০১. লাল নীল দীপাবলি

লাল নীল দীপাবলি

যদি তুমি চোখ মেললা বাঙলা সাহিত্যের দিকে, তাহলে দেখবে জ্বলছে হাজার হাজার প্রদীপ; লাল নীল সবুজ, আবার কালোও। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য। এর একেকটি বই একেকটি প্রদীপের মতো আলো দিচ্ছে আমাদের। বুক ভরে যায় সে-আলোকের ঝরনাধারায়; সে-আলোকে ভরে যায় টেবিল, খাতার ধূসর সাদা খসখসে পাতা, পৃথিবী ও স্বপ্নলোক। সাহিত্য হচ্ছে আলোর পৃথিবী, সেখানে যা আসে আলোকিত হয়ে আসে; কালো এসে এখানে নীল হয়ে যায়, অসুন্দর হয়ে যায় সুন্দর শিল্পকলা। বাঙলা সাহিত্যকে এমন সুন্দর করে রচনা করেছেন যুগ যুগ ধরে কতো কবি, কতো গল্পকার। তাঁদের অনেকের নাম আমরা মনে রেখেছি, ভুলে গেছি অনেকের নাম। কিন্তু সকলের সাধনায় গড়ে উঠেছে বাঙলা সাহিত্য। সবাই সমান প্রতিভাবান নন, সময় সকলকে মনে রাখে না। সময় ভীষণ হিংসুটে, সে সব সময়ই বসে আছে একেকজন লেখকের নাম তার পাতা থেকে মুছে ফেলতে। এভাবে মুছে গেছে কতো কবির নাম; কতো লেখকের মুখের ছবি অকরুণ আঙুলে মুছে ফেলেছে সময়। কিন্তু এমন অনেকে। আছেন সময় যাঁদের ভোলে না, বরং তাঁদের নাম সোনার অক্ষরে লিখে রাখে। যেমন বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বিহারীলাল, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের নাম, বা চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, আলাওলের নাম। এঁরা এতো বড়ো যে ভোলা যায় না, বরং তাদের নাম বার বার মনে পড়ে।

সময় থেমে থাকে না, সময়-নদী গোপনে বয়ে যায়। সাহিত্যও সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলে। এভাবেই সাহিত্যের বিকাশ ঘটে, তার রূপান্তর সম্পন্ন হয়। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম বইটি হাতে নিলে চমকে উঠতে হয়, এটা যে বাঙলা ভাষায় লেখা সহজে বিশ্বাস হয় না। কেননা হাজার বছর আগে আমাদের ভাষাটিও অন্য রকম ছিলো, তা পরিবর্তিত হতে হতে আজকের রূপ ধরেছে। এক হাজার বছর আগে সাহিত্যও আজকের মতো ছিলো না। আজ যে-সব বিষয়ে সাহিত্য রচিত হয়, তখন সে-সব বিষয় নিয়ে কোনো কবি লিখতেন না। সময় এগিয়ে গেছে, সাহিত্যের জগতে এসেছে নতুন নতুন ঋতু, এর ফলে বদলে গেছে তার রূপ। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম বইটির নাম হলো চর্যাপদ। এর কবিতাগুলো ছোটো ছোটো, কবিদের মনের কথা এগুলোতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এর পরেই দেখা দেয় বড়ো বড়ো বই, বিরাট বিরাট তাঁদের গল্প, এবং কবিরাও মনের কথা বলছেন না, বলছেন মানুষ ও দেবতার গল্প। এর পরে আবার আসে ছোটো ছোটা কবিতা, এগুলোকে আমরা বলি বৈষ্ণব পদাবলি। এগুলোতে প্রবল আবেগ আর মনের কথা বড়ো হয়ে ওঠে। এভাবে সাহিত্য বদলায়। কবিরা চিরকাল একই বাঁশি বাজান না। প্রতিটি নতুন সময় তাঁদের হাতে তুলে দেয় নতুন বাঁশরী।

বাঙলা সাহিত্য সম্বন্ধে আরো একটি কথা মনে রাখার মতো। এ-সাহিত্য জন্ম থেকেই বিদ্রোহী; এর ভেতরে জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। কেননা এ-আগুন? বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য সমাজের উঁচুশ্রেণীর লোকের কাছে সহজে মর্যাদা পায় নি। এর জন্মকালে একে সহ্য করতে হয়েছে উঁচুশ্রেণীর অত্যাচার, উৎপীড়ন। দশম শতকে যখন বাঙলা সাহিত্য জন্ম নিচ্ছিলো, তখন সংস্কৃত ছিলো সমাজের উঁচুশ্রেণীর ভাষা, তারা সংস্কৃতের চর্চা করতো। ঠিক তখনি সংগোপনে সাধারণ লোকের মধ্যে জেগে উঠছিলো বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য। সাধারণ মানুষ একে লালনপালন করেছে বহুদিন। সমাজের উঁচুশ্রেণীর লোকেরা সব সময়ই হয় সুবিধাবাদী; যেখানে সুবিধা সেখানে তারা। তাই জন্মের সময় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য তাদের ভালোবাসা পায় নি, পেয়েছে অত্যাচার। তারপরে মুসলমান আমলে এ-উঁচুশ্রেণী সংস্কৃতের বদলে সেবা করেছে ফারসির, এবং ইংরেজ রাজত্বে তারা আঁকড়ে ধরেছে। ইংরেজিকে। অথচ এরা ছিলো এদেশেরই লোক। তবে বাঙলা ভাষা বিদ্রোহী, অত্যাচারকে পরোয়া করে নি; নিজেকে প্রিয় করে তুলেছে সাধারণ মানুষের কাছে, সাধারণ মানুষের বুকের মধ্যে অগ্নিশিখার মতো জ্বলেছে। সাধারণ মানুষ একে নিজের রক্তের চেয়েও প্রিয় করে নিয়েছে, এবং একে ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। এর ফলে ভীত হয়েছে উঁচুশ্রেণী, এবং সব কিছুকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য।

বাঙলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। চর্যাপদ হচ্ছে বাঙলা সাহিত্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বা গ্রন্থ। এটি রচিত হয়েছিলো দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে [৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ]। এরপরে যুগে যুগে কবিরা, লেখকেরা এসেছেন; সৃষ্টি করে গেছেন বাঙলা সাহিত্য। আমরা আজকাল সাহিত্যে দুটি ভাগ দেখে থাকি; এর একটি কবিতা, আর একটি গদ্য, যে-গদ্যে লেখা হয় গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নাটক আরো কত কী। বাঙলা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ কবিতা; ১৮০০ সালের আগে বাঙলা সাহিত্যে গদ্য বিশেষ ছিলোই না। এতোদিন ধরে রচিত হয়েছে কেবল কবিতা। কবিতায় লেখা হয়েছে বড়ো বড়ো কাহিনী, যা আজ হলে অবশ্যই গদ্যে লেখা হতো। ভাবতে কেমন লাগে না যে সেকালে কেউ গদ্যে লেখার কথা ভাবলেন না, সব কিছু গেঁথে দিলেন ছন্দে! সব সাহিত্যেরই প্রথম পর্যায়ে এমন হয়েছে। এর কারণ মানুষ কবিতার যাদুতে বিহ্বল হ’তে ভালোবাসে। সেই কবে যেদিন প্রথম সাহিত্যের আবির্ভাব ঘটেছিলো, সেদিন লেখকের বুকে তরঙ্গিত হয়ে উঠেছিলো ছন্দ। তখন মানুষ সাহিত্যে খোঁজ করতো তা, যা বাস্তব জীবনে পাওয়া যায় না। যে-ভাষায় তারা সারাদিন কথা বলতো, যে-গদ্যে ঝগড়া করতো, তাতে সাহিত্য হতে পারে একথা তারা ভাবতে পারে নি। তাই তারা বেছে নিয়েছিলো এমন জিনিশ, যা প্রতিদিনের ব্যবহারে মলিন নয়, যাতে ছন্দ আছে, সুর আছে। এমন হয়েছে সব দেশের সাহিত্যে; বাঙলা সাহিত্যেও। দশম শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্য রচিত হয়েছে কবিতায়, বা পদ্যে।

লাল নীল দীপাবলি বাঙলা সাহিত্যের প্রধান সংবাদগুলো শোনাবে। সব সংবাদ শুনবে বড়ো হলে। তখন তোমাদের হাতে আসবে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বা বৈষ্ণব পদাবলি। হাতে পাবে বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের লেখা বড়ো বড়ো বইগুলো। রবীন্দ্রনাথ তখন তোমার হাতে হাতে ফিরবে; তোমার জন্যে কবিতা গল্প নাটক নিয়ে টেবিলে এসে হাজির। হবেন কবি মধুসূদন দত্ত, ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঔপন্যাসিক শরৎ-বিভূতিমানিক-তারাশঙ্কর, কবি জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব, এবং আরো অনেকে। এবং আসবেন একালের লেখকেরা। তোমার চতুর্দিকে প্রদীপ, মাঝখানে তুমি বসে আছে। রাজা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *