পিকম্যানের মডেল

পিকম্যানের মডেল (PICKMANS MODEL)

[পিকম্যান আর লাভক্র্যাফটের মধ্যে মিল প্রচুর। পিকম্যানও তাঁর মতোই বাস্তবতার সঙ্গে মহাবিশ্বের অজানা ভয়ংকরকে নিয়ে ছবি আঁকে। পিকম্যানের অদ্ভুত ছবি যেমন শিল্প হিসেবে অত্যন্ত উঁচুদরের হলেও শিল্পবিশেষজ্ঞরা সেগুলিকে মানতে চান না, সেরকম লাভক্র্যাফটেরও ধারণা ছিল তাঁর গল্পগুলি বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বোস্টনের উত্তর অংশে যথেষ্ট সময় কাটিয়ে লাভক্র্যাফট গল্পটির পটভূমি সেখানে ফেলেছিলেন।]

এলিয়ট, মোটেই ভেব না যে, আমি পাগল হয়ে গেছি। এই পৃথিবীতে অনেক মানুষেরই আমার থেকেও অদ্ভুত ধরনের কুসংস্কার আছে। অলিভারের দাদুকেই দেখো, বুড়োটা মোটরগাড়িতে চাপতে চায় না। তো, আমি যদি ওই ফালতু সাবওয়েটা পছন্দ না করি, সেটা আমার ব্যাপার। আর ট্যাক্সিতে করেই যখন এখানে আরও তাড়াতাড়ি আসা যায়, তাহলে আমি সাবওয়ে ব্যবহার করতে যাবই বা কেন? ট্রেনে করে আসতে চাইলে পার্ক স্ট্রিট থেকে হেঁটে সোজা পাহাড়ের মাথায় উঠতে হত।

আমি জানি… গত বছর তুমি যখন আমায় দেখেছিলে, তখন আমার অবস্থা আরও খারাপ ছিল। কিন্তু তার জন্যে একটা হাসপাতাল সঙ্গে করে নিয়ে চলার তো কোনও কারণ নেই। ভগবান জানেন, আর আমিও বিশ্বাস করি, শুধুমাত্র ভাগ্যের জোরেই আমি সুস্থ আছি আজকে। তা ছাড়া… তুমি তো এত কৌতূহলী ছিলে না কখনও!

ঠিক আছে, যদি তুমি শুনতেই চাও। আর, কেনই বা চাইবে না? তোমারও উচিত তো। আমি ভেবেছিলাম, তুমি যখন জানতে পারবে, আমি আর্ট ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেছি আর পিকম্যানের সঙ্গেও বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ করেছি; তখন তুমি ওই অভিভাবকদের মতো আহা-উঁহু-মার্কা চিঠি লিখে পাঠাবে। আমি অবশ্য পিকম্যানের খোঁজে একবার ফিরে গিয়েছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তবে আমি, আমি ছিলাম না তখন।

না! আমি জানি না পিকম্যানের কী হয়েছিল! আর সে কথা আমি জানতেও চাই না। তুমি নিশ্চয়ই কিছু তথ্য পেয়েছ, যখন আমি ওদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। না, না, আমি ভাবতেও চাই না সে কোথায় যেতে পারে। যদি খোঁজার হয় তাহলে পুলিশকে খুঁজতে দাও। যদিও পুলিশ জানেই না যে, সে পুরোনো নর্থ এন্ড প্লেসটা পিটার ছদ্মনামে ভাড়া নিয়েছে। আমি ঠিক জানি না, ওই জায়গাটা আবার চিনতে পারব কি না– অবশ্য সে চেষ্টা আমি আর করিনি; দিনের আলোতেও না।

হাঁ, আমি জানি… আমি ভয় পাই যে, আমি জানি। আজকাল আমি সাবওয়েও ব্যবহার করতে পারি না। এমনকী, ভাঁড়ারঘরেও নামতে পারি না। উফ! আমি ভেবেছিলাম, তুমি বুঝবে আমার সঙ্গে কী হয়েছে! যখন আমি পুলিশের কাছে কিছু জানাতে চাইনি, তখনই বুঝবে তুমি। ওরা আমাকে বলেছিল ওদেরকে রাস্তাটা দেখিয়ে দিতে। যদিও রাস্তাটা আমিই একমাত্র জানতুম, কিন্তু ওখানে ফিরে যাওয়া! রক্ষে করো!

বিশ্বাস করো, সেই দিন আমি পিকম্যানের সঙ্গ কোনও সামান্য কারণে ছেড়ে দিইনি। অন্তত ওই ডক্টর রেইড বা জো মিন্ট অথবা বসয়ার্থের মতো কোনও সংকীর্ণমনা বুড়ির মানসিকতায় তৈরি কারণগুলোর জন্য তো নয়ই। …উঁহু! উঁহু। পিকম্যানের আঁকা ওই অমানুষিক রোগগ্রস্ত ছবিগুলো আমাকে কোনও শক দেয়নি। বরং সেই দিন আমি গর্ব বোধ করছিলাম। পিকম্যানের মতো একজন জিনিয়াসের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে বলে আমার বুক ফুলে উঠেছিল। তার শিল্পগুলো মানুষকে যেখানেই টেনে নামাক-না কেন, রিচার্ডের থেকে উঁচুদরের আঁকিয়ে বোস্টন আর কখনও পায়নি, যত দিন না পিকম্যান এসেছে। আমি আগেও এই কথা বলতুম, আর এখনও বলব। আমার বক্তব্য থেকে আমি একচুলও সরে আসিনি, আসবও না। এমনকী ওর ওই বিখ্যাত নারকীয় ভক্ষণ ছবিটা দেখার পরেও।

আসলে, পিকম্যানের শিল্পকলা বোঝার জন্য যেমন অঙ্কনক্ষেত্রে গভীরতার প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন জীবনের এক অন্তর্নিহিত উপলব্ধির। আজকাল তো যে-কোনও পত্রিকার প্রচ্ছদই নিজেদেরকে খানিকটা লাল-কালো রঙে চুবিয়ে ঘোষণা করতে থাকে, এই হল অন্ধকারের আতঙ্ক অথবা ডাকিনীর প্রতিহিংসা অথবা খোদ শয়তানের প্রতিবিম্ব। কিন্তু আমি মনে করি, একমাত্র সত্যিকারের শিল্পীরাই পারে প্রকৃত আতঙ্ককে চিত্রকলায় ফুটিয়ে তুলতে। তার অনুষঙ্গে প্রয়োজন শুধু দুটি জিনিস, ভয়ের নিবিড় উপলব্ধি এবং আন্তরিকতা। কারণ একজন প্রকৃত শিল্পীই জানে আতঙ্কের অঙ্গসংস্থান অথবা ভয়ের দেহবিদ্যা। সঠিক লাইন আর অনুপাত, যা সেই প্রচ্ছন্ন প্রবৃত্তিকে অথবা পুরুষানুক্রমে বইতে থাকা জিনের স্মৃতিতে রক্ষিত ভয়কে দৃঢ়ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম। সঠিক রঙের অনুপাত আর আলোছায়ার খেলাই নাড়িয়ে দেয় অন্তরে লুকিয়ে-থাকা সুপ্ত অজানা বোধটাকে।

তোমাকে অবশ্য এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা করে বলার কিছুই নেই। তুমি তো জানোই, কেন ফুজেলির আঁকা ছবি মনের ভেতরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, আর একটা সস্তা ভূতের গল্পের প্রচ্ছদ মানুষকে হাসতে বাধ্য করে। এই জীবনের বাইরের কিছু একটা ওরা অনুভব করেছে। সেটা দিয়েই ওরা আমাদের মুহূর্তের জন্যে আটকে ফ্যালে। ডোর পেয়েছিল। সাইম পেয়েছে। আঙ্গালোরা অব শিকাগো ছবিতে যা ফুটে উঠেছে। আর পিকম্যান, সে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে এমনভাবে পেয়েছে, যা আগে কেউ কখনও পায়নি। আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, কেউ যেন কখনও না পায়।

আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না, যে তারা কী দেখেছিল। তুমি কি জানো, সাধারণ শিল্পে একটা জলজ্যান্ত মানুষ বা প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা, আর কৃত্রিমভাবে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের জন্য স্টুডিয়োতে বসে একের পর এক ছবি আঁকার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক আছে। তবে আমি বলব, ওই শিল্পীর অদ্ভুত এক অন্তদৃষ্টি ছিল। তিনি মডেলের ওপরে ন্যস্ত করতে পারতেন বিশ্বজগতের সেই অলৌকিক দৃশ্যাবলি। যে প্রেততুল্য জগতে তিনি বাস করতেন, সেইসব দৃশ্য। ঠিক যেমন একজন জীবন্ত মানুষ আঁকা চিত্রশিল্পীর কাজের সঙ্গে একজন করেসপন্ডেন্স স্কুলের ছাত্রের তৈরি বিকৃত কার্টুনের পার্থক্য থাকে; ঠিক তেমনই শুধুমাত্র নরকের কসাইয়ের স্বপ্ন-দেখা মানুষদের আঁকা ছবি থেকে নিজের আঁকাতে বৈষম্য তৈরি করতে পারতেন তিনি।

যদি আমি কখনও দেখতে পারতুম, যা পিকম্যান দেখেছিল! তাহলে… আমি হয়তো বাঁচতাম না, যদি আমি দেখতে পেতাম, যা ওই মানুষটা দেখেছিল। যদি সে আদৌ মানুষ হয় তো…। নাহ! আচ্ছা, আরও গভীরে যাওয়ার আগে, এসো, এক গ্লাস করে খাওয়া যাক।

তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, পিকম্যানের আসল গুণ ছিল মুখাবয়ব আঁকাতে। গোয়্যার পরে আর কেউ অভিব্যক্তির এমন মোচড় অথবা আকৃতিগত দিক থেকে এতটা খাঁটি নারকীয়তা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। গোয়্যার আগেও মধ্যযুগীয় কিছু মানুষ ওই বেয়াড়া বিদঘুটে মুখওয়ালা অমানুষগুলো অথবা ওই বিকট কাল্পনিক জীবগুলো বানিয়েছিল। যেগুলো নোতরদাম বা মন্ট সেইন্ট মিচেল-এর স্থাপত্যের মধ্যে আছে এখনও। তারাও কি ওইসব জিনিসে বিশ্বাস করত? কে জানে, তারা হয়তো ওই জীবগুলোকে দেখেওছিল। মধ্যযুগে বেশ কিছু অবিশ্বাস্য গোপন ও রহস্যময় পর্ব আছে।

আমার মনে পড়ল, তুমি একবার পিকম্যানকে নিজের থেকেই জিজ্ঞাসা করেছিলে, ওই তুমি চলে যাওয়ার আগের বছরেই, কোন আকাশ থেকে সে অমন কল্পনা আর দর্শন পেল। সে তোমার মুখের ওপরে বিশ্রীভাবে হেসে উঠেছিল না? ওটার খানিকটা কারণ, রেইড সেই সময় পিকম্যানের সংস্পর্শ ত্যাগ করেছিল।

আরে, রেইড। সেই রেইড, যে তুলনামূলক বিকারতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছিল তখন। অবশ্য ওই বিষয়টাই ছিল অমন। কুলকুণ্ডলিনী-মার্কা বিভিন্ন আড়ম্বরপূর্ণ শব্দ দ্বারা ভরতি। এ ছাড়াও ছিল আত্মিক এবং শারীরিক বিভিন্ন বিবর্তনীয় দ্যোতনা। তিনিই বলেছিলেন, পিকম্যান তাঁকে প্রতিদিনই বেশি বেশি করে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। তিনি ক্রমেই আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে উঠছিলেন৷ রেইড বলেছিলেন, পিকম্যানের আকৃতি এবং অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে এমন দিকে পরিবর্তিত হচ্ছিল যে, ব্যাপারটা তাঁর মোটেও ভালো লাগছিল না। পরিবর্তনটা যেন ঠিক মনুষ্যপদবাচ্য নয়। এমনকী তিনি নাকি এটাও বলেছিলেন যে, পিকম্যান অস্বাভাবিক রকমের ছিটগ্রস্ত হয়ে গেছে।

আমার যত দূর মনে পড়ে, তুমিই রেইডকে বলেছিলে। পিকম্যানের ছবিগুলোই আসলে তার নার্ভের ওপরে চাপ ফেলছে, অথবা তার অস্বাভাবিক কল্পনাই তার চেতনাকে নষ্ট করে ফেলছে। আমি নিজেই যখন রেইডকে এই কথাগুলো জানিয়েছিলাম, তখন রেইডও আমাকে বলেন যে, তুমি আর রেইড এই ব্যাপারে একমত ছিলে।

কিন্তু মনে রেখো, আমি কিন্তু পিকম্যানকে এইসব কিছুর জন্যে ছেড়ে আসিনি। বরং উলটোটাই হচ্ছিল, ওই অসাধারণ কীর্তি নারকীয় ভক্ষণ ছবিটার দেখার পর থেকে, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ক্রমে বেড়েই যাচ্ছিল। যেমনটা তুমি জানো, তেমনটাই ঘটেছিল। ক্লাবে ওটা প্রদর্শনই করা হয়নি। আর ফাইন আর্টসের মিউজিয়াম তো ওটাকে উপহার হিসাবেও গ্রহণ করেনি। আর আমি এটাও শপথ নিয়ে বলতে পারি যে, কেউ ওটা কিনবেও না। তো পিকম্যান ওটা নিজের বাড়িতেই রেখে দিয়েছিল, চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। এখন ওর বাবার কাছে আছে ওটা, সালেমে। তুমি তো জানোই পিকম্যান পুরোনো সালেমীয়দের একজন। ১৬৯২-তে পিকম্যানের পরিবারের একজন নারীকে ডাকিনী সন্দেহে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

পিকম্যানের ডাকে সাড়া দেওয়াটা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষত যখন আমি অদ্ভুত চিত্রকলার বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তার পর থেকেই। হয়তো তার আঁকাই আমাকে এই ব্যাপারে মাথা ঘামাতে বাধ্য করেছিল। তথ্যের খনি হিসাবে তাকেই খুঁজে পেয়েছিলাম। অবশ্য আমার লেখাটা তৈরি করতে তার গুরুত্বপূর্ণ মতামতও আমাকে সাহায্য করছিল।

পিকম্যান আমাকে তার কাছে যে সমস্ত রঙিন ছবি আর রেখাঙ্কন ছিল, সব কটা দেখিয়েছিল। ওগুলোর মধ্যে এমন কিছু কালি আর পেনের স্কেচ ছিল, ক্লাবের অন্য সদস্যরা ওগুলো দেখলে তাকে নির্ঘাত ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত সদস্যপদ থেকে।

অতএব যেটা বলাই যায় যে, খুব কম সময়ের মধ্যেই আমি পিকম্যানের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। একটা ছাত্রের মতোই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শুনতাম পিকম্যানের শিল্পতত্ত্ব আর তাদের দার্শনিক ব্যাখ্যা। অবশ্য কথাগুলো তাকে ডেনভার পাগলাগারদে পাঠাবার পক্ষে একদম যোগ্য ছিল। তার কাছে অন্যান্য মানুষের আসা-যাওয়া যত কমতে থাকল, ততই আমার বীরভক্তির পারদ চড়তে লাগল। সে আর তার অদ্ভুত চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণভাবে আমাকে পেয়ে বসল।

একদিন সন্ধেবেলা সে আমাকে বলল, আমি যদি একদম মুখ বন্ধ করে থাকি আর একদমই খুঁতখুঁত না করি তাহলে সে আমাকে একদম অন্যরকম একটা জিনিস দেখাবে। এমন একটা জিনিস, যা এত দিন যে সমস্ত জিনিস দেখেছি, সেগুলোর থেকে একটু বেশিই দুষ্পাচ্য।

তুমি কি জানো? পিকম্যান বলেছিল, এমন অনেক জিনিসই আছে, যাদেরকে ওই নিউবেরি স্ট্রিটের শিল্পসভার জন্যে বানানো সম্ভব নয়? এমন জিনিস, যা এখানে মানায় না। এখানে তার সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। যা-ই হোক গে, আমার কাজ হল আত্মার স্বরূপটাকে ছবিতে ধরা। আর সেটা কোনও ভুঁইফোঁড় রাস্তার ধারে গজিয়ে-ওঠা বাড়িতে করা যায় না। এর জন্য প্রাচীনত্ব লাগে। একটা অতীত লাগে। লাগে স্মৃতি। এই বোস্টন তো এখনও কিছুই হয়ে ওঠেনি। স্থানীয় আত্মাদের আকর্ষণ করার মতো স্মৃতি তৈরি করার সময় কোথায় পেয়েছে? যদি এখানে কোনও ভূত থেকেও থাকে, তাহলে তারা ওই লবণ জলাভূমি আর অগভীর চড়াগুলোতে চরে-বেড়ানো গৃহপালিত পশু বই আর কিছু নয়। আমার চাই মানুষের আত্মা, প্রেত। যারা নরকে উঁকি দেওয়ার মতো ক্ষমতা ধরে আর যে সমস্ত নারকীয় দৃশ্য তারা দেখে, সেইগুলো বোঝার ক্ষমতাও রাখে। মনে রাখবে, ব্যাক বে বোস্টন নয়।

কোনও শিল্পীর আসল থাকার জায়গা হল নর্থ এন্ড। যদি কোনও কলাবিদ্যাবিশারদ তার শিল্পের প্রতি একনিষ্ঠ হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই ঐতিহ্যের পিণ্ডি চটকাতে চলে যেতে হবে ওই গ্রামগুলোতে। ওহ ভগবান! তুমি কি বুঝতে পারছ না, ওই বসতিগুলো কেউ তৈরি করেনি, ওগুলো আসলে গড়ে উঠেছে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ ওখানে থেকেছে, জীবনকে অনুভব করেছে এবং মারা গেছে। সেই সময়ে যখন মানুষ থাকতে, অনুভব করতে কি মারা যেতে ভয় পেত না। তুমি কি জানো, ১৬৩২-এ কপস হিলে একটা কারখানা ছিল? আর ওখানকার বেশির ভাগ রাস্তাই গড়ে উঠেছিল সেই ষোলোশা পঞ্চাশ নাগাদ। আমি তোমাকে এমন বাড়িও দেখাতে পারি, যেগুলো আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরোনো। সেই সমস্ত বাড়ি যা দেখেছে, তা আজকালকার ওই আধুনিক বাড়িগুলোর গর্ব ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে। এই নব্যকৃষ্টিগুলো কী জানে প্রাণ আর জীবনের অন্তঃশক্তির ব্যাপারে?

সালেম, ডাকিনীবিদ্যাকে তুমি অবহেলায় বলে দিতে পারো বিভ্ৰমমাত্র। কিন্তু আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আমার ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পিতামহী অবশ্যই অন্য কিছু বলবে এই ব্যাপারে। ওরা তাকে গ্যালোস হিলে ফাঁসি দিয়েছিল। ধর্মধ্বজী কটন ম্যাথার নিজের চোখে দেখছিল সেই ফাঁসি। ম্যাথার শয়তানটা, সারাজীবন ভয়ে ভয়ে ছিল যে, এই বুঝি কেউ গতানুগতিক অভিশপ্ত ধার্মিক চিন্তাভাবনার খাঁচাটা ভেঙে ফেলল। আমি সত্যিই খুশি হতাম, কেউ যদি তাকে অভিশাপ দিত বা রাতের অন্ধকারে তার রক্ত চুষে খেত।

আমি তোমাকে ওই বাড়িটাও দেখাতে পারি, যেখানে সে থাকত। তোমাকে আরও একটা বাড়ি দেখাতে পারি, অত বারফট্টাই সত্ত্বেও ধর্মের ষাঁড়টা যেখানে পা রাখতে ভয় পেত। সে আসলে কিছু জিনিস জানত, কিন্তু সেগুলোকে ওই বোকা ম্যাগনালিয়া অথবা বুড়োর ওয়ান্ডারস অব দি ইনভিসিব্‌ল ওয়ার্ল্ড-এ ছাপাতে ভয় পেয়েছিল। তুমি নিশ্চয়ই জানো, এই সম্পূর্ণ নর্থ এন্ড একসময় সুড়ঙ্গে ভরতি ছিল। কিছু মানুষ বাকিদের অগোচরে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্যে এই ব্যবস্থা চালু করেছিল। এ ছাড়াও ছিল কবরখানা আর সমুদ্র। ওই বোস্টনের বোকাদেরকে মাটির ওপরের জিনিস নিয়েই হয়রান হতে আর নালিশ করতে দাও। প্রতিদিন মাটির গভীরে এমন অনেক কিছুই ঘটে যায়, যেখানে ওদের কল্পনাও কোনও দিন পৌঁছোতে পারবে না। ওইসব হাসির শব্দের হদিশও ওরা কোনও দিন খুঁজে পাবে না।

কিন্তু কেন? সতেরোশোর আগে তৈরি হওয়া বাড়িগুলির অন্তত দশটার ক্ষেত্রে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, মাটির নীচের ঘরগুলোয় তুমি অবশ্যই বীভৎস কিছু জিনিস খুঁজে পাবে। আরে, এই তো মাসখানেক আগেই, কিছু মজুর ইটের গাঁথনি ভাঙতে গিয়ে কুয়ো খুঁজে পেয়েছে। তুমি পড়োনি? এমন গভীর সব কুয়ো, যেগুলো সুড়ঙ্গ হয়ে কোন পাতালে অদৃশ্য হয়েছে, কেউ জানে না। হেঞ্চম্যান স্ট্রিটে অমন একটা দেখতে পাবে তুমি। ওসব জায়গায় ডাইনিরা থাকত। মন্ত্র পড়ে ডাক পাঠাত। জলদস্যুরাও আসত, সঙ্গে করে নিয়ে আসত লুটের মাল। মৃত মানুষের সম্পদ।

আমি বলছি তোমায়, আগেকার দিনে মানুষ জানত, কীভাবে বাঁচতে হয়। জানত, কীভাবে জীবনের সীমানাকেও বিস্তৃত করে দেওয়া যায়। জ্ঞানী আর সাহসী মানুষদের কাছে এটাই একমাত্র পৃথিবী ছিল না। আর আজকের অবস্থা দেখো, ঠিক উলটো। ওই ক্লাবের হবু শিল্পীগুলোর ফ্যাকাশে গোলাপি ঘিলুতে কাঁপুনি আর খিচুনি ধরে যায়, যদি কোনও চিত্রকলায় বেকন স্ট্রিটের চায়ের টেবিলের সহ্যক্ষমতার থেকে বেশি কোনও অনুভূতি ফুটে ওঠে।

অতীতকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার না করে অগ্রসর হওয়ার বোকামি করা হয়তো বর্তমানের পক্ষেই সম্ভব। আচ্ছা, এখান থেকে ওই উত্তরদিকের জায়গাগুলোর ব্যাপারে তোমার ম্যাপ, গাইড বই কী বলে? অ্যাঁ? আমি আন্দাজে তোমাকে প্রিন্স স্ট্রিটের উত্তরে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটা গলিতে নিয়ে যাব– তারও আবার তস্য গলি আছে। বিদেশি পর্যটকের দল হয়তো সেখানেও ভিড় করে মচ্ছব করছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তারা কল্পনাতে আনতে পারবে না সেসব স্থানমাহাত্ম। আরে, বিদেশি পর্যটকদের তো ছেড়েই দিলাম। এখানকার কতজনই বা এসব চেনে বলো দিকিনি? দেখাও তো এমন কয়েকটাকে!! থ্রাবার, মেনে নাও, পারবে না। এই প্রাচীন জায়গাগুলো তাদের আতঙ্কের জটার মধ্যে দুর অতীত স্বপ্নের যে ঊর্ণনাভ জাল বুনে চলেছে, তার হদিশ পাওয়া সাধারণের কম্ম নয় হে৷ সাধারণের থেকে অনেক অনেক উর্ধ্বে এরা সম্পূর্ণ উপলব্ধির বিষয়। কেউ বুঝতে পারেনি, কেউ না –না না– একজন পেরেছিল। আমি কি বৃথাই এত দিন ধরে অতীতের কবর খুঁড়ে চলেছিলাম নাকি? হুঁ।

তবে, তুমি এই সমস্ত বিষয়ে কৌতূহলী। বেশ খোলা মনেই গ্রহণ করেছ আমার ছবিগুলোকে। খুব একটা পেট-পাতলাও নও। তাই ভাবছি, তোমাকে বলাই যায়… আমার আরও একটা স্টুডিয়ো আছে, পাহাড়ের ওপরের দিকে। ওখানে আমি সেইসব ছবি আঁকি, যা আমি নিজেই এই নিউবেরি স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে কল্পনাও করতে পারি না। ক্যানভাস বন্দি করা প্রাচীন সব ভীতি। অবশ্য ক্লাবের ওই বুড়ি ঠাকুমাদের মতো নীতিসর্বস্ব সদস্যগুলোর সামনে এই ব্যাপারে আমি কোনও দিনও কিছু বলিনি, আর বলবও না। ওই শয়তান রেইড তো কিছু না জেনেই এমন ফিশফিশ করে, যেন আমি একটা বিকৃত মস্তিষ্কের দানব। এমন এক দানব, যে বিবর্তনের উলটোদিকে গড়িয়ে নামছে। তবে গ্রাবার, বহু দিন ধরেই আমি মানতাম, একজন চিত্রকর যেমন জীবনের সৌন্দর্যটা ফুটিয়ে তোলে, তেমনি আতঙ্কটাও ফুটিয়ে তোলা উচিত। সেই জন্যেই আমি জীবনভর অনুসন্ধান করেছি। অবশেষে কিছু জায়গা খুঁজেও পেয়েছি, জানতে পেরেছি প্রাচীন আতঙ্কদের।

এমন একটা জায়গার খোঁজ পেয়েছি, যেটা আমি ছাড়া আর মাত্র তিনজন জীবিত নর্ডিক মানুষ দেখেছে। দূরত্ব হিসাবে মাপলে সেটা এমন কিছুই দূরে নয়। কিন্তু, প্রাচীনতার দিক থেকে দেখলে স্থানটার আত্মা শত শত বছরের পুরোনো। আমি ওই বাড়িটা ঠিক করেছিলাম, কারণ ওই বাড়ির সেলারের মধ্যে একটা উৎকট ধরনের কুয়ো রয়েছে। ঠিক যেমন একটু আগে তোমাকে বলছিলাম। কুটিরটা প্রায় ভেঙেই পড়েছিল। ওখানে কেউ বাসও করত না। এত কম দামেই ওটা নিয়েছি যে, ভাবতেও লজ্জা করে। জানলাগুলো কাঠকুটো খুঁজে পুরোপুরি বন্ধ করা। তবে ওটা আমার কাজেই লেগেছে। আমি যা করি, তার জন্যে দিনের আলোর কোনও প্রয়োজন নেই। আমি মাটির নীচের ঘরে বসেই আঁকি। ওখানেই আমার অনুপ্রেরণারা ভিড় করে আসে। তবে একতলার কয়েকটা ঘরকে আমি পরিষ্কার করে রেখেছি। ওই বাড়িটার মালিক ছিল এক সিসিলিয়ান, আমি ওটা পিটার নামে ভাড়া নিয়েছি।

এখন তুমি যদি চাও, তবে আমি তোমাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারি। আমার মনে হয়, ছবিগুলো তোমার ভালোই লাগবে। ওখানে আমি প্রায়ই যাই। কখনও কখনও পায়ে হেঁটেই চলে যাই। বারে বারে ট্যাক্সি করে গেলে ওই জায়গাটার প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হবে। বুঝতেই পারছ, সেটা আমি একদমই চাই না। অবশ্য আজকে সাউথ স্টেশন থেকে ব্যাটারি স্ট্রিটের জন্যে আমরা একটা শার্ট নিতে পারি, তারপরে না-হয় বাকি রাস্তাটা হেঁটেই চলে যাওয়া যাবে।

ওই জাঁকালো বক্তৃতার পরে, প্রথম খালি ক্যাবটা দেখামাত্রই হাঁটার বদলে দৌড়ে যাওয়া ছাড়া, আমার অবশ্য আর বিশেষ কিছুই করার ছিল না। সাউথ স্টেশনে ক্যাব চেঞ্জ করে, পুরোনো ওয়াটারফ্রন্টের পেছন দিয়ে সরকারি ঘাট পেরিয়ে, ব্যাটারি স্ট্রিটের সিঁড়ি ভাঙতে যখন শুরু করেছি, তখন ঘড়িতে পাক্কা বারোটা বাজে। অত গলিঘুজির হিসাব রাখতে পারিনি আমি, তবে বলতে পারি, যেখানে আমরা গিয়ে পৌঁছেছিলাম, সেটা গ্রিনাফ লেন নয়।

রাস্তাটা বেঁকতেই একটা বহু প্রাচীন আর নোংরা গলির মধ্যে গিয়ে পড়ল। অমনটা আমি জীবনেও দেখিনি। একটা জনমানবশূন্য সরু রাস্তা ক্রমশ ঢাল বেয়ে ওপরের দিক উঠে গেছে। আশপাশের বাড়িগুলোর হাড়গোড়ের মতো বেরিয়ে-আসা কার্নিশ বয়সের ভারে ক্ষয়প্রাপ্ত। ছোট ছোট জানলার কাচগুলো চিড়-খাওয়া। সাবেককালের আধভাঙা চিমনিগুলো চাঁদের আলো ফুড়ে বিসদৃশভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আমার দৃষ্টির মধ্যে ওই তিনটে বাড়ি, কটন ম্যাথারের সময়ের থেকেও প্রাচীন। আচমকাই আরও দুটো বাড়ি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমার মনে হল, আমি প্রায় ভুলে-যাওয়া ছুঁচোলো তেকোনা ছাদওয়ালা স্থাপত্যের একটা বাড়ি দেখলাম। পুরাতত্ত্বজ্ঞরা নিশ্চয়ই বলবেন, ওরকম বাড়ি বোস্টনে আর দুটি নেই।

আলো-আবছায়ার ওই গলিটা থেকে আমরা বাঁয়ে বেঁকলাম। প্রায় একই রকমের আরেকটা নিস্তব্ধ এবং আরও সরু গলি, এটা একদম অন্ধকার। কয়েক পা পরেই ডানদিকে একটা ত্যারচা বাঁক নিলাম যেন আমরা, অন্ধকারের মধ্যেই। তৎক্ষণাৎ পিকম্যান ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালল।

মান্ধাতারও আগের যুগের দশ খোপওয়ালা এক দরজা। ঘুণে খাওয়ার নরকযন্ত্রণাতেই যেন সেটা অমন বেঁকেচুরে গেছে। তালা খুলে, পিকম্যান আমাকে ফাঁকা নির্জন হলওয়েতে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানাল। হলওয়ের দেয়াল জুড়ে চমৎকার কালো ওক কাঠের প্যানেলিং। দেখতে খুবই সাধারণ হলেও, অ্যান্ড্রোস ও ফিপ্সের আমলের এবং ডাকিনীবিদ্যার যুগের ওই ব্যাবস্থাটা এক প্রাচীন পরিবেশ তৈরি করেছিল ঘর জুড়ে। তারপরে সে আমাকে বাঁদিকের একটা দরজা দিয়ে ঢোকাল। একটা তেলের বাতি জ্বেলে আমার দিকে ফিরে বলল, আপাতত এটা নিজের বাড়ি বলেই মনে করো।

বিশ্বাস করো এলিয়ট, আমি তেমনই মানুষ, যার মানসিক দৃঢ়তা খেটে-খাওয়া কুলিমজুরদের মতোই ইস্পাতকঠিন। তবে আমি তোমাকে বলতে পারি, ওই ঘরের দেওয়ালগুলোতে আমি যা দেখেছিলাম, তাতে আমারও রক্ত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। দেওয়ালে ঝুলছিল পিকম্যানের আঁকা বিভিন্ন ছবি। অবশ্যই যেগুলো ও নিউবেরি স্ট্রিটে আঁকতে পারত না বা দেখাতেও পারত না। ও যে বলছিল মন খুলে আঁকা তা একদিক থেকে ঠিকই। এসো, আরেক পাত্তর নেওয়া যাক। তুমি না নিলেও, আমার দরকার!

ছবিগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বিশেষ কোনও লাভ নেই। ক্যানভাসের ওপরে তুলির কিছু সামান্য আঁচড়েই ফুটে উঠেছে ভয়ংকর, অমানবিক আতঙ্ক, অবিশ্বাস্য ন্যক্কারজনক নীতিহীন এক বর্ণনাতীত নরক। এরকম বিজাতীয় টেকনিক সিডনি সাইমের আঁকাতেও দেখা যায় না। এমনকী ট্রান্স সাটার্নিয়ান ল্যান্ডস্কেপ বা লুনার ফাঙ্গি ছবিতে, ক্লার্ক আসটন স্মিথের ওই রক্ত-হিম-করা টেকনিকের থেকেও এ যেন আরও ভয়াবহ কিছু।

দৃশ্যপটগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরোনো চার্চের উঠোন, গভীর অরণ্য, সমুদ্রের ধার থেকে উঠে-যাওয়া খাড়া পাহাড়, ইটের সুড়ঙ্গ, প্রাচীন কড়িকাঠওয়ালা ঘর অথবা সাধারণ অর্ধবৃত্তাকার ডোম– এইসবই। ওই বাড়ি থেকে কয়েকশো মিটার দূরেই যে কপস হিলের কবরখানা, সেটা দৃশ্যপট হিসাবে ব্যবহার হয়েছে অনেকবার।

কিন্তু সেই দৃশ্যপটের পটভূমিতে আঁকা চেহারাগুলোর শিরায় শিরায় পাগলামি আর অস্বাভাবিকতা পরিস্ফুট। পিকম্যানের ওই রোগগ্রস্ত চিত্রকলা যেন মাত্রাতিরিক্তভাবেই কোনও শয়তানের প্রতিকৃতি। ছবির চেহারাগুলো কদাচিৎ পুরোপুরি মানুষের মতো। কিন্তু সেগুলোর ক্ষেত্রেও মানবিকতা যেন প্রায় অনুপস্থিত। মোটামুটিভাবে দ্বিপদী দেহগুলো হয় বসে আছে অথবা সামনে ঝুঁকে, তাদের শ্বদন্তের সারি দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। সব থেকে বড় কথা হল, এই বিকট গঠনবিন্যাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক বিশ্রী রকমের প্রাণময়তা।

আহ! আমি আবার ওগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দয়া করে আমাকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা দিতে বোলো না। ওগুলোর প্রবৃত্তি… বেশির ভাগ দেহধারী ছিল ভক্ষণরত অবস্থায়… না! কী খাচ্ছিল তা আমি বলতে পারব না!

তারা দলবদ্ধভাবে চরে বেড়াচ্ছিল কবরখানাগুলোতে অথবা মাটির তলায় সুড়ঙ্গের মধ্যে। অনেকগুলো ছবিতেই তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল শিকার অথবা গুপ্তধন নিয়ে। এই চোখ-মুখবিহীন দেহধারীগুলোর আকৃতিতে কী যে এক অলৌকিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছে পিকম্যান! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। কিছু কিছু ছবিতে দেহগুলো জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রাত্রির অন্ধকারে। অথবা, বসে বসে পা দোলাচ্ছে ঘুমন্ত ব্যক্তির বুকের ওপর; অধীরভাবে তাকিয়ে আছে মানুষগুলোর কণ্ঠার দিকে। একটা ক্যানভাসে ছিল গ্যালোস হিলের ফাঁসি-দেওয়া এক ডাইনিকে ঘিরে অনেকগুলো জীবের চক্রাকার অবস্থান। ডাইনির মৃত মুখটা ওই জীবগুলোর সঙ্গে প্রায় একই রকম।

একের পর এক ছবিতে ওই উকট বিষয়ের পরিবেশের বীভৎস চর্চা দেখতে দেখতে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি কোনও শিশু নই, ওইরকম বিষয়বস্তুর ওপরে আঁকা চিত্রকলা আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু ওই মুখগুলো! এলিয়ট! ওই নারকীয় অভিশপ্ত মুখের সারি। কুটিল দৃষ্টি আর লালা-ঝরানো মুখগুলো যেন ভীষণ প্রাণবন্ত হয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে ক্যানভাস কুঁড়ে। ওহ্ ভগবান, আমার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল ছবিগুলো যেন জ্যান্ত! ওই জঘন্য জাদুকর নরকের আগুনের এক-একটা টুকরো তুলে এনেছে ওর ক্যানভাসে। ওর তুলিই যেন জাদুদণ্ড হয়ে প্রসব করেছে দুঃস্বপ্ন। বোতলটা দাও, এলিয়ট! বোতলটা…

একটা ছবি ছিল, নাম শিক্ষা… উফ, কেন যে ওটা দেখতে গেলাম! ভগবান আমায় রক্ষা করুক! একটা ভাঙা চার্চ, উঠোন দখল করে চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিকটদর্শন কুকুরের মতো দেহধারী জীবগুলো। মধ্যিখানে একটা বাচ্চা। তারা বাচ্চাটাকে শেখাচ্ছে তাদের খাদ্যরীতি। কোটি টাকার ওপরে দাম হবে ওটার। তুমি কি সেই লোককথাটা জানো! কখনও নরকের না-মানুষের দল দোলনা থেকে মানুষের বাচ্চা তুলে নিয়ে তার বদলে রেখে যেত তাদের ছানা। পিকম্যান এঁকেছে, তারপরে কী ঘটত সেইসব মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে কীভাবে তারা বড় হয়ে উঠত– তারপরেই আমি লক্ষ করতে শুরু করলাম মানুষ আর অমানুষ দেহধারীগুলোর মুখের মধ্যে এক পাশবিক মিল। ছবিটার মধ্যে অমানবিক দেহধারী জীবগুলো আর অধঃপতিত মানুষদের মধ্যে এক অদ্ভুত ক্রমবিন্যাসের বিকার ফুটে উঠছিল। এ যেন বিবর্তনবাদের ছিঁড়ে-যাওয়া এক পৈশাচিক সুতো। ওই হায়েনাশ্রেণির জীবগুলো যেন মরমানব থেকেই বিবর্তিত হয়েছে।

পরক্ষণেই আমার মাথায় এক চিন্তা এল, ওই হায়েনা জীবগুলো তো লুকিয়েচুরিয়ে নিজেদের বাচ্চা রেখে যাচ্ছে মানুষজাতির মধ্যেই। এরপরেই আরেকটা ছবি আমার চিন্তা দখল করে নিল। ওটা ছিল একটা প্রাচীন হর্মের অন্তঃস্থল। বিশাল বিশাল কড়িকাঠ-দেওয়া উঁচু উঁচু ঘর, জাফরি-কাটা জানালা, চিরস্থায়ীভাবে রাখা যোড়শ শতকের সব জবরজং আসবাবপত্র। একটি পরিবার সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। গৃহকর্তা নিষ্ঠাভরে বাইবেল পড়ছেন। প্রত্যেকের মুখে সম্ভ্রম এবং শ্রদ্ধার ছাপ স্পষ্ট, শুধু একজন বাদে। তার ঠোঁটের কোনা মুচড়ে ঠিকরে আসছে চাপা ব্যঙ্গ-হাসি। এটা নিশ্চয়ই ওই একটা বদলে দেওয়া বাচ্চা, যে যুবক হয়ে উঠেছে বিগত কয়েক বছরে। একজন ধর্মজ্ঞ নিষ্ঠাবান বাবা পেয়েও তার রক্তের মধ্যে খেলা করে যাচ্ছে জন্মের সময়কার অশুচিতা। আর এই সমস্ত কিছুর থেকে থেকে বড় ব্যাপার হল, ওই যুবকের সঙ্গে পিকম্যান তার নিজের মুখের এক প্রত্যক্ষ সাদৃশ্য রেখেছে।

এই সময় পিকম্যান পাশের ঘরে গিয়ে আরেকটা বাতি জ্বালল। বিনয়বশত দরজাটাও খুলে ধরল আমার জন্যে। জিজ্ঞাসা করল, আমি কিছু আধুনিক চিন্তা দেখতে আগ্রহ বোধ করব কি না?

আরও আধুনিক! আমি অবশ্য নিজের মতামত ব্যক্ত করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। ভয়ে, ঘৃণায়, কী এক অস্বাভাবিক বোধে, আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কাঠ হয়ে গিয়েছিল। তবে আমার মনে হয়, সে আমার অবস্থাটা ভালোই বুঝতে পারছিল, আর নিজের কাজের জন্যে বেশ আত্মশ্লাঘা বোধও করছিল। আমি তোমাকে আবারও নিশ্চিত করছি এলিয়ট, আমি কোনও দুর্বলচিত্ত মানুষ না, যে সাধারণ জীবনের গায়ে একটু ঘা দেখলেই ভয়ে কেঁপে উঠব। আমি প্রায় মধ্যবয়স্ক এবং যথেষ্ট বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন। তুমি আমাকে ফ্রান্সে দেখেছিলে, আশা করি বুঝতে পারছ যে, আমি সহজেই উলটে-যাওয়া মানুষ নই। মনে করে দ্যাখো, স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে হাওয়া বদলে গিয়ে, আমি কোন সব ছবির ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। যেগুলোতে কলোনিয়াল নিউ ইংল্যান্ডকে নরকের রাজ্য ভেবে আঁকা হয়েছিল। এসব কিছু সত্ত্বেও, পরবর্তী ঘরের ছবিগুলো সত্যি সত্যি আমার মুখ থেকে আর্তনাদ টেনে বার করে আনতে সমর্থ হল। আমি টলে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে দরজার হাতলটা চেপে ধরলাম। আগের ঘরটায় দলকে দল পিশাচ আর ডাইনিরা আমাদের পূর্বপুরুষের অতীত হয়ে-যাওয়া মাটিতে চরে বেড়িয়েছে। কিন্তু এই ছবিটাতে আতঙ্ক নিজে উঠে এসেছে আমাদের প্রাত্যহিক বর্তমান জীবনে।

 ভগবান, কী করে একটা মানুষ এরকম আঁকতে পারে! এই ছবিটার নাম সাবওয়ে অ্যাক্সিডেন্ট। বয়েলস্টোন স্ট্রিটের সাবওয়ের একটা প্ল্যাটফর্ম ভরতি মানুষ। কোন এক অজানা ক্যাটাকুম্বের সুড়ঙ্গের সঙ্গে একটা দীর্ঘ ফাটল সেই প্ল্যাটফর্মকে যুক্ত করে দিয়েছে। সেই ফাটল বেয়ে উঠে আসছে রাশি রাশি নরকের জীব, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্ল্যাটফর্মের হতভাগ্য মানুষগুলোর ওপরে। অন্য ছবিটায়, কপস হিলের ওপরে নৃত্য। দৃশ্যপটে বর্তমান সময়ের শবঘরগুলো। চারপাশে নৃত্য করছে একদল দেহধারী জীব। আরও কয়েকটা ছবিতে বেশ কিছু ভাঁড়ারঘরের ছবি। মাটির নীচের এই ভাঁড়ারঘরগুলোর দেওয়ালের ফাটল আর সুড়ঙ্গ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছে কিছু জীব। কড়িকাঠের ওপরে আলো-আবছায়ায় ছুঁচোলো দাঁত মেলে তারা উবু হয়ে বসে আছে। সিঁড়ি দিয়ে যে নামবে, তার ঘাড়েই চোখের পলকে লাফিয়ে পড়বে।

আর-একটা জঘন্য ক্যানভাস জুড়ে বেকন হিলের এক বিস্তীর্ণ ক্রস সেকশন। সেই উপত্যকা বেয়ে দানবীয় পিঁপড়ের মতো উঠে আসছে নরকের পূতিগন্ধময় রাক্ষসদের সেনাবাহিনী। ঠিক মাটির নীচে গর্ত কেটে কেটে মাকড়সার জালের মতোই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তারা। ক্রমশ এগিয়ে আসছে জনবসতির দিকে। বর্তমান সময়ের একটা কবরখানার মধ্যে নৃত্য ছবিটা স্বাভাবিকভাবেই আঁকা। তবে একটা ধারণা আমাকে নাড়িয়ে দিল একেবারে। একটা অজানা সমাধিকক্ষের মধ্যে খান কুড়ি পিশাচ দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে একটা বই। সে সেটা তারস্বরে পড়ছে। বাকিরা সবাই একটা নির্দিষ্ট সুড়ঙ্গের দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করছে। তাদের বিকৃত চোয়াল বেয়ে ঝরে পড়ছে অট্টহাসি। সমস্ত ছবিটা এতটাই সুস্পষ্ট যে, আমি যেন নিজের কানে সত্যি সত্যি শুনতে পাচ্ছিলাম ওই বর্বর পৈশাচিক হাসি। বইটা ছিল আমাদের অতি পরিচিত বোস্টন গাইড বুক। ছবিটার নাম ছিল, হোমস, লয়েল আর লংফেলো। এই পাহাড়ের তলায় শুয়ে আছে।

ধীরে ধীরে আমি দ্বিতীয় ঘরের অত্যুচ্চমানের শয়তানি আর বিকারের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে লাগলাম। গা গোলাচ্ছিল তা-ও আমি ছবিগুলোকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম। প্রথমেই আমি নিজেকে নিজে বললাম, পিকম্যানের ঘোরতর অমানবিকতা আর নির্মম নিষ্ঠুরতার প্রতিবিম্ব এই ছবিগুলো। দেহমনের ওপরে এই অবিরাম নিপীড়ন। মানুষের এই পবিত্র আত্মার বাসস্থানস্বরূপ দেহবাড়িকে এইভাবে নিকৃষ্ট রূপ দেওয়া! এই

লোকটা নির্ঘাত মানবতাবাদের এক নির্দয় শত্রু। দ্বিতীয়ত, আমার মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়ে উঠল ছবিগুলোর উচ্চমানের রূপ দেখে। ছবিগুলোর শিল্পকলা এতই উঁচুদরের যে, ক্রমশ হৃদয়ের মধ্যে প্রত্যয় জন্মাচ্ছিল তাদের বাস্তবতার প্রতি। বুকের মধ্যে ভয় জমছিল ছবিগুলোর প্রতি। যখন আমরা চিত্রগুলো দেখছিলাম, তখন যেন শুধু চিত্রকলা নয়, ওই পিশাচগুলোকেই আমরা দেখছিলাম। প্রত্যেকটা ছবি এতটাই সুচারুভাবে আঁকা হয়েছিল। আর সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল, পিকম্যান ছবিগুলোর মধ্যে কোথাও কোনও অবাস্তবতা কিছুই ব্যবহার করেনি। একটা অংশও ঝাপসা, আবছা, বিকৃত বা গতানুগতিক ছিল না। প্রত্যেকটা বস্তু বা জীবের আউটলাইনগুলো পরিষ্কার এবং প্রায় জীবিত মডেল ব্যবহার করার মতোই পরিষ্কার। যন্ত্রণাদায়কের মতোই প্রত্যেকটা ডিটেইল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আঁকা। আর মুখগুলো!

না! যা আমি দেখছিলাম, ওগুলো কোনও সাধারণ শিল্পীর কল্পনার ব্যাখ্যা নয়। বিষয়বস্তুর প্রাঞ্জলতা, চরিত্রদের ঘৃণ্যতা, সব মিলিয়ে ছবিগুলো নিজেই নরক। হ্যাঁ, নরক! ওহ্ ভগবান! ওই লোকটা মোটেও কোনও কল্পনাপ্রবণ বা ভাববিলাসী নয়। সাধারণ কল্পনার মন্থনপ্রসূত হলাহল সে তুলে আনেনি। সে স্বয়ং নেমে দাঁড়িয়েছে হিমশীতল, বিষাক্ত দুনিয়ায়। একই সঙ্গে দু-হাতে টেনে নামাতে চাইছে আমাদের এই জাগতিক পৃথিবীকেও। যেখানে শত শত রৌরব নরকের জীব ঘুরপাক খাচ্ছে, সড়সড়িয়ে বুকে হাঁটছে অথবা ভেসে বেড়াচ্ছে। ভগবান জানে, কোথায় ও কীভাবে ওই সমস্ত নারকীয় দৃশ্যের একঝলকও তার মনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল! তবে যেভাবেই সেগুলো মনের আয়নায় বিম্বিত হোক-না কেন, একটা জিনিস খুব পরিষ্কার। পিকম্যানের আঁকা ওই ছবিগুলো, ওই দেহধারীরা, ওই প্রেক্ষাপট– ভাবনাচিন্তা ও চিত্রায়ণের দিক থেকে একদম নিখুঁত আর প্রায় বাস্তব। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাস্তব।

এইবার গৃহকর্তা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলেন মাটির তলার ভাঁড়ারঘরটার দিকে, যেটাকে উনি আসলে স্টুডিয়ো হিসাবে ব্যবহার করেন। আমি ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে বুকটাকে শক্ত করতে লাগলাম। আরও কী বীভৎস উৎকট শিল্পকলা অপেক্ষা করছে অসম্পূর্ণ ক্যানভাসে! ড্যাম্প-ধরা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে উনি ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়ে ঘরের একপাশে রাখলেন।

ঘরের মেঝের মধ্যে একটা বিশাল ইটে বাঁধানো কুয়ো। কুয়োর দেওয়ালে আলো লেগে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। আমরা ওটার কাছে এগিয়ে গেলাম। পাঁচ ফুট দূরে থাকাকালীনই আমি ওটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, প্রায় এক ফুট চওড়া সলিড বেড়বিশিষ্ট, মেঝে থেকে ইঞ্চি ছয়েক উঁচু ষোড়শ শতকের একটা স্থাপত্য।

পিকম্যান জানাল, এই ধরনের স্থাপত্যের কথাই সে বলছিল। এই জিনিসগুলোই সুড়ঙ্গের জাল তৈরি করে ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের তলা দিয়ে। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম জিনিসটা ইটে বাঁধানো নয়। বরং একটা খুব ভারী কাঠের চাকতি দিয়েই তৈরি। ওপরের ছবিগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে এই কুয়োর স্থাপত্য ইতিহাস বিশ্লেষণ আমার মোটেও ভালো লাগল না। নিজের অজান্তেই কেমন যেন শিউরে উঠলাম। পিকম্যান পাশের সরু দরজা দিয়ে এক ধাপ ওপরে একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। আমিও তড়িঘড়ি তাকে অনুসরণ করলাম। ঘরটা মেঝে কাঠের আর আসবাবপত্রও একজন শিল্পীর স্টুডিয়োর মতোই। একটা অ্যাসিটিলিন গ্যাসের জোরালো বাতি শিল্পীকে তার প্রয়োজনীয় আলো দিয়ে সাহায্য করে।

ইজেলের ওপরে অসমাপ্ত চিত্রগুলো চাপানো। অনুশীলনের কিছু কিছু ছবি দেওয়ালের গায়ে ঠেসান দেয়া। সবই ওই ওপরের ঘরের সম্পূর্ণ ছবিগুলোর মতোই। একই রকমের নৃশংস আর যন্ত্রণাদায়ক শিল্পকলায় পরিপূর্ণ। দৃশ্যপটের ব্লকগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে আঁকা। চরিত্রের পেনসিল স্কেচিংগুলোও খুব সূক্ষ্ম। পিকম্যান খুব যত্ন সহকারে ছোট ছোট অনুশীলনেও দৃষ্টিকোণ আর বিজাতীয় দেহের অনুপাত সঠিকভাবে বজায় রেখেছে।

নাহ্! শিল্পী হিসাবে মানুষটা মহান, স্বীকার করতেই হবে! সব কিছু জানার পরে আমি এখনও সেই কথাই বলব। টেবিলের ওপরে রাখা একটা বড় ক্যামেরা হঠাৎ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। পিকম্যান বলল, ওটা পটভূমির জন্যে প্রাকৃতিক ছবি তুলতে কাজে দেয়। বিভিন্ন শহরের ছবি অথবা কবরখানা অথবা পাহাড়ের উপত্যকা, সবই যেন এই স্টুডিয়োয় বসেই সে ছবি দেখে অনুপুঙ্খভাবে আঁকতে পারে। সে মনে করে, একটা ছবি অনেকটা প্রকৃত দৃশ্যপটের মতোই হওয়া উচিত। এমনকী মডেলদেরও। সে স্বীকার করল যে, সে প্রায়শই তাদের ভাড়া করে আনে।

ঘরের মধ্যে চতুর্দিক থেকে উঁকি মারছে বমন উদ্রেককারী স্কেচগুলো আর অসমাপ্ত নারকীয় দৃশ্যপটেরা। এই ছবিগুলোতে কী যেন একটা ব্যাপার আছে। কেমন একটা অস্বস্তি ক্রমে ঘিরে ধরছে আমাকে। পিকম্যান হঠাৎ একটা বিশাল ক্যানভাসের ওপরের সাদা কাপড়টা টেনে সরিয়ে দিল। আমার গলা থেকে একটা আর্ত চিৎকার আপনা-আপনি ছিটকে বেরিয়ে এল। দ্বিতীয়বার, ওই সন্ধেতেই। প্রাচীন বদ্ধ সেলার ঘরের ভ্যাপসা দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আর্তনাদটা ফিরে ফিরে আসতে লাগল। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমার দম আটকে এল, পরক্ষণেই নিজের অবস্থা বুঝে একটা পাগল-করা হাসি বেরিয়ে এল গলা চিরে।

ভগবানের দোহাই, এলিয়ট, আমি ওটাকে প্রথমে সত্যিই ভেবেছিলাম। জিনিসটা এত বেশি প্রাণবন্তভাবে আঁকা হয়েছিল। আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি, পৃথিবীতে কেউ এমনও কল্পনা করতে পারে।

ওটা একটা প্রকাণ্ড ছবি। নামহীন অতলের অন্ধকার থেকে উঠে-আসা এক জীব। তার রক্তচক্ষু জ্বলজ্বল করছে নৃশংসতায়, অস্থিময় নখরযুক্ত হাতে ধরে আছে একটা নরদেহ। একটা শিশু যেরকম লালসার সঙ্গে ললিপপ চুসে খায়, ঠিক সেভাবেই দেহ থেকে মাথাটা ছিঁড়ে খাচ্ছে সেই জীব। জীবটা সামান্য গুঁড়ি মেরে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, সে যে কোনও সময়ে হাতের দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে নতুন লজেন্সের সন্ধানে। কিন্তু ওসব কিছু না, বিষয়বস্তুও কিছু অতিপৈশাচিক নয়, যা কারও হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ করে দেবে। ওই কুকুরমুখে ছুঁচোলো কান নয়, ওই রক্তচক্ষু, থ্যাবড়া নাক, ঝোলা ঠোঁট, ওইসবও নয়। দীর্ঘ নখরে দুমড়ে-মুচড়ে-যাওয়া মনুষ্যদেহের ধ্বংসাবশেষও না, না ওই ক্ষুরকায় পদযুগল– ওইসব কিছু না। যদিও ওইগুলোর মধ্যে যে-কোনও একটাই সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে পাগল করার জন্যে যথেষ্ট ছিল, তবু আমি বলব, ওইসব কিছু নয়।

টেকনিক, এলিয়ট, ওই মারাত্মক শাপগ্রস্ত অবাস্তব টেকনিক! আমি, আমি একটা জ্যান্ত মানুষ হয়ে বলছি, আমি কোথাও দেখিনি, একটা আঁকা ছবিও ওরকম শ্বাসপ্রশ্বাসযুক্ত জীবিত প্রাণীর মতো হতে পারে। ওই পিশাচটা যেন আমার থেকে কয়েক হাত দূরে ওই ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে, বাড়ানো হাতের নখরগুলো যেন এক্ষুনি আমাকে ছুঁয়ে যাবে। প্রকৃতির নিয়মের বেড়াজালে থাকলে এই ধরনের চিত্রকলা কোনও মানুষ মন থেকে ফুটিয়ে তুলতে পারে না। মডেল ছাড়া এত প্রাণবন্ত ছবি আঁকা কোনওমতেই সম্ভব নয়। ওই নারকীয় জগতের একঝলক সত্য সত্যই না দেখলে, শুধুমাত্র কল্পনা থেকেই এত নিখুঁত চিত্র কোনও মানুষ আঁকতে পারে না। নরকের শয়তানের কাছে বিক্রি না হয়ে গেলে, এমন কল্পনাই বা কারও মাথায় আসে কী করে! আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না।

ক্যানভাসের খালি অংশে একটা পিন-গাঁথা কাগজের টুকরো বিশ্রীভাবে গুটিয়ে আছে। ওটা বোধহয় দৃশ্যপটের ছবি। যেগুলো পিকম্যান পার্থিব জগৎ থেকে ক্যামেরাবন্দি করে। এই নৃশংস দানবটার পটভূমিকা আঁকার জন্য হয়তো ওই ছবিটা ব্যবহার করবে। যে পটভূমিকা এখনকার চরিত্রের নৃশংসতাকে আরও দশগুণ বাড়িয়ে দেবে। আমি হাত বাড়িয়ে গোটানো ছবিটা খুলে দেখতে চাইলাম। হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম, পিকম্যান যেন মূর্তিবৎ স্থাণু হয়ে গেল। আমি খেয়াল করছিলাম, ওই অন্ধকার ঘরে আমার আর্তনাদ বিশ্রী প্রতিধ্বনি তোলার পর থেকেই সে যেন খুব মনোযোগ দিয়ে কী একটা শোনার চেষ্টা করছে। এখন আচমকাই মনে হল, তার মুখে যেন একটা ভয়ের ছায়া সরে গেল। না, ঠিক আমার মতো মারাত্মক আতঙ্কিত হল না সে, কিন্তু তারা সারা দেহে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। সে একটা রিভলভার টেনে বের করে, আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ঘরটা থেকে মেইন সেলারে বেরিয়ে গেল। দরজাটাও বন্ধ করে দিয়ে গেল।

কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল, আমার সারা শরীর বুঝি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। পিকম্যানের কান পেতে শোনা ভয়ার্ত ভঙ্গিমাটার কথা মনে পড়তেই, আমি যেন অস্পষ্টভাবে পাথরের ওপরে নখের ছরছর আওয়াজ শুনলাম। কে যেন দ্রুতবেগে ছুটে গেল। তারপরেই বিভিন্ন দিক থেকে খনখন, গোঁ গোঁ শব্দ উঠতে লাগল। কারা যেন পাথরের গায়ে নখ ঠুকে নালিশ জানাচ্ছে। মানুষখেকো ইঁদুরের দল নয় তো! আমি দেখেছি বিড়ালের থেকেও বড় বড় ইঁদুর। দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করে। দুর্বল অসহায় নিরস্ত্র মানুষ পেলে জীবিত খুবলে খেয়ে নেয়। আমি শিউরে উঠলাম। হঠাৎ একটা চাপা গুম শব্দে আমার ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেল। আমি যেন শুনলাম না, বরং অনেক বেশিভাবে অনুভব করলাম ওই অদ্ভুত চোরা শব্দটা। যদিও আমি জানি না, আমি কীভাবে ব্যাখ্যা করব শব্দটাকে। আমার মনে হল, বিশাল ভারী কিছু একটা এসে পড়ল পাথরের মেঝের ওপরে।

আবারও শব্দটা হল। এবার স্পষ্ট এবং আরও জোরে। এমনকী আমিও পায়ের তলার মেঝেতে কাঁপুনি অনুভব করতে পারলাম, যদিও শব্দটা আসছিল অনেকটা দূর থেকে।

গুমগুম শব্দটার সঙ্গে ক্রমে যোগ হল একটা তীক্ষ্ণ কর্কশ আওয়াজ। আমি স্পষ্ট শুনলাম, পিকম্যান হ্রীং ক্রীং জাতীয় আবোল-তাবোল কী সব আওড়াচ্ছে। তারপরেই কান-ফাটানো ছ-ছ-টা গুলির শব্দ। সার্কাসের রিংমাস্টার সিংহকে পোষ মানাতে যেমন ফাঁকা বাতাসে গুলি করে, সেইরকম ফাঁপা আওয়াজ শুনলাম বলেই মনে হল আমার। একটা দমচাপা কর্কশ চিৎকার শুনলাম, পরক্ষণেই দুম করে কী যেন একটা পড়ল। তারপরে সেই একই রকমের গুমগুম শব্দ, পাথরের দেওয়ালে নখ আঁচড়ানোর শব্দ। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পরে দরজাটা খুলে গেল, যেটার দিকে আমি উন্মাদের মতো তাকিয়ে ছিলাম। পিকম্যান ফিরে এল। হাতের রিভলভারের নল থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছিল। জাহান্নমের ইঁদুরের গুষ্টি বলে সে খিস্তি করল।

শয়তান জানে, হতচ্ছাড়াগুলো ওই গর্তে কী খায়! সে ভেংচি কেটে হাসল, এই সুড়ঙ্গগুলো হয়তো মাটির তলা দিয়ে কবরখানাটাকে ছুঁয়ে গেছে। সেইসব জায়গা থেকেই হয়তো ওইগুলো খাবার জোগাড় করে। তবে যা-ই হোক-না কেন, ওদের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। ওরা বেরিয়ে আসতে চাইছে মাটির ওপরে। তোমার চিৎকার ওদেরকে টেনে এনেছিল বলেই মনে হচ্ছে। এই সমস্ত প্রাচীন জায়গায় একটু সাবধানে থাকতে হয়। এই জাহান্নমের জীবগুলো একটা অসুবিধা তো বটেই। তবে আমার মনে হয়, ওদেরও এই পরিবেশকে তৈরি আর বৈচিত্র্যময় করার পিছনে যথেষ্ট অনুদান আছে। এ তো এক রকমের সম্পদই বটে।

হ্যাঁ। সেই রাত্রের বিভীষিকাপূর্ণ অভিযানের সেইখানেই সমাপ্তি, এলিয়ট। পিকম্যান আমার কাছে প্রতীজ্ঞা করেছিল যে, সে আমাকে জায়গাটা দেখাবে, আর সে কথাও রেখেছে। সে আমাকে সেই গোলকধাঁধার মতো গলির মধ্যে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। চার্টার স্ট্রিটে এসে আমি রাস্তাটা চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি মানসিকভাবে এতটাই অবশ হয়ে পড়েছিলাম যে, বুঝতেই পারিনি, কোথা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। তখন অনেকটাই রাত্রি হয়ে গিয়েছিল। কোনওরকম গাড়ি পাওয়ার জন্যে আমরা বস্তির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হ্যাঁনোভার স্ট্রিটে ফিরে এসেছিলাম। সেই হাঁটার কথা আমার মনে আছে। ট্রেমন্ট আপ বেকনে উঠে আসার পরে পিকম্যান আমাকে একটা কফি শপের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে যায়। ওখান থেকেই আমি একটা ক্যাব পাই। তারপরে আর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।

কেন? কেন আমি ওর সঙ্গ ত্যাগ করলুম? আহ্ অধৈর্য হোয়ো না। এক কাপ কফি বলো। অনেক কারণই ছিল, তবে একটাই কারণ যথেষ্ট ছিল। না, না– ওই ছবিগুলো নয়। হতে পারে, ছবিগুলো ভয়ংকর ছিল। অবশ্যই বোস্টনের কলাশিল্পের ক্লাব আর অন্যান্য মানুষজন ছবিগুলো দেখলেই তাকে একঘরে করতে দ্বিধা করত না। তবু আমি বলব, ওই ছবিগুলো না।

এতক্ষণে তুমি বোধহয় একটু একটু আন্দাজ করতে পারছ আমার কুসংস্কারের ব্যাপারটা। বুঝতে পারছ, আমি কেন অন্ধকার সাবওয়ে আর মাটির নীচে সেলার ঘরে যাওয়ার ব্যাপারে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছি।

আসলে পরের দিন সকালে আমি আমার কোটের পকেটে একটা দলা-পাকানো কাগজের টুকরো পাই। ওটা সেই গোটানো কাগজের টুকরোটা, যেটা ক্যানভাসের গায়ে পিন দিয়ে আটকানো ছিল। ওই যেটা আমি ভেবেছিলাম পটভূমি আঁকার জন্যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ক্যামেরায় তোলা ছবি। আমি ওটা খুলে হাতে নিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তারপরেই সেই ভয়ংকর ইঁদুরগুলোর মোকাবিলায় পিকম্যান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমিও উদ্‌বেগে-আতঙ্কে ছবিটা কখন যেন দলা পাকিয়ে কোটের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছি। মনেই ছিল না।

নাও, এক কাপ কফি খাও এলিয়ট। আহা, কড়া কালো কফিই খাও না-হয়। জানো না, ওটা স্নায়ুকে শক্তিশালী করে।

হ্যাঁ, ওই ছবিটাই, ওই ফোটোগ্রাফিটাই পিকম্যানের সঙ্গ ত্যাগ করার মূল হেতু। রিচার্ড আপটন পিকম্যান, আমার জ্ঞানত এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। ওইরকম বিকৃতমনস্করাই জাগতিক জীবন ছেড়ে অকাল্ট আর উন্মাদের গহ্বরে ঝাঁপ দিতে পারে। রেইড ঠিকই বলেছিল, পিকম্যান কখনওই পুরোপুরি মানুষ নয়। হয় সে কোনও অন্ধকার ছায়াময় জগতের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, অথবা সে খুলতে পেরেছে সেই জগতে যাওয়ার দরজাটা। অবশ্য এখন আর তাতে কিছু যায়-আসে না। সে চলে গেছে। যে ভয়ানক অন্ধকার জগৎকে সে ভালোবাসত, তলিয়ে গেছে তারই গহ্বরে।

উঁহু, জানতে চেয়ো না, আমি কী পুড়িয়ে দিয়েছি। এ-ও জিজ্ঞেস কোরো না, ওই অতিকায় জীবগুলো আদতে কী ছিল, যেগুলোকে পিকম্যান শুধুমাত্র ইঁদুর বলে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল। কিছু জিনিস রহস্য থাকাই ভালো। সেই প্রাচীন সালেমদের সময় থেকেই চলে আসছে এমন অনেক জিনিস। কটন মাথুরের গল্পেও তারা আছে। তুমি তো জানোই, পিকম্যানের ওই চিত্রগুলো কতটা জীবন্ত ছিল– আর আমরা সবাই অবাক হচ্ছিলাম যে, কোথা থেকে ওই পৈশাচিক মুখাকৃতি সে পেয়েছে।

আসলে, ওই ফোটোগ্রাফটা কোনও দৃশ্যপটের ছবি নয়। ওতে ছিল সেই নারকীয় জন্তুটা, যেটা আমি দেখেছিলাম মাটির নীচের ঘরে বিশাল ক্যানভাস জুড়ে। ওটা আসলে মডেলেরই ফোটোগ্রাফ। আঁকার সময় সে ব্যবহার করছিল। ওটার ব্যাকগ্রাউন্ডটা জাস্ট একটা ভাঁড়ারঘরের ইটের গাঁথনি, নিখুঁতভাবেই আঁকা। কিন্তু ফোটোগ্রাফটা আদতে ওই জীবটারই।

[প্রথম প্রকাশ: উইয়ার্ড টেলস পত্রিকায়, ১৯২৭ সালের অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় লেখাটি। ভাষান্তর: অঙ্কিতা]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *