সুতো

সুতো

না, এবারে অবস্থা একেবারে সঙ্গিন। খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে সংকটজনক পরিস্থিতি।

অন্তত আমাদের বুদ্ধিতে আর কুল পাওয়া যাচ্ছে না।

একে একে সব কলাকৌশলই আমরা প্রয়োগ করেছি, কিন্তু সবই বৃথা।

কঞ্চির তীরের মতো আমাদের সব ফন্দিফিকির এক দুর্ভেদ্য বর্মে ঠেকে নিল হয়ে গেছে।

প্রথমে গৌর, তারপর আমি এবং আমাদের পরে শিবু ও শিশির হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। ঘনাদাকে তাঁর ঘর থেকে নীচে নামাতে পারিনি।

আজ সাতদিন ধরে তিনি স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন নিজের তেতলার ঘরে।

রামভুজ দু বেলা খাবারের থালা পৌঁছে দিয়ে আসে। উদ্ধব জলের কুঁজো ভরে দিয়ে এসে সে থালা যথারীতি রোজ দুবার নামিয়ে আনে।

ব্যস। মেসের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক ঘনাদার নেই।

আমরা চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কিন্তু ঘরের দরজাই না খুললে বাইরে থেকে কত আর কৌশল প্রয়োগ করা যায়। দরজায় টোকা দিয়ে তবু ডেকেছি, শুনছেন, ঘনাদা!

কোনও সাড়া নেই প্রথমে। বারকয়েক ডাকের পর ভেতর থেকে একটা আওয়াজ শোনা গেছে যার মধ্যে অভ্যর্থনার বাম্পও নেই!

কে?

প্রশ্নটা অর্থহীন, কারণ আমাদের সকলের গলাই ঘনাদার ভাল রকম চেনা। তবু সবিস্তারে পরিচয় দিয়ে শিবুই হয়তো জানায়, আজ্ঞে, আমি শিবু। আপনার সঙ্গে বিশেষ একটু দরকার ছিল।

পরে এসো।

মুশকিল ওইখানেই। ঘনাদা অন্য কিছু বলে বিদায় করতে চাইলে তবু উপরোধ অনুরোধ করা যায়। তিনি যদি রাগ দেখান তাতেও ক্ষমা চেয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করবার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু পরে এসো বলবার পর বেশিক্ষণ তা নিয়ে আর সাধাসাধি চলে না।

পরে এসেও অবশ্য তাঁর দরজা খোলা পাওয়া যায় না। হয় তিনি ঘুমোচ্ছেন, নয় বাথরুমে গেছেন।

নিরুপায় হয়ে শেষে রামভুজের সঙ্গেই সেদিন রাত্রে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়লাম। একটু চালাকি অবশ্য করতে হয়েছিল। দুবেলা রামভুজ এসে বড়বাবু, খাবার আনিয়েছি বলে ডাকলে তিনি দরজা খুলে দেন। আমরা একেবারে নিঃশব্দে রামভুজের পেছন পেছন এসে সেদিন দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেছি।

দরজা খোলার পর রামভুজ মেঝের ওপর থালা বাটি সাজাচ্ছে এমন সময়ে আমাদের প্রবেশ।

ঘনাদা আসনে বসে সবে গেলাসের জলে হাতটা ধুয়ে মহাযজ্ঞের জন্য তৈরি হচ্ছেন, এমন সময় আমাদের ক-জনকে দেখে মুখে তাঁর আষাঢ়ের মেঘ নেমে এসেছে।

শিশির তখন তাঁকে দেখিয়ে দেখিয়েই নতুন সিগারেটের টিনটা ঢাকনা ঘুরিয়ে খুলে হাওয়া ঢোকবার আওয়াজটুকু পর্যন্ত শুনিয়ে দিয়েছে। শিবু যেন রেগে গিয়ে রামভুজকেই বকতে শুরু করেছে, তোমার কী রকম আক্কেল, ঠাকুর! ওইটুকু বাটিতে ঘনাদার জন্য মাংস এনেছ! কেন, আর বড় বাটি নেই মেসে?

তা, যে বাটিতে ঘনাদাকে মাংস দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে বড় বাটি অবশ্য ফরমাস দিয়ে না গড়ালে বোধহয় পাওয়া মুশকিল।

কিন্তু হায়, সবই বৃথা!

ঘনাদা আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত না করে রামভুজকেই উদ্দেশ করে বলেছেন, এসব নিয়ে যাও রামভুজ! আমি আজ আর খাব না।

আমরা হতভম্ব! রামভুজও তথৈবচ। তবে তার মুখেই প্রথম কথা বেরিয়েছে, খাইনে না কী বলছেন, বড়বাবু! আজ ভাল মটন আছে। আমি কোপ্তা কারি বানিয়েছি।

ঘনাদা আড়চোখে একবার মাংসের বাটিটার দিকে চাইলেও নিজের সংকল্পে অটল থেকেছেন।

না, আমার খাবার উপায় নেই। উপায় নেই! হঠাৎ হল কী? আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে সবিস্ময়ে! ঘনাদা রামভুজকেই শুনিয়ে বলেছেন, কারুর সামনে আমার খাওয়া বারণ, তুমি তো জানো।

রামভুজ কী জানে তা আর আমরা যাচাই করবার জন্য অপেক্ষা করিনি। সবাই তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এসেছি অপ্রস্তুত হয়ে। ঘনাদার একথা শোনার পর আর সেখানে থাকা যায়!

 

সেই থেকে আজ সাতদিন হল ঘনাদার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।

ঘনাদার রাগটা এবার একটু বেশি এবং তা নেহাত অকারণেও নয়। আমাদের রসিকতাটা এবার বোধহয় মাত্রা একটু ছাড়িয়েও গেছল।

কিন্তু সব দোষ তো আসলে সেই বাপি দত্তর।

হাঁস খাইয়ে খাইয়ে আমাদের পাগল করে না তুললে তাকেই অমন একদিন খেপে গিয়ে মেস ছাড়তে হয়, না ঘনাদা আমাদের সঙ্গে সব সম্বন্ধ ঘুচিয়ে দেন!

বাপি দত্ত দুমাসে বিগড়ি হাঁসের পেছনে বেশ কিছু গচ্চা দিয়ে নিজেও জব্দ হয়ে গেল, আমাদেরও মেরে গেল। আপনি মজিলি তুই, মজালি লঙ্কায়। এই আর কী!

গায়ের জোরে না মারুক, যাবার সময় বাপি দত্ত যেসব বাক্যবাণ ছেড়ে গেছে, নেহাত গণ্ডারের চামড়া না হলে আমরা তাতেই কাবু হতাম। বাপি দত্ত রোজকার মতো মিউনিসিপ্যাল মার্কেট থেকে হাঁস কিনে এনে নিজেই সেদিন যথারীতি কাটতে বসেছে। ধৈর্য তার অসীম সন্দেহ নেই। দুমাস ধরে হাঁস কেটে নাড়িভুড়ি ছাড়া কিছু না পেয়েও সে দমেনি। ঘনাদার সেই সাত রাজার ধন মানিকের কৌটা কোন হাঁসের পেট থেকে বেরিয়ে হঠাৎ একদিন তাকে রাজা করে দেবে, এ বিশ্বাস নিয়েই সে রোজ হাঁস কাটতে বসে।

অন্যদিন আমরা কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে ঠাট্টা বিদ্রুপ মাঝে মাঝে করি।

কী হে, দত্ত! পেলে কৌটো? বিগড়ি হাঁস ছেড়ে এবার পাতিহাঁস ধরো হে! ইত্যাদি।

এ-দিন কিন্তু আমরা বাপি দত্ত হাঁস কাটতে বসার পরই যে যেখানে পারি গা ঢাকা দিয়েছিলাম।

হঠাৎ বাপি দত্তর বাজখাঁই গলার চিৎকারে মেস কম্পমান! ইউরেকা! পেয়েছি। পেয়েছি।

আমরা যে যার জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে সবিস্ময়ে নীচে উঁকি দিয়েছি এবার! ঘনাদা পর্যন্ত তাঁর তেতলার ঘর থেকে নেমে এসে বারান্দা দিয়ে গলা বাড়িয়েছেন।

বাপি দত্ত নীচের উঠোন থেকে কী একটা রক্ত-মাখা জিনিস হাতে তুলে ধরে শুধু বুঝি ধেই নৃত্য করতে বাকি রেখেছে—শিগগির শিগগির আসুন! মার দিয়া কেল্লা!

আমরা শশব্যস্ত হয়ে নীচে নেমে গেছি—ঘনাদাকেও এক রকম টানতে টানতে সঙ্গে নিয়ে।

নীচে নামবার পর বাপি দত্তের গলায় যত উত্তেজনা, আমাদের মুখে তত বিমূঢ় বিস্ময়!

বলেছি, অ্যাঁ! সেই কৌটো! সেই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা যাতে কেনা যায় সেই ভারী জলের হ্রদের ম্যাপ?

আড় চোখে ঘনাদার মুখটাও দেখে নিয়েছি তার মধ্যে। কিন্তু কেমন, কী বলেছিলাম! ভাবখানার বদলে তাঁকে যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকাই দেখিয়েছে।

বাপি দত্তর সে দিকে লক্ষ নেই। কৌটোটা ঘনাদাকে সগর্বে দেখিয়ে সে হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁসের পেট কেটে সেটা বার করার কাহিনী সবিস্তারে শুরু করেছে।

শিবু একটু কেশে বাধা দিয়ে বলেছে, কিন্তু কৌটোটা এবার খুললে হত না!

শিশির গম্ভীর মুখে সায় দিয়ে বলেছে, তবে খোলবার সম্মানটা ঘনাদারই পাওয়া উচিত।

বাপি দত্ত সোৎসাহে বলেছে, নিশ্চয়! নিশ্চয়! ঘনাদা ছাড়া খুলবে কে? কৌটোটা সে ঘনাদার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু ঘনাদার হঠাৎ হল কী? এত বড় জয়-গৌরবের মুহূর্তে তিনি যেন সরে পড়তে পারলে বাঁচেন।

না, না, আমার কী দরকার! ও তোমরাই খোললা! বলে তিনি সটান সিড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন।

কিন্তু বাপি দত্তই তাঁকে আটকেছে। আনন্দে গদগদ হয়ে বলেছে, তা কি হয় নাকি! এ আপনারই কৌটো, আপনাকেই খুলতে হবে?

অগত্যা ঘনাদাকে বাধ্য হয়ে কৌটোটা খুলতে হয়েছে। আমরা সকলে তখন উদগ্রীব হয়ে তাঁকে চার ধারে ঘিরে দাঁড়িয়েছি। বাপি দত্তর চোখ দুটো প্রায় কোটর ঠেলে বুঝি বেরিয়েই আসে।

কৌটোর ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের যে চিৎকার উঠেছে তা প্রায় মোহনবাগান কি ইস্টবেঙ্গলের শেষ মিনিটে গোল দিয়ে জিতে যাবার সামিল।

বাপি দত্ত আর ধৈর্য ধরতে পারেনি। ঘনাদার হাত থেকে কাগজের পাকান টুকরোটা নিজের অজান্তেই ছিনিয়ে নিয়ে খুলে ফেলেছে।

তারপর তার মুখে পর পর যে ভাবান্তর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেছে, ছায়াছবিতে হলে হাততালি পেত নিশ্চয়।

প্রথমে আহ্লাদে আটখানা, তারপরে চমকে হতভম্ব, তারপর একেবারে কালবোশখির কালো মেঘ।

সেই কালবোশেখির মেঘই গর্জে উঠেছে এবার, কার, কার এই শয়তানি?

গৌর বোকা সেজে বাপি দত্তের হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিয়ে পড়ে শুনিয়েছে ভাল মানুষের মতো।

কাগজের টুকরোতে গোটা গোটা করে ছাপার হরফের মতো লেখা—ঘনাদার গুল!

তারপর যে লঙ্কাকাণ্ড হয়েছে তার পরিণামেই বাপি দত্ত মেস ছেড়েছে আর ঘনাদা ছেড়েছেন আমাদের।

 

বিকেল বেলা।

ঘনাদার রুটিন আমাদের জানা। এতক্ষণে তিনি দুপুরের দিবানিদ্রা সেরে গড়গড়ায় পরিপাটি করে তামাকটি সেজে পরমানন্দে খাটের ওপর বালিশ হেলান দিয়ে বসে তা উপভোগ করছেন। এই গড়গড়ায় তামাক খাওয়াটা ইদানীং শুরু হয়েছে, আমাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পর।

হঠাৎ নীচে শোরগোল উঠল। গৌর গলা চড়িয়ে শিশিরকে বকছে, আচ্ছা, তুই পিয়নকে ফেরত দিলি কী বলে?

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গলা। শিশিরকে সবাই মিলে আমরা কোণঠাসা করছি চেচিয়ে।

আহা! একবার জিজ্ঞেস করে দেখা তো উচিত ছিল?

একেবারে হিয়া নেহি বলে বিদেয় করবার কী দরকার ছিল!

ঘনাদার নাম যখন বললে, তখন তাঁকে একবার ডাকতে ক্ষতি কী ছিল!

শিশির যেন সকলের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে রেগে জবাব দিলে, ডেকে লাভ কী! ঘনাদা কি ঘর থেকে বেরুতেন! আর রেজেস্ট্রি চিঠি ঘনাদার নামে কোখেকে আসবে?

কয়েক সেকেন্ড বিরতির মধ্যে টের পেয়েছি ওপরে গড়গড়ার ভুড়ুক ভুভুক আওয়াজ থেমে গিয়েছে।

দরজার খিলটা সাবধানে খোলার আওয়াজও যেন পাওয়া গেল। আমরাও গলা। চড়িয়ে দিলাম।

রেজেস্ট্রি করা চিঠি কেউ ফেরত দেয়? তার ওপর আবার ইনসিওর করা! ওই ইনসিওর শব্দটিতে বাজিমাত হয়ে গেল।

একটা গলা খাঁকারির আওয়াজে আমরা যেন চমকে চোখ তুলে তাকালাম। ঘনাদা ছাদের আলসের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ঘর থেকে বেরিয়ে।

এই যে ঘনাদা! শুনেছেন শিশিরের আহাম্মকি!

সেইটেই শুনতে চাইছি।

আর দুবার বলতে হল না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে সবাই ওপরের ছাদে গিয়ে হাজির। তারপর এর মুখের কথা ও কেড়ে নিয়ে সবিস্তারে ফলাও করে ব্যাপারটা জানানো হল। সেই সঙ্গে শিশিরকে গালমন্দ আর আমাদের থেকে থেকে আপশোস!

ইস, ইনসিওর করা চিঠি—! কী ছিল তাতে কে জানে!

কিন্তু পোস্টাফিসে গেলে এখনও তো সে চিঠি পাওয়া যায়! ঘনাদা নিজেই পথ খুঁজে বার করলেন আগ্রহের সঙ্গে।

আমরা তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আর কী করে পাওয়া যাবে! কালই নাকি শেষ তারিখ ছিল চিঠি দেবার! আজ একবার শুধু শেষ চেষ্টা করবার জন্য এসেছিল। পিয়ন বলে গেল আজ দুপুরেই চিঠি যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফেরত যাবে।

শিশিরকেই আমরা ধমকালাম, ফেরত যাবে মানে? এতদিন কী করছিল? রেজেস্ট্রি চিঠি এতদিন দেয়নি কেন?

নামের একটু গোলমাল ছিল যে। নাম ছিল Gana Sam Dos, তাইতেই পোস্টাফিস ঠিক বুঝতে পারেনি এতদিন? শিশির ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তুললে।

আমরা শিশিরের ওপরেই চটে উঠলাম, বুঝতে পারেনি বললেই হল। নামে গোলমাল থাক, ঠিকানা তো ছিল, আর বিদেশের চিঠিতে নামের বানান তো কতরকম হতে পারে। ঘনাদার কি শুধু ইংরেজেদের সঙ্গেই কারবার! জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান কার সঙ্গে নয়?

না, দোষ কিন্তু শিশিরের! শেষ পর্যন্ত আমরা শিশিরের ওপরেই গিয়ে পড়লাম, চিঠিটা ও কী বলে ফেরত দিলে?

খুব অন্যায় হয়েছে আমার! অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য শিশির যেন সিগারেটের টিনটা খুলে ধরল।

ঘনাদা অন্যমনস্ক ভাবে তা থেকে একটা তুলে নিতেই আর আমাদের পায় কে? চিঠিটা কোনও জার্মানের লেখা বোধহয়। শিবুই জল্পনা শুরু করে দিলে সোৎসাহে, ঘনাদাকে সেখানে হের ডস নামেই তো সবাই চেনে।

গৌর প্রতিবাদ জানালে, না, না, নিশ্চয়ই ফরাসি কেউ লিখেছে। কী শিশির নামের আগে সঁসিয়ে ছিল না?

মঁসিয়ে নয়, সেনর বলে মনে হচ্ছে। ইটালি থেকে কেউ লিখেছে বোধহয়। তাই? প্রশ্নটা শিশিরকেই করলাম।

শিশির অপরাধীর মতোই স্বীকার করলে চিঠির নামের আগে কী লেখা ছিল সে লক্ষই করেনি।

তা লক্ষ করবে কেন? তা হলে যে কাজ হত! বলে শিশিরকে ধমকে গৌর সোজা ঘনাদাকেই প্রশ্ন করলে, চিঠিটা কোথা থেকে কে পাঠিয়েছিল কিছু বুঝতে পারছেন?

কয়েকটা উৎকণ্ঠিত মুহূর্ত। পাল্লা কোনদিকে হেলবে? সন্ধি, না বিগ্রহ?

শিবু হঠাৎ পাল্লায় পাষাণ চড়িয়ে দিলে আলসে থেকে ঝুঁকে ঠাকুরকে চিৎকার করে ডেকে, আমাদের কবিরাজি কাটলেটগুলো আর চা ওপরেই নিয়ে এসো ঠাকুর। ঘনাদার দিকে ফিরে সলজ্জভাবে বিশদ বিবরণও দিয়ে দিলে, স্পেশা , অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি আজ!

ওই পাষাণটুকুতেই পাল্লা হেলল। কাটলেটের কথা যেন শুনতেই পাননি এইভাবে ঘনাদা আগেকার প্রশ্নটাকেই তুলে ধরলেন, চিঠিটা কোথা থেকে কে পাঠিয়েছে, জানতে চাও, কেমন?

আমরা ঘনাদার আগেই তাঁর ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললাম, হ্যাঁ, হঠাৎ বিদেশ থেকে ইনসিওর করা চিঠি!

ততক্ষণে ঘনাদার ঘরে আমরা ঢুকে পড়েছি। নীচে থেকে বড় ট্রেতে করে চা আর কাটলেটের ডিসও এসে গেছে।

ঘনাদা তাঁর তক্তপোশটিতে সমাসীন হয়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা কাটলেট তুলে নিয়ে বললেন, চিঠিটা হঠাৎ নয় হে, এই চিঠি…

কথাটা আর শেষ করা তাঁর হল না। পরপর চারটি স্পেশাল অর্ডার দেওয়া কবিরাজি কাটলেট যথাস্থানে প্রেরিত না হওয়া পর্যন্ত কথাটার সঙ্গে আমরাও মাঝপথেই ঝুলে রইলাম।

কাটলেটের পর ডান হাতের তর্জনী ও অনামিকার মধ্যে শিশিরের গুঁজে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া সিগারেটটিতে দুবার সুখটান দিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি বাক্যাংশটি শেষ করলেন।

…অনেকদিন আগেই আসার কথা।

তাহলে কে পাঠিয়েছে বুঝতে পেরেছেন! আমরা যেন অবাক!

তা আর বুঝিনি! ওই নামের বানান দেখেই বুঝেছি। আমার নামের বানান শুধু একজনেরই করা সম্ভব। আজ ছ-বছর ধরে তার এই চিঠির জন্যই দিন গুনছি!

ছ-বছর ধরে! খুব দামি চিঠি নিশ্চয়? শিশির চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলে।

ধমকে বললাম, দামি না হলে ইনসিওর করে।

ঘনাদা কিন্তু একটু বিদ্রুপের হাসি হাসলেন, ইনসিওর তো নামে, নইলে ও-চিঠি ইনসিওর করার খরচা দিতে পেরুর ট্রেজারি ফতুর হয়ে যেত!

এবার নির্ভাবনা হয়ে কপালে চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, চিঠিটার এত দাম?

কী ছিল ওতে? হিরে-মুক্তো? সরলতার প্রতিমূর্তি হয়ে জিজ্ঞাসা করলে শিবু।

দুর! হিরে-টিরে হলে তো ভারী হত! আর হিরের দাম যতই হোক ইনসিওর করবার খরচ দিতে ট্রেজারি ফতুর হয় নাকি? শিশির শিবুর মৃঢ়তায় বিরক্ত হয়ে উঠল।

কিন্তু পেরুর ট্রেজারি কেন? গৌর একেবারে সার কথাটা ধরে বসল, চিঠিটা পেরু থেকে এসেছিল নাকি?

ঘনাদা একটু হেসে আমাদের উগ্রীব মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, পেরুর কুজকো শহর থেকে ডন বেনিটো ছাড়া আর কেউ ও-চিঠি পাঠাতে পারে না।

কিন্তু কী ছিল ওতে? আমরা উদগ্রীব।

আমাদের যথারীতি কয়েক সেকেন্ড রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করিয়ে রেখে ঘনাদা ধীরে ধীরে বললেন, ছিল কটা রঙিন সুতো।

সুতো! আমরা এবার সত্যিই হতভম্ব।

সুতো মানে এই কার্পাসের তুলো থেকে যে সুতো পাকানো হয়? শিবুর মুখের হাঁ আর বুজতে চায় না।

হ্যাঁ, গাঁটপড়া রঙিন খানিকটা সাধারণ সুতোলি? ঘনাদা আমাদের দিকে সকৌতুক অনুকম্পার সঙ্গে তাকিয়ে বললেন, ওই সুতোর জট ক-টা পেলে, আমেরিকা এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে যেখানে যত ধার দিয়েছে, সব শোধ করে দেওয়া যায়। শুধু ওই গাঁটপড়া সুতোলি ক-টার জন্য গত সওয়া চারশো বছরে সওয়া চার হাজার মানুষ অন্তত প্রাণ দিয়েছে!

আমাদের এবার আর অবাক হবার ভান করতে হল না। গৌর শুধু ধরা গলায় কোনও রকমে জিজ্ঞাসা করলে, তা ওই সর্বনাশা সুতো আপনার কাছে পাঠাবার মানে?

মানে? মানে কিংকাজুর ডাক। কিংকাজু একরকম ভাম। মরণ নিশ্চিত জেনেও তার ডাক সেদিন চিনতে না পারলে এ গল্প শুনতে পেতে না। তবে ঘনাদা একটু হাসলেন। মানে ভাল করে বুঝতে হলে বারো বছর আগের ব্রেজিলের মাত্তো গ্রসোর এমন একটি জঙ্গলে যেতে হয় কোনও সভ্য মানুষ যেখান থেকে জীবন্ত কখনও ফিরে আসেনি।

সেই ভরসায় আপনি বুঝি সেখানে গেছলেন? দুম করে কথাটা বলে ফেলে শিশির একেবারে কুলের কাছে ভরাড়ুবি প্রায় করেছিল আর কী!

কিন্তু কবিরাজি কাটলেটের গুণ অনেক। শিশিরের কথা ঘনাদার যেন কানেই গেল না।

সিগারেটা একটা মোক্ষম টান দিয়ে তিনি নিজের কথাতেই মশগুল হয়ে শুরু করলেন, পাঁচটি প্রাণী আমরা প্রাণ হাতে নিয়ে সেই জঙ্গল দিয়ে চলেছি পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় একটি জাতির সন্ধানে। তাদের নাম শাভান্তে। ব্রেজিলের দুর্গমতম যে-জঙ্গলে তারা থাকে সেখানে পৌঁছতে হলে জলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাপ আনাকো আর কুমীর, আর রক্তখেকো পিরহানা মাছের ঝাঁকের হাত থেকে বাঁচতে হয়, আর দুর্ভেদ্য জঙ্গলের পথে যুঝতে হয় বাঘের বড় মাসি জাগুয়ার থেকে শুরু করে বিষাক্ত সাপ বিয়ে পর্যন্ত অনেক কিছুর সঙ্গে।

এসব বিপদের হাত এড়ালেই নিস্তার নেই। শাভান্তেরা দুনিয়ার সেরা ঠ্যাঙাড়ে। তীরধনুক তাদের আছে, কিন্তু গাঁটওয়ালা মোটা মোটা লাঠি দিয়ে মানুষ মারতেই তাদের আনন্দ। জঙ্গলে কোথায় যে তারা ওত পেতে আছে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। প্রতি পদে কুড়ুল দিয়ে গাছ লতা পাতা কেটে যেখানে এগুতে হয় সেখানে বনের জানোয়ারের চেয়েও নিঃশব্দ-গতি শাভান্তেদের হদিস পাওয়া অসম্ভব।

শাভান্তেদের চাক্ষুষ দেখে ফিরে এসে বিবরণ দেবার সৌভাগ্য এ পর্যন্ত কোনও সভ্য পর্যটক কি শিকারির হয়নি। এ অঞ্চলের অন্য অধিবাসীরাও তাদের যমের মতো ভয় করে এড়িয়ে চলে। তবু তাদের কিংবদন্তি থেকেই শাস্তেদের সম্বন্ধে সামান্য যা কিছু বিবরণ এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

সেবার কিন্তু ঠিক বিজ্ঞানের খাতিরে শাভান্তেদের রাজ্যে ঢুকিনি। ওই অঞ্চলে দুবছর আগে সেনর বেরিয়েন নামে একজন পর্যটক নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাঁকে খুঁজতে পরের বছর আর-একদল নিয়ে ডন বেনিটো নামে একজন বিখ্যাত শিকারিও ওই অঞ্চলে গিয়ে আর ফেরেননি। ব্রেজিল সরকারের পক্ষ থেকে এই দুজনের খোঁজ পাবার জন্য বিরাট এক পুরস্কার তখন ঘোষণা করা হয়েছে। কতকটা সেই পুরস্কারের লোভে, কতকটা অন্য এক মতলবে ছোট একটা দল নিয়ে সেই অজানা অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছিলাম।

দলে পাঁচটি প্রাণী। তিনজন মোট বইবার কুলি বাদে আমি আর রেমরেমন্ডো। রেমরেমন্ডো আধা পতুর্গিজ, একজন ওদেশি শিকারি। ঠিক শাভান্তেদের রাজ্যে কখনও না গেলেও আশেপাশের অঞ্চলটা তার কিছু জানা ছিল বলে তাকেই পথ দেখাতে এনেছিলাম।

জানা এলাকা ছেড়ে অজানা মুল্লুকে ঢোকবার পরই কিন্তু বুঝেছিলাম, আমি যদি কানা হই তো সে চোখে দেখে না, এই অবস্থা!

রেনুরো নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গভীর জঙ্গলের ভেতর ঢুকে তখন আমাদের দিশাহারা অবস্থা। তবু জঙ্গলের মধ্যে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে কুলিদের দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে সেদিন রাতে তাঁবু ফেলেছি। পালা করে আমি ও রেমরেমন্ডো পাহারায় থাকব—এই ঠিক হয়েছে। প্রথম রাতটা পাহারা দিয়ে সবে তাঁবুর মধ্যে দুচোখের পাতা একটু এক করেছি, এমন সময় রেমরেমন্ডোর ঠেলায় ধড়মড় করে উঠে বসতে হল।

শুনতে পাচ্ছেন, আমো! রেমন্ডো কাঁপতে কাঁপতে বললে।

কী, শুনব কী! বিরক্ত হয়ে বললাম, ও তো জংলি ম্যাকাও কাকাতুয়ার ডাক!

না, আমো, ভাল করে শুনুন! রেমরেমন্ডোর গলা দিয়ে ভয়ে কথাই বার হতে চাচ্ছে ।

মন দিয়ে এবার শুনলাম এবং সত্যই প্রথমে সমস্ত গায়ে আপনা থেকে কাঁটা দিয়ে উঠল।

ম্যাকাও-র কর্কশ ডাকের পরই ব্ৰেজিলের লাল বাঁদর গুয়ারিবাস-এর বুক কাঁপানো চিকার। তারপর সেটা থামতে না থামতেই ময়ুর জাতের পাভাস পাখির গলার ঝনঝনে ঝংকার।

রেমরেমন্ডোর দিকে চেয়ে দেখি সে ইতিমধ্যে ঘামতে শুরু করেছে।

এ অবস্থায় ঘেমে ওঠা কিছু আশ্চর্যও নয়। পাভাস পাখির ডাক বন্ধ হবার পরই জাগুয়ারের গলার ফাঁস ফ্যাঁস শোনা গেল, আর তারপরই আবার গুয়ারিবাস বাঁদরের ডাক।

আওয়াজগুলো ক্রমশ কাছেই এগিয়ে আসছে।

কী হবে, আমো! রেমরেমন্ডো মাটির ওপরই বসে পড়ল। তাকে সাহস দেব কী, নিজের অবস্থাই তখন কাহিল। তবু ধমকে বললাম, আমো আমো কোরো না। কতবার বলেছি আমি তোমার মনিব নয়, বন্ধু, আমো নয়, আমিগো।

যে আজ্ঞে, আমো বলে রেমরেমন্ডো তেমনই কাঁপতে লাগল।

বিপদের মধ্যেও না হেসে পারলাম না। তারপর আবার ধমক দিয়ে বললাম, লজ্জা করে না তোমার? তুমি না ব্রেজিলের সেরা শিকারি!

শিকারি হয়ে লাভ কী, আমো!

লাভ যে নেই তা আমিও জানতাম। এটা শাভান্তেদের শত্রু মারবার একটা কায়দা। সারারাত দল বেঁধে শত্রুকে বেড়াজাল দিয়ে ঘিরে এমনই জঙ্গলের নানা জানোয়ারের আওয়াজ করতে করতে তারা এগিয়ে আসে, আবার পিছিয়ে যায়। সারারাত শত্রুর চোখে ঘুম তো নেই-ই, প্রতি মুহূর্তেই আক্রমণের ভয়ে তটস্থ অবস্থা। এমনই করে সারারাত শত্রুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়ে ভয়ে ভাবনায় আধমরা করে ভোরের দিকে শাভান্তেরা সমস্ত আওয়াজ থামিয়ে একেবারে যেন বিদায় নিয়ে চলে যায়। শত্রু তখন বিপদ কেটেছে মনে করে ক্লান্তিতে হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়ে। শাভান্তেরা ঠিক সেই সময়েই হানা দিয়ে তাদের গেটে লগুড় দিয়ে সব সাবাড় করে দেয়। শাভান্তেদের একটি লোকও তাতে মারা পড়ে না। শুধু ফন্দিতেই কাজ হাসিল হয়ে যায়।

বুনো জানোয়ারের ডাক ইতিমধ্যেই পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে, টের পেলাম।

রেমরেমন্ডোকে ও সেই সঙ্গে নিজেকেও সাহস দেবার জন্য বললাম, এখুনি এত ভেঙে পড়বার কী হয়েছে। ওদের এ চালাকি তো সারারাত চলবে। ভোরে ওরা চড়াও হবার আগে পালাতে পারলেই হল।

কিন্তু পালাবেন কোথায়, আমো! আমরা মাত্র পাঁচজন, আর ওরা অন্তত পাঁচশো। পাঁচজন হলেও ওরা এমনিতে রাত্রে আক্রমণ করতে চায় না। কিন্তু পালাবার চেষ্টা করলেই ঠেঙিয়ে শেষ করে দেবে! আমাদের দুজনের দুটো বন্দুকে কটাকে ঠেকাবেন এই অন্ধকার জঙ্গলে?

রেমরেমন্ডোর কথাগুলো মিথ্যে নয়। কী বলে আপাতত তাকে শান্ত করব ভাবছি, এমন সময় জংলা আওয়াজ আবার কাছে এগুতে শুরু করল। প্রথমে টুকান পাখির চড়া গলা, তারপর জাগুয়ারের জাতভাই কুজার-এর গর্জন, আর সে-ডাক থামতেই সেই কিংকাজুর ঝগড়াটি বেড়ালের মতো ডাক।

এই ডাক শুনেই চমকে উঠে দাঁড়ালাম।

রেমরেমন্ডো সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সভয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কী হল, আমো?

এখুনি জানতে পারব। বলে বেরুবার চেষ্টা করতেই রেমরেমন্ডো দুহাতে আমায় জড়িয়ে প্রায় ককিয়ে উঠল, আপনি কি পাগল হলেন আমো! যাচ্ছেন কোথায়?

বেশ জোর করেই তার হাত ছাড়িয়ে কোনও উত্তর না দিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লাম।

ঘুটঘুটে অন্ধকার যাকে বলে। দিনের বেলাতেই যেখানে চলাফেরা শক্ত, রাতের অন্ধকারে সে জঙ্গলে এক পা এগুনোই দায়। টর্চ জ্বালবার উপায় নেই বলেই সঙ্গে নিইনি। কোনওরকমে হোঁচট খেতে খেতে হাতড়াতে হাতড়াতে সেই জঙ্গল ভেদ করে চললাম।

কিংকাজুর ডাকের পর আবার গুয়ারিবাস-এর চিৎকার হতেই একটা শিস দিলাম উইরা পুরু পাখির তীক্ষ্ণ বাঁশির মতো আওয়াজ করে।

অন্যদিকের শব্দটা খানিক থেমে গেল তাইতেই।

তারপর ওদিক থেকে আবার ম্যাকাও পাখির ডাক শুরু হতেই আস্তা মানে টাপির-এর আওয়াজ শুরু করলাম।

জঙ্গল এবার একেবারে চুপ।

নিজেই আবার প্রসিওর আওয়াজ নকল করে তার উপর পাভাস পাখির গলার ঝংকার জুড়ে দিলাম।

জঙ্গলে আর কোনও শব্দ নেই। আমি কিন্তু যথাসম্ভব সাবধানে তও এগিয়ে চলেছি।

বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর জঙ্গল একটু ফাঁকা হতে দেখি, যা ভেবেছিলাম তাই।

একটা চিড়িয়াখানা! শিবু বোধহয় আর থাকতে না পেরেই বলে উঠল।

ঘনাদা ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই আমরা শিবুকে ধমকে উঠলাম, চিড়িয়াখানা! শিবুর যেমন বুদ্ধি! জঙ্গলে কখনও চিড়িয়াখানা থাকে!

ঘনাদা খুশি হলেন কি না বলা যায় না, কিন্তু তাঁর বর্ণনা আবার চলল।

বনের ওই ফাঁকা জায়গায় একটা তাঁবু। চারিদিক ঢাকা হলেও তার ভেতর থেকে জোরালো হ্যাসাক বাতির সামান্য আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নিঃশব্দে সেই তাঁবুর পেছনে গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ধেড়ে ইদুর কাপিবারার মতো আওয়াজ দিলাম।

তাঁবুর ভেতর থেকে বাঘের মতো গর্জন শোনা গেল, কিয়ে এস্তা আহি? অর্থাৎ, কে ওখানে?

বললাম, সয় ইয়ো! অর্থাৎ, আমি।

এবার তাঁবুটাই যেন দুলে উঠল এবং তার পর্দা সরিয়ে ছোটখাট পাহাড়ের মতো যে-লোকটি খেপে বেরিয়ে এল, অন্ধকারের মধ্যেও শুধু তার আকার দেখেই তাকে আমি তখন চিনে ফেলেছি।

সে বেরিয়ে আসতেই আমি নিঃশব্দে অন্যদিকে সরে গেলাম। টর্চ জ্বেলে সে তাঁবুর চারিদিকে ঘুরে যখন আবার ভেতরে ঢুকল তখন আমি তার জিনিসপত্র যা ঘাঁটবার ঘেঁটে দেখে তারই বিছানায় শুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছি।

তাঁবুর ভেতর ঢুকে আমায় ওই অবস্থায় দেখে পাহাড় একেবারে আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠল।

তবে রে, মুকুরা চিচিকা! মানে, পুঁচকে গন্ধগোকুল বলে সে তেড়ে আসতেই উঠে বসে বললাম, ধীরে, ধুমসো আই, ধীরে! আই হল দুনিয়ার সবচেয়ে কুঁড়ের ধাড়ি জানোয়ার ব্রেজিলের শ্লথ।

মাঝপথে থেমে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বললে, তুমি ডস্! এখানে! কী দেসিয়া উস্তেদ? মানে, কী তুমি চাও?

বিশেষ কিছু না! সেনর বেরিয়েন-এর সন্ধান করতে যে দলবল নিয়ে বেরিয়েছিল সেই বেনিটোর সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। সেনর বেরিয়েন-এর কী হয়েছে, ডন বেনিটো-ই বা তাঁর খোঁজে বেরিয়ে কেন নিরুদ্দেশ, এসব খবর জানবার জন্য পৃথিবীর সবাই একটু উদগ্রীব কিনা!

আমার পাশেই সেই চার-মণী লাশ নিয়ে বসে ডন বেনিটো এবার হতাশভাবে বললে, সেনর বেরিয়েন শাভান্তেদের হাতে মারা গেছেন।

তা তো বুঝলাম, কিন্তু সে কথা জানবার পর সভ্য সমাজে না ফিরে ডন বেনিটো এই জঙ্গলের মধ্যে এখনও লুকিয়ে থাকতে এত ব্যাকুল কেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেনিটো পালটা প্রশ্ন করে বসল এবার, তুমি আমার খোঁজ পেলে কী করে?

হেসে বললাম, তোমার একটু ঠিকে ভুলের দরুন, বন্ধু। তুমি মস্ত শিকারি। প্রত্নতত্ত্ব নিয়েও কিছু নাড়া-চাড়া করেছ, শুনেছি, কিন্তু প্রাণিবিদ্যাটায় তেমন পাকা তো নও, তাই শাভান্তেদের সঙ্গে ভাব করবার জন্য তাদের মতো হরবোলার গলা দুরস্ত করলেও একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছ।

কী ভুল? বেনিটো বেশ খাপ্পা।

ভুল কিংকাজুর ডাক। ওই প্রাণীটি যে ব্রেজিলের এ অঞ্চলে থাকে না, সেইটি তোমার জানা নেই। শাভান্তেরা ও ডাক জানে না। ওই ডাক শুনেই বুঝলাম শাভান্তেরা নয়—অন্য কেউ ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াতে চাইছে।

বেনিটোর জালার মতো মুখখানা তখন দেখবার মতো। হতভম্ব ভাবের সঙ্গে আপশোস, বিরক্ত, রাগের সেখানে একটা লড়াই চলেছে।

সে লড়াই শেষ হবার আগেই আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু ব্যাপার কী বলল তো? এই জঙ্গলে কোথায় সভ্য মানুষজন দেখলে খুশি হয়ে দেখা করবে, না ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়াতে চাও?

আমি…মানে আমি… বেনিটো আমতা আমতা করে বললে, সেনর বেরিয়েনকে যখন ফিরিয়ে আনতে পারিনি তখন সভ্যসমাজে আর মুখ দেখাতে চাই না।

বটে! গম্ভীরভাবে বললাম, তুমি বিফল হবার লজ্জায় এখন অজ্ঞাতবাসই চাইছ তা হলে? ভাল কথা! কিন্তু আমাকে কি তা হলে শুধু হাতে ফিরতে হবে! ওদিকে ব্রেজিল সরকারের পুরস্কারটাও তো ফসকাচ্ছে।

কী, কী তুমি চাও? বেনিটো আমায় যে-কোনও ভাবে তাড়াতে পারলে বাঁচে বোঝা গেল।

কী চাই? যেন বেশ ভাবনায় পড়ে বললাম, এই জঙ্গলে কী-ই তোমার আছে যে দেবে?

তুমি বলো না কী চাও! ব্রেজিলের সরকার তোমায় যা পুরস্কার দিত তাই তোমায় যদি দিই, হবে? বেনিটো বেশ ব্যাকুল।

কিন্তু দেবে কী করে! এখানে অত টাকা তুমি পাচ্ছ কোথায়?

এখানে নয়, পেরুতে। এখুনি একটা চিঠি তোমায় লিখে দিচ্ছি। তুমি লিমায় গিয়ে যে-ঠিকানায় চিঠি দিচ্ছি সেখানে দেখালেই পাবে। বেনিটো আমায় রাজি করাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে বললে, আমার কথা তো বিশ্বাস করো?

খুব করি। কিন্তু অত টাকার আমার দরকার নেই। তুমি বরং…ঘরের চারিদিকে একবার চোখ ঘোরালাম।

বেনিটো অধীর হয়ে বললে, হ্যাঁ বলো, কী চাও। চাই খানিকটা সুতো! বলে ফেলে বোকার মতো চেহারা করে তার দিকে তাকালাম।

সুতো! সেই বিরাট জালার মতো মুখে মনের ভাব কি সহজে লুকোনো যায়। তবু প্রাণপণে ঠাণ্ডা থাকার চেষ্টা করে বেনিটো বললে, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি। সুতোসুতো আবার কী?

কী আর, খানিকটা রঙিন সুতো। তা-ই হলেই আমার চলবে।

নাঃ, তোমার দেখছি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে! বলে বেনিটো খুব জোরে হাসবার চেষ্টা করলে।

আমার পাগলামিতে তোমার হাসি পাচ্ছে? তা হলে আর একটা মজার গল্প বলি শোনন। পিজারোর নাম শুনেছ তো?

পিজারো? কে পিজারো? বেনিটো তামাশার সুরে বলবার চেষ্টা করলেও তার চোখ দুটোয় আর তখন হাসির লেশ নাই। ঠাট্টার সুর বজায় রেখে সে তবু বললে,

আমি তো পিজারো বলে একজনকে চিনি–আমাদের রাস্তা সাফ করত।

এ পিজাবোও এক রকমের ঝাড়ুদার, তবে প্রায় সওয়া চারশো বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু সাফ করে দিয়ে গেছে।

ও, তুমি কংকিসতাপদার বীর পিজারোর কথা বলছ! বেনিটো যেন এতক্ষণে আমার কথা বুঝল, স্পেনের হয়ে যিনি পেরু জয় করেছিলেন!

হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতকতাকে যদি জয় করা বলল, খুনি আর শয়তানকে যদি বলো বীর।

খাঁটি ইস্পাহানি না হলেও এ কথাগুলো বেনিটোর খুব মধুর লাগল না, তবু নিজেকে সামলে সে বললে, তা—পিজারোর উপর যত খুশি গায়ের ঝাল ঝাড়ো। কিন্তু তার গল্প আমায় কী শোনাবে?

শোননই না। হয়তো প্রাণ খুলে হাসবার কিছু পাবে। পেরুর রাজাদের নাম যে ইংকা তা তোমায় বলবার দরকার নেই। পেরুর শেষ স্বাধীন ইংকা আতাহুয়ালপা কাজামারকা (Cajamarca) শহরে সরল বিশ্বাসে পিজারো আর তার একশো তিরাশি জন অনুচরকে অভ্যর্থনা করেন। সেই সাদর অভ্যর্থনার প্রতিদানে পিজারো চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে কৌশলে ইংকা আতাহুয়ালপাকে বন্দী করে। মুক্তির দাম হিসেবে ইংকা সোনা রুপোয় প্রায় কুবেরের ভাণ্ডার পিজারোকে দেন। সে সমস্ত নিয়েও পিজারো ইংকা আতাহুয়ালপাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মানুষের ইতিহাসে সেই কলঙ্কিত তারিখ হল ১৫৩৩-এর ২৯শে নভেম্বর।

এই পর্যন্ত শুনেই বেনিটো ধৈর্য হারিয়ে বললে, তোমার সব কথা সত্যি নয়, তবু এ ইতিহাস পৃথিবীর কে না জানে!

সবাই যা জানে না তা-ই একটু তা হলে বলি। পেরুর শেষ ইংকার কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করে পিজারো সোনাদানা যা নিয়েছিল, তা বিরাট দীঘির একটা গণ্ডুষ মাত্র। পেরু তখন সোনায় মোড়া বললেও বেশি বলা হয় না। ইংকারা নিজেদের সূর্যের সন্তান বলত, আর সোনাকে বলত সূর্যের চোখের জল। সোনায় তারা থালাবাটি ঘটি গয়না থেকে বড় বড় মূর্তিই শুধু তৈরি করত না, তাদের মন্দিরের মেঝেও হত সোনা দিয়ে বাঁধানো। কুজকো শহরের সূর্যমন্দিরের চারিধারে বর্ষার জলের নর্দমাগুলোও ছিল সোনার পাত নয়, তাল দিয়ে তৈরি। আর রুপো তো তখন এমন সস্তা যে কংকিসতাদের মানে পিজারোর বিজয়ী সৈনিকেরা তাই দিয়ে ঘোড়ার নাল বাঁধাত। পিজারো সোনার লোভে ইংকাকে আগেই মেরে না ফেললে আরও কত সম্পদ যে পেত কেউ ধারণাই করতে পারে না। কারণ কুজকো শহর থেকে ইংকা পুরোহিতেরা আতাহুয়ালপার মুক্তির জন্য আরও রাশি রাশি সোনার জিনিস তখন কাজামারকাতে পাঠাবার আয়োজন করছে। ইংকার হত্যার খবর পাবার পরই তারা পিজারোর আসল স্বরূপ বুঝে সে সোনাদানা সব লুকিয়ে ফেলে। কুজকো শহরই সোনার খনি জেনে পিজারো সে শহর লুণ্ঠন করেও তার আসল গুপ্ত ভাণ্ডারের সন্ধানই পায়নি। প্রধান ইংকা পুরোহিত ভিল্লাক উমু সেই সমস্ত ভাণ্ডারের এমন ভাবে হদিস রেখে দেন, ইস্পাহানিদের পেরু থেকে তাড়াবার পর যাতে সেগুলো উদ্ধার করা যায়। ইংকাদের কোনও লিখিত ভাষা ছিল না। তাঁরা যে ভাষায় কথা কইতেন তার নাম কেচুয়া। প্রধান পুরোহিত তাঁর সংকেত-চিহ্ন তাই ভাষার অক্ষরে লিখে যাননি। তিনি সংকেতগুলি যাতে রেখে গিয়েছিলেন তাকে বলে কিপু।

বেনিটো কী কষ্টে যে স্থির হয়ে আছে বুঝতে পারছিলাম। সে এখন হালকা সুরে বলবার চেষ্টা করলে, তোমার ও কিপু-মিপু শুনে হাসি তো আমার পাচ্ছে না!

পাচ্ছে না? তা হলে আর একটু শোনো। প্রধান পুরোহিতের পর এই সব কিপু দ্বিতীয় পুরোহিতের হাতেই পড়ে। তারপর পুরোহিত-বংশই শেষ হয়ে যাবার সঙ্গে, সেসব কিপু কোথায় যে হারিয়ে যায় কেউ জানে না। শেষ ইংকা আতাহুয়ালপার এক ভাইপো গার্সিলাসোদ্য লা ভেগা সারা জীবন সেসব কিপু খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। শুধু সম্প্রতি এখান ওখান থেকে কয়েকটা টুকরো কিপু উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু মুশকিলের কথা এই যে কিপুর সংকেত-চিহ্ন পড়বার লোক পৃথিবীতে প্রায় নেই বললেই হয়।

বেনিটোর ধৈর্যের বাঁধ আর রইল না। রাগে উত্তেজনায় সে গর্জন করে উঠল এবার, কী তুমি বলতে চাও, কী? এ-গল্প আমায় শোনাবার মানে?

মানে এই যে পৃথিবীর দু-তিনটি মাত্র লোক এখনও কিপুর সংকেত-চিহ্ন বুঝতে পারেন, সেনর বেরিয়েন তাঁদের একজন। তাঁর শরীরে ইংকাদের রক্তও কিছু আছে। সারা জীবন শুধু পেরুতে নয়, কলম্বিয়ায়, ইকোয়েডরে, চিলিতে, বলিভিয়ায় ও ব্রেজিলে তিনি হারানো কিপু সন্ধান করে বেড়িয়েছেন। সংগ্রহও করেছেন কিছু। তাঁর শেষ সন্ধান এই মাত্তো গ্রস্সাের জঙ্গলে। পেরু স্পেনের কবলে যাবার পর ইংকাদের একটি শাখা টিটিকাকা হ্রদ পেরিয়ে প্রথমে বলিভিয়ায় ও পরে সেখান থেকে ব্রেজিলের এই অংশে এসে রাজ্য গড়বার চেষ্টা করে বলে কিংবদন্তী আছে। কুজকোর গুপ্ত ভাণ্ডারের সংকেত দেওয়া সবচয়ে দামি কিপু নাকি এই ইংকারাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। সেনর বেরিয়েন এই কিপুর খোঁজেই এই দুর্গম জঙ্গলে এসেছিলেন। এবং আমি নিশ্চিত জানি যে তা তিনি পেয়েও ছিলেন।

তুমি নিশ্চিত জানো—বেনিটো একেবারে মারমূর্তি—হাত গুনে নাকি?

একটু হেসে হাতের মুঠোটা তার সামনে খুলে ধরে বললাম, হাত গুনে নয়, হাতের মুঠোয় ধরে–

আমার হাতের দিকে চেয়ে বেনিটোর জালার মতো মুখের ভাঁটার মতো চোখদুটো এয় ঠেলে বেরিয়ে আসে আর কী?

তার এই অবস্থা যেন দেখেও না-দেখে নিতান্ত ভাল মানুষের মতো বললাম, এই জন্যই তোমার কাছে একটি রঙিন সুতো মানে এই কিপু চাইছিলাম। এইটে পেলেই খুশি মনে আমি চলে যাই, তুমিও পরমানন্দে জঙ্গলে অজ্ঞাত বাস করো।

এতক্ষণে সেই মাংসের পাহাড় সত্যিই আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠল। তবে রে কালা নেংটি কুটিয়া! বোড়ার রাজা আনাকোণ্ডার গর্তে এসেছ চুরি করতে! বলে সেই চার-মণী লাশ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটু গা-ঝাড়া দিয়ে দেখি–

তাঁবুর কাপড় ছিঁড়ে সেই মাংসের পাহাড় বাইরে ছিটকে পড়ে খাবি খাচ্ছে–গৌরই ঘনাদার কথাগুলো জুগিয়ে দেবার চেষ্টা করলে।

ঘনাদা একটু ভুরু কুঁচকে বলে চললেন, না, দেখি আমিই তাঁবুর কোণে দড়ি-দুড়ার মধ্যে থুবড়ে পড়েছি। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠবার পর বেনিটোর সে কী গর্বের হাসি, তারই সঙ্গে আবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো জ্বালা ধরানো কথার চিমটি, কী, ডস। প্যাঁচটা লাগল কেমন? বড় জব্দ করেছিলে আর বারে, তাই হরবোলা গলা সাধার সঙ্গে যুযুৎসুটাও শিখেছি।

তার হাসি থামাতে নিজেই এবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপর। কিন্তু আবার মাটি নিয়ে তার বিদ্রুপ শুনতে হল, জাপানি কুস্তি সুমোও শিখতে ভুলিনি, বন্ধু।

তার হাসি কিন্তু মাঝপথেই গেল বন্ধ হয়ে। মাটিতে পড়ে তখন সে গোঙাচ্ছে। গলাটায় আর একটু চাপ দিয়ে বললাম, সবই শিখেছ, শুধু এই বাংলা কাঁচিটাই শেখোনি। এখন বলল এ-কিপু কোথায় তুমি পেয়েছ? সেনর বেরিয়েনকে খোঁজার নাম করে এসে তাঁকে কোন ছলে মেরে এ-কিপু বাগিয়েছ—কেমন?

জবাবে তার মুখ থেকে একটু কাতরানির মতো আওয়াজ বেরুল মাত্র, না, না।

পায়ের ফাঁস একটু আলগা করতে বেনিটো ককিয়ে উঠল, হলফ করে বলছি, সেনর বেরিয়েন মারা যাবার আগে এ-কিপু আমায় দিয়ে গেছেন। তাঁর নিজের হাতে লেখা প্রমাণ আমি দেখাচ্ছি।

তাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, বেশ, দেখাও সে প্রমাণ। বাংলা কাঁচি দেখেছ, কোনও চালাকি করবার চেষ্টা করেছ কি একেবারে বাংলা তুড়ুম ঠুকে দেব।

মানে বুঝুক আর না বুঝুক চালাকি করবার উৎসাহ আর তখন বেনিটোর নেই। নিজের ঝোলা থেকে সত্যিই সে একটা আধময়লা চিঠি বার করে দেখালে। সেনর বেরিয়েনের হাতের লেখা আমার চেনা। দেখলাম তিনি সত্যিই তাঁর মৃত্যুশয্যায় বেনিটোর সেবার প্রশংসা করে তার হাতে কিপুটা দেওয়ার কথা লিখেছেন।

চিঠিটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, কিপুটা যখন সেনর বেরিয়েন নিজেই তোমায় দিয়েছেন, তখন সেটা নিয়ে তোমার এমন লুকিয়ে থাকার মানে কী?

বেনিটোর মুখ দেখে মনে হল পারলে মানেটা সে আমার গলা টিপেই বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু পরিণাম ভেবেই বোধহয় নিজেকে সামলে সে চুপ করেই রইল।

হেসে আবার বললাম, মানেটা তাহলে আমিই বলি। এ-কিপু সেনর বেরিয়েন তোমাকে দান করেননি। নিজের মৃত্যুর পর এটা পেরুর সরকারি মিউজিয়মে পৌঁছে দেবার জন্য তোমার হাতে দিয়েছিলেন। তুমি এখন এই কিপুর অর্থ নিজে বার করে কুজকোর গুপ্তধন একলা বাগাতে চাও। এখনই সভ্য জগতে ফিরে গেলে তোমার গতিবিধি পাছে কেউ সন্দেহ করে, তাই তুমি কিপুর সংকেত-চিহ্ন না বুঝতে পারা পর্যন্ত এই জঙ্গলেই লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছ। আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টাও করেছিলে সেই জন্য।

তাই যদি করে থাকি তাতে দোষ কী? প্রাণের মায়া ছেড়ে এ-কিপু আমি সন্ধান করেছি। এ-কিপু আজ যখন আমার হাতে এসেছে তখন সে-গুপ্তভাণ্ডারের দখল আমি অন্য কাউকে দেব কেন?

হেসে বললাম, কিন্তু গুপ্তধন পাওয়ার আগে এ-কিপুর মানে তো বোঝা চাই। এ তো কয়েকটা গেরো দেওয়া রঙিন সুতোর জট মাত্র! ইংকাদের সাম্রাজ্য যাওয়ার সঙ্গে এই সুতোর গিটের সংকেত-চিহ্ন পড়বার বিদ্যাও প্রায় হারিয়ে গেছে। গুপ্তধনের লোভে তুমি সামান্য যা কিছু শিখেছ তা দিয়ে সারা জীবন চেষ্টা করলেও এর মানে খুঁজে পাবে না। সুতরাং এ-কিপু আমিই নিয়ে যাচ্ছি।

না, না! বেনিটো প্রায় কেঁদে উঠল, আমায় শুধু দুবছর সময় দাও। দুবছরে এ-কিপুর মানে যদি আমি না বুঝতে পারি তা হলে তোমাকেই এ-কিপু আমি পাঠিয়ে দেব।

ঘনাদা থামলেন।

তা হলে মানে বুঝতে না পেরেই এতদিনে সে সুতোটা আপনার কাছে পাঠিয়েছিল! কিন্তু দুবছর বাদেই পাঠাবে কথা ছিল না? শিশির সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলে।

হ্যাঁ, কথা তা-ই ছিল। কিন্তু আমার ঠিকানা তো পাওয়া চাই। ঘনাদা শিশিরের নির্বুদ্ধিতায় যেন একটু বিরক্ত, কত মুল্লুক ঘুরে তবে ঠিকানা পেয়েছে কে জানে! দেরি হয়েছে তাইতেই।

কিন্তু সুতো সমেত চিঠিটাই যে এখন লোপাট। তাহলে উপায়? শিবু প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ও-কিপুর মানেও তাহলে আর জানা যাবে না, গুপ্তধনও উদ্ধার হবে না।!

গুপ্তধন অনেক আগেই উদ্ধার হয়েছে! ঘনাদা আমাদের প্রতি একটু অনুকম্পার হাসি হেসে বললেন, আমি কি দুবছরের পরেও ঘুমিয়ে ছিলাম! পেরুর লিমা শহরে প্লাজা দস দে মেয়োর কাছে সরকারি মিউজিয়ামে গেলেই দেখতে পাবে, কিপু-তে যার সংকেত দেওয়া ছিল সে সমস্ত দুর্লভ সোনার জিনিস একটি আলাদা ঘরে সাজানো।

তার মানে? গৌর হতভম্ব হয়ে বললে, আপনি কিপ পড়তে পারেন। সেই রাতেই তার মানে বুঝে নিয়ে আপনি মুখস্থ করে ফেলেছিলেন।

ঘনাদা এ প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেন ঘৃণা বোধ করে শিশিরের পুরো সিগারেটের টিনটা তুলে নিয়ে পকেটে ফেললেন।

নীচে নেমে শিশিরকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, আচ্ছা, ইনসিওর করা চিঠিটা কি আমাদের বানানো, না সত্যি এসেছিল?

শিশির চিন্তিত মুখে বলল, তা-ই তো ভাবছি।