২. উইক্কা হাঁটু গেড়ে বসে

১১.

উইক্কা হাঁটু গেড়ে বসে তরুণী মেয়েটির দিকে তাকালো। এক সময় আমি যেমন ছিলাম, ও ঠিক তেমনই। উইক্কা ভাবল। সব কিছুর অর্থ খুঁজবে বলে বের হয়েছে। একজন বয়স্কা শক্তিশালী বলিষ্ঠ মহিলা অন্য দৃষ্টিতে জগত্তাকে দেখতে পারে। সে তার নিজের জগত শাসন করে সন্তুষ্ট।

সেই সময়, যাই হোক, ঈশ্বর নারীর রূপ ধরে এলো। উইক্কা ব্রাইডার শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ল। ব্রাইডার জিনসের বোম খুলতে লাগল। অর্ধেকটা খুলে ফেলল। ব্রাইডার মাংসপেশি টান টান হয়ে গেল।

চিন্তা করো না। উইক্কা আবেগের সাথে বলল।

উইক্কা ব্রাইডার টি-শার্ট ওপরের দিকে তুলে সুগভীর নাভি উন্মোচিত করল। তারপর সে তার আলখাল্লার পকেট থেকে একটা কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল বের করে ব্রাইডার নাভিমূলে রাখল।

 এখন আমি চাই তুমি চোখ বন্ধ করো। উইক্কা নরম স্বরে বলল, আমি চাই তুমি আকাশের রং নিয়ে ভাবো, আর তোমার চোখ বন্ধ রাখো।

উইক্কা আলখাল্লার পকেট থেকে ছোট্ট একটা অ্যামেথিস্ট পাথর বের করে ব্রাইডার দুই বন্ধু চোখের মাঝখানে রাখল।

এখন থেকে, আমি যা বলি তাই করো। আর অন্য কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি জগতের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছ। তুমি তোমার চারদিকে তারকারাজি দেখতে পাবে। দেখতে পাবে উজ্জ্বল গ্রহ-নক্ষত্র। এই দৃশ্য তোমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এমনটা ভাবতে থাকো। ছবি অথবা স্ক্রিনের মতো দেখে না। এই জগতের আনন্দ নিজের মধ্যে টেনে নাও। কোনো কিছু নিয়ে তোমার চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। শুধু নিজের আনন্দের দিকে মনোযোগ দাও। নিজেকে কোনো দোষে দোষী ভেব না।

 ব্রাইডা তারকাখচিত জগত্তাকে দেখছিল। বুঝতে পারল উইক্কার কণ্ঠস্বর শোনার চেয়ে সে ওদিকেই বেশি মনোযোগী হয়েছে। কণ্ঠস্বর তাকে জগতের মাঝখানে একটা ক্যাথেড্রাল কল্পনা করতে বলছিল। ব্রাইডা একটা গথিক, ধাঁচের কালো পাথরের ক্যাথেড্রাল দেখতে পেল। সেটাকে জগতের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই মনে হচ্ছিল।

ক্যাথেড্রালের দিকে এগিয়ে যাও। ভেতরে ঢোকো।

ব্রাইডা উইক্কার আদেশ পালন করল। সে ক্যাথেড্রালের দিকে এগিয়ে গেল। ঠাণ্ডা শীতল মেঝের ওপর তার নগ্ন পায়ের ব্যাপারে সচেতন ছিল। এক সময় তার মনে হতে লাগল আরেকজন কেউ তার সাথে আছে। উইক্কার কণ্ঠস্বর যেন তার পাশে হাঁটা মানুষটার ভেতর থেকেই আসছে। আমি বস্তু কল্পনা করছি। ব্রাইডা ভাবল। কিন্তু হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল দৃশ্যমান আর অদৃশ্য জগতের সেতুবন্ধের ব্যাপারে কী বলা হয়েছিল। তাকে ভয় পেলে বা ব্যর্থতায় হতাশ হলে চলবে না।

ব্রাইডা এখন ক্যাথেড্রালের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রট-আয়রনের সমারোহ, যে রকমটিতে সন্তুরা বাস করত। ট্যারট কার্ডের ভ্রমণে সে যেমনটি দেখেছিল, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

দরজা খুলে ভেতরে ঢোকো।

ব্রাইডার হাতে ঠাণ্ডা ধাতবের স্পর্শ পেল। দরজার বিশালত্ব সত্ত্বেও সহজেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে নিজেকে বিশাল একটা চার্চের মধ্যে দেখতে পেল সে।

তোমার চারদিকে যা আছে সেদিকে খেয়াল করো। উইক্কা বলল। যদিও ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার, ক্যাথেড্রালের বিশাল স্টেইন-কাঁচের জানালা দিয়ে হালকা আলো আসছিল। গির্জার ভেতরের সারি, পাশের বেদি, সুসজ্জিত কলাম আর কয়েকটা মোমবাতি দেখতে পেল। সব কিছু কেমন যেন ফাঁকা আর এলোমেলো মনে হচ্ছিল। সব কিছুই ধুলো-ময়লায় ভর্তি।

তোমার বাম দিকে হেঁটে যাও। কোথাও না কোথাও তুমি আরেকটা দরজা পাবে। কিন্তু দরজাটা খুব ছোট হতে পারে।

 ব্রাইডা ক্যাথেড্রালের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেল। মেঝের ধুলো খালি পায়ে অস্বস্তিকর অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কোথাও থেকে খুব বন্ধুসুলভ কণ্ঠস্বর তাকে গাইড করছিল। সে জানত এটা উইক্কার কণ্ঠস্বর, কিন্তু সে এও জানত, কল্পনার ওপর তার আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে সচেতন, আর এখনো পর্যন্ত তাকে যা করতে বলা হয়েছে, তা অমান্য করেনি।

ব্রাইডা দরজাটা খুঁজে পেল।

ভেতরে যাও। ওখানে প্যাচানো সিঁড়ি নিচের দিকে চলে গেছে।

দরজার ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে ব্রাইডাকে হামাগুড়ি দিতে হলো। সিঁড়িঘরের দেয়ালের গায়ে ছোট ছোট টর্চ লাগানো, যা সিঁড়িগুলোকে আলোকিত করেছে। ধাপগুলো খুবই পরিষ্কার। টর্চের আলো জ্বালাবার আগে কেউ একজন এখানে ছিল।

 তুমি তোমার অতীত অনুসরণের জন্য তৈরি হয়ে আছে। ক্যাথেড্রালের সেলারে একটা লাইব্রেরি আছে। তুমি সেখানেই যাও। আমি সিঁড়ির গোড়ায় তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

 ব্রাইডা নিচের দিকে নামতে লাগল। কত সময় ধরে নামছে তা নিজেও জানে না। একটু মাথা ঘোরার ভাব হয়েছিল। একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে দেখল উইক্কা আলখাল্লা গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। এখন ব্যাপারটা অনেক সহজ হবে। নিজেকে অনেক বেশি সুরক্ষিত মনে করল সে। এখনো গভীর আবেশের মধ্যে আছে।

উইক্কা সিঁড়ির বিপরীতে আরেকটা দরজা খুলে ধরল।

আমি তোমাকে এখানে একা ছেড়ে যাচ্ছি। আমি বাইরে অপেক্ষা করব। একটা বই বেছে নাও। এই বই তোমার যা জানার তা দেখাবে।

ব্রাইডা উইক্কার অনুপস্থিতি ভুলে গেল। সে ধুলোময় তাকের দিকে তাকিয়ে রইল। এখানে এসে সব কিছু পরিষ্কার করে রাখা উচিত আমার। তার অতীত ঝড় ঝঞ্ঝা আর মূর্খতায় কেটেছে। এই জাতীয় বই সে আগে কখনো পড়েনি বলে দুঃখবোধ করল। সম্ভবত এখানে ভুলে যাওয়া দারুণ সব পাঠ আছে, যা তার জীবনে সে কখনও কাজে লাগায়নি।

 ব্রাইডা তাকের বইগুলোর দিকে তাকালো। এই তো জীবন! সে ভাবল। সে যদি আগের আমলের মানুষ হতো তাহলে নিশ্চয় জ্ঞানী হতো। সে সব বই পড়ে ফেলবে বলে মনস্থ করে। যদিও অত সময় নেই। তাকে তার ইনটুইশনকে বিশ্বাস করতে হবে। সে যখন খুশি আসতে পারবে। এখন সে পথটা চেনে।

ব্রাইডা মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে রইল, বুঝতে পারছে না কোন বইটা বেছে নেবে। তারপর এলোমেলোভাবে একটা বই টেনে বের করল। বেশ ছোটখাটো একটা ভলিউম। ব্রাইডা মেঝেতে বসে বইটা কোলের ওপর রাখলো।

ভয় হচ্ছে বইটা খুলে হয়তো ভেতরে কিছু দেখতে পাবে না। ভয় পাচ্ছে হয়তো বইতে যা লেখা আছে, তা পড়তে সমর্থ হবে না।

আমাকে এটুকু ঝুঁকি নিতে হবে। ব্যর্থতার ভয়ের দরকার আছে, বই খুলতে খুলতে ভাবল সে। যখনই বইয়ের পাতার দিকে তাকাতে গেল, তার মাথা ঘুরতে লাগল।

আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে ব্রাইডা কোনোমতে ভাবতে পারল।

.

১২.

মুখের ওপর পানির ফোঁটা পড়তেই ব্রাইডা জেগে উঠল। তার মধ্যে অদ্ভুত অদম্য স্বপ্নের ঘোর রয়ে গেছে। ক্যাথেড্রাল বাতাসে ভাসছে। লাইব্রেরি বইয়ে ঠাসা। আর এখন মনে হচ্ছে সে কখনো লাইব্রেরিতে যায়নি।

লনি, তুমি ঠিক আছে?

না, সে ঠিক নেই। ডান পায়ের কোনো শোত্ম নেই। এটা খুব খারাপ লক্ষণ, কথা বলার মতো অবস্থা নেই। কারণ সে স্বপ্নটা ভুলে যেতে চায় না।

লনি, জেগে ওঠো।

তার অবশ্যই জ্বর হয়েছে। ঘোরের মধ্যে আছে সে। ঘোরের মধ্যে সে বাস্তব কিছু দেখতে পাচ্ছে। আশা করছে যে লোকটা তাকে ডেকে চলেছে সে থেমে যাবে। স্বপ্নটা অর্থ বোঝার আগে তা তার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে।

মেঘলা আকাশ। মেঘগুলো এত নিচে নেমে এসেছে যেন ক্যাথেড্রালের চূড়া ছুঁয়ে যাবে। সে চিত হয়ে শুয়ে মেঘ দেখতে লাগল। কোনো তারা দেখতে পেল না। পুরোহিতদের মতে, তারারা সব সময় ভালো নয়।

সে চোখ খোলার আগে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেল। লনি খুশি যে বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই মুহূর্তে ক্যাসেলের পানি পরিপুর্ণ হয়ে গেছে। সে ধীরে ধীরে তার চোখ মেঘ থেকে সরিয়ে ক্যাসেলের টাওয়ারের দিকে তাকাল। উঠানে অগ্নৎসব শুরু হয়েছে। অনেক লোক হতবুদ্ধি হয়ে আছে।

টালবো। সে নরম স্বরে বলল।

টালবো তার হাত দিয়ে লনিকে জড়িয়ে ধরল। একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ আর চুলের গন্ধ পেল সে।

কতক্ষণ হল? আজ কী বার?

তুমি তিন দিন ধরে ঘুমিয়ে। টালবো বলল।

টালবোর দিকে তাকালো লনি। দুঃখবোধ করল ছেলেটার জন্যে। শুকনো পাতলা, মুখ কুঁচকানো, ত্বক রুক্ষ একজন মানুষ। কিন্তু এসব কোনো ব্যাপার নয়, টালবোকে সে ভালোবাসে।

খুব তেষ্টা পেয়েছে, টালবো।

এখানে কোনো পানি নেই। ফরাসিরা গোপন পথটা খুঁজে পেয়েছে।

আবার লনি মাথার ভেতরে সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। অনেক সময় ধরে, এই কণ্ঠস্বরটাকে সে ঘৃণা করে এসেছে। তার স্বামী একজন যোদ্ধা। একজন মার্সিনারি, যে জীবনের অধিকাংশ সময় যুদ্ধ করে কাটিয়েছে। সে সব সময় ভয় পেত, ওই কণ্ঠস্বর একদিন তাকে বলবে তার স্বামী যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছে। এটা যাতে না বলতে পারে, তেমন একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে সে। গ্রামের কাছে একটা প্রাচীন বুড়ো গাছের দিকে মনোযোগ দিয়ে রাখতে হয়। তাতে কণ্ঠস্বরটি থেমে যায়। এখন, সে দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর সে কণ্ঠস্বরটাও ফিরে এসেছে।

তুমি মারা যাচ্ছ। কণ্ঠস্বরটি তাকে বলল; কিন্তু ও তোমাকে বাঁচাবে।

বৃষ্টি হচ্ছে, টালবো। সে বলল, আমার পানির দরকার।

মাত্র কয়েক ফোঁটা, যথেষ্ট নয়।

লনি আবার আকাশের মেঘের দিকে তাকালো। সপ্তাহজুড়ে আকাশে মেঘের আনাগোনা। সূর্যকে আড়াল করে রাখা ছাড়া আর কিছুই করছে না ওগুলো। শীতকে আরো হিমশীতল করে তুলছে। ক্যাসলটাকে আরো বেশি বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। সম্ভবত ফরাসি ক্যাথলিকরা ঠিক। ঈশ্বর তাদের পাশে আছেন।

কয়েকজন মার্সিনারি কাছে এলো। চারদিকে আগুন জ্বলছে। লনির হঠাৎ মনে হলো সে নরকে আছে।

পুরোহিতরা সবাই একত্রে জড়ো হয়েছে স্যার। তাদের একজন বলল টালবোকে।

আমরা যুদ্ধের জন্য এসেছি, মরার জন্য নয়। আরেকজন বলল।

ফরাসিরা আমাদের আত্মসমর্পণের শর্ত দিয়েছে। টালবো উত্তর দিল। তারা বলেছে যারা নিজেদের ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করবে, তাদের কোনো রকম ক্ষতি করা হবে না, ছেড়ে দেয়া হবে।

প্রকৃত যোদ্ধারা তা মেনে নেবে না। কণ্ঠস্বরটা লনির কাছে ফিসফিস করে বলল। লনি তা জানে। লনি প্রকৃত যোদ্ধা ভালোই চেনে। আর এ কারণেই সে এখানে, বাড়িতে নয়। প্রকৃত যোদ্ধারা চার মাস ধরে ক্যাসল আগলে রেখেছে। সেই সময় গ্রামের মহিলারা গ্রাম ও দুর্গের মধ্যে একটা গোপন পথ বানিয়ে নিয়েছে। সেখান দিয়ে খাবার, কাপড়চোপড়, অস্ত্রপাতি আনা-নেয়া করা হয়। তখন তারা তাদের স্বামীদের দেখতে পারে। আর মহিলাদরে কারণেই লড়াইটা এত দিন চালিয়ে যাওয়া গেছে। এখন, যেভাবেই হোক, গোপন পথ প্রকাশ হয়ে গেছে। লনি এখন আর গ্রামে ফিরে যেতে পারবে না। অন্য মহিলারাও কেউ যায়নি।

লনি উঠে বসার চেষ্টা করল। তার পায়ে আর কোনো ব্যথা নেই। কণ্ঠস্বর তাকে জানিয়ে দিল, এটা খুব খারাপ লক্ষণ।

ওদের ঈশ্বরকে নিয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা ওভাবে মারা যেতে পারি না, স্যার। আরেকজন যোদ্ধা বলল।

দুর্গের ভেতরে অন্য রকম শব্দ হতে লাগল। টালবো উঠে দাঁড়াল।

আমাকে তোমার সাথে নাও। লনি জোর দিয়ে বলল। টালবো তার সাথীদের দিকে তাকালো। তারপর সামনে শুয়ে কাঁপতে থাকা মেয়েটির দিকে মুহূর্তের জন্যে মনে হল সে জানে না কী করবে। তার লোকজন যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত। তারা জানে যেসব যোদ্ধারা যুদ্ধের সময় ভালোবাসায় মগ্ন থাকে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা পালিয়ে যায়।

আমি মারা যাচ্ছি টালবো। দয়া করে আমাকে তোমার সাথে নাও।

একজন মার্সিনারি টালবোর দিকে তাকালো।

ওকে এখানে একা রেখে যাওয়া যাবে না। সে বলল, ফরাসিরা আবার আগুন দিতে শুরু করতে পারে।

টালবো একমত হওয়ার ভান করল। জানে ফরাসিরা এই জাতীয় কিছু করবে না। মনসেগড়ের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে একটা আলোচনা চলছে। মার্সিনারিরা টালবোর হৃদয়ে কী ঘটে চলেছে বুঝতে পারছে। টালবো একজন প্রেমিক পুরুষ।

সে জানে তুমি মারা যাচ্ছ। কণ্ঠস্বরটা লনিকে বলল। টালবো তাকে খুব আলতো করে তুলে নিচ্ছিল। কণ্ঠস্বর কী বলছে লনি তা শুনতে চাইল না। সে সেই দিনের কথা মনে করতে চাইল, যখন তারা একসাথে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় গমের ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছে। সে আগের মতোই তৃষ্ণার্ত। তারা একটা ঝরনা থেকে তাকে জলপান করিয়ে নিল।

একদল মানুষ-সৈন্য, নারী আর শিশুরা মনসেগড় দুর্গের পশ্চিম দেয়ালের বড় পাথরটার কাছে জড়ো হয়েছে। দমবন্ধ করা নীরবতা বিরাজ করছে, লনি জানে পুরোহিতদের সম্মানে ওরা এভাবে জড়ো হয়ে নেই। তারা জড়ো হয়ে আছে ভয়ের কারণে।

পুরোহিতরা চলে এলেন। সংখ্যায় অনেক। সবাই কালো আলখাল্লা পরে আছে। তাতে বিশালাকৃতির হলদে ক্রস সেলাই করা। তারা পাথরের ওপর বসে পড়ল। একজন সাদা চুলের মানুষ এলেন। তিনি দেয়ালের উঁচু অংশে উঠলেন। অগ্নিশিখায় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার কালো আলখাল্লার প্রান্ত আগুন প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।

 উপস্থিত সবাই হাঁটু গেড়ে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে দুহাত একত্রে করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে তাদের মাথা তিনবার মাটিতে ছোঁয়াল। টালবোসহ মার্সিনারিরা দাঁড়িয়ে রইল। তাদের শুধু যুদ্ধের জন্যে আনা হয়েছে।

আমরা তোমাদের আত্মসমর্পণ অনুমোদন করেছি। প্রধান পুরোহিত বললেন, তোমরা সবাই মুক্ত।

জনতার মধ্য থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ভেসে এলো।

অন্য ঈশ্বরের কাছের আত্মারা এই পৃথিবীর রাজত্বে অবস্থান করে। সত্যিকারের ঈশ্বরের কাছের আত্মারা তার অসীম ক্ষমায় আবার ফিরে আসে। যুদ্ধ চলবে কিন্তু এটা কোনো স্বর্গীয় যুদ্ধ নয়, কারণ অন্য ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত পরাজিত হবে। যদিও কোনো কোনো দেবতা এরই মধ্যে তাকে দূষিত করে ফেলেছে। অন্য ঈশ্বর স্তিমিত হবে, কিন্তু ধ্বংস হবে না। তিনি অনন্তকাল ধরে নরকে অবস্থান করবেন, যেসব আত্মাদের তিনি নিজের পথে এনেছেন তাদের সাথে।

দেয়ালের কাছে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে জনতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারা এখনো নিশ্চিত নয় যে তারা পালিয়ে যেতে চায়, নাকি অনন্তকাল ধরে যন্ত্রণা ভোগ করতে চায়।

ক্যাথার চার্চই হচ্ছে প্রকৃত চার্চ। পুরোহিত বলে চললেন। যিশুখ্রিস্ট আর পবিত্র আত্মাকে ধন্যবাদ, আমরা ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেতে পেরেছি। আমাদের পুনর্জন্মে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের অন্য ঈশ্বরের রাজত্বে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই।

লনি লক্ষ্য করল যে তিনজন পুরোহিত বাইবেল এনেছিল তারা সামনে এগিয়ে এল।

যারা আমাদের সাথে মৃত্যুবরণ করতে চায় তাদের সান্ত্বনার অংশীদার করা হবে। নিচে আগুন অপেক্ষা করছে। যন্ত্রণাকাতর, ভয়ানক এবং ধীর মৃত্যু। অগ্নিশিখা তোমাদের রক্তমাংস পুড়িয়ে এ এমন যন্ত্রণা দেবে, যা তোমরা আগে কখনো দেখনি। যাহোক, তোমাদের সবাইকে সেই সম্মান দেয়া হবে না। শুধু খাঁটি ক্যাথাররা তা পাবে। আর অন্যদের বেঁচে থাকার শাস্তি দেয়া হবে।

দুজন মহিলা বাইবেল ধরে রাখা পুরোহিতের কাছে নিঃশব্দে চলে এলো। একজন কিশোর তার মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওদের সাথে যোগ দিল।

চারজন মার্সেনারি টালবোর দিকে তাকালো।

আমরা পবিত্র আশীর্বাদ গ্রহণ করতে চাই, স্যার। আমরা বাপটাইজড হতে চাই।

এভাবেই ঐতিহ্য টিকে থাকে। কণ্ঠস্বরটি বলল, কারণ লোকজন একটা ধারণার জন্য মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়।

লনি টালবোর সিদ্ধান্ত শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। মার্সিনারিরা তাদের সারা জীবন অর্থের জন্য লড়াই করেছে। যত দিন পর্যন্ত না তাদের এসব লোকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে।

টালবো শেষ পর্যন্ত মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিল, যদিও তাকে সবচেয়ে ভালো কজন যোদ্ধাকে হারাতে হবে।

চলো যাই। লনি বলল, চলো, দেয়ালের দিকে চলে যাই। তারা বলেছে যারা যেতে চায়, যেতে পারে।

তার চেয়ে ভালো হয় আমরা বিশ্রাম নিই, লনি।

 তুমি মারা যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরটা আবার ফিসফিস করে বলল।

আমি জীবন্ত মানুষ অগ্নিদ্বগ্ধ হওয়া দেখতে চাই। আমি সেই উপত্যকা আরেকবার দেখতে চাই, টালবো। তুমি জানো আমি মারা যাচ্ছি।

হ্যাঁ, টালবো জানে। সে যুদ্ধক্ষেত্রের একজন দক্ষ যোদ্ধা। আর সে বলতে পারে কোন ক্ষত তার সৈন্যদের মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। লনির ক্ষত গত তিন দিন ধরে পরিচর্যাহীন। তার রক্তে বিষাক্ত জীবাণু ঢুকে গেছে। এই ক্ষত গত দুই দিনে ভালো হয়নি, দুই সপ্তাহেও ভালো হবে না, দুই দিন বা দুই সপ্তাহ টিকে থাকলেও তার চেয়ে বেশি কখনো টিকবে না মেয়েটা।

লনি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। তার জ্বর চলে গেছে। টালবো তা জানে। এটা খারাপ লক্ষণ যতক্ষণ পায়ের যন্ত্রণা হচ্ছিল আর জ্বর শরীর পুড়িয়ে দিচ্ছিল, ততক্ষণ শরীরের কণিকাগুলো লড়াই করছিল। এখন লড়াই শেষ হয়েছে। মৃত্যু শুধু সময়ের ব্যাপার।

তুমি ভীত নও। কণ্ঠস্বর বলল। না, লনি ভীত নয়। এমনকি ছোটবেলা থেকেই সে জানে, মৃত্যু হচ্ছে আরেকটা গুরুর ব্যাপার। এই সময়ে, কণ্ঠস্বরটা তার সবচেয়ে বড় সঙ্গী হয়ে দেখা দিল। তাদের চেহারা, শরীর আর অভিব্যক্তি তার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে। তারা বিভিন্ন জগৎ থেকে আসা মানুষ। তারা তার সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। তাকে একা হতে দিচ্ছে না। মজার এক শৈশব কেটে ছিল তার। অন্য শিশুদের সাথে খেলা করেছে, তার অদৃশ্য বন্ধুদের ব্যবহার করে জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়েছে, অদ্ভুত শব্দ করেছে। তার মা খুশি ছিল। কারণ তারা একটা ক্যাথার দেশে বাস করত। যদি ক্যাথলিকরা এখানে থাকে, তোমাকে জলন্ত পুড়িয়ে মারবে। সে বলত। ক্যাথাররা এসব কথায় কান দিত না। তারা বিশ্বাস করত ভালোরা ভালো, আর খারাপেরা খারাপ। জগতের কোনো শক্তি তা বদলে দিতে পারবে না।

তারপর ফরাসিরা এলো। তারা বলল, কোনো ক্যাথার গ্রাম থাকবে না। তার বয়স যখন আট বছর তখন থেকেই যুদ্ধের সাথে পরিচিত সে।

যুদ্ধ তার জীবনে অমূল্য উপহার এনে দিয়েছে। তার স্বামী। ক্যাথার পুরোহিতরা তাকে অনেক দূর থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল, যারা নিজেরা কখনো অস্ত্র হাতে তুলে নিত না। কিন্তু তারা খারাপ কিছুও নিয়ে এসেছিল। জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার ভয়, কারণ ক্যাথলিকরা গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছিল। সে তার অদৃশ্য বন্ধুদের ব্যাপারে ভীত হয়ে পড়েছিল। কারণ তারা ধীরে ধীরে তার জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। শুধু কণ্ঠস্বরটা রয়ে গেল। কী ঘটছে, কী ঘটতে পারে আর তার কেমন ব্যবহার করা উচিত কণ্ঠস্বর এসব বলে যেতে লাগল। কিন্তু সে তার বন্ধুত্ব চায়নি, কারণ সে সব সময় অনেক বেশিই জানত। তারপর একটা কণ্ঠস্বর তাকে এক প্রাচীন গাছ সমন্ধে ভাবতে শেখাল। তারপর থেকে সে আর কণ্ঠস্বরগুলো শুনতে পেত না, যত দিন না ক্যাথারদের বিরুদ্ধে শেষ ক্রুসেড শুরু হলো। ফরাসি ক্যাথলিকরা যুদ্ধের পর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল।

আজ প্রাচীন গাছের ব্যাপারে ভাবার মতো যথেষ্ট শক্তি তার নেই। কণ্ঠস্বরটি ফিরে এসেছে। লনি কিছু মনে করেনি। উপরন্তু তাদের ওকে দরকার। সে মারা গেলে তারা পথ দেখিয়ে দিতে পারবে।

আমার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ো না, টালবো। আমি মরতে ভয় পাই না। লনি বলল।

 তারা দেয়ালের একেবারে ওপরে উঠে গেল। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। টালবো গায়ের আলখাল্লাটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিল। লনির এখন আর ঠাণ্ডার অনুভূতি নেই। সে শহরের আলোক রেখা দেখতে পাচ্ছে। সেই আলোক রেখা পাহাড়ের পাদদেশে এসে পড়েছে। উপত্যকার নিচে অগ্নৎসবের আগুন জ্বলছে। ফরাসি যোদ্ধারা শেষ সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে।

নিচ থেকে সংগীতের সুর ভেসে এলো। তার সাথে কয়েকটা কণ্ঠস্বর গাইতে লাগল।

যোদ্ধারা! টালবো বলল। তারা জানে যেকোনো মুহূর্তে তারা মারা যেতে পারে। সে কারণেই জীবন তাদের কাছে উৎসবের মতো।

লনি হঠাৎ জীবনের প্রতি উন্মত্ত হয়ে উঠল। কণ্ঠস্বরটা তাকে বলছে, টালবোর অন্য নারীর সঙ্গে দেখা হবে। তাদের সন্তানাদি হবে। শহরে ধনীর জীবন উপভোগ করবে। কিন্তু তোমাকে যতটা ভালোবাসত সে রকম ভালো সে কখনো কাউকে বাসতে পারবে না। কারণ তুমি তার জীবনের একটা অংশ ছিলে।

লনি আর টালবো হাত ধরাধরি করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। যযাদ্ধাদের গান শুনছিল। লনি বুঝতে পারল পর্বতের এখানে অতীতে অন্য যোদ্ধারা এসেছে। তারা এতটাই দূর অতীতের যে, এমনকি কণ্ঠস্বরও তা মনে করতে পারল না।

আমরা স্বর্গীয়, টালবো। কণ্ঠস্বরটা আমাকে অমনটিই বলেছে, যে দিনগুলোতে আমি দেহ আর মুখ দেখতে পেতাম।

টালবো স্ত্রীর এই দিব্যদৃষ্টি সমন্ধে জানত। কিন্তু অনেক দিন ধরে লনি এর কথা উল্লেখ করেনি। সম্ভবত জ্বরের ঘোরের কারণে।

 আর এখন কারো জীবনই অন্য জীবনের মতো নয়। এমনও হতে পারে আমরা আর কোনদিন মিলিত হবো না। তোমাকে দেখার আগে থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। তুমি আমার অংশ ছিলে।

আমি মারা যাচ্ছি। মনে হয় আগামীকাল মৃত্যুর জন্য ভালো একটা দিন। আমি পুরোহিতদের সাথে মরতে ভালোবাসি। জগতের ব্যাপারে ওদের ধারণাটা আমি কখনো বুঝতে পারি নি। কিন্তু ওরা সব সময় আমাকে বুঝতে পেরেছে, পরবর্তী জীবনে আমি ওদের সান্নিধ্য চাই। আমি সম্ভবত খুব ভালো একজন গাইড হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করতে পারব। আগেই ঐ জগতটা আমি দেখে এসেছি।

লনি ভাগ্যের পরিহাসের ব্যাপারে ভাবছিল। কণ্ঠস্বরগুলোকে সে ভয় পেত, কারণ তারা তাকে এমন পথে নিয়ে যেতে পারে যে পথ আগুনের পথে গিয়ে শেষ হয়েছে। আর এখন আগুন তার জন্য অপেক্ষা করছে।

টালবো স্ত্রীর দিকে তাকালো। ওর চোখ ধীরে ধীরে মলিন হয়ে আসছে। কিন্তু সেই প্রথম দেখার মত একই আকর্ষণ ধরে রেখেছে। টালবো কখনো ওকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। সেই নারীটির কথা ওকে বলেনি, যাকে সে যুদ্ধের ময়দানে পেয়েছে। যখন সে জগৎ ভ্রমণ করছিল তখন তার সাথে দেখা হয়েছে, যে আশা করে আছে একদিন টালবো যুদ্ধ থেকে ফিরে আসবে। টালবো কখনো ওকে সেই মহিলার ব্যাপারে বলেনি, কারণ সে নিশ্চিত ছিল যে লনি যেভাবেই হোক, সব কিছু জানে। আর তাকে ক্ষমা করেছে। কারণ লনির প্রেম মহৎ। আর মহৎ প্রেম জগতের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপহার।

কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু আছে, যা টালবো কখনো ওকে বলেনি। আর সম্ভবত, সে ব্যাপারটা ও কখনো জানতেও পারেনি। লনির ভালোবাসা জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার মত বিরাট আবিষ্কার। লনির প্রেম তাকে দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত নিতে চায়। কারণ তার যথেষ্ট ধনী হওয়া দরকার, যাতে করে নিজের জমি কিনতে পারে আর জীবনের শেষ দিন ওখানে শান্তিতে থাকতে পারে। ভঙ্গুর জীবনে এমন চিন্তাভাবনা, যার জীবন খুব তাড়াতাড়িই মিলিয়ে যাচ্ছে, তাকে সম্মানের সাথে লড়াই করে যেতে উৎসাহ দেয়। কারণ যুদ্ধের পর সে এই সমস্ত ভয়াবহ দিনের কথা একদিন ভুলে যাবে। সেই নারীর দুবাহুর ভেতর চোখ বন্ধ করে শিশুর মতো ঘুমোতে পারবে।

যাও, গিয়ে পুরোহিতকে ডেকে আনন, টালবো। লনি বলল, আমি ব্যাপ্টাইজড হতে চাই।

টালবো মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করতে লাগল। শুধু যোদ্ধারাই বেছে নিতে পারে সে কীভাবে মারা যাবে, কিন্তু এই মেয়েটি ভালোবাসার জন্য তার জীবন দিচ্ছে। হয়ত, ওর কাছে ভালোবাসা যুদ্ধেরই আরেক রূপ।

টালবো উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের খাজ ধরে নিচে নেমে গেল। লনি নিচ থেকে আসা সংগীতের মূর্ঘনায় মনোনিবেশ দিল। সংগীতের সুর যেন তার মৃত্যুটাকে সহজ করে দিতে চাইছে। একই সাথে কণ্ঠস্বরও কথা বলে যেতে লাগল।

প্রত্যেক নারী জীবনে চারটি আংটি ব্যবহার করতে পারে। তুমি শুধু একটি ব্যবহার করেছে। তাও ভুলটি। কণ্ঠস্বর বলল।

লনি তার আঙুলের দিকে তাকালো। আঙুলগুলো ভেঙে গেছে। নখে ময়লা জমেছে। কোনো আংটি নেই।

কণ্ঠস্বর হাসতে লাগল।

তুমি জানো আমরা কী বোঝাতে চেয়েছি। তারা বলল, কুমারী, সন্তু, শহীদ আর ডাইনি।

লনি জানত কণ্ঠস্বরগুলো কী বলতে চাচ্ছে, কিন্তু সে এর অর্থ মনে করতে পারল না। অনেক আগে এ রকম কথা শুনেছিল। তখন লোকজন অন্যভাবে কাপড় পরত। জগক্টাকেও অন্যভাবে দেখত। তখন তার অন্য এক নাম ছিল। অন্য ভাষায় কথা বলত।

 চারটা উপায়ে একজন নারী এই পৃথিবীতে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কণ্ঠস্বর বলল। সেই পুরনো জিনিস মনে করিয়ে দেয়া যা তার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। কুমারীদের নারী পুরুষ উভয়ের ওপরে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সে নিঃসঙ্গতার জন্য দায়ী হতে পারে, কিন্তু নিঃসঙ্গতা নিজেই তার গোপনীয়তা উন্মোচিত করে। কুমারীকে তার কুমারীত্বের জন্য দাম চুকাতে হয়– কাউকে দরকার হয় না। অন্যের ভালোবাসার জন্য বস্ত্র পরিধান করতে হয়। নিঃসঙ্গতার মাঝে সে জগতের প্রজ্ঞাকে উন্মোচিত করে।

লনি এখনো একই দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ, সে এসব ব্যাপারে জানত।

 আর শহীদ কণ্ঠস্বর বলে চলল, শহীদের ক্ষমতা আছে, কেউ তাকে যন্ত্রণা বা দুর্ভোগ দিয়ে ক্ষতি করতে পারে না। সে নিজে আত্মসমর্পণ করে, যন্ত্রণা ভোগ করে, নিজেকে উৎসর্গ করে জগতের প্রজ্ঞাকে আবিষ্কার করে।

 লনি আবার তার হাতের দিকে তাকালো। সেখানে, অদৃশ্যভাবে জ্বলজ্বল করছে, তার এক আঙুলে শহীদের আংটি।

 তুমি সন্তুর জীবন বেছে নিয়েছ, এই আংটিটা তোমার জন্য সঠিক ছিলো না। কণ্ঠস্বর বলল, সম্ভদের সেই জ্ঞান আছে যে দেয়ার মাধ্যমেই একমাত্র জগতে কিছু পাওয়া যায়। সেখানে একটা তলাহীন কুয়া আছে, যেখান থেকে সবাই অনরবত জল পান করে। আর যদি সেই কুয়া শুকিয়ে যায়, সম্ভরা নিজেদের রক্ত দিয়ে তা পূর্ণ করে, যাতে অন্যরা কখনো তৃষ্ণার্ত না থাকে। এভাবে নিজেকে সমর্পণের মাধ্যমে সন্তুরা জগতের প্রজ্ঞাকে উন্মোচিত করে।

 কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে গেল। লনি শুনতে পেল টালবো পাথরের ওপর পা ফেলে আসছে। সে জানত কোন আংটি তার এই জীবনে থাকা উচিত, কারণ এই একটাই তার অতীতের জীবনটাকে ধ্বংস করেছে, যখন সে অন্য নামে অন্য ভাষায় বেড়ে উঠেছিল। সে আংটির দিয়ে আনন্দের মধ্য দিয়ে জগতের প্রজ্ঞা আবিষ্কৃত হয়েছিল, যা এখন সে ভাবতে চায় না।

শহীদের আংটি তার আঙুলে জ্বলজ্বল করছে।

.

১৩.

টালবো কাছে এলো। লনি টালবোর দিকে চেয়ে দেখল, রাতের জাদু প্রভাব বিস্তার করেছে, যেন মনে হচ্ছে একটা সূর্যোলোকিত দিন।

জেগে ওঠো। একটা কণ্ঠ বলে উঠল।

এ কণ্ঠস্বরটা ভিন্ন। এ রকম কণ্ঠ সে আগে কখনো শোনেনি। তার মনে হলো, কেউ তাকে নিয়ে যেতে এসেছে।

জেগে ওঠো, ব্রাইডা। উঠে পড়ো।

ব্রাইডা চোখ খুলল। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। কারণ দিনের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। মৃত্যু কী অদ্ভুত ব্যাপার!

তোমার চোখ খোলো। উইক্কা বলল।

কিন্তু তার আবার দুর্গে ফিরে যাওয়া দরকার। যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে সে পুরোহিতের খোঁজে গেছে। সে এভাবে পালিয়ে আসতে পারে না। ও একা আছে। ওর তাকে দরকার।

আমাকে বলল তোমার ঐশ্বরিক শক্তিটা কী।

উইক্কা ব্রাইডাকে ভাবার সময় দেয়নি। ব্রাইডা জানত অসাধারণের চেয়ে বেশি কিছুর দেখা সে পেয়েছে। ট্যারট কার্ডের অভিজ্ঞতার চেয়ে অনেক শক্তিশালী কিছুর সন্ধান পেয়েছে। এখনো উইক্কা তাকে ভাবার মতো সময় দিচ্ছে না, তার অনুভূতিটুকু বুঝতে চাইছে না, সম্মানটুকুও দেখাচ্ছে না। সে শুধু তার ঐশ্বরিক শক্তিটা কী, সেটাই খুঁজে বের করতে চায়।

 তোমার ঐশ্বরিক শক্তির ব্যাপারে বলো আমাকে। উইক্কা জোর দিয়ে বলল।

ব্রাইডা গভীরভাবে শ্বাস নিল। উদ্ধত ক্রোধ রাখল। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত সে না বলছে, এই মহিলা তার ওপর জোর করতে থাকবে।

সেখানে আমি এমন এক নারী, যে ভাববাসা…।

উইক্কা তাড়াতাড়ি ব্রাইডার মুখ ঢেকে দিল। তারপর উঠে দাঁড়াল। শূন্যের পানে তাকিয়ে অদ্ভুত কিছু ভঙ্গি করল। তারপর ফিরে এলো।

শব্দই ঈশ্বর। সব সময় খুব সতর্ক থাকবে পরিস্থিতির মুখে কী বলছ আর কোনো মুহূর্তে কী বলছ।

ব্রাইডা বুঝে উঠতে পারল না উইক্কা তার সাথে এমন আচরণ করছে কেন।

 ঈশ্বর সব কিছুর ওপর নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। কারণ শব্দের মাধ্যমে চিন্তা কম্পনে পরিণত হয়। তুমি চারদিকে তোমার শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছ। তুমি যা কিছু বলবে তার ব্যাপারে খুব যত্নবান হবে। উইক্কা আবার বলল, অনেক রীতিনীতির চেয়ে শব্দের শক্তি অনেক বেশি।

ব্রাইডা তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। তার অভিজ্ঞতার ব্যাপার বর্ণনার একমাত্র উপায়ই তো শব্দ।

তুমি যখন একজন নারীর সাথে কথা বলো, উইক্কা ব্যাখ্যা করল, তুমি সেই নারী নও। তুমি তার একটা অংশ। অন্য মানুষেরও তোমার মতো একই স্মৃতিশক্তি আছে।

 ব্রাইডা অস্বস্তি বোধ করল। মহিলা এত বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে যে তাকে কিছু বলাই যাচ্ছে না। উপরন্তু সেখানে টালবোও আছে।

আমাকে তোমার ঐশ্বরিক শক্তির ব্যাপারে বলোউইক্কা আবার বলল। এই মেয়েটি ওই অভিজ্ঞতায় এতটা হতচকিত হয়ে যাক সে তা চায় না। এই জাতীয় সময় পরিভ্রমণ অধিকাংশ সময় সমস্যার সৃষ্টি করে।

আমার অনেক কিছু বলার আছে। আপনার সাথে আমার কথা বলা দরকার। কারণ অন্য কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। প্লিজ! ব্রাইডা অনুনয় করল।

বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখের ওপর পড়ছিল; সেখান থেকে উইক্কাকে সব কিছু বলতে শুরু করল সে। তার একটা সুযোগ ছিল আর সে তা নষ্ট করল না। সে জানত কেউ তার কথা ও রকম সম্মানের সাথে শুনবে না। কারণ, জীবন যে জাদুময়ী সাধারণ মানুষ তা আবিষ্কার করতে ভয় পায়। তারা তাদের বাড়িঘরে অভ্যস্ত, অভ্যস্ত তাদের কাজে, আশা-আকাঙ্ক্ষায়। কেউ যদি বলে এ সময় ভ্রমণ সম্ভব, প্রাচীন দুর্গে ঘুরে আসা সম্ভব, গল্প বলা ট্যারট কার্ড, আর গাঢ় অন্ধকার রাতে সেই মানুষটির চলে যাওয়া এ সমস্ত কিছু যেসব মানুষ কখনো এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়নি, তারা ভাববে জীবন তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। জীবনকে তারা যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, প্রতিটি দিন একই রকম, প্রতিটি রাত, সপ্তাহান্তে সেই একই নির্জীব নিস্পৃহতা।

ব্রাইডার সুযোগটা নিজের ভেতরে রাখা উচিত। যদি শব্দই ঈশ্বর হয়, তাহলে বাতাস হয়তো তার ভ্রমণের প্রতিটি শব্দ মনে রেখেছে, ধরে রেখেছে। এমনও অনেক কিছু, যা সে মনে করতে পারছে না। সে পড়ে ছিল বনের ভেতর কিন্তু তারই মাঝে স্থান-কাল এক সরল রেখা চলে এসেছিল, আর তাকে মুখোমুখি করে ছিল অবিশ্বাস্য সব অভিজ্ঞতার। স্থান-কাল যখন বিভ্রান্তি করে, তখন নিজের ভেতর এক মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে। মনে পড়ছে সেই সাঝে বলা কথাগুলো, এ সঁঝের বাতাসের প্রতিটি কাপন যেন এ বনের মাঝে সে কথাগুলোকে বিকিরিত করে চলেছে। আর মাত্র একজনই; জাদুবিদ্যা যার জীবনে অংশ, বুঝতে পারবে যে সত্যিই এমনটি ঘটেছিল।

 ব্রাইডা দুর্গের কথা, কালো হলুদ আলখাল্লা পরা পুরোহিতের কথা, উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়া আগুন, তার স্বামীর কথা সব বলল, উইক্কা ধৈর্য ধরে সব শুনল। লনির মনের মধ্যে যে কণ্ঠস্বর কথা বলত তার কথা শুনে উইক্কা আগ্রহ দেখাল। তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ জানতে চাইল, সেই কণ্ঠস্বর নারী নাকি পুরুষ ( উভয়ই), তারা কি কখনো ব্যক্তিগত আবেগ দেখিয়েছে না, সে ইচ্ছা করলেই কণ্ঠস্বরকে ডেকে আনতে পারত কি না (এটা জানার সুযোগ হয়নি!)।

ঠিক আছে, আমরা এখন যেতে পারি। উইক্কা বলল। তার আলখাল্লা তুলে নিয়ে ব্যাগে রাখল। ব্রাইডা হতাশ। ভেবেছিল উইক্কা তার প্রশংসা করবে, অন্ততপক্ষে, কিছু ব্যাখ্যা দেবে। কিন্তু উইক্কাকে দেখে সেই ডাক্তারের কথা মনে হলো, যে রোগীকে শীতল চোখে পরীক্ষা করে আর রোগীর যন্ত্রণা দুর্ভোগের চেয়ে উপসর্গ লেখার পেছনই বেশি উৎসাহী থাকে! যে যন্ত্রণার কারণেই উপসর্গগুলো এসেছিল।

তারা দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ফিরে এলো। যখনই ব্রাইডা ঐ প্রসঙ্গ ওঠাতে যায়, উইক্কা তখনই হঠাৎ করে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার কীভাবে বেড়ে যাচ্ছে, রাশ আওয়ারে ট্রাফিক জ্যামের কী অবস্থা, আর তার ভবনের ম্যানেজারের মতো মানুষের ওখানে বাস করা কত কঠিন, সেসব প্রসঙ্গ তুলেছে।

তারা দুজন আবার উইক্কার রুমে আর্মচেয়ারে মুখোমুখি হলো। তখনই শুধু উইক্কা ব্রাইডার অভিজ্ঞতার ব্যাপারে মন্তব্য করল।

 আমি তোমাকে শুধু একটা জিনিস বলতে চাই উইক্কা বলল, তোমার আবেগকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে নিজেকে বিব্রত করো না। তুমি যেভাবে পারো সেভাবে জীবনযাপন করো। ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি তুমি নিজের কাছে রাখো। যদি তুমি মনে করো জীবনযাপন করার চেয়ে বোঝাঁপড়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে এখনই জাদুবিদ্যা ছেড়ে দাও। দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের সেতুবন্ধ ধ্বংস করে দেয়ার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে তোমার আবেগকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা।

আবেগ হচ্ছে বুনো ঘোড়ার মতো। ব্রাইডা জানত তাদের কখনো প্রভুত্ব করতে দেয়া যায় না। একবার তার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গেল, কোন ব্যাখ্যা দিল না। সে মাসখানেক বাড়িতে কাটাল। মনে আছে, সারাক্ষণ ভেবে ভেবে সে শুধু ছেলেটির দোষগুলো খুঁজতো, আর ভাবতো, তাদের সম্পর্কের ভেতর কোথাও একটা ভুল ছিল। প্রতি সকালে ঘুম ভাঙার পর তাকে গভীরভাবে মনে পড়ত, মনে হত, একবার ফোন করলে সে নিশ্চয়ই দেখা করতে রাজি হবে!

রান্নাঘরে কুকুর ডাকছিল। ব্রাইডা জানত তার সময় যে শেষ হয়েছে, এটা তারই সংকেত।

 ওই, প্লিজ, এখনো কী ঘটেছিল সে সম্বন্ধে কথা বলিনি আমরা! ব্রাইডা কেঁদে ফেলল। আর মাত্র দুটো প্রশ্ন আমি সাদাসিধেভাবে জিজ্ঞাসা করতে চাই।

উইক্কা উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা সব সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করে আর ঠিক মেয়েটা চলে যাওয়ার সময়ই সেটা করে সে।

আমি জানতে চাই, যে পুরোহিতদের আমি দেখেছি বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব আছে কি না?

 আমাদের দারুণ অভিজ্ঞতা আছে। আর কমপক্ষে দুই ঘন্টা পূর্বে, আমরা নিজেদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছি। এটা আমাদের কল্পনার সৃষ্টি। উইক্কা বলতে বলতে বুকশেলফের কাছে গেল।

ব্রাইডার মনে পড়ে গেল তারা বনের মধ্যে থাকার সময়, সে অসাধারণ লোকদের ব্যাপারে ভেবেছিল। এখন নিজেই সে জন্য লজ্জা পেল।

উইক্কা একটা বই নিয়ে ফিরে এলো।

ক্যথাররা দ্বাদশ শতকের দক্ষিণ ফ্রান্সে চার্চের প্রতিষ্ঠাতা ছিল। তারা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করত। প্রকৃত ঈশ্বর এবং প্রকৃত শয়তানে বিশ্বাস করত। বিশ্বাস করত, দুনিয়াটা পছন্দনীয় এবং হারানো এ দুই ভাগে বিভক্ত। তার মানে কাউকে রূপান্তরিত করার কোনো দরকার নেই।

ক্যাথাররা ভিন্নভাবে জাগতিক বিষয়ে অনেক প্রজাতান্ত্রিক জমিদারদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। লংগিডক রিজনে তাদের ধর্মকে ব্যবহার করে ক্যাথলিক চার্চের ওপর যে বহু ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছিল, তা এড়িয়ে যায়। সমভাবে, জন্মের সময়ই সিদ্ধান্ত হয় কে ভালো হবে, কে খারাপ। ক্যাথাররা তাদের যৌনজীবনে অনেক সহনশীল ছিল, বিশেষত মেয়েদের ব্যাপারে। তারা শুধু সেসব ব্যাপারে কঠোর ছিল, যেসব পুরোহিতদের সাথে জড়িত।

ক্যাথরিজম ছড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। ক্যাথলিক চার্চ হুমকির মুখে পড়ে গেল এবং তাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করল। চল্লিশ বছর ধরে, ক্যাথার আর ক্যাথলিকরা রক্তক্ষয়ী লড়াই করে কিন্তু আইনগত যোদ্ধারা, অন্য রাজ্যের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত নতুন ধর্মে প্রভাবিত সবগুলো শহরকে ধ্বংস করে দেয়। শুধু পাইরিনেসের মনসেগড়ের দুর্গ খাড়া হয়ে থাকে। ক্যাথাররা সেখানে অবস্থান করে যতদিন পর্যন্ত না ফরাসিরা তাদের গোপন পথ খুঁজে না পায়। ১২৪৪ সালে এক মার্চের সকালে, দুর্গের আত্মসমর্পণের পর, দুইশ বিশজন ক্যাথার নিজেদের মহান শক্তির কাছে নিবেদন করে, গান গায়, বিশাল ব্যুৎসব করে, যা পাহাড়ের গোড়া থেকে দুর্গের একেবারে চূড়া পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল।

উইক্কা এসব বই দেখে বলছিল। বইটা এখন কোলের ওপর বন্ধ অবস্থায় আছে। গল্প বলা শেষ করে সে বইটা আবার খুলল। একটা ফটোগ্রাফ খুঁজতে লাগল।

ব্রাইডা ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিংটা দেখল। টাওয়ারটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু দেয়ালটা এখনো খাড়া আছে। এখানে উঠানটাও দেখা যাচ্ছে, যেখানে লনি আর টালবো বেয়ে উঠেছিল। সেই পাথরটা দেয়াল আর টাওয়ার অংশ হিসেবে ছিল।

 তুমি বলতে চাই, আমার কাছে তোমার আরেকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আছে।

প্রশ্নটার এখন আর কোনো গুরুত্ব নেই। ব্রাইডা খুব কমই সরাসরি চিন্তা করতে পারে। তার অদ্ভুত লাগছিল। অনেক কষ্ট করে কোনোমতে কী জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল তা মনে করতে পারল।

আমি জানতে চাই, আপনি কেন আমার পেছনে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন?

কারণ আমাকে রীতিনীতিগতভাবে সে রকমটি করতে বলা হয়েছে। উইক্কা উত্তর দিল। তোমার সফল দেহধারণের পরে, তুমি খুব কম বদলেছ। আমি আর আমার বন্ধুরা যে দলে থাকি, তুমিও এখন সেই দলে ভিড়ে গেছ। আমরা চাঁদের রীতিনীতির দায়িত্বে আছি। তুমি একজন উইচ বা ডাইনি।

উইক্কা কী বলছিল ব্রাইডা তাতে কোনো মনোযোগ দিল না। এমনকি আরেকটা সাক্ষাতের ব্যাপারেও ভাবল না। সে শুধু চাইছিল এ মুহূর্তে এখান থেকে চলে যেতে, যাতে তার পরিচিত জগতে ফিরে যেতে পারে যেখানে নোনাধরা দেয়াল, মেঝেতে ছড়ানো সিগারেটের টুকরো, ডেস্কে কয়েকটা চিঠি পড়ে আছে।

আমাকে আগামীকাল কাজে যেতে হবে। ব্রাইডা হঠাৎ করে সময়ের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল।

বাড়ি ফেরার পথে, ব্রাইডা কোম্পানির ক্যাশমেমোর প্রশাসনিক ব্যাপারগুলো ভাবতে লাগল, তার বেশ ভালো লাগল। সে যা করেছে বস হয়তো তা মেনে নেবেন, তাকে আবার সুযোগ দেবেন।

ব্রাইডা বাড়ি ফিরে রাতের খাওয়া শেষ করল। কিছুটা সময় টিভি দেখে কাটাল। তার চিন্তাগুলো কাগজে লিখে ফেলল। সর্বশেষ, ক্লান্ত শরীর নিয়ে আশ্রয় নিল বিছানায়।

 অফিসের এসব রপ্তানিমুখ্য দ্রবের ক্যাশমেমো তার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যাহোক, এ কাজের জন্যই তাকে বেতন দেয়া হয়।

আর অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। বাকি সব মিথ্যা।

.

১৪.

সপ্তাহজুড়ে ব্রাইডা অফিসে কঠোর পরিশ্রম করল। বসের প্রশংসা কুড়াল। কোনো ক্লাস মিস করল না। নিউজস্টান্ডের ম্যাগাজিনের সব কিছুই বেশ আগ্রহের সাথে খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ল। তার চিন্তাগুলোকে এড়িয়ে চলতে হবে। জাদুকরের সাথে সেই জঙ্গল পরিভ্রমণের কথা যখন তার মনের গহিন থেকে উঠে আসে অথবা শহরের ডাইনির সাথের ঘটনা, সে তৎক্ষণাৎ সেগুলোকে মন থেকে মুছে ফেলে ভাবতে থাকে সামনের সপ্তাহে তার পরীক্ষা আছে, অথবা আরেকজন বান্ধবীর কথা মনে করতে থাকে।

শুক্রবার এলে এর সাথে সে সিনেমায় গেল, তারপর পরিচিত বারে। সেখানে ফিল, নিজেদের কলিগ, চাকরী; এসব নিয়ে খুব গল্প করল। তারপর পার্টি ফেরত বন্ধুদের সাথে রাতের খাবারের পরিকল্পনা করল, তারপর চমৎকার ব্যাপার হল এই, কেউ ডাবলিনের রেস্তোরাঁগুলো সারারাত খোলা পাবে। তাদের যেসব বন্ধু পার্টি থেকে ফিরে এসেছিল, তাদের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সৌভাগ্যের ব্যাপার ডাবলিনে আপনি প্রায় সারা রাত সব সময় রেস্টুরেন্ট খোলা পাবেন।

 রাত দুটোয় বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে দুজন বাড়ি ফিরল, আয়রন বাটা…রেকর্ড ছেড়ে গ্লাসে ঢালল নির্জলা হুইস্কি। তারপর কোমর জড়িয়ে সোফায় এলিয়ে দিল। ক্লান্ত শরীর জোড়া। দুজনেই নিরব, শুধু মাঝে মাঝে ল ব্রাইডার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছিল, আর আদর করছিল বুকে।

একটা সপ্তাহ গেল পুরো পাগলের মত। ব্রাইডা হঠাৎ বলল; একটানা কাজ করেছি, পড়াশোনা করেছি, সমস্ত কেনাকেটা করেছি।

রেকর্ড শেষ হয়ে গিয়েছিল। উঠে গিয়ে রেকর্ডটা ঘুরিয়ে দিল সে।

তুমি কি জানো কিচেনের কাপবোর্ডের দরজা হঠাৎ করে উল্টে আসে? শেষ পর্যন্ত আমি একজনকে ঠিক করেছি যে এটা ঠিক করে দিয়ে যাবে। কয়েকবার ব্যাংকে গিয়েছি। একবার বাবার পাঠানো টাকা তুলতে, আরেকবার ফার্মের জন্য কয়েকটা ডিপোজিট রাখতে এবং তারপর…

লরেন্স ওর দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইল।

 এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? ব্রাইডা ক্ষেপে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল। মনে হল সোফাটি শুয়ে তাকিয়ে থাকা মানুষটিকে সে চেনে না; কেন যেন তার কোন ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না? চুলোয় যাক, ওকে তার দরকার নেই; কাউকেও নয়।

 তুমি আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আবার জিজ্ঞাসা করল সে।

লরেন্স এবারও কিছু বলল না। শুধু উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে এলো। তারপর আলতো করে জড়িয়ে শুইয়ে দিল সোফার উপর।

আমি যা বলছিলাম তুমি কিছু শুনছিলে না। ব্রাইডা বলল।

লরেন্স জড়িয়ে ধরল তাকে।

ব্রাইডা ভাবল, আবেগ বুনো ঘোড়ার মতো।

আমাকে সব কিছু খুলে বলো, লরেন্স মধুর স্বরে বলল আমি শুনব। তুমি যা সিদ্ধান্ত নাও, আমি তা শ্রদ্ধার সাথে নেব। এমনকি যদি তোমার অন্য কারোর সাথে দেখা হয়ে যায়, এটা যদি আমাদের শেষ রাতটিও হয়। আমরা এখন একসাথে আছি। আমি হয়তো তোমাকে ভালো করে জানি না। আমি আসলে বোঝাতে চাচ্ছি, আমি জানি না আসলেই তুমি কে, কিন্তু আমি জানি তুমি কী নও। তুমি আজ রাতে নিজের মধ্যে নেই।

ব্রাইডার কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু অন্ধকার রাতে সে অনেক কেঁদেছে, ট্যারট কার্ড নিয়ে কথা বলেছে, জঙ্গলে গিয়েছে। আবেগ সত্যি সত্যিই বুনো ঘোড়ার মতো। সে এখন সেগুলোকে মুক্ত করে দিতে চায়।

ব্রাইডা লরেন্সের সামনে উঠে বসল। মনে পড়ে গেল ম্যাগাস আর উইক্কা দুজনেরই এ আসন পছন্দের। তারপর সে লরেন্সকে আদ্যোপান্ত সব খুলে বলল। একেবারে জাদুকরের সাথে জঙ্গলে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে শেষাবধি। লরেন্স চুপচাপ শুনে গেল। শেষে ব্রাইডা লরেন্সকে মনসেগড়ের ফটোগ্রাফের কথা বললে; লরেন্স জিজ্ঞাসা করল, ইউনিভার্সিটি কোর্সের কোনো একটা বিষয়ে ক্যাথারদের সমন্ধে শুনেছিল কি না সে।

দেখ, আমি জানি, যা বলেছি তার এক বর্ণও তুমি বিশ্বাস করোনি। ব্রাইডা বেশ উষ্ণস্বরে বলল, তুমি মনে করো, এটা আমার অবচেতন মনের ব্যাপার। যে জিনিস এখন আমার মনে পড়ছে, তা আমি আগে থেকে জানতাম। কিন্তু না, লরেন্স, আমি এর আগে কখনো ক্যাথারদের কথা শুনিনি। কিন্তু সব কিছুর ব্যাপারেই তো তোমার ব্যাখ্যা আছে।

ব্রাইডার হাত অপ্রকৃতিস্তের মতো কাঁপছিল। লরেন্স উঠে দাঁড়াল। একটা কাগজ তুলে নিল। আট ইঞ্চি দূরে কাগজের মধ্যে দুটো ছিদ্র করল, তারপর টেবিলের ওপর কাগজটা হুইস্কির বোতলের গায়ে হেলান দিয়ে রাখল, যাতে ওটা সোজা হয়ে থাকে।

কিচেনে থেকে একটা কর্ক নিয়ে ফিরে এলো।

তারপর টেবিলে বসে কাগজ আর বোতলটা অন্যদিকে ঠেলে দিল। কর্কটা রাখল সামনে।

এখানে এসো। লরেন্স বলল।

 ব্রাইডা উঠে দাঁড়াল। কাঁপতে থাকা হাতদুটো লুকোতে চাইল।

ধরে নাও, এই কর্কটা হলো ইলেকট্রন, একটা ছোট্ট পার্টিকেল, যা এটমকে তৈরি করে। বুঝতে পারছ?

ব্রাইডা সায় জানাল।

ঠিক আছে, খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো। নির্দিষ্ট জটিল বিট থাকলে আমি একটা ইলেকট্রনকে আঘাত করতে পারি যেটা ওই কাগজের, একই সাথে দুটো গর্ত দিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে, কিন্তু কোনোভাবেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে না।

আমি তা বিশ্বাস করি না। ব্রাইডা বলল, ব্যাপারটা অসম্ভব।

লরেন্স কাগজের টুকরো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর কর্কটা আবার জায়গামতো নিয়ে এলো।

তুমি হয়তো তা বিশ্বাস করতে পারো না, কিন্তু এটাই সত্য। এটা এ রকম কিছু যা বিজ্ঞানীরা জানে, কিন্তু ব্যাখ্যা করতে পারে না। তুমি যা বলেছ তা আমি বিশ্বাস করতে পারি না, কিন্তু আমি জানি তা সত্যি।

ব্রাইডার হাত তখনো কাঁপছিল। কিন্তু সে কাঁদছিল না। লক্ষ করল অ্যালকোহলের প্রতিক্রিয়া কেটে যাওয়াতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে এসেছে।

আর এ রকম রহস্যময় ব্যাপার যখন ঘটে তখন বিজ্ঞানীরা কী করে?

তারা অন্ধকার রাত্রিতে প্রবেশ করে, তমি আমাকে এই কথাটা শিখিয়েছ। আমরা জানি, রহস্য কখনো অনেক দূর গড়ায় না। তো আমরা এটাকে মেনে নিতে শিখি। এক জীবনের অনেক কিছু ঘটে। একজন মা যখন সন্তানের জন্ম দেয়, তখন সেও অনুভব করে ওই অন্ধকার রাত্রির রহস্যময়তা। অথবা একজন প্রবাসী যখন কাজ আর অর্থের খোঁজে বহু দূর দেশে পাড়ি জমায় তার মধ্যেও অন্ধকার রাত্রির রহস্যময়তা কাজ করে। তারা বিশ্বাস করে তাদের এ প্রচেষ্টা অবশ্যই মূল্যয়িত হবে। একদিন তারা বুঝতে পারবে এ পথে কী ঘটে গেছে। সেই সময়টা খুব ভীতিপদ। ব্যাখ্যা আমাদের জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় না, আমাদের আকাঙ্ক্ষাই গিয়ে নিয়ে যায় সম্মুখপানে।

 ব্রাইডা হঠাৎ খুব ক্লান্ত বোধ করতে লাগল। তার ঘুমানোর দরকার। ঘুমই একমাত্র জাদুকরী রাজ্য যেখানে সে মুক্তভাবে প্রবেশ করতে পারে।

.

১৪.

সেই রাতে ব্রাইডা সুন্দর স্বপ্ন দেখল। সমুদ্র আর গাছপালা ঘেরা দ্বীপের স্বপ্ন। খুব ভোরে জেগে গেল। লরেন্সকে পাশেই ঘুমাতে দেখে খুশি হয়ে উঠলো সে। স্নানঘরে গিয়ে তার জানালার কাছে দাঁড়াল। বাহিরে তখনও ঘুমিয়ে আছে ঝাপসা ডাবলিন শহর।

ব্রাইডা বাবার কথা ভাবল। ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে জেগে উঠলে বাবা তাকে নিয়ে ঠিক এ কাজটাই করতেন। স্মৃতিটা শৈশবের আরেকটা দৃশ্যকে টেনে নিয়ে এলো।

বাবার সাথে সে সমুদ্রসৈকতে গিয়েছিল। তিনি তাকে সমুদ্রের পানির কাছে নিয়ে পানির উষ্ণতা দেখতে বললেন। ব্রাইডা তখন পাঁচ বছরের বালিকা এবং নিজে কাজ করতে পারায় খুশি। সে পানির কিনারায় গিয়ে পায়ের বুড়ো। আঙুল ডুবিয়ে দিল।

আমি পা দিয়ে দেখেছি। খুব ঠাণ্ডা। ব্রাইডা বাবাকে বলল।

বাবা তাকে তুলে নিলেন। আবার পানির কাছে নিয়ে গেলেন। কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই তাকে পানির ভেতরে ছুঁড়ে দিলেন। প্রথমে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর সে জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। বাবা তার সাথে মজা করেছেন।

পানি কেমন? বাবার প্রশ্ন।

মজার!

ঠিক, এখন থেকে, যখনই তুমি কোনো কিছু খুঁজে বের করতে চাইবে, সরাসরি তার মধ্যে ঢুকে যাবে।

ব্রাইডা খুব তাড়াতাড়িই এই শিক্ষা ভুলে গেছে। তার বয়স হয়তো মাত্র একুশ, কিন্তু এরই মধ্যে সে অনেক প্রাণশক্তি ভেতরে ভেতরে গড়ে তুলেছে, যা তার চারদিকে বেপরোয়াভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। জটিলতা নিয়ে সে ভীত নয়। নির্দিষ্ট পথ বেছে নেয়ার ব্যাপারেই সে ভয় পাচ্ছে।

একটা পথ বেছে নেয়া মানে অন্যগুলোকে মিস করা। তার সামনে যাপন করার জন্য গোটা জীবন পড়ে আছে। সে সব সময় তা নিয়ে ভাবে। ভবিষ্যতে, এখন যে পথ বেছে নিচ্ছে তার জন্য তাকে দুঃখ করতে হবে।

 আমি নিজের কমিটমেন্টের ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি। ব্রাইডা ভাবল। সে সম্ভাব্য সকল পথ অনুসরণ করতে চায়। এ কারণে কোনোটাই শেষ হয় না। এমনকি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়, ভালোবাসা, সেখানেও নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা রাখতে সে ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রথম রোমান্টিক হতাশার পরে কখনো নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দেয়নি। সে ব্যথা, যন্ত্রণা, বিচ্ছেদের ভয়ে ভীত, এ জিনিসগুলো ভালোবাসার পথে বাধাস্বরূপ। এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, এ পথে না হাঁটা। যন্ত্রণা ভোগ না করতে চাইলে, তোমার ভালোবাসার দরকার নেই। এটা এমন, যেন তোমার নিজের চোখ দিয়ে জীবনে কোনো খারাপ কিছু দেখতে চাইবে না।

জীবন অনেক জটিল।

তোমাকে ঝুঁকি নিতে হবে। কোনো একটা পথ অনুসরণ করতে হবে। অন্যগুলোকে ছেড়ে দিতে হবে।

মনে পড়ে গেল উইক্কা বলেছিল, লোকজন একটা নির্দিষ্ট পথ বেছে নেয়, কারণ তারা প্রমাণ করতে চায়, তারা ঠিক পথে নেই। কিন্তু তা একটা পথকে বেছে নেয়ার চেয়ে খারাপ কিছু নয়। আর সারাটা জীবন ত্রস্ততায় কাটে যে, তুমি যদি ঠিক পথটা বেছে নিতে। ভয় না পেয়ে কেউ কখনো তার পছন্দের পথটাকে বেছে নিতে পারে না।

এটাই জীবনের আইন। এটাই অন্ধকার রাত্রি। কেউ অন্ধকার রাত্রিকে এড়িয়ে যেতে পারে না। এমনকি যদি তারা কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নাও নেয়। এমনকি যদি তারা কোনো কিছু বদলে দেয়ার ব্যাপারে ভীত থাকে। কারণ তা নিজেই একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার। শুধু অন্ধকার রাত্রির আড়ালে যে সম্পদ লুকিয়ে আছে তার সুফল বুঝতে না পারা।

লরেন্স হয়তো ঠিকই বলেছে। শেষ পর্যন্ত, তারা তাদের প্রাথমিক সেই ভয়ের ব্যাপারে হেসে ফেলে। যেমনটি সে জঙ্গলের মধ্যে সাপ-বিচ্ছুর কথা কল্পনা করে পেয়েছিল। ভুলেই গিয়েছিল আয়ারল্যান্ডের পথপ্রদর্শক সম্ভ, সেইন্ট প্যাট্রিক অনেক আগেই সব সাপ তাড়িয়ে দিয়েছে।

আমি খুব খুশি যে তুমি আছো, লরেন্স। ব্রাইডা নরম স্বরে বলল। ভয় পাচ্ছিল লরেন্স হয়তো শুনতে পাবে।

ব্রাইডা বিছানায় শুয়ে পড়ল। আশা করছে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে, বাবার ব্যাপারে আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেল। সেদিন ছিল রবিবার। তার দাদীর বাড়িতে দুপুরের নিমন্ত্রণ ছিল সবার। তার তখন বয়স চৌদ্দের কাছাকাছি। সে একটা হোমওয়ার্কের অ্যাসাইনমেন্ট করা হয়নি বলে অনুযোগ করছিল। যতবার তা শুরু করতে যায় ততবারই ভুল হয়ে যায়।

সম্ভবত যতবার তা ভুল হয় ততবার তুমি কিছু না কিছু শেখ। বাবা বলেছিলেন। কিন্তু ব্রাইডা নিশ্চিত সে ভুল পথে এগোচ্ছে আর ঠিক হওয়ার কোনো উপায় নেই।

বাবা তার হাত ধরে তাকে লিভিংরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে সাধারণত দাদিমা বসে বসে টেলিভিশন দেখেন। ওখানে বিশাল প্রাচীন আমলের অ্যান্টিক গ্রান্ডফাদার ক্লক ছিল। যেটা বছরের পর বছর ধরে বন্ধ ছিল, কারণ তা আর সারাই করার মতো ছিল না।

এই দুনিয়ায় কোনো কিছুই পুরোপুরি ভুল নয়। বাবা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, এমনকি একটা বন্ধ ঘড়িও দিনে দুই বার ঠিক সময় দেয়।

.

১৪.

জাদুকরকে খুঁজে পাওয়ার আগে ব্রাইডা কিছু সময় জঙ্গলঘেরা পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করল। পাহাড়ের ওপরের দিকে পাথরের গোড়ায় বসল। পাহাড় আর উপত্যকার সৌন্দর্য দেখল। সত্যিই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। ব্রাইডার মনে হয়, আত্মারা সম্ভবত এ রকম জায়গাই পছন্দ করে।

ঈশ্বরই সৌন্দর্যের একমাত্র ঈশ্বর? তার মনে এ রকম প্রশ্নের উদয় হয়, যদি তাই হয়, তাহলে কুৎসিত মানুষ আর কুৎসিত জায়গার ব্যাপারে কী হবে?

জাদুকর কোনো উত্তর দিলেন না। ব্রাইডা বিব্রত বোধ করল।

আপনার সম্ভবত আমাকে মনে নেই। আমি দুই মাস আগে এখানে এসেছিলাম। আমি গোটা রাত একা এই জঙ্গলে কাটিয়েছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম শুধু যখন আমার পথ আবিষ্কার করতে পারব, তখনই এখানে ফিরে আসব। উইক্কা নামের একজন মহিলার সাথে আমার দেখা হয়েছে।

জাদুকর চমকে উঠলেন। বুঝতে পারলেন মেয়েটা তা খেয়াল করেনি। তারপর তিনি ভাগ্যের পরিহাস দেখে হেসে উঠলেন।

উইক্কা আমাকে বলেছে, আমি একজন ডাইনি। মেয়েটি বলে চলল।

 তুমি কি তাকে বিশ্বাস করোনি?

জাদুকরের প্রথম প্রশ্ন। ব্রাইডা আসার পরে প্রথম কথাও বলা যেতে পারে। ব্রাইডা খুশি হলো, সে যা বলছে তিনি তা তা শুনেছেন। তার পরও, সে ঠিক নিশ্চিত ছিল না।

হ্যাঁ, আমি তাকে বিশ্বাস করেছি। ব্রাইডা বলল, আর চাঁদের রীতিনীতিতে বিশ্বাস করেছি। কিন্তু আমি এও জানি, সূর্যের রীতিনীতি আমাকে অন্ধকার রাত্রির ব্যাপারে বুঝতে সাহায্য করেছে। এ কারণে আমি ফিরে এসেছি।

তাহলে চুপ করে বসে সূর্যাস্ত দেখ। জাদুকর ম্যাগাস বললেন।

আমি এই জঙ্গলে আর একা থাকতে চাই না। ব্রাইডা উত্তর দিল, শেষবার আমি যখন এখানে ছিলাম…।

জাদুকর ম্যাগাস তাকে বাধা দিলেন।

ও কথা বোলো না। ঈশ্বরই শব্দ।

 উইক্কাও একই কথা বলেছিল।

আমি ভুল কী বলেছি?

যদি তুমি বলো শেষবার, তার মানে গিয়ে দাঁড়ায় শেষ। তুমি যা বোঝাতে চাইছ তা হলো, সম্প্রতি যে সময়ে আমি এখানে ছিলাম।

ব্রাইডা চিন্তিত হয়ে পড়ল। এখন থেকে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হবে। চুপচাপ বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। জাদুকরের কথামতো সূর্যাস্ত দেখতে লাগল।

সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে থেকে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চারদিকে অন্ধকার নেমে যাবে, সে জন্য নয়, তাকে অনেক কিছু বলতে হবে, অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করতে হবে সেজন্যে। যখনই সে চুপচাপ বসে কোনো কিছু দেখতে থাকে, তার মনের মধ্যে এ রকম অনুভূতি হয়, যেন সে মূল্যবান সময় অপচয় করে ফেলছে। সে সময়টা কাজ করতে পারত অথবা লোকজনের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারত। সে তার সময়টাকে আরো ভালো কাজের জন্য ব্যয় করতে পারে, কারণ এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।

সূর্য দিগন্তের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। সোনালি, গোলাপি রশ্মি মেঘে ঢেকে আছে। ব্রাইডার মনে হতে থাকে জীবনটা এ রকমই, একদিন চুপচাপ বসে সূর্যাস্ত দেখা।

তুমি কি জানো কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়? এক পর্যায়ে জাদুকর ম্যাগাস জিজ্ঞাসা করলেন।

অবশ্যই সে জানে। সবাই জানে কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়।

 ঠিক, যখনই সূর্য দিগন্তের রেখা স্পর্শ করবে, প্রাথনা করো। সূর্যের রীতিনীতিতে প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। প্রার্থনা, আত্মার আকুতি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রার্থনা যেকোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

আমি জানি না কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়। কারণ আমার আত্মা নীরব। ব্রাইডা বলল।

জাদুকর হাসলেন।

শুধু সত্যিকার আলোকিতদের নীরব আত্ম রয়েছে।

তাহলে আমি কেন আমার আত্মার প্রার্থনা করতে পারি না?

কারণ তোমার তা শোনার ঘাটতি আছে। খুঁজে বের করো আত্মা কী চায়। তোমার আত্মার আকুতি শোনার ব্যাপারে তুমি বিব্রত বোধ করো। আর এই অনুরোধগুলো ঈশ্বরের কাছে পাঠাতে ভয় পাও। কারণ তুমি মনে করো, ঈশ্বরের সেগুলো শোনার মতো সময় নেই।

 ব্রাইডা পাশে বসে সূর্যাস্ত দেখছিল। যাই হোক, এসব মুহূর্তে সব সময় যা ঘটে, তার মনে হতে লাগল এখানে বসে থাকার উপযুক্ত সে নয়।

সত্যিই আমি নিজেকে অযোগ্য মনে করি। সব সময় মনে করি আত্মিক খোঁজের মানুষেরা আমার চেয়ে ভালো।

 সেই মানুষেরা, যদি তাদের অস্তিত্ব থাকে, কোনো কিছু খোঁজার দরকার হয় না তাদের। তারা আত্মার ইশতেহার। আমাদের মতো মানুষেরই খোঁজার দরকার পড়ে।

আমাদের মতো। তিনি বললেন।

ঈশ্বর সূর্যের রীতিনীতি আর চাঁদের রীতিনীতি উভয়েরই ঈশ্বর। ব্রাইডা বলল। বিশ্বাস করে ঐতিহ্যগত ব্যাপারগুলো সব একই রকম। তো আমাকে কীভাবে প্রার্থনা করতে হয় তা শেখান।

জাদুকর সূর্যের দিকে মুখ করে দুই চোখ বন্ধ করলেন।

আমরা মানুষ, হে ঈশ্বর। আমরা আমাদের মহত্ত্ব জানি না। ঈশ্বর, আমাদের কী প্রয়োজন তা জানার জন্য বশ্যতা দরকার। কারণ কোনো আকাঙ্ক্ষাই ব্যর্থ নয়। কোনো অনুরোধই নিষ্ফল নয়। আমরা প্রত্যেকেই জানি আমাদের আত্মাকে পরিপুষ্ট করতে সর্বোত্তম কী করতে হয়। আমাদের সাহস দাও, যাতে আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে তোমার স্বর্গীয় প্রজ্ঞায় নিতে পারি। শুধু আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে বরণ করে আমাদের বোঝার সুযোগ দাও আমরা কারা, আমিন। এখন তোমার পালা। জাদুকর ম্যাগাস বললেন।

ঈশ্বর, আমাকে বুঝতে সাহায্য করো। যেসব ভালো জিনিস আমার জীবনে ঘটেছে তা বুঝতে দাও, কারণ আমি সেগুলোকে আশা করেছি। আমাকে বুঝতে সাহায্য করো, তোমার সত্য খোঁজার জন্য আমি যে শক্তি ব্যয় করেছি সে রকম শক্তি সন্তুরাও ব্যয় করেছিল। আমার যেসব সন্দেহ আছে একই রকম সন্দেহ সল্লদেরও ছিল। আমার ভঙ্গুরতা সেই একই রকম ভঙ্গুরতা। আমাকে যথেষ্ট বিনয়ী হতে সাহায্য করো, যাতে আমি অন্য মানুষের চেয়ে আলাদা না হয়ে তা গ্রহণ করতে পারি। আমিন।

 তারা চুপচাপ বসে রইল। সূর্যাস্ত দেখতে লাগল। সূর্যের শেষ রশ্মি মেঘের আড়ালে না ঢেকে যাওয়া পর্যন্ত বসে থাকল। তাদের আত্মা প্রার্থনা করছিল। আশা করছিল প্রার্থনা গৃহিত হবে। তারা একসাথে আছে বলে ধন্যবাদ জানালো।

এখন চলো সরাইখানায় যাই। ম্যাগাস বললেন।

ব্রাইডা আর ম্যাগাস হাঁটা শুরু করল। ব্রাইডার প্রথম দিনের কথা মনে পড়ল, ম্যাগাসকে এখানে খুঁজতে এসেছিল। ব্রাইডা নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল এ ঘটনা সে আর মাত্র একবার ঘটতে দেবে। নিজের ওপর জোর খাটানো অর্থহীন।

ম্যাগাস তার সামনে হেঁটে চলা মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল মেয়েটা জানে কোথায় পা ফেলতে হবে, ভেজা মাটিতে নাকি পাথরের ওপরের। কিন্তু বারবার হোঁচট খাচ্ছিল। অর্থহীন। ম্যাগাসের হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন।

মাঝে মাঝে ঈশ্বরের দান সমস্ত জানালা বন্ধ করে দেয়ার পরে আসে।

.

১৫.

ব্যাপারটা বেশ ভালো যে ব্রাইডা ম্যাগাসের পাশেই আছে, যদিও ম্যাগাস তার পাশ দিয়ে পাহাড়ের নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। তিনি অন্য সাধারণ মানুষের মতোই, একই রকম দুর্বল, একই রকম ধার্মিক। তিনি এখনো শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেননি। প্রথমত, লোকজন যখন আয়ারল্যান্ড থেকে তার কাছে শিক্ষা নেয়ার জন্য আসত, তিনি সূর্যের রীতিনীতর ব্যাপারে বলতেন। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতেন তারা কী শিক্ষা নিয়েছে। ঈশ্বর তার প্রজ্ঞ এখানে সঞ্চিত করে রেখেছেন। কয়েকটা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের রীতি পালন করলে তারা তা বুঝতে পারবে। যে পদ্ধতিতে তিনি সূর্যের রীতিনীতর শিক্ষা দেন তা দুই হাজার বছর আগে সন্তপল শিক্ষা দিয়েছেন, আর আমি তোমার দুর্বলতার সাথে আছি। তোমার ভয়, তোমার কাপুনির সাথে আছি। আমার কথা, তার অন্তর্নিহিত; জ্ঞান নয়। আত্মা আর শক্তির প্রসারে তোমার বিশ্বাস প্রজ্ঞার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে না।

এখনো মানুষ ম্যাগাসকে বুঝতে পারে না। তিনি সূর্যের রীতিনীতির ব্যাপারে কথা বলেন। তারা হতাশ হয় যখন দেখে তিনি অন্য মানুষের মতোই একজন মানুষ।

জাদুকর ভাবেন, এটা গ্রাহ্য করার মত কিছু নয়। তিনি একজন শিক্ষক। তিনি যা করতে পারেন, তাহল মানুষকে জ্ঞানের পথের সন্ধান দেয়া। কিন্তু তাদের আরো বেশি চাই। তাদের পথপ্রদর্শক চাই। তারা অন্ধকার রাত্রির ব্যাপার বুঝতে পারে না, তারা বুঝতে পারে না কোনো পথপ্রদর্শক অন্ধকার রাত্রির মাধ্যমেই কেবল আলোকিত করতে পারে পথ। আর সেই আলো যদি কোনো কারণে নিভে যায়, লোকেরা হারিয়ে যেতে পারে, কারণ তারা ফিরে আসার পথ জানে না। তাদের একজন ভালো শিক্ষকের প্রয়োজন, যে তাদের প্রয়োজনটাকে বুঝতে পারবে।

শিক্ষা অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে দিতে লাগলেন। আকর্ষণীয় জিনিস সবাই বুঝতে পারে, গ্রহণ করে। পদ্ধতিটা কাজ করেছে। লোকজন সূর্যের রীতিনীতি শিখেছে। তারা বুঝতে পেরেছে অনেক জিনিসত, যা ম্যাগাস বলেছে তা অপ্রয়োজনীয়, পুরোপুরি অদরকারি, তারা নিজেরাই হাসাহাসি করেছে। ম্যাগাস খুশি, কারণ তিনি শেষ পর্যন্ত শিখতে পেরেছেন কীভাবে শিক্ষা দিতে হয়।

ব্রাইডার ব্যাপারটা আলাদা। তার প্রার্থনা ম্যাগাসের আত্মাতে গভীরভাবে। ছুঁয়ে গেছে। মেয়েটা বুঝতে পেরেছে সব মানুষই এই জগতে একে অন্যের থেকে ভিন্ন। মাত্র কয়েকজন জোর গলায় বলতে পারে, অতীতের মহান শিক্ষকদের মতো একই যোগ্যতা আর একই রকম ত্রুটি সব মানুষের মধ্যে আছে। আর সে ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে খোঁজ করার ব্যাপারে তাদের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখা যায় না। অন্য মানুষের চেয়ে নিজেকে ছোট করে দেখা সবচেয়ে জঘন্য কাজ। কারণ অন্যের চেয়ে আলাদা হওয়ার পথে সবচেয়ে ধ্বংসাত্বক এটি।

তারা বারে পৌঁছালে ম্যাগাস দুটো হুইস্কির অর্ডার দিল।

অন্যদের দিকে দেখুন। ব্রাইডা বলল, তারা সম্ভবত এখানে প্রতি রাতে আসে। আর সব সময় একই কাজ করে।

ম্যাগাস অতটা নিশ্চিত নয় যে ব্রাইডা সত্যিই নিজেকে অন্য সবার সাথে একই ভাবে তুলনা করতে পারে কিনা।

 অন্য লোকদের নিয়ে তোমার সচেতনতাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। ম্যাগাস উত্তর দিলেন। তারা তোমারই প্রতিচ্ছবি।

 হ্যাঁ, আমি জানি। আমি ভেবেছিলাম কী আমাকে সুখী করে তা আমি জানি। কী আমাকে দুঃখিত করে তাও জানি। তারপর হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম আমার আরো চিন্তাভাবনা করা দরকার। ব্যাপারটা কঠিন।

তোমার ভাবনাগুলো কিসে বদলে গেল?

ভালোবাসা। আমি একজন মানুষকে জানি, যাকে দেখলে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। তিন দিন আগে, ও আমাকে দেখিয়ে দেয় ওর জগটা পুরোপুরি রহস্যে পরিপূর্ণ। আর আমি একা নই।

ম্যাগাস কিছুই বললেন না। কিন্তু তার মনে পড়ে গেল এ রকম চিন্তাভাবনা তিনি আগে করতেন। ঈশ্বরের করুণা সময় সময় বন্ধ জানালার ওপর পড়ে।

তুমি কি তাকে ভালোবাসো?

আমি যা বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হলো আমি এখনো তাকে ভালোবাসতে পারতাম। এমনকি যদি আমি এই পথে নতুন কিছু নাও শিখি, অন্ততপক্ষে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখব, আমাদের ঝুঁকি নিতে হবে।

তিনি ব্রাইডাকে নিয়ে বড় ধরনের পরিকল্পনা করেছেন। তারা পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামতে লাগল। তিনি ব্রাইডাকে দেখাতে চাইলেন তার কতটা প্রয়োজন। তাকে বোঝাতে চাইলেন তিনিও একজন সাধারণ পুরুষের মতোই, নিঃসঙ্গতার ব্যাপারে অনেক বেশি কাতর। কিন্তু ব্রাইডা শুধু তার প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইল।

এখনকার আবহাওয়ায় অদ্ভুত ব্যাপার আছে। ব্রাইডা বলল। আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে বলে মনে হয়।

এগুলো বার্তাবাহক। ম্যাগাস বললেন, আর্টিফিশিয়াল ডেমনস, যারা ঈশ্বরের বাম হাতের অংশ নয়। এগুলো আমাদের আলোর পথ দেখাবে না।

ম্যাগাসের চোখ জ্বলজ্বল করছিল। সত্যিই কিছু একটা বদলে গেছে। তিনি সে সময় শয়তানদের ব্যাপারে কথা বলছিলেন।

 ঈশ্বর লিজিয়নকে তার বাম বাহু থেকে সৃষ্টি করেছিলেন, যাতে আমরা উন্নতি করতে পারি। যাতে আমাদের লক্ষ্যে কী করতে হবে তা জানতে পারি। তিনি বলে চললেন, কিন্তু তিনি মানুষকে অন্ধকারের শক্তির ব্যাপারে প্রভুতু দিলেন। মানুষ নিজেরাই নিজেদের ডেমন তৈরি করে নিল।

সে কাজটাই তিনি এখন করছেন।

কিন্তু আমরা ভালোর শক্তির দিকেও মনোযোগ দিতে পারি। সতর্ক ভঙ্গিতে ব্রাইডা বলল।

না, আমরা পারি না।

ম্যাগাসের মনোযোগ বিছিন্ন করা দরকার, মেয়েটি যদি তাকে শুধু অন্য কিছু জিজ্ঞাসা করত। তিনি কোনো ডেমন সৃষ্টি করতে চান না। সূর্যের রীতিনীতির কারণে তাদের ম্যাসেঞ্জার বা বার্তাবাহক বলা হয়। তারা ভালো কাজ, শয়তানি কাজ দুইই করতে পারে। শুধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকরা তাদের অনুমোদন দিতে পারে। তিনিও সেই সব শিক্ষকদের একজন। কিন্তু তিনি এখন ও রকম একজন ম্যাসেঞ্জার চান না। কারণ একজন ম্যাসেঞ্জার খুব বিপজ্জনক শক্তি হতে পারে, বিশেষত যখন ভালোবাসার হতাশার সাথে তা মিশে যায়।

ব্রাইডা ম্যাগাসের সাড়াদানের ধরনে দ্বিধায় পড়ে গেল। ম্যাগাস অদ্ভুত আচরণ করছে।

আমরা ভালোর শক্তির ব্যাপারে মনোযোগ দিতে পারি না। তিনি আবার বললেন। তিনি যে ব্যাপারে আলোকপাত করতে চাচ্ছেন সেদিকে চেষ্টা করছেন,

ভালোর শক্তি সময়ই আলোর মতো ডিফিউজ হয়ে যায়। যখন তুমি ভালোর দিকে মনোযোগী হবে, তুমি সমস্ত মানবতার উপকার করবে কিন্তু যখন তুমি ম্যাসেঞ্জারের শক্তির দিকে মনোযোগ দেবে, তখন শুধু তুমিই লাভবান অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 ম্যাগাসের চোখ তখনো জ্বলজ্বল করছিল। তিনি বারটেন্ডারকে ডেকে বিল মিটিয়ে দিলেন।

 চলো আমার ডেরায় যাই। ম্যাগাস বললেন, আমি তোমাকে চা বানিয়ে দেব। আর তুমি আমাকে তোমার সব প্রশ্ন করতে পারবে।

ব্রাইডা ইতস্তত করল। জাদুকর একজন আকর্ষণীয় পুরুষ। সে নিজে আকর্ষণীয়া তরুণী। সেই রাতে সে ভয় পেয়েছিল। আজ সে শিক্ষানবিশির শেষ পর্যায়ে এসেছে।

আমাকে অবশ্যই ঝুঁকি নিতে হবে।ব্রাইডা মনে মনে বলল।

.

১৬.

জাদুকর ম্যাগাস গ্রামের এক প্রান্তে বাস করেন। গ্রামের বাইরের দিকে। ব্রাইডা লক্ষ করল, ম্যাগাসের বাড়ি উইক্কার বাড়ি থেকে অন্য রকম। বেশ আরামদায়ক আর খুব সুন্দরভাবে সাজানো। যাই হোক, কোনো বই দেখা যাচ্ছে না। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মাত্র কয়েকটা আসবাব আছে।

তারা চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে গেল। তারপর লিভিংরুমে ফিরে এলো।

তুমি আজ এখানে এসেছ কেন? ম্যাগাস জিজ্ঞাসা করলেন।

নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি এখানে আসব। অনেক কিছু জানার আছে আমার।

তুমি কী জেনেছ?

আমি খুব কমই জেনেছি। আমি জেনেছি, পথটা খুব সহজ-সরল আর আমি যেমনটি ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক কঠিন। কিন্তু আমি আমার আত্মাকে সরল করে নিয়েছি। যাই হোক, আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনি কেন আমার সাথে আপনার সময় নষ্ট করছেন?

কারণ তুমি আমার আত্মার সঙ্গী। ম্যাগাস ভাবলেন। কিন্তু বললেন, কারণ আমার কিছু কথা বলা দরকার।

 আমি যে পথটা বেছে নিয়েছি চাঁদের রীতিনীতি– সে ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন?

ম্যাগাস বুঝতে পারলেন সত্য কথাটা বলা দরকার, যদিও তিনি আশা করেন সত্যটা অন্য রকম হবে।

চাঁদের রীতিনীতিই তোমার পথ। উইক্কা মোটামুটি ঠিক। তুমি একজন ডাইনি। ঈশ্বর যা শিখিয়েছেন তা উঘাটন করতে তুমি সময়ের স্মৃতিকে কাজে লাগিয়েছ।

জাদুকর বিস্মিত, জীবনটা এ রকম কেন। কেন তিনি তার আত্মার সঙ্গীর দেখা পেলেন যে শুধু চাঁদের রীতিনীতিতে আছে।

আমার শুধু আরেকটা প্রশ্ন আছে। ব্রাইডা বলল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর একটু পরে এই লাইনে কোনো বাস পাওয়া যাবে না। আমার উত্তরটা জানা দরকার। আমি জানি উইক্কা আমাকে তা শেখায়নি। আমি তা জানি, কারণ উইক্কা আমার মতোই একজন মেয়েমানুষ। আমি জানি কীভাবে আমার আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পেতে হয়।

সে তোমার সামনেই আছে। ম্যাগাস ভাবলেন। কিন্তু তিনি তা কিছু বললেন না। তিনি রুমের এক কোনায় গিয়ে আলো নিভিয়ে দিলেন। শুধু অ্যাক্রেলিক ভাস্কর্যের ওখানে এক ধরনের আলো জ্বলে রইল। ব্রাইডা ভেতরে এসে ওটা লক্ষ করেনি। রুমের ভেতরে লাল-নীল আলোর তরল ও বুদ্বুদের আলো ভেসে আসছে।

আমাদের দুইবার সাক্ষাৎ হয়েছে। ম্যাগাস বললেন। তার চোখ ভাস্কর্যের দিকে নিবদ্ধ। আমার শুধু সূর্যের রীতিনীতির ব্যাপারে শিক্ষা দেয়ার অনুমতি আছে। সূর্যের রীতিনীতি লোকজনদের…

সূর্যের রীতিনীতির মাধ্যমে কীভাবে আমার আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পাব?

এই দুনিয়ায় সবাই তো তাই খুঁজে বেড়াচ্ছে। ম্যাগাস বললেন।

উইক্কার কথারই যেন আবার প্রতিধ্বনিত হলো। হতে পারে সতীর্থরা ব্রাইডা ভাবল।

সূর্যের রীতিনীতি এই জগতে অবস্থান করছে। যে কারণে প্রত্যেকেই দেখতে পায়, কোনো না কোনো আত্মার সঙ্গীর নিদর্শন। নির্দিষ্ট জ্যোর্তিময় চক্ষু।

আমি অনেক মানুষের চোখে বিভিন্ন রকমের আলো দেখেছি। ব্রাইডা বলল, উদাহরণ হিসেবে, আজকে আপনার চোখও জ্বলজ্বল করছে। প্রত্যেকে সেই জিনিসটারই খোঁজ করে।

ও ওর প্রার্থনার কথা ভুলে গেছে। ম্যাগাস ভাবলেন। ও ভাবছে ও অন্যদের থেকে আলাদা। ঈশ্বর তাকে কী দেখাতে চান তা ও বুঝতে পারে না।

আমি মানুষের চোখের দৃষ্টি বুঝতে পারি না। ব্রাইডা জোর দিয়ে বলল, তার চেয়ে আপনি বলুন, লোকজন কীভাবে চাঁদের রীতিনীতির মাধ্যমে তাদের আত্মার সঙ্গীকে আবিষ্কার করে।

ম্যাগাস ব্রাইডার দিকে ফিরলেন। তার চোখের দৃষ্টি শীতল ও অভিব্যক্তিহীন।

 আপনি বিষাদগ্রস্ত। ব্রাইডা বলল, আপনি বিষাদগ্রস্ত কারণ আমি খুব সাধারণ জিনিস শিখতে পারি না। আপনি বুঝতে পারেন না, মানুষ দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করে ভালোবাসা খুঁজে ফেরে। তারা বুঝতেও পারে না তারা আত্মার সঙ্গী খোঁজার স্বর্গীয় মিশনকেই পরিপূর্ণ করছে। আপনি ভুলে গেছেন। কারণ আপনি একজন জ্ঞানী মানুষ। সাধারণ মানুষ কেমন তা নিয়ে আপনি মাথা ঘামান না। আমি নিজের মধ্যে হাজার রকমের হতাশা লুকিয়ে রাখতে পারি। আমি জীবনের সাধারণ পাঠ থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারি।

ম্যাগাস তখনো চুপ করে রইলেন।

আলোর একটা নির্দিষ্ট রেখা ম্যাগাস বললেন, তোমার আত্মার সঙ্গীর বাম কাঁধের ওপর আলোর রেখা। চাঁদের রীতিনীতিতে তুমি অমনটিই দেখতে পাবে।

আমাকে যেতে হবে। ব্রাইডা বলল। আশা করছে তিনি তাকে থাকতে বলবেন। এখানে থাকতে তার ভাল লাগছে। তিনি তার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।

ম্যাগাস উঠে দাঁড়িয়ে ব্রাইডাকে দরজার দিকে এগিয়ে দিলেন।

আপনি যা কিছু জানেন আমি তা সব শিখতে যাচ্ছি। ব্রাইডা বলল, কীভাবে আলোক রশ্মি দেখতে হয় তা আবিষ্কার করতে যাচ্ছি।

ব্রাইডা নিচের সিঁড়ি পর্যন্ত যাওয়া অবধি ম্যাগাস অপেক্ষা করলেন। পরবর্তী আধা ঘণ্টার মধ্যে ডাবলিনের বাস আছে। তো মেয়েটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। তিনি বাগানে গিয়ে প্রতি রাতের মতো নিয়ম-কানুন পালন করলেন, যাতে তিনি অভ্যস্ত। কিন্তু মাঝে মাঝে তার মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়। আজ রাতে তিনি পুরোপুরি অমনোযোগী হয়ে পড়লেন।

উপাসনা শেষ হলে তিনি দরজার গোড়ায় বসে। আকাশ দেখতে লাগলেন। ব্রাইডার কথা ভাবছিলেন। তিনি তাকে বাসের মধ্যে দেখতে পারেন। মেয়েটির বাম কাঁধের ওপর আলোকরশ্মি আছে, কারণ তিনি মেয়েটার আত্মার সঙ্গী। একমাত্র তিনিই তা দেখতে পারেন। ভাবলেন, মেয়েটা জনের পর থেকেই কতটা আগ্রহ নিয়ে খোঁজার পরিসমাপ্তি ঘটাতে ব্যস্ত। ভাবলেন, তার বাড়িতে পৌঁছে মেয়েটা কতটা শীতলতা আর দূরত্ব বজায় রেখেছিল। এটা খুব ভালো লক্ষণ। যার মানে, মেয়েটা তার নিজের অনুভূতি নিয়ে বিভ্রান্ত। মেয়েটা বুঝতে পারছে না এমন একটা কিছু নিয়ে নিজের সাথে লড়ে যাচ্ছে।

তিনি বুঝতে পারলেন, মেয়েটা প্রেমে পড়েছে।

প্রত্যেকেই তাদের আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পায়, ব্রাইডা। তিনি বাগানের চারাগাছ পরিচর্যা করতে করতে জোরে জোরে বললেন। তার মনে হলো এত বছরের সাধনার পর তিনি নিজেও তা পেয়েছেন। এখন নিজের বিশ্বাসের ওপর জোর দেয়াটা সঙ্গত। তিনি আপন মনে বলে গেলেন।

 আমাদের জীবনের কোনো এক সময়ে, আমরা সবাই আমাদের আত্মার সঙ্গীর দেখা পাই। আমরা তাদের চিনতে পারি। আমি যদি জাদুকর না হতাম আর তোমার বাম কাঁধের ওপর আলোকবিন্দু দেখতে না পেতাম, তোমাকে গ্রহণ করতে আমার আরো কিছুটা সময় লাগত, কিন্তু তুমি আমার ব্যাপারে যুঝে চলেছ। একদিন আমি তোমার চোখে বিশেষ আলো দেখতে পাব। যাই হোক, ঘটনা হলো আমি জাদুকর আর এখন তোমার জন্য লড়াই করাটা আমার ওপর বর্তেছে। যাতে আমার সমস্ত জ্ঞানকে আমি প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত করতে পারি।

তিনি সে রাতে অনেকটা সময় চুপ করে বসে রইলেন। ব্রাইডার বাসে করে ডাবলিনে ফিরে যাওয়া নিয়ে ভাবতে লাগলেন। ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। খুব শিগগিরই গ্রীষ্ম শেষ হবে।

 ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নেই, যতক্ষণ না তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে। লোকজন ভালোবাসা খুঁজে মরে আর হাজার বছর ধরে ভালোবাসা খুঁজে ফেরে।

হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন, তার ধারণা হয়তো ভুল। ভালোবাসার ক্ষেত্রে সব সময় ঝুঁকি আছে, একটা ছোট্ট ঝুঁকি। একজন মানুষের জীবনে একজনের বেশি আত্মার সঙ্গীর সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে। যেমনটি আগেও ঘটেছে।

.

শীত আর বসন্ত

পরবর্তী দুই মাসে, উইক্কা ব্রাইডার কাছে ডাইনিবিদ্যার প্রথম রহস্য উন্মোচিত করল। তার মতে, মেয়েরা পুরুষের চেয়ে এসব জিনিস অনেক দ্রুত শিখতে পারে। কারণ প্রতি মাসে তারা নিজের শরীরে প্রকৃতির পরিপূর্ণ চক্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, মাসিকের মাধ্যমে। যেটা জন্ম, জীবন আর মৃত্যুর সমন্বয়ে গঠিত। মাসিককে চাঁদের চক্র নামেই ডাকা হয়।

ব্রাইডা একটা নতুন নোটবই কিনেছে। এতে তার প্রতিটি সাইটিক্যাল বা মনোস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা লিখে রাখছে। উইক্কার সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই এ কাজটি করছে সে। এর মলাটে পাঁচটি তারকা চিহ্ন, যা চাঁদের রীতিকে ধারণ করে। উইক্কা তাকে বলেছে, সব ডাইনিই এ রকম নোটবই নিজের কাছে রাখে। এ বইকে বলা হয় ছায়া বই বা বুক অব শ্যাভোস। এখন থেকে চারশ বছর আগে ডাইনি শিকারের সময় থেকে এ বই খুঁজে পাওয়া গেছে।

আমার কেন এসব করতে হবে?

আমাদের ঈশ্বরের শক্তিটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এটা ছাড়া তুমি শুধু ছোটখাটো রহস্য জানতে পারবে। ঐশ্বরিক শক্তি তোমাকে তোমার পদ্ধতিতে জগৎটাকে চিনতে শেখাবে।

ব্রাইডা তার ঘরের একটা অব্যবহৃত কোণে ছোট্ট একটা ব্যক্তিগত খুদে চার্চ গড়ে তুলল, যেখানে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি সারা দিন-রাত জ্বলে। মোমবাতিটা চাঁদের রীতি অনুসারে, চারটি জিনিসের প্রতীক, সলতে, প্যারাফিনের জল, জ্বলন্ত আগুন আর পুড়ে যাওয়া বাতাসের প্রতিনিধিত্ব করে। মোমবাতিটা তাকে এও মনে করিয়ে দেয়, সে একটা মিশনের মধ্যে আছে। মিশনটাকে সফল করতে হবে। শুধু মোমবাতিটাই দৃশ্যমান, বাকি সব কিছুই শেলফ অথবা ড্রয়ারে রাখা আছে। সেই মধ্যযুগ থেকে, চাঁদের রীতি অনুসারী ডাইনিরা তাদের সব কর্মকাণ্ডই পুরোপুরি গোপন রাখত। ওখানে এমন কিছু ভয়াবহ সংকেত ছিল, যার কারণে অন্ধকার যুগ আবার শতকের শেষে ফিরে আসতে পারত।

যখনই ব্রাইডা বাসায় ফেরে, মোমবাতির শিখা দেখতে পায়। তার মনের মধ্যে অদ্ভুত পবিত্র অনুভূতি হতে থাকে।

উইক্কা তাকে বলেছে, অবশ্যই জগতের শব্দের দিকে মনোযোগ দেবে।

তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তা শুনতে পারো। উইক্কা বলল, এই ধরনের গুঞ্জন কখনো শেষ হয় না। তাই তুমি পাহাড়ের চূড়ায়, শহরে, আকাশে অথবা সাগরের তলদেশে থাক না কেন। এই গুঞ্জন কতকটা কম্পনের মন্ত্রে জগতের আত্মারা এক রূপ থেকে আরেক রূপে রূপান্তরিত হয়। আলোর দিকে যাত্রা করে। যেকোনো ডাইনিকে এ ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কারণ সে নিজেই এই ভ্রমণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

উইক্কা আরো ব্যাখ্যা করল, প্রাচীনেরা আমাদের জগতের সাথে প্রতাঁকের মাধ্যমে কথা বলে। এমনকি যদি কেউ নাও শোনে, যদি প্রায় সব জায়গা থেকে সেই প্রতাঁকের ভাষা সবাই ভুলেও গিয়ে থাকে, প্রাচীনেরা কখনো কথা বন্ধ করে নেয় না।

তারা কি আমাদের মতো? একদিন ব্রাইডা জিজ্ঞাসা করেছিল।

আমরা তাদের মতো। হঠাৎ করে আমরা সব কিছু বুঝতে পারি যা আমাদের অতীত জীবনে শিখেছিলাম, জগতের যা কিছু লিখে রাখা হয়েছে। যিশুখ্রিস্ট বলেছেন, ঈশ্বরের জগৎ এ রকম যেন একজন মানুষ যদি ভূমিতে বীজ রোপণ করে দিন-রাত ঘুমিয়ে কাটায়, একদিন দেখতে পাবে বীজ অঙ্কুরোদাম হয়ে বড় হয়ে উঠছে। কীভাবে ঘটছে তা সে জানে না।

মানবজাতি সব সময় সেই অক্লান্ত ঝরনা থেকে পান করে। এমনকি যখন সবাই বলতে থাকে, এটাই শেষ দিন, তারপর তারা বেঁচে থাকার পথ খুঁজে বের করে। বানরেরা যখন মানুষকে গাছ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তখনো মানুষ বেঁচে ছিল। যখন গোটা পৃথিবী পানিতে ডুবে গেল, তখনো টিকে ছিল। সবাই শেষ বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতি নিলেও তখনো টিকে থাকবে।

আমরা এই জগতের দায়িত্বে আছি কারণ আমরাই এই জগৎ।

যত বেশি সময় সে উইক্কার সাথে কাটায়, ততই বুঝতে পারে, যত মেশে ততই সে বুঝতে পারে, উইক্কা চমৎকার একজন মানুষ। উইক্কা একজন ভালো মানুষ।

.

১৭.

উইক্কা ব্রাইডাকে চাঁদের রীতির ব্যাপারে শিক্ষা দিতে লাগল। সে ব্রাইডাকে খঞর খুঁজে নিতে বলল, যার ধার অগ্নিশিখার মতো। ব্রাইডা নানা রকম দোকানে চেষ্টা করল। কিন্তু এমন কিছু পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত, লরেন্স সমস্যার সমাধান করে দিল। সে তার ইউনিভার্সিটির একজন ধাতব রসায়নের প্রকৌশলীকে অমনটি তৈরি করে দিতে বলল। প্রকৌশলী ধারালো ছুরি তৈরি করে দিলে লরেন্স নিজে হাতে ছুরির হাতল বানিয়ে ব্রাইডাকে ছুরিটা উপহার দিল। লরেন্স বোঝাতে চাইল, ব্রাইডার প্রয়োজনকে সে কতটা সম্মান করে।

খঞ্ঝরটিকে উইক্কা নানারকম উপাসনা আর জাদুকরী শব্দের মাধ্যমে উপযুক্ত করে তুলল। এর ধাতব ফলায় চারকোল দিয়ে ছক আঁকল, যার কয়েকটা ছক হাতল পর্যন্ত পৌঁছে গেল। জিনিসটা তার হাতের একটা লম্বা সংস্করণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, তার শরীর থেকে ধাতব ফলার মাধ্যমে শক্তি প্রবাহিত হবে। রূপকথার গডমাদার একই উদ্দেশ্যে এ রকম ছুরি ব্যবহার করতেন। জাদুকররা ব্যবহার করতেন তলোয়ার।

ব্রাইডা চারকোল আর কাঠের চামচের ব্যাপারে প্রশ্ন প্রকাশ করলে, উইক্কা জানালো, ডাইনি শিকারের সময়টিকে ডাকিনীরা এমন জিনিস ব্যবহার করত। যা…দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস বলে মনে হয়। ড্যাগার, চারকোল আর কাঠের চামচের রীতি রয়ে গেছে। প্রাচীন প্রকৃত জিনিসগুলো পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।

 কীভাবে উপচার পুড়িয়ে, ম্যাজিক্যাল বৃত্তের মধ্যে ছুরিটাকে ব্যবহার করতে হয় ব্রাইডা শিখে ফেলল। চাঁদের কলা দশা পরিবর্তন করলে ব্রাইডা তার উপাসনা শুরু করল। জানালার গোবরাটে এক কাপ জল রেখে দিল যাতে চাঁদের আলো জলের ওপর প্রতিফলিত হয়। তারপর এমনভাবে দাঁড়াল, যাতে তার নিজের মুখ কাপের জলের ওপর পড়ে। সেখান থেকে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে তার ঠিক কপালের মাঝখানে প্রতিফলিত হয়। পুরোপুরি ফোকাসে চলে এলে সে কাপের ভেতরের জল ছুরি দিয়ে কেটে এলোমেলো করে দিল, যাতে প্রতিফলন ভেঙে ছোট ছোট টুকরোতে পরিণত হয়।

জলটা খুব তাড়াতাড়ি পান করতে হবে। তারপর চাঁদের শক্তি তার ভেতরে বাড়তে থাকবে।

 এসবের কোনো কিছুর কোনো মানে হয় না। ব্রাইডা একবার বলেছিল। উইক্কা সে কথা ধর্তব্যের মধ্যে ফেলল না। উইক্কা এক সময় এ রকম কথাই ভেবেছিল। কিন্তু তার মনে পড়ে যায় যিশুখ্রিস্টের কথা, কীভাবে জিনিসগুলো আমাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে তা আমরা কখনো জানতে পারি না।

এই উপাসনা কোনো অর্থ বহন করে কি করে না, তা কোনো ব্যাপার নয়। উইক্কা ব্রাইডাকে বলল, অন্ধকার রাত্রির কথা চিন্তা করো। তুমি যত বেশি এসব করবে, ততই প্রাচীনরা তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। তারা শুরুতে এ রকমভাবে করবে তুমি তা বুঝতে পারবে না। কারণ শুধু তোমার আত্মা শুনছে। কিন্তু একদিন সেই কণ্ঠস্বরটা তুমি শুনতে পাবে।

ব্রাইডা সেই কণ্ঠস্বর শুনতে চায় না। সে তার আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু সে উইক্কাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি।

অতীত থেকে ফিরে আসার ব্যাপারে ব্রাইডাকে পুরোপুরি নিষেধ করা হয়েছে। উইক্কার মতে, এর খুব একটা দরকার নেই।

ভবিষ্যৎ দেখার জন্য কার্ডগুলোকে আর ব্যবহার করো না। কার্ডগুলো শুধু কোনো কথাবার্তা ছাড়াই বেড়ে ওঠার জন্য ব্যবহার করা হয়। ও রকম বেড়ে ওঠা নিজের অগোচরেই ঘটে।

ব্রাইডা সপ্তাহে তিনবার কার্ডগুলোকে টেবিলের ওপর বিছিয়ে চুপ করে বসে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে দৃষ্টিসীমায় অন্য কিছু চলে আসে। কিন্তু সেগুলো সাধারণত দুর্বোধ্য। সে এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে, উইক্কা জানায়, দৃশ্যমানতার একটা অর্থ আছে। অর্থটা এতটাই গভীর যে, মাঝে মাঝে তা বোধগম্য নয়।

তাহলে কেন ভবিষ্যৎ দেখার জন্য কার্ডগুলোকে ব্যবহার করতে করব না?

 শুধু বর্তমানই আমাদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। উইক্কা উত্তর দিল, যখন তুমি কার্ডের ওপর ভবিষ্যৎ দেখতে, তুমি ভবিষ্যত্তাকে বর্তমানে টেনে আনবে। আর তা খুব ক্ষতিকর ব্যাপার হতে পারে। বর্তমান তোমার ভবিষ্যৎকে দ্বিধান্বিত করে দিতে পারে।

 সপ্তাহে একদিন তারা জঙ্গলে যায়। উইক্কা শিক্ষানবিশের মতো তাকে জঙ্গলের গুলুলতার ব্যাপারে শিক্ষা দেয়। উইক্কার মতে, জগতের সব কিছু ঈশ্বরের স্বাক্ষর বহন করে, বিশেষত গাছপালা। কিছু পাতা আছে, যেগুলো হৃৎপিণ্ডের সদৃশ, আর সেগুলো হৃদরোগের জন্য উপকারী। যেসব ফুল চোখের জন্য দৃষ্টিনন্দন সেগুলো চোখের অসুখ সারাতে সাহায্য করে। ব্রাইডা বুঝতে শুরু করল, অনেক গুল্মলতা সত্যি সত্যিই মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে সাদৃশ্য বহন করে। লরেন্সের ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি থেকে আনা ফোক মেডিসিনের বইটাতে সে গ্রাম্য লোকজনের গাছপালার ওপর বিশ্বাসের গবেষণা পেয়েছিল। আর ডাইনিরা এ ব্যাপারে ঠিক।

ঈশ্বর এই জগতে গাছপালা আর লতাপাতায় ফার্মেসি তৈরি করে রেখেছেন, উইক্কা বলল একদিন, তারা গাছের নিচে বসেছিল, যাতে সবাই ভালো স্বাস্থ্য উপভোগ করতে পারে।

 ব্রাইডা জানত তার শিক্ষকের আরো অনেক শিষ্য আছে। কিন্তু কখনো তাদের সাথে দেখা হয়নি। উইক্কার সাথে সাক্ষাতের সময় শেষ হলে কুকুরটা সব সময় ডেকে উঠত। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সে আরও অনেকবারই পাশ কাটিয়ে যেতো। একজন বৃদ্ধা মহিলা একজন তারই বয়সী এক তরুণী, অপরজন এক সুবেশী পুরুষ। ব্রাইডা নামতে নামতে দূর থেকেই শুনতে পেত, পায়ের শব্দ উইক্কার এপার্টমেন্টের ফ্লোরবোর্ডে গিয়ে শেষ হচ্ছে।

একদিন, অন্য কথা জানতে চাইল ব্রাইডা।

উইচক্রাফট বা ডাইনিবিদ্যা সম্মলিত শক্তির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। উইক্কা তাকে বলল, সমস্ত ভিন্ন রকম ঐশ্বরিক ক্ষমতা আমাদের কাজের শক্তিকে নির্দিষ্ট চলাচলে রাখে। প্রত্যেক ঐশ্বরিক উপহার অন্য সবার উপর নির্ভর করে।

উইক্কা বলল, নয়টা ঐশ্বরিক উপহার আছে। যার সবগুলোই সূর্যের আর চাঁদের রীতির ওপর ভিত্তি করে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকে।

কী সেই উপহারগুলো?

উইক্কা ব্রাইডাকে অলস বসে থেকে প্রশ্ন না করে এসব ব্যাপার খুঁজে নিতে বলল। একজন সত্যিকারের ডাইনির সব রকম আত্মিক ব্যাপারে আগ্রহ থাকা উচিত। ব্রাইডা জানালো সে অনেক বেশি সময় বাইবেল পড়ে ব্যয় করেছে। বাইবেলের মধ্যে প্রকৃত গুপ্ত প্রজ্ঞা রয়েছে। সেন্টপলের করিন্থিয়ানে ঐশ্বরিক উপহারগুলো খুঁজে বেড়িয়েছে সে, আর পেয়েও গেছে তার সবকটা। জ্ঞান, বিশ্বাস, উপশম, অলৌকিকবার্তা, শিক্ষকতা, আত্মা, কথা বলা এবং না বলা।

এরপরই ব্রাইডা বুঝতে পেরেছে কোন ঐশ্বরিক শক্তিটা সে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

উইক্কা ব্রাইডাকে নাচ শেখাল। বলল, ব্রাইডার জগতের শব্দ আর কম্পনের সাথে তাল রেখে শরীরটাকে নাড়াতে শিখতে হবে। কোনো বিশেষ কৌশল নেই। শুধু তার মাথায় যে চিন্তা আসে সেই অনুযায়ী শরীরটাকে নাড়াতে হবে। এ রকমভাবে নাচতে ব্রাইডার বেশ কিছুটা সময় লাগল।

জাদুকর ম্যাগাস তোমাকে অন্ধকারতম রাত্রি সমন্ধে শিক্ষা দিয়েছেন। দুই রীতিনীতিতে অন্ধকার রাত্রিই একমাত্র বেড়ে ওঠার উপায়। তুমি যখন জাদুবিদ্যার পথকে বিস্তৃত করবে, প্রথম যে জিনিসটা তোমাকে করতে হবে, বৃহৎ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ। এমন জিনিসের ওপর তোমার আস্থা রাখতে হবে, যা তুমি কখনো বুঝতে পারবে না।

 তুমি যে রকমটি আশা করে এসেছ সে রকম কোনো কিছুই যুক্তিবুদ্ধির পথে হবে না। তুমি শুধু তোমার হৃদয় দিয়ে জিনিসগুলো বুঝতে পারবে। আর ব্যাপারটা কিছুটা ভীতিকর। দীর্ঘসময় ধরে ভ্রমণটাকে অন্ধকার রাত্রির মত মনে হবে। তার পরও, যেকোনো খোঁজ বিশ্বাসের পথ ধরেই আসে।

কিন্তু ঈশ্বরকে বোঝা অন্ধকার রাত্রির চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। আমাদের বিশ্বাস হাত ধরে আমাদের রহস্যময়তার দিকে নিয়ে যায়।

উইক্কা জাদুকর ম্যাগাসের কথা কোনো রকম তিক্ততা ছাড়াই বলল।

ব্রাইডার ধারণা ভুল। উইক্কার সাথে জাদুকর ম্যাগাসের কখনো কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। উইক্কার চোখ দেখেই তা বোঝা যায়। সম্ভবত প্রথম দিন উইক্কার চোখে যে বিরক্তি ব্রাইডা দেখেছিল, তা ছিল দুজন আলাদা আলাদা পথ বেছে নিয়েছে এই কারণে। জাদুবিদ্যা আর ডাকিনীবিদ্যা দুটো আলাদা পথ। আর প্রত্যেকেই নিজেদের পথটাকে সর্বোত্তম প্রমাণ করতে চায়।

ব্রাইডা হঠাৎ বুঝতে পারল সে কী ভাবছে।

সে শুধু উইক্কার চোখ দেখেই বলে দিতে পারে উইক্কা ম্যাগাসের প্রেমে পড়েনি।

ব্রাইডা অনেক সিনেমা দেখেছে, অনেক বই পড়েছে, যাতে এসব ব্যাপারে লেখা আছে। কেউ যদি প্রেমে পড়ে তাহলে দুনিয়ার সবাই তাদের চোখ দেখে বলে দিতে পারে।

আমি খুব সাধারণ জিনিস বুঝতে শুরু করেছি, যা এক সময় আমার কাছে খুব জটিল বিষয় বলে মনে হতো।ব্রাইডা ভাবল।

সম্ভবত একদিন সে সূর্যের রীতি অনুসরণ করতে পারবে।

.

১৮.

এ বছর শীত দেরিতে শুরু হয়েছে। শীত কেবল জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে এমন সময় ব্রাইড উইক্কার কাছ থেকে একটা ফোন পেল।

আমরা দুই দিন পর জঙ্গলে দেখা করছি। অন্ধকার নামার আগে, নতুন চাঁদের রাতে। উইক্কা বলল।

ব্রাইডা এই দুই দিন সাক্ষাতের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে কাটাল। সে স্বাভাবিক উপাসনাগুলো রপ্ত করেছে। সঙ্গীতের সাথে আমি নাচতে পারব, এ মনোবল তার এসেছে। সে অদ্ভুত কম্পনের সাথে শরীর দোলাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এই অদ্ভুত কম্পনের রাতের নিস্তব্ধতায় সে ভালো শুনতে পায়। উইক্কা তাকে বলেছিল, জগতের শব্দের সাথে নাচতে শুরু করলে, আত্মা শরীরের সাথে আরো বেশি আরামদায়ক অবস্থানে চলে আসে। তাতে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তাও অনেক কমে আসে। ব্রাইডা প্রথম বারের মত লক্ষ্য করল লোজন কীভাবে ছন্দের তালে তালে নিজেদের দুই হাত নাড়িয়ে হাঁটে, তা তারা জানে না। জানে না তাদের কাধ অথবা পশ্চাদদেশ কীভাবে ছন্দের তালে দোলে। তার ইচ্ছা হয় তাদের ডেকে বলে, দুনিয়াটা একটা বাজনার মতো। যদি তারা সেই বাজনার সাথে একটু তাল মিলিয়ে নাচত, যদি দিনের মধ্যে একটুখানি সময় তাদের শরীরটাকে এলোমেলোভাবে দোলাত, আগের চেয়ে ভালো বোধ করত।

 যাই হোক, এই নাচের ছন্দ চাঁদের রীতির একটা অংশ। শুধু ডাইনিরাই তা জানে। সূর্যের রীতিনীতিতেও অবশ্যই ও রকম কিছু আছে। সব সময় অমন কিছু থাকে, যদিও কেউ তা শিখতে চায় না।

জগতের গোপনীয়তার সাথে বাস করার সামর্থ্য আমরা হারিয়েছি। ব্রাইডা লরেন্সকে বলল। তারা আমাদের সামনেই আছে। ওই সব গোপনীয়তা দেখার জন্যই শিখতে চাই ডাকিনীবিদ্যা :

 নির্দিষ্ট দিনে, ব্রাইডা জঙ্গলে যায়। গাছপালার মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকে। প্রকৃতির জাদুময়ী উপস্থিতি টের পায়। প্রায় পনেরো শ বছর আগে, ড্রইডদের জন্য এই জঙ্গল পবিত্রভূমি ছিল, যত দিন না সেইন্ট প্যাট্রিক আয়ারল্যান্ড থেকে সাপদের বিতাড়িত করেন। এরপর ড্রইডরা হতাশ হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও, এই জায়গার সম্মান দেখানোটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসতে থাকে। এমনকি এখনো গ্রামবাসী জায়গাটাকে ভয় পায়, সম্মান করে।

ব্রাইডা উইক্কাকে তৃণভূমিতে দেখতে পেল। আলখাল্লা জড়িয়ে বসে আছে। তার সাথে আরো চারজন নারী। তাদের গায়ে সাধারণ আলখাল্লা। এক সময় যে জায়গায় ছাই দেখেছিল আজ সেখানে আগুন জ্বলছে। ব্রাইডা আগুনের দিকে তাকালো। কোনো এক বিচিত্র কারণে সে ভীত হয়ে পড়ল এবং জানে না কী সে কারণ। তার ভেতরে এক লনিকে বহন করে চলেছে তার কারণে, নাকি সে জানে আগুন আরেকটা দেহধারণ, সে কারণে।

আরো চারজন নারী এলেন। কয়েকজন তার বয়সী, অন্যরা উইক্কার চেয়ে বয়সে বড়। সব মিলে ওরা নয়জন।

আজ আমি কোনো পুরুষকে আমন্ত্রণ জানাইনি। আমরা এখানে চাঁদের সাম্রাজ্যের জন্য অপেক্ষা করছি।

চাঁদের সাম্রাজ্য হলো রাত।

তারা আগুনের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। জগতের সবচেয় প্রাচীন বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগল। ব্রাইডার মনে হলো সে যেন কোনো চা পাটির্তে এসেছে। এখানে প্রচুর গালগল্প চলছে। যদিও এখানকার পরিবেশ ভিন্নতর।

যাই হোক, আকাশ তারাখচিত হয়ে উঠলে আবহাওয়া পুরোপুরি বদলে গেল। নীরবতার জন্য বলতে হল না, ধীরে ধীরে কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেল।

ব্রাইডা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল, যেখানে তারা আগুনকে ঘিরে ছিল, সেই তৃণভূমি এরই মাঝে অরণ্য হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ নীরবতার পরে উইক্কা কথা বলল।

এই রাতে, বছরে একবার, জগতের ডাইনিরা শিকারের জন্য একত্র হয়। তাদের উত্তরসূরিদের ঋণ শোধ করে। রীতিনীতি অনুসারে, বছরের দশম মাসে, আমরা আগুনের পাশে গোল হয়ে একত্র হই। যেখানে আমাদের সতীর্থরা জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়।

উইক্কা তার আলখাল্লার নিচ থেকে একটা কাঠের চামচ বের করল।

এখানেই সেই প্রতীক। সে বলল। সবাইকে চামচটা দেখাল।

মহিলারা কাঠপুত্তলির মতো দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর হাতে হাত দিয়ে উইক্কার প্রার্থনা শুনতে লাগল।

কুমারী মেরি মাতা আর তার সন্তান যিশুখ্রিস্টের নামে আজ রাতে আমরা নিজেদের উৎসর্গ করছি। আমাদের শরীরে আমাদের পূর্বসূরির আত্মার সঙ্গী ঘুমিয়ে আছে। কুমারী মেরি তাদের আশীর্বাদ করুন।

তিনি আমাদের আশীর্বাদ করবেন কারণ আমরা নারী। আমরা এমন জগতে বাস করি যেখানে পুরুষরা আমাদের বোঝে এবং অনেক বেশি ভালোবাসে। যদিও আমরা এখনো আমাদের শরীরে অতীত জীবনের চিহ্ন বহন করে চলি। সেই চিহ্ন এখনো আমাদের ব্যথিত করে।

কুমারী মেরি মাতা আমাদের সেই চিহ্ন থেকে মুক্ত করুন। আমাদের দোষ থেকে চিরজীবনের জন্য মুক্ত করে দিন। আমরা কাজে বেরিয়ে গেলে নিজেদের দোষী মনে করি, কারণ আমরা আমাদের সন্তানকে রেখে যাচ্ছি উপার্জন করে তাদের খাওয়াব বলে। আমরা বাড়িতে বসে থাকলে নিজেদের দোষী মনে করি, কারণ তাতে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে ভোগ করছি না। আমরা সব কিছুতেই নিজেদের দোষী ভাবি, কারণ আমাদের সব সময় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং শক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে।

কুমারী মেরি মাতা আমাদের সব সময় মনে রাখবেন আশা করি। কারণ যিশুখ্রিস্টের কাছ থেকে সব পুরুষ মানুষ চলে গেলেও মেয়েরাই ছিল। কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। যিশুখ্রিস্ট ক্রস বহন করার সময় সেই মেয়েটিই কেঁদেছিল। আর মৃত্যুর সময় যিশুর পায়ের কাছে অপেক্ষা করেছিল। সেই মেয়েটিই শূন্য কবরে যিশুকে দেখতে গিয়েছিল। সে কারণেই আমাদের দোষী অনুভব করার কোনো কারণ নেই।

কুমারী মেরি আমাদের সব সময় মনে রাখবেন কারণ আমরা আগুনে পুড়েছি, যন্ত্রণা সয়েছি কারণ আমরা ভালোবাসার ধর্ম পালন করেছি। অন্যরা যখন পাপের শক্তি নিয়ে সময়কে থামিয়ে দিতে চেয়েছে, আমরা একত্র হয়ে নিষিদ্ধ উৎসবকে ধরে রেখেছি, পালন করেছি, যা এখনো জগতের সবচেয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত হিসেবে আছে। কারণ আমরা পাবলিক স্কয়ারে দণ্ডিত ও অগ্নিদগ্ধ হয়েছি।

কুমারী মেরি আমাদের সব সময় মনে রাখবেন, যখন পুরুষরা পাবলিক স্কয়ারে জমি দখলের চেষ্টা করেছে আর নারীরা পাবলিক স্কয়ারকে ব্যভিচারমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছে।

কুমারী মেরি মাতা আমাদের সব সময় মনে রাখবেন আমাদের পূর্বসূরিদের কথা, যারা সেইন্ট জোয়ান অব আর্কের মতো– ঈশ্বরের বাণী পরিপূর্ণ করার জন্য নিজেকে পুরুষের ছদ্মবেশে ছিলেন। আর তাকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।

উইক্কা দুই হাতে কাঠের চামচ নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করল।

এখানে আমাদের পূর্বসূরিদের শহীদ হবার প্রতীক চিহ্ন রয়েছে। যে আগুন তাদের শরীরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে, তা সব সময় আমাদের আত্মাকে আলোকিত করবে। কারণ তারা আমাদের ভেতরে রয়েছে। কারণ আমরা তারাই।

তারপর উইক্কা আগুনের মধ্যে কাঠের চামচ দুটি ছুঁড়ে দিলেন।

.

ব্রাইডা উইক্কার শেখানো আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যেতে লাগল। সে সব সময় মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখত। জগতের শব্দের সাথে তাল রেখে নাচত। সে তার বুক অব শ্যাডোতে উইক্কার সাথে সাক্ষাতের কথা লিখে রাখতে লাগল। আর সপ্তাহে দুইবার পবিত্র গাছের কাছে যেতে লাগল। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল, এখন বৃক্ষ লতাগুলগুলোকে সে আগের চেয়ে অনেক কম বুঝতে পারছে।

যাই হোক, উইক্কা যে কণ্ঠস্বরকে জাগাতে চেয়েছিল তার দেখা এখনো পাওয়া যায়নি। এখনো সে কারো বাম কাঁধের ওপর আলোকবিন্দু দেখতে পায়নি।

 কে জানে, সম্ভবত এখনো আত্মার সঙ্গীর সাথে আমার দেখা হয়নি। সে ভাবতে লাগল। যারা চাঁদের রীতি জানে, তাদের এই ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়। তাদের জীবন সঙ্গীকে বেছে নিতে কখনো ভুল করা যায় না। যে মুহূর্ত থেকে তারা খাঁটি ডাইনি হয়ে যায়, তারা আর কখনো অন্য মানুষের মতো আগের সেই ভালোবাসার আবেশে জড়িত হতে পারে না। এর অর্থ তারা কম যন্ত্রণা ভোগ করে অথবা আদৌ কোনো যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না, কারণ তারা সব কিছুকে আগের চেয়ে গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে। নিজের আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পাওয়া প্রত্যেকের জীবনের স্বর্গীয় মিশন। খুঁজে পেলে তাকে ভালবাসার জন্যে যদি নিজ মনের ওপর জোর খাটাতে হয়, তবে উভয় রীতি অনুসারে, তুমি তা গর্বের সাথে করবে। মন স্মৃতিকাতর হতেই পারে।

তার মানে, যে মুহূর্ত থেকে তুমি সেই আলোকবিন্দু দেখতে পাবে, তখন থেকেই ভালোবাসার ক্ষেত্রে আর কোনো অন্ধকার রাত্রি থাকবে না।

 ব্রাইডা অনেক ভেবেছে, ভালোবাসার জন্য অনেক যন্ত্রণা ভোগ করেছে সে। যে রাতে সে একটা ফোন কলের জন্য অপেক্ষা করেছিল, তা আর আসেনি কখনও। সেই রোমান্টিক সপ্তাহান্তে পরবর্তী সপ্তাহে আর স্থায়ী ছিল না। পার্টিগুলোতে চারদিকে কে আছে উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ করত। দুঃখ আর একাকিত্ব তাকে ঘিরে ধরত, যখন নিশ্চিত হয়ে যেতে যে সবচেয়ে ভালো বন্ধুর বয়ফ্রেন্ডই একমাত্র মানুষ যে সুখী করতে পাবে। নিজস্ব জগতের সেই অংশটার মাধ্যমেই সে অন্যদের জানতে পেরেছে। এরই নাম ভালোবাসা। ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষ আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে নিতে শুরু করে। একজন মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে বিশেষ আলো খুঁজে নেয়ার অপেক্ষা মনে পড়ে। সে সব সময় কারো না কারোর জন্য যন্ত্রণা ভোগ করেছে। যার সাথে জীবনটাকে উপভোগ করা যেত তাকে খুঁজে পায়নি। এখন যেভাবেই হোক, এ ধরনের ভয় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করার সুযোগ এসেছে।

আমি কি সত্যিই সেই আলোকবিন্দু দেখতে পাব?

ব্রাইডা জাদুকর ম্যাগাসের কথা ভাবল। সে ভাবতে শুরু করল ম্যাগাসের কথাই ঠিক। একমাত্র সূর্যের রীতি ভালোবাসার ব্যাপারে কাজ করে। কিন্তু সে এখন মন পরিবর্তন করতে পারে না। সে পথটাকে অনুসরণ করতে জানে। তাকে শেষ পর্যন্ত তা অনুসরণ করতে হবে। সে জানত এখন পথ অনুসরণ ছেড়ে দিলে, তার জীবনের কোনো কিছুর জন্য পথ আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

এক সন্ধ্যায়, বৃদ্ধা ডাইনিদের বৃষ্টি তৈরি উপাসনা সমাপনের দীর্ঘ শিক্ষার পর ব্রাইডা তার বুক অব শ্যাডোস নোটবুকে আচার-অনুষ্ঠান লিখে রেখেছে। সম্ভবত কখনো তা ব্যবহৃত হবে না। উইক্কা জিজ্ঞাসা করল, ব্রাইডার মত পরিধেয় আছে তার সবগুলো সে ব্যবহার করছে কিনা।

 না, অবশ্যই করিনি। উত্তর এলো।

বেশ, এখন থেকে, তোমার ওয়ার্ডরোবে যা আছে তা পরে আসবে।

ব্রাইডা ভাবল, সম্ভবত সে বুঝতে ভুল করছে।

উইক্কা বলে গেল, যা কিছু আমাদের শক্তি দান করে তা নির্দিষ্ট গতিতে থাকে। যে সমস্ত কাপড় তুমি কিনেছ তা তোমারই অংশ। তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও সেগুলো তখন সে সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। কারণ তুমি সুখী ছিলে কিন্তু যখন আঘাত পেয়েছ, নিজেকে আরো ভালো করার চেষ্টা করেছ, ভেবেছিলে তোমার জীবনটাকে বদলে দেবে, তখন পোশাকগুলো তোমার সঙ্গী ছিল।

পোশাক সব সময় আবেগকে বস্তুতে রূপান্তরিত করে। দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। কিছু পোশাক, এমনকি ক্ষতিকরও হতে পারে, কারণ সেগুলো অন্য কারো জন্য তৈরি কিন্তু তোমার হাতে এসে পড়েছে।

ব্রাইডা জানে উইক্কা কী বোঝাতে চেয়েছে। কিছু পোশাক আছে, যেগুলো তার পরিধানের জন্য আনা হয়নি। কারণ যখনই সে পরতে যায়, খারাপ কিছু ঘটে।

 যে পোশাক তোমার জন্য নয়, তা থেকে বেরিয়ে এসো। উইক্কা বলে চলল, আর বাকিগুলো সব পরো। মাটিতে রূপান্তরিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তোমার সমস্ত আবেগকে চলনে বদলে দাও। গোটা জগৎ সব সময় প্রবহমান। আমাদের সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

বাড়িতে পৌঁছে ব্রাইডা তার ওয়ার্ডরোব থেকে সব কিছু টেনে বিছানার ওপর ফেলল। প্রতিটি পোশাক খুটিয়ে দেখতে লাগল। কয়েকটা পোশাকের কথা সে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল। কিছু পোশাক তাকে স্মৃতিমধুর সুখী মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু সেগুলোর চল চলে গেছে। ব্রাইডা তবুও কাপড়গুলোও রেখে দিল, কারণ সেগুলোর একটা বিশেষ আবেদন আছে। যখন সে পুরনো দিনগুলোর সুখ-স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইবে, তখন এগুলো আশ্রয় হিসেবে কাজ করবে হয়ত।

ব্রাইডা রেখে দেয়া পোশাকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, খারাপ কম্পন। সে সব সময় আশা করে এই খারাপ কম্পন হয়তো একদিন ভালো কম্পনে পরিণত হবে। তারপর সে আবার সেই পোশাকগুলো পরতে পারবে। যাই হোক, যখনই সেগুলো পরতে হবে সেগুলোর ফলাফল ভয়াবহ হবে।

ব্রাইডা বুঝতে পারল পোশাকের সাথে তার সম্পর্ক সে যেমনটি ভেবেছিল। তা আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিল। যদিও উইক্কার কথা সব সময় গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত পোশাক পরিধানের ওপর। কিছু পোশাক বিশেষ অনুষ্ঠানে পরে যেতে হবে। যখন সেগুলো পরা হবে তখনই তা বলতে পারবে। অন্যগুলো কাজের উপযুক্ত নয় হয়ত সপ্তাহান্তের জন্য উপযুক্ত। উইক্কা কেন এ ব্যাপারে এত আগ্রহী? উইক্কা তাকে যা করতে বলে তা নিয়ে সে কখনো প্রশ্ন করেনি। সে তার জীবন অদ্ভুত নেচে, মোমবাতি জ্বালিয়ে আর ছুরি দিয়ে পানি কেটে কাটাচ্ছে, আর এ রকম উপাসনা শিখছে, যা সে কখনো করতে পারবে না। সে এসব গ্রহণ করেছে, কারণ এগুলো রীতিনীতিরই অংশ। যে সব রীতিনীতি সে বুঝতে পারে না, সম্ভবত সে সব তার অপরিচিত সত্তাকে স্পর্শ করে যায়। তার পোশাকের ব্যাপারে আইন জারি করে উইক্কা অবশ্য তার জগতেও নাড়া দিয়ে গেছে।

উইক্কা তার অধিকারের অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে। এমন সব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে যা তার করা উচিৎ নয়।

ভেতরের জিনিসের চেয়ে বাইরের জিনিস পরিবর্তন করা কঠিন।

 কেউ একজন কিছু বলছিল। ব্রাইডা চারদিকে দেখল। জানত, খুঁজে পাবে না।

সেই কণ্ঠস্বর!

 এই কণ্ঠস্বরকে উইক্কা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল।

ব্রাইডা নিজের উত্তেজনা আর ভয়কে কোনোমতে সামাল দিল। চুপ করে রইল। আরো কিছু শোনার আশা করছে। কিন্তু আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। শুধু রাস্তার, টেলিভিশনের, জগতের চিরায়ত যত শব্দ শোনা গেল। সে আগের মতোই বসার চেষ্টা করল, ভাবতে চাইল, সব কিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে, এমনকি ভয় পেতে বা বিস্মিত বা গর্ববোধ করারও সময় পেল না সে।

কিন্তু কণ্ঠস্বর কিছু একটা বলছিল। যদি দুনিয়ার সবাই এসে তাকে প্রমাণের চেষ্টা করে যে এটা শুধু তার কল্পনা মাত্র, এমনকি যদি সেই ডাইনি শিকারিরা ফিরে এসে তাকে কোর্টে দাঁড় করায় এবং আগুনে পুড়িয়ে মারার ঝুঁকি থাকে, তাহলেও সে পুরোপুরি নিশ্চিত সে এ রকম কণ্ঠস্বর শুনেছে, যা তার নিজের নয়।

ভেতরের জিনিসের চেয়ে বাইরের জিনিস পরিবর্তন করা বেশি কঠিন। কণ্ঠস্বরটা সম্ভবত আরো বেশি কিছু বোঝাতে চেয়েছিল। হঠাৎ করে ব্রাইডার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সে লরেন্সকে ফোন করতে চাইল। ম্যাগাসকে দেখতে চাইল। উইক্কাকে বলতে চাইল, শেষ পর্যন্ত ঈশর প্রদত্ত দান তার কাছে উন্মোচিত হয়েছে। এখন থেকে সে চাঁদের রীতিনীতির অংশ হতে পারে।

ব্রাইডা রুমের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। কয়েকটা সিগারেট শেষ করল। ঘণ্টাখানেক পর শান্ত হয়ে বিছানায় বসল। চারদিকে তার পোশাকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

কণ্ঠস্বরটাই ঠিক। ব্রাইডার হৃদয় আত্মা একজন অদ্ভুত মহিলার দ্বারা আবর্তিত হয়ে আছে। যেভাবে সে পোশাক পরে তার চেয়ে আত্মাকে আত্মসমর্পণ করা অনেক সহজ।

 ব্রাইডা তখনই বুঝতে শুরু করল কীভাবে এই অর্থহীন কর্মকাণ্ড তার জীবনকে প্রভাবিত করেছে। নিজের জীবনের বাইরেরটুকু বদলে দিতে গিয়ে ভেতর কতটা বদলে গেছে।

.

১৯.

আবার দেখা হবার পর, উইক্কা কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে সব কিছু জানতে চাইল। ব্রাইডা বুক অব শ্যাডোসে সব লিখে রেখেছে, দেখে খুশি হলো।

ওটা কার কণ্ঠ ছিল? জানতে চাইল ব্রাইডা।

কিন্তু তার এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেয়ে উইক্কার যেন আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।

যাহোক, আমি তোমাকে তোমার আত্মা কয়েকবার দেহধারণ করার আগে যেখানে ঘুরেফিরে এসেছে সেটা দেখাচ্ছি। আমি সরাসরি কথা বলে জেনেছি তা। উপাসনা আর প্রতীক দিয়ে আত্মার মাধ্যমে আমাদের উত্তরসূরিদের জেনেছি। তুমি হয়তো এ ব্যাপারে একটু মুখ গোমড়া করে থাকতে পারো। কিন্তু তোমার আত্মা অনেক খুশি, তুমি যেসব কাজ করছ তাতে তুমি বিরক্ত হচ্ছে, এ রকম নাচে বিরক্ত বোধ করছ। আচার-অনুষ্ঠানের বদলে ঘুমিয়ে নিতে পারতে, তোমার অন্য অংশ তখন সময়ের জ্ঞান আহরন করতে পারত। তুমি আগে কী শিখেছিলে তা স্মরণ করতে পারতে। আর বাইবেলে যেমনটি বলা আছে, বীজগুলো বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, যদিও কীভাবে তুমি তা জানো না। তারপর নতুন জিনিস শেখার সেই মুহূর্তটি এলো, যেটাকে দীক্ষা বলে। কারণ তোমার যা শেখা দরকার তা সত্যিই তুমি শিখতে শুরু করবে। কণ্ঠস্বর এরই মধ্যে তোমাকে তা জানিয়ে দিয়েছে।

 ডাইনিদের ঐতিহ্যে, দীক্ষা সব সময় ইকুইনক্স সময়ের জায়গা দখল করে নেয়। বছরের দুটো বিশেষ দিনে, যখন দিন আর রাত সমান হয়ে যায়। পরবর্তী সময়টা বসন্তের সময়। মার্চের একুশ তারিখ। আমি সেদিনই তোমাকে দীক্ষিত করতে চাই, আমিও ওই সময়ে দীক্ষিত হয়েছিলাম। কীভাবে উপাসনার যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করতে হয় তুমি জানো। দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের মধ্যে সেতুবন্ধের সব রকম উপাসনাও তুমি জানো। তুমি যখন যেকোনো উপাসনা পালন করবে, তোমার আত্মা অতীতের আত্মা থেকে সব কিছু শিখে যাবে।

 তুমি কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেয়েছ। তার মানে তুমি অদৃশ্যমান জগতের সংঘটিত কোনো কিছু দৃশ্যমান জগতে নিয়ে এসেছ। অন্য কথায়, তুমি বুঝতে পেরেছ তোমার আত্মা পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য তৈরি হয়ে আছে। তুমি তোমার প্রথম বড় লক্ষ্য অর্জন করেছ।

 ব্রাইডার নিজস্ব চিন্তা অনুসারে, তার প্রকৃত আকাক্ষা হলো আত্মা নির্দেশক আলোকবিন্দু দেখা। কিন্তু সম্প্রতি সে ভালোবাসার খোঁজের ব্যাপারে অনেক বেশি চিন্তিত। এখন তার সেই আকাক্ষার প্রতি সপ্তাহান্তে বেড়ে যাচ্ছে আরও।

বসন্তের দীক্ষা গ্রহণের আগে তোমাকে একটা পরীক্ষায় অবশ্যই উত্তীর্ণ হতে হবে। তুমি অকৃতকার্য হলে, কোনো চিন্তা নেই, তোমার সামনে আরো ও রকম বিশেষ দিন আসবে। একদিন না একদিন তুমি দীক্ষিত হবে। এখন থেকে, তুমি শুধু তোমার পুরুষ অংশটা নিয়ে ভাববে। জ্ঞান। তুমি জানো কয়েকটা জিনিস তুমি বেশ ভালোই বুঝতে পারো। কিন্তু এখনো তোমার সেই নারীত্বের শক্তিকে স্পর্শ করেনি। রূপান্তরিত শক্তির অন্যতম অংশ। আর রূপান্তর ছাড়া জ্ঞান কখনোই প্রজ্ঞা হতে পারে না।

এই শক্তি সব সময় সাধারণভাবে ডাইনিদের মধ্যে অর্জিত থাকে। বিশেষত নারীদের মধ্যে। এই জগতের সবাই এই শক্তির ব্যাপারে জানে। নারীরা জানে, তারা এই গোপনীয়তার সবচেয়ে বড় অভিভাবক। কারণ এই শক্তির মাধ্যমে আমরা বিপজ্জনক হতে পারি। জগতের শত্রুতে পরিণত হতে পারি। কারণ আমরাই এই শক্তিতে জাগিয়ে তুলি। কারণ অনেক জায়গা আছে যেখানে এই শক্তিকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এই শক্তির সংস্পর্শে যেই আসে; সে অজ্ঞাতেই হোক, আজীবন তার বন্ধনে বাঁধা পড়ে। এই শক্তি তোমার প্রভু হতে পারে, হতে পারে তোমার দাস। তুমি একে জাদুকরী শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারো, অথবা এই শক্তি সমন্ধে অবগত না হয়েও একে তোমার জীবনে ব্যবহার করতে পারো। আমাদের চারদিকে যা কিছু আছে তা এই শক্তির অধীন। দৃশ্যমান জগতে তা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত, অদৃশ্যমান জগতে রহস্যময়। হত্যাকাণ্ড, সংঘর্ষ, গুম, অপহরণ। প্রতারণা-যে কোন কিছু হতে পারে। আমরা যেভাবেই চাই তা ব্যবহার করতে পারি। এ শক্তি বছরের পর বছর ধরে সুপ্ত থাকতে পারে, বা ভুলেও থাকা সম্ভব। কিন্তু একবার যে এ শক্তির অভিজ্ঞতা অর্জন করে সে আর কখনও তা ভুলতে পারে না।

কী সেই শক্তি?

 বোকার মতো প্রশ্ন করো না। উইক্কা বিরক্তস্বরে বলল, এই শক্তি সমন্ধে তুমি খুব ভালো করেই জানো।

হ্যাঁ, ব্রাইডা জানে।

সেক্স।

যৌনতা।

উইক্কা এক পাশে সাদা পর্দা টেনে দিয়ে ব্রাইডাকে দৃশ্যটা দেখাল। জানালা দিয়ে বাইরে নদী দেখা যায়। একটা পুরাতন ভবন, দূরে পাহাড়। জাদুকর ম্যাগাস ওখানে কোথাও বাস করেন।

ওটা কী? উইক্কা গির্জার একেবারে ওপরে আঙুল তুলে দেখাল।

 একটা ক্রস। ক্রিশ্চিয়ানিটির প্রতীক।

একজন রোমান কখনো ক্রস থাকা কোনো ভবনে প্রবেশ করে না। সে মনে করবে ওই বাড়িতে অত্যাচার করা হয়। কারণ মানুষের সৃষ্ট অত্যাচারের যন্ত্রপাতির মধ্যে ক্রস সবচেয়ে নিষ্ঠুরতার প্রতীক বহন করে। ক্রস হয়তো বদলে যায়নি। কিন্তু তার অর্থ বদলে গেছে। একইভাবে, মানবজাতি ঈশ্বরের কাছাকাছি হলে, স্বর্গীয় যোগাযোগের প্রতীক হিসেবে যৌনতা চিহ্নিত হয়ে থাকে, যাতে জীবনের অর্থ বহন করে।

মানুষ কেন যৌনতাকে দূরে সরিয়ে রেখে ঈশ্বরকে খোঁজ করে?

কথার মাঝে বাধা দেয়ায় উইক্কা বিরক্ত হলো। কিন্তু উত্তর দিল।

আমি যখন এই শক্তির কথা বলেছি, আমি শুধু যৌনক্রীড়ার কথা বলিনি। কেউ কেউ প্রকৃতপক্ষে যৌনক্রিয়া না করেই এই শক্তির ব্যবহার করে। তুমি কোন পথ বেছে নিচ্ছ তার ওপরই সব কিছু নির্ভর করে।

যৌনতার শক্তি সমন্ধে আমি জানি। ব্রাইডা বলল, আমি জানি কীভাবে একে ব্যবহার করতে হয়।

 তুমি হয়তো একজনের সাথে বিছানায় কীভাবে যৌনক্রিয়া করতে হয় তা জানো, কিন্তু তা জানা আর এই শক্তি সমন্ধে জানা এক কথা নয়। নারী-পুরুষ উভয়ই যৌনতার শক্তির ব্যাপারে অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে। কারণ যৌনক্রিয়ার সময় আনন্দ আর ভয় একইসাথে সমানভাবে উপস্থিত থাকে।

আনন্দ আর ভয় একই সাথে কীভাবে থাকে?

উইক্কার প্রশ্নটা পছন্দ হলো।

কারণ যারা যৌনতার সংস্পর্শে আসে তারা জানে এমন কারো সাথে যৌনতা করছে, যা শুধু নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেই ঘটে। আমরা যখন কারো সাথে বিছানায় যাই, আমরা আমাদের সঙ্গীকে সেই অনুমতি দিই, যাতে শুধু আমাদের শরীরটার সাথে সংযোগ স্থাপন না করে বরং গোটা ব্যাপারটার সাথে সংযোগ থাকে। জীবনের খাঁটি শক্তি একে অন্যের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ঘটে, আমাদের স্বাধীন করে। তখন আমরা কে তা লুকাতে পারি না।

আমাদের নিজেদের ইমেজ কেমন তা কোনো ব্যাপার নয়। আমরা কোনো ছদ্মবেশে থাকি, তাও কোনো ব্যাপার নয়। কেমন স্মার্ট উত্তর অথবা বিনয়ী অজুহাত খাড়া করতে পারি, তাও কোনো ব্যাপার নয়। যৌনক্রিয়ার সময়, অন্যকে প্রতারিত করা খুবই কঠিন ব্যাপার। কারণ তখন প্রতিটি মানুষ নিজে কী, তা প্রদর্শন করে।

উইক্কা এমনভাবে কথা বলছিল, যাতে মনে হয় সে এই শক্তি সমন্ধে খুব ভালোভাবেই জানে। তার চোখের তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কণ্ঠস্বরে গর্ব ফুটে উঠেছে। সম্ভবত তার এই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের পেছনে সেই শক্তির অবদান রয়েছে। উইক্কা তার শিক্ষক হওয়াতে ব্রাইডা হয়ত খুশি। উইক্কার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের রহস্য একদিন সে উদঘাটন করবে।

দীক্ষা নেয়ার আগে, তোমাকে এই শক্তির অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। সব কিছুই বিশাল একটা রহস্যের আঁধারে ঢাকা। দীক্ষার অনুষ্ঠানের পরে তোমাকে তা শিখতে হবে।

আমি কীভাবে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করব?

খুব সহজ ফর্মুলা। সব সাধারণ জিনিসের মতো। আমি তোমাকে যত জটিল উপাসনা শিখিয়েছি, এর ফলাফলটা তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।

উইক্কা ব্রাইডার কাছে এলো। তার কাধ ধরে চোখের দিকে তাকালো।

ফমুর্লা এটাই। তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার করো। যদি অর্গাজম বা চরম তৃপ্তির মুহূর্তে সব ইন্দ্রিয় একসাথে কাজ করতে শুরু করে, তাহলে তুমি দীক্ষা গ্রহণের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হবে।

.

২০.

আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।ব্রাইডা বলল।

প্রথমে যেখানে দেখা হয়েছিল সেখানেই এসেছে ওরা। ডান হাতের দিকে পাহাড়ের পাশে পাথুরে জায়গা। ওখান থেকে নিচে উপত্যকা দেখা যায়।

মাঝে মাঝে আমি ভাবি এক আর করি আরেক, ব্রাইডা বলল, কিন্তু আপনি যদি কখনো প্রেমে পড়েন, তাহলে জানতে পারবেন ভালোবাসার জন্য যন্ত্রণা ভোগ করা কতটা যন্ত্রণাদায়ক।

হ্যাঁ, আমি জানি। জাদুকর ম্যাগাস উত্তর দিলেন। এই প্রথমবার তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো মন্তব্য করলেন।

 আলোকবিন্দুর ব্যাপারে আপনার কথাই ঠিক। ব্যাপারটা সত্যিই অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন আমি বুঝতে পেরেছি কোনো কিছু খুঁজে পাওয়ার মতোই কোনো কিছুর খোঁজ করাও খুব মজার ব্যাপার।

যতক্ষণ তুমি তোমার ভয়কে জয় করতে পারছ।

তা সত্যি।

ব্রাইডা জেনে বেশ খুশি হলো, এমনকি জাদুকরও তার এত সব জ্ঞানগরিমা সত্ত্বেও এখনো ভয় অনুভব করেন।

তারা পুরো বিকেল তুষার আবৃত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াল।

তারা গাছপালা নিয়ে কথা বলল, কথা বলল ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে। এমনকি মাকড়সা কীভাবে জাল বোনে তা নিয়েও, এক সময় তাদের দেখা হল ভেড়ার পাল নিয়ে ঘরে ফেরা এক রাখালের সাথে।

হেই, সান্তিয়াগো! জাদুকর ম্যাগাস চেঁচিয়ে উঠলেন। তারপর ব্রাইডার দিকে ফিরলেন।

 ঈশ্বর রাখালদের মধ্যে বিশেষ ধরনের আবেগ দিয়েছেন। তারা প্রকৃতি, নীরবতা আর ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। জগতের জন্য দরকারি সব রকমের গুণ তারা অর্জন করেছে।

তারা তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করল না। ব্রাইডা ওই মুহূর্তে ওদের কথোপকথনে অংশ নিতে চাইল না। সে তার জীবনে আর জগতে কী ঘটছে তাই নিয়ে নিজের সাথে কথা বলতে লাগল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, লরেন্সের নাম উল্লেখ না করাই ভালো। সে জানে না কী ঘটে চলেছে। জাদুকর ম্যাগাস কেন আজ এত মনোযোগী তাও জানে না। কিন্তু তাকে আলোটা জ্বালিয়ে রাখতে হবে। উইক্কা একে অর্জিত শক্তি বলে। তার নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য আছে, আর সে কারণে তাকে অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

তারা কয়েকটা ভেড়ার পাশ দিয়ে গেল। ভেড়ার পাল তুষারের বুকে অদ্ভুত পদচিহ্ন একে একে যাচ্ছে। এবারে কোনো রাখাল নেই, কিন্তু ভেড়াগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে কোথায় যেতে হবে ওগুলো তা জানে। জাদুকর ম্যাগাস দীর্ঘসময় ধরে ভেড়াগুলোকে দেখলেন। এমনভাবে ভেড়াগুলোকে দেখতে লাগলেন যেন তিনি সূর্যের রীতিনীতির গোপনীয়তা জেনে গেছেন। ব্যাপারটা ব্রাইডা বুঝতে পারছে না।

দিনের আলো কমে আসতে শুরু করেছে। ভয় এবং সম্ভ্রমে ব্রাইডা আনত হয়ে আছে। জাদুকর ম্যাগাসের সাথে থাকলে সব সময় এ রকম অনুভূতি হয়। এই প্রথমবার ম্যাগাসের সংস্পর্শে এসে তার ভেতরটা শান্ত হয়ে গেছে, আত্মবিশ্বাস কাজ করছে। সম্ভবত তার ঐশ্বরিক শক্তি প্রদর্শন করার দরকার নেই। সে ওই কণ্ঠস্বরটা শুনেছে। অন্য পুরুষ আর নারীদের অদৃশ্য জগতে তার ঢুকে পড়াটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। যে মুহূর্ত থেকে সে ওই কণ্ঠস্বর শুনেছে, সেই রহস্যময় পথের সন্ধান পেয়েছে, তার পাশের এই মানুষটি তার জগতের একটা অংশ হয়ে গেছে।

ব্রাইডার মনে হলো, সে ম্যাগাসের হাত ধরে আছে। সূর্যের রীতিনীতির কিছু ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করে সে, যেভাবে লরেন্সকে প্রাচীন তারকারাজি সমন্ধে জিজ্ঞাসা করত। তারা পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একই জিনিস দেখছে; অভিজ্ঞতাটুকু বের করে আনার জন্য প্রশ্নটা মোক্ষম উপায়।

 কেউ একজন ব্রাইডাকে বলল, ম্যাগাসের তাই দরকার। চাঁদের রীতিনীতির সেই রহস্যময় কণ্ঠস্বর নয়। কিন্তু তার বোকা হৃদয়ের কথা। এই কণ্ঠস্বরের তাগিদ সে প্রায় শোনেই না। তার হৃদয় তাকে এমন পথে নিতে চায়, যা সে বুঝতে পারে না।

কিন্তু আবেগ বুনো ঘোড়ার মতো। কিছুই মানতে চায় না। আবেগের বুনো ঘোড়া ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্তসেগুলোকে মুক্ত করে দিতে চাইল ব্রাইডা। আবেগ তাকে জানিয়ে দিল, এই সন্ধ্যাটা ম্যাগাসের সাথে প্রেম করে কাটালে কতই না ভালো হবে। কারণ তুমি প্রেমে পড়লে, যেসব জিনিস শেখার কথা ভাবতেও পারতে না, তা শিখতে পারবে। ভালোবাসাই সমস্ত রহস্যময় জিনিসের চাবি।

 ব্রাইডা শেষ পর্যন্ত নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনল। ম্যাগাসের ব্যাপারে তার বেশ কিছু চিন্তাভাবনা ছিল। নিজেকে বলল, সে কখনো এ রকম একজন মানুষকে ভালোবাসতে পারে না, কারণ তিনি জগৎকে বুঝতে পারেন। দূর থেকে তাকে দেখলে সমস্ত মানবিক আবেগ অনেক ছোট দেখায়।

তারা দুজন ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন মনাস্টিক গির্জার কাছে গেল। ম্যাগাস ধ্বংসপ্রাপ্ত পাথরের ওপরে বসে পড়লেন। ব্রাইডা জানালার গোবরাট থেকে বরফ সরিয়ে দিল।

এখানে থাকাটা বেশ মজার ব্যাপার, সারা দিন জঙ্গলে কাটিয়ে এ রকম উষ্ণ ঘরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়া! ব্রাইডা বলল।

হ্যাঁ, ভালোই হবে। আমি অনেক পাখির গান জানি। ঈশ্বরের চিহ্ন পড়তে পারি। সূর্য ও চাঁদের রীতিনীতিও শিখেছি।

কিন্তু আমি একা, জাদুকর যোগ করলেন। আর একাকী গোটা জগতের কোনো উপহার উপভোগ করা যায় না।

জাদুকর ম্যাগাস জানালার গোবরাটের দিকে তাকালেন। তিনি ব্রাইডার কাঁধের ওপর আলোকবিন্দু দেখতে। নিজে উভয় রীতিনীতির ব্যাপারে শিখেছেন বলে তার দুঃখবোধ হলো। কারণ ওই আলোকবিন্দুর কারণে তিনি হয়তো মেয়েটির প্রেমে পড়তে পারেন না।

মেয়েটি বুদ্ধিমতী। বিপদটা আগেভাগেই বুঝতে পারে। এখন আলোকবিন্দু ছাড়া আর বেশি কিছু জানতে চায় না। তিনি ভাবলেন।

আমি কণ্ঠস্বরটা শুনেছি। উইক্কা দারুণ শিক্ষক!

এই প্রথমবার সেই সন্ধ্যায় ব্রাইডা জাদুবিদ্যা নিয়ে কথা বলল।

কণ্ঠস্বরটা তোমাকে জগতের রহস্যময়তা শেখাবে, যে রহস্যময়তা সময়ের সাথে বন্দি হয়ে থাকে। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ডাকিনীরা বহন করে নিয়ে আসে।

ব্রাইডা কী বলছে তা না শুনেই তিনি কথা বলতে লাগলেন। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন, কখন প্রথম তার আত্মার সঙ্গীর সাথে দেখা হয়েছিল। নিঃসঙ্গ মানুষ সময়ের হিসাব ভুলে যায়। তাদের কাছে ঘণ্টাগুলো দীর্ঘ আর দিনগুলো অসহ্য। এমনকি তিনি জানেন, তাদের মাত্র দুইবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। ব্রাইডা খুব দ্রুত শিখছে।

আমি উপাসনার রীতিনীতি জানি। আমি বসন্তের সময়ে মহৎ রহস্যময়তার দীক্ষা নিতে যাচ্ছি।

ব্রাইডা আবার চিন্তিত হতে শুরু করল।

আরেকটা জিনিস আছে, যার অভিজ্ঞতা এখনো আমার হয়নি। যে শক্তির কথা সবাই জানে, তাকে রহস্য দিয়ে ঘিরে রাখে।

জাদুকর ম্যাগাস বুঝতে পারলেন কেন মেয়েটা এই সন্ধ্যায় এখানে এসেছে। গাছপালার মাঝখান দিয়ে শুধু হেঁটে যাওয়ায় তার উদ্দেশ্য নয়।

ব্রাইডা জ্যাকেটের কলার তুলে ঠাণ্ডা লাগা ঠেকাল। হাঁটা থামানোর কারণে আগের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা লাগছে। আবার তার নার্ভাসনেসের কারণেও হতে পারে। সে নিশ্চিত নয়।

পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কীভাবে যৌনতার শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হয় আমি তা শিখতে চাই। ব্রাইডা শেষ পর্যন্ত বলল, উইক্কা এবারে কিছু বলেনি। সে বলেছে আমি যেভাবে কণ্ঠস্বরটা খুঁজে পেয়েছি, সেভাবেই এটাকে আবিষ্কার করতে পারব।

তারা আরো কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল। ব্রাইডা ভাবল, এর চেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত চার্চ নিয়ে কথা বলাই ভালো ছিল। কিন্তু তারপর তার মনে পড়ে গেল, শক্তিকে ব্যবহার করার অনেক পদ্ধতি আছে। এখানে যে পুরোহিত ব্ৰহ্মাচার্য নিয়ে বাস করে সে হয়তো, সে কী বোঝাতে চেয়েছে তা বুঝতে পারবে।

আমি সব রকম চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় ওখানে কোনো একটা কৌশল আছে। যেভাবে ট্যারট কার্ডের ক্ষেত্রে ফোনে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা হয়েছিল। আমার মনে হয় ব্যাপারটা এ রকম, যা উইক্কা আমাকে শেখাতে চায়নি। হয়ত উইক্কার নিজের তা শিখতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আর চাইছে, আমিও যেন সে রকম কঠোরতার মুখোমুখি হই।

সে কারণেই তুমি আমার খোঁজ করতে এসেছিলে?

ব্রাইডা ম্যাগাসের দিকে গাঢ় চোখে তাকালো।

হ্যাঁ।

ব্রাইডা চায় তার উত্তর ম্যাগাসকে প্রভাবিত করুক। কিন্তু সে কোনো কিছুর ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। তারা তুষার আবৃত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল। বরফের ওপর সূর্যের শেষ আলো, সাধারণ বিষয়ে সহজ কথাবার্তা, ব্রাইডার আবেগকে বুনো ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে নিতে থাকে। সে নিজেকে খুঁজে পেয়ে বুঝতে পারে ওখানে শুধু একটা কারণেই এসেছে, তার উদ্দেশ্যকে কীভাবে পরিণতিতে রূপ দেয়া যায়। কারণ ঈশ্বর পুরুষে রূপান্তরিত হওয়ার আগে নারীরূপে ছিলেন।

ম্যাগাস পাথরের ওপর থেকে উঠে দাঁড়ালেন। খাড়া হয়ে থাকা দেয়ালের দিকে হাঁটতে লাগলেন। মাঝামাঝি একটা দরজা। তিনি তার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। সূর্যাস্তের শেষ আলো এর পেছন দিকটাকে আলোকিত করে রেখেছে। ব্রাইডা ম্যাগাসের মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

একটা জিনিস তোমাকে শিক্ষা দেয়নি উইক্কা। ম্যাগাস বললেন, ও সম্ভবত, শেখাতে ভুলে গেছে। অথবা ও চেয়েছে, তুমি হয়তো একাই তা বের করতে পারবে।

বেশ, আমি তো একাই এসেছি এখানে।

ব্রাইডা নিজেকে প্রশ্ন করল, সম্ভবত এটা তার শিক্ষকের পরিকল্পনা, তাদের দুজনকে এক করে দেয়া।

আমি তোমাকে শেখাতে যাচ্ছি, তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন। আমার সাথে এসো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *