২.১১ এলিফ কোথায় আছে

২.১১

“এলিফ কোথায় আছে জানো?”

কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো ইউরি। “ওকে খুঁজছে কেন?”

 “বিশেষ কোন কারণ নেই। এই একটু পরিচিত হতে চাচ্ছিলাম। এখানকার সব রোগিদের সাথেই তো জানাশোনা রাখা দরকার, নাকি?”

চেহারা থেকে সন্দেহ দূর হলোনা ইউরির। “ঠিক আছে। তবে কথা না বললে আবার কিছু মনে করে বসোনা। ওর মেজাজ মর্জির কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কিছুক্ষণ আগেই আর্ট থেরাপি সেশন শেষ হয়েছে। এখন খুব সম্ভবত বিনোদন কক্ষে তাকে পাবে।”

“ধন্যবাদ।”

বিনোদন কক্ষটা মূলত বিশাল গোলাকার একটা কামরা। ভেতরে পুরনো কাউচ, নিচু টেবিল আর তাকভর্তি পুরনো বই। সার্বক্ষণিক পানসে চা-পাতা আর তামাকের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। আমার ধারণা আসবাবপত্রগুলোই এই গন্ধের উৎস। ভেতরে ঢুকে দেখি দুইজন রোগী পেছনে ব্যাকগ্যামন খেলছে। পুল টেবিলের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছে এলিফ। হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম।

“হ্যালো, এলিফ।”

ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সে। “কি?”

 “ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একটু কথা বলতে এসেছি।”

 “তুমি তো আমার ডাক্তার না।”

“আমি ডাক্তার নই, সাইকোথেরাপিস্ট।”

 নাক দিয়ে ঘোঁত শব্দ করলো এলিফ। “আমার একজন সাইকোথেরাপিস্টও আছে।”

মুখের হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেছি এখনও। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম যে এলিফ ইন্দিরার রোগি, আমার নয়। এলিফের কাছাকাছি দাঁড়ালে তাকে আরো ভয়ঙ্কর লাগে। শুধু তার আকৃতির জন্যে নয় কিন্তু, বরং ওর চেহারাতেই সদা বিরক্ত আর মেজাজী একটা ভাব আছে। চোখের দৃষ্টিও স্বাভাবিক নয়। শরীর থেকে সবসময় ঘাম আর হাতে বানানো সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়। একটার পর একটা সিগারেট টানতেই থাকে।

সেকারণে আঙুলগুলো কালচে হয়ে গেছে, দাতে আর নখে হলদেটে ভাব।

“তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করতাম।”

 ভ্রু কুঁচকে গেল এলিফের। পুল খেলার লাঠিটা শব্দ করে টেবিলের নামিয়ে রেখে পরবর্তী গেমের জন্যে বলগুলো গোছাতে শুরু করলো। এরপর হঠাৎই থেমে গেল কি মনে করে। কিছু একটা ভাবছে।

“এলিফ?”

কোন জবাব দিল না। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কিছু একটা ঠিক নেই। “তুমি কি কিছু একটা শুনতে পাচ্ছো, এলিফ?”

সন্দেহ ফুটলো এলিফের দষ্টিতে। কাধ ঝাঁকানো একবার।

 “কি বলছে কণ্ঠগুলো?”

“বলছে তুমি নিরাপদ নও। তোমার থেকে সাবধানে থাকতে।”

“বেশ। ঠিকই বলছে কিন্তু। তুমি তো আমাকে চেনো না, তাই ভরসাও করতে পারছে না। হয়তো সময়ের সাথে সাথে আমাদের সম্পর্কটা আরো ভালো হবে, এ ব্যাপারে আশাবাদী আমি।”

এলিফের চেহারা দেখে মনে হলো না কথাটা বিশ্বাস করেছে সে।

“এক গেম হয়ে যাবে নাকি?” পুল টেবিলের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম।

“না।”

“কেন?”

 আবারো কাঁধ ঝাঁকালো এলিফ। “অন্য কিউটা এখনও ভাঙা।”

“কিন্তু আমরা দু’জন তো চাইলে তোমারটা দিয়েই খেলতে পারি।”

কিউটা টেবিলের ওপর রাখা। ওটার দিকে হাত বাড়াতে যাবো এমন সময় টান দিয়ে সেটা সরিয়ে নিল এলিফ। “এটা আমার কিউ? খেলতে হলে নিজেরটা নিয়ে এসো!”

পেছনে সরে এলাম, এতটা ক্ষেপে যাবে বুঝিনি। একা একাই খেলতে শুরু করলো সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার খেলা দেখলাম কিছুক্ষণ। এরপর আবারো চেষ্টা করলাম কথা বলার।

 “অ্যালিসিয়া প্রথম গ্রোভে ভর্তি হবার সময়কার একটা ঘটনা জানতে চাইছি। মনে আছে তোমার?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল এলিফ।

“ফাইলে পড়েছি যে ক্যান্টিনে কী যেন সমস্যা হয়েছিল তোমাদের মধ্যে। বোধহয় ব্যথা পেয়েছিলে?”

“ওহ হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল ও, তাই না? গলা কেটে ফেলতে চাইছিল।”

“একজন নার্স নাকি তোমাকে দেখেছিল অ্যালিসিয়ার উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে কিছু বলতে। কি এমন বলেছিলে সেটাই ভাবছিলাম।”

 “না।”জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো এলিফ। “কিছুই বলিনি আমি।”

“আমি কিন্তু বলছি না যে অ্যালিসিয়াকে উসকে দিয়েছো তুমি। কেবলমাত্র একটু কৌতূহলী বলতে পারো। কি বলেছিলে?”

“হ্যাঁ, একটা প্রশ্ন করেছিলাম। তাতে কি হয়েছে?”

 “কি প্রশ্ন করেছিলে?”

 “জিজ্ঞেস করেছিলাম যে শাস্তিটা তার প্রাপ্য ছিল কি না।”

 “কার?”

“আরে ওই যে, ঐ লোকটার।” হাসার চেষ্টা করলো এলিফ।

“অ্যালিসিয়ার স্বামীর কথা বলছো?” ইতস্তত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম। “তুমি অ্যালিসিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলে তার স্বামীর খুন হওয়াটা প্রাপ্য ছিল কিনা?”

মাথা নেড়ে সায় দেয় এলিফ। “আর জিজ্ঞেস করেছিলাম যে গুলি করার পর তার চেহারাটা কেমন হয়েছিল, মগজ বের হয়ে এসেছিল কিনা।” আগের চেয়েও জোরে হেসে উঠলো এবারে।

বিতৃষ্ণায় ছেয়ে উঠলো মন, আমি নিশ্চিত অ্যালিসিয়াও এরকমই অনুভব করেছিল সেসময়। এলিফ যে কারো ভেতরে ঘৃণা আর রাগ জাগিয়ে তুলবে-এটাই তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। তার মা নিশ্চয়ই ছোটবেলায় এরকম ব্যবহারই করতো তার সাথে। তাই এলিফ অবচেতন মনেই মানুষের মনে ঘৃণার উদ্রেক ঘটায়। অনেকাংশে সফলও হয়।

“আর এখন অ্যালিসিয়ার সাথে সম্পর্ক কেমন তোমার? ভালো?”

 “হ্যাঁ, একদম। আমার জানের বান্ধবী ও,” আবারো হাসলো এলিফ।

জবাবে কিছু বলার আগেই টের পেলাম যে ফোন বাজছে পকেটে। বের করে দেখি অপরিচিত একটা নম্বর থেকে কল এসেছে।

“ফোনটা ধরতে হবে আমাকে। কথা বলার জন্যে অনেক ধন্যবাদ, এলিফ।”

জবাবে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বিড়বিড় করে আবারো খেলায় মনোযোগ দিল এলিফ।

***

করিডোরে বেরিয়ে এসে কলটা রিসিভ করলাম। “হ্যালো?”

“থিও ফেবার?”

 “জি। কে বলছেন?”

 “ম্যাক্স বেরেনসন, কয়েক দিন আগে ফোন দিয়েছিলেন আপনি।”

“ওহ, হ্যাঁ। ধন্যবাদ মনে করে কল দেয়ার জন্যে। আপনার সাথে অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কিছু কথা ছিল আমার।”

“কেন? কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”

“না, মানে, ওরকম কিছু না। আমি তার চিকিৎসার ব্যাপারটা দেখছি এখন। সেজন্যেই কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। যখন আপনার সময় হয় আরকি।”

“ফোনে সাড়া যায় না আলাপটা? আমি একটু ব্যস্ত আছি এই ক’দিন।”

 “সামনাসামনি দেখা করে কথা বললেই ভালো হতো।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওপাশে বিড়বিড় করে অন্য কারো উদ্দেশ্যে কিছু বললেন ম্যাক্স বেরেনসন। “কাল সন্ধ্যা সাতটায়, আমার অফিসে।”

ঠিকানা জিজ্ঞেস করার আগেই ফোন কেটে দিল লোকটা।

.

২.১২

ম্যাক্স বেরেনসনের রিসিপশনিস্টের বেশ বাজে রকমের ঠাণ্ডা লেগেছে। একটা টিস্যু হাতে নিয়ে নাক ঝেড়ে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলল আমাকে।

“ফোনে কথা বলছে মি, বেরেসন। এক মিনিট বসুন।”

মাথা নেড়ে ওয়েটিং এরিয়াতে একটা সিটে বসে পড়লাম। চেয়ারগুলো বিশেষ সুবিধার নয়, পিঠ সোজা করে রাখতে হয়। এক পাশে কফি টেবিলের ওপর বেশ কয়েকটা পুরনো পত্রিকা রাখা। সব ওয়েটিং রুমের চেহারাই বোধহয় একইরকম হয়, ভাবলাম। এই জায়গাটাকে অনায়াসে কোন ডাক্তারের চেম্বার বা ফিউনারেল হোমের ওয়েটিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

হলওয়ের অন্যপ্রান্তের দরজাটা খুলে গেল কিছুক্ষণ পর। সেখান থেকে মাথা বের করে আমাকে ডাকল ম্যাক্স বেরেসন। উঠে এগিয়ে গেলাম সেদিকে।

ফোনের ওরকম কাঠখোট্টা কথাবার্তা শুনে ভেবেছিলাম আলাপচারিতা খুব একটা সুবিধার হবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রথমেই দুঃখপ্রকাশ করলো সে।

“ফোনে ঠিকমতো কথা বলতে পারিনি দেখে কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। খুবই ব্যস্ত একটা সপ্তাহ গিয়েছে, আমার শরীরটাও ভালো না। বসুন।”

 ডেস্কের উল্টোদিকের চেয়ারগুলোয় একটায় বসে পড়লাম। “ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও দেখা করতে রাজি হবার জন্যে ধন্যবাদ।”

“দেখা করবো কি না সে বিষয়ে সন্দিহান ছিলাম প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি বুঝি সাংবাদিক, অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে খোঁজ-খবর করছেন সেজন্যেই। কিন্তু পরে গ্রোভে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হই যে আসলেও সেখানে কাজ করেন আপনি।”

“ওহ, আচ্ছা। এরকমটা প্রায়ই ঘটে নাকি? মানে সাংবাদিকরা প্রায়ই ফোন দেয়?”

“ইদানীং আর খুব একটা দেয় না। কিন্তু আগে বড্ড বেশি জ্বালাতন করতো। তাই একটু সাবাধানী-” হাঁচির কারণে বাক্যটা শেষ করতে পারলোনা ম্যাক্স বেরেনসন। “মাফ করবেন, আমারও ঠাণ্ডা লেগেছে।”

শব্দ করে নাক ঝরলো সে। এই ফাঁকে তাকে ভালো করে খেয়াল করলাম। চেহারাটা ছোট ভাইয়ের মতন আকর্ষণীয় নয় ম্যাক্স বেরেনসনের। মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে, পেটে দশাসই ভুড়ি। মুখভর্তি ব্রনের ছেড়ে যাওয়া দাগ। পুরনো আমলের ওল্ড স্পাইস পারফিউমের গন্ধ নাকে এলো, আমার বাবাও ব্যবহার করতো এটা। গোটা অফিসে বনেদি একটা ভাব আছে। চামড়ার মোড়া আসবাবপত্র, কাঠের প্যানেলিং, তাকভর্তি বই। গ্যাব্রিয়েলের রঙিন জগতের সাথে আকাশ পাতাল তফাৎ জায়গাটার। দুই ভাইয়ের মধ্যে বেজায় পার্থক্য, বোঝাই যাচ্ছে।

গ্যাব্রিয়েলের বাঁধানো একটা ছবি রাখা ডেস্কে। তার অগোচরেই তোলা হয়েছিল ছবিটা-ক্যান্ডিড। খুব সম্ভবত ম্যাক্সই ছিল লেন্সের পেছনে। গ্রামাঞ্চলে বিশাল একটা মাঠের বেড়ার ওপর বসে আছে সে ছবিতে। গলা থেকে একটা ক্যামেরা ঝুলছে। ফটোগ্রাফার তো নয়, যেন নামকরা কোন অভিনেতা। কিংবা এভাবেও বলা যায় যে ফটোগ্রাফারের ভূমিকায় অভিনয় করছে সে।

ছবিটার দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা নাড়লো ম্যাক্স। “চেহারা আর চুলের দিক থেকে আমার ভাই বিজয়ী, মগজের দিক থেকে আমি, আমার মনের কথাই বলল সে। পরক্ষণেই হেসে উঠলো। “মজা করলাম। আসলে, আমাকে দত্তক নেয়া হয়েছিল। আমাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক নেই।”

“তাই নাকি? এটা জানা ছিল না। আপনাদের দু’জনকেই দত্তক নেয়া হয়েছিল?”

“নাহ, শুধু আমাকে। আমাদের বাবা-মা প্রথমে ভেবেছিল তাদের কোন সন্তান হবে না। কিন্তু আমাকে দত্তক নেয়ার পরেই মা কনসিভ করে। খুঁজলে এরকম আরো উদাহরণ পাবেন কিন্তু। বোধহয় সন্তান না হবার দুশ্চিন্তা মাথা থেকে দূর হওয়ার সাথে এর সম্পর্ক আছে।”

“আপনাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে কেমন মিল ছিল? ঘনিষ্ঠ বলা যাবে?”

“হ্যাঁ, তা যাবে। তবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময় গ্যাব্রিয়েলই থাকতো। আমি একরকম ওর ছায়াতেই বড় হয়েছি।”

“এরকমটা হবার কারণ?”

“আসলে এরকমটা না হওয়াই অস্বাভাবিক ছিল। মানে কিভাবে যে বলব…ছোট থেকেই একটু অন্যরকম ছিল ও, কথা বলার সময় আনমনে হাতের আঙটি নাড়াচাড়া করছে ম্যাক্স। একটু পরপরই এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। “সবখানে ক্যামেরা নিয়ে যেত, ছবি তুলতে। বাবা অবশ্য ভেবেছিল ওর মাথায় নির্ঘাত কোন সমস্যা আছে। কিন্তু পরবর্তীতে সবাই বুঝতে পারে যে সে কতটা প্রতিভাবান। ওর ভোলা কোন ছবি দেখেছেন?”

জবাবে একটা কৌশলী হাসি ফুটলো আমার মুখে। গ্যাব্রিয়েলের ছবি তোলার প্রতিভা নিয়ে কথা বলার জন্যে এখানে আসিনি। বিষয় পরিবর্তনের চেষ্টা করলাম। “গ্যাব্রিয়েলের স্ত্রীকে নিশ্চয়ই ভালো করেই চিনতেন আপনি?”

“অ্যালিসিয়াকে? ভালো করে চিনতে হবে নাকি?” অ্যালিসিয়ার প্রসঙ্গ উঠতেই কথা বলার সুর বদলে গেল ম্যাক্সের। এখন আর আগের উষ্ণতাটুকু নেই, চোখে ভর করেছ শীতল চাহনি। “আপনাকে এই ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারবো বলে মনে হয় না। তবে আপনি চাইলে আমার সহকর্মী প্যাট্রিক ডোহার্টির সাথে আপনার যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে, সে বিচার সংক্রান্ত সব খবরাখবর জানাতে পারবে।”

“আসলে এরকম বিষয়াদি নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই।”

“তাই?” কৌতূহল ফুটলো ম্যাক্সের চেহারায়। “একজন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে তো রোগির উকিলের সাথে দেখা করার কথা নয় আপনার, তাই না?”

“না। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমরা যে রোগির ব্যাপারে কথা বলছি সে গত কয়েক বছরে মুখ খোলেনি।”

কথাটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো ম্যাক্স। “বেশ। কিন্তু যেমনটা বললাম, আপনার কোন কাজে আসবো না আমি। তাই-”

“খুব কঠিন কিছু জিজ্ঞেস করবো না।”

 “ঠিক আছে। শুনি তাহলে আপনার প্রশ্নগুলো।”

“একটা পেপারে পড়েছিলাম, গ্যাব্রিয়েল খুন হবার আগের রাতে তাদের বাসায় গিয়েছিলেন আপনি?”

“হ্যাঁ, একসাথে ডিনার করি আমরা।”

 “তখন তাদের কেমন দেখেছিলেন?”

ক্লান্তি ভর করলো ম্যাক্সের দৃষ্টিতে। এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই আগেও অনেকবার শুনতে হয়েছে তাকে। জবাবটাও তৈরিই ছিল। “স্বাভাবিক, একদম স্বাভাবিক।”

“আর অ্যালিসিয়া?”

“স্বাভাবিক।”কাঁধ ঝকালো ম্যাক্স। “অন্যান্য সময়ের তুলনায় একটু অস্থির লাগছিল, কিন্তু…”

“কিন্তু কি?”

“কিছু না।”

বুঝতে পারছিলাম, ঘটনার এখানেই শেষ নয়, তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম।

একমুহূর্ত পর আবারও বলতে শুরু করলো ম্যাক্স। “ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে কতটা জানেন আপনি?”

“পত্রিকায় যতটুকু পড়েছি।”

“কী পড়েছেন সেখানে?”

 “সুখি দম্পতি ছিল তারা।”

“সুখি?” শীতল একটা হাসি ফুটলো ম্যাক্সের মুখে। “আসলেও সুখি ছিল। অ্যালিসিয়াকে সুখি রাখার জন্যে হেন কাজ নেই যা গ্যাব্রিয়েল করেনি।”

“বুঝলাম,” বললাম ঠিকই, কিন্তু আদতে কিছুই বুঝছি না। কি বলতে চাইছে ম্যাক্স?

 আমার বিভ্রান্ত চেহারা দেখে কাঁধ নাচালো সে। “আমার কাছ থেকে এর বেশি আর কিছু জানতে পারবেন না। তবে আপনি যদি এই ধরণের গালগপ্পে আগ্রহী হন, তাহলে জিন-ফিলিক্সের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন।”

 “জিন-ফিলিক্স?”

“জিন-ফিলিক্স মার্টিন। অ্যালিসিয়ার গ্যালারিস্ট। অনেক বছর ধরে একে অপরকে চেনে তারা, সম্পর্কও খুব ভালো। তবে সত্যি বলতে আমার লোকটাকে কেন যেন কখনোই পছন্দ হয়নি।”

“গল্পগুজবে কোন আগ্রহ নেই আমার।” মনে মনে ঠিক করলাম যত দ্রুত সম্ভব জিন-ফিলিক্সের সাথে আলাপ করতে হবে। আমি আসলে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত শুনতেই বেশি আগ্রহী। আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”

“করলেন তো কেবলই।”

“আপনি কি অ্যালিসিয়াকে পছন্দ করতেন?”

 “অবশ্যই,” অনুভূতহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ম্যাক্স।

তার কথাটা বিশ্বাস হলো না আমার। “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে। আপনি আইনজীবীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই কথাটা বলছেন। আর একজন। আইনজীবীকে তো অনেক কিছু গোপন রাখতেই হয়। দয়া করে গ্যাব্রিয়েলের ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু বলুন।”

নীরবতা ভর করলো ঘরটায়। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম আমাকে হয়তো অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে ম্যাক্স। কিছু একটা বলতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে মত বদলালো সে। এরপর হঠাৎই ডেস্ক ছেড়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পাল্লা খুলতেই শীতল বাতাস ঢুকে পড়লো ভেতরে। লম্বা শ্বাস নিল ম্যাক্স, যেন এতক্ষণ রুমের ভেতরে দমবন্ধ লাগছিল তার।

অবশেষে নিচু স্বরে বলল। “সত্যিটা হচ্ছে…ওকে ঘৃণা করি আমি…ঘৃণা…”

কিছু বললাম না। তার পরবর্তী কথাগুলো শোনার অপেক্ষা করছি।

“গ্যাব্রিয়েল শুধু আমার ভাইই ছিল না, ও ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু,” জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই বলল সে। “ওর মতো দয়ালু আর কাউকে দেখিনি। একটু বেশিই দয়ালু। কিন্তু তার সব প্রতিভা, উদারতা, প্রাণচাঞ্চল্য-অকালে শেষ হয়ে গেল কুত্তিটার জন্যে। ঐ রাতে গ্যাব্রিয়েলের পাশাপাশি আমার জীবনও শেষ করে দিয়েছে সে। ভাগ্যিস এই দিন দেখার জন্যে মা-বাবা বেঁচে নেই।” গলা ধরে এলো ম্যাক্সের।

তার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি, খারাপও লাগছে বেচারার জন্যে। “অ্যালিসিয়ার আইনজীবীর বন্দোবস্ত করাটা আপনার জন্যে বেশ কঠিন ছিল নিশ্চয়ই।”

জানালা বন্ধ করে ডেস্কে ফিরে এলো ম্যাক্স। নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। এখন পুরোদমে একজন উকিল সে। নিরপেক্ষ, বিচার বিবেচনাপূর্ণ, অনুভূতিহীন।

আমার উদ্দেশ্যে কাঁধ ঝাঁকালো একবার। “গ্যাব্রিয়েল বেঁচে থাকলে এমনটাই চাইতো। অ্যালিসিয়ার জন্যে সবসময়ই সেরাটা দিতে চেয়েছে সে। ওর জন্যে পাগল ছিল আমার ভাই। আর অ্যালিসিয়া আসলেও একটা পাগল।”

“আপনার ধারণা তার মাথায় সমস্যা আছে?”

 “আপনিই বলুন, এখন তো তার চিকিৎসা করছেন।”

 “আপনার কী মনে হয়?”

 “ওর কর্মকাণ্ড নিজের চোখে দেখেছি বলেই বলছি।”

 “কী দেখেছেন?”

“মুড সুইং। মেজাজ এই ভালো তো এই খারাপ। প্রচণ্ড বদমেজাজী। একটুতেই জিনিসপত্র ভাঙচুর করতো। গ্যাব্রিয়েলের কাছে শুনেছিলাম বেশ কয়েকবার নাকি তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। তখনই কিছু একটা করা উচিৎ ছিল আমার। অন্তত অ্যালিসিয়া যখন আত্মহত্যার চেষ্টা করে, এরপর চুপ থাকাটা একদমই উচিৎ হয়নি। গ্যাব্রিয়েল আগলে রাখতে চাইছিল ওকে আর আমিও সেটা করতে দিয়েছি। আস্ত গর্দভ আমি।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকালো ম্যাক্স। ইঙ্গিতটা পরিস্কার, আর কথা বাড়াতে চাইছে না সে।

কিন্তু আমি শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। “অ্যালিসিয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল? মানে? কবে? খুনের ঘটনার পর?”

মাথা ঝাঁকালো ম্যাক্স। “নাহ, আরো কয়েক বছর আগে। আপনি জানতেন না? আমি ভেবেছিলাম জানেন।”

“এটা কবেকার ঘটনা?”

“ওর বাবা মারা যাওয়ার পরপর। একসাথে অনেকগুলো ওষুধ খেয়ে ফেলেছিল…ওভারডোজ। আসলে পরিস্কার মনে নেই আমার। মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।”

তাকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো এসময় দরজা খুলে গেল। রিসিপশনিস্ট মহিলা ভেতরে এসে নাক টেনে বলল, “ডার্লিং, আমাদের বের হওয়া উচিৎ। দেরি হয়ে যাবে।”

“ওহ হ্যাঁ, আসছি দাঁড়াও।”

বন্ধ হয়ে গেল দরজা। উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় ম্যাক্স। “থিয়েটারে যাবো আজকে।” আমার চেহারার হতভম্ভ ভাব দেখে হেসে উঠলো সে। “গত বছর বিয়ে করেছি আমি আর তানিয়া।”

“ওহ আচ্ছা।”

“গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুর পর ঘটেছে ব্যাপারটা। ও না থাকলে দুঃসময়টা কিভাবে কাটাতাম, কে জানে।”

ম্যাক্সের ফোন বেজে উঠলো এ সময়।

“ধন্যবাদ, অনেক সাহায্য করেছেন।” ইশারায় তাকে ফোনটা ধরতে বলে অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। এবারে ভালো করে তাকালাম রিসিপশনের তানিয়ার দিকে-স্বর্ণকেশী, সুন্দরি, কিছুটা খাটো গড়ন। আবারো নাক ঝারলো সে, তার হাতের বিয়ের হিরের আঙটিটা নজর এড়ালো না।

আমাকে অবাক করে দিয়ে এগিয়ে এল সে। ভ্রূ কুঁচকে নিচু গলায় বলল, “আপনি যদি অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে জানতে চান, তাহলে ওর ফুপাতো ভাই পলের সাথে কথা বলুন। পলই সবার চাইতে ভালো করে চেনে ওকে।”

“আমি অ্যালিসিয়ার ফুপিকে ফোন দিয়েছিলাম, লিডিয়া রোজ। কথা বলতে আগ্রহী মনে হয়নি তাকে।”

 “লিডিয়ার কথা ভুলে যান। সরাসরি ক্যামব্রিজে গিয়ে পলের সাথে কথা বলুন। অ্যালিসিয়া আর দুর্ঘটনার পরদিনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস-”

অফিসরুমের দরজা খোলার শব্দ কানে আসামাত্র মুখে কুলুপ আটলো তানিয়া। ম্যাক্স বেরিয়ে এলে তার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সে। “তুমি তৈরি, ডার্লিং?”

তানিয়া হাসছে, তবে তার কণ্ঠের নার্ভাস ভাবটা আমার কান এড়ালো না। ম্যাক্সকে ভয় পায় সে, ভাবলাম। কিন্তু কেন?

.

২.১৩

অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ডায়েরি
জুলাই ২২

বাড়িতে বন্দুক রাখার ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগে না আমার কাছে।

গত রাতে এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে আমাদের মধ্যে। অন্তত তখন মনে হয়েছিল যে বন্দুকটা নিয়েই ঝগড়া হচ্ছে, কিন্তু এখন আমি অতটা নিশ্চিত নই সে ব্যাপারে।

গ্যাব্রিয়েল বলছিল যে আমিই নাকি ঝগড়া লাগিয়েছি। ভুল বলেনি। ওকে আমার দিকে ওরকম আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলে আমার খুবই খারাপ লাগে। আমার কারণে কষ্ট পাচ্ছে এটা কল্পনাও করতে পারি না-তবুও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কষ্ট দেই ওকে। কেন, সেটা আমি নিজেও বলতে পারবো না।

ও বলছিল আমি নাকি মেজাজ খারাপ করে বাসায় ফিরেছি গতকাল। আর ফিরেই দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর উদ্দেশ্যে চেঁচানো শুরু করে দেই। হয়তো সেটাই করেছিলাম। মনমেজাজ খারাপ ছিল কোন কারণে। আসলে আমি নিশ্চিত নই যে কি ঘটেছিল। তখন কেবল পার্ক থেকে ফিরেছি। আসার পথে পুরো রাস্তা দিবাস্বপ্নে মশগুল ছিলাম। আমার কাজগুলো নিয়ে ভাবছিলাম, বিশেষ করে জিশুর ছবিটার কথা। একটা বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় দেখি দুটো ছেলে পানির মোটা পাইপ। নিয়ে খেলছে। বয়স বড়জোর সাত কি আট। বড় ছেলেটা ছোটজনের দিকে পাইপ তাক করে আছে, সেখান থেকে ফোয়ারার মত পানি বেরুচ্ছে। আর দু’পাশে হাত বাড়িয়ে পানিতে ভিজছিল ছোট ছেলেটা, মুখে উজ্জ্বল হাসি। পানির ধারায় সূর্যের আলো পড়ে রংধনুর মত দেখাচ্ছিল অনেকটা। একসময় খেয়াল করি যে আমার দুই গালে অশ্রুর ধারা।

তখন বিষয়টাকে পাত্তা দেইনি, কিন্তু এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি। সত্যটা আসলে নিজের কাছে স্বীকার করতে চাইনি কখনো, জীবনের বড় একটা সুখ থেকে বঞ্চিত আমি। শতবার নিজেকে বুঝিয়েছি যে সন্তান চাই না আমার, আঁকাআঁকিই আমার জীবনের সব। কিন্তু এটা ডাহা মিথ্যে, একটা অজুহাত মাত্র। সত্যটা হচ্ছে-সন্তান নিতে ভয় পাই আমি। বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারে আমার ওপর ভরসা করা সম্ভব নয়।

হাজার হোক, আমার ভেতরে তো মা’র রক্তই বইছে, নাকি?

বাসায় ফেরার পর অবচেতন মনে এসবই ভাবছিলাম হয়তো। ঠিকই বলেছিল গ্যাব্রিয়েল, অবস্থা সুবিধের ছিল না আমার।

কিন্তু সেই মুহূর্তে ওকে বন্দুকটা পরিস্কার করতে না দেখলে মাথায় রক্ত উঠতো না। ওটা দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বন্দুকটা বাসা থেকে দূর করেনি ও। সবসময়ই বলে যে এটা নাকি ১৬ বছর বয়সে ওর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল, বংশ পরম্পরায় বন্দুকটা ওদের পরিবারের কাছে আছে। যতসব ফালতু কথা। আমার বিশ্বাস হয় না, নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে। সেটাই বলেছিলাম। তখন গ্যাব্রিয়েল বলে যে নিজের এবং স্ত্রীর নিরাপত্তার খাতিরে বাসায় একটা বন্দুক রাখা এমন কোন বিষয় না। যদি হঠাৎ কেউ ঢুকে পড়ে ভেতরে, তখন?

“তখন পুলিশে ফোন দেব!” বলেছিলাম। “গুলি নিশ্চয়ই করবো না!”

গলার স্বর চড়ে গিয়েছিল আমার। জবাব দেয়ার সময় ওর গলা আরো চড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুন্ধুমার ঝগড়া শুরু করি দু’জনে। আমি হয়তো একটু বেশি বেশিই করে ফেলেছি। কিন্তু শুরুটা তো ও-ই করেছে। রেগে গেলে মাঝে মাঝে একটু আগ্রাসী হয়ে ওঠে গ্যাব্রিয়েল। খুব কম ক্ষেত্রেই হয় এমনটা, কিন্তু আমার খুব ভয় লাগে তখন। মনে হয় যেন অচেনা কারো সাথে সংসার করছি।

বাকি সন্ধ্যা কথা বলিনি কেউই। চুপচাপ ঘমোতে যাই।

আজ সকালে সবকিছুর মীমাংসা হয় সেক্সের মাধ্যমে। এরকমটাই হয়ে আসছে বরাবর। বিছানায় চাদরের নিচে নগ্ন দেহে আলিঙ্গনরত অবস্থায় একদম মন থেকে “দুঃখিত” বলাটা সহজ। সব যুক্তি আর প্রতিবন্ধকতা ধলোয় মিশে মাটিতে লুটোপুটি খায়, জামাকাপড়গুলোর মতন।

 “যাবতীয় ঝগড়া আমাদের এখন থেকে বিছানাতেই করা উচিৎ।” আমার ঠোঁটে লম্বা চুমু খেয়ে গ্যাব্রিয়েল। “আই লাভ ইউ। বন্দুকটা ফেলে দিব, কথা দিচ্ছি।”

“না, থাক,” বলি আমি। “বাদ দাও। আমার কোন সমস্যা নেই। আসলেই।”

চুম খেয়ে আবারো আমাকে কাছে টেনে নেয় গ্যাব্রিয়েল। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। আমার নগ্ন দেহটা একদম ঠিকঠাকভাবে ওর শরীরে এঁটে যায়। অবশেষে প্রশান্তি ভর করে আমার চিত্তে।

.

জুলাই ২৩

ক্যাফে দি আরটিস্টায় বসে লিখছি। এখন প্রায় প্রতিদিনই এখানে আসি। বাসায় একা একা থাকতে ভালো লাগে না। বাইরে মানুষজনের মধ্যে আসলে মনে হয় বনবাস থেকে লোকালয়ে ফিরেছি। প্রায়ই ভাবি যে বাইরে না বেরুলে আমার অস্তিত্বই মুছে যাবে পৃথিবী থেকে। জানি, খুবই অদ্ভুত একটা ভাবনা।

মাঝে মাঝে অবশ্য পুরোপুরি উধাও হয়ে যেতে ইচ্ছে করে-যেমন আজকে। রাতের বেলা ম্যাক্সকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে গ্যাব্রিয়েল। কথাটা সকালে জানায় আমাকে।

“অনেকদিন ধরে ম্যাক্সের সাথে দেখা হয় না আমাদের,” বলে ও। “শেষ মনে হয় জোয়েলের নতুন বাসায় ওঠার পার্টিতে কথা হয়েছিল। আজ বার্বিকিউ করবো।” অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় গ্যাব্রিয়েল। “তোমার আপত্তি নেই তো?”

“আপত্তি থাকবে কেন?”

হাসে গ্যাব্রিয়েল। “তুমি একেবারেই মিথ্যে বলতে পারো না, জানো সেটা? চেহারা দেখেই সব বুঝে যাই আমি।”

“এবারে কি বুঝলেন শুনি?”

“ম্যাক্সের আসাটা পছন্দ হচ্ছে না তোমার। আসলে ওকে কখনোই পছন্দ করোনি তুমি।”

“ভূয়া কথা।” বুঝতে পারি যে চেহারা লাল হয়ে উঠছে আমার। কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখ অন্য দিকে ফেরাই। ওকে অপছন্দ করবো কেন? দেখা হলে ভালোই লাগবে। আমার ছবি আঁকার জন্যে পোজ দেবে কখন আবার? শেষ করতে হবে কাজ।”

হাসে গ্যাব্রিয়েল। “এই সপ্তাহের শেষে? তবে শোনন, ম্যাক্সকে পেইন্টিংটা দেখানোর দরকার নেই, ঠিক আছে? চাইনা আমাকে জিশুর রূপে দেখুক ও। সারাজীবন খোঁচাবে।”

“দেখাবো না। তাছাড়া কাজ তো শেষই হয়নি।”

শেষ হলেও ম্যাক্সকে দেখাতাম না কখনো। আমার স্টুডিওতে ওর পা। পড়ছে, এটা ভাবলেই রাগ লাগে। মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে কিছু বললাম না।

বাসায় ফিরতে ইচ্ছেই করছে না। ম্যাক্সের চলের যাওয়া অবধি এই ক্যাফের এই শীতল পরিবেশে বসে থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ওয়েট্রেস মেয়েটা ইতোমধ্যে ঘড়ির দিকে তাকানো শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে পড়তে হবে আমাকে। অর্থাৎ বাড়ি ফিরতে না চাইলে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা ছাড়া কোন উপায়। সেটা সম্ভব না। ম্যাক্সের মুখোমুখি হতেই হবে।

.

জুলাই ২৪

ক্যাফেতে ফিরে এসেছি আমি। প্রতিদিন যেখানে বসি, আজকে সেখানে অন্য একজন আগেই বসে পড়েছে। সুন্দরি ওয়েট্রেস সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। অন্তত দৃষ্টিটা সহানুভূতিরই মনে হলো আমার কাছে, ভুলও হতে পারে। অন্য একটা টেবিলে বসলাম আজকে, এসির কাছাকাছি। তবে এদিকটা একটু অন্ধকার আর বেশি ঠাণ্ডা, ঠিক আমার মনের মতন।

গতরাতটা অসহ্য কেটেছে। যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।

প্রথম দেখায় ম্যাক্সকে চিনতেই পারিনি। আগে কখনো ওকে স্যুট ব্যতীত অন্য কিছু পরতে দেখিনি। হাফপ্যান্টে বোকা বোকা লাগছিল। স্টেশন থেকে ওটুকু পথে হাঁটতেই ঘেমে গেছিল একদম। টেকো মাথাটা দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল একটা চকচকে টমেটোর দিকে তাকিয়ে আছি। বগলের কাছটা ভিজে একসা। প্রথম প্রথম আমার দিকে তাকাতেই পারছিল না। নাকি আমিই তাকাচ্ছিলাম না ইচ্ছে করে?

প্রথমে বাসা নিয়ে বকবক শুরু করলো ম্যাক্স, কত বদলে গেছে-হেনতেন। এরপর বলে সে ভেবেছিল আমরা বোধহয় আর ওকে কখনো আসতেই বলবো না। গ্যাব্রিয়েল বারবার দুঃখপ্রকাশ করে, বলে যে আমরা সময়ই পাচ্ছিলাম না। একটা প্রদর্শনীর জন্যে কাজ করছি আমি আর ও নিজে ছবি তুলতে ব্যাস্ত। হাসিমুখে কথাগুলো বললেও আমিও ঠিকই বুঝতে পারছিলাম যে ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয়েছে ও।

শুরুতে আমিও কিছু বুঝতে দেইনি। তক্কে তক্কে ছিলাম, ওরা বার্বিকিউ করতে বাইরে গেলেই রান্নাঘরে চলে আসি সালাদ বানানোর অজুহাতে। জানতাম যে কোন না কোন ছুতোয় আমার সাথে একা কথা বলতে আসবে ম্যাক্স। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। পাঁচ মিনিট পরেই ম্যাক্সের ভারি পদশব্দ শুনতে পাই। গ্যাব্রিয়েল আর ওর হাঁটার ধরণে আকাশ পাতাল তফাৎ। গ্যাব্রিয়েল হাঁটে বিড়ালের মতন, নীরবে আর ম্যাক্স…

“অ্যালিসিয়া।”

 বদটার মুখে আমার নাম শোনামাত্র হাত কাঁপতে শুরু করে। ছুরিটা নামিয়ে রেখে ওর মুখোমুখি হই।

হাতের খালি বিয়ারের বোতলটা দেখায় ম্যাক্স। হেসে বলে, “আরেকটা নিতে এসেছি।” তখনও আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছিল না।

 মাথা নাড়ি আমি, কিন্তু কিছু বলিনি। ফিজ খুলে আরেকটা বিয়ার বের করে ও। ওপেনারের জন্যে আশপাশে তাকালে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেই কোথায় আছে জিনিসটা।

বোকার হাসি হেসে বিয়ার খোলে ম্যাক্স। এরপর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মুখ খুলি আমি :

“কি ঘটেছিল এ ব্যাপারে গ্যাব্রিয়েলকে সব বলবো আমি। তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম।”

হাসি মুছে গেল ম্যাক্সের। “কি?” সাপের নজরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

“গ্যাব্রিয়েলকে বলে দিব। জোয়েলদের ওখানকার ঘটনাটা।”

“কি বলছো এসব, বুঝতে পারছি না কিছু।”

 “আসলেই?”

“আসলে কিছু মনে নেই। সেদিন একটু বেশিই গিলে ফেলেছিলাম।”

 “ফালতু কথা।”

 “না…”

“আমাকে চুমু খাওয়ার কথা মনে করতে পারছো না? আমাকে জড়িয়ে ধরার কথা ভুলে গেলে?”

“অ্যালিসিয়া, না।”

 “কি না? হইচই করবো না? আমার গায়ে হাত দিয়েছিলে তুমি।”

বুঝতে পারি যে রেগে উঠছি। খুব কষ্ট হয় নিজেকে সামলাতে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি গ্যাব্রিয়েল তখনও বার্বিকিউ নিয়ে ব্যস্ত। ধোয়ার কারণে চেহারাটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না।

“তোমাকে কত মানে গ্যাব্রিয়েল,” বলি একটু পর। “তুমি ওর বড় ভাই। যখন সত্যটা জানবে, ভীষণ কষ্ট পাবে।”

“তাহলে বোলো না। বলার মত কিছু নেই তো।”

 “সত্যটা জানা উচিৎ ওর। ভাইয়ের আসল চেহারা যে কি, সেটা

কথা শেষ করার আগেই আমার হাত ধরে একটা হেঁচকা টান দেয় ম্যাক্স। তাল সামলাতে না পেরে ওর ওপরেই পড়ে যাই। এমনভাবে হাত উঠেয়েছিল, এক মুহূর্তের জন্যে ভেবেছিলাম ঘুষি দিবে। “আই লাভ ইউ,” আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে ম্যাক্স। “আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ”

আমি কিছু বলার আগেই ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। ওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু শক্ত করে ধরে রেখেছিল শুয়োরটা। আমার মুখের ভেতরে ওর জিহ্বার উপস্থিতি টের পেতেই গা গুলিয়ে উঠলো।

কামড় বসিয়ে দিলাম যতটা জোরে সম্ভব।

 চিৎকার করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ম্যাক্স। মাথা উঁচু করলে দেখতে পাই মুখভর্তি রক্ত।

 “কুত্তার বাচ্চা!” বিকৃত কন্ঠে বলে সে, দাঁত পুরো লাল হয়ে গেছে, ততক্ষণে। চোখে আহত পশুদের মতন দৃষ্টি।

আমার মাঝে মাঝে বিশ্বাসই হয় না যে ম্যাক্স গ্যাব্রিয়েলের ভাই। গ্যাব্রিয়েলের গুণাবলীর কোনটাই নেই ওর মধ্যে। আস্ত ইতর।

“অ্যালিসিয়া, গ্যাব্রিয়েলকে এ ব্যাপারে কিছু বলবে না তুমি,” আমাকে শাসায় ম্যাক্স। “সাবধান করে দিচ্ছি।”

জবাবে কিছু বলিনি। ঠোঁটে ওর রক্ত লেগে ছিল তাই পেছনে ফিরে ট্যাপের পানি দিয়ে কুলি করি কয়েকবার। এরপর বাগানে বেরিয়ে আসি।

ডিনারের সময়ে বুঝতে পারি, ম্যাক্স কিছুক্ষণ পরপর আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আমি মুখ তুললেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। কিছু খেতে পারিনি ডিনারে। খাওয়ার কথা ভাবলেই অসুস্থ লাগছিল। মুখের ভেতরে ওর রক্তের স্বাদ টের পাচ্ছিলাম তখনও।

কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছিলাম না। গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে কিছু লুকোনোর ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু সত্যটা বললে ও কষ্ট পাবে ভীষণ। ম্যাক্সের সাথে আর কখনো যোগাযোগ করবে না। তার ভাই যে একটা আস্ত জোচ্চোর, এটা মেনে নেয়াটা কষ্টকর হবে বেচারার জন্যে। আসলেও ম্যাক্সকে খুব বেশি শ্রদ্ধা করে গ্যাব্রিয়েল। যদিও হারামিটা ওর শ্ৰদ্ধার যোগ্য নয়।

আমি বিশ্বাস করি না যে ম্যাক্স আমাকে ভালোবাসে। আসলে গ্যাব্রিয়েলকে দেখতে পারেনা সে, ঈর্ষা করে। আর সেই ঈর্ষা থেকেই ওর সবকিছু কেড়ে নিতে চায়, আমাকেও। কিন্তু একবার যখন বুঝে গেছে যে আমি ছেড়ে দেবার পাত্র নই, আর কিছু করার সাহস হবে বলে মনে হয় না। অন্তত সেরকমটাই আশা করছি।

সেজন্যেই ব্যাপারটা আপাতত চেপে যাবো ঠিক করেছি।

অবশ্য আমার মনে কি চলছে সেটা গ্যাব্রিয়েল ঠিকই বুঝতে পারবে। আসলে মেকি ভান ধরা সম্ভব হয় না আমার পক্ষে। গত রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় বলে ম্যাক্সের সামনে আমি নাকি অদ্ভুত আচরণ করছিলাম।

“আসলে ক্লান্ত ছিলাম আমি।”

“নাহ, কী যেন হয়েছে তোমার। অন্যমনস্ক ছিলে পুরোটা সময়। একটু চেষ্টা করলেও পারতে, ম্যাক্সের সাথে এখন তো আর খুব বেশি একটা দেখা হয় না আমাদের। ওকে যে কেন এত অপছন্দ করো, বুঝতেই পারি না।”

 “অপছন্দ করিনা, গ্যাব্রিয়েল। ম্যাক্সের সাথে আমার অন্যমনষ্কতার কোন সম্পর্ক নেই। আসলে কাজ নিয়ে ভাবছিলাম। খুব বেশি দেরি নেই প্রদর্শনীর।” যতটা সম্ভব বিশ্বাসযোগ্য সুরে বললাম।

আমার কথা বিশ্বাস না করলেও আর কিছু বলে না গ্যাব্রিয়েল। তবে পরবর্তীতে ম্যাক্সের সাথে দেখা হলে আবারো এ বিষয়ে কথা হবে আমাদের, নিশ্চিত আমি।

পুরো ঘটনাটা এখানে লিখতে পেরে খুব শান্তি লাগছে। কিছু লিখে ফেলার মধ্যে অন্য রকম একটা অনুভূতি আছে। আমার অবর্তমানে লেখাগুলো প্রমাণ হিসেবে কাজে দেবে।

যদিও কখনো ওরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না।

.

জুলাই ২৬

আজকে আমার জন্মদিন। তেত্রিশে পা দিলাম।

একটু অদ্ভুতই লাগছে, কখনো ভাবিনি যে এতদিন বেঁচে থাকবো। এক হিসেবে মা’র চেয়ে বড় আমি এখন। বত্রিশেই থেমে গিয়েছিল তার বয়স। এখন আমার বয়স বাড়তেই থাকবে না, কিন্তু মার বয়স বাড়বে না।

সকালটা খুব মিষ্টি ছিল আজ। তেত্রিশটা গোলাপ নিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়েছে গ্যাব্রিয়েল। ফুলগুলো এত্ত সুন্দর! একটা গোলাপের কাঁটায় ওর আঙুল সামান্য কেটে যায়। ছোট্ট এক বিন্দু রক্ত লেগে ছিল সেখানটায়। এরকম একটা দৃশ্যই মন ভালো করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

এরপর নাস্তার জন্যে আমাকে পার্কে নিয়ে যায় ও, অনেকটা পিকনিকে মতন। বেলা বেশি না হওয়াতে গরমে কষ্ট লাগেনি খুব একটা। হ্রদের দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছিল, সদ্য কাটা ঘাসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সেখানেই মেক্সিকো থেকে কেনা নীল চাদরটা পেতে লম্বা একটা শুয়ে ছিলাম দুজনে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলছিল সূর্যটা। খাবার হিসেবে সাথে ছিল শ্যাম্পেইন, ছোট ঘোট মিষ্টি টমেটো, রুটি আর স্যালমন। এসময় অদ্ভুত একটা অনুভূতিতে ছেয়ে ওঠে আমার মন। মনে হতে থাকে যে আগেও এরকম একটা দিন কাটিয়েছি। কিন্তু কবে, সেটা মনে করতে পারছিলাম না। হয়তো ছোটবেলায় শোনা কোন গল্পের কথা ভাবছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসে বেরসিক স্মৃতিটা :

 নিজেকে আমাদের ক্যামব্রিজের বাসার বাগানে আবিষ্কার করি। সেখানেও এখানকার মত একটা উইলো গাছ ছিল। ওটার আড়ালে অনেক সময় কাটিয়েছি। শৈশবে খুব একটা হাসিখুশি ছিলাম না হয়তো, কিন্তু উইলো গাছটার নিচে শুয়ে থাকার সময় ঠিক আজকের মত এরকম প্রশান্তি অনুভব করতাম। কিছুক্ষণের জন্যে আমার অতীত আর বর্তমান একাকার হয়ে গিয়েছিল। চাচ্ছিলাম না যে মুহূর্তটুকু শেষ হোক কখনো। গ্যাব্রিয়েল ঘুমিয়ে পড়লে ওর একটা ছবি আঁকি। মুখের ওপর এসে পড়া সূর্যের আলোটুকু ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম। তবে আজকে ওর সুন্দর চোখজোড়া আঁকতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ছোট একটা ছেলে শুয়ে আছে।

পিকনিক শেষে বাসায় ফিরে সেক্স করি আমরা। এরপর আমাকে শক্ত করে ধরে একদম অপ্রত্যাশিত একটা কথা বলা গ্যাব্রিয়েল।

“অ্যালিসিয়া, ডার্লিং…তোমাকে একটা কথা বলতে চাই আমি।

ওর কথার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে বড় নার্ভাস লাগতে থাকে। “বলো,” কোনমতে বলি।

“একটা বাচ্চা নিলে কেমন হয়?”

এক মুহূর্তের জন্যে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলি। কী বলবো বুঝেই উঠতে পারছিলাম না।

“কিন্তু…কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে যে বাচ্চা-কাচ্চা পছন্দ না।”

“ভুলে যাও ওকথা। মত পাল্টেছি আমি। এখন আমি চাই আমাদের একটা বাচ্চা হোক। তুমি কি বলো?”

উত্তরে প্রতীক্ষায় আশাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় গ্যাব্রিয়েল। “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ…” চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে শুরু করে আমার।

ওকে শক্ত জড়িয়ে ধরি। এই হাসছি তো আবার এই কাঁদছি।

এখন বিছানায় ঘুমিয়ে আছে ও। আমি চুপচাপ উঠে এসেছি সবকিছু লিখে ফেলার জন্যে আজকের দিনটা সারা জীবন মনে রাখতে চাই আমি, যতদিন বেঁচে আছি।

খুব বেশি খুশি লাগছে। অবসাদ নামের এই সুড়ঙ্গটার শেষ মাথায় আশার আলো দেখতে পাচ্ছি যেন।

.

২.১৪

ম্যাক্স বেরেনসনের বলা কথাগুলো মাথা থেকে দূর হচ্ছে না। বাবার মৃত্যুর পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল অ্যালিসিয়া। ফাইলে এ বিষয়ে কিছু লেখা নেই কেন?

পরদিন ম্যাক্সের অফিসে আবার ফোন দিলাম। আরেকটু হলেই এক মক্কেলের সাথে দেখা করার জন্যে বেরিয়ে পড়তে সে।

“অল্প কিছু প্রশ্নের জন্যে ফোন দিয়েছি আবারো।”

 “ভাই আমি আসলেই খুব ব্যস্ত এখন।”

 “বেশি সময় লাগবে না।”

“পাঁচ মিনিট দিলাম আপনাকে।”

“ধন্যবাদ। আপনি তো বলেছিলেন অ্যালিসিয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। তখন কোন হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে, এটা মনে আছে?”

“হাসপাতালে ভর্তি হয়নি ও।”

 “তাই?”

“হাঁ। বাসাতেই সেরে ওঠে। আমার ভাই দেখভাল করে গোটা সময়।”

“কিন্তু…ডাক্তার তো দেখিয়েছিল নিশ্চয়ই। ড্রাগ ওভারডোজ যেহেতু?”

“হ্যাঁ। বাসাতেই নিয়ে এসেছিল ডাক্তার। তিনি…এ ব্যাপারটা চেপে যেতে রাজি হয়েছিলেন।”

“ডাক্তারের নামটা মনে আছে আপনার?”

এক মুহূর্ত ভাবলো ম্যাক্স। “সরি, মনে নেই।”

 “ওনারা কি সবসময় এই ডাক্তারকেই দেখাতো অসুস্থ হলে?”

“নাহ। গ্যাব্রিয়েল আর আমার পারিবারিক ডাক্তার আলাদা একজন। ও বলে দিয়েছিল যাতে ওনাকে কখনো এ ব্যাপারে কিছু না বলি।”

“নামটা মনেই পড়ছে না?”

 “না, সরি। আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন? যেতে হবে আমাকে।”

“আরেকটা কথা…গ্যাব্রিয়েলের উইলের ব্যাপারে আমার একটু কৌতূহল আছে।”

উইলের কথা ওঠায় গলা চড়ে গেল ম্যাক্সের। “ওর উইল? এসবের সাথে কি সম্পর্ক

“অ্যালিসিয়াই কি তার সম্পত্তির মূল স্বত্বভোগী?”

 “বড় অদ্ভুত প্রশ্ন করছেন কিন্তু।”

 “আসলে, আমি বোঝার চেষ্টা করছি।”

“কি বোঝার চেষ্টা করছেন?” বিরক্ত কণ্ঠে বলল ম্যাক্স। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর যখন দেখলো আমি কিছু বলছি না, অগত্যা প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য হলো। “আমি মুল স্বত্বভোগী। অ্যালিসিয়া ওর বাবার দিক থেকে অনেক সম্পত্তি পেয়েছে। তাই গ্যাব্রিয়েল ওর জন্যে আলাদাভাবে কিছু রেখে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। ওর সব সম্পত্তি মালিক এখন আমি। অবশ্য গ্যাব্রিয়েল ধারণা করেনি, তার মৃত্যুর পর সম্পত্তিগুলোর দাম এভাবে বেড়ে যাবে। আপনার প্রশ্ন কি শেষ?”

“আর অ্যালিসিয়ার উইল? তার উত্তরাধিকারী কে?”

“সেটা, দৃঢ়কণ্ঠে বলে ম্যাক্স, “আপনাকে বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আশা করছি আর কখনো আমাকে ফোন দেবেন না।”

লাইন কেটে গেল। শেষদিকে তার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছিলো আমার কথাগুলো ভালোভাবে নেয়নি।

কিছুক্ষণ পরেই এর প্রমাণ পেলাম।

****

দুপুরের খাবারের পর আমাকে অফিসে ডেকে পাঠায় ডায়োমেডেস। ভেতরে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন। একদম গম্ভীর।

“তোমার সমস্যাটা কি?”

“সমস্যা?”

“সাধু সাজার চেষ্টা করবে না। আমাকে সকালে কে ফোন দিয়েছিল জানো? ম্যাক্স বেরেসন। তুমি নাকি দুবার তার সাথে যোগাযোগ করে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করেছো?”

“অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কিছু কথা জানার ছিল। তখন তো বিরক্ত মনে হয়নি তাকে।”

 “কিন্তু এখন যথেষ্ট বিরক্ত সে। আমাদের বিরুদ্ধে হয়রানির মামলা করার হুমকি দিয়েছে।”

“পাগল নাকি-”

“এ মুহূর্তে গ্রোভের বিরুদ্ধে মামলা হলে পরিণতি কি হবে জানো? এখন থেকে আমার অনুমতির বাইরে কিছু করবে না, বুঝেছো?”

 ভেতরে ভেতরে রেগে উঠলেও, মাথা নেড়ে সায় জানলাম। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছি।

 “থিও, তোমাকে একটা পরামর্শ দেই,” পিতৃসুলভ কণ্ঠে আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললেন ডায়োমেডেস। “তুমি ভুল পথে হাটছে। একে ওকে প্রশ্ন করছে, সূত্র খুঁজছে-যেন এটা একটা গোয়েন্দা কাহিনী।” হেসে উঠলেন প্রফেসর। এভাবে বের করতে পারবে না।”

“কী বের করতে পারবো না?”

“সত্যটা। উইলফ্রেড বিয়নের কথাটা মনে রেখ- যার কোন স্মৃতি নেই, তার কোন উদ্দেশ্যও নেই। থেরাপিস্ট হিসেবে আগে থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে এগোনো যাবে না। শুধুমাত্র অ্যালিসিয়ার সাথে যতক্ষণ সময় কাটাবে তার অনুভূতিগুলো নিজের মধ্যে ধারণের চেষ্টা করবে। সেগুলো বোঝার চেষ্টা করবে। বাকিটা আপনাআপনিই হয়ে যাবে।”

“জানি আমি। ঠিক বলেছেন।”

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। আর যেন না শুনি যে অ্যালিসিয়ার পরিচিত কারো সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছো, বুঝেছো?”

“জি”

.

২.১৫

ওদিন বিকেলে ক্যামব্রিজে অ্যালিসিয়ার ফুপাতো ভাই পল রোজের সাথে দেখা করতে গেলাম।

ট্রেন স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছুলে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্যের জায়গা দখল করে নিল ছোট ছোট লোকালয়। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আলোগুলো নীল দেখাচ্ছে। লন্ডন থেকে বের হতে পেরে ভালো লাগছে। এখানকার আকাশ অনেক বেশি পরিস্কার, বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি।

এক ঝাঁক পর্যটক আর ছাত্রছাত্রির সাথে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম আমি, ফোনের ম্যাপ দেখে সামনে এগোচ্ছি। রাস্তাগুলো এত নীরব যে আমার নিজের হাঁটার শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ করেই রাস্তা শেষ হয়ে গেল। সামনে পতিত জমি। আরেকটু এগোলেই দেখা মিলবে নদীর।

একটা বাড়িই দাঁড়িয়ে আছে নদীর ধারে। আশপাশের পরিবেশের সাথে বড্ড বেমানান। অবস্থাও খুব একটা সুবিধার নয় বাড়িটার। দেয়ালজুড়ে লতানো গাছ আর বাগানভর্তি আগাছা। দেখে মনে হবে যেন প্রকৃতি তার বেহাত হয়ে যাওয়া জায়গাটুকু পুনর্দখলের চেষ্টা করছে। এই বাড়িটাতেই জন্ম হয়েছিল অ্যালিসিয়ার। জীবনের আঠারো বছর কাটিয়েছে এখানে। এই চার দেয়ালের মাঝে বিকশিত হয়েছে তার ব্যক্তিত্ব। এখন আমরা যে পরিণত অ্যালিসিয়াকে দেখি, তার স্বভাব চরিত্রের বীজ বপিত হয়েছিল এখানেই। মাঝে মাঝে জীবন নামের ধাঁধার উত্তর খুঁজতে অতীতে ডুব দিতে হয়। একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা আরো ভালোভাবে বোঝানো যায়:

যৌন নির্যাতনের ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করা একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট একবার আমাকে বলেছিলেন, তার ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন কোন পেডোফাইল বা শিশু নিয়াৰ্তনকারীর দেখা পাননি, যে কি না ছোটবেলায় নির্যাতনের শিকার হয়নি। তবে এমনটা কিন্তু নয় যে শৈশবে নির্যাতনের শিকার হলেই বড় হয়ে পেডোফাইল হতে হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি কখনো এরকম নির্যাতনের শিকার হয়নি, তার দ্বারা অন্য কারো নির্যাতিত হবার সম্ভাবনা একদম কম। কেউ খারাপ হয়ে জন্মায় না। উইনিকটের ভাষায়, “একটা শিশু কখনোই মা’কে ঘৃণা করবে না। যদি কোন কারণে তার মা তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে, কেবলমাত্র তখনই শিশুর মনে ঘৃণার সঞ্চার হবে।” শিশু হিসেবে আমাদের সবার মনই স্পঞ্জের মতন। জীবনের চাহিদাও তখন কেবল খাওয়া, ঘুম আর ভালোবাসা পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এর ব্যতয় ঘটে, ফলশ্রুতিতে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হয় না। এটা নির্ভর করে আমরা কেমন পরিবেশে বড় হচ্ছি, সেটার ওপর। এক নির্যাতিত, অবুঝ শিশুর কিন্তু বাস্তবে প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা নেই। তাই তার ভেতরে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে প্রচণ্ড ক্ষোভ। কিভাবে প্রতিশোধ নেয়া যায়, এ ব্যাপারে জল্পনা-কল্পনা করতে শুরু করে সে। ভয়ের মত রাগের পেছনেও নির্দিষ্ট কারণ থাকে।

এ পৃথিবীতে কেউ কখনো বিনা প্ররোচনায় হাতে বন্দুক তুলে নেয়নি। ঠিক তেমনি, গ্যাব্রিয়েলকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করার পেছনেও অ্যালিসিয়ার নির্দিষ্ট কোন কারণ আছে অবশ্যই। গোটা ব্যাপারটা তার মানসিক কোন সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করছে। আর সেই মানসিক সমস্যা এমনি এমনি হয়নি।

আজকে আমার এখানে আসার কারণ হচ্ছে অ্যালিসিয়ার শৈশব কেমন কেটেছে, সে সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া। এই বাড়িতেই হয়তো অপ্রীতিকর এমন কোন ঘটনা ঘটেছিল, যা তাকে বড় হয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে খুন করার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

বাগানটায় পা রাখলাম। চারপাশে নাম না জানা গুল্মজাতীয় গাছ। বুনো ফুল ফুটেছে কয়েকটায়। ধীরে ধীরে বাড়িটার পেছন দিকে চলে এলাম, একটা বিশাল উইলো গাছ রাজসিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। কল্পনার চোখে দেখলাম অ্যালিসিয়া এই গাছটার নিচে খেলা করছে। মুখে হাসি ফুটলো আপনা থেকেই।

এসময় হঠাই এক ধরণের অস্বস্তিতে ছেয়ে উঠলো মন। যেন কেউ নজর রাখছে আমার ওপর।

বাড়িটার দিকে তাকাতেই ওপরতলার জানালায় একটা মুখ দেখতে পেলাম। বয়স্ক, কুৎসিত এক মহিলার মুখ। কাঁচে নাক ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অস্বস্তির জায়গায় আতংক ভর করলো এবারে।

শেষ মুহূর্তের আগে বুঝলামই না যে আমার পেছনে কেউ একজন উপস্থিত হয়েছে। মাথার পেছনে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম পরপরই।

অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *