২৫. নাটক : জীবনের দ্বন্দ্ব

নাটক : জীবনের দ্বন্দ্ব

বাঙলাদেশের চিরকালের নাটক যাত্রা’। নাটক বলতে আজ যা বোঝায়, তা আধুনিক কালের সৃষ্টি। যাত্রার সাথে নাটকের পার্থক্য অনেক। যাত্রা পুরোনো কালের, নাটক নতুন কালের। বাঙলা নাটকের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে এক বিদেশিকে। সেবিদেশির দেশ রাশিয়া; নাম তার গেরাসিম লেবেদেফ [১৭৪৯-১৮১৮]। নাটক আর জ্ঞানপাগল এ-লোকটি কলকাতা আসেন আঠারোশতকের শেষদিকে। তিনিই কলকাতায় সবার আগে মঞ্চস্থ করেন নাটক। তিনি “ডিসগাইস” নামে একটি প্রহসনের অনুবাদ মঞ্চস্থ করেন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁকে অনুসরণ করে এরপর এ-দেশে গড়ে ওঠে মঞ্চ, এবং লিখিত ও অভিনীত হতে থাকে নাটক।

কিন্তু প্রথম বাঙলা মৌলিক নাটক লিখিত হ’তে লেগেছিলো আরো অর্ধেক শতাব্দীরও বেশি সময়। ১৮৫২ সাল বাঙলা নাটকের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা। এ-বছরে লেখা হয় প্রথম বাঙলা মৌলিক নাটক। লেখা হয় কমেডি বা মিলনমধুর নাটক, লেখা হয় ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্ত নাটক। বাঙলা ভাষার প্রথম মৌলিক নাটকটির নাম ভদ্রার্জুন (১৮৫২), লিখেছিলেন তারাচরণ শিকদার। এটি একটি কমেডি। এ-নাটক প্রকাশের কিছুদিন পরে, এ-বছরই, প্রকাশিত হয় প্রথম ট্র্যাজেডি কীর্তিবিলাস (১৮৫২)। লিখেছিলেন যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত। দ্রার্জুন নাটকের কাহিনী নেয়া হয়েছিল মহাভারত থেকে। মহাভারতের গল্পে আছে অর্জুন কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে হরণ করে। সে-হরণের কাহিনী অবলম্বনে লেখা এটি। কীর্তিবিলাস-এর কাহিনী বেশ জটিল। পাঁচটি অঙ্কে নাট্যকার এক বেদনাঘন কাহিনী পরিবেশন করেছেন। ফরাশি ভাষায় একটি নাটক আছে, নাম তার ফায়েড্রা। এর কাহিনীর সাথে মিল আছে কীর্তিবিলাস নাটকের। এ-সময়ের আরেকজন নাট্যকার হরচন্দ্র ঘোষ (১৮১৭-১৮৮৪)। তিনি ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়রের কয়েকটি নাটকের কাহিনী অবলম্বনে বাঙলা ভাষায় লিখেছিলেন নাটক। তিনি মার্চেন্ট অফ ভেনিস-এর কাহিনী নিয়ে লেখেন ভানুমতী-চিত্তবিলাসনাটক (১৮৫৩), রোমিও-জুলিয়েট-এর গল্প নিয়ে লেখেন চারুমুখচিত্তহরা (১৮৬৪) নাটক। তাঁর আরো দুটি নাটক কৌরব বিয়োগ (১৮৫৮), রজতগিরিনন্দিনী (১৮৭৪)।

এ-সময় নাটক লিখে খুব নাম করেছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬)। রামনারায়ণ বিদেশি সাহিত্যের সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। চিন্তাভাবনায় ছিলেন একেবারে দেশি। তিনি লিখেছিলেন অনেকগুলো নাটক, সেগুলোতে নাটুকেপনা আছে ভীষণভাবে। তাই তখনকার লোকেরা রামায়ণকে বলতো নাটুকে রামনারায়ণ। তাঁর নাটকগুলো হচ্ছে কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪), বেনীসংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞানশকুন্তল (১৮৬০), মালতীমাধব (১৮৬৭), রুক্মিনীহরণ (১৮৭১), কংসবধ (১৮৭৫), ধর্মবিজয় (১৮৭৫), নবনাটক (১৮৬৬)। তার কয়েকটি প্রহসন হচ্ছে যেমন কর্ম তেমন ফল, উভয়সংকট, বুঝলে কিনা। কুলীনকুলসর্বস্ব তার শ্রেষ্ঠ নাটক। এ-নাটকটি রচনার এক চমৎকার ইতিহাস আছে। জমিদার কালীচন্দ্র রায়চৌধুরী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, কৌলীন্যপ্রথার অপকারিতা দেখিয়ে যিনি সবচেয়ে ভালো নাটক লিখতে পারবেন, তাঁকে তিনি পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার দেবেন। কৌলীন্যপ্রথার অপকারিতা দেখিয়ে রামনারায়ণ রচনা করেন কুলীনকুলসর্বস্ব এবং পান পুরস্কার। তিনি নবনাটক রচনা করেছিলেন বহুবিবাহের দোষ দেখিয়ে। এটিও পেয়েছিলো পুরস্কার। এ-সময়ের আরো কয়েকজন নাট্যকার হচ্ছেন উমেশচন্দ্র মিত্র, নন্দকুমার রায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ। উমেশ মিত্র বিধবাবিবাহের পক্ষে লেখেন বিধবাবিবাহনাটক (১৮৫৬), তাঁর অন্য নাটক হলো সীতার বনবাস নাটক (১২৭২)। নন্দকুমারের নাটকের নাম অভিজ্ঞানশকুন্তলা (১৮৫৫)। কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন সেকালের এক বিখ্যাত ব্যক্তি। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র তিরিশ বছর { ১৮৪০-১৮৭০)। তিনি রচনা করেছিলেন সাবিত্রী-সত্যবান (১৮৫৮), মালতীমাধব (১৮৫৯)। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মারা যান কালীপ্রসন্ন; আর বাঙলা সাহিত্য হারায় এক অসাধারণ প্রতিভাকে।

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আসেন বাঙলা নাটকের অমর পুরুষ মধুসূদন দত্ত। যেমন কবিতার ক্ষেত্রে তিনি এসেছিলেন সকলকে চমকিত করে এবং রাশিরাশি সোনার ফসল ফলিয়ে গিয়েছিলেন, নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি আসেন তেমনি করে। আসেন আর নাটকের সোনার ফসল ফলান। মধুসূদন বাঙলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন নাটক হাতে করেই। মধুসূদন অনেক কিছু করেছেন তীব্র ঝোঁকের বশে, অনেকটা বাজি ধরে। তার ছিলো অসামান্য প্রতিভা, তাই তিনি হঠাৎ করে দিগ্বিজয় করতে পেরেছেন। অন্যরা যা পারেন না অনেকদিন সাধনা করে, মধুসূদন তা করেন কলম হাতে নিয়েই। মধুসূদনের সময় নাটক লেখা হতো অনেক, এবং ভীষণ উৎসবের সাথে সেগুলো হতো অভিনীত। কিন্তু ও-সকল নাটককে তিনি মেনে নিতে পারেন নি নাটক বলে।

তাঁর চোখের সামনে ছিলো গ্রিক ও ইংরেজি মহৎ নাট্যসৃষ্টিগুলো। তিনি তখনকার বাঙলা নাটকের দীনতায় দুঃখ বোধ করতেন। ১৮৫৮ সালে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় মহাআড়ম্বরে অভিনীত হয় রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী। মধুসূদন দেখেন সেনাট্যাভিনয়। ওই নাটক দেখে অনেকটা উপহাস করেন তিনি। প্রতিজ্ঞা করেন অল্পকালের মধ্যে তিনি লিখে দেবেন সত্যিকার নাটক। লিখেও ফেলেন একটি নাটক, নাম তার শর্মিষ্ঠা। এটি বের হয় ১৮৫৯ অব্দে। এটি বাঙলা ভাষায় সত্যিকারের প্রথম আধুনিক নাটক। কাহিনীবিন্যাস, অঙ্ক ও দৃশ্যসজ্জা, ভাষা, নাটকীয়তা, সব মিলে এটি বাঙলা ভাষার প্রথম খাঁটি নাটক। মধুসূদন শর্মিষ্ঠা নাটকের শুরুতে সেকালের নাটকের গ্রাম্যতায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন :

অলীক কুনাট্যরঙ্গে          মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।

বাঙলা নাটককে কুনাটকের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন মধুসূদন; তবে বাঙলার মঞ্চ আজো কুনাটকেরই দখলে।

মধুসূদন শর্মিষ্ঠা নাটকের কাহিনী নিয়েছিলেন মহাভারত থেকে। মহাভারতে যযাতি ও শর্মিষ্ঠার কাহিনী রয়েছে। মধুসূদন সে-পুরানো গল্পকে নতুন কালের মতো করে পরিবেশন করেন। নাটকটি মিলনমধুর। এরপরে মধুসূদন লেখেন দুটি প্রহসন : একেই কি বলে সভ্যতা?, ও বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ। প্রথম প্রহসনটিতে মধুসূদন বিদ্রুপের আঘাত করেন। সেকালের বিপথগামী তরুণদের এবং দ্বিতীয়টিতে আঘাত করেন ভীমরতিগ্রস্ত বুড়োদের। তখন বাঙলা ভাষায় প্রচলিত ছিলো মোটা রসিকতা। প্রহসন দুটিতে মধুসূদন রসিকতাকে করে তোলেন আধুনিক রুচিসম্মত।

১৮৬০-এ বেরোয় মধুসূদনের দ্বিতীয়, অভিনব, নাটক পদ্মবতী। তিনি শর্মিষ্ঠা নাটকের কাহিনী নিয়েছিলেন মহাভারত থেকে, পদ্মাবতীর কাহিনী নেন গ্রিক উপকথা থেকে। গ্রিক উপকথায় প্যারিসের বিচার’ নামে একটি গল্প আছে। গল্পটি চমৎকার। দেবী ডিসকর্ডিয়া তৈরি করে একটি সোনার আপেল। তার উদ্দেশ্য ভালো ছিলো না, সে চেয়েছিলো জুননা, প্যালাস এবং ভেনাস নামক তিন দেবীর মধ্যে বিরোধ বাধাতে। সে ওই আপেলটির গায়ে যে দেবী সবচেয়ে রূপসী সে পাবে এ-আপেল’ কথাটি লিখে আপেলটি ফেলে দেয় জুনো, প্যালাস এবং ভেনাসের সামনে। তিনজনই নিজেকে রূপসী ভাবে এবং কামনা করে আপেলটি। তাই তারা বিচারক মানে রাজপুত্র প্যারিসকে। তারা বলে, আপনি যাকে সবচেয়ে রূপসী বিবেচনা করেন, তাকে দিন এ-আপেলটি। প্যারিসকে একেক দেবী একেক লোভ দেখায়। প্যারিস সেকে দেয় আপেলটি। এ-নিয়ে পরে প্যারিস জড়িয়ে পড়েছিলো মহাসংকটে, সে-সংকটের কাহিনী আছে হোমারের ইলিয়াড কাব্যে। মধুসূদন এ-গ্রিক গল্পকে ভারতীয় রূপ দিয়ে লেখেন “পদ্মাবতী”।

তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারীনাটক। এটি তিনি লিখেছিলেন ১৮৬০-এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে, আর এটি প্রকাশিত হয় ১৮৬১ অব্দে। এটি এক মর্মস্পর্শী ট্র্যাজেডি। উদয়পুরের রাজকন্যা কৃষ্ণকুমারীর জীবনের করুণ পরিণতি এর বিষয়। মধুসূদন এনাটকের কাহিনীর বীজ পেয়েছিলেন টডের লেখা রাজস্থানের কাহিনী গ্রন্থে। মধুসূদন এনাটকে পাশ্চাত্য ট্র্যাজেডির আদর্শ পুরোপুরি কাজে লাগান। এর কাহিনী এমন : উদয়পুরের রাজকন্যা কৃষ্ণকুমারী অপরূপ রূপসী। তার পিতা ভীমসিংহ। রাজ্য হিশেবে উদয়পুর দুর্বল। জয়পুরের রাজা জয়সিংহ কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে মরুদেশের রাজা মানসিংহও দেয় কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ের প্রস্তাব। তারা দুজনই উপযুক্ত। ভীমসিংহ জয়সিংহের সাথে বিয়ে দিতে চায় কৃষ্ণাকে। কিন্তু কৃষ্ণা অনুরাগী মানসিংহের। রাজা পড়ে বিপদে; সে কাকে দান করবে কন্যা? একজনকে দিলে আরেকজন আক্রমণ করবে রাজ্য। চারদিক থেকে আক্রান্ত হয় ভীমসিংহের দুর্বল রাজ্য উদয়পুর। রাজ্যরক্ষার এক ভয়াবহ প্রস্তাব রাজাকে দেয় মন্ত্রী। তা হচ্ছে যদি কৃষ্ণাকে হত্যা করা হয় তবে আর কোনো বিপদ থাকবে না। রাজা তাতে রাজি হয়। সেনাপতি বলেন্দ্ৰসিংহের ওপর ভার পড়ে কৃষ্ণকুমারীকে হত্যার। বলেন্দ্র হত্যা করতে গিয়ে নিজের আবেগে ব্যর্থ হয়; কিন্তু কৃষ্ণা নিজে বুকে তরবারি বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করে। এ-কাহিনীকে এক বেদনাকরুণ রূপ দিয়েছেন মধুসূদন তাঁর নাটকে। কাহিনী যতোই এগিয়ে যায়, আমরা ততই এগিয়ে যাই বিষাদময় পরিণতির দিকে। নিজের ভাগ্যের জন্যে বিন্দুমাত্র দায়ী ছিলো না কৃষ্ণা। মধুসূদন তাকে এঁকেছেন সহজ সরল আকর্ষণীয় করে। তার মতো নিস্পাপ মেয়ে যে এরকম। পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়াবে, তা নিয়তি ছাড়া আর কে বলতে পারে! তবে আমরা আর নিয়তিতে বিশ্বাস করি না। মধুসূদন এরপরে লিখেছিলেন আরেকটি নাটক; নাম মায়াকানন (১৮৭৪)। এটি বের হয় তাঁর মৃত্যুর পরে।

মধুসূদনের সাথেসাথে একজন দুঃসাহসী প্রতিভাবান নাট্যকার আসেন বাঙলা নাটকের ক্ষেত্রে। তিনি দীনবন্ধু মিত্র [১৮৩০-১৮৭৩)। তিনি অল্পায়ু ছিলেন, কিন্তু লিখেছিলেন। অনেকগুলো নাটক। তাঁর প্রথম নাটকটি আলোড়ন জাগায় দারুণভাবে। দীনবন্ধু মিত্র জন্মগ্রহণ করেন নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। তাঁর পিতৃদত্ত নাম গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র। দীনবন্ধু ডাকবিভাগে চাকুরি করতেন। কিন্তু সরকারি চাকুরি তাঁকে ভীত করতে পারে নি। তাঁর প্রথম নাটকের নাম নীলদর্পৰ্ণনাটক। নাটকটি বেরোয় ১৮৬০-এ। প্রকাশের সাথে সাথে এটি সাহিত্য এবং সমাজে জাগায় আলোড়ন। এটি এক বিপ্লবী রচনা। তখন বাঙলার গ্রামে গ্রামে নীলকরদের অত্যাচার চরমে উঠেছিলো। নীলকরদের অত্যাচার তিনি তুলে ধরেন এ-নাটকে। নাটকটি প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। তখন নাটকে নাট্যকারের নাম ছিলো না, তিনি গোপন করেন নিজের নাম। এ-নাটকে তিনি নীলকরদের অত্যাচারে একটি পরিবারের ধ্বংসের কাহিনী বলেন। সেপরিবারটি নবীনমাধবদের। দীনবন্ধু তীব্র আবেগ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর নাটকে। নাটক হিশেবে এটি অসাধারণ হয়তো নয়, কিন্তু সামাজিক কারণে এটিকে অসাধারণ বলতে হয়। এ-নাটকে মৃত্যু ও বিলাপের বাড়াবাড়ি আছে, নাট্যগুণও সব অঙ্কে রক্ষা পায় নি। তবু নাটকটি একটি মহৎ সৃষ্টি। এটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন পাদ্রি লং এবং মধুসূদন। দীনবন্ধু মিত্রের অন্যান্য নাটক নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩), সধবার একাদশী (১৮৬৬), বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬), লীলাবতী (১৮৬৭), জামাই বারিক (১৮৭২), কমলে-কামিনী (১৮৭৩)। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সধবার একাদশী। এ-নাটকে নিমচাঁদ নামক এক শিক্ষিত অথচ পতিত তরুণের বেদনাকে তুলে ধরা হয়েছে। নিমচাদের মেজাজ দেখে অনেকে মনে করেন এ-নাটকে তিনি নিমচাঁদের ছদ্মবেশে মধুসূদনের কথা বলেছেন।

দীনবন্ধুর পরে আসেন মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২)। তিনি লেখেন রামের অধিবাস ও বনবাস (১৮৬৭), প্রণয় পরীক্ষা (১৮৬৯), সতী (১৮৭৩), হরিশচন্দ্র (১৮৭৫), ইত্যাদি নাটক। এ-সময়ে আসেন আরো অনেক নাট্যকার। তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন লেখেন বসন্তকুমারী (১৮৭৩), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩); মণিমোহন সরকার লেখেন মহাশ্বেতা (১২৬৬); হরিশচন্দ্র মিত্র লেখেন মাও ধরবে কে?(১৮৬২)।

উনিশশতকের শেষাংশে মঞ্চ আলোকিত করেছিলেন অনেক নাট্যকার। তারা সবাই নাটককে এগিয়ে দিয়েছেন। সকলের কথা বলবো না, শুধু উল্লেখ করবো কয়েকজন প্রধান নাট্যকারকে। তাঁরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), গিরিশচন্দ্র ঘোষ [১৮৪৪-১৯১২], অমৃতলাল বসু (১৮৫৩-১৯২৯), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৪-১৯২৭)।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন নানা গুণে গুণী; তীব্র দেশপ্রেমিক। তিনি রবীন্দ্রনাথের বড়ো ভাই। রবীন্দ্রনাথের ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রভাব অনেক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গান গাইতেন, নাটক লিখতেন, দেশোদ্ধারের স্বপ্ন দেখতেন, বাঙালি জাতীয়তার বিকাশ সাধন করতে চাইতেন। তিনি রচনা করেছিলেন অনেকগুলো নাটক ও প্রহসন। তাঁর রচনা ছিলো মঞ্চসফল। তিনি প্রথমে রচনা করেন একটি প্রহসন, নাম কিঞ্চিৎ জলযোগ (১৮৭২)। এটিতে তিনি বিদ্রুপ করেন নব্যব্রাহ্মদের অর্থাৎ তাদের, যারা ছিলো কেশবচন্দ্র সেনের অনুসারী। তাঁর আরেকটি প্রহসন হলো অলীক বাবু (১৮৭৭)। এটির নায়ক বাবু অলীকপ্রকাশ মিথ্যে কথাকে শিল্পকলায় পরিণত করেছিলো। বেশ মজার বই এটি। তাঁর কয়েকটি নাটক হচ্ছে পুরুবিক্রম (১৮৭৪), সরোজিনী (১৮৭৫), অমতি (১৮৭৯), স্বপ্নময়ী (১৮৮২)। এছাড়া তিনি অনুবাদ করেছিলেন অনেকগুলো নাটক; ইংরেজি থেকে, ফরাশি থেকে, সংস্কৃত থেকে। ইংরেজি ও ফরাশি থেকে তিনি অনুবাদ করেন রজতগিরি (১৩১০), হঠাৎ নবাব (১৮৮৪), দায়ে পড়ে দারাহ (১৩০৯)। সংস্কৃত থেকে তিনি অনুবাদ করেছিলেন অনেক নাটক। তার কয়েকটি হচ্ছে অভিজ্ঞানশকুন্তল, উত্তরচরিত, মালতীমাধব, মুদ্রারাক্ষস, মৃচ্ছকটিক।।

গিরিশচন্দ্র ছিলেন নট ও নাট্যকার। তিনি লিখেছিলেন পঁচাত্তরটি নাটক; বাঙলাদেশে এতো নাটক আর কোনো নাট্যকার লেখেন নি। তাঁর নাটক শিল্পমূল্যে খুব উচ্চ নয়, তাঁর অধিকাংশ নাটকই মধুসূদনের ভাষায় কুনাট্য’, তবে দর্শকেরা মজেছিলো এগুলোতে। তাঁর কয়েকটি নাটক আনন্দ রহো (১২৮৮), চৈতন্যলীলা, প্রফুল্ল (১৮৯১), হারানিধি (১৮৯০), জনা (১৮৯৩)। তিনি শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ অনুবাদ করেছিলেন। তিনি দেশপ্রেমমূলক নাটক লিখেছিলেন সিরাজদ্দৌলা, মীরকাশিম, ছত্রপতি শিবাজি। অমৃতলাল বসুও ছিলেন অভিনেতা ও নাট্যকার। তিনি অনেকগুলো প্রহসন রচনা করেছেন। তাঁর নাটক ও প্রহসন হচ্ছে হীরকচূর্ণ (১৮৭৫), তরুবালা (১২৯৭), চোরের উপর বাটপারি (১২৮৩), ডিসমিস, তাজ্জব ব্যাপার। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন নাটক ও প্রহসন। তিনি বাঙলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারদের একজন। তাঁর নাটক ও প্রহসন হলো কল্কি অবতার (১৮৯৫), বিরহ (১৮৯৭), তারাবাই (১৯০৩), প্রতাপসিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৬), নূরজাহান (১৯০৮), মেবার পতন (১৯০৮), শাজাহান (১৯০৯), চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১)। তাঁর নাটকে রয়েছে অনেক স্মরণীয় সংলাপ, যেগুলো একসময় মুখেমুখে ফিরতো। চন্দ্রগুপ্ত নাটকে আছে কি বিচিত্র এই দেশ। ক্ষীরোদপ্রসাদ লিখেছিলেন চল্লিশটির মতো নাটক। তাঁর দুটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক প্রতাপ-আদিত্য (১৯০৩), ও আলমগীর (১৯২১)। তিনি বিশেষ জনপ্রিয় আলিবাবা (১৮৯৭) নাটকের জন্যে। উনিশ ও বিশশতকে বাঙলা ভাষায় অসংখ্য নাটক’ লেখা হয়েছে, তার মধ্য থেকে মধূসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর নাটকগুলো বাদ দিলে যা থাকে, তার শিল্পমূল্য খুবই কম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *