৪. মোবাইলের রিংটোনের শব্দে

০৪.

ভোর ছটা নাগাদ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল অনীশের। ওপাশ থেকে ড্রাইভার পবন বলল, গুড মর্নিং স্যার। আপনি কি আজ আসছেন?

অনীশ বলল, হ্যাঁ, যাব। কোনও খবর আছে নাকি?

পবন একটু ইতস্তত করে বলল, এখানে তো গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়ে। তার ওপর কাল সন্ধ্যা থেকেই তুষারপাত শুরু হয়েছিল। চাঁদ ওঠার কিছু পরে তুষারপাত দেখার জন্য আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি গ্রামপ্রধান নরবু একা তুষারপাতের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে বেরোচ্ছে। কৌতূহলবশত আমি এগোলাম তার পিছনে। সে আমাকে দেখেনি। নরবু ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে পাইনবনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক। সে নরবুকে নিয়ে পাইনবনের ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর বেশ কিছু সময় পর বন থেকে বেরিয়ে এক গ্রামে ফিরে এল সে।

অনীশ প্রশ্ন করল, লোকটা কে? কেমন দেখতে।

পবন মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বলল, সম্ভবত ভাইমার সাহেব।

ভাইমার সাহেব! বেশ অবাক হয়ে গেল অনীশ। তবে ভাইমার কি গোপনে সন্ধি করতে গেছিলেন গ্রামের মাথা নরবুর সঙ্গে? অনীশ অবশ্য এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না পবনকে। শুধু বলল, ঠিক আছে। চোখকান খোলা রেখো। তেমন কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে আমাকে।

বিছানা ছেড়ে উঠে অনীশের কিছুক্ষণ সময় লাগল তৈরি হয়ে নিতে। দরজা খুলেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল সে। সামনের চত্বর তো বটেই, এমনকী চারপাশের সবকিছু সাদা হয়ে গেছে তুষারপাতের ফলে। পাইনবনের মাথাটাও পুরো সাদা!

বারান্দাটা পুরো ফাঁকা। ভাইমার বা তার কর্মচারীরা কেউ কোথাও নেই। বারান্দা ছেড়ে নীচে নামল অনীশ। সঙ্গে সঙ্গে তার দু-পা ডুবে গেল তুষারের মধ্যে। জমির ওপর অন্তত এক ফুট তুষার জমেছে। সারা রাত ধরে এতটা তুষারপাত হয়েছে তা ধারণা করতে পারেনি অনীশ। বাড়ির সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে পেঁজা তুলোর মতো তুষার মাড়িয়ে অনীশ এগোল বাড়িটার পিছন দিকে। বাড়িটাকে বেড় দিয়ে বাঁক ফিরতেই অনীশ কিছুটা তফাতেই দেখতে পেল ভাইমার আর তার এক কর্মচারীকে। ভাইমার তার কর্মচারীকে ধমকে বললেন, তুমি ওখানে গেছিলে কেন?

কর্মচারীটা যেন মাথা নীচু করে জবাব দিল, এভাবে আর পারছি না স্যার।

ভাইমার এরপর কিছু একটা যেন বলতে যাচ্ছিলেন তার লোকটাকে। কিন্তু অনীশকে দেখতে পেয়ে থেমে গেলেন। অনীশের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, সুপ্রভাত। ঘুম কেমন হল?

অনীশ জবাব দিল, ভালো।

ভাইমারের সেই লোকটা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইমার তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাও। খাঁচাগুলোর সামনে তেরপলের পরদা টাঙাবার ব্যবস্থা করো যাতে ঠান্ডা বাতাস আটকানো যায়।

তার কথা শুনে লোকটা ধীরে ধীরে চলে গেল খাঁচাগুলোর দিকে।

সে চলে যাবার পর ভাইমার বললেন, এই নেকড়েগুলো বরফের দেশের প্রাণী। বরফ। বা তুষারপাতে ওদের কিছু হয় না। কিন্তু ঠান্ডা বাতাসে ওরাও কাবু হয়ে যায়। সহ্য করতে পারে না। বাতাসের থেকে বাঁচার জন্য বরফে গর্ত খুঁড়ে থাকে। দেখেছেন কাল কেমন তুষারপাত হয়েছে। এমন আর দু-তিন দিন হলে সিল্ক রুট, নাথুলা পাস বন্ধ হয়ে যাবে।

অনীশ বলল, হ্যাঁ। দেখলাম। কাল রাতে নেকড়েগুলোকে খেলতেও দেখলাম সামনের চত্বরে। তার মধ্যে একটা নেকড়ে কী বিশাল! সুন্দর! ওই নেকড়েটাই তো কাল খাঁচার গর্তে লুকিয়ে ছিল তাই না?

ভাইমার হেসে বললেন, হ্যাঁ। ধবধবে সাদা বিশাল নেকড়ে। যাদের দেখলেন তাদের মধ্যে প্রথম ওই আসে এই ক্যাম্পে। ওকেই অন্য প্রাণীগুলোর দলপতি বলা যেতে পারে। এত সুন্দর প্রাণীগুলো মারার চেষ্টা হচ্ছে আপনি ভাবতে পারছেন। বিষণ্ণতা নেমে এল ভাইমারের মুখে।

অনীশ বলল, আমি এখন গ্রামে যাব কথা বলতে। দেখি ওদের মত পরিবর্তন করা যায় কিনা? তবে সময় তো বেশি নেই। হাতে আজ আর কালকের দিনটা আছে। পরশু ভোরে আমাকে ফিরতে হবে। এ দেশে আমাদের বন্যপ্রাণ সংস্থার প্রধান প্রতিনিধি যিনি, সেই ডক্টর মাধবনও আমাকে বলেছেন যে প্রাণীগুলোকে বাঁচাবার জন্য যেন আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। একটা কথা আপনাকে বলতে পারি যে আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না।

বিষণ্ণ হেসে ভাইমার বললেন, চেষ্টা করে দেখুন ওই নরবু বলে লোকটাকে অভিযোগ ওঠাতে রাজি করাতে পারেন কিনা? ভাইমার কিন্তু একবারও বললেন না যে গতরাতে নরবুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা। অনীশও তাকে প্রশ্ন করা সমীচীন মনে করল না। ভাইমার এরপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে তুষারের মধ্যে দিয়ে এগোলেন অনীশকে কাঁটাতারের বাইরে বার। করে দেবার জন্য। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছে তার মুখ।

অনীশ বাইরে বেরোবার সময় তিনি একবার শুধু বললেন, তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবেন। দুপুরের পর থেকেই আবার গতকালের মতো প্রকৃতির রূপ বদলাতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে তুষার পড়তে শুরু করবে।

পাইনবনে প্রবেশ করল অনীশ। আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলো আজ ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাতাসে পাইনবনের ডাল-পাতা থেকে টুপটাপ তুষারকণা ঝরে পড়ছে অনীশের গায়ে। বনটাকে যেন আজ আরও বেশি নিঝুম মনে হচ্ছে। অজানা কোনও এক কারণে যেন আজ থমকে আছে সারা বন। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে একসময় ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গ্রামে পৌঁছে গেল অনীশ। গ্রামে নরবু সহ অন্যদের জমায়েত দেখে অনীশের মনে হল লোকগুলো যেন তারই জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ অনীশ আজও গ্রামে ঢুকতেই নরবু তার হাতে গতদিনের মতোই একটা কাঠ-গোলাপের তোড়া দিয়ে তাকে সম্মান জানাল।

অনীশকে বেশ খাতির করে তারা একটা বাঁশের মাচায় বসাল। একজন একটা কাপে ধূমায়িত চা আর একটা পাত্রে চমরি গাইয়ের জমাট বাঁধা দুধ–ছুরপি দিয়ে গেল। একটা ছুরপির টুকরো মুখে ফেলে বার কয়েক চায়ে চুমুক দিল অনীশ। গ্রামের ঘরের চালাগুলো সাদা তুষারের চাদরে ঢেকে আছে। প্রথমে আসল প্রশ্নে না গিয়ে ঘরের চালগুলোর দিকে তাকিয়ে অনীশ বলল, বেশ তুষারপাত হয়েছে দেখছি!

নরবু বলল, হ্যাঁ, এবার শুরু হল। আর দু-তিনদিনের মধ্যে পথঘাট কিছুই চিনতে পারবেন না। সবই বরফের তলায় চলে যাবে। এই কটা মাস আমাদের খুব কষ্টে কাটে। বাইরে বেরোনো যায় না, চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ! খাবার দাবারেরও খুব কষ্ট। আর্মির লোকেরা কিছু খাবার দিয়ে যায় তাতেই চলে যায়। পশুপাখিদের আরও কষ্ট। তাদের তো আর খাবার দেয় না কেউ। জানেন এ সময় খিদের জ্বালায় নেকড়েরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। অনেক সময় ছাগল-ভেড়ার লোভে তারা গ্রামেও হানা দেয়।

চা-পান শেষ হবার পর অনীশ এবার প্রশ্ন করল, কাল যা বললাম সে ব্যাপারে কী ঠিক করলে তোমরা?

তার প্রশ্ন শুনে নরবু একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি সরকারি লোক তাই তুমি অনুরোধ করায় ব্যাপারটা নিয়ে আমরা ভেবেছি। আপাতত আমরা তিনমাস সময় দিতে রাজি তাকে। তবে কিছু শর্ত আছে। আমাদের কাছ থেকেই তাকে মাংস কিনতে হবে। শীতের এই তিনমাস আমাদের গ্রামের রুটির ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। বেশি কিছু নয় চল্লিশ বস্তা আটা। পয়সা দিলে আমরাই সেগুলো সংগ্রহ করে আনব।

আমাদের গ্রামে কোনও স্কুল নেই। স্কুল খুলব। সেই স্কুলের একজন মাস্টারের বেতন দিতে হবে সাহেবকে। আমার নাতি মাস্টার হবে। আমার নাতি গ্যাংটক থেকে মাস্টারি পাশ করে ফিরছে। আজই তার গ্রামে ফেরার কথা। সেই চালাবে স্কুলটা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা নেকড়েগুলোকে সামলাতে হবে সাহেবকে। ওই খামারের বাইরে তাদের বার করা চলবে না। যদি গ্রামের একটা মানুষেরও কোনও ক্ষতি হয় তবে আমরা খামারে আগুন লাগিয়ে দেব।

অনীশ নরবুর কথা শুনে বুঝতে পারল যে ব্যাপারটা আপাতত মেনে নিতে রাজি হয়ে গেছে নরবু। হয়তো গতরাতে ভাইমারের সঙ্গে আরও কিছু বোঝাপড়া হয়ে গেছে নরবুর। সেটা অর্থনৈতিক লেনদেনও হতে পারে। নরবুর কথাই গ্রামের মানুষের কাছে শেষ কথা।

অনীশ বলল, ভাইমার সাহেব যদি তোমাদের শর্ত মেনে নেন তবে তোমরা সরকারকে জানাবে তো যে নেকড়ে খামারটা আপাতত এখানে থাকুক? চিঠি দিয়ে জানাতে হবে কিন্তু। সেটা আমি নিয়ে যাব। সরকারের ঘরে জমা দেব।

নরবু বলল, আমরা কেউ লিখতে পড়তে জানি না। গতবার আমার নাতিই চিঠিটা লিখে সরকারের ঘরে জমা দিয়েছিল। আমরা শুধু টিপসই দিয়েছিলাম। তুমি কাগজ তৈরি করো। নাতি ফিরলে সেটা দেখব। সব ঠিক থাকলে টিপ সই দিয়ে দেব।

পাহাড়ি লোকরা একবার কথা দিলে সেটা রাখে এটা শুনেছে অনীশ। যদিও নরবুর নাতির ওপর ব্যাপারটা কিছুটা ঝুলে রইল তবে সে শিক্ষিত ছেলে। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তাকে অনীশ বোঝাতে সক্ষম হবে। এই ভেবে অনীশ বলল, ঠিক আছে আমি কাগজ তৈরি করছি। নাতি এলে তাকে দেখিয়ে তবে সই কোরো। কিন্তু সে ঠিক আসবে তো? আমার হাতে শুধু। কালকের দিনটাই আছে।

নরবু বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে আজ রাতেই বা কাল ভোরে চলে আসবে।

এরপর নরবুর সঙ্গে আরও কিছু টুকটাক কথা বলে অনীশ উঠে পড়ল। ড্রাইভার পবন তাকে ঢাল বেয়ে পাইনবনের মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে পবন বলল, একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি স্যার। এই বোকেটা দেখে মনে পড়ল। কাল যখন নরবু গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছিল তখন তার হাতে কিছু ছিল না। কিন্তু যখন সে বন ছেড়ে বেরোল। তখন তার হাতে এই কাঠগোলাপের বোকেটা ছিল। হয়তো বা এটা ভাইমার সাহেবই তাকে দিয়েছেন?

অনীশ কথাটা শুনে হেসে বলল, না, ভাইমার সাহেবের এ ফুলে অ্যালার্জি আছে। যে কারণে গতকাল ফুলের বোকেটা ফেলে দিতে হল আমাকে। নরবু ওটা অন্য কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে। আমার ধারণা নরবুর সঙ্গে সাহেবের কোনও গোপন চুক্তি বা লেনদেন হয়েছে। যা নরবু অন্যদের বলতে চাইছে না। ও কারণেই নরবু সাহেবের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। যাই হোক, যে ভাবেই হোক ব্যাপারটা ভালো হল। প্রাণীগুলো আপাতত কিছুদিনের জন্য বিপদমুক্ত হল। কথাগুলো বলে পবনের থেকে বিদায় নিয়ে পাইবনে ঢুকল অনীশ।

ক্যাম্পে ফিরে কোনও কাজ নেই। কাজেই গতদিনের মতো জঙ্গল ভেঙে উলটোদিকের ঢাল বেয়ে গাড়ির রাস্তায় নেমে এল অনীশ। আজ রাস্তা তুষারে ঢাকা। মনটা বেশ খুশি লাগছে অনীশের। যে কাজের জন্য সে এসেছিল সে কাজে সম্ভবত সে সফল হতে চলেছে। প্রাণীগুলোকে আপাতত রক্ষা করার পথ পাওয়া গেছে। সরকার এখন আর গ্রামবাসীদের অজুহাত দিতে পারবে না প্রাণীগুলোকে মারার ক্ষেত্রে। তুষার মাড়িয়ে আগের দিনের মতোই হাঁটতে লাগল সে।

আগের দিন অনীশ যেখানে গিয়ে বসেছিল তার কাছাকাছি গিয়ে অনীশ দেখতে পেল গতদিনের সেই সাঁজোয়া আর্মি জিপটা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই পাথরটার ওপর বসে চুরুট খাচ্ছেন লেফটানেন্ট ছেত্রী।

অনীশ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাবলাম হয়তো আপনার সঙ্গে এখানে এলে দেখা পাব। দেখা না হলে ফোন করতাম।–একথা বলে তিনি পকেট থেকে একটা চুরুটের বাক্স বার করে অনীশের হাতে ধরিয়ে বললেন, এটা আমার উপহার। খাঁটি হাভানা চুরুট। আপনি রাখুন।

অনীশ খুব বেশি ধূমপান না করলেও বাক্সটা নিল। তার থেকে একটা চুরুট বার করে মুখে দিয়ে লেফটানেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাক্সটা ওভারকোটের পকেটে রাখল।

লেফটানেন্ট ছেত্রীই তার লাইটার দিয়ে অনীশের চুরুটটা জ্বালিয়ে দিলেন। বেশ কয়েক মুহূর্ত দুজনে নিঃশব্দে ধূম্র উদগিরণের পর ছেত্রী জানতে চাইলেন, গ্রামে গেছিলেন? কী বলল ওরা?

অনীশ সতর্ক হয়ে গেল। ছেত্রীরা চাইছেন না ক্যাম্পটা এখানে থাকুক। হয়তো দু-পক্ষের মিটমাট হতে চলেছে শুনলে ব্যাপারটায় তারা বাগড়া দিতে পারে। তাই সে কৌশলে বলল, তেমন কিছু নয়। ওদের বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করছি আর কী।

লেফটানেন্ট এরপর জানতে চাইলেন, ক্যাম্পের সব কর্মচারীকে দেখেছেন আপনি? আমার ফাইলে দেখা ছবির সঙ্গে কারও মিল পেলেন?

অনীশ জবাব দিল, হ্যাঁ, সবাইকে দেখেছি। তবে আপনার ফাইলের ছবির সঙ্গে কারো মিল নেই।

অনীশের মনে হল যে উত্তরটা শুনে ঠিক যেন খুশি হলেন না ছেত্রী। কী যেন একটু ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, আর নেকড়েগুলোকে দেখেছেন?

অনীশ বলল, হ্যাঁ, সব কটাকে দেখেছি। কাল চাঁদের আলোতে তুষারপাতের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছিল ওরা। খুব সুন্দর প্রাণী। কিন্তু ওরাতো মানুষ নয়, ওরাও ওয়ান্টেড নাকি?

অনীশ হেসে কথা শেষ করলেও মৃদু খোঁচা ছিল তার শেষ কথায়। কিন্তু লেফটানেন্ট সেটা গায়ে মাখলেন না। তিনি বললেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার! ওপারের সেনারা মানে চীন সেনারাও নেকড়েগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী! সীমান্তে দু-দেশের সেনাদের মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং হয় জানেন নিশ্চয়ই? কাল তেমনই একটা মিটিং ছিল। ওদের সেনাদের কাছে কীভাবে খবর গেছে যে গ্রামবাসী আর সরকার ক্যাম্পটা তুলে দিতে চায়। ওরা বলছে ওরা নেকড়েগুলোকে নিতে চায়। নেকড়েগুলো তো ওদেশ থেকেই এদেশে ঢুকেছিল তাই ওরা প্রাণীগুলোর দাবিদার। কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক পথ ভুলে ওদেশে ঢুকে কিছুদিন হল ওদের সেনাদের হাতে আটকে আছে। নেকড়েগুলোকে পেলে তাদেরও মুক্তি দেবার প্রস্তাব দিচ্ছে ওরা। অথচ যে সব নির্দোষ ভারতীয় নাগরিককে ওরা বন্দি করে রেখেছে তাদের কিছুতেই আগে মুক্তি দিতে রাজি হচ্ছিল না ওরা। খালি বলছিল যে ওই নিরীহ ভারতীয় নাগরিকরা নাকি আসলে গুপ্তচরবৃত্তি করতে ঢুকেছিল ওদেশে। তাই তাদের হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। হঠাৎ চীনা সৈনিকরা এত বন্যপ্রাণপ্রেমী হয়ে উঠল কেন বুঝতে পারছি না।

অনীশ বেশ আশ্চর্য হল তার কথা শুনে। একইসঙ্গে তার ভালোও লাগল কথাটা জেনে। সে বলল, প্রস্তাবটা তো ভালোই। প্রাণীগুলো তাহলে তাদের দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেই তো সবদিক বজায় থাকে। ক্যাম্পও থাকল না আবার প্রাণীগুলোও বাঁচল।

অনীশের কথা শুনে লেফটানেন্ট বললেন, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। প্রাণীগুলো আমরা এভাবে তুলে দিতে পারি না ওদের হাতে। একথা ঠিক যে ক্যাম্পের নেকড়েগুলো ওদেশ থেকেই এদেশে এসেছে। কিন্তু ওরা এখন আমাদের সম্পত্তি। সুন্দরবনের বাঘও তো সীমানা মানে না। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াত করে। যখন যে দেশে বাঘ ধরা পড়ে তখন সেটা তারই সম্পত্তি হয়। এক্ষেত্রেও তেমনই ব্যাপার। ওভাবে নেকড়েগুলোর হস্তান্তর করা যাবে না। নেকড়েগুলোকে আমরা বাঁচিয়ে রাখব না মারব সেটা এখন একান্তই আমাদের দেশের সরকারের ব্যাপার।

কথাটা শুনে অনীশ চুপ করে গেল। সামান্য কটা নিরিহ প্রাণীর দামের চেয়েও, এমনকী মানুষের জীবনের চেয়েও দু-দেশের সরকারি ফাইলের লাল ফিতের ক্ষমতা অনেক বেশি।

কিন্তু এরপরই চারপাশে হঠাৎ কেমন যেন অন্ধকার নেমে এল। ঘড়িতে সবে মাত্র বেলা দশটা বাজে। আকাশের দিকে তাকিয়ে লেফটানেন্ট বললেন, আজ দুপুরের আগে থেকেই তুষারপাত হবে মনে হয়। চলুন আপনাকে নেকড়ে ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে আসি। গাড়িতে উঠে বসুন।

সত্যি চারপাশের প্রকৃতি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যেন অন্য রূপ ধারণ করেছে। ব্যাপারটা অনুধাবন করে অনীশ লেফটানেন্টের সঙ্গে চড়ে বসল তার গাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামল ক্যাম্পের কাছাকাছি জায়গাতে। গাড়ি থেকে নামার সময় ছেত্রী সাহেব শুধু বললেন, কোনও প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন আমাকে।

গাড়ি থেকে নেমে অনীশ এগোল ক্যাম্পের দিকে। আজও ক্যাম্পের সামনের চত্বরে কোনও লোকজন নেই। অনীশ গেট খুলে ভিতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হল। তার সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাতাস সোঁ-সোঁ শব্দে ধেয়ে আসতে লাগল পাহাড়ের দিক থেকে। কোনওরকমে মাথার টুপিটাকে সামলে তুষারের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে অনীশ বারান্দায় উঠে প্রবেশ করল তার ঘরে। হঠাৎ তার খেয়াল হল যে হাতের পুষ্পস্তবকটা তার সঙ্গে আনা উচিত হয়নি। সে সেটা জানলা গলিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করলেন ভাইমার। তিনি প্রথমে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে দ্বিপ্রহরে আপনার খাবারের ব্যবস্থা সম্ভব হল না বলে। ভাঁড়ারে একদানাও খাবার নেই। ভাইমারের মুখমণ্ডল বেশ থমথমে, চিন্তান্বিত।

অনীশ বলল, আপনি বিব্রত হবেন না। দুটো দিন চালিয়ে নেবার মতো শুকনো খাবার আমার কাছে আছে।

ভাইমার এরপর বললেন, কী বলল গ্রামবাসীরা?

অনীশ উৎফুল্লভাবে ব্যাপারটা জানাল ভাইমারকে। কিন্তু ভাইমারের মুখমণ্ডলের তেমন। কিছু পরিবর্তন হল না।

তা দেখে অনীশ বলল, আপনি কি ওদের প্রস্তাবে সম্মত নন? আপনি এত চিন্তান্বিত কেন?

ভাইমার বললেন, আমি সম্মত। আপনি চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করুন। আসলে আমি খুব মানসিক চাপে আছি। ওপার থেকে রসদ নিয়ে দলটা আজও, এখনও এল না। আমাদের কথা বাদ দিন। কিন্তু দু-দিন হল পশুগুলোর মুখে একটুকরো খাবার তুলে দিতে পারিনি।

অনীশ বলল, আপনি আজকের রাতটা দেখুন। যদি রসদ না আসে তবে কাল সকালে গ্রামে গিয়ে অন্তত পশুগুলোর জন্য মাংস সংগ্রহ করে আনব। আশা করি তারা আপত্তি করবে না।

ভাইমার শুধু বললেন, দেখা যাক কী হয়? একথা বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ভাইমার চলে যাবার পর দরজা-জানলা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল অনীশ। বাইরে থেকে ভেসে আসতে লাগল বাতাসের শব্দ। বাতাসের ধাক্কায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠতে লাগল দরজা-জানলাগুলো।

শেষ বিকালে বিছানা থেকে উঠল অনীশ। দরজাটা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তুষারপাত হয়েই চলেছে। পেঁজা তুলোর মতো তুষার ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে আকাশ থেকে। এত ঠান্ডা যে বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না অনীশ। পিছু ফিরে সে যখন ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে ঠিক তখন একটা জিনিসের উপর নজর পড়ল তার। কাঠের প্যানেল অলা দরজার পাল্লার নীচের দিকে কেমন যেন লম্বা লম্বা দাগ! কাঠের ছিলকা উঠেছে সেখান থেকে। এই আঁচড়ের দাগগুলো কি আগেই ছিল? কে জানে?

ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে সেজবাতিটা জ্বালাল অনীশ। ঠিক তারপরই বাইরে ঝুপ করে অন্ধকার নামল। অনীশ কাগজকলম বার করে চুক্তিপত্রটা আর গ্রামবাসীরা যে চিঠি সরকারকে দেবে তার খসড়া তৈরি করতে বসল। লিখতে লিখতেই অনীশ বুঝতে পারল বাইরে বাতাসের দাপট আবার শুরু হয়েছে। দরজা-জানলার পাল্লাগুলো মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। আর এরপরই হঠাৎ একসময় বাড়ির পিছন দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল নেকড়েগুলোর ডাক। না, ঠিক গর্জন নয়, যেন করুণ স্বরে আত্মবিলাপ করে চলেছে প্রাণীগুলো।

ভাইমারের কথাটা মনে পড়ল অনীশের। প্রাণীগুলো দু-দিন খায়নি। সম্ভবত অন্ধকার নামার পর ঘুম ভেঙে খিদের জ্বালায় কাঁদছে ওরা। কী করুণ সেই ডাক! লেখা থামিয়ে কিছুক্ষণ সেই ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলোর কান্না শুনল অনীশ। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল। রাত আটটা নাগাদ লেখার কাজ শেষ হল অনীশের। ততক্ষণে অবশ্য নেকড়ের কান্না থেমে গেছে। বিস্কুট আর জল খেয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় চলে গেল অনীশ।

বেশ অনেকক্ষণ ঘুমাবার পর হঠাৎ কীসের একটা শব্দে যেন ঘুম ভেঙে গেল অনীশের। তার রেডিয়াম লাগানো ঘড়িতে রাত আড়াইটে বাজে। শব্দটা বুঝতে পারল সে। দরজাটা মাঝে মাঝে কাঁপছে। তাতেই শব্দ হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটা নাকি? কিন্তু তাতে তো এতটা শব্দ হবার কথা নয়। ঠিক যেন কেউ ঘা দিচ্ছে দরজায়। অনীশকে কেউ ডাকছে নাকি? সে একবার বলল, কে? তার গলার আওয়াজে মুহূর্তের জন্য শব্দটা যেন থামল। তারপর আবার হতে শুরু করল।

অনীশ কম্বল ছেড়ে উঠে বসে টর্চের আলো ফেলল দরজার ওপর। আলোটা ওপর থেকে নামতে নামতে স্থির হয়ে গেল কাঁপতে থাকা দরজার নীচের দিকে। চমকে উঠল অনীশ। দরজার একটা পাল্লার নীচের দিকে একটা ছোট ছিদ্র তৈরি হয়েছে। আর তার মধ্যে দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে তীক্ষ্ণ নখর যুক্ত একটা থাবা! নেকড়ের থাবা। হিংস্র থাবাটা একবার ফুটো দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকছে, আবার বেরোচ্ছে! প্রাণীটা যেন পাল্লার নীচের প্যানেলটা ভেঙে ঘরের ভিতর ঢোকার চেষ্টা করছে! ব্যাপারটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অনীশ খাট ছেড়ে লাফিয়ে নেমে টেবিলের বাতিটা জ্বালিয়ে নিল। হ্যাঁ, সে এবার আরও স্পষ্ট দেখতে পেল সেই থাবাটা। সেটা ঘরে ঢুকে বাইরে বেরোবার সময় প্রচণ্ড আক্রোশে যেন ফালা ফালা করে দিচ্ছে পাল্লা সংলগ্ন কাঠের মেঝেটাকে। ভাইমার আর তার সঙ্গীরা এখন কোথায়? অনীশ একবার চিৎকার করার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রচণ্ড উত্তেজনায় তার গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। আর এরপরই আরও ভয়ংকর কাণ্ড ঘটল।

পাল্লার নীচের ফুট দুই চওড়া কাঠের প্যানেলটা হঠাই পাল্লা থেকে খসে ছিটকে পড়ল ঘরের ভিতর। কয়েক মুহূতাঁর নিস্তব্ধতা। আর তারপরই সেই ফোকর দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল একটা বিশাল নেকড়ের মাথা! বাতির আলোতে দেখা যাচ্ছে প্রাণীটার চোয়ালে সার সার হিংস্র দাঁতের পাটি, টকটকে লাল জিভ। লোলুপ দৃষ্টিতে অনীশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রাণীটা। তার চোয়ালের দু-পাশ বেয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে।

হিম হয়ে গেল অনীশের শরীর। সম্মোহিতের মতো বেশ কিছুক্ষণ তারা চেয়ে রইল পরস্পরের দিকে। প্রাণীটা এবার মাথা দিয়ে চাপ দিতে লাগল পাল্লার ওপরের প্যানেলটাকে ভেঙে ফেলার জন্য। একটা মৃদু মড়মড় শব্দ হতে লাগল সেই কাঠের প্যানেল থেকে। এবার হুঁশ ফিরল অনীশের। ওই কাঠের প্যানেলটা ভেঙে দিতে পারলেই হিংস্র প্রাণীটা তুড়ি মেরে ঘরের ভিতরে ঢুকে যেতে পারবে। অনীশের কাছে কোনও অস্ত্র নেই ক্ষুধার্ত নেকড়েটাকে রোখার মতো। মুহূর্তর মধ্যে কর্তব্য স্থির করে নিল অনীশ। এতে যা হবার তা হবে। অনীশ টেবিল থেকে তুলে নিল তেলভর্তি কাচের বাতিটা। তারপর দু-পা এগিয়ে নেকড়ের মাথাটা লক্ষ্য করে বাতিটা প্রচণ্ড জোরে ছুঁড়ে মারল। চৌকাঠের কাছে নেকড়ের মাথার ওপর আছড়ে পড়ে জোর শব্দে চুরমার হয়ে গেল বাতিটা। একটা রক্ত জল করা বীভৎস আর্তনাদ করে মাথাটা দরজার বাইরে বার করে নিল শ্বাপদটা। সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল এরপর।

অন্ধকার ঘর। অনীশের হঠাৎ মনে হল, প্রাণীটা যদি আবার ফিরে আসে তখন? জানলাটা খুলে দিল সে। আবছা আলোতে ভরে উঠল ঘর। বাইরে তখনও তুষারপাত হয়েই চলেছে। বাকি রাতটা সেই আধো অন্ধকার ঘরে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিল অনীশ। তবে নেকড়েটা আর ফিরে এল না। শেষ রাতে তুষারপাত যেন কিছুটা কমে এল। আবছা আলো ফুটে উঠল বরফ পাহাড়ের মাথায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *