মূষিক আতঙ্ক

মূষিক আতঙ্ক (THE RATS IN THE WALLS)

[লাভক্র্যাফটের অন্যতম বিতর্কিত গল্প যেখানে কথক নিজের বংশ পরিচয় খুঁজতে গিয়ে প্রধান চরিত্রটি এক ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হয়। গল্পটিতে লাভক্র্যাফট নিউ ইংল্যান্ডের নানা রকম অতিকথার সঙ্গে বংশগতি ও সেই কারণজনিত বিকৃতির সম্পর্কে নিজের ধারণার কথা বলেছেন। মনে করা হয় গল্পের কথক ও তার বংশের জাতিবিদ্বেষ আসলে লাভক্র্যাফটের নিজের মনের কথাই বলে। গল্পটির বর্ণনা অত্যন্ত ভয়ংকর বলে লাভক্র্যাফটের নিজেরই দ্বিধা ছিল পাঠকেরা এটি পড়তে পারবে কি না।]

শেষ মিস্ত্রিটা কাজ খতম করে যে দিন বিদায় নিল, ১৯২৩ সালের সেই ১৬ জুলাই আমি এক্সাম প্রায়োরিতে পাকাপাকিভাবে প্রবেশ করলাম। পুরো অট্টালিকাই প্রায় নতুন করে সংস্কার করতে হয়েছিল। একটু শামুকের খোলার মতো ধ্বংসস্তূপ ছাড়া বাড়িটার বিশেষ কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। কাজটা কিন্তু বেশ ঝক্কির গেল ক-দিন। তবুও হাজার হোক, পূর্বপুরুষের ভিটে বলে কথা– তাই অর্থের ব্যাপারে কোনওরকম কার্পণ্য করিনি আমি। প্রথম জেমসের আমল থেকেই এই বাড়িতে কেউ বাস করে না। দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত থাকার পেছনে নাকি এক রহস্যময় ঘটনা দায়ী, যার কোনওরকম যুক্তিসংগত ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। শোনা যায়, এই বাড়ির ভূতপূর্ব মালিকের সঙ্গে এক রহস্যময় পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলস্বরূপ শুধু এই বাড়ির মালিকই নন, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে এবং সঙ্গে চাকরবাকরগুলো অবধি সেই ভয়ানক ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। একটু ভুল বললাম, একমাত্র তাঁর তৃতীয় সন্তানটিই সেই বীভৎস ঘটনার নাগপাশ কেটে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। ভাগ্যচক্রে তিনিই আমার পূর্বপুরুষ।

এই নারকীয় হত্যালীলার দায় খুব স্বাভাবিকভাবেই এই তৃতীয় সন্তানের ওপর বর্তায়। কিন্তু দুভার্গ্যক্রমে, তাঁর পক্ষে সাক্ষী দেবার মতোও কেউই বেঁচে ছিলেন না। পিতৃহত্যার দায় মাথায় নিয়ে তিনি তাঁর নিজের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন, এবং আইনানুসারে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তৎকালীন রাজাবাহাদুর বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই ঘটনার বহু দিন পরেও ইনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার না কোনও উৎসাহ দেখিয়েছেন, না তাঁর হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন। উলটে সদা সর্বদাই চেষ্টা করে গেছেন কোনও এক ভয়ংকর স্মৃতিকে এবং এই অভিশপ্ত বসতবাড়িকে তাঁর মন এবং দৃষ্টিসীমানার বাইরে রাখতে। মনে হয়, আইনের চোখরাঙানির চেয়েও অজানা কোনও এক প্রচণ্ড আতঙ্কের প্রভাব তাঁর ওপর প্রবল ছিল।

এই ভদ্রলোকের পোশাকি নাম, ওয়াল্টার ডে লা পোর। ইনিই এককালে এক্সাম অঞ্চলের এগারোতম ব্যারন এবং আমার প্রপিতামহ। শুনেছি, ওই ঘটনার পর গোপনে ইনি ভার্জিনিয়াতে পালিয়ে আসেন এবং অতীত দুঃস্বপ্নকে পেছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মই পরের শতাব্দীতে ডেলপোর বংশ নামে পরিচিতি লাভ করে।

এক্সাম প্রায়োরি কিন্তু এই পুরোটা সময় খালিই পড়ে ছিল যদিও পরবর্তীকালে এটিকে নরিস পরিবারের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। অট্টালিকাটির গঠনের মধ্যে বহু পুরাতন এক মিশ্র স্থাপত্যরীতি লক্ষ করা যায়। সে জন্য, কেউ বসবাস না করলেও অনেকদিন ধরে এটা রিসার্চের এবং তদুপরি অ্যাকাডেমিক আগ্রহের একটা বিষয়বস্তু ছিল। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই বাড়ির গথিক ঘরানার বড় বড় উঁচু মিনার, বাড়ির নীচের দিকে স্যাক্সন বা রোমানিয়ান টাইপের গঠন, তার ওপর ড্রুইডিক এবং সিমরিক স্থাপত্যের মিশ্রণে তৈরি এর ভিত যেন একে মহাকালের স্রোতে অটুট দণ্ডায়মান এক সুপ্রাচীন ও স্থবির প্রস্তরখণ্ডের রূপ দিয়েছিল। প্রায়োরির নীচের অংশটি একভাবে সোজা উঠে গিয়ে মিশে গেছে কঠিন চুনাপাথরের তৈরি এক উঁচু বাঁধের সঙ্গে যার মাথায় উঠলে অদূরের অ্যানচেস্টার গ্রামটির তিন মাইল পশ্চিমে বিস্তৃত ভগ্ন উপত্যকাটি পুরোপুরি দেখা যায়। স্থপতি এবং প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুব আগ্রহের সঙ্গে শতাব্দীপ্রাচীন এই ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে দেখতে চাইবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু এখানকার মানুষজন কেন জানি না জায়গাটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেন না। একশো বছর আগে আমার পূর্বপুরুষরা যখন এখানে বাস করতেন, তখনও লোকজন এটিকে এড়িয়েই চলত। আর এখন তো শ্যাওলা আর অবহেলার অন্ধকার জায়গাটার ওপর একটা বিষাদ-ছায়ার মতো নেমে এসে আশপাশের লোকজনদের কাছে একে আরও ভীতিপ্রদ করে তুলেছে। তাই পারতপক্ষে কেউ এদিক বিশেষ মাড়ায় না। অ্যানচেস্টারে এসেছি একদিনও হয়নি, এরই মধ্যে জেনে গিয়েছিলাম যে, আমি এক অভিশপ্ত ইমারতের সন্নিকটে উপস্থিত হয়েছি। এসবের মাঝে, সপ্তাহের শুরুতেই মিস্ত্রি লাগিয়ে পুরোদমে এক্সাম প্রায়োরি সংস্কারের কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম আর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এই অট্টালিকার সঙ্গে জুড়ে-থাকা শতাব্দীপ্রাচীন প্রবাদের ভিত্তিকে সমূলে উচ্ছেদ করতে।

আমার পরিবারের অতীত ইতিহাস বেশ অদ্ভুত। যে রহস্য নিয়ে আমার পূর্বপুরুষ সুদূর অ্যানচেস্টার থেকে ভার্জিনিয়ার কলোনিতে এসে নতুনভাবে জীবন শুরু করেন, সে ব্যাপারে ডেলাপোর বংশ কিন্তু নিশ্চিদ্র মন্ত্রগুপ্তি বজায় রেখে চলেছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই রহস্যের বিশেষ কিছুমাত্র উদ্ধার করে উঠতে পারিনি। আমাদের পাড়া প্রতিবেশীদের মতো আমরা কিন্তু নিজেদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করা বা বহু বছর আগে তাদের নায়কোচিত কার্যকলাপের বিবরণ দিয়ে ছাতি দশ হাত করে ফেলার মতো কিছুই করিনি, বরং নিজেদের পরিবারের ইতিহাসের বিষয়ে বিশেষ কিছু না-জানার জন্য চুপ করে থাকতে হয়েছে অধিকাংশ সময়েই। বংশানুক্রমে কিছু সংস্কার, আদবকায়দা বা আচার-বিচার ইত্যাদি আদিপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষের ওপর হস্তান্তরিত হয়, কিন্তু সেখানেও ভাঁড়ে মা ভবানী! কেবল আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বাধার সময়ে, আমার পূর্বপুরুষ সেই রহস্যময় ভদ্রলোক, একটি মুখবন্ধ খামে কিছু লিখে তাঁর বড় ছেলের হাতে সঁপে দিয়ে যান এবং নির্দেশ দেন, খামের মুখ যেন তাঁর মৃত্যুর পরেই খোলা হয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের বংশের গৌরবের সূচনাই ঘটেছে, আমার পূর্বপুরুষের এই দেশান্তরকরণের পর থেকেই। তবে এটা ঠিক যে, পরবর্তীকালে এক সম্মানজনক বংশের মর্যাদা আমরা লাভ করেছিলাম, তবুও সবাইকে এড়িয়ে চলার মতো অসামাজিকতা এবং তদুপরি চাপা স্বভাবটা যেন আমাদের বংশের রক্তের মধ্যে ভীষণভাবে ঢুকে গিয়েছিল যতই তাতে ভার্জিনীয় মিশ্রণ থাকুক না কেন।

যা-ই হোক, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ভাগ্যদেবতা আরও একবার আমাদের ওপর বিমুখ হলেন। কারফ্যাক্স পতনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বসংকট দেখা দিল। আমাদের বাড়িটা ছিল জেমস নদীর ধারেই। উন্মত্ত জনতা যখন সেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন সেখানে আমার দাদু উপস্থিত ছিলেন। সেই ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের তিনি বলি হন, আর সেই সঙ্গে তাঁর বাবার দেওয়া বিশেষ খামটি, যা ছিল আমাদের পরিবারের রহস্যময় অতীতের এক চরম গোপনীয় দলিল সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। আজ, এত দিন পরেও সেই দিনটির কথা আমার স্মৃতিতে দগদগ করছে। তখন আমার সাত বছর বয়স। পুলিশের চিৎকার, মহিলাদের বিলাপ, নিগ্রোদের বুকফাটা আর্তি– সব মিলিয়ে সে রাতটা আমার মন থেকে কোনও দিনই মুছে যাবার নয়। আমার বাবা তখন মিলিটারিতে, রিচমন্ডের হয়ে লড়ছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি আর মা শেষ পর্যন্ত বাবার সঙ্গে যোগ দিতে পেরেছিলাম। যুদ্ধ শেষ হবার পর আমরা সপরিবারে উত্তরের দিকে যাত্রা করি। এভাবেই ধীরে ধীরে আমি বড় হলাম, মধ্যবয়সে পৌঁছোলাম, এবং শেষ পর্যন্ত এক কর্তব্যপরায়ণ ইয়াঙ্কিতে পরিণত হলাম। যদিও আমার বাবা, আমি– কেউই জানতে পারিনি যে, সেই খামের মধ্যে কী লেখা ছিল।

ম্যাসাচুসেটসে ফিরে আমি নিজের ব্যাবসার ব্যস্ততায় ডুবে গেলাম, আর রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে প্রতিদিন মোলাকাতের ফলে, সুদূর অতীতে কোনও একসময়ে আমার পরিবারের এক প্রাচীন রহস্যের প্রতি আগ্রহ আমার মন থেকে ক্রমশ হারিয়ে গেল। যদি সেই সময় কোনওভাবেও আন্দাজ করতে পারতাম!! তাহলে এক্সাম প্রায়োরিকে এরকম ইঁদুর বাদুড়ের আস্তানাই থাকতে দিতাম জীবনে কোনও দিনই এই অভিশপ্ত এলাকায় পা রাখতাম না।

১৯০৪ সালে আমার বাবা মারা গেলেন। না, আমার জন্য না, আমার মা-হারা ছেলে অ্যালফ্রেডের জন্য, আমাদের পরিবারের এই প্রাচীন রহস্যের ওপর তিনি কোনও সূত্রই রেখে গেলেন না। আমার ছেলেই কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের প্রায় বিস্মৃত পরিবারের আদি ইতিহাস ঘেঁটে বের করেছিল। আমি ওকে বানিয়ে বানিয়ে কিছু গল্প বলেছিলাম বটে ওর ছোটবেলায়, তবে সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল আমার কল্পনা। ১৯১৭ সালে আমার ছেলে এভিয়েশন অফিসার হয়ে লন্ডনে যায়। আর সেখান থেকে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে খুব আশ্চর্যজনক কিছু খবর আমাকে লিখে পাঠিয়েছিল। পড়ে জানতে পারলাম, ডেলাপোরদের জীবন একসময় যেমন বর্ণময়, ঠিক ততখানিই অভিশপ্ত ছিল। আরও জানলাম, আমার ছেলের এক বন্ধু, ক্যাপটেন নরিস, আমাদের পুরোনো ভিটের নিকটবর্তী গ্রাম অ্যানচেস্টারের বাসিন্দা। তার থেকেই এসব খবরের সন্ধান পেয়েছে। অ্যালফ্রেড। তা ছাড়া সে নরিসের গ্রামের বাড়িতে গিয়েও থেকেছে। সেখানে আমাদের আদি পরিবারের ব্যাপারে গ্রাম্য লোকমুখে যা কুসংস্কার এবং কিংবদন্তি যুগযুগান্তর ধরে ছড়িয়েছে, সেটা বড় বড় লেখকের গল্প-উপন্যাসকেও হার মানাবে। যদিও নরিস নিজেও এসব গালগল্পের খুব কমই বিশ্বাস করে, তবুও এই গল্পগুলি আমার ছেলে অ্যালফ্রেডের কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক লেগিয়েছিল, সন্দেহ নেই। বলতে দ্বিধা নেই, এই জনশ্রুতিগুলিই কিন্তু সুদূর অতলান্তিক পারের পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। অ্যালফ্রেড লিখেছিল যে, নরিসের কাকাই এখন ওই সম্পত্তির মালিক। আমার ছেলের পরিচয় জেনে তিনি খুব কম দামে ওই জমি-বাড়ি আমাকে বিক্রি করে দিতে রাজি হলেন। অদম্য কৌতূহলে, আমিও নরিস ছেলেটির সাহায্যে আমাদের হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হলাম।

১৯১৮ সালে এক্সাম প্রায়োরি আমি কিনে নিলাম। কিন্তু সংস্কারের কাজে নামা তখনই সম্ভব হল না। যুদ্ধ থেকে আমার ছেলে পঙ্গু হয়ে ফিরে এল, আর আমার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হল আমার ছেলের শুশ্রূষার ব্যাপারে। পরবর্তী যে দুটি বছর অ্যালফ্রেড বেঁচে ছিল, আমি ওর সেবা ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। নিজের ব্যাবসার কাজও আমার পার্টনারদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আলফ্রেড মারা যাবার বছরখানেক পর, ১৯২১ সাল নাগাদ, নিজেকে এতটাই রিক্ত এবং লক্ষ্যহীন মনে হতে লাগল, যে সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে নতুন-কেনা সম্পত্তির সঙ্গে সময় কাটানোই মনস্থ করলাম। মনে হল, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হয়তো এই চরম একাকিত্ব আর দুঃখ ভুলে থাকা যাবে।

অ্যানচেস্টারে এসে উপস্থিত হলাম ডিসেম্বর নাগাদ। ক্যাপটেন নরিস আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। গোলগাল, হাসিখুশি একটি ছেলে, সারাদিন অ্যালফ্রেডের কথাই বলতে থাকতেন। দেখলাম, বেশ আগে থেকেই দুই বন্ধু মিলে এই জায়গাটির ব্যাপারে অনেক তথ্য, নানা আশ্চর্য জনশ্রুতির সম্ভার আর প্ল্যান জোগাড় করে রেখেছে যেগুলো আমাকে এই অট্টালিকার সংস্কারসাধনে প্রচুর সহায়তা করবে। এক্সাম প্রায়োরিকে আমি এবার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখলাম ভাঙাচোরা, মধ্যযুগীয় ধ্বংসস্তূপের গাদা জঞ্জালের মধ্যে অশ্বত্থা, ফার্ন গজিয়েছে। জায়গায় জায়গায় মৌচাক আর ঘুঘুর বাসা বিপজ্জনকভাবে এদিক-সেদিক থেকে ঝুলে আছে। ঘরের মেঝে এবং আসবাবের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। স্থানে স্থানে পাথর উঠে গিয়ে।

কয়েকদিন ভালো করে সরেজমিনে পরীক্ষা করার পর, প্রায় তিন শতাব্দী আগে জায়গাটা কীরকম ছিল, সে ব্যাপারে একটা ধারণা মোটামুটি স্পষ্ট হল। সেইভাবে হিসেব কষে আমি সংস্কারে নামলাম। মিস্ত্রি, শ্রমিক জোগাড় করা শুরু করলাম। প্রত্যেকটি কাজের ব্যাপারে আমাকে লোকালয়ের বাইরে যেতে হচ্ছিল, কারণ অ্যানচেস্টারের লোকজনদের মধ্যে দেখলাম জায়গাটার প্রতি এক অপরিসীম ভীতি এবং অবিশ্বাস্য ঘৃণা এখনও বর্তমান। এই আবেগটা এতই তীব্র ছিল, যে মাঝে মাঝে বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয়ে পড়ত আর যত রাজ্যের গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটত। যত কুসংস্কার আর গুজব শুনতাম, সবই কিন্তু এই বাড়িটা এবং তাতে একদা বসবাসকারী আমার পূর্বপুরুষদের ঘিরেই।

আমার ছেলে একসময় আমাকে বলেছিল, যে, সে যখনই এখানে আসত, ডেলাপোর পরিচয় জেনে সবাই তাকে নাকি কেমন এড়িয়ে চলত। এহ বাহ্য– আমাকে তো এখানে প্রায় একঘরে করে দিয়েছিল লোকজন। আমি অতিকষ্টে ব্যাটাদের বিনীতভাবে বুঝিয়েছিলাম যে, আমি প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটতে আসিনি, কেননা সেসব ব্যাপারে আমার জ্ঞান ও মানসিকতা দুটোই অপর্যাপ্ত। আমি প্রবাসী, নেহাত পড়ে-পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো পূর্বপুরুষদের জমি-জায়গা হাতে এসেছে, তাই সংস্কার করে নিচ্ছি। দিনকাল যা পড়ছে– এরকম একটা জমকালো সম্পত্তি হাতছাড়া করা উচিত হবে না ইত্যাদি। এসব বোঝানোর পরও ওরা খুব যে আমাকে বিশ্বাস করেছে তা নয়– থেকে থেকেই সন্দেহের চোখে দ্যাখে। তাই যা কিছু জোগাড়পাতি করতে হয়েছে, সবই নরিসের মধ্যস্থতায়। পরে বুঝেছিলাম ওদের রাগের কারণ অন্য। আমি এমন এক স্থান সংস্কার করতে এসেছি, যেটার থেকে বেশি অভিশপ্ত এবং বিভীষিকাময় স্থান ওদের কাছে ও তল্লাটে কিছু নেই। পিশাচ এবং রক্তপায়ী শ্বাপদের বিচরণভূমি হিসাবেই ওরা জায়গাটাকে দেখে এসেছে এতদিন দূরে থেকেছে অপরিমিত ঘৃণা এবং আতঙ্কে।

বাড়িটা সম্বন্ধে যেসব গ্রাম্য গল্প বা কিংবদন্তি নরিস জোগাড় করে রেখেছিল, সেগুলোকে নিয়ে বসলাম। গল্পগুলোকে জুড়ে জুড়ে আর সেই সঙ্গে এই ধ্বংসস্তূপের ওপর নানা প্রামাণ্য লেখায় চোখ বুলিয়ে একটা থিয়োরি খাড়া করলাম। আমার যুক্তি অনুযায়ী, এখন যেখানে এক্সাম প্রায়োরি অবস্থান করছে, বহু শতাব্দী পূর্বে সেখানে একটা প্রাগৈতিহাসিক মন্দির ছিল। মন্দিরের বয়স বোধ করি স্টোনহেঞ্জেরৎ সমসাময়িক হবে। শোনা যায়, বেশ কিছু সুপ্রাচীন রহস্যময় তন্ত্রানুষ্ঠান ওখানে হত, যা নিয়ে কিছু অস্বস্তিকর রটনাও আছে। কথিত আছে, সেইসব আচার-অনুষ্ঠান নাকি শেষ অবধি ডাকিনী দেবী সিবেলের৫৪ আরাধনার রূপ নেয়। অট্টালিকার নীচের ঘরের চোরাকুঠুরিগুলিতে এখনও খোদাই করা আছে সেইসব পূজার মন্ত্র– দিভ… ওপাস… মাগনা– মাতে… মহাভৈরবীরূপিণী মহাদেবীর স্তুতি। রোমান আক্রমণের পর এইসব গুপ্তবিদ্যাচর্চা জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু গোপনে গোপনে এই ভয়ানক আদ্যাশক্তির সাধনা চলতেই থাকে। যত দূর জানা যায়, জুলিয়াস সিজারের আমলে অগস্টাস সেনাবাহিনীর তৃতীয় শাখাটি এই অ্যানচেস্টারেই শিবির স্থাপনা করেছিল। আরও কথিত আছে যে, দেবী সিবেলের অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরের পুরোহিতরা নাকি কোনও অজানা, গোপন তন্ত্রানুষ্ঠান করতেন এক ফ্রিজিয়ান প্রধান পুরোহিতের নেতৃত্বে। পরবর্তীকালে মূল ধর্মের মধ্যে নানা পরিবর্তন এলেও, ওই বিশেষ মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান সেই প্রাচীন গোপনীয় এবং মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ীই হত। রোমানদের পতনের পরে এই মন্দিরও নাকি কোনওভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে পরে স্যাক্সনদের প্রচেষ্টায় এর পুনঃসংস্কার ঘটে– আর এই স্থানটি হয়ে ওঠে সপ্তসাম্রাজ্যের সবচাইতে ভয়াল অঞ্চল। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের এক প্রাচীন পত্রিকায় দেখতে পেলাম, এই জায়গাটি নাকি দুনিয়ার পিশাচসিদ্ধ গুপ্তবিদ্যার সাধকদের এক আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল– আর এর চারপাশে ছিল ঘন গাছপালায় ঘেরা এক বাগান। পাথরে ঘেরা এই স্থানটিকে ঘিরে দিয়ে কোনও পাঁচিল না থাকলেও, এই অঞ্চলের শত মাইলের মধ্যে কেউ ভুলেও পা দিত না– এমনই কোনও এক অজানা আতঙ্কে মোড়া স্থান ছিল এটি। ড্যানিশদের আমলেও কেউ এই স্থানটির কোনও ক্ষতিসাধন করেনি, কিন্তু নরম্যানদের আগমনে স্থানটির মাহাত্ম্যের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। রাজা তৃতীয় হেনরি শেষ অবধি জায়গাটি আমাদের ঊর্ধ্বতন আদিপুরুষ গিলবার্ট ডেলাপোরের হাতে তুলে দেন, ঘটনাচক্রে তিনিই ছিলেন এক্সাম অঞ্চলের প্রথম ব্যারন– আর সালটা ছিল ১২৬১।

এর পূর্বে আমাদের পরিবারের ওপর কোনও অশুভ অপচ্ছায়ার প্রাদুর্ভাবের খবর জানা যায় না, কিন্তু এখানে আসবার পর থেকেই অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছিল। ১৩০৭ সালের আর-একটা লেখায় দেখতে পেলাম, জনৈক ডেলাপোরকে ঈশ্বরের অভিশাপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রাম্য প্রবাদ এবং জনশ্রুতিতে সেই পুরোনো মন্দিরের ভগ্ন্যুপের ওপর গড়ে-ওঠা এই অট্টালিকাকে চূড়ান্ত অশুভ এবং শয়তানের স্থান আখ্যা দেওয়া হয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত গল্পগুলি তো আরও ভয়ানক প্রতিটি জনশ্রুতি মোটমাট ভয়ংকর সব বর্ণনায় পরিপূর্ণ। ভয়ের নানা রূপের প্রকাশ সেসব গল্পে প্রকটভাবে বিদ্যমান, কিন্তু এই বিপুল আতঙ্কের কারণ হিসাবে কোথাও সেরকম কিছু লেখা নেই। ঠিক কী যুক্তিতে এতগুলো মানুষ এত বছর ধরে ভয়ে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে এই স্থানকে পরিত্যাগ করে চরম ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তা নিশ্চিতভাবে কোথাও খুঁজে পেলাম না। উলটে আমাদের পূর্বপুরুষদের, বলা ভালো, আমার আদি পরিবারকে এমন পৈশাচিক আতঙ্ক এবং ঘৃণার পাত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, যার বর্ণনার তুলনায় গিলস দ্য রেটজ বা মাকুইস দ্য সাদের মতো অত্যাচারী শাসকের নিষ্ঠুরতার বিবরণও নেহাতই ছেলেভুলোনো বলে মনে হতে পারে। গ্রামের কিছু মানুষের হঠাৎ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিবারকেই দায়ী করা হয়েছে সর্বতোভাবে।

ব্যারন আর তাদের ছেলেপুলেরাও কিছু কম রহস্যময় ছিলেন না। কানাঘুষো শোনা যায় যে, এই ব্যারন নির্বাচনেও নাকি এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটত। উত্তরাধিকাররা যদি যোগ্য না হত তাহলে তারা নাকি কোনও অজ্ঞাত কারণে অপঘাতে মৃত্যুবরণ করত– যাতে পরের বিশেষ গুণাবলিসম্পন্ন যোগ্য সন্তান ব্যারন-এর সেই জায়গাটি নিতে পারে। এটা কীরকম যেন এক পারিবারিক রীতিতে পরিণত হয়েছিল যা পরিচালিত হত পরিবারের তৎকালীন যিনি মাথা থাকতেন, তাঁর অধীনে। এখানে বংশপরম্পরাগতভাবে উত্তরপুরুষ নির্বাচনের থেকে লোকটির মেজাজ এবং তার উৎকট আচার-আচরণ বেশি প্রাধান্য পেত। যে সমস্ত পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হত, তারাও এই অদ্ভুত প্রথার অঙ্গ হয়ে যেত। কনওয়েলের লেডি মার্গারেট ট্রেভর, যিনি কিনা পঞ্চম ব্যারনের দ্বিতীয় সন্তানের স্ত্রী ছিলেন, তিনি তো বহু দিন এই অঞ্চলে শিশুদের ত্রাস বলে পরিচিত ছিলেন। ওয়েলস সীমানার কাছে এখনও তাঁর নামে এক লোকগাথা আছে– কী ভয়ানক তার কথাগুলি, পড়লেই বুকের মধ্যে কেমন যেন শিরশিরানি জাগে। এরকম আরও এক চরিত্র ছিলেন, লেডি ম্যারি ডেলাপোর। তিনিও নাকি সমান কুখ্যাত ছিলেন কিন্তু আর্ল অব শ্রেউসফিল্ডের সঙ্গে বিবাহের কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি খুন হন। খুনের দায়ে তাঁর স্বামী এবং শাশুড়ি নাকি গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু চার্চে গিয়ে প্রধান পাদরির কাছে তাঁরা নাকি নিজেদের দোষ স্বীকার করে পুরো ঘটনা খুলে বলেছিলেন। এই ঘটনার অনতিবিলম্বেই তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং পুরো বিষয়টা এমনভাবে চেপে যাওয়া হয়, যাতে কাকপক্ষীও না জানতে পারে।

এই লোককথা এবং জনশ্রুতিগুলো, বলাই বাহুল্য, আমাকে বিলক্ষণ বিচলিত করেছিল। নানা বই, খবরের কাগজ, পুথির পাতায় পাতায় এইসব ভয়ানক ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বারংবার আমার বিভিন্ন পূর্বপুরুষের নাম জড়িয়ে আতঙ্কের এক আবহাওয়া সৃষ্টি হওয়া– আমার খুবই বিরক্তিকর লেগিয়েছিল। এইসব আধিভৌতিক ঘটনাপরম্পরার চলচ্ছবি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে গেল আমার খুড়তুতো দাদা র‍্যাডলফ ডেলাপোরের কথা। আমরা যখন কারফ্যাক্সে থাকতাম, তখন র‍্যাডলফ নিগ্রোদের সঙ্গে ভীষণভাবে মেলামেশা শুরু করেছিল। শুনেছিলাম, পরবর্তীকালে মেক্সিকান যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর সে নাকি কালাজাদু চর্চা করে এক ভুডু বিশারদ হয়ে উঠেছিল।

যা-ই হোক, এক্সাম প্রায়োরির লাগোয়া যে চুনাপাথরের উঁচু দেওয়ালটা রয়েছে, তার অপর পাড় থেকে শুরু হয়েছে এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা– সে কথা আমি আগেও বলেছি। এই উপত্যকাকে নিয়ে এক অদ্ভুত গল্প পড়লাম। উপত্যকার কাছেই যে কবরস্থান আছে, বসন্তের ঝিরঝিরে বৃষ্টির একরাতে স্যার জন ক্লেভের ঘোড়া অদ্ভুত সাদা কিছু একটাকে মাড়িয়ে ফ্যালে– আর সেই জিনিসটার তীক্ষ্ণ চিঙ্কারে সচকিত হয়ে, ক্লেভের চাকর প্রায়োরির দিকে মুখ তুলে চেয়ে ছিল। চাঁদনি রাতের মায়াবী জ্যোৎস্নাতে সে প্রায়োরিতে এমন কিছু দেখেছিল, যাতে সে আতঙ্কে পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যায়। তবে এসব গাঁজাখুরি গল্প হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এটাকে আমার চোখের ভুল ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। রাতের বেলায় কবরস্থানে দাঁড়িয়ে এসব ভুল দেখা অস্বাভাবিক কিছু না। যদিও আমি সেই সময়ে ভীষণ সন্দেহবাদী ছিলাম। গ্রামের চাষিদের মাঝে মাঝে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়াটা যদিও সন্দেহজনক, তবুও মধ্যযুগীয় সামাজিক পরিবেশে এসব খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। তবে এ জিনিসটা খুব অস্বস্তিকর যে, এক্সাম প্রায়োরির বাইরে সুবিশাল পাঁচিলের এদিক ওদিকে বল্লমের ফলায় মানুষের কাটা মুণ্ডু টাঙিয়ে রাখা হত– কেবল বোঝানোর জন্য যে, অতিরিক্ত কৌতূহলের অর্থ মৃত্যু।

এই গল্পগুচ্ছের মধ্যে এমন বেশ কিছু গল্প ছিল, যেগুলো কাহিনি হিসাবে বেশ ভালো। তুলনামূলক পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে কেন আগে একটু পড়াশোনা করিনি, ভেবে রীতিমতো আপশোস হতে লাগল। এরকমই কিছু গল্প, যেমন এই প্রায়োরিতে নাকি রাতের বেলা পিশাচ এবং ডাইনিদের রীতিমতো জমায়েত হত এবং বাদুড়রূপী শয়তানের এক বিরাট বাহিনী সেই জমায়েত পাহারা দেওয়ার জন্য চারপাশ ঘিরে থাকত। প্রায়োরিকে ঘিরে-থাকা বিরাট বাগানটিতে যেসব অদ্ভুত ধরনের খড়খড়ে খোসার ফল চাষ হত, সেইসব নাকি ওই শয়তান বাদুড়বাহিনীর ক্ষুন্নিবৃত্তিতে কাজে লাগত। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ইঁদুর নিয়ে এক নাটকীয় কাহিনি। পূর্বে বর্ণিত সেই কালান্তক ঘটনায় প্রায়োরি পরিত্যক্ত হবার প্রায় মাস তিনেক পর একরাতে নাকি কিলবিলে জঘন্য এই প্রাণীগুলোর এক বিরাট বাহিনী প্রায়োরি থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এদিক-সেদিক। এই নোংরা, হিংস্র এবং বুভুক্ষু শয়তানের দল নাকি পথে যা পেয়েছিল, সব কিছু গোগ্রাসে আত্মসাৎ করতে করতে এগোতে থাকে। মুরগি, শুয়োর, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল, এমনকী দুটি হতভাগ্য মানুষও এই রাক্ষুসে বাহিনীর পৈশাচিক খিদের শিকার হয় সেই অভিশপ্ত রাতে। এই ইঁদুরবাহিনীর নারকীয় কার্যকলাপের ওপর স্বতন্ত্রভাবে রচিত বা কথিত প্রচুর ভয়ানক গল্পকথা ছড়িয়ে আছে এই গ্রামের ঘরে ঘরে।

এতসব গল্পকথা, গ্রাম্য প্রবাদ, ভয়ানক ইতিহাসের সারি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বেশ কয়েকদিন। তবে এসবের মধ্যে দিয়েই দীর্ণ শতাব্দীপ্রাচীন আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটের এই ধ্বংসাবশেষের সংস্কারের কাজ প্রায় সমাপ্ত করে এনেছিলাম। শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসের অলৌকিক কর্মকাণ্ড আমার মনকে বিবশ করলেও– ক্যাপটেন নরিস এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ পুরাতত্ত্ববিদরা আমাকে প্রতিমুহূর্তে উৎসাহ জুগিয়েছিল এই প্রাচীন ইতিহাস পুনরুদ্ধারের কাজে। দু-বছরের ক্রমাগত পরিশ্রমের পর যখন কাজটা শেষ হল, তখন আমি প্রাণভরে পুরো বাড়িটা দেখলাম। খাঁজকাটা কাঠের দেওয়াল, ধনুকের মতো বাঁকা সিলিং, পাথরের গোবরাট-বসানো জানলা, চওড়া সিঁড়ি- সব মিলিয়ে এক প্রাচীন অভিজাত স্থাপত্যরীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নিজের পরিশ্রম এবং খরচকে সার্থক বলে মনে হল। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের প্রতিটা অংশে নিখুঁতভাবে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে ফেলা গেছে। যে জায়গাগুলো নতুনভাবে বানাতে হয়েছে, সেগুলোর স্থাপত্যও বেশ চমৎকারভাবে অট্টালিকার পুরোনো মেজাজের সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে। এবার আমার পরবর্তী কাজ হল নিজের পরিবারের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা। কারণ আমার পরিবারে শেষ পুরুষ বলতে কেবল আমিই অবশিষ্ট রয়েছি। এখানে বাস করে আমার বাপ-দাদাদের নামে যেসব অভিশাপ আর ঘৃণা ছড়িয়ে আছে সেগুলো ভুল প্রমাণিত করা এবং ডেলাপোর যে শয়তানের আর-এক নাম নয়, তা প্রতিষ্ঠা করাই আমার মূল কর্তব্য বলে ঠিক করলাম। আমার নিশ্চিন্ত হবার আরও বড় কারণ ছিল এই যে, যদিও বাইরের চাকচিক্যে এক্সাম প্রায়োরি সেই পুরোনো সময়কেই ধরে রেখেছে, তবুও তার ভেতরের অনেক কিছুরই খোলনলচে বদলে ফেলা হয়েছে, আধুনিক করে ফেলা হয়েছে এই প্রাচীন অট্টালিকার বেশ কিছু অংশ। তাই ভূত-টুত কিছু থাকলেও তারা এত দিনে পাততাড়ি গুটিয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।

হ্যাঁ– যা দিয়ে শুরু করেছিলাম– ১৬ জুলাই ১৯২৩ সালে আমি প্রায়োরিতে পাকাপাকিভাবে উঠে এলাম। আমার এখন পরিবার বলতে, সাতটা চাকর আর ন-টা বেড়াল, যার মধ্যে শেষোক্তদের প্রতি আমার ভালোবাসা একটু বেশি। সবচেয়ে বয়স্ক বেড়ালটা, আমার আদরের কালো-মানিক আমার সঙ্গে সাত বছর ধরে রয়েছে সেই ম্যাসাচুসেটের বোলটন থেকে। আর, ক্যাপটেন নরিসের সঙ্গে এখানে এত দিন থাকার সুবাদে বাকি বেড়ালগুলোকে আমিই জোগাড় করেছিলাম।

দিন পাঁচেক একরকম শান্তিতেই কেটে গেল। নিজের পরিবারের ব্যাপারে তথ্যাদি নথিভুক্ত করতেই আমার দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হত। যে রাতের ভয়ানক ঘটনায় আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছিল, সেই বিশেষ রাতের ব্যাপারে বিশদে জানার জন্য আমার কৌতূহল ছিল অদম্য। সে ব্যাপারে আমি প্রচুর তথ্য নাড়াঘাঁটা করেছিলাম। এত নথি পড়ে মনে হল, যেন কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাপার আমি ধরতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস, এই ঘটনার কথাই লিখে সেই চিঠি মুখবন্দি খামে পুরে আমার দাদুকে রাখতে দিয়ে গিয়েছিলেন আমার প্রপিতামহ, যা কারফ্যাক্সে থাকার সময় ভস্মীভূত হয়ে যায়।

যা জানলাম, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমার প্রপিতামহ নাকি নিজের হাতে, চারজন চাকরের সাহায্যে, পরিবারের বাকি সদস্যদের ঘুমের মধ্যেই হত্যা করেন। এই ঘটনার হপ্তা চারেক আগে তিনি নাকি এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেন, যাতে তাঁর স্বাভাবিক চালচলনে আমূল পরিবর্তন আসে। তাঁর এই পরিবর্তন নাকি শুধু ওই চারজন চাকরের কাছেই তিনি নিজে প্রকাশ করেছিলেন। বাকিদের সামনে তিনি স্বাভাবিক আচরণই করে বেড়াতেন। হতে পারে, এই কারণেই চাকরগুলো রক্ষা পায়, এবং সেই ঘটনার পরদিন থেকে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি যেন তারা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। এই সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের বলি হয়েছিল এক বাবা, তিন ভাই এবং দুই বোন– যাদের গ্রামবাসীরা খুব একটা সুবিধের চোখে কোনও দিনই দেখত না। এবং হতে পারে, সে কারণেই আইনের ফাঁস আমার প্রপিতামহের ওপর সেভাবে চেপে বসতে পারেনি, বা ইচ্ছে করেই হয়তো বসেনি। বিচার এমনভাবেই হয়েছিল, যাতে এই হত্যাকারী নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে এবং দিনের আলোয় এই অভিশপ্ত ভিলা ছেড়ে ভার্জিনিয়ায় পালিয়ে যেতে পারে। কানাঘুষো এমন পর্যায়ে চলেছিল যে, তিনি নাকি এই জায়গাটিকে সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে-আসা এক নারকীয় অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছিলেন। আমার প্রপিতামহ এমন কী আবিষ্কার করেছিলেন, যা তাঁকে ঠান্ডা মাথায় এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড করতে প্রলুব্ধ করল, সেটা আমি কিছুতেই ভেবে পেলুম না। ওয়াল্টার ডেলাপোর তো এই পরিবারেরই মানুষ ছিলেন, এবং নিজের পরিবারের ব্যাপারে কানাঘুষো, জনশ্রুতি, লোককথা সবই ওঁর অবগত ছিল। তাই সেসব গল্পকথা বা ভয়ানক ঘটনার বিবরণ তাঁর ওপর হঠাৎ এতটা প্রভাব নিশ্চয়ই ফেলেনি, যার প্ররোচনায় তিনি নিজের পরিবারকে হত্যার মতো এরকম বীভৎস পদক্ষেপ নেবেন। তাহলে তিনি কি কিছু দেখে ফেলেছিলেন- কিছু প্রাচীন রীতিনীতি? যা ভয়ানক গোপন কিন্তু সাংঘাতিক? নাকি কিছু গোপন সংকেত রহস্য উদ্ধার করেছিলেন, যার থেকে বেরিয়ে পড়েছিল কোনও ভয়ংকর পৈশাচিক সত্য? ওয়াল্টার কিন্তু তাঁর নরম স্বভাব এবং মৃদুভাষ্যের জন্য পরিচিত ছিলেন সারাজীবন। ভার্জিনিয়াতে যখন ছিলেন, তখনও চুপচাপ এবং শান্তিপ্রিয়ই ছিলেন। কিন্তু এমন কী ঘটে থাকতে পারে তাঁর সঙ্গে, যে এই শান্ত স্বভাবের মানুষ হঠাৎ রক্তপিপাসু জল্লাদ হয়ে উঠে এহেন নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করলেন?

২২ জুলাই থেকে আমার চারপাশেও এমন কিছু ঘটতে আরম্ভ করল, যা ঠিক স্বাভাবিক নয়। প্রথমে অত পাত্তা না দিলেও, এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলিই পরে এমন কিছু ঘটনার সূত্রপাত ঘটাল, যেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে আমি অপারগ। ঘটনাটা যদিও খুবই অকিঞ্চিৎকর এতটাই যে, প্রায় নজরেই পড়ে না। এত বড় বাড়িতে একপাল চাকরবাকর সমেত আছি, বড় বড় পাথরের নতুন রং-করা দেওয়াল, নতুন কাঠের আসবাব, এক আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে বাস করছি। চাকরবাকররা সারাক্ষণ আমার খিদমত খাটার জন্য মুখিয়ে রয়েছে– এই পরিবেশে ভয়ডর বিশেষ লাগে না। তবুও মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আমার বুড়ো বেড়ালটা যেন বিনা কারণে খুব উত্তেজিত এবং সতর্ক। কালো মানিকের মুড আমি খুব বুঝি, কিন্তু এ পরিবর্তনটার কোনও বিশেষ কারণ খুঁজে পেলাম না। সে সারা ঘরবাড়ি ছটফট করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগল, আর বিশেষ করে পাথরের দেওয়ালগুলো, যেগুলো বাড়িটার স্থাপত্যে একটা গথিক চেহারা দিয়েছে সেগুলোকে শুঁকতে লাগল। বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা কীরকম একটা ক্লিশে হরর মুভির মতো শোনাচ্ছে। ওইসব সিনেমাতে সাধারণত একটা কুকুর থাকে, যে মনিবের সামনে থাকা অদৃশ্য কিছু দেখে চিৎকার করে ওঠে। আমার মার্জার-পর্বও অনেকটা সেরকমই লাগতে পারে, কিন্তু কী করব– ব্যাপারটা না বলেও থাকতে পারছি না।

পরের দিন এক চাকর এসে অভিযোগ জানাল যে, সব কটা বেড়ালই নাকি এরকম উত্তেজিত আচরণ করা শুরু করে দিয়েছে। আমার স্টাডিরুমটা বাড়ির দোতলায়। বাঁকানো খিলানের ছাদ, কালো ওক কাঠের কড়িবগা, বড় বড় পুরোনো আমলের গথিক জানলা– যা দিয়ে বাইরে তাকালে চুনাপাথরের টিলা আর পরিত্যক্ত উপত্যকাটিকে স্পষ্ট দেখা যায় –সব মিলিয়ে ঘরটির মধ্যে এক প্রাচীন আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। এই ঘরে ঢুকে চাকরটি যতক্ষণ আমাকে মার্জারকুলের গত রাতের ছটফটানির কাহিনির বিবরণ দিচ্ছিল, আমি খেয়াল করলাম– কালো মানিক কাঠের কালো প্যানেলগুলোর কাছে গুটিশুটি মেরে বসে কী শুঁকছে, আর মাঝে মাঝে সেগুলোকে আঁচড়ে চলেছে। অট্টালিকার প্রাচীন পাথরের দেওয়ালের ওপর আস্তরণ হিসাবে জায়গায় জায়গায় কাঠের প্যানেলিং ব্যবহার করা হয়েছে। –কিন্তু কালো মানিকের তার ওপর এত আক্রোশ কেন? আমি চাকরটাকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, পুরোনো পাথরের স্তরে কিছু অদ্ভুত গন্ধ থাকে, কাঠের স্তর ভেদ করে যা হয়তো আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। কিন্তু কোনও কারণে তা মার্জারকুলের সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়েছে। আমার এই ব্যাখ্যা মনে হল, আমার ভৃত্যের ঠিক মনঃপূত হল না। সে চটপট বলে উঠল, আচ্ছা কত্তা, ইঁদুর বা ছুঁচোও তো থাকতে পারে? আমি হেসে ওকে জানালাম যে, গত তিনশো বছরে এই অট্টালিকাতে কোনও ইঁদুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বাইরে মেঠো ইঁদুর হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু কোনও পথভ্রষ্ট মেঠো ইঁদুরও এখানে কোনও দিন ঢুকেছে বলে জানা যায়নি। যা-ই হোক, সে দিন দুপুরে আমি ক্যাপটেন নরিসকে ডাকলাম। তিনি সোজা বলে দিলেন যে, মেঠো ইঁদুরের পক্ষে এত কম সময়ের মধ্যে সুবিশাল অট্টালিকাতে ঢুকে এর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব।

সে দিন রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে বিশ্রামের আয়োজন করছিলাম। অট্টালিকার পশ্চিম মিনারের একটা ঘরে আমি থাকতাম। আমার স্টাডি থেকে শোয়ার ঘরে পৌঁছোনোর জন্য একটা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট গ্যালারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সিঁড়িটা যদিও একই রকম আছে, তবে গ্যালারিটা পুরোপুরি সংস্কার করা হয়েছিল। আমার শোয়ার ঘরটি আকৃতিতে গোলাকার, এবং দেওয়ালে বেশ কারুকার্যময় পর্দা ঝোলানো। ঘরটা সাজাব বলে আমি নিজে পর্দাগুলো লন্ডন থেকে বেছে বেছে কিনে এনেছিলাম। এই ঘরের দেওয়ালগুলোতে সেই জন্য কাঠের প্যানেলিং রাখা হয়নি। যা-ই হোক, কালো মানিককে সঙ্গে করে শোবার ঘরে ঢুকে আমি বিরাট দরজাটায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম, আর দেওয়ালে মোমবাতিদানের মতো লাগানো ইলেকট্রিক আলো বন্ধ করে সুবিশাল পালঙ্কের নরম গদিতে ডুবে গেলাম। বাধ্য ভৃত্যের মতো কালো মানিক আমার পায়ের কাছটিতেই শুয়ে থাকল। তবে জানলার দিকের পর্দাটা পুরোপুরি টানলাম না। পর্দার ফাঁক দিয়ে রাতের কালো আকাশের এক অদ্ভুত ফ্যাকাশে আলো এসে আমাকে যেন আরও তন্দ্রাবিষ্ট করে তুলল। জানলার ওপরে চকমকি পাথরের কালো সিলয়েট সেই মায়াবী আলোয় একতাল জমাট অন্ধকারের মতো থম মেরে রইল।

বেশ ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্নের ঘোরেই বুঝতে পারলাম, বেড়ালটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছে। চোখ খুলে সেই আধো অন্ধকারে দেখতে পেলাম, কালো মানিক তার সামনের দুটি পা আমার গোড়ালির ওপর রেখে আর পেছনের পা দুটো টানটান করে ঘরের পশ্চিমদিকের দেওয়ালের দিকে সোজাভাবে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও আমার চোখ কিছুই দেখতে পেল না, কিন্তু তবুও স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি না মনে হল, কালো মানিকের উত্তেজনা অমূলক নয়। পর্দাটা কি একটু নড়ল? হতে পারে। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, পর্দার পেছনে একদল প্রাণীর চলে-ফিরে বেড়ানোর আওয়াজ অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম। ইঁদুর না ছুঁচো? কালো মানিক ততক্ষণে খাট থেকে এক লাফে নেমে পড়েছে, এবং সেই বিশেষ দিকের ঝোলানো পর্দার ওপর আক্রমণ শানিয়েছে। ওর শরীরের ভারে এবং দাঁতের টানে সাজানো পর্দা ছিঁড়ে নেমে এল মাটিতে, আর উন্মুক্ত হয়ে গেল পর্দার পেছনের স্যাঁতসেঁতে প্রাচীন পাথরের দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে এদিক ওদিক সংস্কারের ছাপ পাথরের দেওয়ালে কোনও ফাঁকফোকরও নেই। তাই ইঁদুর বা ছুঁচো এসে ঘরে ঢুকে পড়বে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু কালো মানিকের তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে চরম আক্রোশে কাঠের মেঝে আর পাথরের দেওয়ালের সংযোগস্থলে পা দিয়ে আঁচড়াতে থাকল, যেন ওখানে সে কিছুর সন্ধান পেয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ এরকম চলার পর, হতোদ্যম হয়ে ফিরে এসে আবার আমার পায়ের কাছে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। আমি একই রকমভাবে শুয়ে শুয়ে সব দেখলাম– একচুলও নড়িনি। আমার বেড়ালটা ঘুমিয়ে পড়লেও সে রাত্রে আমার আর ঘুম এল না।

সকালে উঠে সব কটা চাকরকে জড়ো করে জেরা করতে লাগলাম তারা গত রাত্রে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে কি না। বাকি সবাই মাথা নেড়ে সরে পড়লেও, রাঁধুনি জানাল, তার ঘরের বেড়ালটা কিছু অদ্ভুত আচরণ করেছে কাল রাত্রে। বেড়ালটা ঘরের জানলায় কাঠের গোবরাটটার ওপর শুয়ে ছিল চুপচাপ। কিন্তু মধ্যরাতের কোনও একসময়ে তার গরগর আওয়াজে রাঁধুনির ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখতে পায়, বেড়ালটা খোলা দরজা দিয়ে তিরবেগে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে।

দুপুরের দিকে আবার নরিসকে ডেকে পাঠালাম। ঘটনাটা শুনে নরিস এবার বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়ল। খুব আহামরি কিছু না হলেও ব্যাপারটার মধ্যে একটা বিশেষত্ব যে আছে, সেটা নরিস স্বীকার করতে বাধ্য হল। কিন্তু ইঁদুরের উপস্থিতির ব্যাপারটা আমাদের দু-জনকেই বেশ ভাবিয়ে তুলল। ঠিক করা হল, ইঁদুর ধরার কল পাতা হবে বিশেষ কিছু জায়গায়। চাকরবাকরগুলোকে কল কেনার নির্দেশ দিয়ে দুপুরের দিকে একটু বেরোলাম।

সে রাতে বেশ ক্লান্ত থাকায় একটু তাড়াতাড়িই শুতে গেলাম। কিন্তু বিধি বাম। এমন মারাত্মক দুঃস্বপ্ন দেখলাম যে, আমার শরীর কেমন করতে লাগল। স্বপ্নে দেখলাম, আমি অনেক উঁচু থেকে নীচে এক আবছায়া গুহামুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। তবে গুহামুখটা বেশি গভীর না, আবর্জনায় ভরে উঠে তার গভীরতা খুব বড়জোর পায়ের গোড়ালি ডোবাতে পারে। সেই গুহামুখের সামনে দিয়ে এক অপদেবতার মতো অবয়ব কিছু থলথলে ফাঙ্গাসের মতো জিনিসকে চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রাণীগুলো এতটাই বিশ্রী এবং ভয়ংকর যে, দেখেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। এবার সেই অবয়ব হঠাৎ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা নেড়ে কিছু একটা ইশারা করতেই, কোথা থেকে স্রোতের মতো একপাল কালো কুচকুচে ইঁদুর বেরিয়ে এসে ওই সমস্ত জীব, মায় মানুষটাকে অবধি খেয়ে শেষ করে ফেলল।

এরকম একটা আতঙ্কের স্বপ্নদর্শনে ছেদ পড়ল, কারণ গত রাতের মতো কালো মানিকের উত্তেজিত ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সে বেশ ভয় পেয়েছে। তার সামনের পা দুটো আমার গোড়ালির ফাঁকে ঢুকিয়ে সে কান খাড়া করে বসে আছে দেওয়ালের দিকে চেয়ে। তবে আজ আর কষ্ট করে শব্দের উৎসের খোঁজ করতে হল না। ঘরের প্রতিটি দেওয়াল যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এক খলবলে শব্দে। লোলুপ বিশালকায় ইঁদুরের দলের হুড়মুড়িয়ে চলার আওয়াজে পূর্ণ হয়ে উঠেছে আমার ঘর। জানলা দিয়ে ঘরে আজ এক ফোঁটা আলোও ঢোকেনি যে, কালকের ছিঁড়ে-যাওয়া পর্দাটার দিকে তাকাতে পারব। আমি লাফিয়ে উঠে ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম।

ঘর আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম, নতুন পর্দাটা বিপজ্জনকভাবে নড়ে চলেছে একটা নির্দিষ্ট দিকে। যেন ঢেউ খেলছে তার ওপর। কিন্তু পরমুহূর্তেই নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল– সঙ্গে সেই খলবলে শব্দটাও থেমে গেল নিমেষে। খাট থেকে নেমে আমি ফায়ারপ্লেসের শিকটা তুলে নিয়ে সন্তর্পণে পর্দার ওই অংশটাতে একটু খোঁচালাম, তারপর পর্দাটাকে একটু সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম ওর পেছনে আছেটা কী। পাথরের নিরেট দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। বেড়ালটাও এখন অনেক স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছিল। মনে হয়, অতিপ্রাকৃতের উপস্থিতির ভীতিটা সে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এতক্ষণে। এবার আমি ইঁদুর ধরার কলগুলো ভালো করে পরীক্ষা করলাম, যেগুলো আমার ঘরে রাখা ছিল। প্রত্যেকটি কলের মুখ বন্ধ– তার মানে কিছু তো এদের মধ্যে দিয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তা অক্ষতভাবে কলের মারণ-ফাঁস উপেক্ষা করে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

আর ঘুমোনোর প্রশ্ন আসে না। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমি গ্যালারি অতিক্রম করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমার স্টাডিতে বসা স্থির করলাম। কালো মানিকও আমার পায়ে পায়ে চলল। সিঁড়ির কাছে পৌঁছোনোর মুখেই সে আমাকে অতিক্রম করে একছুটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। কয়েক ধাপ নামার পরেই বুঝলাম, নীচের বড় ঘরে একটা কিছুর আওয়াজ হচ্ছে এমন একটা শব্দ, যা চিনতে ভুল হওয়ার নয়। দেওয়ালে লাগানো ওক কাঠের প্যানেলগুলো যেন চলমান হয়ে উঠেছে মূষিকদলের দ্রুত এবং খড়খড়ে চলাফেরার আওয়াজে। কালো মানিক ফোঁস ফোঁস করতে করতে এক দিশাহীন শিকারির মতো সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরে ঢুকেই আমি আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম কিন্তু আশ্চর্য, এবারে আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শব্দ কিন্তু আগের বারের মতো থেমে গেল না। মূষিকদের প্রচণ্ড গতিতে চলাফেরা চলতেই থাকল। তবে অদৃশ্য এই ধাবমান মূষিকদল যে একটি নির্দিষ্ট দিকেই চলেছে, তার আন্দাজ পাওয়া গেল। বুঝলাম, এই সংখ্যায় অগণিত মূষিকশ্রেণি কোনও এক সুউচ্চ স্থান থেকে নীচের কোনও এক অকল্পনীয় গভীরতায় এক অজানার আকর্ষণে অবিশ্রান্ত গতিতে ছুটে চলেছে।

আচমকা হলঘরে পদশব্দ শোনা গেল, আর পরমুহূর্তেই দেখলাম, দু-জন ভৃত্য স্টাডির দরজা ঠেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের মতে, বাড়িতে এমন কিছু একটা ঘটছে, যার ফলে বাড়ির সমস্ত বেড়াল উন্মত্তের মতো ছোটাছুটি শুরু দিয়েছে। আর প্রত্যেকটি বেড়াল সিঁড়ির পর সিঁড়ি অতিক্রম করে বাড়ির একদম নীচে অবস্থিত চোরাকুঠুরির দরজার সামনে গিয়ে বসে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইঁদুরের খড়খড়ানি তারা শুনেছে কি না। কিন্তু তারা মাথা নেড়ে না বলল। আমি যখন ঘরের দেওয়ালের ভেতর ধাবমান মূষিকদলের শব্দ তাদের শোনাতে গেলাম, বুঝতে পারলাম, সেই আওয়াজ অনেকক্ষণ আগেই থেমে গিয়েছে। অগত্যা দুই ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেই চোরাকুঠুরি অভিমুখে রওনা দিলাম। যতক্ষণে সেখানে পৌঁছোলাম, মার্জারকুল সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। পরে অবশ্য এই কুঠুরির তত্ত্বতল্লাশ আমি করেছিলাম, কিন্তু এখন আপাতত এর আশপাশে ঘুরেই আমি ক্ষান্ত দিলাম। এই ঘরের চারপাশেও বেশ কিছু ইঁদুর ধরার কল পাতা ছিল দেখতে পেলাম, আর সেগুলোও যথারীতি বন্ধ। কলে আটকা-পড়া কোনও জীবের চিহ্নমাত্র নেই। তবে ইঁদুরদের উপস্থিতিটা যে আমি ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনি, সেটা জেনে একটু নিশ্চিন্ত লাগছিল। নিজের স্টাডিতে ফিরে আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। এই বাড়ি এবং এই পূর্বতন বাসিন্দাদের ব্যাপারে যা কিছু পড়েছিলাম, যতরকম গল্প, লোককথা জেনেছিলাম– এক-এক করে মনে করার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।

ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল। দুপুরে জেগে উঠে ক্যাপটেনকে ফোন লাগালাম। তিনি আসার পর দুজনে মিলে সেই চোরাকুঠুরির ভেতরে ঢুকে খোঁজ চালালাম, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই পাওয়া গেল না। তবে রোমানদের আমলে তৈরি এই কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। ঝুঁকে-পড়া প্রতিটি খিলান, প্রতিটি থাম যেন সিজারের সময়কার বিশুদ্ধ এবং সর্বোত্তম রোমান স্থাপত্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে অটলভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। দেওয়ালে বেশ কিছু খোদিত লিপি প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে আগ্রহের বিষয়, যেমন– P.GETAE. PROP TEMP DONA 100 L. PRAEC VS. PONTIFI AT.Y.S …

অ্যাটিয়াসের নামটা পড়ে শিউরে উঠলাম। ল্যাটিন কবি ক্যাথুলুসের লেখা আমার পড়া ছিল, আর সেই সুবাদে আমি প্রাচ্য দেবদেবীদের বীভৎস পূজাপদ্ধতি একটু হলেও জানতাম। দেবী সিবেলের আরাধনার সঙ্গে এঁর বেশ কিছু মিল লক্ষণীয়। আমি এবং ক্যাপটেন নরিস মিলে লণ্ঠনের আলোয় খোদিত লিপি এবং ছবিগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। অধিকাংশই প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু ঘরের মাঝে পাথরের মসৃণ বেদি দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হল না, এটা নরবলি বা ওই জাতীয় কিছু দেব-উৎসর্গের জন্য ব্যবহার করা হত।

দেওয়ালগুলো পরীক্ষা করার সময় কিছু খোদাই-করা ছবি দেখেছিলাম। তাতে দৃশ্যমান সূর্যের বিচ্ছুরিত রশ্মি নিশ্চিতভাবেই রোমান ভাস্কর্য নয়। মনে হয়, রোমান পুরোহিতরা এসব জায়গা থেকে কিছু আরও প্রাচীন পূজাপদ্ধতি আয়ত্ত করেছিলেন। কিছু কিছু পাথরে বাদামি রঙের দাগ দেখে চমকে উঠলাম। ঘরের মাঝবরাবর পাথরের যে চওড়া বেদিটা রাখা ছিল, তার উপরিতল পরীক্ষা করে মনে হল, এর সঙ্গে আগুনের কিছু সম্পর্ক ছিল, কারণ তার ওপর কালো মোটা দাগ বেশ ঘন হয়ে ফুটে রয়েছে। হয়তো এখানে আগুনে দগ্ধ করে বলিদান দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল।

ঠিক করলাম, আমি আর নরিস আজ এখানেই রাত্রিযাপন করব, এই চোরাকুঠুরির মধ্যে বসেই। সোফা-টোফাগুলো নামিয়ে আনা হল। চাকরবাকরদের বলে দিলাম, রাত্রে যা ই ঘটুক, কেউ যেন কিছু না করে। কালো মানিক আমাদের সঙ্গেই থাকল। ঘরের বিশাল ওক কাঠের দরজাটা চেপে বন্ধ করে দিলাম– যদিও কাঠের মধ্যে এমন কিছু ছিদ্র করা ছিল, যা দিয়ে হাওয়া-বাতাস ঢুকতে পারে অবাধে। না হলে দমবন্ধ হয়ে মারা পড়াও বিচিত্র নয়। যা-ই হোক, সব কিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে আমরা একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে সোফাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

প্রায়োরির পেটের গভীরে, মাটির বেশ খানিকটা নীচে এই কুঠুরিটার অবস্থান। সেক্ষেত্রে হয়তো খলবলে ইঁদুরদের বাসস্থানের জন্য এটা একটা আদর্শ জায়গা হতে পারে, কিন্তু ঠিক কী কারণে ওরা সবাই এদিকেই ধেয়ে আসে, সেটা বলতে আমি অপারগ! বসে পাহারা দেওয়ার অবস্থায় যদিও জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, তবুও ঘুম ও জাগরণের মধ্যবর্তী এক স্বপ্নালু তন্দ্রাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম মাঝে মাঝেই। পায়ের ওপর দিয়ে বেড়ালের উত্তেজিত চলাফেরা আমার এই আচ্ছন্ন অবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল। স্বপ্ন যেটা দেখছিলাম, সেটাও ছেঁড়া-ঘেঁড়া, কিন্তু এটাকেও আমার আগের রাতে দেখা ভয়ংকর স্বপ্নটারই জুড়িদার বলা যেতে পারে। সেই আলোছায়ায় মেশা গুহামুখ, সেই ঘৃণ্য, থকথকে ছত্রাকময় জীবগুলির নোংরার মধ্যে গড়াগড়ি দেওয়া। আমি যতই তাদের দেখতে থাকলাম, জীবগুলো যেন ততই কাছে আসতে থাকল– আর… আর… তাদের অবয়ব স্পষ্টতর হতে থাকল আমার কাছে। এতটাই, যে তাদের প্রতিটা অঙ্গ আমি আলাদা করে দেখতে পাচ্ছিলাম। খুব নিকটে একটা মূর্তিমান আতঙ্ককে দেখে এতটাই ভয়ে পেয়ে গেলাম, যে ঘুমের মধ্যেই প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলাম। কালো মানিক চমকে উঠে দাঁড়াল আর ক্যাপটেন নরিস, যে কিনা এক ফোঁটাও ঘুমোয়নি, হো হো করে হেসে উঠল। কী ভয়ানক দৃশ্য যে আমি স্বপ্নে দেখেছি, সেটা জানলে হয়তো নরিস এরকম আচরণ করতে পারত না বা হয়তো এর থেকেও বেশি হাসত। কিন্তু এরপর বহুক্ষণ আমি আমার মধ্যে ছিলাম না– প্রচণ্ড ভয় মাঝে মাঝে মানুষের স্মৃতিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতেই আবার কেমন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল।

ঘটনাটা শুরু হতেই নরিস আমাকে ঠেলে তুলল। ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, নরিস আমাকে হালকা হালকা ধাক্কা দিচ্ছে আর শোনাতে চাইছে বেড়ালগুলোর সমস্বরে গরগর আওয়াজ। কান পেতে শুনলাম, ভারী ওক কাঠের দরজার বাইরে বেড়ালদের গজরানি আর দরজার ওপর তাদের নখের আঁচড়। কালো মানিক দরজার বাইরে তাদের বন্ধুদের উপস্থিতি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে, পাথরের দেওয়ালগুলোর কাছে উত্তেজিত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল বারংবার আর আমি শুনতে পেলাম দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে খলবল করতে থাকা ইঁদুরদের চলাফেরা করার আওয়াজ, যা গত রাতে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।

আতঙ্ক ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করল– ব্যাখ্যার অতীত অতিপ্রাকৃত ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেলাম। এই উন্মত্ত মূষিকের দল নিশ্চিতভাবেই এই দেওয়ালের ভেতর দিয়েই চলাচল করছে– যেটাকে আমি এত দিন কঠিন চুনাপাথরে তৈরি বলেই জানতাম। সম্ভবত সতেরোশো বছরের মধ্যে এই দেওয়ালের ভেতরে চুঁইয়ে জল ঢুকে সেটাকে এমনভাবে ক্ষইয়ে দিয়েছে, যা দিয়ে পরবর্তীকালে এই ধেড়ে ইঁদুরের দল প্রবেশ করে, এবং বাকি এবড়োখেবড়ো অংশগুলো কেটে মসৃণ করে ভেতর দিয়ে চলাচলের দিব্যি রাস্তা বানিয়ে ফ্যালে। এই ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের মনকে বোঝানো সত্ত্বেও চারপাশের ভৌতিক আবহাওয়া কিন্তু একচুলও হালকা হল না। যদি এই মূষিকের দল সত্যি সত্যি দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করছে, তাহলে নরিস সেটা শুনতে পাচ্ছে না কেন? কেন কেবল আমার হতচ্ছাড়া কানেই ইঁদুর-দৌড়ের এই খড়বড়ে আওয়াজ শ্রুতিগোচর হচ্ছে? কেন নুরিস কেবল কালো মানিকের অদ্ভুত আচরণ এবং দরজার বাইরে বেড়ালদের ক্রমাগত গজরানিতে অবাক হয়ে গিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে? কেন সে এখনও বুঝে উঠতে পারছে না মার্জারকুলের এই নিশাচর উত্তেজনা ও আক্রোশের কারণ?

যতক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণভাবে নরিসকে আমার শোনা আওয়াজের কথা এবং বেড়ালদের আচরণের সম্ভাব্য কারণ বোঝাতে চেষ্টা করছি, দেওয়ালের মধ্যে ইঁদুরদের চলাচলের আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। শব্দের তীব্রতা ধীরে ধীরে নিম্নগামী হয়ে অর্থাৎ এই কুঠুরির থেকেও আরও গভীরে, হয়তো-বা পাতালে প্রবেশ করল। মনে হতে লাগল, এই পুরো বাড়িটার ভিতের নীচে অতল গভীরে ঘিনঘিনে ইঁদুরের দল চরম আক্রোশে খলবল করে বেড়াচ্ছে।

নরিসকে যতটা অবিশ্বাসী ভেবেছিলাম, বাস্তবে দেখলাম সে ততটা নয়। আমার ব্যাখ্যা মন দিয়ে শুনে যে যেন কিছুটা চমকেই গেল। আমাকে আঙুল তুলে দেখাল, যে দরজার বাইরে বেড়ালদের তর্জনগর্জন অন্তর্হিত হলেও, কালো মানিকের উত্তেজনা তিলমাত্র কমেনি। সে একইভাবে এখনও আঁচড়ে চলেছে ঘরের মাঝের সেই পাথরের বেদির নীচের অংশটা।

ঠিক এই মুহূর্তে কী এক অজানা আতঙ্কের প্রতি অব্যক্ত ভয়ে আমি অবশ হয়ে গেলাম। যেন কিছু একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটেছে। ক্যাপটেন নরিসের দিকে তাকালাম আশ্চর্যজনকভাবে ক্যাপটেনের মতো হাট্টাকাট্টা, সাহসী, প্রাণোচ্ছল এবং চটপটে যুবকের মধ্যেও আমার আতঙ্কের অনুভূতি সঞ্চারিত হয়ে পড়েছে। হতে পারে, অট্টালিকাকে জড়িয়ে এইসব গেঁয়ো প্রবাদ এবং ভয়াল কিংবদন্তির প্রভাব হয়তো এত দিনে ফলতে শুরু করেছে তার ওপর। আমরা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কালো মানিক সমানে সেই বেদির তলদেশ আঁচড়ে চলেছে, এবং মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিউ মিউ শব্দ করছে। সাধারণত, যখন সে আমার থেকে সাহায্য চায়, তখনই এরকম আচরণ করে থাকে।

নরিস এবার লন্ঠনটা তুলে নিয়ে বেদির ঠিক সেই অংশটার দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে কালো মানিক তার থাবা দিয়ে কিছু একটা খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছে। হাঁটু মুড়ে বসে, পাথরের বেদি এবং মেঝের সংযোগস্থলে পড়ে-থাকা কিছু টুকরো ভগ্নাবশেষ সরিয়ে ফেলে, সেখানে আলো ফেলে তার চারপাশ পরীক্ষা করেও নরিস কিছু দেখতে পেল না। আলোটা ঘুরিয়ে সে ফিরেই আসছিল। আচমকা আমি এমন কিছু দেখতে পেলাম, যাতে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। নরিসকে আমি ব্যাপারটা দেখালাম, এবং দু-জনেই সেই অস্পষ্ট কিন্তু অপূর্ব আবিষ্কারের উত্তেজনায় স্থিরদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। লণ্ঠনটা বেদির যেখানে বসানো ছিল, সেখানে তার শিখাটা যেন মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছিল কীসের এক তাড়নায়। ভালো করে দেখে বোঝা গেল, বেদির কোনও এক ফাঁকফোকর দিয়ে হাওয়া বেরোচ্ছে, আর সেই হাওয়ার প্রকোপেই লণ্ঠনের শিখার এই অস্বাভাবিক আচরণ। হাওয়া বেরোচ্ছে বেদি এবং কুঠুরির মেঝের জোড়ের অংশটা থেকে, যেখানে এতক্ষণ নরিস বসে বসে আবর্জনা সরাচ্ছিল। তার মানে বেদির ঠিক নীচেই কোনও গুপ্ত কুঠুরি আছে, যা থেকে উদ্গত বাতাস পাথরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে।

বাকি রাতটা আমার বড়সড়ো স্টাডির উজ্জ্বল আলোতে বসে আলোচনা করেই কেটে গেল। আমাদের দুজনের মনেই প্রশ্ন– এবার কী কর্তব্য? আমরা এমন এক গুপ্ত কুঠুরি আবিষ্কার করে ফেলেছি, যা গত তিন শতকে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক খুঁজে পায়নি। এই প্রায়োরিতে প্রচুর মানুষ নিছক অ্যাকাডেমিক আগ্রহে এবং প্রত্নসন্ধানে এসেছিলেন বহু দিন ধরে। আমরা যে কুঠুরিতে আজ রাতে ছিলাম, সেটিকে এখানকার গভীরতম স্থান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এরও নীচে কিছু একটা আছে, সেটা জানার পরে আমাদের মতো অ-গবেষক মানুষও যেরকম উত্তেজিত হয়ে পড়েছি, তাতে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক যে উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবেন, সেটা বলাই বাহুল্য।

এই ঘটনার পর দুটি সম্ভাবনা উদয় হল। এক, এই প্রায়োরি ছেড়ে চিরতরে পালিয়ে যাওয়া। এই অট্টালিকাকে জড়িয়ে যেসব গা-ছমছমে কুসংস্কার এবং প্রবাদ আছে, তাতে এরকম একটা গুপ্ত কুঠুরির কথা বলা আছে বটে। আর দুই, সাহসে ভর করে একটা রোমাঞ্চকর অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া দেখাই যাক-না আর কত গভীরে যাওয়া যেতে পারে, আর সেখানে কী রহস্যই বা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

সারারাত আলোচনা চালিয়ে, ভোরবেলা এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যে লন্ডনে ফিরে গিয়ে কয়েকজন প্রত্নতাত্ত্বিক এবং কিছু বিজ্ঞানীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা যাক। তাতে অন্তত এই ঐতিহাসিক আবিষ্কার স্বীকৃতি পাবে। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গুপ্ত কুঠুরির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা দু-জনে সে দিন ওই পাথরের বেদিটাকে সরানোর বহু বিফল প্রচেষ্টা করেছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওই বেদিটাই হল কোনও অজানা গভীরতায়, বিপুল রহস্যময় এক দুনিয়াতে প্রবেশের একমাত্র পথ।

লন্ডনে গিয়ে আমি আর ক্যাপটেন নরিস আমাদের প্রাপ্ত প্রমাণ, মায় প্রায়োরির ইতিহাসের দলিল, তাকে ঘিরে গল্পকথা, প্রবাদ, কিংবদন্তি– সব কিছুই পাঁচজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, বিজ্ঞানবিদের সামনে উপস্থিত করলাম। এমন পাঁচজন, যাঁদের আমাদের পরিবারের গুপ্তকথা বিশ্বাস করে বলা যায়, এবং এঁরা এসব ব্যাপারে আগ্রহ নিয়ে অনুসন্ধানকাজও চালিয়ে থাকেন।

দেখলাম, এঁরা ব্যাপারটাতে বেশ আগ্রহী। হেসে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কারও ভেতরেই বিশেষ দেখা গেল না, বরং বেশ সমানুভূতি নিয়েই এঁরা আমাদের কথাগুলো শুনলেন। এঁদের সবার নামোল্লখ প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু তবু বিশেষ করে স্যার উইলিয়াম ব্রিন্টনের নাম না নিলে অবিচার করা হবে। ইনি তত দিনে ট্রোড উপদ্বীপে (তুর্কি দেশের অন্তর্গত) খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে বেশ নাম কিনেছেন। এঁরা সকলেই আমাদের সঙ্গে প্রায়োরিতে গিয়ে খননকার্য চালাতে রাজি হলেন। ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে যেদিন সবাই মিলে অ্যানচেস্টারের ট্রেনে চেপে বসলাম। সে দিন মনটা যেন কেমন এক অশুভ ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার ওপর শুনলাম, দুনিয়ার অপর প্রান্তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে খুন হয়েছেন। খবরটা আমার চারপাশের আবহাওয়াকে আরও বিষণ্ণ করে তুলে এক অশুভ পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করতে লাগল। কেন জানি মনে হতে লাগল, এ যাত্রা মোটেই সুখকর হবে না।

অগাস্টের সাত তারিখ নাগাদ আমরা এক্সাম প্রায়োরিতে পৌঁছোলাম। ভৃত্যেরা জানাল, এ ক-দিনে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। কালো মানিক সমেত আমার বাকি পোষ্য মার্জারশ্রেণি বিলকুল ঠান্ডা হয়ে ছিল। ইঁদুর-ধরা কলের একটা স্প্রিংও বাঁকা হয়নি। ঠিক হল, পরের দিন থেকেই অনুসন্ধান শুরু হবে। আমার অতিথিদের বসবাসের জন্য সব থেকে ভালো ঘরগুলোর ব্যবস্থা করা হল। সব মিটিয়ে, আমার ক্লান্ত শরীরটাকে কোনওমতে টেনে বিছানায় ফেললাম। কালো মানিক অভ্যাসমতো পায়ের কাছটিতে শুয়ে রইল।

শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরমুহূর্তেই সেই বীভৎস দুঃস্বপ্নের করাল ছায়া আমায় নিমেষে গ্রাস করল। স্বপ্নে রোমানদের এক ভোজসভার দৃশ্য দেখতে পেলাম– খাবারের প্রাচুর্যে ভরপুর সেই ভোজসভা। কিন্তু প্রতিটি প্লেট ঢাকা দেওয়া যেন কী এক অজানা আতঙ্ক সেইসব ঢাকা-দেওয়া প্লেটের ভেতরে লুকিয়ে আছে। তারপর আবার সেই জঘন্য স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই শুয়োরের পাল ঘষটাতে ঘষটাতে আলো আঁধারিতে মোড়া আবর্জনাময় গুহার অন্ধকারে প্রবেশ করল। এসব দেখে যখন আমি চরম অস্বস্তি নিয়ে জেগে উঠলাম, দেখি চারদিকে ফটফটে দিনের আলো। আশপাশে পরিবেশের স্বাভাবিক শব্দ– কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। ইঁদুর বা বেড়াল কেউই উৎপাত করছে না। কালো মানিক পায়ের কাছে ঘুমিয়ে কাদা।

ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলাম। চতুর্দিকে নিবিড় নিস্তব্ধতা। আমার এই অনুসন্ধানদলের এক বিজ্ঞানী তিনি আবার কিছুটা অধ্যাত্মবাদীও বটে– আমাকে বলেছিলেন, এই বাড়িতে নাকি কিছু মহা-অশুভশক্তি রয়েছে। এই শক্তির প্রভাবেই নাকি আমি এসব উলটোপালটা ব্যাপার প্রত্যক্ষ করছি।

সবাইকে ঘুম থেকে তুলে প্রাতরাশ খেয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। তারপর আমাদের সাতজনের দলটা হাতে বড় বড় টর্চলাইট এবং খোঁড়াখুঁড়ির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সমেত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে চললাম। সেই রোমান স্থাপত্যে ঠাসা চোরাকুঠুরিতে পৌঁছে কাঠের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া গেল। কালো মানিক আমাদের সঙ্গেই ছিল। অনুসন্ধানকারীরা তাকে না নিয়ে যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাননি, তা ছাড়া তার আচরণও আপাতত স্বাভাবিক। কুঠুরির দেওয়ালে রোমানদের শিলালিপি এবং আরাধনা বেদির নানা বৈচিত্র্যময় নকশা খুব সামান্য সময়ের জন্য দেখেই তাঁরা ঘরের কেন্দ্রস্থলে থাকা পাথরের মূল বেদির দিকে অগ্রসর হলেন। দলের দু-একজন প্রত্নবিজ্ঞানী এই অট্টালিকাতে আগে এসে থাকার সুবাদে রোমান শিলালিপির বিষয়ে তাঁরা আগেই পরিচিত ছিলেন। তাই সেসব বাদ দিয়ে সবার আকর্ষণের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠল ঘরের মাঝের সেই রহস্যময় পাথরের খণ্ডটি।

অনেক কায়দাকানুনের পর, স্যার ব্র্যান্টন বেদির পাথরটাকে পেছনে হেলাতে সক্ষম হলেন। যথেষ্ট মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসা সত্ত্বেও, সেই রন্ধ্রপথের গহিন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে আমাদের শ্বাসরোধ হয়ে আসার উপক্রম হল। চৌকো করে কাটা সেই সুড়ঙ্গপথের মুখের কাছে পাথরের সিঁড়ি এঁকেবেঁকে নেমে গেছে অজানা কোন অন্ধকারে। আর সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে একটা বিশাল স্কুপের মতো বীভৎস নরকঙ্কাল বা মানুষের মতো কিছুর হাড়গোড়ের রাশি ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে যেগুলোকে মানুষের বলে চিহ্নিত করা গেল, সেগুলো বাদে বাকি বিভিন্ন রকমের খুলির উপস্থিতিও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদের মধ্যে অতি প্রাচীনকালের মানুষের মাথার খুলিও যেমন আছে, তেমনি আছে বামন গোত্রের মানুষের করোটি। তা ছাড়া ইঁদুরে খাওয়া মনুষ্যশরীরের কঙ্কালময় ভুক্তাবশেষও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে। সিঁড়ির ধাপগুলো দেখেই বোঝা গেল, কেউ পাথর কেটে মসৃণ করে সেগুলিকে তৈরি করেছে, আর সেই ধাপের পাশে দেওয়ালের খাঁজ দিয়ে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাসের স্রোত।

আশ্চর্য হয়ে অনুভব করলাম এই বাতাস বহুকালের সুড়ঙ্গ খুলে বেরিয়ে-আসা বিষাক্ত বা কটু বাতাস নয়। এ বাতাস তাজা, ফুরফুরে। আমরা বেশিক্ষণ সেখানে অপেক্ষা না করে দুরুদুরু বুকে সেই সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামতে থাকলাম। স্যার উইলিয়াম সুড়ঙ্গের পাশের দেওয়ালের গায়ে কাটা খাঁজগুলো পরীক্ষা করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আর তখনই তিনি হাড়-হিম-করা আবিষ্কারটি করলেন। ওঁর অস্ফুট স্বর স্বগতোক্তির মতো ভেসে এল– ছেনি বা পাথর কাটার যন্ত্রের ঘা দেখে মনে হচ্ছে, এই সুড়ঙ্গ ওপর থেকে নীচের দিকে কাটা হয়নি। বরং কেউ বা কারা এটা নীচ থেকে কাটতে কাটতে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে এসেছে।

ছড়িয়ে-থাকা হাড়গোড় এবং করোটির স্তূপ সরিয়ে কিছুটা নামার পর দূর থেকে একটা আলোর ক্ষীণ রেখা দেখতে পাওয়া গেল। টিমটিমে কোনও মায়াবী আলোর বিচ্ছুরণ নয়– এ রীতিমতো সূর্যের আলো যা কেবল প্রায়োরির পশ্চিমের উপত্যকার দিকে মুখ করে থাকা উঁচু বাঁধের কোনও অজ্ঞাত ফাটল দিয়েই আসা সম্ভব। কিন্তু সারা বাড়ি সংস্কার করার সময়ও এই ফাটলটা চোখে পড়ল না, এটা বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার। তবে ওই পশ্চিম উপত্যকাতে শুধু মানুষ থাকে না তা-ই নয়, উঁচু বাঁধটাও এমন লম্বা এবং খাড়াই যে, বেলুনে চড়েই কেবলমাত্র ওর ওপর উঠে পরীক্ষা করা সম্ভব।

আর কিছুটা এগিয়েই এমন দৃশ্য দেখতে পেলাম যে, আতঙ্কে আমাদের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের দলের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানী খ্রনটন সেদিকে তাকিয়েই জ্ঞান। হারিয়ে তাঁর ঠিক পেছনের লোকটির কোলের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। নরিসের গোলগাল মুখও ফ্যাকাশে হয়ে চুপসে গেল, আর সে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠল। হয়তো আমিও সেরকমই কিছু একটা শব্দ করে চোখ চাপা দিয়েছিলাম। আমার পেছনে থাকা দলের সদস্যটির গলা দিয়ে বেরিয়ে এল বহুশ্রুত সেই শব্দবন্ধটি– হে ভগবান! সাত সাতটা আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাওয়া পুরুষের মধ্যে কেবল স্যার উইলিয়াম ব্রিন্টন বুক চিতিয়ে খাড়া রইলেন। তিনি যেহেতু পুরো দলের নেতা, তাই তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ শোভা দেয় না। আর তা ছাড়া, দলের পুরোভাগে থাকার জন্য তিনি হয়তো আমাদের ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর আগেই দৃশ্যটি দেখেছিলেন, তাই তাঁর দ্বিতীয়বারের প্রতিক্রিয়া এতটা ভয়াবহ হয়নি।

আমাদের সামনে আলো-আঁধারিতে ঘেরা এক বিশাল গুহামুখ। অকল্পনীয় উঁচু তার প্রাকার। কতটা গভীর যে তার বিস্তৃতি, চোখে দেখে তার কোনও আন্দাজও পাওয়া যায় না। ভূগর্ভস্থ এই দুনিয়া যেন রহস্যের খাসমহল, ভয়ংকরের অভয়ারণ্য! এদিক-ওদিক নানা স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে। একঝলক তাকিয়ে দেখলাম, প্রাচীন সমাধিস্কৃপের সারি– এক অদ্ভুত বিন্যাসে সাজানো। কবরের উপরে বসানো মাটির স্তূপ, রোমানদের গম্বুজাকার স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ, স্যাক্সন স্থাপত্যের ছড়িয়ে-থাকা টুকরো, কাঠের তৈরি প্রাচীন ও বিশালাকার ইংরেজ স্থাপত্য কিন্তু এসব ছাপিয়ে এক হাড়-হিম-করা পৈশাচিক দৃশ্য মেঝের ওপরেই ছড়িয়ে রয়েছে। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার ফুটখানেক দূরেই বীভৎসভাবে জট-পাকানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে মানুষের হাড়। শয়ে শয়ে স্কুপের মতো। মানুষ এবং মনুষ্যেতর কোনও দু-পেয়ে জন্তুর, যাদের হাড় আমরা সুড়ঙ্গের মুখেও দেখে এসেছি। সমুদ্রের সাদা ফেনার মতো সামনে পড়ে রয়েছে সেই সফেদ চকচকে হাড়ের সারি। কঙ্কালের সারি দেখে আন্দাজ করা কঠিন নয়, এদের কেউ কোনও মাংসাশী দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে, কেউ-বা আরও কোনও ভয়ংকরের করাল গ্রাসে প্রাণ দিয়েছে।

ড. ট্রাস্ক, যিনি আমাদের দলের মধ্যে নৃতত্ত্ববিদ ছিলেন– ঝুঁকে পড়ে কিছু করোটি তুলে নিলেন ভালোভাবে নিরীক্ষণের জন্য। করোটিগুলির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য তাঁকে হতবাক করে দিল। এ যে পিন্টডাউন মানুষের (বানর থেকে মানুষে অভিযোজনের মিসিং লিংক এই পিল্টডাউন ম্যান) চেয়েও পুরাতন করোটি, কিন্তু হাড়ের সমুদ্রের মধ্যে অধিকাংশই মানবকঙ্কাল। অনেক কঙ্কালের বৈশিষ্ট্য দেখে বোঝা গেল, তারা কিছুটা উন্নত শ্রেণির মানুষ। তা ছাড়া অতি উন্নত শ্রেণির মানুষের কিছু কঙ্কালও খুঁজে পাওয়া গেল। এদের অধিকাংশ হাড়ই চিবোনো, ছিবড়ে করে ফেলা। হয় কোনও ছোট প্রাণীর দ্বারা, আর না হলে মানুষের মতো দেখতে এমন কোনও মনুষ্যেতর প্রাণীর দ্বারা। অনেক ইঁদুরের হাড়গোড়ও এদের মধ্যে মিশে রয়েছে দেখা গেল। হয়তো এরা সেই প্রাণঘাতী মূষিকবাহিনীর হতভাগ্য সদস্যরা, যাদের মৃত্যু এ প্রাচীন পৈশাচিক মহাকাব্যের ওপর যবনিকা টেনে দিয়েছে।

এইসব দৃশ্য দেখার পর মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ভাষায় বা অনুভূতিতে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, কী অবিশ্বাস্যরকম জান্তব, পৈশাচিক, ঘৃণ্য, বিকৃত বর্বরতার চূড়ান্ত রূপ দেখেছিলাম আমরা সাতজন সেই আলো-আঁধারি ভূগর্ভস্থ গুহার সামনে। প্রতিটা মুহূর্তেই কিছু-না-কিছু আবিষ্কৃত হচ্ছিল আর সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে সাজাতে চেষ্টা করছিলাম, কয়েকশো বছর আগে, বা হাজার বছর পূর্বে না না, দু-হাজার বছর, তা-ও হয়তো নয় দশ হাজার বছর আগে এখানে ঠিক কী ঘটেছিল। এটা যেন নরকের গর্ভগৃহ, যা মৃত্যুর গন্ধে ম-ম করছে।

এসব কিছু মাঝে থ্রনটনের জ্ঞান এসেছিল বটে, কিন্তু ড. ট্রাস্ক যখন তাঁকে শোনালেন যে, স্থূপের কিছু কঙ্কালের নমুনা হাজার-দু-হাজার বছর পুরোনো চতুষ্পদের নমুনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, ভয়ে তাঁর আবার দাঁতকপাটি লাগল।

স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষগুলো পরীক্ষা করে আমাদের আতঙ্ক যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। বুঝলাম, চতুষ্পদ জীবগুলির মধ্যে দ্বিপদ প্রাণীরাও পাথরের বড় বড় ঘরের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকত। জেগে ওঠার পর হয় তারা ক্ষুধায় প্রাণত্যাগ করত বা মূষিক-আতঙ্কে মারা পড়ত। পরীক্ষা করে বোঝা গেল, এই জায়গায় চতুষ্পদ প্রাণীদের একটা পুরো পাল ছিল তাদের খাওয়ানোর জন্য প্রচুর শাকসবজি রাখা থাকত পাথরের একটা বিশাল কোটরে। সেইসব জাবনার অবশিষ্টাংশ এখনও সেখানে পাওয়া গেল। সেই পাথরের তৈরি বিশাল পাত্রটিরই বয়স আন্দাজে হিসেব কষে দেখা গেল রোমান সাম্রাজ্যের থেকেও বেশি! এখন বুঝলাম, আমাদের পূর্বপুরুষরা বাড়ির সামনে বিরাট শাকসবজির বাগান কাদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য বাজিয়েছিলেন।

রোমান স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যার উইলিয়াম। তিনি টর্চ হাতে দেওয়ালে খোদাই-করা লিপি থেকে পাঠ করলেন এমন এক গুপ্তবিদ্যার পদ্ধতি, যা আমি আগে কোনও দিন শুনিনি। খ্রিস্টপূর্বোক্ত যুগের কিছু ধর্মবিশ্বাস এবং খাদ্যভ্যাসের বিবরণ পড়ে শোনালেন তিনি, যার সঙ্গে পরবর্তীকালে দেবী সিবেলের পুরোহিতরা নিজেদের কিছু উপাদানও মিশিয়ে দেন। ক্যাপটেন নরিস, যে একদা যুদ্ধক্ষেত্রের ট্রেঞ্চে বীরের মতো চলাফেরা করেছে, ইংরেজ স্থাপত্যের অংশটি দেখে এসে ভয়ে আর বিস্ময়ে জবুথবু হয়ে বসে পড়েছিল। ঘরের মতো অংশটির মধ্যে যুগপৎ কসাইখানা এবং রান্নাঘর দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সে৷ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা প্রাচীন ইংরেজ নিদর্শন ছাড়াও দেওয়ালে খোদাই-করা প্রচুর শিল্পরীতি তার কাছে বেশ পরিচিত লেগিয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম, এ সব কিছুর বয়সই ১৬১০ সালের কাছাকাছি। ওখানে ঢোকার প্রবৃত্তি হল না আমার কারণ আমি জানতাম, ওই বাড়ির শয়তানি কার্যকলাপ আমার প্রপিতামহ ওয়াল্টার ডেলাপোরের ছুরিকাঘাতে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আমি বরং স্যাক্সন স্থাপত্যের মধ্যে প্রবেশ করলাম। অট্টালিকার ওক কাঠের দরজা ভেঙে খুলে গেছে। ভেতরে ঢুকেই দেখলাম খান দশেক অন্ধকার কুঠুরি, ঠিক জেলখানার মতো। সামনের লোহার শিকগুলোতে মরচে পড়ে গেছে। তিনটে কারাগারে একটা করে কঙ্কাল শায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এদের মধ্যে একজনের হাড়ের আঙুলে একটা আংটি দেখলাম, যার ওপরে খোদিত মোহরটি আমাদের বংশে এখনও ব্যবহৃত হয় নানা সরকারি কাজে। স্যার উইলিয়াম, রোমান প্রার্থনাকক্ষের নীচের অংশে এরকমই আরও একটা কারাগার আবিষ্কার করলেন। সেগুলো যদিও আরও প্রাচীন– তবে সবই খালি। ড. ট্রাস্ক একটা প্রাগৈতিহাসিক সমাধিস্তূপ ভেঙে পরীক্ষা করতে লাগলেন। সেখান থেকে পাওয়া খুলিটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, গোরিলার থেকে সামান্য উন্নতমানের মনুষ্যেতর জীবের মাথার খুলি সেটি– তাতে আবার অদ্ভুত সব প্রাচীন চিত্রলিপি খোদাই করা আছে।

এত ঘটনা এবং নিরন্তর নব নব আবিষ্কারে মধ্যে ডুবে থাকলেও আমি আড়চোখে কালো মানিকের দিকে নজর রেখেছিলাম। এত কিছুর মধ্যেও আমার বেড়াল কিন্তু নিরুত্তাপ থেকেছে। মাঝে একবার একছুটে উঠে গিয়েছিল হাড়ের স্তূপের একদম চূড়ায়, সেখানেই বসেছিল কিছুক্ষণ। ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে তার হলুদ চোখের চাহনি দিয়ে হয়তো-বা বুঝতে চাইছিল এই জায়গার রহস্য।

এরকম ভয়ানক সব অভিজ্ঞতালাভের পর, আমরা গুহার একটু ভেতরে ঢুকতে গেলাম যেখানে বাঁধের ফাটল দিয়ে আসা কোনও আলোর রশ্মি এখনও ঢুকতে পারেনি। সেখানে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম আমি। এ-ও সম্ভব! আমার দুঃস্বপ্নে বারবার যে জায়গাটা আমাকে তাড়া করে এসেছে, আমি ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমাকে কি তাহলে এত দিন এই ভয়ানক রহস্যময় জায়গা হাতছানি দিয়ে এসেছে? আলোর সীমানা অতিক্রম করে আমরা ক্রমশ নিবিড় অন্ধকারের রাজ্যে ঢুকে চললাম। এর ভেতর আরও কি রহস্য তার মায়াজাল বিস্তার করে আছে, সে বিষয়ে জানার কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছিল। যদিও জানতাম, একসঙ্গে এত কিছু জেনে ফেলা আমাদের পক্ষে মোটেই উচিত কাজ হচ্ছে না।

কিছু রহস্যকে হয়তো রহস্য রেখে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।

বেশি দূর যেতে হল না। আমাদের টর্চের আলো গিয়ে পড়ল গুহার গভীরে ছোটবড় অসংখ্য গর্তের মধ্যে। দেখে বোঝা গেল, এখানেই এই মাংসাশী মূষিকশ্রেণি তাদের শিকারকে ছিঁড়ে খেত। খাদ্যের অভাব কেবল খাদ্যের বিপুল অভাবেই তারা তাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল। প্রথমে শেষ করেছিল পোষা চতুষ্পদের পালকে, এবং তারপর তাদের বিশ্বগ্রাসী ও রক্তলোলুপ পৈশাচিক খিদে নিয়ে তারা প্রায়োরি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল একদিন রাত্রে৷

হে ঈশ্বর। এ কী দৃশ্য! প্রতিটি গর্ত কেবল শুকনো মাংস এবং হাড়ের স্তূপে পরিপূর্ণ। হাড়ের টুকরো এবং খুলির অংশগুলো অবধি টুকরে-খাওয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পৈশাচিক শয়তানের দল তাদের বিকৃত ক্ষুধা মিটিয়ে এসেছে নানা ধরনের প্রাণীদের শিকার বানিয়ে। তাদের হাড়গোড়ে পূর্ণ করেছে তাদের অন্ধকার কোটর। এক-একটা যে কত গভীর তা টর্চের আলো ফেলেও পরিষ্কার অনুমান করা সম্ভব নয়। কত শতাব্দী ধরেই না জানি এই হতভাগ্য মূষিকের দল কৃমিকীটের মতো উঠে আসছে এই কুম্ভীপাক নরকের নিঃসীম অন্ধকার থেকে।

হঠাৎ আমার পা পড়ল একটা হাঁ করে থাকা নরকঙ্কালের ওপর। চকিতে কিছুটা পিছলে গিয়েছিলাম। চারপাশে চোখ পড়তেই ভয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। আমি হয়তো দেখতে গিয়ে একটু বেশিই মনোযোগী হয়ে থাকব, তাই খেয়াল করিনি যে, বাকিরা কখন আমার পাশ থেকে চলে গেছে। টর্চটা জ্বালিয়ে দেখলাম কেবল একটু দূরে ক্যাপটেন নরিস দাঁড়িয়ে। ওঁকে চিৎকার করে ডাকতে যাব, সেই মুহূর্তেই সেই পরিচিত শব্দটা কানে এল। যেন কোন অসীম থেকে ভেসে আসছে সেটা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে আর ক্রমশ এগিয়ে আসছে। দেখতে পেলাম, আমার কালো বেড়ালটা মুহূর্তে আমার পাশ দিয়ে তিরের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। আমিও তড়িৎগতিতে ফেরবার রাস্তা ধরলাম। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। খড়মড় করে বীভৎস শব্দে, খলবলে নারকীয় মূষিকদলের ছুটে আসার আওয়াজ ক্রমশই তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল। এই পৈশাচিক জন্তুগুলো প্রতি মুহূর্তেই নতুন আতঙ্কের জন্মদাতা। এরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে, টেনে নিয়ে যাবে সুদূর নরকে, যেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে আননহীন এক কিলবিলে শয়তান, নায়ারলাথোটেপ–যার মোহনবাঁশির মতো ভয়ংকর আর্তনাদে মোহিত হয়ে ছুটে আসে রক্ত-খদ্যোতের দল।

আমার টর্চের আলো নিবে গেছে, কিন্তু তবু আমি দিশাহীনভাবে ছুটে চলেছি উন্মাদের মতো। দূর থেকে যেন কারও গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি। কেউ যেন আর্তনাদ করে উঠছে– সেই আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে সেই বিশাল ভূগর্ভস্থ নরকের প্রাকারে প্রাকারে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আরও তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে সেই শব্দ–রক্তলোলুপ ইঁদুরের দলের এগিয়ে আসার কুটিল, ভয়ংকর, ঘৃণ্য শব্দ– সেটা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। ছুটতে ছুটতে কিছুতে একটা যেন হোঁচট খেলাম– কীরকম নরম আর তুলতুলে একটা জিনিস। নিশ্চয়ই সেই রক্তলোলুপ শয়তানের দল গায়ের ওপর এসে গেছে। ঘিনঘিনে থকথকে কি কদাকার সেই পিশাচেরা, যারা মড়া এবং জ্যান্ত এই দুই ধরনের প্রাণীকেই মহানন্দে ভোজন করে। বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল– তাহলে ইঁদুরগুলো ডেলাপোরদের ভক্ষণ করল না কেন? ডেলাপোররা নিষিদ্ধ কিছু খেত বলে? যেমন যুদ্ধটা আমার ছেলেকে খেয়েছে? মর শালারা!! ইয়াঙ্কিগুলো কিনা কারফ্যাক্সের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল– শয়তানগুলো দাদুকে কিনা জ্বালিয়ে মেরে দিল!!

না না– এসব কী ভাবছি আমি? আমি সে নই, আমি আমার স্বপ্নে দেখা সেই শয়তানরূপী কদাকার অবয়ব নই!! ছত্রাকে পূর্ণ ওই বীভৎস থলথলে মুখটা এড নরিসের হতে পারে না!!

কে বলেছে আমি ডেলাপোর? শালা নরিস বেঁচে রইল, আর আমার ছেলে মরে গেল?? কে নরিস? সে কিনা ডেলাপোরের সম্পত্তি দখল করে থাকবে? ওহে থ্রনটন, চাঁদবদন আমার!! এটাই আসলি কালাজাদু, বুঝলে সাপের ছোবল হিসসস!!! আবার জ্ঞান হারাবে নাকি?? কোনও সমস্যা নেই!! আমি তোমাকে দেখাব, কীভাবে আমাদের পরিবারের প্রাচীন কাজকর্মের প্রভাবে তোমার স-জ্ঞানকে অ-জ্ঞানে পরিণত করা যায়।

রক্ত চাই রক্ত, বুঝলি ইতর!! রক্ত– তোর রক্ত চাই। কীভাবে ছোবল মারবি, আমি দেখাচ্ছি, দেখ!! ম্যাগনা মাতের! ম্যাগনা মাতের!! আতিয়াস দিয়া আদ আদান আগুস বাস দুনাত ওরট– আগুস লেট সাআআআআআআ–উররর রাআআআহহ সসসসস!!!!!!

প্রায় তিন ঘণ্টা পর ওরা যখন আমাকে এই অন্ধকার কুঠুরির তলা থেকে উদ্ধার করে, তখন নাকি এই শব্দগুলো আমি ক্রমাগত আওড়ে যাচ্ছিলাম। ওরা আরও বলে, আমি নাকি ক্যাপটেন নরিসের আধখাওয়া দেহের ওপরে হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম। আমার নিজের বেড়াল কালো মানিক নাকি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার টুটি ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করছিল। এক্সাম প্রায়োরিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চিরকালের জন্য। ওরা কালো মানিককেও আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, আর আমাকে পুরে দিয়েছে। হ্যানওয়েলের এই ছোট্ট ঘরে। আমি বুঝতে পারছি, আমার পরিবার নিয়ে, এবং আমাকে নিয়ে নানা কুৎসা রটানো হচ্ছে আমার চারপাশে। প্রায়োরির সব রহস্য চেপে দেওয়ার চেষ্টা করছে এরা!! বেচারা নরিসের কথা জিজ্ঞেস করলে আমার ওপর বীভৎস সব আরোপ লাগাচ্ছে, কিন্তু তাদের জানতে হবে, এসবের জন্য আমি দায়ী নই!! ওদের জানতে হবে ওই ইঁদুরগুলোর কথা। সেই ঘিনঘিনে মূষিকের দল, যাদের খড়খড়ে চলাফেরা, ক্রমাগত উল্লম্ফন আমাকে একটুও ঘুমোতে দেয় না। শয়তানের দল সারাক্ষণ এই ঘরের দেওয়ালের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমাকে ডাকছে মাটির গভীরে, আরও নিবিড় আতঙ্কের যাত্রাতে তাদের সঙ্গে শামিল হতে।

এরা কোনও দিন এই বীভৎস ডাক শুনতে পাবে না। কেবল আমি পেতে থাকব, চিরটাকাল! ওই ইঁদুরের দলের ঘিনঘিনে আওয়াজ যা ভেসে আসছে ওই দেওয়ালের ভেতর থেকে।

[প্রথম প্রকাশ: গল্পটি ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে উইয়ার্ড টেলস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষান্তর : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *