২. পিচ ঢালা অন্ধকার

০৫.

গয়া ছেড়ে এসেছে একটু আগেই। সামনে এখন পিচ ঢালা অন্ধকার। সার্চলাইটের ফোকাসে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত আলোর বৃত্তাকার সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গ ধরে ছুটে চলেছে রাতের কালকা মেল।

বড় স্টেশন আসতে দেরি আছে। তাই ক্রমেই স্পিড তুলছেন চালক। এখনও লেট রান করছে ট্রেন, যতটা পুষিয়ে নেওয়া যায়।

প্রচণ্ড গতিতে ছুটছে ট্রেন। তীব্র হর্নে মাঝে-মাঝে কেঁপে উঠছে নিশুতি চরাচর।

অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনের দুলুনিতে ঢুলতে শুরু করেছে। সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। ড্রাইভার। থাক্‌ ঘুমোক। তেমন তো দরকার পড়ছে না। ড্রাইভার কন্ট্রোল হুইলে হাত রেখে আরও গতি বাড়ালেন। এই রুটের লাইনের কন্ডিশন ভালো।

হঠাৎ–ও কী! কী ওটা? ড্রাইভারের ভ্রু কুঁচকে উঠল।

আলোর সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে লাল আলোর মতো কিছু একটা নাচছে! সঙ্গে সঙ্গে হর্ন বাজিয়ে দিলেন তিনি।

কিন্তু লাল আলোটা তো একটুও সরছে না! লাইনের ওপর শুধু আলোটা দুলছে। পেন্ডুলামের মতো। কে দোলাচ্ছে ওকে? নাহ্। আর কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না।

লাল আলো মানেই বিপদসংকেত!

 মুহূর্তে স্পিড গিয়ার ছেড়ে দিয়ে ব্রেকে পা রাখলেন ড্রাইভার।

 দোদুল্যমান লাল আলো অনেক স্পষ্ট, বড় এবং বেশ জোরালো।

 সহকর্মীকে বললেন ড্রাইভার,ওহে, ওঠো! দ্যাখো, দ্যাখো!

অদ্ভুতুড়ে লাল আলো একইভাবে দুলছে ডাইনে থেকে বাঁয়ে। আর কেউ কোথাও নেই।

অ্যাসিস্ট্যান্ট চোখটোখ কচলে তাকিয়েই লাফিয়ে উঠল,–ও–ও কী!

মাত্র শখানেক গজ দূরে চোখধাঁধানো লাল আলো!

প্রাণপণে ব্রেক কষলেন ড্রাইভার!..

প্রবল ঝাঁকুনি খেতে-খেতে একটু দূর গিয়ে থেমে গেল কালকা মেল।…

বাইরে একবার মুখ বাড়িয়েই ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমেছেন ড্রাইভার ও সহকর্মী। পিছনে গার্ডের কেবিন থেকেও, ছুটে আসছে অন্য রেলকর্মীরা। কম্পার্টমেন্টের ভিতর থেকে মৃদু কাতরানির শব্দও ভেসে আসছে।

ওরা ভ্রূক্ষেপ করলেন না। খুব জোরে ছুটতে লাগলেন লাইন ধরে সামনের দিকে।

কিন্তু কোথায় দুলতে থাকা সেই লাল আলো? সার্চলাইটে বহুদূর পর্যন্ত লাইন ধবধবে সাদা। দিনের মতো স্পষ্ট। কোথাও কিছু নেই।

হঠাৎ–তাই তো! লাইনে ঝিমঝিম একটা স্পন্দন হচ্ছে না? ওদিক থেকে আর কোনও ট্রেন আসছে নাকি? হ্যাঁ, ঠিক! লাইনে হাত ছোঁয়াতেই স্পষ্ট বোঝা গেল, এ লাইনেই অন্য কোনও ট্রেন চলছে।

এ কী করে সম্ভব? সিগন্যালিং সিস্টেমে তো ভুল থাকার কথা নয়।

সকলের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে। এখন?

ড্রাইভার বললেন,সবাই আরও সামনের দিকে ছুটে চলো। গার্ডসায়েব আপনি লাল ফ্ল্যাগ আর টর্চ ঘুরিয়ে যান।

শীতের জনহীন রাত। লাইনের এবড়োখেবড়ো স্লিপারের উপর দিয়ে কালকার রেলকর্মীরা ছুটে চলেছেন সামনের দিকে। গার্ড দুজন সামনে, ফ্ল্যাগ ও আলো নাড়ছেন।

বহু বহুদূরে আলোর বিন্দু। উলটোদিকের ট্রেনটা আসছে!

 একটু একটু করে বড় হচ্ছে।

 দূরে লাইনের ওপরেও হালকা আভা।

কিন্তু ট্রেনটা থেমে গেল! হ্যাঁ, তাই। আলো আর বড় হচ্ছে না! তফাত কম করে দু কিলোমিটার। এতদুর থেকে তো এদের আলো-ফ্ল্যাগ দেখা সম্ভব নয়।

লাইনে ফের হাত রাখলেন ড্রাইভার। হ্যাঁ, লাইন আবার নিথর। উলটোদিকের ট্রেন থেমে গেছে।

কে থামাল ওকে?…

.

অনাথবাবু খেতে বসে কাগজ পড়ছিলেন। আর শিউরে উঠছিলেন। দুই ড্রাইভারের ইন্টারভিউয়ের ভিত্তিতে ফলাও করে খবরটা ছাপা হয়েছে কানপুরের সবকটা কাগজে।

পরশু রাতের কালকা মেল-এ অনাথবাবুরাও ছিলেন। উনি আর ওঁর স্ত্রী।

সেই রাতটা যেন ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। রাত তখন কত হবে? আড়াইটে তিনটে। কামরার সব প্যাসেঞ্জার অঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন।

হঠাৎ কী প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষল ট্রেনটা! উপরের বার্থে ছিলেন অনাথবাবু, সোজা গড়িয়ে পড়লেন নীচে। নেহাত মাঝে সুটকেস-বেডিং ছিল, তাই মাথাটা ফাটেনি। কতজনের যে রক্তারক্তি কাণ্ড!

তবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন সকলে। ভূতুড়ে লাল আলোটা না দুললে এতক্ষণ তো অনাথবাবুরা ফটো হয়ে গেছেন।

ওদিকের ট্রেনটি ছিল মালগাড়ি। দিল্লি থেকে আসছিল। তার ড্রাইভার জানিয়েছে, সে নিজের লাইন ধরেই আসছিল। কিন্তু আগের স্টেশন পার হবার পর সে সিগন্যাল পায় লাইন চেঞ্জ করার। সে জানত, পাশের লাইনে এসময় কালকা আসে। কিন্তু সিগন্যাল অনুযায়ী সে চলতে বাধ্য।

কালকার লাইন ধরে এগোতে-এগোতে সেও–হ্যাঁ, সেও বলেছে ওই লাইনের ওপর দুলতে থাকা লাল আলোর কথা। তৎক্ষণাৎ ব্রেক কষে থামিয়েছে ট্রেনকে।

সে রাতে গোড়া থেকেই সব যা-তা ব্যাপার! ট্রেনে ওঠার সময়েই পাঞ্জাবির ঝুল পকেট থেকে শদেড়েক টাকা খোয়া গেল। বোধহয় যাত্রীদের নামা ওঠার ভিড়ে কোনও পকেটমার মিশেছিল।

তারপর মোগলসরাই পেরোবার একটু পরেই–ডাকাত! ডাকাত! আর্তনাদ। চার পাঁচটা মুষকো কালো জোয়ান, হাতে পিস্তল, ছোরা-ছুরি। অনাথবাবু উঁকি মেরে দেখে কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে ছিলেন।

কিন্তু যাত্রীদের ডাকাত চিৎকার শুনে অ্যাটেনডেন্ট নিঃশব্দে ছুটে গেছিলেন পুলিশ ফোর্সের কামরায়। দশ মিনিটের মধ্যে রাইফেল নিয়ে ঢুকে এল আর পি এফ। তাদের আওয়াজ শুনে চেন টেনে মাঠের মধ্যে লাফিয়ে পালিয়ে গেল লোকগুলো।

মনে-মনে তখন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন অনাথবাবু। যাক্, ঈশ্বরের কৃপায় ফাড়াকেটে গেল। একটু পরেই তলিয়ে গেছিলেন ঘুমে।

কিন্তু তারপর?…

 কিন্তু, ওই লাল আলোটা দোলালো কে? কোনও অপার্থিব অলৌকিক শক্তি? ভগবান?

কী অদ্ভুত, কথাটা মনে হতেই পিপ.পিপ.পিপ!

অনাথবাবু চমকে উঠলেন। হাতের আংটিটা বাজতে শুরু করেছে। বাব্বা, কতদিন পরে!

তাড়াতাড়ি টিপে ধরলেন একটা বোতাম। সঙ্গে সঙ্গে সেই মিহি ধাতব কণ্ঠ, টিভি খুলুন। টিভি খুলুন।

তার মানে, তার মানে অনিন্দ্য! মানুষ, কিন্তু মানুষ নয়! ভিনগ্রহী!

কলকাতার মাসদুয়েক আগের রাতের পর থেকে অনিন্দ্যর কোনও খোঁজ নেই। ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত বলে সে রাতে ও মিলিয়ে গেছিল।

তারপর মেয়ে-নাতি চলে গেল। তারও একমাস পরে ওঁরা দুজন রওনা হলেন মেয়ের বাড়ি বেড়াতে।

এত দিনের মধ্যে একবারও যোগাযোগ হয়নি। মাঝে একদিন বোতাম টিপেছিলেন। খবরাখবর জানতে। কিন্তু আংটি সাড়াশব্দ করেনি।

অনাথবাবু মাঝে-মাঝে ভাবতে শুরু করেছিলেন, গোটাটাই অনিন্দ্যর গালগপ্পো নয়তো। হয়তো উঁচু জাতের ম্যাজিশিয়ান। তাকে নিয়ে মজা করছে। ভিনগ্রহ-ট্রহ ফাতু।

তবু সাতপাঁচ ভেবে আংটিটা আঙুলছাড়া করেননি।

পা টিপে টিপে পাশের ঘরে এলেন অনাথবাবু। যাক্, জামাই বাবাজীবন অফিস থেকে এখনও ফেরেনি। আর নাতি, মেয়ে আর মেয়ের মা গেছে মন্দিরে। কিষণজীকে পুজো দিতে।

বাড়ি ফাঁকা।

সুইচটা অন করে একটা চ্যানেল টিপলেন অনাথবাবু। কী একটা হিন্দি নাচগানের প্রোগ্রাম হচ্ছে।

ঝট্‌ করে প্রোগ্রামটা মিলিয়ে গেল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল অনিন্দ্য।

নমস্কার অনাথবাবু। এখন ভালো আছেন তো?

হ্যাঁ। এখন ঠিক আছি। তবে পরশু রাতে–

–হ্যাঁ, একচুলের জন্যে বেঁচে গেছেন। নেহাত পৃথিবীতে শুধু আপনার সঙ্গেই যোগাযোগটা ছিল। আপনার আঙুলের ঐ আংটির কল্যাণে। নইলে জানতেও পারতাম না।

–আপনি সব জানেন?

–অনাথবাবু, আপনাকে আরও বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। আপনার গতিবিধি, ভবিষ্যৎ সবসময় আমাদের ল্যাবে মনিটরিং হচ্ছে। মাঝে এমনসব ঝাটে জড়িয়ে গেছিলাম, যে কয়েকদিন লক্ষ্য রাখতে পারিনি। আপনার সিগন্যালেও রেসপন্ড করিনি। কিন্তু ওদিন রাতে যখন দেখলাম, তার মধ্যেই দুটো ট্রেন এক লাইনে ঢুকে পড়েছে।

মানে আপনি, আপনারা ওই লাল আলো–

–লেসার বিম চালিয়ে ইলুশন তৈরি করতে হল। হ্যাঁ। তখন আর কিছু করার সময় ছিল না।

-ওটা না হলে কেউ বাঁচতাম না!

হ্যাঁ। কিন্তু সেদিন কেন দুর্ঘটনা ঘটানো হচ্ছিল, জানেন?

–ঘটানো হচ্ছিল!

–হ্যাঁ অনাথবাবু।

-ক-কেন অনিন্দ্য?

–আপনাকে মেরে ফেলার জন্যে।

–আমাকে! কী বলছেন!

হ্যাঁ, আপনাকে। মন শক্ত করুন, ভয় পাবেন না। সেদিন যে বলে গেছিলাম ষড়যন্ত্র চক্রান্ত, বোঝেননি কিছু? এই পৃথিবীতে আমরা আসার আগে থেকেই এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে আরেক দল। ওরা এসেছে অন্য কোনও ছায়াপথ থেকে। জেনেছি, ওদের গ্রহটা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই থাকার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে এসেছে আপনাদের এখানে। ওরা চেহারা, হাবভাব অবিকল আপনাদের মতো করে ফেলতে পারে। ফলে কেউ চিনতেও পারবে না। এসেই ওরা মিশে গেছে আপনাদের মধ্যে। আর আপনাদের ব্রেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিষাক্ত সব মানসিকতা। হিংসা, লোভ, খুন, রাহাজানি। ওরা খুব হিংস্র স্বভাবের প্রাণী। যে-কোনও কিছু ধ্বংস করা, নষ্ট করা ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

সর্বনাশ!

–হ্যাঁ অনাথবাবু। খুব দুশ্চিন্তার বিষয়। ওরা চায়, এইভাবে অধঃপতনের দিকে গিয়ে মানুষরা একদম মুছে যাক পৃথিবী থেকে। ব্যস, ওরা তখন মানুষ সেজে নিঝাটে শাসন করতে পারবে।

–তাহলে কী হবে?

–আমরা এসে পড়েছি এবং চক্রান্তটা জেনেও ফেলেছি। এখন এত সহজ হবে না। মুশকিল হল, ওরাও বিজ্ঞানে বেশ খানিকটা এগিয়ে। তাই ওরাও আমাদের টের পেয়ে গেছে। আরও জেনে গেছে, আপনি আমাদের সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম। খবরের সোর্স। তাই আপনাকে যে-কোনওভাবে সরিয়ে দিতে চাইছে।

অনন্তবাবুর রক্ত হিম হয়ে গেছে। বুকের কাছটা খচখচ করছে।

–আঃ অনাথবাবু! বি স্টেডি। আমরা তো আছি! একটাই কথা, সবসময় আংটিটা পরে থাকবেন। একটু অসুবিধেয় পড়লেই বোতামটা টিপবেন। আর

বাইরে কলিং বেল বেজে উঠল।

অনিন্দ্য বলে উঠল, আপনার বাড়ির সবাই এসে গেছে। চলি। যোগাযোগ রাখবেন।

আবার টিভির হিন্দি নাচাগানা শুরু হয়ে গেল। অনাথবাবু স্খলিত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

.

০৬.

ঠিক পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল অনাথবাবুর। বাইরে এখনও পাতলা অন্ধকার। দু-একটা পাখির রব শোনা যাচ্ছে।

এটা বরাবরের অভ্যেস অনাথবাবুর। কী গ্রীষ্ম কী শীত, পাঁচটা বাজলে চোখ খুলে যায়। কলকাতায় থাকলে হৃষিকেশ পার্কে চলে যান। ঘণ্টাখানেক চক্কর মারেন। কানপুরে এলে গঙ্গার তীর। গঙ্গা এখান থেকে খুব কাছে, হাঁটাপথে বড়জোর মিনিট পাঁচেক।

জলটল খেয়ে গরম পোশাকে তৈরি হয়ে নিলেন অনাথবাবু। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হলেও ঠান্ডা এখানে বেশ কনকনে।

পথঘাট পুরো ফাঁকা। চা-নাস্তার দোকানও খোলেনি। বাঁদিকের রাস্তাটা চলে গেছে গঙ্গার দিকে।

দুম করে কালকের সন্ধেটা মনে পড়ে গেল। অমনি গা ছমছম করে উঠল। এভাবে একা বেরিয়ে পড়াটা ঠিক হল?

ধুৎ, শুধু-শুধু ভয় পেয়ে লাভ নেই। যা হবার, হবে। বয়স তো কম হল না।

ভাবলে কী হবে, মন থেকে ভয়টা গেল না। নির্জন রাস্তায় ওঁরই পায়ের শব্দ! অথচ মনে হচ্ছে, পেছনে কেউ ফলো করছে।

অনাথবাবু বোঝার জন্যে বারকয়েক দাঁড়ালেন। সঙ্গে-সঙ্গে শব্দটা থেমে গেল। আবার হাঁটতে শুরু করলেন, ফট-ফটু শব্দও শুরু হয়ে গেল।

ধেত্তেরি! অনাথবাবু হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। সোজা এসে উঠলেন গঙ্গার তীরে। দাঁড়ালেন, পিছন ফিরে এদিক-ওদিক দেখলেন। নাঃ, কেউ কোথাও নেই। প্রাণভরে নিশ্বাস নিলেন। ভোরের তাজা বাতাস ফুসফুসে ঢুকল।

সামনে চওড়া নদী। ভোরের হালকা আভা গায়ে মেখে রুপোলি হয়ে শুয়ে আছে। শব্দহীন। গঙ্গার বুকে এখনও দু-চারটে আলো ফুটফুট করছে। ডিঙি নৌকো।

গঙ্গার কাছে এসে দাঁড়ালেই অনাথবাবুর মন ভালো হয়ে যায়। সেই হিমালয় থেকে কোটি-কোটি গ্যালন জল বয়ে নিয়ে চলেছে সাগর পর্যন্ত। কত কত যুগ ধরে। যাত্রাপথে কত শহর, জনপদ, গ্রামগঞ্জ, কতরকমের মানুষ।

কত ইতিহাসের সাক্ষী এই নদী। সকলের কাছেই বড় পবিত্র। এর জলে সব পাপ নাকি দূর হয়ে যায়। আবার এই পবিত্র গঙ্গাতেই মানুষ ফেলে যত আবর্জনা।

সত্যি, মানুষের মতো এমন আজব জীব বোধহয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর নেই।

গঙ্গার বুক থেকে অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস বইছে। অনাথবাবুর বাঁদুরে টুপির ফাঁক দিয়ে সূঁচের মতো বিঁধছে। অনাথবাবু গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করলেন দক্ষিণমুখো।

চারিদিক এরমধ্যেই অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। দূরে দু-একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছে।

হাঁটতে হাঁটতে বাঁধানো ঘাটের কাছে এসে গেলেন অনাথবাবু। একজন খালি গায়ে তেল চাপড়াচ্ছে। তারপর তরতর করে নেমে গেল জলে।

বাপরে, এই কনকনে কাকভোরে গঙ্গাস্নান। এলেম আছে বলতে হবে। লোকটা নামতে নামতে বুকজল অব্দি গিয়ে দুহাত জড়ো করল। তার মানে স্তব করছে। ধর্মের কী অদ্ভুত শক্তি!

অনেকখানি একনাগাড়ে হেঁটেছেন, বেশ শ্রান্ত লাগছে। ঘাম দিচ্ছে। ঘাটের বাঁধানো জায়গায় পা ঝুলিয়ে বসলেন।

আরে, মিত্রমশাই এখানে!

অনাথবাবু পিছন ফিরে অবাক হয়ে গেলেন। ভবতারণবাবু। হেসে বললেন,জানেনই তো, মর্নিং ওয়াক। আপনি?

–আমিও।

–তাই? কবে থেকে শুরু করলেন?

 –এই কদিন হয়েছে। ঠিকমতো হজম হয় না! ডাক্তার বলল, গণ্ডা গণ্ডা ওষুধ গিলে কিস্যু হবে না, রোজ মাইলদুয়েক হাঁটতে হবে।

–এক্কেবারে ঠিক দাওয়াই। আগেরবারই বলে গেছলুম, দেখলেন তো! সকালে হাঁটার চেয়ে বড় ওষুধ আর নেই।

ভবতারণ গাঙ্গুলি অনাথবাবুর পরিচিত। বিপত্নীক। ছেলে এখানকার গানশেল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। তাই বছরদুয়েক হল, কলকাতার পাট চুকিয়ে ছেলের কাছে চলে এসেছেন। ওঁর ছেলে আবার অনাথবাবুর জামাইয়ের বন্ধু। কাছাকাছি ফ্ল্যাট। দুই পরিবারের মধ্যেও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা।

ভবতারণবাবু বললেন,–মিত্ৰমশাই, চলুন, আরটু এগোনো যাক।

–হ্যাঁ। চলুন।

দুজনে নানান গপ্পোসপ্পো করতে করতে এগোচ্ছেন। কলকাতার কথা, কানপুরের কথা। অনাথবাবু ভাবছেন, বলবেন নাকি ওনার সব অভিজ্ঞতার কথা? আবার ভাবছেন, না থাক।

একটু দুরে শ্মশান। ধোঁয়া উঠছে। তার পাশে মন্দির। জায়গাটা বেশ ফঁকা।

অনাথবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। হাঁফ ছেড়ে বললেন,–অনেকটা চলে এসেছি। এবার তাহলে ফেরা যাক গাঙ্গুলিমশাই।

আর ফিরে কী হবে মিত্ৰমশাই?

অনাথবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন,–মানে?

মানে তো জলের মতো সোজা।–ভবতারণবাবু হেসে বললেন, আমরা কি কোনওদিন ফিরে যেতে পারি? ছোট থেকে বড়, যুবক থেকে বুড়ো, শুধু এগিয়েই যাচ্ছি। ফেরা আর যায় না। বলুন না, চেষ্টা করলেও কি আপনি ফিরে যেতে পারবেন আপনার ছেলেবেলায়?

সর্বনাশ! লোকটার মাথায় নির্ঘাত ছিট আছে! আগে তো কোনওদিন টের পাননি।

অনাথবাবু মোলায়েম গলায় বললেন,আহা, সে তো অন্য ব্যাপার। সে ফেরা আর এখন আমাদের বাড়ি ফেরা কি এক হল?…চলুন চলুন, বেলা হয়ে যাচ্ছে।

হোক্ বেলা, আমরা আর ফিরছি না।–ভবতারণবাবু বললেন, একবার এগিয়ে এলে আর পিছনে ফেরা যায় না মিত্রমশাই। এখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সামনের পরম সত্যের দিকে। সেই সত্য কী জানেন?

কী?

–মৃত্যু। মৃত্যুই জীবনের পরম সত্য। জন্মিলে মরিতে হবে…আর ফেরার উপায় নেই আপনার। এবার সেই সময় এসে গেছে।

অনাথবাবু চতুর্দিকে তাকালেন। নাহ্, আশপাশে কেউ নেই। সামনে শুধু ভবতারণ গাঙ্গুলি।

ভবতারণবাবু মৃদু মৃদু হাসছেন। কিন্তু ওর চোখদুটো পাল্টে যাচ্ছে কেন? দু-চোখে কেন। হিংস্র দৃষ্টি ভেসে উঠছে? লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে?

প্রবল ভয় এসে চেপে ধরছে অনাথবাবুকে। এই উন্মাদ পাগলটা আজ তাকে মারবে নাকি? কিন্তু কেন? চেঁচিয়েও কাউকে পাওয়া যাবে না। ভবতারণের শরীর স্বাস্থ্যও বেশ মজবুত। একসময় নাকি ব্যায়াম-ট্যায়ামও করত।

তবু সমস্ত সাহস জড় করে ঝাঁঝালো স্বরে অনাথবাবু বললেন, কী হচ্ছে? পাগলামি শুরু করলেন কেন? সরুন। আমি ফিরব।

–উ-হুঁ! ওটি হচ্ছে না। যেতে আপনাকে দেব না। অনেক দিন বেঁচেছেন। এবার পরম সত্যকে বরণ করে নিন।

বলতে-বলতে এগিয়ে এসে তিনি অনাথবাবুর দুকাঁধ চেপে ধরলেন,–বেশ মজায় আছেন, না? দালালি করছেন? পৃথিবীর খবর পাচার করছেন? আপনাকে ছেড়ে দেব?

বোঁ করে মাথা ঘুরে গেল অনাথবাবুর। ভবতারণবাবু নির্ঘাত ছদ্মবেশী শত্রুপক্ষ! ওই আরেকদল ভিনগ্রহীর লোক। ওরাই তো তাকে মারতে চাইছে। হায় হায়, অনিন্দ্যর কথায় কান। না দিয়ে প্রোটেকশন না নিয়ে বেরিয়ে এলেন! এখন?

তাঁর দুকাঁধ ঝাঁকিয়ে ভবতারণ হা-হা করে হাসতে শুরু করেছে, বাছা অনাথ মিত্তির, তোমার নাচনকোঁদন এবার শেষ। কথায় আছে না, পিপীলিকার পাখা ওড়ে মরিবার তরে। বড় ফরফর করছিলে! মালিকদের নানারকম খবরাখবর দিচ্ছিলে! কিনা পৃথিবীর ভালো করবে? হাঃ হাঃ হাঃ! কত আশা! মরবার আগে শুনে রাখো মিত্তির, তোমাদের এই পৃথিবী এখন আমাদের মুঠোয়। তোমরা কোনওদিন খুঁজে বার করতে পারবে না আমাদের। খেয়োখেয়ি করে তোমরা মানুষরা লোপাট হয়ে যাবে, আমরা তখন মানুষ সেজে পৃথিবীর পুরো দখল নিয়ে নেব। এখনই অনেকটা কবজা করে ফেলেছি। কী, বুঝলে কিছু?

অনাথবাবুর দৃষ্টি ঝাপসা। মাথার মধ্যে পাগলা ঘন্টি বাজছে। পরিত্রাণের পথ কোথায়?

ভবতারণ ফের খলখল করে হাসল,বলো, কীভাবে মরতে চাও? যদি নিজে নিজে গঙ্গায় ডুবে যাও, ভালো। আমার আর পরিশ্রম করতে হয় না। নতুবা তোমার গলা টিপে কিংবা চাকু দিয়ে

কখন যে হঠাৎ অনাথবাবুর মাথায় আংটিটার কথা এসে গেছে, আর উনি টিপে দিয়েছেন, নিজেরই খেয়াল নেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উনি কানের কাছে শুনলেন, উঁহু, মগজের মধ্যেই শুনলেন পরিচিত গলা,ভয় নেই অনাথবাবু। এসে গেছি।

আর তারপরেই অবাক হয়ে দেখলেন, ওঁর ডান হাত সপাটে আছড়ে পড়ল ভবতারণের চোয়ালে।

ভবতারণ চারগজ দূরে ছিটকে পড়ল।

এবং বালি ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। তেড়ে এল খ্যাপা মোষের মতো, তবে রে হাড়গিলে বুড়ো! আমায় গায়ের জোর দেখাচ্ছিস?

অনাথবাবু এখন আর পঁয়ষট্টি বছরের মিত্রমশাই নয়! অন্য মানুষ। পলকের মধ্যে তাঁর বাঁ-পা উঠে এল নব্বই ডিগ্রি কোণে, লোহার গদার মতো ঘা মারল ভবতারণের পাঁজরে।

ভবতারণ পাড়ের ঢালু জমি বেয়ে গড়াচ্ছে।

অনাথবাবু নিজেকেই জিগ্যেস করলেন,–এবার কি পালাব?

না–!–মগজের মধ্যেই এল উত্তর, শত্রুকে এভাবে রেখে যাওয়া যাবে না।

অনাথবাবুর এখন কোমরে হাত, শরীর টানটান, চোখে বাজপাখির দৃষ্টি।

ভবতারণ পাড় বেয়ে উঠে আসছে। ওর হাতে চকচক করছে একটা মস্ত ভোজালি।

–এবার? এবার কোথায় যাবি?

ভবতারণের মুখে বিষাক্ত হাসি। ভোজালি নাচাতে নাচাতে এগিয়ে আসছে।

ভবতারণ এগোচ্ছে, অনাথবাবু পিছোচ্ছেন।

সাঁ করে ভোজালিটা একবার ঘুরে গেল তার গলার এক চুল তফাতে! পলকে সরে বাঁচলেন। আবার…আবার..বারবার! এলোপাথাড়ি ভোজালি ঘোরাচ্ছে। অনাথবাবু অদ্ভুত কৌশলে আঘাত এড়াচ্ছেন আর পিছোচ্ছেন।

আজ তোর শেষদিন! তোকে খতম করবই।

করো না! এই যে আমি।

চট করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন অনাথবাবু।

একমুহূর্তের জন্যে বোধহয় অসতর্ক হয়ে পড়েছিল ভবতারণ! অনাথবাবু ডান পা বাড়িয়ে আঁকশি টানলেন ওর পায়ে।

ভবতারণ চিৎ হয়ে উলটে পড়ল।

অনাথবাবু ছুটে গিয়ে চেপে বসলেন ওর ওপরে। ভোজালি কেড়ে নিলেন।

তারপর সম্পূর্ণ অন্যরকম গলায় বললেন, ব্যস! তোর জারিজুরি শেষ। এবার বল তো, তুই কে?

–ভবতারণ গাঙ্গুলি।

–অসম্ভব! ভবতারণবাবু ভালো লোক। সে তোর মতো খুনি নয়।

–যদি না বলি–?

না বললেও কিছু যায় আসে না। এখনই তোর মগজে..দেখবি–দেখবি ঢুকে পড়ব?

 –তু-তুই কে?

 –তোদের যম। আমি একা নই রে শয়তান! লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ছড়িয়ে গেছি।

 –কোটি, কোটি! কী চাস তোরা?

–চাই এই সুন্দর গ্রহটাকে বাঁচাতে! তোদের মতো খুনিদের তাড়াতে।

কী আবদার! ছেলের হাতের মোয়া আর কী। ওনারা বললেন আর আমরা সুড়সুড় করে চলে যাব!

–যেতেই হবে। নয়তো দেখবি…দেখবি..

–একমিনিট! শোন, আমায় কষ্ট দিয়ে তুই বিশেষ কিছু জানতে পারবি না।

দ্যাখ, পারি কিনা।

একটু থাম। আমি সবকিছু সত্যিই বলতে পারব না। তোকে যেতে হবে আমাদের জিরো-এক্স-এর কাছে।

–সে কে?

–আমাদের সবার নেতা। সে আমাদের চালায়।

 –কোথায় থাকে সে?

ভবতারণ ভ্রু কুঁচকে একটু চিন্তা করল। তারপর বলল,–এখন সে হিমালয়ে।

–হিমালয়ের কোথায়?

–ওই গঙ্গোত্রী, তপোবন পেরিয়ে একটা গুহায়।

–আমায় নিয়ে চ। শোন, জেনে রাখ, তোদের চেয়ে আমরা বিজ্ঞানে কয়েক হাজার বছর এগিয়ে আছি। তোরা পারবি না। শুধু শুধু মরবি। কখন যাবি?

কাল।

অনাথবাবু ভোজালিটা নিয়ে শূন্যে পাক মেরে ছুঁড়ে দিলেন গঙ্গার দিকে। বহুদূরে জলের মধ্যে একটা শব্দ উঠল।

তারপর ভবতারণ গাঙ্গুলিকে বললেন,–চল, যে যার বাড়ি ফিরি। তবে খবরদার! আজকের এই ঘটনা যেন তোদেরও কেউ না জানে।

বাড়ির দরজায় এসে কলিংবেল টিপলেন অনাথবাবু। তখনই মগজের মধ্যে বেজে উঠল চেনা স্বর,–চললাম অনাথবাবু। আপনাকে থ্যাঙ্কিউ!

কে যে কাকে ধন্যবাদ দিল!

.

০৭.

গতকাল সন্ধের পর থেকে আবার সারারাত তুষারপাত হয়েছে। আজ সকালে আকাশ পরিষ্কার। হতেই দিগদিগন্ত কাঁচা সোনার মতো ঝলসে উঠেছে। যেদিকে তাকাও, শুধু বরফ আর বরফ।

জনহীন হিমালয় শরীরে তুষার মেখে দাঁড়িয়ে আছে।

সামনের চাতালে দাঁড়ালে নীচে চোখে পড়ে তপোবন। হিমালয় প্রেমীদের প্রিয় জায়গা। গ্রীষ্মকালে গঙ্গোত্রী, গোমুখ পেরিয়ে দলে দলে পায়ে হেঁটে আসেন। তপোবনের রূপ উপভোগ করতে। এখন অবশ্য কেউ নেই, থাকার কথাও নয়।

নেই হিমালয়ের বাসিন্দা গাড়োয়ালি মানুষজনও। প্রতি বছরের মতো তারাও নেমে গেছে। সমতলে।

শুধু কিছু সাধুসন্ত থেকে গেছেন। লোকে বলে, এঁরা মানসিক শক্তিতে বলীয়ান সিদ্ধপুরুষ। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা কোনওকিছুই এঁদের কাবু করতে পারে না। হিমালয়ের এই নিভৃত নির্জনে ওঁরা ডুবে থাকেন কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তির খোঁজে।

সাটুয়াবাবা এমনই এক সিদ্ধপুরুষ। তপোবন থেকে কিছুটা উঠে এই পাহাড়ের গুহাতেই তাঁর বাস। লোকে বলে সাটুয়াবাবার আশ্রম।

কোনও চেলাচামুণ্ড নেই। সম্পূর্ণ একাই থাকেন বাবা। কী খান, কোত্থেকে পান, কেউ জানে না। তবে কখনও কোনও ট্যুরিস্ট এলে সাটুয়াবাবা তাঁদের যত্ন করে থাকতে দেন, খেতে দেন। বিনিময়ে কিছুই নেন না।

শীত-গ্রীষ্ম সবসময় সাটুয়াবাবার একই পোশাক। খেটো ধুতি, উপরে একটা জোব্বা গোছের গেরুয়া আলখাল্লা।

প্রতিদিনকার মতো আজ সকালেও সাটুয়াবাবা গুহা থেকে বেরিয়ে বাইরের চাতালে এসে দাঁড়ালেন। আজ আকাশ চকচকে নীল, ঝলমলে রোদ। মনও বেশ প্রফুল্ল সাটুয়াবাবার। মনে হচ্ছে, সিদ্ধিলাভ হতে আর বেশি দেরি নেই।

অপরূপ সুন্দর নিসর্গের দিকে চুপচাপ চেয়ে রইলেন সাটুয়াবাবা। কিছুক্ষণ। মুগ্ধকণ্ঠে বললেন,আঃ, কত সুন্দর এই পৃথিবী!

ঢুকে গেলেন গুহার ভিতরে।

ভিতরটা আধো অন্ধকার। এককোণে ছোট্ট অগ্নিকুণ্ড। ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। একখণ্ড হরিণের চামড়া। তার উপর বসলেন।

এবার শুরু করতে হবে সাধনা।

চোখ বুজলেন সাটুয়াবাবা। মনের সব শক্তি একজায়গায় আনতে শুরু করলেন। সব তরঙ্গ একত্রিত হও, পাঠাও সংকেত!

হে আমার শিষ্যগণ…সময় সমাগত…এই পৃথিবীর সর্বত্রগামী…

 নাহ্! হচ্ছে না তো! সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

সাটুয়াবাবার চিবুক শক্ত হয়ে উঠল। আবার চোখ বুজে মনকে একাগ্র করলেন। মগজকে উদ্দীপ্ত করতে চাইলেন, সব শক্তি একত্রিত হও!

যাঃ! আজ হচ্ছেটা কী? আবার ছিঁড়ে গেল সমস্ত তরঙ্গজাল!

সাটুয়াবাবা উঠে দাঁড়ালেন। গুহার কোণে একটা থলি। থলি থেকে ছোট্ট একটা শিশি বার করলেন। হাঁ করে দু ফোঁটা তরল ঢাললেন গলায়।

মুহূর্তে মস্তিষ্ক সতেজ, সক্রিয়। বাবা আবার বসে পড়লেন। এখনই ধ্যান শুরু করতে হবে।

চোখ বুজে সর্বশক্তি দিয়ে মনকে বাঁধতে শুরু করেছেন–যা! ছিঁড়ে গেল।

মগজের মধ্যে কে যেন ফিক করে হেসে উঠল–উঁহু বাবা। আর পারবে না। মনের বারোটা বেজে গেছে।

কে–কে? কে বলল কথাটা?

সাটুয়াবাবা চোখ খুলে উদভ্রান্তের মতো চারিদিকে তাকালেন। কেউ কোথাও নেই।

ব্যাপারটা তো ঠিক বোধ হচ্ছে না। মগজের তরঙ্গের মধ্যে এ আবার কী উৎপাত শুরু হল? কেউ ট্যাপ করছে নাকি?

কাছেপিঠে কোনও অশুভ শক্তি ঘাঁটি গেড়েছে? ওঁর এতদিনের সাধনা নষ্ট করে দিতে চায়?

এরকম অদ্ভুত অভিজ্ঞতা কোনওদিন হয়নি সাটুয়াবাবার। ওঁর পরিপক্ক বুদ্ধি বলে উঠল, পালাও! এখনি এখান থেকে পালাও! অন্য কোথাও চলে যাও।

বাবা দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। একটুও দেরি করা যাবে না! ঘরের কোণ থেকে থলিটা কাঁধে ফেলে গুহা দিয়ে বেরোতে গেলেন।

পারলেন না। অদৃশ্য কোনও দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিৎপাত হয়ে গেলেন মেঝেতে।

ভিতর থেকে কে যেন খিকখিক করে হেসে উঠল,–পারলে না! আর পারবে না বাপু! এখন পড়ে থাকো, অপেক্ষা করো।

সাটুয়াবাবা ওই অবস্থায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। মস্তিষ্ক অসাড়। কেউ যেন ভিতর থেকে সব তথ্য শুযে নিয়েছে।

.

সক্কাল-সক্কাল বাড়ি ফিরে লুচি-আলুরদম খেয়ে সেই যে বিছানায় শুয়ে পড়েছেন অনাথবাবু, আর ওঠেননি। শরীর শক্তিহীন, হাড়গোড় অব্দি ঝনঝনে ব্যথা।

স্ত্রী মেয়ে জামাই উদ্বিগ্ন হয়ে বারকয়েক ঘুরে গেছে। জামাই ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছিল, অনাথবাবু জোর করে থামিয়েছেন। বলেছেন, কিচ্ছু হয়নি। আজ একটু বেশি হাঁটাহাঁটি হয়ে গেছে। রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সবচেয়ে মুশকিল হয়েছে আদরের নাতি বন্দিতর। দাদুনের সঙ্গে স্কুলে যাবার আগে পর্যন্ত মজার মজার গপ্পোগুজব, পাজগেম চলে। বেচারি সকাল থেকে বারকয়েক ঘুরে গেছে,দাদুন! ও দাদুন!

–বলো।

তবিয়ৎ ঠিক হ্যায় তো দাদুন? আচ্ছেসে আরাম করো। বিকেলে কিন্তু ঘুমতে বেরোতে হবে।

–দেখি।

 –দেখি-টেখি না, পুরা পাক্কা! ওয়াদা করো।

 –আচ্ছা, আচ্ছা রে। তবিয়ৎ ঠিক থাকলে জরুর যাব। তুই এখন স্কুলে যা। বাবা অফিস গেছে?

হ্যাঁ।

বন্দিত মাথা-টাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। অনাথবাবু এলিয়ে রইলেন বিছানায়।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন জানেন না। মেয়ের ডাকে তন্দ্রা ভেঙে গেল।

বাবা, বাবা!

 –অ্যাঁ…হ্যাঁ!

 –শরীর ঠিক আছে তো বাবা?

 –হ্যাঁ, এখন অনেকটা ভালো।

জানো বাবা, এদিকে এক কাণ্ড হয়েছে। মানবদার বাবা ভবতারণবাবুকে চেনো তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ। অবশ্যই। উত্তেজনায় ধড়ফড় করে উঠে বসলেন অনাথবাবু, কেন? তার আবার কী হল? আজ সকালেই তো মর্নিং ওয়াক করে একসঙ্গে ফিরলাম।

ভাবতেই অনাথবাবুর শরীর আবার শিউরে উঠল। বাস্য! কী সব ঘটল! এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

মেয়ে বলল, হ্যাঁ। ওরাও তাই বলল। তোমরা নাকি একসঙ্গেই ফিরেছ। অদ্ভুত ব্যাপার, বাড়ি ফিরে উনিও নাকি শুয়ে পড়েছিলেন। শরীর খারাপ লাগছিল। আধঘণ্টা আগে বউদি খোঁজ করতে গিয়ে দেখে, শ্বশুরমশাই নেই!

–নেই! মানে?

মানে বাড়িতে নেই! চারিদিকে খোঁজ খোঁজ, আমাদের বাড়িও ছুটে এসেছিল। তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে। তাই ডাকিনি। মানবদা অফিস থেকে ছুটে এসেছে, এখন থানা পুলিশ হচ্ছে!

–বলিস কী! জলজ্যান্ত লোকটা নিখোঁজ?

–সেটাই তো! তুমি কিছু বলতে পারো? মানে সকালে তোমায় কিছু বলেছিলেন উনি?

নাঃ! বরঞ্চ কাল সকালে আবার দেখা হবে, কথা হল।

অনাথবাবু একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বলছেন। কিন্তু মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে। সর্বনাশ! খুনি ভবতারণ পালিয়ে গেল! প্রতিশোধ নেবে! অনিন্দ্যরা ধরতে পারবে না ওকে?

মেয়ে আরও বলে যাচ্ছিল! অনাথবাবু সাড়া দিচ্ছেন না বুঝে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, বাবা! ও বাবা!

–উঁ। বল।

ভাবছটা কী?

ভাবছি, কোথায় যেতে পারে বুড়ো মানুষটা।–অনাথবাবু নিজেকে নিয়ে চিন্তার ভাব ফুটিয়ে বললেন, ছেলে-বউ বাবাকে যত্নআত্তি করত তো?

হ্যাঁরে বাবা। দেখি, তোমার জামাইকে অফিসে একটা ফোন করে আসি। হাজার হোক, ওর বন্ধুর বাবা।…অনেক বেলা হয়েছে! বাবা, চান করে নাও।

মেয়ে বেরিয়েছে। অমনি পিঁপ…পিপ…পিপ…!

অনাথবাবুর গায়ে কাঁটা ফুটল। মনে হয়, অনিন্দ্যরা খবর পেয়ে গেছে। উনি আংটির বোতাম টিপলেন। সেই চেনা মিহি গলা–টিভি খুলুন।

টিভির সুইচ অন করলেন। অনিন্দ্য ফুটে উঠল স্ক্রিনে।

খবর পেয়ে গেছি অনাথবাবু! ভবতারণ পালাতে পারবে না। পৃথিবীতে আমরা পুরো ফোর্স নামিয়ে দিয়েছি।

যাক্। নিশিন্ত হলাম।

–শুধু তাই নয় অনাথবাবু, ওদের জিরো-এক্সকেও কবজায় নিয়ে ফেলেছি। নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছি। ও হচ্ছে ওদের সেন্ট্রাল মনিটর। ওর নিদের্শ ছাড়া ওরা অচল। বুঝলেন?

–একটু-একটু।

–ভবতারণ পালিয়ে গিয়ে আমাদের সুবিধে হয়েছে। ওকে ফলো করে আমরা বাকিদের কাছে পরপর পৌঁছে যাব। একদম চিন্তা করবেন না। আর আজ রাতে তৈরি থাকবেন।

আজ! কেন?

 বাঃ, যেতে হবে না? এরমধ্যে ভুলে গেলেন?

 –সে তো কালকে।

উঁহু। আজকেই যা করার করতে হবে। দেরি করা যাবে না।

–কিন্তু এখানে? আমার ফ্যামিলিকে কী বলব? যাব কীভাবে? হিমালয় তো অনেক দূরের পথ।

–আপনি মাঝে-মাঝে বড্ড বোকার মতো কথা বলেন অনাথবাবু। আরে আপনি কি মানুষের মতো যাবেন নাকি? আমাদের পদ্ধতিতে যাবেন। বাড়িতে কিছু বলতে হবে না। ওরা সকলে রাতে অঘোরে ঘুমোবে। কেমন?…

–ঠিক আছে।

 –আপনার মেয়ে আসছে।… চলি।…

সুইচ অফ করে দিলেন অনাথবাবু। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মেয়ে ঢুকে পড়ল। বলল, বাবা, তোমার জামাইও অফিসের জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। স্টেশন, থানা, হাসপাতাল সব জায়গায় খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নো ট্রেস! অনেকেই ভবতারণবাবুকে চেনে, অথচ কেউ নাকি দেখেনি।

.

০৮.

পিপি..পিপ…পি্প…পিপ-পিপ…পি্প.পিপ…।

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন অনাথবাবু। কাঁচাঘুম ভাঙা চোখে অন্ধকারে হাতড়ালেন এদিক ওদিক। তারপর বেডসুইচ টিপলেন। অ্যালার্ম ঘড়িটা কোথায়?

ওই তো ড্রেসিং টেবিলের ওপর। বোতাম নীচে নামানো। তার মানে ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া নেই।

কিন্তু তীব্র শব্দটা সমানে বেজেই চলেছে–পিপিপ পিঁপ…।

এ কী! শব্দটা বাজছে নিজের মগজের মধ্যে! যেই না ভাবা, অমনি শব্দ থেমে গেল। শোনা গেল চেনা কণ্ঠস্বর,–অনাথবাবু। সময় হয়ে গেছে। রেডি হয়ে নিন।

শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে রাত সাড়ে নটার মধ্যে রুটি-দুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন অনাথবাবু। সেই পার্শিবাগানে জলঝড়ের সন্ধে থেকে শুরু করে ভবতারণ পর্ব পর্যন্ত অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো মনের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে আসছিল। একসময় ঘুমিয়ে পড়েছেন!

খাটের একপাশে স্ত্রী অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। গোটা বাড়ি নিঃশব্দ, সবাই ঘুমে অচেতন। শুধু অনাথবাবুকেই এখন বেরোতে হবে ওদের সঙ্গে।

গা ছমছম ভাব ঝেড়ে ফেলে অনাথবাবু বাথরুমে গেলেন। চোখেমুখে জল দিলেন, তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছলেন। এসে দাঁড়ালেন আয়নার সামনে।

ঠিক তখনই অনিন্দ্যর গলা–এসে গেছি। ভয় পাবেন না অনাথবাবু। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আপনি হয়ে যাবেন আমাদের মতো।

অনাথবাবু বিহ্বল চোখে দেখলেন, ওঁর প্রতিবিম্ব দ্রুত মুছে যাচ্ছে আয়না থেকে!

আয়নার সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন না। কোনও ছায়া পড়ছে না আয়নায়।

তবে? তবে কি এখন উনি ভূত? শুনেছেন, সূক্ষ্মদেহী অপদেবতাদেরও নাকি ছায়া পড়ে না!

মগজের মধ্যে অনিন্দ্য বলে উঠল,–আজেবাজে কথা ভাববেন না অনাথবাবু। ভূতটুত অল বোগাস। আপনার যেটা হয়েছে, সেটা সায়েন্স। আপনার গোটা শরীরকে অণু পরমাণুতে বিভাজিত করা হয়েছে। সেই পার্টিকলগুলো চেঞ্জ হয়েছে এনার্জিতে। ম্যাটার থেকে যে এনার্জিতে ট্রান্সফরম্ হয়, সে কথা তো এখন আপনাদের সায়েন্স আবিষ্কার করে ফেলেছে। আপনি এখন আর ম্যাটার নন। এনার্জি। বুঝলেন?

ম্যাটার…! এনার্জি!…আর সায়েন্স! অনাথবাবুর বোধবুদ্ধি কাজ করছে না। কোনওক্রমে উনি বললেন বা ভাবলেন,–এ-এখন কী করব?

কী করবেন? স্রেফ ভাবুন।

কী ভাবব?

–ভাবুন, কোথায় যেতে চান। আপনি জানেন, আমাদের এখন যেতে হবে জিরো-এক্স এর ডেরায়।

-ম-মানে হিমালয়ের তপোবন? গোমুখ পেরিয়ে?

 –ঠিক।

অনাথবাবু মন একাগ্র করে ভাবলেন,তপোবন।

এক সেকেন্ড! অবাক হয়ে দেখলেন, কোথায় কানপুরের মেয়ের বাড়ি! তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পার্বত্য উপত্যকায়। চারিদিকে আকাশছোঁয়া হিমালয় আলোকিত জ্যোৎস্নায় তরল রুপো গলে গলে পড়েছে বরফঢাকা শিখরদের গা বেয়ে। অপূর্ব!

এ দৃশ্য কোনও সশরীর মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়! উনি স্বর্গরাজ্যে পৌঁছে গেলেন?

–এসব বাড়ি ফিরে ভাববেন অনাথবাবু। এখন চলুন। সময় কম।

 –কোথায়?

–ওই যে ওখানে।

অনিন্দ্য ইশারা করতেই অনাথবাবু নিমেষে পৌঁছে গেলেন আরও অনেকটা ওপরে। এক বিশাল গুহার সামনের চাতাল।

ভিতরে আসুন।

সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই গুহার ভিতরে।

কয়েক সেকেন্ড লাগল চোখ সইয়ে নিতে। তারপরেই অনাথবাবু থরথর করে কেঁপে গেলেন।

প্রশস্ত গুহা। মিটমিটে আলো। এককোণে একটা তেলের কুপি জ্বলছে। তার পাশে পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে একজন মানুষ। লম্বা দাড়ি গোঁফ, সুপুরুষ চেহারা। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক হল–হ্যাঁ, ওর চক্ষুদুটি। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে, কিন্তু চোখ দুটো যেন ধকধক করে জ্বলছে। রক্তহিম করা দৃষ্টি।

অনিন্দ্যর ফিসফিস,–আমরা আবার শরীরে ফিরছি অনাথবাবু।

 তারপরেই ওর গলা গমগম করে উঠল,নমস্কার সাটুয়াবাবা। প্রণাম হই।

লোকটি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল,–কে? কে তোমরা?

আমরা আপনার শিষ্য প্রভু।

–মিথ্যে কথা!

ছুটে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল, কারা তোমরা? কোনও মানুষ এসময়ে এখানে আসতে পারে না। সত্যি বলো।

সত্যি বলছি প্রভু। আমরা আপনাকে বাঁচাতে এসেছি। প্রভু, খামোকা রাগ করছেন। কেন? আপনিও তো পৃথিবীর মানুষ নন।

ক-কী! আমি মানুষ নই?

উত্তেজিত হয়েই পরক্ষণে মিইয়ে গেল সাটুয়াবাবা। তীব্র দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করল ওদের দুজনকে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল,বুঝেছি। তোমরাই তাহলে তারা। বলো, কেন এসেছ? কী চাও?

–চাই, তোমরা এ গ্রহ ছেড়ে চলে যাও।

চলে যাব! তাতে তোমাদের লাভ?

–এখানে লাভ-লোকসানের প্রশ্ন নেই। আমরা চাই, এমন সুন্দর গ্রহ পৃথিবী যেন এমন সুন্দরই থাকে।

সুন্দরই তো আছে। থাকবেও। তাতে আমাদের চলে যেতে হবে কেন?

না। তোমরা থাকলে পৃথিবী সুন্দর থাকবে না। তোমরা শেষ করে দিচ্ছ মানুষের সভ্যতাকে। মানুষের মধ্যে রাগ-হিংসা বাড়াচ্ছ। খুনোখুনি করেই পৃথিবীর মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে।

গেলে যাবে। সাটুয়াবাবা নির্লিপ্তভাবে বলল, তখন আমরাই পৃথিবীর দখল নেব। এ জন্যেই তো আমরা এসেছি। চলে যাব বলে তো আসিনি।

একটু থেমে বলল, তোমরা আমায় মেরে ফেলতে পার। কিন্তু তাতে কিছু লাভ হবে না।

আমরা ছড়িয়ে পড়েছি পৃথিবীর সর্বত্র। ঢুকে পড়েছি এখানকার বাসিন্দা মানুষের মধ্যে। আমি না থাকলেও বাকিরা সবাই সবার কাজ করে যাবে।

–আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা কোরো না! আমার পাশে যাকে দেখছ, সে পৃথিবীরই মানুষ। পৃথিবীতে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। এর মাধ্যমেই আমরা

কথা শেষ হয় না অনিন্দ্যর, সাটুয়াবাবা কিংবা জিরো-এক্স চকিতে তার জোব্বা থেকে টেনে বের করেছে এক অদ্ভুত অস্ত্র। সোজা অনাথবাবুর দিকে নিশানা করে বলে উঠল,–চমৎকার! এটাকেই এতদিন খুঁজছি!

গলগল করে আগুনের গোলা ছুটে এল অনাথবাবুর দিকে। কিন্তু অনাথবাবুর শরীর ছোঁয়ার আগেই অদৃশ্য প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে নিভে গেল।

হাঃ হাঃ! অনিন্দ্য হেসে উঠল, তুমি রাগে পাগল হয়ে গেছ! ঠান্ডা হয়ে আমার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করো। এই যে অনাথবাবু–মানুষ, তুমি এর কিছুই করতে পারবে না। আমরা একে দিয়েই তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেব।

–আমাদের খুঁজে পাবে কী করে?

–ফের বোকার মতো কথা বলছ। তুমি তো জানো, তোমার মস্তিষ্কের সবটা আমরা। দখলে নিয়েছি। ওর মধ্যে জমা আছে তোমাদের সকলের সুলুক সন্ধান।

একটু থিতিয়ে গেল জিরো-এক্স। তারপর সুর পালটে বলে,–একটা কথা বলব?

বলো।

 এসো না, আমরা দুইপক্ষ এই গ্রহটার দখল নিই!

অনিন্দ্য ফের হেসে উঠল,–তোমরা সত্যিই বোকা। এতক্ষণ কথা বলেও বুঝলে না, দখলদারি-শাসন এসব আমাদের ডিকশনারিতে নেই। আমরা মনের আনন্দে এই ব্রহ্মাণ্ডে ঘুরে। বেড়াই, খুঁজে বেড়াই প্রাণ। সাহায্য করি প্রাণের বিকাশে। তোমাদের এসব বলা অবশ্য নিরর্থক। কারণ, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, তোমাদের মধ্যে আনন্দ-খুশি-ভালোবাসা-মায়া এসব কোত্থাও কিচ্ছু নেই। পুরোটাই তোমাদের হিংসা দিয়ে গড়া।…যাগ্যে, বলো তো, কী চাও? আমরা অকারণে হত্যা চাই না। তোমাদের সুযোগ দিচ্ছি। পৃথিবী ছেড়ে তোমরা চলে যাও।

গুম্ মেরে খানিকক্ষণ বসে রইল সাটুয়াবাবা। দু-চোখের অগ্নিদৃষ্টি ঘোলাটে।

তারপর বলল, ঠিক আছে। আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। তবে যেতে হবে তোমাদেরও।

সিওর! আগেই যাচ্ছিলাম। তোমাদের কথা জানতে পেরে এতদিন থাকতে হল।

–আর একটা কথা।সাটুয়াবাবা বলল, আমাদের চলে যাওয়ার জন্যে একটু সময় দিতে হবে।

–কেন?

–আমরা এরমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছি পৃথিবীতে। দেশে-দেশে, হাজার-হাজার মানুষের মধ্যে। তার মধ্যে রয়েছে মন্ত্রী-নেতা-আর্মি-পুলিশ, এমনকী উঁচুপদের অফিসার। সবাই এখনই চলে গেলে তো কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে।

অনিন্দ্য একটু ভাবল। তারপর বলল,–বেশতবে ততদিন আমরাও থাকব। তুমিও থাকবে আমাদের মুঠোয়।

–কেন? তোমরা কি এটুকুও বিশ্বাস করছ না?

বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নেই। এটা চুক্তি। আমরা একসঙ্গে পৃথিবী থেকে বিদায় নেব।

 মাথা নীচু করে বসে থাকল সাটুয়াবাবা।

অনিন্দ্য বলল,–আসুন অনাথবাবু। আমাদের কাজ শেষ।…ওর হয়ে আমরাই নির্দেশ দেব ওর চেলাদের। কিচ্ছু ভাববেন না।

অনিন্দ্যর পিছন পিছন বেরিয়ে এলেন অনাথবাবু। আঃ! কী শান্তি।

অন্ধকার ক্রমেই পাতলা হয়ে আসছে। পুবের আকাশে আবছা গোলাপি ছোপ। পশ্চিম দিকে এখনও জ্যোত্সার ঢল। অলৌকিক অপার্থিব হিমালয়।

–চলুন অনাথবাবু, এবার বাড়ি ফেরা যাক।

অনাথবাবু কানপুরের বাড়ির কথা ভাবলেন।

অমনি চোখ মেলে দেখলেন, উনি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

 হ্যাঁ, এবার নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন আয়নায়।

 টলতে টলতে গিয়ে শুয়ে পড়লেন ঘুমন্ত স্ত্রীর পাশে।

.

ঘুম ভাঙল বন্দিতর ডাকে,দাদুন, দাদুন! ওঠো! ভবদাদুকে নিয়ে একটু পরেই ওরা নিকাল যাবে। তুমি একবার দেখতে যাবে না?

অনাথবাবু দেখলেন, মেয়েও সামনে দাঁড়িয়ে। থমথমে মুখ। বলল,–গতকাল রাতে ভবতারণবাবুর ডেডবড়ি পাওয়া গেছে গঙ্গার ধারে শ্মশানের পাশে।

সে কী! কী বলছিস রে।–উঠে বসলেন অনাথবাবু। মনে-মনে অবশ্য বিড়বিড় করলেন, একটু হলে তোর বাবারও এই দশা হত রে। তোরা বুঝতেও পারতিস না।

হ্যাঁ বাবা। দিব্যি সুস্থ মানুষ, হঠাৎ কিডন্যাপড…মৃত্যু অবশ্য হার্ট অ্যাটাক…পুলিশ কিছু বুঝতেই পারছে না।

তাই তো রে! কী যে হয়ে গেল, বোঝাই গেল না।–অনাথবাবু মুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে বললেন, সজ্জন, অমায়িক মানুষ। কোনও শত্রু-টঞ আছে বলেও তো শুনিনি।…দাদুভাই! আমি আর ও দৃশ্য দেখতে যাব না। তুমি বলে দাও, দাদুর দেখতে কষ্ট হবে।

হোঁ-ওঁ করে নটার সাইরেন বেজে উঠল। মেয়ে-নাতি চলে গেল। অনাথবাবু উঠে পড়লেন।

ব্রাশ করতে করতে টিভি চালিয়ে দিলেন। সকাল নটায় বিশেষ ওয়ার্ল্ড নিউজ পড়ে।

 টিভি খুলতেই হেডলাইন নিউজ

গতকাল রাত তিনটে তিরিশ মিনিটে আলবানিয়ার প্রেসিডেন্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন।…ফিলিপিনসে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রধান উগ্রপন্থী নেতা নিহত।… রাশিয়ায় অভ্যুত্থান ব্যর্থ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। এটুকু শুনেই বাথরুমে ঢুকে গেলেন অনাথবাবু। অনেকখানি নিশ্চিন্ত বোধ হচ্ছে। কাজ শুরু হয়ে গেছে। পৃথিবীর আবর্জনা এবার সাফ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *