অন্য শোক

অন্য শোক

তোতন-স্মৃতি শীতস্বাপ সংরক্ষণকেন্দ্রের ম্যানেজার রণজিৎ দেবরায়ের পিছুপিছু রক্ষণাগারের পাঁচ নম্বর ঘরের বাইরে সোফায় এসে বসলেন ডক্টর স্বস্তিকা বসু। তাঁর সঙ্গে এলেন ডেভিড হেয়ার হাসপাতলের ডক্টর বিমলিন লাহিড়ী, তাঁর সহকারী ডক্টর দিলীপ গুপ্ত এবং হালডেন হাসপাতালের ডক্টর হোমা রহমান মল্লিক। তাঁরাও বসলেন। স্বস্তিকা বসুর বয়স প্রায় পঞ্চাশ। ইতিহাসের কৃতী ছাত্রী ও কলেজের সুনামি অধ্যাপিকা ডক্টর বসুকে দেখলে কিন্তু বয়স আরও কম বলেই মনে হয়। রণজিৎবাবু তাঁদের বসিয়ে রেখে বললেন, আগে কিছু রুটিনমাফিক নিয়মকৃত্য আছে। সেগুলো হয়ে গেলেই তাঁদের ভেতরে নিয়ে যাবেন।

বসে থাকতে থাকতে স্বস্তিকা বসুর মনের পর্দায় ধ্বনিত হল চল্লিশ বছর আগে শোনা কাকুর কথা–সে দিন তুইই তো সব করবি, ঝিলিক। পঞ্চাশ বছর পরে তোর বাবা-মা, আমি কেউই থাকব না। ভাব-না, বেঁচে থাকলে আমিই পঁচাশি বছরের বুড়ো। লাঠি নিয়ে গুটুর গুটুর করে তোর হাত ধরে আসব। আর তুই তখন চশমা চোখে হাতে ব্যাগ নিয়ে একজন গম্ভীর ডাক্তারবাবু, থুড়ি, ডাক্তারবিবি। মাথার চুলও তোদের মলিনাদির মতন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। শুনে নয় বছরের ঝিলিক খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সেই পরিবেশেই। আজ এত বছর পরে স্বস্তিকা বসুর ঠোঁটে মুহূর্তের জন্য একটা বিষাদ মাখানো হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। না, কাকুর অনেক কথাই মেলেনি। পঞ্চাশ বছর নয়, চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁকে। উনপঞ্চাশ বছরের ঝিলিকের চোখে চশমা ওঠেনি এখনও, চুলেও সাদা রেখা নজরে পড়ে না। কাকু অবশ্য পঁচাশিতে পৌঁছোনোর অনেক আগেই আকস্মিক দুর্ঘটনায় চলে গেলেন বাহান্ন বছর বয়সে। আর নিজেও ডাক্তার হননি, তাঁকে অন্য ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে আসতে হয়েছে।

তবে মিলেছে কিছু। বাবা-মা-ও পরিণত বয়সেই মারা গিয়েছেন মাত্র কয়েক বছর আগে। অবশ্য আজকের দিনে তার চেয়ে বেশি বয়সে কত লোকই তো রাস্তাঘাটে, পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা তো বৃদ্ধ বয়সে এই আনন্দটুকু… থাক, স্বস্তিকা বসু ভাবলেন, কী হতে পারত, হল না, ভাবলে কষ্টটুকুই বাড়ে। অবিবাহিত ঝিলিককেই আজ কাকুর সেই কথামতো পুরো দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। নয় বছর বয়সের সেই দিনটার ছবি মনে ফুটে উঠল তাঁর। এখানেই কোনও সোফাতে তাঁর বাবা-মা বসেছিলেন, যখন দাদাকে নিয়ে যাওয়া হল ভেতরে। মা কাঁদছিলেন। কিছুক্ষণ আগে খুশি-থাকা বাবাও তখন কনুইয়ের ভাঁজে মুখ খুঁজে আছেন। আর কাকু ঝিলিকের হাত ধরে এক কোণে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছেন। দাদু-দিদা, ঠাম্মা, মামু, আরও অনেকে এই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।

এখানে আসার আগে ঘুম পাড়িয়ে রাখা দাদামণিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সমীক্ষা পর্ষদের নির্বাচক সমিতিতে। সেখানে পরপর তিনজন গুরুগম্ভীর লোক বসে। তাঁরাই নাকি নির্বাচক। পেছনে একজন সহকারী দাঁড়িয়ে। পাশের টেবিলে কম্পিউটার সামনে রেখে আরেকজন। নির্বাচকদের একজন বাবা-মা, দাদামণির সবার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। বাবা বললে তাঁরা এবার আইডেন্টিটি কার্ড চাইলেন। ঝিলিক বুঝল না, যদি কার্ডই দেখবে, তাহলে আগে শুধু শুধু নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করার কী দরকার। সব তো কার্ডেই আছে। একজন এবার দাদামণির বয়স জিজ্ঞেস করলেন। বাবা বয়স বলার পরে সেই বিচারক আবার আগের মতো জন্মের সময়কার কম্পিউটার রেকর্ড দেখতে চাইলেন। ঝিলিকের রাগ হল। মা একটা কাগজ দিলে সেটা হাতে নিয়ে মাঝের নির্বাচক পেছনে দাঁড়ানো লোকটার হাতে দিলেন। লোকটা তা-ই নিয়ে চলে গেল। তখন সেই নির্বাচক বাবা-মা-কে বললেন, কিছু মনে করবেন না। ব্যাপারটা জীবনমরণের। তাই দু-একটা কারচুপির ঘটনাও ঘটেছে। সে জন্য এই সাবধানতা। পাঁচ মিনিটেই ওটা ফিরিয়ে দিচ্ছি।

দাদামণির বয়স জানতে চাইছেন কেন, ঝিলিক সেই প্রশ্ন কাকুকে করতে কাকু বললেন, পাঁচ বছর থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত বয়সের ছেলেমেয়েকে শীতস্বাপ সংরক্ষণকেন্দ্রে রাখার নিয়ম আছে আপাতত। তাই বিচারকরা ঝলকের বয়সটা যাচাই করে দেখছেন।

ঝিলিক অবাক হয়ে বলল, কিন্তু দাদামণি তো আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। দেখেই তো বোঝা যায়, পাঁচ বছরের বাচ্চাও না, আবার পঁচিশ বছরের মতন অত্ত বড়ও না। তবে?

কাকু হেসে বললেন, তবুও নির্বাচকরা রেকর্ড না দেখে কিছু বিশ্বাস করেন না।

 ঝিলিক একটু ভেবে নিয়ে বলল, নির্বাচকরা বোকা হয়। তা-ই না কাকু?

কাকু ভয় পেয়ে ঝিলিকের মুখ চেপে ধরে আরও পেছনে চলে গেলেন। বললেন, চুপ, চুপ। ওঁরা রেগে গেলে কিন্তু ঝলককে ফেল করিয়ে দেবেন। ঝিলিকও তাতে ভয় পেয়ে চুপ করে গেল।

একটু পরে জন্মের প্রমাণপত্র ফিরে এল। একজন নির্বাচক সেটা কম্পিউটারের লোকটাকে দিয়ে বললেন, জন্মতারিখ থেকে আজকের তারিখ যত দিন হয়, তাকে তিনশো পঁয়ষট্টি দশমিক দুই পাঁচ দিয়ে ভাগ করে কত হয়, বলো।

মুহূর্তে দাদামণির বয়সের হিসেব একটা ছাপা কাগজে বেরিয়ে এল কম্পিউটার থেকে। মাঝের বিচারক সেটা হাতে নিয়ে বললেন, এগারোর বেশি, বারোর কম। ঠিক আছে। এবার রোগের নাম-বিবরণের রেকর্ডগুলো দিন।

সব হয়ে গেলে দাদামণি পরীক্ষায় পাস করে গেল। নির্বাচকমশাই বললেন, এবার রোগীকে শীতস্বাপ সংরক্ষণকেন্দ্রে রাখা যাবে। এখনই অনুমতিপত্র দেওয়া হচ্ছে। সব রেকর্ডের কপিও রোগীর সঙ্গে থাকবে। পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত রোগীকে হাইবারনেশন বা মহাসুপ্তিতে রেখে দেওয়া হবে। শীতের সময় সাপ-ব্যাং প্রভৃতি প্রাণী যে সুপ্তিতে থাকে, তার চাইতেও প্রগাঢ় এই ঘুম। মেরুপ্রদেশে মাছ বছরে ছ-মাস বরফের তলায় চাপা পড়ে যেমন সাময়িক মৃত্যুতে থাকে, আবার বরফ গললেই জলে খেলে বেড়ায়, এটা সেরকম মহানিদ্রা। এখন পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত রাখারই নিয়ম আছে। এর মধ্যে যে দুরারোগ্য রোগে আপনাদের ছেলের মৃত্যু আর কয়েকদিনের মধ্যেই নিশ্চিত, সেই রোগের নিরাময় যদি আবিষ্কৃত হয়, তবে ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বেঁচে উঠবে। এত বছরে তার বয়স এক ঘণ্টাও বাড়বে না। তবে কয়েকটা শর্ত আছে। একবার কেন্দ্রের রক্ষণাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া হলে আর আপনারা এই সময়কালের মধ্যে রোগীর শরীর কোনও দিন দেখতে পাবেন না। আপনাদের ভাগ্যে থাকলে হয়তো আপনাদের জীবনকালের মধ্যেই আপনাদের ছোট সুন্দর প্রাণবন্ত ছেলেকে ফিরে পাবেন। নয়তো তার পরে হলেও সে বেঁচে উঠে একটা স্বাভাবিক ছেলের মতোই জীবন কাটাবে। আর যদি পঞ্চাশ বছরেও এই দুরারোগ্য রোগের নিরাময় আবিষ্কৃত না হয়, তাহলে ভদ্রলোক হতাশ ভঙ্গিতে দু-হাত উলটোলেন। তারপর আবার বললেন, তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি দেখে মনে হচ্ছে, সে সম্ভাবনা নেই, এই আশাই করতে পারেন।

অনুমতিপত্র নিয়ে যখন তারা বেরিয়ে আসছে, ঝিলিক দেখল, গাড়িতে শোয়ানো একজনের দেহের কাছে বসে দু-তিনজন সমানে কেঁদে যাচ্ছে। ঝিলিক জিজ্ঞেস করে, ও মরে গিয়েছে নাকি, কাকু?

কাকু আস্তে উত্তর দিলেন, না রে। একটুর জন্যে পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি ছেলেটা। বয়স পঁচিশ বছরের চাইতে সাতাশ দিন বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই

বাইরে গাড়ি ছিল। দাদামণিকে তুলে এনে তাতে করে কেন্দ্রে নিয়ে আসা হল। বাবা মা, কাকুর সঙ্গে ঝিলিকও এল। এই ঘরেই একটা সোফাতে বসে ছিলেন মা। কাকু বাইরে গিয়ে দাদুদের খবরটা দিয়ে এসেই তার হাত ধরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। নির্বাচকের কথা শুনে ওখানেই মা কেঁদে উঠেছিলেন। বাবা আর কাকুর মুখে কিন্তু খুশি-খুশি ভাব ফুটে উঠতে দেখেছিল ঝিলিক। এখানে আসার পরে বাবাও মাথা নিচু করে কনুইয়ের ভাঁজে মুখ গুঁজে আছেন। আর কাকু অন্যদিকে ফিরে মুখ চেপে আছেন কান্না ঠেকাতে। দাদুদের বয়স হয়েছে বলে তাঁদের বোঝাতে মামুকে বলেছেন বাবা-মা। তা ছাড়া তিনজনের বেশি তো থাকতেও দেয় না। অবশ্য ঝিলিককে ধরেনি। ঝিলিক সবার ভাবসাব বুঝতে না পেরে বলে উঠল, দাদামণি তো ভালো হয়ে উঠবে, কাকু। তাহলে তোমরা ওরকম করছ কেন?

কাকু থেমে থেমে বললেন, ঝলক যদি পাঁচ বছরের জন্যে একা কোনও দূর দেশে চলে যেত, তাহলে আমাদের মন খারাপ হত না? আর এখানে তো আমাদের সারাজীবনের জন্যে। তবুও তো ঝলক মরে যাচ্ছিল। এখন আর মরবে না। আবার একদিন ভালো হয়ে এখান থেকে বাড়ি ফিরে যাবে। তবুও দাদা-বউদি, আমি, মা, তোর দাদু-দিদা, মামা কারও জীবনেই হয়তো ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না। তাই আমাদের মন খারাপ। ভাব তো, এখন ঝলক ঘুমিয়ে থাকবে ঠান্ডা ঘরে। কোনও ব্যথা নেই, জ্বর নেই। তারপর তো পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ফিরে আসবে আবার সেরকম ছটফটে তোর পেছনে লাগা ঝলক। তখন তুইই তো এখানে এসে ওকে বাড়ি নিয়ে যাবি। ও তখন এরকমই ছোট্ট। তুই তার পড়াশোনার আর বড় করার দায়িত্ব নিবি। আমরা কেউ থাকলে তখন তো থুথুড়ে বুড়ো। আর তুই…। ঝিলিককে কেমন দেখতে হবে, বলতেই ঝিলিক হেসে উঠেছিল।

বাইরে জোরে কার চিৎকার শুনে মুহূর্তে চার দশক এগিয়ে বর্তমানে ফিরে এলেন ডক্টর স্বস্তিকা বসু। সামনের দেয়ালে দেখলেন একটি আট-নয় বছরের ছেলের উপবিষ্ট ফোটো সাদা-কালোয়। এরই নাম তোতন-সমীর। যার নামে এই শীতস্বাপকেন্দ্র করেছেন তার ভাইয়ের বংশের কেউ। শুনেছেন, বিংশ শতকের প্রথমের দিকেই সামান্য নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছিল অসাধারণ মেধাসম্পন্ন বালকটি। তখনও পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়নি। স্বস্তিকা বসু শুনেছেন, তারও আগে অসাধারণ সাহিত্যস্রষ্টা সুকুমার রায়ও মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে যখন কালাজ্বরে মারা গেলেন, তার মাত্র দু-মাস পরে কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করলেন কলকাতারই একজন। তখন শীতস্বাপকেন্দ্রের ব্যবস্থা ছিল না। যেমন গত চল্লিশ বছরে তাঁর দাদামণি ঝলক বা স্বস্তিককে হাইবারনেশনে রেখে দেওয়া হয়েছে। যে রোগে তাঁর দাদামণি মাত্র এগারো বছর বয়সে মারা যাচ্ছিল, তাতে এখন আর কেউ মরে না। পাঁচ বছর আগেই তার অব্যর্থ ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুসারে ওষুধ পরীক্ষিত করার জন্যে আবিষ্কারের পাঁচ বছর পূর্ণ না হলে রোগীর দেহে সেটা প্রয়োগ করা যাবে না–যদি না সংরক্ষণসীমার পঞ্চাশ বছর তাতে ছাড়িয়ে যায়, অথবা সংরক্ষণকেন্দ্রে রাখা যায়নি, এমন কেউ মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে যায়।

বাইরের চিৎকারটা ক্রমে ভেতরে চলে এল। দেখা গেল, একটা উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে চিৎকার করে বলছে, আমি পুলিশে খবর দেব। আপনারা আমাকে কিডন্যাপ করে এনে এখানে আটকে রেখেছেন। কয়েকজন ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এসে মেয়েটিকে কী সব বোঝাতে বোঝাতে নিয়ে গেলেন।

একটু পরে রণজিৎ দেবরায় একটা ফাইল হাতে করে এসে বললেন, এবার আপনারা ওই পাশের ঘরে আসুন। রোগীর দেহ এনে এই ঘরে রাখা হয়েছে। ডাক্তার ছাড়া রোগীর আত্মীয় একজনই আসবেন।

স্বস্তিকা বসু বললেন, আমি রোগীর বোন এসেছি। এঁদের পরিচয় জানেন।

রণজিত্যাবু সবাইকে দেখে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে। যদিও এঁরা প্রখ্যাত চিকিৎসক, তবুও একটা কাগজে আপনার আর এঁদের সই করতে হবে। এটা একটা ফর্মালিটি। আমাদের নিজেদের চিকিৎসক হলে পুরো দায়িত্ব আমাদের। এমনকী, দাবিহীন রোগীদের ক্ষেত্রেও পঞ্চাশ বছর সময়সীমার মধ্যে সুস্থ হয়ে গেলে আমরাই তার আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিই। এ ব্যাপারে পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থাও আমাদের সাহায্য করে। তবে আদৌ কারও কোনও খোঁজ না পাওয়া গেলে আমরা তার মানসিক চিকিৎসা, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নিয়ে নিজেরাই অভিভাবক হই, যত দিন না সে সমাজে পুনর্বাসিত হয়। যেমন, ওই যে মেয়েটি বাইরে রাগারাগি করছিল, ওর ক্ষেত্রে হয়েছে। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর জেগে উঠে এই অজানা পরিবেশে বাবা-মা, ভাইবোন বা পরিচিত কোনও মুখ দেখতে না পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। ওদের পাবেও না কোনও দিন। এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় তাঁরা সপরিবারে মারা গিয়েছিলেন অনেককাল আগে। অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের পরবর্তী প্রজন্মরা এই দায়িত্ব নিতে রাজি বা আগ্রহী কিছুই হয়নি। আসুন এবারে।

হঠাৎ স্বস্তিকা বসুর মনটা থমকে গেল। তাঁর দাদামণিও কি এক রোগ থেকে সেরে উঠে আরেক রোগের শিকার হবে–যে রোগ মানসিক? তার বাবা-মা, কাকু এবং সেই বয়সের বন্ধুদের কাউকে দেখবে না। এমনকী ঝিলিককেও না। উনপঞ্চাশ বছরের গুরুগম্ভীর ডক্টর বসুকে কি তার ছোট্ট বোন বলে মানতে পারবে সে? একটা দেহকে প্রাণবন্ত করে ফিরিয়ে দেবে বিজ্ঞান, কিন্তু সেই মৃত অতীতটাকে কি বাঁচিয়ে সামনে এনে দিতে পারবে? অনেককালের মরে-যাওয়া সেই শৈশবের অতীতটার জন্যে নতুন করে শোকে অভিভূত হলেন স্বস্তিকা বসু।

তার মধ্যেই সবার সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলেন, চল্লিশ বছর আগের দেখা সেই কাচের বাক্সে একটি বালকের ঘুমন্ত রোগপাণ্ডুর মুখ। চল্লিশ বছর আগের এক পঁয়ত্রিশ বছরের লোকের মতোই অন্যদিকে ফিরে কান্না চাপার চেষ্টা করলেন উনপঞ্চাশ বছরের অধ্যাপিকা ডক্টর স্বস্তিকা বসু।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৪১২
এই গল্পটি সন্দেশ, শারদীয়া ১৪০৩-এ প্রকাশিত আরেক শোক গল্পের পরিমার্জিত রূপ।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্য শোক
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

অন্য শোক

অন্য শোক

তোতন-স্মৃতি শীতস্বাপ সংরক্ষণকেন্দ্রের ম্যানেজার রণজিৎ দেবরায়ের পিছুপিছু রক্ষণাগারের পাঁচ নম্বর ঘরের বাইরে সোফায় এসে বসলেন ডক্টর স্বস্তিকা বসু। তাঁর সঙ্গে এলেন ডেভিড হেয়ার হাসপাতলের ডক্টর বিমলিন লাহিড়ী, তাঁর সহকারী ডক্টর দিলীপ গুপ্ত এবং হালডেন হাসপাতালের ডক্টর হোমা রহমান মল্লিক। তাঁরাও বসলেন। স্বস্তিকা বসুর বয়স প্রায় পঞ্চাশ। ইতিহাসের কৃতী ছাত্রী ও কলেজের সুনামি অধ্যাপিকা ডক্টর বসুকে দেখলে কিন্তু বয়স আরও কম বলেই মনে হয়। রণজিৎবাবু তাঁদের বসিয়ে রেখে বললেন, আগে কিছু রুটিনমাফিক নিয়মকৃত্য আছে। সেগুলো হয়ে গেলেই তাঁদের ভেতরে নিয়ে যাবেন।

বসে থাকতে থাকতে স্বস্তিকা বসুর মনের পর্দায় ধ্বনিত হল চল্লিশ বছর আগে শোনা কাকুর কথা–সে দিন তুইই তো সব করবি, ঝিলিক। পঞ্চাশ বছর পরে তোর বাবা-মা, আমি কেউই থাকব না। ভাব-না, বেঁচে থাকলে আমিই পঁচাশি বছরের বুড়ো। লাঠি নিয়ে গুটুর গুটুর করে তোর হাত ধরে আসব। আর তুই তখন চশমা চোখে হাতে ব্যাগ নিয়ে একজন গম্ভীর ডাক্তারবাবু, থুড়ি, ডাক্তারবিবি। মাথার চুলও তোদের মলিনাদির মতন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। শুনে নয় বছরের ঝিলিক খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সেই পরিবেশেই। আজ এত বছর পরে স্বস্তিকা বসুর ঠোঁটে মুহূর্তের জন্য একটা বিষাদ মাখানো হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। না, কাকুর অনেক কথাই মেলেনি। পঞ্চাশ বছর নয়, চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁকে। উনপঞ্চাশ বছরের ঝিলিকের চোখে চশমা ওঠেনি এখনও, চুলেও সাদা রেখা নজরে পড়ে না। কাকু অবশ্য পঁচাশিতে পৌঁছোনোর অনেক আগেই আকস্মিক দুর্ঘটনায় চলে গেলেন বাহান্ন বছর বয়সে। আর নিজেও ডাক্তার হননি, তাঁকে অন্য ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে আসতে হয়েছে।

তবে মিলেছে কিছু। বাবা-মা-ও পরিণত বয়সেই মারা গিয়েছেন মাত্র কয়েক বছর আগে। অবশ্য আজকের দিনে তার চেয়ে বেশি বয়সে কত লোকই তো রাস্তাঘাটে, পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা তো বৃদ্ধ বয়সে এই আনন্দটুকু… থাক, স্বস্তিকা বসু ভাবলেন, কী হতে পারত, হল না, ভাবলে কষ্টটুকুই বাড়ে। অবিবাহিত ঝিলিককেই আজ কাকুর সেই কথামতো পুরো দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। নয় বছর বয়সের সেই দিনটার ছবি মনে ফুটে উঠল তাঁর। এখানেই কোনও সোফাতে তাঁর বাবা-মা বসেছিলেন, যখন দাদাকে নিয়ে যাওয়া হল ভেতরে। মা কাঁদছিলেন। কিছুক্ষণ আগে খুশি-থাকা বাবাও তখন কনুইয়ের ভাঁজে মুখ খুঁজে আছেন। আর কাকু ঝিলিকের হাত ধরে এক কোণে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছেন। দাদু-দিদা, ঠাম্মা, মামু, আরও অনেকে এই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।

এখানে আসার আগে ঘুম পাড়িয়ে রাখা দাদামণিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সমীক্ষা পর্ষদের নির্বাচক সমিতিতে। সেখানে পরপর তিনজন গুরুগম্ভীর লোক বসে। তাঁরাই নাকি নির্বাচক। পেছনে একজন সহকারী দাঁড়িয়ে। পাশের টেবিলে কম্পিউটার সামনে রেখে আরেকজন। নির্বাচকদের একজন বাবা-মা, দাদামণির সবার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। বাবা বললে তাঁরা এবার আইডেন্টিটি কার্ড চাইলেন। ঝিলিক বুঝল না, যদি কার্ডই দেখবে, তাহলে আগে শুধু শুধু নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করার কী দরকার। সব তো কার্ডেই আছে। একজন এবার দাদামণির বয়স জিজ্ঞেস করলেন। বাবা বয়স বলার পরে সেই বিচারক আবার আগের মতো জন্মের সময়কার কম্পিউটার রেকর্ড দেখতে চাইলেন। ঝিলিকের রাগ হল। মা একটা কাগজ দিলে সেটা হাতে নিয়ে মাঝের নির্বাচক পেছনে দাঁড়ানো লোকটার হাতে দিলেন। লোকটা তা-ই নিয়ে চলে গেল। তখন সেই নির্বাচক বাবা-মা-কে বললেন, কিছু মনে করবেন না। ব্যাপারটা জীবনমরণের। তাই দু-একটা কারচুপির ঘটনাও ঘটেছে। সে জন্য এই সাবধানতা। পাঁচ মিনিটেই ওটা ফিরিয়ে দিচ্ছি।

দাদামণির বয়স জানতে চাইছেন কেন, ঝিলিক সেই প্রশ্ন কাকুকে করতে কাকু বললেন, পাঁচ বছর থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত বয়সের ছেলেমেয়েকে শীতস্বাপ সংরক্ষণকেন্দ্রে রাখার নিয়ম আছে আপাতত। তাই বিচারকরা ঝলকের বয়সটা যাচাই করে দেখছেন।

ঝিলিক অবাক হয়ে বলল, কিন্তু দাদামণি তো আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। দেখেই তো বোঝা যায়, পাঁচ বছরের বাচ্চাও না, আবার পঁচিশ বছরের মতন অত্ত বড়ও না। তবে?

কাকু হেসে বললেন, তবুও নির্বাচকরা রেকর্ড না দেখে কিছু বিশ্বাস করেন না।

 ঝিলিক একটু ভেবে নিয়ে বলল, নির্বাচকরা বোকা হয়। তা-ই না কাকু?

কাকু ভয় পেয়ে ঝিলিকের মুখ চেপে ধরে আরও পেছনে চলে গেলেন। বললেন, চুপ, চুপ। ওঁরা রেগে গেলে কিন্তু ঝলককে ফেল করিয়ে দেবেন। ঝিলিকও তাতে ভয় পেয়ে চুপ করে গেল।

একটু পরে জন্মের প্রমাণপত্র ফিরে এল। একজন নির্বাচক সেটা কম্পিউটারের লোকটাকে দিয়ে বললেন, জন্মতারিখ থেকে আজকের তারিখ যত দিন হয়, তাকে তিনশো পঁয়ষট্টি দশমিক দুই পাঁচ দিয়ে ভাগ করে কত হয়, বলো।

মুহূর্তে দাদামণির বয়সের হিসেব একটা ছাপা কাগজে বেরিয়ে এল কম্পিউটার থেকে। মাঝের বিচারক সেটা হাতে নিয়ে বললেন, এগারোর বেশি, বারোর কম। ঠিক আছে। এবার রোগের নাম-বিবরণের রেকর্ডগুলো দিন।

সব হয়ে গেলে দাদামণি পরীক্ষায় পাস করে গেল। নির্বাচকমশাই বললেন, এবার রোগীকে শীতস্বাপ সংরক্ষণকেন্দ্রে রাখা যাবে। এখনই অনুমতিপত্র দেওয়া হচ্ছে। সব রেকর্ডের কপিও রোগীর সঙ্গে থাকবে। পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত রোগীকে হাইবারনেশন বা মহাসুপ্তিতে রেখে দেওয়া হবে। শীতের সময় সাপ-ব্যাং প্রভৃতি প্রাণী যে সুপ্তিতে থাকে, তার চাইতেও প্রগাঢ় এই ঘুম। মেরুপ্রদেশে মাছ বছরে ছ-মাস বরফের তলায় চাপা পড়ে যেমন সাময়িক মৃত্যুতে থাকে, আবার বরফ গললেই জলে খেলে বেড়ায়, এটা সেরকম মহানিদ্রা। এখন পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত রাখারই নিয়ম আছে। এর মধ্যে যে দুরারোগ্য রোগে আপনাদের ছেলের মৃত্যু আর কয়েকদিনের মধ্যেই নিশ্চিত, সেই রোগের নিরাময় যদি আবিষ্কৃত হয়, তবে ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বেঁচে উঠবে। এত বছরে তার বয়স এক ঘণ্টাও বাড়বে না। তবে কয়েকটা শর্ত আছে। একবার কেন্দ্রের রক্ষণাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া হলে আর আপনারা এই সময়কালের মধ্যে রোগীর শরীর কোনও দিন দেখতে পাবেন না। আপনাদের ভাগ্যে থাকলে হয়তো আপনাদের জীবনকালের মধ্যেই আপনাদের ছোট সুন্দর প্রাণবন্ত ছেলেকে ফিরে পাবেন। নয়তো তার পরে হলেও সে বেঁচে উঠে একটা স্বাভাবিক ছেলের মতোই জীবন কাটাবে। আর যদি পঞ্চাশ বছরেও এই দুরারোগ্য রোগের নিরাময় আবিষ্কৃত না হয়, তাহলে ভদ্রলোক হতাশ ভঙ্গিতে দু-হাত উলটোলেন। তারপর আবার বললেন, তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি দেখে মনে হচ্ছে, সে সম্ভাবনা নেই, এই আশাই করতে পারেন।

অনুমতিপত্র নিয়ে যখন তারা বেরিয়ে আসছে, ঝিলিক দেখল, গাড়িতে শোয়ানো একজনের দেহের কাছে বসে দু-তিনজন সমানে কেঁদে যাচ্ছে। ঝিলিক জিজ্ঞেস করে, ও মরে গিয়েছে নাকি, কাকু?

কাকু আস্তে উত্তর দিলেন, না রে। একটুর জন্যে পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি ছেলেটা। বয়স পঁচিশ বছরের চাইতে সাতাশ দিন বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই

বাইরে গাড়ি ছিল। দাদামণিকে তুলে এনে তাতে করে কেন্দ্রে নিয়ে আসা হল। বাবা মা, কাকুর সঙ্গে ঝিলিকও এল। এই ঘরেই একটা সোফাতে বসে ছিলেন মা। কাকু বাইরে গিয়ে দাদুদের খবরটা দিয়ে এসেই তার হাত ধরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। নির্বাচকের কথা শুনে ওখানেই মা কেঁদে উঠেছিলেন। বাবা আর কাকুর মুখে কিন্তু খুশি-খুশি ভাব ফুটে উঠতে দেখেছিল ঝিলিক। এখানে আসার পরে বাবাও মাথা নিচু করে কনুইয়ের ভাঁজে মুখ গুঁজে আছেন। আর কাকু অন্যদিকে ফিরে মুখ চেপে আছেন কান্না ঠেকাতে। দাদুদের বয়স হয়েছে বলে তাঁদের বোঝাতে মামুকে বলেছেন বাবা-মা। তা ছাড়া তিনজনের বেশি তো থাকতেও দেয় না। অবশ্য ঝিলিককে ধরেনি। ঝিলিক সবার ভাবসাব বুঝতে না পেরে বলে উঠল, দাদামণি তো ভালো হয়ে উঠবে, কাকু। তাহলে তোমরা ওরকম করছ কেন?

কাকু থেমে থেমে বললেন, ঝলক যদি পাঁচ বছরের জন্যে একা কোনও দূর দেশে চলে যেত, তাহলে আমাদের মন খারাপ হত না? আর এখানে তো আমাদের সারাজীবনের জন্যে। তবুও তো ঝলক মরে যাচ্ছিল। এখন আর মরবে না। আবার একদিন ভালো হয়ে এখান থেকে বাড়ি ফিরে যাবে। তবুও দাদা-বউদি, আমি, মা, তোর দাদু-দিদা, মামা কারও জীবনেই হয়তো ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না। তাই আমাদের মন খারাপ। ভাব তো, এখন ঝলক ঘুমিয়ে থাকবে ঠান্ডা ঘরে। কোনও ব্যথা নেই, জ্বর নেই। তারপর তো পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ফিরে আসবে আবার সেরকম ছটফটে তোর পেছনে লাগা ঝলক। তখন তুইই তো এখানে এসে ওকে বাড়ি নিয়ে যাবি। ও তখন এরকমই ছোট্ট। তুই তার পড়াশোনার আর বড় করার দায়িত্ব নিবি। আমরা কেউ থাকলে তখন তো থুথুড়ে বুড়ো। আর তুই…। ঝিলিককে কেমন দেখতে হবে, বলতেই ঝিলিক হেসে উঠেছিল।

বাইরে জোরে কার চিৎকার শুনে মুহূর্তে চার দশক এগিয়ে বর্তমানে ফিরে এলেন ডক্টর স্বস্তিকা বসু। সামনের দেয়ালে দেখলেন একটি আট-নয় বছরের ছেলের উপবিষ্ট ফোটো সাদা-কালোয়। এরই নাম তোতন-সমীর। যার নামে এই শীতস্বাপকেন্দ্র করেছেন তার ভাইয়ের বংশের কেউ। শুনেছেন, বিংশ শতকের প্রথমের দিকেই সামান্য নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছিল অসাধারণ মেধাসম্পন্ন বালকটি। তখনও পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়নি। স্বস্তিকা বসু শুনেছেন, তারও আগে অসাধারণ সাহিত্যস্রষ্টা সুকুমার রায়ও মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে যখন কালাজ্বরে মারা গেলেন, তার মাত্র দু-মাস পরে কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করলেন কলকাতারই একজন। তখন শীতস্বাপকেন্দ্রের ব্যবস্থা ছিল না। যেমন গত চল্লিশ বছরে তাঁর দাদামণি ঝলক বা স্বস্তিককে হাইবারনেশনে রেখে দেওয়া হয়েছে। যে রোগে তাঁর দাদামণি মাত্র এগারো বছর বয়সে মারা যাচ্ছিল, তাতে এখন আর কেউ মরে না। পাঁচ বছর আগেই তার অব্যর্থ ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুসারে ওষুধ পরীক্ষিত করার জন্যে আবিষ্কারের পাঁচ বছর পূর্ণ না হলে রোগীর দেহে সেটা প্রয়োগ করা যাবে না–যদি না সংরক্ষণসীমার পঞ্চাশ বছর তাতে ছাড়িয়ে যায়, অথবা সংরক্ষণকেন্দ্রে রাখা যায়নি, এমন কেউ মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে যায়।

বাইরের চিৎকারটা ক্রমে ভেতরে চলে এল। দেখা গেল, একটা উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে চিৎকার করে বলছে, আমি পুলিশে খবর দেব। আপনারা আমাকে কিডন্যাপ করে এনে এখানে আটকে রেখেছেন। কয়েকজন ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এসে মেয়েটিকে কী সব বোঝাতে বোঝাতে নিয়ে গেলেন।

একটু পরে রণজিৎ দেবরায় একটা ফাইল হাতে করে এসে বললেন, এবার আপনারা ওই পাশের ঘরে আসুন। রোগীর দেহ এনে এই ঘরে রাখা হয়েছে। ডাক্তার ছাড়া রোগীর আত্মীয় একজনই আসবেন।

স্বস্তিকা বসু বললেন, আমি রোগীর বোন এসেছি। এঁদের পরিচয় জানেন।

রণজিত্যাবু সবাইকে দেখে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে। যদিও এঁরা প্রখ্যাত চিকিৎসক, তবুও একটা কাগজে আপনার আর এঁদের সই করতে হবে। এটা একটা ফর্মালিটি। আমাদের নিজেদের চিকিৎসক হলে পুরো দায়িত্ব আমাদের। এমনকী, দাবিহীন রোগীদের ক্ষেত্রেও পঞ্চাশ বছর সময়সীমার মধ্যে সুস্থ হয়ে গেলে আমরাই তার আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিই। এ ব্যাপারে পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থাও আমাদের সাহায্য করে। তবে আদৌ কারও কোনও খোঁজ না পাওয়া গেলে আমরা তার মানসিক চিকিৎসা, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নিয়ে নিজেরাই অভিভাবক হই, যত দিন না সে সমাজে পুনর্বাসিত হয়। যেমন, ওই যে মেয়েটি বাইরে রাগারাগি করছিল, ওর ক্ষেত্রে হয়েছে। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর জেগে উঠে এই অজানা পরিবেশে বাবা-মা, ভাইবোন বা পরিচিত কোনও মুখ দেখতে না পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। ওদের পাবেও না কোনও দিন। এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় তাঁরা সপরিবারে মারা গিয়েছিলেন অনেককাল আগে। অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের পরবর্তী প্রজন্মরা এই দায়িত্ব নিতে রাজি বা আগ্রহী কিছুই হয়নি। আসুন এবারে।

হঠাৎ স্বস্তিকা বসুর মনটা থমকে গেল। তাঁর দাদামণিও কি এক রোগ থেকে সেরে উঠে আরেক রোগের শিকার হবে–যে রোগ মানসিক? তার বাবা-মা, কাকু এবং সেই বয়সের বন্ধুদের কাউকে দেখবে না। এমনকী ঝিলিককেও না। উনপঞ্চাশ বছরের গুরুগম্ভীর ডক্টর বসুকে কি তার ছোট্ট বোন বলে মানতে পারবে সে? একটা দেহকে প্রাণবন্ত করে ফিরিয়ে দেবে বিজ্ঞান, কিন্তু সেই মৃত অতীতটাকে কি বাঁচিয়ে সামনে এনে দিতে পারবে? অনেককালের মরে-যাওয়া সেই শৈশবের অতীতটার জন্যে নতুন করে শোকে অভিভূত হলেন স্বস্তিকা বসু।

তার মধ্যেই সবার সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলেন, চল্লিশ বছর আগের দেখা সেই কাচের বাক্সে একটি বালকের ঘুমন্ত রোগপাণ্ডুর মুখ। চল্লিশ বছর আগের এক পঁয়ত্রিশ বছরের লোকের মতোই অন্যদিকে ফিরে কান্না চাপার চেষ্টা করলেন উনপঞ্চাশ বছরের অধ্যাপিকা ডক্টর স্বস্তিকা বসু।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৪১২
এই গল্পটি সন্দেশ, শারদীয়া ১৪০৩-এ প্রকাশিত আরেক শোক গল্পের পরিমার্জিত রূপ।]