১.০৭ পাপস্খলন

১.৭ পাপস্খলন

ফতেপুর শিক্রি যাবার পথে শুকনো মাটির উপরে ঘোড়ার খুরের ছন্দোবদ্ধ শব্দ তাঁর কানে সন্তুষ্টির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, জাহাঙ্গীর ভাবে। শব্দটা তাকে বলছে যে মাসাধিক কাল অপেক্ষার পরে সে অবশেষে অভীষ্ট সাধনে কাজ করছে। মেহেরুন্নিসাকে দেখার পর থেকেই তাকে নিজের ভাবনা থেকে সে কদাচিত দূরে রাখতে পেরেছে। সে যে সাহসের সাথে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বাবার পক্ষে সাফাই দিয়েছে সেটা বহুবছর পূর্বে সে যা আঁচ করেছিল সেটাকেই অভ্রান্ত প্রমাণিত করেছে–যে সে রূপবতী হবার সাথে সাথে একজন অসাধারণ মহিলা। অন্য যে কেউ হলে শোকে কাঁদতে বিলাপ করতো কিন্তু তিনি নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তাঁদের মধ্যকার আলাপচারিতা শেষে একটা বিষয়ে তাঁর মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে তার পুরো পরিবারে মীর খানই একমাত্র বিশ্বাসঘাতক। সে সেই সাথে এটাও জানে যে বহু বছর আগে সে তার মাঝে যে অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল সেটা আজও একই রকম রয়েছে। সে এখন তাকে আগের চেয়ে আরও বেশি করে কামনা করে।

অবশ্য, গোয়ালিওরে খসরুর কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে অঙ্কুরিত তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার শেষ প্রচেষ্টা সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করাই ছিল তাঁর প্রথম লক্ষ্য। যতই দিন অতিবাহিত হয়েছে সে ততই মীর খানের মত আরো মাথা গরম তরুণদের কথা জানতে পেরেছে যারা খসরুর প্রতি নিজেদের আনুগত্য ঘোষণা করেছিল তার প্রতিশ্রুতির বহরের কারণে মোহিত হয়ে যা করার কোনো এক্তিয়ারই তার উচ্চাকাঙ্খী ছেলের ছিল না। সে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, খসরুর সহযোগীরা উড়াল দেয়ার আগেই তাদের গ্রেফতারের বিষয়টা নিশ্চিত করে, তাদের জেরা করে আরো ষড়যন্ত্রকারীদের নাম তাঁদের কাছ থেকে আদায় করে এবং তারপরে তাঁদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে।

খসরুর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। সে অতীতে অনেক বেশি করুণা প্রদর্শন করেছে কিন্তু তার ফলাফল কি হয়েছে? খসরু তাঁর উদারতার বদলে কেবলই ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। না, সে তার কাছ অনুতাপ কিংবা কৃতজ্ঞতা কিছুই আশা করতে পারে না। খসরুকে সে যে শাস্তিই দিক না কেন সেটা যেন এতটাই কঠোর হয় যে ভবিষ্যতে তাঁর বিদ্রোহের ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কিন্তু তারপরেও তাঁর তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই… সে বর্তমানে খসরুকে কেবল গোয়ালিওরের ভূগর্ভস্থ একটা কারা কুঠরিতে অন্তরীণ করে রাখতে আদেশ দিয়েছে এবং নির্দেশ দিয়েছে তাকে যেন সম্পূর্ণভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়।

সে ইয়ার মোহাম্মদকে, বাদখশান থেকে আগত বৃদ্ধ কিন্তু কঠোর শাসক, বিশ্বাস করতে পারে যাকে সে সম্প্রতি গোয়ালিয়রের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছে, তার আদেশ যেন যথাযথভাবে পালিত হয় সেটা নিশ্চিত করতে। পূর্ববর্তী শাসনকর্তার বিষয়ে, সে নিশ্চিতভাবেই অনেক বিষয়ে শিথিলতা প্রদর্শন করেছিল আর খসরুকে অনেকবেশি সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল। যুবরাজকে ষড়যন্ত্রের সুযোগ দেয়ার জন্য সেই সবচেয়ে বেশি দায়ী আর সে কারণেই জাহাঙ্গীরের কোপানলে পরার ভয়ে সে নিজের অবহেলার জন্য খেসারত দিতে মরীয়া হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করেছে, এমনকি নিজেকে বাঁচাতে সে নিরীহ গিয়াস বেগকেও পর্যন্ত ফাঁসিয়ে দিয়েছে। জাহাঙ্গীর তাকে বরখাস্ত করতে, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে এবং তাকে নির্বাসিত করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে নি।

তার ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার হঠকারী ভাবনা বহুদিন আর কারো মনে উদয় হবে না। আর বিপর্যয় এখন যখন সমাপ্তির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে তখন সে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে মনোযোগ দেবার মত সময় সে অবশেষে লাভ করেছে। গতরাতে, মেহেরুন্নিসার ভাবনা যখন তাকে পুনরায় আবার রাতের বেলা জাগিয়ে রাখতে আরম্ভ করেছে, তখন সে না ভেবে থাকতে পারে নি যে খসরুর এই অনাকাঙ্খিত বিদ্রোহের কারণে মেহেরুন্নিসার পরিবার আর তার নিজের মধ্যকার পরিস্থিতি কি আদতে খুব সূক্ষভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর কেবল পাক কেবলা সুফি বাবাই দিতে পারবেন। আর এই কারণেই তাঁর প্রাত্যহিত দরবারিক কর্মকাণ্ড সমাধা হতেই সে তার সাথে দেখা করার জন্য যাত্রা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জাহাঙ্গীর তার সামনে দ্রুত ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যালোকে, সে দেখতে পায় ইতিমধ্যেই রাতের খাবারের জন্য আগুন জ্বালান হয়েছে। ফতেপুর শিক্রি এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। সে তার কচি আর দেহরক্ষীদের চমকে দিয়ে সহসাই নিজের ঘোড়ার খুরে ঝড়ের বোল তুলে। তারা সবাই নিজের ঘোড়ার গতিবেগ বৃদ্ধি করে তার কাছাকাছি থাকবার প্রয়াসে তাঁদের ব্যস্ত হয়ে উঠার আওয়াজ সে পেছনে থেকে ভেসে আসতে শুনে।

 পনের মিনিট পরে, তাকে বেশিরভাগই এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ফতেপুর শিক্রির বেলেপাথরের শহরের মূল প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে নিচু একটা মাটির বাড়ির সামনে ঘোড়া থেকে নামতে দেখা যায়। সে ছেলেবেলায় বর্তমান সুফি সাধকের বাবার সাথে প্রথমবার যখন দেখা করতে এসেছিল তখনকার চেয়ে বাড়িটাকে এখন যেন অনেকবেশি ছোট আর হতদরিদ্র মনে হয়, কিন্তু এটাও সত্যি যে স্মৃতির সাথে সময় প্রায়শই বিবিধ ছলনা করে থাকে। তোমরা সবাই এখানেই অপেক্ষা করো।’ দরজার ডানপাশে অবস্থিত একটা ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে সে একটা তেলের প্রদীপের খুবানি আভা দেখতে পায়। সে হাত থেকে ঘোড়া চালনার দস্তানা জোড়া খুলে ফেলে কাঠের দবেজ দরজায় টোকা দেয় এবং তারপরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে দরজার পাল্লা খুলে। কক্ষের ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে আবারও দরজায় টোকা দেয় এবং এবার মাথা নত করে নিচু সরদলের নিচে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।

কক্ষটার মেঝে দুরমুজ করা মাটির তৈরি তার উপরে কেবল কয়েকটা জীর্ণ মাদুর বিছানো রয়েছে এবং তাঁর যতদূর মনে পড়ে এক কোণে একটা দড়ির চারপায়া থাকবার কথা কিন্তু সুফি বাবার কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। জাহাঙ্গীরের মনটা এক মুহূর্তের জন্য হতাশায় ছেয়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই সে বাইরে থেকে কণ্ঠস্বরের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে এবং মুহূর্ত পরেই সুফিবাবা ভেতরে প্রবেশ করেন, তিনিও নিজের সাদা পাগড়ি পরিহিত মাথা সরদলের সাথে গুতো খাওয়া থেকে বাঁচাতে নিচু করে রেখেছেন।

‘সম্রাট, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে পারি নি। আমি আগুন জ্বালাবার কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম।’

 ‘আপনাকে আগে থেকে না জানিয়ে আসবার কারণে আমিই আসলে ভুল করেছি।’

‘সম্রাট, অনুগ্রহ করে…’ সুফিবাবা একটা মাদুরের দিকে ইঙ্গিত করে এবং জাহাঙ্গীর যখন তাঁর মুখোমুখি আসন পিড়ি হয়ে থিতু হয়ে বসে। এত ব্যগ্রভাবে আমার কাছে ছুটে আসবার কারণটা কি এবার জানতে পারি?

‘আপনার দিক নির্দেশনা আমার আবার প্রয়োজন।

 ‘সেই একই বিষয়ে?

জাহাঙ্গীরের মনে হয় সে বুঝি সুফিবাবার চোয়াল সামান্য চেপে বসতে দেখেছে। হ্যাঁ। পরিস্থিতি এখন বদলে গিয়েছে।

কীভাবে সেটা হয়েছে?

 ‘আপনি আমায় বলেছিলেন যে আমি কেবল আল্লাহতালার চোখের গুনাহগার নই সেইসাথে আমি আমার ভালোবাসার রমণীর এবং যাকে আমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই–আমার কোষাধ্যক্ষ গিয়াস বেগের কন্যা মেহেরুন্নিসার–পরিবারের প্রতিও অন্যায় করেছি, তাঁরা তাঁর জন্য যাকে স্বামী হিসাবে নির্বাচিত করেছিল তাকে হত্যা করে। আমার এই অন্যায়ের কারণে আপনি আমাকে হুশিয়ার করেছিলেন আমি যা চাই সেটা পাবার জন্য কোনো ধরনের ব্যগ্রতা প্রদর্শন করে আল্লাহ্তা’লার রোষানলে পড়ার ঝুঁকি না নিয়ে বরং ধৈর্য ধারণ করতে আর অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুফিসাধক কোনো কথা না বলে কেবল মাথা নাড়ে এবং জাহাঙ্গীর পুনরায় বলতে শুরু করে, আমার সন্তান খসরু আবারও আমায় সিংহাসনচ্যুত করে আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। গিয়াস বেগের ছোট ছেলে প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম–মেহেরুন্নিসার আপন ভাই। সে অপরাধ স্বীকার করে এবং আমি তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করি। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন হলো আমার প্রতি তার অপরাধ কি তাঁর পরিবারের প্রতি আমার অন্যায়কে কি নাকচ করবে না?

 সুফিবাবা চোখ এখন অর্ধনিমিলিত এবং তার থুতনি এই মুহূর্তে নিজের ভাঁজ করা হাতের উপরে রাখা কিন্তু এখনও তিনি কোনো কথা বলেন না। জাহাঙ্গীর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। সে সম্ভবত মেহেরুন্নিসাকে এমনিও ডেকে পাঠাতে পারতো কিন্তু সুফি সাধক আর বহুকাল আগে গত হওয়া তার বাবার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা তাকে সেটা করা থেকে বিরত রেখেছে।

সুফিবাবা অবশেষে মৌনতা ভঙ্গ করেন। আপনি যা বললেন তার কিছুটা অংশ বাস্তবিকই যুক্তিযুক্ত। আপনার অপরাধের চুড়ান্ত বিচারের ভার আল্লাহতালার হাতে কিন্তু এই মুহূর্তে আপনাদের দুই পরিবারের ভিতরে এখন আপনিই কেবল একমাত্র অপরাধী নন। আমার বিশ্বাস পাপে পাপ ক্ষয় হয়েছে। কিন্তু স্মরণ রাখবেন যে আপনার ভাগ্যে যাই লেখা থাকুক, আপনি নিজের আকাঙ্খকে চরিতার্থ করতে আপনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটা একজন মানুষ আর বিশেষ করে একজন সম্রাট হিসাবে আপনার জন্য অগৌরবের।’

‘আমি জানি। জাহাঙ্গীর তার মাথা নত করে। সুফিবাবা ঠিকই বলেছেন। শের আফগানকে হত্যা করাটা তার একেবারেই ঠিক হয় নি। পুরো ব্যাপারটা ঈর্ষাতুর এক প্রেমিকের মত কাজ হয়েছে কোনোভাবেই সেটা একজন অমিত-ক্ষমতাধর সম্রাটের উপযুক্ত নয়। কিন্তু সুফিবাবার কথাগুলো এসব ভাবনা ছাপিয়ে তাকে আনন্দে আপ্লুত করে তুলে। মেহেরুন্নিসা অবশেষে তার হতে চলেছে। সুফিবাবা আমায় বলেন ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে? এই রমণী কি আমি যাকে খুঁজছি আমার সেই আত্মার আত্মীয় হবে?

 ‘সম্রাট আমার পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমার আব্বাজানের মত আত্মার অধিকারী আমি নই। তাঁর মত ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আপনি যেমন বলেছেন সত্যিই যদি আপনি তাকে সেরকমই ভালোবাসেন–এবং তার মাঝেও আপনার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে সবকিছুই সম্ভব।

বাঁচালেন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আপনার কথায় আমি কতটা স্বস্তি পেয়েছি। আমি কীভাবে আপনাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি?

 ‘আমি যা কিছু বলেছি সবই আল্লাহতালার প্রতি আমার বিশ্বাস আর তাঁর অভিপ্রায় মাথায় রেখে বলেছি কোনো পুরষ্কারের আশায় নয়, কিন্তু ফতেপুর শিক্রি থেকে চলে যাবার আগে আমার আব্বাজানের কবরটা জিয়ারত করলে আমি খুশি হব। আপনার সমস্ত অত্যাচার আর পাপের জন্য, কেবল শের আফগানের হত্যাকাণ্ডের জন্যই না, আবারও আল্লাহতা’লার কাছে করুণা ভিক্ষা করবেন। আব্বাজান হয়ত তাহলে বেহেশত থেকে আপনাকে আশীর্বাদ করবেন এবং আপনার আগামী জীবনটা আরও সুগম করে দেবেন।

*

‘নাহ্, এটাও পুরোপুরি ঠিক হয় নি। শোন…’ সাল্লা পংক্তিটা জোরে জোরে আবৃত্তি করে, আবৃত্তি করার সময় সে তার মাতৃভাষা আর্মেনীয় থেকে পার্সীতে অনুবাদ করতে থাকে। মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। ভাষাটা রপ্ত করতে তাঁর আরও সময় লাগবে কিন্তু এই বিনোদনটা তার ভালোই লাগে। এখানে প্রতিটা দিন আগের দিনের মতই এবং নিঃসন্দেহে আগামী দিনও। সে যদিও পুনরায় ফাতিমা বেগমের সাথেই বসবাস করছে, তাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। পুরোটা সময় কেবলই খসরুর সাথে ষড়যন্ত্রকারী সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের তাজা খবর সে শুনছে। তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডই হেরেমের অধিবাসীদের তাঁর প্রতি সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট। সাল্লার যদিও, তাঁর বিদ্বান বাবা রাজকীয় পাঠাগারের আধিকারিক, এসব নিয়ে কোনোপ্রকার হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। ফাতিমা বেগমের পরিচারিকা হিসাবে তাকে সম্প্রতি নিয়োগ করা হয়েছে এবং মেহেরুন্নিসা তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে একরকম বর্তে গিয়েছে। সাল্লা আর্মেনিয়াসের পাশাপাশি মেহেরুন্নিসাকে খানিকটা ইংরেজিও শিখাবে বলেছে, যা তার আব্বাজান, যখন তরুণ বয়সে জনৈক ইংরেজ ব্যবসায়ীর অধীনে মুনশী বা সেক্রেটারি হিসাবে কর্মরত থাকার সময়ে রপ্ত করেছিলেন, তাকে শিখিয়েছে।

মেহেরুন্নিসা যে পংক্তিগুলো ভাষান্তর করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল সেই পংক্তিগুলো সে পুনরাবৃত্তি করার সময়ে সাল্লার আন্তরিক মুখের চারপাশে তাঁর ঘন কালো লম্বা চুলের গোছা বৃত্তাকারে ঝুলতে থাকে তাঁর চুল এতই ঘন যে চুল আচড়াবার সময়ে তাকে চিরুনির সাথে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়: ‘রাত যখন গম্ভীর হয়ে আলকাতরার ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে তখন ভয় পাবে না। জানবে সেটা কেবলই ভেসে যাওয়া কোনো মেঘের কারসাজি যা চাঁদ আর তারাদের আলো শুষে নিয়েছে। আবারও তাদের আলোর দীপ্তি ফিরে আসবে, পূর্বের মতই সৌন্দর্যমণ্ডিত যা একদা হারিয়ে গিয়েছিল।’

শব্দগুলো মেহেরুন্নিসাকে স্পর্শ করে। এটা কার কবিতা?

‘আমাদের অন্যতম মহান কবি-ইয়েরেভানের হ্যাগোপান।

কতদিন আগের…’ মেহেরুন্নিসা কথা শেষ করতে পারে না কারণ নাদিয়া ঝড়ের বেগে তার কক্ষে এসে প্রবেশ করেছে।

 ‘মালকিন, আপনাকে এখনই আমার সাথে যেতে হবে। খাজাসারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আবার কি ঘটলো? মেহেরুন্নিসা চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীরের সাথে তার সাক্ষাৎকারের পর থেকেই সে আশঙ্কা করছে যেকোনো মুহূর্তে তাকে তার বাবা-মায়ের কাছে ফেরত পাঠানো হবে। বাবা মা আর ভাই আসাফ খানের কাছে যে চিঠিগুলো সে লিখেছিল সেগুলোয় আশঙ্কার কথা ছিল। সে নিশ্চিত যে হেরেম থেকে বাইরের সাথে যেকোনো ধরনের সংবাদ বিনিময়–বিশেষ করে ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত পরিবারের সাথে সতর্কতার সাথে খুটিয়ে দেখা হবে।

নাদিয়াকে অনুসরণ করে বাইরের আলোকউজ্জ্বল প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতে–উত্তল মার্বেলের উপর সূর্যঘড়ির ছায়া বলছে এখনও দুপুর হয়নি–মেহেরুন্নিসা দেখে মালা তার জন্য অপেক্ষা করছে। খাজাসারার দীর্ঘদেহী অবয়বের পিছনে গাঢ় সবুজ বর্ণের আলখাল্লা পরিহিত ছয়জন পরিচারিকা মালার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁদের ভিতরে তিনজন খোঁজা আর তিনজন মহিলা।

 ‘আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, মেহেরুন্নিসা খাজাসারার উদ্দেশ্যে বলে।

 ‘হ্যাঁ, মালকিন।

 ‘আপনি কি বলতে চান?

 ‘জনসমক্ষে কথাটা বলার অনুমতি আমায় দেয়া হয়নি। অনুগ্রহ করে আমায় অনুসরণ করুন।

খাজাসারা উচ্চপদস্থ কোনো রাজকীয় কর্মচারীর ন্যায় দন্ডটা হাতে নিয়ে সদর্পে এগিয়ে যায়, একদিক দিয়ে বিবেচনা করতে গেলে সে আসলেও তাই। পরিচারিকার দল তাকে অনুসরণ করে এবং মিছিলটার একেবারে শেষে থাকে মেহেরুন্নিসা। ছোট্ট মিছিলটা জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত খাস কামরায় প্রবেশের বাঁকটা এড়িয়ে, যা মেহেরুন্নিসা এখন ভালো করেই চেনে, প্রধান প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হেরেমের প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যায়। তাকে শেষ পর্যন্ত তাহলে বহিষ্কারই করা হচ্ছে…

 কিন্তু তখনই মেহেরুন্নিসা তোরণগৃহের বামে একটা ক্ষুদ্র খিলানযুক্ত তোরণদ্বার লক্ষ্য করে। সেখানে পৌঁছে মালা ভেতরে প্রবেশ করে হারিয়ে যায়। পরিচারিকার দলকে অনুসরণ করে খিলানাকৃতি তোরণের নিচে দিয়ে এগিয়ে যেতে মেহেরুন্নিসা একটা সংকীর্ণ গলিপথের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে যা বামদিকে বাঁক খেয়ে খাড়াভাবে নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। সে এক মুহূর্তের জন্য আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করে তাকেও কি একই ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু তারপরেই সে খেয়াল করে যে ভেতরের বাতাস ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। বেলেপাথরের দেয়াল বেয়ে জলকণা গড়িয়ে নামছে এবং কারাগারের সেঁতসেঁতে গন্ধের বদলে তাঁর নাকে–গোলাপজল, চন্দনকাঠ আর তিমিমাছ থেকে প্রাপ্ত গন্ধদ্রব্যের সুগন্ধ ভেসে আসে। সামনে আরেকটা তীক্ষ্ণ বাঁক দেখা যায় এবং মেহেরুন্নিসা সামনে আলো দেখতে পায়। আরও কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যেতে সে নিজেকে একটা ক্ষুদ্র আয়তাকার আঙ্গিণায় আবিষ্কার করে যার চারদিকেই উঁচু দেয়াল। সে উপরের দিকে তাকিয়ে সে কেবল ছোট আয়তাকার আকাশের ধাতব নীল দেখতে পায়। প্রাঙ্গণের মাঝে একটা ঝর্ণা থেকে বুদ্বুদ নিঃসৃত হচ্ছে এবং ঠিক উল্টোদিকের দেয়ালের ফাঁকাস্থানের ভিতর দিয়ে সুগন্ধি স্রোত, আর্দ্রতার উৎস দেখা যায়– হাম্মামখানা।

 ‘অনুগ্রহ করে কাপড় খুলে রাখুন, খাজাসারা বলে।

 মেহেরুন্নিসা বিস্মিত চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে।

 ‘হেরেমের প্রচলিত নিয়মরীতির কারণে আমরা এই নিভৃতস্থানে পৌঁছাবার পূর্বে আপনাকে কিছু জানানো থেকে আমায় বিরত রেখেছিল, কিন্তু সম্রাট আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আজ রাতে আপনি যদি তাকে প্রীত করতে, পারেন তাহলে আপনি তার সাথে একই শয্যায় শয়ন করবেন। কোনো তর্ক করা চলবে না। আমি যা বলছি আপনাকে তাই করতে হবে।

 মেহেরুন্নিসা এতটাই বিস্মিত হয় যে পরিচারিকার দল তার দেহ থেকে পোষাকের আবরণ সরিয়ে নিয়ে তাকে নগ্ন করতে থাকলে সে বাধা না দিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তারা প্রথমেই তাঁর পালিশ করা গোলাপি স্ফটিকের টুকরো বসানো কলাই করা পরিকরের মুক্তাখচিত টাসেল খুলে দেয় তার পরনের গোলাপি রেশমের আলখাল্লা সরিয়ে দিয়ে তাঁর অন্তর্বাস খুলে নেয় এবং তার পা থেকে রেশমের তৈরি চটিও তাঁরা সরিয়ে নেয়। সে কিছু বোঝার আগেই সে দেখে পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায় সে ছোট আঙিনায় নেমে আসা উজ্জ্বল সূর্যালোকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর খাজাসারা কাবুলের দাসবাজারে তার দেখা দাস ব্যবসায়ীদের মত নিরাসক্ত চোখে তাকে খুটিয়ে দেখছে। নিজের ঘন কালো চুল ঝাঁকিয়ে সে চেষ্টা করে নিজের স্তনযুগল আড়াল করতে এবং ঘুরে দাঁড়ায়, সে এখনও মালা একটু আগে যা বলেছে সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছে। জাহাঙ্গীর অবশেষে তাহলে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি তাকে আর নিজের স্ত্রী করতে চান না। মামুলী একজন রক্ষিতার মত তাকে তার শয্যার জন্য উপযোগী করা হচ্ছে।

‘চলুন, খাজাসারা উন্মুক্তস্থানটার দিকে ইশারা করে তাকে হাম্মামে প্রবেশ করতে বলে। ভেতরে, গরম পাথরের উপরে প্রবাহিত সুগন্ধি পানির স্রোত থেকে উষ্ণতা নির্গত হচ্ছে যা মার্বেলের সংকীর্ণ ঢালু পথ দিয়ে নিচে নামছে। তার চোখ জ্বালা করে এবং সে টের পায় তাঁর ত্বক ঘামতে শুরু করেছে। সে বরাবরই হাম্মাম পছন্দ করে কিন্তু এখন দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হতে সে অনুভব করে তার দেহ উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছে। প্রথমে, একটা মার্বেল পাথরের খণ্ডের উপর শুয়ে থাকার সময় পরিচারিকার দল গরম হিসহিস করতে থাকা উষ্ণ পাথরের উপরে আরো পানি ঢালে, সে টের পায় এবার আসলেই তাঁর দেহ কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে, তার ত্বক পরিষ্কার করে এবং সেটাকে এখন রেশমের ন্যায় নরম আর তুলতুলে মনে হয়। এরপরে, পাশের একটা কক্ষে সে পানির ছোট্ট একটা চৌবাচ্চায় অবগাহন করে যার পানি এত ঠাণ্ডা যে দূর্গের বরফঘর থেকে চৌবাচ্চায় দেয়ার জন্য নিয়ে বরফের টুকরোগুলো এখনও পানিতে ভাসছে। তাকে এরপরে তৃতীয়, বড় একটা কক্ষে নিয়ে আসা হয়। কক্ষটায় কোনো প্রাকৃতিক আলো নেই কিন্তু চারপাশের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে স্থাপিত অসংখ্য তেলের প্রদীপের আভায় দেখা যায় দেয়ালের আস্তরের উপরে আর উঁচু খিলানাকৃতি ছাদে জটিল ফুলের নক্সা করা রয়েছে। সেখানে তূর্কী এক মহিলা বিশাল পুরুষালি হাতে সুগন্ধি তেল দিয়ে তার সারা দেহ মালিশ করে দেয়ার সময় সে মুখ নিচু করে একটা মার্বেলের বেঞ্চে শুয়ে থাকে।

কামরাটার এক কোণে পিতলের ধূপাধারে জ্বলতে থাকা ধূপের ঝাঁঝালো গন্ধে তার মাথা ঘুরতে শুরু করে। সে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলে যখন তার মালিশ শেষ হতে কোথা থেকে এক খোঁজা এসে তাঁর দেহ মসলিনের একটা আলখাল্লায় জড়িয়ে দেয় যা এতই সূক্ষ যে তার দেহের চারপাশে এটাকে প্রায় স্বচ্ছ দেখায় এবং তাকে একটা নিচু তেপায়র কাছে বসার জন্য নিয়ে আসে। তাকে সেখানে বসিয়ে খোঁজাটা এবার তার চুল আচড়াতে আরম্ভ করে, সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয় এবং পাথরখচিত ফিতে দিয়ে চুলে বেণী করে দেয়। আরেক খোঁজা, মনোসংযোগের কারণে এর জ্বটা কুঁচকে রয়েছে, তার ভ্র তুলে দেয় এবং তারপরে চোখে সুন্দর করে কাজল দিয়ে তার লম্বা কালো চোখের পাপড়িতে আরও কালো করে তুলে। তারপরে, মর্মরসদৃশ অ্যালাবাস্টারের একটা আলতার পাত্র থেকে আলতা নিয়ে তার ঠোঁট দুটো রাঙিয়ে দেয়। খোঁজাটা যখন উঠে দাঁড়িয়ে উফুল্ল একটা শব্দ করে মেহেরুন্নিসা বুঝতে পারে সে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। তৃতীয় খোঁজা এবার সবুজ জেড পাথরের পাত্রে মেহেদী নিয়ে আসে। একটা সূক্ষ্ম তুলি দিয়ে সে তার হাতে পায়ে আর বাহুতে জটিল আলপনা এঁকে দেয়। অন্যমনস্কভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে যেন অনেক দূর থেকে দেখছে এমনভাবে সে তার কাজ দেখে-ভাবটা এমন যেন সে একটা ছোট্ট পুতুল সাজাচ্ছে যার সাথে তার নিজের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু লোকটা পরবর্তী কথায় তার সম্বিত ফিরে সে বুঝতে পারে এটা আসলেই তাঁর দেহ। মালকিন, এবার আপনার আলখাল্লাটা খুলতে যে হবে।’

মেহেরুন্নিসা তার মসৃণ, খানিকটা বিরক্তিকর মুখে দিকে চোখ তুলে তাকায়। খোঁজা হলেও তার কণ্ঠস্বর পুরুষের মতই ভারি। তুমি কি বলছো?’

 ‘অনুগ্রহ করে আপনার আলখাল্লাটা খুলেন, সে আবারও বলে। সে তারপরেও যখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সেই তার দিকে ঝুঁকে এসে তাঁর মসলিনের আলখাল্লার গলার নিচে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে সেটা তার কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে আসে যতক্ষণ না তাঁর স্তনযুগল অনাবৃত হয়। তারপরে, শক্ত করে ঠোঁট চেপে রেখে সে তার স্তনবৃন্তে তুলির অগ্রভাগ আলতো করে ছুঁইয়ে সেগুলোকে আরও গাঢ় করে তুলতে তুলির স্পর্শে তার স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে যায় এবং এসব কিছুই লক্ষ্য না করে লোকটা তার স্তনবৃন্তের চারপাশের আপাত ধুসর ত্বকে ছোট ছোট ফুলের নক্সা আঁকতে থাকে। তার কাজ শেষ হতে সে পুনরায় তাঁর আলখাল্লাটা জায়গামত নামিয়ে দেয় এবং চিৎকার করে বলে, ‘খাজাসারা মালকিন প্রস্তুত।’

 মালা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় তারা দু’জনে জহুরীর চোখ নিয়ে তাকে খুটিয়ে দেখে। তারপরে মালা সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। চমৎকার। তুমি দারুণ কাজ দেখিয়েছে। আর মেহেরুন্নিসাকে সে বলে, বাইরের আঙিনায় আবার ফিরে চলো।’ প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্থানে বন্ধনীযুক্ত মশালদানে মশাল জ্বলতে শুরু করেছে এবং আঙিনার উপরের এক চিলতে আকাশের বুকে তাকিয়ে সে দেখে ইতিমধ্যে রাতের প্রথম তারারা উঁকি দিতে শুরু করেছে, যেন তাকে বলছে প্রস্তুতি নিতে তার কত দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়েছে।

 ‘এসো কিছু খেয়ে নেবে। খাজাসারা ঝর্ণার কাছে একটা রূপার তৈরি কাঠামোর উপরে রাখা একটা পাত্রে রক্ষিত খুবানি, পেস্তা আর অন্যান্য শুকনো ফলের দিকে ইঙ্গিত করে কিন্তু মেহেরুন্নিসার পেটে শক্ত গিট অনুভূত হয় এবং সে মাথা নেড়ে মানা করার সময় মাথায় পরানো অলঙ্কারের ভার অনুভব করে। যেমন তোমার অভিরুচি। খাজাসারা আবার হাততালি দিতে তিন মহিলা পরিচারিকা হলুদ রঙের ব্রোকেডের কাজ করা ঢোলা একটা আলখাল্লা, স্যাটিনের সোনালী রঙের পাদুকা এবং গলায় পরার জন্য হলুদ বিড়ালাক্ষের মত দেখতে পাথরের ছড়া তার গলায় আর কোমড়ে পরাবার জন্য নিয়ে আসে। অনুগ্রহ করে একটু ঘুরে দাঁড়ান যাতে করে আমি অন্তত সন্তুষ্ট হতে পারি যে সবকিছু ঠিক ঠিক করা হয়েছে, পরিচারিকার দল তাদের কাজ শেষ করার পরে মালা কথাটা বলে। মেহেরুন্নিসা অনুগত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে পাক খেয়ে ঘুরতে শুরু করে। মালা তাকে আসন্ন রাতে তাঁর জন্য কি অপেক্ষা করছে খুলে বলার পর থেকেই তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে যে কেউ একজন যেন তার নিয়তির ভার তার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে আর এই বোধটা আশঙ্কাজনকভাবে কেবল প্রবলতর হচ্ছে। সে অচিরেই আরো একবার জাহাঙ্গীরের সামনে নিজেকে দেখতে পাবে। শেষবার তার কি বলা আর করা উচিত সে সম্বন্ধে তার ঠিক ঠিক ধারণা ছিল। এইবার তাঁর কোনো ধারণাই নেই…

যথেষ্ট হয়েছে। মালা বলে। চলুন এবার যাওয়া যাক। সময় হয়ে এসেছে।’

 ‘খাজাসারা… আমাকে পথ দেখান, একটু পরামর্শ দিন।’ সে যদিও তাকে অনুরোধ করে মেহেরুন্নিসা এর জন্য নিজেকে তিরস্কার করে, কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।

মালা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কেমন চাপা একটা হাসি হাসে। তোমার দায়িত্ব সম্রাটকে প্রীত করা। এটুকুই কেবল তোমার জানা থাকা জানা দরকার।

*

মেহেরুন্নিসাকে খোঁজাদের একজন মূল আঙিনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং উপরে সম্রাটের কক্ষের দিকে উঠে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে আসে। মালা সতর্কতার সাথে তাঁর মাথায় সোনালী চুমকি বসানো যে নেকাবটা পরিয়ে দিয়েছে সেটার ঝকমকে পর্দার ভিতর দিয়ে তাকাতে সবকিছু কেমন নির্বাক আর তুচ্ছ মনে হয়–রাজপুত প্রহরীর দল দরজার রুপালি পাল্লাগুলো হট করে খুলে দিয়ে তাকে আর তাঁর সঙ্গী খোঁজাকে অতিক্রম করতে দেয়, জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত কামরার অতিকায় দরজার সোনালী পাল্লাগুলো মনে হয় যেন শীতল শক্ত ধাতুর চেয়ে নরম কাপড়রে মত যেন চকচক করছে।

সোনালী দরজার পাল্লার ঠিক মুখেই অপেক্ষমান মহিলা পরিচারিকাকে মেহেরুন্নিসা জীবনে কখনও দেখেনি, কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে খোঁজা আর মেয়েটা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত। খোঁজাটা মাথা নত করে, বলে, মহামান্য সম্রাটের আদেশ অনুসারে আমি মেহেরুন্নিসাকে নিয়ে এসেছি।’

‘খালেদ আপনাকে ধন্যবাদ, ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা উত্তর দেয় এবং তারপরে, তার সঙ্গে আসা খোঁজাটা বের হয়ে যায় এবং প্রহরীরা সোনালী পাল্লা দুটো বাইরে থেকে টেনে তার পেছনে সেটা বন্দ করে দেয়, মেয়েটা এবার মেহেরুন্নিসার হাত আঁকড়ে ধরে। আমার নাম আশা, আমি মহামান্য সম্রাটের বামা দেহরক্ষীবাহিনীর প্রধান এবং এটা আমার দায়িত্ব যে রাজকীয় শয়নকক্ষে গমনকারী সব রমণী যে নিরস্ত্র সেটা নিশ্চিত করা। অনুগ্রহ করে আপনি হাত তুলে দাঁড়ান। মেয়েটা এবার দ্রুত কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেহেরুন্নিসার দেহ তল্লাশি করে। বেশ। আমার সাথে এসো।’

মেহেরুন্নিসা আশাকে অনুসরণ করে লম্বা কক্ষটার দূরতম প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাবার সময়, বেদীটার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় যেখানে জাহাঙ্গীর তার ভাইয়ের বিচারের সময় উপবেশন করেছিল এবং বেদীটা থেকে প্রায় পনের ফিট পেছনে একটা পর্দা দ্বারা আড়াল করা একটা দরজার নিচে দিয়ে বের হয়ে আসে। দরজাটা তাঁদের বেশ প্রশস্ত একটা করিডোরে পৌঁছে দেয় যার শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটা ছোট বর্গাকার দরজার কাছে যাবার রাস্তাটা আরো রাজপুত সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর নেকাবের ভেতর থেকেও দরজায় বসান পাথর থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া আগ্নেয় আলোর আভা স্পষ্ট দেখতে পায়। আশা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে কথা বলে। এই রমণীকে সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য পাঠান হয়েছে। দরজা খুলে দাও।’ রাজপুত প্রহরীর দল বিনা বাক্য ব্যয়ে আদেশ পালন করে। মেহেরুন্নিসা অনুভব করে আশা তার পিঠের মাঝে আলতো করে হাত রেখে তাকে সামনের দিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষের মাঝে তাকে পথ দেখায়।

 দরজার পাল্লাগুলো তার পেছনে বন্ধ হতে, মেহেরুন্নিসা দাঁড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীর মাত্র কয়েক ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরনের ব্রোকেডের আলখাল্লাটা গলার কাছে রুবির একটা বকলেশ দিয়ে আটকানো, তাঁর কালো চুল কাঁধের উপর ছড়িয়ে রয়েছে।

‘সম্রাট, আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাদের শেষবার দেখা হবার সময় সে যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এত কষ্ট করেছিল দেখা যায় এই দফা তাকে পরিত্যাগ করেছে এবং সে নিজের কণ্ঠস্বরে মৃদু একটা কম্পন টের পায়।

 জাহাঙ্গীর আরো কাছে এগিয়ে আসে। তোমার নেকাবটা খুলে রাখো। সে ধীরে ধীরে হাত তুলে রেশমের চুমকি শোভিত টুকরোটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে এবং সেটাকে ভাসতে ভাসতে মাটিতে পড়তে দেয়। মেহেরুন্নিসা, আমি দীর্ঘসময় আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। আমি আজ রাতটা আপনার সাথে অতিবাহিত করতে চাই, কিন্তু তার আগে আমাকে জানতে হবে আপনি কি আমার সাথে রাত কাটাতে আগ্রহী?

 ‘জাঁহাপনা, আমি আগ্রহী, সে নিজেই কথাগুলো বলছে টের পায়।

 ‘আসুন তাহলে।’ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলের নক্সা তোলা রেশমের চাদর দিয়ে আবৃত বিশাল একটা নিচু বিছানার দিকে এগিয়ে, কিন্তু বিছানায় কোনো বালিশ বা কোনো তাকিয়া কিছুই নেই। বিছানার দুই পাশে রূপার মোমদানিতে জ্বলন্ত লম্বা মোমবাতি বিছানার মসৃণ উপরিভাগে ছায়া ফেলেছে। জাহাঙ্গীর নিজের আলখাল্লাটা খুলে ফেলে এবং অবহেলা ভরে সেটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। মৃদু আলোতে তাঁর তৈলাক্ত, পেষল দেহ চিকচিক করে। মেহেরুন্নিসা যখন ধীরে ধীরে নিজের বসন ত্যাগ করে আপন নগ্নতা প্রতিভাত করতে তখন সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। তিনি যদি জোর করে তাকে নিজের বাহুর ভেতর টেনে আনতেন তাঁর স্বামী শের আফগান মেসটা করতে পছন্দ করতো তারচেয়ে তার দেহের প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা ফাটল চোখে পড়তে জাহাঙ্গীরের চোখে ফুটে উঠা চাঞ্চল্য অনেকবেশি উত্তেজক। অচিরেই যা ঘটতে চলেছে সেটা একটা দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে সূচনা করবে নাকি তাঁদের জীবনের কেবলই স্বল্পকালস্থায়ী একটা অধ্যায় মেহেরুন্নিসার নিজের ভেতরে উপচে উঠা শারীরিক চাহিদার তুলনায় সহসাই গুরুত্বহীন হয়ে উঠে। সে এতদিন বিশ্বাস করে এসেছে যে মন দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু এখন সে বুঝতে পারে ব্যাপারটা সবক্ষেত্রে সত্যি নয়।

জাহাঙ্গীর কিছু বলবে সেজন্য অপেক্ষা না করে সে নিজেই ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে যায় এবং নিজের হাত উঁচু করে সে নিজের সুরভিত দেহ দিয়ে তাঁর দেহকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে। সে অনুভব করে তাঁর স্তনবৃন্ত জাহাঙ্গীরের বুকের কাছে শক্ত হয়ে উঠেছে এবং তার কামোত্তেজনাও কম প্রবল নয়। সে দু’হাতে তাঁর নিতম্ব আঁকড়ে ধরতে সে সহজাত প্রবৃত্তির কারণে সাথে সাথে বুঝতে পারে সে তার কাছে কি চাইছে। সে তার কাঁধ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, সে দু’পায়ে তার কোমর সাপের মত পেঁচিয়ে ধরে। জাহাঙ্গীর তার ওজন সামলাতে গিয়ে আরও জোরে তার নিতম্ব চেপে ধরে এবং নিজের ভেতর সম্রাটের প্রবল উপস্থিতি অনুভব করে সে কেঁপে উঠে এবং চাপানউতোর শুরু হয়। সে যতই তার গভীর থেকে গভীরতর অংশে প্রবিষ্ট হয় ততই তাঁর পিঠ ধনুকের মত বেঁকে যায় আর শীৎকার শুরু করে, তার নখ জাহাঙ্গীরের ত্বক খামচে ধরে তাকে আরো প্রবল হতে উৎসাহিত করে।

‘সোনা অপেক্ষা করো, সে ফিসফিস করে মেহেরুন্নিসার কানে কানে বলে। সে তাকে বিছানার কাছে নিয়ে এসে তাকে সেখানে শুইয়ে দিয়ে আপাতনের ছন্দপতন না ঘটিয়ে তার উপরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। তাঁর মুখ এখন তাঁর ডান স্তনবৃন্তে, তাঁর জীহ্বা সেটাকে উত্তেজিত করে আর তাঁর দাঁত এর চারপাশের নরম জায়গাগুলো ঠোকরাতে থাকে। তাদের দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের বেশ জোরালো হয়। সে টের পায় জাহাঙ্গীরের পিঠ টানটান হয়ে উঠেছে। সে শীর্ষানুভূতির চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে কিন্তু কোনমতে নিজেকে প্রশমিত করে, অপেক্ষা করে সঙ্গীর সহচর্যের। সে শেষ একটা প্রবল অভিঘাতে মেহেরুন্নিসাকেও সেখানে উঠিয়ে আনে। মেহেরুন্নিসা তাঁদের দুজনের সম্মিলিত শীৎকারের শব্দ শুনতে পায় যখন তাঁর ঘামে ভেজা দেহটা ভগ্নস্তূপের মত তার উপরে নেমে আসে আর তারা দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে, হৃৎপিণ্ডে ঝড়ের মাতম। তাকে আপুত করে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া অনুভূতি ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে শুরু করতে সে নিজের আরুক্তম মুখ দিয়ে তার বুকে ঘষতে থাকলে জাহাঙ্গীরের আঙুল তার লম্বা চুল নিয়ে খেলতে থাকে।

*

মেহেরুন্নিসা ছয় ঘন্টা পরে নিদ্রালু ভঙ্গিতে তার চোখের পাতা মেলে এবং আধ-খোলা গবাক্ষ দিয়ে ভোরের ধুসর আলো বর্শার মত নেমে আসতে দেখে। সে সেই সাথে আরও দেখে কেন তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। আশা তাঁর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেহেরুন্নিসা এস্ত ভঙ্গিতে নিজের নগ্ন দেহ রেশমের চাদরের একপাশ টেনে নিয়ে ঢাকতে চেষ্টা করে।

 ‘জাহাপনা,’ আশা পিঠের উপর ভর দিয়ে, একহাত বুকের উপরে রাখা আর অন্যহাত নিজের মাথার উপর প্রসারিত করে, তখনও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন জাহাঙ্গীরের দিতে তাকিয়ে কথাটা বলে। অনুগ্রহ করে উঠেন, জাহাঙ্গীর চোখ খুলে তাকায়। জাহাপনা, ঝরোকা বারান্দায় আপনার উপস্থিতির সময় হয়েছে।’

 জাহাঙ্গীর সাথে সাথে শয্যা থেকে উঠে পড়ে এবং আশা ইতিমধ্যে তার জন্য নিজের হাতে যে রেশমের আলখাল্লাটা ধরে রয়েছে সেটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে মাথা নিচু করে তাকে সুযোগ করে দেয় রেশমের একটা সবুজ পাগড়ি মাথায় পরিয়ে দিতে যেটায় লম্বা একটা সারসের পালক হীরক খচিত ব্রোচ দিয়ে আটকানো রয়েছে। তারপরে, তার দিকে আশার বাড়িয়ে রাখা ব্রোঞ্জের আয়নায় নিজের উপস্থিতি দ্রুত একবার পর্যবেক্ষণ করে, সে রেশমের উড়তে থাকা সবুজ পর্দা সরিয়ে বাইরে অবস্থিত ঝরোকা-ই-দর্শনের, উপস্থিতির বারান্দা যেখান থেকে দিকে যমুনা নদী দেখা যায় সেদিকে, এগিয়ে যায়।

 মেহেরুন্নিসা শয্যা ত্যাগ করে, কক্ষের ভিতর দিয়ে নগ্নভাবেই নেমে এসে পর্দার আড়াল থেকে দেখার জন্য এগিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেমনটা সে প্রতিদিন সকালেই করে নিজের লোকদের কাছে প্রমাণ করতে যে মোগল সম্রাট এখনও জীবিত রয়েছেন। তোরণগৃহে রক্ষিত অতিকায় দুষ্টুভি ঢাকের বোলের তালে সে তার হাত উঁচু করে। দূর্গের নিচে নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার অনুকূল গর্জন শোনার সময় মেহেরুন্নিসাও সেই উত্তেজনায় জারিত হয়। এটাই হল আসল ক্ষমতা যখন একজনের বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া নিয়ে লক্ষ কোটি মানুষ চিন্তিত। দূর্গপ্রাকার থেকে এবার তূর্যধ্বনি ভেসে আসে–সবকিছুই সম্রাটের প্রাত্যহিক কৃত্যানুষ্ঠানের অংশ।

মহান সম্রাট… মেহেরুন্নিসার সহসাই শীত শীত অনুভূত হওয়ায় সে শয্যায় ফিরে আসে এবং তাঁদের দেহের ওমে তখনও উষ্ণ রেশমের চাদরটা দিয়ে নিজের দেহ আবৃত করে। গত রাতে সে মুহূর্তের জন্য ইতস্তত না করে রক্ত মাংসের তৈরি একজন মানুষের কাছে নিজেকে এমন আবেগের সাথে সমর্পিত করেছিল যে সে নিজেই জানতো না তার মাঝে এমন আবেগ রয়েছে। তারা তিনবার দৈহিকভাবে মিলিত হয়েছিল, প্রতিবারই আবেগের প্রচণ্ডতা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কিন্তু এখন দিনের আলোয় চারপাশ অভিষিক্ত এবং তাঁর প্রেমিক মোটেই কোনো সাধারণ লোক নয় বরং একজন সম্রাট যার নিজের পছন্দের কোনো শয্যাসঙ্গিনী থাকা খুবই সম্ভব। তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠালেন? কাবুলে তাকে প্রথমবার দেখার পর থেকে কাটার মত তাকে বিব্রত করতে থাকা একটা বাসনাকে প্রশমিত করতে? কেবলই কৌতূহল?

তাঁর কি আশা করা উচিত? মাঝে মাঝে সম্রাটের শয্যাসঙ্গিণী হবার নিয়তি মেনে নেয়া? তার উপপত্নীর মর্যাদা লাভ করা? তিনি সম্ভবত বাসনা চরিতার্থ করার পরে তার সম্পর্কে আর আগ্রহ প্রদর্শন করবেন না। তার চেয়ে দশ বছরের ছোট কোনো মেয়েকে তিনি অনায়াসে শয্যাসঙ্গিনী করতে পারেন… আধঘন্টা পরে জাহাঙ্গীর যখন ফিরে আসে তখনও সে এই বিষয়টা নিয়েই আকাশ কুসুম ভেবে চলেছে। তিনি ইতিমধ্যেই গোসল করে নিয়েছেন–তাঁর মুখের চারপাশে ভেজা চুলের কালো গোছ ঝুলে আছে। সে আগেই যেমন লক্ষ্য করেছে তার অভিব্যক্তি আন্দাজ করা খুবই কঠিন।

‘সম্রাট, আমি কি এবার হেরেমে ফিরে যাবো? সে জানতে চায়, রাতের অন্ধকারে যে লোকটার বাহুলগ্না হয়ে তার সম্পূর্ণভাবে নিজেকে যার সমকক্ষ মনে হয়েছে তাঁর কাছ থেকে চলে যাবার আদেশ শোনবার চেয়ে প্রশ্নটা সে ইচ্ছে করে নিজেই করে।

 ‘হ্যাঁ।

 মেহেরুন্নিসা নিজের সাবলীল পা দুটো এক ঝটকায় শয্যার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনে এবং ঝুঁকে নিজের হলুদ রঙের আলখাল্লাটা তুলে নেয়। জাহাঙ্গীর তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সে স্তনবৃন্তে তার হাতের আর ঘাড়ের কাছে তার ঠোঁটের উপস্থিতি অনুভব করে। সে তারপরে তাকে এক ঝটকায় তুলে নেয় এবং তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করে।

 ‘তুমি কিছুই বুঝতে পার নি, সে বলে, আর আমি নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই যে আমিও পুরোপুরি বুঝেছি…’

 ‘জাহাপনা?’

 ‘গত রাতে তোমায় এখানে ডেকে পাঠানোটা কিন্তু আমার খেয়াল ছিল না। কাবুলে তোমায় প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই আমি তোমায় কামনা করেছি এবং তোমায় নিয়ে আমার ভাবনা কখনও থেমে থাকেনি। আমি যখন জানতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রে তোমার পরিবারকে মিথ্যা জড়ানো হয়েছে আমি তখন ভয় পেয়েছিলাম ঘটনাটা হয়তো চিরতরে তোমায় আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। একজন সম্রাট কখনও অসন্তোষ… রাজবৈরীতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, উচিত নয়। তাঁর শক্তিশালী চোয়াল দৃঢ়ভাবে চেপে বসে। তুমি যখন আমার সাথে দেখা করার অনুমতির জন্য রীতিমত অনুনয় করেছিলে তখনও আমি জানতাম না তুমি আসলে ঠিক কি অনুরোধ করবে। গিয়াস বেগের ব্যাপারটা খুব একটা জটিল ছিল না। আমি তোমায় তখনই বলেছিলাম আমি ততক্ষণে বিশ্বাস করেছি যে তিনি নির্দোষ। সে যাই হোক, তুমি সাহসিকতার সাথে তাঁর পক্ষাবলম্বন করেছিলে যখন তুমি জানতে যে আমি তাকে ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত করেছি। কিন্তু তোমার ভাই মীর খানের বিষয়ে তোমার আচরণ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল। আমি জানি পরিবারের ভিতরে একজন বিশ্বাসঘাতক থাকলে নিজের কাছে কেমন লাগে…’ তিনি কথাটা শেষ না করে খানিকটা নির্দয় ভঙ্গিতে হাসেন, ‘আমি জানি পরিবারের প্রতি ভালোবাসার টান প্রশমিত করাটা কত কঠিন। সেটা করবার মত সামর্থ্য তোমার রয়েছে–আমি তোমার ভাইয়ের প্রাণদণ্ড কার্যকর করছি তুমি প্রত্যক্ষ করেছে যাতে করে তোমার পরিবারের বাকি সমস্যরা বাঁচবার একটা সুযোগ পায়।

তিনি তাঁর থুতনি উপরের দিকে কাত করে তার মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালে মেহেরুন্নিসার চোখের কোণে কান্নার রেশ জমতে শুরু করে।

 ‘আমার দাদাজান হুমায়ুন নিজের জীবনসঙ্গিনী হামিদার মাঝে আত্মার আত্মীয়কে খুঁজে পেয়েছিলেন। আমার মনে হয় আমি তোমার মাঝেই যাকে খুঁজছি পেয়েছি। আমি তোমায় আমার সম্রাজ্ঞী করতে চাই এবং আমার সব স্ত্রীদের প্রধান। আমার বিরুদ্ধে নিজ পুত্রের বিদ্রোহ দমন করা শেষ হলেই আমরা বিয়ে করবো_যদি তুমি আমায় গ্রহণ করতে সম্মত হও।

 ‘আমি অন্য কারো কথা চিন্তাই করতে পারি না। সে টের পায় তিনি পরম মমতায় তাঁর অশ্রু মুছিয়ে দিচ্ছেন।

কিন্তু আমি তোমায় আরো একটা কথা বলতে চাই। আমি যদি কথাটা না বলি তাহলে আমি নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাব। তোমার স্বামী শের আফগানকে আমার নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছিল। আমিই আগ্রা থেকে গৌড়ে একজন আততায়ী প্রেরণ করেছিলাম তাকে হত্যা করতে।’

মেহেরুন্নিসা চমকে উঠে, সে আরো একবার সেই ধুসর নীল চোখ দুটো নিজের মানস পটে ভেসে উঠতে দেখে। খুনী কি একজন ফিরিঙ্গি ছিল?

‘হা। তার নাম বার্থোলোমিউ হকিন্স। সে এখন আমার দেহরক্ষীদের একজন। আমি তাকে হত্যা করার পরেই কেবল জানতে পেরেছি যে তোমার স্বামী অসংখ্য অপরাধে অপরাধী ছিল–উৎকোচ গ্রহণ, নিষ্ঠুরতা, হুমকি প্রদর্শন করে অর্থ আদায়–কিন্তু তাকে হত্যা করার সময়ে আমি এসব কিছুই জানতাম না। আমি তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলাম কারণ সে আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেহেরুন্নিসা… তুমি কি পারবে আমায় ক্ষমা করতে?

মেহেরুন্নিসা তাঁর আঙুলের অগ্রভাগ জাহাঙ্গীরের ঠোঁটে পরম আবেগে স্থাপন করে। কোনো কিছু বলার কোনো দরকার নেই আর আমার ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। আমি শের আফগানকে ঘৃণা করতাম। সে আমার সাথে ভীষণ নিষ্ঠুর আচরণ করতো। আমি তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি বলে আমি কৃতজ্ঞ।

 ‘তাহলে আমাদের মিলনের মাঝে আর কোনো বাঁধাই রইল না। জাহাঙ্গীর মাথা নুইয়ে এনে মেহেরুন্নিসাকে লম্বা আর আবেগঘন একটা চুম্বন দেয়।

*

পরিচারকের দল তাঁর ব্যক্তিগত দর্শনার্থী কক্ষে তাঁর প্রবেশের জন্য প্রবেশ পথের পর্দা দুপাশে সরিয়ে ধরতে, জাহাঙ্গীর ইয়ার মোহাম্মদের চওড়া কাঠামোটা দেখতে পায়, তাঁর সদ্য নিযুক্ত গোয়ালিওরের শাসনকর্তা। ইয়ার মোহাম্মদ, জাহাঙ্গীরকে দেখা মাত্র, মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত নিজ মাতৃভূমিতে প্রচলিত অভিবাদন জানাবার ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুসারে নিজেকে সামনের দিকে নিক্ষেপ করে, শ্ৰদ্ধাপ্রকাশের জন্য হাত শরীরের দু’পাশে প্রসারিত করে অধোমুখে মাটিতে প্রণত হয়।

 ‘ইয়ার মোহাম্মদ, ওঠো। আমার বিরুদ্ধে আমার বিশ্বাসঘাতক ছেলের সাথে মিলিত হয়ে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল তুমি কি তাদের হাত থেকে পৃথিবীকে মুক্তি দিয়েছো?

 ‘জাঁহাপনা, আমি বিশ্বাস করি, আমি তাঁদের সবাইকে সনাক্ত করতে আর তাদের সবার সাথে হিসাব চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আপনার আদেশ অনুসারে, যারা অপরাধ স্বীকার করেছিল জল্লাদের তরবারির নিচে আমি তাদের দ্রুত আর সহজ মৃত্যু দান করেছি। সাদ আজিজ নামে একজনই কেবল তপ্ত লাল লোহার দ্বারা নির্যাতন করার পরেও নিজের দোষ স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিল। আমার মনে হয় তার ধারণা ছিল সে চালাকি করে আমাদের পরাস্ত করতে এবং বিচার এড়িয়ে যেতে পারবে কিন্তু অন্য একজন ষড়যন্ত্রকারীকে যখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সে সাদ আজিজের লেখা একটা চিঠি আমাকে দেখিয়েছিল– আমার মনে হয় মৃত্যুর পূর্বে সে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চেয়েছে। সাদ আজিজ সেই চিঠিতে যুবরাজ খসরুকে সমর্থন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আমি যখন চিঠিটা নিয়ে তার মুখোমুখি হয় সে ঔদ্ধত্যের চরমে পৌঁছে দাবি করে যে চিঠিটা জাল।

বিশ্বাসঘাতকতা পুরষ্কার সম্বন্ধে সবার সম্যক ধারণা থাকা উচিত বিবেচনা করে আমি তৃণভূমি এলাকায় প্রচলিত প্রাচীন মোগল শাস্তির একটা তাকে দেই, গোয়ালিওর দূর্গের নিচে অবস্থিত বিশাল কুচকাওয়াজ ময়দানে আমি সেনাছাউনি আর শহরের লোকদের সমবেত হবার আদেশ দেই। তোরণগৃহ থেকে দামামার বাদ্যের সাথে আমি সাদ আজিজের চার হাত পায়ের সাথে শক্ত করে বুনো স্ট্যালিয়ন বাঁধার আদেশ দেই। প্রহরীরা ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দেয় এবং চাবুকের আঘাতের বল্পা চালে ঘোড়াগুলোকে ছুটতে বাধ্য করে যাতে করে সাদ আজিজের চার হাত পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসে। আমি তাঁর চার হাত পা দূর্গের চারটা প্রবেশ পথের প্রতিটায় একটা করে স্থাপন করি আর তার দেহ আর মস্তক বাজারে প্রদর্শন করার জন্য রাখা হয়।

ইয়ার মোহাম্মদের বাম গালের সীসা-রঙের ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন বিশিষ্ট সরু মুখটা ভাবলেশহীন দেখায় যখন সে তার কার্যবিবরণী পেশ করে। জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তের জন্য তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তার নিষ্ঠুরতার বিষয়ে নিজের কাছেই প্রশ্ন করে কিন্তু সে যা করেছে সেটা করার এক্তিয়ার তার রয়েছে। সাদ আজিজকে দোষ স্বীকার করার যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তার যন্ত্রণাদায়ক আর লজ্জাজনক মৃত্যু দেখে যদি অন্যরা বিদ্রোহের ভাবনা থেকে নিজেদের বিরত রাখে তাহলে কাজটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। বস্তুত পক্ষে একটা বিষয় জেনে তাঁর ভালো লাগে যে মাত্র তিনমাসের ভিতরে সে তার সন্তানের বিদ্রোহ প্রচেষ্টা পুরোপুরি নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছে। এরপরেও অবশ্য পরবর্তী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাটা তার জন্য খুব কঠিন হয়।

 “আর যুবরাজ খসরু?

 ‘আপনি ঠিক যেমন আদেশ দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে। আপনার প্রেরিত হেকিম, যিনি বাস্তবিকই এসব বিষয়ে ভীষণ দক্ষ, প্রথমেই যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য তাকে আফিম দিয়েছিল। তারপরে আমার চারজন শক্তিশালী সৈন্য তাকে মাটিতে চেপে ধরে এবং পঞ্চমজন তাঁর মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে যখন হেকিম রেশমের মজবুত সুতো দিয়ে তার চোখের পাতা একসাথে শক্ত করে সেলাই করে দেয়। যুবরাজ তার চারপাশের পৃথিবীর কিছুই দেখতে পাবেন না এবং জাহাপনা আপনার আর আপনার সাম্রাজ্যের শান্তির জন্য তিনি এখন আর কোনো হুমকি নন।

জাহাঙ্গীরের কাছে ভাবতে খারাপই লাগে যে তাঁর সুদর্শন আর প্রাণবন্ত ছেলেটার এমন পরিণতি হয়েছে কিন্তু সে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে সে নিজেই এই পরিণতি ডেকে এনেছে। অন্ধ করে দেয়াটা মোগলদের আরেকটা ঐতিহ্যবাহী শাস্তি দেয়ার পদ্ধতি যা তাদের সাথেই মধ্য এশিয়া থেকে হিন্দুস্তানে এসেছে। একজন শাসক এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে নিজের পরিবারের অবাধ্য সদস্যদের হত্যা না করে তাদের নিষ্ক্রিয় করতে পারেন। তাঁর উজির মজিদ খান তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে এভাবেই তার দাদাজান হুমায়ুন নিজের সৎ-ভাইদের ভিতরে সবচেয়ে দুর্দমনীয়, কামরানের সমস্যার সমাধান করেছিল। জাহাঙ্গীর বিষয়টা নিয়ে যতই চিন্তা করেছে ততই তাঁর কাছে মনে হয়েছে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে। কামরানের ক্ষেত্রে তার চোখের মণিতে সুই দিয়ে এঁফোড় ওফোঁড় করার পরে তাতে লবণ আর লেবু ঘষে দিয়ে চিরতরে তাঁর দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। খসরুর চোখের পাতা কেবল সেলাই করে দেয়া হয়েছে, তার সন্তান যদি কোনোদিন সত্যিই নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় সে তখন তাহলে হেকিমকে আবার তাঁর চোখের পাতা খুলে দেয়ার আদেশ দিবে।

জাহাঙ্গীর সহসা একটা শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে কক্ষের প্রবেশ পথে সন্ত্রস্ত দর্শণ এক কর্চিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

 ‘জাহাপনা-’ সে বলতে শুরু করে, কিন্তু মাঝপথেই থেমে যায়।

 ‘আমি আদেশ দিয়েছিলাম যে আমাকে যেন কোনোভাবেই বিরক্ত করা না হয়, আমি ইয়ার মোহাম্মদের সাথে একা আলাপ করতে চাই।’ জাহাঙ্গীর ক্রুদ্ধ চোখে অল্পবয়সী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

 ‘আমি হেরেম থেকে একটা জরুরি সংবাদ নিয়ে এসেছি।’

‘সেটা কি?’ জাহাঙ্গীর ভাবতে গিয়ে সহসাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে, মেহেরুন্নিসার কি কিছু হয়েছে।

‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, মান বাঈ। তাঁর পরিচারিকা তাকে তার বিয়ের পোষাকে নিজের শয্যায় শায়িত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে। তাঁর শয্যার পাশে আফিম মিশ্রিত পানির একটা বোতল পড়ে ছিল। তাঁদের ধারণা তিনি মাত্রাতিরিক্ত সেবন করেছেন–বোতলে কেবল তলানি পড়ে ছিল।

জাহাঙ্গীরের মনটা করুণার সাথে সাথে বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। মান বাঈ সবসময়েই অস্থিরপ্রকৃতির কখনও কখনও উন্মত্ত, এবং তার প্রথম স্ত্রী হবার কারণে একটা সময়ে সে পরবর্তীতে যাদের বিয়ে করেছে তাদের পাগলের মত ঈর্ষা করতো। সে একাধিকবার নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। সে নিশ্চয়ই তার সন্তান খসরুর অন্ধত্বের কথা শুনেছে। গোয়ালিওর থেকে ইয়ার মোহাম্মদের সাথে আগত পরিচারিকাদের একজন নিশ্চয়ই শাস্তির কথা আলোচনা করেছে এবং খবর দ্রুত দেখা যাচ্ছে বেশ তড়িৎ গতিতে ছড়িয়েছে। নিজের সন্তানের প্রতি মান বাঈয়ের অন্ধ স্নেহের কারণে তিনি সবসময়ে ছেলের অপরাধের গুরুত্ব অস্বীকার করেছেন। তিনি সবসময়ে তাকে অবাধ্য, একটু বেশিমাত্রায় প্রাণবন্ত হিসাবেই দেখেছেন। খসরুর উচ্চাশার রক্তলোলুপ গভীরতা এবং সেটা অর্জন করার জন্য সে কত কিছু করতে পারে, তিনি কখনও বোঝার চেষ্টা করেন নি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনি জাহাঙ্গীরের কাছে বারবার অনুরোধ করেছেন খসরুকে ক্ষমা করতে, কখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন কখনওবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আফিম সেবন সম্ভবত সংবাদটা পাবার পরে তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া–শোক আর প্রতিবাদের অভিব্যক্তি। কিন্তু খসরুকে অন্ধ করে দিয়ে তিনি যেমন সন্তুষ্ট বোধ করেন নি তেমনি ব্যাপারটা নিয়ে তার ভিতরে কোনো ধরনের আক্ষেপও নেই। ষড়যন্ত্র দমনে শাস্তি প্রদান করা না হলে, বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। ‘আমি এখনই যাচ্ছি। ইয়ার মোহাম্মদ আমায় মার্জনা করবেন, সে কথাটা বলেই দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে।

হেরেমে মান বাঈয়ের কক্ষের কাছাকাছি পৌঁছাতে, সহসা সে বিলাপধ্বনি শুনতে পায়। সে ভিতরে প্রবেশ করতে, একহাত প্রসারিত করে, ডিভানের উপর নিখুঁতভাবে শুয়ে থাকা একটা আকৃতির চারপাশে তার রাজপুত পরিচারিকাদের জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তাঁর প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছে এটা জানার জন্য জাহাঙ্গীরকে কারো সাথে কোনো কথা বলতে হয় না।

সে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁর মনে সন্দেহ, মর্মপীড়া আর আত্মনিন্দার একটা ঝড় বইতে থাকে। সে তাকে প্রথমবার যখন দেখেছিল সেই মান বাঈয়ের স্মৃতি-তরুণী এবং তাকে তার অশুভ সত্ত্বা দখল করার আগে ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার জন্য কাঙাল-হুহু করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে একটা সময়ে তাকে পছন্দই করতে এবং কখনও তার ক্ষতি চায় নি, এমন নির্মম মৃত্যুর প্রশ্নই উঠে না। তাঁর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু টলটল করতে থাকে, কিন্তু সে চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার আত্মহত্যায় তাকে কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না। খসরু নিজের জীবনের সাথে সাথে আরও অনেকের জীবনই ধ্বংস করেছে, এবং সে, একমাত্র সেই নিজের হঠকারীতা আর স্বার্থপর উচ্চাশার দ্বারা নিজের মায়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। জাহাঙ্গীরের মুখের অভিব্যক্তি কঠোর হয়ে উঠে। সে আর কখনও নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে সুযোগ দেবে না তার রাজতুকে হুমকির সম্মুখীন করে বা তার সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

 ‘অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য চিতা নির্মাণের আদেশ দাও। মান বাঈকে তাঁর হিন্দু ধর্ম অনুসারে দাহ করা হবে কিন্তু সেই সাথে সম্রাটের স্ত্রী হিসাবে তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেখান হবে, সে গম্ভীরভাবে বলে এবং তারপরে একটা কথা না বলে কামরা থেকে বের হয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *