২.০১ বৃষ্টির আশায়

দ্বিতীয় পর্ব

অব্যক্ত অনুভূতিগুলো কখনো পুরোপুরি চাপা পড়ে না। মনের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকে। জীবনের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তে বেরিয়ে এসে তছনছ করে দেয় সবকিছু।
—সিগমুন্ড ফয়েড

২.১

অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ডায়েরি থেকে জুলাই ১৬

আমি কখনো ভাবিনি, বৃষ্টির আশায় এভাবে চাতক পাখির মত বসে থাকতে হবে আমাকে। তাপদাহের চতুর্থ সপ্তাহে এসে এখন আর টেকা যাচ্ছে না। দিন দিন বেড়ে চলেছে তাপমাত্রা। মনেই হচ্ছে না যে ইংল্যান্ডে আছি। যদি গ্রিস বা অন্য কোন গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে থাকতাম, তাহলে অভিযোগ করতাম না।

 আজ হ্যাম্পস্টেড হিথ পার্কে বসে লিখছি ডায়েরিতে। পুরো পার্কজুড়ে অর্ধনগ্ন মানুষের অবাধ বিচরণ, সৈকত বা যুদ্ধক্ষেত্র বলে ভুল হতে পারে প্রথম দর্শনে। যে যার মত বেঞ্চে বা ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে বসে আছে। আমি বড় দেখে একটা গাছের ছায়া খুঁজে নিয়েছি আগেভাগেই। ছ’টা বাজতে চললো, এখন তাপমাত্রা কিছুটা কমবে। ডুবন্ত সূর্যের উজ্জ্বল লাল-সোনালী আলোয় পার্কটাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ঘাসগুলো দেখে মনে। হচ্ছে কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওগুলোর গায়ে।

 এখানে আসার পথে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে ফেলেছিলাম। ছোটবেলায় বাইরে খেলতে বেরুলে এরকমটা করতাম মাঝে মাঝে। হাঁটতে হাঁটতে এরকমই এক গ্রীষ্মের কথা মনে পড়ে গেল, মা মারা যায় সে বছর। বাইরে। বের হলে পল সবসময় আমার সাথে আসতো, দুজন একসাথে সাইকেল চালাতাম সোনালি মাঠে। চারপাশে বুনো ডেইজির মেলা। আমার স্মৃতিতে সেবারের গ্রীষ্মটা অমলিন। মার কথা মনে হলেই তার রঙিন পোশাকগুলোর ছবি স্মৃতির চোখে ফুটে ওঠে। টপসের ফিতাগুলো দেখে মনে হতো একদম নাজুক, ঠিক মা’র মতন। বড্ড বেশি চিকন ছিল সে। রেডিও ছেড়ে দিয়ে পপ গানের তালে তালে আমাকে নিয়ে নাচতো। তার শরীর থেকে যে শ্যাম্পু আর নিভিয়া ক্রিমের সুবাস আসতো, তা এখনও আমার নাকে লেগে আছে। তবে এ দুটোর সাথে ভদকা আর সিগারেটের গন্ধও পেতাম। তার বয়স কত ছিল তখন? আটাশ? উনত্রিশ? এখন আমার যে বয়স, তার থেকে কম।

একটু অদ্ভুত না ব্যাপারটা?

এখানে আসার সময় একটা ছোট পাখিকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখি, গাছের কোণ ঘেঁষে। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো বাসা থেকে কোন কারণে পড়ে গেছে। একদমই নড়ছিল না দেখে ভাবলাম পাখনা ভেঙে যেতে পারে। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার পরেও যখন কিছু হলো না, তখন সাবধানে উল্টিয়ে দিলাম। দৃশ্যটা দেখে আরেকটু হলেই বমি হয়ে যেত। পাখিটার পেটের ভেতরে পোকা কিলবিল করছে। গা গুলিয়ে উঠেছিল।

এখনও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না দৃশ্যটা।

.

জুলাই ১৭

এই প্রচণ্ড গরমে বাধ্য হয়ে একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফের ভেতরে আশ্রয় নিতে শুরু করেছি। ক্যাফে দি আরটিস্টা। ভেতরটা একদম কনকনে ঠাণ্ডা, মনে হয় যেন ফ্রিজের ভেতরে ঢুকে বসে আছি। প্রতিদিন জানালার পাশে নির্দিষ্ট একটা সিটে বসে আইস কফি খাই। মাঝে মাঝে কফি খাওয়ার পাশাপাশি বই পড়ি বা টুকটাক জিনিস নোট করি। ইচ্ছে হলে ছবিও আঁকি। তবে বেশিরভাগ সময়ই নিজের গরজে চলতে দেই মনটাকে, হারিয়ে যাই ভাবনায়। কাউন্টার স্ট্যান্ডের পেছনে বসে থাকা সুন্দরি মেয়েটা সারাক্ষণ একঘেয়ে ভঙ্গীতে ফোন গুঁতায়, মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকায় আর নিয়মিত বিরতিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তবে গতকাল ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ও দেখে বুঝতে পারি যে আমার চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে সে, তাহলে দোকান বন্ধ করতে পারবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে পড়ি।

 এই গরমে হাঁটা আর কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া একই কথা। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠি। আমাদের শরীর অভ্যস্ত নয় এরকম আবহাওয়ার সাথে। তাছাড়া গ্যাব্রিয়েল আর আমার বাসায় এসিও নেই, আসলে এখানকার কারো বাসাতে যে এসির দরকার হবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি। কিন্তু ইদানীং গরমের চোটে রাতে ঘুমোতেও অসুবিধে হয়। গা থেকে চাদর ফেলে দিয়ে অন্ধকারে ঘর্মাক্ত, নগ্ন শরীরে শুয়ে থাকি। জানালা খোলা রেখেও কোন লাভ নেই, বাইরে একটা গাছের পাতাও নড়ে না। শুধুই ভ্যাপসা গরম।

গতকাল একটা ইলেকট্রিক ফ্যান কিনেছি। রাতের বেলা সেটা বিছানার পায়ের দিকটাই বসিয়ে দেই।

 গ্যাব্রিয়েল গাইগুই শুরু করে দেয় সাথে সাথে। “বড় বেশি শব্দ। আমাদের ঘুমই হবে না।”

“ঘুম না আসুক। অন্তত গরমে সিদ্ধ হতে হবে না।”

কিছুক্ষণ গজগজ করলেও আমার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে ও। কিন্তু আমার চোখে ঘুম আসে না, চুপচাপ শুয়ে ফ্যানের আওয়াজ শুনতে থাকি। খারাপ লাগে না কিন্তু শব্দটা। শব্দের তালে তালে একসময় আমিও হারিয়ে যাই ঘুমের দেশে।

বাড়ির ভেতরে সবখানে ফ্যানটাকে সাথে নিয়ে ঘুরি। আজ বিকালে বাগানের শেষ মাথায় আমার স্টুডিওতেও নিয়ে যাই। ওটা না থাকলে ভেতরে টিকতেই পারতাম না। তবুও কিছু আঁকা সম্ভব হয় না। এই গরমে কাজ করা যায় নাকি?

 তবে একটা উপকার হয়। জিশুর ছবিটা নিয়ে কেন খচখচ করছিল মন, তা বুঝতে পারি। রঙ বা আঁকার ধরণে কোন সমস্যা নেই। মূল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ক্রুশবিদ্ধ লোকটার চেহারার সাথে জিশুর চেহারার কোন মিল নেই।

মিল আছে গ্যাব্রিয়েলের।

এত বড় একটা ব্যাপারে কিভাবে চোখ এড়িয়ে গেল বুঝলাম না। অবচেতন মনেই গ্যাব্রিয়েলের ছবি আঁকা শুরু করেছি। ওর চেহারা, ওর শরীর। অদ্ভুত না ব্যাপারটা? তবে এখন আর কিছু করার নেই, এভাবেই আঁকতে হবে। মাঝে মাঝে শিল্পই শিল্পীকে নিয়ন্ত্রণ করে।

আরেকটা ব্যাপার পরিস্কার হয়ে গেল, আগে থেকে একদম নির্দিষ্ট কোন আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করে আমার পক্ষে ছবি আঁকা সম্ভব নয়। তাহলে ছবিতে কোন প্রাণ থাকে না। কিন্তু আমি যদি মনোযোগ দিয়ে নিজের মত করে আঁকতে থাকি, তাহলে আর কোন ঝামেলা হয় না। অদৃশ্য কোন শক্তি আমাকে পথে দেখিয়ে নিয়ে যায়। এমন কোথাও, যেখানটায় যাবার কথা আমি হয়তো কল্পনাও করিনি, কিন্তু সেখানে সবকিছু জীবন্ত, প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরপুর।

তবে অনিশ্চয়তাটুকু আমাকে ভোগায়। কি হতে যাচ্ছে সেটা না জানা থাকলে অস্বস্তি লাগে। আর সেজন্যেই আগে থেকে কিছু খসড়া স্কেচ একে রাখি, তবে খুব একটা লাভ হয় না। স্কেচগুলো একদমই নিষ্প্রভ লাগে দেখতে। সুতরাং চূড়ান্ত ফলাফল কি হবে সেটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করাই আমার জন্যে ভালো। এখন যেহেতু জেনেই গিয়েছি যে গ্যাব্রিয়েলের ছবি আঁকছি, তাহলে আবার শুরু করতে পারবো।

ওকে বলবো আমার জন্যে পোজ দিতে। শেষ কবে আমার পেইন্টিংয়ের জন্যে মডেল হয়েছিল, ভুলেই গেছি। আশা করি ও ছবির বিষয়বস্তুর ব্যাপারে কিছু মনে করবে না।

মাঝেমধ্যে একটু অদ্ভুত আচরণ করে বসে গ্যাব্রিয়েল।

.

জুলাই ১৮

আজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে ক্যামডেন মার্কেটে চলে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েক বছর ওখানে পা পড়েনি আমার। শেষবার যাই গ্যাব্রিয়েলের তরুণ বয়সের স্মৃতি রোমন্থনে। বন্ধুদের সাথে ওখানে প্রায়ই আড্ডা দিত আর ড্রিঙ্ক করতো ও। মাঝে মাঝে নাকি পুরো রাত কাটিয়ে ভোরে বাসায় ফিরতো। আবার কাকডাকা ভোরে মার্কেটের সামনে জড়ো হয়ে দোকানিদের স্টল সাজানো দেখতো। অবশ্য আমার ধারণা স্টল সাজানোর দেখার চাইতে গাঁজার ডিলারের কাছ থেকে গাঁজা সংগ্রহ করার প্রতিই ওদের আগ্রহ ছিল বেশি। ক্যামডেন লেকের পাশে ব্রিজের ওদিকটায় মাদক বিক্রেতাদের আখড়া। আমি আর গ্যাব্রিয়েল যেবার যাই, তখন অবশ্য তাদের কেউ ছিল না। একটু হতাশই মনে হয় ওকে। “চেনাই যায় না। পর্যটক আকর্ষণের জন্যে সবকিছু নষ্ট করে ফেলেছে।”

 আজকে ইতস্তত হেঁটে বেড়াবার সময় ভাবছিলাম পরিবর্তন কার বেশি হয়েছে। গ্যাব্রিয়েল, নাকি মার্কেটটার? এখনও ষোল-সতেরো বছরের ছেলেমেয়েরা স্বল্পবসনে ঘুরে বেড়ায় জায়গাটাতে। ছেলেদের পরনে শর্টস আর মেয়েদের বেশিরভাগেরই গায়ে বিকিনি টপস। গরমের চোটে সবার চেহারাই রক্তিম। তবে এই বয়সি ছেলেমেয়েদের সহজাত কামনা-লালসা একদম পরিস্কার অনুভব করা যায়। জীবনকে উপভোগ করার অমিয় তাড়না। হঠাৎ করেই গ্যাব্রিয়েলকে কাছে পেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আমার ওপরে ওর নগ্ন শরীর…শক্ত পা জোড়া চেপে ধরে আছে আমাকে…আর ভাবতে পারছিলাম না। সেক্সের সময় গ্যাব্রিয়েলের প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে যায় সবসময়। ওকে নিজের ভেতরে অনুভব করার তীব্র আকাঙ্ক্ষাটুকু ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের সম্পর্কের এই অংশটুকু বরাবরই অপার্থিব মনে হয়। পবিত্র।

এসব ভাবনার মাঝখানেই হঠাৎ আবিষ্কার করি যে এক ভবঘুরে ফুটপাথ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ফিতা দিয়ে কোন মতে বাঁধা তার ট্রাউজারটা, পায়ের জুতো টেপ দিয়ে আটকানো। গা ভর্তি ঘা, মুখটা একদম লাল হয়ে আছে। হঠাৎই লোকটার জন্যে বড় মায়া হয় আমার। সচরাচর এরকম পরিস্থিতিতে মুখ ঘুরিয়ে নেয়াই আমার অভ্যাস। কিন্তু আজকে পার্স থেকে খুচরো কিছু পয়সা বের করে তার সামনে রাখি। একবার মনে হয় আমার উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলে উঠেছে সে, কিন্তু পরবর্তীতে টের পাই একা একাই কথা বলছে।

এরপর ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরি। আমাদের বাসাটা একটু উঁচু জায়গায় হওয়ায় ফেরার পথে বরাবরই কষ্ট বেশি হয়। কিন্তু আজকে রাস্তাটা গতানুগতিকের চেয়ে বেশি খাড়া মনে হচ্ছিলো। তার ওপর বিশ্রী গরম। কোন এক অজ্ঞাত কারণে ভবঘুরে লোকটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। করুণার পাশাপাশি মনের ভেতরে আরেকটা অনুভূতির উপস্থিতি টের পাই-ভয়। কিন্তু ভয়টা যে কিসের তা বলতে পারবো না। লোকটাকে তার মায়ের কোলে কল্পনা করছিলাম। মহিলা কি কখনো ভেবেছিল যে তার সন্তান এরকম মানবেতর জীবন যাপন করবে এক সময়? সারা শরীরে ময়লা মেখে নিজমনে বিড়বিড় করবে?

আমার মার কথা মনে হলো এসময়। তার মাথায় কি কোন সমস্যা ছিল? সেজন্যেই কাজটা করেছিল? আমাকে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে স্বেচ্ছায় সরাসরি গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল সামনের লাল দেয়াল লক্ষ্য করে? তার হলুদ গাড়িটা বরাবরই পছন্দ ছিল আমার। তখন হলুদ রংটাকে প্রফুল্লতার প্রতীক মনে হতো। কিন্তু এখন যতবার হলুদ কিছু দেখি, মৃত্যুর কথা ভাবি।

কাজটা কেন করেছিল সে? এর উত্তর বোধহয় কখনোই পাবো না। একসময় ভাবতাম যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল মা, কিন্তু এখন মনে হয় আমাকে হত্যা করাই মূল উদ্দেশ্যে ছিল তার। আমিও তো ছিলাম গাড়িতে, তাই না? কিন্তু এই ভাবনাটা অমূলক। আমাকে কেন হত্যা করতে চাইবে সে?

হাঁটতে হাঁটতেই চোখের কোণে পানি জমে আমার। আসলে মার জন্যে কাঁদছিলাম না। এমনকি আমার নিজের জন্যে বা ঐ ভবঘুরে লোকটার জন্যেও না। আসলে কাঁদছিলাম আমাদের সবার জন্যে। খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে কথাটা? চারদিকে এত কষ্ট, অথচ আমরা কিছু না দেখার ভান করি। সত্যটা হচ্ছে, আমরা সবাই ভীতু। নিজেকে ভয় পাই আমি। আমার ভেতরে থাকা মায়ের ছায়াটাকে ভয় পাই। পাগলামি কি আমার রক্তে? আমিও কি তার মতন

না। আর কিছু লেখা যাবে না এই বিষয়ে।

 নিজেকে কথা দিয়েছিলাম যে ডায়েরিতে এসব ব্যাপারে কিছু লেখবো না।

.

জুলাই ২০

গত রাতে আমি আর গ্যাব্রিয়েল বাইরে খেতে গিয়েছিলাম। প্রতি শুক্রবারেই সাধারণত এই কাজ করি আমরা। গ্যাব্রিয়েল মজা করে আমেরিকানদের মত ‘ডেট নাইট’ বলে ব্যাপারটাকে।

 ওর মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে। আবেগী যে কোন কিছু নিয়ে ঠাট্টা করবে। নিজেকে আবেগহীন আর শক্ত মনের ভাবতে পছন্দ করে ও। কিন্তু সত্যি বলতে ভেতরে ভেতরে দারুণ রোমান্টিক একটা ছেলে গ্যাব্রিয়েল। তবে সেটা তার কাজে বোঝা যায়, কথায় নয়। গ্যাব্রিয়েলের কর্মকাণ্ডে আমার প্রতি ওর ভালোবাসাটুকু টের পাই।

“কোথায় যেতে চাও?” জিজ্ঞেস করি।

 “বলো দেখি কোথায় যেতে চাই, তিনটা সুযোগ দিলাম।”

 “অগাস্টোস?”

 “বাহ, একবারেই পেরেছে।”

অগাস্টোস হচ্ছে আমাদের এখানকার স্থানীয় ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ। সেরকম আহামরি কোন জায়গা না, কিন্তু গ্যাব্রিয়েল আর আমার অনেক পছন্দের। অনেকগুলো সন্ধ্যা সেখানে একসাথে কাটিয়েছি আমরা।

আটটা নাগাদ পৌঁছে যাই। এসি কাজ করছিল না তাই ঠাণ্ডা ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে জানালার পাশের টেবিলটায় বসি। ডিনার শেষ হতে হতে উল্টোপাল্টা বকা শুরু করি বেশি ওয়াইন গেলার ফলে। অল্পতেই হেসে উঠছিলাম বাচ্চাদের মতন। রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়েই একজন আরেকজনকে চেপে ধরে চুমু খাই আর বাসায় এসে সেক্স করি।

এ কদিনে ফ্যানটার সাথে মানিয়ে নিয়েছে গ্যাব্রিয়েল। অন্তত বিছানায় থাকার সময় কিছু বলে না। ফ্যানটা পায়ের কাছে বসিয়ে শীতল হাওয়ায় নগ্ন শরীরে ওর বাহুড়োরে শুয়ে থাকি। ‘আই লাভ ইউ’-কিছুক্ষণ পর আমার কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে গ্যাব্রিয়েল। জবাবে আমি কিছু বলিনি, বলার দরকারও নেই। ও জানে আমার মনের কথা।

কিন্তু ছবি আঁকার জন্যে মডেল হতে বলে সুন্দর মুহূর্তটার গায়ে পানি ঢেলে দেই আমি।

 “তোমার ছবি আঁকবো।”

 “আবার? এঁকেছো তো।”

“সেই চারবছর আগে। আবারো আঁকতে চাই।”

“ওহ।” খুব একটা উৎসাহী মনে হয় না ওকে। “কী রকম ছবি আঁকবে?”

এক মুহূর্ত দ্বিধাবোধ করে জিশুর ছবিটার ব্যাপারে বলি! শুনে উঠে বসে গ্যাব্রিয়েল। মুখের হাসিটা যে জোর করে আনা সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না।

“কী যে বলল না।”

“কেন? কী হয়েছে?”

“আমার মনে হয় না এই আইডিয়াটা ভালো।”

“ভালো না হবার কী আছে?”

 “ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় আমাকে দেখে লোকে কী বলবে?”

“লোকে কি বলবে সেটা নিয়ে তুমি পরোয়া করা শুরু করলে কবে থেকে?”

“কিছু ব্যাপারে পরোয়া না করলে চলে না। ওরা হয়তো ভাববে, আমাকে এরকমটা দেখতেই পছন্দ করো তুমি।”

 হেসে উঠেছিলাম। “তোমাকে কেউ জিশু ভাববে না, এসব ভেবো না। শুধুই একটা ছবি। অবচেতন মনেই তোমাকে আঁকা শুরু করেছিলাম, জানো? সাতপাঁচ ভাবিনি।”

“হয়তো ভাবা উচিৎ।”

“কেন? ছবিটা দ্বারা তো আমি তোমাকে নিয়ে বা আমাদের বিয়ে সম্পর্কে কিছু বোঝাতে চাচ্ছি না।”

“তাহলে কি বোঝাতে চাচ্ছো?”

 “সেটা আমি কি করে বলবো?”

এই কথা শুনে হেসে ফেলে গ্যাব্রিয়েল। “আচ্ছা বাবা, এঁকো! এত করে চাইছো যখন তোমার কাজের ওপর ভরসা আছে আমার।

কথাটা হয়তো একটু প্রাণহীন ঠেকতে পারে, কিন্তু আমি জানি যে আমার আর আমার ছবি আঁকার প্রতিভার ওপর বিশ্বাস আছে গ্যাব্রিয়েলের। ও না থাকলে আমি কখনোই পেইন্টার হতে পারতাম না। ও যদি আমাকে বারবার উৎসাহ না দিত তাহলে ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করার পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই দমে যেতাম। দেখা যেত এখনও জিন-ফিলিক্সের সাথে দেয়ালে দেয়ালে ছবি এঁকে বেড়াচ্ছি। গ্যাব্রিয়েলের সাথে দেখা হবার আগে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, আর সেই সাথে নিজেকে। সেই সময়ের নেশাখোর বন্ধুদের প্রতি কোন টান কাজ করে না আমার। শুধুমাত্র রাতেই দেখা পাওয়া যেত ওদের, দিনের বেলা উধাও হয়ে যেত বাদুড়দের মতন।

গ্যাব্রিয়েল আমার জীবনে আসার পর ওরা ব্রাত্য হয়ে পড়ে, সে নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথাও ছিল না। আসলে এরকম একজন মানুষকে পেলে আর কাউকে দরকার হয় না। আমাকে ভুল পথ থেকে আলোর পথে এনেছে গ্যাব্রিয়েল, জিশুর মতন। এজন্যেই বোধহয় ছবিতে ওর চেহারাই ফুটিয়ে তুলেছি আনমনে। গ্যাব্রিয়েলই আমার জীবন, আমাদের দেখা হবার একদম প্রথম দিন থেকেই। ও যা-ই করুক বা যা-ই বলুক না কেন, ওকে সবসময় ভালোবেসে যাবো আমি। সবসময়। ও যেমন, সেভাবেই ওকে আপন করে

একমাত্র মৃত্যুর আমাদের আলাদা করতে পারবে।

.

জুলাই ২১

আজকে গ্যাব্রিয়েল স্টুডিওতে আমাকে সময় দিয়েছে।

 “দিনের পর দিন কিন্তু এভাবে বসে থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে,” বলে সে। “কতদিন লাগতে পারে?”

“এক-দুই দিনে হবে না, এটা নিশ্চিত।”

“গোটাটাই তোমার আমাকে কাছে পাবার চক্রান্ত নয় তো? সেক্ষেত্রে এসব ধনফুন বাদ দিয়ে বিছানায় চলো।”

 হেসে ফেললাম। “দাঁড়াও, আগে কাজ শেষ করি। যদি ভদ্র ছেলের মত চুপচাপ বসে থাকো, তাহলে পুরষ্কার পাবে।

গ্যাব্রিয়েলকে ফ্যানের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলাম। বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছিল।

“কেমন পোজ দেব?”

 “কোন পোজ দেয়া লাগবে না, স্বাভাবিক থাকো।”

 “খুব কষ্ট পাচ্ছি, এরকম বোঝাব?”

“জিশু ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছিলেন কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার। কিংবা কষ্ট পেলেও কাউকে বুঝতে দেননি। আহ, মুখ ওরকম করো না তো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। নড়বে না একদম।”

“জি, বস।”

বিশ মিনিট ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকে গ্যাব্রিয়েল। এরপর বলে যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

“বসো তাহলে। কিন্তু কথা বলবে না। চেহারাটা আঁকছি এখন।”

 চুপ করে চেয়ারে বসে পড়ে গ্যাব্রিয়েল, আর কিছু বলে না। ওর চেহারা এঁকে আসলেও মজা পাচ্ছিলাম। কি সুন্দর একটা চেহারা! শক্ত চোয়াল, চাপার হাড্ডিগুলোর একদম পরিস্কার বোঝা যায়। নাকটাও সুন্দর। মনে হচ্ছিল যে এক গ্রিক দেবতা বসে আছে আমার সামনে।

কিন্তু কী যেন একটা ঠিক নেই। কী, সেটা বলতে পারবো না। হয়তো নিজের ওপরে বেশি চাপ দিচ্ছি। ওর চোখটা অনেকবার চেষ্টা করেও ঠিকমতো আঁকতে পারলাম না। অথচ প্রথমবার যখন গ্যাব্রিয়েলকে দেখি, ওর উজ্জ্বল চোখ দুটোই আকর্ষণ করে সবচেয়ে বেশি। সেটা হাজার চেষ্টা করেও ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না, হয়তো এরকম কিছু আঁকার প্রতিভাই নেই আমার। অথবা এমনটাও হতে পারে যে গ্যাব্রিয়েলের সৌন্দর্য ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় কারো পক্ষে। ছবির চোখগুলো বড় বেশি প্রাণহীন লাগছিল, কিছু একটা নেই। বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম ধীরে ধীরে।

“ধুর, হচ্ছে না।” হতাশ সুরে বলি কিছুক্ষণ পর।

“বিরতি নেবে?”

 “হ্যাঁ, বিরতি নেয়া যাক।”

 “সেক্সের বিরতি।”

হেসে ফেললাম আবারো। “ঠিক আছে।”

লাফিয়ে সামনে এসে আমাকে তুলে নিল গ্যাব্রিয়েল। স্টুডিওর মেঝেতেই একজন আরেকজনকে আদর করতে শুরু করি আমরা।

কিন্তু আমার নজর বারবারই ইজেলে আটকানো ক্যানভাসটার দিকে চলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন গ্যাব্রিয়েলের প্রাণহীন চোখটা সেখান থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জোর করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই।

তবুও টের পাচ্ছিলাম যে আমাকেই দেখছে চোখজোড়া।

.

২.২

অ্যালিসিয়ার সাথে দেখা করার ব্যাপারে রিপোর্ট দেয়ার জন্যে ডায়োমেডেসের অফিসে গেলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি স্বরলিপিগুলো গোছগাছ করছেন।

“তারপর,” মুখ না তুলেই বললেন। “কেমন বুঝলে?”

“কিছু বোঝার সুযোগই পাইনি।”

বিভ্রান্তি ভর করলো তার দৃষ্টিতে।

“অ্যালিসিয়ার সাহায্য তখনই করা যাবে, যখন ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারবে সে। আশপাশে কি হচ্ছে সেটা না বুঝলে কিছুই সম্ভব নয়।”

“ঠিক। কিন্তু তুমি এই কথাগুলো বলছে, কারণ…”

“আসলে ওকে যে ঔষধগুলো দেয়া হচ্ছে, সেগুলো এত কড়া ডোজের যে কারো কোন কথা সে মোটামুটি বুঝতেই পারছে না।”

ভ্রু কুঁচকে গেল প্রফেসর ডায়োমেডেসের। “এটা একটু বেশি বেশি বলে ফেললে। ওকে কি ঔষধ দেয়া হচ্ছে, সেটা অবশ্য ঠিক জানি না।”

“ইউরির সাথে কথা বলেছি আমি। ষোল মিলিগ্রাম রিস্পেরিডোন। এই তোজে তো একটা ঘোড়াও কাবু হয়ে যাবে।”

ভ্রূ নাচালেন ডায়োমেডেস। “এটা তো আসলেই বেশি। কমানো যেতে পারে। অ্যালিসিয়ার চিকিৎসা দলের প্রধান হচ্ছে ক্রিস্টিয়ান। ওর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারো।”

“আপনি বললেই ভালো হয়।”

“হুম।” সন্দেহ ভর করলো ডায়োমেডেসের দৃষ্টিতে। “তুমি আর ক্রিস্টিয়ান আগে থেকেই একে অন্যকে চেনো, তাই না? ব্রডমুরে পরিচয় হয়েছিল বোধহয়?”

“আসলে খুব ভালো করে চিনি বলাটা ঠিক হবে না।”

তৎক্ষণাৎ কিছু বললেন না ডায়োমেডেস। সামনে রাখা চিনি দেয়া কাঠবাদামের বাটি থেকে একটা বাদাম তুলে নিয়ে আমাকে সাধলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে দিলাম।

বাদামটা মুখে দিয়ে সময় নিয়ে চিবুলেন। আমার দিক থেকে চোখ সরালেন না। “তোমার আর ক্রিস্টিয়ানের মধ্যে সব ঠিকঠাক তো?”

“প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত। এটা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে একে অপরকে সহ্য করতে পারো না তোমরা।”

“আমার তরফ থেকে কোন সমস্যা নেই।”

“কিন্তু ওর তরফ থেকে?”

“সেটা ক্রিস্টিয়ানকেই জিজ্ঞেস করতে হবে আপনাকে। ওর সাথে কাজ করতে কোন অসুবিধে নেই আমার।”

“ঠিক আছে। হয়তো ভুল ভেবেছি। তবুও একটু কেমন যেন লাগছে…ভেবো ব্যাপারটা নিয়ে। কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বা ব্যক্তিগত রেষারেষি কিন্তু ভালো ফল বয়ে আনে না। একসাথে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে তোমাদের।”

“জি, জানি সেটা।”

“বেশ, ক্রিস্টিয়ানের সাথেও এই ব্যাপারে আলাপ করা উচিৎ। তুমি চাইছে যাতে অ্যালিসিয়া চেতনা ফিরে পাক। কিন্তু মনে রেখো, এটা ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে।”

“কার জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ?”

“অ্যালিসিয়া, আর কার?” আমার উদ্দেশ্যে আঙুল নাচাতে শুরু করলেন। ডায়োমেডেস। “ভুলে গেলে চলবে না, বেশ কয়েকবার আত্মঘাতী কাজ করেছে অ্যালিসিয়া। নিজের জীবন শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সেজন্যেই কিন্তু কড়া ডোজের ঔষধ দেয়া হয়েছে ওকে। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হলে আর এরকম চিন্তা মাথায় ভর করবে না। এখন যদি ভোজ কমানো হয়, তাহলে আবারো উল্টোপাল্টা কিছু করে বসতে পারে। এই ঝুঁকিটা নিতে রাজি তুমি?”

প্রফেসরের কথায় যুক্তি আছে। তা সত্ত্বেও মাথা নাড়লাম। “এই ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে, প্রফেসর। নতুবা অ্যালিসিয়াকে সাহায্য করা সম্ভব নয়।”

কাঁধ ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। “তাহলে তোমার হয়ে ক্রিস্টিয়ানের সাথে কথা বলবো।”

“ধন্যবাদ।”

“ও ব্যাপারটাকে কিভাবে নেয়, সেটা দেখার বিষয়। সাইকিয়াট্রিস্টরা সচরাচর তাদের নিজের কাজে অন্য কারো নাক গলানোর ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয় না। তবে আমার কথার ওপরে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু এরকমটা সাধারণত করিনা আমি। কৌশলে বলতে হবে। তোমাকে জানাবো কি হলো?”

“আমার কথা না উল্লেখ করলেই বোধহয় ভালো হবে।”

“তাই?” অদ্ভুত হাসি ফুটলো ডায়োমেডেসের মুখে। “ঠিক আছে, তোমার ব্যাপারে কিছু বলবো না।”

ডেস্ক থেকে একটা ছোট বক্স বের করলেন প্রফেসর, ভেতরে সারি করে রাখা বেশ কয়েকটা চুরুট। আমাকে সাধলেন একটা। না করে দিলাম।

 “ধূমপান করো না?” কিছুটা অবাক মনে হলো তাকে। “তোমাকে দেখে তো মনে হয়েছিল স্মোকার।”

“না, না। কালেভদ্রে খাই আর কি…চেষ্টা করছি অভ্যাসটা ছেড়ে দিতে।”

“বাহ্, ভালো তো।”জানালা খুললেন ডায়োমেডেস। “থেরাপিস্টদের কেন ধূমপান করা সাজে না, সেই কৌতুকটা শুনেছো না? ধূমপানের অর্থ তোমার নিজেরই কোন সমস্যা আছে।”হেসে একটা চুরুট মুখে দিলেন। “এখানে আমাদের সবার মাথাতেই এক আধটু সমস্যা আছে, কি বলো?”

আবারো হাসলেন ডায়োমেডেস। চুরুট জ্বালিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বাইরে ধোয়া ছাড়লেন। ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ মুহূর্তে কিছু করার নেই আমার।

.

২.৩

লাঞ্চের পর করিডোরে পায়চারি করতে লাগলাম। আসলে বাইরে যাবার ছুতো খুঁজছি, একটা সিগারেট না খেলেই নয়। এসময় ইন্দিরার সাথে দেখা হয়ে গেল, ভাবলেন আমি বুঝি হারিয়ে গেছি।

“চিন্তা কোরো না থিও,” আমার হাত ধরে বললেন। “এখানকার সব রাস্তা চিনতে আমারো কয়েক মাস লেগে গেছে। গোলকধাঁধা মনে হয় মাঝে মাঝে। এখনও প্রায়ই হারিয়ে যাই, চিন্তা করো!” হাসি ফুটলো তার মুখে। আমি কিছু বলার আগেই চট করে চা খাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। না করতে পারলাম না।

“কেতলিটা গরম দেই, দাঁড়াও। এত্ত বাজে আবহাওয়া। এর চেয়ে তুষারপাত হলেই ভালো। আমার কি ধারণা জানো? তুষারপাতের সাথে মানুষের মানসিক অবস্থার একটা সম্পর্ক আছে। অনেকক্ষণ টানা তুষারপাতের পর সবকিছু কিন্তু একদম সাদা হয়ে যায়, মনে হয় যে নতুন করে শুরু করতে হবে সবকিছু। কিন্তু তুষারের নিচে আগের জিনিসগুলো কিন্তু ঠিকই থাকে। মানুষও এরকম নতুন করে শুরু করতে চায়। তুষারপাতের সময় রোগিদের দেখো ভালো করে, বুঝতে পারবে।”

আমাকে অবাক করে দিয়ে ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়ানো মোটা এক স্লাইস কেক বের করলেন তিনি। ওটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এই নাও। ওয়ালনাট কেক, গতরাতে বানিয়েছি।”

“আরে এটার কি দরকার ছিল।”

“আমি জানি ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত, কিন্তু রোগিদের হাতে একটা কেক ধরিয়ে দিয়ে সবসময় ভালো ফলাফলই পেয়েছি।”

হাসলাম। “এরকম সুস্বাদু কেক দিলে তো ফলাফল ভালো পাবেনই। আমি রোগি হিসেবে ঝামেলার নাকি?”

ইন্দিরার মুখেও হাসি ফুটলো। “আরে নাহ্। কিন্তু মাঝে সাঝে গোমড়া স্টাফদের হাতে কেক দিলে, তারাও খুশি হয় কিন্তু। তুমি অবশ্য মুখ গোমড়া করে রাখে না। একটু মিষ্টি কিছু খেলে কাজের উদ্যোম বেড়ে যায়। আগে তো আমি প্রায়ই ক্যান্টিনে দেয়ার জন্যে কেক বানাতাম, কিন্তু স্টেফানি আসার পর থেকে বাইরের খাবার নিয়ে বেশি কড়াকড়ি শুরু করেছে। তবুও মাঝে মাঝে কেক নিয়ে আসি ব্যাগে করে। নীরব প্রতিবাদ বলতে পারো। এখন খাও তো“।

এরকম আদেশ অমান্য করা যায় না। কেকে কামড় দিলাম। আসলেও দারুণ খেতে।

 “আপনার রোগিদের মন নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যায় কেক খাওয়ার পর,” মুখে কেক নিয়েই বললাম।

সন্তুষ্টির হাসি ফুটলো ইন্দিরার মুখে। কেন তাকে ভালো লাগে এটা পরিস্কার হয়ে গেল, একটা মা মা ভাব আছে তার মধ্যে। অনেকটা আমার পুরনো থেরাপিস্ট রুথের মতন। এরকম মানুষের মন কোন কারণে খারাপ, এটা ভাবতেও যেন কেমন লাগে।

আমরা এখন নার্স স্টেশনে। এখানকার সবাই জায়গাটাকে ‘গোল্ডফিশ বোউল বলে। চারপাশের কাঁচের জন্যেই এই নাম। যে কোন সাইকিয়াট্রিক ইউনিটের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে নার্স স্টেশন। চারদিকে নজর রাখা যায় কাঁচ ভেদ করে। কিন্তু উল্টোটা ঘটে সাধারণতবাইরে থেকে রোগিরাই সবসময় তাকিয়ে থাকে ভেতরের অধিবাসীদের দিকে। ছোট জায়গাটায় পর্যাপ্ত চেয়ার নেই। যেগুলো আছে, সেগুলোয় সাধারণত নার্সরা বসে টুকটাক কাজ করে। সুতরাং আমাদের বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে বা ডেস্কে হেলান দিয়ে থাকতে হয়। ভেতরে লোক যতই থাক, সবসময়ই মনে হবে যে অনেক ভিড়।

 “এই নাও তোমার চা।” বড় একটা মগ আমার হাতে ধরিয়ে দিল ইন্দিরা।

“ধন্যবাদ।”

এসময় ক্রিস্টিয়ান ঢুকলো ভেতরে। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়ায় একবার মাথা নাড়লো। সবসময় পিপারমিন্ট চুইংগাম চিবোনো ওর একটা অভ্যাস। ওটার গন্ধই নাকে এসে লাগলো। ব্রডমরে থাকতে দেখতাম কিছুক্ষণ পরপরই সিগারেট টানছে; এই একটা ব্যাপারেই মিল ছিল আমাদের। এরপর অবশ্য ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে ক্রিস্টিয়ান। বিয়ে করেছে, একটা মেয়েও আছে। বাবা হিসেবে সে কিরকম, কে জানে। ওকে কখনোই খুব একটা সহনশীল মনে হয়নি আমার।

 “আবারো কোন একটা নার্স স্টেশনে তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে এটা কখনো ভাবিনি, থিও,” শীতল হেসে বলল ক্রিস্টিয়ান।

“আমিও ভাবিনি। দুনিয়াটা বড় ছোট।”

“মানসিক স্বাস্থ্য খাতের চিন্তা করলে, আসলেও ছোট।” এমনভাবে কথাটা বলল যেন এর বাইরেও বড় একটা দুনিয়া আছে ওর। সেটা জিম বা রাগবি খেলার মাঠ বাদে আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয়না।

কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো ক্রিস্টিয়ান। ওর এই অভ্যাসটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কিছু বলার বা করার আগে প্রায়ই সময় নিয়ে ভাবে ও, ইচ্ছে করে অপেক্ষা করায়। ব্রডমুরে থাকতে খুবই বিরক্ত লাগতো ব্যাপারটা, এখনও লাগছে।

 “এরকম একটা সময়ে গ্রোভে যোগ দিলে কেন বুঝতে পারছি না,” এক পর্যায়ে বলল সে। “যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”

“অবস্থা এতটাই খারাপ?”

“সময়ের ব্যাপার মাত্র। ট্রাস্টের তরফ থেকে খুব শিঘ্রই ঘোষণা এসে পড়বে। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, জেনে বুঝে এরকম একটা ইউনিটে যোগ দিলে কেন তুমি?”

“মানে?”

“ডুবন্ত জাহাজ থেকে সাধারণত লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করে ইঁদুরের দল, চড়ে বসে না।”

ক্রিস্টিয়ানের এরকম সরাসরি আক্রমনে অবাক না হয়ে পারলাম না। তবে প্রতিক্রিয়া দেখানোটা বোকামি হবে। বরং কাঁধ ঝাঁকিয়ে উড়িয়ে দিলাম প্রচ্ছন্ন অভিযোগটা। “হতে পারে। কিন্তু আমি তো আর ইঁদুর নই।”

 ক্রিস্টিয়ান কিছু বলার আগেই ধপ করে একটা শব্দ হওয়ায় চমকে উঠলাম আমরা। বাইরে থেকে কাঁচের গায়ে কিল বসাচ্ছে এলিফ। মুখটাও চেপে রেখেছে শক্ত করে। রীতিমত একটা দানবীর মতন দেখাচ্ছে।

“এই বালের ওষধ আমি আর খাবো না। মাথা খারাপ করে দেয়।

গ্লাসের মধ্যেই একটা হ্যাঁচ খুলে দেয় ক্রিস্টিয়ান। “এখন তো আমাদের এসব নিয়ে আলাপ করার সময় নয়, এলিফ।”

“বললাম না, খাবো না। অসুস্থ লাগে সারাদিন-”

“যদি কথা বলতে চাও তাহলে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করো। এখন সরে দাঁড়াও এখান থেকে, প্লিজ।”

গড়িমসি করলেও কিছুক্ষণ পর চলে গজরাতে গজরাতে চলে যায়। এলিফ। যেখানে মুখ ঠেকিয়েছিল সেখানে ওর চেহারার একটা অবয়ব ফুটে উঠেছে।

“রোগি বটে একখান,” বললাম।

“এরকম রোগি সামলানো মুশকিল,” চিবিয়ে বলে ক্রিস্টিয়ান।

 মাথা নেড়ে সায় জানায় ইন্দিরা। “বেচারা এলিফ।”

 “এখানে পাঠানো হয়েছে কেন ওকে?”

“জোড়া খুন,” ক্রিস্টিয়ান বলল। “ওর মা আর বোনকে খুন করেছিল ঘুমের মধ্যে।”

কাঁচ ভেদ করে বাইরে তাকাই। অন্যান্য রোগিদের সাথে যোগ দিয়েছে। এখন এলিফ। সবার তুলনায় লম্বা সে। একজনকে দেখলাম ওর হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিতে, সেটা পকেটে খুঁজে ফেললো তৎক্ষণাৎ।

এসময় অ্যালিসিয়াকে খেয়াল করলাম বাইরে এক কোণায়। জানালা দিয়ে আনমনা দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ দেখলাম ওকে।

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকালো ক্রিস্টিয়ান। “ওহ আচ্ছা, অ্যালিসিয়ার ওষুধের ব্যাপারে ডায়োমেডেসের সাথে কথা হয়েছে আমার। রিস্পেরিডোনের ডোজ কমিয়ে দেয়ার ফলাফল কি হয় সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। এখন প্রতিদিন পাঁচ মিলিগ্রাম করে দেয়া হয় ওকে।”

“আচ্ছা।”

“ভাবলাম তোমাকে জানিয়ে রাখি, যেহেতু ওর সাথে এক সেশনে দেখা করেছে।”

“হ্যাঁ।”

“এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে অ্যালিসিয়াকে, ব্যবহারে কোন পরিবর্তন আসে কি না বুঝতে হবে। আরেকটা কথা, এর পরে যদি কখনো আমার কোন রোগির ওষুদের ডোজ পরিবর্তনের কথা বলতে হয়, তাহলে সরাসরি আমার কাছে আসবে। ডায়োমেডেসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের কোন দরকার নেই,” চোখ পাকিয়ে কথাটা বলল ক্রিস্টিয়ান।

জবাবে হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে। “কাউকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করিনি আমি। তোমার সাথে সরাসরি কথা বলতেও কোন সমস্যা নেই। আমার, ক্রিস্টিয়ান।”

 বেশ একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে ঘরটায়। মনস্থির করার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ক্রিস্টিয়ান। “তুমি তো এটা বুঝতে পারছো যে অ্যালিসিয়া রোগি হিসেবে বর্ডারলাইন। একটু এদিক সেদিক হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। থেরাপিতে কোন লাভই হবে না ওর। সময় নষ্ট করছে।”

“তুমি কিভাবে বুঝলে ও বর্ডারলাইন? কথাই তো বলতে পারে না।”

“বলতে পারে না বলাটা ভুল হবে। বলে না।”

“তোমার ধারণা গোটাটাই অভিনয়?”

 “হ্যাঁ।”

 “যদি অভিনয়ই হয়ে থাকে তাহলে তো বর্ডারলাইন হবার প্রশ্নই ওঠে না।”

বিরক্তির ছাপ ফুটলো ক্রিস্টিয়ানের চেহারায়।

তবে সে কিছু বলার আগেই ইন্দিরা হাত ওঠায়। “তোমাদের দুজনের মতের ওপরেই সম্মান রেখেই বলছি, বর্ডারলাইন’ কথাটা দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিস্কার করে কিছু কিছু বোঝা যায় না।”ক্রিস্টিয়ানের দিকে তাকালেন তিনি। এই ব্যাপারটা নিয়ে আগেও ক্রিস্টিয়ানের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে।”

“তাহলে আপনার অ্যালিসিয়াকে নিয়ে কি ধারণা?” জিজ্ঞেস করলাম।

কিছুক্ষণ প্রশ্নটা নিয়ে ভাবলেন ইন্দিরা। “আসলে ওর প্রতি মাতৃসুলভ একটা টান অনুভব করি আমি। কাউন্টার ট্রান্সফিয়ারেন্স বলতে পারো। ওকে দেখলেই আমার ভেতরের মাতৃসত্ত্বা জেগে ওঠে, মনে হয় কারো উচিৎ ওর দেখভাল করা।”আমার উদ্দেশ্যে একবার হাসি দেয় ইন্দিরা। “আর এখন ওর যত্ন নেয়ার মত মানুষ এসেছে এখানে। তুমি।”

 হেসে উঠলো ক্রিস্টিয়ান, ওর বিরক্তিকর সেই হাসি। শুনলেই পিত্তি জ্বলে ওঠে। “বোকার মত প্রশ্ন করার জন্যে মাফ করবেন, কিন্তু অ্যালিসিয়া যদি কথাই না বলে তাহলে থেরাপি থেকে কি লাভ হবে তার?”

“থেরাপির ক্ষেত্রে কথা বলাটাই সবকিছু নয়,” ইন্দিরা বললেন। “বরং বলতে পারো থেরাপির মাধ্যমে রোগিদের এটা বোঝানো হয় যে তাদের মত প্রকাশের জন্যে পরিবেশটা নিরাপদ। কথা বলা ছাড়াও মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারে মানুষ, সেটা নিশ্চয়ই ভালো করেই জানো তুমি।”

চেহারায় সবজান্তা একটা ভাব এনে আমার দিকে তাকায় ক্রিস্টিয়ান। “ভালো কোন জ্যোতিষী দেখিয়ে নিও। কপালে শনি আছে নাহলে।”

.

২.৪

“হ্যালো, অ্যালিসিয়া,” বললাম।

ওষুধের ডোজ কমানোর খুব বেশিদিন হয়নি, কিন্তু এই কদিনেই ওর মধ্য দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। চলাফেরায় আগের জড়তা নেই। চোখের দৃষ্টিও আগের তুলনায় পরিস্কার। মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মানুষকে দেখছি।

দরজায় ইউরির সাথে দাঁড়িয়ে আছে ও, দোটানায় ভুগছে। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেন এই প্রথম আমাকে খেয়াল করেছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে মানুষ হিসেবে আমি কেমন। ভেতরে ঢুকলে কোন সমস্যা হবে মেনে নিয়ে পা বাড়ালো সামনে। আজকে আর বসতে বলতে হলো না।

ইউরিকে চলে যাবার ইশারা করলাম। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে দরজা বন্ধ করে চলে গেল সে।

অ্যালিসিয়ার মুখোমুখি বসে আছি আমি। ঘরের নীরবতা ছাপিয়ে কানে আসছে বাইরের অবিরাম বর্ষণের শব্দ।

“আজকে কেমন লাগছে আপনার?”

 কোন জবাব পেলাম না। অ্যালিসিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখে পলক পড়ছে না।

মুখ খুলে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। ঠিক করেছি ওর চুপ করা থাকা সময়টায় আমিও যতটা সম্ভব কম কথা বলবো। এতে হয়তো ও নিজেকে আমার চারপাশে নিরাপদ অনুভব করবে, বুঝতে পারবে যে আমাকে ভরসা করা যায়। অর্থাৎ ওর কাছে এই বার্তাটা পৌঁছুনোর জন্যে মুখ খোলার কোন দরকার নেই আমার। ওকে কথা বলাতে চাইলে আগে ভরসা অর্জন করতে হবে। তবে সেজন্যে সময় দরকার, রাতারাতি কিছু হয় না।

চুপ করে বসে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে মাথার দুই পাশে দপদপ করতে থাকে আমার। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যাবে। রুথের কথা মনে হলো। প্রায়ই বলতো যে ভালো একজন থেরাপিস্ট হিসেবে রোগির অনুভূতিগুলো বুঝতে হবে তোমাকে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে অনুভূতিগুলো আসলে তোমার নয়, অন্য কারো। অর্থাৎ এখন যে আমার মাথা দপদপ করছে, এই কষ্টটা আসলে আমার নয়; অ্যালিসিয়ার। আর হঠাৎ করেই চিত্তে চেপে বসা এই তীব্র বিষণ্ণতা, মরে যাবার ইচ্ছেটাও ওর। চুপচাপ বসে অ্যালিসিয়ার হয়ে এগুলো অনুভব করতে লাগলাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল পঞ্চাশ মিনিট।

আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম। “আজকের সেশন এখানেই শেষ।”

মাথা নামিয়ে কোলের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো অ্যালিসিয়া। দৃশ্যটা দেখে নিজের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলাম না। পরবর্তী কথাগুলো একদম মন থেকেই বললাম।

“আপনাকে সাহায্য করতে চাই আমি, অ্যালিসিয়া। বিশ্বাস করুন কথাটা। সত্যিটা হচ্ছে, আমি চাই আপনি যাতে ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারেন।”

এবারে মুখ তোলে অ্যালিসিয়া। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।

আমাকে সাহায্য করার যোগ্যতা তোমার নেই, দৃষ্টিটা যেন চিৎকার করে বলে। নিজেকেই তো সাহায্য করতে পারোনি। এমন ভাব ধরো যেন বিরাট জ্ঞানী। আমার জায়গায় এখানে তোমার বসা উচিৎ। ভন্ড, মিথ্যুক, মিথ্যুক–

হঠাৎই একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়। গত পঞ্চাশ মিনিট এ ব্যাপারটাই খেচাচ্ছিল আমাকে। কথাটা বলে বোঝানো মুশকিল, একজন সাইকোথেরাপিস্ট চোখের দৃষ্টি বা অঙ্গভঙ্গি দেখে খুব দ্রুত তার রোগির মানসিক কষ্ট চিহ্নিত করতে শিখে যায়। আর এখানেই অ্যালিসিয়া ব্যতিক্রম। গত ছয় বছর ধরে এত চিকিৎসা, এত রকমের ঔষধ-এসব কিছু সত্ত্বেও তার চোখের দৃষ্টিটা এখন একদম টলটলে হ্রদের পানির মত পরিস্কার। পাগল নয় সে। তাহলে কি? চোখের এরকম দৃষ্টির মানেই বা কি? এটা

ভাবনাটা শেষ হবার আগেই চেয়ার থেকে আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অ্যালিসিয়া। সরে যাবার সময়টুকুও পেলাম না। তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যাই ওকে সহ।

মেঝেতে মাথা ঠুকে যায়। আমার ওপর চেপে বসেছে অ্যালিসিয়া। চুলগুলো মুঠি করে ধরে মাথাটা বারবার মেঝের সাথে বাড়ি দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর উপর্যুপরি থাপড়াতে আর খামচাতে শুরু করলো। খুব কষ্ট করে ওকে আমার ওপর থেকে সরালাম।

কোনমতে টেবিল অবধি পৌঁছে পার্সোনাল অ্যালার্মটা হাতে নিয়েছি, এসময় আবারো আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় অ্যালিসিয়া। অ্যালার্মটা ছুটে যায়।

 “অ্যালিসিয়া-”

 সাড়াশির মত ওর হাতজোড়া চেপে বসে আমার গলায়। আবারো অ্যালার্মটা হাতে নেয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু লাভ হয় না। আরো শক্ত হয়ে বসে যাচ্ছে ওর আঙুলগুলো, নিশ্বাস নিতে পারছি না। এবারের অ্যালার্মটার নাগাল পাই, বোতামটা সাথে সাথে চেপে ধরি সর্বশক্তিতে।

বিকট শব্দে বেজে ওঠে অ্যালার্ম। দূর থেকে ইউরির দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসে। চিৎকার করে অন্যদের ডাক দেয় সে। টেনে হেঁচড়ে আমার ওপর থেকে সরানো হয় অ্যালিসিয়াকে। এতক্ষণে বুক ভরে শ্বাস নেই।

চারজন নার্স মিলে শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে। তবুও সমানে হাত পা ছুঁড়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন অশরীরি, জান্তব কিছু ভর করেছে। দ্রুত ক্রিস্টিয়ান এসে একটা ইঞ্জেকশন দেয়। জ্ঞান হারায় অ্যালিসিয়া।

অবশেষে আবারো নীরবতা নেমে আসে ঘরটায়।

.

২.৫

“একটু জ্বলবে।”

 অ্যালিসিয়ার নখের আঁচড়ে ছিলে যাওয়া জায়গাগুলোয় অ্যান্টিসেপ্টিক লাগানোর সময় বলল ইউরি। নার্স স্টেশনে আমরা। অ্যান্টিসেপ্টিকের ঘ্রাণটা আমাকে স্কুলের ফাস্ট এইড জোনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। খেলার সময় পড়ে গিয়ে হাত পা ছিলে গেলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো আমাদের। এরপর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে সাহসিকতার জন্যে প্রত্যেকের হাতে একটা করে ক্যান্ডি ধরিয়ে দিতেন নার্স। অ্যান্টিসেপ্টিকের তীব্র জ্বলুনি বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে এল আমাকে। এখন আর আগের মত সহজেই ক্ষতগুলোর কথা ভুলে যাওয়া যায় না।

“মনে হচ্ছে কেউ যেন হাতুড়িপেটা করেছে আমাকে।”

“ভালো জোরেই মেরেছে, আরো ফুলে যাবে একটু পর। খেয়াল রেখো,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ইউরি। “তোমাকে ওর সাথে একা ছাড়াটাই উচিৎ হয়নি আমার।”

“আসলে দোষটা আমারই।”

“তা অবশ্য ঠিক।”নাক দিয়ে শব্দ করলো ইউরি।

 ‘আগেই সাবধান করেছিলাম তোমাকে’-এটা না বলার জন্যে ধনবাদ। মনে থাকবে আমার।”

কাঁধ ঝাঁকালো ইউরি। “আমার কিছু বলতে হবে না, প্রফেসর সাহেবই যা বলার বলবেন। তোমাকে অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন ডায়োমেডেস।”

“এহহে।”

 “তোমার জায়গায় আমি হলে কাপতাম এই কথা শোনার পর।”

বেশ কসরত করে উঠে দাঁড়ালাম।

খেয়ালী চোখে আমাকে দেখছে ইউরি। “এত তাড়াহুড়োরও কিছু নেই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যাও। মাথা ঘোরালে বা ব্যথা করলে সাথে সাথে আমাকে জানাবে।”

“ঠিক আছি আমি।”

কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, তবে দেখে যতটা খারাপ মনে হচ্ছে আমার অবস্থা তার চেয়ে ভালো। গলার যেখানটায় অ্যালিসিয়া চেপে ধরেছিল সেখানে কালশিটে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। পুরো চেহারায় নখের আচড়ের দাগ। কয়েকটা ক্ষতস্থান থেকে বেশ ভালোই রক্ত ঝরেছে।

প্রফেসরের দরজায় নক করলাম। আমাকে দেখে চোখ বড়বড় হয়ে গেল তার। “আহারে। সেলাই লাগবে নাকি?”

“না, না। আমি ঠিক আছি।”

মনে হলো না আমার কথা বিশ্বাস করলেন তিনি। “ভেতরে এসে বসো, থিও।”

অন্যেরা আগেই সেখানে জড়ো হয়েছে। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিস্টিয়ান আর স্টেফানি। ইন্দিরা জানালার ধারে একটা চেয়ারে বসে আমাকে দেখছেন। মনে হচ্ছে যেন আমাকে নতুন চাকরিতে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয়েছে সবাই। কিন্তু বাস্তবতা এর উল্টো, হয়তো চাকরিটা খোয়াতে হবে আজকেই।

 ডায়োমেডেস তার ডেস্কের পেছনে বসে আছেন। আমাকে হাত দিয়ে উল্টোদিকের খালি চেয়ারটায় বসার ইশারা করলেন। বসে পড়লাম। কিছু না বলে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, আঙুলগুলো ডেস্কের ওপর নড়ছে অবিরাম। হয়তো ভাবছেন যে কথাটা কি করে বলবেন। তবে তাকে সে সুযোগ দিল না স্টেফানি।

 “খুবই খারাপ হলো ব্যাপারটা,” আমার দিকে তাকিয়ে বলল ইউনিট ম্যানেজার। “আপনি যে সুস্থ আছেন, সেটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তবুও…কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। অ্যালিসিয়ার সাথে একা কেন দেখা করেছিলেন আপনি, বলুন তো?”

“আসলে দোষটা আমারই। আমিই ইউরিকে বলি যে ওকে একা সামলাতে পারবো।”

“এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছিল? আপনাদের কেউ যদি মারাত্মক আহত হতেন-”

“একটু বেশি বেশি বলে ফেলছে স্টেফানি,” ডায়োমেডেস বলে উঠলেন এই সময়ে। “সৌভাগ্যবশত তেমন কিছু হয়নি কারোই। এরকম জেরার প্রয়োজন দেখছি না,” ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন প্রফেসর।

“ঘটনাটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, প্রফেসর।” থমথমে কন্ঠে বলল স্টেফানি। “একদমই নেই।”

“খাটো করে দেখছি কে বলল?” আমার দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “আমার কথা উল্টোপাল্টা অর্থ বের করবে না, স্টেফানি। থিও, তুমি বলো তো কি হয়েছিল।”

সবাই চোখে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। খুব সাবধানে পরবর্তী কথাগুলো বললাম। “আমাকে হঠাৎ করেই আক্রমন করে বসে অ্যালিসিয়া। ঘটনা বলতে এটুকুই।”

“সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কেন? কোন রকমের উসকানি ছাড়াই কাজটা করেছিল বোধহয় সে?”

“হ্যাঁ। অন্তত সজ্ঞানে উসকানিমূলক কিছু বলিনি আমি।”

“তাহলে হয়তো নিজের অজান্তেই কিছু একটা করে ফেলেছিলে?”

“অ্যালিসিয়ার ওরকম প্রতিক্রিয়া দেখানর কোন না কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। এটা থেকে বোঝা যায় অ্যালিসিয়া নিজের মনের ভাব প্রকাশে আগ্রহী।”

হেসে উঠলো ক্রিস্টিয়ান। “এভাবে?”

“হ্যাঁ। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দ্বারাও কিন্তু অনেক কিছু বোঝাতে পারে মানুষ। অন্যান্য রোগিদেরই দেখো, চুপচাপ বসে থাকে সারাদিন, হাল ছেড়ে দিয়েছি পুরোপুরি। কিন্তু অ্যালিসিয়া সেরকম না। ওর আমার ওপর এভাবে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে এটা বোঝা যায় যে ভেতরে ভেতরে কোন একটা কারণে খুব কষ্ট পাচ্ছে। আর ওটাই আমাদের বোঝানোর জন্যে মরিয়া সে।”

চোখ বাঁকালো ক্রিস্টিয়ান। “এত কাব্যিক ব্যাখ্যা দেয়ার কিছু নেই। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে ঔষধের ডোজ কমানোয় এই কাজ করেছে সে।”ডায়োমেডেসের দিকে ঘুরলো ও। “আপনাকে আগেই সাবধান করেছিলাম, প্রফেসর। বলেছিলাম যে ডোজ কমালে হিতে বিপরীত হতে পারে।”

“তাই ক্রিস্টিয়ান?” বললাম। “তুমি না বললে তো জানতামই না।”

আমার কথা আমলে নিল না ক্রিস্টিয়ান। এখানেই সাইকোথেরাপিস্ট আর সাইকিয়াট্রিস্টের মধ্যে পার্থক্য। রোগিদের মানসিকতার পরিবর্তন কিভাবে করা যায়, সেটা প্রায়ই ভুলতে বসে ক্রিস্টিয়ানের মত লোকেরা। শুধু ঔষধ খাইয়ে ঠাণ্ডা করে রাখতে পারলেই খুশি। প্রতিবেলা খাবার শেষে নিয়ম করে তাই কয়েকটা ট্যাবলেট দেয়া হয় অ্যালিসিয়াকে। ক্রিস্টিয়ানের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে না যে আমার কোন পরামর্শ শুনবে সে।

তবে ডায়োমেডেস চেহারায় ভাবনার ছাপ। “ঘটনাটা তাহলে দমিয়ে দেয়নি তোমাকে, থিও।”

“না, এখন তো মনে হচ্ছে ঠিক পথেই এগোচ্ছি,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম।

সন্তুষ্টি ফুটলো ডায়োমেডেসের চেহারায়। “ভালো। আমি তোমার সাথে একমত। এরকম প্রতিক্রিয়া দেখানোর কারণ খুঁজে বের করা উচিৎ। তুমি কাজ চালিয়ে যাও।”

আর নিজেকে সামলাতে পারলো না স্টেফানি। “প্রশ্নই ওঠে না,” বলে উঠলো সে।

“তোমার কি মনে হয়? অ্যালিসিয়াকে কথা বলাতে পারবে?” স্টেফানির কথা যেন কানেই ঢোকেনি প্রফেসরের।

“আমার বিশ্বাস, পারবে,” পেছন থেকে ইন্দিরা বললেন এসময়। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে ঘরে তিনিও আছেন। “একভাবে চিন্তা করলে, অ্যালিসিয়া কিন্তু কথা বলতে শুরু করেছে। থিও’র মাধ্যমে যোগাযোগ করছে সে। অর্থাৎ থিও হচ্ছে তার যোগাযোগের মাধ্যম।”

 মাথা নেড়ে সায় জানালেন ডায়োমেডেস। এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তিত দেখালো তাকে। মাথায় কি চলছে বুঝতে পারছি। অ্যালিসিয়া নামকরা একজন পেইন্টার, সুতরাং গ্রোভকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সে-ই হতে পারে ডায়োমেডেসের তুরুপের তাস। আমরা যদি দেখাতে পারি যে অ্যালিসিয়ার মানসিক অবস্থায় উন্নতি হচ্ছে, তাহলে হয়তো গ্রোভ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে ট্রাস্ট।

“কতদিনের মধ্যে ফলাফল আশা করতে পারি আমরা?” জানতে চাইলেন ডায়োমেডেস।

“এর উত্তর নেই আমার কাছে,” সত্যটাই বললাম। “আপনিও নিশ্চয়ই জানেন সেটা। এসব ব্যাপারে আগে থেকে কোন কিছু আন্দাজ করা যায় না। ছয় মাস, এক বছর-কিংবা তার চেয়েও বেশি।”

“ছয় সপ্তাহ সময় দিলাম তোমাকে।”

সামনে এগিয়ে এলো স্টেফানি। “আমি এই ইউনিটের ম্যানেজার, এরকমটা হতে দিতে”।

 “আর আমি গ্রোভের ক্লিনিকাল ডিরেক্টর। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার একমাত্র আমারই আছে, আর কারো নয়। থিও’র যদি কোন কিছু হয়, তাহলে সেটার দায় পুরোপুরি আমার,” বলে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন ডায়োমেডেস।

আর কথা বাড়ালো না স্টেফানি। দৃষ্টিবাণে কিছুক্ষণ আমাদের ভস্ম করে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।

“আশ্চর্য, মেয়েটা রেগে গেল কেন?” আমুদে কন্ঠে বললেন প্রফেসর। “তুমি দেখি ইউনিট ম্যানেজারের শত্রু হয়ে গেলে থিও, কপালটাই খারাপ তোমার,” ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে উদ্দেশ্যপুর্ণ হাসি দিলেন তিনি। খানিক বাদেই চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললেন, “ছয় সপ্তাহ, আমার তত্ত্বাবধায়নে। বুঝেছো?”

রাজি হয়ে গেলাম-আসলে রাজি না হয়ে আর কোন উপায়ও ছিল না। “ছয় সপ্তাহ,” বললাম।

“বেশ।”

 ক্রিস্টিয়ান উঠে দাঁড়ালো, দৃশ্যতই বিরক্ত। “ছয় সপ্তাহ কেন, ছয়শো বছরেও কথা বলবে না অ্যালিসিয়া। সময় নষ্ট করছেন আপনারা।”

চলে গেল সে। আমার ব্যর্থতার ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত কিভাবে সে?

মনের মধ্যে জেদ চেপে গেল। সফল হতেই হবে আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *