হোমিফাইটা

হোমিফাইটা

নিছক একটা কৌতূহল আর খেয়ালিপনা যে আমাকে এরকম বিস্ময়ের মুখোমুখি এনে দেবে তা আমি কোনও দিন কল্পনাতে আনতে পারিনি। এ কথা কাউকে বললে বিশ্বাস তো করবেই না, বরং আমার মাথার দিকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। হয়তো দীপ্তেন্দুকে বললে সে-ও তা-ই করত। কিন্তু দীপ্তেন্দু তো আজ নেই। পরলোক বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেখানে তার ছোট দাদুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে পারে তার। সেখানে হয়তো…

কী সব আজেবাজে কল্পনা করছি। এ কথা আমি কাউকে বলব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। এমনকী দীপ্তেন্দুর বাড়ির কাউকেও নয়। অবশ্য তাদের সঙ্গে আমার কুড়ি বছর যোগাযোগ নেই। জানিই না তারা এখনও খড়াপুরে আছে কি না।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বৃদ্ধ মারাঠি ইঞ্জিনিয়ার মি. শিরোদকার আমাকে যা বললেন, তার মধ্যে একটুও খাদ নেই। জটিয়া ঝোরার কাছে বট গাছটার নীচে যে পাথরটাকে গাঁয়ের সবাই পুজো দেয়, সেটা যে পাথর বা হাতির দাঁত বা প্রাগৈতিহাসিক কোনও প্রাণীর হাড় নয়, সেটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কী সেটা? গাছের গুঁড়ি–নাকি মানুষের…

থাক। গ্রাম্য দেবতার বিগ্রহটা ওখানেই চিরকাল থাকুক। তবে ওর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ মি, শিরোদকারের চোখ দুটো ছলছল করছিল, সেটা আমি লক্ষ করেছি। আমার চোখে তখন ছিল অগাধ বিস্ময়। সংবিৎ ফিরল, যখন মি. শিরোদকার বললেন, ‘বলুন মি. গোস্বামী, কাউকে এ কথা বলবেন না। Let him rest in peace–এই শান্ত প্রকৃতির পরিবেশে।

আমি কথা দিয়েছিলাম।

ব্যাপারটা প্রথম থেকেই বলা যাক। দেশভ্রমণের বাতিক আমার অনেক দিনের। কোথায় যাব, সেটা বড় কথা নয়। একা একা বেরিয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। এবারও বেরিয়েছিলাম এইভাবে। একটা অরণ্যময় ছোট্ট পার্বত্য স্টেশনে ট্রেন থেমে গেল। থামার কথা ছিল না। হয়তো ছোটখাটো কোনও কারণ ছিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, স্টেশনের নাম–পাইনজল।

পাইনজল! নামটা যেন আমার শৈশবের মূল থেকে আমার স্মৃতিটাকে নাড়া দিল। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম, যেমন দীপ্তেন্দুর কথাও আজকাল মনে পড়ে না। নইলে দীপ্তেন্দুর কাছে কত শুনেছি নামটা। দীপ্তেন্দু বলত, “জানিস বকু, পাইনজলে সাংঘাতিক সব বাঘ আছে। আমার ছোট দাদুকে বাঘে খেয়ে ফেলেছিল। তখন ছোট দাদুর বাবা শোকে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গিয়েছিলেন!”

ছোট দাদু, মানে দীপ্তেন্দুর বাবার কাকা। ওসব দীপ্তেন্দুর জন্মের অনেক আগের কথা। তার বাবাই তখন কলেজে পড়েন। কিন্তু দীপ্তেন্দু যখন এই কথা বলত, তখন বেশ গর্বের সঙ্গেই বলত।

কীসের খেয়াল মাথায় উঠল, ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। সত্যিই কি এখানে বাঘ আছে এখনও? স্টেশনে একজন কুলিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, বাঘের কথা তো সে শোনেনি। এখানেই সে বুড়ো হতে চলল। তবে দেখার মতন ঝরনা আছে এখানে–জটিয়া ঝোরা। জটিয়া ঝোরার পাশে বাউরি নদীর ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে সরকারি সড়ক। এখানে আমি বাঘ দেখতে এসেছি। শুনে সে তো হেসেই বাঁচে না।

বাঘ না থাক, বনবাদাড় আছে। আর আছে অসংখ্য টিলা। একটা টিলার কাছে ছবির মতন একটা বাড়ি দেখে এগিয়ে গেলাম। দেখি, সামনে একজন বৃদ্ধ লোক চেয়ারে বসে আছেন। চারপাশে পাহাড়িদের কুঁড়ে ছাড়া এরকম পাকা বাড়ি নজরে পড়ল না। অন্তত এত সুন্দর তো নয়ই। কিছু না ভেবে ওদিকে এগিয়ে গেলাম।

ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। নাম পুরুষোত্তম মাধবদাস শিরোদকার। বোম্বাইয়ের কাছে নিজের বাড়ি থাকলেও এখানে একটা বাংলো বানিয়েছেন। কখনও সপরিবারে এসে থাকেন। স্থানীয় একজন কেয়ারটেকার বাড়ির দেখাশোনা করে। আমি খেয়ালিপনা করে পাইনজলে নেমে পড়েছি শুনে আমাকে একটু ধমকই দিলেন এরকম বেআক্কেলে হওয়ার জন্যে। তাঁর বাড়ি না থাকলে আমি যে অকূলে পড়তাম, সে কথা শোনাতে ছাড়লেন না। হোটেল দূরের কথা, স্টেশনে ওয়েটিং রুমও নেই। গাড়িও আজ আর নেই। সুতরাং তাঁর ওখানেই আজ আমায় আতিথ্য গ্রহণ করতে হবে।

পুরুষোত্তম সাহেবকে খাস বোম্বাইয়ে দেখলে কীরকম দেখতাম জানি না, তবে নির্জন প্রকৃতির বীক্ষণে মানুষের মনুষ্যত্বটা বেশি করে ধরা পড়ে বোধহয়। কারণ নিজের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য আর বড় হোটেলের আরামবিলাস, দুইই একযোগে পেয়ে গেলাম পাইনজলে এসে।

খাওয়াদাওয়ার পর নানা কথাবার্তায় পাইনজলে বাঘের উল্লেখ করতেই মি. শিরোদকার যেন চমকে উঠলেন। তখন আমি আমার ছেলেবেলায় বন্ধু দীপ্তেন্দুর ছোট দাদুর বাঘের মুখে মৃত্যুর কথাটা তুলতেই তিনি বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা না বলে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। অনেকক্ষণ পরে অনুনয়ের স্বরে বললেন, ‘মি, গোস্বামী, আমার হাত ধরে বলুন, আমি যা বলব তা প্রকাশ করবেন না। তবে আমি আমার জীবনের একটা ঘটনার কথা বলব। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা না হলে করবেন না। কিন্তু দোহাই, এ বিষয়ে কোনও শোরগোল তুলবেন না।‘

আমি তাঁর হাত ধরে কথা দিতে তিনি আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন জটিয়া ঝোরার দিকে। যেতে যেতে বলতে লাগলেন তাঁর কাহিনি। তাঁর মুখে যা শুনেছিলাম তা এইরকম—

আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। ভারত সরকারের কনস্ট্রাকশন বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করি। পাইনজলে একটা ভার পড়ল আমার ওপর। বাউরি নদীর ওপর যে ব্রিজটা এখন আছে, ওটা তৈরি করার কাজ। কুলিকামিন নিয়ে অস্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে জরিপটরিপের কাজ হয়ে গেল। নদীর ধারে অনেক গাছটাছ কাটতে হবে। পাথর কেটে রাস্তা করতে হবে। সন্ধেবেলা নকশা হাতে নিয়ে বসেছি, এমন সময় একজন কুলি এসে বলল, ‘সাব, নদীর পাড়ে জটিয়াবাবার গাছটা কাটতে বারণ করছে গাঁয়ের সকলে। ওটাকে নাকি ওরা পুজো করে।’

গাছটাছ পুজো মহেনজোদারোর যুগে ছিল বলে শুনেছি। এখন এসব কুসংস্কারের কথা শুনলে পিত্তি জ্বলে ওঠে। বিশেষ করে, এসব কাজে হাত দেওয়ার সময় এরকম বাধায় অনেক পড়েছি আমি। মন্দির-মসজিদ হলেও না-হয় কথা ছিল। এখানে কিনা একটা গাছ!

সে দিন এ বিষয়ে না ভেবে পরদিন সকালে জায়গাটাতে এলাম। গাছটা একটু অদ্ভুতই। আমি বনেবাদাড়ে অনেক কাজ করেছি, কিন্তু এরকম গাছ দেখিনি। অনেকটা ফার বা পাইন গাছের মতন সোজা-সরল। শাখাগুলো দু-পাশ দিয়ে উঠেছে সিমেট্রি রেখে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, প্রত্যেক শাখার প্রান্তে একটি করে পাতা। শিমুলপাতার মতন করতলাকার, কিন্তু ক্যাকটাসের মতন পুরু। আমি উদ্ভিদবিজ্ঞানী নই–কাজেই গাছটার নাম জানতাম না। গাছটা যে জাতীয়ই হোক, তার জন্যে তো আর কাজ বন্ধ রাখা যায় না। আজ বিকেলেই গাছটা কেটে ফেলার আদেশ দিয়ে ফিরে এলাম অন্য কাজকর্ম দেখতে। যদি কেউ গোলমাল করে, তবে তাদের গ্রেফতার করার পরোয়ানা নিয়ে আসা হবে, এটা যেন গ্রামবাসীদের জানিয়ে দেওয়া হয়–সে কথাও বলে এলাম। অবশ্য শুনলাম, গ্রামবাসীরা খুবই নিরীহ। তারা কোনও গোলমাল পাকাতে চায় না এ নিয়ে।

বিকেলের দিকে বেরিয়ে কাজকর্ম তদারক করছি, এমন সময় কুলির সঙ্গে একজন গ্রামবাসী এসে বলল, জটিয়াবাবা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

জটিয়াবাবা বলে যে কেউ আছে তা জানতাম না। শুনলাম, তিনি বৃদ্ধ ও অসুস্থ অবস্থায় গাঁয়ের মোড়লের বাড়িতে আছেন। প্রায় মরণাপন্ন। আমার কথা তিনি শুনেছেন। মরবার আগে আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চান।

ভাবলাম, গাছ কাটার কথা জটিয়াবাবা নিশ্চয় শুনেছেন। সে বিষয়েই হয়তো কিছু বলবেন। যা-ই হোক, বৃদ্ধ মুমূর্ষ লোকের একটা অনুরোধ রাখতে দেখা করাই মনস্থ করলাম।

মোড়লের বাড়িতে ঢুকতেই বিছানায় শায়িত জটিয়াবাবাকে দেখলাম। তাঁর নামের যথার্থতাও বুঝলাম। মাথার জট খাটিয়া বেয়ে ঝুলছে বটের ঝুরির মতন। হাত দুটো সামনে এনে নমস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, বসুন মি. শিরোদকার। আপনার সঙ্গে গোপনে কিছু কথা আছে। ইঙ্গিতে সকলকে চলে যেতে বললেন ঘর থেকে। তারপর তিনি নিজের কথা যা বললেন, তাতে আমি চিন্তাশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার তখনকার অবস্থা সব শুনলে আপনিও বুঝবেন মি. গোস্বামী।

জটিয়াবাবা বললেন, তাঁর আসল নাম নরনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। তিনি বাঙালি। তাঁর এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী বন্ধু ছিলেন। তখনকার কালে তাঁর গবেষণা শুধু দেশে নয়, বাইরেও বেশ নাম করে। তাঁর নামটা তিনি বলতে চান না। কারণ সাধারণে এবং শিক্ষাজগতের সবাই জানত, শেষের দিকে তিনি যোগটোগ করে সাধু হয়ে যান। সেই অজ্ঞাতবাসে তাঁর মৃত্যু হয়। যা জেনেছে তা-ই জানুক লোকে। তবে কাহিনির খাতিরে ধরে নিন তাঁর নাম বনবিহারী।

এই বলে জটিয়াবাবা যা বললেন, সেটা তাঁর নিজের ভাষাতেই বলি।

‘আমার ছোট ছেলে কৃষ্ণেন্দু বনবিহারীর বেশ ভক্ত হয়ে পড়ে। বনবিহারী মাঝে মাঝে আমার বাড়ি আসত। বলত, পাইনজল নামে নির্জন এক পার্বত্য গ্রামে সে একটা যোগাশ্রম করেছে। কৃষ্ণেন্দু মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় এসেছে এখানে। সাধুকাকার উৎসাহে যোগ আর ধ্যান অভ্যাসও আরম্ভ করল। আমার স্ত্রী-র আর বড় ছেলের এসব একদম পছন্দ হত না। আমি অতটা অপছন্দ করতাম না। ওতে মনের একাগ্রতা বাড়ে, দেহ সুস্থ থাকে।

যা-ই হোক, সেবারও এক ছুটিতে কৃষ্ণেন্দু এসে এখানে ছিল। তার ক-দিন পরেই বনবিহারীর কাছ থেকে একটা চিঠি এসে আমার বাড়ির সব সুখশান্তি একেবারে তছনছ করে দিল।

বনবিহারী লিখেছে, কৃষ্ণেন্দু মাঝরাতে একবার ঘর থেকে বেরিয়েছিল। একটা বাঘ বাগানে ওঁত পেতে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়। ক-দিন থেকেই বাঘের ডাক লোকে শুনছিল। সেটা যে মানুষখেকো তা জানা যায়নি। তবুও কৃষ্ণেন্দুকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল সন্ধের পরে ঘরের বাইরে না যেতে। বাঘটা কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে বোধহয় অন্য অঞ্চলে চলে যায়, কারণ কৃষ্ণেন্দুর দেহ পাওয়া যায়নি।

আমার জন্যই কৃষ্ণেন্দুকে হারালাম, এই বোধ আমাকে নির্বাক করে দিল। তার পাগলপ্রায় মা সে কথাই দিনরাত আমাকে শোনাতে লাগল। সংসার থেকে ক্রমে ক্রমে আলগা হয়ে পড়লাম আমি। কয়েক বছর পরে ঠিক করলাম, কৃষ্ণেন্দু যেখানে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, সেখানেই বাকি জীবনটা ঈশ্বর উপাসনা করে কাটিয়ে দেব।

কাউকে কিছু না বলে একদিন বাড়ি ছাড়লাম। আমি যে পাইনজলে এলাম, সে কথা কেউ জানল না। পাইনজলের বনবিহারীর আশ্রমে আসতে সে তো আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। নদীর ধারে সুন্দর আশ্রম করেছে। আমার সিদ্ধান্তের কথা শুনে বলল, এই আশ্রমকেই নিজের আশ্রম ভেবে ধ্যানধারণা করতে পারি। স্থানীয় গ্রামবাসীরাই চাল-ডাল, ফলমূল আর দুধ দিয়ে যায়। কেউ কেউ ওষুধবিশুধও নিতে আসে-হাসতে হাসতে বলল বনবিহারী।

আশ্রমের বাগানে দেখলাম অনেক কবিরাজি গাছ-কালমেঘ, বাসক, কন্টিকারি, সিঙ্কোনা প্রভৃতি। বুঝলাম, এগুলোই চাল-ডাল আর দুধের মূল্য।

একদিন বনবিহারীর ঘরে ঢুকে দেখি, বনবিহারী কী যেন লিখছে। আমাকে দেখেই থতমত খেয়ে খাতাটা বিছানার তলায় লুকিয়ে ফেলল। একজন সন্ন্যাসীর কী গোপনীয়তা থাকতে পারে আত্মপ্রচার বিষয় ছাড়া? অবাক হলেও ওটা নজরই করিনি, এভাবে অন্য কথাবার্তা বলে বেরিয়ে এলাম।

বনবিহারী আশ্রমের বাইরে গেলে খাতাটা বের করে খুললাম। দু-জনে আজ সন্ন্যাসী হলেও এককালে সহপাঠী বন্ধু ছিলাম। সেই পেছনে লাগার মনোভাবটা হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু উদ্ভিদবিদ্যার নানা খুঁটিনাটিই শুধু চোখে পড়ল। হয়তো ঈশ্বরসাধনার সঙ্গে সঙ্গে তার গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছে বনবিহারী। জীবকোশ আর উদ্ভিদকোশের কয়েকটা ছবি আর নানারকম শব্দ বা টার্মসের ছড়াছড়ি প্রোটোপ্লাজম, নিউক্লিয়াস, ফোটোসিন্থেসিস ইত্যাদি। হঠাৎ একটা পাতায় কৃষ্ণেন্দুর নাম দেখে চমকে উঠলাম। নোটের আকারে লেখা–কৃষ্ণেন্দুর সমাধিশিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। সে বারো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ধ্যান করতে সক্ষম। তবুও একটা খাঁচাতে তার দেহ সোজা করে রাখতে হবে। কারণ এটা তো বারো ঘণ্টার ব্যাপার নয়। পা দুটো গোড়ালি পর্যন্ত পোঁতা থাকবে।

কিছু বুঝতে পারলাম না। বেশ কিছু দিন পরের তারিখ দিয়ে আবার লেখা–হরিণের খুলি পাহাড়ে পড়ে থাকতে থাকতে পাথর হয়ে যায়। কৃষ্ণেন্দুর শরীরে অ্যালজি বা শ্যাওলা। লাগিয়ে দেখা যাক পরিবর্তনটা তাড়াতাড়ি আনে কি না। গাছ থেকে ইনজেকশনটা দিনে দু-বার করে দিচ্ছি।

আরেক দিনের তারিখে শরীরে ক্লোরোফিল ঢুকিয়ে দেওয়াতে আজ থেকে সূর্যের আলোতেই অল্প অল্প খাদ্য তৈরি করছে। ওর আঙুল-পাতা থেকে যে অক্সিজেন বেরোচ্ছে, সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি। বর্তমানে দুটোমাত্র শাখা, যা তার হাত ছিল। আরও শাখার সৃষ্টি করতে হবে।

পরের পাতায়–বট গাছের শেকড় কৃষ্ণেন্দুর পায়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা কলম করে জুড়ে দিতে চমৎকার মোটা হয়ে সেখানে সেলুলোজের স্তর জমছে। আমি সফলতার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।

আবার একদিন লেখা–আজ আমার কী আনন্দের দিন! উদ্ভিদজগৎ প্রাণীজগতের কাছাকাছি আসে শুধু ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসে নয়। বড় গাছ আর উন্নততম প্রাণীও মিলে যেতে পারে। এটাই আমি প্রমাণ করলাম। নরনারায়ণের ছেলে কৃষ্ণেন্দু আজ উদ্ভিদমাত্র। এই নতুন গাছে মানুষের জীবনের লক্ষণ ধরা পড়বে। সেটা কতখানি তা নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। পৃথিবীতে আমিই এর সৃষ্টিকর্তা। এইবার এতে ফুল-ফল ও বীজের সৃষ্টি হলে এই গাছ থেকেই অনেক গাছের সৃষ্টি হবে। হয়তো এই পাইনজলেই একটা মায়াকানন গড়ে উঠবে। কেউ জানবে না এর সৃষ্টিরহস্য। এই নতুন গাছের বটানিক্যাল নাম দিলাম–হোমিফাইটা অর্থাৎ নৃবৃক্ষ।’

জটিয়াবাবা বলে চললেন, এইটুকু পড়ে আমার সামনে থেকে পৃথিবীটা যেন সরে গেল। কৃষ্ণেন্দুকে তবে বাঘে খায়নি। আজও অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সে বেঁচে আছে! ছুটে নদীর ধারে চলে এলাম, নোটবইয়ের বর্ণনা ও ছবি দেখে মিলিয়ে দেখলাম–কৃষ্ণেন্দুকে, নাকি একটা গাছকে! দু-পাশে মাত্র দুটো ডাল উঠে গিয়েছে, একটাতে বাঁধা তার সেই মাদুলি। ওটা খুলতে বোধহয় ভুলে গিয়েছে বনবিহারী শয়তানটা। গায়ে হাত বোলাতেই থরথর করে কেঁপে উঠল কৃষ্ণেন্দু। লজ্জাবতীর পাতার মতন তার পাতাগুলোও নড়ে উঠল।

বনবিহারী আশ্রমে ফিরতেই তাকে ভুলিয়ে নদীর ধারে নিয়ে এলাম। দূর থেকে কৃষ্ণেন্দুকে দেখিয়ে বললাম, “দ্যাখো, গাছটা কেমন অদ্ভুত না? এটার নাম জানো?”

ভয় আর বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকানোর মুহূর্তেই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম নীচে খাদে। ওখান থেকে আর কোনও দিন সে উঠবে না।

তারপর আমি ওই গাছের তলাতেই দিন কাটাতাম, রাত কাটাতাম। তার সঙ্গে কথা বলতাম। তাকে খেতে দিতাম নদীর ঠান্ডা জল। ফুল দিয়ে সাজাতাম তার দেহ। গাঁয়ের লোকে আমার নাম দিল জটিয়াবাবা। আমার দেখাদেখি তারাও গাছের পুজো আরম্ভ করল।

এটুকু বলে মি, শিরোদকার একটু থামলেন। তারপর ব্রিজের ওপর দিয়ে আসা লরিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, জটিয়াবাবা সে দিন আমার হাত ধরে কেঁদে বলেছিলেন, নদীর ধারের ওই গাছটা আমার ছেলে মি. শিরোদকার, ওকে হত্যা করবেন না।’

জটিয়াবাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েই অফিসের দিকে ছুটলাম। কুলিদের এক্ষুনি বারণ করতে হবে গাছটা কাটতে। অফিসঘরের কাছাকাছি আসতেই কুলিদের জটলা চোখে পড়ল। কানেও গেল সব কিছু। গাছটা আমার নির্দেশ অনুসারে এর মধ্যেই কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু গাছটার কাঠের ভেতর ছিল নাকি শক্ত হাড়। ওরা ভয় পেয়েছে। অভিশাপ আর পাপের ভয়।

ছুটতে ছুটতে আবার নদীর ধারে গেলাম। দেখলাম, গাছটা নদীর মধ্যে গিয়ে পড়েছে। কিছু ভক্ত আর অন্ধবিশ্বাসী গ্রামবাসী তার গোড়াটা কেটে এনেছে বট গাছতলায় প্রতিষ্ঠা করবে বলে।

আমি মাথা নিচু করে ফিরে এলাম। জটিয়াবাবার কাছে দেখানোর মুখ নেই আমার। জটিয়াবাবা অবশ্য সে দিনই মারা গেলেন। জন্তুর হাতে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ তিনি সহ্য করতে পেরেছিলেন, মানুষের হাতে পুত্রহত্যার শোকাঘাত তিনি সইতে পারলেন না।

বট গাছতলা থেকে বাড়ির দিকে ফেরার পথে মি. শিরোদকার বললেন, নদীর ওপরে ব্রিজ তৈরি হতে কোনও বাধা থাকল না আর। আমি শুধু এখানে একটা ছোট্ট বাড়ি করলাম। বাড়ির লোকে সেটা আমার খেয়াল বলেই মনে করল। কী একটা আকর্ষণে আমি আজও এখানে না এসে পারি না। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমি নিজেই বুকে বয়ে বেড়াই। আজ আপনাকে প্রথম বললাম, মি. গোস্বামী। কিন্তু আপনি কথা দিয়েছেন–you’llet him rest in peace. তার ওই অস্থিটুকু সরল ভক্ত গ্রামবাসীর পুজো নিয়েই থাক।

[সন্দেশ, ফাল্গুন ১৩৮৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হোমিফাইটা
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

হোমিফাইটা

হোমিফাইটা

নিছক একটা কৌতূহল আর খেয়ালিপনা যে আমাকে এরকম বিস্ময়ের মুখোমুখি এনে দেবে তা আমি কোনও দিন কল্পনাতে আনতে পারিনি। এ কথা কাউকে বললে বিশ্বাস তো করবেই না, বরং আমার মাথার দিকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। হয়তো দীপ্তেন্দুকে বললে সে-ও তা-ই করত। কিন্তু দীপ্তেন্দু তো আজ নেই। পরলোক বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেখানে তার ছোট দাদুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে পারে তার। সেখানে হয়তো…

কী সব আজেবাজে কল্পনা করছি। এ কথা আমি কাউকে বলব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। এমনকী দীপ্তেন্দুর বাড়ির কাউকেও নয়। অবশ্য তাদের সঙ্গে আমার কুড়ি বছর যোগাযোগ নেই। জানিই না তারা এখনও খড়াপুরে আছে কি না।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বৃদ্ধ মারাঠি ইঞ্জিনিয়ার মি. শিরোদকার আমাকে যা বললেন, তার মধ্যে একটুও খাদ নেই। জটিয়া ঝোরার কাছে বট গাছটার নীচে যে পাথরটাকে গাঁয়ের সবাই পুজো দেয়, সেটা যে পাথর বা হাতির দাঁত বা প্রাগৈতিহাসিক কোনও প্রাণীর হাড় নয়, সেটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কী সেটা? গাছের গুঁড়ি–নাকি মানুষের…

থাক। গ্রাম্য দেবতার বিগ্রহটা ওখানেই চিরকাল থাকুক। তবে ওর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ মি, শিরোদকারের চোখ দুটো ছলছল করছিল, সেটা আমি লক্ষ করেছি। আমার চোখে তখন ছিল অগাধ বিস্ময়। সংবিৎ ফিরল, যখন মি. শিরোদকার বললেন, ‘বলুন মি. গোস্বামী, কাউকে এ কথা বলবেন না। Let him rest in peace–এই শান্ত প্রকৃতির পরিবেশে।

আমি কথা দিয়েছিলাম।

ব্যাপারটা প্রথম থেকেই বলা যাক। দেশভ্রমণের বাতিক আমার অনেক দিনের। কোথায় যাব, সেটা বড় কথা নয়। একা একা বেরিয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। এবারও বেরিয়েছিলাম এইভাবে। একটা অরণ্যময় ছোট্ট পার্বত্য স্টেশনে ট্রেন থেমে গেল। থামার কথা ছিল না। হয়তো ছোটখাটো কোনও কারণ ছিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, স্টেশনের নাম–পাইনজল।

পাইনজল! নামটা যেন আমার শৈশবের মূল থেকে আমার স্মৃতিটাকে নাড়া দিল। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম, যেমন দীপ্তেন্দুর কথাও আজকাল মনে পড়ে না। নইলে দীপ্তেন্দুর কাছে কত শুনেছি নামটা। দীপ্তেন্দু বলত, “জানিস বকু, পাইনজলে সাংঘাতিক সব বাঘ আছে। আমার ছোট দাদুকে বাঘে খেয়ে ফেলেছিল। তখন ছোট দাদুর বাবা শোকে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গিয়েছিলেন!”

ছোট দাদু, মানে দীপ্তেন্দুর বাবার কাকা। ওসব দীপ্তেন্দুর জন্মের অনেক আগের কথা। তার বাবাই তখন কলেজে পড়েন। কিন্তু দীপ্তেন্দু যখন এই কথা বলত, তখন বেশ গর্বের সঙ্গেই বলত।

কীসের খেয়াল মাথায় উঠল, ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। সত্যিই কি এখানে বাঘ আছে এখনও? স্টেশনে একজন কুলিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, বাঘের কথা তো সে শোনেনি। এখানেই সে বুড়ো হতে চলল। তবে দেখার মতন ঝরনা আছে এখানে–জটিয়া ঝোরা। জটিয়া ঝোরার পাশে বাউরি নদীর ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে সরকারি সড়ক। এখানে আমি বাঘ দেখতে এসেছি। শুনে সে তো হেসেই বাঁচে না।

বাঘ না থাক, বনবাদাড় আছে। আর আছে অসংখ্য টিলা। একটা টিলার কাছে ছবির মতন একটা বাড়ি দেখে এগিয়ে গেলাম। দেখি, সামনে একজন বৃদ্ধ লোক চেয়ারে বসে আছেন। চারপাশে পাহাড়িদের কুঁড়ে ছাড়া এরকম পাকা বাড়ি নজরে পড়ল না। অন্তত এত সুন্দর তো নয়ই। কিছু না ভেবে ওদিকে এগিয়ে গেলাম।

ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। নাম পুরুষোত্তম মাধবদাস শিরোদকার। বোম্বাইয়ের কাছে নিজের বাড়ি থাকলেও এখানে একটা বাংলো বানিয়েছেন। কখনও সপরিবারে এসে থাকেন। স্থানীয় একজন কেয়ারটেকার বাড়ির দেখাশোনা করে। আমি খেয়ালিপনা করে পাইনজলে নেমে পড়েছি শুনে আমাকে একটু ধমকই দিলেন এরকম বেআক্কেলে হওয়ার জন্যে। তাঁর বাড়ি না থাকলে আমি যে অকূলে পড়তাম, সে কথা শোনাতে ছাড়লেন না। হোটেল দূরের কথা, স্টেশনে ওয়েটিং রুমও নেই। গাড়িও আজ আর নেই। সুতরাং তাঁর ওখানেই আজ আমায় আতিথ্য গ্রহণ করতে হবে।

পুরুষোত্তম সাহেবকে খাস বোম্বাইয়ে দেখলে কীরকম দেখতাম জানি না, তবে নির্জন প্রকৃতির বীক্ষণে মানুষের মনুষ্যত্বটা বেশি করে ধরা পড়ে বোধহয়। কারণ নিজের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য আর বড় হোটেলের আরামবিলাস, দুইই একযোগে পেয়ে গেলাম পাইনজলে এসে।

খাওয়াদাওয়ার পর নানা কথাবার্তায় পাইনজলে বাঘের উল্লেখ করতেই মি. শিরোদকার যেন চমকে উঠলেন। তখন আমি আমার ছেলেবেলায় বন্ধু দীপ্তেন্দুর ছোট দাদুর বাঘের মুখে মৃত্যুর কথাটা তুলতেই তিনি বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা না বলে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। অনেকক্ষণ পরে অনুনয়ের স্বরে বললেন, ‘মি, গোস্বামী, আমার হাত ধরে বলুন, আমি যা বলব তা প্রকাশ করবেন না। তবে আমি আমার জীবনের একটা ঘটনার কথা বলব। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা না হলে করবেন না। কিন্তু দোহাই, এ বিষয়ে কোনও শোরগোল তুলবেন না।‘

আমি তাঁর হাত ধরে কথা দিতে তিনি আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন জটিয়া ঝোরার দিকে। যেতে যেতে বলতে লাগলেন তাঁর কাহিনি। তাঁর মুখে যা শুনেছিলাম তা এইরকম—

আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। ভারত সরকারের কনস্ট্রাকশন বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করি। পাইনজলে একটা ভার পড়ল আমার ওপর। বাউরি নদীর ওপর যে ব্রিজটা এখন আছে, ওটা তৈরি করার কাজ। কুলিকামিন নিয়ে অস্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে জরিপটরিপের কাজ হয়ে গেল। নদীর ধারে অনেক গাছটাছ কাটতে হবে। পাথর কেটে রাস্তা করতে হবে। সন্ধেবেলা নকশা হাতে নিয়ে বসেছি, এমন সময় একজন কুলি এসে বলল, ‘সাব, নদীর পাড়ে জটিয়াবাবার গাছটা কাটতে বারণ করছে গাঁয়ের সকলে। ওটাকে নাকি ওরা পুজো করে।’

গাছটাছ পুজো মহেনজোদারোর যুগে ছিল বলে শুনেছি। এখন এসব কুসংস্কারের কথা শুনলে পিত্তি জ্বলে ওঠে। বিশেষ করে, এসব কাজে হাত দেওয়ার সময় এরকম বাধায় অনেক পড়েছি আমি। মন্দির-মসজিদ হলেও না-হয় কথা ছিল। এখানে কিনা একটা গাছ!

সে দিন এ বিষয়ে না ভেবে পরদিন সকালে জায়গাটাতে এলাম। গাছটা একটু অদ্ভুতই। আমি বনেবাদাড়ে অনেক কাজ করেছি, কিন্তু এরকম গাছ দেখিনি। অনেকটা ফার বা পাইন গাছের মতন সোজা-সরল। শাখাগুলো দু-পাশ দিয়ে উঠেছে সিমেট্রি রেখে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, প্রত্যেক শাখার প্রান্তে একটি করে পাতা। শিমুলপাতার মতন করতলাকার, কিন্তু ক্যাকটাসের মতন পুরু। আমি উদ্ভিদবিজ্ঞানী নই–কাজেই গাছটার নাম জানতাম না। গাছটা যে জাতীয়ই হোক, তার জন্যে তো আর কাজ বন্ধ রাখা যায় না। আজ বিকেলেই গাছটা কেটে ফেলার আদেশ দিয়ে ফিরে এলাম অন্য কাজকর্ম দেখতে। যদি কেউ গোলমাল করে, তবে তাদের গ্রেফতার করার পরোয়ানা নিয়ে আসা হবে, এটা যেন গ্রামবাসীদের জানিয়ে দেওয়া হয়–সে কথাও বলে এলাম। অবশ্য শুনলাম, গ্রামবাসীরা খুবই নিরীহ। তারা কোনও গোলমাল পাকাতে চায় না এ নিয়ে।

বিকেলের দিকে বেরিয়ে কাজকর্ম তদারক করছি, এমন সময় কুলির সঙ্গে একজন গ্রামবাসী এসে বলল, জটিয়াবাবা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

জটিয়াবাবা বলে যে কেউ আছে তা জানতাম না। শুনলাম, তিনি বৃদ্ধ ও অসুস্থ অবস্থায় গাঁয়ের মোড়লের বাড়িতে আছেন। প্রায় মরণাপন্ন। আমার কথা তিনি শুনেছেন। মরবার আগে আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চান।

ভাবলাম, গাছ কাটার কথা জটিয়াবাবা নিশ্চয় শুনেছেন। সে বিষয়েই হয়তো কিছু বলবেন। যা-ই হোক, বৃদ্ধ মুমূর্ষ লোকের একটা অনুরোধ রাখতে দেখা করাই মনস্থ করলাম।

মোড়লের বাড়িতে ঢুকতেই বিছানায় শায়িত জটিয়াবাবাকে দেখলাম। তাঁর নামের যথার্থতাও বুঝলাম। মাথার জট খাটিয়া বেয়ে ঝুলছে বটের ঝুরির মতন। হাত দুটো সামনে এনে নমস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, বসুন মি. শিরোদকার। আপনার সঙ্গে গোপনে কিছু কথা আছে। ইঙ্গিতে সকলকে চলে যেতে বললেন ঘর থেকে। তারপর তিনি নিজের কথা যা বললেন, তাতে আমি চিন্তাশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার তখনকার অবস্থা সব শুনলে আপনিও বুঝবেন মি. গোস্বামী।

জটিয়াবাবা বললেন, তাঁর আসল নাম নরনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। তিনি বাঙালি। তাঁর এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী বন্ধু ছিলেন। তখনকার কালে তাঁর গবেষণা শুধু দেশে নয়, বাইরেও বেশ নাম করে। তাঁর নামটা তিনি বলতে চান না। কারণ সাধারণে এবং শিক্ষাজগতের সবাই জানত, শেষের দিকে তিনি যোগটোগ করে সাধু হয়ে যান। সেই অজ্ঞাতবাসে তাঁর মৃত্যু হয়। যা জেনেছে তা-ই জানুক লোকে। তবে কাহিনির খাতিরে ধরে নিন তাঁর নাম বনবিহারী।

এই বলে জটিয়াবাবা যা বললেন, সেটা তাঁর নিজের ভাষাতেই বলি।

‘আমার ছোট ছেলে কৃষ্ণেন্দু বনবিহারীর বেশ ভক্ত হয়ে পড়ে। বনবিহারী মাঝে মাঝে আমার বাড়ি আসত। বলত, পাইনজল নামে নির্জন এক পার্বত্য গ্রামে সে একটা যোগাশ্রম করেছে। কৃষ্ণেন্দু মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় এসেছে এখানে। সাধুকাকার উৎসাহে যোগ আর ধ্যান অভ্যাসও আরম্ভ করল। আমার স্ত্রী-র আর বড় ছেলের এসব একদম পছন্দ হত না। আমি অতটা অপছন্দ করতাম না। ওতে মনের একাগ্রতা বাড়ে, দেহ সুস্থ থাকে।

যা-ই হোক, সেবারও এক ছুটিতে কৃষ্ণেন্দু এসে এখানে ছিল। তার ক-দিন পরেই বনবিহারীর কাছ থেকে একটা চিঠি এসে আমার বাড়ির সব সুখশান্তি একেবারে তছনছ করে দিল।

বনবিহারী লিখেছে, কৃষ্ণেন্দু মাঝরাতে একবার ঘর থেকে বেরিয়েছিল। একটা বাঘ বাগানে ওঁত পেতে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়। ক-দিন থেকেই বাঘের ডাক লোকে শুনছিল। সেটা যে মানুষখেকো তা জানা যায়নি। তবুও কৃষ্ণেন্দুকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল সন্ধের পরে ঘরের বাইরে না যেতে। বাঘটা কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে বোধহয় অন্য অঞ্চলে চলে যায়, কারণ কৃষ্ণেন্দুর দেহ পাওয়া যায়নি।

আমার জন্যই কৃষ্ণেন্দুকে হারালাম, এই বোধ আমাকে নির্বাক করে দিল। তার পাগলপ্রায় মা সে কথাই দিনরাত আমাকে শোনাতে লাগল। সংসার থেকে ক্রমে ক্রমে আলগা হয়ে পড়লাম আমি। কয়েক বছর পরে ঠিক করলাম, কৃষ্ণেন্দু যেখানে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, সেখানেই বাকি জীবনটা ঈশ্বর উপাসনা করে কাটিয়ে দেব।

কাউকে কিছু না বলে একদিন বাড়ি ছাড়লাম। আমি যে পাইনজলে এলাম, সে কথা কেউ জানল না। পাইনজলের বনবিহারীর আশ্রমে আসতে সে তো আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। নদীর ধারে সুন্দর আশ্রম করেছে। আমার সিদ্ধান্তের কথা শুনে বলল, এই আশ্রমকেই নিজের আশ্রম ভেবে ধ্যানধারণা করতে পারি। স্থানীয় গ্রামবাসীরাই চাল-ডাল, ফলমূল আর দুধ দিয়ে যায়। কেউ কেউ ওষুধবিশুধও নিতে আসে-হাসতে হাসতে বলল বনবিহারী।

আশ্রমের বাগানে দেখলাম অনেক কবিরাজি গাছ-কালমেঘ, বাসক, কন্টিকারি, সিঙ্কোনা প্রভৃতি। বুঝলাম, এগুলোই চাল-ডাল আর দুধের মূল্য।

একদিন বনবিহারীর ঘরে ঢুকে দেখি, বনবিহারী কী যেন লিখছে। আমাকে দেখেই থতমত খেয়ে খাতাটা বিছানার তলায় লুকিয়ে ফেলল। একজন সন্ন্যাসীর কী গোপনীয়তা থাকতে পারে আত্মপ্রচার বিষয় ছাড়া? অবাক হলেও ওটা নজরই করিনি, এভাবে অন্য কথাবার্তা বলে বেরিয়ে এলাম।

বনবিহারী আশ্রমের বাইরে গেলে খাতাটা বের করে খুললাম। দু-জনে আজ সন্ন্যাসী হলেও এককালে সহপাঠী বন্ধু ছিলাম। সেই পেছনে লাগার মনোভাবটা হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু উদ্ভিদবিদ্যার নানা খুঁটিনাটিই শুধু চোখে পড়ল। হয়তো ঈশ্বরসাধনার সঙ্গে সঙ্গে তার গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছে বনবিহারী। জীবকোশ আর উদ্ভিদকোশের কয়েকটা ছবি আর নানারকম শব্দ বা টার্মসের ছড়াছড়ি প্রোটোপ্লাজম, নিউক্লিয়াস, ফোটোসিন্থেসিস ইত্যাদি। হঠাৎ একটা পাতায় কৃষ্ণেন্দুর নাম দেখে চমকে উঠলাম। নোটের আকারে লেখা–কৃষ্ণেন্দুর সমাধিশিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। সে বারো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ধ্যান করতে সক্ষম। তবুও একটা খাঁচাতে তার দেহ সোজা করে রাখতে হবে। কারণ এটা তো বারো ঘণ্টার ব্যাপার নয়। পা দুটো গোড়ালি পর্যন্ত পোঁতা থাকবে।

কিছু বুঝতে পারলাম না। বেশ কিছু দিন পরের তারিখ দিয়ে আবার লেখা–হরিণের খুলি পাহাড়ে পড়ে থাকতে থাকতে পাথর হয়ে যায়। কৃষ্ণেন্দুর শরীরে অ্যালজি বা শ্যাওলা। লাগিয়ে দেখা যাক পরিবর্তনটা তাড়াতাড়ি আনে কি না। গাছ থেকে ইনজেকশনটা দিনে দু-বার করে দিচ্ছি।

আরেক দিনের তারিখে শরীরে ক্লোরোফিল ঢুকিয়ে দেওয়াতে আজ থেকে সূর্যের আলোতেই অল্প অল্প খাদ্য তৈরি করছে। ওর আঙুল-পাতা থেকে যে অক্সিজেন বেরোচ্ছে, সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি। বর্তমানে দুটোমাত্র শাখা, যা তার হাত ছিল। আরও শাখার সৃষ্টি করতে হবে।

পরের পাতায়–বট গাছের শেকড় কৃষ্ণেন্দুর পায়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা কলম করে জুড়ে দিতে চমৎকার মোটা হয়ে সেখানে সেলুলোজের স্তর জমছে। আমি সফলতার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।

আবার একদিন লেখা–আজ আমার কী আনন্দের দিন! উদ্ভিদজগৎ প্রাণীজগতের কাছাকাছি আসে শুধু ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসে নয়। বড় গাছ আর উন্নততম প্রাণীও মিলে যেতে পারে। এটাই আমি প্রমাণ করলাম। নরনারায়ণের ছেলে কৃষ্ণেন্দু আজ উদ্ভিদমাত্র। এই নতুন গাছে মানুষের জীবনের লক্ষণ ধরা পড়বে। সেটা কতখানি তা নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। পৃথিবীতে আমিই এর সৃষ্টিকর্তা। এইবার এতে ফুল-ফল ও বীজের সৃষ্টি হলে এই গাছ থেকেই অনেক গাছের সৃষ্টি হবে। হয়তো এই পাইনজলেই একটা মায়াকানন গড়ে উঠবে। কেউ জানবে না এর সৃষ্টিরহস্য। এই নতুন গাছের বটানিক্যাল নাম দিলাম–হোমিফাইটা অর্থাৎ নৃবৃক্ষ।’

জটিয়াবাবা বলে চললেন, এইটুকু পড়ে আমার সামনে থেকে পৃথিবীটা যেন সরে গেল। কৃষ্ণেন্দুকে তবে বাঘে খায়নি। আজও অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সে বেঁচে আছে! ছুটে নদীর ধারে চলে এলাম, নোটবইয়ের বর্ণনা ও ছবি দেখে মিলিয়ে দেখলাম–কৃষ্ণেন্দুকে, নাকি একটা গাছকে! দু-পাশে মাত্র দুটো ডাল উঠে গিয়েছে, একটাতে বাঁধা তার সেই মাদুলি। ওটা খুলতে বোধহয় ভুলে গিয়েছে বনবিহারী শয়তানটা। গায়ে হাত বোলাতেই থরথর করে কেঁপে উঠল কৃষ্ণেন্দু। লজ্জাবতীর পাতার মতন তার পাতাগুলোও নড়ে উঠল।

বনবিহারী আশ্রমে ফিরতেই তাকে ভুলিয়ে নদীর ধারে নিয়ে এলাম। দূর থেকে কৃষ্ণেন্দুকে দেখিয়ে বললাম, “দ্যাখো, গাছটা কেমন অদ্ভুত না? এটার নাম জানো?”

ভয় আর বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকানোর মুহূর্তেই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম নীচে খাদে। ওখান থেকে আর কোনও দিন সে উঠবে না।

তারপর আমি ওই গাছের তলাতেই দিন কাটাতাম, রাত কাটাতাম। তার সঙ্গে কথা বলতাম। তাকে খেতে দিতাম নদীর ঠান্ডা জল। ফুল দিয়ে সাজাতাম তার দেহ। গাঁয়ের লোকে আমার নাম দিল জটিয়াবাবা। আমার দেখাদেখি তারাও গাছের পুজো আরম্ভ করল।

এটুকু বলে মি, শিরোদকার একটু থামলেন। তারপর ব্রিজের ওপর দিয়ে আসা লরিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, জটিয়াবাবা সে দিন আমার হাত ধরে কেঁদে বলেছিলেন, নদীর ধারের ওই গাছটা আমার ছেলে মি. শিরোদকার, ওকে হত্যা করবেন না।’

জটিয়াবাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েই অফিসের দিকে ছুটলাম। কুলিদের এক্ষুনি বারণ করতে হবে গাছটা কাটতে। অফিসঘরের কাছাকাছি আসতেই কুলিদের জটলা চোখে পড়ল। কানেও গেল সব কিছু। গাছটা আমার নির্দেশ অনুসারে এর মধ্যেই কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু গাছটার কাঠের ভেতর ছিল নাকি শক্ত হাড়। ওরা ভয় পেয়েছে। অভিশাপ আর পাপের ভয়।

ছুটতে ছুটতে আবার নদীর ধারে গেলাম। দেখলাম, গাছটা নদীর মধ্যে গিয়ে পড়েছে। কিছু ভক্ত আর অন্ধবিশ্বাসী গ্রামবাসী তার গোড়াটা কেটে এনেছে বট গাছতলায় প্রতিষ্ঠা করবে বলে।

আমি মাথা নিচু করে ফিরে এলাম। জটিয়াবাবার কাছে দেখানোর মুখ নেই আমার। জটিয়াবাবা অবশ্য সে দিনই মারা গেলেন। জন্তুর হাতে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ তিনি সহ্য করতে পেরেছিলেন, মানুষের হাতে পুত্রহত্যার শোকাঘাত তিনি সইতে পারলেন না।

বট গাছতলা থেকে বাড়ির দিকে ফেরার পথে মি. শিরোদকার বললেন, নদীর ওপরে ব্রিজ তৈরি হতে কোনও বাধা থাকল না আর। আমি শুধু এখানে একটা ছোট্ট বাড়ি করলাম। বাড়ির লোকে সেটা আমার খেয়াল বলেই মনে করল। কী একটা আকর্ষণে আমি আজও এখানে না এসে পারি না। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমি নিজেই বুকে বয়ে বেড়াই। আজ আপনাকে প্রথম বললাম, মি. গোস্বামী। কিন্তু আপনি কথা দিয়েছেন–you’llet him rest in peace. তার ওই অস্থিটুকু সরল ভক্ত গ্রামবাসীর পুজো নিয়েই থাক।

[সন্দেশ, ফাল্গুন ১৩৮৭]