পরপার

পরপার (FROM BEYOND)

[প্রভিডেন্সে ঘটা লাভক্র্যাফটের এই প্রথম গল্পটিতে তিনি সায়েন্টিফিক হরর গল্প লেখার চেষ্টা করেছেন। সেই সময়ের ফিজিক্স সম্পর্কে লাভক্র্যাফটের যেটুকু জ্ঞান ছিল তাই নিয়ে তিনি মহাবিশ্বের রহস্যকে নিজের গল্পের মধ্যে ধরেছেন। লাভক্র্যাফটের কসমিক হররেরও এটাই প্রথম দিককার উদাহরণ যেখানে তিনি বুঝিয়েছেন এই মহাবিশ্বের অগণিত আশ্চর্য প্রাণীদের কাছে মানবজাতির অস্তিত্ব একেবারেই তুচ্ছ।]

এ ক-দিনেই কেমন বীভৎসভাবে পালটে গেছে ক্রফোর্ডের চেহারা। চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না।

ক্রফোর্ড টিলিংহাস্ট। আমার এককালের প্রাণের বন্ধু। এর আগে তাকে দেখেছি প্রায় দু আড়াই মাস আগে। সেবার যখন মোলাকাত হয়, তার অতিপ্রাকৃত গবেষণার আসল উদ্দেশ্যের কথা সে দিন খুলে বলেছিল ক্রফোর্ড। কিন্তু আমি ভয়ে আঁতকে উঠে দু-একটা আপত্তি জানাতেই সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল সে। একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে আমাকে বিদায় করেছিল তার ল্যাবরেটরি আর বাড়ি থেকে।

এরপর টুকরোটাকরা খবর এসেছে কানে। সে নাকি তার সেই হতচ্ছাড়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রখানা নিয়ে আস্তানা গেড়েছে চিলেকোঠার ঘরে। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ, চাকরবাকরদেরও ঘেঁষতে দেয় না কাছে।

কিন্তু স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, মাত্র দশ সপ্তাহের মধ্যে ক্রফোর্ডের চেহারাখানা বদলে এমন কুৎসিত কদাকার রূপ নেবে। তার আগের তাগড়াই শরীরটা শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে। ঝুলে-পড়া শিথিল চামড়ায় লেগেছে ধূসর হলদেটে রঙের ছোঁয়া। কালি-পড়া কোটরে বসে-যাওয়া দুই চোখ জ্বলছে কেমন এক বুকে কাঁপুনি-ধরানো দীপ্তিতে। বলিরেখা-পড়া কপালে ডালপালা মেলেছে অজস্র শিরা-উপশিরা। হাত দুখানা বিরামহীনভাবে কেঁপে চলেছে থরথর করে। এককালের পরিষ্কার করে কামানো মুখ ঢেকে গেছে একরাশ সাদা দাড়িতে। সাদা হয়ে গেছে মাথার ঝাঁকড়া চুলের গোড়াগুলোও। পোশাক-আশাক পর্যন্ত আলুথালু, অবিন্যস্ত। সে হতশ্রী চেহারাটার ওপর চোখ পড়লে শিউরে না উঠে উপায় নেই।

মাসকয়েকের বিচ্ছেদের পর ক্রফোর্ডের অসংলগ্ন ভাষায় লেখা চিঠিখানা পেয়ে সে রাতে যখন তার বেনেভোলেন্ট স্ট্রিটের বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন এই কদাকার মূর্তিতেই দর্শন পেলাম তার।

ক্রফোর্ডের হাতে মোমবাতি, সারা শরীর কাঁপছে ঠকঠক করে। আমায় বাড়িরে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বারংবার পেছন ফিরে তাকায় সে। যেন সেই জনমানবহীন সেকেলে বাড়িটায় ওঁত পেতে থাকা অজানা কোনও কিছুর আতঙ্ক চেপে বসেছে তার মনে।

দর্শন আর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করাটা ক্রফোর্ডের আদৌ উচিত হয়নি। ওসব বিষয়ের চর্চা ঠান্ডা মাথার নির্মোহ গবেষকদেরই মানায়। ক্রফোর্ডের মতন কাজ-পাগল, আবেগি মানুষ এসবের মধ্যে মাথা গলালে তার পরিণতি হয় ঠিক দু-রকমের। অসফল হলে নেমে আসে চূড়ান্ত হতাশা, আর সফল হলে সঙ্গী হয় এক অবর্ণনীয়, অকল্পনীয় আতঙ্ক। এত দিন ক্রফোর্ড ছিল তার গবেষণায় অসফল। নিঃসঙ্গতা আর নৈরাশ্য ছিল তার সহচর। কিন্তু আজ তাকে দেখে আতঙ্কে গুলিয়ে উঠল শরীর। বুঝলাম, সাফল্যের কবলে পড়েছে সে।

দশ সপ্তাহ আগেকার কথা মনে পড়ে গেল, যে দিন পইপই করে সাবধান করেছিলাম ক্রফোর্ডকে। কিন্তু সে দিন উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল সে। অস্বাভাবিক উচ্চকণ্ঠে জ্ঞান দিয়েছিল আমায় পণ্ডিতি ঢঙে।

এই পৃথিবী আর ব্রহ্মাণ্ডের আমরা কতটুকুই বা জানি? যেমন সীমিত আমাদের পর্যবেক্ষণক্ষমতা, তেমনি ক্ষুদ্র আমাদের চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে ধারণা। জগৎটাকে বোঝার জন্যে আমাদের শরীরটা গড়ে উঠেছে যেমনভাবে, বিশ্বপ্রকৃতির বিষয়বস্তুগুলো আমারা বুঝি ততটুকুই। তাদের মূল রূপ সম্বন্ধে আমাদের ধারণাই নেই এতটুকুও। বৃথাই আমরা ভাবি, এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের সব গূঢ় রহস্য আমাদের পাঁচটা দুর্বল ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝে ফেলেছি। কিন্তু কল্পনা কর এমন এক শ্রেণির জীবের, যাদের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা আরও গভীর, আরও বিস্তৃত। কিংবা যাদের ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির পরিসরই আলাদা। তারা আমাদের এই চেনা জগৎটাকেও একবারে আলাদা নজরে দেখবে তো বটেই, আমাদের খুব কাছে ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে জড়-চেতনশক্তির যে আর-একটা দুনিয়া আছে, তাকেও তারা সমানভাবে দেখতে পারবে, বুঝতে পারবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সৃষ্টির এই গুপ্ত অংশ লুকিয়ে আছে আমাদের হাতের নাগালেই। আর আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি সেই গুপ্ত জগতের আবরণ উন্মোচন করার পদ্ধতি। না, ঠাট্টা করছি না। ওই যন্ত্রটা দেখছ? চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওর থেকে ছড়িয়ে যাবে তরঙ্গ। মানুষের শরীরে যেসব সুপ্ত, অপরিণত ইন্দ্রিয় আছে, জাগিয়ে তুলবে সেগুলোকে। শুধু মানুষ কেন? যে-কোনও জীবিত প্রাণীর ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরের সব নানান দৃশ্যপট খুলে যাবে আমাদের সামনে। অন্ধকার, যা দেখে কেঁদে ওঠে কুকুরে, মাঝরাতে যা দেখে কান খাড়া করে ফেলে বেড়ালে, দেখতে পাব সেইসব। দেখতে পাব এমন আরও অনেক কিছু, যা আজ পর্যন্ত নজরে পড়েনি কোনও জীবিত প্রাণীর। টপকে যাব স্থান-কাল-মাত্রা, শরীর না নড়িয়েই ডুব দেব সৃষ্টিরহস্যের অতলে।

না, ক্রফোর্ড টিলিংহাস্টের এইসব কথাবার্তায় মোটেও মজা পাইনি আমি। কারণ তাকে চিনতে বাকি ছিল না। তাই উলটে কড়া কড়া কথা শুনিয়েছিলাম তাকে। কিন্তু আবিষ্কারের নেশায় সে তখন পাগল। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল আমায় গলাধাক্কা দিয়ে।

না, আজও তার সেই উন্মাদনা কাটেনি। কেবল আমার ওপর রাগের চাইতেও প্রবল হয়ে উঠেছে আমাকে তার কাজের ফিরিস্তি শোনানোর বাসনা। তাই অপাঠ্য হস্তাক্ষরে লেখা চিঠিতে একরকম হুকুমের ভাষায় ডেকে পাঠিয়েছে আমাকে।

ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে ক্রফোর্ডের প্রেতমূর্তি। বৃত্তের আকারে আলো ফ্যালে তার হাতের মোমবাতি। তার পেছনে বাড়ির অন্দরে পা রেখে এক অজানা ভয় স্পর্শ করে আমাকেও। মনে হতে থাকে, অন্ধকারের আনাচকানাচে কোনও আতঙ্ক বুঝি-বা নিঃশব্দ পদসঞ্চারে পিছু নিয়েছে আমার। আলোর বৃত্তাকার সীমানার বাইরে যেন রূপ ধরে আস্তানা গেড়েছে দশ সপ্তাহ আগে শোনা শব্দ আর কল্পনাগুলো। ক্রফোর্ডের নিস্পৃহ, শীতল কণ্ঠস্বরে মেশে তার সঙ্গে। কেমন গুলিয়ে উঠতে থাকে আমার সমস্ত শরীর।

কাজের লোকগুলো থাকলেও তবু খানিকটা স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু ক্রফোর্ডের কাছে শুনলাম, তারা নাকি বিদায় নিয়েছে দিন তিনেক আগেই। গতবার ক্রফোর্ড খেপে উঠে আমাকে গলাধাক্কা দেওয়ার পর থেকে বুড়ো গ্রেগরিই যা হোক আমাকে কিছু খবরাখবর দিত। কিন্তু সে-ও যে আমার মতন একজন বিপদ-আপদের বন্ধুকে কিছু না জানিয়েই মনিবকে ফেলে পালিয়েছে, সেটা শুনে বড় আশ্চর্য লাগল।

হঠাৎ তলব করার কারণটা সঠিক বুঝতে পারছিলাম না বটে। কিন্তু আন্দাজ করতে পারছিলাম, অচিরেই ক্রফোর্ড আমাকে শোনাতে চলেছে কোনও চমক-লাগানো রহস্য কিংবা আবিষ্কারের কথা। অতএব খানিকক্ষণের মধ্যেই ঘুচে গেল ভয় আর আতঙ্ক। উলটে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল কৌতূহল আর অধীর আগ্রহ। কল্পনার জগতেরও বাইরের বিষয় নিয়ে বেহিসেবি অনুসন্ধানের বিরুদ্ধে দিনকয়েক আগে সরব হয়েছিলাম আমিই। কিন্তু আজ যখন ক্রফোর্ড অনেক মূল্য চুকিয়ে সাফল্যের পথে, তখন তার ওই অদম্য উদ্দীপনা যেন স্পর্শ করল আমাকেও।

ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে ক্রফোর্ডের অমানুষিক চেহারা। দুলতে থাকে তার হাতের মোমের আলো। তার পেছনে পেছনে আমি হাঁটি জনবিহীন বাড়ির অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।

খেয়াল করলাম, বাড়িতে বিদ্যুৎসংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। ক্রফোর্ডকে জিজ্ঞেস করতে উত্তর পেলাম, বিশেষ কারণ আছে।

সাহসে কুলোয়নি… বাড়াবাড়ি হয়ে যেত।

ক্রফোর্ড বিড়বিড় করে বকে চলে আপন মনে। বুঝলাম, এ এক নতুন রোগে ধরেছে তাকে।

পা রাখি ক্রফোর্ডের চিলেকোঠার ল্যাবরেটরিতে। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে সেই হতচ্ছাড়া যন্ত্রটা। গতবারে মৃদু গর্জন তুলে চলতে দেখেছিলাম এটাকেই। কিন্তু এখন দেখলাম, যন্ত্রের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কেমন একটা মরমর, অশুভ, বেগুনি রঙের আলোর প্রভা। একটা রাসায়নিক ব্যাটারির সঙ্গে যন্ত্রটা তার দিয়ে জোড়া রয়েছে বটে, তবে মনে হল না, সেখান থেকে কোনও বিদ্যুৎ আসছে। ক্রফোর্ডকে প্রশ্ন করে জানলাম, ওই বিরামহীন আলোর উৎস নাকি বিদ্যুঞ্জাতীয় কিছুই নয়।

যন্ত্রের একপাশে আমায় বসায় ক্রফোর্ড। যন্ত্রের মাথার ওপরে একথোকা কাচের বাল্ব। চালু করে দেয় তার ঠিক নীচের একটা সুইচ। আগের দিনের মতনই মৃদু গর্জন করে চালু হয়ে যায় যন্ত্র।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে যন্ত্রের গর্জন পালটে যায় তীক্ষ্ণ আর্তনাদে। সে আর্তনাদও খানিক বাদে পরিণত হয় একটা অস্পষ্ট গুঞ্জনে। যন্ত্রের চারপাশের আলোকচ্ছটাও যেন তার সঙ্গে তাল রেখে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেই ফের নিবুনিবু হয়ে আসে। একই সঙ্গে আলোর বর্ণও যায় পালটে। অস্বাভাবিক, বিকট, সেই জগাখিচুড়ি রঙের বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে।

আমার কপালের প্রশ্নের রেখাগুলো বোধহয় ক্রফোর্ডের নজর এড়ায়নি। ভেসে আসে তার অনুচ্চ কণ্ঠস্বর। বুঝতে পারছ না কীসের আলো? আলট্রাভায়োলেট!

বিস্ময়ে চমকে উঠি আমি। খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে ক্রফোর্ড।

কী ভাবছ? আলট্রাভায়োলেট চোখে দেখা যায় না? তা অবশ্য সত্যি! কিন্তু কেবল আলট্রাভায়োলেট কেন, চোখে দেখা যায় না, তেমন অনেক কিছু এবার দেখতে পাবে।

শোনো হে! বহু বছরের বিবর্তনে আলগা ইলেকট্রন থেকে জৈবিক মানুষ হয়ে উঠেছি আমরা। উত্তরাধিকারে পেয়েছি হাজারটা ইন্দ্রিয়। তরঙ্গের প্রভাবে জেগে উঠছে সেসব সুপ্ত ইন্দ্রিয়। যেসব সত্য জেনেছি আমি, এইবার তুমিও জানবে সেইসব। বুঝতে পারছ, কেমন লাগবে? বলছি, দাঁড়াও।

ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিবিয়ে দেয় ক্রফোর্ড। আমার উলটোদিকে বসে আমার চোখের দিকে তাকায় বীভৎস দৃষ্টিতে।

বর্তমান ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে সুপ্ত ইন্দ্রিয়গুলোর একটা নিবিড় সংযোগ আছে। অতএব প্রথমে নানান সংকেত পাবে সেগুলোই। শুরু হবে কান দিয়ে। তারপর পালা আসবে অন্য ইন্দ্রিয়গুলোরও। পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের কথা শুনেছ? ওটা হল ইন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়। নিজে পরখ করে দেখেছি। কাজ করে অনেকটা দৃষ্টিশক্তির মতনই। মস্তিষ্কে ছবি পাঠায়। ওভাবেই প্রমাণ পাবে তুমি। পরপারের প্রমাণ।

চুপ করে যায় ক্রফোর্ড। চারপাশে তাকাই সেই সুযোগে। বিশাল ঘরখানার দক্ষিণের দেওয়ালটা ঢালু। সেটায় পড়েছে এমন একটা ম্লান আলো, যেটা নিত্যদিনের দৃষ্টিতে ধরা পড়ার কথা নয়। ঘরের কোণগুলো ঢাকা পড়েছে ছায়ায়। ঘর জুড়ে কেমন একটা কুয়াশাচ্ছন্ন অপ্রাকৃত পরিবেশ। সে পরিবেশ যেন কল্পনাকে টেনে নিয়ে গেল গূঢ় প্রতীক চিহ্নে মোড়া কোনও এক অশরীরী জগতে। কেমন যেন মনে হতে লাগল, আমি বসে রয়েছি অদ্ভুত এক বিশাল মন্দিরে। তার কালো প্রস্তরস্তম্ভগুলো পাষাণফলকের সিক্ত মেঝে থেকে মেঘ অবধি উঠে হারিয়ে গেছে দৃষ্টির অন্তরালে।

এই স্পষ্ট ছবিখানাও কিছুক্ষণের মধ্যেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ফুটে উঠল আর-এক ভয়ংকর মানসচিত্র। চারপাশে যেন কেবল আদি-অন্তহীন এক নিঃসঙ্গ শূন্যতা। শব্দহীন, দৃশ্যবস্তুহীন সে শূন্যতায় যেন অস্তিত্ব নেই কোনও কিছুরই। শিউরে উঠলাম ছোট শিশুর মতনই। আতঙ্কে পেছনের পকেট থেকে টেনে বের করলাম বহুকালের সঙ্গী পিস্তলখানা।

সেই নিঃসীম শূন্যতার কোনও এক সুদূর প্রান্ত থেকে ধীরগতিতে ভেসে এল অদ্ভুত ধ্বনি। অতি অস্পষ্ট তার আওয়াজ, অতি মৃদু তার কম্পন, অথচ তাকে সুরেলা বলে চিনে নিতে ভুল হয় না। সে ধ্বনিতে মেশানো মাত্রাছাড়া বন্যতা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দিল কেমন একটা হালকা যন্ত্রণা। আনমনে ভাঙা কাচ ঘষলে যেমন অনুভূতি হয়, বোধ করলাম সেইরকম একটা কিছু। সেই সঙ্গে শব্দের উৎস থেকে ভেসে এল হিমশীতল দমকা বাতাস, বয়ে গেল আমার পাশ দিয়ে।

বসে রইলাম নিশ্বাস বন্ধ করে। বুঝতে পারলাম, শব্দ আর বাতাস, প্রকোপ বাড়ছে দুটোরই। মনে হতে লাগল, আমি যেন বাঁধা রয়েছি রেললাইনের সঙ্গে, আর দূর থেকে ছুটে আসছে কোনও দানবিক ইঞ্জিন।

ডাকতে গেলাম ক্রফোর্ডকে। সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল সমস্ত অদ্ভুত অনুভূতি। ঘরের ম্রিয়মাণ আলোয় নজরে পড়ল কেবল ক্রফোর্ড আর তার যন্ত্রখানা। ক্রফোর্ডের দৃষ্টি আমার হাতের পিস্তলের ওপর, মুখে তার রক্ত-জল-করা হাসি।

তার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না যে, আমি যা দেখেছি আর শুনেছি, সে দেখেছে-শুনেছে তার চাইতে ঢের বেশি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতে যেতেই আমাকে থামিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে।

যতটা সম্ভব চুপ করে থেকে বোঝার চেষ্টা করো। আর নড়াচড়াও কোরো না। ভেবো না, ওই যন্ত্রের কিরণে কেবল আমরাই দেখতে পাই। ওর প্রভায় আমাদেরকেও দেখা যায়। চাকরবাকরগুলো বিদেয় হয়েছে তো বলেছি। কিন্তু কী করে তা বলিনি, না? ওই মাথামোটা হাউসকিপার মিসেস আপডাইককে আমি পইপই করে মানা করেছিলাম আলো জ্বালাতে। শোনেনি। একতলার আলো জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের তার আকর্ষণ করে নিয়েছিল অনুরূপ কম্পনকে। ফল হয়েছিল সাংঘাতিক। অন্য এক জগতের শব্দ আর দৃশ্যের মধ্যে ডুবে থেকেও এখান থেকেই শুনতে পেয়েছিলাম মরণ চিৎকার। পরে দেখেছিলাম, সারা বাড়িময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে কেবল জামাকাপড়ের স্তূপ। কেউ নিস্তার পায়নি। মিসেস আপডাইকের জামাকাপড়গুলো সামনের হলঘরের সুইচের কাছে পড়ে ছিল। সেটা দেখেই বুঝতে পারি, আলোটা জ্বালাতে গিয়েছিল সে-ই। নড়াচড়া না করলে খানিকটা নিরাপদে থাকবে। মনে রেখো, যে ভয়ংকর জগৎ আমরা ঘাঁটাঘাঁটি করছি, সেখানে আমরা দুর্বল, অসহায়। বলছি না, নড়াচড়া কোরো না!

সত্যিটা জানতে পেরে আর ক্রফোর্ডের হুকুমের জোড়া ধাক্কায় আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে এল। আতঙ্কের ধাক্কায় খুলে গেল মনের বোঝার ক্ষমতা। ক্রফোর্ড যাকে পরপার আখ্যা দিয়েছিল, ফের মনের মধ্যে ফুটে উঠল সেখানকার অনুভূতিগুলো। মনে হল, শব্দ আর গতির এক আবর্তের মধ্যে আটকে পড়েছি আমি, আমার দৃষ্টি ঢেকে রেখেছে নানান টুকরো টুকরো ছবির বিশৃঙ্খলা। ঝাপসা হয়ে এসেছে ঘরের কিনারাগুলো। দূরের শূন্যতা থেকে সামনে ডানদিকের ছাদ ফুঁড়ে ফেনার মতো উপচে নেমে আসছে মেঘের আকৃতির একটা স্তম্ভ। ফের নজরে ভেসে উঠল আগে-দেখা সেই মন্দিরের আকার। কিন্তু এবার সে মন্দিরের থাম স্পর্শ করেছে অন্তরিক্ষের এক আলোর সাগরকে। আলোর সমুদ্র থেকে একটি আলোকরশ্মি এবার ছিটকে এল একটু আগে দেখা স্তম্ভের দিকে। শব্দ, দৃশ্য আর নানান অজানা অনুভূতির খণ্ডচিত্রের এক বিচিত্র বর্ণময় বিশৃঙ্খলা যেন ছড়িয়ে গেল চারপাশে। মনে হতে লাগল যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমার কঠিন দেহাবয়ব, তরল হয়ে গলে যাচ্ছে আমার শরীর। এর মধ্যেই মনের মধ্যে ফুটে উঠল একঝলক ছবি। অদ্ভুতদর্শন একচিলতে রাতের আকাশ। সে আকাশ ঢাকা ঘুরপাক খেতে থাকা গোলকে, সূর্যের মতনই তারা উজ্জ্বল। ক্রমশ পেছনদিকে সরতে শুরু করে গোলকের ঝাঁক। দূরে গিয়ে রূপ নেয় নক্ষত্রপুঞ্জের। আকার তার ক্রফোর্ডের মুখমণ্ডলের বিকৃত প্রতিচ্ছবির মতন।

খানিক বাদে বুঝলাম, চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে বিশালদেহী সজীব কিছু ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার শরীর। না, কেবল ছুঁয়ে নয়, হেঁটে যাচ্ছে আমার শরীরের মধ্যে দিয়েই। দেখলাম, ক্রফোর্ড তাদের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। মনে পড়ে গেল তার পিনিয়াল গ্ল্যান্ড নিয়ে বলা কথাগুলো। হয়তো তার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো ঠাহর করতে পারছে অনেক বেশি। তার অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিতে যে কী ধরা পড়ছে, সেই প্রশ্নের ঝড় উঠল মনে।

হঠাৎ যেন আমার মধ্যে জেগে উঠল আর-এক পৃথক দৃষ্টিশক্তি। বাড়তি ক্ষমতা তার। আলোছায়ার উথালপাথালের মাঝে এবার দেখতে পেলাম আর-এক দৃশ্য। তার বেশির ভাগটাই ঝাপসা হলেও কিছু অংশ ফুটে রয়েছে পরিষ্কারভাবে। সিনেমার ছবি ভুলক্রমে যবনিকার রঙিন কাপড়ের ওপর পড়লে যেমন দেখতে হয়, চেনা জগতের ওপর সে দৃশ্য চাপানো তেমনভাবেই। চিলেকোঠার ল্যাবরেটরি, বৈদ্যুতিক যন্ত্র, ক্রফোর্ডের কদাকার চেহারা, দৃশ্যের এই কয়েকটা জিনিস অপরিচিত নয় মোটেও। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে বাকি স্থানটুকুতে তিলধারণের জায়গা নেই। সেখানে জানা-অজানা, জড়-চেতন নানান অবর্ণনীয় আকৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এলোমেলোভাবে। প্রতিটি পরিচিত জিনিসের সঙ্গে মিলেছে অজস্র অপরিচিত, অদ্ভুতদর্শন বস্তু। কেবল মিলেছে বললে ভুল হবে, পরিচিতের গঠনে যেন মিশেছে অচেনা বস্তু, অজানা বস্তু যেন গড়ে উঠেছে রোজের চেনা জিনিস দিয়ে১৫।

চেতন বস্তুর মধ্যে যে প্রাণীগুলো সর্বপ্রথম চোখে পড়ে, তাদের কুৎসিত মিশকালো অবয়ব যেন জেলি দিয়ে গড়া। যন্ত্রের কম্পনের সঙ্গে তাল রেখে থিরথির করে কাঁপে তাদের শরীরগুলো। অতুল সংখ্যায় তারা ভেসে বেড়ায় যেন কোনও অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে। পরস্পরের শরীরের মধ্যে দিয়ে অনায়াসে অতিক্রম করে যায় তাদের থলথলে চেহারাগুলো। মাঝেমধ্যে প্রাণীগুলো অতর্কিত আক্রমণে গ্রাস করে পরস্পরকে। আক্রান্ত জীবটি বেমালুম মিলিয়ে যায় কোনওরকম চিহ্ন না রেখেই।

শিউরে উঠলাম আমি, হতভাগা চাকরবাকরগুলো কী করে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। প্রথমবার নজরে আসা আমাদের চারপাশের গোপন জগৎটার বাকি খুঁটিনাটিগুলোও ঠাহর করতে চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল জীবগুলোর চিন্তাই।

এতক্ষণ আমার ওপর নজর রাখছিল ক্রফোর্ড। এবার ভেসে এল তার কণ্ঠস্বর।

দেখছ? ওদের দেখতে পাচ্ছ? তোমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তোমার চারপাশ দিয়ে, তোমার মধ্যে দিয়ে কারা ছিটকে ছিটকে ভেসে বেড়ায়, এবার বুঝতে পারছ? আকাশ, বাতাস– এসব আদতে কোনও প্রাণীতে গড়া, এবার বুঝতে পারছ? এবার বলল, সীমানার প্রাচীর আমি ভেঙে নামিয়েছি কি না? কোনও জীবিত মানুষ এযাবৎ যা দেখেনি, সেইসব জগৎ তোমায় দেখিয়েছি কি না? বলো! বলো!

সেই তুমুল বিশৃঙ্খলার মধ্যে চিৎকার করতে থাকে ক্রফোর্ড, ক্রোধে বিকৃত মুখখানা নিয়ে আসে আমার মুখের কাছে। পুঞ্জীভূত ঘৃণা আর আক্রোশে চোখ দুটো তার জ্বলতে থাকে আগুনের মতন। বিরক্তিকর গুঞ্জন তুলে চলতে থাকে যন্ত্র।

কী ভাবলে? ওই এলোমেলো ভাসতে-থাকা জীবগুলো নিকেশ করেছে চাকরবাকরদের? ওহে বুদ্ধ, ওগুলো নিরীহ। কোনও ক্ষতি করে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও চাকরবাকরগুলো উধাও হয়ে গেছে, তাই না? কী করে বলো তো? তুমি আমায় বাধা দিয়েছিলে। যখন আমার দরকার ছিল প্রচণ্ড উৎসাহের, তখন নিরুৎসাহ করেছিলে তুমি আমায়। সৃষ্টিরহস্যের সত্য তুমি জানতে চাওনি, এত বড় কাপুরুষ তুমি। কিন্তু এইবারে পেয়েছি তোমায়। কীসে তুলে নিয়ে গেছে চাকরগুলোকে? কেন গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েছিল তারা? জানো না, না? কোনও সমস্যা নেই, এখনই জানতে পারবে। তাকাও আমার দিকে। শোনো ভালো করে, কী বলছি। তোমার কী মনে হয়ে বস্তু, আকার– এসবের আদৌ কোনও অস্তিত্ব আছে? ওহে, সৃষ্টির যে গভীরে আমি গিয়েছি, তোমার পুঁচকে মগজখানা তার কল্পনাও করতে পারবে না। অনন্তের গণ্ডির বাইরেটা অবধি দেখতে পেয়েছি আমি। নক্ষত্রলোক থেকে টেনে এনেছি দানবদের। এক-এক পদক্ষেপে জগৎ থেকে জগৎ টপকে যারা মৃত্যু আর মত্ততা বিলোয়, নিজের কাজে লাগিয়েছি সেইসব ছায়াশরীরকে করায়ত্ত করেছি শূন্যতাকে। যারা মানুষকে গ্রাস করে, যাদের স্পর্শে মানুষ বিলীন হয়ে যায়, তারা সব আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বটে, কিন্তু তাদের কী করে এড়াতে হয়, আমার জানা আছে। কিন্তু তুমি পড়বে তাদের খপ্পরে, বুঝেছ? যেমন চাকরগুলো পড়েছিল। দারুণ, না? বলেছিলাম না, নড়াচড়া করাটা বিপজ্জনক। তোমায় এতক্ষণ নড়াচড়া না করতে দিয়েই বাঁচিয়ে রেখেছি। বাঁচিয়ে রেখেছি, যাতে দেখতে পাও আরও অনেক কিছু শুনতে পাও আমার কথা। নড়লে অনেক আগেই ওদের খপ্পরে পড়ে যেতে তুমি। তবে চিন্তা কোরো না। ওরা তোমাকে কোনওরকম যন্ত্রণা দেবে না। চাকরগুলো কষ্ট পেয়ে চিৎকার করেনি, চিৎকার করেছিল ওদের দেখে। আমার পোষ্যরা যে দুনিয়া থেকে আসে, সেখানকার সৌন্দর্যের মাপকাঠি অনেকটা আলাদা। আমাদের চোখে ওদের চেহারাটা তাই বড় একটা সুন্দর ঠ্যাকে না। আমি প্রায় একবার দেখে ফেলেছিলাম ওদের, কোনওমতে সামলে নিয়েছি। কিন্তু আমি চাই, তুমি ওদের দিকে তাকাও। চিন্তা কোরো না, বিলীন হয়ে যাওয়াটা মোটেই যন্ত্রণাদায়ক নয়। আরে, তাকাও-না! জানতে ইচ্ছে করছে না ওদের কেমন দেখতে? সাধে কি বলি, তুমি বৈজ্ঞানিক নও! কাঁপছ? আমার আবিষ্কার-করা অনন্য জীবদের দেখার আগ্রহে কাঁপছ? নড়ছ না কেন তাহলে? ক্লান্ত লাগছে? চিন্তা কোরো না। ওরা এসে পড়ল বলে। দ্যাখো, দ্যাখো! আরে, দ্যাখোই-না! ঠিক তোমার বাঁদিকের কাঁধের পেছনে।

এর বাকি অংশটুকু সংক্ষিপ্ত। খবরের কাগজের কল্যাণে সেটুকুও আপনাদের জানা। গুলির আওয়াজ পেয়ে পুলিশ আসে। দেখে ক্রফোর্ড মৃত, আর আমি পড়ে আছি অচৈতন্য হয়ে। পুলিশ প্রথমে আমায় গ্রেফতার করে, কারণ আমার হাতে পিস্তল ধরা ছিল। কিন্তু অনুসন্ধানের পর যখন দেখা গেল যে, ক্রফোর্ড মারা পড়েছে মৃগীরোগে, আর গুলি লেগে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে কেবল যন্ত্রটা, তখন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই পুলিশ আমায় ছেড়ে দেয়। যা দেখেছি, তার সবটুকু খোলাখুলি প্রকাশ করিনি। মনে হয়েছিল, করোনার হয়তো আমার সেসব কথায় সন্দেহ করবেন। কিন্তু যেটুকু বলেছিলাম, সেটুকু শুনে ডাক্তারটি রায় দিয়েছিলেন যে, খুনে পাগল ক্রফোর্ড নিঃসন্দেহে আমায় কোনওভাবে সম্মোহন করেছিল।

ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করতে পারলে আমার ভালোই হত। চারপাশের আকাশ বাতাসের কথা ভাবলেই মনে যে চিন্তাগুলো উঠে এসে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় প্রতিটি স্নায়ুতে, তার থেকে অন্তত রেহাই পাওয়া যেত। আমি যে একা আছি, আমার সে বোধ চলে গেছে। চলে গেছে সব রকমের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। ক্লান্ত হয়ে পড়লে মনে হয়, ভয়ংকর কিছু তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমায়। কিন্তু তা-ও ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করতে পারি না একটিমাত্র কারণে– যে চাকরবাকরগুলোকে ক্রফোর্ড টিলিংহাস্ট খুন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়, তাদের দেহগুলো আজ পর্যন্ত পুলিশ খুঁজে পায়নি।

[প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৪ সালের জুন মাসে গল্পটি দ্য ফ্যান্টাসি ফ্যান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।

 ভাষান্তর: সুমিত বর্ধন]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *