৬. দুঃস্বপ্নের রাত

০৬.

দুঃস্বপ্নের রাত অতিবাহিত হল শেষ পর্যন্ত। বাইরে সূর্যোদয় হয়েছে। অনীশ জানলা খুলতেই একরাশ আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। বাইরের দিকে তাকিয়েই অনীশ বুঝতে পারল গতকাল অন্ধকার নামার পর থেকেই আরও অনেক তুষারপাত হয়েছে। অন্তত চার-পাঁচ ফুট বরফের চাদরে ঢেকে গেছে মাটি। বাড়িটার সামনের বা পিছনের কোনও অংশ থেকেই কোনও শব্দ আসছে না।

ঘরে আলো ঢুকতেই মনে অনেকটা বল ফিরে এল অনীশের। সে মনে মনে ভাবল যে যাবার আগে গত রাতের ব্যাপারটা নিয়ে একবার জবাবদিহি চাইবে ভাইমারের কাছে। পরপর দু-রাত ভাইমারের অসতর্কতার জন্য প্রাণ যেতে বসেছিল তার। গ্রামবাসীদের অভিযোগ এবার সত্যি বলে অনীশের মনে হল। ওয়্যার উলফ না হলেও তার নেকড়েগুলোই হয়তো ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে একের পর এক মানুষ মেরেছে। ভাইমার ঘটনাটা যতই অস্বীকার করুন না কেন এ ব্যাপারটাই সম্ভবত সত্যি। কপাল ভালো যে পরপর দু-রাত বেঁচে গেছে অনীশ।

অনীশের ঘড়ির কাটায় সাতটা বাজল একসময়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোবাইলও বেজে উঠল। ড্রাইভার পবনের ফোন। সে বলল, আমি চলে এসেছি স্যার।

অনীশ বলল, ঠিক কোথায় তুমি?

পবন বলল, ঠিক গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে। ভিতরে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে গেট খোলা।

অনীশ বলল, দাঁড়াও আমি ঘরের বাইরে বেরোচ্ছি।

দরজা খুলল অনীশ। বাইরেটা পুরো তুষারে মুড়ে আছে। এমনকী বঁটাতারগুলো থেকেও ঝুলের মতো তুষার ঝুলছে। বারান্দার মেঝেও ঢেকে গেছে বাতাসে ভেসে আসা তুষারে। পবনকে দেখে হাত নেড়ে ভিতরে ঢোকার ইঙ্গিত করল অনীশ। চীনাদের তাঁবুটারও এখন কোনও চিহ্ন নেই। আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও ভাইমার বা তার লোকজনকেও দেখতে পেল না অনীশ।

পবন হাঁটু পর্যন্ত বরফ ভেঙে বারান্দায় উঠে এল। তার চোখে মুখে কেমন যেন উত্তেজনার ছাপ। দরজার সামনে এসে বারান্দার মেঝের দিকে তাকিয়ে সে আঁতকে উঠে বলল, ওটা কী?

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনীশ দেখল দরজার বাইরে তুষারের মধ্যে আঁকা হয়ে আছে নেকড়ের অসংখ্য পায়ের ছাপ! গতরাতের ঘটনার চিহ্ন। অনীশ জবাব দিল, গত রাতে ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। একটা নেকড়ে দরজা ভেঙে ঢুকতে যাচ্ছিল। কোনওমতে বেঁচে গেছি!

অনীশের কথা শুনে ফ্যাকাসে হয়ে গেল পবনের মুখ। অনীশ তাকে নিয়ে ঘরে ঢোকার পর পবন উত্তেজিতভাবে বলল, ওদিকে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছে। তাই গ্রামে থাকা সুবিধার মনে হল না। তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।

অনীশ বলল, কী ঘটনা?

পবন বলল, কাল সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে এসে ছেলেটাকে যে পাওয়া যায়নি সে খবর দেবার পর গ্রামের লোকরা তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল দল বেঁধে। পাস থেকে যে রাস্তাটা এদিকে ঢুকেছে সেখানে জঙ্গলের মধ্যে ছেলেটার দেহর কিছু অংশ মিলেছে। নেকড়ে খাওয়া দেহ। সম্ভবত গত পরশু রাতে তাকে ধরেছিল নেকড়েগুলো। গ্রামবাসীরা প্রচণ্ড উত্তেজিত। তারা হয়তো সত্যিই পুড়িয়ে দেবে এই ক্যাম্প। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে ফেরা যায় ততই ভালো।

অনীশ তার কথা শুনে চমকে উঠে বলল, আমি তৈরি হয়েই আছি। এখনই বেরিয়ে পড়ব। যাবার আগে শুধু ভাইমারকে একবার জানিয়ে যাই।

অনীশ বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর মিস্টার ভাইমার, মিস্টার ভাইমার বলে হাঁক দিতে লাগল। কিন্তু কোথা থেকে কোনও সাড়া মিলল না ভাইমারের। বারান্দার সার বাঁধা একটার। পর একটা ঘরগুলোও দেখল তারা দুজন। সব ঘর বাইরে থেকে তালা বন্ধ। এমনকী অনীশ প্রথমদিন যে ঘরে এসে বসেছিল সেটাও তালা দেওয়া। অনীশ বলল, ভাইমার নিশ্চয়ই তবে বাড়ির পিছনের দিকে আছেন। চলো সেখানে।

অনীশ আর পবন বারান্দা থেকে নামতেই তাদের প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল তুষারের মধ্যে। বরফ ভেঙে তারা বাড়ির পিছন দিকে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেইসময় একটা আর্মি জিপ এসে থামল গেটের সামনে। গাড়ি থেকে নামলেন ছেত্রীসাহেব সহ আরও জনা পাঁচেক অস্ত্রধারী সেনা। সটান গেট খুলে তারা প্রবেশ করলেন ভিতরে। অনীশ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তাদের দেখে।

অনীশদের সামনে এসে দাঁড়ালেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। তিনি প্রশ্ন করলেন, এখানে যে চীনাদের দলটা ছিল তারা কই?

অনীশ জবাব দিল, কাল সন্ধ্যায় তাদের তাবু ছিল। সকালে উঠে দেখতে পাচ্ছি না।

থমথম করছে লেফটানেন্ট ছেত্রীর মুখ। তিনি বললেন, শুনেছেন নিশ্চয়ই কাল রাতে সেই নিখোঁজ ছেলেটার নেকড়ে খাওয়া দেহ মিলেছে। ভাইমার সাহেব কই? তিনি হয়তো ঘটনাটা বলতে পারবেন। আমার ধারণা তার নেকড়েই পরশু এ কাণ্ডটা ঘটিয়েছে।

অনীশ জবাব দিল, হ্যাঁ, এখন আমারও তাই ধারণা। কাল আর পরশু দু-দিন রাতেই দুটো নেকড়ে আমার ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছে। ফিরে যাবার আগে তাকেই আমরা খুঁজতে যাচ্ছিলাম। হয়তো তিনি বাড়ির পিছনের অংশে আছেন।

লেফটানেন্ট বলল, তবে চলুন ওদিকে।

বাড়ির পিছন দিকে এগোল তারা সবাই মিলে। যেতে যেতে লেফটানেন্ট অনীশকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি গতকাল সন্ধ্যার পর বাইরে বেরিয়েছিলেন?

অনীশ জবাব দিল, না, কেন বলুন তো?

লেফটানেন্ট ছেত্রী যদিও জবাব দিলেন এমনি জিগ্যেস করলাম কিন্তু তার জবাব শুনে লেফটানেন্টের সঙ্গে যেন মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হল তার এক সেনার। ব্যাপারটা অনীশের চোখ এড়াল না।

অনীশরা বাড়ির পিছনে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে ভাইমার বা তার লোকজন কেউ নেই। সেই চীনাদের দল বা তাদের ভারবাহী পশুগুলোও নয়। আর এরপরই তাদের নজর পড়ল খাঁচাগুলোর দরজাতে। দরজাগুলো সব খোলা! কোনও খাঁচাতেই কোনও প্রাণী নেই!

বিস্মিত অনীশ বলে উঠল, নেকড়েগুলো সব কোথায় গেল?

অন্যরাও বিস্মিত! কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাই হতবাক হয়ে গেল। লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত বিপদের আঁচ করে পশুগুলোকে নিয়ে পালিয়েছেন ভাইমার। তবু ক্যাম্পটা একবার ভালো করে খুঁজে দেখতে হবে।

লেফটানেন্টের নির্দেশ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল সেনারা।

অনীশ বলল, কিন্তু প্রাণীগুলোকে নিয়ে কোথায় যাবেন ভাইমার?

লেফটানেন্ট জবাব দিল, সম্ভবত সীমান্তের ওপারে। চীনা সেনারা তো প্রাণীগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী। হয়তো ওই চীনা রসদ সরবরাহকারী দলের সাহায্যে বা অন্য কোনওভাবে চীনা সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন ভাইমার। পশুগুলোকে নিয়ে তিনি ওপাশে চলে গেলে আমাদের কিছু করার থাকবে না। যদিও আপনাকে সব কথা বলা ঠিক না তবু বলি চীনা সৈনিকদের একটা বেতারবার্তা ধরা পড়েছে আমাদের কাছে। সাংকেতিক সেই বেতারবার্তায় তারা নিজেদের মধ্যে খোঁজখবর নিচ্ছিল যে ওই চীনা ব্যবসায়ীদের দলটা এই ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে কিনা? অর্থাৎ ওই লোকগুলোর সঙ্গে চীনা ব্যবসায়ীদের কোনও সম্পর্ক আছে। সেজন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই এখানে এসেছিলাম আমি।

লেফটানেন্ট ছেত্রীর পাশে একজন সেনা দাঁড়িয়ে ছিল। তার পিঠে বাঁধা ওয়ারলেস সেট। ছেত্রী তাকে বললেন, আটশো চব্বিশ আউটপোস্টের স্নো-আউলকে ধরে দাও।

তার নির্দেশ শুনে সেই সৈনিক ওয়ারলেসে ধরে দিল স্নো-আউল ছদ্মনামের কোনও লোককে। মাইক্রোফোন নিয়ে লেফটানেন্ট বললেন, স্নো-লেপার্ড কলিং। এরপর অবশ্য সাংকেতিক কথা-বার্তা শুরু হল দুজনের মধ্যে। মিনিট তিনেক কথা বলার পর লাইনটা কেটে দিয়ে লেফটানেন্ট বললেন, আজ সূর্যোদয়ের সময় নাথুলা পাসে প্রবেশ করেছে চীনাদের ওই দলটা। ওদের সঙ্গে ভাইমার নেই ঠিকই কিন্তু পশুগুলোর পিঠে ভারী ভারী চটের বস্তা আছে। কিন্তু ওভাবে বস্তায় পুরে নেকড়ে নিয়ে যাওয়া কী সম্ভব? তারা ডাক ছাড়বে, ছটফট করবে, অনায়াসে চটের বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।

পশুগুলোকে নিয়ে ভাইমার কোথায় গেলেন ভাবতে লাগলেন ছেত্রী। নেকড়ে তো আর কুকুর নয় যে চেনে বেঁধে কোথাও নিয়ে যাওয়া যাবে? তার ওপর অমন পাঁচ পাঁচটা হিংস্র নেকড়ে।

যে সব সেনারা ক্যাম্পের ভিতর ভাইমারকে খুঁজতে গেছিল তারা এসে জানাল যে ভাইমার কোথাও নেই। তবে?

হঠাৎ অনীশের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। সে বলল, হ্যাঁ, হা, ওভাবেও কিন্তু প্রাণীগুলোকে বস্তাবন্দি করে পাচার করা সম্ভব।

বিস্মিত লেফটানেন্ট জানতে চাইল, কীভাবে?

অনীশ বলল, আফ্রিকার রোডেশিয়াতে একবার একটা চিতা হানা দিচ্ছিল গ্রামে। গ্রামবাসীরা তাকে ফাঁদ পেতে ধরে খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে বস্তাবন্দি করে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছিল আমাদের রেসকিউ ক্যাম্পে। নেকড়েগুলোকে যদি ঘুমের ওষুধ বা ইনজেকশন দেওয়া হয়ে থাকে? আট-নয় ঘণ্টা অনায়াসে এভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় ওদের। ভাইমার অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটাও জানেন।

অনীশের কথা শুনে লেফটানেন্ট চমকে উঠে বললেন, এমনটা হতেই পারে। ওই চীনাদের পিছু ধাওয়া করতে হবে। আপনি লোকগুলোকে চিনতে পারবেন? কেন না ওইরকম খচ্চরের পিঠে বস্তা চাপিয়ে অনেকে যাতায়াত করে রেশমপথে। সবাইয়ের তল্লাসী নেবার সময় হাতে নেই। ও দেশের সীমান্তে প্রবেশের আগেই তাদের ধরা চাই।

অনীশ জবাব দিল, সম্ভবত চিনতে পারব।

লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত আজ আর আপনার ফেরা হবে না। সব ঠিক থাকলে কাল আপনি ফিরবেন। আপনার ফেরার যাবতীয় ব্যবস্থা আমি করব। এমনকী যদি তেমন প্রয়োজন হয় তবে আর্মি কপ্টার আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। আমি আপনাকে কথা দিলাম। আর দেরি করা যাবে না। এখনই পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের। চলুন আমার সঙ্গে।

লেফটানেন্ট ছেত্রীর বাচনভঙ্গির মধ্যে এমন একটা প্রচ্ছন্ন নির্দেশ লুকিয়ে ছিল যে অনীশ কিছু বলতে পারল না। শুধু পবন বলল, আমি কি গাড়ি নিয়ে যাব আপনাদের সঙ্গে?

ছেত্রী পকেট থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা কার্ড বার করে পবনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এতে আমার ফোন নং আছে। প্রয়োজন হলে, ভাইমার ফিরে এলে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করবে আমার সঙ্গে। তাছাড়া তোমার স্যারের ফোন নম্বর তো নিশ্চয়ই আছে তোমার কাছে। তুমি এখানেই থাকবে।

অনীশ বলল, তুমি বরং আমার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করো। ওখানে আমার জিনিসপত্র সব রাখা আছে।

লেফটানেন্ট ছেত্রী অনীশকে তাড়া দিলেন–দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলুন চলুন…।

মিনিট খানেকের মধ্যেই ক্যাম্প ছেড়ে নাথুলা পাস বা রেশম পথের উদ্দেশ্যে আর্মি জিপে রওনা হয়ে গেল অনীশরা।

বরফ মোড়া রাস্তা। পথের পাশের পাইন গাছগুলোর মাথাও বরফে ঢেকে আছে। অন্য পাশের পাথুরে দেওয়ালও বরফের চাদরে ঢাকা। আর্মি গাড়িটার চাকার চাপে দু-পাশে ছিটকে যাচ্ছে বরফের কাদা। সকলেই নিশ্চপ, লেফটানেন্ট আর তার সেনারা হিমশীতল মুখে বসে আছে, অনীশ বুঝতে পারল তাদের সবার ভিতরই প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করছে। অনীশ নিজেও ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড উত্তেজিত। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড দুলে উঠছে গাড়িটা। মনে হয় এই বুঝি উলটে যাবে সেটা। তবু কারও মুখে কোনও ভাবান্তর হচ্ছে না। একসময় পাসের কাছাকাছি চলে এল গাড়িটা। তার আগে পথের পাশে পাইনবন যেখানে শেষ হয়েছে তার কিছুটা আগে বনের ভিতরে আঙুল তুলে দেখিয়ে ছেত্রী বললেন, ওর ভিতরই ছেলেটার দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। মাথা আর কঁধ বাদ দিয়ে দেহের পুরো অংশটাই সাবাড় করে দিয়েছে নেকড়ের দল।

পাসে প্রবেশ করল গাড়িটা। বরফ মোড়া রাস্তা। সংকীর্ণ পথের দু-পাশে কোথাও বরফের দেওয়াল, আবার কোথাও খাদ। নীচে পাকদণ্ডিগুলো দেখা যাচ্ছে। যে পথ বেয়ে অনীশ ওপরে উঠে এসেছিল। গাড়ি চলতে লাগল তার বিপরীতে আরও ওপর দিকে। কখনও গাড়িটা খাড়া উঠছে ওপর দিকে, আবার কখনও চুলের কাটার মতো বাঁক নিচ্ছে। বরফে চাকা পিছলোলেই যে-কোনও মুহূর্তে উলটে যেতে পারে গাড়ি। এ পথে কাউকেই ওপরে উঠতে দেখতে পাচ্ছে না অনীশরা। তবে মাঝে মাঝে দু-পাঁচ জনের ছোট ছোট দল ওপর থেকে নামছে। তাদের সঙ্গে কখনও বা নারী-শিশুও আছে। কখনও বা ভারবাহী খচ্চর বা গাধা। অনীশ জানতে চাইল, এই লোকগুলো কোথায় যাচ্ছে?

লেফটানেন্ট জবাব দিলেন, পাসের এদিক-ওদিকে দু-চারটে ছোট ছোট গ্রাম আছে। বরফ পড়ছে বলে ওরা নীচে নেমে আসছে। এই তিনমাস ওরা নীচে থাকবে। আর গ্রামগুলো জনশূন্য অবস্থায় বরফের নীচে চাপা পড়ে থাকবে।

পাস বা রেশমপথ ধরে আরও কিছুটা ওপরে ওঠার পরই ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হল। তার সঙ্গে বইতে লাগল কনকনে ঠান্ডা বাতাস। মাঝে মাঝে পাহাড়ের ঢাল থেকে শুড়িপথ এসে মিশেছে মূল রাস্তায়। সেগুলোও বরফে মোড়া। সে পথগুলো দেখিয়ে লেফটানেন্ট তার এক সৈনিককে বললেন, এ পথগুলো বরফে ঢাকা না থাকলে ওরা নির্ঘাত এ পথগুলোই ধরত সীমান্ত পেরোবার জন্য। আমরা ওদের ধরতে পারতাম না। এখন সোজা পথে ওদের চলতে হচ্ছে এটা বাঁচোয়া।

চলতে লাগল গাড়ি। তুষারপাত আর বাতাস ক্রমশ বাড়ছে। মাঝে মাঝে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। একসময় লেফটানেন্ট বারবার ঘড়ি দেখতে লাগলেন। তারপর আক্ষেপের স্বরে বললেন, এমন চললে আমরা হয়তো আর ওদের নাগাল পাব না। সীমান্ত পেরিয়ে যাবে ওরা। আমরা সীমান্তর অনেকটা কাছে চলে এসেছি। অথচ ওদের দেখা নেই!

অনীশ প্রশ্ন করল, আর কতদূর সীমান্ত?

লেফটানেন্ট জবাব দিলেন, আমাদের পথের ডানপাশের দেওয়ালটাই তো চীনের ভূখণ্ডে। সীমান্ত বলতে যেখানে ওদের চেকপোস্ট আছে এই রেশম পথের ওপর আমি সে জায়গার কথাই বলছি। ও জায়গা এখান থেকে আর পাঁচ-ছয় কিলোমিটার হবে। হয়তো ওরা সীমান্তের ওপাশে পৌঁছে দাঁত বার করে হাসবে, আর এ-পাশ থেকে আমরা তাকিয়ে দেখব।

এবার স্পষ্ট উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠল লেফটানেন্ট আর তার সৈনিকদের মুখে। দাঁতে দাঁত চিপে শক্ত হাতে হুইল ধরে যথাসম্ভব গাড়িটা দ্রুত চালাবার চেষ্টা করছে ড্রাইভার। কিন্তু। পারছে না। বাতাসের দাপটে মনে হচ্ছে উলটে যাবে গাড়িটা।

একসময় গাড়িটা এভাবেই আরও দু-তিন কিলোমিটার এসে থামল এক জায়গাতে। পথ সেখানে দুটো ভাগে ভাগ হয়েছে। ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্ন করল, কোন পথ ধরব? দুটো পথই তো চীনা আউটপোস্টে পৌঁছেছে।

লেফটানেন্ট মুহূর্তখানেক ভেবে নিয়ে বললেন, বাঁ-দিকের পথটা একটু শর্টকাটে চীনা আউটপোস্টে পৌঁছয় ঠিকই কিন্তু পথের শেষ এক কিলোমিটার খুব খাড়াই। ওদের পশুগুলোর পিঠে মাল আছে। ওদের পক্ষে ও পথে যাওয়া একটু কষ্টকর। ডান দিকের পথটাই বরং ধরো। যা হবার হবে।

ডান দিকের পথটাই ধরল ড্রাইভার। একটু এগোতেই হঠাই একটা ধাতব খটখট শব্দ কানে এল অনীশদের। গাড়ির কিছুটা তফাতে রাস্তার ওপর যেন বরফের ঝড় উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা থেমে গেল। লেফটানেন্ট গাড়ি থেকে মুহূতাঁর মধ্যে লাফিয়ে নেমে অনীশকে টেনে নামিয়ে জাপটে ধরে শুয়ে পড়লেন রাস্তার পাশে একটা ফাটলের মধ্যে। চাপা স্বরে তিনি বলে উঠলেন, চীনা আর্মি পাহাড়ের মাথা থেকে মেশিনগান চালাচ্ছে। মাথা তুলবেন না।

গাড়ির অন্য জওয়ানরাও মুহূতাঁর মধ্যে নেমে পড়েছিল গাড়ি থেকে। গাড়ির আড়াল বা বরফের দেওয়ালে পজিশন নিয়ে এবার তারা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করল। বুলেটের আঘাতে ছিটকে উঠতে লাগল বরফ, এতগুলো আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দে খানখান। হয়ে যেতে লাগল রেশম পথের নিস্তব্ধতা। টানা এক মিনিট মতো চলল গুলির লড়াই। তারপর হঠাই থেমে গেল গুলির শব্দ। শুধু অনেক ওপর থেকে ধপ করে কোনও ভারী জিনিস যেন খসে পড়ল রাস্তায়!

সাংকেতিক শিস দিল একজন সৈনিক। গর্ত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লেফটানেন্ট আর অনীশ। কিছু দূরে রাস্তার পাশে পড়ে আছে একজন চীনা সৈনিকের মৃতদেহ। এ লোকটাই ওপর থেকে মেশিনগান চালাচ্ছিল। ভারতীয় সেনাদের গুলি ওপর থেকে পেড়ে ফেলেছে তাকে।

মৃতদেহটাকে দেখে লেফটানেন্ট বললেন, আমরা ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছি। সেজন্য লোকটা আমাদের আটকাবার চেষ্টা করছিল। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না। চীনাদের দলটা এখনও সীমান্ত পেরোতে পারেনি।

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে গাড়িতে উঠল সকলে। আবার চলতে শুরু করল গাড়ি।

তুষারঝড় শুরু হয়েছে এ পথে। শনশন শব্দে বাতাস বইছে প্রবল বেগে। রাস্তা থেকে বাতাসের ধাক্কায় পাক খেয়ে উঠছে তুষারকণা। তারই মধ্যে দিয়ে চলছে গাড়িটা। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। হঠাৎ ড্রাইভারের পাশে যে জওয়ান অস্ত্র উঁচিয়ে বসে ছিল সে চিৎকার করে উঠল, ওই! ওই!

অনীশ তাকাল সেদিকে। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ওদের। একটা বাকের দিকে এগোচ্ছে লোকগুলো। অনীশও বলে উঠল, হা হা ওরাই! ওরাই! একটা বাঁক পেরোচ্ছে লোকগুলো। গতি বাড়িয়ে গাড়িটা তুষারঝড়ের মধ্যে দিয়ে এগোল তাদের দিকে। কিন্তু তাদের কাছাকাছি পৌঁছোবার আগেই লোকগুলো টের পেয়ে গেল তাদের পিছনে ধাবমান গাড়িটার উপস্থিতি। ভারবাহী পশুগুলোকে ফেলে লোকগুলো পালাবার জন্য তুষারঝড়ের মধ্যে এদিক-ওদিকে ছুটল। অনীশদের গাড়িটা যখন সে জায়গাতে পৌঁছল তখন ভারবাহী খচ্চরগুলোই শুধু রাস্তার মাঝে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারটে খচ্চরের পিঠে বিরাট বিরাট চটের বস্তা। তার মধ্যে সম্ভবত বড় বড় কাঠের বাক্সর মতো কিছু আছে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। ঠিক সেই সময় দূরের পাহাড় থেকে মেশিনগানের র‍্যাট র‍্যাট শব্দ শোনা যেতে লাগল। লেফটানেন্ট সৈনিকদের বললেন, তাড়াতাড়ি বস্তাগুলো নামিয়ে গাড়ির মাথায় তোলো। এখানে আর ওর ভিতর কী আছে দেখার সময় নেই। বস্তার ভিতর বাক্সর মধ্যে যদি জীবন্ত নেকড়েগুলো থাকে তবে সেগুলো ওদের কাছে দামী। ছাদে থাকলে গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালাবে না ওরা।

লেফটানেন্টের কথা মতোই কাজ হল। ছুরি দিয়ে দড়ি কেটে বস্তাগুলো নামিয়ে সেগুলো গাড়ির ছাদের খাঁচা মতো জায়গাটাতে তুলে ফেলা হল। মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরল অনীশদের গাড়ি। এদিকে পাসের মধ্যেও তখন তুষারঝড় শুরু হয়েছে। অনীশরা পাসে উঠে কিছুটা এগোতেই আবারও গুলির শব্দ ভেসে আসতে লাগল দূরের পাহাড় থেকে। লেফটানেন্ট যাতে তাদের জিনিস নিয়ে পালাতে না পারেন সেজন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীনা সেনারা। একটু বিস্মিতভাবে লেফটানেন্ট বলে উঠলেন, সামান্য এই নেকড়েগুলো হঠাৎ ওদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন?

তারপর তিনি ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন, একটু এগিয়ে পাস থেকে ডান পাশের নীচে নামার পথটা ধরো। আমাদের ও পথে ফিরতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে ঠিকই। কিন্তু পথটার দু-পাশেই পাথরের দেওয়াল আর ভারতের ভূখণ্ড। চীনা সেনাদের গুলি সেখানে পৌঁছোবে না। লেফটানেন্টের নির্দেশ পালিত হল কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর্মি গাড়িটা সে পথই ধরল। আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল চীনা সেনাদের মেশিনগানের শব্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *