একটি অলৌকিক জ্যোৎস্না

একটি অলৌকিক জ্যোৎস্না (WHAT THE MOON BRINGS)

[স্বপ্ন দেখে সেটা নিয়ে গল্প লেখা ছিল লাভক্র্যাফটের প্রিয় এক অভ্যাস। এই ছোট্ট লেখাটিও তাঁর দেখা এক স্বপ্নেরই টুকরো। তাঁর অধিকাংশ গল্পের তুলনায় খুবই ছোট এই গল্পটি।]

চাঁদকে আমি ঘৃণা করি। ভয়ও পাই। যখন দেখি, চিরচেনা ও প্রিয় জিনিসও জ্যোৎস্নায় কেমন অপরিচিত ও কুৎসিত হয়ে ওঠে।

নির্জন গ্রীষ্মের সেই ছমছমে রাতে পুরোনো এক বাগানের ভেতরে পায়চারি করছি। নিস্তব্ধ বাগানটার চারপাশ ধুয়ে যাচ্ছে চাঁদের অমল আলোয়। বাগানময় ছড়িয়ে-থাকা রাশি রাশি পাতা আর ফুলের মাতাল গন্ধে ভরা এমন গ্রীষ্মের রাত। আহা! এমন রাতেই তো মনের ভেতরে আশ্চর্য রঙের সব স্বপ্ন জেগে উঠতে থাকে।

হাঁটতে হাঁটতেই আচমকা চমকে উঠে লক্ষ করলাম বাগানের মধ্যে একটা ঝরনা! ঝরনার জলের মধ্যে হলদে আলো পড়ে চকচক করছে। শান্ত সেই ঝরনার স্রোত আপন মনে বয়ে যাচ্ছে, বয়ে যাচ্ছে এমন এক সমুদ্রের দিকে, যার অস্তিত্ব আমাদের চেনা দুনিয়ায় কোনও দিনই ছিল না! আমি ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। শব্দহীন, উজ্জ্বল, ঝলমলে ঢেউগুলিকে অশুভ বলে মনে হচ্ছিল। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, পূর্ণ চাঁদের মায়ার ভেতরে কোথা থেকে এল এই অভিশপ্ত স্রোত! কীভাবে এল?

পদ্মের কুঁড়িগুলো খসে পড়ছিল একে একে। নিয়তিতাড়িতের মতো তারা সেই জলের ভেতরে ঘূর্ণি তুলে চকিতে হারিয়ে যাচ্ছিল এক আশ্চর্য নকশার সেতুর তলায়। তারা ভেসে বেড়াচ্ছিল আপন খেয়ালে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কতকগুলি শান্ত, মৃত মুখের সারি ভেসে চলেছে জলের মধ্যে দিয়ে!

আমি দ্রুতবেগে ছুটতে শুরু করলাম সেই তীর ধরে। আমার পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছিল বাগানের মাটিতে পড়ে-থাকা ঘুমন্ত ফুলগুলি। কী এক অজানা ভয়ে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এগোচ্ছি। হয়তো জলের মধ্যে ভেসে বেড়ানো মৃত মুখের সেই কল্পনা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। ছুটতে ছুটতে অবাক হয়ে দেখলাম, বাগানের শেষে যে পাঁচিল ছিল, তা অদৃশ্য! কী এক আশ্চর্য জাদুতে বাগানটা এক অনিঃশেষ পথের ভেতরে হারিয়ে গিয়েছে! চাঁদের আলোয় যত দূর দেখা যায়, কেবল অচেনা আগন্তুক সব গাছ। সেই গাছেদের সঙ্গে নিয়ে চলেছে পথ। পথ জুড়ে কেবল ফুল, গাছ আর ঝোপ। পাথরের মূর্তি আর প্যাগোডা! আর সেই নদী, ঘাসে ভরা পাড়ের কিনার বেয়ে শ্বেতপাথরের বিচিত্র আঁকাবাঁকা সামঞ্জস্যহীন সেতু পেরিয়ে সে এগিয়ে গিয়েছে সামনের দিকে।

ঠিক সেই সময় বাতাসের ভেতরে কার যেন বিষণ্ণ ফিশফিশ শুনতে পেলাম! কে যেন আমাকে এগিয়ে যেতে বলছে। অনেকটা দূরে শ্বেতপাথরের সেতুটার দিকে এগিয়ে যেতে হবে আমায়। সেই ফিশফিশকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। ক্রমে আবিষ্কার করলাম, সেই ঝরনার জলস্রোত থেকে সৃষ্টি হয়েছে একটা নদী। আর তারপর সেই নদীটা চলতে চলতে গিয়ে মিশেছে এক বিস্তীর্ণ জলাভূমির পথ ধরে এক বিরাট অচেনা সমুদ্রে। সেই অচেনা সমুদ্রের তীর বরাবর ছড়িয়ে রয়েছে ঝকমকে বালি। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের শরীর। অন্ধকার রাতেও চাঁদের আলোয় তার ঢেউগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটা বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসছিল সেখান থেকে।

চাঁদের আলোয় আচমকা এ রহস্যের শরিক হয়ে পড়েছি আমি, এই নির্জন রাতে! যদি সত্যিই ওই মৃত মুখেদের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, তাহলে তাদের থেকে জেনে নিতাম জ্যোৎস্নাময় রাতের ভেতরে লুকিয়ে-থাকা রহস্যকে।

ধীরে ধীরে চাঁদ পশ্চিমদিকে হেলে গেল। ক্রমে ভাটার টান ফুটে উঠল সমুদ্রে। দেখলাম, শান্ত ঢেউগুলি বিষণ্ণ তীর থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। ঢেউ সরে গিয়ে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সবুজ শ্যাওলাময় সাদা মন্দিরের চূড়া। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, এই জলময় স্থান কেবল মৃতদের জন্যই। কোনও জীবিত মানুষের কখনও এখানে আসা উচিত নয়। টের পেলাম, থরথর করে কাঁপছি আমি। মনে মনে বললাম, এই শেষ। আর নয়। আর কখনও কোনও ফিশফিশ শব্দের পাল্লায় পড়ে এমন জায়গায় আসার মতো ভুল করব না। নাহ্!

এই সময় দেখতে পেলাম, অন্ধকার আকাশ থেকে একটা শকুন নেমে আসছে। সম্ভবত সামনের জলমগ্ন প্রবালপ্রাচীরটায় বসে বিশ্রাম নিতে চায় সেটা। আমি ঠিক করলাম, ওর কাছে জানতে চাইব মৃতদের এই জগৎ সম্পর্কে! শকুনটা ক্রমশ নেমে আসছিল। ভেবেছিলাম, আমার কাছেই ও নামবে, কিন্তু ক্রমে বুঝলাম, ভুল ভেবেছি। কাছে নয়, দূরে। অনেক দূর দিয়ে সেই রাক্ষুসে প্রবালপ্রাচীরের আড়ালে কোথায় যেন তলিয়ে গেল শকুনটা। আমি তার কোনও হদিশ পেলাম না।

অপলক নেত্রে তাকিয়ে রয়েছি সামনের দিকে। ডুবন্ত চাঁদের আলোয় ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে জলের তলায় লুকিয়ে-থাকা এক মৃত শহরের আশ্চর্য সব গম্বুজ, খিলান ও ছাদ! আর তার সঙ্গে সেই গন্ধটার তীব্রতাও বেড়ে চলেছে। বলা ভালো, দুর্গন্ধ। যেন পৃথিবীর সমস্ত মৃতের গন্ধ এসে মিশেছে সেই গন্ধের মধ্যে। টের পেলাম, রাতের গহিনে বিস্মৃত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত এক শহরের মধ্যে সমুদ্রের মাংসখেকো কীটেরা এসে ভিড় করেছে কবরের পচা মাংসের লোভে।

এই ভয়াল, থমথমে শহরের ওপরে আলো ফেলতে ফেলতে চাঁদ ক্রমে নীচে নেমে যাচ্ছিল। অবশ্য জ্যোৎস্নার কী-ই বা প্রয়োজন ওই কীটদের? তারা ব্যস্ত রইল নিজেদের কাজে। কুরে কুরে খেতে লাগল মৃত শরীরের মাংস। আমি সেই কীটময় স্রোতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকাতে তাকাতে আমার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল দূরে। ঠিক সেখানে, যেখানে একটু আগে শকুনটাকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছি। আর সেদিকে তাকাতেই যেন শিউরে উঠলাম। আমার শরীরের মধ্যে কী এক অলৌকিক সংকেত ঝিলিক দিয়ে উঠল। যদিও আমার চোখ তখনও নতুন কিছুই দেখেনি। তবু…

ক্রমে বুঝতে পারলাম, ভুল কিছু ভাবিনি। অকারণে বুকের মধ্যে অনুভব করিনি আতঙ্কের চোরাস্রোত। ভাটার টানে জলস্তর নামতে নামতে দূরের প্রবালপ্রাচীরটা ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছিল। এতক্ষণ যার চুড়োটুকুই আমার চোখের সামনে ছিল। আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল সবটা। বুঝলাম, ওটা আসলে শয়তানের ভয়ংকর মুকুট! হ্যাঁ, শয়তান। তার প্রকাণ্ড কপালটা এবার জলের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদের ম্লান হয়ে-আসা আলোয় একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। বুঝতে পারছিলাম, আরও নীচে, মাইলের পর মাইল গভীরে ওই দানবের খুরের মতো পা ছুঁয়ে আছে সমুদ্রের তলদেশ।

আমি চিৎকার করে উঠলাম। চারপাশের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিল আমার সেই ভয়ার্ত আর্তনাদ। আমি বুঝতে পারছিলাম, জলের স্তর আর-একটু নেমে গেলেই সেই অতিকায় শয়তানের চোখ দুটো জেগে উঠবে। বিশ্বাসঘাতক চাঁদ তার চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলবে আমাকে!

আমার আর উপায় ছিল না। সেই অমানুষিক দৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে নিঃসংকোচে আমি লাফ দিয়ে পড়লাম সেই দুর্গন্ধময় শ্যাওলা-মাখা জলের গভীরে, যেখানে স্থূলকায় সমুদ্রকীটরা পৃথিবীর মৃতদের শরীর ঘিরে বনভোজনে মত্ত।

[প্রথম প্রকাশ: গল্পটি ১৯২৩ সালের মে মাসে, দ্য ন্যাশনাল অ্যামেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ভাষান্তর: বিশ্বদীপ দে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *