অদৃশ্য আততায়ী

অদৃশ্য আততায়ী

ভোরবেলায় একটা হইচই কানে আসতেই ডক্টর কৌস্তুভ সান্যালের ঘুম ভেঙে গেল। ল্যাবরেটরি থেকে আসতে কাল একটু বেশিই রাত্তির হয়েছিল। ঘরের বাইরে আসতে তাঁর পরিচারক তথা পরিচালক অর্জুন খবরটা দিল, এবার আমাদের বাড়ির সামনেই মেরেছে, দাদাবাবু। একসঙ্গে দুটো–একটা বুড়ো আর একটা বাচ্চা।

ডক্টর সান্যাল বুঝলেন, আবার দু-জন নিদ্রিত ফুটপাথবাসী বলি হল সেই তথাকথিত গ্যাসম্যানের হাতে। এত দিন ডালহৌসি স্কোয়্যার, গড়িয়াহাট মোড়, শ্যামবাজার মোড় এইসব ব্যস্ত জায়গাতেই ঘটনাগুলো ঘটছিল। এবার তাঁর রমেশ মিত্র রোডের বাড়ির সামনেই। এই নিয়ে তাহলে প্রায় এক ডজন হতে চলল। গত কয়েকদিন ধরে, বলতে গেলে, কয়েকরাত ধরে এই ডিসেম্বরের শীতের রাতে ফুটপাথে শুয়ে-থাকা গরিব লোকদের কে বা কারা একে একে বিষাক্ত গ্যাস শুকিয়ে মেরে ফেলছে। পুলিশ এ পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি। খবরের কাগজ তো পুলিশ আর সরকারের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। লিখেছে, অনেককাল আগে এইভাবেই কোনও দুষ্কৃতী কলকাতার নানান জায়গায় ঘুমন্ত ফুটপাথবাসীদের মাথা পাথর দিয়ে পিষে হত্যা করত রাতের অন্ধকারে। কী তার বা তাদের উদ্দেশ্য ছিল, জানাই গেল না। কাউকে চিহ্নিত করতে সেবারও ব্যর্থ হয়েছিল পুলিশ।

আগের সেই অদৃশ্য ঘাতকের নাম লোকে দিয়েছিল স্টোনম্যান, মানে প্রস্তরমানব।

 রাস্তায় নামতেই দেখলেন, পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে এলেন তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র সুগত দাশগুপ্ত। বললেন, নমস্কার স্যার। এবারেও একইভাবে মেরেছে। দু-জনেরই মুখ দেখুন, সেই নীলচে আভা। ময়নাতদন্তেও মনে হয়, সেই মিশ্র গ্যাসের প্রয়োগ ধরা পড়বে।

বৃদ্ধ লোকটির মৃত্যু অতটা ব্যথিত না করলেও বছর পাঁচেকের শিশুটির মৃত্যু তাঁর বুকে মোচড় মারল। স্টোনম্যানের চাইতেও হৃদয়হীন এই গ্যাসম্যান। স্টোনম্যান কোনও শিশুকে হত্যা করেনি। খাওয়াদাওয়া সেরে সকাল সকাল তিনি তাঁর গবেষণাগারের উদ্দেশে রওনা হলেন। তিনি আর ডক্টর নিরূপ কুণ্ডু মিলে যে যন্ত্রের উদ্ভাবন করার শেষ পর্যায়ে, তার নাম গ্যাস কমপোনেন্ট রেকগনাইজার বা সংক্ষেপে জিসিআর। এই কম্পিউটারাইজড যন্ত্র প্রায় সহস্ররকম মৌল ও যৌগ গ্যাসের সংস্পর্শে এলেই তার পর্দায় কেবলমাত্র সেই গ্যাসগুলোর ফর্মুলাই ডিসপ্লে করবে না, পারিপার্শ্বিক মিশ্রিত গ্যাসে তাদের শতাংশের অনুপাতও ফর্মুলাগুলির পাশে দেখাবে। নিম্নতম এক হাজার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ০.০০১ শতাংশ পর্যন্ত এই যন্ত্রে ধরা পড়বে। ডক্টর সান্যাল একজন ইলেকট্রনিক্স বিজ্ঞানী। ডক্টর নিরূপ কুণ্ডু রসায়নবিদ। বাতাসে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের সিংহভাগ শতাংশ তো আছেই। তা ছাড়া রসায়নাগারে ক্লোরিন, হাইড্রোজেন প্রভৃতি মৌল গ্যাস এবং অ্যামোনিয়া, মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, এমনকী জলীয় বাষ্প পর্যন্ত প্রায় এক হাজার গ্যাস নিয়ে পরীক্ষা করে তাঁরা আজ সফল। ডক্টর কুণ্ডু অন্যভাবে পরিপার্শ্বের গ্যাসের আয়তন মেপে দেখেছেন যে, কম্পিউটার তাঁর থেকেও অনেক নিখুঁতভাবে পরিমাপ করছে। সেই গ্যাসগুলির। এর জন্য মাঝে মাঝেই বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন তাঁরা, বিশেষত ডক্টর সান্যাল। আগ বাড়িয়ে নিজেই কখনও জলের মধ্যে ক্যালশিয়াম কার্বাইড ফেলছেন, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে মার্বেল পাথর ফেলছেন, নাইট্রিক অ্যাসিডে…

ডক্টর কুণ্ডু তাড়াতাড়ি হাত চেপে ধরেন কখনও। এখনই এমন করতে যাচ্ছিলেন, যাতে দু-জনেরই গবেষণার ইতি হয়ে যেত। মারাত্মক বিষাক্ত সায়ানোজেন গ্যাসও এর মধ্যে উৎপন্ন হত। এমনিতেই তো ডক্টর সান্যাল বেশ কিছু দিন ধরে অ্যাজমাটিক ব্রঙ্কাইটিসে ভুগছেন।

আগামী ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রর জন্মদিনকেই তাঁরা ঠিক করেছেন, যে দিন কলকাতার বিজ্ঞান নগরীতে বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির সামনে এই যন্ত্রের কার্যকারিতা প্রদর্শন করবেন। এই মর্মে কাগজে ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি তাঁরা দিয়েছেন। অনেক কাজেই এই যন্ত্র ব্যবহার হতে পারে। খনিগর্ভে বা অন্য কোনও গহ্বরে ঢোকার আগে এই যন্ত্র পাঠিয়ে তার বাতাবরণের নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে। এমনকী তাঁরা এ-ও আশা করেন, ভবিষ্যতে দূরদূরান্তরের গ্রহে এই যন্ত্র পাঠিয়ে সেখানকার গ্যাসীয় আবহাওয়ামণ্ডল সম্পর্কে আরও সঠিক জ্ঞান মানুষ পাবে।

গতকালের মতো আজও রাত হয়ে গিয়েছিল। ডক্টর কুণ্ডু হেসে বললেন, আপনাকে নেশায় পেয়ে গেল দেখছি, ডক্টর সান্যাল। সবরকমভাবেই যাচাই করা হয়েছে। যন্ত্রটা যে নিখুঁত তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। জিসিআর সফল। থাক-না আজকের মতো। আপনি তো অনেকগুলি মডেল বানিয়ে ফেলেছেন। সব কটি একই রিডিং দিচ্ছে। এবার পাততাড়ি গোটানো যাক।

ডক্টর সান্যাল বললেন, হ্যাঁ, তা-ই ভালো। তবে একটা পোর্টেবল জিসিআর আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। আরও দু-চারটে পারিবারিক মিশ্র গ্যাসের কাছে ধরে দেখব। যেমন চায়ের ধোঁয়া, অর্জুনের বিড়ির ধোঁয়া। পরে আপনি মিলিয়ে দেখবেন যন্ত্রের নাসিকাশক্তি সঠিক কি না।

ডক্টর কুণ্ডু মনে মনে বললেন, পাগল! প্রকাশ্যে বললেন, আপনার সালবুটামল ইনহেলারই তো যন্ত্রটা বেশি করে শুঁকছে, ডক্টর সান্যাল। সত্যিই, হাঁপানির জন্য ডক্টর কৌস্তুভ সান্যালকে ঘন ঘনই এই শ্বাসনালি-প্রসারক গ্যাস নিতে হয়। তবে তিনি ভাবলেন, ডক্টর কুণ্ডুও তো এই গ্যাসমণ্ডলের মধ্যে তেমন সুস্থ নেই। হয়তো তাঁকেও নিতে হবে ভবিষ্যতে।

তবে দেখা যাচ্ছে, আরও ভালো হাঁপানির ওষুধ বেরিয়েছে। আহা, আসুক।

ডক্টর নিরূপ কুণ্ডু নিজের গাড়িতে তাঁর দক্ষিণ শহরতলির বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেন। ডক্টর সান্যাল একটা ট্যাক্সি ধরে নিলেন। ব্রিফকেসের আকারের পোর্টেবল জিসিআর হাতে নিয়ে রওনা হলেন তাঁর ভবানীপুরের বাড়ির উদ্দেশে। হাজরা রোডে এসে তিনি ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লেন। কিছু ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছে। ভুলেই গিয়েছিলেন কেনার কথা। রাতদিনের খোলা ওষুধের দোকান থেকে কিনে নিলেন ওষুধ। তারপর একটা গলি দিয়ে তাঁর বাড়ির দিকে এগোলেন।

শীতের রাতে বড় রাস্তায় কিছু লোকজন আর গাড়ির আনাগোনা থাকলেও এই গলি নির্জন। দু-একটা পান-সিগারেটের দোকান খোলা আছে। একটু দূরেই দেখলেন, তাঁর ভবানীপুরবাসী এক প্রাক্তন ছাত্র শুভব্রত তার স্ত্রী ও দুই ছোট্ট ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। তিনি আর তাকে ডাকলেন না। হয়তো নিমন্ত্রণ বা কোনও উপলক্ষ্যে গিয়েছিল। বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। তিনি দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।

পরের দিন সকালে সংবাদপত্রের প্রথম পাতাতেই খবরটা দেখে ডক্টর কৌস্তুভ সান্যাল এতটাই চমকে উঠলেন যে, তাঁর হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে খানখান হয়ে ভেঙে গেল। অর্জুন ছুটে এল। কিন্তু তার কোনও প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে পড়ে চললেন খবরটা। দীর্ঘ শিরোনাম দিয়েছে–পথচারী শিশুও গ্যাসম্যানের বলি! চার বছরের ঋদ্ধিমান বসু তার বাবা-মা-র সঙ্গে পথ দিয়ে যাচ্ছিল। বাবার হাতে ছিল আত্মীয়বাড়ি থেকে সঙ্গে দিয়ে দেওয়া মিষ্টান্নের প্যাকেট। মা-র কোলে ছিল তার বছর দেড়েকের ছোট বোন। কিছুক্ষণের জন্য শিশুটি তার বাবার হাতছাড়া হয়ে পেছনে হাঁটছিল। নির্জন পথের আধো অন্ধকারে হঠাৎ সে রাস্তায় পড়ে গিয়ে গোঙাতে থাকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে মারা যায়। ময়নাতদন্তের আগে কিছু বলা সম্ভব না হলেও চিকিৎসকের সন্দেহ, কোনও বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবেই তার মৃত্যু হয়েছে। খবরাখবর-এর সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, পথের পাশের এক পানের দোকানদারের বিবৃতি অনুযায়ী, ঘটনার ঠিক আগেই শিশুটির কাছ দিয়ে একজন লম্বা ব্যক্তিকে দ্রুত চলে যেতে দেখা যায়। অস্পষ্ট আলোয় ভালোভাবে দেখা না গেলেও লোকটির পরনে সাদাটে রঙের স্যুট, হাতে নীল রঙের ব্রিফকেস আর মাথায় লাল উলের বাঁদরটুপি ছিল। নির্জন গলি এবং সম্ভাব্য ক্রেতা মনে করেই দোকানদার তাকে লক্ষ করেছিলেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে বলে প্রকাশ।

ডক্টর সান্যাল অবাক হয়ে ভাবেন, কয়েক ঘণ্টা আগে যে শিশুটিকে বাবা-মা-র সঙ্গে হেঁটে যেতে দেখেছেন, সে এখন খবর! কী তৎপরতার সঙ্গে কাজ করে এখনকার সংবাদমাধ্যম! রাতের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এত কাণ্ড হয়ে গেল, যখন তিনি অনেকদিন পর ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিশ্চিত নিদ্রার ঘোরে আচ্ছন্ন।

তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলেন, পানের দোকানওয়ালা যার বর্ণনা দিয়েছে, তিনি নিজেই সেই ব্যক্তি। জিসিআর-এর কেসটা নীল রঙেরই। তা ছাড়া স্যুট, বাঁদরটুপি সবই মিলে যাচ্ছে। তিনি ভাবলেন, পুলিশের কাছে গিয়ে কি সব বলে দেবেন? মুহূর্তে এই ভাবনা ভুলে গিয়ে তিনি একটু পরেই বেরিয়ে পড়লেন শুভব্ৰতর বাড়ির উদ্দেশে। সেখানেই তিনি যা বলার বলবেন। তা ছাড়া, তাঁর মনে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে, সেটাও যাচাই করা দরকার অবিলম্বে।

সে দিন তাঁর ল্যাবরেটরিতে যাওয়ার দিন ছিল না। সারাটা দিন আনমনাভাবে কাটিয়ে রাত্তিরে কর্তব্য ঠিক করে নিলেন। মাঝরাত্তির পার করে তিনি চুপচাপ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন। অর্জুনকে জাগালেন না। তাঁর বাড়ির লাগোয়া গলিটার মুখে অনেকে শুয়ে আছে। এখানেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল দু-জন অসমবয়সি মানুষকে। ডক্টর সান্যালের হাতে একটি ঘনকাকার ছোট যন্ত্র। নীল ঢাকনাটা বাড়িতে রেখে এসেছেন। তিনি যন্ত্রটা নিয়ে ঘুমন্ত লোকগুলোর দিকে এগোলেন।

আবছা আলোয় আর ধোঁয়াশায় ডক্টর সান্যাল দেখতে পাননি যে, বাড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছু দূর পরপর এক-একজন লোক জেগে বসে চারদিকে তাকাচ্ছিল। তাঁকে এভাবে এগোতে দেখে তাদের একজন চিৎকার করে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে সবাই তাঁর কাছে ছুটে এল। ঘুমন্ত মানুষগুলোও জেগে উঠল। বিছানার পাশে লুকিয়ে-রাখা লাঠিগুলো বের করে একসঙ্গে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল কৌস্তুভ সান্যালের ওপর।

এমন সময় পুলিশের একটা গাড়ি এসে পড়াতে গুরুতরভাবে আহত হলেও ঘটনাস্থলেই মারা পড়লেন না ডক্টর সান্যাল। গাড়ি থেকে পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এসে তাঁর মুখের ওপর টর্চ ফেললেন। তারপর বিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কী স্যার, আপনি!

ডক্টর সান্যাল জড়িত স্বরে বললেন, আমি বেশিক্ষণ বাঁচব না, সুগত। তুমি আমার জবানবন্দি নেওয়ার ব্যবস্থা করো, যত তাড়াতাড়ি পারো।

পরদিন রেডিয়ো আর টেলিভিশনের খবরে প্রথমেই ঘোষিত হল প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর কৌস্তুভ সান্যালের মৃত্যুসংবাদ। যখন নার্সিং হোম ঘিরে ডক্টর সান্যালের অগণিত আত্মীয়স্বজন, প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র ও গুণমুগ্ধরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে, সেই সময় লালবাজারে কমিশনারের ঘরে বেজে চলেছে একটি টেপরেকর্ড। স্তব্ধ হয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে শুনছেন কমিশনার ও কয়েকজন পুলিশ অফিসার, যার মধ্যে রয়েছেন স্কটিশ চার্চ কলেজের ডক্টর সান্যালের প্রাক্তন ছাত্র সুগত দাশগুপ্তও।

রেকর্ডে মৃত্যুপথযাত্রী বিজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর বেজে চলেছে–হ্যাঁ, সুগত। ফুটপাথের লোকগুলো ঠিকই ধরেছিল। আমিই সেই হত্যাকারী। শুধু আমি নই, আমি-তুমি সবাই। মাত্রাবিহীন গাড়ি-নিঃসৃত ধোঁয়া, বিলীয়মান সবুজ আর অট্টালিকার বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ চলাচলহীন বায়ু কলকাতার বাতাসকে মাত্রাতিরিক্তভাবে দূষিত করছে। বিশেষ করে শীতকালে, সারাদিনের জমা এই বিষাক্ত গ্যাস বায়ুমণ্ডলের চাইতে ভারী হওয়াতে ভূমিস্তরের ওপর জমতে থাকে। মধ্যরাত্রে সেই কার্বন মনোক্সাইড, সিসে, গন্ধক আর নাইট্রোজেন অক্সাইডের মিশ্র বিষাক্ত গ্যাস প্রায় আধ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়, আর তিন-চার ঘণ্টা থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারপাশে। গঙ্গার কাছাকাছি জায়গায় সেই ছড়িয়ে পড়াটা তাড়াতাড়ি হয়। ওরা আমাকে আক্রমণ করার আগেই আমার যন্ত্রের স্ক্রিনে যেসব গ্যাসের সংকেত দেখেছি, তার যে-কোনও একটি বেশিক্ষণ ফুসফুসে প্রবেশ করলেই একজন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাই রাস্তায় হাঁটা অবস্থায় ছোট্ট শিশুটি থেকে নিদ্রিত ফুটপাথবাসীকে আক্রমণ করেছে সেই অদৃশ্য ঘাতক। কিন্তু মায়ের কোলের শিশুটি বেশি উচ্চতায় থাকায় সে বেঁচে গেল। কুকুর-বেড়ালরা ছুটে নিরাপদ জায়গায় যেতে পারে বলে বেঁচে যাচ্ছে। তাদের ইন্দ্রিয় বেশি প্রখর। অবশ্য ওপরের বাতাসও সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। দূষিত বাতাস শ্বাসযন্ত্র আক্রমণ করছে প্রথমে। তারপর হৃদয়, স্নায়ু, এমনকী মস্তিষ্কও। দেহের কোশকেও আক্রমণ করছে স্লো পয়জনের মতো। শারীরিক ও মানসিক দুইদিকেই অসুস্থ করে দিচ্ছে নগরবাসীকে। স্টোনম্যানের মতো এই গ্যাসম্যান কিন্তু আমাদের অপরিচিত নয়। সবার মধ্যেই সে লুকিয়ে আছে। পারবে তাকে শাস্তি দিতে? পার্ক আর ফাঁকা জায়গা দখল করে বাড়ি করা হচ্ছে। পারবে উলটোদিকে ঘুরতে? বাড়ি ভেঙে পার্ক, পুকুর আর বাগান করতে? জানি, পারবে না। স্টোনম্যানের চাইতে অনেক ক্ষমতাবান এই গাসম্যান। কারণ, সে যে আমাদের মধ্যে ঢুকে বসে আছে! আমাকেও অজান্তে আক্রমণ করেছে বেশ কিছুকাল আগেই। তবে এই সুখ নিয়ে মরছি যে, সে আমাকে পুরোপুরি মারার আগেই আমি মানুষের হাতে মরছি। ফুটপাথবাসীরা গ্যাসম্যানের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ করল…

তারপর কিছু জড়ানো কথার পরেই ডক্টর সান্যালের কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে গেল। কমিশনার বোতাম টিপে রেকর্ডার বন্ধ করলেন। তারপর সবাইয়ের মুখের দিকে চাইলেন।

গ্যাসম্যান শনাক্ত হয়েছে। এখন কে তাকে গ্রেফতার করবে? এই প্রশ্নগুলো সাগরের ঢেউয়ের মতো রেডিয়ো, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ধ্বনিত হতে থাকবে। কিন্তু কে দেবে উত্তর?

[শুকতারা, শারদীয়া ১৪০৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *