজেকে উজ্জীবিত করার জন্য খাবারের সন্ধানে নীচে নামলাম। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে বলে বাধ্য হয়ে হোটেলের রেস্তরাঁতেই ডিনার সারলাম। কপাল ভালো, প্যাকেট আর টিনের জিনিসই ওখানে গরম করে দেওয়া হয়। নইলে ওই নোংরা শহরে যে কী খায় লোকে…! খাওয়া সেরে, কাউন্টারের পাশ থেকে একটা খবরের কাগজ আর একটা পত্রিকা নিয়ে আমি নিজের ঘরে গেলাম। দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম, কারণ সেটাকে আটকানোর মতো কোনও তক্তা বা পাল্লা ছিল না। এই শহরের আরও অনেক অকেজো জিনিসের মতো ওটাও ভেঙে গেছে ভেবে আমি ঘরের মলিন আলোটা জ্বালোম। তারপর শব্দছক সমাধান করতে ব্যস্ত হলাম, যাতে ঘুমোনোর আগের সময়টা ঠিকঠাক কাটে।

অনেক চেষ্টা করেও কাগজে বা পত্রিকায় মন বসাতে পারলাম না। জাড়কের উপাখ্যান আর গিলম্যান হাউসে সেই ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর কী শুনেছিলেন, সেই নিয়ে ভাবনা, দুইয়ে মিলে আমার মাথায় নানা দুশ্চিন্তার জন্ম দিচ্ছিল। ঠিক কীসের ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিল, বলতে পারব না। তবে সেই ভয়ের তাড়নাতেই দরজাটা ভালো করে দেখতে বাধ্য হলাম। কম আলোতেও বোঝা গেল, একটা পাল্লা ওখানে ছিল, কিন্তু সম্প্রতি সেটাকে সরানো হয়েছে। ঘরটার আগাপাশতলা খুঁজে জামাকাপড়ের আলমারিতে একটা ওই মাপের জিনিস পাওয়া গেল। ঘোরাঘুরি করার অঙ্গ হিসেবে আমাকে নিজের সঙ্গে কয়েকটা জরুরি জিনিস রাখতেই হয়। তেমনই একটা ছুরি-কাম-ক্রুড্রাইভার দিয়ে ওটাকে জায়গামতো ফিট করলাম। ঘরে আরও দুটো দরজা ছিল। সেগুলোকেও বন্ধ করে তবে নিশ্চিন্ত হলাম। আমি জামাকাপড় ছাড়িনি। বরং একেবারে সাজগোজ করেই ওই শক্ত বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল, ঘুম না-আসা অবধি হাবিজাবি যা পাই তা-ই পড়ব। কিন্তু সারাদিনের হাঁটাহাঁটির ফলে আলো জ্বেলে পড়তে ইচ্ছে করছিল না, আবার যা শুনেছি আর দেখেছি, তার ঠ্যালায় ঘুমও আসছিল না। এভাবে কতক্ষণ কেটেছিল জানি না, তবে হঠাৎ মনে হল, আমি যেন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। যেন সিঁড়ি দিয়ে কেউ বা কারা সন্তর্পণে উঠে আসছে!

উঠে বসলাম। কান পেতে কিছু শুনতে পেলাম না। নিজেকে একপ্রস্থ গালাগাল দিলাম উলটোপালটা গল্প শুনে নার্ভ উত্তেজিত করে তোলার জন্য। একবার মনে হল, লাইট জ্বালিয়ে আশপাশটা দেখি, যদি তাতে মাথা একটু ঠান্ডা হয়। নিজেকে এ-ও বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমার কাছে যে টাকাপয়সা নেই, সেটা নিশ্চয় ইন্সমাউথের লোকেরাও বুঝেছে। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠে লাইটের সুইচ অবধি যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তাই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। সে জন্যই কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম, ওই আওয়াজটা আমি কল্পনা করিনি!

সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠে এসেছে। এবং শুধু উঠে আসাই নয়, আমি বুঝতে পারলাম, সে আমার ঘরের দরজার হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলতে চেষ্টা করছে!

অন্য সময় বা অন্য কোথাও এই জিনিস হলে বোধহয় ভয়ে আমি জমে যেতাম। কিন্তু হোটেলে ঢোকার পর থেকে নিজের অজান্তেই আমি সতর্ক এবং প্রস্তুত ছিলাম। এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি যে, ভুল করে বা মদের নেশায় কেউ আমার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। একেবারে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, আমার একেবারে শিয়রে শমন! তবু, আশঙ্কা সত্যি হলেও ধাক্কাটা জোরেই লাগে।

কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও আমার ঘরের দরজাটা খুলতে পারল না হানাদার, সে যে-ই হোক না কেন। চাবির আওয়াজ শুনে বুঝলাম, আমার পাশের ঘরে কেউ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকল। তারপর ওই ঘর থেকে আমার ঘরের দিকে আসার দরজাটা খোলার চেষ্টা হল। কিন্তু পাল্লাগুলোর জন্য সে গুড়েও বালি পড়ল। একই জিনিস হল একটু পরে অন্য ঘরেও। দরজা না ভেঙে আমার ঘরে ঢোকা যাবে না বুঝে লোকটা এবার চলে গেল। আমি প্রথমে করিডরে, পরে সিঁড়ি দিয়ে তার সাময়িক পশ্চাদপসরণের শব্দ পেলাম।

কিন্তু আমার পক্ষে নিশ্চিন্ত হওয়া অসম্ভব ছিল। তা ছাড়া মন বলছিল, এই শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে নিরস্ত্র অবস্থায় আমার জেতার কোনও সম্ভাবনা নেই। আমাকে পালাতে হবে। সামনের দরজা বা সিঁড়ি দিয়ে নয়, অন্য কোনও পথে। এখনই!

আমার লক্ষ্য ছিল ব্যাগটা রেখে, স্রেফ জরুরি কয়েকটা জিনিস নিজের সঙ্গে নিয়ে পালানো। লাইটের সুইচ টিপলেও আলো জ্বলল না। বুঝতে পারলাম, আমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। কী করব ভাবছিলাম, কিন্তু তখনই নীচের তলায় বেশ কয়েকটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেগুলোর ওঠানামা থেকে গলার আওয়াজ বলেই মনে হয়। তবে মানুষের গলায় ওইরকম আওয়াজ…? বেশি ভাবার সময় ছিল না আমার কাছে। ফ্ল্যাশলাইটের সাহায্যে নিজের পকেটে জরুরি কিছু জিনিস ভরে নিলাম।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, সরকারি নিয়ম থাকা সত্ত্বেও হোটেলে কোনও ফায়ার-এসকেপ নেই। লাফালে তিনতলা নীচের উঠোনে পড়ে হাড়গোড় ভাঙবেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝলাম, আমার থেকে দুটো ঘর পরে একটা জানলা দিয়ে লাফালে পাশের একটা বাড়ির নিচু আর ঢালু ছাদের নাগাল পাওয়া যাবে।

কিন্তু ওই ঘর অবধি যাব কীভাবে? করিডরে বেরোনো যাবে না, কারণ তাহলেই নীচে আমার শত্রুরা আওয়াজ পেয়ে যাবে। একমাত্র উপায় হল ঘরের মাঝের দরজাগুলো। সেগুলো যদি এমনি বন্ধ করা থাকে, তাহলে ধাক্কা দিয়ে ভাঙা যাবে, কারণ হোটেলটার সব কিছুই জরাজীর্ণ। কিন্তু আমার মতো করে সেগুলোতেও যদি কেউ পাল্লা লাগিয়ে থাকে? ওসব ভেবে লাভ নেই। আর এই কাজ নিঃশব্দে করাও যাবে না। তাই আমাকে গতির ওপর নির্ভর করতে হবে, যাতে শত্রুরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক ঠিক দরজাটা খোলার আগেই আমি গিলম্যান হাউস থেকে বেরিয়ে যেতে পারি।

আমি জানতাম, আমার পরিকল্পনা সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তা ছাড়া, মোটামুটি অক্ষত দেহে পাশের বাড়ির ছাদে পৌঁছোতে পারলেও নীচে নামা কঠিন। নেহাত, পাশের বাড়িগুলো একেবারে পরিত্যক্ত মনে হচ্ছিল। গোটা এলাকাতেই খুব বেশি জনপ্রাণী আছে বলে মনে হচ্ছিল না। তাই যা-থাকে-কপালে ভেবে আমি তৈরি হলাম। অন্ধের যষ্টির মতো ম্যাপটা দেখে ঠিক করলাম, শহর ছেড়ে বেরোনোর সেরা রাস্তা দক্ষিণদিকে যাওয়া। পথে কী কী বিপদ আসবে, সেই নিয়ে ভাবিনি, কারণ ভেবে কোনও লাভ হত না।

আমি আওয়াজ না করে একটা আলমারি নিজের দরজাটার সামনে আনলাম, যাতে ওটা ভাঙতে একটু বেশি কষ্ট হয়। দক্ষিণমুখো যে ঘরটা আমার লাগোয়া, সেটার দরজা পরীক্ষা করে বুঝলাম, ওটা আমার দিকেই খোলে। ওটা ভেঙে পাশের ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই, বরং ওটার সামনে আমার খাটটা যথাসম্ভব নিঃশব্দে এনে রাখলাম। উত্তরদিকের ঘরের দরজাটা ওই ঘরের দিকে খোলে। চাপ দিয়ে বুঝলাম, ওটা পাল্লা দিয়ে আটকানো আছে। কিন্তু তবু এটা আমার কাছে স্পষ্ট হল, আমাকে ওখান দিয়েই বেরোতে হবে। প্রথমে পাশের ঘর, সেখান থেকে তার পাশের ঘর, সেখান থেকে পাশের বাড়ির ছাদ, সেখান থেকে পেইন স্ট্রিট, আর সেখান থেকে ওয়াশিংটন স্ট্রিট। দমকলের দফতরটা সারারাত খোলা থাকতে পারে, তাই সেটাকে পাশ কাটাতে হবে। নইলে আমাকে কেউ দেখে ফেলতে পারে।

চাঁদ উঠছিল। সেই আলোয় বাইরে নিচু আর নোংরা ছাদের সমুদ্রও ঝকমকিয়ে উঠছিল। তার ওপাশে মানুক্সেটের খাত, পরিত্যক্ত কারখানা, ভাঙাচোরা রেল স্টেশন, জং-ধরা আর আগাছায় ঢাকা রেললাইন, ঝোপঝাড়ে ভরা জমি শেষ হয়ে শুরু হওয়া জলা– এগুলো ওই সাদা আলোয় কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছিল। আর্কহ্যামের দিকে যাওয়ার কোনও রাস্তাই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে উত্তরে ইন্সউইচের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছিলাম। এক মুহূর্তের জন্য চিন্তায় পড়ে গেলাম।

তাহলে কি উত্তরদিকে যাওয়াই ঠিক হবে? এর বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেলাম না, কারণ তখনই আমার কানে এল একটা অন্যরকম শব্দ। একটা ভারী পায়ের শব্দ শুনলাম, যা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। তার পেছনে একটা গুঞ্জনও উঠছে, যেন বেশ কিছু লোক উত্তেজিতভাবে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে কাউকে। কিছুক্ষণ পরেই আমার ঘরের দরজায় একটা জোরালো নক করল কেউ।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি একদম অনড় হয়ে গেলাম। পরমুহূর্তেই একটা তীব্র আঁশটে গন্ধে আমার গা গুলিয়ে উঠল। ওতেই আমার মাথা আবার কাজ করতে শুরু করল। দরজায় আওয়াজটা জোরালো হল। বুঝতে পারলাম, ভাবাভাবি পরে হবে, এবার চাই অ্যাকশন! উত্তরদিকের দরজার পাল্লা সরিয়ে নিজের পুরো জোর দিয়ে দরজাটা ভাঙতে চেষ্টা করলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, দারুণ জোরে দরজাটা যে পেটাচ্ছে, তার আওয়াজেই আমার দরজা ভাঙার শব্দ ঢাকা পড়বে।

সর্বাঙ্গে কালশিটে পড়ে গেলেও আমি ধাক্কা মারা ছাড়িনি। তারই পুরস্কার হিসেবে সশব্দে দরজাটা ভেঙে পড়ল ওপাশে। মুশকিল হল, আওয়াজটা এতই জোরালো ছিল যে, আমার শত্রুরা চট করে বুঝে ফেলল, কী ঘটছে। আমার ঘরের দরজায় এবার প্রায় দুরমুশ শুরু হল। তার পাশাপাশিই আমি চাবি ঘোরানোর আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আগে আমার দক্ষিণের ঘরটাতেই ঢুকল একটা দল। তারপর সেদিকের দরজাটায় শুরু হল খোলা বা ভাঙার চেষ্টা।

প্রায় লাফিয়ে আমি যে ঘরে ঢুকেছিলাম, সেটার পাল্লাটা আটকালাম। মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম দুটো দরজাকেই আলমারি আর খাট দিয়ে আরও দুর্ভেদ্য করে রেখেছি বলে। কিন্তু তখনই দারুণ হতাশায় আমার মনটা প্রায় ভেঙে গেল।

এই হোটেলে আমার অন্তিম গন্তব্য যে ঘরটা, সেটার দরজায় চাবি ঢোকানোর আওয়াজ পেলাম আমি।

তখনও আমি ওই ঘরে যাওয়ার দরজাটা খুলতে পারিনি৷ যদি পাল্লা না-ও দেওয়া থাকে, তা-ও ওটা ভাঙতে আমার কিছুটা সময় লাগবেই। কিন্তু তার মধ্যে তো ওই ঘরে ঢুকে পড়বে আমার শত্রুরা! যে ঘরে এখন আমি আছি, সেটাতে তো জানলাও নেই। তাহলে? একরকম গা-ছাড়া ভঙ্গিতেই আমি পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাটা আলগাভাবে ঠেলোম।

দরজাটা খুলে গেল!

আমি কিছু ভাবিনি। যখন আমি ওই ঘরে ঢুকেছি, তখন করিডরের দিকের দরজাটা খুলে যাচ্ছে। তবে যে ওটা খুলছিল, সে বোধহয় ভাবতে পারিনি, আমি ইতিমধ্যেই ওখানে এসে যাব। তাই আমি যখন দরজাটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটাকে ঠেলে বন্ধ করলাম, তখন সে বাধা দিতে পারেনি। দরজা বন্ধ করে, পাল্লাটা টেনে দিলাম। তারপর খাট আর আলমারি টেনে ঘরের দুটো দরজাকেই দুর্ভেদ্য করলাম। দুটো দরজার ওপরেই হামলা শুরু হয়েছিল। তবে আমি জানতাম, স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে আমি পেইন স্ট্রিটে পৌঁছোতে পারব। পাশের বাড়ির ছাদটা এমনই ঢালু যে, ওতে লাফালে পা পিছলে যেতে পারে। একটু ভেবে আমি একটা জানলা বাছলাম, যেখান থেকে লাফিয়ে ছাদে পড়ে একটু গেলেই একটা ভাঙা স্কাইলাইট পাওয়া যাবে। ওটা দিয়ে আমার পক্ষে নীচে, রাস্তায় পৌঁছোনো সম্ভব হবে।

ঘরটা ভালোভাবে দেখে বুঝলাম, আমার ভাগ্য সত্যিই ভালো। জানলার ওপরে ভারী পর্দা আর পর্দা ঝোলানোর স্ট্যান্ড আছে। জানলাটাকে বাইরে খুলে রাখার জন্য ছিটকিনির মতো আংটাও আছে বাইরের দেওয়ালে। ততক্ষণে ঘরের দরজার কাঠ ভেঙে পড়ছে, কিন্তু খাট আর আলমারি আমার শত্রুদের ঠেকিয়ে রেখেছে। সেই অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা রেখে আমি পর্দা সমেত স্ট্যান্ড টেনে নামালাম। সেটাকে বাইরের আংটায় খুঁজে আমি নীচে নামার মতো একটা দড়ির সিঁড়ি টাইপের জিনিস বানালাম। তারপর ওটা ধরে নীচে ঝুলে, পাকাপাকিভাবে ছাড়লাম আমি।

খাড়া ছাদে লাফিয়ে নামলেও ভারসাম্য রাখতে পেরেছিলাম। দেখলাম, ঘরের জানলা অবধি তখনও পৌঁছোতে পারেনি কেউ। তবে দূরে অর্ডার অব ডেগন আর অন্য চার্চগুলোয় আলো জ্বলছে। স্কাইলাইট থেকে লাফিয়ে নীচে নেমে ধুলো আর ইট-পাটকেল, ভাঙা পিপে –এসবের স্কুপের মধ্যে পড়লাম, তবে তাতে আমার হাত-পা ভাঙেনি। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ঘড়ি দেখে বুঝলাম, রাত দুটো বাজে। পেইন স্ট্রিটের দিকের দরজাটা খুঁজে পেলেও আমি ওদিকে গেলাম না। বরং উলটোদিকের অন্ধকার চাতাল দিয়ে ওয়াশিংটন স্ট্রিটে যাওয়াটাই আমার কাছে বেশি নিরাপদ মনে হল।

চাতালে চাঁদের আলো তখনও পৌঁছোয়নি। তবে অন্ধকারে চোখ সয়ে গিয়েছিল। ওয়াশিংটন স্ট্রিটের দিকে পরপর বেশ কয়েকটা দরজা আধভাঙা বা খোলা ছিল। আমি তাদের একটা দিয়ে ঢুকে দেখলাম, একটা অন্ধকার হলঘরে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু রাস্তার দিকের দরজাটা দেখলাম, একেবারে তক্তা আর পেরেক দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশের দরজাটা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করতে যাব বলে আবার চাতালের দিকে আসছিলাম। কিন্তু বেরোনোর মুখেই থেমে গেলাম।

গিলম্যান হাউস থেকে ওখানে বেরিয়ে এসেছে একটা বেশ বড়সড় দল। চাঁদের আলো না এলেও সেই দলের লোকেদের চেহারা বোঝা যাচ্ছে। তবে তার চেয়েও স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে আলখাল্লা দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা, অদ্ভুত গড়নের শিরস্ত্রাণ পরে থাকা একজনের চেহারা!

প্রায় দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ওদের ভাবসাব দেখে মনে হল, আমি কোথায় আছি, সেই সম্বন্ধে ওদের কোনও ধারণা নেই। তবে চাতালে বেরোনো যাবে না আর। কিন্তু এই অন্ধকার হলঘরেও কি আমি নিরাপদ? ওই প্রাণীটির শরীর থেকে বেরিয়ে-আসা আঁশটে গন্ধের ঢেউ আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিল। ওখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি অজ্ঞানই হয়ে যেতাম। হঠাৎ খেয়াল হল, একটা জানলায় লাগানো বোর্ডের নীচটা ফাঁক হয়ে আছে। ঝটপট ওখানে গিয়ে আমি কাজে লেগে পড়লাম। গোটা দুই পেরেক খুলে গিয়েছিল ইতিমধ্যেই। আমার চেষ্টায় আরও একটা খুলে গেল। নিঃশব্দে তাটা সরিয়ে আমি জনমানবহীন ওয়াশিংটন স্ট্রিটে বেরিয়ে এলাম। তারপর তক্তাটা সযত্নে, বরং আগের চেয়ে একটু ভালোভাবেই জায়গামতো ফিট করে, আমি দক্ষিণদিকে এগোলাম। ততক্ষণে দূরে দূরে আমি গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, আমাকে খুঁজে বের করার জন্য অনেকগুলো দলকে কাজে লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিছু আওয়াজ শহরের দক্ষিণ থেকেও আসছিল, তবে আমি ওই নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমি জানতাম, এই শহরে এতই ফাঁকা আর ভাঙা বাড়ি আছে যে, আমি ওদের নজর এড়িয়ে যেতে পারব। রাস্তায় আলো জ্বলছিল না। এটা অন্য সময় হলে বাজে লাগত, তবে তখন অন্ধকার আমার কাছে খুব জরুরি ছিল।

ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর গা ঘেঁষে যত দ্রুত সম্ভব হাঁটছিলাম। আমার চেহারা উশকোখুশকো হলেও এমন কিছু অস্বাভাবিক ছিল না, যা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তবে আমি ঝুঁকি নিতে চাইছিলাম না। বেটস স্ট্রিটের কাছে দু-জনকে আসতে দেখলাম, যাদের হাঁটাটা ঠিক স্বাভাবিক ছিল না। আমি তৎক্ষণাৎ পাশের একটা ভাঙা দরজার আড়ালে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু এরপরেই এল একটা চওড়া জায়গা, যেখানে ইলিয়ট স্ট্রিট আর ওয়াশিংটন স্ট্রিট কাটাকুটি খেলেছে। নকশা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, এটাই হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা, কারণ এখানে চাঁদের আলো পড়বে একেবারে সোজাসুজি। কাছেপিঠে কোনও বাড়িঘর না-থাকায় আমার পক্ষে লুকোনোও সম্ভব ছিল না। আবার জায়গাটা এড়িয়ে যেতে গেলেও এত ঘুরতে হবে, যার অন্য বিপদ আছে। তাই আমি স্থানীয় মানুষদের হাঁটার ভঙ্গি অনুকরণ করে, যথাসাধ্য স্বাভাবিকভাবে জায়গাটা দিয়ে হাঁটলাম।

ঠিক কীভাবে এবং কোন উদ্দেশ্য নিয়ে শহরে এত রাতেও আলোড়ন চলছে, বুঝতে পারছিলাম না। যদি আমাকে খুঁজে বের করাই এসবের লক্ষ্য হত, তাহলে অন্যরকম হত ব্যাপারটা। তবে আমি শহরটা ছেড়ে বেরোতে চাইছিলাম শুধু। আমি জানতাম, ধুলোয় আমার পায়ের দাগ থেকে সহজেই বোঝা যাবে, কীভাবে আমি গিলম্যান হাউসের চৌহদ্দি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। তাই আমার পেছনে একটা বড় দলের লেগে পড়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

আমি বিনা ঝামেলায় জায়গাটা পার হচ্ছিলাম। ওখানে একটা পার্ক আছে, যেটা দিনের বেলায় সেভাবে খেয়াল করিনি। কিন্তু চাঁদের আলোয় ওই নিষ্প্রাণ সবুজটুকুও অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। ওখান থেকে একদিকে টাউন স্কোয়্যার। শুনতে পাচ্ছিলাম, সেদিক থেকে একটা জোরালো গুঞ্জন উঠছে। ভাবছিলাম, ওদিক থেকে কেউ যদি এইদিকে তাকাইয়, তাহলে ধু-ধু ফাঁকা রাস্তায় আমাকে একেবারে স্পষ্ট দেখা যাবে। সন্দেহ হতেই পারে কারও, তখন….

কিন্তু এই দুশ্চিন্তার পৃথিবী থেকে দু-দণ্ডের জন্য আমাকে সরিয়ে নিল সমুদ্র। চাঁদের আলোয় তার সফেন সৌন্দর্য দেখে আমি সব ভুলে গেলাম। অলসভাবে ওখানে আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম, জানি না। তবে আমার খোয়াব চুরমার হল অন্য একটা জিনিসে।

দূরে ডেভিলস রিফ-এর কালো রেখার ওপর কয়েকটা আলোর ঝলক দেখলাম।

বিদ্যুৎচমকের মতো আমার খেয়াল হল, কী ভয়ানক বিপদের মাঝে রয়েছি আমি। আপনা থেকেই আমার নজর ঘুরে গেল স্কোয়্যার-লাগোয়া গিলম্যান হাউসের দিকে।

গিলম্যান হাউসের ছাদ থেকেও ভেসে এল আলোর বেশ কয়েকটা ঝলক! আমার জ্ঞানগম্যি খুব একটা বেশি নয়। তবে এটা যে সিগনাল বিনিময় হল, সেটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল। কীসের সিগনাল, সেই নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমার তখন কাজ ছিল নিজেকে সামলানো। আমার শরীর, মন, প্রবৃত্তি প্রবলভাবে বলছিল, পালাও! পালাও! কিন্তু আমি জানতাম, দৌড়োতে গেলেই আমি ধরা পড়ে যাব শত্রুদের হাতে। সেই ঘষটে ঘষটে হাঁটা আর ছোটার মাঝামাঝি ভঙ্গিতে এগোনোর অবস্থা আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে তার মধ্যেও আমাকে ডেভিলস রিফ-এর দিকে নজর রাখতে হচ্ছিল। মন বলছিল, নরকের ওই দরজা দিয়ে আজ রাতে বিশেষ কেউ উঠে আসতে পারে, হয়তো আমার খোঁজে!

লনের মতো ঘেরা জায়গাটা পার হয়ে আমি স্বাভাবিকভাবেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি একটা জিনিস দেখতে পেলাম।

রিফ আর সমুদ্রতটের মাঝের জল ফাঁকা নয়! সেখানে জেগে উঠেছে অজস্র মাথা। কিন্তু তাদের গড়ন, আর যে ভঙ্গিতে তারা সাঁতরে আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে তারা মানুষ নয়।

আমি পাগলের মতো দৌড়োলাম। একটা ব্লক পেরিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার সন্ধানে একাধিক দল বেরিয়ে পড়েছে। ফেডারেল স্ট্রিট ধরে দক্ষিণে এগোলাম যত দ্রুত সম্ভব। আওয়াজ পেতেই একটা ভাঙা বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। বাইরে থেকে আসা আওয়াজ, হইচই, কয়েকটা গাড়ির এদিক-ওদিক যাওয়ার গর্জন– এগুলো থেকে বুঝতে পারছিলাম, ইন্সমাউথ থেকে বেরোনোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে!

দারুণ হতাশায় আমার শরীর-মন নুয়ে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল, তাহলে কি এখানেই, এভাবেই আমি শেষ হব? ইন্সমাউথের এই ভাঙা বাড়িটাই কি তাহলে আমার জীবনের শেষ স্টেশন?

 স্টেশন!

অন্ধকার রাতে বিদ্যুৎ ঝলসালে যেমন সব কিছু সাদা আর স্পষ্ট হয়, ঠিক সেভাবেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল রোলির দিকের ব্রাঞ্চ রেললাইন! পাথর, ঘাস, আগাছা আর কাঁটালতায় ভরা ওই লাইনটা দিয়ে শহর ছেড়ে পালানোর কথা কেউ ভাববে না। তাই হয়তো ওই রাস্তাটা বরাবর পাহারা থাকবে না। হোটেলের জানলা দিয়ে যা দেখেছি, তাতে এটা স্পষ্ট যে রোলি যাওয়ার রাস্তা, বা গিলম্যান হাউসের মতো উঁচু বাড়ি থেকে রেললাইনটা অনেক দূর অবধি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কিন্তু আমি যদি লাইনের পাশের ঝোপঝাড় দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোই তাহলে হয়তো…!

সাবধানে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে নকশাটা দেখলাম। বুঝতে পারলাম, ব্যাবসন স্ট্রিট ধরে সোজা গিয়ে, তারপর লাফায়েত স্ট্রিট ধরে এগোতে হবে আমাকে। তারপর বেটস, অ্যাডামস, এবং অবশেষে ব্যাংক স্ট্রিট ধরে এগোলে আমি নদীখাত একপাশে রেখে পরিত্যক্ত স্টেশনটায় পৌঁছোব। এভাবে গেলে আমি ওই খোলা জায়গাটা আর সাউথ স্ট্রিটের বিশাল চওড়া এলাকাটা এড়িয়ে যেতে পারব। বেরিয়ে পড়লাম তারপরেই।

ফেডারেল স্ট্রিট থেকে আওয়াজ আসছিল। রাস্তার মোড় ঘুরতে গিয়ে বুঝলাম, যে বাড়িটায় আমি সাময়িক আশ্রয় পেয়েছিলাম, সেটার কাছেই আলো নিয়ে একটা দল ঘোরাঘুরি করছে। ব্যাবসন স্ট্রিটের কোণে একটা বাড়ির জানলায় পর্দা দেখে বুঝলাম, সেখানে লোকজন থাকে। তবে বাড়িটা অন্ধকার ছিল, আমিও নির্বিঘ্নেই জায়গাটা পেরিয়ে এলাম। ভাঙা বাড়িগুলোর ছায়ায় নিজেকে মিশিয়ে এগোনোর সময় বেশ কয়েকটা দলকে দেখলাম ইলিয়ট স্ট্রিট হয়ে ইউইচের দিকে যাওয়ার রাস্তায় উঠতে। একটা দল কাছে আসামাত্র আঁশটে গন্ধে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। সেই দলে দু-জনের সর্বাঙ্গ আলখাল্লায় ঢাকা ছিল। একজনের মাথায় একটা উঁচু গয়না বা মুকুট চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল। তবে আমার আতঙ্কের মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছিল একটাই কারণে। মনে হচ্ছিল, আলখাল্লার আড়ালে ওই প্রাণী দুটি হাঁটছিল না, থপথপিয়ে লাফাচ্ছিল।

আশপাশটা আবার ফাঁকা হয়ে গেলে আমি লাফায়েত স্ট্রিট, আর তারপর ইলিয়ট স্ট্রিট প্রায় দৌড়েই পেরোলাম। সাউথ স্ট্রিট এড়ানো অসম্ভব বুঝে আমি চেষ্টা করলাম আগের মতোই ঘষটে ঘষটে জায়গাটা পেরোতে। আমার কপাল খুবই ভালো ছিল বলে টাউন স্কোয়্যারের দিক থেকে কোনও দল সেই মুহূর্তে ওখানে আসেনি, নইলে…! জায়গাটা নিরাপদে পেরিয়ে আমি আবার জলের ধারে এসে পড়লাম। আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমি অন্যদিকে নজর সরাতে পারলাম না। সমুদ্র আমার নজর টেনে নিল।

না, সমুদ্রে কোনও জাহাজ ছিল না। তবে একটা দাঁড়-টানা নৌকোকে আমি দেখলাম পরিত্যক্ত জেটিগুলোর দিকে যেতে। মনে হল, নৌকোয় কেউ, বা কিছু একটা জিনিস ঢাকা দিয়ে রাখা রয়েছে। যারা দাঁড় টানছিল, তাদের চেহারায় একটা বীভৎসতা ছিল। নৌকোর আশপাশে বেশ কিছু সাঁতারুকেও দেখলাম। দূরে ডেভিলস রিফ-এ তখন একটা মৃদু, কিন্তু স্থির আলো জ্বলেছিল। আলোটার রং আমার কাছে অজানা। উলটোদিকে গিলম্যান হাউসও তখন একদম অন্ধকার।

রাস্তাটা পুরোপুরি পার হওয়ার আগেই জোরালো গুঞ্জন শুনলাম। দেখলাম, উত্তরদিক থেকে ওয়াশিংটন স্ট্রিট ধরে একটা বড় দল এগিয়ে আসছে। চাঁদের আলো খুব স্পষ্ট ছিল বলেই লোকগুলোর চেহারার বিকৃতি আমার নজর এড়াল না। শুধু মুখের গড়ন নয়, কয়েকজনের শরীর দেখে মনে হচ্ছিল, তাতে বাঁদর আর ব্যাং, দুয়ের মিশ্রণ ঘটেছে! ওই দলেই আমি আলখাল্লা-পরা, মাথায় টায়রা-চড়ানো একজনকেও দেখলাম। মনে হল, এই দলটাই গিলম্যান হাউসে আমার সন্ধানে হানা দিয়েছিল। ঠিক তখনই ওদের একজন আমার দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য আমি ওখানেই থমকে গিয়েছিলাম। তবে মাথা ওই অবস্থাতেও কাজ করছিল। যথাসাধ্য স্বাভাবিকভাবে, একজন স্থানীয় লোকের মতো করেই আমি হেঁটে জায়গাটা পেরোলাম। আমার নকলনবিশি নির্ঘাত জবরদস্ত ছিল, কারণ দলটা আমাকে উপেক্ষা করে, নিজেদের মধ্যে কোনও বিজাতীয় ভাষায় কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেল।

অন্ধকারে আমি আবার ছোটা আর হাঁটার মাঝামাঝি গতিতে এগোতে থাকলাম। বেটস স্ট্রিটে দুটো বাড়ি দেখে বুঝলাম, তাতে তোক থাকে। তবে আমার নিঃশব্দ পদসঞ্চার কারও ঘুম ভাঙায়নি। অ্যাডামস স্ট্রিটে পৌঁছে আমি নিজেকে একটু নিরাপদ মনে করছিলাম। কিন্তু তখনই একটা বিপর্যয় হতে যাচ্ছিল। একটা অন্ধকার দরজা থেকে একজন বেরিয়ে একেবারে আমার সামনেই পড়েছিল। আবার ভাগ্য প্রসন্ন হল। লোকটা মদের নেশায় এমনই টলমল অবস্থায় ছিল যে, ও আমার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগেই আমি ব্যাংক স্ট্রিটের ভাঙা গুদামগুলোর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

নদীখাতের পাশের রাস্তাটা তখন একেবারে শুনশান। জলের গর্জনে আমার পায়ের শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছিল। গুদামগুলোর অন্ধকারে কী থাকতে পারে ভাবলে হাত-পা অচল হয়ে যেতে পারে ভেবে আমি মাথাটা ফাঁকা রাখার চেষ্টা করছিলাম। স্টেশনটার আলোছায়া ধ্বংসস্তূপে আমি দাঁড়ালাম না, সোজা রেললাইন ধরে এগোতে শুরু করলাম। জং-ধরা লাইনগুলো ঠিক থাকলেও তাদের মাঝের পাটাতন আর জয়েন্টগুলো খুলে এসেছিল। ওইরকম লাইন ধরে হাঁটা ভয়ানক বিপজ্জনক। কিন্তু ওসব ভাবার অবস্থা ছিল না। নিচু হয়ে, নদীখাত একপাশে রেখে আমি রেললাইনের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা ব্রিজটার কাছে পৌঁছোলাম। যদি রেল ব্রিজটা আমার শরীরের ভার নেওয়ার মতো অবস্থায় থাকে, তাহলে আমি ওটা পেরিয়ে ওদিকে যাব। নইলে আমাকে একটা রাস্তা খুঁজতেই হবে ওদিকে যাওয়ার।

চাঁদের আলোয় যত দূর বুঝলাম, তাতে সামনের দিকে কয়েকটা জয়েন্ট আমার ভার নেওয়ার অবস্থায় ছিল। কিছুটা এগিয়ে আমাকে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাতেই হল। তাতে আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় বাদুড়দের একটি বিরাট দল বিরক্ত হয়ে ব্রিজের ছাদ থেকে নেমে আসে। তাতে চমকে গিয়ে আমি আর-একটু হলেই ব্রিজ থেকে নীচে পড়ছিলাম। শেষ অবধি আমার কিছু হয়নি। সাবধানে জয়েন্টে পা রেখে, কয়েক জায়গায় লাফিয়ে ভাঙা অংশ পেরিয়ে আমি যখন ওপাশে পৌঁছে চাঁদের আলোয় দাঁড়ালাম, তখন এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে নিরাপদ মনে হল।

রিভার স্ট্রিটের একধার দিয়ে গিয়েছিল রেললাইন। কিছুটা এগিয়েই আমি বুঝলাম, ইন্সমাউথের ওই ভয়ানক আঁশটে গন্ধের এলাকা ছাড়িয়ে আমি সত্যিকারের গ্রামীণ এলাকায় ঢুকছি। কাঁটা আর ঝোপঝাড়ে আমার পোশাক ছিঁড়ে যাচ্ছিল ঠিকই। তবে আমি জানতাম, রোলি রোড থেকে তাকালেই আমাকে দেখা যাবে, যদি না এই ঝোপঝাড় আমাকে লুকিয়ে রাখে। একটু পরেই জলাজমি শুরু হল। তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক জায়গায় রেললাইনটা নিচু একটা খাতের মধ্য দিয়ে গেছে। জায়গাটা কাঁটাগাছ আর বুনো লতায় ভরতি। আমি আবার নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম, কারণ রোলি রোড ওই জায়গাটার একেবারে লাগোয়া। নিচু খাতের মধ্য দিয়ে জায়গাটা পেরিয়ে গেলে রোলি রোড, এবং নজরদারদের থেকে দূরে চলে যেতে পারব আমি।

জায়গাটাতে ঢোকার আগে আমি পেছনে তাকালাম। না, কেউ আমাকে অনুসরণ করছিল না। এক মুহূর্তের জন্য ইন্সমাউথের ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর দিকে আমার চোখ গেল। মনে হল, এখন অভিশপ্ত হলেও একসময় শহরটা সত্যিই সুন্দর ছিল। চোখটা নামাতে গিয়েই অত্যন্ত অসুন্দর কিছুতে আমার চোখ আটকে গেল।

দক্ষিণে আমি একটা নড়াচড়া দেখলাম। অতটা দূর থেকে জিনিসটা দেখা যাচ্ছে, এর একটাই অর্থ হয়। একটা বিশাল বড় দল আমার পিছু নিয়েছে। সেনাবাহিনীর কোনও ইউনিট নয়, বরং জন্তুদের একটা বিরাট দলের কথাই মনে হল তাদের উঠে-নেমে এগোনো দেখে আর গর্জন, ঘোঁত ঘোঁত– এসব শুনে। তাহলে কি ইন্সমাউথের সেইসব প্রাচীন বাসিন্দা, যাদের লুকিয়ে রাখা হয় লোকের নজর থেকে, তারাই আমার পিছু নিয়েছে। কিন্তু এরা সব কি তাহলে মাটির নীচে, সুড়ঙ্গে, গর্তে… বা অন্য কোথাও লুকিয়ে ছিল? নাকি ডেভিলস রিফ থেকে হানা দিয়েছে এই বিরাট বাহিনী? কী চায় ওরা?

সবচেয়ে বড় কথা, তাহলে কি অন্য রাস্তাগুলোতেও নজরদারি শুরু হবে?

আমি ওই নিচু জায়গা দিয়ে নিঃশব্দে, সন্তর্পণে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ আঁশটে গন্ধের একটা ঢেউ আমার নাকে এসে লাগল। তাহলে কি হাওয়ার দিক বদলাল? নিশ্চয় তা-ই, কারণ গন্ধই শুধু নয়, ততক্ষণে শব্দরাও আমার কানে এসে পৌঁছোচ্ছে! বুঝতে পারলাম, রোলি রোড ধরে একটা দল এগোচ্ছে। যেহেতু ওই জায়গাটায় রোলি রোড রেললাইনটাকে প্রায় ছুঁয়ে তারপর আবার পশ্চিমে গেছে, তাই দলটা আমার সামনে দিয়েই যাবে! ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজের পাশাপাশি একটা অন্যরকম শব্দও আমার কানে আসছিল, যেন কোনও একটা প্রাণী থপথপ করে এগোচ্ছে। মনে হল, দূরে আমি যে বিরাট বাহিনীর অস্তিত্ব টের পেয়েছি, তাতেও যেন এমনই কেউ… বা কিছু আছে। কিন্তু নিচু ঝোপ আর বালিতে নিজেকে প্রায় গুঁজে দিয়ে সেই মুহূর্তে আমি শুধু একটাই কথা ভাবছিলাম।

ভাগ্যিস জন্তুজানোয়ার ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের পছন্দ করে না। নইলে, যদি একটা কুকুর ওই দলে থাকত, তাহলে এতক্ষণে আমার খেল খতম হয়ে যেত। অবশ্য এই সাংঘাতিক গন্ধের মধ্যে কুকুরদের নাকও কাজ করত কি?

দলটা আমার সামনে একটা খোলা জায়গা দিয়েই পার হল। চাঁদের আলোয় লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার গা ঘিনঘিন করছিল। এই যদি ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের অন্তিম চেহারা হয়, আর এই চেহারায় যদি এরা অমরত্বও পায়, কী অর্থ সেই জীবনের? ওদের শরীর থেকে বেরোনো গন্ধে আমার দম আটকে আসছিল। কণ্ঠস্বর নয়, বরং গলা আর নাক দিয়ে বের-করা নানা রকমের গর্জন আর ঘোঁত ঘোঁত দিয়ে ওরা ভাববিনিময় করছিল। মানুষের বদলে ওবেদ মার্শের দ্বারা আহূত দেবতাদের কাছাকাছি পৌঁছে-যাওয়া এই প্রাণীদের এত কাছ থেকে দেখাটাও একটা অভিশাপ। আমার মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছিল, তাই নিজের মাথা নিচু রেখেছিলাম। ভাগ্যিস! নইলে এরপর ওখান দিয়ে যে গেল, তাকে দেখলে আমি চুপ করে থাকতে পারতাম না।

আমি কি ভুল দেখেছিলাম? হতেই পারে। ইন্সমাউথে গোটা একটা দিন কাটিয়ে, জাডক অ্যালেনের ওইসব আখ্যান শুনে, তারপর অজ্ঞাত শত্রুদের হাত থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে গিয়ে আমার স্নায়ুতে যে কতটা চাপ পড়েছিল, তা আমিই জানি। কিন্তু পরে যখন সরকার ওখানে তদন্ত চালিয়েছিল, তখন জানা গিয়েছিল, আমি ভুল দেখিনি।

কী দেখেছিলাম আমি?

 আমি একঝাঁক অদ্ভুত প্রাণীকে সারিবদ্ধভাবে এগোতে দেখেছিলাম। তাদের মাথায় আর গলায় ছিল বিচিত্র গড়নের গয়না বা শিরস্ত্রাণ। কিন্তু তারা হাঁটছিল না, বরং লাফিয়ে বা পিছলে এগোচ্ছিল। মানুষের মতো দ্বিপদ চেহারা ছিল ওই প্রাণীদের। কিন্তু তাদের চকচকে, সবজেটে শরীর, পিঠে খাঁজকাটা ভাব, মুখের দু-পাশের ফোলা কানকো আর সাদা পেট… এগুলো মাছ, ব্যাং, সরীসৃপ– এই তিন ধরনের প্রাণীকেই মনে করায়।

সৃষ্টির কোন পর্যায়ে তৈরি হয়েছিল এই প্রাণীরা? তখন পৃথিবী কি নরক ছিল, না স্বর্গ? জানি না, তবে ওই প্রাণীদের আমি চিনতে পারলাম। নিউবারিপোর্টের মিউজিয়ামে সেই টায়রাটার গায়ে এদের ছবিই তো নকশা করে আঁকা ছিল।

সংখ্যায় ওরা কত ছিল? অগুনতি! আমি যাদের দেখেছিলাম, সেই বিরাট সংখ্যাও নিশ্চয় ওদের মোট সংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। তবে আমি আর ওইসব ভাবতে পারিনি। ইন্সমাউথে আসার পর অনেক কিছু দেখেও আমি অনড় ছিলাম। কিন্তু সেই সময় আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

.

০৫.

বৃষ্টির ছাট যখন আমার ঘুম ভাঙাল, তখন দিনের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। নিচু খাত থেকে সাবধানে বেরিয়ে আমি চারপাশে দেখলাম। না, কোনও সাম্প্রতিক পায়ের ছাপ বা দাগ দেখিনি। দূরে তাকিয়ে ইন্সমাউথের জনহীন পরিত্যক্ত বাড়িঘর দেখতে পেলাম, তবে একটাও শব্দ শুনতে পেলাম না। এমনকী আঁশটে গন্ধটাও মনে হল যেন কম লাগছে। ঘড়ি দেখে বুঝলাম, বেলা দুটো বাজে।

খিদেয়, তেষ্টায়, ক্লান্তিতে শরীর ঝিমঝিম করছিল। কিন্তু ইন্সমাউথ থেকে যথাসম্ভব দূরে যাওয়ার ইচ্ছেটা এতই জোরালো ছিল যে, আমি ওসব পাত্তা দিইনি। রোলি রোড ধরে টানা হেঁটে আমি সন্ধের মধ্যে একটা গ্রামে পৌঁছেই। সঙ্গে যা টাকাপয়সা ছিল তা-ই দিয়ে খাদ্য, পানীয় এবং নতুন এক সেট পোশাক জোগাড় করতে অসুবিধে হয়নি। সেই রাতের ট্রেনেই আমি আর্কহ্যাম পৌঁছেই। প্রথমে সেখানে, তারপর বস্টনে, তারপর আরও বেশ কয়েক জায়গায় সরকারি দফতরগুলোতে গিয়ে আমি যা দেখেছি আর জেনেছি, তার বিবরণ দিই। তার ফলে কী হয়েছিল তা সবাই জানে। সেই কথাগুলো বলেই আমি এই লেখা শুরু করেছি।

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে সবচেয়ে ভালো হত, তা-ই না? কিন্তু বাস্তব আমার আপনার ইচ্ছেমতো চলে না।

.

ইন্সমাউথের অভিজ্ঞতার পর আমি আমার পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য হই। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভূগোল… এসব নিয়ে আর মাথা ঘামানোর ইচ্ছে ছিল না আমার। মিসক্যাটনিক ইউনিভার্সিটি মিউজিয়ামে যেসব রহস্যময় গয়নাগাটি রাখা ছিল, সেগুলোকে তো আমি বিষবৎ এড়িয়ে যাই! তার বদলে, আর্কহ্যামে থাকাকালীন আমি একটু পড়াশোনা করে, আর স্থানীয় পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে নিজের পরিবারের পুরোনো ইতিহাস জানার চেষ্টা করি। ওখানকার হিস্টরিক্যাল সোসাইটির কিউরেটর ছিলেন মিস্টার ই. ল্যাপহ্যাম পিবডি। আমি ওঁকে জানাই, আমি আর্কহ্যামের এলিজা ওর্নের নাতি, যাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৬৭ সালে, এবং মাত্র সতেরো বছর বয়সে যাঁর সঙ্গে ওহায়োর জেমস উইলিয়ামসনের বিয়ে হয়েছিল। এই কথাটা শুনেই পিবডি দারুণ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

কথায় কথায় জানা গেল, আমার এক মামা নাকি এভাবেই পরিবারের ইতিহাস খুঁজতে আর্কহ্যামে এসেছিলেন। তিনিই খোঁজ নিয়ে জানেন যে, আমার দিদিমার বাবা বেঞ্জামিন অর্নে গৃহযুদ্ধের ঠিক পরেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বধূটির বংশপরিচয় খুঁজতে গিয়ে ব্যাপারটা জটিল হয়। কাগজে-কলমে মেয়েটি নিউ হ্যাঁম্পশায়ারের মার্শ পরিবারের এক অনাথ ছিল। পরিবারের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ ছিল না। বস্টনের এক ব্যাংকে তার নামে একটা মোটা টাকা কেউ গচ্ছিত রেখেছিল। তা-ই দিয়েই ফ্রান্সে তার শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা হয়। এক ফরাসি গভর্নেস তার দেখাশোনা করতেন। নিউ হ্যাঁম্পশায়ার, এমনকী এসেক্স কাউন্টির মার্শদের মধ্যেও মেয়েটির বাবা এনখ বা মা লিডিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই আদালত একসময় সেই গভর্নেসকেই মেয়েটির অভিভাবক করে দিতে বাধ্য হয়। গভর্নেস মহিলা কারও কাছে পরিবারের ইতিহাস নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে যাঁরা মেয়েটিকে দেখেছেন, তাঁদের বক্তব্য ছিল, মেয়েটির চোখ দেখেই বোঝা যায় যে সে মার্শ পরিবারের একজন। আমার দিদিমার জন্ম দিতে গিয়েই মেয়েটি মারা যায়।

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার ফলে মার্শ নামটা আমার কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল। সেই পরিবারের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ থাকতে পারে জেনে আমি আর এই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে সাহস পাইনি। তার ওপর পিবডি একেবারে জোর দিয়ে আপনার চোখজোড়া দেখলেও কিন্তু মার্শদের কথা মনে হয়! বলায় আমি আরও চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। শেষ অবধি অর্নে পরিবারের ঠিকুজিকুষ্ঠি নোট করেই আমি আর্কহ্যাম ছাড়ি।

বস্টন হয়ে টলেডো, তারপর মাউমি–এই ছিল আমার পরবর্তী যাত্রাপথ। বিশ্রাম নিয়ে শরীর আর মন সারিয়ে নিই আমি। সেপ্টেম্বর থেকে জুন অবধি সময়টা কাটে পড়াশোনায়। এই সময়ের মধ্যে ইন্সমাউথ আমার মন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। শুধু মাঝেমধ্যে যখন সরকারি লোকজন কিছু প্রশ্ন নিয়ে আমার কাছে উদয় হত, তখনই ওই শহর, ওই সমুদ্র আর ওই বিভীষিকারা আমার কাছে ফিরে আসত। পরের জুলাইয়ে, মানে আমার অ্যাডভেঞ্চারের বর্ষপূর্তির সময়ে আমাকে ক্লিভল্যান্ডে যেতে হয় আমার মা-র পরিবারের কিছু আইনি ব্যাপারের জন্য। তখন, নিতান্তই দায়ে ঠেকে, আমাকে উইলিয়ামসন পরিবারের ইতিহাস নিয়ে আবার নাড়াচাড়া করতে হয়।

ওই পরিবারটা আমার কখনওই ঠিক সুবিধের লাগেনি। মা আমাকে তাঁর পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করতেন। বিশেষত আমার দিদিমার চেহারায় এমন কিছু একটা ছিল, যেটা দেখলেই আমার খুব অস্বস্তি হত। আমার যখন আট বছর বয়স, তখন দিদিমা হারিয়ে যান। লোকে বলত, তাঁর বড় ছেলে ডগলাস, মানে আমার বড় মামা আত্মহত্যা করায় সেই শোকেই নাকি উনিও বিবাগী হয়ে গিয়েছিলেন। ডগলাসই ছিলেন আমার সেই মামা, যিনি নিউ ইংল্যান্ড হিস্টরিক্যাল সোসাইটিতে বেশ কিছু দিন কিছু একটা বিষয় নিয়ে গবেষণার পর আত্মহত্যা করেন।

আমার মনে পড়ল, ওই মামাটিকেও আমি বিশেষ পছন্দ করতাম না। না, ওঁর স্বভাবটা খুব ভালো ছিল। কিন্তু ডগলাসকেও দেখতে ছিল আমার দিদিমার মতোই। ওঁদের দু জনেরই একদৃষ্টিতে তাকানোর ধরনটা দেখলে আমার গা শিরশির করত। আমার মা আর ছোট মামা ওয়াল্টার কিন্তু তাঁদের বাবার মতো দেখতে ছিলেন। তবে ওয়াল্টারের ছেলে, আমার মামাতো ভাই লরেন্স আবার দিদিমার চেহারা পেয়েছিল। লরেন্স এখন বদ্ধ উন্মাদ। ওয়াল্টার মামার সঙ্গে আমার শেষ যা কথা হয়েছিল, তাতে জেনেছিলাম, লরেন্সের শরীরও নাকি খুব খারাপ হয়ে গেছে। কতটা খারাপ, সেটা উনি বলেননি, তবে ওকে নাকি আর লোকের সামনে আনা যায় না। এই শোকে ওয়াল্টারের স্ত্রী-ও বছর দুই আগে মারা গিয়েছিলেন। ফলে ক্লিভল্যান্ডের উইলিয়ামসন নিবাসের বর্তমান বাসিন্দা শুধু আমার বৃদ্ধ দাদু, আমার ছোট মামা, আর অনেক অনেক স্মৃতি।

পুরোনো কাগজ থেকে আমার যা জানার তা পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুরোনো বিবর্ণ ফোটোগুলোতে আমার দিদিমা আর মামাকে দেখে অন্য একটা চিন্তা আমার মাথায় চাপল। বহু বছর আগে যা শুধুই অস্বস্তি ছিল, এক বছর আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেটা নিশ্চিত আতঙ্কের চেহারা নিল। অর্নে পরিবারের দলিলপত্র হাতড়ে বুঝলাম, আমার মনের মধ্যে আতঙ্কের মেঘটা এবার ঘূর্ণিঝড়ের আকার নিচ্ছে। জানতাম, আমার বংশপরিচয়ের রহস্যটা উন্মোচিত হলে সেটা আমি হয়তো হজম করতে পারব না। তবু এই জিনিসের শেষ না দেখে আমি থামতে পারছিলাম না।

দাদু একসময় বলেছিলেন, বিয়ের সময় বেঞ্জামিন অর্নে যৌতুক হিসেবে যেসব গয়নাগাটি পেয়েছিলেন, সেগুলো নাকি পারিবারিক ভল্টে রাখা আছে। তাদের ডিজাইন নাকি এমনই কুৎসিত, যে ওগুলো লোকের সামনে বের করা যায় না। আগে এই কথাটাকে গুরুত্ব দিইনি, কারণ গয়নার ডিজাইন নিয়ে আমার কস্মিনকালেও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এইবার আমি ছোট মামাকে একরকম চাপ দিয়ে অর্নে পরিবারের ভল্ট খোলাই।

কাপড়ের আস্তরণ সরিয়ে গয়নাগুলো বের করার সময় ওয়াল্টার গজগজ করছিলেন। মণিকার, এমনকী পুরাতত্ত্ববিদরাও নাকি গয়নাগুলোর উৎস নিয়ে কিছু বলতে পারেননি। এদিকে নতুন বউয়ের অভিভাবক, আদতে গভর্নেস এক ফরাসি মহিলা নাকি ওগুলোকে নিউ ইংল্যান্ড এলাকায় পরতে বারণই করেছিলেন! এইসব গয়না লোকে কেন বানায়, বোঝা দায়– এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। তবে আমার দিকে মন ছিল না। কাপড়ের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে আসা গয়নাগুলোর নকশা দেখতে দেখতে আমার মুখ বেঁকে যাচ্ছিল ভয়ে। সেটা দেখে ওয়াল্টার উদবিগ্ন হয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমি ওঁকে কাজটা চালিয়ে যেতে বলি। অবশেষে বেরিয়ে আসে একটা টায়রা। আর সেটার গায়ের নিপুণ, জটিল, উঁচু-হয়ে-থাকা নকশাগুলো দেখে আমার ঠিক সেই অবস্থাই হয়, যা হয়েছিল এক বছর আগে রোলি রোডের কাছে রেললাইনের খাতে শোয়া অবস্থায়।

আমি অজ্ঞান হয়ে যাই!

.

তারপর? তারপর আমার দিনরাত্রি মানে শুধু ভাবনা। সবসময় আমার মনে পড়ত জাডকের বলা একটা কথা। আর্কহ্যামের এক বাসিন্দাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে, তাঁর সঙ্গে ওবেদ মার্শের এক মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই কথাটাকে কেন্দ্রে রেখে আমার মন একটা ভয়ানক জাল বোনে। তাতে সুতো হয় আমার দিদিমা, আমার মামা আর মামাতো ভাইয়ের পরিণতি, আর… অর্নে ভল্ট থেকে পাওয়া ওই যৌতুক!

তা-ও আমি এগুলোকে সমাপতন ভেবে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম প্রায় দু-বছর ধরে। ইতিমধ্যে বাবা আমাকে একটা ফার্মে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে যথাসাধ্য মনোযোগ দিয়ে কাজকর্মও করছিলাম। কিন্তু ১৯৩০-৩১ সালের শীত থেকে আমি বিশেষ একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করি। শুরুতে ওগুলো ছিল হালকা, অনেকটা ভোরের স্বপ্নের মতো। কিন্তু ক্রমে সেগুলো ঘন আর জটিল হতে থাকে।

কী দেখতাম আমি স্বপ্নে?

দেখতাম, জলের নীচে প্রকাণ্ড সব ধ্বংসস্তূপ আর শহর। সেই শহরের আনাচকানাচে বিচিত্র চেহারার মাছেদের সঙ্গে আমি সাঁতরে বেড়াচ্ছি। ক্রমে সেই স্বপ্নে অন্য চেহারাও দেখা দিতে শুরু করে। ঘুম ভাঙার পর সেই চেহারাগুলোর কথা ভেবে আমি ভয়ে শিউরে উঠতাম। অথচ স্বপ্নে আমি ওদের ভয় পেতাম না। মনে হত, ওদের মতো বিচিত্র গয়না বা শিরস্ত্রাণ পরে অতল জলে ঘুরে বেড়ানোই আমার ভবিতব্য।

আমার চেহারা খারাপ হতে শুরু করল। বেশ বুঝতে পারছিলাম, চুম্বকের টানে লোহার মতো আমিও ওই স্বপ্নগুলোর টানে জাগর দুনিয়া ছেড়ে কল্পনার অতলে ডুবে যাচ্ছি। কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। ঘরবন্দি এক পঙ্গুর মতো জীবন শুরু হল আমার। তবে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতাম প্রায়ই। না, স্বেচ্ছায় নয়। আমার একটা অদ্ভুত রোগ হয়েছিল, যে জন্য আমি চোখের পাতা বন্ধ করতে পারতাম না। বাবা আমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, আমিও নাকি দেখতে আমার দিদিমা বা ডগলাসের মতো হয়ে যাচ্ছি।

একরাতে আমি দিদিমাকে স্বপ্নে দেখলাম।

সমুদ্রের তলায় এক বিশাল প্রাসাদে ছিলেন মহিলা। তার বাগান তৈরি হয়েছে ছত্রাক জড়ানো প্রবাল দিয়ে। একটা সবুজেটে আভায় আলোকিত হয়েছে প্রাসাদের দেওয়াল, ছাদ, প্রতিটি ঘর। সেখানেই তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন।

দিদিমা বললেন, ডগলাস নাকি খোঁজখবর নিয়ে এই জায়গাটার সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আসতে পারেননি এখানে। সাহস পাননি বলাই ভালো, কারণ নিতান্ত কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করেছিলেন ডগলাস। কিন্তু আমি পারব ওখানে আসতে। ওটাই নাকি আমার আসল জগৎ, যেখানে আমি অমর হয়ে থাকব।

দিদিমা আমাকে তাঁর পূর্বপুরুষদের কথাও বললেন। তিনি বললেন, ওই প্রাসাদ যেখানে আছে, সেই শহরের নাম রলিয়েহ। কোনও এক আদিম যুগে আরও শক্তিধর প্রাচীন দেবতাদের জাদু রলিয়েহ শহরকে জলের নীচে আটকে রেখেছে। কিন্তু একদিন ওঁরা ওপরে উঠবেন। সেদিন থেকে পৃথিবীতে আসবে এক নতুন যুগ। ইন্সমাউথ দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, তা একদিন শেষ হবেই।

আমার হঠকারিতায় ইন্সমাউথ শহরে ওঁদের বসতিটা নষ্ট হয়ে গেলেও তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। আসল ইন্সমাউথ আছে অনেক নীচে। তবে হ্যাঁ, আমার ওপর ওঁদের রাগ, অভিমান, দুঃখ– এসব আছে। আমাকে রলিয়েহ গিয়ে আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। যার সামনে আমাকে দাঁড়াতে হবে, তার চেহারাটা দেখে দারুণ ভয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আয়নায় তাকিয়ে বুঝলাম, আমার মধ্যে ইন্সমাউথ লুক এসে গেছে!

না। আমি এখনও আত্মহত্যা করিনি। আর এই কথাগুলো আপনাদের জন্য লিখতে গিয়ে বুঝলাম, ওসব করার কোনও দরকারও নেই। আমার প্রথম কাজ হবে ক্যান্টনের সেই পাগলাগারদ থেকে লরেন্সকে উদ্ধার করা। তারপর আমরা দু-জনে যাব ইন্সমাউথ। মাটির ওপরে ওই মৃত শহর নয়, বরং ডেভিলস রিফ-এর ওপাশে জলের নীচে থাকা ইন্সমাউথ। তারপর… যা হওয়ার তা-ই হবে। হয়তো কোরালের সারির মাঝে অন্ধকার সরণী ধরে সাঁতার কেটে ইয়াহানথেলির পাথুরে প্রাসাদে আর সেই অতলের দেবতাদের রাজত্বে অমর হব। আবার অন্য কিছুও হতে পারে।

মোদ্দা কথা হল, এই রহস্যের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। করলে কী হয়, দেখেছেন তো? ইন্সমাউথের ইশারায় সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না যে!

[প্রথম প্রকাশ: লেখাটি প্রাথমিকভাবে উইয়ার্ড টেলস ম্যাগাজিন ছাপতে অস্বীকার করে এর আয়তনের কারণে। সম্পাদক লেখাটিকে দু-ভাগে ভাগ করে ছাপতে চাননি। অবশেষে ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসে, উইলিয়াম ক্রফোর্ডের ভিশনারি পাবলিশিং লেখাটি পুস্তকাকারে প্রকাশ করে। ভাষান্তর: ঋজু গাঙ্গুলী]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *