১.১৫ গৃহ প্রত্যাবর্তন

১.১৫ গৃহ প্রত্যাবর্তন

চম্বল নদীর বালুকাময় তীরে দুটো লাল-মাথাঅলা সারস নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে। খুররমের বাহিনী কাছাকাছি পৌঁছালে তারা আকাশে ভাসে, তাদের সরু পা ঘুড়ির লেজের মত ভাসতে থাকে। এক জোড়া চকচকে মসৃণ মাথাবিশিষ্ট লম্বা গলাওয়ালা করমোরান্ট মাছের খোঁজে পানিতে ডুব দেয় কিন্তু দৃশ্যপটের এহেন সমাহিত সৌন্দর্য খুররমকে স্পর্শ করে না। দাক্ষিণাত্য থেকে উত্তরে তার দীর্ঘ ঝটিকা সফরের সময় পুরো চম্বল এলাকা তাঁর কাছে ছিল শেষ প্রতিবন্ধকতা। প্রথম সকালের আলো থেকে চোখ আড়াল করে সে নদীর অগভীর অংশ যাকে প্রতর বলে সেদিকে তাকায় যেখানে পিঠে জ্বালানী কাঠ বোঝাই উটের সারি নিয়ে ইতিমধ্যেই তাদের চালকেরা অতিক্রম করতে আরম্ভ করেছে। বর্ষাকাল যদিও নিকটেই কিন্তু এখনও বৃষ্টি পুরো দমে শুরু না হওয়ায় নদীর পানি বেশ নিচু দেখায়। সে এবং তার লোকজনের নদী অতিক্রম করতে কোনো অসুবিধা হবার কথা না। ভাগ্য সহায় থাকলে রাত নামার আগেই তারা আগ্রা পৌঁছে যাবে।

 মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য সে ঠিক যখন তাকে তার ভূখণ্ডের গভীরে ধাওয়া করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন মাঝ পথে সে তার অভিযান সমাপ্ত করতে চায়নি কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে তার সামনে অন্য কোনো বিকল্প নেই। তাকে জানতেই হবে তাঁর আব্বাজানের মনে কি রয়েছে। সে এখন থেকে আর টকটকে লাল তাবু স্থাপনের সম্মান লাভ করবে না বার্তা প্রেরণ করে জানানই ছিল যথেষ্ট অপমানজনক, কিন্তু এই ঘটনার পরে সে যখন জানতে পারে যে জাহাঙ্গীর প্রথমে তাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাহরিয়ারকে সেই জমিদারি দান করেছে তার মানসিক শান্তির প্রতি এটা আরো বিব্রতকর আঘাত হানে। কিন্তু অচিরেই–সম্ভবত আর কয়েক ঘন্টার ভেতর–সে তার আব্বাজানের মুখোমুখি দাঁড়াবে এবং তার কাছে জানতে চাইবে সে কীভাবে তাকে অসন্তুষ্ট করেছে। তার আব্বাজান নিশ্চয়ই তাঁর অনুরোধের যথাযথ উত্তর দেবেন যদি সে ব্যক্তিগতভাবে সেটা তার কাছে পেশ করতে পারে।

খুররম যা আশা করেছিল বস্তুতপক্ষে যাত্রার শেষ অংশটুকু সমাপ্ত করতে তার চেয়ে একটু বেশিই সময় লাগে। চম্বল অতিক্রম করার পরেই, কালচে-বেগুনী রঙের মৌসুমী মেঘ, পশ্চিম দিক থেকে তাঁদের দিকে ধেয়ে এসে অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু করে, নিমেষের ভিতরে পায়ের নিচের মাটিকে পিচ্ছিল কাদায় পরিণত করায় তাদের পরিশ্রান্ত ঘোড়া আর মালবাহী প্রাণীগুলো এর উপরে পিছলে যায় এবং আছাড় খায়। কিন্তু সূর্যাস্তের ঠিক আগে আগে খুররম বৃষ্টির ভিতরে তাঁর হাভেলীর সদর দরজার দু’পাশে দপদপ করে জ্বলতে থাকা মশালের আলো দেখতে পায়, তাঁদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে দরজার পাল্লা দুটো ইতিমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে। সে অবশ্য আগেই অনেক বিচারবিবেচনার পরে তাঁর আব্বাজানকে একটা ছোট চিঠি লিখেছে যেখানে সে তাঁর আহত অপাপবিদ্ধতার কথা বয়ান করেছে। আপনাকে ক্রুদ্ধ করার মত আমি কি করেছি সেটা না জেনে আমার পক্ষে আর দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করা সম্ভব নয়। আমি কেবল আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আপনি আমার সাথে এমন আচরণ করছেন যেন আমি আপনার বিরোধিতা করেছি। আমি যখন আগ্রা পৌঁছাব আমি যেকোনো অভিযোগ, প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত থাকবো।

খুররম দুলকি চালে হাভেলীর আঙিনায় প্রবেশ করে এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে লাগামটা তার কচির উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়। আরজুমান্দ আর বাচ্চারা পর্দা ঘেরা যে বিশাল গরুর গাড়িতে রয়েছে সেটা কেবলই মাত্র গড়িয়ে গড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। গাড়িটা থামতে খুররম ভেজা পর্দা তুলে ভেতরে উঁকি দেয়। আরজুমান্দ যদিও কোনোমতে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে তবুও স্পষ্টই সেখানে ক্লান্তি আর কষ্টের ছাপ বোঝা যায় এবং নিজের স্ফীত উদরে সে হাত দিয়ে রেখেছে। সাম্প্রতিক এই গর্ভাবস্থা বেশ কষ্টকর বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। চার বছরের জাহানারা এবং তার ছোট বোন রওসোন্নারা যাকে সে কোলে নিয়ে আছে, দু’জনেই তাঁদের আম্মিজানের মতই জেগে রয়েছে কিন্তু তাঁদের দুই ভাই দারা শুকোহ্ আর শাহ শুজা ঘুমিয়ে কাদা, কুকুরের বাচ্চার মত তাদের দেহগুলো পরস্পরের সাথে কুণ্ডলী করে রয়েছে। খুররম তাঁর পরিবারের কচি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় তার মাঝে ক্রোধের সঞ্চার হতে শুরু করে এই জন্য যে তাঁদেরও বাধ্য হয়ে এই ঝটিকা সফরের বিপদ আর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সে আগ্রায় গতবার যখন ফিরে এসেছিল সেবারের তুলনায় এবারের ফিরে আসা কত আলাদা, যখন আব্বাজান তার উপরে মোহর আর রত্ন বর্ষণ করে তাকে বরণ করেছিল এবং তাকে ‘শাহ জাহান’ নামে অভিনন্দিত করেছিল।

*

‘যুবরাজ, আপনার কাছে একজন অতিথি এসেছে।

 খুররম উঠে দাঁড়ায়। সে আঙিনার মার্বেলের সূর্যঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। সে গতরাতে তাঁর আব্বাজানের সাথে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে দূর্গে যে বার্তা প্রেরণ করেছিল সে তার উত্তরের জন্য সারা সকাল অপেক্ষা করেছিল। এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখা আরো একটা উপেক্ষাপূর্ণ আচরণ যদিও জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করার জন্য তাকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু অতিথির চেহারা দেখে খুররমের মুখ নামিয়ে নেয়। তাঁর আব্বাজানের উজির মাজিদ খান বা দরবারের অন্য কোনো উচ্চপদস্থ অমাত্যের পরিবর্তে, সে ইংরেজ রাজদূতের কৃশকায়, লম্বা অবয়ব দেখতে পায়। স্যার টমাস রো যখন সামনে এগিয়ে আসে সে তার হতাশার মাঝেও লক্ষ্য করে তাকে দেখতে কতটা আলাদা লাগছে। লোকটা আগের চেয়েও কৃশকায় হয়েছে, তার দাগ টানা ছোট পাতলুনের নিচে দিয়ে বের হয়ে থাকা উরুদ্বয় খুররমের উৰ্দ্ধবাহুর চেয়ে সামান্যই পেষল হবে, এবং তার একদা লালচে মুখাবয়ব ফ্যাকাশে দেখায়। তাঁর চোখের সাদা অংশ প্রায় হলুদ হয়ে আছে এবং খুররম লক্ষ্য করে যে তার সামান্য কাঁপতে থাকা হাতে ধরে থাকা আবলুস কাঠের লম্বা লাঠিটা, যার হাতলে জমকালো ফিতে জড়ানো রয়েছে, মর্যাদা বা আভিজাত্যের জন্য নয় বরং অবলম্বনের কাজ করছে। দূতমহাশয় লাঠিটার উপরে ভীষণভাবে ভর দিয়ে রয়েছেন।

‘যুবরাজ, আমার সাথে দেখা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা নিচু কাঠের আসনে বসার জন্য খুররম রো’কে ইঙ্গিত করে এবং পরিচারকদের তাকিয়া নিতে আসবার জন্য আদেশ দেয়। সে দূতমহাশয়কে কখনও পছন্দ করতো না–সব বিদেশী যারা দরবারে এসে সমবেত হয়েছে তাদের সবাইকে সে অবিশ্বাস করে এবং এই নমুনার প্রতি তাঁর আব্বাজানের আগ্রহ তাঁর কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়েছে–কিন্তু লোকটার শারীরিক অবস্থা তাঁর সৌজন্যতাবোধের দাবি করে। রো সতর্কতার সাথে আসনের উপরে নিজেকে উপবিষ্ট করে এবং এটা করার সময়েই যন্ত্রণায় তাঁর চোখমুখ কুঁচকে যায় এবং কোনোভাবেই নিজের মুখ থেকে মৃদু গোঙানির আওয়াজ নিঃসৃত হওয়া বন্ধ করতে পারে না। যুবরাজ, আমি দুঃখিত। আমার পাকস্থলী আমাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে। আমার পাকস্থলীই কেবল না, দূতমহাশয় যন্ত্রণায় বাঁকানো মুখে ভাবে। তার পেটের নাড়িভুড়ি এখনও পীড়ন করছে। একটা সপ্তাহও ভালোমত অতিক্রান্ত হতে পারে না তার আগেই তারা আমাশয়ে আক্রান্ত হয়, এবং সে এখন অর্শরোগের কারণে বিব্রত- ইংল্যান্ডে বাড়িতে স্ত্রীর কাছে তাঁর ক্রমশ নালিশ করার স্বভাব লাভ করা চিঠিতে সে তাদের আমার পান্না বলে অভিহিত করে। সে অবশ্য এসব কিছুই এই তরুণ অহঙ্কারী যুবরাজের কাছে বলবে না। আলোচনার জন্য আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। খুররম দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে আসছে শোনার পর থেকেই সে তার সাথে দেখা করবে কিনা সেটা নিয়ে যুক্তির জাল বুনছে। তাঁদের আলোচনাটা বেশ কষ্টসাধ্য হবে কিন্তু আলোচনাটা করা তাঁর নিজের দেশ, নিজের সম্রাটের প্রতি তার দায়িত্ব।

 ‘যুবরাজ, আমার যা বলার আছে আমি সেটা কেবল আপনাকেই বলতে চাই।’

 ‘আমাদের একা থাকতে দাও, খুররম তাঁর পরিচারকদের আদেশ দেয়, এবং তাঁর দিকে ঝুঁকে আসে। কি বলতে চান?

রো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিশ্চিত হতে যে আসলেই চারপাশে আর কেউ নেই। যুবরাজ, আপনি আগ্রা ফিরে আসবার পরে এত দ্রুত আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি বলে আমায় মার্জনা করবেন কিন্তু আপনার সাথে আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি ছিল। আপনার আব্বাজানের দরবারে আমি যদিও একজন বহিরাগত, কিন্তু আপনাদের এখানে অবস্থান করার সময় আমি আপনাদের ভাষা আয়ত্ত্ব করেছি এবং দরবারের অমাত্যদের অনেকের সাথে বন্ধুত্ব করার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি আপনার আব্বাজানের অনুগ্রহ কিছু সময়ের জন্য উপভোগ করেছিলাম। বস্তুতপক্ষে, একটা সময়ে আমার মনে হত যে তিনি আমাকে তার একজন বন্ধুর চোখে দেখেন…’

 তিনি কি তাহলে আপনাকে এখানে প্রেরণ করেন নি? ভাবনাটা সহসা খুররমের মনে উঁকি দেয়।

না। আমি তার নয়, আমার নিজের কৈফিয়ত দেয়ার জন্য এসেছি, আপনার আব্বাজানের নয়। সত্যি কথা বলতে, বেশ কিছুদিন যাবত তাঁর সাথে আমার একান্ত মোলাকাত হয়নি। আমি আপনাকে যা বলতে চাইছি তা আপনার কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।’ রো তার দুই হাত নিজের হার ছড়ির উপর রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসার ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। তিনি এখন আর আপনার বন্ধু নন। বাস্তবিক পক্ষে তিনি এখন আপনার শত্রু।

 ‘মেহেরুন্নিসা? ইংরেজ হতভাগার কি দেহের সাথে সাথে মস্তিষ্কবিকৃতিও শুরু হয়েছে? তাঁর এই উদ্ভট অভিযোগ বা সেটা করার সময় তার অসহিষ্ণুতা আর কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। আপনি ভুল করছেন, কামরান শীতল কণ্ঠে বলে। সম্রাজ্ঞী সম্পর্কে আমার স্ত্রীর ফুপুজান–আমার সন্তানদের পিতামহী। পারিবারিক বন্ধনের সাথে সাথে আমার স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসার কারণে আমি জানি এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার।

 ‘যুবরাজ, আমার কথা ভালো করে শোনেন। আমি শীঘ্রই ইংল্যান্ডে আমার স্বদেশে ফিরে যাচ্ছি। আমার শরীরের পক্ষে আর এখানকার আবহাওয়ার অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি দেশে ফিরে যাবার সময় অন্তত এটুকু সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যেতে চাই যে আমি আপনাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম যদিও আপনি আমার কথায় কর্ণপাত করেন নি। আপনি একটা কথা মনে রাখবেন যে বিদেশী হবার কারণে আমি আপনাকে এমন কথা অবলীলায় বলতে পারি যা মোগল কোনো অমাত্য আপনাকে বলার সাহস করবে না। আপনার আব্বাজান কেন আপনার উপর বিরূপ হয়েছেন নিজেকে কেবল এই একটা প্রশ্নই করেন… নিজেকে জিজ্ঞেস করেন কেন তিনি শাহজাদা শাহরিয়ারকে আজকাল বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন…’।

খুররম দূতমহাশয়ের অকপট কথায় চমকে উঠে। আমাদের মাঝে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির জন্ম হয়েছে, সে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে।

 না। পুরো ব্যাপারটায় সম্রাজ্ঞীর নিজের হাত রয়েছে। তিনি নিজেকে ভীষণ চতুর মনে করলেও দরবারের অনেকেই তাঁর দুরভিসন্ধি আঁচ করতে পেরেছে। আপনি যখন দাক্ষিণাত্যে ছিলেন তখন তিনি শাহজাদা শাহরিয়ারকে সম্রাটের সুনজরের আনতে তাঁর সাধ্যের ভিতরে যা কিছু রয়েছে সবকিছুই করেছেন। আমি পুরো বিষয়টা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি এবং নিজেকে প্রশ্ন করেছি কেন। শাহজাদা নিজে এমন কোনো বিশেষ যোগ্যতা বা প্রতিভার অধিকারী নয় এবং–যুবরাজ, আমায় মার্জনা করবেন, আপনার সৎ-ভাই সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করেছি বলে–আমার কানে এমন কথাও এসেছে যে তিনি নাকি খানিকটা স্থূলবুদ্ধির। সম্রাজ্ঞীর নিজের মেয়ের সাথে বাগদানের বিষয়টা যখন আমার কানে আসে, পুরো ব্যাপারটা আমার সামনে দিনের মত পরিষ্কার হয়ে যায়। সম্রাজ্ঞী ক্ষমতার জন্য লালায়িত। আপনি সম্ভবত জানেন না তিনি নিজে কত আদেশ জারি করেন, কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অনেকে তাকে পর্দার অন্তরালবর্তিনী সম্রাট হিসাবে অভিহিত করে থাকে। তিনি সম্রাটকে দিয়ে শাহরিয়ারকে–আপনি নন–তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করতে প্ররোচিত করছেন। আপনার আব্বাজানের ইন্তেকালের পরে তিনি হিন্দুস্তান শাসন করবেন। শাহজাদা শাহরিয়ার আর শাহজাদী তার ক্রীড়ানকে পরিণত হবে।

খুররম অপলক দৃষ্টিতে দূতমহাশয়ের আন্তরিক মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকে, চাঁদোয়ার নিচে ছায়ায় অবস্থান করার পরেও তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। রো এখন পর্যন্ত যা কিছু বলেছে সবই অসম্ভব, কিন্তু তারপরেও… আমার আব্বাজান কখনও তাকে এভাবে প্রভাবিত করার অনুমতি নিজের স্ত্রীকে দেবেন না, সে মন্থর কণ্ঠে বলে, যতটা না দূতমহাশয়ের উদ্দেশ্যে তাঁর চেয়ে বেশি যেন নিজেকেই শোনায়।

‘আপনার আব্বাজান বদলে গিয়েছেন। শাসনকার্য তাঁর কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। আপনি তার যেকোনো পরামর্শদাতাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। সম্রাজ্ঞী তাকে কাজ থেকে বিরত থেকে, প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহের উত্তর খুঁজতে তাকে প্ররোচিত করেন যা তাকে ভীষণভাবে ব্যস্ত রাখে, তাকে সুরাপান আর আফিম গ্রহণে প্ররোচিত করেন… তিনি সম্রাটকে পুরোপুরি নিজের উপরে নির্ভরশীল করে ফেলেছেন এবং তাঁর আস্থাকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অপব্যবহার করছেন।

 ‘আপনি বলছিলেন আপনি এখন আর আমার আব্বাজানের প্রিয়পাত্র নন। কি হয়েছিল?

 ‘আমি ঠিক নিশ্চিত নই। একটা সময় ছিল যখন সম্রাটের সাথে আমি প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আমি যখন প্রথমবার অসুস্থ হই, তিনিই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, উপশমের বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন এমনকি নিজের ব্যক্তিগত হেকিমকে একবার আমার চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমার প্রতি তার আগ্রহ ক্রমশ হ্রাস পায়। কিছুদিনের ভিতরেই আমি যখন সুস্থ থাকতাম তাঁর ডেকে পাঠাবার হার ক্রমশ পূর্বের চেয়ে হ্রাস পেতে থাকে এবং একটা সময় বন্ধই হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কেবল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেই তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে।

 ‘আমার আব্বাজান সম্ভবত আপনাদের বাণিজ্য শুল্ক হ্রাসের অনুরোধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। খুররম রো’র অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারে তাঁর মন্তব্য একেবারে জায়গামত আঘাত হেনেছে এবং সে কথা চালিয়ে যায়।

 ‘আপনি আমাকে সতর্ক করার সম্ভষ্টির কথা বলছিলেন। স্যার টমাস, কেন? আমার আব্বাজান তাঁর কোনো সন্তানকে প্রশ্রয় দেবেন সেটা নিয়ে আপনার কেন এত আগ্রহ?

 ‘আমার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ মক্কায় হজ্জযাত্রী পরিবহণে পর্তুগীজ আর আরব জাহাজের সাথে ইংরেজ জাহাজকে অনুমতি দিতে আমার অনুরোধ সম্রাট প্রত্যাখান করেছেন। আমার রাজা এতে দারুণ আশাহত হবেন। আপনার আব্বাজান যদি অনুমতি দিতেন তাহলে আরো অনেক ইংরেজ জাহাজ সুরাটে আসতো এবং সেখানে অবস্থিত আমাদের বাণিজ্য কুঠি তাহলে সমৃদ্ধি লাভ করতো। ইংল্যান্ড থেকে আমাদের জাহাজগুলো তাহলে আরো বেশি পরিমাণে পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতে পারতো এবং সেই সাথে হিন্দুস্তান থেকে আরবে বাণিজ্যের সাথে সাথে হজ্জযাত্রীদের বহন করতে পারতো কিংবা দেশে আরো বেশি পরিমাণে এখানের পণ্য নিয়ে যেতে পারতো। বাণিজ্য হওয়া উচিত প্রতিটা সভ্য দেশের আদর্শ এবং মোগল সাম্রাজ্যের সাথে ইংল্যান্ডের বাণিজ্য বিপুলভাবে সমৃদ্ধি লাভ করতো।

 খুররম ভাবে, বাণিজ্যের জন্য ফিরিঙ্গিগুলোর এই উৎসাহের বিষয়টা সে হয়তো কোনোদিনই ঠিকমত বুঝতে পারবে না। রো একজন অভিজাত ব্যক্তি কিন্তু তিনি যখন ব্যবসার লাভ নিয়ে কথা বলেন তখন বাজারের মামুলি যেকোনো ব্যবসায়ীর মত তাঁর চোখ মুখ চকচক করতে থাকে। দৃতমহাশয় উত্তেজনার বশে হাত থেকে নিজের লাঠিটা ফেলে দেয় এবং তিনি ঝুঁকে সেটা তুলে নেয়ার আগেই কথা বলতে শুরু করে।

 ‘আমি বড় আশা করে এসেছিলাম যে নিজেকে রক্ষা করতে আমার তথ্য আপনাকে সাহায্য করবে… যে আপনি পরবর্তীতে মনে রাখবেন যে একজন ইংরেজ আপনাকে সতর্ক করেছিল এবং কৃতজ্ঞ বোধ করবেন… এবং একদিন আপনি যখন সম্রাট হবেন, আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি আপনি হবেন, তখন আমার মাতৃভূমির দাবি আপনার সুনজরে থাকবে।

 ‘নিজেকে রক্ষা করা বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন?

 ‘সম্রাজ্ঞী নিজে একবার যখন এই সর্বনাশা খেলায় নেমেছেন তখন তিনি যতক্ষণ না আপনার এবং আপনার আব্বাজানের মাঝে একটা প্রকাশ্য বিরোধের সৃষ্টি করতে পারছেন–এমনকি যুদ্ধের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না–ততক্ষণ তিনি বিরত হবেন না। খুররমের চোখে মুখে ততক্ষণ সন্ধিগ্ধ অভিব্যক্তি দেখে রো হতাশ ভঙ্গিতে নিজের মাথা নাড়ে। যুবরাজ, আমি এতক্ষণ আপনাকে যা বলেছি তা একটু ভেবে দেখবেন। আমি আপনাকে দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে আমি একটা কথাও মিথ্যা বলিনি। আপনি যদি আমার কথা উপেক্ষা করেন তাহলে আখেরে আপনারই ক্ষতি হবে।

খুররমের মনের অবিশ্বাসের মেঘ ভেদ করে প্রথমবারের মত রো’র আন্তরিক কণ্ঠস্বর, তাঁর আবেগপূর্ণ প্রত্যয় প্রবেশ করে। মেহেরুন্নিসা… তাঁর পক্ষে কি আসলেই এমনটা করা সম্ভব–কোনো অবাধ্য কর্মচারী কিংবা উচ্চাকাঙ্খি অমাত্যর পরিবর্তে–যে আব্বাজানকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে? তিনি যদি আসলেই তার শত্রুতে পরিণত হয়ে থাকেন তাহলে প্রতিটা হতবাক করে দেয়া ঘটনা এতদিন যার কোনো ব্যাখ্যা ছিল না সবকিছুই অর্থবহ হয়ে উঠে। আমি বুঝতে পারছি না আপনাকে আমার বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা, কিন্তু আপনি যা বললেন সে বিষয়ে আমি ভেবে দেখবো।

 ‘আমি এতক্ষণ আপনাকে ঠিক এই কথাটাই বলতে চেয়েছি, সেই সাথে অবশ্য একটা অনুরোধও আছে। আমি আগেই বলেছি, আমি শীঘ্রই ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠবো কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পরিচারক নিকোলাস ব্যালেনটাইন হিন্দুস্তানে থেকে যেতে চায়। সে খুবই বিশ্বস্ত এবং বুদ্ধিমান আর যেকোনো মনিবের অধীনে কাজ করতে সক্ষম। আপনি কি অনুগ্রহ করে তাকে আপনার গৃহস্থালীর কোনো কাজে নিয়োজিত করবেন? যাতে গোপনে পর্যবেক্ষণ করতে এবং ইংল্যান্ডে আপনাকে সবকিছু লিখে জানাতে পারে?

 রো’র মুখে প্রথমবারের মত হাসির আভাস ফুটে উঠে। না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তাকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার জন্য রাজি করাতে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। যুবরাজ, আপনি যদি তাকে কাজে নিযুক্ত না করেন, আমি দরবারে আমার কোনো পরিচিত জনকে তাঁর বিষয়ে অনুরোধ করে দেখবো।

*

আসফ খানের স্বভাবজাত প্রাণবন্ত মুখমণ্ডল শান্ত দেখায় কথাগুলো শোনার সময়। খুররম কথা শেষ করার পরে, তিনি উত্তর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ সময় নেন। নিজের বোন সম্পর্কে এই মন্তব্য করাটা আমার পক্ষে কষ্টকর কিন্তু আমার মনে হয় দূতমহাশয় ঠিকই অনুমান করেছেন। মেহেরুন্নিসা আপনার শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। শাহরিয়ারকে সামনে রেখে সে একদিন শাসনকার্য পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছে এবং আপনি তাঁর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দূতমহাশয় যেমনটা বলেছেন, লোকজন দরবারে ক্ষমতার প্রতি তাঁর মোহের বিষয়ে আলোচনা করতে আরম্ভ করেছে।

 খুররম তাঁর দস্তানা পরা হাত দিয়ে সে যে স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটায় আঘাত করে। আমার আব্বাজান এতটা অন্ধ হন কীভাবে? এসব আলোচনার কথা কি তিনি জানেন না?

‘তিনি অবশ্যই এসব বিষয়ে অবগত কিন্তু এসব বিষয় উপেক্ষা করবেন বলে স্থির করেছেন। একমাস আগের কথা, মোল্লা শেখ হাসান শুক্রবার মসজিদে জুম্মার নামাযে নসিহত প্রদান করার সময় সম্রাট রাজকীয় আদেশ জারি করতে সম্রাজ্ঞীকে অনুমতি দেয়ায় তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি দাবি করেন একজন মহিলার এটা করার কোনো অধিকার নেই। তিনি সুরাপানের জন্য সম্রাটের সমালোচনা করেন, আপনার আব্বাজানের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখার জন্য এই অভ্যাসকে দোষারোপ করেন এবং ধর্মীয় পরামর্শদা, উলেমাদের, সভায় অংশ নেয়ার সময় তাকে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। মেহেরুন্নিসা সেই মোল্লাকে চাবকাতে চেয়েছিল কিন্তু সম্রাট সেবারের মত তাকে বিরত করেন এবং বিক্ষোভের পুরো বিষয়টা একেবারে উপেক্ষা করেন। মেহেরুন্নিসার বিরুদ্ধে কেবলমাত্র মোল্লারাই ক্ষুব্ধ হননি। সেনাপতিদের বেশ কয়েকজন–বিশেষ করে, গোয়ালিয়রের শাসক, ইয়ার, মোহাম্মদের মত বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকেই আমার কাছে অভিযোগ করেছে। যে তাঁদের কাছে প্রেরিত আদেশে সম্রাটের চেয়ে আজকাল তাঁর সীলমোহরই বেশি সংযুক্ত থাকে, অবশ্য তারা তাদের এই অসন্তোষ একান্ত আলাপচারিতার সময় ব্যক্ত করেছে। সম্রাটের সামনে একজন সাহস করে এ বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলায় পরেরদিন বাংলার জলাভূমির জ্বরজ্বালা অধ্যুষিত প্রদেশের একটা বসতিতে নিজের পদোন্নতি হয়েছে দেখতে পায়।’

একটু আগেই সন্ধ্যা হয়েছে। রো বিদায় নেয়ার পরে খুররম বৃথাই আব্বাজানের কাছ থেকে তাঁর দূর্গে যাবার শমন আগমনের জন্য অপেক্ষা করে। সে সারাদিন রো’র কথাগুলো নিজের মনে বারবার উল্টেপাল্টে দেখে, প্রতিবারই কথাগুলো আগের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। সশরীরে দূর্গে উপস্থিত হয়ে জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করার দাবি জানাতে সে যখন নিজের ঘোড়া নিয়ে আসতে বলবে সেই সময়ে আসাফ খানের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার কথা তার মাথায় আসে। নিজের বোনের মনে কি রয়েছে সে বিষয়ে তার চেয়ে ভালো আর কারো জানবার কথা নয়, এবং আরজুমান্দের আব্বাজান হবার কারণে নির্দ্বিধায় তাকে বিশ্বাস করা যায়।

 ‘আমার ক্ষতি করতে গিয়ে মেহেরুন্নিসা আরজুমান্দ আর আমাদের সন্তানদের অমঙ্গল সাধন করতে পারে। তার কাছে কি এর কোনো মূল্যই নেই?

না। জাহাঙ্গীরের ভালোবাসা অর্জন করার পরে, নিজের স্বার্থের বিষয়ে সে প্রথমে চিন্তা করে এবং তারপরেই কেবল নিজের মেয়ের কথা সে ভাবে। সে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহ্য করবে না… সে যেই হোক। তুমি দরবার থেকে দূরে ছিলে। আমি যা উপেক্ষা করতে অপারগ ছিলাম তুমি সেসব কল্পনাও করতে পারবে না। সে সম্রাটকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আমি যদিও আগ্রা সেনানিবাসের প্রধান সেনাপতি, আজকাল কদাচিত আমি তাকে দেখতে পাই। এমনকি আমার সাথে তাঁর যখন দেখা হয়, মেহেরুন্নিসা সবসময়ে সেখানে উপস্থিত থাকে। অন্য সেনাপতিদের মত আমায় প্রদত্ত আদেশও সেই জারি করে। তাকে দেয়া জাহাঙ্গীরের নতুন খেতাবের সীলমোহর সেসব আদেশে জ্বলজ্বল করে। আমার বোন এখন আর কেবল “নূর মহল”, “প্রাসাদের আলো” নয়–তোমার আব্বাজান তাকে নতুন খেতার দিয়েছে “নূর জাহান”, “জগতের আলো”। গিয়াস বেগের কি মনোভাব?

তার উপরে এমনকি তারও কোনো প্রভাব নেই। রাজকীয় কোষাগারের নিয়ন্ত্রক হবার কারণে, তিনি ভালো করেই জানতেন বাদখপুর জায়গীর তোমাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি করা হয়েছে। মেহেরুন্নিসার কাছে তিনি যখন এর কারণ জানতে চান কেন সেটা শাহরিয়ারকে দেয়া হয়েছে তিনি তাকে কড়া ভাষা বলেন এ বিষয়ে তাঁর মাথা না ঘামালেও চলবে। আমার আব্বাজান একজন নরম স্বভাবের মানুষ। আমি কখনও ভাবিনি যে তাকে এতটা ক্রুদ্ধ দেখতে পাব।’ আসফ খান কথা শেষ করে কিছুক্ষণ নিরবে বসে থাকেন, তারপরে জানতে চান, আপনি এখন কি করতে চান?

 ‘এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে দেয়া যায় না। আমি আমার আব্বাজানকে বাধ্য করবো আমার সাথে দেখা করতে, তিনি দেখা করতে চান বা না চান। আমি তাকে বোঝাব যে সম্রাজ্ঞী আমার নামে তাঁর কানে বিষ ঢালছে এবং এটাও যে আমি এখনও তার সেই বিশ্বস্ত সন্তানই রয়েছি। আমি দরবার থেকে অনেকদিন দূরে রয়েছি। তিনি আবার যখন আমায় দেখতে পাবেন আমার জন্য তার ভালোবাসা পুনরায় জাগ্রত হবে।’

 ‘যুবরাজ, সতর্ক থাকবেন। আবেগের সাথে যেন ভাবনাও আপনার কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করে। আপনি যদি আবেগকে যুক্তির উপরে স্থান দেন আপনার পরাজয় তাহলে কেউ আটকাতে পারবে না। দূতমহাশয়ের সতর্কবাণী সবসময়ে মনে রাখবেন। মেহেরুন্নিসার ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। সে যতটা ধূর্ত ঠিক ততটাই নির্ভীক।

‘আসফ খান, উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি এখন অন্তত জানি কে আমার শত্রু–আর সে কতটা ভয়ঙ্কর। যুদ্ধক্ষেত্রে আমার মানসিক অবস্থা যেমন থাকে তার চেয়ে বেশি আবেগ আমি নিজের ভেতরে প্রশ্রয় দেবো না। আমি আব্বাজানের জন্য পরিচালিত কোনো অভিযানে আজ পর্যন্ত পরাজিত হইনি। আমি এখন তার এই স্ত্রীকে আমাকে পরাস্ত করার সুযোগ দেবো না।

*

‘যুবরাজ, আমি দুঃখিত, সম্রাট আদেশ দিয়েছেন যে তাকে যেন বিরক্ত করা না হয়।

 মাজিদ খান, আমি জানি আপনি আমার আব্বাজানের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। তাঁর উজির হবার কারণে আপনি অবশ্যই সর্বান্তকরণে তার স্বার্থের বিষয়টা বিবেচনা করবেন, একই সাথে সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষা করাও আপনার দায়িত্ব। আমার আর আব্বাজানের মাঝে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে যা মোটেই আমার দ্বারা সৃষ্ট নয়। আমি যদি তার সাথে নিভৃতে কয়েক মুহূর্ত সময় অতিবাহিত করতে পারি আমি নিশ্চিত যে আমি তাঁর মন থেকে আমার আনুগত্যের ব্যাপারে যাবতীয় সংশয় দূর করতে এবং আমাদের সম্পর্কের মাঝে জন্ম নেয়া দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে পারবো।’

উজির খুররমের বাম কাঁধের উপর একটা নির্দিষ্ট স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকবার সময় তার লম্বা, কৃশকায় মুখমণ্ডলে চিন্তার ছাপ ফুটে থাকে। খুররম ভাবে, লোকটা জানে আমি ঠিক কথাই বলেছি, কিন্তু সে মনে মনে কৌতূহলী হয়ে উঠে লোকটা ম্রাজ্ঞীর আদেশের বিরোধিতা করে কিনা দেখতে। সে মাজিদ খানের বাহু আঁকড়ে ধরে, তাকে তার দিকে সামান্য ঘোরায় এবং তাঁর চোখের দিকে তাকাতে তাকে বাধ্য করে। আব্বাজান আমাকে ডেকে পাঠাবেন সেজন্য আমি আজ নিয়ে তিনদিন অপেক্ষা করছি। আমি খসরু নই। আমি ষড়যন্ত্র করি নি এবং আব্বাজানের সিংহাসন দখলের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। মাজিদ খান, আপনি সেটা নিশ্চয়ই জানেন। আমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আর সন্তানদের নামে দিব্যি দিয়ে বলছি যে আমি কেবল ন্যায়বিচারের প্রত্যাশী। দেখুন…’ খুররম উজিরের হাত ছেড়ে দেয় এবং এক পা পিছিয়ে এসে কোমরের পরিকর থেকে নিজের বাঁকানো খঞ্জরটা বের করে সেটা বিস্মিত মাজিদ খানের হাতে তুলে দেয়। এটা আপনার কাছে রাখেন–এবং সেই সাথে আমার তরবারি।’

না, না, যুবরাজ। উজিরকে এবার পুরোপুরি অসহায় দেখায়। আপনার অভিপ্রায় সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তারপরে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে, যেন ভীত যে দূর্গে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষেও কেউ আড়িপেতে থাকতে পারে, তিনি তাঁর কণ্ঠস্বর নামিয়ে আনেন এবং বলেন, যুবরাজ, প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় সম্রাট নিয়মিত দূর্গপ্রাকারে তার কবুতরের খোপের কাছে তাঁর পাখিদের ফিরে আসা দেখতে যান। কবুতরগুলো ভয় পেতে পারে ভেবে তিনি সেখানে যাবার সময় সাথে কোনো প্রহরী বা পরিচারক রাখেন না। সম্রাজ্ঞী কখনও কখনও তার সাথে থাকেন কিন্তু আজ রাতে তিনি সম্রাটের বাসস্থানে একটা বিশেষ বিনোদনের আয়োজন করেছেন এবং তিনি, আমি নিশ্চিত, ব্যক্তিগতভাবে পুরো আয়োজনের তদারকি করবেন।

*

পশ্চিমের আকাশ গোলাপি বর্ণ ধারণ করতে শুরু করে খুররম যখন দূর্গের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত একটা সংকীর্ণ, খাড়া সিঁড়ি বেছে নিয়ে সেখান দিয়ে দূর্গপ্রাকারের উদ্দেশ্যে উঠতে শুরু করে যেখানে ছেলেবেলায় সে আর তার ভাইয়েরা একসময় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতো। মাকড়সার জাল আর ধূলো দেখে বোঝা যায় যে আজকাল খুব কম লোকই সিঁড়িটা ব্যবহার করে এবং সে কারো কৌতূহলের উদ্রেক না ঘটিয়ে, বস্তুতপক্ষে সবার অলক্ষ্যে দূর্গপ্রাকারে পৌঁছে যায়। সে তাঁর সামনে প্রায় একশ গজ দূরে চোঙাকৃতি কবুতরের খোপ দেখতে পায় এবং তার পেছনে একটা খিলানাকৃতি দরজার ভিতর দিয়ে একটা প্রশস্ত সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে সে জানে নিচের রাজকীয় আঙিনায় গিয়ে সিঁড়িটা শেষ হয়েছে। সে নিজের চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে কোথাও একজন প্রহরীও নেই।

সে কবুতরের খোপের আরেকটু কাছে এগিয়ে যায় তারপরে কি মনে করে সামান্য পিছিয়ে এসে ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করে। সে নিচের আঙিনায় মশাল আর তেলের প্রদীপ জ্বালাবার সময় পরিচারকদের গলার আওয়াজ শুনতে পায়। সে তারপরে অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের বুকে সহসা আলোর একটা ঝলকানি দেখতে পায় যার মানে দেওয়ানি আমের পাশের প্রধান আঙিনায় অবস্থিত অতিকায় আকাশ দিয়া–বিশ ফিট উঁচু একটা সোনালী দণ্ডের মাথায় অবস্থিত একটা বিশালাকৃতির তেলপূর্ণ পাত্র-জ্বালানো হয়েছে। দৃশ্যটা তার মাঝে আকষ্মিক একটা বেদনার জন্ম দেয়। প্রদীপের আলোর কমলা রঙের আভা থেকে শুরু করে রাতের বাতাসে ভাসতে থাকা ধূপের গন্ধ, সবকিছু কত পরিচিত। এটাই তাঁর পৃথিবী, তার স্থান যেখানে তাঁর থাকবার কথা। তারপরে খিলানাকৃতি দরজার নিচে দিয়ে খালি-মাথায় দীর্ঘদেহী একটা অবয়ব আন্দোলিত আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত হয় এবং কবুতরের খোপের দিকে এগিয়ে আসে।

আব্বাজান! জাহাঙ্গীরের দিকে খুররম দৌড়ে যেতে, যার ডান হাত সাথে সাথে নিজের কোমরের খঞ্জরের দিকে উড়ে যায়। খুররম আধো-আলোয় ইস্পাতের শানিত ঝিলিক খেয়াল করে। আব্বাজান… আমি, খুররম। সে তাঁর পায়ের কাছে নিজেকে ছুঁড়ে দেয় যা কিছু বলবে বলে ঠিক করে ছিল সব শব্দ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সে জাহাঙ্গীরের হাত তার মাথা স্পর্শ করবে বলে আশা করে, কিন্তু মাথায় কিছুই অনুভব করে না। সে মুখ তুলে উপরের দিকে তাকিয়ে সম্রাটের ক্রোধে টানটান হয়ে থাকা মুখমণ্ডল দেখতে পায়।

 ‘তোমার এত বড় স্পর্ধা আততায়ীর মত আড়াল থেকে আমার পায়ের কাছে লাফিয়ে পড়ো?’ জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর খানিকটা কর্কশ শোনায়, যেন এইমাত্র তিনি পান করে এসেছেন।

খুররম তাঁর আব্বাজানের এহেন কুপিত মূর্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে ধীরে ধীরে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমি কোনো আততায়ী নই, আমি উপরের আশা করে, যায়। সে জাহকছু বলবে বলেও হুররম। সে আপনার সন্তান। আপনার সাথে নিশ্চয়ই আমার দেখা করার অধিকার আছে।

 ‘তোমার কোনো অধিকার নেই।’ জাহাঙ্গীর এতক্ষণ পরে খঞ্জরের ফলাটা পুনরায় ময়ানে ঢুকিয়ে রাখে।

 ‘আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। তিনদিন পূর্বে আগ্রায় পৌঁছাবার পর থেকেই আমার সাথে দেখা করার জন্য আমি বারবার আপনার কাছে অনুরোধ জানিয়েছি। আপনি কেন আমার আবেদনে সাড়া দেননি?”

কারণ আমি তোমার মুখদর্শন করতে চাই না, ঠিক যেমন দাক্ষিণাত্যে আমি তোমায় তোমার নেতৃত্ব পরিত্যাগ করার আদেশ দেইনি। তুমি ঔদ্ধত্যের বশবর্তী হয়ে তোমার যা ইচ্ছে তাই করছে।

 ‘আমি আগ্রা ফিরে এসেছি কেবল একটা বিষয়ে পরিষ্কার হতে যে আপনাকে অসন্তুষ্ট করার মত আমি কি করেছি। আপনার কাছ থেকে আগত প্রতিটা রাজকীয় বার্তা যখন নতুন নতুন অবজ্ঞা বয়ে নিয়ে আসে তখন আমার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পার্সীদের বিরুদ্ধে আপনি কেন শাহরিয়ারকে পাঠালেন? কেন আপনি তাকে আমার জায়গীর দান করলেন?

 ‘আমায় প্রশ্ন করার কোনো অধিকার তোমার নেই।’

 ‘আপনি যদি আমায় প্রশ্ন করার অধিকার না দেন তাহলে আমায় অন্তত অনুমতি দেন প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসাবে আমি যা বিশ্বাস করি সেগুলো যেন আপনাকে বলতে পারি। আমার ধারণা কেউ হয়তো আমার বিরুদ্ধে আপনাকে খেপিয়ে দিয়েছে।’

 ‘কে?

 খুররম সামান্য সময়ের জন্য ইতস্তত করে। মেহেরুন্নিসা।

জাহাঙ্গীর সামনের দিকে এক পা এগিয়ে আসে এবং খুররম মর্মাহত হয়ে দেখে তাঁর দাক্ষিণাত্যে অবস্থানের সময় গত আঠারো মাসে তার আব্বাজানের মাঝে কি বিপুল পরিবর্তন এসেছে। তার চোখ দুটো রক্তজবার মত লাল এবং তাঁর একদা দৃঢ় চোয়ালের উপরে ত্বক এখন শীথিলভাবে ঝুলে রয়েছে। সম্রাজ্ঞী আপনার মাঝে আমার জন্য–একটা সময়–যে ভালোবাসা ছিল তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত, সে কথা চালিয়ে যেতে নিজেকে বাধ্য করে। তিনি আপনার প্রতি আমার প্রভাবকে ভয় পান এবং আমার প্রতি আপনার মমতাকে শাহরিয়ারের সাথে প্রতিস্থাপিত করতে আগ্রহী যার নিজের কোনো স্বাধীন মতামত নেই। সে যখন তার জামাতা হবে তখন নিজের কন্যার মত তার উপরও সম্রাজ্ঞীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ অধিষ্ঠিত হবে… এবং সেই সাথে আপনার উপরেও!

‘অনেক হয়েছে! তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপাট হয়েছে? তোমার সাথে আরজুমান্দ বানুর বিয়ের দেয়ার জন্য সম্রাজ্ঞী স্বয়ং আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন এবং প্রথমবারের মত স্বাধীনভাবে তোমার উপরে সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করতেও তাঁরই আগ্রহ বেশি ছিল। ব্যাপারটা মোটেই এমন নয় যে তিনি তোমায় ভয় পান বরং তুমিই আমার প্রতি তার ভালোবাসা এবং তার প্রভাবকে সহ্য করতে পারছে না। আমার মরহুম আব্বাজান একজন মহান মানুষ ছিলেন কিন্তু তুমি যখন একেবারে ছোট ছেলে তখন তোমায় মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয়াটা তার অনেকগুলো ভুলের মধ্যে অন্যতম। আমার উত্তরাধিকারী হওয়া তোমার এক্তিয়ারের ভিতরে পড়ে এমন একটা ধারণা নিয়ে তুমি বড় হয়েছে।

না, কিন্তু সেরকম ভাবতে আপনিই আমায় সাহস যুগিয়েছেন। আপনি আমায় শাহজাহান উপাধি দিয়েছেন এবং লাল তাবু স্থাপনের অধিকার।

 ‘কিন্তু পরবর্তী মোগল সম্রাট হিসাবে আমি তোমায় মনোনীত করিনি। আমার সন্তানদের ভিতরে আমার উত্তরাধিকারী কে হবে সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব। দাক্ষিণাত্যে তোমার উদ্ধত আচরণের কথা আমার কানে এসেছে, কীভাবে তুমি ইতিমধ্যে এমন আচরণ শুরু করেছিলে যেন সিংহাসন তুমি পেয়ে গেছো…’

 ‘এসব কার কাছে শুনেছেন?”

 ‘আমি তোমায় আগেই বলেছি আমায় পাল্টা প্রশ্ন করবে না। তুমি যেভাবে আগ্রায় ফিরে এসেছে এবং জোর করে যেভাবে নিজেকে আমার সামনে হাজির করেছে তাতে তোমার অহঙ্কার, হঠকারী আর বেপরোয়া উচ্চাকাঙ্খ সম্বন্ধে আমি যা কিছু ভয় করেছিলাম সবকিছুকে কি প্রমাণিত করে নি? জাহাঙ্গীরের পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। খুররম যখন তাঁর দিকে তাকায় তার মনে হয় যেন তাঁর আব্বাজান একজন অচেনা আগন্তুকে পরিণত হয়েছেন। সে আশা করেছিল একটা সময়ে তিনি যেমন তাকে ভালোবাসতেন সে তার সেই ভালোবাসাকে পুনরায় জাগ্রত করবে কিন্তু তার উপস্থিতি মনে হচ্ছে তাকে কেবল ক্রুদ্ধ করে তুলছে। একটা অসহায়, হতাশ অনুভূতি যার অভিজ্ঞতা যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর কখনও হয়নি ধীরে ধীরে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নেয় শেষ একবার অনুরোধ করবে।

‘আমি ফিরে এসেছি কারণ আমি আপনার মুখোমুখি দাঁড়িব্বেলতে চেয়েছিলাম যে আমি আপনার অনুগত সন্তান। এটাই আমার বক্তব্য। তার কথাগুলো কি জায়গামত স্পর্শ করতে পেরেছে? জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তি একটু যেন মনে হয় নরম হয়। আমিও সন্তানের পিতা। খুররম সুবিধাজনক পরিস্থিতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। আগামী বছরগুলোতে তারা হয়ত এমন অনেক কিছুই করবে যা আমাকে প্রীত করবে না কিন্তু আমি আশা করি তাদের আমি সবসময়েই ভালোবাসবো এবং তাদের প্রতি সমান আচরণ করতে চেষ্টা করবো। আব্বাজান, আমি আপনার কাছে কেবল এটাই চাই–ন্যায়বিচার। আমি অবশ্যই কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে তার কানে পায়ের শব্দ ভেসে আসে এবং তারপরেই একজন কর্চি ডানহাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে খিলানাকৃতি দরজার নিচে দিয়ে আবিভূর্ত হয় কারণ ইতিমধ্যে চারপাশ প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে।

 ‘জাঁহাপনা, সম্রাজ্ঞী জানিয়েছেন যে বাদ্যযন্ত্রীর দল প্রস্তুত।’

 ‘তাকে গিয়ে বলল আমি শীঘ্রই তাঁর সাথে যোগ দেব।

তরুণ পরিচারক বিদায় নিতে জাহাঙ্গীর কথা বলতে আরম্ভ করে। তুমি যা বলেছো আমি সেটা বিবেচনা করে দেখবো। এখন যাও, এবং আমি পুনরায় ডেকে না পাঠানো পর্যন্ত তুমি দূর্গে আসবে না।’ তিনি কথা শেষ করেই গোড়ালির উপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। খুররম একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে কবুতরের ডাক শুনে। সে এবার হাভেলি ফিরে যাবে এবং তার আব্বাজানের আদেশ অনুযায়ী অপেক্ষা করবে। সে এছাড়া আর কি করতে পারে?

*

‘আপনাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। আপনার কোনো কবুতর কি আজ ফিরে আসে নি?’ মেহেরুন্নিসা জানতে চায়।

তুমি আমার মনমর্জি ভালোই বুঝতে পার। না, আমাকে আমার কবুতরেরা বিরক্ত করে নি। আমি যখন দূর্গপ্রাকারে গিয়েছিলাম খুররম সেখানে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।

‘খুররম? তার এতবড় স্পর্ধা!

‘আমিও তাকে ঠিক এই কথাই বলেছি।’

 ‘সে কি চায়?

‘জানতে চেয়েছিল কেন আমি তার সাথে দেখা করছি না এবং সে কীভাবে আমার অসন্তোষের কারণ হয়েছে সেটা জানতে।’

মেহেরুন্নিসা ভ্রূকুটি করে। কামরার ভেতরে একজন পরিচারিকা প্রবেশ করে, নিঃসন্দেহে তাঁর কাছে জানতে এসেছে বাইরের বারান্দায় বাদ্যযন্ত্রীরা এখন তাঁদের বাজনা শুরু করবে কি না, এবং সে হাতের ইশারায় মেয়েটাকে বিদায় করে। সে বুঝতে পারে নি যে খুররম তাঁর আব্বাজানের কাছে সরাসরি অনুরোধ করার কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারবে। তার অভিপ্রায় ছিল যে আগামী আরও কয়েকদিন পরে–যত বিলম্ব হবে ততই মঙ্গল এতে করে খুররমের অবমাননা আরও বেশি হবে–জাহাঙ্গীর তাকে দেওয়ানি আমে ডেকে পাঠাবে এবং পুরো দরবারের সামনে তাঁর দাক্ষিণাত্যের অভিযান পরিত্যাগ করার কারণে তাকে তিরষ্কার করবে এবং তাকে অবিলম্বে সেখানে ফিরে যাবার আদেশ দেবে। খুররম এমন একটা প্রকাশ্য দরবারে জাহাঙ্গীর আবেগতাড়িত হতে পারে এমন কিছুই বলার সুযোগ পাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যুবরাজকে সে ঊনজ্ঞান করেছিল।

 খুররমের অনেক দোষের ভিতরে একটা হল অনুমিতি,’ সে বলে।

 ‘তাকে দেখে বাস্তুবিকই সঙ্কটাপন্ন বলে মনে হয়েছে।

কারণ সে জানে যে তাঁর দুষ্টাচরণ ফাঁস হয়ে গিয়েছে। সে আপনার সহানুভূতি উদ্রেক করার চেষ্টা করেছিল।

 ‘সে দাবি করেছে সে কোনো অন্যায় করে নি… যেকোনো শত্রু চেষ্টা করছে তাকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে।

 ‘কোনো শত্রু? কে হতে পারে?

 ‘তুমি।’ জাহাঙ্গীর মাথা উঁচু করে এবং সরাসরি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 ‘কিন্তু আমি কেন তাঁর শত্রু হতে যাব?

 ‘সে দাবি করেছে যে তুমি ক্ষমতার জন্য লালায়িত এবং ভীত সে তোমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মেহেরুন্নিসা টের পায় তার হৃৎপিণ্ড প্রবল গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে কিন্তু সে জোর করে নিজের অভিব্যক্তি সংযত রাখে, এমনকি খানিকটা অবজ্ঞার ভাবও সেখানে ফুটিয়ে তোলে। আমি চিন্তা করিনি তার উচ্চাকাঙ্খ তাকে এতটা বেপরোয়া করে তুলতে পারে। আপনার জন্য আমার ভালোবাসা সম্পর্কে সে জানে, সে আরও জানে কীভাবে আমি আপনার কাছ থেকে প্রসাশনিক দায়িত্বভার কিছুটা গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি যাতে আপনি সাম্রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করার সুযোগ পান। সে এজন্যই আমার মাধ্যমে আপনাকে আক্রমণ করার প্রয়াস নিয়েছে।

 ‘কিন্তু সে এটা কেন করবে?

 ‘আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?’ জাহাঙ্গীরের হাত মেহেরুন্নিসা নিজের হাতে তুলে নেয়। আপনাকে সে যদি এমন কথা বলার স্পর্ধা দেখাতে পারে তাহলে কল্পনা করেন অন্যদের কাছে সে কতটা জঘন্য কথা বলতে পারে! একজন রমণী আপনাকে শাসন করে এমন দাবি করে সে আসলে বোঝাতে চাইছে যে আপনি আর শাসনকার্য পরিচালনা করার মত সুস্থ নন। সে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সৃষ্টি করেছে সিংহাসন দখলের জন্য একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করতে।’

 কিন্তু বিষয়টা যদি তাই হবে তাহলে কেন আগ্রা এসেছে, কেন সে আমার কাছে এসেছে? দাক্ষিণাত্যে তাঁর অধীনে একটা সেনাবাহিনী রয়েছে যা সে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধোদ্যোগে নিয়োজিত করতে পারতো।

 ‘সবকিছুই তার বিশদ পরিকল্পনার অংশ।’ মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরের হাত ছেড়ে দেয় এবং একটা কাঁচের বোতল তুলে নেয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। সে বোতলের মুখ থেকে ছিপি খুলে নিয়ে ভেতরের তরল একটা পানপাত্রে ঢালে এবং পাত্রটা তাঁর হাতে তুলে দেয়। এই পানীয়টা সামান্য পান করেন। এটা আপনার অস্থিরতা প্রশমিত করবে।’

 জাহাঙ্গীর সুরায় চুমুক দিয়ে এর হাল্কা তিতা স্বাদ থেকে বুঝতে পারে আফিমের বড়ি মেশান রয়েছে। পানীয়টা নিমেষের ভেতরে তাঁর পাকস্থলীকে উষ্ণ করতে শুরু করে এবং কয়েক মুহূর্ত পরে সে আরেক চুমুক দেয়, বেশ বড় চুমুক, তাঁর দেহের ভিতর দিয়ে অলক্ষ্যে প্রবাহিত হতে থাকা বিকিরণ সে উপভোগ করে। একটা নিচু বিছানার উপরে বসে মাথার নিচে রেশমের কারুকাজ করা একটা তাকিয়া রেখে সে পানপাত্রের তরলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, লক্ষ্য করে টকটকে লাল তরল কীভাবে আলোয় ঝলসে উঠে যখন সে পাত্রটা নিজের খুব একটা সুস্থির বলা যাবে না হাতে ধরে থাকে। বলতে থাকো…’

‘আমি যা বলছিলাম, আমার মনে হয় খুররম সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা করেছে। দাক্ষিণাত্যে অবস্থানের সময় সে কোনো পদক্ষেপ নেয় নি কারণ সে দরবারের মনোভাব পরখ করে দেখতে চেয়েছিল। সে আগ্রা পৌঁছাবার পর থেকে সম্ভবত এটাই করছে–আমি একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলতে পারি যে মাজিদ খানের সাথে সে আলাপ করেছে। সে সম্ভবত আমাদের দু’জন সম্পর্কে কুৎসা রটনার সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। তাঁর আপনাকে খোঁজার পেছনের কারণ এমনটাও হওয়া বিচিত্র না যাতে করে সে বলতে পারে যে সে আপনার কাছে আবেদন করার পরেও আপনি তার কথা শোনেন নি। আমি নিশ্চিত অচিরেই দাক্ষিণাত্য থেকে তার বাহিনী এসে উপস্থিত হবে। শাহরিয়ারের সাথে উত্তরপশ্চিমে আপনার অন্য বাহিনীগুলো অবস্থান করায়, আপনি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছেন।

জাহাঙ্গীর পাত্র থেকে আরেকটু সুরা পান করে কিন্তু কোনো মন্তব্য করে না।

 ‘নিজের উচ্চাকাঙ্খ গোপন করার ব্যাপারে খুররম খসরুর চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত, কিন্তু সেও একই জিনিষ চায়।’ মেহেরুন্নিসা এগিয়ে এসে জাহাঙ্গীরের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। একজন পিতার কাছে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে না যখন তার আপন সন্তানেরা অবিশ্বাসী আর অবাধ্য হয়ে উঠে। এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা যখন পরিবারগুলো বিভক্ত হয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে অথচ তাদের তখন একত্রিত হয়ে শক্তির সন্ধান করা উচিত কিন্তু এটাই জগতের রীতি। আপনাকে এই পরিস্থিতি অতীতে একবার মোকাবেলা করতে হয়েছিল এবং এখন আবার আপনাকে ঠিক তাই করতে হবে। তার কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ শোনায়। ‘উচ্চাকাঙ্খ একটা খুবই ভালো জিনিষ, কিন্তু বিপুল সম্মানের অধিকারী হবার বাসনা একজন মানুষকে সহজেই অসম্মানজনক কর্মকাণ্ডে প্রবৃত্ত…’

জাহাঙ্গীর ভাবে, মেহেরুন্নিসা ঠিকই বলেছে। শেখ সেলিম চিশতি কি বহু বছর আগে ঠিক একই শব্দগুলো ব্যবহার করেন নি? খসরু আর খুররমের অবাধ্যতার বিষয়টা সুফি সাধক আগেই দেখতে পেয়েছিলেন এবং মেহেরুন্নিসা এখন যেমন তাকে সতর্ক করতে চেষ্টা করছে ঠিক সেভাবে তিনিও তাকে হুশিয়ার করতে চেয়েছিলেন।

 ‘আমার এখন কি করা উচিত? তার চোখের কোণে আত্মকরুণার অশ্রু জমতে শুরু করলে সে এক চুমুকে পানপাত্রটা খালি করে ফেলে।

 ‘খুররমকে গ্রেফতার করেন।

*

খুররম আর আরজুমান্দ সাদা কাপড় বিছানো একটা নিচু টেবিলের সামনে আসন পিড়ি হয়ে বসে আছে। তাদের সামনে রাখা খাবারের পদগুলো থেকে–তেতুল দিয়ে রান্না করা ফিজ্যান্টের মাংস, শুকনো ফল দিয়ে ঠাসা ঝলসানো ভেড়ার মাংস এবং রুটি তন্দুর থেকে সদ্য বের করে আনায় এখনও ধোয়া বের হচ্ছে–রুচিকর ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। খুররমের যদিও কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না এবং আরজুমান্দের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সেও একই রকম বোধ করছে। আব্বাজানের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিবরণ তাকে একদম কাঁপিয়ে দিয়েছে।

 ‘তোমার অবশ্যই একটু কিছু মুখে দেয়া উচিত…’ সে কথা বলতে আরম্ভ করে কিন্তু শেষ করে না। আরজুমান্দের এক পরিচারিকা পর্দা দেয়া দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে ভেতরে প্রবেশ করে।

 ‘যুবরাজ, আমায় মার্জনা করবেন, কিন্তু আসফ খানের কাছ থেকে আপনার জন্য একটা জরুরি বার্তা এসেছে।’

‘আমার আব্বাজান? আরজুমান্দ খুররমের দিকে ঘুরে বিস্মিত চোখে তাকায়, যে লাফিয়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে খাবারের বেশ কয়েকটা পাত্র মাটিতে ফেলে, এবং পরিচারিকার হাত থেকে এক ঝটকায় বার্তাটা নেয়। সে সীলমোহর ভেঙে চিঠিটার ভাঁজ খোলার সময় মনে মনে ভাবে যে জাহাঙ্গীরের নমনীয় হবার বিষয়ে আসফ খান কি কিছু জানতে পেরেছেন। কিন্তু দ্রুত হাতে মুসাবিদা করা শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করার সাথে সাথে তার মনে হয় যেন শরীরের শিরা উপশিরায় রক্ত প্রবাহ বুঝি বরফ হয়ে গিয়েছে: সম্রাট তোমায় অবিলম্বে গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছেন। তোমায় অবশ্যই এখান থেকে পালাতে হবে। প্রহরীদের কাপ্তান, যে আমার বন্ধুও বটে, আমায় লিখিত আদেশ দেখিয়েছে। সে আদেশ পালন করতে অশ্বারোহী দল পাঠাতে সামান্য বিলম্ব করবে কিন্তু খুব বেশিক্ষণ সে অপেক্ষা করতে পারবে না। আমি দোয়া করি এই বার্তা যেন সময়মত তোমার হাতে পৌঁছে। বার্তাটা পড়া শেষ হওয়া মাত্র পুড়িয়ে ফেলবে নতুবা এর বিষয়বস্তু হয়ত আমাকে এবং আমার কাপ্তান বন্ধুকে ধ্বংস করে ফেলবে। খুররম এতটাই বিস্মিত হয় যে কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বলতে বা কাজ করতে পারে না এবং পলকহীন চোখে হাতে ধরে থাকা কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কোনোভাবে যদি সে শব্দগুলো গায়েব করতে পারতো।

 ‘খুররম… কি এটা? আরজুমাদের কণ্ঠস্বর তাকে নিজের মাঝে ফিরিয়ে আনে। সে যুদ্ধক্ষেত্রের মত সহজাত প্রবৃত্তির বশে তেলের প্রদীপের আগুনের শিখায় কাগজের টুকরো ধরে রাখে। সে তারপরে আরজুমান্দের হাত ধরে তাকে তুলে নিজের পায়ে দাঁড় করায়। আমার আব্বাজান আমায় গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছেন। আমাদের সন্তানদের নিয়ে এসো। আমরা এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাব।’

আরজুমান্দের চোখ বড় বড় হয়ে যায় কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের ব্যগ্রতা তাকে বলে যে এটা প্রশ্ন করার সময় না এবং সে কালক্ষেপণ না করে দৌড়ে বাচ্চাদের কক্ষের দিকে যায়। খুররম দরজার ভিতর দিয়ে তাকে অনুসরণ করে এবং তারপরে হেরেম থেকে বের হয়ে নিজের দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, আমাদের সবগুলো ঘোড়াকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করো। সদর দরজায় যেকোনো মুহূর্তে সম্রাটের অনুগত সৈন্যদের উপস্থিত হবার শব্দ শোনার আশঙ্কার মাঝে, সে দৌড়ে নিজের কক্ষের দিকে যায় এবং গলায় ঝোলানো একটা চাবি হাতে নিয়ে একটা রঙ করা সিন্দুক খোলে। সিন্দুকের ভেতর থেকে রত্নপাথরের একটা ছোট বাক্স আর স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটা থলে তুলে নিয়ে সেগুলো একটা চামড়ার বগলিতে ঢুকিয়ে সেটা সে নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়, তারপরে নিজের তরবারিটা নিয়ে সেটা কোমরে বাধতে বাধতে হাভেলীর মূল আঙিনার দিকে দৌড়াতে শুরু করে। আরজুমান্দ ইতিমধ্যে মাথায় একটা শাল জড়িয়ে নিয়ে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার পাশে, অশ্রুসজল দারা শুকোহর হাত ধরে জাহানারা দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং শাহ্ সুজা আর রওসোন্নারা আয়াদের কোলে। একজন সহিস শেষ ঘোড়াটায় পর্যাণ এবং লাগাম পরিয়ে জটার পেটের কাছে নিচু হয়ে পর্যাণ আঁটকে রাখার চামড়ার বেল্টের আঁটুনি পরীক্ষা করে দেখে। সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালে তাঁর কাজ শেষ হবার সাথে সাথে খুররম চিৎকার করে যাত্রার আদেশ দেয় এবং খয়েরী রঙের একটা উঁচু ঘোড়ায় আরোহণ করে তার সাথে ভ্রমণের নিমিত্তে আরজুমান্দকে পেছনে তুলে নেয়। সে পেছন থেকে শক্ত করে খুররমের কোমড় জড়িয়ে ধরে থাকে যখন সে ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে পুতগতিতে সদর দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায় এবং হাভেলী থেকে বের হয়ে আসে। সে আবার কবে এটা দেখতে পাবে? তার পেছনে এবং একই গতিতে ঘোড়া তাড়িয়ে নিয়ে অনুসরণ করছে তার পরিবার-পরিজনের প্রায় ডজনখানেক সদস্য। দারা শুকোহ্ আর জাহানারা খুররমের দু’জন কর্চির ঘোড়ার পর্যাণের সামনের উঁচু অংশে বসে রয়েছে আর রওসোন্নারা এবং শাহ্ সুজা খুররমের দেওয়ান, শাহ্ গুলের চওড়া কাঁধবিশিষ্ট বে ঘোড়ার দু’পাশে ঝোলান খড়ের তৈরি ঝুরিতে রয়েছে।

খুররম কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে দূর্গ থেকে নেমে আসা ঢালু পথটায় আলোর ঝলক দেখতে পায়। মশাল বহনকারী অশ্বারোহী দল নয়তো? না, এগুলো কেবল ধাতব কয়লাদানিতে দপদপ করতে থাকা আগুনের শিখা যা সাধারণত দূর্গের প্রবেশপথ গুলোকে আলোকিত করতে জ্বালানো হয়ে থাকে। সে কান খাড়া করে পিছু ধাওয়া করার শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। নিজের জন্য না পরিবারের কথা চিন্তা করে সে ভয় পায়। তাকে যদি বন্দি কিংবা হত্যা করা হয় তাহলে তাদের কি নিয়তি হবে? আরজুমান্দ তখনই তাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলে সে একটা ক্ষিপ্ত চিৎকার শুনতে পায় এবং রাস্তার পাশের বস্তি থেকে দুটো বিশালাকৃতির কুকুর দৌড়ে এসে খুররমের ঘোড়ার চারপাশে লাফাতে থাকে যতক্ষণ না তাঁরা জন্তুগুলোকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যায়। তাদের চারপাশের অন্ধকার প্রেক্ষাপট শীঘ্রই নিরব হয়ে যায় কেবল যমুনার তীর দিয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকা তার ক্ষুদ্র মরীয়া দলটার ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া যায়। সে অবশ্য এখনও বিপদ কেটে গিয়েছে বলে ভাবতে পারে না। সে তার ঘোড়ার গলার কাছে নিচু হয়ে থাকে, তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন কেবল একটা বিষয়–ভোরের আলো ফোঁটার আগেই সে আর তার পরিবারের আগ্রা থেকে যতটা দূরে সম্ভব সরে আসবার বিষয়টা নিশ্চিত করা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *