১. মৃতদেহ তিনটে

মৃত্যুর আলো সৈকত মুখোপাধ্যায়

০১.

মৃতদেহ তিনটে প্রথম দেখেছিল হরিণডুবি গ্রামের সোনারু মাঝি। হেমন্তের কুয়াশা মাখা ভোরে সোনারু তার ছাগল চারটেকে নিয়ে জয়ন্তী নদীর শুকনো খাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিল।

রোজই যায়। নদীর চর ধরে পশ্চিমদিকে কিছুটা এগোলে দেখা যায়, এক জায়গায় কিনারা থেকে জঙ্গল একটু পেছু হটে গেছে। সেইখানটাতেই, বন আর বালির চরার মাঝখানে পলিমাটির এক ফালি জমি কচি সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে। ওই ঘাসজমিটায় ছাগলগুলোকে চরতে দিয়ে সোনারু বসে থাকে। থাকতেই হয়, চলে এলে হয় না। বক্সা টাইগার রিজার্ভের গা ঘেঁষা এইসব গ্রামে কখনও-সখনও জঙ্গল থেকে চিতাবাঘ চলে আসে, আর ছাগল চিতাবাঘের প্রিয় খাদ্য। হল্লা করলে বাঘ পালায়। ছাগল বাঁচে। সেইজন্যই বসে থাকা। আর, ঘন্টা দেড় দুই সোনারু এখানে বসে থাকলে সংসার কিছু অচল হয়ে যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, আশি বছরের বুড়ো যদি মরেই যায়, তাতেও কারুর কিছু যাবে আসবে না।

সত্যি কথা বলতে গেলে এটাও বলতে হয়, সোনারু নয়, ছাগল চারটেই সেদিন প্রথম বুঝেছিল ঘাসজমির ওপর অস্বাভাবিক কিছু পড়ে আছে। তারা ওই জায়গাটায় পৌঁছিয়ে জমিতে পা গেঁথে সোনারুকে পেছনদিকে টানছিল। মা মা আওয়াজ করে ওদিকে যাবার ব্যাপারে প্রবল অনিচ্ছা জানাচ্ছিল।

ব্যাপারটা কী? এ শালারা ঘাবড়ায় কী দেখে? ভাবল সোনারু। ছানিপড়া চোখদুটো কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই খয়েরি পলি আর সবুজ ঘাসের মধ্যে থেকে আলাদা করে সে দেখতে পেল উর্দি পরা তিনটে মানুষের চেহারা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে।

মরা মানুষের পড়ে থাকার মধ্যে একটা বিশেষ ভঙ্গি থাকে–সে চিৎ হয়েই পড়ুক আর উপুড় হয়ে। কাউকে বলে দিতে হয় না যে, দেহটায় আর প্রাণ নেই। কেমন যেন ন্যাতানো ভিজে তুলোর পুতুলের মতন হয়ে যায় শরীরটা। সোনারুকেও বলে দিতে হল না যে, লোকগুলো আর বেঁচে নেই। সে ছাগল চারটেকে সামনে তাড়িয়ে নিয়ে, আশি বছর বয়সে যতটা দৌড়নো যায় ততটাই দৌড়ে, গ্রামের বটতলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং রিভারবেডের দিকে একটা হাত তুলে অর্থহীন চিৎকার ছাড়তে লাগল। ততক্ষণে রাস্তা দিয়ে গ্রামের লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারা সোনারুকে একটু শান্ত করে তার কাছ থেকে গোটা ঘটনাটা শুনল।

তারপর নদীর তীরে সেই ঘাসজমিটাকে ঘিরে মানুষের বৃত্ত তৈরি হল। ফিরতি মানুষজনের মুখে মুখে ফিসফিস করে খবরটা ছড়াতে লাগল–জয়ন্তীর তীরে তিনটে ফরেস্টগার্ডের লাশ পড়ে আছে। তিনটে ফরেস্টগার্ড…মরে গেছে।

এইভাবে সেদিন সকালে সোনারুর বটতলায় আগমনের বড়জোর পনেরো মিনিটের মধ্যেই খবরটা ছড়াতে ছড়াতে পৌঁছে গেল গ্রামের প্রান্তে ঘন শাল জঙ্গলের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা হরিণডুবি বিট অফিসের ভেতর। সেখানে তখন ছিলেন বিট-অফিসার সজল দত্ত আর দুজন ক্লার্ক জীবন সিং আর গোপিনাথ মন্ডল। তারা তিনজনেই দৌড়লেন নির্দিষ্ট জায়গায় এবং যা দেখলেন তাতে তাদের মাথা ঘুরে গেল। জীবন আর গোপিনাথকে ওখানে পাহারায় রেখে সজলবাবু আবার দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এলেন বিট অফিসে এবং আর.টি.সেট চালু করে বক্সা টাইগার রিজার্ভের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার প্রমিত ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

প্রমিতের বয়েস আঠাশ। অরিজিনালি কলকাতার ছেলে। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসে যোগ দেবার পরে প্রথম তিন বছর কাজিরাঙায় কাটিয়ে তারপর দু-বছর হল বি.টি.আর-এ পোস্টিং পেয়েছে এবং হরিনডুবি বিটের দায়িত্বে রয়েছে। প্রমিত কাজ-পাগল ছেলে এবং দক্ষ অফিসার হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। সর্বোপরি যেহেতু সে এখনও বিয়ে থা করেনি তাই তার হাতে অফিসকে দেওয়ার মতন সময়ও প্রচুর। আলিপুরদুয়ারে বি.টি.আর-এর অফিস আর প্রমিতের কোয়ার্টার প্রায় পাশাপাশি। প্রতিদিনের মতন সেদিনও সকাল সাড়ে আটটাতেই সে অফিসে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল। রেডিয়ো অপারেটর যে মুহূর্তে বলেছে, স্যার, হরিণডুবি কলিং, সেই মুহূর্তেই সে গিয়ে কল রিসিভ করেছে।

উলটোদিক থেকে সজলবাবু ভয়ে এবং উত্তেজনায় খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না, তবে এইটুকু বলতে পেরেছিলেন যে তিনজন ফরেস্টগার্ড তাদের নাম বাবুয়া, সন্দীপ আর বিমল–তারা খুন হয়েছে।

সজলবাবুর মুখে এইটুকু শুনেই প্রমিত আর একমুহূর্ত দেরি করেনি। তখনি জিপ বার করে নিজেই ড্রাইভ করে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল হরিণডুবি। যাবার পথেই আলিপুরদুয়ার থানাকে ঘটনা সম্বন্ধে ইনফর্ম করে তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অকুস্থলে পৌঁছতে অনুরোধ করে এসেছিল। পুলিশ ঘটনার গুরুত্ব বুঝে দেরি করেনি। ও.সি. আলিপুরদুয়ার রতন বৈদ্যের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটা ফোর্স প্রমিতের পেছন পেছনই হরিণডুবি পৌঁছেছিল। তখন ঘড়িতে ঠিক নটা কুড়ি। হরিণডুবি বিট-অফিসের কম্পাউন্ডে গাড়িগুলো রেখে তারা সবাই জয়ন্তীর তীরে সেই জায়গাটায় পৌঁছেছিল যেখানে একের সঙ্গে অন্যের সামান্য দুরত্ব রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে শুয়েছিল তিনজন ফরেস্ট গার্ড বিমল, বাবুয়া আর সন্দীপ।

এই তিনজন ফরেস্টগার্ডের সঙ্গে প্রমিত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধুর মতন সময় কাটিয়েছে। বক্সার কুখ্যাত পোচারদের হাত থেকে অরণ্যকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রমিতই এই তিনজন স্পেশালি ট্রেইনড় যুবককে ভারতের বিভিন্ন রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে খুঁজে এখানে নিয়ে এসেছিল। এদের তিনজনের কম্যান্ডো ট্রেনিং-এর ব্যবস্থাও সেই করে দিয়েছিল। বিনিময়ে এই তিন যুবক গত একবছর ধরে বি.টি.আর-কে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল। ওদের দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পোচিং আর কাঠ চুরি।

সেই সকালে প্রমিত অবিশ্বাসের চোখে তার তিন নির্ভরযোগ্য যোদ্ধার মৃতদেহের দিকে চেয়েছিল। ওরা তিনজনেই চিৎ হয়ে পড়েছিল। তিনজনেরই বুকে একটা করে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। প্রমিত কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সামনাসামনি লড়াইয়ে ওদের কেমন করে কেউ এত পরিষ্কারভাবে মারতে পারে। এ তো মেশিনগানের শট নয় যে, ওরা প্রস্তুত হবার আগেই এলোপাথারি গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল। এ তো রীতিমতন টিপ করে, সময় নিয়ে, মারা হয়েছে।

কেমন করে…কেমন করে কেউ ওদের সামনে এসে, সেই সময়টা দিয়েও, বেঁচে ফিরে যেতে পারে! ওরা কী করছিল তা হলে? কেন উলটে মারেনি সেই আগুয়ান ঘাতককে?

এই প্রশ্নের ভার মাথায় নিয়ে হরিণডুবি বিট-অফিসের কাঠের বাড়িতে ফিরে এসেছিল প্রমিত। মৃতদেহগুলোকে পোস্টমর্টেমের জন্যে শিলিগুড়িতে রওনা করিয়ে দিয়ে ও.সি রতন বৈদ্যও এসেছিলেন তার সঙ্গে। প্রমিতের সামনেই তিনি ইন্টারোগেট করেছিলেন দুই ক্লার্ক জীবন সিং আর গোপিনাথ মণ্ডলকে। বিট-অফিসার সজলবাবুর সঙ্গেও অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন তিনি। সেই কথাবার্তায় যা জানা গিয়েছিল, তা রহস্যকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল।

বিট-অফিসের পেছনে ছোট্ট লিভিং-কোয়ার্টারে রান্নাঘর আর বাথরুম ছাড়া দুটো মাত্র কামরা। তার একটায় থাকতেন নিহত তিন ফরেস্টগার্ড, আর অন্যটায় থাকতেন বিট-অফিসার সজল দত্ত। তৃতীয় কোনও ঘর না থাকায় জীবন সিংহ আর গোপিনাথ মণ্ডল অফিসঘরের মেঝেতেই রাতে বিছানা পেতে শুতেন। লিভিং কোয়ার্টারের ঘরদুটোর পেছনদিকেও যেমন দরজা আছে তেমনি আরও একটা দরজা আছে অফিসঘরের দিকে। যখন ফরেস্টগার্ডরা গভীর রাতে সারপ্রাইজ চেকিং-এ বেরোতেন, তখন পেছনের দরজা দিয়ে না বেরিয়ে তারা অফিসঘরের মধ্যে দিয়েই বেরোতেন, কারণ সে ক্ষেত্রে, তারা বেরিয়ে যাবার পরে, জীবনবাবু কিম্বা গোপিনাথ মণ্ডল আবার ভেতর থেকে দরজায় খিল দিয়ে দিতে পারতেন। এই ব্যবস্থায় নিরাপত্তা ছিল। বেশি।

ঘটনার আগের রাতে ওরা যে যার নির্দিষ্ট ঘরেই ঘুমোচ্ছিল। এমন সময় অনেকদূর থেকে ভেসে আসা দুটো রাইফেল ফায়ারিং-এর আওয়াজে ওদের সকলেরই ঘুম ভেঙে যায়। একটা ফায়ারিং-এ ওরা জেগে ওঠে। তার প্রায় পাঁচ মিনিট বাদে দ্বিতীয় গুলির শব্দটা ভেসে আসে।

এমনিতে এই হেমন্তমাসে, যখন জঙ্গলের প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জমিগুলোতে পাকা ফসল বিছিয়ে আছে, তখন সারারাতই সেই ফসল নষ্ট করতে আসা হাতির পালকে তাড়াবার জন্যে এদিক ওদিকে ক্র্যাকার ফাটানো হয়। অনভ্যস্ত কানে ক্র্যাকারের আওয়াজ থেকে রাইফেলের গুলির আওয়াজ আলাদা করে চেনা কঠিন। কিন্তু হরিণডুবি বিট-অফিসে যারা ছিল তারা জঙ্গলের সমস্ত আওয়াজকে খুব ভালো করে চিনবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা শুধু যে গুলির আওয়াজকেই আলাদা করে চিনতে পেরেছিল তাইই নয়, সেই আওয়াজ জঙ্গলের ঠিক কোনখান থেকে এসেছে সেটা বুঝে নিতেও তাদের অসুবিধা হয়নি, বিশেষত, ওই দ্বিতীয় গুলির আওয়াজটা থেকে, যখন তাদের মাথা থেকে ঘুমের ঘোর সরে গেছে।

ওদের সন্দেহ ছিল না যে, ওই গুলির আওয়াজ এসেছে জঙ্গলের প্রান্তে জয়ন্তী নদীর বেড-এর ওপর থেকে। তার মানে পোচাররা জঙ্গলে ঢুকবার ধান্দা করছে।

জয়ন্তীর যে পাড়ে হরিণডুবি, তার ঠিক অন্য পাড়েই ভুটান। ও পাড়ে, নদীর কিনারার সামান্য জায়গা বাদ দিয়ে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের দেয়াল। ভুটান-গভর্নমেন্টের কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই ওই জায়গাটার ওপর। ওটা সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তাঞ্চল।

আর এ কথা সকলেই জানে যে, সন্ত্রাসবাদী আর চোরাশিকারি এখন সমার্থক। ভারতের বিভিন্ন বনাঞ্চলে টেররিস্টরাই চোরাশিকারের কাজটা করে, বিশেষ করে এই উত্তরপূর্ব ভারতের বনগুলোয়। এইভাবেই ওরা সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালাবার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করে। হাতির দাঁত, গন্ডারের খড়গ কিম্বা বাঘের চামড়ার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোনা জহরতের চেয়েও বেশি। ওইসব প্রাণীর দেহাংশ বিদেশে, বিশেষ করে চীনের চোরাবাজারে বিক্রি করে টেররিস্টরা তাদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ কেনে। এইভাবেই বোরো জঙ্গিদের হাতে এককালের অপরূপ মানস স্যাংচুয়ারি ছারখার হয়ে গেছে। লোয়ার অসমের এই টাইগার-স্যাংচুয়ারিতে আজ একটিও ডোরাকাটা বাঘ বেঁচে আছে কি না সন্দেহ। পোচারদের এর পরের লক্ষ বক্সা টাইগার রিজার্ভ। এই বনাঞ্চলও নানান দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী আর দুমুল্য কাঠের গাছের জন্যে বিখ্যাত। আর সেই ধনাগারে ঢুকবার সবচেয়ে সহজ রাস্তা জয়ন্তীর বেড পেরিয়ে হরিণডুবির মধ্যে দিয়ে। এর আগেও বহুবার এইভাবে জঙ্গলে ঢুকে লুঠপাট চালিয়ে গেছে চোরা শিকারিরা। বিগত এক বছরে, বিমল, বাবুয়া, সন্দীপেরা আসবার পর থেকে ওরা তিনজনে সিংহবিক্রমে চোরাশিকারিদের আটকাচ্ছিল। কাল রাতে গুলির আওয়াজ শুনে ওদের কারুর সন্দেহ থাকে না যে, কিছুদিন চুপচাপ কাটানোর পরে আবার পোচাররা জঙ্গলে ঢুকে জংলি জানোয়ার মারছে। তিন ফরেস্টগার্ড দ্রুত সাজপোশাক পরে নিয়ে ওদের মোকাবিলায় রওনা হয়ে যায়। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে দরজায় খিল তুলে দেন দুই ক্লার্কের মধ্যে একজনজীবন সিংহ। ও.সি. রতন বৈদ্যের প্রশ্নের। উত্তরে তিনি জানান, তখন রাত ঠিক দেড়টা।

সজলবাবু, জীবন কিম্বা গোপিনাথ, প্রত্যেকেই ওই তিন ফরেস্টগার্ডের বলবীৰ্য্য সম্বন্ধে এতটাই সংশয়হীন ছিলেন যে, তারা তারপরেই আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন। তারা জানতেন, পোচারদের সঙ্গে এনকাউন্টার যদি হয়ই, তাতে বিমল বাবুয়ারা একশোবারের মধ্যে একশোবারই জয়ী হবে। গত একবছরের নানান ঘটনা তাদের সেরকমটাই বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল।

কাজেই ঘণ্টাখানেক বাদে আবার যখন পরপর তিনটে ফায়ারিং-এর শব্দ ভেসে আসে তখন ঘুম ভেঙে গেলেও ওরা কোনও দুশ্চিন্তা করেনি। বিশেষত এবারের আওয়াজগুলো এসেছিল অনেকদুর থেকে, সম্ভবত নদীর অপর পাড়ে, ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে। তার মানে, ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিলেন, বিমল বাবুয়ারা ওদের তাড়িয়ে ছেড়েছে। পালাতে পালাতে টেররিস্টরা গুলি ছুড়ছে।

এর পরে সারারাত আর কোনও গুলির শব্দ পাওয়া যায়নি।

সকালেও যখন বিমল বাবুয়ারা ফিরল না তখনও ওরা কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা করেনি। কারণ একবার বেরোলে ওই তিনজন ফরেস্টগার্ড সাধারনত পুরো বিট টহল দিয়ে আসত; পোচারদের মধ্যে দুয়েকজন তো এদিকে ওদিকে ছিটকে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, তাই। এমন টহলদারীতে প্রচুর সময় লাগে। সজলবাবুরা নিশ্চিন্তমনেই অফিস খোলার উদ্যোগ করছিলেন। এমন সময় গ্রামবাসীদের মুখে সেই দুঃসংবাদ এসে পৌঁছয়–ওরা তিনজনেই মারা পড়েছে।

যেখানে মৃতদেহ পড়েছিল সেই জায়গাটার আশেপাশে অনেকখানি জায়গা জুড়ে তল্লাশি চালান রতন বৈদ্য এবং তার সহকর্মীরা। তাদের এই উদ্যেগ সম্পূর্ণ বিফলে যায়নি। যেখানে বিমল সন্দীপ আর বাবুয়ার মৃতদেহ পড়েছিল, তার থেকে কিছুটা দূরেই রিভারবেডের ওপর পাওয়া যায় দুটো কার্তুজের খোল। তার মানে ওইখানে দাঁড়িয়েই প্রথম দুটো গুলি চালানো হয়েছিল যে দুটো গুলির আওয়াজ শুনে বিমলরা বেরিয়ে এসেছিল। গুলি চালানোর জায়গাটা সম্বন্ধে বিমলদের আন্দাজ কত নির্ভুল ছিল, এটা তার প্রমাণ।

কিন্তু এটা বুঝতেও প্রমিত কিম্বা রতন বৈদ্যের বেশি সময় লাগেনি যে, ওই দুটো গুলি কাউকে মারার জন্যে চালানো হয়নি। ধু ধু শূন্য রিভারবেডের মধ্যে রাত দেড়টার সময়ে মারার মতন কোনও মানুষ বা প্রাণীকে পাওয়া মুস্কিল। ওই গুলিদুটো চালানো হয়েছিল ঠিক ওই জায়গায় তিন ফরেস্টগার্ডকে টেনে আনার জন্যে। শব্দের উৎসটাকে যাতে ফরেস্টগার্ড তিনজন নির্ভুলভাবে চিনে নিতে পারে, সেইজন্যই সম্ভবত, দুবার গুলি চালানোর মধ্যে পাঁচ মিনিট গ্যাপ রাখা হয়েছিল।

এবং এই প্ল্যান একশোভাগ সাকসেসফুল হয়েছিল। বিমল, বাবুয়ারা কোয়ার্টার থেকে বেরোনোর সময়েই জানত তাদের ঠিক কোনখানটায় যেতে হবে, ঠিক কোনখান থেকে ভেসে এসেছে গুলির শব্দ।

ওরা রিভারবেডের কাছাকাছি এসে বুকের ওপর শুয়ে পড়েছিল। কারণ জঙ্গলের বাইরে, খোলা জায়গায় উঠে দাঁড়ানোর মানে রিভারবেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনও ঘাতকের সামনে সহজ টার্গেট হয়ে যাওয়া। ওরা নদীর তীর অবধি বুকে হেঁটে, ক্রল করে এগিয়েছিল। ওদের শরীরের ভারে দুমড়ে নুয়ে পড়া ঘাস থেকে ওই সরীসৃপ-গতির ব্যাপারে রতন বৈদ্যের লোকজন নিশ্চিত হয়েছিল। তারপর নিশ্চয় ওরা ভালো করে চেয়ে দেখেছিল, চারপাশে কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কি না। দেখে নিয়েছিল দুদিকের রিভারবেড, যেখানে একটা পাখিরও লুকিয়ে থাকার মতন কোনও আড়াল নেই। দেখে নিয়েছিল নিশ্চয় নদীর অপর তীরটাকেও। সেই অহল্যা জমিতেও একটাও গাছের আড়াল ছিল না যেখানে কোনও মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। অপর তীরের পাহাড়গুলোকে ওরা নিশ্চয় দেখতে পায়নি। কারণ গতকাল ছিল দ্বিতীয়া, আকাশে চাঁদ ছিল নামমাত্র, বাতাসে ছিল হালকা কুয়াশার চাদর, এবং রাত ছিল গভীর। অর্থাৎ নদীর তীরভূমির ওপাড়ে আর কিছু ওদের চোখে পড়ারই কথা নয়।

যুক্তি বলে, একই কারণে ওই পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মানুষের পক্ষেও ওদের দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়।

অথচ পেয়েছিল।

এক বা একাধিক রাইফেলধারী শার্প-শুটার নদীর অন্যপাড়ের পাহাড়ের ওপরে কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই তিন ফরেস্টগার্ডকে এতটাই নিখুঁতভাবে দেখতে পেয়েছিল যে, তারা অনায়াসে ওদের হৃদপিণ্ড ছুঁড়ে দিতে পেরেছিল।

হ্যাঁ, যে বুলেটগুলোতে ওদের মৃত্যু হয়েছে সেগুলো যে উলটোদিকের ওই পাহাড়ের মাথা থেকে ছুটে এসেছে সে ব্যাপারে ও.সি. রতন বৈদ্য এবং প্রমিত ব্যানার্জি দুজনেই নিশ্চিত। প্রথম কারণ জীবনবাবু, গোপিনাথবাবুদের সাক্ষ্য–যেখানে ওরা বলেছেন পরের তিনটে ফায়ারিং এর শব্দ ভেসে এসেছিল অনেক দূর থেকে।

দ্বিতীয়ত, নদীর বেড কিম্বা অপর পাড়ের তীরভূমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আগে যে দুটো বুলেটের কার্তুজের কথা বলা হয়েছে তা ছাড়া অন্য কোনও কার্তুজের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার মানে পাহাড়ের ওপরে কোথাও সেগুলো পড়ে আছে।

তৃতীয় এবং সবচেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ মৃতদের শরীরের বুলেটের ক্ষতের চেহারা। তিনজনের বুকে যেখানে বুলেটগুলো ঢুকেছে সেখানে ক্ষতের আকৃতি গোল নয়–লম্বাটে। এরকমটা একমাত্র তখনই হয় যখন বুলেট শরীরে ঢোকে কোণাকুণি ভাবে, ওপর কিম্বা নীচ থেকে। এক্ষেত্রে নীচ থেকে আসার কোনও জায়গা নেই। অতএব ধরে নেওয়া যায় পাহাড়ের মাথা থেকেই নীচের দিকে কোণাকুণিভাবে ছুটে এসেছিল বুলেটগুলো। তাছাড়া বুলেট যতদূর থেকে আসে, তত ক্ষতের চারিপাশে জমে থাকা বারুদের পরিমাণ কমে যায়। এক্ষেত্রে বিমল বাবুয়াদের বুকের ক্ষতের চারিপাশে বারুদের দাগ একেবারেই ছিল না। এই বুলেটগুলো সন্দেহাতীতভাবে বহুদূরের পথ পেরিয়ে এসেছিল।

যে প্রশ্নটার উত্তর প্রমিত এবং রতন বৈদ্য কেউই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা হল, অমন কুয়াশা আর অন্ধকারের মধ্যে শু্যটাররা কেমন করে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা বিমল, সন্দীপ, বাবুয়াদের দেখতে পেল? নাইট ভিশন টেলিস্কোপিক সাইট-এর কথা একবার ওদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু ওরা জানত পৃথিবীর আধুনিকতম টেলিস্কোপিক সাইটের রেঞ্জও ওই দূরত্বের দশভাগের একভাগ।

জিপের দিকে ফিরতে ফিরতে প্রমিত বলল, কয়েকটা ব্যাপার মাথায় ঢুকছে না মিস্টার বৈদ্য।

কী বলুন তো? বছর চল্লিশের বুদ্ধিমান মানুষটি বললেন।

আজ দিনের আলোয় আমরা এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়েছিলাম। শুধু আমরা কেন, সকাল থেকে অজস্র গ্রামবাসীও ঘুরে গেছে ওখানে। কিন্তু একটাও গুলি ছুটে আসেনি।

আজ বলে নয়, এত বছরের মধ্যে কোনওদিন ওইদিকের পাহাড় থেকে গুলি ছুটে আসেনি–না দিনে, না রাতে। না আসাটাই স্বাভাবিক। দুদিকের তীরভূমির মধ্যে যা দূরত্ব তাতে গুলি ছুঁড়লে গুলির অপব্যয়। টার্গেটকে যেখানে দেখতে পাওয়া যায় না সেখানে যা হয় আর কি।

আজ প্রথম ওদিক থেকে গুলি ছুটে এল, তাও রাতে। এবং সেই গুলি টার্গেটে হিট করল। তার মানে ওরা কি দিনের চেয়ে রাতে ভালো দেখতে পাচ্ছে? যদি কোনও যন্ত্রের সাহায্যে এমন ক্ষমতা ওরা পেয়ে থাকে, তাহলে সেই যন্ত্র দিনের বেলায় ব্যবহার করছে না কেন? তাহলে তো অনেক বেশি শিকার পেয়ে যেত। আরও অনেকগুণে টেরিফাই করে দিতে পারত আমাদের।

রতন বৈদ্য বললেন, জানি না এর উত্তর কবে খুঁজে পাব। তবে আপাতত আজ থেকেই আপনি ওদিকের জঙ্গলে, মানে যেখান থেকে ভুটান পাহাড় দেখা যায় সেদিকে লোক যাতায়াত বন্ধ করে দিন। দিনে এবং রাতে।

একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রমিত বলল এটাই পোচাররা অনেকদিন ধরে চাইছিল– আমাদের ভয় পাইয়ে দিতে, আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে। আমি ওদের চারজনকে নিয়ে একটা ফাইট দিচ্ছিলাম। যুদ্ধটা আজকে শেষ হয়ে গেল। শুধু যদি বুঝতে পারতাম, কোন অস্ত্রের কাছে হারলাম!

.

০২.

বাবুয়া সন্দীপেরা যেদিন খুন হল তার পরে আরও চারটে দিন কেটে গেছে। মাঝের দিনগুলোয় মিডিয়ায় প্রবল হইচই হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে। উত্তরবঙ্গে তো বটেই, কলকাতার কাগজগুলোতেও একসঙ্গে তিনজন ফরেস্টগার্ডের খুন হওয়ার খবর যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রমিতকে প্রথম দুদিনে বেশ কয়েকবার টিভি ক্যামেরা ফেস করতে হয়েছে। প্রত্যেকবারই প্রবল। অস্বস্তি নিয়ে সে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিল। মিডিয়ার সামনে নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হয়েছিল তার।

সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রমিতের প্রশ্নোত্তরের পালাটা ছিল মোটামুটি এইরকম—

কারা মারল ওই তিনজনকে?

 প্রমিত জানাতে বাধ্য হয়েছিল, এর উত্তর সে জানে না।

পরের প্রশ্ন–এই ঘটনার পরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কর্মীদের সুরক্ষার জন্যে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?

প্রমিত বলেছিল, আপাতত আমরা নাইট-পেট্রোলিং বন্ধ রাখছি।

প্রমিতের এই উত্তর শুনে সাংবাদিকদের মুখগুলো বাঁকা হাসিতে ভরে গিয়েছিল। ছদ্ম বিনয়ের সঙ্গে তারা প্রশ্ন করেছিল তাহলে কি স্যার মাথায় যন্ত্রণা হলে মাথাটা কেটে ফেলাই একমাত্র রেমিডি? নাইট-পেট্রোলিং বন্ধ হয়ে গেলে বন্যপ্রাণীগুলোকে চোরাশিকারিদের হাত থেকে কে বাঁচাবে?

টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল প্রমিতের। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল–এই বনকে আমি আপনাদের থেকে কম ভালোবাসি না। গত দুবছর আমি ঘরবাড়ি ছেড়ে এই জঙ্গলে দিন রাত পড়ে থেকেছি সে শুধু মাইনের টাকা কটার জন্যে নয়, ওই ভালোবাসার টানে। বলতে ইচ্ছে করছিল–যে তিনটে ছেলের খুন হওয়ার খবর পেয়ে আপনারা আজ এখানে এসেছেন, তাদের আমিই সারা ভারতের ফরেস্ট সার্ভিস থেকে বেছে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। রাতের পর রাত আমি ওদের সঙ্গে এই জঙ্গলের রাস্তায় গুঁড়ি মেরে হেঁটেছি, ওদের এই জঙ্গল চেনাবার জন্যে। একটা পাঁউরুটি ছিঁড়ে চারজনে ভাগ করে খেয়েছি; একই বোতল থেকে জল। একটা বোল্ডারে হেলান দিয়ে বসে চারজনে সারারাত রিভারবেডের ঘাসজমির দিকে চেয়ে থেকেছি, যাতে বন্য জন্তুরা নিরাপদে গ্রেজিং করে ভোরবেলা জঙ্গলে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব? এইভাবে যেখানে টেররিস্টরা নিখুঁত লক্ষে মানুষ মারছে, সেখানে রাতের পর ওদিকে কারুর পা ফেলা মানে তো আত্মহত্যা করা।

সেসব কিছুই বলেনি প্রমিত। সরকারি কর্মীর আচরণবিধি মেনে শান্ত থেকেছে। বলেছে, আর একটু সময় দিন আমাদের। এভরিথিং উইল কাম আন্ডার কন্ট্রোল।

বলেছে বটে এ কথা। কিন্তু সে নিজেও জানে না কেমন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে হরিণডুবি বিট-কে, বক্সা টাইগার রিজার্ভকে।

তবে গতকাল থেকেই প্রমিত বুঝতে পারছিল যে, মিডিয়ার কৌতূহল অনেক কমে এসেছে। স্বাভাবিক। এক খবর নিয়ে বেশিদিন বাণিজ্য হয় না।

প্রমিত আজ সকাল নটা নাগাদ নিজের মারুতি জিপসিটা নিয়ে জলপাইগুড়ি গিয়েছিল। গিয়েছিল জলপাইগুড়ি জেলার ডেপুটি সুপারিন্টেডেন্ট অফ পুলিশ দেবেশ কাশ্যপের ফোন পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। দশটার মধ্যে দেবেশ কাশ্যপের বাংলোয় পৌঁছিয়ে গিয়েছিল প্রমিত। বাংলোতেই আসতে বলেছিলেন কাশ্যপসাহেব। সেখানেও তাঁর একটা অফিস আছে, ডিস্ট্রিক্টের। যে-কোনও বড় মাপের অফিসারের যেমন থাকে।

দেরাদুনের মানুষ দেবেশ কাশ্যপ নিজে একজন প্রকৃতি প্রেমিক। উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটা প্রকৃতি সংরক্ষণ উদ্যোগের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তাদের নানান ভাবে সাহায্য করেন। পোচারদের হাতে ফরেস্টগার্ডদের এই অসহায় মৃত্যু তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল, তাই তিনি নিজে থেকেই এই কেসটার তদন্তভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

প্রমিতের সঙ্গে দেবেশ কাশ্যপের আগে থেকেই যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। প্রমিত ঘরে ঢোকা মাত্র তিনি সাদরে তাকে ডেকে বসালেন। জানালেন, গতকালই পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিকের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। সেসবের থেকে এমন কিছুই জানা যায়নি যা ঘটনাটার ওপর নতুন করে আলোকপাত করে। জানা জিনিসকেই ওইসব রিপোর্ট কনফার্ম করেছে মাত্র। যেমন হাই ভেলোসিটি বুলেটের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে ওই তিনজনের। বুলেটগুলো এসেছে ভুটান সীমান্তের নো-ম্যান ল্যান্ডের দিক থেকে। প্রত্যেকের জন্যে একটাই বুলেট–যেন বুলেটের গায়ে বাবুয়া বিমলদের নাম লিখে পাঠানো হয়েছিল।

কাশ্যপ সাহেব চিন্তিত মুখে বলে চললেন বুঝলেন মিস্টার ব্যানার্জি, অ্যাকচুয়াল ওয়ারফেয়ারের সময় ফাইটার-প্লেন বম্বিং শুরু করার আগে মার্কার-প্লেন টার্গেটের কাছে উজ্জ্বল। আলোর বোমা ফেলে চলে যায়, যাতে বহুবারদের টার্গেটে হিট করতে অসুবিধে না হয়। ভেবেছিলাম এক্ষেত্রেও বাবুয়া কিম্বা সন্দীপদের ওপর কেউ জোরালো আলো ফেলেছিল; ওদের এক্সপোজ করে দিয়েছিল নদীর উলটোদিকে অপেক্ষা করে থাকা টেররিস্টদের কাছে। কিন্তু বোধহয় আমার সেই চিন্তা ঠিক ছিল না।

প্রমিত মাথা নীচু করে মন দিয়ে কাশ্যপ সাহেবের কথা শুনছিল। সে কোনও মন্তব্য করল না।

কাশ্যপ সাহেব বলে চললেন–ভেবেছিলাম ডেড বডিগুলোর আশেপাশে রিভারবেডের বালিতে পায়ের ছাপ পাব। বিশ্বাসঘাতকের পায়ের ছাপ। কিম্বা রঙমশালের মতন কোনও আলো ছড়ানো জিনিসের অবশিষ্টাংশ। কিন্তু না। কিচ্ছু পাইনি। আই ওয়াজ রং। আমার ট্রেইটর থিয়োরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

প্রমিত মুখ তুলে বলল, কিছু মনে করবেন না কাশ্যপ সাহেব। আপনি যদি বিমল, বাবুয়া আর সন্দীপের ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানতেন তাহলে শুরুতেই ট্রেইটর থিয়োরি নাকচ করে দিতেন।

একজন অর্ডারলি ট্রেতে করে দুটো প্লেটে আলুর পরোটা, সজি আর আচার নিয়ে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে ধূমায়িত চা। দেবেশ কাশ্যপ ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসে বেরোবেন এবং বোঝাই যাচ্ছে প্রমিতকে না খাইয়ে তিনি ছাড়বেন না। প্রমিতেরও বেশ খিদে পেয়েছিল। সে বেশি ভদ্রতা না করে প্লেট টেনে নিল।

দেবেশ কাশ্যপ একটুকরো পরোটা মুখে পুরে বললেন, তাই! কেমন ছিল ওদের ব্যাকগ্রাউন্ড?

প্রমিত খেতে খেতেই বলে চলল–আমি আর চিফ কনজার্ভেটর অফ ফরেস্ট অরিন্দম বসু সারা ভারতের ফরেস্ট সার্ভিস ক্যাডার থেকে খুঁজে খুঁজে ওই তিনজনকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা ছিল যাকে ইংরিজিতে বলে হ্যান্ড-পিক।

বাবুয়াকে নিয়ে এসেছিলাম মধ্যপ্রদেশ থেকে। ওর আসল নাম ছিল বাবুলাল মুন্ডা। বস্তারের একটা জঙ্গলঘেরা গ্রামেই ও জন্মেছিল। জঙ্গলকে তাই ও হাতের পাতার মতন চিনত। জঙ্গলের ভেতরে ওর চলাফেরা ছিল ঠিক চিতাবাঘের মতন দ্রুত কিন্তু নিঃশব্দ। কানহার জঙ্গলে পোচারদের সঙ্গে বাবুয়ার যুদ্ধটা ছিল প্রায় একার যুদ্ধ। ফরেস্ট সার্ভিসের লোকেরাও অনেকে পয়সার লোভে পোচারদের সাহায্য করত। তবু লড়াইটাতে বাবুয়াই জিতছিল।

সন্দীপ সিং ইউ পির ছেলে কুমায়ুনের। করবেট ন্যাশনাল পার্কের পোচাররা শুধু সন্দীপকে খুন করবার জন্যেই তিন তিনবার স্টাফ কোয়ার্টারে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে সন্দীপকে খুন করা তো দূরের কথা, ওকে দেখতে পাওয়াও অসাধ্য ব্যাপার ছিল। পোকামাকড়ের মতন ক্যামুফ্লেজিং জানত সন্দীপ। গাছের গুঁড়ির গায়ে কিম্বা শুকনো পাতার স্কুপের মধ্যে চোখের পলক ফেলবার আগে হারিয়ে যেত ও। অনুসরণকারীরা সন্দীপের অবস্থান টের পেত অনেক দেরিতে। ততক্ষণে সন্দীপের রিভলবারের বুলেট তাদের পিঠে ঢুকে গেছে।

আর বিমল? বিমল বর্মনকে খুঁজতে বেশি দূরে যেতে হয়নি। ও ছিল কাজিরাঙায়। বিমলের স্পেশালিটি ছিল বুশ-ক্র্যাফট। একটা ভাঙা গাছের ডাল কিম্বা মাড়িয়ে যাওয়া পাতার। চিহ্ন ধরে কেউটে সাপের মতো বুকে হেঁটে এগিয়ে যেত বিমল। তাকে ফলো করত বাকি ফরেস্ট গার্ডরা। আর এইভাবে একসময় ওরা ঠিক পৌঁছে যেত চোরা শিকারিদের কোনও লুকনো ডেরায়। অতর্কিত আক্রমণে পাকড়াও করে ফেলত তাদের। চোরাশিকারিদের পেতে রাখা লুকনো ফাঁদ বা বুবি ট্র্যাপ খুঁজে বার করার কাজেও বিমলের এই আশ্চর্য বুশ-ক্র্যাফট কাজে লাগত। বিমল যেন গন্ধ শুঁকেই বার করে ফেলত কোথায় গভীর গর্তের ওপর লতাপাতার পাতলা আস্তরণ বিছিয়ে ওরা তৈরি করেছে হাতি মারার মরণফাঁদ কিম্বা কোথায় বাঘের যাতায়াতের পথে গাছের ডালের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা আছে লুকনো বন্দুকের ট্রিগার যাতে পা দিলেই গুলি ছুটবে আর মুখ থুবড়ে পড়বে বনের রাজা। এমন কত ফাঁদ যে খুঁজে বার করে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে বিমল, কত বন্যপ্রাণী যে ওর জন্যে পুরো আয়ুটা জুড়ে বেঁচে থাকতে পেরেছে, তার হিসেব নেই।

পেপার ন্যাপকিনে আঙুলের ডগাগুলো মুছে নিয়ে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল প্রমিত। তারপর বলল, বুঝতেই পারছেন কাশ্যপসাহেব, এই তিনজনকে জঙ্গলের রাস্তায় অনুসরণ করা মানে আত্মহত্যা করা। যে কাজ শঙ্খচূড় সাপে পারেনি, হাতিতে পারেনি, চিতাবাঘে পারেনি, সে কাজ কেমন করে কোনও মানুষে পারবে বলুন তো?

ওদের খুন করবার একমাত্র উপায় ছিল যেভাবে করা হয়েছে ঠিক সেইভাবেদূর থেকে, অন্ধকারের আড়াল নিয়ে, কাপুরুষের মতন। না, কাশ্যপসাহেব, কোনও ট্রেইটর ওদের ধারে কাছে ছিল না। এমন কি, যে লোকটা রিভারবেড়ে দাঁড়িয়ে ফাঁকা বুলেটের আওয়াজ করেছিল, সে-ও যে বহু আগেই চম্পট দিয়েছিল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ওরা পৌঁছনো অবধি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বিমল বাবুয়াদের হাত থেকে সে বাঁচত না। আমরা তখন একটাই লাশ পেতাম, তিনটে নয়।

দ্যাটস্ ট্রু। এনি ওয়ে, আমরা কিন্তু সেই কানা গলিতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কোনও ব্রেক থ্র পেলাম না। চিন্তিত মুখে বললেন কাশ্যপ সাহেব। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, মিস্টার ব্যানার্জি! আপনার সেই রিসর্ট-ওয়ালির কী খবর? মিসেস বিনতা মেহরা?

আমার রিসর্ট-ওয়ালি বলবেন না স্যার, প্লিজ। মুখটা তেঁতো করে বলল প্রমিত। বিনতা মেহরা যে জগতে চলাফেরা করে, তার দশমাইলের মধ্যে পৌঁছবার ক্ষমতা এই সামান্য সরকারি চাকুরে প্রমিত ব্যানার্জির নেই। আর তার সে ইচ্ছাও নেই।

মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কিন্তু তাকে তো প্রমিত ব্যানার্জির কাছে আসতে হয়েছিল। আর একটা ইনফর্মেশন আপনাকে দিয়ে রাখি। বিনতা মেহরার অনেকগুলো পরিচয়ের মধ্যে একটা হল, সে আদমখোর। মানুষখেকো। পুরুষমানুষ অবশ্যই। হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান দেখলে বিনতা তার জাতপাত, অর্থগৌরব কিছু দেখে না। আপনি বিনতাকে পছন্দ নাও করতে পারেন, কিন্তু আপনাকে ওর অপছন্দ হবার কোনও কারণ দেখছি না।

প্রমিত দেবেশের কথায় হাসতে পারল না। ব্যাজার মুখে বলল, ওনার কাজটা করে দেওয়ার জন্যে প্রচন্ড পলিটিকাল প্রেসার আসছে। তবে যতক্ষণ চিফ কনজার্ভেটরের চেয়ারে অরিন্দম বসু আছেন, আর এখানে আপনি আছেন, ততক্ষণ মিসেস মেহরার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু আমরাই যদি না থাকি?

কাশ্যপসাহেবের কথায় অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল প্রমিত। মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কি জানেন তো মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি যাদের ওপর ভরসা করছেন তাদের পারচেজ হয়তো করা যায় না, কিন্তু সরিয়ে দেওয়া তো যায়? যে গভর্মেন্ট-সার্ভেন্ট পথের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার এফিসিয়েন্সির ওপরে একটা কালো দাগ লাগিয়ে তাকে ট্রান্সফার করিয়ে দেওয়াটা ইন্ডিয়ায় খুব পপুলার গেম। বিনতা মেহরাদের মতন লোকেরা এই খেলাটা খুব ভালো জানে। আর সেই কিস্তিমাতের লক্ষেই বোড়ের একটা চাল হয়তো তিনজন ফরেস্টগার্ডের মৃত্যু।

কথাটা উড়িয়ে দিতে পারল না প্রমিত। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মিডিয়ার অস্বাভাবিক মাতামাতির কথা। কলকাতার কাগজগুলো কেমন করে সেদিন ওই রিমোট জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটার কথা অত তাড়াতাড়ি জানতে পেরেছিল? কেউ কি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ওদের টিপস দিয়েছিল? সম্ভব, সবই সম্ভব।

ওদের ব্রেকফাস্ট হয়ে গিয়েছিল। পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিক রিপোর্টের একটা করে কপি ব্রাউন খামে ভরে প্রমিতের হাতে তুলে দিলেন দেবেশ কাশ্যপ। তারপর হ্যাঁঙ্গার থেকে নিজের ইউনিফর্মের টুপিটা নিয়ে মাথায় ঠিক করে বসাতে বসাতে আগের কথার সূত্র ধরেই বললেন, আমি কিন্তু সন্দেহের আওতা থেকে ওই মহিলাকে বাদ দিচ্ছি না মিস্টার ব্যানার্জি। এই জঙ্গলে যদি টেররিস্টদের সাহায্যকারী কেউ থাকে, তাহলে এভরি পসিবিলিটি যে সেটা ওই মহিলা। বিকজ শী হ্যাঁজ হেভি স্টেক ইন দ্যা অ্যাফেয়ার।

বাংলো থেকে বেরিয়ে দেবেশ কাশ্যপ আর প্রমিত ব্যানার্জি যে যার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের গাড়িতে ওঠার আগে কাশ্যপ নীচু স্বরে প্রমিতকে বললেন, যদি সন্দেহজনক কিছু দ্যাখেন বা শোনেন, তা হলে আমাকে ওভার ফোন জানাবেন।

নিশ্চয়ই। বলল প্রমিত। তারপর সে নিজের জিপসি জিপের দরজা খুলে ভেতরে উঠে বসল। জিপসি রওনা দিল আলিপুরদুয়ারের দিকে। লম্বা সফরটার বেশিরভাগ জুড়ে তার মাথার মধ্যে খেলা করতে থাকল কাশ্যপ সাহেবের ঢুকিয়ে দেওয়া সন্দেহটা।

বিনতা মেহরা…বিনতা মেহরা! সত্যিই কি ওই সুন্দরী মহিলাটির এই হত্যালীলায় কোনও হাত আছে? সে-ই কি নাচাচ্ছে মিডিয়াকে?

প্রমিতের মনে পড়ে গেল, মাত্রই পনেরো দিন আগে ওই মহিলার সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের কথা।

.

০৩.

সেদিন প্রমিত বিনতা মেহরাকে চোখে দেখার আগে তার শরীর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেয়েছিল।

ভোরবেলা আলিপুরদুয়ারের প্রান্তসীমার নির্জন এক মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতন ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ সেরে, ততোধিক নির্জন রাস্তা ধরে নিজের কোয়ার্টারে ফিরছিল প্রমিত। তার। পরিধানে ছিল দুধ সাদা টি-শার্ট আর গাঢ় নীল টেনিস-শর্টস্। ব্যায়ামের পরে তখন তার শিরায় শিরায় জোরদার রক্ত সঞ্চালন, ফলে মেজাজ ছিল ফুরফুরে। বড় বড় স্টেপ ফেলে হাঁটতে হাঁটতে প্রমিত শুনছিল রাস্তার দুপাশের বিশাল বিশাল গাছগুলোর ডালপালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা অজস্র পাখির বৃন্দগান। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিল সে–তাজা অক্সিজেনের জন্যে তো বটেই, তবে তার চেয়েও বেশি শিশু ফুলের গন্ধের জন্যে। রাস্তার ধারের দানবাকৃতি শিশু গাছগুলোয় ফুল এসেছিল। ঈশ্বরের প্রসাধনীর মতন গুঁড়ো-গুঁড়ো মিহি সবুজ ফুলে ছেয়েছিল গাছতলা।

কিন্তু রাস্তা থেকে নিজের বাড়ির বারান্দায় পা দেওয়া মাত্র অন্য এক অচেনা গন্ধের ধাক্কায় প্রমিতের বুক থেকে ফুলের গন্ধ মুছে গেল। অবাক প্রমিত বুঝতে পারল সেই সুগন্ধ ভেসে আসছে তারই পরদাফেলা ড্রইংরুমের অন্দর থেকে।

পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকল প্রমিত। সোফায় এক বছর পঁয়ত্রিশের দীর্ঘাঙ্গী মহিলা বসেছিলেন। প্রমিতকে দেখে তিনি কেবল হাতের ওয়াইল্ডলাইফ ম্যাগজিনটা কোলের ওপর ভাঁজ করে রাখলেন, আর কিছু না।

নমস্কার করলেন না। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন না। প্রমিতের ঘরে তার উপস্থিতির কোনও ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলেন না। শুধু চর্চিত হাস্কি গলায় জিগ্যেস করলেন, আপনি ডি এফ ও, মিস্টার ব্যানার্জি?

তার প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই প্রমিত একটা জিনিস খেয়াল করেছিল–মহিলার অঙ্গে সেই মুহূর্তে যত টাকার জিনিস ছিল তত টাকা অনেক মধ্যবিত্ত সারা জীবন চাকরি করে জমাতে পারে না। সোনালি জরির কাজ করা ঘিয়ে সিল্কের শাড়িটার দাম সে আন্দাজ করতে পারল না, তবে মহিলার হাতে, কানে এবং আঙুলে যে রত্নপাথর আর প্লাটিনামের হালকা গয়না গুলো আছে সেগুলোর দাম সব মিলিয়ে লাখ পাঁচেক টাকার কম হবে না। বাঁ-হাতের মুঠোয় আলতো করে ধরে রাখা ওয়েফার থিন মোবাইলটার দামও নিঃসন্দেহে লাখের ঘরে। ঘড়ির ব্র্যান্ডটা দূরে দাঁড়িয়ে ঠিক বুঝতে পারল না প্রমিত, তবে তার ডায়াল এবং স্ট্র্যাপে গাঁথা হিরেকুচির ঝলক তার চোখ এড়ালো না। আর সোফায় নামিয়ে রাখা হোয়াইট লেদারের পার্স আর পায়ের কাছে খুলে রাখা একই রঙের স্লিপার, দুটো জিনিসের ওপরেই ক্রিশ্চিয়ান ডিয়রের পৃথিবীবিখ্যাত লোগগা। শুধু ওই দুটো জিনিসের দামে একটা ভারতীয় মোটরগাড়ি কেনা যায় মনে মনে ভাবল প্রমিত।

আরেকটা জিনিসও না ভেবে পারল না প্রমিত, মহিলা কাকে দেখাবার জন্যে এই জনবিরল মফস্বলে এত সাজগোজ করে বেরিয়েছেন? যে সাজ পার্কস্ট্রিটের সন্ধেবেলায় চলে তা কি আলিপুরদুয়ারের ভোরবেলায় পরা যায়!

একেই ইংরিজিতে বলে স্টিংকিং রিচ। এনার গা থেকে পয়সার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, এবং রুচিহীনতার সেই দুর্গন্ধ শানেল ফাইভের সুগন্ধেও ঢাকা যাচ্ছে না।

প্রমিত খেয়াল করল মহিলার ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠেছে। বাঁকা হাসি। হাসিটার মানে বুঝতে অসুবিধা হল না প্রমিতের। কোনও শিকারি যখন একইসঙ্গে নিজের সাফল্যের আনন্দ আর নিহত শিকারের প্রতি করুণায় হাসে, তখন দুরকম হাসি মিশে গিয়ে এই হাসিটা তৈরি হয়। এই মহিলা যিনিই হন, ইনি প্রমিতকে তার সামনে এরকম বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেবেছেন সেও তার নিত্য নতুন শিকারের তালিকায় এক নতুন সংযোজন, আর ওনার এই ভাবনাটা শুধু পয়সা থেকে আসছে না। পয়সা ছাড়াও ওনার অন্য অস্ত্র আছে। ওনার যৌবন। সে যৌবনে হয়তো সামান্য ভাটার টান লেগেছে, তবুও তা মোহিনী। আর সেটা উনি বিলক্ষণ জানেন। স্বেচ্ছাস্থলিত আঁচলের আড়াল থেকে জেগে থাকা বুকের গভীর খাঁজ, স্লিভলেস ব্লাউজের বাইরে বেরিয়ে থাকা দুই সুডৌল বাহু এবং নাভি থেকে নীবিবন্ধ অবধি বিস্তৃত মাখনরঙের উপত্যকা–এই সবই ওনাকে আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। উনি আলুলায়িত ভঙ্গিতে বসে এই মুহূর্তে শরীরের সেই মাদক মানচিত্রের ওপর প্রমিতের চোখের দ্রুত নড়াচড়া দেখছেন, উপভোগ করছেন। ভাবছেন প্রমিত ঘায়েল হয়েছে।

কিন্তু সেই ভাবনাটা ভুল। আকর্ষণ নয়, প্রমিতকে প্রথম থেকেই ওনার উপস্থিতি বিকর্ষণ করছিল। ভালো লাগছিল না প্রমিতের। কেন, তা সে ঠিক বলতে পারবে না। হয়তো ওনার নিজের সম্বন্ধে অত্যন্ত নিশ্চিত ভঙ্গিটাই এর কারণ, কিম্বা পয়সা দেখানোর নির্লজ্জ ধরণটা।

যাই হোক, ওনার এই আত্মবিশ্বাসটা ভেঙে দেওয়া দরকার–প্রমিত ভাবল।

সে তাই উলটোদিকের সোফায় বসে সকালের নিউজপেপারটা হাতে তুলে নিল, তারপর সেটাকে মুখের সামনে মেলে ধরল। সেই অবস্থাতেই নিস্পৃহ গলায় জবাব দিল, হ্যাঁ, আমিই ডি এফ ও, প্রমিত ব্যানার্জি। আপনার পরিচয়টা? কাগজের আড়াল থেকেও প্রমিত অনুভব করতে পারছিল ভদ্রমহিলার মুখের ভাব কত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।

ডেলিবারেট অপমানটা সামলাতে একটু সময় নিলেন ভদ্রমহিলা, তবে একটুই। বোঝা যায় প্রতিদিন বহু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সামলে উনি অভ্যস্ত। বড় জোর দশ সেকেন্ড চুপ করে থেকে তারপর উত্তর দিলেন, আমি বিনতা মেহরা। আমার নাম আপনি শুনে থাকবেন। মারমেড বিজনেস গ্রুপ..ওটা আমাদেরই। আমার স্বামী অতুল মেহরা ছিলেন ওই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা।

পরিচয়টা শুনে প্রমিত মনে মনে একটু সচকিত হলেও শরীরী ভাষায় সেটাকে ফুটে উঠতে দিল না। একইভাবে কাগজটা মুখের সামনে ধরে রাখল। মারমেড গ্রুপের নাম কে না জানে? হেৰ্থ-চেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইমপোর্ট এক্সপোর্ট, হোটেল, এবং সর্বোপরি কনস্ট্রাকশন বিজনেস–বহু ব্যবসার মালিক ওই গ্রুপ। অতুল মেহরা নামটা বছর দুয়েক আগে অবধি খবরের কাগজে প্রায় রোজই দেখা যেত। ছবিও কখনও সিএম-এর সঙ্গে, কখনও পি এম-এর। তারপরেই মারা যান ভদ্রলোক। কিন্তু প্রমিত যতদূর মনে করতে পারছে, তিনি তো মারা গেছেন বেশ বুড়ো বয়সেই। সত্তরের ওপরে বয়েস হয়েছিল। ইনি তো তাহলে সেই বৃদ্ধের তরুণী ভায্যাই ছিলেন দেখা যাচ্ছে।

আমি একটু অফিসিয়াল কাজে আপনার কাছে এসেছিলাম।

মুখের সামনে থেকে কাগজটা সরিয়ে প্রমিত দেখল ইতিমধ্যে বিনতা মেহরা সোজা হয়ে বসেছেন। আঁচল টাঁচলও যথাস্থানে ফিরে এসেছে। প্রমিত তার চোখে চোখ রেখে বলল, অফিসিয়াল কাজ? তাহলে বাড়িতে কেন? দশটার পর অফিসে আসবেন।

প্লিজ, ব্যানার্জি সাহেব। নটায় বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট। আমাকে আজ কলকাতায় পৌঁছতেই হবে। সেইজন্যই বাধ্য হয়ে আপনাকে বাড়িতে ডিস্টার্ব করলাম। তাছাড়া আমাদের কথার মধ্যে এমন কিছু প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে, যেগুলো অফিসের কলিগদের সামনে বলাটা মুস্কিল হবে।

প্রমিত স্বভাবতই ভদ্রলোক। বেশিক্ষণ অভদ্রতা করতে পারে না। তার ওপর ভদ্রমহিলা অল্প দু-একটা কথাতেই তার মনে কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সে বলল, বেশ বলুন, কী বলবেন।

বিনতা মেহরা প্রথমে একটা অত্যন্ত দামি কাগজে ছাপা ব্রশিওর প্রমিতের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি জানেন নিশ্চয়ই, মারমেড বিজনেস গ্রুপের নানান ফিল্ডে ব্যবসা আছে। তার মধ্যে একটা হল হোটেলের ব্যবসা। আমাদের স্টার হোটেল সারা ভারতের সবকটা বড় সিটিতেই ছড়ানো আছে। এমনকি দুবাই আর সিঙ্গাপুরেও আমাদের হোটেল রয়েছে। এই ব্রশিওরটায় আপনি সেগুলোর ডিটেইলস্ পাবেন।

প্রমিত ব্রশিওরটা উলটেপালটে দেখে একটু অবাক হয়েই বলল, কিন্তু আমার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?

সেটাই এক্সপ্লেন করছি। রিসেন্টলি আমরা একটা নতুন ভেঞ্চারে নেমেছি। আমরা না বলে আমি বলাই ভালো। কারণ, মারমেডের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে আমার আত্মীয়েরা থাকলেও হেমিংওয়ে টুরর্স-এর মালিকানা আমার নিজের। হ্যাঁ, আমার নতুন প্রোজেক্টের নাম দিয়েছি হেমিংওয়ে ট্যুর। ভালো হয়নি? আমার এক প্রফেসর বন্ধু আছেন, বাঙালি। উনিই নামটা সাজেস্ট করলেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে না কি খুব জঙ্গল ভালোবাসতেন।

ও, এটা কি জঙ্গলের সঙ্গে রিলেটেড কোনও প্রোজেক্ট না কি?

এগজ্যাক্টলি মিস্টার ব্যানার্জি। আপনি ঠিক ধরেছেন। এইজন্যে বাঙালিদের আমি এত ভালোবাসি। এত শার্প দিমাগ হয় আপনাদের। আমার বন্ধুদের মধ্যে মেজরিটিই বাঙালি।

প্রমিত বুঝতে পারছিল না এর মধ্যে শার্প দিমাগের কি দেখলেন বিনতা মেহরা। তবে তেল দেওয়ার চেষ্টাটা সে দিব্যি বুঝতে পারছিল, এবং সেইজন্যেই আশঙ্কিতও হচ্ছিল। কি জানি এর পরে কী ধরনের রিকোয়েস্ট আসবে। সে চুপ করে থেকে বিনতাকে কথা বলে যেতে দিল। বিনতা বলে চললেন–

অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ব্যাপারটা নিশ্চয় আপনি জানেন। আফটার অল, জাঙ্গল ইজ ইয়োর ব্রেড অ্যান্ড বাটার। হেমিংওয়ে ট্যুরিজম অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর কন্ডাক্ট করে। আমাদের মেজরিটি ক্লায়েন্টস হল ফরেনার্স। তাদের আমরা ভারতের বনে, জঙ্গলে, দুর্গম পাহাড়ে, অজানা সমুদ্রতটে বেড়িয়ে আনি। দে ডু নট সিক কমফর্টস্। ওরা শুধু অ্যাডভেঞ্চার চায়। নির্জন তুষারপ্রান্তরে তাঁবুর মধ্যে শুয়ে কল্পনা করবে, তাঁবুর বাইরে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে ইয়েতি। ব্রিটিশ আমলের পরিত্যক্ত ফরেস্ট বাংলোয় রাত্রিবাস করবে; বাঘের গর্জনে মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যাবে। এইরকম সব খেয়াল আর কি।

প্রমিত একটু একটু আন্দাজ করতে পারছিল বিনতা মেহরা কোনদিকে কথাটিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

একটু চুপ করে থেকে বিনতা সরাসরি সেই প্রসঙ্গে চলে এলেন ব্যানার্জি সাহেব। আপনার এই বক্সা প্রোজেক্টের সীমানায় এমন একটা জায়গা রয়েছে যেটার মতন অপূর্ব অ্যাডভেঞ্চার স্পট আর হয় না। ঘন জঙ্গল আর নদীর মাঝখানে টিলার মাথায় প্রাচীন কেল্লা। সামনে ওয়াটার হোল। সেখানে সন্ধেবেলা হাতি, গউর, সম্বর-হরিণ অ্যান্ড ওয়াইল্ড বোরস্ সবাই জল খেতে আসে। রাত নামলে এমন নিঃশব্দ হয়ে যায় চারিদিক যে, গাছের পাতা খসে পড়ার আওয়াজও স্পষ্ট শোনা যায়। অ্যান্ড অ্যাবাভ অল, দেয়ার ইজ আ মিথ–ওই কেল্লাটাকে ঘিরে একটা অদ্ভুত লোককথা চালু আছে যে, একদিন ওই কেল্লার রাজা আবার ফিরে আসবেন। সেই রাজা, যিনি মারা গেছেন আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, তাই না? মাই ক্লায়েন্টস উড পে এনিথিং…জাস্ট এনিথিং ফর হ্যাঁভিং চান্স টু স্পেন্ড আ নাইট দেয়ার। মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি আমাকে ওই শিরোমণির গড়ে একটা হোটেল খোলার ব্যবস্থা করে দিন। বড় কিছু নয়, জাস্ট কটেজেস।

প্রমিতের হতবাক মুখের দিকে চেয়ে মাঝখানেই কথা থামিয়ে দিয়েছিলেন বিনতা মেহরা। তারপর আস্তে আস্তে জিগ্যেস করলেন, কী হল মিস্টার ব্যানার্জি? আমি কি অ্যাবসার্ড কোনও প্রোপোজাল দিয়েছি?

নিজেকে সামলাতে পারেনি প্রমিত। ক্রোধে আর ঘৃণায় হিস হিস করে উঠেছিল তার গলার স্বর। সেইভাবেই বলেছিল–অ্যাবসার্ড কথা বলেছেন কি না সেটা আপনি নিজে বুঝতে পারছেন না? আপনি জানেন না, বক্সা একটা ন্যাশনাল পার্ক, এর সীমানার অংশটুকু বাদ দিলে, বাকি যে কোনও জায়গায়, যে-কোনও রকমের কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটি আইনত নিষিদ্ধ? আপনি জানেন না, একসময়ে ওই বনের মধ্যে ডলোমাইটের খনি ছিল, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? আলিপুরদুয়ার থেকে জয়ন্তী গ্রাম অবধি রেললাইন ছিল, তাও একই কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইসব বড় বড় প্রোজেক্ট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, আর আজ আপনি ফরেনার্সদের সার্কাস দেখাবার জন্যে সেই জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু ফেলতে চাইছেন! সাহস তো কম নয় আপনার!

কিন্তু আমি তো যতদূর জানি, শিরোমণির গড় ফ্রিঞ্জ এরিয়ার মধ্যে পড়ছে। ওসব জায়গায় বিজনেস-অ্যাক্টিভিটি বারণ নয় তো?

বারণ নয়, বাট ইন রেস্ট্রিক্টেড ম্যানার। নিয়ন্ত্রিতভাবে বিজনেস অ্যাক্টিভিটি চলতে পারে। তাও, সেইসব ব্যবসা যেগুলো ইকো-ফ্রেন্ডলি। যেগুলোর মধ্যে দিয়ে লোকাল পিপলের কিছু লাভ হয়। আর আপনি যা করতে চাইছেন তা তো স্ট্রেটওয়ে বনকে ধ্বংস করা।

তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। শিরোমণির গড় সম্বন্ধে লোকাল পিপলের মনে স্ট্রং সেন্টিমেন্ট কাজ করে–জানেন সে কথা? ওটা ওদের কাছে তীর্থস্থান। কোনওভাবেই ওই জায়গার…

বিনতা মেহরা প্রমিতকে তার কথার মধ্যে বাধা দিয়ে বললেন, ফরগেট বাউট লোকাল পিপল। ও ব্যপারটা আমি দেখে নেব।

তার মানে? প্রমিত বিনতার মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইল।

এই পৃথিবীতে সমস্ত কিছুই পারচেজেবল মিস্টার ব্যানার্জি। তীর্থস্থানও তার বাইরে পড়ে না। নাউ টেল মি অ্যাবাউট ইয়োর প্রাইস-সিলিং।

অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে প্রমিত বিনতার দিকে চেয়ে রইল। এই মহিলা কি জানেন, ইনি কী বলছেন?

বিনতার মধ্যে অবশ্য কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি এমন একটা খেলা খেলছেন যে খেলায় সম্ভবত আজ অবধি তিনি কখনও হারেন নি। তাই চোখের পাতাটি অবধি না ফেলে, অত্যন্ত সহজ সুরে তিনি বললেন, আপনাকে আমি এই প্রোজেক্ট থেকে যা ইনকাম হবে স্ট্রেট অ্যাওয়ে তার টেন পার্সেন্ট দেব। মাসে এক লাখের কম হবে না।

গেট আউট!

আরও বেশি দিতে পারতাম, কিন্তু আপনাদের এখানকার সবকটা রাজনৈতিক দলের নেতারা বখরা চেয়ে বসে আছে। তবে আমি বলছি, দুবছরের মধ্যে দ্যা অ্যামাউন্ট উইল বি ডাবল।

আই সে গেট আউট!

মার্কামারা হাস্কি গলায় বিনতা বললেন, উত্তেজিত হচ্ছেন কেন মিস্টার ব্যানার্জি? আপনাকে দিয়ে কাজটা না হলে অন্য কাউকে দিয়ে করাব। মাঝখান থেকে আপনি একটা হ্যান্ডসাম অফার মিস করবেন। ভেবে দেখুন।

আমিও আপনাকে বলে দিচ্ছি মিসেস মেহরা, আজকের পরে আর কোনদিন বক্সা টাইগার রিজার্ভের বাউন্ডারির মধ্যে আপনাকে দেখতে পেলে ট্রেসপাসিং-এর জন্যে ফাটকে পুরে দেব। নাউ, গেট লস্ট।

শান্তভাবেই সোফা ছেড়ে উঠে বিনতা মেহরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রমিত অবাক হয়ে দেখল, তিনি গেটের সামনে পৌঁছন মাত্র যে সাদা টয়োটা-টা রাস্তার বাঁক ঘুরে তার সামনে এসে দাঁড়াল, সেটা তার খুব চেনা। এখানকার এক পাওয়ারফুল ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে সে ওই গাড়িটায় চড়ে ঘুরতে দেখেছে।

সেদিনই প্রমিত বুঝতে পেরেছিল, শিরোমণির গড়ে হোটেল বানানোর স্কিমটা বিনতা মেহরা খুব সহজে ছাড়বে না। লড়াইটা সে চালিয়ে যাবে, কারণ তার পেছনে সৈন্যদল রয়েছে।

আর প্রমিত জানে না সে পেছনে কতজনকে পাবে, কতজন শিবির বদলে চলে যাবে উলটোদিকে। এ দেশে সরকারের পক্ষ নিয়ে লড়তে গেলে যেমনটা হয়।

হঠাই প্রমিতের জিপটা প্রচন্ড দুলে উঠল। সেই ঝাঁকুনিতে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল প্রমিত। দেখল জিপ ডিমা নদীর শুকনো খাত পেরোচ্ছে। এখন এই হেমন্তের শেষে নদীর বুকে একফোঁটাও জল নেই। নুড়িপাথরের ওপর দিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে জিপ। তবে বর্ষার ফ্ল্যাশ ফ্লাডে এই শুকনো নদীরই যে কি রূপ হয়, তা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই যেন অনতিদূরে বালির চড়ায় সার সার কয়েকটা কংক্রিটের থাম দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই থামগুলোর মাথায় কয়েকবছর আগেও একটা ব্রিজ ছিল। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমিত রাজাভাতখাওয়ায় পৌঁছে গেল। তিন বছর আগে, প্রথম দর্শনেই, আরণ্যক এই ছোট্ট শহরটার শান্ত রূপ প্রমিতকে মুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতা আজও তার কাটে নি। শহরে ঢুকবার একটু আগে রাস্তা আর রেললাইনের মাঝখান দিয়ে একটা ছোট ঝোরা বয়ে চলে, নাম চৈতন্যঝোরা। যাতায়াতের পথে প্রত্যেকবারই প্রমিত জিপ থামিয়ে ওই ঝোরার ধারে একটা বড় পাথরের ওপর কিছুক্ষণ বসে। তাকে ঘিরে ল্যানটানা আর বন-ধুতরোর ঝোপে মধ্যে কলকল করে ঘুরে বেড়ায় বুলবুলি পাখির ঝাঁক। পাথরে ধাক্কা খেয়ে চৈতন্যঝোরার জল শিরশির শব্দে বয়ে যায়। প্রজাপতিরা নির্ভয়ে গায়ে মাথায় এসে বসে। সারাদিনের সমস্ত গ্লানি মন থেকে ধুয়ে চলে যায়।

প্রমিতের ড্রাইভার অশোক রাই নেপালি ছেলে, তবে শিলিগুড়িতে জন্ম এবং কর্ম বলে জলের মতন বাংলা বলে। প্রমিতের এই জায়গাটা সম্বন্ধে অনুরাগের কথা সে জানে। চৈতন্যঝোরার কাছে এসে সে ঘাড় ঘুরিয়ে জিগ্যেস করল, দাঁড়াব স্যার?

দাঁড়া। প্রমিত জিপের দরজা খুলে মাটিতে পা দিয়ে মাথার ওপর দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল।

ঠিক তখনই দুজন লোক একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।

.

০৪.

আলিপুরে আপনার অফিসে গিয়ে শুনলাম জলপাইগুড়ি গেছেন। জানি, এই পথ দিয়েই ফিরবেন। তাই অপেক্ষা করছিলাম। দুজনের মধ্যে যে ছেলেটির বয়েস একটু বেশি, সে এগিয়ে এসে কথাগুলো বলল। বলল, প্রমিতের প্রায় গায়ের ওপর দাঁড়িয়ে। দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আর চোখের চাউনিতে পরিষ্কার ঔদ্ধত্য ফুটে বেরোচ্ছে।

ছেলেটিকে প্রমিত খুব ভালো করে চেনে। ওর নাম মধু…মধু বর্মন।

যে-কোনও রিজার্ভ ফরেস্টেরই দুটো ভাগ থাকে–একটা ফ্রিঞ্জ-এরিয়া বা প্রান্তিক অঞ্চল, আরেকটা কোর-এরিয়া বা কেন্দ্রীয় অঞ্চল। বক্সা টাইগার রিজার্ভও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু পাখি, হরিণ, বাঁদর, আর ছিটকে আসা হাতির পাল ছাড়া বক্সার প্রান্তিক অঞ্চলে বিপন্ন প্রজাতির বণ্যপ্রাণী বিশেষ থাকে না। তাই বনদফতর এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিতভাবে কিছু মানুষকে বসবাস আর কৃষিকাজের সুযোগ দেয়। যে আসে তাকেই যে দেয় এমন নয়। তাদেরই দেয়, যারা বনদফতর তৈরি হবার আগে থেকে তো বটেই, ভারতরাষ্ট্র তৈরি হবারও অনেক আগে থেকে, হয়তো রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকেই পুরুষানুক্রমে এই অরণ্যে বসবাস করে আসছে। সারা ভারতের সমস্ত বনভূমিতেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এমন বনবাসীদের অস্তিত্ব রয়েছে। আর্য ঋষিদের রচিত মহাকাব্যগুলোতে এদেরই কিরাত, রাক্ষস প্রভৃতি নামে দেগে দেওয়া হয়েছে। বনবাসকালে আর্য রাজকুমারদের প্রধান প্রমোদ তথা কর্তব্য ছিল এই অনার্য কিরাত বা রাক্ষসদের নিধন করা।

মধু বর্মন এমনই এক আরণ্যক গ্রামের অধিবাসী। বক্সার ফ্রিঞ্জ এরিয়ায় ঘন শালবনে ঢাকা সেই গ্রামটার নাম বেশ অদ্ভূত–চকচকি। কে জানে, ওই নামের মানে কী।

টাইগার রিজার্ভের প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এরকম দশ বারোটা গ্রামে সাকুল্যে হয়তো সাত আট হাজার নারী পুরুষ বাস করে। প্রমিত তাদের সামান্য কয়েকজনকেই চেনে। কারণ তারা স্বভাবতই লাজুক, সঙ্কুচিত। চিতল হরিণের মতই তারা গাছপালার আড়াল থেকে ভীত চোখে ভদ্রলোকেদের লক্ষ্য করে। ভদ্রলোকেদের হাতে অনেক পুরুষ ধরে সয়ে আসা অত্যাচার তাদের ওইরকম ব্যবহারই শিখিয়েছে।

যে তাদের হয়ে সামনে আসে, সে ওই মধু বর্মন।

মধু বর্মন নিজের গুণেই বনবাসী মানুষদের নেতা হয়ে উঠেছে। গত দুবছরের মধ্যে প্রমিত অনেকবার তাকে তার জাতের লোকেদের হয়ে বনদফতরের অফিসে দরবার করতে দেখেছে। কখনও জঙ্গলে শালপাতা কুড়োবার সময়সীমা বাড়াবার জন্যে দরবার করতে এসেছে, আবার কখনও হাতিতে ফসল খেয়ে গেলে ক্ষতিপূরণ চাইতে এসেছে। ছেলেটা ছোটবেলায় জলপাইগুড়ির একটা মিশনারি স্কুলে মাধ্যমিক অবধি লেখাপড়া করেছিল, তাই ইংরিজি আর হিন্দি দুটো ভাষাতেই ভালো লিখতে পড়তে পারে। সেই বিদ্যা দরখাস্ত লেখার সময়ে বা ফরেস্টের অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার সময়ে কাজে আসে। ফলে আরণ্যক গ্রামের মানুষদের লিডার হতে মধুর সময় লাগেনি।

প্রমিতের যেটা খারাপ লাগে সেটা হল, নিজের এই বিশেষ অবস্থানের ফায়দাটা মধু বর্মন পুরোদস্তুর তুলে নিচ্ছে। সাত-আট হাজার মানুষ, আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে সাত আট হাজার ভোট মেশিনের বোতামে রাখা আঙুল, মধুর কথায় নড়ে-চড়ে। এই সত্যটা জানে বলেই রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ইলেকশনের আগে মধুকে নিয়ে নিলামের ডাক ওঠে। মধুকে যে কিনতে পারবে, ওই সাত-আট হাজার ভোট তার বাঁধা।

ফলে তিরিশ বছর বয়েস হওয়ার আগেই মধু বর্মনের আলিপুরদুয়ারে সুন্দর দোতলা বাড়ি, যদিও সে বাড়ির অস্তিত্ব তার জঙ্গলের প্রতিবেশীরা জানে কি না সন্দেহ। একটা এনফিল্ড বাইক। এটিও সে রাজাভাতখাওয়ায় রেখে দিয়ে পায়ে হেঁটে চকচকি গ্রামে ঢোকে। তা ছাড়া ভারত ভুটান সীমান্তে বেনামে একটা কমলালেবুর বাগানও রয়েছে। আর সম্ভবত এই সব সম্পত্তির সাদা টাকায় উৎস দেখাতে কাজে লাগবে বলেই একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরিও করে দেওয়া হয়েছে তার জন্যে। প্রমিতের নিজের অফিসে এদিকের কয়েকজন লোক কাজ করেন। তারাই। প্রমিতকে মধুর সম্বন্ধে এই সব খবর সরবরাহ করেন।

হাতিতে ফসল নষ্ট করলে ফসলের মালিককে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তার থেকেও যে মধু বর্মন পয়সা সরায়, তা প্রমিত একবার হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। মুস্কিল হচ্ছে মধুর অক্ষরজ্ঞানহীন প্রতিবেশীরা কিছুই ধরতে পারে না। তারা মধুকে তাদের রক্ষাকর্তা মনে করে। অন্ধের মতন বিশ্বাস করে তাকে।

প্রমিতের ঘোর সন্দেহ, বক্সার কাঠ পাচার চক্রের সঙ্গেও যোগ রয়েছে এই লোকটার। ওর মতন লোভী মানুষের পক্ষে সেটাই স্বাভবিক।

এই মধু বর্মনকে তার জন্যে ফাঁকা রাস্তায় অপেক্ষা করতে দেখে স্বভাবতই প্রমিতের মনটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠল। তবু সে বিরক্তি গোপন করে বলল, অপেক্ষা করছ কেন মধু? কিছু বলবে?

অবশ্যই বলব। বলব বলেই তো এসেছি। ঝাঁঝিয়ে উঠল মধু বর্মন। শিরোমণির গড়ের থেকে পবিত্র জায়গা আমাদের কাছে আর কিছু নেই। সেই জায়গা আপনার জন্যে মানুষের রক্তে অপবিত্র হল।

এ কথা ঠিক যে, যে জায়গাটায় বিমল, বাবুয়াদের খুন করা হয়েছে সেই জায়গাটার গা ঘেঁষেই উঠে গেছে শিরোমণির গড়ের টিলা। তবু, আক্রমণটা যে এইদিক থেকে আসবে তা ভাবতে পারেনি প্রমিত। সে একটু হকচকিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, আমার জন্যে মানে?

হ্যাঁ, আপনার জন্যেই। অভদ্রের মতন চেঁচিয়ে উঠল মধু। বহুদিন ধরে আপনার কাছে দাবি করে আসছি শিরোমণির গড়কে আমার জাতের লোকেদের হাতে ফিরিয়ে দিতে। যদি সে কথা শুনতেন তাহলে আজ ওই জায়গায় লোক গমগম করত। খুন খারাবি হতে পারত না।

প্রমিত শান্তভাবে বলল, তা হয় না মধু। কেন হয় না তা তোমাকে আগেও অনেকবার বুঝিয়েছি। শিরোমণির গড় টাইগার রিজার্ভের ফ্রিঞ্জ এরিয়ার মধ্যে পড়ে। ওটা সবার জন্যে খুলে দেওয়া যায় না। কিন্তু তোমরা যারা জঙ্গলের গ্রামে থাক, তাদের তো ওখানে যেতে আমরা কোনওদিন বাধা দিই নি। কারণ আমরা খুব ভালো করেই জানি, জঙ্গলের গ্রামগুলোয় তোমরা। যারা থাকো, তারা জঙ্গলের ভালোমন্দ আমাদের মতন বাইরের লোকের থেকে অনেক ভালো বোঝে। জঙ্গলকে তোমরা কিছু কম ভালোবাসো না।

কিন্তু তুমিই বল, শয়ে শয়ে তীর্থযাত্রী যদি ওই ভাঙা গড়ে জমায়েত হয় তাহলে তারা কি তোমাদের মতন জঙ্গলকে বাঁচিয়ে, জঙ্গলের জন্তুদের বাঁচিয়ে চলাফেরা করতে পারবে? এতে বন্যপ্রাণীদের যেমন ক্ষতি হবে, তেমন ক্ষতি হবে তোমাদেরও। তারপর ওদের সঙ্গে মিশেই কোর-এরিয়ায় ঢুকে পড়বে কাঠচোর কিম্বা পোচাররা।

আপনি কিন্তু জেনে বুঝে আমাদের অপমান করছেন ব্যানার্জি সাহেব। গ্রামবাসীদের আপনি চোর বলছেন। পেপাচার বলছেন। এরপর অশান্তি শুরু হলে আমাকে দোষ দেবেন না।

প্রমিত পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, মধু তাকে প্ররোচিত করছে। ওর একমাত্র লক্ষ্য, তাকে রাগিয়ে বেফাঁস কিছু বলিয়ে নেওয়া, আর সেটাকে ইস্যু করে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলা। একবার সেরকম অশান্তি শুরু হলে প্রমিতকে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে মধু বর্মণের দ্বারস্থ হতেই হবে।

তখন সেই শান্তির জন্যে কী মূল্য চাইবে মধু? সেইটাই ঠিক আন্দাজ করতে পারছিল না প্রমিত। সেটা জানবার জন্যেই তাকে আরও কিছুক্ষণ এই নীচ লোকটার সঙ্গে ভদ্রতার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে। সেইরকম মনস্থ করেই একটু ভীতু সুরে প্রমিত বলল, তোমার মতন লিডার থাকতে হরিণডুবিতে অশান্তি কেন হবে, মধু? তুমি কী চাইছ তাই বল না।

মধু বোধহয় মনে মনে ভাবল, হাতি কাদায় পড়া একেই বলে। এই ব্যানার্জি সাহেব তার কত দুনম্বরী প্রোপোজাল পুরোটা না শুনেই তাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে। আর এখন, যেহেতু তিনটে গার্ড মারা গেছে, কাগজে, টিভিতে হইচই হচ্ছে, তাই ওই লোকেরই সুর কত নরম হয়ে গেছে। কথাটা পাড়ার এটাই ভালো সময়।

মধু গলা নামিয়ে বলল, বিনতা ম্যডামকে শিরোমণির গড়টা দিয়ে দিন ব্যানার্জিসাহেব।

প্রমিতের নিখুঁত অভিনয়েও প্রায় চিড় ধরতে যাচ্ছিল। অতি কষ্টে রাগটা গিলে নিয়ে সে বলল, এতদিন তোমার জাতের লোকেদের হাতে শিরোমণির গড়কে দিয়ে দিতে বলছিলে, তার না হয় একটা কারণ বুঝতে পারছিলাম। সেখানে তোমাদের বিশ্বাস, তোমাদের জাতের ইতিহাস, জাতের অতীত গৌরবের ব্যাপার ছিল। কিন্তু হঠাৎ বিনতা ম্যাডামকে দিয়ে দিতে বলছ কেন? তিনিও তো আমার মতনই বাইরের লোক।

গোঁয়ারের মতন মাথা নীচু করে মধু বলল, তা হোক। উনি কথা দিয়েছেন, ওখানে রিসর্ট খুললে আমাদের অনেকগুলো লোককে চাকরি দেবেন–গার্ডের চাকরি, গাইডের চাকরি…

তোমার নিজের লোকেরা আপত্তি করবে না? তারা বলবে না, ওই গড়ে রাজা শিরোমণি যখন ফিরে আসবেন, তখন তিনি যদি দ্যাখেন গড় সারিয়ে হোটেল হয়ে গেছে, তখন তিনি কোথায় যাবেন?

ওদের বোঝাবার দায়িত্ব আমার। চাকরি পেলে অতীতকে ভুলতে সময় লাগবে না।

হঠাৎ চৈতন্যঝোরার নৈঃশব্দকে ভেঙে খান খান করে দিয়ে চিৎকার করে উঠল প্রমিত বোঝাবার দায়িত্ব তোমার, তাই না? তুমি বোঝাবে যে, ওই রিসর্টে সাত আট হাজার লোককে চাকরি দেবেন ম্যডাম, আর তার বদলে যে জঙ্গলটা যুগ যুগ ধরে তোমাদের ভাত কাপড় যুগিয়ে যাচ্ছে, সেই জঙ্গলটাকে বিক্রি করে দিতে হবে। তুমি খুব ভালো করেই জানো মধু, একবার ওখানে রিসর্ট চালু হয়ে গেলে, বিনতা মেহরা তোমার লেংটি পরা জাতভাইদের ওই শিরোমণির। গড়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবেন না। দেখলেই কুকুর লেলিয়ে দেবেন ওদের পেছনে। তোমার অবশ্য তাতে কিছু যাবে আসবে না। তুমি তখন হয়তো শিলিগুড়ির কোনও বারে বসে ওই মেহরাদের সঙ্গেই কাবাব হুইস্কি খাবে। আমাকে চাপ দিয়ে কাজটা করানোর জন্যে বিনতা মেহরার কাছ থেকে কত টাকা পেয়েছ মধু?

প্রমিতের হঠাৎ রূপ বদলে, এবং তার চেয়েও বেশি তার কথাগুলোর ধাক্কায়, স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মধু বর্মন। তার সঙ্গীও একটু পেছনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছিল। ওদের দুজনেরই একটু আগের সেই ঘাড় তুলে দাঁড়াবার ভঙ্গিটা একেবারেই পালটে গেছে।

ঘৃণাভরে ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রমিত বলল, টাকাটা বিনতা মেহরাকে ফিরিয়ে দিও। বোলো, কাজটা সম্ভব নয়।

মধু আর তার সঙ্গী হঠাৎ উলটোদিকে ফিরে রাস্তার বাঁকে মোড় নিল। সেইখানেই নিশ্চয় ওদের বাহনটা রাখা ছিল। একটু বাদে মোটরবাইকের শব্দ দ্রুত মিলিয়ে গেল শহরের দিকে।

সেদিন আর চৈতন্যঝোরায় সময় কাটানো হল না প্রমিতের। মধু আর তার সঙ্গী চলে যাওয়ার পর জিপের পেছনের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সে অশোক রাইকে বলল, চল অশোক।

অশোক জিগ্যেস করল, কোথায় যাব স্যার?

সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর দিতে পারল না প্রমিত। সে কি এখন আলিপুরদুয়ারে বি.টি.আর এর অফিসে ফিরবে? হয়তো তাই যাওয়া উচিত। প্রতিদিন অজস্র ফাইল তার মতামতের জন্যে ওখানে আসে। একদিন কাজ না করলেই অনেক কাজ জমে যায়। কিন্তু আজ একদম অফিসে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না প্রমিতের। তার চোখে ভাসছিল অফিসের বারান্দায় পেতে রাখা বেঞ্চিতে দাঁতে শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে বসে থাকা তিন বিধবার মূর্তি। তাদের চোখে শূন্য দৃষ্টি। তাদের আশেপাশে দু-তিনটে শিশু ঘোরাঘুরি করছে, কখনও তারা ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদছে, কখনও আপনমনে খেলা করছে। মায়েদের হুঁশ নেই। অফিসে ঢুকতে বেরোতে গত কয়েকদিন ধরেই বারবার প্রমিত ওই তিন সদ্য স্বমীহারা রমণীর মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে, আর প্রত্যেকবারই সে দ্রুত পায়ে আড়াল খুঁজে পালিয়ে যাচ্ছে ওদের সামনে থেকে। অফিসের ভেতরে সে হেডক্লার্ককে ডেকে হাতজোড় করে বলছে, দেখুন না দত্তবাবু, বিমল, সন্দীপদের ডেথ গ্র্যাচুইটির টাকাগুলো একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়া যায় কিনা। ওরা তাহলে যে যার দেশে ফিরতে পারে।

চেষ্টা করছি তো স্যার। বোঝেনই তো, অ্যাবনর্মাল ডেথ। ফাইল কলকাতায় গেছে, সেখান থেকে ফেরত আসবে। তবে না।

দত্তবাবুর কথার সত্যতা বোঝে প্রমিত। কিন্তু সে কি করে অন্য কাউকে বোঝায়, অনুযোগহীন ওই তিন বিধবার শুন্যদৃষ্টির সামনে দিয়ে যাতায়াত করার সময় তার নিজের কি ভীষণ ক্লান্ত লাগে। মনে হয়ে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার শরীর মাটির ওপর ভেঙে পড়তে চায়।

তাহলে কি সে হরিণডুবি বিট অফিসে গিয়ে বসে থাকবে? কিন্তু সেখানেও তো বিমল বাবুয়াদের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াবে। ওই বিট-অফিসের গেট খুলেই রাতের পর রাত সে ওই তিন সহকর্মীর সঙ্গে নৈশ প্রহরায় বেরিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে ওই বিট অফিসেই ফিরে এসেছে। ওই অফিসের টালি ছাওয়া বারান্দাতে স্টোভ জ্বেলে চা করে খেয়ে ক্লান্ত চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়েছে চারজন একসঙ্গে। ওখানে গেলে এই সবই মনে পড়বে।

বাকি থাকে তার নিজের কোয়ার্টার। কিন্তু সেই ব্যাচেলর কোয়ার্টারেই বা কে আছে, যে তার মাথার মধ্যে জমে থাকা এই গভীর বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি দিতে পারবে? যার সঙ্গে দুটো অন্য কথা বলে সে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভুলে থাকবে ভয়াবহ মৃত্যুর কথা? সেখানেও তো ঘরগুলো শূন্যতায় হা হা করছে।

না, কেউ নেই।

প্রমিতের মায়ের কথা মনে পড়ল। কলকাতা থেকে মাকে কয়েকদিনের জন্যে আনিয়ে নেবে? একটা ফোন করবে দাদাকে? তরপরেই মনে হল না, থাক। এবার যাওয়ার সময় মা বলেই গিয়েছিল, সামনে তোতনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা রয়েছে। সেটা শেষ না হলে আর এদিকে আসতে পারবে না। তোতন দাদার ছেলে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা-বউদি দুজনেই চাকরি করে বলে ওর স্কুল যাওয়া, স্কুল থেকে ফেরত আসা এবং খাওয়া দাওয়া, সবটাই মায়ের হাতে৷ এই সময়ে মাকে নিয়ে চলে আসা মানে দাদা-বউদিকে বিপদে ফেলা।

শেষ অবধি আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিল প্রমিত। কলকাতার অফিসের সঙ্গে একটু যোগাযোগ করে দেখা যাক বিমলদের ডেথ-বেনিফিটের টাকাগুলো তাড়াতাড়ি আনানো যায় কি না।

প্রমিত সিটের ওপর সোজা হয়ে বসে বলল, আলিপুরদুয়ার চল অশোক।

.

০৫.

আচ্ছা, আমার তাহলে এখন কী হবে?

প্রমিত আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। সবে সকাল নটা বাজে। ভিজিটরদের ভিড় তাই একেবারেই নেই। জানলা দিয়ে প্রমিত দেখছিল, অফিস কম্পাউন্ডের মাঠে দুটো খঞ্জন পাখি দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে ওই পাখিদুটো ঠিক এই মাঠটিতেই মাইগ্রেট করে চলে আসে। সময় বা জায়গায় এতটুকু হেরফের। হয় না। গত দু-বছরে ওদের চিনে গেছে প্রমিত। পাখিদুটোর দিকে তাকিয়ে প্রমিত পরিযানের রহস্যের কথাই ভাবছিল। এমন সময়ে হঠাৎ ওই প্রশ্নে সে চমকে মুখ ফেরাল। দেখল দরজার কাছে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়েস বড় জোর তেইশ চব্বিশ বছর হবে। খুব রোগা, খুব ফরসা। এত ফরসা যে গলার কাছটায় নীল শিরা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট মুখে কালো লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমাটা বড্ড ভারী লাগছে। মেয়েটার পরণে ব্লু জিনস এবং হাতা গোটানো সাদা কটনের শার্ট। এই কালার কম্বিনেশনটার মধ্যেও একটা স্কুল ইউনিফর্মের ছাপ আছে, যেটা মেয়েটার বয়েসকে আরও কমিয়ে দেখাচ্ছে।

প্রমিতকে নিরুত্তর দেখে দরজা পেরিয়ে ঘরের মধ্যে দু-পা এগিয়ে এসে আবার জিগ্যেস করল মেয়েটি আমি তা হলে কী করব এখন?

চশমার ফ্রেমটা বোধহয় একটু ঢিলে হয়ে গেছে, বারবার চোখের সামনে থেকে নেমে যাচ্ছে, আর মেয়েটা সেটাকে দু-আঙুলে যথাস্থানে তুলে দিচ্ছে। কিম্বা এমনও হতে পারে যে, যুবতী মেয়েটা তার বালিকাসুলভ চেহারায় এইভাবে কিঞ্চিৎ ভারিক্কীভাব আনবার চেষ্টা করছে। মনে মনে হেসে ফেলল প্রমিত। মেয়েটার চেহারা এবং হাবভাবে যে একটা কমিক্‌ ব্যাপার আছে, সেটা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।

আসুন, এখানে বসে বলুন আপনার সমস্যাটা কী? তা না হলে আমি বলব কীভাবে, আপনি কী করবেন? প্রমিত হাতের ইঙ্গিতে তার উলটোদিকের চেয়ারগুলোর মধ্যে একটা দেখিয়ে দিল মেয়েটাকে।

চেয়ারে বসার পরেও মেয়েটা ইতস্তত করছিল। যেন কোথা থেকে কথাটা শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। প্রমিত তাকে সাহায্য করল–আপনার নামটাই বলুন আগে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। প্রমিতের প্রস্তাবটা যেন লুফে নিল মেয়েটি। আমার নাম দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত। পুরো নামটা অবশ্য কেউই বলে না। দ্যুতি বলেই ডাকে সক্কলে।

এইটুকু বলেই ব্যস, আবার চুপ। মোটা লেন্সের মধ্যে দিয়ে বড় বড় দুটো চোখ মেলে ঘরের চারপাশের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ বাদে প্রমিত বাধ্য হয়ে বলল, কী যেন একটা সমস্যার কথা বলছিলেন।

অফিসের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা বক্সার ম্যাপের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটি বলল, কই? সমস্যার কথা বলিনি তো।

তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এইভাবে বলল, ও, হ্যাঁ। আপনারা যে জঙ্গলে ঢোকা বারণ করে দিলেন, আমি এবার কী করব তাহলে?

ব্যাপারটা সামান্য হৃদয়ঙ্গম হল প্রমিতের। বিমল, বাবুয়ারা মারা যাবার পরেই প্রথম স্টেপ যেটা সে নিয়েছে, সেটা হল হরিণডুবি থেকে উত্তরদিকে কারুর যাতায়াত বারণ করে দিয়েছে। ওইদিকেই ভূটান সীমান্ত, ওইদিকেই বিপদ। এমনিতে তাতে কারুর বিশেষ অসুবিধে হবার কথা নয়, কারণ ওদিকে কোনও লোকালয় নেই। মাঝেমধ্যে শিলিগুড়ি কিম্বা কলকাতা থেকে ভ্রমণপিপাসু ছেলেমেয়েদের দল আসে। জয়ন্তীর জলধারার পাশ দিয়ে, ভুটানপাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওই স্বর্গের মতন সুন্দর পথে কিছুটা ট্রেক করে আসে তারা। একমাত্র তাদেরই এখন আটকে দেওয়া হচ্ছে। ওরা বাদে সোনারু মাঝির মতন লোকাল লোকজন, যারা বিভিন্ন প্রয়োজনে জঙ্গলে যেত, তারা নিজেরাই ওই ঘটনার পরে এমন ভয় পেয়ে গিয়েছে যে, উত্তরের জঙ্গলের দিকে পা বাড়াবার কথা মুখেই আনছে না। প্রমিত জিগ্যেস করল, আপনি কি কোনও ট্রেকিং দলের সঙ্গে এসেছেন?

আবার বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে প্রমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটি, মানে দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত। যেন ট্রেকিং শব্দটাই সে এই প্রথম শুনল। তারপর বলল, না তো। আমি একাই এসেছি। আমি রিসার্চের কাজে এসেছি।

এই একটা কথাতেই মেয়েটার পরিচয় পরিষ্কার হয়ে গেল প্রমিতের কাছে।

যেদিন বিমল বাবুয়াদের ওই দুর্ঘটনা ঘটল, ঠিক তার দুদিন আগে কলকাতা থেকে তাদের দফতরের এক বড়কর্তার একটা ফ্যাক্স এসে পৌঁছেছিল তার কাছে। তাতে বলা হয়েছিল ওই বড়কর্তার এক ঘনিষ্টা আত্মীয়া কলকাতা থেকে কি যেন রিসার্চের কাজে বক্সার জঙ্গলে ঘুরতে চায়। তাকে যেন প্রমিত সবরকমের সাহায্য করে। কলকাতা থেকে এ ধরনের অনুরোধ, বা বলা ভালো প্রচ্ছন্ন আদেশ, বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবারই আসে। প্রতি ক্ষেত্রেই প্রমিত যা করে, এবারেও তাই-ই করেছিল। ফ্যাক্সের কপিটা তার অফিসের বড়বাবু দত্তবাবুর হাতে দিয়ে বলেছিল, টেক প্রপার অ্যাকশন, দত্তবাবু! দেখবেন, আমার চাকরিটা যেন থাকে।

ভাইবেন না সার! আপনের চাকুরি না থাকলে আমারটাও কি রইব? পান-খাওয়া দাঁতে মিচকে হেসে দত্তবাবু কাগজটা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। ঝানু লোক। অতিথিদের সুখসুবিধের ব্যবস্থা কিভাবে করতে হয় সঅঅব জানেন। প্রমিত নিশ্চিন্ত হয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছিল। আর তার পরেই তো প্রমিতের প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মকে তছনছ করে দিল টেররিস্টদের তিনটে গুলি। মাঝের এই কটা দিনে সে আর সেই রিসার্চ ওয়ার্কারের কোনও খবরই নিতে পারেনি।

বেশ লজ্জিত হয়ে পড়ল প্রমিত। এই মহিলা…না, মেয়েটি এসেছে পাঁচদিন হয়ে গেল। এর মধ্যে একবার অন্তত তার উচিত ছিল, দত্তবাবু একে কোথায় রেখেছেন, ঘোরাঘুরির কী ব্যবস্থা করেছেন সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া।

মনে মনে জিভ কেটে প্রমিত বলল, আপনিই কি মজুমদার সাহেবের আত্মীয়া? কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে পি এইচ ডি করছেন?

মজুমদার সাহেব? মেয়েটা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ও, বুধোজ্যাঠার কথা বলছেন? হ্যাঁ, উনি আমার বাবার পিসতুতো দাদা।

প্রমিত নিজেকে সামলাতে পারল না। তাদের দফতরের দোর্দন্ডপ্রতাপ অফিসার সমীর মজুমদারকে বুধোজ্যাঠায় পর্যবসিত হতে দেখে হেসেই ফেলল।

হাসছেন কেন? মেয়েটা পরম গাম্ভীর্যের সাথে প্রশ্ন করল।

নেভার মাইন্ড। তা, দ্যুতিদেবী…

ইসসস! মেয়েটা নাক কুঁচকোলো। দেবী আবার কী? দ্যুতি, দ্যুতি। শুধু দ্যুতি। সবাই তাই বলে। আমার আড়াইবছরের বোনঝি অবধি আমাকে ডুটটি বলে ডাকে। মেয়েটা সম্ভবত ভাইঝির কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই ফিক করে একটু হাসল। প্রমিত দেখল, হাসলে ওর গজদাঁত দেখা যায়। হাসিটা নিঃসন্দেহে সুন্দর, এবং বেশিরভাগ সুন্দর জিনিসের মতনই–দুর্লভ।

প্রমিত ক্ষণেকের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে বলল, বেশ বেশ। তা দ্যুতি, আপনাকে কি আমাদের লোকেরা জঙ্গলে যেতে দিচ্ছে না?

হ্যাঁ। এদিকে আমার ছুটি ফুরিয়ে আসছে। কী হবে এখন?

কিছু একটা করতে হবে। আপনি বুধোজ্যাঠার ভাইঝি বলে কথা। আচ্ছা, আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কোথায়?

হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোয়।

আর আপনার কাজটা কী ধরণের? কোথায় যেতে হবে?

দ্যুতি আবার থতমত খেল। বলল, কোথায় যেতে হবে তা তো জানি না। জ্যেঠু বলেছিলেন আপনার কাছেই পরামর্শ নিতে। তবে যে কাজটার কথা ভেবেছি সেটা আপনাকে বলতে পারি।

বলুন।

এখানকার আদিবাসীদের ফোকটেলস্ নিয়ে কাজ করব। ওদের নানারকম রূপকথা, ব্রতকথা, মিথ…

ছেড়ে দিন।

মানে! কথার মধ্যে এইভাবে হঠাৎ বাধা পেয়ে দ্যুতি চোখ বড় করে বোঝবার চেষ্টা করল প্রমিত ইয়ার্কি মারছে কি না।

প্রমিত কিন্তু খুব সিরিয়াস গলাতেই আবার বলল, প্রোজেক্টটা ছেড়ে দিন, প্লিজ! আমি এমনিতেই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছি। তার চোখে মধু বর্মনের হিংস্র মুখটা ভেসে উঠল।

সে দ্যুতিকে বুঝিয়ে বলল–আসলে ব্যাপারটা কি জানেন তো? এই মুহূর্তে এখানে জঙ্গলের গ্রামগুলোয় যারা থাকে তাদের সঙ্গে আমাদের, মানে ফরেস্টের লোকজনের সম্পর্কটা নানান কারণে বেশ স্ট্রেইনড় হয়ে রয়েছে। ওদের মধ্যে কয়েকটা খারাপ লোক যেন তেন প্রকারেণ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে একটা গণ্ডগোল বাধানোর চেষ্টা করছে। এই সময়ে ধরুন আপনি কোনও একটা ফরেস্ট ভিলেজে কাজ করতে গেলেন। ওরা জানতে পারল, আপনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের কারুর আত্মীয়া, আমাদের অতিথি। জানতেই পারে, অসুবিধে কিছু নেই। আমাদের অফিসে ওদের নিত্য যাতায়াত। তখন ওরা আপনার সামান্য কোনও ত্রুটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে দেবে–আমাদের ধর্মে আঘাত করা হয়েছে, আমাদের বিশ্বাসে আঘাত করা হয়েছে…এইসব আর কি।

প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে আড়ি হলে একটা ছোট্ট মেয়ের মুখ যেমন অন্ধকার হয়ে যায়, প্রমিতের এই কথায় তেমনই ম্লান হয়ে গেল দ্যুতির মুখ। প্রমিত সেটা খেয়াল করে দুঃখিত হল। সে বেশ বুঝতে পারছিল, তার কথাগুলো ওই পড়ুয়া মেয়েটার স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে।

কিন্তু প্রমিতেরই বা উপায় কী? এই মুহূর্তে হরিণডুবির চারিদিকে যে টালমাটাল পরিবেশ তার মধ্যে কি একজন বহিরাগতা মেয়েকে একা ছেড়ে দেওয়া যায়? তবু প্রমিত খুব দ্রুত একটা। রাস্তা বার করার চেষ্টা করছিল যাতে দ্যুতি তার কাজটা করতে পারে। কোনও বড়সাহেবকে খুশি করার জন্যে প্রমিত এটা করছিল না। সে বুঝতে পারছিল, উলটোদিকে বসে থাকা ওই মেয়েটা বড্ড বেচারি, বড্ড কমজোরি। বইয়ের পাতায় যা লেখা আছে তার বাইরে ও দুনিয়াটাকেই খুব বেশি জানে না। কিন্তু একইসঙ্গে মেয়েটা বড্ড ভালো।

সেইজন্যেই প্রমিত চাইছিল দ্যুতির কাজটা না আটকাক।

ঠিক সেই সময়েই জানলার ঠিক বাইরের মোরাম বিছানো রাস্তায় খড়মড় শব্দ তুলে একটা জলপাই রঙের বোলেরো ভ্যান খুব স্মার্টলি বাঁক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সেইদিকে তাকিয়ে প্রমিতের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, কি আশ্চর্য! মিস্টার শইকিয়ার কথাটা মাথায় আসেনি কেন?

তারপর দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলল, দ্যুতি শুনুন।

উ! যথারীতি মেয়েটা এইটুকু সময়ের মধ্যেই তার নিজের চিন্তায় তলিয়ে গিয়েছিল। প্রমিতের ডাকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে সাড়া দিল।

মনে হয় আপনার জঙ্গলে যাওয়ার…মানে যাওয়ার এবং নিরাপদে ফিরে আসার একটা উপায় করতে পারব।

এইটুকু সময়ের মধ্যে প্রমিতের মতামত বদলে যাওয়ায় দ্যুতি স্বাভাবিকভাবেই একটু অবাক হল। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে বলতে না দিয়ে প্রমিত দরজার দিকে নির্দেশ করল।

দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকছিলেন বোলেরোর মালিক হাস্যোজ্জ্বল এক পুরুষ। লম্বা, চওড়া, স্বাস্থ্যবান। চকোলেট রঙের ট্রাউজারের ওপর গোলাপি পিন স্ট্রাইপ ফুল স্লিভ শার্ট। ঘন চুলে সামান্য কিছু রুপোলি আঁচড়। বয়েস পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে। ঢুকতেই তার দিকে প্রমিতের বাড়ানো হাতটা দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুখের হাসিটা একইরকম রইল।

তাকে দেখিয়ে প্রমিত দ্যুতিকে বলল, মি ডক্টর রূপেন শইকিয়া, বক্সা টাইগার রিজার্ভের একজন বড় বন্ধু। আপনাকে ওনার সঙ্গেই গেঁথে দেব। উনি সঙ্গে থাকলে ক্ষ্যাপা হাতিও আপনাকে শুড় তুলে সেলাম দিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেবে।

কার সামনে আমাকে এইভাবে গ্লোরিফাই করছেন সেটা জানতে পারলে ভালো লাগত। হাতের অ্যাটাচিটা পাশে নামিয়ে রেখে একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসলেন রূপেন শইকিয়া। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খাঁটি সেগুনের আলিশান চেয়ার অবধি সেই ওজনে মচমচ করে উঠল। মিস্টার শইকিয়ার চোখের কৌতূহলী দৃষ্টি দ্যুতির দিকে।

মিট মিস দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত…দ্যুতি। আমাদের মজুমদার সাহেবের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে তো? ডেপুটি চীফ কনজার্ভেটর সমীর মজুদার? ওনার আত্মীয়া। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পি এইচ ডি অ্যাসপায়ারান্ট। সাবজেক্ট অ্যানথ্রোপলজি, মানে নৃতত্ব। বাংলাটা ঠিক বললাম তো?

দ্যুতি ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

উনি এখানে এসেছেন ফিল্ড ওয়ার্ক করবেন বলে।

আচ্ছা, আচ্ছা। রূপেন শইকিয়া দু-হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন দ্যুতিকে। তারপর যোগ করলেন, আমি কিন্তু আপনি আজ্ঞে চালাতে পারব না। তোমার বয়েসি অনেক ছাত্রী ছিল। আমার।

দ্যুতি কথাটা ভালো বুঝতে পারল না। ইনি কি প্রফেসর?

প্রমিত দ্যুতিকে বলল, দ্যুতি, ডক্টর শইকিয়ার সঙ্গে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। আপাতত এইটুকু জেনে রাখুন। ডক্টর শইকিয়া এখানে এলে হরিণডুবি বাংলোতেই ওঠেন। মানে, আগামী কদিন উনি আপনার পাশের ঘরেই থাকবেন। ওনার সম্বন্ধে বাকিটা ওনার কাছ থেকেই ধীরেসুস্থে শুনে নেবেন। ওনার ভাণ্ডারে জঙ্গল নিয়ে অজস্র গল্প আছে। আপনার রিসার্চের কাজেও তার কিছু কিছু লেগে যেতে পারে।

রূপেন শইকিয়া হাত নেড়ে বললেন, আরে ধুর, ওসব কিছু না। তুমি আমার সঙ্গে এসো দ্যুতি। আমি এই টেন্ডার পেপারগুলো অফিসে জমা দিয়েই বেরিয়ে পড়ব। তারপর আমরা একসঙ্গেই হরিণডুবিতে ফিরব। কাল সকালে আমি তোমাকে জঙ্গলে নিয়ে যাব। তার আগে আজ সন্ধেবেলা তুমি আমাকে তোমার ফিল্ড-ওয়ার্কের প্ল্যানটা বুঝিয়ে দেবে, কেমন?

দ্যুতি ইতস্তত করে বলল, জঙ্গলে ঢুকবেন? কিন্তু রেস্ট্রিকশন?

জবাবটা দিল প্রমিত। বলল, ও রেস্ট্রিকশন ডক্টর রূপেন শইকিয়ার জন্যে নয়। এই জঙ্গল আর জঙ্গলের লোকজনকে উনি নিজের ঘরের লোকের থেকেও ভালো করে চেনেন। নিজেকে কেমন করে বাঁচাতে হবে সেটাও। ভালো কথা, মিস্টার শইকিয়া। আপনার সঙ্গে আমার একটু অন্য ব্যাপারে কথা ছিল।

রূপেন শইকিয়া প্রমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, বললেন, বিমল, বাবুয়াদের মার্ডার নিয়ে কি?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল প্রমিত। মুখে বলল, ডিটেইলস তো আপনাকে ফোনে বলেছি। আমি কিন্তু এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি একবার জায়গাটা দেখবেন?

রূপেন শইকিয়া বললেন, হ্যাঁ, সে দেখতে আর অসুবিধে কোথায়? কাল ভোরবেলা তাহলে চলে আসুন না হরিণডুবি। আমি, আপনি আর দ্যুতি একসঙ্গেই জঙ্গলে ঢুকব। যাবার পথে ওই জায়গাটাও একবার ঘুরে যাব। তবে, আপনি যেখানে কিছু বুঝতে পারছেন না, সেখানে আমি আর নতুন করে কী বলব বলুন তো? এই বলে, অ্যাটাচি-কেসটা হাতে নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আচ্ছা, আজ আমি একবার অফিসটা ঘুরে তাহলে বেরিয়ে পড়ছি। চল। দ্যুতি।

এই প্রথম অন্তর্মগ্নতার ডুবজল থেকে মাথা তুলে দ্যুতি একটু বেশিক্ষণ প্রমিতের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে কোনও ধন্যবাদ দিল না। তবে চেয়ার ছেড়ে উঠবার সময় আবার সেই খুশির হাসি হেসে বলল, কাল ভোরে দেখা হচ্ছে তা হলে?

সিওর।

এত নিশ্চিত স্বরে প্রমিত গত কয়েকদিনে কোনও কথা বলেনি।

1 Comment
Collapse Comments

Can you please publish 2020 (1427) pujabarshiki specially Ananda,Kishor Bharati,Sukhtara,Pratidin,Aajkal,Ei Samay

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *