১.১৩ আবিসিনিয়ার অসুর

১.১৩ আবিসিনিয়ার অসুর

‘আমার আব্বাজান আমাদের আরো একবার মালিক আম্বারের মুখোমুখি হতে প্রেরণ করছেন। তার বিরুদ্ধে আমাদের পূর্ববর্তী বিজয়ের পরেও আবিসিনিয়ার এই ভাড়াটে যোদ্ধা পুনরায় আবার মোগল ভূখণ্ডে হানা দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে, খুররম কথা শুরু করে। সে মুক্তার চারটা ছড়া পরিকর হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এমন দুধসাদা রঙের একটা আলখাল্লায় অনবদ্যভাবে সজ্জিত হয়ে এবং তাঁর একই রঙের পাগড়িতে প্রায় আঙুরের মত বড় একটা দীপ্তিময় মুক্তা শোভিত অবস্থায় আগ্রা দূর্গের ঝরোকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নিচে কুচকাওয়াজ ময়দানে ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা তার সৈন্যদলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে। বারান্দার পেছনে অবস্থিত কক্ষ থেকে তাকিয়ে দেখার সময়, জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে এই বয়সে সে কি এতটা আত্মবিশ্বাস আর কর্তৃত্বের সাথে কথা বলতে পারতো। খুররমের কথায়, গমের খেতের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাবার মত সারিবদ্ধ লোকের ভিতর দিয়ে মনে হয় যেন একটা মৃদু তরঙ্গ বয়ে যায় এবং তারা উল্লাস ধ্বনি করতে আরম্ভ করে।

‘আমরা এইবার মালিক আম্বারের সৈন্যদলকে পরাস্ত করে এবং তাকে আমাদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করেই কেবল শান্ত হবো না যেমনটা আমরা তিনবছর আগে করেছিলাম, খুররম তাঁর কথা অব্যাহত রাখে, সে তাঁর ডান হাত উঁচু করে সবাইকে শান্ত থাকতে হুকুম করে। আমরা সেইসাথে দাবি করবো তার প্রভুরা গোলকুণ্ডা, বিজাপুর আর আহমেদনগরের সুলতানেরা যেন তাদের ভূখণ্ডের একটা অংশ আর স্বর্ণমুদ্রা আমাদের হাতে ছেড়ে দেয়। যুদ্ধে অর্জিত লুণ্ঠিত দ্রব্যের পরিমাণ দারুণ হবে এবং আমি নিজে সেটা তোমাদের সবার ভিতরে ভাগ করে দেয়াটা নিশ্চিত করবো। খুররম তার হাত নিচু করে এবং তার লোকদের ভিতর থেকে খুররম জিন্দাবাদ, পাদিশাহ জাহাঙ্গীর জিন্দাবাদ এর সমবেত ঐক্যতান ভেসে আসতে সে মুচকি হাসে। জাহাঙ্গীর ভাবে, তাঁর পূর্বপুরুষ বাবর ঠিকই বলেছিলেন যখন তিনি তাঁর রোজনামচায় লিখেছিলেন যে একটা সৈন্যবাহিনীর সাহসিকতা আর আনুগত্য নিশ্চিত করার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় লাভের সম্ভাবনা তাদের সামনে তুলে ধরা।

নিচে সমবেত লোকদের চিৎকার স্তব্ধ হয়ে পুনরায় নিরবতা বিরাজ করলে, খুররম বলতে থাকে, আজ রাতে, আমাদের চুড়ান্ত প্রস্তুতি যখন সমাপ্ত হলে, আমি আমাদের রাধুনিদের আদেশ দিয়েছি আমাদের জন্য বিশেষ ভোজের আয়োজন করতে যাতে আগামীকাল আমরা যখন আগ্রা দূর্গ থেকে যাত্রা করবো তখন আমরা আমাদের সর্বাত্মক বিজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী থাকার সাথে সাথে আমাদের সবার পাকস্থলীও যেন খাদ্যে পরিপূর্ণ থাকে।’ খুররম ঘুরে দাঁড়াতে উল্লাসধ্বনির আরেকটা ঝাপটা তাকে আচ্ছন্ন করে, মাখন রঙের পোষাক পরিহিত দু’জন দীর্ঘদেহী দেহরক্ষী যাদের বক্ষাবরনী আর শিরোস্ত্রাণ পালিশ করে আয়নার দীপ্তি আনা হয়েছে তাঁর অনুগামী হয় এবং সে ভেতরে যেখানে তাঁর আব্বাজান অপেক্ষা করছে সেখানে যায়।

 ‘তুমি দারুণ বলেছে, জাহাঙ্গীর তাকে আলিঙ্গণ করে, বলে।

কারণ আমি চাই আমার লোকেরা যেন জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করে। আমার ভোজসভার ঘোষণা তাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে গতির সঞ্চার করবে।

‘মালিক আম্বারের গতিবিধি সম্বন্ধে আজ আমি আরও কিছু তথ্য পেয়েছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মানডুর আশে পাশের এলাকায় লুটতরাজের অভিপ্রায়ে সে সমৃদ্ধশালী জায়গিরগুলোতে হানা দিচ্ছে। সে দুটো জেলার কোষাগার আর একটা স্থানীয় অস্ত্রশালাও দখল করেছে।

 ‘সে তাহলে বেশ ভালো পরিমাণের লুষ্ঠিত দ্রব্য একত্রিত করেছে।

‘হা, কিন্তু সেটা তাঁর অগ্রসর হবার গতি সামান্য হ্রাস করে বিষয়টা হয়তো আমাদের পক্ষেই রাখবে আর তোমার জন্যও সহজ হবে তার নাগাল পাওয়া।’

‘এটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমার সৈন্য সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি এবং তারা অনেক বেশি অস্ত্রে সজ্জিত। আমি যদিও আমার লোকদের অপ্রয়োজনীয় উপকরণ বা মালপত্র বহন করতে নিষেধ করেছি, তারপরেও তার সৈন্যবাহিনী অনেকবেশি দ্রুতগামী আর ক্ষিপ্রগতির। সেইসাথে দাক্ষিণ্যের সীমান্ত তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো করে চেনে, যা তিনবছর আগে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। তারা আবারও পলায়নপর একটা শিকার হিসাবে প্রতিপন্ন হবে…’।

 ‘কিন্তু সাফল্য অর্জনে তোমার দক্ষতা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।’

তার ছেলের মনেও যে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই জাহাঙ্গীর সেটা খুররমের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝতে পারে। তপতি নদীর কিনারে বুরহানপুরেই আমি এবারও আমার মূলশিবির স্থাপন করবো। মালিক আম্বারকে ধরতে সেখান থেকেই আমি মানডু অভিমুখে যাত্রা করবো। আমি সেই সাথে তার পশ্চাদপসারণ বন্ধ করার অভিপ্রায়ে দক্ষিণ দিন অবরোধ করতে সৈন্যবাহিনীও প্রেরণ করবো। আমি আমাদের ভূখণ্ড থেকে তাকে তাড়িয়ে বের করার বদলে তাকে দাবড়ে এখানে নিয়ে আসতে চাই যাতে আমরা স্থানীয় এলাকা সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানের বাড়তি সুবিধা নাকচ করতে পারি। তাকে সেখানে একবার পরাস্ত করতে পারলে–যদি আল্লাহতালা সহায় থাকে আমি পারবো–তার বাহিনীর অবশিষ্টাংশ যখন নিজেদের এলাকা অভিমুখে পশ্চাদপসারণ শুরু করবে তাদের ধ্বংস করার সুন্দর সুযোগ আমি তখন পাবো এবং সেইসাথে মালিক আম্বারকে বন্দি করে তাঁর হুমকি চিরতরে শেষ করতে পারবো।’

‘সতর্ক থাকবে। শত্রু হিসাবে সে ভীষণ ধূর্ত।

 ‘সে এইবার আমার হাত থেকে পালাতে পারবে না।’

 ‘আমি জানি, কিন্তু মনে রাখবে তারুণ্যদীপ্ত ব্যগ্রতা আর আত্মবিশ্বাস, যতই যুক্তিযুক্ত মনে হোক, তোমার দক্ষতায় ব্যাঘাত না ঘটায়, তোমায় বিচক্ষণতা তোমায় পরিত্যাগ করে। তোমার সেনাপতিদের সাথে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে। আর নিজে অপ্রয়োজনীয় কোনো ঝুঁকি নিতে যাবে না।

 ‘আব্বাজান, আমি চেষ্টা করবো আপনার কথা স্মরণ রাখতে।

 ‘আরজুমান্দ সন্তানসম্ভবা হওয়া সত্ত্বেও তোমার সাথে যাচ্ছে?

 ‘সে গতবারের মত এবারও যাবার জন্য জেদ করছে। সে আমাদের সন্তানদের কাছ থেকেও আলাদা হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যদিও আমরা একবার বুরহানপুর পৌঁছাতে পারলে তারা সেখানের দূর্গের নিরাপত্তায় নিরাপদেই থাকবে। আব্বাজান এবার আমায় মার্জনা করবেন। আগামীকাল সকালে যাত্রা করতে হলে এবার আমায় বিদায় নিতেই হবে। বিদায়পূর্ব ভোজসভায় যোগ দেবার আগে আমায় রসদসংক্রান্ত শেষ মুহূর্তের কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জাহাঙ্গীর তার সন্তানদের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় এবং দু’জন পুনরায় পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। আল্লাহতা’লা তোমার সহায় হোন এবং বাছা আমার, বিজয়ীর বেশে তুমি যেন দ্রুত আবার আমার কাছে ফিরে আসো।’ খুররম বিদায় নেয়ার পরে, জাহাঙ্গীর ঝরোকা বারান্দার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। কুচকাওয়াজ ময়দানে সমবেত সৈন্যরা সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। যমুনা নদীর দিকে তাকিয়ে সে হাতিমহল হাতির একটা সারিকে পান পান করার জন্য মন্থর গতিতে বাদামি পানির দিকে ধীরে ধীরে নামতে দেখে, কিন্তু এছাড়া নদীর তীরে আর কোনোকিছু চলাফেরা করতে দেখা যায় না। পশ্চিম আকাশে বেগুনী আর লালচে আভার ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। একজন মোগল সম্রাট কতবার এখানে দাঁড়িয়ে এমন একটা দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ লাভ করেছেন? জাহাঙ্গীর একমুহূর্তের জন্য কল্পনা করে তাঁর পূর্বপুরুষেরা–এশিয়ার তৃণাঞ্চল থেকে আগত যোদ্ধা বাবর, জ্যোতিষী হুমায়ুন, তার আব্বাজান মহামতি আকবর, নিজের প্রজাদের কাছে ভীষণ শ্রদ্ধেয়–তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা একটা প্রাচীন বংশ, তৈমূরের পূর্বেও লড়াকু যোদ্ধা চেঙ্গিস খান অব্দি তাদের বংশ বিস্তৃত… বংশচিন্তা চিন্তা মাথায় আসতে গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠে, এবং খুররমের মত একজন যোগ্য আর অনুগত সন্তানের পিতা হতে পেরে সে নিজেকে আরো গর্বিত মনে করে, যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা যে সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য রক্তপাত করেছিল সেটা রক্ষা করতে মোগল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করবে।

*

‘যুবরাজ, দাক্ষিণাত্যের সূর্যের খরতাপে কাপড়ের লাল নিয়ন্ত্রক তাবুর নিচে খুররম একটা ছোট নিচু ডিভানের উপর তাঁর বয়োজ্যষ্ঠ সেনাপতিদের দ্বারা পরিবেষ্টত অবস্থায় বসে থাকার সময় কামরান ইকবাল তাঁর বক্তব্য শুরু করে। আমরা মানডুর চারপাশের এলাকা মুক্ত করার পর থেকেই মালিক আম্বারের লোকেরা আমরা অগ্রসর হবার পূর্বেই পশ্চাদপসারণ করছে। তারা এখনও বারি নদীর গতিপথ অনুসরণ করছে, তারা নদীর পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছে। তারা এই মুহূর্তে তাঁদের নিজেদের এলাকা থেকে বিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে।

‘বেশ। তার মানে বুরহানপুর থেকে আমরা আমাদের অভিযান শুরু করার পর আমরা কিছুটা হলেও সাফল্য লাভ করেছি, কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়… আমাদের দুটো এলাকার ভিতরে বিভাজন চিহ্নিতকারী উঁচু পাহাড়ের সারি আর তাদের ভিতরে আমাদের কোনো সৈন্যবাহিনী কি অবস্থান করছে?

না, যুবরাজ। গুপ্তদূতদের সামান্য কয়েকটা দল কেবল রয়েছে যাদের পক্ষে প্রলম্বিত যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

 ‘আমারও তাই মনে হয়। মালিক আম্বার আবারও সুকৌশলে আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। আমাদের সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও আমরা কখনও তাঁর অবস্থানের আর সীমান্তের মাঝামাঝি স্থানে আমাদের বাহিনী পর্যাপ্ত সংখ্যায় সমবেত করতে ব্যর্থ হয়ে তাকে আমাদের পছন্দের এলাকায় যুদ্ধ করতে বাধ্য করতে পারিনি। আমাদের প্রতিটা চাল যেন সে আগেই টের পেয়ে যায়।’

‘কিন্তু আমরা তাঁর লোকদের সাথে যতগুলো খণ্ডযুদ্ধে অবর্তীণ হয়েছি তাঁর প্রতিটাই আমরাই বিজয়ী হয়েছি এবং আমরা তাকে নতুন লুটতরাজের সম্ভাব্য সব স্থান থেকে দূরে রেখেছি–আমরা এমনকি তার আগে লুট করা কিছু সম্পদ উদ্ধারও করেছি, কামরান ইকবাল কথাটা বলে তার কণ্ঠে খানিকটা বুঝি গর্বেরও আভাস পাওয়া যায়, এসময় বেশ কয়েকজন আধিকারিক প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে।

 সত্যি কথা, কিন্তু আমি তার হুমকি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আরও বেশি কিছু করতে আগ্রহী। আমার এখন ভয় হচ্ছে যে আগামী দুই একদিনের ভিতরে সে তার পরিচিত পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছে যাবে এবং সেখানে ফলাফল নির্ধারণী যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব, খুররম কথাগুলো বলার সময় নিজের হতাশা কণ্ঠে ফুটে উঠা থেকে লুকিয়ে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। তার মাঝে মাঝে মনে হয় যে মালিক আম্বারের বোধহয় তার জ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের ভেতর কোনো গুপ্তচর রয়েছে, গতকাল সন্ধ্যাবেলায় সে তার তাবুতে আরজুমান্দকে বিষয়টা নিয়ে রীতিমত অভিযোগ করেছে।

 ‘কিন্তু যদি তাই হবে তাহলে সে কেবল পশ্চাদপসারণ না করে আপনাকে অতর্কিত আক্রমণ করে পরাস্ত করার একটা সুযোগ কি খুঁজে পেতো না? সে পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে। তার অর্ধাঙ্গিনী হয়ত ঠিকই বলেছে, সে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে।

 ‘যুবরাজ, আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গুপ্তদূতদের একজন আমায় বলেছে যে মালিক আম্বারের বর্তমান অবস্থান থেকে প্রায় দশ মাইলের দূরে নদী সহসা পশ্চিমে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়েছে। কামরান ইকবাল খুররমের তন্ময় ভাবনার ঘোর ছিন্ন করে বলে। আমরা কি তাকে নদীর বাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করতে পারি না?’

 ‘চেষ্টা করা যায়, কিন্তু সেটা বাঁকের কাছে ভূমির গঠন প্রকৃতির উপর নির্ভর করছে। এলাকাটা নিশ্চয়ই জলাভূমি নয়, তাই কি?

 ‘না। জায়গাটায় বেশকিছু বালুচর রয়েছে যার হয়ত প্রতিরক্ষা সহায়ক হিসাবে প্রতীয়মান হতে পারে কিন্তু সেগুলো বেশ নিচু আর আপাতদৃষ্টিতে সেখানে খুব বেশি সংখ্যক বালুচরও নেই।’

 ‘তাহলে সম্ভবত ঝুঁকিটা নেয়া যায়, খুররম বলে, তার উদ্দীপনা বাড়তে শুরু করেছে। মালিক আম্বার সেখানে কখন পৌঁছাতে পারে?

‘আগামী কাল সকাল দশটা নাগাদ–সে যদি রাতের বেলা নয় ঘন্টা শিবির স্থাপনের তাঁর চিরাচরিত রীতি অনুসরণ করে।

 ‘বেশ, তাহলে তাকে আমরা সেখানেই আক্রমণ করবো। আমাদের আক্রমণের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করার মত কাছাকাছি আসা থেকে মালিক আম্বারের গুপ্তদূতদের বিরত রাখতে আমাদের শিবির থেকে দূরবর্তী পাহারার স্থানগুলোয় লোক সংখ্যা দ্বিগুণের দ্বিগুণ বৃদ্ধি কর। অন্ধকার নামার পর নিরাপত্তা জোরদার করতে আমরা প্রহরীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেব।

*

খুররম পরের দিন সকালে নদীর বাঁকে মালিক আম্বারের অবস্থানের দিকে বালুময় ভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে এগিয়ে যাবার সময় ভয় আর উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি সে টের পায় যা যুদ্ধের আগমুহূর্তে অন্যসব অনুভূতি মুছে গিয়ে সে সবসময়ে অনুভব করে। গতরাতে তাঁদের যুদ্ধ প্রস্তুতি আপাতদৃষ্টিতে তাদের শত্রুর অগোচরে সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু তাঁর রণহস্তীর একটা অগ্রবর্তী দল নদীর বাঁকে অতর্কিত হামলার জন্য নির্ধারিত স্থান অভিমুখে দশ মাইল পথের মাত্র অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করার পরেই মালিক আম্বারের গুপ্তদূতদের একটা দলের মুখোমুখি পড়ে যায়। হাওদায় অবস্থানরত তবকিরা যদিও তিনজনকে গুলি করে ধরাশায়ী করেছে কিন্তু অন্ততপক্ষে দু’জন মালিক আম্বারের সৈন্যসারি অভিমুখে অক্ষত অবস্থায় ঘোড়া হাঁকিয়ে পালিয়ে গিয়েছে, তার মানে সে তাঁদের আক্রমণের প্রায় এক ঘন্টা পূর্বেই হুশিয়ার হয়ে যাবে। খুররম ভাবে, কেবলমাত্র অশ্বারোহী বাহিনীর উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে সে হয়ত ভুলই করেছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সে তার হাতির হাওদায় স্থাপিত ছোট কামানের গোলাবর্ষণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো, তার অশ্বারোহী বাহিনীর সামান্য পিছনে অবস্থান করে দুর্বহ-দর্শন অতিকায় প্রাণীগুলোর পক্ষে বিস্ময়কর দ্রুততায় যারা আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

গুপ্তদূতেরা তাঁদের হুশিয়ার করার পরের অব্যবহিত সময়ে, মালিক আম্বারের তোপচিরা সম্ভবত তাঁদের ছয়টা কামান বালুচরের পেছনে সুবিধাজনক স্থানে মোতায়েন করতে পারবে, যা খুররম যেমনটা ধারণা করেছিল তারচেয়ে সামান্য নিচু হলেও সংখ্যায় মনে হয় অগণিত। তাঁদের প্রথম গোলাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, বালুমাটির বুকে ভোঁতা শব্দ করে নিরীহ ভঙ্গিতে আছড়ে পড়ে। এখন অবশ্য মোগল অশ্বারোহীদের অগ্রবর্তী দলের ভেতরে কামান থেকে নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় দফার দুটো গোলা কাছাকাছি একসাথে পতিত হয়।

খুররম, নিজে অশ্বারোহী বাহিনীর দ্বিতীয় দলটার সাথে অবস্থান করছিল যুদ্ধ পরিস্থিতি ভালো করে দেখতে আর যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে, তাঁর অগ্রবর্তী দু’জন অশ্বারোহী যোদ্ধার ঘোড়া মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখে, তাঁদের আরোহীরা ঘোড়ার মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে ছিটকে যায়। অন্য ঘোড়াগুলো যার ভেতরে মোগল ঝাণ্ডা বহনকারী একটা ঘোড়াও রয়েছে মাটিতে পড়ে থাকা দেহগুলোতে হোঁচট খায় এবং তাঁরাও নিষ্ফল ভঙ্গিতে বাতাসে পা আন্দোলিত করতে করতে ভূপাতিত হয়। সবুজ রঙের লম্বা ঝাণ্ডাটা বাহকের হাত থেকে ছিটকে গিয়ে বাতাসে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির দিকে কয়েক গজ গড়িয়ে গিয়ে বালুচরের একপাশে জন্মানো একটা ছোট কাঁটাঝোঁপের সাথে জড়িয়ে যায়।

 মালিক আম্বারের তোপচিরা দারুণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর নিয়মনিষ্ঠ। প্রতি মুহূর্তে আরো অধিক সংখ্যক কামানের গর্জন ভেসে আসতে থাকে আর সেই সাথে আরো সংখ্যায় অশ্বারোহী যোদ্ধা পর্যাণ থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে। দুটো ঘোড়া, একটার সামনের বামপায়ের বেশ কিছুটা অংশ উড়ে গিয়েছে এবং দুটোই সওয়ারীবিহীন অবস্থায় যন্ত্রণায় চিঁহি রব করে, কামানের আওতা থেকে সরে এসে অন্যান্য মোগল অশ্বারোহীদের পথে বাধার সৃষ্টি করে। ঘোড়া দুটো এমন আচরণ করার সাথে সাথে মোগল অশ্বারোহীর প্রথম আক্রমণ তাঁর সমস্ত প্রাণোন্মাদনা হারিয়ে ফেলতে আরম্ভ করে। অচিরেই অশ্বারোহীদের আক্রমণের দ্বিতীয় ঝপটার সামনের দিকের যোদ্ধারা আর খুররম অশ্বারোহীদের প্রথম দলটার অবশিষ্ট যোদ্ধাদের সাথে মিশে যায়। প্রাণোন্মাদনা

 ‘ফিরে এসো! আমাদের সাথে আক্রমণ করো!’ খুররম কতিপয় ভগ্নমনোরথ অশ্বারোহীদের প্রতি যুদ্ধের হট্টগোলের মাঝে তার পক্ষে যতটা জোরে সম্ভব চিৎকার করে বলে। বামে নিচু বালিয়াড়ির পেছনে সবচেয়ে কাছের কামানগুলোকে আক্রমণ করো। দূরত্ব অনেক কম থাকায়–আমরা তাদের কাছে পৌঁছাবার পূর্বে তাঁরা যথেষ্ট দ্রুততার সাথে কামানগুলোকে গোলাবর্ষণের উপযোগী করতে না পারায় একবারের বেশি গোলাবর্ষণ করতে পারবে না।’ খুররম, তাঁর ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নুইয়ে এনে তরবারি ধরা ডানহাত সামনের দিকে প্রসারিত করে, তাঁর বাহন বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির কেন্দ্রে নিচু বালিয়াড়ির দিকে সরাসরি তাঁদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় যার পেছনে দুটো কামানের নল মুখব্যাদান করে রয়েছে।

 সে অর্ধেক পথ অতিক্রম করার আগেই, সে বিকট একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পায় প্রায় সাথে সাথেই দ্বিতীয় আরেকটা গর্জন ভেসে আসে এবং তার চারপাশে কাঁকড় আর বালির সাথে ধাতুর টুকরো বৃষ্টির মত আছড়ে পড়তে উষ্ণ বাতাসের একটা ঝাপটা সে অনুভব করে এবং বালিয়াড়ির পেছন থেকে ঝাঁঝালো ধোয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকে। তাঁর পাশের এক যোদ্ধার খয়েরী রঙের ঘোড়া গলায় ধাতুর এবড়ো-থেবড়ো একটা টুকরো বিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর এর পিঠে উপবিষ্ট কমলা রঙের পোষাক পরিহিত দীর্ঘদেহী রাজপুত যোদ্ধা মাথা নিচের দিকে দিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং স্থির হয়ে থাকে, বেচারার ঘাড় ভেঙে গিয়েছে। খুররম তার ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তার কান ভোঁ ভোঁ করে, মাথা ঠিকমত কাজ করে না এবং ধোয়া আর কাকড়ে তার চোখ মুখ জ্বালা করতে থাকে। সে যদিও হতভম্ভ বোধ করে তারপরেও বুঝতে পারে যে কামানের স্বাভাবিক গোলাবর্ষণের ফলে এমন ভীষণ বিস্ফোরণ হওয়া অসম্ভব। নিমেষের জন্য তাঁর চিন্তায় নতুন কোনো অস্ত্রের সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায় কিন্তু তারপরেই যখন তার কালো ঘোড়াটা নিচু বালিয়াড়ি টপকে পার হয় এবং বোয়াও খানিকটা সরে যায় সে দেখে যে বালিয়াড়ির পিছনে বিশাল কামান দুটোর ভিতরে একটা বিস্ফোরিত হয়েছে। কামানের নল কলার ছিলকার মত পিছনের দিকে গুটিয়ে গিয়েছে। বিস্ফোরিত কামানের বেশ কয়েকজন তোপচির ছিন্নভিন্ন আর দুমড়ে যাওয়া নিথর দেহ চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। বালির উপরে কাছেই আরেকটা বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে যার চারপাশে সাদা কাপড় আর টিনের টুকরো পড়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিস্ফোরণটার কারণ নিশ্চিতভাবেই কাছেই মজুদ করে রাখা বারুদ এবং প্রথম বিস্ফোরণের ফলে যা প্রজ্জ্বলিত হয়েছে।

প্রথম কামানের বিস্ফোরণ দ্বিতীয় কামানের লম্বা নলটাকে কাঠের ভারি কাঠামো থেকে ছিটকে ফেলায় এর নিচে কামানের দু’জন তোপচি চাপা পড়েছে। তৃতীয় আরেকজন ছিন্নভিন্ন বাম পা নিয়ে বিস্ফোরণ স্থল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করছে যা তাঁর পায়ের গোলাকৃতি মাংসপেশীর মাঝামাঝি স্থান থেকে নিচের দিকে হাড় আর মাংসের একটা রক্তাক্ত দলায় পরিণত হয়েছে।

খুররম তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তার চারপাশে পুনরায় নিজের সৈন্যদের সমবেত হবার সুযোগ দিয়ে, সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে তাঁর বক্ষাবরণীর নিম্নাংশ, তার পর্যাণের সামনের দিকে উঁচু হয়ে থাকা বাঁকা অংশ এবং তাঁর ঘোড়ার মাথাকে সুরক্ষা দানকারী ইস্পাতের একটা পাত সবকিছুতে রক্ত আর মাংসের ছোট টুকরো আটকে রয়েছে যা অবশ্যই প্রথম কামানের কোনো তোপচির দেহ থেকে ছিটকে এনেছে। সে কেঁপে উঠে ভাবে, তার ভাগ্যটা বেশ ভালোই বলতে হবে। তাঁর একেবারে সামনে বিস্ফোরণটা হয়েছিল। অত্যাধিক মাত্রায় গোলাবর্ষণ বা ত্রুটিযুক্ত গঠণের কারণে যদি কামানের নলটা বিস্ফোরিত না হত কামানের গোলা নিশ্চিতভাবেই তাকে এতক্ষণে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতো। নিয়তি তাকে যে সুযোগ দিয়েছে সে অবশ্যই সেটার যথাযোগ্য ব্যবহার করবে।

 সে পুলকিত হয়ে লক্ষ্য করে তার চারপাশে দ্রুত সমবেত হতে থাকা যোদ্ধারা এখন মালিক আম্বারের সৈন্যব্যুহের ভেতর অবস্থান করছে এবং আবিসিনিয়ান সেনাপতির তোপচিরা তাঁদের অবশিষ্ট কামানগুলোকে দৈহিক শক্তির দ্বারা কোনোভাবেই এমনকোন অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে না যেখান থেকে তাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করা যাবে এমনকি যদি, বিস্ফোরণের কারণে তাদের বিমূঢ় হয়ে পড়ার কথা, এটা করার মত তাদের মানসিক স্থিরতা বজায় থাকে। রণহস্তীর বহরের একটা অংশ এতক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছে, বালিয়াড়ির নরম বালির ভিতর দিয়ে তারা সবকিছু ভেঙে এগিয়ে যায়। খুররম তাঁদের সামনে মালিক আম্বারের অবস্থানের কেন্দ্রের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে আরো বেশ কয়েকটা বালিয়াড়ির পেছনে সে মালবাহী শকটের বহর আর তাঁদের পেছনে একদল অশ্বারোহী যোদ্ধা দেখতে পাচ্ছে, এবং সে চিৎকার করে তার অশ্বারোহীদের অনুসরণ করতে বলে।

 মালিক আম্বারের লোকজন তাদের বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। হাতির পাল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে খুররম আশেপাশের বালিয়াড়ির আড়াল থেকে গাদাবন্দুকের শব্দের সাথে সাথে হাতির গায়ের ভারি ইস্পাতের পাতে বন্দুকের গুলি প্রতিহত হবার শব্দ শুনতে পায়। একটা হাতি, দেহের অরক্ষিত স্থানে মোক্ষমভাবে গুলিবিদ্ধ হতে, প্রথমে গতি শ্লথ করে এবং তারপরে দিক পরিবর্তন করে কিন্তু বাকিরা এমন প্রাণবন্ত ভাবে সামনে এগিয়ে যায় যেন তারা তাদের সাথীদের বিপর্যয়ের আর্তনাদ শুনতে পায়নি। গোলন্দাজদের মত তবকিদেরও গুলিবর্ষণের পরে পুনরায় গুলি ভরার ঝামেলাপূর্ণ পদ্ধতি সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সময়ের সমস্যার কথা জানা থাকায়, খুররম তার সৈন্যদলের পার্শ্বদেশে অবস্থানরত এক সেনাপতিকে কিছু অশ্বারোহী যোদ্ধা নিয়ে তবকিরা তাঁদের গাদাবন্দুকে গুলি ভরার আগেই তাদের নিষ্ক্রিয় করার ইঙ্গিত করে। লোকটা সাথে সাথে তার আদেশ পালন করে এবং এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে অশ্বারোহী যোদ্ধারা সবচেয়ে কাছের বালিয়াড়ির একপাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে আক্রমণ করতে বেশ কয়েকজন তবকি বালিয়াড়ির অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে আসে। শত্রুপক্ষের যোদ্ধারা তাদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দেয় এবং দৌড়ে পালাবার সময় তারা অসহায় ভঙ্গিতে পেছনে ধেয়ে আসা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ধারালো তরবারির ঘাতক ফলার হাত থেকে নিজেদের মাথা হাত তুলে বাঁচাতে চেষ্টা করে। তাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং অচিরেই সবাই বালির উপরে হাত পা ছড়িয়ে নিথর পড়ে থাকে।

হাতির পাল ইত্যবসরে মালবাহী শকটের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। খুররম সহসা মালিক আম্বারের একদল লোককে দুটো অপেক্ষাকৃত ছোট মালবাহী শকট প্রাণপণে ঠেলে একপাশে সরাতে দেখে, তারা সেটা করতে দুটো কামান আর চামড়ার আঁটসাঁট পোষাক পরিহিত তাঁদের তোপচিরা দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। তোপচির দল গোলাবর্ষণ করতে সাথে সাথে তাঁদের হাতের মোম লাগান জ্বলন্ত সলতে দিয়ে কামানে অগ্নিসংযোগ করে। আগুয়ান হাতির পালের একটা হাতি সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কামানের একটা গোলা তাকে আঘাত করেছে যা তার একটা গজদন্ত একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং শুড় আর মুখের সম্মুখভাগ মাংসের রক্তাক্ত মণ্ডে পরিণত করেছে। কামানের দ্বিতীয় গোলাটা সৌভাগ্যক্রমে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু গোলাটা আরেকটা অতিকায় মোগল রণহস্তির পায়ের কাছে বালিতে আছড়ে পড়ার সময় বৃষ্টির মত আকাশে বালি ছিটিয়ে দেয়। অতিকায় দানবটা সাথে সাথে থমকে দাঁড়িয়ে যায়, ধূলিকণার কারণে সম্ভবত মুহূর্তের জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং বৃংহিতের শব্দে চারপাশ মুখরিত করে তুলে। অন্য হাতিরা অবশ্য, তাদের মাহুতের নির্দেশে সাড়া দিয়ে, সুবোধ ভঙ্গিতে তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে ভাবটা এমন যেন কুচকাওয়াজ ময়দানে কসরত করছে। একটা হাওদা থেকে তার গজনলগুলোর একটা গোলাবর্ষণ করতে খুররম আগুনের ঝলক দেখতে পায় এবং সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখে। গোলাটা মালিক আম্বারের সবচেয়ে কাছের কামানে আঘাত করে, এর ধাতু দিয়ে বাধান কাঠের চাকার একটা গুঁড়িয়ে দিয়ে দুটো চাকাকে সংযুক্তকারী অক্ষদণ্ড ভেঙে দেয়ায় কামানের নলটা আকাশে দিকে এক উদ্ভট নতি করে উঁচু হয়ে আছে। অন্য আরেকটা হাওদায় অবস্থানরত তবকিরা দ্বিতীয় কামানের দু’জন তোপচিকে ঘায়েল করে, আহত তোপচিদের একজন চিৎ হয়ে মাটিতে শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বালুর উপরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে কষ্টের বোল তুলে। খুররম তাকিয়ে থাকার মাঝেই তাঁর চারজন অশ্বারোহী অবশিষ্ট দু’জন তোপচিকে ঘিরে ফেলে যারা আত্মসমর্পণের স্মারক হিসাবে মুখ মাটিতে দিয়ে উপুড় হয়ে বালিতে শুয়ে পড়ে।

নদীর তীরের দিকে অগ্রসর হবার জন্য খুররম তাঁর লোকদের আদেশ দিতে সে পুলকিত হয়ে লক্ষ্য করে যে মালিক আম্বারের যোদ্ধারা নদী অভিমুখে পশ্চাদপসারণ আরম্ভ করেছে। সে তার লোকদের ইশারায় যখন পলায়নপর শত্রুদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে আদেশ দেয়, খুররম তখন অনুধাবন করতে শুরু করে যে একঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে সে পুনরায় আবার বিজয় অর্জন করবে, যদিও এই বিজয় নিশ্চিত করতে যখন কামান বিস্ফোরিত হয়েছিল তখন সৌভাগ্যের বিশাল একটা বরাভয় দারুণ ভূমিকা রেখেছে। সে অবশ্য এর মাঝেই আরেকটা বালিয়াড়ি টপকে যায় এবং প্রথমবারের মত নদীর পরিষ্কার একটা চিত্র তার সামনে ভেসে উঠে, সে দেখে যে নদীর অপরতীরে সেখানে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের বিশাল একটা দল সমবেত হয়েছে এবং মাঝ নদীতে অন্যান্যদের বহনকারী ভেলা এস্তভঙ্গিতে দূরবর্তীপ্রান্ত অভিমুখে লগি মেরে পরিচালিত করা হচ্ছে। সে নদীর তীরে উপস্থিত হবার এক কি দুই মিনিট পরে ঘুরে দাঁড়াবার আগে একটা ক্ষুদ্রাকৃতি অবয়ব যার বুকের বর্ম আসন্ন মধ্যাহ্নের সূর্যালোকে আয়নার মত দ্যুতি ছড়াচ্ছে ঔদ্ধত্যের ভঙ্গিতে নিজের হাতের তরবারি আন্দোলিত করে এবং নিজের অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে যাত্রা করে। মালিক আম্বার আরো একবার সাফল্যের সাথে তাঁর নাগাল এড়িয়ে গিয়েছে, খুররম ভাবে, কিন্তু এটাও কম নয় যে লোকটা তাঁর পুরো বাহিনীই নদীর তীরে খুইয়েছে এবং–পরিত্যক্ত মালবাহী শকটগুলোয় যদি সে যা ভেবেছে সত্যিই তাই থাকে–সেই সাথে তাঁর লুণ্ঠিত ঐশ্বর্যের অধিকাংশ।

তাঁর আব্বাজান খুশি হবেন যখন খবরটা তাঁর কাছে পৌঁছাবে। তাঁর আম্মিজানও খুশি হতেন, কিন্তু যোধা বাঈ তিনমাস পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর কাছে যে খবর রয়েছে সেই অনুসারে তার মৃত্যু অপ্রত্যাশিতভাবে হলেও ঘুমের ভিতরে শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। সে এখনও প্রায়ই তাঁর কথা ভাবে এবং তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আম্মিজান আর নেই।

*

কসরতবাজের নমনীয় দেহ, কমলা রঙের একটা ল্যাঙট ছাড়া একেবারে নগ্ন, জবজব করে তেল মাখার কারণে চকচক করছে, জাহাঙ্গীরের আবাসন কক্ষের শান বাঁধান বারান্দায় পায়ের উপরে শক্ত করে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে পেছনের দিকে হেলে পড়ে এবং ডান হাত উঁচু করে দুই ফিট লম্বা ইস্পাতের সরু তরবারি যা জাহাঙ্গীর একটু আগেই নিজে পরখ করে দেখেছে নিজের ভোলা মুখে প্রবিষ্ট করতে। তরবারির ফলা একেবারে বাট পর্যন্ত ভিতরে প্রবেশ করতে জাহাঙ্গীর শ্বাস রুদ্ধ করে তাকিয়ে থাকে, তাঁর মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে তরবারির ফলার অগ্রভাগ লোটার পেষল উদর ভেদ করে রক্তের ধারার সাথে বের হয়ে আসবে। কিন্তু লোকটা যত সাবলীলভাবে তরবারির ফলা মুখের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছিল ধীরে ধীরে ততটাই সাবলীলভাবে তরবারিগুলো বের করে এনে, মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীরের সামনে মাথা নত করে অভিবাদন জানায় এবং তরবারিগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখে। সে হাততালি দিতে আরও দু’জন কসরতবাজ সামনে এগিয়ে আসে, প্রত্যেকের হাতে মাংসের কাবার তৈরির শিক ধরা রয়েছে যার চারপাশে তেলে ভেজান কাপড় শক্ত করে জড়ানো রয়েছে এবং এখন সেটায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সে পুনরায় পিছনের দিকে হেলে যায়, এবার এতটাই যে তার লম্বা কালো চুল বারান্দার পাথর স্পর্শ করে, লোকটা এবার প্রথমে একটা জ্বলন্ত শিক গলধঃকরণ করে তারপরে দ্বিতীয়টা তারপরে দুটো একসাথে। ত্বক বিদীর্ণ যেমন হয়নি তেমনি এবার আগুনে চামড়া পোড়ার গন্ধও পাওয়া যায় না। লোকটা যখন আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে তখনও জ্বলন্ত শিকে ফুঁ দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয়, জাহাঙ্গীর তার দিকে এক মুঠো সোনার মোহর ছুঁড়ে দেয়।

‘আমি ভেবেছিলাম তারা আপনাকে আনন্দ দেবে, কসরতবাজেরা চপল পায়ে দৌড়ে বারান্দা থেকে বিদায় নিতে মেহেরুন্নিসা বলে। সুদূর উত্তরপূর্বের পাহাড়ী এলাকা থেকে লোকগুলো এসেছে সেখানে উপজাতীয় লোকেরা এসব করতে পারদর্শী।

 ‘তাঁরা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সকালে আমি লোকগুলোকে আবার ডেকে পাঠাব এবং তাদের এই কসরতের রহস্য আমি তাদের তাদের ব্যাখ্যা করতে বলবো।

মেহেরুন্নিসা মুচকি হাসে। জাহাঙ্গীরকে ভুলিয়ে রাখতে সে সবসময়ে– কৌতূহল উদ্রেককারী কিছু খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। তাঁর সাথে সে যখন নিজের প্রশান্তি খুঁজতে চেষ্টা করে সে তখন সেটা বেশ পছন্দই করে এবং সন্ধ্যার নির্জনতা কথা বলার জন্য আদর্শ সময়।

সে জাহাঙ্গীরের জন্য গোলাপের সুগন্ধিযুক্ত যে সুরা প্রস্তুত করেছে সে তাতে চুমুক দেয়। শাহরিয়ারের কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছি। সে এখনও ভাদোরে অবস্থান করছে কিন্তু লিখেছে যে নতুন দূর্গ স্থাপনের জন্য সে একটা ভালো স্থান খুঁজে পেয়েছে। সে যা লিখেছে তাতে মনে হচ্ছে যে পুরো এলাকাটা সে বেশ ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করেছে এবং দূর্গটার নির্মাণশৈলী কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিয়েছে।’

 ‘বেশ।’ মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। নিজের ভাইয়ের সাথে আগ্রা অভিমুখি দক্ষিণের প্রবেশপথ সুরক্ষিত করতে নতুন একটা দূর্গ নির্মাণে জাহাঙ্গীরের অভিপ্রায়ের বিষয়ে আলোচনার পরে শাহরিয়ারকে সে নিজে কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছে, শাহরিয়ারকে কাজটার দায়িত্ব দেয়ার–তার অনুরোধে, এমন নয় যে আসাফ খান জানে না–জাহাঙ্গীরের সিদ্ধান্তের শুনে আসাফ খানের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল। আগ্রা সেনানিবাসের সর্বাধিনায়ক হিসাবে তার ভাইয়ের মনে হয়েছিল তার অন্তত যুবরাজের সঙ্গী হওয়া উচিত। সে মেহেরুন্নিসাকে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে প্রস্তাবিত নতুন দূর্গের জন্য সে কতকিছু করতে পারে সব বলেছিল। সে মুখে সহানুভূতিপূর্ণ হাসি নিয়ে মনেযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছে এবং সবকিছু মনে রেখেছে। সে তারপরে শাহরিয়ারকে চিঠি লিখে তরুণ মনে নিগূঢ়ভাবে কিছু ধারণা প্রোথিত করেছে যার ভিতরে কিছু অবশ্য তার নিজের।

 ‘আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে শাহরিয়ার এত বড় একটা দায়িত্ব সামলাতে পারবে–ভুলে গেলে চলবে না যে তার মাত্র সতের বছর বয়স–কিন্তু মনে হচ্ছে যে তাকে কাজটা দেয়ার জন্য তোমার পরামর্শ ঠিক ছিল।

 ‘আর আপনি তাকে একা পাঠিয়ে ঠিক কাজটাই করেছেন। আপনি প্রথমে যেমন প্রস্তাব করেছিলেন সেই অনুযায়ী যদি আমার ভাইকে তার সাথে পাঠাতেন, তাহলে শাহরিয়ারের হয়ত মনে হতো আপনি তার উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না।

 ‘তুমি খুব ভালো মানুষ চিনতে পারো।

 ‘আপনি আপনাকে আগেই বলেছিলাম শাহরিয়ারের সামর্থ্যকে আপনি ছোট করে দেখছেন।

 ‘কেবল পারভেজের ব্যাপারে তুমি যদি আমাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারতে। বিয়ের পরেও তার ভিতরে কোনো পরিবর্তন আসেনি–সত্যি বলতে কি ঠিক উল্টোটা হয়েছে। সে আমাকে আমার নিজের সৎ-ভাই ডানিয়েল আর মুরাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের সুরাপান থেকে বিরত রাখতে আমার আব্বাজানের সমস্ত প্রয়াস ব্যর্থ করে তারা শেষে সুরাপানের কারণেই মারা গিয়েছে। আমার মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হয় যে এটা আমাদের পরিবারের জন্য একটা অভিশাপ।

 ‘পারভেজ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। নিজের দূর্বলতা অতিক্রম করা তাকেই শিখতে হবে। সে যে কদাচিৎ অপ্রমত্ত অবস্থায় থাকে সেটা আপনার দোষ না। আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন কিছুর অনুমতি আপনি দিতে পারেন না।

জাহাঙ্গীর আপন মনে ভাবে, আমি কি করি না। তার বয়স যখন বিশের কোটায় ছিল তখন সে আফিম আর সুরার দাসে পরিণত হয়েছিল, তাকে দায়িত্বপূর্ণ কোনো পদ প্রদানে তার আব্বাজানের অনীহার জন্য নিজেকে সান্ত্বনা দিতে সে এসবের আশ্রয় নিত। সে নিজেও হয়ত এই আসক্তির কারণে মৃত্যুবরণ করতো যদি সে তার দুধ-ভাই সুলেমান বেগের ভালোবাসা না পেতো, সেই তাকে সাহায্য করেছিল আসক্তির কবল থেকে বের হয়ে আসতে। সুলেমান বেগের মুখটা তার মানসপটে মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠে–সে শেষবার জ্বরের আক্রমণে বিপর্যস্ত অবস্থায় যেমন দেখেছিল তেমন না বরং প্রাণবন্ত আর আত্মবিশ্বাসী। সে ছিল তাঁর সত্যিকারের বন্ধু এবং এতগুলো বছর পরেও সে অনুভব করে এখনও সে তার অভাব কতটা বোধ করে। সুলেমান বেগ এখন তার সম্বন্ধে কি মন্তব্য করতো? তাঁর এই ক্রমশ বাড়তে থাকা আলস্য, সাম্রাজ্যের কাজে তার অনীহা, ইংরেজ রাজদূতের সাথে তাঁর উদ্দাম পানাহারের আসর–যদিও আক্ষেপের বিষয় আজকাল এসব পানাহারের আসর অনেকটাই কমে গিয়েছে স্যার টমাস আজকাল প্রায়ই কেমন অসুস্থ বোধ করেন–আর আফিমের প্রতি তার আসক্তি যার কবল থেকে সে আসলে কখনও পুরোপুরি নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি এবং এখন আবার সেটা প্রবল হয়ে উঠেছে।

আফিম আর সুরা সে কেন এত পছন্দ করে? তাঁর বয়স যখন অল্প ছিল তখন সে হৃদয়ের তিক্ততার উপশম ঘটাতে এসবে আসক্ত হয়েছিল জীবনের হতাশা ভুলে থাকতে। সে এখন যখন সমৃদ্ধ আর স্থায়ী একটা সাম্রাজ্যের অধিকারী প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এবং দুই পুত্রের জনক যাঁদের নিয়ে সে গর্ববোধ করতে পারে, আনন্দের জন্য সে এখন কেন এসব উপকরণ ব্যবহার করতে পারবে না? আফিম আর সুরা তাকে শমিত করে, এমনকি এগুলো তাঁর মনকে প্রসারিত করে। আফিম আর সুরা একত্রে তাকে যে সুখাবহ ভাব সমাধিতে পৌঁছে দেয় তখনই তাঁর পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর সবচেয়ে অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন ভাবনাগুলো তাঁর কাছে ধরা দেয়… এবং রো’র সাথে চিত্রকলা থেকে শুরু করে খৃস্টান ধর্মের খামখেয়ালিপনা সবকিছু নিয়ে সে সবচেয়ে উদ্দীপক আলাপচারিতায় মেতে উঠতো। মেহেরুন্নিসা এইমাত্র মন্তব্য করেছে সে আসক্তির অনুসঙ্গগুলোকে তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে দেয় না, কিন্তু সে নিজের বুকে হাত দিয়ে এত নিশ্চিতভাবে এই কথাটা বলতে পারবে না। সে যদি এসব অনুসঙ্গ ছাড়া অর্ধেক দিন অতিবাহিত করে তাহলেই এসবের জন্য ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং সে কদাচিৎ দীর্ঘ সময় তাঁদের আসক্তি এড়িয়ে থাকতে পারে। তার সাম্রাজ্যের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড থেকে এসব যদি আদতেই তাকে দূরে সরে থাকতে প্ররোচিত করেই, এতে কি এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে? তাঁর অনুগত অসংখ্য বিশ্বস্ত লোক রয়েছে যারা তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে, এঁদের ভিতরে মেহেরুন্নিসাও রয়েছে। তার ক্রমাগত নতুন দায়িত্ব গ্রহণের আকাঙ্খা দেখে সে মুগ্ধ হয়, প্রতিবারই তাকে আশ্বস্ত করতে ভুল হয় না যে সে কেবলই তাঁর সাহায্যকারী হতে আগ্রহী। সে নিশ্চিত, বিয়ষটা সত্যি, কিন্তু সে এটাই জানে যে বিষয়টা মেহেরুন্নিসা কতটা উপভোগ করে। তাকে আগলে রাখার জন্য মেহেরুন্নিসা যতক্ষণ তাঁর পাশে রয়েছে তার হয়ত সুরা আর আফিমের আসক্তির সাথে লড়াই করার ততটা প্রয়োজন নেই।

‘আপনি আজ খুররমের কাছ থেকে একটা বার্তা পেয়েছেন, তাই নয় কি? তাকে তার স্বপ্ন-কল্পনার রেশ থেকে মুক্ত করে, সে জানতে চায়।

 ‘হা। মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান ভালোই অগ্রসর হচ্ছে। সে একজন দক্ষ সেনাপতি। আমি কৃতজ্ঞ যে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ আমি তাকে দিয়েছি যা আমার আব্বাজান আমাকে কখনও দিতো না। তাঁর জন্মগ্রহণের সময় জ্যোতিষী যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, সৌভাগ্য মনে হয় তার পক্ষেই আছে। তার পরিবারও বড় হচ্ছে। সে চিঠিতে জানিয়েছে তাঁর সদ্যোজাত কন্যাসন্তান জ্বর থেকে সেরে উঠেছে এবং সুস্থ আছে। তাঁরা তাঁর নাম রেখেছে রওসোন্নারা।

মেহেরুন্নিসা চুপ করে থাকে। দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে খুররমের যাত্রা করার পরে প্রায় নয়মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। জাহাঙ্গীর প্রথম দিকে তাঁর অভাব দারুণ অনুভব করতো এবং তার অনুপস্থিতির জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করতো কিন্তু ধীরে ধীরে তার প্ররোচনায় জাহাঙ্গীর ক্রমশ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতি অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠছে। সে অনুধাবন করতে পেরেছে যে নিজের বড় দুই ছেলের একজন বিশ্বাসঘাতক আর অন্যজন মাতাল এই বিষয়টা জাহাঙ্গীরকে কষ্ট দেয়… পিতা হিসাবে বিষয়টাকে সে নিজেরই ব্যর্থতা হিসাবে দেখে ঠিক যেমন সে মনে করে যে তার আব্বাজান আকবর তাকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। ঠিক এই কারণেই সে যেমন যোগ্য আর শক্তিমান খুররমের কারণে গর্বিত বোধ করতে আগ্রহী, ঠিক একইভাবে সে সুদর্শন শাহরিয়ারের মাঝে ভালো গুণাবলী দেখে প্রসন্ন। জাহাঙ্গীরের সন্তানদের মাঝে তার অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রতিযোগিতার আবহ বিরাজ করাটা একটা ভালো লক্ষণ, মেহেরুন্নিসা ভাবে। তাদের ঈর্ষা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা তাকে তার প্রভাব বিস্তারের আরেকটু সুযোগ করে দেবে যদি না কেবল খুররম তার একমাত্র প্রিয় পুত্র হতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *