১.১৪ ঘরের শত্রু বিভীষণ

১.১৪ ঘরের শত্রু বিভীষণ

‘জাঁহাপনা, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমায় মার্জনা করবেন। জাহাঙ্গীরের কক্ষে প্রবেশ করার সময় মজিদ খান মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে। দাক্ষিণাত্য থেকে আরেকটা বার্তা নিয়ে রাজকীয় এক বার্তাবাহক এসেছে। আমি সেটা নিয়ে এসেছি।’

 রওসোন্নারার আরোগ্য লাভের খবর নিয়ে আগত বার্তার পরে গত কয়েক সপ্তাহ জাহাঙ্গীর খুররমের কাছ থেকে কোনো সংবাদ পায় নি এবং তিনি জানতে উদগ্রীব হয়ে আছেন যে খুররম যেমনটা ধারণা করেছিল তার অভিযান কি আসলেই ততটা সাফল্যের সাথে অগ্রসর হচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয় এবং সীলমোহর ভাঙে। আমি এখনও যদিও মালিক আম্বারকে বন্দি করতে সমর্থ হই নি আমি তাঁর সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেছি এবং তাঁর সম্পদ কুক্ষিগত করেছি, খুররম তাঁর বলিষ্ঠ হাতে চিঠিতে লিখেছে। নদীর বাঁকে আবিসিনীয় সেনাপতির সৈন্যদের সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করার পরে তার শেষ সর্বশেষ প্রফুল্ল শব্দচয়ন হল, আমাদের শত্রু লাথি খাওয়া কুকুরের মত নিজের এলাকায় পালিয়ে গিয়েছে। আমার বাহিনীকে একত্রিত আর পুনরায় রসদ মজুদ করেই আমি আবার তাকে ধাওয়া করবো। আমার বিজয় নিয়ে আমার ভিতরে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই।

জাহাঙ্গীর আনন্দিত হয়ে মুচকি হাসে। মাজিদ খান, সুখবর। যুদ্ধক্ষেত্রে আমার পুত্র মালিক আম্বারকে পরাস্ত করেছে এবং পরাস্ত হয়ে মালিক আম্বার পালিয়েছে। সম্রাজ্ঞীকে খবরটা আমার জানাতেই হবে।

তাকে কয়েক মিনিট পরে মেহেরুন্নিসার আবাসন কক্ষে প্রবেশ করতে দেখা যায়। খুররমের কাছ থেকে আমি অবশেষে একটা বার্তা পেয়েছি। এই যে, এখানে…’

মেহেরুন্নিসা সতর্ক ভঙ্গিতে চিঠিটা পড়তে আরম্ভ করে, কিন্তু সে চিঠিটা পুরো পড়া শেষ করার আগেই জাহাঙ্গীর নিজের পুত্রের গুণকীর্তন করা আরম্ভ করে। সে দারুণ বিচক্ষণতা, ভীষণ বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছে… সে এবার যখন আগ্রা ফিরে আসবে আমি তাকে আমার সামরিক পরিষদের পূর্ণ সদস্য হিসাবে নিয়োগ দেবে। সে সেখানে নিজের স্থান অর্জন করেছে। জাহাঙ্গীর যখন নিজের উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে, মেহেরুন্নিসার ঠোঁটের কোণে ফুটে থাকা হাসির ঝিলিকের চেয়ে তার মনের ভিতরে বইতে থাকা চিন্তাধারা অনেকবেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন। সে ধারণা করতে পারেনি যে খুররম এতটাই সফল হবে এবং অবশ্যই এত দ্রুত। নিজের বিজয়ী বাহিনী নিয়ে সে যখন বিজয়ীর বেশে ফিরে আসবে তখন জাহাঙ্গীর তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে বিলম্ব করবে? তার জন্য সেটা করাই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে….

‘আমাদের খবরটা উদ্যাপন করা উচিত। আজ বিকেলের দিকে, আবহাওয়া একটু শীতল হলে, আমি যমুনার তীরে উটের দৌড়ের আয়োজন করার আদেশ দিব। আম্বারের রাজা আমায় যে উটগুলো পাঠিয়েছে আমি তাঁদের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে আগ্রহী। তিনি দিব্যি দিয়ে বলেছেন যে দ্রুতগামী রাজপুত উটের কোনো তুলনা হয় না কিন্তু আমি ঠিক ভরসা করতে পারছি না…’

 ‘এটা দারুণ হবে। আমি আমার বারান্দা থেকে দেখবো।

সে পরবর্তীতে যখন জাহাঙ্গীর আর তাঁর দেহরক্ষীদের দুলকিচালে নদীর তীরের রৌদ্রদগ্ধ কাদার উপর দিয়ে সৈন্যরা দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য আধ মাইল লম্বা একটা এলাকা প্রস্তুত করেছে সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখে, তার মাথা ব্যাথা শুরু হয় এবং প্রদর্শনীটা তাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করে না। সে সচরাচর উটের দৌড় উপভোগই করে–জম্ভগুলোর নাক ডাকতে থাকার দৃশ্য, তাদের সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখা গলা, তাদের আরোহীদের দ্বারা তাড়িত হওয়া, দর্শকদের উল্লসিত চিৎকার…তাঁর বিয়ের পরপরই জাহাঙ্গীর নিজে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিত এবং বিজয়ী হতো। তাঁর মনে আছে সে প্রতিযোগিতা শেষে তাঁর কাছে আসতো, তাঁর দেহ তখনও বিজয়ের ঘামে সিক্ত…

তূর্যবাদকেরা তাঁদের বাজনা নিজেদের ঠোঁটে ঠেকিয়ে প্রথম দৌড় শুরুর সংকেত ঘোষণা করা মাত্র সে নদীর তীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় এবং ভিতরে চলে আসে। ‘সাল্লা,’ সে ডাকে, আমার চোখের পিছনে কেমন একটা ব্যাথা করছে। অনুগ্রহ করে আমায় একটু মালিশ করে দাও–যা আমাকে সবসময়ে আরাম দেয়।

মেহেরুন্নিসা একটা লাল স্যাটিনের গড়িতে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলে, আর্মেনিয়ান বাদী আলতো ভঙ্গিতে কাজ শুরু করে, তার গলার মাংসপেশী দক্ষতার সাথে মালিশ করতে থাকে। দবদব করতে থাকা ব্যাথাটা ধীরে ধীরে কমে আসে এবং মেহেরুন্নিসার মন আবার খুররমের বার্তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। খুররমকে পুনরায় দক্ষিণে পাঠাতে জাহাঙ্গীরকে প্ররোচিত করে সে সম্ভবত ভুলই করেছে… জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাকে দূরে সরাতে চেয়ে সে খুররমকে আরো বিপুল গৌরব অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। মালিক আম্বারকে বন্দি কিংবা হত্যা করতে যদি খুররম সমর্থ হয়–যা সে করতে পারবে বলে তাকে নিশ্চিত মনে হচ্ছে–সে কয়েক মাসের ভিতরে পুনরায় দরবারে ফিরে আসবে এবং অবশ্যম্ভাবীভাবেই নতুন খেতাব, নতুন দায়িত্বের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকবে। তার অবশ্যই কিছু প্রত্যাশা রয়েছে…।

তার স্বামীর বয়স যদিও এখনও পঞ্চাশ পূর্ণ হয়নি, ক্রমবর্ধমান আসক্তি ফলে যা তাঁর তৈরি আফিম ও সুরার মিশ্রণে বুঁদ হয়ে থাকতে তাকে আরও আগ্রহী করে তুলছে এবং সম্রাটকে তাঁর দায়িত্ব পালনে তাকে সুযোগ করে দিচ্ছে সেটাই হয়তো তাকে উৎসাহিত করবে সাম্রাজ্য পরিচালনার অধিকাংশ দায়িত্ব যোগ্য পুত্রের হাতে যাকে নিয়ে সে ভীষণ গর্বিত সমর্পিত করতে যাতে করে সে তার অবশিষ্ট দিনগুলোতে আগ্রহের সাথে প্রকৃতির অসামঞ্জস্য অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতে পারেন। সম্রাটের ক্ষমতা আর উদ্দীপনা যা তাকে এত আকর্ষিত আর উত্তেজিত করে হ্রাস পাবে। সে নিজেকে বলে, জাহাঙ্গীরের জন্য এটা মোটেই শুভ হবে না। তিনি এর ফলে দ্রুত বার্ধক্যে উপনীত হবেন। আর তারই বা কি হবে? হেরেমের বৃদ্ধ আর বিরক্ত শাসক। তাঁর মানসপটে মুহূর্তের জন্য ফাতিমা বেগমের বিরক্ত, কুঞ্চিত মুখাবয়ব আর পৃথুল অলস দেহ ভেসে উঠে। তাঁর জন্য হেরেম খুব ছোট একটা রাজত্ব। জাহাঙ্গীরের উপরে কেবল তাঁরই অধিকার এবং আর কারো নয়–ঠিক যেমনটা তিনি তাকে প্রায়শই বলে থাকেন। খুররমের উত্থানকে অবশ্যই মন্থর না, বিঘ্নিত করতে হবে, এবং হয়তো এমনকি বাতিল করতে হবে…

‘মালকিন, আমি দুঃখিত, আমি কি আপনাকে ব্যাথা দিয়েছি? আমি আয়নায় দেখলাম সহসা আপনি ভ্রুকুটি করলেন।

‘না, সাল্লা, আমি আসলে চিন্তা করছিলাম।’

মেহেরুন্নিসা যতই বিষয়টা বিবেচনা করতে থাকে, আতঙ্কের মত একটা অনুভূতি সে অনুভব করে। সে কি করবে? সে তাঁর জীবনের সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক পরিস্তিতিতেও সবসময়ে কোনো না কোনো পথ খুঁজে পেয়েছে। তার আব্বাজান তাকে যখন বায়ু আর নেকড়ের মুখে পরিত্যাগ করেছিলেন তখনও কি সে টিকে থাকেনি? তাঁর ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁদের পরিবারের সবাই যখন অভিযুক্ত হবার মুখে পড়েছিল তখন কি সে নিজেকে আর তার পরিবারকে রক্ষা করে নি? এটা দ্বিধাগ্রস্থ হবার সময় না…

সে বিছানায় উঠে বসে। সাল্লা, তোমায় ধন্যবাদ, আমার মাথা ব্যাথা অনেকটা কমেছে। তুমি এখন যেতে পারো। আর খেয়াল রেখো আমাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।’ উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে ভেসে আসা জনতার উফুল্ল চিৎকার আর তূর্যবাদনের শব্দ তাকে বলে যে উটের দৌড় এখনও শেষ হয়নি, মেহেরুন্নিসা পায়চারি আরম্ভ করে যা সে সবসময়েই করে থাকে যখন সে কিছু চিন্তা করতে চায়। তাঁর দৃষ্টি একটা নিচু মার্বেলের টেবিলের উপরে নিবদ্ধ হয় যেখানে সম্প্রতি জাহাঙ্গীর তাকে যে খেতাব দান করেছে তার প্রতীক উত্তীর্ণ করা হাতির দাঁতের তৈরি সীলমোহরটা রাখা আছে। সে এখন আর নূর মহল নয়, সে এখন নূর জাহান, জগতের আলো। সে কেবল জাহাঙ্গীরের প্রিয় সম্রাজ্ঞীই নয় বরং তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা… যা তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। তার মস্তিষ্কে অচিরেই একটা পরিকল্পনা দানা বাঁধতে আরম্ভ করে। ভীষণ সাহসী একটা পরিকল্পনা এবং এতে ঝুঁকিও রয়েছে, কিন্তু এটা যদি সফল হয় সে–তাঁর ভাস্তি আরজুমান্দ না–তাহলে হবে সম্রাটের পিতামহী এবং প্রপিতামহী। মেহেরুন্নিসার কক্ষে জাহাঙ্গীর যখন আবার আসে ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। তাকে উৎফুল্ল এবং শমিত দেখায়। আমিই ঠিক বলেছিলাম- রাজস্থানের এই উটগুলো দেখে যতটা মনে হয় তারা ততটা দ্রুতগামী নয়, এবং জন্তুগুলোকে পোষ মানান কঠিন। তুমি কি দেখেছিলে যে একটা তার আরোহীকে পিঠ থেকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তারপরে তাকে লাথি মারতে চেষ্টা করেছিল?

‘আপনাকে সত্যি কথাই বলি আমি আসলে দৌড়টা দেখিনি। খুররমের বার্তাটা আমি দেখার পর থেকেই–সারাটা দুপুর আমার মন অন্য একটা বিষয়ে ব্যস্ত ছিল।

‘সেটা কি?

তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হয় কিন্তু সে উত্তর দেয়ার সময় নিজের মুখাবয়ব সংযত রাখে, এমনকি সামান্য বিষণ্ণতাও ফুটিয়ে তোলে। আমি বুঝতে পারছি না যে আপনাকে কথাটা আমার বলা উচিত কিনা কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েও রাখতে পারি না।’

 জাহাঙ্গীরের মুখমণ্ডল এখন তাঁর মতই গম্ভীর দেখায়। বলো।

‘আপনি জানেন আমি খুররমের সেনাছাউনিতে অবস্থানরত আপনার আধিকারিকদের কাছ থেকে প্রেরিত নিয়মিত প্রতিবেদন দেখি। প্রতিবেদনগুলো বেশিরভাগই নতুন তাবু বা মালবাহী শকট কিংবা আরও অধিক খাদ্যের চাহিদা সম্পর্কিত–দৈনন্দিন বিষয়সমূহ যা নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। কিন্তু সম্প্রতি আমি অন্যসব বিবরণের মাঝে অন্য কিছু একটা বিষয় আঁচ করতে পারি–কিছু ইঙ্গিত যে খুররম ক্রমশ উদ্ধত হয়ে উঠছে… যে সে তার সামরিক পরামর্শ সভায় অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছে, যার ভিতরে তার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ আর বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিরাও রয়েছেন, যেমন ওয়ালিদ বেগ, তাঁর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান। এসব বিষয় হয়ত ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়–এখন পর্যন্ত খুররমের সামরিক অভিযান সফলই বলতে হবে। কিন্তু একেবারে সাম্প্রতিক কয়েকটা প্রতিবেদন থেকে এটাও প্রতিয়মান হয় যে খুররম আপনার সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করেছে, উদ্ধত ভঙ্গিতে বলেছে যে আপনার চেয়ে অনেক অল্প বয়সে সে সামরিক সাফল্য অর্জন করেছে…’।

জাহাঙ্গীর তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে এবং সে খেয়াল করে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের বেগ দ্রুততর হয়ে উঠেছে। তুমি নিশ্চিত? তার এমন প্রভৃষ্ট আচরণ করার কথা না…’।

 ‘এ বিষয়ে সন্দেহের সামান্যই অবকাশ রয়েছে। সে একজন দক্ষ সেনাপতি কিন্তু মুশকিল হল সেটা সে জানে এবং ক্রমশ আত্মগর্বী হয়ে উঠছে। আপনি অবশ্য চাইলে এত বিশাল সাফল্যের অধিকারী এমন একজন তরুণকে ক্ষমা করতেও পারেন। সাফল্যে তার মাথা খানিকটা ঘুরে যেতেই পারে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তাঁর শেষ বার্তাটার বাচনভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যায় সে নিজের প্রতি কতটা মুগ্ধ। আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত সে খসরুর মত কোনো বোকামি সে করতে যাবে না কিন্তু তারপরেও এমন আচরণ যদি নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে…’

‘এসব অভিযোগ কে করেছে? ব্যর্থতার জন্য খুররমের কাছে তিরস্কৃত হওয়া কিংবা যুক্তিসঙ্গত পদোন্নতি উপেক্ষিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ লোকজন এসব অভিযোগ করতেই পারে?

 ‘আমার মনে হয় না। আমি নিজে যাচাই করে দেখেছি। সবাই অনেক নিচু পদস্থ কর্মকর্তা-খুররমের সরাসরি নজরে পড়া কিংবা তাঁদের নাম জানা আপনার জন্য একেবারেই গুরুত্বহীন। তারা যদিও তাদের দায়িত্ব পালন করছে বলেই সম্ভবত ভেবেছে, এসব কথা কাগজে লিখে তারা অবশ্য ভুল করেছে। এসব লেখা যদি ভুল লোকের চোখে পড়ে তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ভেবে… আপনার খাতিরে এবং অবিবেচক সেইসব কর্মকর্তাদের কথা ভেবে, আমি বার্তাগুলো পুড়িয়ে ফেলেছি। মেহেরুন্নিসা একটা ধূপদানির দিকে ইঙ্গিত করে যেখানে কিছু পোড়া কাগজের টুকরো পড়ে রয়েছে।

জাহাঙ্গীরের কানে সহসা মেহেরুন্নিসার পরিবর্তে বহু বছর পূর্বে বৃদ্ধ সেলিম চিশতির উচ্চারিত সতর্কবাণী ভাসতে থাকে: বিশ্বাসের উপর কোনো কিছু ছেড়ে দিবে না, এমনকি যাদের সাথে তোমার রক্তের বন্ধন রয়েছে এমনকি তোমার অনাগত সন্তানেরা…’ খসরুকে অন্ধ করে দেয়ার পরে, সে ভেবেছিল সন্তানদের কাছ থেকে তাঁর আর ভয়ের কোনো কারণ নেই–পারভেজের কাছ থেকে নয় বেশিরভাগ সকালে যার বিছানা ত্যাগ করার কোনো ইচ্ছাই থাকে না বা খুররমের কাছ থেকে, আপাতদৃষ্টিতে এমন দায়িত্বশীল এবং সে যা কিছু চেয়েছে সে পিতা হিসাবে তাই তাকে দিয়েছে–এমনকি আরজুমান্দের সাথে বিয়ে পর্যন্ত–এবং নিশ্চিতভাবেই শাহরিয়ারের কাছ থেকে তো নয়ই। কিন্তু সে সম্ভবত কোথাও ভুল করেছিল। তাঁর পুত্রদের ভিতরে খুররম অনায়াসে সবচেয়ে প্রতিভাবান সারা পৃথিবী সেটা দেখতে পাবে–এবং খুররমও সেটা টের পেয়েছে। মেহেরুন্নিসা তাকে পুনরায় আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে–সে চায় না জাহাঙ্গীর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠুক–কিন্তু সে কীভাবে নিশ্চিত হবে যে খসরুর মত খুররম ইতিমধ্যে বিদ্রোহের বিষয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করে নি?

‘আপনাকে এতটা উদ্বিগ্ন কেন দেখাচ্ছে? আমি আপনাকে সতর্ক করেছি যাতে আপনি সহজেই বিষয়টার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেন।’

 ‘যদি তোমার কথা ঠিক হয়, তাহলে আমার কি করা উচিত?

 ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’ মেহেরুন্নিসা যেন এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত বোধ করে। খুররমকে আপনার অবশ্যই বিরত করতে হবে…’

‘আমার সেটাই করা উচিত, কিন্তু কীভাবে?

 ‘বেশ… আপনি সম্ভবত এখন পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারবেন তাকে লাল তাবু স্থাপনের অধিকার দান করে বেশি মাত্রায় উদারতা প্রদর্শন করেছেন। আমি জানি, আপনি এটা করেছিলেন, কারণ আপনি তাকে পুরস্কৃত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এরফলে সম্ভবত তাঁর প্রত্যাশা আর গর্ব মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল… আপনি তাকে এখন কেন অবহিত করেন না যে আগামী কিছু দিনের জন্য আপনি তার এই পদমর্যাদা রদ করছেন। আপনি তাকে জানাতে পারেন যে যদিও আপনি তার বিজয়ে আনন্দিত হয়েছেন কিন্তু আপনি হয়তো একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করেছিলেন…’

 ‘আমি নিশ্চিত–সে এটাকে নিশ্চিতভাবেই অপমান হিসাবে বিবেচনা করবে।

 ‘হা, কিন্তু একই সাথে তাকে পরীক্ষাও করবে। সে তার দাদাজানের কাছে তার অন্যসব নাতিদের চেয়ে বেশি প্রশ্রয় লাভ করেছিল এবং আপনি তাঁর সমস্ত ইচ্ছাপূরণ করায়, সে ভাবতে শুরু করেছে নিরূপদ্রব অগ্রযাত্রা তাঁর অধিকার এবং সেটা কোনো সম্মান বা উপহার নয় যা আপনিই কেবল তাকে দান করতে পারেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে সে এখনও আপনার অনুগত আর বিশ্বস্ত ছেলেই রয়েছে নাকি তার উচ্চাশা এখন তাঁর দায়িত্ববোধকে অতিক্রম করেছে। মনে রাখবেন আপনি একই সাথে তার সম্রাট এবং পিতা। আর খুররমের নিজের মঙ্গলের জন্য আপনি এসব কিছু করছেন। আপনি এখনই একজন আদর্শ পিতার মত উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে তাকে আরও বিপথগামী করার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন।’

জাহাঙ্গীর সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। মেহেরুন্নিসা যা বলেছে সত্যিই বলেছে। তিনি নিজে যুবক বয়সে যে বিরুদ্ধতার মোকাবেলা করেছেন খুররমকে সেসব কিছুই মোকাবেলা করতে হয়নি। খুররম যদি বিচক্ষণতার সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাহলে তাকে তার লাল তাবু অচিরেই ফিরিয়ে দেয়া হবে।

*

রঙধনুর সাত রঙে রঞ্জিত আর গলায় রত্নখচিত ক্ষুদ্রাকৃতি ফিতা বাঁধা–পায়রার দল বাতাসে ডানা ঝাপটে রাজকীয় পায়রার খোপে ফিরে আসতে শুরু করে জাহাঙ্গীর যখন মেহেরুন্নিসাকে পাশে নিয়ে তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষের বেলেপাথরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ছাগল আর উটের পালকে পানি খাওয়াতে নিচে যমুনার তীরে রাখালের দল এসেছে এবং গাধভূমিতে কালচে-ধূসর রঙের মহিষেরা উষ্ণ বাদামি পানিতে দিনের শেষবারের মত গড়াগড়ি দিয়ে নিচ্ছে।

 জাহাঙ্গীর তারপরে অস্তগামী সূর্যের দিক থেকে অশ্বারোহীদের একটা ক্ষুদ্র দলকে দূর্গের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। দলটা আরেকটু কাছে আসলে সে দলের একেবারে সম্মুখে নিজের ছোট ছেলে শাহরিয়ারকে চিনতে পারে এবং তার পেছনে কব্জিতে টোপর পড়ান বাজপাখি নিয়ে রয়েছে দু’জন শিকারী। তৃতীয় আরেক শিকারীর পর্যাণ থেকে ঝুলতে থাকা মৃত পাখির সংখ্যা দেখে বোঝা যায় তাদের পাখি শিকারের অভিযান বেশ সফল হয়েছে।

 ‘আপনি জানেন যে হেরেমে শাহরিয়ার একটা চিরকুট পাঠিয়ে লাডলিকে গর্ব করে বলেছে যে তাঁর বাজপাখিরা আজ কমপক্ষে এক ডজন পাখি শিকার করবে?’ মেহেরুন্নিসা জিজ্ঞেস করে। আমার মেয়ে উত্তর দিয়েছে সে যদি শিকারের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে না পারে তাহলে খামোখা যেন বড়াই না করে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে সফল হয়েছে। সে প্রায় আপনার মতই একজন চৌকষ খেলোয়াড় হয়ে উঠছে।

 ‘বলার অপেক্ষা রাখে না তুমিও…’।

‘আমাকে আর তোষামদ করতে হবে না। মেহেরুন্নিসা হেসে উঠে তারপরে বলে, ‘আমি শীঘ্রই লাডলিকে গাদাবন্দুক দিয়ে গুলি করতে শিখাবো। তাঁর এখন পনের বছর বয়স–শিকারে পর্দা দেয়া হাওদায় আমার সঙ্গী হবার মত তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।

জাহাঙ্গীর অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের বুকে তার অবশিষ্ট একটা কবুতরের খোঁজে তাকিয়ে থাকে। শাহরিয়ারের বাজপাখি নিশ্চয়ই তাঁর কবুতর শিকার করে নি, নাকি করেছে? শাহরিয়ারকে তিনি বারবার নিষেধ করেছেন দূর্গের কাছাকাছি কখনও বাজপাখি নিয়ে শিকার না করতে কিন্তু তিনি ঠিক নিশ্চিত নন তার ছোট ছেলে তার নির্দেশের প্রতি কতটা মনোযোগ দেয়। তাছাড়া, কবুতরগুলোও তাদের যতদূর যাওয়া উচিত প্রায়ই সেই সীমা অতিক্রম করে আরো দূরে চলে যায়। তিনি তারপরেই পাখিটা দেখতে পান, পালকগুলো রাঙিয়ে হাল্কা লাইলাক ফুলের রঙে রাঙান, তাঁর কাছেই পাথরের রেলিং এর উপরে নামার জন্য উড়ে আসছে। তিনি যখন বিলম্বে আগত পাখিটিতে আলতো করে কবুতরের খোপে তুলে রাখছেন, মেহেরুন্নিসা তাঁর কথা চালিয়ে যায়, আমি ভাবছিলাম যে আপনাকে জিজ্ঞেস করবো–লাডলি সম্বন্ধে কি শাহরিয়ার আপনার কাছে কখনও কিছু বলেছে?

 জাহাঙ্গীর এক মুহূর্ত চিন্তা করেন। শাহরিয়ারের সুদর্শন মাথাটা মনে হয় অন্য কোনো কিছুর চেয়ে শিকার আর বাজপাখি উড়ানো নিয়েই বেশি মেতে থাকে। নাহ্, আমার মনে পড়ে না, কেন?

 নাহ্, ব্যাপারটা হয়ত কিছুই না কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকবার সে আমার কাছে লাডলি সম্পর্কে মুগ্ধ ভঙ্গিতে কথা বলেছে–বেশ কয়েকবার সে তার সাথে দেখা করেছে এবং নওরোজের উৎসবের সময় তারা একত্রে আলাপও করেছে। সে কথা শেষ করে কাঁধ ঝাঁকায়। সে তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু বলেনি কিন্তু ব্যাপারটা হল যেভাবে সে কথাগুলো বলেছে।’

‘তোমার ধারণা লাডলির জন্য তার ভেতরে কোনো অনুভূতি কাজ করছে? ‘আমি জানি না। হয়ত…’

 ‘আমি তার সাথে কথা বলে দেখতে পারি।’

হা। আপনি আর শাহরিয়ার আজকাল বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। আমি নিশ্চিত, আপনার কাছে সে তাঁর মনে কথা খুলে বলবে… এবং লাডলির জন্য যদি তাঁর মনে কোনো ভালোবাসা কাজ করে থাকে তাহলে তাকে বলবেন এসব ভাবনা যেন সে এখানেই শেষ করে।

 জাহাঙ্গীর বিস্ময়ে চোখ পিট পিট করে। শাহরিয়ার তার দিকে কেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে পারবে না… এবং তাকে বিয়ে করলেই কি সমস্যা?

 কিন্তু আমি মনে করেছিলাম আপনার ইচ্ছা সিন্ধের কোনো রাজপরিবার থেকে আপনি তার জন্য বধূ নির্বাচিত করবেন?

 ‘আমি তাই চাই। আমি ইতিমধ্যে বিষয়টা নিয়ে আমার পরামর্শদাতাদের সাথে আলোচনাও করেছি, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। শাহরিয়ার সিন্ধ থেকে যেকোনো সময় একজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে কিন্তু এসব কিছুই তোমার মেয়েকে প্রথমে বিয়ে করা থেকে তাকে বিরত রাখতে পারে না। আর তাছাড়া, আমি তোমার ভাইঝির সাথে খুররমের বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলাম পার্সী রাজকন্যাকে বধূ হিসাবে বরণ করার পূর্বে…’

মেহেরুন্নিসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। শাহরিয়ার যদি সত্যিই লাডলিকে বিয়ে করতে আগ্রহী হয়, আমার কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না–আপনি জানেন আমি তাকে কতটা পছন্দ করি।’

‘আমার মনে হয়, সে সবসময়ে তাঁর দাবিদার … গত সপ্তাহেই তাকে আমি তিরষ্কার করেছি আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য নতুন কতগুলো ঘোড়া কিনতে হবে সে বিষয়ে আমার অশ্বশালার প্রধানের সাথে সে আলোচনা করতে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু তার বয়স এখন অল্প এবং সময় হলে শিখে নেবে। কে জানে, হয়ত বিয়ে করলে তার ভিতরে দায়িত্ববোধ জন্ম নেবে। আমি এখনই গিয়ে তাকে খুঁজে বের করছি।’

মেহেরুন্নিসা, কবুতরের খোপের কাছে একাকী প্রসন্নচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভাবতেও পারেনি বিষয়টা এত সহজে সমাধা হবে। সে জানে শাহরিয়ার জাহাঙ্গীরকে ঠিক কি বলবে। শাহজাদাকে সে এই মুহূর্তের জন্য তিল তিল করে প্রস্তুত করেছে, অকপট আর প্রভাবিত করা সম্ভব এমন এক তরুণকে তার জন্য এবং তাঁর সুদর্শন চেহারার জন্য লাডলির মুগ্ধতার ইঙ্গিত দিয়ে এবং সেই সাথে এটাও নিশ্চিত করেছে বিনিময়ে সে যেন লাডলির সন্দেহাতীত সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করার যথেষ্ট সুযোগ লাভ করে। শাহরিয়ার তাকে ভালোবাসে এই বিষয়ে যুবরাজকে নিজেকে বিষয়টা বোঝাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি। আর তাঁর মেয়ে, সে তাকে আগেই ভাবতে শিখিয়েছে যুবরাজের সাথে বিয়ের চেয়ে ভালো কোনো সম্বন্ধ হতে পারে না।

এই তরুণ দম্পতি সুখী হবে–এবং সে নিজেও, বিশেষ করে যখন শাহরিয়ারকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে জাহাঙ্গীরকে সে রাজি করাতে পারবে এবং সেটা করতেও বেশিও দিন সময় লাগবে না। বিপর্যয় কিংবা মতানৈক্যের সাথে অপরিচিত এবং তেজোদীপ্ত, খুররম, তাঁর চরিত্রের সাথে পরিচিত থাকায় সে যেমনটা আশা করেছিল ঠিক সেভাবেই, তাকে লাল তাবু স্থাপনের অধিকার থেকে তাঁর আব্বাজান বঞ্চিত করায় ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সে আহত আর রুষ্ট হয়ে একটা চিঠি লেখে যেখানে প্রচলিত চমৎকারিত্বপূর্ণ সৌজন্যতা অনুপস্থিত যা মোগল শিষ্টাচারের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাহাঙ্গীরকে বিষয়টা ভীষণ ক্রুদ্ধ করে, যে চিঠিতে সৌজন্যতাবোধের অনুপস্থিতিকে নিজের মর্যাদার প্রতি প্রকাশ্য অপমান হিসাবে বিবেচনা করে। তিনি তাঁর একদা প্রিয় পুত্রকে যে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন সেটা ক্রমেই বাড়তে শুরু করে। সে যদি তাদের ভিতরে একটা প্রকাশ্য বিভেদের জন্ম দিতে পারে তাহলে তার নিজের স্থান দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবে। এবং জাহাঙ্গীরের স্বার্থেই সবকিছু হবে। আর সর্বোপরি, সে ছাড়া অন্তরে তাঁর স্বার্থকে আর কে এতটা গুরুত্ব দেয়।

*

জাহাঙ্গীর এক মাস পরে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে, অনুষ্ঠানের জন্য আজ রঙিন লণ্ঠন চারপাশে ঝুলছে, লাডলির পেলব আঙুলে পান্নার একটা বাগদানের আংটি পরিয়ে দেয় তারপরে তাঁর হাতটা নিয়ে শাহরিয়ারের হাতে দেয়। ‘আমি আজ এই আংটি পরিয়ে তোমাদের আসন্ন মিলনকে আশীর্বাদ করছি। এই বিয়ে তোমাদের জন্য সুখ আর সমৃদ্ধি এবং অসংখ্য সন্তানের সৌভাগ্য বয়ে আনুক। জাহাঙ্গীর বাগদানের নেকাবের আড়ালে লাডলির অভিব্যক্তি দেখতে পায় না কিন্তু মেহেরুন্নিসার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সে তাকে আনন্দিত দেখে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে তাকে পুত্র সন্তান উপহার দিতে না পারার বিষয়টা তাকে খুব কষ্ট দেয়–এবং বিয়ের এত বছর পরে সেটা হয়ত আর সম্ভব না–কিন্তু সে তাকে বলেছে যে তার একমাত্র সন্তানকে তার একজন পুত্রের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখাটা তার কষ্টের উপশম হিসাবে কাজ করবে। তিনি নিজে অবশ্য বিষয়টা নিয়ে যতই চিন্তা করেন ততই তিনি এই মিলনের কারণে প্রীত বোধ করেন। শাহরিয়ারের যদিও এখনও অনেক কিছু শেখা বাকি আছে, সে সুপুত্র আর ভরসা করা যায় এমন ছেলে, পারভেজের কোনো বদভ্যাস বা খুররমের মত ক্রমশ গর্বিত বা উদ্ধত সে হবে না।

খুররমের কথা মনে পড়তে, জাহাঙ্গীরের মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। শাহরিয়ারের বাগদানের সংবাদ সে যখন শুনতে পাবে তখন তার কি প্রতিক্রিয়া হবে? আব্বাজান তাকে বিষয়টা লিখিতভাবে জানায়নি বলে কি সে অপমানিত বোধ করবে? বেশ, তার অপমানিত বোধ করাই উচিত। সে তার নিজের শ্রদ্ধার ঘাটতির কারণে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করতে পারে না। সে যাই হোক, তিনি এখন যে ঘোষণা করতে যাচ্ছেন সেটা অনেক বেশি শীতল আচরণ হবে। শাহরিয়ার, তোমার বাগদানের উপহার হিসাবে আমি তোমাকে বাদাখপুর-জমিদারির–জাগির তোমায় দিচ্ছি এর পূর্ববর্তী জায়গিরদার সম্প্রতি মারা যাওয়া এটা আবারও সম্রাটের কাছে অর্পিত হয়েছে।

 ‘আব্বাজান, আপনাকে ধন্যবাদ। শাহরিয়ার হাঁটু মুড়ে বসে এবং জাহাঙ্গীর অঙ্গুরীয় পরিহিত হাতে তার মাথা স্পর্শ করে, তার উদারতায় ছেলেকে এতটা আপুত হতে দেখে প্রীত হয়েছে। একজন সন্তানের আচরণ–শ্রদ্ধা আর বিনয়ের সাথে এমন হওয়া উচিত। দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে খুররম যাত্রা করার কিছুদিন পূর্বে জাহাঙ্গীর তাকে বাদখপুরের সমৃদ্ধ আর উর্বর জমিদারি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জমিদারিটা এখন তার কনিষ্ঠ সৎ-ভাইকে তিনি দিয়েছেন এই সংবাদটা, মেহেরুন্নিসা যেমন বলেছে, আরেকটা হিতকার শিক্ষা বলে প্রতিয়মান হবে এবং সম্ভবত তাকে বাধ্য করবে বশীভূত হতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *