নেপোলিয়নের নবজীবন

নেপোলিয়নের নবজীবন

সাতসকালে তাঁর বৈঠকখানায় হাজির প্রখ্যাত প্রাক্তন ফুটবল খেলোয়াড় ও প্রতিবেশী নেপোলিয়ন বিশ্বাসের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন বৈজ্ঞানিক সাত্যকি সোম। তারপর চিন্তান্বিতভাবে বললেন, তুমি কী বলতে চাইছ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ন্যাপলা। বয়স কমানোর কোনও ওষুধ তো আমি আবিষ্কার করিনি। সময়ের গতিবর্তন নামে আমার একটা প্রবন্ধ পড়ে অনেকে ঠিক বুঝতে পারেনি। তারাই এসব রটাচ্ছে। বিজ্ঞান কখনও প্রকৃতির নিয়মকে উলটে দেয়নি। সেই নিয়মকেই নিজের কাজে লাগিয়ে মানুষের অসহায়তা দূর করেছে। তোমার মাথায় এসব উদ্ভট চিন্তা এল কী করে? আরে, বয়স কমাতে পারলে আমি নিজেই তো বাচ্চা ছেলে হয়ে গবেষণাটবেষনা ছেড়েছুঁড়ে ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে মেতে উঠতাম।

নেপোলিয়ন নাছোড়বান্দার মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না স্যার, আপনার ল্যাবরেটরিতে সময়কে পিছু হটানোর যন্ত্র আছে, এ কথা দেশসুদ্ধ লোক জানে। আমাকে অন্তত বাইশ বছর বয়স কমিয়ে দিন। আমার বয়স এখন চল্লিশ। আমি আবার আঠারো বছরে ফিরে গেলে নতুন উদ্যমে ফুটবল খেলতে শুরু করব। আগের অভিজ্ঞতা থাকাতে তখন খেলা আরও নিখুঁত হবে। আরও কত নাম হবে তখন। হয়তো পৃথিবীর সেরা ফুটবলার আমিই হব। নইলে আজ তিন বছর খেলা ছেড়েছি। এর মধ্যেই দুর্ধর্ষ নেপোলিয়ন বিশ্বাসের নাম দেশের লোক ভুলতে বসেছে। কথাগুলো বলতে বলতে নেপোলিয়নের গলাটা যেন ভারী হয়ে এল।

সাত্যকি সোম বললেন, তুমি ভুল বুঝছ। সময়কে পিছু হটানো মানে আগের সেই সময়টাকে ফিরিয়ে আনা। রেকর্ডকে পিছিয়ে দিয়ে চালানোর মতন। এতে ওসব অভিজ্ঞতাটভিজ্ঞতাও পিছিয়ে কমে যাবে, ওই বয়সে যেমন ছিল।

নেপোলিয়ন বিশ্বাস একটু ভেবে বললেন, তা হোক, আমি আবার সেই বয়সে ফিরে যেতে চাই। এই বলে কাতরভাবে সাত্যকি সোমের হাত দুটো চেপে ধরলেন।

সাত্যকি সোম অসহায়ভাবে তাঁর দিকে চাইলেন। তারপর বললেন, গত শতাব্দীতে আমাদের দেশে এক কবি ছিলেন। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কবিতা না পড়ে থাকতে পারো, কিন্তু ইচ্ছাপূরণ নামে তাঁর একটা গল্প পড়েছ কি?

নেপোলিয়ন বিশ্বাস লজ্জার হাসি হেসে বললেন, স্যার, আমি লেখাপড়া বিশেষ করিনি। আই-কিউ থেরাপি সেন্টারে গিয়ে মাঝে মাঝে ব্রেনটাকে কাজ চালানোর মতো করে নিই। জানেন তো, আমার জীবনে খেলাটাই সব।

সাত্যকি সোম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর সোফা থেকে উঠে পড়ে বললেন, ঠিক আছে। তোমার বয়স আমি বাইশ বছর কমিয়ে দেব। এসো আমার সঙ্গে।

নেপোলিয়ন বিশ্বাস প্রায় কান পর্যন্ত ছড়ানো হাসি হেসে লাফাতে লাফাতে ডক্টর সোমকে অনুসরণ করলেন।

ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করে সাত্যকি সোম পেছন ফিরে নেপোলিয়নের দিকে চেয়ে শেষবারের মতন বোঝাতে চেষ্টা করলেন, আর-একবার ভেবে দ্যাখো ন্যাপলা। তোমার এই বয়সের এত সম্মান, এত সংবর্ধনা, পুরস্কার, পদক–সব কিন্তু বয়স কমার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যাবে…।

তাঁর কথা শেষ না হতেই নেপোলিয়ন উত্তেজিতভাবে মেঝেতে পা ঠুকে বলে উঠলেন, ফ্রি-কিক মারি ওসব সম্মানের মাথায়। তারপরেই লজ্জিতভাবে সাত্যকি সোমের দিকে চেয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না, স্যার। বুঝতেই তো পারছেন…।

সাত্যকি সোম মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলেই দেয়ালের দিকে হাত বাড়িয়ে একটা সুইচ টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের একদিকে দুই দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত একটা পর্দা সরে গেল। নেপোলিয়ন দেখলেন, প্রায় পনেরো ফুট লম্বা আর পাঁচ ফুট উঁচু একটা রকেটের আকারের বস্তু ঘরের ওইদিকটা জুড়ে আছে। প্লেনের মতো একটা ছোট দরজাও আছে ওটার ভেতরে ঢোকার জন্যে।

সাত্যকি সোম নেপোলিয়ন বিশ্বাসের দিকে চেয়ে বললেন, ঢুকে পড়ো এর মধ্যে মাথা নিচু করে। ভেতরে সুন্দর নরম বিছানা আছে, তাতে শুয়ে পড়ো। কিছুক্ষণ ঘুম পাড়িয়ে রাখব। ভেতরে মহেন্দ্র আছে। ও তোমাকে ঠিক সময়ে ডেকে তুলবে।

নেপোলিয়নের হতভম্ব চাহনি দেখে সাত্যকি নোম হেসে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। মহেন্দ্র একটা রোবট। মুখের চেহারাটা মহেনজোদারোর মূর্তির মতন বলে ওটার নাম মহেন্দ্র রেখেছি।

নেপোলিয়ন নির্দ্বিধায় রকেটটাতে প্রবেশ করতেই সাত্যকি সোম দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ভেতরে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে নেপোলিয়ন দেখলেন, এক কোণে মহেন্দ্র বসে আছে উবু হয়ে। তাঁর মতন লোকেরও হঠাৎ গা-টা ছমছম করে উঠল। তবে সেটা এক মুহূর্তের জন্যে। বিছানায় শুয়ে দেখলেন, সত্যিই সেটা পালকের মতো নরম। শোয়ামাত্র একটা যন্ত্রসংগীতের রেশ শুনতে পেলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল।

হঠাৎ কীসের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে যেতেই নেপোলিয়ন দেখলেন, মহেন্দ্র তাঁর হাতে মৃদু টোকা দিতে দিতে ধাতব গলায় একঘেয়েভাবে বলে চলেছে, উঠুন.. উঠুন… উঠুন…।

খঞ্জনি ঠোকার মতন সেই আওয়াজ শুনে নেপোলিয়নের হাসি পেয়ে গেল। ধড়মড় করে উঠতেই রকেটটা চারপাশে ফুলের পাপড়ির মতন খুলে গেল। আর নেপোলিয়ন দেখলেন, তিনি নীল আকাশের নীচে একটা ফাঁকা জায়গায় ওই খুলে-যাওয়া রকেটের শয্যার ওপর বসে আছেন। মহেন্দ্র তার পাশে জাদুঘরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে।

নেপোলিয়ন মহেন্দ্রর দিকে চেয়ে কেঠো হাসি হেসে বললেন, বাব্বাঃ, কয়েক মিনিট ঘুমিয়েছি। এর মধ্যে কোথায় এনে ফেলেছেন ডক্টর সোম!

বেশির ভাগ রোবটের মতো মহেন্দ্রও হাসতে জানে না, কিন্তু জ্ঞান দিতে ওস্তাদ। ঘণ্টার মতন ঢংঢঙে গলায় বলল, কয়েক মিনিট কাকে বলছেন? আপনি কতকাল ঘুমিয়ে ছিলেন, জানেন? পৃথিবীর মাপে তিন হাজার সাতশো পঁচিশ বছর চার মাস একুশ দিনের চেয়ে দু-চার ঘণ্টা বেশি। এই দেখুন আমার হাতের ক্যালকুলেটরে সংখ্যাটা। আপনাকে সেই পৃথিবীর দুনিয়া থেকে আলোর গতিতে এমন এক জগতে এনে ফেলা হয়েছে, যেখানে সবই পৃথিবীর মতন। তফাত শুধু, এখানে সব কিছুই উলটো দিকে পিছিয়ে চলে।

মহেন্দ্রর কথায় হতবাক হয়ে গেলেন নেপোলিয়ন বিশ্বাস। তারপরেই একটা দারুণ রাগ আর হতাশায় তাঁর দেহের শিরা দিয়ে যেন একই সঙ্গে আগুন আর বরফের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। তাঁকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন সাত্যকি সোম! একবার তাঁকে হাতের কাছে পেলে.

সঙ্গে সঙ্গে নেপোলিয়ন বিশ্বাসের মনে হল, সাত্যকি সোম এখনকার পৃথিবীর হিসাবে তিন হাজার বছর আগে ছিলেন। অর্থাৎ, নেপোলিয়ন বিশ্বাস যখন পৃথিবীতে ছিলেন, তখন মহেনজোদারোর সভ্যতা যেমন অতীত ছিল।

মহেনজোদারোর কথা মনে হতেই মহেন্দ্রর দিকে আবার তাকালেন তিনি। সে বলল, প্রভু আপনার জন্যে একজন গাইড ঠিক করে দিতে বলেছেন। এই বলে মুখে একটা যন্ত্র লাগিয়ে কী একটা অদ্ভুত ভাষায় চিৎকার করতে লাগল সে।

প্রভু–অর্থাৎ সাত্যকি সোম। তাঁর কথা মনে হতেই নেপোলিয়নের আপাদমস্তক জ্বলে যেতে লাগল। কিন্তু অসহায়ের মতন বসে থাকা ছাড়া তাঁর কিছু করার নেই।

সামনে চোখ পড়তেই দেখলেন, তিনি যে মাঠে বসে আছেন, তার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে একটা ছোট্ট নদী। নদীর পাড়ে সাদা কাশফুলগুলো হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন নেপোলিয়ন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। তিনি দেখলেন, কোথা থেকে একটা বক উলটোভাবে উড়তে উড়তে এসে নদীর জলে বসল। তারপর জলের দিকে ঠোঁট নামিয়ে ফাঁক করতেই মুখের ভেতর থেকে একটা জ্যান্ত মাছ জলে লাফিয়ে পড়ল।

তারপরে একটার পর একটা আজব দৃশ্য। একটা ভিজে কাপড়-পরা লোক উলটোদিকে হাঁটতে হাঁটতে নদীর জলে ডুব দিল। ডুব দিয়ে যখন সে উঠল, নেপোলিয়ন দেখলেন, তার শরীরে এক ফোঁটা জল নেই। কাপড়ও শুকনো খটখটে।

অন্যদিকে নজর পড়তেই দেখলেন, কয়েকটা গাড়ি সাঁত সাঁত করে উলটো দিকে ছুটে চলে গেল। ফিল্মকে উলটোদিকে চালিয়ে পর্দায় ফেললে যেমন দেখতে লাগে, এসব কাণ্ডকারখানাও নেপোলিয়ন বিশ্বাসের কাছে সেরকমই লাগল।

এর মধ্যেই মহেন্দ্রর ডাকে একজন গাইড এসে হাজির হয়েছে। বোঝা গেল, সে-ও একটা রোবট। এই গ্রহেরই। সে এসে কিচমিচ করে কী সব বলতে শুরু করতেই, মহেন্দ্র তার মুখে ছাঁকনির মতন কী একটা এঁটে দিল। নেপোলিয়নকে বলল, এটা এস-সি বা স্পিচ কনভার্টর। কথার আয়না বলতে পারেন। এবার ওর কথা বুঝতে আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। আপনিও ওর সঙ্গে কথা বলার সময় মুখে এটা লাগিয়ে কথা বলবেন। বলে তাঁর হাতেও মহেন্দ্র একটা ছাঁকনি দিল।

নতুন গ্রহের রোবটটা এসব দেখে এখন পরিষ্কার বাংলায় বলল, ও, আপনারা বুঝি উলটো জগৎ থেকে এসেছেন? আপনাদের রকমসকম দেখে আগেই সন্দেহ হয়েছিল। আমার নাকের গ্যাস অ্যানালাইজার দিয়ে তখন থেকে বুঝতে পারছি, এই ভদ্রলোক নাক দিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড টেনে অক্সিজেন না ছেড়ে তার উলটোটাই করে যাচ্ছেন।

নেপোলিয়ন রোবটের কথায় রেগে গিয়ে মুখে যন্ত্র লাগিয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাঁ, ঠিকই করছি। আমি তো আর গাছ নই, মানুষ।

এই রোবট মহেন্দ্রর মতন গোমড়ামুখো নয়। হাসতে পারে। হো-হো করে হেসে বলল, আবার সেই উলটোরকম কথা। যা-ই হোক, আমার নাম দু-শো চার পঞ্চাশ। দু-শ চার নাম, আর পঞ্চাশ পদবি। এখানে সকলের নাম-পদবিই সংখ্যা দিয়ে। এবার চলুন, আপনাদের ঘুরিয়ে সব দেখাই। কিন্তু…

দু-শো চার মাথা নিচু করে কী ভাবতে লাগল। তারপর বলল, আপনাদের মতন নাক বরাবর হাঁটলে এখানকার লোকে অবাক হয়ে তাকাবে। পাগল ভেবে বুড়ো লোকেরা হয়তো পিছু লাগতে পারে, ইট-পাটকেলও আপনাদের গা থেকে টানতে পারে।

নেপোলিয়নের মাথার মধ্যে সব কিছু যেন ঘুরপাক খেতে লাগল এসব কথা শুনে। ইট-পাটকেল ছোঁড়া হয়, এটাই তো তিনি জানেন। সেগুলো আবার গা থেকে টানা হয় কী করে!

দু-শো চারের সমস্যার সমাধান যে সাত্যকি সোমই করে রেখেছিলেন, মহেন্দ্রর কথায় নেপোলিয়ন সেটা বুঝতে পারলেন। মহেন্দ্র বলল, আমি ব্যাক গিয়ারে চোখের পেছনদিকেও হাঁটতে পারি। আর এই মানুষটার জন্যে একটা খোলস পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রভু। গায়ে পরে নিলে মনে হবে, চোখ-নাক-কপাল সব এখন যেদিকে আছে, তার উলটোদিকে। কেউ কিছু বুঝতেই পারবে না।

দু-শো চার হো-হো করে হেসে উঠে বলল, বাঃ, তাহলে তো ভাবনাই নেই। এতে ভালোই হবে, মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে বলতে পথ চলা যাবে।

নেপোলিয়ন বিশ্বাস ব্যাজার মুখে সেই উদ্ভট ডুবুরির পোশাক পরে দুই মূর্তিমানের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন। মনে মনে সাত্যকি সোমের শ্রাদ্ধ করতে করতে ভাবতে লাগলেন, বয়স না কমিয়ে বুড়ো নিশ্চয় ইচ্ছে করে তাঁকে এই গ্রহে পাঠিয়ে কোনও গবেষণা করছেন। থুড়ি, গবেষণা করছিলেন সেই তিন হাজার বছর আগে।

রাস্তায় দোকানপত্র খোলা। লোকে জিনিসপত্র হাতে নিয়ে পিছু হটতে হটতে দোকানে ঢুকছে। তারপর সেগুলো দোকানদারকে ফিরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে বেরিয়ে আসছে। দোকানের ঘড়িগুলোর কাঁটা নীচে থেকে দেখা সিলিং ফ্যানের ব্লেডের মতো উলটোদিকে ঘুরছে।

কিছু দূর গিয়ে ভিজে মাটি দেখে দু-শো চার বলল, বৃষ্টি উঠবে বোধহয়। তবে বেশিক্ষণ হবে না। অল্প জল আছে।

নেপোলিয়ন তাকিয়ে দেখলেন, আকাশ পরিষ্কার, একটুও মেঘ নেই। তিনি অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় মঝমঝ শব্দে চেয়ে দেখলেন, চারদিকের মাটি থেকে ফোয়ারার মতন জলের ধারা সোজা আকাশে উঠে যাচ্ছে। ছুটে বারান্দায় আশ্রয় নিতে গেলে দু-শ চার হেসে ফেলল। বলল, ভিজলে তো আগেই ভিজে থাকতেন। এতক্ষণে শুকিয়ে যেত।

নেপোলিয়ন অবাক হয়ে দেখলেন, চারপাশের মাটি শুকনো। শুধু আকাশে কিছু মেঘ আস্তে আস্তে একপাশে সরে যাচ্ছে।

রাস্তার মধ্যে একটা সুন্দর বাচ্চা ছেলেকে দেখে নেপোলিয়ন আদর করে তার পিঠে একটা টোকা দিলেন। সেদিকে নজর পড়তে দু-শো চার বলে উঠল, বেচারা! একেবারে বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। আর বেশি দিন আয়ু নেই।

নেপোলিয়ন বিশ্বাসের মাথা এবার বেশিরকম ঝিমঝিম করতে লাগল। তিনি মাথা টিপে বসে পড়লেন।

মহেন্দ্র দু-শো চারের কানে কানে কী বলল, তা-ই শুনে দু-শ চার বলল, সে তো নিশ্চয়। তোমাদের গ্রহের এই মানুষটা আস্তে আস্তে এই গ্রহের মানুষের মতনই হয়ে যাবে। উলটো পোশাকটা একটু পরে খুলে নিলেই হবে। তখন আমাদের নিয়মে চলতে কোনও অসুবিধেই হবে না। বাইশ বছর আগে ওর বয়স যখন আঠারো বছর হবে, তখন আবার ওকে পৃথিবীতে নিয়ে যাবে।

এই কথা শুনে নেপোলিয়ন বিশ্বাস লাফিয়ে উঠলেন। শরীর থেকে খোলসটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে পৃথিবীর নিয়মে সামনের দিকে ছুটতে ছুটতে বললেন, না, না, না! আমি উলটোদিকে যেতে চাই না। সামনের দিকে চলতে চাই। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে –অতীতে নয়। বয়স বাড়ুক। বড় হয়েই মরতে চাই, ছোট হয়ে নয়। কিছুতেই নয়!

টুং করে একটা শব্দ হতেই নেপোলিয়ন বিশ্বাসের ঘুম ভেঙে গেল। রকেটের দরজাটা খুলে যেতেই দেখলেন, সামনে দাঁড়িয়ে হাসছেন সাত্যকি সোম। বললেন, বেরিয়ে এসো৷

নেপোলিয়ন অবাক হয়ে দেখলেন, ডক্টর সোম সোজাভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে এসে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, তোমার বয়স এখন আঠারো বছর। তুমি এখন নতুন করে খেলোয়াড়-জীবন শুরু করতে পারো। তবে সেই সঙ্গে তোমার শিক্ষাজীবনও। কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বাতিল হয়ে গিয়েছে। আর ভালো কথা, তোমাকে একটা নতুন নাম নিতে হবে। লোকে জানবে, বিখ্যাত নেপোলিয়ন বিশ্বাস নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। দেখো, তোমার আত্মজীবনী বা পদকগুলোকে নিজের বলে দাবি করে বোসো না যেন। তাহলে লোকে তোমাকে পাগল মনে করে দূর-দূর করবে। খেলায় সুযোগ দেওয়া তো দূরের কথা।

নেপোলিয়ন বিশ্বাস এবারে প্রায় কেঁদে ফেলে সাত্যকি সোমের হাঁটু দুটো চেপে ধরলেন। তারপর কাতর কণ্ঠে বললেন, না, না। আমি ছোট হতে চাই না। আপনি দয়া করে আমাকে আমি করে দিন। আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাব।

সাত্যকি সোম অনেকক্ষণ মিটিমিটি হাসলেন নেপোলিয়নের দিকে চেয়ে। তারপর তাঁর কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, তুমি যা ছিলে, তা-ই আছ। নিজের শরীরের দিকে চেয়ে দ্যাখো। আর ভালো কথা, তুমি যে আমার কাছে এসেছ, সেটা কী করে লোকে জেনে ফেলেছে। নেপোলিয়ন বিশ্বাস বলে কথা! এইমাত্র এক ভদ্রলোক টেলিফোন করেছিলেন। তোমাকে তাঁর ভীষণ দরকার। তোমার ওপর একটা ডকুমেন্টারি ছবি তুলবেন। তুমি তখন বোপোদয় ক্যাপসুলে ঘুমোচ্ছিলে। যা-ই হোক, তাঁর নাম-ঠিকানা লিখে রেখেছি, এই নাও।

সাত্যকি নোম একটা চিরকুট নেপোলিয়নের হাতে দিলেন।

কাগজটা হাতে নিয়ে নেপোলিয়ন বিশ্বাস জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বর্ষা শেষ হয়ে শরতের আলোতে চারদিক ঝলমল করছে। বর্ষার পরে শরৎ না এসে যদি গ্রীষ্ম আসে। মনে হতে আপন মনেই হেসে ফেললেন তিনি।

এই শরতের সকালে পৃথিবীটাকে খুব ভালো লেগে গেল নেপোলিয়নের। তিনি ভাবলেন, সাত্যকি সোমের বাড়ি থেকে বেরিয়েই তিনি রাস্তায় নামবেন, ঠিক যেভাবে নাচতে নাচতে মাঠে নামতেন। তারপর আস্তে আস্তে ছুটতে থাকবেন। সামনের দিকে।

[আনন্দমেলা, ১৭ আশ্বিন ১৩৯১]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *