৪. ডিনার পার্টি

১৬.

ডিনার পার্টি থেকে বেরিয়ে রবিন গাড়িতে উঠতে যাবে হঠাৎ অফিস নাম্বার থেকে ফোন। রবিন আমেরিকার সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স।

লিমুজিনে উঠে বসে ফোনটা ধরল রবিন।

–বলো শেরী। এত রাতে! জরুরি কোনও দরকার আছে?

–খুব ভালো হয় যদি আপনি একবার অফিসে চলে আসেন–একটা জরুরি খবর আছে। বলব?

–আমি গাড়িতে আছি। বলতে পারো।

ল্যাংলে রিসার্চ সেন্টার থেকে IRVE-12 স্পেসক্র্যাক্ট ছাড়ার কথা ছিল। ওটা সাকসেসফুলি লঞ্চ হয়েছে।

এই কথা শোনানোর জন্য জরুরি ফোন? প্রতিমাসে এরকম পাঁচটা ভেহিকল ছাড়া হয়। আর সাম্প্রতিককালে লঞ্চ ফেলিওর হয়েছে এরকম ঘটনাও খুব কম। তবু প্রচণ্ড বিরক্তিটা কথায় প্রকাশ না করে রবিন বলে ওঠেন, পরমাণু বোমা-টোমা লাগানো নেই তো?

–না, না, সেরকম কিছু নয়। এটা হল ইনফ্ল্যাটেবল রি-এন্ট্রি ভেহিকল এক্সপেরিমেন্টের অংশ। অনেক বড় বড় যন্ত্রপাতি এতে করে মহাকাশে পাঠানো যেতে পারে। ম্যাক 20 স্পিডে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পরও পুড়ে যায় না, গরম হয় না।

একে তো প্রচুর ওয়াইন পার্টিতে খাওয়া হয়ে গেছে–তারপর এসব জটিল জটিল শব্দ– মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিল রবিনের। বললেন,–তা খুব ভালো। কিন্তু অসুবিধেটা কোথায়?

–এটা ছমাস পরে লঞ্চ হওয়ার কথা ছিল। আজকে লঞ্চ হয়ে গেছে। সাকসেসফুল যদিও।

–বাহ, খুব ভালো খবর। মিশনের সঙ্গে যারা ছিল তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে, নামগুলো কাল পাঠিয়ে দিও। আর কিছু?

–এ মিশনটা নাসার কন্ট্রোলে ছিল না।

–মানে? ল্যাংলে রিসার্চ সেন্টার তো নাসারই আন্ডারে। কী বলছ?

–চারদিন আগে দুজন ছেলে রিসার্চ সেন্টার অ্যাটাক করে এ মিশনের পুরো কন্ট্রোল নিয়ে নিয়েছিল।

–দুজন? নাসার মতো সিকিউরিটি ভেঙে! বলো কি!

–হ্যাঁ, সেজন্যই তো ফোন করছি। আপনি যদি অফিসে আসেন–! ইনফ্যাক্ট বাকি যে কাজ ছিল তা ওরা দুজনে দুদিনেই শেষ করে দেয়। পুরো প্রোগ্রামের কন্ট্রোল নিয়ে নেয়। সেন্টারের ম্যানেজমেন্টের সিনিয়ার লোকেদের হোস্টেজ করে নেয়। একটা আলাদা বিল্ডিং-এ। বন্দি করে রাখে।

–ওরা কতজন ছিল যেন?

দুজন। আগেই তো বললাম।

-বলো কী! শুধু দুজনে? ওখানকার সিকিউরিটি কি করছিল? ঘুমোচ্ছিল? কতজন সিকিউরিটি ছিল ওখানে?

দু-হাজার চারশো। আমাদের দেশের সেরা সিকিউরিটি। নাসার সিনিয়ার ম্যানেজমেন্টকে হোস্টেজ করার সময় ওদের সঙ্গে ছেলেদুটোর সংঘর্ষ হয়। চল্লিশ জন আহত হয়েছে। দুজন মারা গেছে।

বলো কী! এজন্যই অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধটুদ্ধ মাঝেমধ্যে দরকার। বসে বসে আর খেয়ে খেয়ে সিকিউরিটিগুলো নড়তে চড়তে ভুলে গেছে। যে কটা বেঁচে আছে সবকটাকে ডিসমিস করব।

–ছেলেদুটো নাকি খুব সাধারণ ছিল না। অ্যালিয়েনও হতে পারে।

–কেন অ্যালিয়েন হবে কেন? চারটে মাথা, আটটা পা ছিল নাকি? কীরকম দেখতে ছিল?

না, না, সেরকম কিছু নয়। একদম আমাদের মতো, খুব সুন্দর দেখতে। নীল চোখ, আঁকড়া সোনালি চুল। নাক-মুখ শার্প। দেখলেই গ্রিক দেবতাদের কথা মনে পড়ে যায়।

–তুমি কাদের দলে শেরী? ওদের দলে নয় তো? এত প্রশংসা করছ! মেয়েদের নিয়ে এই সমস্যা। নীল চোখ হোক, লাল চোখ হোক, তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমার প্রশ্ন, দুজন মিলে এত হাই সিকিউরিটি এরিয়াতে ঢুকে এতগুলো লোককে ভেড়া বানিয়ে কন্ট্রোলটা নিল কী করে?

–ছেলে দুটো নাকি চিতাবাঘের থেকেও জোরে দৌড়োয়। গায়ে অমানুষিক জোর। যে দুজন সিকিউরিটি মারা গেছে, তাদের একজন তো মারা গেছে স্রেফ একটা ঘুষি খেয়ে। যে কোনও কিছু বেয়ে বাঁদরের মতো উঠে যেতে পারে ওরা।

–তা তারা আছে কোথায় এখন? চিড়িয়াখানায়? আর এত যে কথা বলছ,–ওদের স্পেকস-পার্সন হয়ে যাওনি তো?

না, না স্যার। ওরা চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে যে এটা নাকি ওদের টেস্ট ছিল। রেজাল্ট অবশ্য জানে না। ফেল করলে আবার এরকম কোনও একটা হাই সিকিউরিটি সেন্টারের কন্ট্রোল নিতে হবে।

বলো কী? এরকম কোনও টেররিজমের কোর্স কোনও ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হচ্ছে না তো! তা নাসার কর্তাব্যক্তিরা করছেনটা কী? আমাকে কনফারেন্স করো তো ওখানকার ডিরেক্টারের সঙ্গে।

না, উনি এখন কথা বলবেন না।

–কেন? অভিমান করেছেন না কি?

না স্যার, ওদের মধ্যে একটা ছেলে যাওয়ার সময় ওনার গোঁফটা টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে। বলেছে প্রুফ দিতে হবে।

–মাই গড!

ভাবুন! অত সাধের গোঁফ ডঃ ফ্রেডরিক পাফের। তারপর থেকে কথাই বলছেন না।

ফোনটা ছেড়ে গাড়ি থেকেই আরেকটা ফোন করলেন রবিন। CIA-র ডিরেক্টর রবার্টকে।

রবার্ট, তুমি সেদিন কি একটা প্রোজেক্টের কথা বলছিলে না? ইনহিউম্যান লোক তৈরির। কী নাম যেন–প্রোজেক্ট এইচ।

–ইনহিউম্যান নয়, সুপার হিউম্যান বা অতিমানব তৈরির প্রোজেক্ট। অসাধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন লোক তৈরির।

কী স্ট্যাটাসে ছিল যেন প্রোজেক্টটা?

 –শুনেছিলাম শেষের দিকে। ফাইনাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

–কে দেখছে প্রোজেক্টটা?

–সেটাই তো জানি না। সেজন্যই তো ফোন করেছিলাম আপনাকে। আপনার কাছ থেকে যদি কিছু জানা যায়।

–শোনো, একটা ঘটনা ঘটেছে। আমার ধারণা ওটা এই পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত। আমি আধঘণ্টা পরে ভিডিয়ো কনফারেন্স রাখছি। ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রোজেক্ট এজেন্সির হেড ডঃ কেভিনকেও ডেকে নিচ্ছি। এই প্রোজেক্টটা আমাদের ইমিডিয়েটলি বন্ধ করার দরকার। জানা দরকার যে কে আসলে এটা নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা তিনজনেই যদি না জানি, তাহলে আর কে জানবে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট?

.

১৭.

লাস ভেগাস আর নাসার ল্যাংলে রিসার্চ সেন্টারের ঘটনা দুটোর ভিডিয়ো ফুটেজ বেশ কয়েকবার দেখলেন রবিন। সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স রবিনের সন্দেহ নেই যে দুটোই সাধারণ মানুষের কাজ নয়। বিদ্যুৎবেগে এরা যাতায়াত করে। খালি হাতে কংক্রিটের দেওয়াল ভেঙে ফেলে। নির্ভুল লক্ষ্যে পরের পর গুলি চালিয়ে যেতে পারে। এক লাফে পঞ্চাশ ফুট পেরিয়ে যায়। খুব চটপট ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে।

ওনার সঙ্গে আজ মিটিং-এ আছেন সিআইএ-র ডিরেক্টর রবার্ট।

–তা আপনার কাছে যা খবর তাতে এসব পরীক্ষা চলছে প্রোজেক্ট এইচ-এর অংশ হিসেবে?

–হ্যাঁ, শুধু এই নয়, কয়েকদিন আগে আমেরিকায় যে পাওয়ার গ্রিড ফেলিওর হয়েছিল, সেটাও নাকি ওরাই ঘটিয়েছিল।

–সেকী? সেবার তো পুরো আমেরিকা পাঁচ ঘণ্টার জন্য অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। নাহ্, এদের এগেনস্টে স্টেপ নিতেই হচ্ছে। তা এসব করে এদের লাভ?

–দেখাতে চায় যে এরাই সেরা মানবজাতি। কুড়িজনেই সারা পৃথিবী দখল করার ক্ষমতা রাখে।

বলো কী?

–শুধু তাই? আমি তো এ-ও খবর পেয়েছি–আপনাকে নাকি কিডন্যাপ করার প্ল্যান আছে।

সর্বনাশ! মেরে-টেরে ফেলবে নাকি?

–না, সেটা অবশ্য জানায়নি। বেঁচে থাকতেও পারেন। তবে এদের কাছে প্রাণের তো বিশেষ দাম নেই। যারা টেস্ট দিতে গিয়ে কয়েকজনকে মেরে ফেলে, তারা পরীক্ষা পাশের পরে কতজনকে মারবে কে জানে!

এই এসি-র ঠান্ডাতেও রবিন রীতিমতো ঘামতে শুরু করলেন।

–তা এই প্রোজেক্ট এইচ চালাচ্ছেটা কে?

–আমি খবর পেয়েছি ডঃ কোলিন বলে একজন। আর্মিতে ছিলেন একসময়। প্রোজেক্টের গোপনীয়তার জন্য যাবতীয় ক্ষমতা ওনার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

–ওনাকে জানিয়ে দিন এ প্রোজেক্ট বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে।

–আর যে সব অতিমানবদের অলরেডি সৃষ্টি করা হয়েছে?

–অবশ্যই মেরে ফেলতে হবে।…ওহ, সেদিন এসি চলেনি বলে আমার কুকুরটার যে কী কষ্টই না হয়েছিল! এখনই কোলিনকে ফোন করুন।

–ব্যাপারটা অত সহজে হবে না। মনে রাখবেন এরা প্রত্যেকেই খুব স্পেশাল ক্ষমতা রাখে। অতজন সিকিউরিটি মিলে দুজনকে সামলাতে পারেনি। দেখতে হবে যাতে ওরা কেউ টের না পায়। আমি এমনও শুনেছি যে ওরা সবাই ওদের ওখানে একজনের কথা ছাড়া অন্য কারও কথা শোনে না। এমনকী ডঃ কোলিনেরও নয়।

–কেন? এমন কেন?

–আসলে আর্মির জন্য তৈরি হতো। তা না হলে ওদের মধ্যে ডিসিপ্লিন বোধ আনা যেত না। যে যার ইচ্ছেমতো চললে তো সর্বনাশ। এরা সবাই একজনেরই নির্দেশ শোনে।

–হুঁ বুঝলাম। তা তার সঙ্গেও কথা বললো তাহলে। মোদ্দা কথা এ প্রোজেক্ট ইমিডিয়েটলি বন্ধ করতে হবে। আমাকে কিডন্যাপ কী সর্বনেশে কথা!

.

১৮.

কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না ডঃ কেন। একটা সময়ে উনি এ প্রোজেক্টে অংশগ্রহণ করতে চাননি। চাননি অতিমানব তৈরি করতে। উনি জানতেন এর বিপদ। একবার তৈরি করার পর এদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। কারণ এরা বুদ্ধির দিক থেকেও সাধারণ মানুষের থেকে অনেক এগিয়ে। বলার আগেই বুঝে যায়।

কিন্তু উপায় ছিল না। ওনার বিরুদ্ধে টেররিজমের চার্জ আনা হয়েছিল। তার থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এই প্রোজেক্টের চিফ সায়েন্টিস্ট হওয়া। সবাই জানত যে জিন নিয়ে ছেলেখেলা যদি কেউ করতে পারে–সে একজনই, ডঃ কেন। কীভাবে মানুষের জিনের মধ্যে পরিবর্তন এনে তাকে স্পেশাল ক্ষমতা দেওয়া যায় সে প্রযুক্তি শুধু ডঃ কেনেরই জানা ছিল। আর এটাই সর্বনাশ ডেকে আনল। ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন। আর এই ষড়যন্ত্রের জাল পাতল কে? আর কেউ নয়, স্বয়ং গভর্নমেন্ট। যে সে গভর্নমেন্টও নয়, সব থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রের গভর্নমেন্ট। এ ধরনের জাল থেকে চেষ্টা করলেও একজনের একার পক্ষে বেরোনো সম্ভব নয়।

আর ভাগ্যের কী পরিহাস! আজ সেই গভর্নমেন্টই আদেশ দিয়েছে তার সব সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিতে। এরা কি একটা মাটির পুতুল যে তৈরি করলাম আর ভেঙে দিলাম! এরা প্রত্যেকেই ডঃ কেনের সন্তানের মতো। এরা ডঃ কেনকেই এদের বাবা বলে জানে। এরা ছোটবেলায় ডঃ কেনের কাছে গল্প না শুনে ঘুমোতে যেত না। সকালে ডঃ কেনের সঙ্গে বসে প্রার্থনাসঙ্গীত না গাইলে এদের ভোর শুরু হত না। এরাই বিস্ফারিত চোখে, মুখে খাবার নিয়ে বসে থাকত, আর ডঃ কেনের তাসের ম্যাজিক দেখত। এদের কারও জ্বর হলে ডঃ কেনই মাঝরাতে বারবার এসে কপালে হাত দিতেন। রাত জেগে বসে থাকতেন। আর এদেরকেই মেরে ফেলতে হবে?

প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর ডঃ কোলিন খানিক আগেই ওপরতলার আদেশ শুনিয়েছেন। উনি প্রতিরোধের যাবতীয় চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আদেশের কোনও নড়চড় হয়নি। আজকের মধ্যেই এ কাজ সারতে হবে। এ ল্যাবও বন্ধ করে দিতে হবে।

ঝাপসা চোখে বিল্ডিংটা একবার শেষবারের মতো পর্যবেক্ষণে বেরোলেন ডঃ কেন। চারতলা। বেসমেন্টে নানান ধরনের জন্তু রাখা। চিতাবাঘ থেকে গিরগিটি। ইঁদুর থেকে র‍্যাটল স্নেক। এদের থেকে ডিএনএ নিয়ে নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। এদের ওপরেও অনেক টেস্ট হয়। এর পাশেই বিশাল অপারেশন থিয়েটার। বিশাল স্টেনলেস স্টিলের ফার্মেন্টর, সাইক্লোট্রন–জিন পরিবর্তনে যে রেডিয়ো অ্যাকটিভ কণা লাগে তার জন্য।

একতলায় NMR স্ক্যানার। PET স্ক্যানার। অত্যাধুনিক মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব। ডঃ কেনের নিজের হাতে খুব যত্নে তৈরি করা। দোতলায় বিশাল ল্যাবরেটরি–এখানেই জিনের গঠন পালটানোর নানান ধরনের যন্ত্রপাতি। তিনতলায় লাইব্রেরি। সার দিয়ে কম্পিউটার রাখা আছে। অফিস এরিয়া। বিশাল অডিটোরিয়াম।

ধীরপায়ে পুরো অফিসটা ঘুরে ডঃ কেন অডিটোরিয়ামে ঢুকলেন। ওনার তৈরি সব অতিমানবকে উনি অডিটোরিয়ামে আসতে বলেছেন দু-ঘণ্টা বাদে। এখন অবধি কেউ কিছু জানে না। আর দু-ঘণ্টা বাদে এই অডিটোরিয়ামই হবে ওদের বধ্যভূমি। ওদের প্রত্যেককে ইঞ্জেকশন দিতে হবে। কৃত্রিমভাবে তৈরি ক্ষতিকারক ভাইরাসের ডিএনএ এদের ক্রোমোজোমে মিশে যাবে। তারপর আর কতক্ষণ?

মুখে হাত চাপা দিয়ে অন্ধকার অডিটোরিয়ামের প্রথম সারিতে বসে গেলেন ডঃ কেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এদের কী বলবেন? তোমাদের জীবন আমিই দিয়েছি, আজকে সে জীবন আমিই আবার কেড়ে নেব।

তিলতিল করে যত্নে গড়ে তোলা এই প্রাণগুলোকে কালকের ভোর কোনওভাবেই দেখতে দেওয়া যাবে না। আর ওরা? ডঃ কেন জানেন যে ওরা এর কোনও প্রতিবাদ করবে না। ওদের কাছে একটাই পৃথিবী–একটাই সূর্য–একটাই ঈশ্বর–একজনই শেষ কথা–তিনি হলেন ডঃ কেন। সেরা সৈনিকদের মতো হাসিমুখে মৃত্যুও মেনে নেবে আদেশ পেলে।

কতক্ষণ এভাবে কাঁদছিলেন কে জানে? বাইরের বন্ধ দরজায় টোকা পড়ছে। ল্যাবের টিম ইঞ্জেকশন রেডি করে এসে গেছে। প্রথম সারির চেয়ার থেকে দরজার দিকে হেঁটে এগিয়ে গেলেন ডঃ কেন। মাঝের কুড়ি ফুটকে ওনার মনে হল যেন কুড়ি বছর পেছনে হাঁটা।

স্পষ্ট কানে ভাসছে অনেকগুলো বাচ্চার কান্না। প্রথম ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ওদের ছোট ছোট শরীরে, হাতে-পায়ে। আর তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন উনি। না, এরা তো শুধু নিজের সৃষ্টি নয়–কোনও এক্সপ্রেরিমেন্টের ফসল নয়–এরা তো ডঃ কেনেরই সন্তান। মনে মনে ডঃ কেন তখনই স্থির করেছিলেন সুখে-দুঃখে সবসময় এদের সঙ্গে থাকবেন উনি। বাবা-মার আরও নানান পরিচয়ের শূন্যস্থানগুলো একাই পূরণ করবেন উনি। আর আজকে? আজকে সে প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হবে–খুনি হতে হবে। ওরা যখন ছটফট করবে যন্ত্রণায়, তখনও মনকে বোঝাতে হবে–যা এতদিন ভেবেছি সব মিথ্যা সব অহেতুক প্রশ্রয়। এরা সন্তান নয়– কেউ নয়। বিজ্ঞানীর জীবনে সত্য শুধু একটাই বিজ্ঞান।

.

১৯.

স্যার, ওরা সব অডিটোরিয়ামে এসে বসেছে। আমাদের মেডিকাল টিমও রেডি। আপনি কি একবার ওদের সঙ্গে কথা বলবেন? শেষবার?

শেষবার কথাটা খুব কানে লাগল ডঃ কেনের। না–বিরক্ত হয়ে স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ডঃ কেন। তারপর কি ভেবে আবার উঠে দাঁড়ালেন। বলে উঠলেন– চলো।

খানিক আগে অডিটোরিয়াম ছেড়ে চলে এসেছিলেন। মেডিকাল টিমের প্রস্তুতি–একবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। এসে বসেছিলেন ওনার চেম্বারে–তখন ওদের কেউ ছিল না।

ধীরপায়ে ডঃ কেন এগিয়ে চললেন অডিটোরিয়ামের দিকে। সঙ্গে জুনিয়র সায়েন্টিস্ট ডক্টর রজার। ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গেই পরিচিত সমবেত কণ্ঠ–গুড মর্নিং ডক্টর কেন। অন্যদিনের মতো একইভাবে ফিরতি গুডমর্নিং–বলতে গিয়ে আওয়াজ বেরোল না ডঃ কেনের। ডায়াসের ওপর উঠে নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন–

–আমি সরাসরি আসল কথায় চলে আসি। তোমরা হয়তো আগেই খানিকটা আন্দাজ পেয়েছ। হা–আজকেই তোমাদের শেষ দিন। খানিকক্ষণের মধ্যেই তোমাদের ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে। আর তার দশমিনিটের মধ্যেই তোমাদের মৃত্যু হবে। যন্ত্রণা খুব একটা হবে না হলেও তা সহ্য করার শক্তি তোমাদের আছে। ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় তোমরা মেডিকাল টিমের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করো। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?

পুরো অডিটোরিয়ামে পিন ড্রপ সাইলেন্স। একেই বলে ট্রেনিং। একেই বলে শৃঙ্খলাবোধ। এদের কি আর কষ্ট হচ্ছে না! এ জীবনের প্রলোভন কাটানো বড় শক্ত। সেই আবেগ-অনুভূতিকে সহ্য করার ট্রেনিং পেয়েছে এরা! কিন্তু ডক্টর কেন তো আর এদের মতো ট্রেনিং নেওয়া সেনা নন। তাই এই নীরবতা ওনার সহ্য হল না। উনি ফের বলে উঠলেন,আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। তোমরাই ছিলে আমার সবথেকে আপনার। তোমাদের প্রত্যেককে আমি আমার সন্তানের মতো দেখেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই আমার আদেশ। আরেকবার জিগ্যেস করছি– কারও কোনও প্রশ্ন আছে? ধরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

একটা হাত উঠেছে। কোলিন। ডক্টর কেন সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসার চেষ্টা করলেও, যাদেরকে একটু বেশি ভালোবাসতেন, তাদের মধ্যে কোলিন একজন। খুব শান্ত-বাধ্য ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলায় মাঝেমধ্যেই পালিয়ে ডক্টর কেনের ঘরে চলে আসত। আর ডক্টর কেনের গা ঘেঁষে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ডক্টর কেন কি করেন তা লক্ষ্য করত। হাজারো প্রশ্ন করত। কখনও-বা রাতে ভয় পেয়ে ডক্টর কেনের চাদরের মধ্যে ঢুকে ডক্টর কেনকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।

ডক্টর কেন–আপনি যে বলতেন আমাদের জীবন খুব মূল্যবান। আমরা কখনও যেন তা অহেতুক নষ্ট না করি। কিন্তু আজ হঠাৎ করে আমাদের মৃত্যুর আদেশ। খানিকক্ষণ থেমে কোলিন ফের বলে উঠল–আমরা কি একসপ্তাহ সময় পেতে পারি?

না কোলিন–আজকেই–পরের একঘণ্টার মধ্যে এ বিল্ডিং-এর সব আলো নিভে যাবে। তোমাদের তৈরিই করা হয়েছিল যুদ্ধের সেনা হিসেবে। সেনাদের তো মৃত্যু যখন-তখনই আসে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের মৃত্যুবরণ করতে হয়। একটু থেমে ডঃ কেন ফের বলে উঠলেন, আমায় তোমরা পারলে ক্ষমা করো।

তারপর মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ঘাড় ঘোরালে দেখতে পেতেন ঘরের সবাই যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে উঠেছে তাদের প্রিয় দেবতাকে শেষবারের মতো সম্মান জানাতে।

.

২০.

পিকুর ঘুম খুবই পাতলা। তাই দরজায় একটা টোকাতেই ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। ঘড়িতে ভোর পাঁচটা। তিন ঘণ্টা হল ঘুমিয়েছে। দরজায় সুবীরবাবু ড্রেসিংগাউন পরে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে চিন্তার ছাপ।

কী ব্যাপার কাকু? এত সকালে?

–আমার বাগানে কীসের আওয়াজ পেলাম। উঠে বেরোতে যাব, দেখি ফোনে মেসেজ এসেছে, পড়ে দ্যাখো।

ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল পিকু,–লিভ অ্যান আবার ইমিডিয়েটলি।

সুবীরবাবু বললেন,–তোমার জন্য মেসেজ বুঝতেই পারছ। কেউ তোমার এখানে থাকা পছন্দ করছে না। এক্ষুনি অ্যান আর্বার ছাড়তে বলছে।

কাকু, আমি এ-বাড়ি ছেড়ে এখনই বেরিয়ে যাব। আমার জন্য আপনিও বড় বিপদে পড়েছেন, আমিই এরজন্য দায়ী।

সুবীরবাবু এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন পিকুকে।

–আমার যদি তোমার মতো ছেলে হত, আমি নিজেকে সত্যি ভাগ্যবান মনে করতাম পিকু। আমার বিশ্বাস আসল সত্যের সন্ধান তুমি খুব তাড়াতাড়ি পাবে। সেটা ভালো বা খারাপ যেটাই হোক। আর আমার বিপদ নিয়ে একদম ভাববে না। গত পনেরো বছর ধরে আমার জীবন কীরকম জানো তো? কোনও বৈচিত্র্য নেই, কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। কথা বলার কোনও লোক নেই। অনেকসময় জীবন এত বিবর্ণ হয়ে যায় যে থাকা আর না থাকা একই ব্যাপার।

এই যে তোমার সঙ্গে এতদিন বাদে কথা বলতে পারছি, মনে হচ্ছে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছি।

একটু থেমে সুবীরবাবু আবার বললেন, আমার ব্যাপারে ভয় পেয়ো না। আমার গায়ে কিন্তু অসম্ভব জোর। একবার এখানে দশটা গুন্ডাকে একা পিটিয়েছিলাম।

পিকুকে হাসতে দেখে সুবীরবাবু যেতে যেতে বললেন,–আহা! মারপিটের সময় কি আর কেউ কাউন্ট করে দেখে কজন আছে! তবে একাধিক লোক ছিল তাতে সন্দেহ নেই। আমি এবার একটু বাইরের আওয়াজের ব্যাপারটা দেখে আসি। কীরকম একটা অস্বাভাবিক পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়েছিলাম।

দাঁড়ান কাকু, আমিও যাচ্ছি।

চলো!

পোশাক পরে দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল। আকাশ একটু লালচে হতে শুরু করেছে। পাশের কোনও একটা গাছের থেকে কাঠঠোকরার ঠুকঠুক আওয়াজ আসছে। বাতাসে এখন শীতের আমেজ। পাতলা চাদরে গা ঢাকা দেওয়ার মতো ঠান্ডা। সুবীরবাবুর বাড়িটা অনেকটা জায়গা জুড়ে। প্রথমেই ওরা গেটের দিকে এগিয়ে গেল বাড়িতে ঢোকার রাস্তা দিয়ে, সেখানে কাউকে দেখতে পেল না। ঘাসের লন পেরিয়ে দূরের পুকুরের দিকটাও ঘুরে দেখে এল। নাহ, কিছুই নেই! রান্নাঘরের পাশ দিয়ে সারি সারি ম্যাপল গাছ। ওখান দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল পিকু।

–ওটা কী?

ছুটে কাছে গেল ওরা। উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন। মুখটা একপাশে ঘোরানো। গায়ের সবুজ শার্টে স্পষ্ট রক্তের ছোপ। গায়ের রংও অদ্ভুত সবুজ। তাই ঘাস ঝোপে সত্যিই চট করে চোখে পড়ে না। কেউ পিছন থেকে গুলি করেছে। লোকটার বাঁ-হাতে একটা রিভলভার।

–চিনতে পেরেছেন? পিকু জিগ্যেস করল।

বিস্ময়ে বিমূঢ় সুবীরবাবু বলে উঠলেন,না, ভালো করে মুখটা দেখা যাচ্ছে না তো! কে বলো তো? এরকম সবুজ রং কারো হয় না দেখলে বিশ্বাস হত না!

–সেদিন যে ছেলেটা চেস টুর্নামেন্টে জিতল, সেই ছেলেটা।

 –বলো কী? ওই ভালো স্টুডেন্ট? শিওর? রংটা ওরকম সবুজ হল কী করে?

–কে জানে? তবে এটা যে ওই ছেলেটাই তাতে সন্দেহ নেই। গায়ে হাত দেওয়ার দরকার নেই। আপনি 911 ডায়াল করুন। পুলিশ এসে দেখুক।

সুবীরবাবু ফোন করার খানিকক্ষণের মধ্যে পুলিশ এসে গেল। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল ছেলেটাকে। তবে তখনই চেক করে বলে দিলেন যে প্রাণ নেই। পুলিশ গায়ের রং দেখে মুখে কিছু না বললেও সবাই অবাক। সেই একই পুলিশের ডিটেকটিভ এসেছে সঙ্গে। ওদের দেখেই চিনতে পেরে বলে উঠল,–পরশু রাতে জুলি জর্ডনের ওখানে দেখা হয়েছিল না? আপনারাই তো ডেকেছিলেন!

একটু থেমে ফের বলল, ফরেন্সিক এক্সপার্ট আসবে এক্ষুনি। এ জায়গাটা সিল করে দেওয়া হবে। আপনারা বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোবেন না ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া অবধি। আচ্ছা, আপনারা কি ছেলেটাকে চিনতেন?

সম্মতি জানিয়ে পিকু মাথা নাড়ল,–পরশু ওপেন চেস টুর্নামেন্টে একসঙ্গে খেলেছিলাম। ও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেই সূত্রে পাঁচ মিনিটের আলাপ।

ডিটেকটিভ আরও বেশ কিছু প্রশ্ন করল। এখানে আগে কখনও ছেলেটাকে দেখা গেছে। কিনা, এখানে আসার কোনও কারণ থাকতে পারে কিনা ইত্যাদি।

সব কথা শুনে রীতিমতো ভুরু কুঁচকে চলে গেল অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে।

সুবীরবাবু পাশ থেকে বললেন,–চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তা না বললেই পারতে। এখানকার পুলিশ অসম্ভব বোকা। কমনসেন্সের প্রচণ্ড অভাব। মনে মনে ভাবছে তুমি টুর্নামেন্ট হারার জন্য মার্ডার করেছ কিনা!

সুবীরবাবুর কথাই ঠিক। ডিটেকটিভ আবার ফিরে এসে খুব গম্ভীরভাবে পিকুকে জিগ্যেস করল,–খেলার শেষে তোমাদের মধ্যে কি মারপিট বা ঝগড়া হয়েছিল?

পিকু হেসে বলল, না, না। আমরা চেস খেলছিলাম, আমেরিকান ফুটবল বা রাগবি নয়।

ডিটেকটিভ কী বুঝল কে জানে? এবার পুরো দলবল নিয়ে চলে গেল আশেপাশে খোঁজ নিতে–কেউ কোনও সন্দেহজনক কিছু দেখেছে কিনা। গেটের কাছে একজনকে আর ক্রাইমের জায়গাটায় আরেকজনকে দাঁড় করিয়ে চলে গেল।

এরমধ্যে সুবীরবাবুর ফোন বেজে উঠল। সাইমনের ফোন। সেই মিসিগান লস্কুলের লাইব্রেরিয়ান–যার সঙ্গে চেস টুর্নামেন্টের দিন দেখা হয়েছিল, যিনি পিকুকে জড়িয়ে ধরে তিনমিনিট কেঁদেছিলেন।

একবার গেটে আসবেন? আপনার গেটে যে গাধাটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

–আরে আপনি! আমি এক্ষুনি আসছি।

গেটের কাছে ভদ্রলোকের সাদা মার্সেডিজ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। উনি ড্রাইভারের সিটে বসে হাত নাড়ছেন। সুবীরবাবু বলার পর রোবট পুলিশ সাইমনকে ঢুকতে দিল। গাড়ি সোজা গ্যারেজে ঢুকিয়ে ভদ্রলোক গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।

সুবীরবাবুর কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে গ্যারেজ থেকে বাড়িতে ঢোকার দরজা দেখিয়ে বলে উঠলেন, সব জানি। ভেতরে ঢুকে বলছি।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলে উঠলেন, পিকু, তুমি দু মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে বেরিয়ে যাও। তোমার খুব বড় বিপদ। রাস্তায় কুড়ি ফুট অন্তর ক্যামেরা রাখা আছে। পুলিশ ওইসব ক্যামেরার ছবি চেক করছে। এ রাস্তা দিয়ে গত তিনঘণ্টায় যত গাড়ি গেছে, সব গাড়ি ও গাড়ির ভেতরের লোকেদের ছবি–ওই সব ক্যামেরায় তোলা আছে। এই সময় এমনিতেও খুব কম গাড়ি যায়, তাই খুঁটিয়ে দেখছে ওরা।

–তাতে কী?

 –তাতে পিকুর ছবি আছে।

-মানে? সে তো আমরা পরশু মাঝরাতে একটা জায়গা থেকে ফিরছিলাম বলে। আমিও তো ছিলাম গাড়িতে। সুবীরবাবু বললেন।

তা নয়। ঠিক পিকুরই মতো দেখতে আরেকজন আছে। তার ছবিই ধরা পড়েছে ক্যামেরাতে। তার হাতেই খুন হয়েছে ওই ছেলেটা। যে মারা গেছে তার নাম ড্যানিয়েল। পরশু দিনই আমি আপনাদেরকে ড্যানিয়েল সম্পর্কে বলতাম। ও কাছাকাছি ছিল বলে বলিনি। ড্যানিয়েল ঠিক সাধারণ মানুষ ছিল না, ও ছিল অনেক স্পেশাল ক্ষমতার অধিকারী। ও আর ওর বন্ধু থাকত আমার পাশের বাড়িতে। তাই আমি ওদের দুজনের সম্পর্কেই খানিকটা জানতাম।

একটু থেমে পিকুর দিকে তাকিয়ে সাইমন বলে উঠলেন,–আমি সেদিন শুধু শুধু অতটা কঁদিনি। তোমার বাবা ছিলেন আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ও মিসিগান মেডিক্যাল স্কুলে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্স রিসার্চ বিল্ডিং-এ রিসার্চ করত। আমরা প্রায়ই বসে দাবা খেলতাম। আগে আমি বলিনি, কারণ ড্যানিয়েল অনেক দূর থেকেও সব কথা শুনতে পায়। দেখতে পায়। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ও তোমাকে বিশেষভাবে লক্ষ করছিল। ওর দৃষ্টিতে তোমার ওপর একটা আক্রোশ ছিল–সেটা আমার চোখ এড়ায়নি।

–দুদিন আগে আমি জুলি জর্ডনের বাড়ি গিয়েছিলাম, ওখানে ওকেই আমি দেখেছিলাম, আমার মনে হয় ও আমাকে দেখেছিল। পিকু ফের বলে, পরশুদিন ও আমার অ্যাড্রেস-ও নিয়েছিল।

–হ্যাঁ, তাই হবে। জুলিকে আমিও চিনতাম, কারণ ওর হাজব্যান্ড ডেভের সঙ্গে আমার। পরিচয় ছিল। কাল মাঝরাতে ড্যানিয়েলকে আমি বেরোতে দেখি। ওর হাতের বন্দুকটা আমার চোখে পড়েছিল। কেন জানি না, তোমার কথাই মনে হয়েছিল। একটু দূরে দূরে থেকে ফলো করছিলাম। গাড়িটা একটু দূরে রেখে তোমাদের পিছন দিকে যে বাড়িটা আছে, দেখলাম, তার মধ্যে দিয়ে তোমাদের বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। ঠিক এর মধ্যে আরেকজনকে দেখলাম ওর পিছু নিতে। অন্ধকারে তাকে আমি অবশ্য ভালো করে দেখতে পাইনি।

ঠিক করলাম ওখানেই অপেক্ষা করব। মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। হঠাৎ একটা আওয়াজ পেলাম তোমাদের বাগানের দিক থেকে। যাব কি যাব না ভাবছি, দেখলাম পিকু তোমাদের পেছনের বাড়ির বাগান থেকে জোরে হেঁটে বেরিয়ে আসছে।

আমি স্বাভাবিক ভাবেই ওর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটা বলে উঠল, আমি পিকু নই, পিকুকে এক্ষুনি অ্যান আবার ছেড়ে চলে যেতে বলুন।

বলে পকেট থেকে একটা খাম বার করে এগিয়ে দিল। একটা গাড়ি দেখিয়ে বলে উঠল, আমি ওর জন্য এখানেই অপেক্ষা করছি। ওর বড় বিপদ।

এটা আধঘণ্টা আগের কথা। পুলিশ এসে যাওয়ায় আমি আগে বলতে পারিনি।

–কিন্তু কোথা দিয়ে বেরোব? গেটে তো পুলিশ আছে।

–আরে সে তো সামনের গেটে। তুমি এই পেছনের বাগান পেরিয়ে পেছনের বাড়ির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যাও।

–কিন্তু ছেলেটা কে?

–ছেলেটা তোমার যমজ ভাই। তুমি নিশ্চিন্তে ওর সঙ্গে যেতে পারো। ও তোমাকে বাঁচাতেই এসেছে, জয়ন্ত আমার খুব বন্ধু ছিল বলেই ব্যাপারটা জানি। শান্তনু, অর্থাৎ তোমার দাদা মারা যাওয়ার পর ওর ডিএনএ দিয়ে দুজন যমজ সন্তানের পরিকল্পনা করেছিল জয়ন্ত। একজন হলে তুমি। অন্যজন নির্ঘাত ওই ছেলেটা। যাও পিকু, আর একমুহূর্তও দেরি কোরো না।

পিকু ব্যাগ নিয়ে পাঁচ মিনিটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সাইমনের কথামতো বাড়ির পিছন দিক দিয়ে অন্য বাড়ির বাগান পেরিয়ে পিছনের রাস্তায় গিয়ে নামল। বাইরে এখন ভালো আলো। সূর্যোদয় হয়ে গেছে। একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই দরজা খুলে গেল।

পিকু ওঠামাত্র গাড়িতে বসে থাকা লোকটা গাড়ি স্টার্ট দিল। ওর মুখ দেখে অবাক হয়ে গেল পিকু। এ যেন নিজেকেই আয়নায় দেখছে। গাড়ি চালাতে চালাতেই ছেলেটা বলে উঠল,–দেখতে এক হলে কী হবে, আমার নামটা কিন্তু একদম অন্যরকম। ব্রায়ান। চট করে। কয়েকটা দরকারি কথা বলে নিই। সাইমনের হাতে একটা খাম পাঠিয়েছিলাম। ওর মধ্যে একটা প্লেনের টিকিট আছে। আর পাম স্প্রিং-এর একটা ঠিকানা আছে। ওই ঠিকানায় কাল সকাল ছটায় আমরা মিট করব। তুমি যে প্রশ্নের খোঁজে এসেছ, সে প্রশ্নের উত্তর ওখানেই পাবে।

একটু থেমে ব্রায়ান একবার সাইড মিররে তাকিয়ে নিয়ে বলল,–যা ভয় পেয়েছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেছে। ফলো করছে।

–কে পুলিশ?

না, না, পুলিশ হলে তো সোজা ছিল। এ হল ড্যানিয়েলের বন্ধু। খুব বিপজ্জনক। ও তিন মিটার অব্দি হাইজাম্প দিতে পারে। আট সেকেন্ডে একশো মিটার ছুটতে পারে। তা, তুমি কি গাড়ি চালাতে জানো?

-কেন?

–তুমি চালাও। আমি ওকে গুলি চালিয়ে থামানোর চেষ্টা করি।

 –কিন্তু আমার যে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই এখানকার।

 জোরে হেসে উঠল ব্রায়ান,–আগে তো প্রাণ বাঁচাও, তারপরে নিয়ম।

গাড়ি চালু অবস্থাতেই ড্রাইভিং সিটে কোনওরকমে চলে এল পিকু। বলল,–কোনদিকে এয়ারপোর্ট?

–আরে যে-কোনওদিকে যাও। স্পিডটা শুধু দেড়শোর কম কোরো না, আর পুলিশের গাড়ি দেখলেও দাঁড়িও না।

পিকু আগে গাড়ি চালিয়েছে, কিন্তু ভারতে আর আমেরিকাতে চালানোর মধ্যে অনেক তফাত। তবু এখন একটাই নিয়ম। ধাক্কা বাঁচিয়ে ম্যাক্সিমাম স্পিড। করলও তাই। ট্রাফিক কাটিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাতে লাগল–ঠিক ভিডিয়ো গেমসের মতো। ওর রিফ্লেক্স এমনিতেও খুব ভালো।

জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে ব্রায়ান পিছনে তাড়া করে আসা গাড়িটাতে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। পিছনের গাড়ির ড্রাইভারও বেশ ওস্তাদ। ডানদিক-বাঁদিক কাটিয়ে এমনভাবে চালাচ্ছে। যে গুলি করা খুব শক্ত। আর এর মধ্যেই পিকুর গাড়ির খুব কাছে চলে এসেছে।

ব্রায়ানের হাত বেশ পাকা। খানিকবাদেই তাড়া করে আসা গাড়িটার ডান দিকের টায়ারে গুলি লাগল। গাড়িটা কাছে চলে এসেছিল। ওই ছেলেটাও গুলি চালাতে শুরু করেছে। কয়েকটা গুলি ব্রায়ানের গাড়িতে এসেও লেগেছে। ব্রায়ানও এখন ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে।

হঠাৎ ব্রায়ান চেঁচিয়ে বলে উঠল, বুকে গুলি লেগেছে ছেলেটার। তবে তাতে ওর কিছু হবে কিনা বলা শক্ত। আমার গাড়ির কাঁচ বুলেট প্রুফ বলে বাঁচোয়া।

পিছনের গাড়িটা থেমে গেছে। ব্রায়ান চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়িও না। জোরে চালিয়ে যাও।

এয়ারপোর্টে পিকুকে ড্রপ করে ব্রায়ান বলল,সাবধানে যেও। পাম স্প্রিংস-এ দেখা হবে। ড্যানিয়েলের বন্ধুকে আমি একটু সামলে আসি। ও জানে যে আমরা কোথায় যাচ্ছি। বেঁচে থাকতে কোনওভাবে সেটা ও হতে দেবে না। গুলি লেগেছে ঠিক, কিন্তু মরেছে কিনা তা দেখে আসি।

পিকু হাঁ করে দাঁড়িয়েছিল, ব্রায়ান বলল,–শিগগির ভেতরে ঢুকে যাও। তুমি আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি তোমার মতো সাধারণ নই। আমি লড়তে শিখেছি। ব্রায়ান জোরে গাড়ি চালিয়ে দিল আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *