২.০১ আসিরগড়

দ্বিতীয় পর্ব – গৃহহীন আর নির্বান্ধব

২.১ আসিরগড়

সমতলের উপর দিয়ে একটা কালো ঘোড়ায় নিঃসঙ্গ এক অশ্বারোহী পুতগতিতে ছুটে যায়, শেষ অপরাহ্নের নিস্তরঙ্গ বাতাসে লাল ধূলো একটা ভারি আচ্ছাদনের মত তার পেছনে ঝুলতে থাকে। অশ্বারোহী যখন পর্বতশীর্ষের পাদদেশের দিকে এগিয়ে আসে যার উপরে আসিরগড় দূর্গ দাঁড়িয়ে রয়েছে, খুররম দূর্গের বেলেপাথরের প্রাকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে দেখে অশ্বারোহী দূর্গের দিকে খাড়াভাবে এঁকেবেঁকে উঠে আসা পথ দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করার সময় ঘোড়ার বেগ সামান্যই হ্রাস করে। লোকটা আরেকটু কাছে আসতে খুররম লক্ষ্য করে যে এই দাবদাহের ভিতরেও সে ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণ এবং গায়ে ধাতব-কীলকযুক্ত চামড়ার আঁটসাট বহির্বাস পরিহিত রয়েছে। আমরা কি গুলি করে তাকে ফেলে দেব? কামরান ইকবাল, যে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

 ‘নাহ্। একজন নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। দেখাই যাক কি তার অভিপ্রায়, খুররম, অশ্বারোহীর উপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে, উত্তর দেয় যে দূর্গের ঠিক নিচে অবস্থিত একখণ্ড সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছেছে এবং নিজের হাপরেরমত হাপাতে থাকা বাহনকে আরো একবার পুতগতিতে ছোটার জন্য তাড়া দিচ্ছে। দূর্গের তোরণগৃহ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে থাকার সময় সে তার ঘোড়ার পর্যাণে ঝুলতে থাকা একটা থলে তুলে নেয়, এবং ঘোড়াটাকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে আচমকা এমনভাবে দাঁড় করায় যে জন্তুটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, থলেটা মাথার উপরে ঘোরায় এবং গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দূর্গের লম্বা কীলকযুক্ত দরজার দিকে সেটা ছুঁড়ে দেয়। বিশ্বাসঘাতক খুররমের জন্য উপহার, তাঁর আত্মার যেন নরকে ঠাই হয়, সে চিৎকার করে বলে, তারপরে সে তার ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং ফিরতি পথে নিচের দিকে ছুটতে শুরু করে, সে তার বাহনের গলার কাছে নিচু হয়ে ঝুঁকে থাকে এবং সামান্য আঁকাবাঁকাভাবে যায় যেন দূর্গের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকা সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়বে বলে সে প্রত্যাশা করছে।

অশ্বারোহী দ্রুত নিচের সমভূমির দিকে নামতে শুরু করলে খুররম চোখ কুঁচকে চারপাশের রুক্ষ ভূপ্রকৃতি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে, মনে মনে ভাবে আসিরগড়ের তোরণদ্বারে লোকটার ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোড়া দাবড়ে আসা কি কোনো সম্ভাব্য আক্রমণের ইঙ্গিতবহ। কিন্তু আকাশের অনেক উঁচুতে বাতাসের স্রোতে ডানা ভাসিয়ে ভেসে থাকা কয়েকটা মরাখেকো শকুন ছাড়া আশেপাশে কোনো জীবন্ত প্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। থলিটা নিয়ে আসবার জন্য তোক পাঠাও,’ সে মুখ থেকে ঘাম মুছে আদেশ দেয়। জুন মাস মাত্র শুরু হয়েছে এবং প্রতিদিনই দাবদাহের আক্রমণ প্রবলতর হচ্ছে এবং বাতাস গুমোট আর অসহনীয় হয়ে উঠছে। সে কিছুক্ষণের ভিতরেই তোরণগৃহ থেকে ধাতব চক্রের পরস্পরকে সজোরে ঘর্ষণের শব্দ শুনতে পায় যার সাথে সাথে কাঠের প্রবেশ তোরণ রক্ষাকারী লোহার বেষ্টনী কম্পিত ভঙ্গিতে উপরে উঠতে শুরু করায় শিকলের ঝনঝন শব্দ ভেসে আসে। তারপরে তোরণের ডানপাশে অবস্থিত একটা ছোট দরজা-খুব বেশি হলে চারফিট উঁচুভেতরের দিকে খুলে যায়। দীর্ঘদেহী, কৃশকায় এক তরুণ, তাঁর মাথার সোনালী রঙের চুল সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করে, দরজার নিচে দিয়ে ঝুঁকে বাইরে বের হয়ে আসে এবং ছুঁড়ে দেয়া থলিটা যেখানে একটা কাঁটা ঝোঁপের পাশে পড়ে রয়েছে সেদিকে দৌড়ে যায়। নিকোলাস পুটলিটা তোলার জন্য উবু হতে, খুররম ভাবে, টমাস রো ঠিকই বলেছিল। তরুণ ইংরেজ গত কয়েক মাসে নিজেকে একজন বিশ্বস্ত আর কুশলী কর্চি হিসাবে প্রমাণ করেছে। আগ্রা থেকে পলায়নের নাটকীয়তার মাঝে এই ইংরেজ তরুণকে তার অধীনে চাকরি দেয়ার ব্যাপারে রো’র অনুরোধের বিষয়টা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। নিকোলাস অবশ্য ভুলে যায়নি। সুরাটের বন্দর থেকে ইংল্যান্ডগামী একটা জাহাজে তাঁর মনিবকে তুলে দিয়ে সে এখানে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির উত্তরপ্রান্তে আসিরগড়ে পথ চিনে নিয়ে হাজির হয়েছে।

 খুররম লক্ষ্য করে নিকোলাস সহসা গুটিয়ে যায় এবং আরেকটু হলেই তাঁর হাত থেকে থলিটা মাটিতে পড়ে যেত। নিজেকে সামলে নিয়ে, সে থলিটা এবার দু’হাতে আঁকড়ে ধরে এবং দেহের কাছ থেকে যতটা দূরে সম্ভব ধরে রেখে সতর্কতার সাথে সেটা বয়ে নিয়ে ঢালু পথ দিয়ে উপরের দিকে উঠতে আরম্ভ করে এবং দূর্গের ভেতরে প্রবেশ করে। অশ্বারোহী কি ছুঁড়ে ফেলে গেছে জানবার কৌতূহলে খুররম দ্রুত পাথরের খাড়া সিঁড়ি দিয়ে নিচের প্রধান আঙিনায় নেমে আসে। নিকোলাসের চারপাশে একদল সৈন্য জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং চটের দাগযুক্ত থলিটা তার পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। খুররম সামনের দিকে এগিয়ে যেতে, তাঁর নাকে বিবমিষাকর একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসে। থলির বাঁধন খুলো, সে নিকোলাসকে আদেশ দেয়। দ্রুত।

নিকোলাস কোমর থেকে নিজের খঞ্জরটা বের করে এক পোঁচে থলির মুখ আটকে রাখা মোটা দড়ি কেটে দেয় এবং তারপরে সেটাকে একপাশে কাত করে দেয়। থলির ভেতর থেকে পচনক্রিয়া শুরু হওয়া একটা কালচে বস্তু গড়িয়ে বের হয়ে আসে। খুররম কিছুক্ষণের জন্য বস্তুটাকে পচা তরমুজ মনে করে যতক্ষণ না সে নাকে বমি উদ্রেককারী মৃত্যুর মিষ্টি দুর্গন্ধ পুরোপুরি পায়। জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের একজন, হালকা পাতলা এক তরুণ, ঘুরে দাঁড়ায় এবং মুখ বিকৃত করে বমনার্থে ওআক তুলে এবং খুররমও যখন বুঝতে পারে সে চোখের সামনে কি দেখছে সে তার গলায় পিত্তের স্বাদ অনুভব করে।

সে, উবু হয়ে বসে, নিজেকে জোর করে বাধ্য করে পচে ফুলে উঠা বস্তুটা পরীক্ষা করে দেখতে যা এক সময় তার বিশ্বস্ত গুপ্তদূতদের একজন, জামাল খানের কাঁধের উপরে শোভা পেত। সে কয়েক সপ্তাহ আগে মানজুর শাসনকর্তার কাছে জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিরোধে শাসনকর্তার সমর্থন কামনা করে একটা বার্তা দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিল। গুপ্তদূতেরা বাম চোখ তুলে ফেলা হয়েছে এবং একজোড়া শূককীট রক্তাক্ত অক্ষিকোটরে মোচড় দিচ্ছে। হাঁ করে থাকা মুখের ভিতর ভাঙা দাঁত, পূজ জমা মাড়ি আর বেঢপ ফুলে বেগুনী হয়ে উঠা ঠোঁটের মাঝে বের হয়ে থাকা একটা কাগজের টুকরোয় কামরান নিজের সীলমোহর সনাক্ত করতে পারে। এটা মানডুর শাসনকর্তার কাছে তাঁর প্রেরিত চিঠিটা ছাড়া আর অন্য কিছু না।

‘যুবরাজ, থলির ভিতরে আরো কিছু একটা রয়েছে, সে নিকোলাসকে বলতে শুনে। সে নিজের পায়ে ভর দিয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে কর্চির ধরে থাকা চামড়ার ছোট থলেটা নেয়, এবং সেটা খুলতে প্রাণপনে ঢোক গিয়ে পাকস্থলী থেকে উঠে আসা বমি দমন করে সে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। বিশ্বাসঘাতক খুররমকে সম্বোধন করে ভেতর একটা চিঠি রয়েছে।

 সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমি একজন অনুগত কর্মচারী। আমি তোমার বার্তাবাহকের সাথে যেমন আচরণ করা উচিত ছিল তাই করেছি। তাঁর মৃত্যু মোটেই দ্রুত হয়নি কিন্তু তোমার মত একজন প্রভুর অধীনস্ত কোনো কর্মচারী সহানুভূতি আশা করতে পারে না। সে শেষ সময়ে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে যা জানে সবকিছু সে স্বীকার করে গেছে–তোমার সাথে কতজন সৈন্য রয়েছে, কতগুলো কামান আছে, ষড়যন্ত্রের অনুরোধ নিয়ে এবং যাঁদের কাছে তুমি বার্তা প্রেরণ করেছে সেইসব বার্তাবাহকদের নাম। তুমি এই বার্তা যখন পাঠ করছে তখন আমি মোগল রাজদরবারে পৌঁছে যাব তোমার রাজবৈরী প্রস্তাবের বিষয়ে তোমার আব্বাজান, মহামান্য সম্রাটকে অবগত করতে।

বার্তাটার নিচে আলী খান, মানডুর শাসনকর্তা, স্বাক্ষর রয়েছে।

 ‘বার্তাটায় কিছু নেই, বাহাদুরি আর ধৃষ্টতাপূর্ণ এক টুকরো কাগজ, খুররম যতটা অনুভব করে কণ্ঠস্বরে তাঁর চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস ফুটিয়ে তুলে বলে। মাথাটা যথাযথ ধর্মীয় আচার অনুসরণ করে কবর দাও। জামাল খানের জন্য আমরা এখন এতটুকুই কেবল করতে পারি।’

সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং দূর্গের উপরিতলে অবস্থিত আরজুমান্দের কক্ষের অভিমুখে সে যখন রওয়ানা দেয় তখনও তার হাতে মানডুর শাসনকর্তার চিঠিটা ধরা রয়েছে। সে কক্ষের দরজার উন্মুক্ত পাল্লার মাঝ দিয়ে দেখে যে আরজুমান্দ গবাক্ষের কাছে বসে রয়েছে তার কোলে তাদের সদ্যোজাত সন্তান আওরঙ্গজেব।সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে তাদের প্রাণ ভরে দেখে। ছেলেটা এখন ভালোই আছে, যদিও সেই দিনটার কথা সে কখনও ভুলবে না, তারা আগ্রা ছেড়ে আসবার দুই মাস পরে এবং সন্তান ভূমিষ্ট হবার পুরো একমাস আগে, তাঁদের দলটা যখন বিন্ধ্যা পর্বতের ভিতর দিয়ে উপরের দিকে যাবার জন্য পরিশ্রম করছিল তখন আরজুমান্দের গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয় যেখানে বর্ষার ভারি বর্ষণে ছোট ছোট খাড়িগুলো বিপদসঙ্কুল পাহাড়ী নদীতে পরিণত হয়েছে এবং তারা যখন যাত্রা বিরতি করে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে তখন টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়তে থাকা গাছের ডালপালা ছিল তাদের তাবু হিসাবে একমাত্র আশ্রয়।

কোনো হেকিম, বা ধাত্রীর সহায়তা ছাড়া কেবল তাঁদের সঙ্গে আসা দু’জন আয়ার সহায়তায় আরজুমান্দ পর্দা দেয়া গরুর গাড়িতে সন্তান জন্ম দেয়। বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে, অসহায়ভাবে তার আর্তনাদ শুনতে শুনতে ইচ্ছা করছিল এসব বন্ধ হোক কিন্তু একই সাথে ভয় হচ্ছিল সহসা এই আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যাবার কি অর্থ ভেবে–এতটা ক্ষমতাহীন নিজেকে তার আর কখনও মনে হয়নি। কেন তার জীবনটা, যা প্রথমে তার দাদাজান তারপরে তার আব্বাজানের প্রশ্রয়ে এত ভালোভাবে শুরু হয়েছিল, এমন এক রমণীর সাথে তার বিয়ে হয়েছিল সে যাকে ভালোবাসে এবং যে তাকে ভালোবাসে তারপরে তার সফল যুদ্ধাভিযান, এতকিছুর পরেও কেন এমন ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার হল? সে মনে মনে ভাবে, তবে কি নিয়তি তাকে পরীক্ষা করছে, খানিকটা স্বস্তির জন্য দু’হাতে নিজেকে আঁকড়ে রয়েছে, দেখতে চায় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে তাঁর উচ্চাকাঙ্খর কি দশা হয়? না, সে স্থিরসংকল্প, আরজুমান্দের আর্তনাদ তাঁদের সপ্তমে পৌঁছেছে মনে হতে সে নিজের দু’পাশে দু’হাত টানটান করে রেখে বুক টানটান করে দাঁড়ায়, তার দুর্ভাগ্য তাকে কেবল আরো দৃঢ়সঙ্কল্প করবে। আরজুমারে কান্নার শব্দ কিছুক্ষণ পরেই হ্রাস পায় এবং এক স্বাস্থ্যবান শিশুর তীক্ষ্ণ স্বরে কান্নার শব্দ তার বদলে ভেসে আসে।

সে এখন যখন দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকে তাঁদের সন্তানের সাথে দেখছে, তাঁদের জন্য উদ্বেগ, অনিশ্চয়তাবোধ যা সে কখনও দীর্ঘ সময় ভুলে থাকতে পারে না পুনরায় তাকে আচ্ছন্ন করে। তাঁর জন্য যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়ার মাঝে ভয়ের খুব বেশি কিছু নেই কিন্তু চারপাশের সবকিছু যখন মনে হয় বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে তখন তার পরিবারকে রক্ষা করা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। সে আশা করেছিল দাক্ষিণাত্যে অবস্থানরত তার বাহিনী তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে কিন্তু তার পরিবারের পলায়নের পরপরই কিন্তু সে নিজের বাহিনীর কাছে পৌঁছাবার অনেক আগেই জাহাঙ্গীর দ্রুতগামী অশ্বারোহী বার্তাবাহক প্রেরণ করে মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান বন্ধের আদেশ দেয় এবং পুরো বাহিনীকে আগ্রায় ডেকে পাঠায়। খুররমের কতিপয় সেনাপতি-কামরান ইকবালের মত মানুষেরা–আদেশ অমান্য করে এবং আসরগড়ে তাকে। খুঁজে বের করে। আরো অনেকেই–কোথায় তাদের নিজেদের সুবিধা হবে সেই সম্বন্ধে সচেতন হবার সাথে সাথে জাহাঙ্গীরের শাস্তির ভয়দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে আগ্রায় ফিরে যায় যেখানে তারা প্রকাশ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে বাধ্য হয়।

 জামাল খানের হত্যাকাণ্ড–এখন আবার নতুন আরেকটা আঘাত। কোনো মানুষের পক্ষে নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করা সম্ভব না। জামাল খান বাস্তবিকই তার পরিকল্পনার কিছুটা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিন্তু তার কাছ থেকে বলপূর্বক আদায় করা স্বীকারোক্তি দ্বারা তাঁর নিজের খুব বেশি সংখ্যক সমর্থকদের নিরাপত্তার বিষয়টার আপোষ করা হয়নি। খুররম তার শিবিরে গুরুত্বপূর্ণ নৃপতি আর শাসনকর্তাদের ভিতর যাঁদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছে তাঁদের কারো কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। বাতাস কোন দিকে প্রবাহিত হয় সেটা দেখার জন্য তারা অপেক্ষা আর পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং তাঁদের কাছে তাঁর প্রেরিত বার্তাগুলো বাস্তবিকই যদি জাহাঙ্গীরের কাছে পৌঁছায় এই মনোভাবের কারণে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। কিন্তু এরফলে তাঁদের পক্ষে তাকে সহায়তা দেয়ার সম্ভাবনা, গোপনে হলেও, অনেকটাই হ্রাস পাবে।

 সে আরজুমান্দের কক্ষে প্রবেশ করার সময় চেষ্টা করে নিজের চেহারায় একটা উৎফুল্লভাব ফুটিয়ে রাখতে কিন্তু সে তাকে খুব ভালো করে চেনে। তার এগিয়ে আসবার শব্দ শুনে সে মুখ তুলে তাকায়, কিন্তু তার চোখেমুখে ফুটে থাকা টানটান উত্তেজনার অভিব্যক্তি দেখে আরজুমান্দের হাসি স্নান হয়ে যায়।

 ‘খুররম, কি হয়েছে?

সে তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রথমে ঝুঁকে তাকে চুমো দেয় তারপরে হেঁটে গবাক্ষের কাছে গিয়ে পুনরায় শুষ্ক, ঝিকমিক করতে থাকা ভূপ্রকৃতির দিকে তাকায়। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়েই সে শুনতে পায় আরজুমান্দ আওরঙ্গজেবকে নিয়ে যাবার জন্য একজন পরিচারিকাকে ডাকে। সে তারপরে টের পায় তার হাত আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরছে এবং তাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায় নিজের মুখোমুখি করতে।

‘খুররম, এভাবে চেপে রেখো না, যাই ঘটুক না কেন তোমার অবশ্যই আমায় সেটা বলা উচিত।

‘তোমার কি মনে আছে যে জামাল খানকে আমি আমার গুপ্তচর হিসাবে মানডুর শাসনকর্তার কাছে পাঠিয়েছিলাম? বেশ, আমি আমার উত্তর পেয়েছি। আমার আব্বাজান তাকে পুরস্কৃত করবেন সেই আশায় সন্দেহ নেই, শাসনকর্তা তাকে শারীরিকভাবে নিপীড়ন করেছে আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে সে যা জানতো সেটা প্রকাশ করতে এবং তারপরে তাকে হত্যা করেছে। সে তার ছিন্নমস্তক সাথে একটা ধৃষ্টতাপূর্ণ চিরকুট দিয়ে আমার কাছে ফেরত পাঠাবার মত হঠকারিতা প্রদর্শন করেছে। সে নির্ঘাত বিশ্বাস করেছে যে আব্বাজান আমায় পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছেন এবং আমার পূনর্বাসিত হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই নতুবা তিনি এমন কাজ করার সাহস করতেন না। আর তিনি সম্ভবত ঠিকই ভেবেছেন। আমাদের এখানে অবস্থানের এতগুলো মাস অবস্থানের সময় আব্বাজানের কাছ থেকে আমি কোনো বার্তা পাইনি যদিও নিজের নিরপরাধিতার বিষয়ে প্রতিবাদ করে আমি তাঁর কাছে বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছি।’

 ‘কিন্তু এটাও তো সত্যি যে তিনি এখনও আপনার বিরুদ্ধে কোন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন নি। এটা নিশ্চয়ই কিছু অর্থবহন করে।

 ‘সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। অন্য আর সবার মত–আমি যাঁদের আমাকে সমর্থন করতে রাজি করাতে চেষ্টা করছি যারা এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায় নি তাদের সকলের মত–তিনিও হয়ত অপেক্ষা করে কালক্ষেপণ করছেন এবং পুরষ্কার আর শাস্তির হুমকি প্রদান করছেন, আমি কোনোভাবেই যা করতে পারবো না, তার জন্য তার লড়াই লড়তে। আমার লোকজন ইতিমধ্যেই দলত্যাগ করতে আরম্ভ করেছে। শেষবার গণনার সময় আমার সাথে দুই হাজারেরও কম লোক ছিল… কে জানে একমাস, দুইমাস পরে আমার সাথে কতজন লোক থাকবে? আমরা এভাবে সবকিছু চলতে দিতে পারি না। আমার জন্মগত অধিকার আর যোগ্যতা আমাকে যে উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্যে অধিকার দিয়েছে আমি কীভাবে তা অর্জন করবো?

 কিন্তু আপনি কি করবেন?

 ‘আগ্রায় আবার ফিরে গিয়ে আরো একবার নিজেকে আব্বাজানের করুণার কাছে নিজেকে সমর্পিত করে তাকে বাধ্য করবো আমার কথা শুনতে…’

না!” আরজুমান্দের কণ্ঠের প্রচণ্ডতা তাকে চমকে দেয়। খুররম, আমার কথা শোনেন। আপনি যা করতে চাইছেন সেটা করার মানে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু। আপনি নিদেন পক্ষে খসরুর মত অন্ধত্যুবরণ করা প্রত্যাশা করতে পারেন। আপনি প্রথমবার আমাকে যখন বলেন যে মেহেরুন্নিসা আমাদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে আমার নিজের ফুপুজান হবার কারণে কথাটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়েছিল… কিন্তু তারপরে আমি চিন্তা করতে শুরু

করি এবং তখন বুঝতে পারি তাকে আমি আসলেই কত অল্প চিনি। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম তখন তিনি তার প্রথম স্বামীর সাথে বাংলায় অবস্থান করছিলেন। তিনি সম্রাজ্ঞী হবার পরে তাকে তখন আরো দূরের কেউ বলে মনে হত, নিজের অবস্থান আর নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত… আমি তাকে কদাচিত একা দেখেছি। শাহরিয়ারের সাথে এখন যখন লাডলির বাগদান সম্পন্ন হয়েছে, আমরা তার জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছি… আমি এখন সেটা বুঝতে পেরেছি। আর আমি একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানি আমার ফুপুজান কতটা ধূর্ত, কতটা স্থিরসংকল্প, কতটা শক্তিশালী… খসরুর বিদ্রোহের সাথে যখন আমার চাচাজান মীর খান যোগ দিয়েছিল তখন তিনি তাঁর এইসব গুণাবলি ব্যবহার করে নিজেকে আর সেই সাথে আমাদের পুরো পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন এবং তিনি সেইসব গুণাবলি আবারও ব্যবহার করতে পিছপা হবেন না যদি তার কাছে সেটা প্রয়োজনীয় মনে হয়। আগ্রায় ফিরে যাবার কথা ভুলে যান… তার প্রভাবের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবেন না। সম্রাটকে তিনি কি করার জন্য প্ররোচিত করতে পারেন সেটা ভেবে আমি আতঙ্কিত। আমার কথা দেন, অনুগ্রহ করে…’।

আরজুমান্দের কণ্ঠে খুররম আবেগপ্রবণ প্রত্যয় শুনতে পায়। সচরাচর তাঁর বিবেচনাবোধের উপর আস্থা রাখতে আগ্রহী আরজুমান্দ কদাচিৎ তার সাথে কিছু নিয়ে তর্ক করেছে। সে সম্ভবত ঠিকই বলেছে। সে নিজের নিরপরাধিতায় এবং যুক্তিতর্ক আর বোঝাবার ক্ষমতায় যতই বিশ্বাস করুক, জাহাঙ্গীরের ভালোবাসায় অপ্রতিরোধ্য, মেহেরুন্নিসা, খুব সম্ভবত আব্বাজানের সাথে তাকে আরেকবার দেখা করার সুযোগ থেকে বিরত রাখবে। বেশ, তাই হবে, সে অবশেষে মন্থর কণ্ঠে বলে, ‘আমি কথা দিচ্ছি… আমি আরেকটু ধৈর্য ধারণ করে দেখবো।

*

হেকিম জাহাঙ্গীরের উর্দ্ধবাহুতে শক্ত করে পট্টি বেধে দেয়ার সময় সে ব্যাথায় কুঁচকে উঠে। যমুনার তীরে বাজপাখি দিয়ে শিকার করার সময় তাঁর নিজের অসতর্কতার কারণে জখমটা হয়েছে। সে যদি চামড়ার দস্তানা পরিধান করে থাকতো তাঁর প্রিয় হলুদ বাজপাখির, পাখিটা তিনি নিজের হাতে পোষ মানিয়েছেন, তীক্ষ্ণ হলুদ ঠোঁট বাহুর একটা পুরাতন ক্ষতস্থানের মুখ উন্মুক্ত করতে পারতো না মির্জাপুরের রাজার সাথে লড়াই করার সময় ক্ষতটা হয়েছিল। হেকিম তার কাজ শেষ করার মাঝেই একজন পরিচারক ভেতরে প্রবেশ করে। জাহাপনা, মানডুর রাজ্যপাল আপনার সাথে দেখা করতে আগ্রহী। তিনি বলেছেন তিনি খবর নিয়ে এসেছেন যা অবিলম্বে আপনার শোনা উচিত।’

 ‘তাকে তাহলে এই মুহূর্তে আমার একান্ত কক্ষে নিয়ে এসো।’ এই লোকটা কি চায়? হেকিম যখন তার চিকিৎসার উপকরণ গুছিয়ে নিয়ে বিদায় নেয় জাহাঙ্গীর তখন আপন ভাবনায় মশগুল। মানডু দক্ষিণে অনেক দিনের দূরত্বে অবস্থিত এবং বয়স্ক আর গাট্টাগোট্টা আলী খান অযথা পথের ধকল সহ্য করবেন না। রাজ্যপাল পাঁচ মিনিট পরে তাকে অভিবাদন জানায়। তার পরনের ঘামে ভেজা আলখাল্লা আর পায়ের ধূলি ধূসরিত নাগরা দেখে বোঝা যায় তিনি বাস্তবিকই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা জানাতে চান।

 ‘আলী খান, কি ব্যাপার?

 ‘আমি নিজ মুখে আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানাতে চাই বা অন্যথায় আমার আশঙ্কা আপনি খবরটা হয়ত বিশ্বাস করবেন না।

‘কি সংবাদ বলেন।

 ‘আপনার সন্তান যুবরাজ খুররম আপনার প্রজাদের আপনার বিরুদ্ধে সংগঠিত করছে।’

‘আপনি কি বলতে চান?

 ‘আপনাদের ভিতরে প্রকাশ্য বিরোধের সম্ভাবনা যদি দেখা দেয় সে আমার সমর্থন কামনা করে আমার কাছে চিঠি লিখেছিল। আমি, অবশ্যই, তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি এবং মনে করেছি সাথে সাথে আপনাকে জানান আমার দায়িত্ব।’

 ‘আমাকে তাঁর চিঠিটা দেখাও।

‘আমার কাছে সেটা এখন নেই, কিন্তু বার্তাটা যে বহন করে এনেছিল আমি সেই বার্তাবাহক বন্দি করে সে সবকিছু স্বীকার না করা পর্যন্ত তাকে নিপীড়ন করি। যুবরাজ খুররম দক্ষিণে একটা শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করতে চাইছেন যেখান থেকে তিনি আপনার আধিপত্যকে প্রশ্ন করতে পারবেন। আমি কেবল একমাত্র রাজ্যপাল নই যুবরাজ যোগাযোগ করেছেন। এই দেখেন–আমার কাছে নামের একটা তালিকা আছে…’ আলী খান হাসলে জাহাঙ্গীর যা অনুগ্রহোদ্দীপক হাসি হিসাবে অনুমান করে।

 জাহাঙ্গীর তার দিকে আলী খানের বাড়িয়ে ধরা কাগজটা নেয়। সে রাজ্যপালের বিশ্বস্ততার বিষয়ে অনেক দিন আগেই খসরুর শেষ বিদ্রোহের সময়েই সন্দেহ করার মত কারণ খুঁজে পেয়েছিল। আলী খান অবশ্য একাধারে ধূর্ত আর উঁচুমহলে আত্মীয়স্বজনও রয়েছে এবং জাহাঙ্গীর কখনও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মত যথেষ্ট প্রমাণ পায়নি। খুররম অবশ্যই জানতো লোকটার বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে এবং সম্ভবত সেই কারণেই সে তার সাথে যোগাযোগ করেছিল। খুররমের অবস্থানের দুর্বলতা সম্বন্ধে এটা থেকে অনেক কিছু অনুমান করা যায় যা আলী খান, কোনো সন্দেহ নেই সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করে, তাকে তার আব্বাজানের কাছে ধরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জাহাঙ্গীর নামের তালিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে দেখে তালিকাটা বেশ লম্বা। সে সহসা ক্লান্তি অনুভব করে এবং একা থাকতে চায়। আলী খান, আমি তোমায় যথাযথভাবে পুরস্কৃত করবো। আমি এখন একা থাকবো।’

 ‘ধন্যবাদ, জাঁহাপনা। আপনি আমার আনুগত্যের উপর ভরসা রাখতে পারেন। আলী খান ঘুরে দাঁড়িয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যাবার জন্য অগ্রসর হবার সময় তাঁর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে থাকে।

 রাজ্যপালের পেছনে দরজা বন্ধ হতে, জাহাঙ্গীর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে। সে যে সন্তানকে একটা সময় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো সে কীভাবে এতটা আনুগত্যহীন হতে পারে? দূর্গের প্রকারবেষ্টিত ছাদে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাঁদের শেষবারের মত দেখা হবার পর থেকে, এমন একটা দিনও অতিবাহিত হয়নি যখন সে খুররমের বিষয়ে চিন্তা করে নি, নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করে নি সে কি করার পরিকল্পনা করছে। তার সত্ত্বার একটা অংশ আশা করেছে যে সে হয়তো নিজের ঔদ্ধত্যের জন্য অনুতপ্ত হবে এবং অনুবর্তী হবে। তাঁর আসিরগড় থেকে লেখা চিঠিগুলো প্রথমদিকে এই আশাগুলোকে সাহসী করে তুলতো, কিন্তু মেহেরুন্নিসা যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত তার শব্দ চয়ন আর কিছু না নিজের কাজের স্বপক্ষে উদ্ধত যুক্তি প্রদর্শন–সেখানে ক্ষমাপ্রার্থনার কোনো ধরনের দোষ স্বীকারের কোনো প্রসঙ্গই নেই। তারই পরামর্শে তিনি চিঠির উত্তর প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু তিনি একই সাথে মেহেরুন্নিসার অনুরোধ মেনে নিয়ে নিজের সন্তানকে গ্রেফতার করার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করা থেকে বিরত থাকেন। এটা এখন প্রতিয়মান হচ্ছে যে মেহেরুন্নিসা বরাবরের মতই ঠিক পরামর্শই দিয়েছিল। তিনি শিথিলতা প্রদর্শন করেছেন, কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নিয়ে তিনি বৃথাই কালক্ষেপণ হতে দিয়েছেন, যা খুররমকে আরো উদ্ধত হতে উৎসাহিত করেছে।

*

জাহাঙ্গীর যখন মেহেরুন্নিসা কক্ষের দিকে এগিয়ে যায় তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সে এইমাত্র পরামর্শদাতাদের একটা বৈঠকে যোগ দিয়ে এসেছে যেখানে আলী খান, পরিষ্কার সবুজ আলখাল্লা পরিহিত হয়ে, তাঁর গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছে। তার পরামর্শদাতাদের রাজ্যপালকে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করা দেখে বোঝা গেছে তার নিজের মত তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্থবা নিদেনপক্ষে সেইরকমই ভান করেছে। আলী খানের তালিকায় তাদের কারও নাম নেই কিন্তু খুররমের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে তাদের কেউ কি অবগত ছিল? ভাবনাটা জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তিকে কঠোর করে তুলে। মন্ত্রণা কক্ষের পেছনের দেয়ালে অবস্থিত একটা তিরস্করণীর আড়াল থেকে মেহেরুন্নিসা সবকিছু দেখেছে এবং শুনেছে। তাঁর কি বলার আছে তিনি শুনতে আগ্রহী–কিন্তু গিয়াস বেগ আর আসফ খানের সাথেও পরামর্শ করা প্রয়োজন, তাঁদের সাথে যোগ দিতে যাদের তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন।

তিনি যখন ভেতর প্রবেশ করছেন মেহেরুন্নিসার কক্ষে তখন মাত্র সন্ধ্যের মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে। তার প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে। মেহেরুন্নিসা সাথে সাথে তার দিকে এগিয়ে এসে, তাঁর কাঁধে হাত রাখে এবং কোনো কথা না বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার জন্য পানপাত্রে সুরা ঢালার পূর্বে আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে তার ওষ্ঠে মৃদু চুম্বন করে। তিনি পানপাত্রে লম্বা একটা চুমুক দেন। তিনি যখন মনে মনে ভাবেন, সুরার তৃপ্তি এবং এর প্রশমিতকারী উষ্ণতা তার প্রয়োজন, তখন কক্ষের দরজা পুনরায় খুলে যায় গিয়াস বেগের দীর্ঘদেহী বয়োজ্যষ্ঠ অবয়ব আর পেছনে রয়েছে তাঁর সন্তান আসফ খানের গোলগাল কাঠামো।

 ‘বেশ, আপনারা সবাই আলী খানের বক্তব্য শুনেছেন। কি মনে হয়েছে। শুনে? তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন।

 ‘জাহাপনা, কি বলবো আমি বুঝতে পারছি না। গিয়াস বেগ তাঁর রূপালী চুল ভর্তি মাথা নাড়ে। আমি কখনও ভাবতে পারিনি এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে।’

‘এটাই কেবল সবচেয়ে বেশি সম্ভব। আমি ঠিক যেমন সন্দেহ করেছিলাম। খুররম সিংহাসন দখল করতে আগ্রহী। তাকে বহুদিন আগেই গ্রেফতার করার পরামর্শ দিয়ে আমি ভুল করিনি। প্রহরীরা সেদিন যদি একটু দ্রুত কাজ সমাধা করতো…’ মেহেরুন্নিসা বলে।

কিন্তু, জাঁহাপনা, এক মুহূর্ত ভেবে দেখেন–আলী খান কেবল এটুকুই বলেছে যে যুবরাজ খুররম সমর্থক সংগ্রহ করতে চেষ্টা করছেন। তার মানে এই নয় যে তিনি আপনার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী, গিয়াস বেগ প্রতিবাদ করেন।

 ‘কিন্তু এমন একটা পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করবে?’ মেহেরুন্নিসা জানতে চায়। কারণ, বাছা, সে নিজেকে অরক্ষিত মনে করছেন। জাহাপনা, আমার অকপট বাচনভঙ্গি মার্জনা করবেন, কিন্তু আপনি যুবরাজকে কখনও বলেননি কীভাবে সে আপনাকে ক্রুদ্ধ করেছে। তিনি এ কারণেই আপনাকে ক্রুদ্ধ করার ঝুঁকি নিয়ে হলেও আগ্রা এসেছিলেন আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে… মাজিদ খান সেই রাতে যুবরাজের সাথে তাঁর কথোপকথনের বিষয়ে বলেছে। আর আমি যদি নিষ্কপট আমি এবং দরবারের আরো অনেকেই বুঝতে পারেনি কেন আপনি তার বিরুদ্ধে খেপে গিয়েছেন। আপনার আদেশ অনুযায়ী যুবরাজ খুররম সবকিছু করেছে… আনুগত্য আর সাহসিকতার সাথে আপনার বাহিনীকে বিজয়ী করেছে। অতি সম্প্রতিও তিনি ছিলেন আপনার সবচেয়ে গর্বের…সবাই আশা করেছিল আপনি তাঁর নাম আপনার উত্তরাধিকারী হিসাবে

 ‘ঠিক তাই। যেহেতু সম্রাট তার মমতার বিষয়ে এত ভোলামেলা, এত উদার, তিনি এহেন প্রত্যাশা জাগ্রত করেছেন, কিন্তু যুবরাজের মাঝে এসব প্রত্যাশা অন্য কিছুতে পরিণত হয়েছিল–একটা লোভী, অধৈর্য উচ্চাকাঙ্খা…’ মেহেরুন্নিসা বাধা দিয়ে বলে।

 যুবকেরা সবসময়ে উচ্চাকাঙ্খী। কিন্তু তিনি যে কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করতে আগ্রহী চেয়েছিলেন তার কি প্রমাণ তোমার কাছে আছে?

‘সে দাক্ষিণাত্যে নিজের নেতৃত্ব পরিত্যাগ করে এখানে, আগ্রায় এসেছে।

 কিন্তু তার কারণ এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল যা তিনি বুঝতে অপারগ হয়েছিলেন। যার একটা হল যুবরাজ শাহরিয়ারকে জায়গির প্রদানের বিষয় খুররমের বিশ্বাস সেটা তাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল… এবং ন্যায়সঙ্গতও, বটে।’

‘এসব জায়গির প্রদান সম্রাটের বিশেষ অধিকার। আপনার অবস্থান থেকে মহামান্য সম্রাটের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে প্রশ্ন করা যায় না।’

‘এবং আপনিও পারেন না আমাকে মত প্রকাশে বাধা দিতে। আপনি সম্রাজ্ঞী হতে পারেন কিন্তু এখনও আমি আপনার জন্মদাতা পিতা। বৃদ্ধ লোকটা এক মুহূর্ত সময় নিয়ে নিজের ভাবনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পুনরায় বক্তব্য শুরু করে, জাঁহাপনা, আপনার মরহুম আব্বাজান আমাকে আর আমার পরিবারকে চরম দুর্গতি আর দারিদ্রের হাত থেকে উদ্ধার করার পর থেকে আমি চেষ্টা করে এসেছি আপনার রাজবংশের সর্বোচ্চ সেবা করতে। আমি আপনাকে সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ করার সময় আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা বলি। আপনি পরবর্তীতে আক্ষেপ করতে পারেন ঝোঁকের মাথায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।

কক্ষের অভ্যন্তরে নিরবতা বিরাজ করে। মেহেরুন্নিসা মুখ ঘুরিয়ে থাকে। জাহাঙ্গীর তার বসার ভঙ্গি, তার মাথার নতি দেখে বুঝতে পারে সে কতটা ক্রুদ্ধ হয়েছে। জাহাঙ্গীর আগে কখনও তাকে তার আব্বাজানের সাথে তর্ক করতে কিংবা গিয়াস বেগকে, সচরাচর ভীষণ ধীরস্থির আর বিচক্ষণ, এতটা আবেগ নিয়ে কথা বলতে শোনেনি। আসফ খানের দৃষ্টি বাপ বেটির উপরে ঘুরতে থাকে, একটা গভীর ভ্রুকুটি তার চেহারায়।

 ‘আসফ খান, আপনি ভীষণ নিরব আর গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আপনার কি কিছুই বলার নেই?’ জাহাঙ্গীর জানতে চায়। খুররম যদি নিজেকে ধ্বংস করে দেয় তাহলে সে আপনার মেয়েকেও সেইসাথে ধ্বংস করবে।’

‘জাহাপনা, আমার ধারণা আব্বাজান ঠিকই বলেছেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বিশদভাবে না জানা পর্যন্ত আপনার কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। খুররম হৃদয় আর মনে আসলেই কি মনোভাব পোষণ করে আপনার সেটা খুঁজে দেখা উচিত। তাঁর কাছে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন–আপনি যদি অনুমতি দেন আমি খুশি মনে যেতে পারি।’

 ‘হ্যাঁ, গিয়াস বেগ সমর্থন জানায়। আপনি তাকে বিরোধ নিষ্পত্তির অন্তত একটা সুযোগ দিতে পারেন সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহুদূরে সরে যাবার আগেই যখন বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

 ‘সে হয়তো বিরোধ নিষ্পত্তি করতেই চায় না।’

 ‘জাহাপনা, আপনি সেই প্রয়াস নেয়ার আগে সেটা নিশ্চিত জানেন না, নিজ সন্তানের সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করার কারণে প্রজারাও আপনার প্রশংসা করবে, গিয়াস বেগ দৃঢ়তার সাথে বলে।

 জাহাঙ্গীর তাঁর পানপাত্রের গাঢ় তলানি পর্যবেক্ষণ করে। গিয়াস বেগের কথাগুলো তাঁর মনের একটা গোপন তন্ত্রীতে আঘাত করেছে। আকবর তাঁর সাথে যেমন আচরণ করেছিলেন তিনিও কি খুররমের সাথে ঠিক তেমনিই অন্যায় করেছেন? সেদিন রাতে প্রাকারবেষ্টিত দূর্গের ছাদে তিনি যদি আরো কিছুক্ষণ খুররমের বক্তব্য শ্রবণ করতেন তাহলে এমন কি ক্ষতি বৃদ্ধি হতো? তারা হয়তো একটা চলনসই বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারতো?

কিন্তু এমন সময় মেহেরুন্নিসা পুনরায় মন্তব্য করে। আব্বাজান, একটা আদর্শ পৃথিবীতে আপনি এইমাত্র যা পরামর্শ দিলেন তা হয়তো অর্থবহন করে। কিন্তু আমাদের পৃথিবী মোটেই নিখুঁত নয়। আমাদের সীমান্তের ভিতরে আর বাইরে শত্রুভাবাপন্ন লোকদের বাস সবাই সম্রাটকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে আপন আপন প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। এমনকি খুররমও এখন হয়ত সৈন্য সংগ্রহ করছে, আমাদের শত্রুর মাঝে মিত্রের সন্ধানে প্রকাশ্যে প্রস্তাব রাখছে।

 ‘তোমার কাছে কি এসবের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ রয়েছে?

 ‘গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতিটা দিন যা আমাদের নিশ্চায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যতিরেকে কেটে যাচ্ছে সম্রাটকে দুর্বল আর খুররমকে শক্তিশালী করছে এবং সে এটা জানতে পারবে। জাহাঙ্গীরের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে সে তার মুখটা দু’হাতের তালুতে ধরে। আমার কথা শোনেন। আমি কি আপনাকে সবসময়ে ভালো পরামর্শ দেইনি? আমি জানি, আপনার জন্য এটা কঠিন কিন্তু খুররমকে ধ্বংস করার জন্য আপনাকে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে। তাকে যখন বন্দি হিসাবে আপনার সামনে হাজির করা হবে তখন কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপনি একজন পিতা বটে কিন্তু তার আগে প্রথমে আপনি একজন সম্রাট। নিজের সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা কি আপনার মহান দায়িত্ব নয়? সে এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে তারপরে সে তাকে ছেড়ে দেয় এবং উঠে দাঁড়ায়। গিয়াস বেগ আবার নিজের মাথা নাড়তে শুরু করেছে। জাঁহাপনা, আমার কন্যার কথাগুলো অবিবেচনাপ্রসূত। আপনি অবশ্যই হঠকারী হয়ে কিছু করবেন না। কয়েকটা দিন অন্তত বিবেচনা করে দেখেন…’

‘আপনি জানেন আপনি এসব কথা বলছেন কারণ আপনি আমার আর আমার কন্যার চেয়ে আমার ভাই আর তার কন্যাকে বেশি পছন্দ করেন, মেহেরুন্নিসা চিৎকার করে উঠে, গলার স্বর কাঁপছে। আর আপনি, ভাইজান।’ সে চরকির মত আসফ খানের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেন আপনার সত্যিকারের আনুগত্য কোথায় নিহিত… আপনার সম্রাটের নাকি আপনার কন্যা?

আসফ খান এক কদম পেছনে সরে যায় এবং উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে জাহাঙ্গীরের দিকে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু গিয়াস বেগ মোটেই ভীত নয়। ‘মেহেরুন্নিসা, তুমি এমন অভিযোগ করো তোমার এত বড় স্পর্ধা! আমরা একইভাবে তোমায় অভিযুক্ত করতে পারি খুররম আর আরজুমান্দের চেয়ে শাহরিয়ার আর তোমার কন্যার স্বার্থরক্ষায় তুমি ব্যক্তিগত কারণে সহায়তা করছো।’

 ‘আপনার বয়স হচ্ছে। আপনার স্মৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে নতুবা আপনি এমন কথা বলতে পারতেন না… সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, কেবলমাত্র পারিবারিক স্বার্থ নিয়ে না।

 ‘তুমি উদ্ধত। তুমি আমাকে সম্মান প্রদর্শন করার তোমার কর্তব্য সম্বন্ধে ভুলে গিয়েছ।

 কর্তব্য? আপনি কর্তব্যের কথা বলছেন? একটা গাছের নিচে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশু অবস্থায় আমাকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়ে পরিত্যাগ করার সময় আপনার কর্তব্যবোধ কোথায় ছিল? আপনি সেই সময় আমায় কতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন?

 ‘মৃত্যু তখন আমাদের খুব কাছে ছিল। আমার সামনে আর কোনো উপায় ছিল না, তুমি সেটা খুব ভালো করেই জানো। আর ভাগ্য যখন প্রসন্ন হয়েছিল, আমি ফিরে এসেছিলাম তোমায় খুঁজতে…’।

 ‘আর আপনি এখন আরো একবার আমায় পরিত্যাগ করছেন।

‘এসব অনেক হয়েছে! জাহাঙ্গীরের মাথায় এখনও যন্ত্রণা হচ্ছে। মেহেরুন্নিসার উপরে সে এক মুহূর্তের জন্য হলেও অসহিষ্ণু হয়ে উঠে, যার সচরাচর মায়াবী চোখ ক্রোধে জ্বলজ্বল করছে এবং যার নিচের ঠোঁট বিশ্রী ভঙ্গিতে বাইরের দিকে ওল্টানো রয়েছে। আমি এই বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য শুনতে চেয়েছিলাম কারণ এর সাথে আমাদের উভয়ের পরিবার জড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত কেবল আমি একাই গ্রহণ করবো।’

 ‘অবশ্যই।’ মেহেরুন্নিসা অনেক সংযত কণ্ঠে উত্তর দেয়। আমি দুঃখিত, আমি রেগে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি আপনার জন্যই ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম, কারণ আমি আপনাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে চাই… আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের জন্য যা সবসময়ে করে থাকি।

জাহাঙ্গীর পালাক্রমে তাদের তিনজনের দিকে তাকায়–বাবা, ভাই আর বোন। সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ কেবল তাঁরই পরিবারকে বিভক্ত করে নি। ‘আপনারা যা বলেছেন আমি সে বিষয়ে ভেবে দেখবো, কিন্তু আমি এখন আমার একান্ত কক্ষে ফিরে যাব।’ সে মেহেরুন্নিসাকে তাঁর দিকে সামান্য এগিয়ে আসতে লক্ষ্য করে, কিন্তু তিনি তাকে উপেক্ষা করেন। আজ রাতে একাকী তাঁর চিন্তা করা প্রয়োজন।

*

অন্ধকারে খোলা জানালার পাশে জাহাঙ্গীর বসে আছে, মেহেরুন্নিসার আফিম মিশ্রিত সুরার একটা পাত্র তাঁর পাশে রাখা। তিনি পাত্রে চুমুক দিতে থাকলে তার মাথার যন্ত্রণাটা প্রশমিত হতে থাকে, কিন্তু এখনও নিজের ভাবনাগুলোকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করতে তার বেশ বেগ পেতে হয়। তার মানসপটে মনোযোগ বিঘ্নিতকারী সব অবয়ব ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাবার সময় তারা সবকিছু এলোমেলো বিকৃত করে দিয়ে যায়–তিনি নিজেকে বালক হিসাবে তার আব্বাজান আকবরের দিকে তাকিয়ে থাকতে এবং ভাবতে দেখেন কখনও কি তিনি তার অনুমোদন লাভ করবেন, গ্রীষ্মের গুমোট রাতের অন্ধকারে সুফি সাধক, সেলিম চিশতির বাড়ির দিকে দৌড়ে চলেছেন নিজের ভয় আর আকবরের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের অনিশ্চয়তার কথা বৃদ্ধ লোকটিকে বলতে। জাহাঙ্গীরের জন্য না তাঁর সন্তানদের প্রতি ছিল আকবরের সব মমতাবোধ, এবং খসরুর ক্ষেত্রে সেটা কি পরিণতি নিয়ে এসেছিল? নিজের বড় ছেলের শূলবিদ্ধ সমর্থকদের আর্তনাদ, তাঁর মাথায় প্রতিধ্বনিত হয়, এবং খসরু তাঁর দিকে দৃষ্টিহীন চোখে তাকিয়ে থাকে।

 জাহাঙ্গীর এইসব অশরীরি অবয়বদের উপস্থিতির কারণে আতঙ্কিত হয়ে জোর করে নিজেকে পুরোপুরি জাগিয়ে তোলে এবং ধাতব পানপাত্রটা কক্ষের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিলে গালিচায় সুরার তলানি ছিটকে পড়ে। পরিষ্কার মন নিয়ে তাঁর চিন্তা করা দরকার। ভোলা বাতায়নের ভিতর দিয়ে বয়ে আসা শীতল বাতাস ধীরে ধীরে আফিম আর সুরার মাদকতাময় ধোয়া সরিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হতে থাকে। আকবর যদি তার জন্য একজন ভালো পিতা হতেন এবং তিনি যদি তার সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতেন, খসরুর বিদ্রোহ আর খুররমের দ্রোহ হয়ত ঘটতো না। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন আকবরের ব্যর্থতাগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন তার মাঝে না ঘটে। যা ঘটেছে সেটা সম্ভবত অনিবার্য ছিল–এশিয়ার তৃণাঞ্চল থেকে সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রে নিয়ে মোগলরা এটা নিয়ে এসেছিল যার কারণে এটা হয়েছে। সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তাঁদের রক্তে রয়েছে, ঠিক যেমন তরুন হরিণ পালের গোদার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের শক্তি পরীক্ষা করে। সন্তানদের কঠোর শিক্ষা দেয়া জন্মদাতা পিতাদের জন্য প্রকৃতির নির্ধারিত পাঠক্রম।

জাহাঙ্গীর তারকাখচিত আকাশে বুকে মগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তাঁর দাদাজান হুমায়ুন বিশ্বাস করতেন যে পুরো জীবনের রহস্যময়তার উত্তর তারকারাজি ধারণ করে রয়েছে। জাহাঙ্গীর ঠোঁট ওল্টায়। তাঁরা হুমায়ুনের সমস্যাবলী নিশ্চিতভাবেই সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিল–সমস্যাগুলোর জন্ম হয়েছিল ক্ষমাশীল হওয়ায় যখন তাঁর কঠোর হওয়া উচিত ছিল, ইতস্তত করায় যখন তার উচিত ছিল নিশ্চায়ক হওয়া। তিনি সে কারণেই নিজের সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন।

 তার ক্ষেত্রে এমন কখনও হবে না। তিনি সিংহাসনের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করেছেন… মেহেরুন্নিসা বরাবরের মত এবারও ঠিকই বলেছে। কোনো ধরনের বিলম্ব, দ্বিধাবোধ তার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতীয়মান হতে পারে। তাকে অবশ্যই আবেগমুক্ত হয়ে খুররমের মোকাবেলা করতে হবে।

*

পরেরদিন সন্ধ্যা নামার সময়, জাহাঙ্গীর দেওয়ানি-আমের মার্বেলের বেদীর নিচে সমবেত হওয়া তার পুরো দরবারের সামনে উঠে দাঁড়ায় সামনে সারিবদ্ধ অভিজাতদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে। তিনি এখন যখন তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি অনুভব করেন নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, ঠিক যেমন তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় যখন ঝরোকা বারান্দায় তাঁর প্রজাদের সামনে তাঁর প্রথমবার দর্শনের সময় হয়েছিল। বেদীর কাছে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের ভিতরে রয়েছে আসফ খান, গিয়াস বেগ আর তার উজির মাজিদ খান। তিনি কাউকে, এমনকি মেহেরুন্নিসাকেও বলেননি, তিনি কি বলবেন, কিন্তু কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু আজ ঘোষণা করবেন।

তিনি দরবারের বেলেপাথরের তৈরি একশ স্তম্ভ রেশমের কালো কাপড় দিয়ে মুড়ে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। বাইরের আঙিনার সবগুলো ফোয়ারা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং উজ্জ্বল রঙের ফুলের কেয়ারি আরো রেশমের কালো কাপড় বিছিয়ে দিয়ে, রঙিন সবকিছুর উপর আড়াল করা হয়েছে। তিনি নিজেও কালো রঙের একটা সাদাসিদে আলখাল্লা পরিধান করেছেন, মাথায় একই রঙের পাগড়ি আর আজ তিনি কোনো অলঙ্কার ধারণ করেন নি। তাঁর অমাত্যরা অস্বস্তির সাথে চারপাশে তাকায়। জাহাঙ্গীর অপেক্ষা করে, উত্তেজনার পারদ আরেকটু বৃদ্ধি পেতে দেয়, এবং তারপর সে তার বক্তব্য শুরু করে।

‘আপনারা সবাই জানে যে গতকাল মানডুর রাজ্যপাল আমায় জানিয়েছে যে আমার সন্তান যুবরাজ খুররম বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। সে আমার রাজ্যপালদের অনেকের কাছেই বার্তা পাঠিয়ে আমার বিরুদ্ধে তাঁর সাথে তাদের মৈত্রী করতে অনুরোধ করেছে। এটাই তার একমাত্র অপরাধ নয়। সে দাক্ষিণাত্যে তাঁর সামরিক নেতৃত্ব পরিত্যাগ করে আমার অনুমতি ছাড়াই আগ্রা এসেছিল। আমি তাকে যখন গ্রেফতার করার আদেশ দেই সে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। আমি এমনকি তখনও আশা করেছিলাম সে নিজের ভুল দেখতে পাবে এবং কর্তব্যের পথে ফিরে আসবে। আমি আমার পিতৃসুলভ মমতায় ধৈর্য ধারণ করেছি, তাকে তার তারুণ্যের অহঙ্কারের জন্য অনুতপ্ত হবার সময় দিয়েছি। আমি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো বাহিনী প্রেরণ করা থেকে বিরত থেকেছি। কিন্তু উচ্চাকাঙ্খা তাকে পুরোপুরি অসৎ করে ফেলেছে। সে নমনীয় হবার বদলে আরো বেশি স্পর্ধিত হয়ে উঠেছে। আমি এখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।’

জাহাঙ্গীর দম নেয়ার জন্য থামে। দরবারে পাথরের মত ভারি নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। তার চোখ গিয়াস বেগের উপরে পড়ে, যার মাথা নত করা রয়েছে। তিনি এই মাত্র যা বলতে যাচ্ছেন মেহেরুন্নিসার বাবা সেটা মোটেই পছন্দ করবে না কিন্তু তাঁর নিজের এবং সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার বিষয়টা অবশ্যই প্রথমে বিবেচ্য হওয়া উচিত। জাহাঙ্গীর মুহূর্তটার গুরুত্ব বোঝাবার জন্য উচ্চস্বরে এবং দৃঢ়তার সাথে আদেশ করে, ‘রাজকীয় খতিয়ান যেখানে আমি বা-দৌলত, খুররম নামের বদমাশটার নামটা, তার জন্মের অশুভ-তিথিতে উত্তীর্ণ করেছিলাম আমার কাছে নিয়ে এসো।

একজন পরিচারক যার হাতে সবুজ চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা বিশাল খণ্ড রয়েছে সামনে এগিয়ে আসে এবং সেটা বেদীর উপরে ইতিমধ্যে আরেকজন পরিচারকের রাখা তুতকাঠের রেহেলের উপরে স্থাপন করে। জাহাঙ্গীর খতিয়ানের খণ্ডটা খুলে এবং ধীরে ধীরে পাতা উল্টাতে থাকে যতক্ষণ না সে যা খুঁজছিল সেটা খুঁজে পায়। তারপরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচারকের হাত থেকে লেখনী নিয়ে সেটা সে কালো অনিক্সের দোয়াতদানিতে চোবায় এবং একটা নিশ্চায়ক আচড়ে পাতার উপরে একটা দাগ টেনে দেয়। আপনাদের সবার সামনে আমি ঘোষণা করছি যে আমি বা-দৌলত, খুররমকে ত্যাজ্য করছি। আপনারা এইমাত্র আমাকে তাঁর নামটা আমার সন্তানদের নামের তালিকা থেকে কেটে বাদ দিতে দেখেছেন তেমনি আমার হৃদয় থেকেও আমি চিরতরে তাকে মুছে ফেলছি। আজকের এই দিন থেকে আগামীতে খুররম আর আমার সন্তান নয়।

জাহাঙ্গীর যখন কথা বলছিল, সে তখনই তাঁর কানে অমাত্যদের মাঝ থেকে বিস্মিত গুঞ্জণ ধ্বনি ভেসে আসতে শুনে। আসফ খান আর গিয়াস বেগ কয়েক ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের মুখাবয়বে আতঙ্ক ফুটে উঠে আর তার উজির মাজিদ খান, চোখ বন্ধ অবস্থায়, তসবি জপছিলেন আর সামনে পিছনে দুলছিলেন। কিন্তু সে এখনও তাঁর বক্তব্য শেষ করে নি।

‘আমার সাম্রাজ্যে আমি কোনোভাবেই বিদ্রোহ বরদাশত করবো না–সে চেষ্টা যেই করুক। আমি আজ সকালেই খুররমকে কলঙ্কিত অপরাধী ঘোষণা করে একটা ফরমানে স্বাক্ষর আর সীলমোহর করেছি এবং তাঁর মাথার জন্য একটা পুরষ্কার ধার্য করেছি–পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা যে তাকে বন্দি করতে সক্ষম হবে। আমি, তাছাড়ও আমার বিশ্বস্ত সেনাপতি মহবত খানের নেতৃত্বে তাঁর বিরুদ্ধে একটা মোগল বাহিনী প্রেরণ করছি। আগামী এক সপ্তাহের ভিতরে তাঁরা যাত্রা শুরু করবে।

জাহাঙ্গীর ঘুরে দাঁড়ায় এবং তাকে আবারও যন্ত্রণা দিতে থাকা পিতা জীবনের, সম্রাটের জীবনের রূঢ় বাস্তবতার তীব্রতা অসাড় করতে মেহেরুন্নিসার আফিম মিশ্রিত সুরার জন্য ব্যাকুল হয়ে দ্রুত দরবার থেকে হেঁটে বের হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *