ডেগন

ডেগন (DAGON)

[ডেগন শুধু লাভক্র্যাফটের প্রথম দিকের রচনাই নয়, এই গল্পেই প্রথম কথুলু মিথোসের বীজ বপন করা হয়। ডেগনের কথা এর পরেও বহু গল্পে লাভক্র্যাফট এনেছেন। স্বীকারক্তি, সুইসাইড নোট, প্যারানয়া, প্রাচীন অপার্থিব দেবতা, অজানার আতঙ্ক লাভক্র্যাফটের নিজস্ব ঘরানার ছাপ এই গল্পের পাতায় পাতায়।]

চূড়ান্ত মানসিক চাপের মধ্যে এই কথাগুলো লিখছি। কারণ আজ রাতের পর এ জীবন আমি আর রাখব না। টিকে থাকার জন্যে যে ওষুধ আমাকে কিছুটা স্বস্তি দিত, ফুরিয়ে এসেছে তার ভাঁড়ার। নিঃশেষ হয়ে গেছে আমার শেষ কপর্দকটুকুও এই যন্ত্রণা সহ্য করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই নিচের নোংরা রাস্তায় চিলেকোঠার জানলা থেকে ঝাঁপ দেব একটু বাদেই।

ভাববেন না যে আমি দুর্বল হৃদয় কিংবা পাগল। সে আমার যতই মরফিনের নেশা থাকুক না কেন। এই যে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা লাইন লিখছি, এগুলো পড়ে হয়তো সমস্তটা বুঝবেন না। কিন্তু কিছুটা অন্তত আন্দাজ করতে পারবেন ঠিক কী কারণে স্মৃতিলোপ বা মৃত্যু, এ দুটোর একটা পথ বেছে নেওয়া আমার জন্যে কেন এত জরুরি ছিল।

মাল সরকারের দায়িত্ব নিয়ে জাহাজে চড়ে যাত্রা করছিলাম। বিস্তীর্ণ প্রশান্ত মহাসাগরের এক অকূল নির্জন অঞ্চলে জার্মান হানাদারের খপ্পরে পড়ল আমাদের জাহাজ। মহাযুদ্ধ তখন সবে শুরু হয়েছে। জার্মান নৌসেনারা তখনও তাদের যুদ্ধের শেষবেলার হতাশা এবং মানসিক অধঃপতনে একেবারে ডুবে যায়নি। জাহাজখানা তারা যুদ্ধের পারিতোষিক হিসেবে দখল করল বটে, কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের প্রতি যে ন্যায্য, ভদ্র আচরণ প্রাপ্য, তাদের আচরণ হল সেরকমই। তাদের ঢিলেঢালা নিরাপত্তার সুযোগ নিয়ে একলা একটা নৌকোয় চড়ে পালালাম ধরা পড়ার পাঁচদিন বাদেই। সঙ্গে নিলাম বেশ কিছুদিন চলার মতো জল আর খাবার।

মুক্তি পেয়ে নৌকো নিয়ে যখন ভাসলাম, তখন ঠিক কোথায় রয়েছি তার বিন্দুবিসর্গ জানতাম না। নাবিকদের মতো দিক নির্ণয় করার ক্ষমতাও আমার ছিল না কোনওদিন। আকাশের তারা আর সূর্যের গতিবিধি থেকে আন্দাজ করতে পারছিলাম যে রয়েছি বিষুবরেখার দক্ষিণে কোথাও। তবে ঠিক কোন দ্রাঘিমাংশে তা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। চোখে পড়েনি কোনও দ্বীপ বা উপকূলের রেখাও।

আশা করেছিলাম হয়তো কোনও জাহজের নজরে পড়ব, অথবা পৌঁছে যাব টিকে থাকার মতন কোনও সমুদ্রতটে। সমুদ্রের পরিষ্কার আবহাওয়ায় জ্বলন্ত সূর্যের নিচে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভাসতে ভাসতে কেটে গেল না-গোনা অনেকগুলো দিন। এ ক-দিনে না কোনও জাহাজ চোখে পড়ল, না ডাঙার চিহ্ন দেখতে পেলাম। সেই বিরামহীন নীল উত্তাল বিশালতার মাঝে একাকীত্ব গ্রাস করল আমায়, ক্রমশ মুষড়ে পড়তে লাগলাম আমি।

অবস্থা যখন পালটালো তখন আমি ঘুমিয়ে। স্বপ্নতাড়িত এক ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে সে সময় একনাগাড়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি আমি। তাই ঠিক কী হয়েছিল জানার এখন আর কোনও উপায় নেই। ঘুম ভেঙে দেখলাম আঠালো পাঁকে শরীরের অর্ধেক ডুবে রয়েছে আমার। আর চারপাশে ভয়ানক ঊর্মিমালার মতো চেহারা নিয়ে দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কৃষ্ণকালো, পঙ্কিল, এক নারকীয় প্রান্তর। একটু দূরে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে আমার নৌকোটা।

.

ভাবছেন হয়তো এইরকম অপ্রত্যাশিত অদ্ভুত দৃশ্যপট পরিবর্তনে আমি একেবারে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। না হইনি। বরং সেখানকার পচা জমি আর হাওয়ায় মিশে ছিল এমন এক অশুভ ইঙ্গিত যে বিস্ময় নয়, আতঙ্ক গ্রাস করেছিল আমায়। হিম হয়ে এসেছিল অন্তরাত্মা। অন্তহীন সেই পূতিগন্ধময় প্রান্তরের চারপাশে ছড়িয়ে পচাগলা মাছ। জঘন্য পাঁক থেকে ইতস্ততঃ উঁচিয়ে রয়েছে অবর্ণনীয় অন্যান্য জীবদেহ। যেদিকে দু-চোখ যায় কেবল আঠালো কালো পাঁক ছাড়া আর দেখার কিছু নেই, কান পাতলে শোনা যায় না কোনও শব্দও। মাথার ওপরে সূর্য আগুন ঝরাচ্ছে যে নির্মেঘ নিষ্ঠুর আকাশ থেকে, তার রংও নিচের জলাভূমির মতনই কালো। সে ঊষর ব্যাপ্তি আর নিথর নীরবতার বীভৎসতাকে বর্ণনা করি এমন সাধ্য আমার নেই। অখণ্ড নিস্তব্ধতায় মোড়া বৈচিত্রহীন সেই দৃশ্যপটের আতঙ্কে নাড়ি উলটে আসছিল আমার।

শরীরটাকে টেনে নৌকোয় নিয়ে যেতে যেতে কী ঘটেছে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। কোনও এক অভূতপূর্ব ভূস্তরীয় উপদ্রবে জলের অতল গভীরতায় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ডুবে থাকা সমুদ্রের তলদেশের একাংশ ছিটকে উঠে এসেছে ওপরে। বুঝলাম এই নবীন ভূখণ্ডের ব্যাপ্তি অতিবিশাল। কারণ বহু চেষ্টা করেও সমুদ্রের ক্ষীণতম আওয়াজটুকু আমার কানে এল না। চোখে পড়ল না মাছের দেহাবশিষ্টের লোভে উড়ে আসা কোনও সামুদ্রিক পাখিও। সূর্যের তাপ বাঁচিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্তভাবে বসে রইলাম কাত হওয়া নৌকোর এক চিলতে ছাওয়ায়।

কয়েক ঘণ্টা বাদে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে লাগল, জমির আঠালো চটচটে ভাবটা শুকিয়ে আসছে। হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই হাঁটাচলার মতন উপযুক্ত হয়ে উঠবে। সে রাতে ভালো করে ঘুমোলাম না। সমুদ্রতীরে পৌঁছতে পারলে হয়তো উদ্ধারের একটা সম্ভাবনা থাকে। তাই পরের দিন ঝোলায় জল আর খাবার বেঁধে নিয়ে নিখোঁজ সমুদ্রের সন্ধানে বেরনোর জন্যে তৈরি হয়ে রইলাম।

তিনদিনের দিন সকালে দেখলাম মাটি শুকিয়ে বেশ শক্ত হয়ে গেছে, অনায়াসে হাঁটা যায়। মাছের দুর্গন্ধে যদিও পাগল হওয়ার জোগাড়, তাকে বিশেষ আমল দিলাম না, আমার মাথায় তখন অন্য দুশ্চিন্তা। বুক বেঁধে পা চালালাম অজানার উদ্দেশে।

উঁচুনিচু ঊষর প্রান্তের পশ্চিম দিকে একটা উঁচু টিলা চোখে পড়েছিল, সারাদিন হাঁটলাম সেইটে লক্ষ করে। তবে পৌঁছতে পারলাম না। রাতটুকু জিরিয়ে নিয়ে ফের হাঁটা শুরু করলাম পরের দিন। তবে সেদিনও মনে হল না পাহাড়টার ধারে কাছে পৌঁছতে পেরেছি।

অবশেষে চতুর্থ দিন সন্ধেবেলা এসে পৌঁছলাম পাহাড়ের গোড়ায়। দেখলাম যা ভেবেছিলাম পাহাড়টার উচ্চতা তার চাইতে অনেক বেশি। সামনের একটা উপত্যকার জন্যে সেটাকে প্রান্তরের বুকে বেশি স্পষ্ট দেখায়। ক্লান্তিতে পাহাড়ে চড়ার ক্ষমতা ছিল না, তাই সেদিনের মতো নিদ্রা গেলাম তার ছায়াতেই।

সে রাতে কেন ভয়ানক সব দুঃস্বপ্ন দেখলাম জানি না। তবে ঘেমে নেয়ে যখন ঘুম ছুটে গেল, তখন পুব প্রান্তরের অনেক ওপরে উঠে এসেছে কৃষ্ণপক্ষের বিশাল ক্ষয়টে চাঁদ। বুঝলাম আর ঘুম হবে না, যা সব স্বপ্ন দেখেছি, তারা ধাক্কা আর দ্বিতীয়বার সহ্য করতে পারব না।

চাঁদের আলোয় যা দেখলাম তাতে বুঝলাম আমার দিনেরবেলায় যাত্রা করাটা বোকামি হয়েছে। রোদের তাপ না থাকলে আমার এত শক্তিক্ষয় হত না। সত্যি বলতে কি সূর্যাস্তের সময় যে পাহাড়ে চড়াটাকে ভয় পাচ্ছিলাম, মনে হল সেটা এবার অনায়াসে করে ফেলতে পারি। ঝোলাটা তুলে নিয়ে পাহাড়ে চড়তে আরম্ভ করলাম শিখর লক্ষ করে।

আগেই বলেছি প্রান্তরের বৈচিত্রহীনতা আমার ওপর কেমন একটা আতঙ্কের ছাপ ফেলেছিল। কিন্তু পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে সে আতঙ্ক বেড়ে গেল বহুগুণ। দেখলাম পাহাড়ের নিচে এক অতলস্পর্শী খাদ। চাঁদের আলো তখনও স্পর্শ করেনি তার গভীরতার জমাট বাঁধা অন্ধকার। মনে হলে যেন দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর অন্তিম কিনারায়, যার পরে রাজত্ব শুরু হয়েছে অনন্ত রাত্রির অরাজকতার। মনে ভেসে উঠল প্যারাডাইস লস্ট আর নিরাকার অন্ধকারের রাজ্যে শয়তানের ভয়ানক উত্থানের অদ্ভুত সব আতঙ্ক জড়ানো স্মৃতি।

চাঁদ আকাশের আরও কিছুটা ওপরে উঠে আসতে দেখলাম সামনের উপত্যকার উতরাই যতটা খাড়া ভেবেছিলাম ততটা নয়। উঁচিয়ে থাকা পাথর আর কার্ণিশ ধরে অনায়াসে নিচে নামা যায়। শখানেক ফুটের পর ঢালের খাড়াইও অনেক কম।

মাথায় কি ভূত চাপল জানি না, হাঁচড়পাঁচড় করে পাথর বেয়ে নেমে এসে দাঁড়ালাম নিচের ঢালের ওপর। তার নিচের পাতালজোড়া অন্ধকারে তখনও আলো এসে পড়েনি।

দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই নজর গেল উলটোদিকের ঢালের একটা অদ্ভুত জিনিসের দিকে। আমার থেকে প্রায় একশো গজের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বিশাল কোনও বস্তু৷ চাঁদের আলোয় সাদা ঝকঝক করছে তার চেহারা। নিজের মনকে প্রথমে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলাম, যে সেটা বৃহৎ আকারের একটা পাথর বই আর কিছু নয়। তার গড়ন আর অবস্থান দেখে তাও কেমন যেন মনে হতে লাগল যে সেটা হয়তো প্রকৃতির হাতে সম্পূর্ণ গড়া নয়।

কিন্তু জিনিসটাকে খুঁটিয়ে দেখার পরে মনের ভেতর যে সব ভাবের উদ্রেক হল তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। বস্তুটি আয়তনে অতিবিশাল। দাঁড়িয়ে সেটা এমন এক পাতাল করে যা অতল সাগরজলে নিমজ্জিত ছিল লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। অথচ বুঝতে অসুবিধে হয় না সেটা একটা শিলাস্তম্ভ। আর তার সুগঠিত আকার এককালে যারা গড়ে তুলেছে, কিংবা হয়তো আরাধনা করেছে, তারা অতি অবশ্যই কোনও জীবন্ত, বুদ্ধিমান প্রাণী।

ভয়ের সঙ্গে যোগ হল কেমন একটা অবিশ্বাসের ঘোর। বৈজ্ঞানিক কিংবা প্রত্নত্বাত্তিকদের মতো উত্তেজিতও হয়ে পড়লাম কিছুটা। আরও একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। চাঁদ উঠে এসেছে প্রায় মাথার ওপরে। তার অদ্ভুত উজ্জ্বল আলো পড়েছে খাদের খাড়া দেওয়ালের ওপর। সে আলোয় দেখলাম সামনে ছড়িয়ে রয়েছে প্রশস্ত জলস্তর, তার দু প্রান্ত এঁকেবেঁকে হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। আমার পায়ের কাছে ছলছল করছে তার মৃদু তরঙ্গ, আর খাদের উলটোদিকে সেই জলের ঢেউ ধুইয়ে দিচ্ছে বিশাল শিলাস্তম্ভের পাদদেশ।

শিলাস্তম্ভের গায়ে এবার নজরে পড়ল শিলালেখ আর অপটু শৈলিতে খোদাই ভাষ্কর্য। শিলালেখের অদ্ভুত দর্শন সেই হাইরোগ্লিফিক লিপি আমি আগে কখনও দেখিনি কিংবা বইতেও পড়িনি। তার বেশির ভাগ অক্ষরই যেন মাছ, তিমি, কাঁকড়া, ঝিনুক, অক্টোপাস ইত্যাদি জলজ প্রাণীর প্রতীকি রূপ। আরও দু-একটা অক্ষরে চেহারা নিয়েছে এমন কিছু প্রাণীর যারা আজকের যুগে অজানা, কিন্তু যাদের পচন লাগা শরীরগুলো আমি আগেই দেখেছি প্রান্তরের পাঁকে পড়ে থাকতে।

প্রকাণ্ড ভাস্কর্যগুলোও জলের এপার থেকেও অনায়াসে দেখা যাচ্ছিল। হতভম্ব হয়ে গেলাম তাদের ওপর চোখ পড়তেও। পাথর কুঁদে বাস-রিলিফে গড়া সেসব প্রস্তর শিল্পের বিষয়বস্তু দেখলে প্রখ্যাত ভাষ্কর ডোরে পর্যন্ত ঈর্ষায় জ্বলতেন৷ মূর্তিগুলো বোধহয় মানুষের, অথবা বলা ভালো মানুষের আদলের কোনও প্রাণীর। কোনও এক সামুদ্রিক গুহার জলে তারা খেলে বেড়ায় মাছের মতন, অথবা উপাসনা করে কোনও জলমগ্ন শিলাস্তম্ভের। তাদের চেহারার বিশদ বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করব না, কারণ সে সব কথা মনে পড়লেই মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। অবয়বের গঠন তাদের অনেকটা মানুষের মতো হলেও হাত পায়ের আঙুল তাদের হাঁসের মতন জোড়া, ড্যাবড়েবে, চকচকে দুই চোখের নিচে বসানো একজোড়া চওড়া থলথলে ঠোঁট। তাদের চেহারার বাকি সব বিশেষত্বের কথা মনেও আনতে চাই না। পো কিংবা বুলওয়ার তাঁদের দুঃস্বপ্নেও সেইরকম বীভৎসতা কল্পনা করতে পারতেন না।

তবে একটা ব্যাপারে একটু খটকা লাগল। মনে হলে পাথর কুঁদে গড়ার সময় পেছনের দৃশ্যপটের অনুপাত অনুযায়ী প্রাণীগুলোর আয়তন যথাযথ রাখা হয়নি। একটা ভাষ্কর্যে লক্ষ করলাম একটা প্রাণী তিমি শিকার করছে, কিন্তু আয়তনে তিমিটা তার চাইতে সামান্যই বড়। ওই আয়তন আর কিম্ভুত চেহারা থেকেই কয়েক লহমায় সিদ্ধান্ত করলাম প্রাণীগুলো খুব সম্ভব কোনও কল্পিত দেবতার রূপ। তাদের উপাসনা করত যে সব প্রাগৈতিহাসিক সমুদ্রচারী কিংবা মৎসজীবি উপজাতিরা, পিল্টডাউন মানব কিম্বা নিয়েনডারথালের প্রথম পুরুষ জন্ম নেওয়ার বহু আগেই হয়তো লুপ্ত হয়ে গেছে তাদের শেষ বংশধরেরা।

কোনও দুঃসাহসিক নৃতত্ত্ববিদেরও কল্পনাতীত এক অতীতের এই অপ্রত্যাশিত দর্শন পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চিন্তামগ্ন হয়ে। সামনের শব্দহীন জলে তখন অদ্ভুত সব ছায়া ফেলছে চাঁদের আলো।

তখনই দেখলাম তাকে। কালো জলে অতি সামান্য আলোড়ন তুলে উঠে এল জীবটা। বিশালাকায়, বীভৎস চেহারা তার, যেন সাক্ষাৎ পসেইডন পুত্র পলিফেমাস। কোনও এক দুঃস্বপ্নের দানবের মতন ছিটকে গিয়ে আঁশে ঢাকা দুই হাতে শিলাস্তম্ভটাকে জড়িয়ে ধরল সেটা। ভয়ানক মাথাটা ঝুঁকিয়ে চিৎকার করে উঠল মাপা আওয়াজে।

ঠিক তখনই বোধহয় আমার মাথাটা বিগড়ে যায়।

আমার উন্মত্তের মতন খাদের চড়াই বেয়ে ওঠার কথা, কিম্বা প্রলাপ বকতে বকতে নৌকো অবধি পৌঁছনোর কথা বিশেষ মনে নেই। কেবল মনে আছে গান গাইছিলাম গলা ছেড়ে, আর তা না পারলে হাসছিলাম আপন মনে। আর মনে আছে নৌকোয় পৌঁছনোর কিছুক্ষণ বাদেই এক প্রলয় তুফানের কথা। সে তুফানের বাজের আওয়াজ আর প্রকৃতির প্রমত্ততার অন্যান্য শব্দের কথাও ভুলিনি এখনও।

ঘোর যখন কাটল তখন আমি সান ফ্রান্সিসকোর এক হাসপাতালে। মাঝ সমুদ্র থেকে যে জাহাজ আমাকে উদ্ধার করে তার ক্যাপ্টেনই আমাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে যায়। প্রলাপের ঘোরে আমি নাকি অনেক কিছুই বলেছিলাম, কিন্তু সেসব কথায় কান দেয়নি কেউই।

প্রশান্ত মহাসাগরে কোন ভূ-প্রলয়ের কথা আমার উদ্ধারকারীরা শোনেনি। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না জেনে আমিও আর বেশি ঘাঁটাইনি। একবার এক স্বনামধন্য এথনোলজিস্টকে খুঁজে বের করে তাঁকে প্রাচীন ফিলিস্টিনদের মৎস দেবতা ডেগনকে নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করেছিলাম। দেখলাম তিনি আমার কথায় কেবল আমোদই পাচ্ছেন। আমিও তাঁর চিন্তাভাবনা একবারেই গতানুগতিক দেখে আর কথা বাড়াইনি।

কিন্তু রাতের বেলায়, বিশেষত কৃষ্ণপক্ষের আকাশে যখন সামান্য ক্ষয়লাগা চাঁদ ওঠে, তাকে আমি দেখতে পাই। মরফিন ব্যবহার করে দেখেছিলাম স্বস্তি মিলেছে সামান্যই। উলটে দাস হয়ে পড়েছি এই কালান্তক নেশার। তাই শেষ করে দিতে চলেছি সব। যদিও জানি যা লিখেছি তা পড়ে মানুষ হয়তো ব্যঙ্গ করবে, নাক ওলটাবে।

প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করি, জার্মান যুদ্ধ জাহাজ থেকে পালিয়ে অনাবৃত নৌকোয় যখন রোদ লেগে জ্বরের ঘোরে পড়েছিলাম, সে সময় সমস্তটা কল্পনা করিনি তো? প্রশ্ন করি বটে নিজেকে, কিন্তু উত্তরে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে প্রায় জীবন্ত এক ভয়ানক ছবি। গভীর সমুদ্রের কথা কল্পনা করলেই মনে হয় সেই জীবগুলো বোধহয় তার তলদেশের কাদায় লেপটে বেড়াচ্ছে। হয়তো উপাসনা করছে তাদের প্রাচীন প্রস্তর মূর্তির। কিম্বা জলমগ্ন গ্রানাইটের শিলাস্তম্ভে ফুটিয়ে তুলছে নিজেদের বীভৎস অবয়ব। দুঃস্বপ্ন দেখি কোনও একদিন তারা উঠে আসবে সমুদ্র তরঙ্গের ওপরে, দূষিত নখরপিঞ্জরে বিঁধে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মানবজাতিকে টেনে নিয়ে যাবে পাতালে। সেইদিন, যেদিন জগৎজোড়া প্রলয়ের মাঝে ভূপৃষ্ঠ যাবে ডুবে, উঠে আসবে সমুদ্রের কালো কুৎসিত তলদেশ।

শেষের সেই সময় ঘনিয়ে এসেছে। দরজায় কার যেন আওয়াজ পাচ্ছি! যেন কোনও পিচ্ছিল শরীর ধীর ভারী পদক্ষেপে ধাক্কা দিচ্ছে তাতে। ওঃ ভগবান ওই হাতটা! জানলা! জানলাটা কোথায়!

[প্রথম প্রকাশ: ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে গল্পটি দ্য ভ্যাগর্যান্ট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে লেখাটি বিখ্যাত পাল্প ম্যাগাজিন উইয়ার্ড টেলস-এও ছাপা হয়।

ভাষান্তর : সুমিত বর্ধন]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *