৩.০৮ মোহনবাঁশি খানিকটা সুস্থ

পরদিন মোহনবাঁশি আরও খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠল। তার ছেলেমেয়ে বউ এবং বিনয়কে নিয়ে অন্য দিনের মতো আজও হাসপাতালে এসেছিলেন শেখরনাথ। ডাক্তার চট্টরাজ তাদের। মোহনবাঁশির কাছে নিয়ে গেলেন। আগের দিন মিনিট তিনেকের বেশি মোহনবাঁশিকে কথা বলতে দেননি তিনি। আজ প্রায় আধঘণ্টা কথা বলল মোহনবাঁশি। ওর স্ত্রী জ্যোৎস্না খুব খুশি। স্বামী বাঁচবে কী বাঁচবে না–এই নিয়ে তীব্র আশঙ্কায় কটা দিন তার কেটেছে। খেতে পারত না, ঘুমোতে পারত না। সারাক্ষণ কাঁদত। কখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কখনও নিঃশব্দে চোখ থেকে অবিরল জল ঝরে যেত। তার মুখে আজ হাসি ফুটেছে। সে বুঝতে পেরেছে, আর কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ মোহনবাঁশিকে নিয়ে সে জেফ্রি পয়েন্টের রিফিউজি সেটলমেন্টে ফিরে যেতে পারবে।

মোহনবাঁশির বেডের পাশ থেকে এক সময় জ্যোৎস্নাদের দোতলায় নামিয়ে এনে অপেক্ষা করতে বললেন শেখরনাথ। মোহনবাঁশি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পর এখানেই সকালে নটায় এসে সন্ধে অব্দি বসে থাকে জ্যোৎস্না এবং তার ছেলেমেয়েরা। দুপুরে এখানেই তাদের জন্য ভাত-তরকারি মাছটাছ এনে দেন শেখরনাথ। তারপর বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে আরও একবার মোহনবাঁশিকে দেখিয়ে তাদের নিয়ে ভাইপোর বাংলোয় ফিরে যান।

জ্যোৎস্নাদের বসিয়ে রেখে বিনয়কে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লেন শেখরনাথ। তিনি জানেন, সেলুলার জেলে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা কীভাবে ক্ষয় হয়ে গেছে, কতটা ভয়াবহ ছিল তার সেই নরকসের অভিজ্ঞতা তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে বিনয়। পুরনো দুঃস্বপ্নের সেই স্মৃতিকথা কাল শুরু করেছিলেন। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা!

হাঁটতে হাঁটতে আজও তারা তিন নম্বর ব্লকে চলে এলেন! আজ আর একতলায় নয়; সোজা দোতলায়। শেষ প্রান্তের যে সেলটায় তাকে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে তার গা ঘেঁষে অলিন্দের যে রেলিংটা রয়েছে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। এখান থেকে হাজার দুয়েক ফিট নিচে সিসোস্ট্রেস উপসাগর, যেটা দূর সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। সেখানে অগুনতি সিগাল উড়ছিল।

শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, কাল কোন পর্যন্ত যেন বলেছিলাম? পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল তার। ও, হ্যাঁ। পাশের সেলে বৈজুকে ঢুকিয়ে দিয়ে পেটি অফিসার আসলাম খান চলে গেল। তাই তো?

বিনয় মাথা নাড়ল। হ্যাঁ৷।

.

শেখরনাথ বলতে লাগলেন। আমার সেলটা তো দেখতে পাচ্ছ। পেছনের জানলা এত উঁচুতে যে বাইরের কিছুই দেখা যায় না। দুধারে সলিড ওয়াল। সামনের দিকের দরজার গরাদের ফাঁক দিয়ে বাইরের যা একটু-আধটু চোখে পড়ে। আমি গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

সন্ধে আগেই নেমে গিয়েছিল। সেলুলার জেলের সব কয়েদিকে আগেই যার যার কুঠুরিতে ঢোকানো হয়েছিল। তবে সামনের চত্বরে পুলিশের টহলদারি চলছে। দূরে ওয়াচ টাওয়ারের চুড়ো থেকে যেন হাজারটা চোখ মেলে প্রতিটি সেল লক্ষ করছে রাতের প্রহরী। বিকেলের দিকের যখন কয়েদিদের খাবার দেওয়া হচ্ছিল তখনকার ব্যস্ততা হইচই আর নেই। ক্রমশ সব ঝিমিয়ে আসছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়েই আছি। সেলের এক কোণে খাবার রয়েছে কিন্তু খিদে বা তেষ্টার বোধটাই নেই। দু-চার টুকরো চাপাটি মুখে দিয়ে জল-টল খেয়ে যে শুয়ে পড়ব তেমন ইচ্ছাটাই কেউ যেন হরণ করে নিয়েছে।

রাত বাড়তে থাকে। ক্রমশ বিশাল কয়েদখানা আরও, আরও নিঝুম হয়ে যায়। শুধু কাছের বা দূরের অলিন্দগুলো থেকে সেন্ট্রিদের বুটের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। আমাদের ব্লকেও তার ব্যতিক্রম নেই। দোতলায় একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ রাইফেল হাতে অলিন্দের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একবার গিয়ে আবার ফিরে আসছে। সমস্ত রাতই বুঝিবা এমনটা চলবে।

আমার খুব হাসি পাচ্ছিল। ওয়াচ টাওয়ারে নজরদার, খোলা চত্বরে পাহারাদার, প্রতিটি ব্লকের অলিন্দে পুলিশের টহলমহা পরাক্রান্ত ইংরেজ, যাদের পৃথিবী জোড়া সাম্রাজ্যে নাকি সূর্যাস্ত হয় না, মাত্র কয়েকশো কয়েদি, বিশেষ করে কয়েকটি বিপ্লবী তাদের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে। নিরস্ত্র তালাবন্দি পায়ে বেড়ি লাগানো কজন বিপ্লবী বা অন্য কয়েদিরা কখন কী করে বসে সে জন্য দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাই পাহারাদারির এত নিচ্ছিদ্র আয়োজন। আসলে ব্রিটিশ জাতটাকে সেদিন মনে হয়েছিল অত্যন্ত ভীরু।

কতক্ষণ গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, খেয়াল নেই। সেটা খুব সম্ভব শুক্লপক্ষ। মাউন্ট হ্যারিয়েটের পেছন দিক থেকে চাঁদ উঠে এসেছে। অফুরন্ত রুপোলি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে যতদূর দেখা যায় ছোট বড় নানা দ্বীপ, দ্বীপের গায়ে ঘন অরণ্য আর বঙ্গোপসাগর। দৃশ্যটা আশ্চর্য সুন্দর, স্বপ্নের মতো। তার মধ্যে অনন্ত দুঃস্বপ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাথায় সেলুলার জেল। সেখানে কয়েদিরা ঘুমোয় কিন্তু শতচক্ষু মেলে জেলে থাকে ইংরেজদের পোষা পাহারাদারের হিংস্র বাহিনী।

হঠাৎ দরজার সামনে ছায়ামূর্তির একটা লোক এসে দাঁড়াল। তার পুরো মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তবে অলিন্দের সিলিং থেকে। যে তেজি বাল্ব ঝুলছিল তার আলো এসে পড়েছে তার ডান গালের ওপর। গালটা পোড়া ঝামার মতো; মাংস শুকিয়ে, ফুলে, কুঁচকে কুঁচকে রয়েছে। নাক বলতে বিশেষ কিছু নেই। শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য শুধু দুটো সুড়ঙ্গ। ওপরের ঠোঁটটা ভেতর দিকে। ঢোকানো; নিচের কালো পুরু ঠোঁটটা বাইরে ঝুলে আছে। তার ফাঁক দিয়ে ভাঙা দাঁত বেরিয়ে রয়েছে।

আমি চমকে উঠেছিলাম। এমন বীভৎস চেহারা আগে কখনও দেখিনি। যেন একটা প্রেত।

লোকটা একটু হেসে, ঘষা ঘষা গলায় হিন্দুস্থানিতে বলল, তুমি আজ নয়া এসেছ, দেখলাম। জাহাজে করে যখন নয়া নয়া কয়েদিকালাপানি আসে তখন এই কয়েদখানায় নয়া নয়া রোশনি জ্বলে ওঠে। তা ভাইয়া, তুমি মেনল্যান্ডে কী করে এসেছকটা খতম? আমি তিন আদমিকে কোতল করে এসেছিলাম।

লোকটাকে বেশ রসিক মনে হল। প্রথমটা চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তার কথা শুনতে শুনতে ভয় কেটে গেল। বেশ মজাও পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম, কোন অপরাধে আমাকে আন্দামানে চালান করা হয়েছে, সে জানে না। তার কথার উত্তর দিলাম না।

লোকটা ফের শুরু করল, কমসে কম তিন চারঠো কোতল করে না এলে এখানকার পুরনো কয়েদিরা ইজ্জত দেয় না। মালুম হচ্ছে, তুমিও তাই করে এসেছ।

তাকে বললাম, ধরে নাও, আমি পাঁচ-ছটা খুন করে এসেছি।

লোকটা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে তারিফের সুরে বলল, ওয়াহ, ওয়াহ্, তুমি তো শের হো জনাব! কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে কপালে হাত ঠেকাল। তোমাকে হাজারো সেলাম। হো ভেইয়া, তুম কোন মুল্লুককা মূর্তি?

বললাম, বাংলা মুল্লুক। কেন?

নোকটা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার পা থেকে মাথা অব্দি বার কয়েক দেখল। তারপর বলল, বঙ্গালির সিনায় (বুকে).ইতনা তাকত। বহুৎ তাজ্জবকি বাত।

আমি জবাব দিলাম না। হঠাৎ খেয়াল হল, একটা কয়েদি এত রাতে সেলের দরজা খুলে কী করে আমার দরজার সামনে চলে আসতে পারল! যে আর্মড পুলিশটা অলিন্দের এ মাথা থেকে ও মাথায় সমানে চক্কর দিচ্ছে সে তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না! যা ভাবছিলাম, রীতিমতো অবাক হয়ে সেই প্রশ্নগুলো তাকে করলাম। সে ভাঙা ভাঙা দাঁত বের করে হাসল। বলল, আমাকে কুঠরিতে তালাবন্ধ হয়ে থাকতে হয় না। দিনে কী রাতে যখন যেখানে যাই না, কোনও পেহেরাদার আমাকে কিছু বলবে না। কুছ ভি নেহী–

আমি হতভম্বের মতো বলি, তুমি খুন করে কালাপানি এসেছিলে না? কয়েদি তো?

লোকটা বলল, জরুর।

তা হলে? আমি জিগ্যেস করলাম।

লোকটা বলল, কয়েদি হলেও আমি টিল্ডাল। জেলরসাব আমাকে মেহেরবানি করে টিল্ডাল বানিয়ে দিয়েছেন।

সেদিন বুঝতে পারিনি, পরে জেনেছিলাম কয়েদিদের ভেতর থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে সেলুলার জেলের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পেটি অফিসার, টিল্ডাল এমনি সব পজিশনে বসিয়ে দেয়। তারা সরকারের বিশ্বস্ত বাহিনী। এরা মোটামুটি স্বাধীন; তবে সেলুলার জেলের চৌহদ্দির বাইরে এদের পা বাড়াবার হুকুম নেই। এদের কাজ হল অন্য বেয়াড়া, ঠ্যাটা, বেপরোয়া কয়েদিদের শায়েস্তা রাখা। পদমর্যাদায় টিল্ডালরা পেটি অফিসারদের চেয়ে একস্তর নিচে। লোকটার কথাবার্তা, হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে মুসলমান৷ জিগ্যেস করলাম টিন্ডাল তো বুঝলাম। তোমার নিশ্চয়ই একটা নামও আছে। সেটা কী?

লোকটা বলল, জাফর আলি৷ খাস ইলাহাবাদি। মতিলাল নেহরু, জবারলাল নেহরুকা মহল যিস টেনমে (টাউনে) হায় উঁহাকা রহনেবালা থা। লেকিন অব সেলুলার জেল আপনা মকান। পুরা জিন্দেগি কে লিয়ে

আমি কিছু বললাম না। এই নিঝুম রাতে সেন্ট্রিদের বুটের আওয়াজ ছাড়া যেখানে আর কোনও শব্দ নেই, আচমকা মাটি কুঁড়ে জাফর আলি নামে টিল্ডালটি উঠে এসেছে সেটা নেহাত আলাপ জমাবার জন্যে নয়; বৈজুর মতো তারও নিশ্চয়ই কোনও গুঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে। অপেক্ষা করতে লাগলাম।

লোকটা ঝপ করে গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রকারীর মতো ফিস ফিস করল, জনাব, বঙ্গলকা শের, আপকো পাস চরস হ্যায়?

চরস যে মারাত্মক কড়া নেশার জিনিস, সেটা জানতাম! বিপ্লবীদের গীতা স্পর্শ করে সে সময় প্রতিজ্ঞা করতে হত, নেশাভাং করবে না, নারীর কাছ থেকে দূরে থাকবে। জিতেন্দ্রিয় না হলে বিপ্লবী হওয়া যেত না। তেমন এক দেশব্রতীর কাছে কিনা টিল্ডাল জাফর আলি চরসের খোঁজ করছে! আমি রুক্ষ গলায় বলেছিলাম, নেই।

জাফর আলি একটু যেন হতাশ হয়ে বলল, পিনিক হ্যায়?

জিনিসটা কী, আগে কখনও শুনিনি। বললাম, পিনিক কাকে বলে? জাফর আলি বুঝিয়ে দিল, গাঁজার সঙ্গে আরও তীব্র ধরনের কী সব মিশিয়ে সেটা তৈরি করতে হয়। সেলুলার জেলে প্রথম দিন পা দিয়েই আমার জ্ঞানের ঝুলিটি ভরে উঠতে লাগল। এতকাল চরিত্রগঠন, গীতাপাঠ এবং দেশের স্বাধীনতা ছাড়া অন্যকোনও দিকে লক্ষ ছিল না। এখানে এসে একদিনেই কত কিছুই। না জানতে পারলাম।

জাফর আলি কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই একটা করুণ, কাতর, আর্ত চিৎকার সেলুলার জেলের নিস্তব্ধ রাত্রিকে ভেদ করে আকাশের দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, বঁচাও– বঁচাও-হো ভগোয়ান রামজি মুঝে বঁচাও-ও-ও বঁচাও–

শিউরে উঠলাম। শব্দটা আমার হৃৎপিণ্ডে যেন আমূল বিধে যেতে লাগল। এমন তীক্ষ্ণ, অস্বাভাবিক আর্তস্বর আগে আর কখনও শুনিনি। কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলাম, কে কাঁদছে?

জাফর আলি টিল্ডাল এতটুকু বিচলিত হয়নি। হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে নিস্পৃহ সুরে বলল, ও শালে, এক ফাঁসির আসামি। সাত রোজ আগে ওর ফাঁসির হুকুম হয়েছে। কাল সুবেহ আট বাজে ওকে রশির ফান্দা গলায় লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। একটু কী ভেবে ফের বলল, তুমি নয়া এসেছ তো। তাই ঘাবড়ে গেছ। তুমি দশ আদমিকে কোতল করেছ। তোমার এত ডরের কী আছে? সে আরও জানাল, এরকম ফাঁসি ফি মাসে তিন-চারটে করে হয়। এমনভাবে বলল, ফাঁসিটা এই জেলখানায় যেন জলভাতের মতো ব্যাপার।

জিগ্যেস করলাম, কী করেছিল ও? জাফর আলি বলেছিল, শালে কুত্তে, ভারী কসুর কিয়া। লোকটার অপরাধ কী সেটা আর বলল না; আমিও জানতে চাইলাম না।

জাফর আলি বলল, ফাঁসির আগের রাতে সব আসামি এরকম চিল্লায়। কেউ খোদাকে ডাকে, কেউ ভগোয়ানকে। সমঝা? দো-চার মাহিনা এখানে থাকো। সব জানতে পারবে। আমি উত্তর দিলাম না।

কাল সকালে যে লোকটার গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো হবে, জাফর আলি টিল্ডাল তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাইল না। আকছার এখানে এসব ঘটছে। এতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।

ফাঁসির আসামিটা সমানে চেঁচিয়ে চলেছে। বুকফাটানো প্রবল সেই আর্তনাদ। জাফর আলি সেটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বলল, তোমার কাছে পাইসা (পয়সা) আছে? তাকে বললাম, পয়সা কোথায় পাব? না–নেই।

জাফর আলি বিশ্বাস করল না। বলল, বহুৎসে কয়েদি গলার অন্দর থলিয়া বানিয়ে পাইসা রুপাইয়া সোনে চাদি ভি ছিপাকে নিয়ে আসছে। আর তুমি আনননি, এটা আমি মানব?

আমি হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। গলার ভেতর কোন কৌশলে গোপন থলি বানানো যায় এবং তার ভেতর সোনাদানা টাকা পয়সা ঢুকিয়ে আনা যায় আন্দামানে না এলে জানতে পারতাম না। বললাম, মানা, না-মানা তোমার ইচ্ছা। সাফ বলে দিচ্ছি, আমার গলার ভেতর থলেও নেই, টাকা-পয়সাও নেই।

জাফর আলি টিল্ডালের বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা ছিল না। সে বলল, দশঠো কোতল করতে পেরেছ, আর গলায় একটা থলিয়া বানাতে পারোনি! ছো? প্রবল ঘৃণায় অলিন্দে থুতু ফেলে বলতে লাগল, পিনিক নেই, চরস নেই, পাইসা নেই। তোমার কাছে বেকার এসে টেইম (টাইম) বরবাদ করে গেলাম। বলে আর দাঁড়াল না; বাঁদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জাফর আলি চলে যাবার পরও আমি গরাদ ধরে দাঁড়িয়েই আছি। ঘুম আসছিল না। সেই কয়েদিটা খুব কাছাকাছি কোনও একটা সেলে রয়েছে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে তাই মনে হয়। তখন কত রাত কে জানে। যদি মধ্যরাতই হয়, আর কয়েক ঘণ্টা পর তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হবে। মৃত্যু পায়ে পায়ে যত এগিয়ে আসছে ততই তার আর্তনাদ আরও আরও তীব্র হয়ে উঠছে। হো ভগোয়ান রামজি, মুঝে বঁচা দে।

সেলুলার জেলে সেই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর বুঝিবা কেউ জেগে নেই। প্রায় হাজারটা সেলের সব কয়েদি ঘুমিয়ে পড়েছে। জাফর আলির মতো তারাও এরকম কত ফাঁসির আসামির বুক কাঁপানো কত আর্তনাদ শুনেছে। এতে তাদের কিছু আসে যায় না। নিশ্চিন্ত, বিঘহীন তাদের রাতের ঘুম। অতন্দ্র শুধু ওয়াচ টাওয়ারের পাহারাদার আর রাইফেলধারী সেন্ট্রিরা।

রামজির কাছে জীবনদানের প্রার্থনা করতে করতে কয়েদিটার গলা চিরে চিরে যাচ্ছে। ভগোয়ান রামজির কানে সেই আর্জি পোঁছচ্ছে কি না, কে বলবে। তার কান্নাটা ঘুমন্ত সেলুলার জেল জুড়ে একটা গা ছমছম-করা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। চলেছে।

আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। পা ভেঙে আসছিল। চার দিনের সমুদ্রযাত্রা, সাইক্লোন, তারপর সেলুলার জেলে পৌঁছে সমস্ত দিনের ধকল–শরীর আর কতক্ষণ সইতে পারবে! আমি দরজার কাছ থেকে কুঠুরির ভেতর দিকে চলে গেলাম। একপাশে খাবারের থালাটা চাপা দেওয়া রয়েছে। আরেক পাশে পায়খানা পেচ্ছাপের জন্য বড় গামলার মতো পাত্র। বিকেলে যে চাপাটি দেওয়া হয়েছিল তা ঠান্ডা হয়ে এতক্ষণে শুকনো চামড়া হয়ে গেছে। তা চিবতে গেলে দাঁতের গোড়া আলগা হয়ে যাবে। তাছাড়া খাওয়ার ইচ্ছাটা আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চাপাটি ঢাকা দেওয়াই রইল। আমি এক গেলাস। জল খেয়ে কম্বল পেতে কুঠুরির মাঝখানে শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।

আমরা যারা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী তাদের ঘুম খুব ঠুনকো। কেননা পুলিশ যে কোনও সময় তাদের আস্তানায় হানা দিতে পারে। তাই সামান্য আওয়াজেই জেগে যেতাম। পুলিশ না এলে ঠিক আছে। এলে তক্ষুনি পালাতে হবে।

যত রাতেই ঘুমোই না কেন, ভোর হতে না হতেই উঠে পড়তাম। সেলুলার জেলেও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। পরদিন, তখনও ভালো করে সকাল হয়নি, বাইরে আবছা আবছা তরল অন্ধকার। প্রথমটা বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় আছি। পরক্ষণে সেই ফাঁসির আসামির আর্ত চিৎকার ভেসে এল। খুব সম্ভব সমস্ত রাত সে একটানা কেঁদে গেছে। কেঁদে কেঁদে গলার স্বর এখন আরও বিকৃত, আরও ভাঙা ভাঙা। অলিন্দে পাহারাদারের বুটের আওয়াজ চলছেই। এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি সেলুলার জেলে রয়েছি।

আমি গামলার ওপর সে দিনের প্রথম প্রাকৃত কর্মটি সেরে নিয়ে সেটার মুখ ঢাকা দিলাম। তার খানিকটা দূরে খাবারের থালা। আরেকটু দূরে বিছানায় যেন স্বর্গালোকে চলে এসেছি। ভাবতেই মজাও লাগল, বেশ হাসিও পেল।

আমি দরজার কাছে চলে এলাম। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে ওটাই আমার একমাত্র যোগসূত্র। গরাদের ফাঁক দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকি। অন্ধকার আরও অনেকটা ফিকে হয়েছে। কিন্তু কাল রাতে কখন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল খেয়াল করিনি। কুয়াশার ঘন স্তর চাদরের মতো মাউন্ট হারিয়েট, সমুদ্র, জঙ্গল, আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপগুলোকে মুড়ে রেখেছে। কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়।

হঠাৎ অলিন্দের দূর প্রান্ত থেকে কর্কশ শব্দ ভেসে এল। ওই সালে লোগ, ওঠ ওঠ। সুবেহ হো গিয়া আওয়াজটা ক্রমশ আমাদের এ প্রান্তের কুঠুরিগুলোর দিকে এগিয়ে আসছে। শুধু আমাদের দোতলাতেই নয়, একতলা, তেতলা এবং সামনের ব্লকেও একই রকম কর্কশ শব্দ। ব্যাপারটা এতক্ষণে বোধগম্য হল। ঘুমন্ত কয়েদিদের এইভাবে জাগানো হচ্ছে।

যে জাগাচ্ছিল তার গলাটা চেনা চেনা। কালই শুনেছি। যা ভেবেছিলাম তাই। সেই পেটি অফিসার, আসলাম খান। পাশের কুঠুরির বৈজুকে জাগিয়ে আমার কুঠুরির সামনে চলে এল। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো একটু খুশিই হল! তার প্রকাণ্ড মুখের ঘন দাড়িগোঁফের জঙ্গল ভেদ করে কোদালের মতো কয়েকটা দাঁত বেরিয়ে পড়ল। বোধহয় সেটা হাসিই। আমাকে ঘুম ভাঙাবার আগেই জেগে উঠতে দেখে সে মনে হয়। খুশিই হয়েছে। সে বলল, শালে, টিরোরিস তেরে নিদ টুট গিয়া? শাশ!

আমি জবাব দিলাম না। আসলাম খানের মতো আরও কত পেটি অফিসার, টিল্ডাল আর টিন্ডালদের মুখে এই মধুর শালে সম্ভাষণটুকু যে শুনতে হয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে আমার নিজের একটা বোনও নেই। পৃথিবীতে কজনের আর এতগুলো ভগ্নীপতি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়?

সে যাই হোক, আসলাম খান এবার জিগ্যেস করল, কিয়া রে, টাট্টি (পায়খানা) হো গিয়া? মুহ ধো লিয়া?

হ্যাঁ আমি ঘাড় কাত করলাম।

আসলাম খানের ঠোঁট দুটো আরও খানিকটা ফাঁক হয়ে আরও কয়েকটা দাঁত বেরিয়ে পড়ল। সে বলল, বহুৎ আচ্ছা টিরোরিস। থোড়ে টিইম (টাইম) বাদ সাফাইবালারা এসে টাট্টির বর্তন নিয়ে যাবে। সাত বাজে আমি এসে তোমাকে নিচে নিয়ে যাব। তখন সবেহকা নাস্তা মিলেগা। তৈয়ার থেকো। সে আর দাঁড়াল না।

আধঘণ্টার মতো কেটে গেল। তারপর একজন আর্মড পুলিশ একটা সাফাইওয়ালা অর্থাৎ সুইপারকে সঙ্গে নিয়ে এল। তার। হাতে চাবির গোছা। তালা খুলে পুলিশটি ছোট্ট সেলটা তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল। আমার মতো একজন টেরোরিস্ট এক রাত্রির মধ্যে পায়ে বেড়ি-লাগানো অবস্থায় মহান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করেছি কিনা এবং তার কোনও চিহ্ন কোথাও পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখাই তার উদ্দেশ্য। সাফাইওয়ালা ময়লার গামলা মাথায় তুলে নিয়েছিল। তাকে নিয়ে নিঃশব্দে পুলিশটি বাইরে গিয়ে ফের তালা লাগিয়ে চলে গেল।

আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। দেখতে দেখতে সূর্য উঠে গেল। কুয়াশার বেড়াজাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এদিকে পুরো সেলুলার জেগে উঠেছে। চারদিকে তুমুল ব্যস্ততা এবং হইচই। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ফাঁসির আসামির চিৎকার থেমে গেছে। তবে কি তার শেষ ভরসা ভগোয়ান রামজির কাছে প্রার্থনা করেও ব্যর্থ হওয়ায় হতাশায় সে চুপ করে গেছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।

আসলাম খান একজন সশস্ত্র পুলিশকে সঙ্গে করে আবার দর্শন দিল। তালা খুলে বলল, থালি লেকে চল টিরোরিস জনাব। নাস্তা তৈয়ার। পায়ের বেড়ি খুলে আমাকে বাইরের টানা অলিন্দে নিয়ে আসা হল। আরও কয়েকজন টিল্ডাল আর পেটি অফিসার আর পুলিশ অন্য সেলগুলো খুলে কয়েদিদের বের করে ফেলেছে। সবার হাতেই খাবারের থালি আর জলের গেলাস।

পাশের কুঠুরির বৈজু আমার কাছে এগিয়ে এল। আমার থালিটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, কিয়া ভাইসাব, কাল রাত্তিরে আপনি খানা খাননি? আপনার থালিয়ায় চাপাটি পড়ে আছে? তাকে বললাম, না, কাল খিদে ছিল না। বৈজু বলল, আপনার থালিয়ায় চাপাটি দেখলে আজ আর নাস্তা দেবে না। ও দুটো আমি নিচ্ছি। আমি কিছু বলার আগেই চকিতে ছোঁ মেরে আমার কালকের বাসি চাপাটি দুটো দিয়ে সবজি মুড়ে নিয়ে গরাদের ফাঁক দিয়ে নিজের কুঠুরিতে ছুঁড়ে দিল। হেসে ডগমগ হয়ে বলল, আপনাকে বলেছিলাম, আমার ভুখটা বহুৎ বেশি। চাপাটি দুটো আমার সেলে থাক। পরে খাওয়া যাবে। আমি একটু হাসলাম শুধু। কিছু বললাম না।

এরপর পুলিশ, টিল্ডাল আর পেটি অফিসাররা শোভাযাত্রা করে কয়েদিদের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হল। বৈজু আমার গায়ে জোঁকের মতো সেঁটে আছে। চলতে চলতে খাটো গলায় বলল, এখন নিচে নামিয়ে নিয়ে আমাদের নাস্তা দেওয়া হবে।

ভাইসাব,আপনার ভাগ থেকে আমাকে থোড়া কুছ দেবেন। এবারও জবাব না দিয়ে হাসলাম।

আমি আর বৈজু ছিলাম মিছিলের পেছনে। লেজের দিকে। হঠাৎ সামনের দিক থেকে রাজনাথ আর মুকুন্দ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, পায়ে বেড়ি লাগিয়ে কালাপানির রাতটা প্রথম কেমন লাগল? আমিও গলার স্বর উঁচুতে তুলে বললাম, তোফা। তোদের কেমন কেটেছে? রাজনাথরা বলল, স্বর্গসুখ কাকে বলে এখানে না এলে জানতে পারতাম না।

পুলিশ থেকে টিল্ডাল অব্দি সবাই হুমকির সুরে শাসায়, এ শালে লোগ, চিল্লাও মাৎ। বিলকুল খামোস। আগর চিল্লাওগে তো গলাকা নলিয়া ফাড় দুঙ্গা–

অগত্যা সুবোধ বালকের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম। কাল আমাদের তিন বিপ্লবীকে অন্য কয়েদিদের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি। দাগি আমের পাশে অন্য আম থাকলে তার গায়ে দাগ ধরতে পারে। বিপ্লবীরা কানে ফুসমন্তর দিয়ে এই কালাপানিতে যাতে দল ভারী করতে না পারে, তাই এই সতর্কতা। কিন্তু আজ কড়াকড়িটা আলগা কেন, আন্দাজ করতে পারলাম না। তাই একটু অবাকই হলাম।

অলিন্দ ধরে এগতে এগতে পাশের রেলিংয়ের ওপর দিয়ে নিচের চত্বরে নজর চলে যাচ্ছিল। সেখানে বিরাট বিরাট ঘড়ি, হাতা, জলের ড্রাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল টিল্ডাল আর পেটি অফিসার। বন্দুকওলা পুলিশে চারদিক ছয়লাপ। চোখে পড়ল উলটোদিকের ব্লক থেকে কয়েদিদের কাতার দিয়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের হাতেও থালা এবং গেলাস।

আমরা নিচে নেমে আসতেই হুংকার ছাড়তে ছাড়তে পেটি অফিসাররা লাইন করে কয়েদিদের দাঁড় করিয়ে দিল। দুটো লম্বা লাইন। একটা আমাদের ব্লকের কয়েদিদের; অন্যটা সামনের ব্লকের কয়েদিদের।

বৈজু আমাকে ছাড়েনি; গায়ে গায়ে লেগে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছি খাবার দেবার সময় সে কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়বে না।

কাল বিকেলে আমাদের তিন বিপ্লবীকে লাইন দিতে হয়নি। দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে পুলিশ চাপাটি-সবজি এনে দিয়েছিল। আজ মুড়ি-মিছরি সব একাকার। পুরনো কয়েদিদের ঝাকে। আমরাও ভিড়ে গেলাম।

লাইন ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে গেলে দুই অফিসার দুটো লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের হাতে দুটো মোটা বাঁধানো খাতা। তারা খাতা খুলে হাঁকতে লাগল, কয়েদি নাম্বার এক-একজন, হাত তুলে জবাব দিল, হাজির– এইভাবে দুই লাইনের সব। কটা কয়েদির নাম হাকার পর খাতা বন্ধ করল। অবশ্য আমাদের তিন বিপ্লবীকেও হাজির বলে সাড়া দিতে হল।

আমার পেছন থেকে বৈজু নিচু গলায় বলল, হর রোজ সুবেহু সাম পুলিশ অফসাররা কয়েদি গিনতি (গুনে) দেখে। শালেদের ভয় কেউ হয়তো ভেগে গেছে। চারদিকে ইতনা ইতনা পেহেরাদার; কী করে ভাগবে বলুন ভাইসাব।

আমি হাসলাম। বৈজু বলল, আমার ভুখের কথাটা মনে আছে। ত? বললাম, আছে, আছে কয়েদি গোনা হয়ে যাবার পর একজন পুলিশ অফিসার চিৎকার করে হুকুম দিল। আভি নাস্তা চালু কর দে।

টিল্ডাল এবং পেটি অফিসাররা তৈরি হয়েই ছিল। তারা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হাড়ি থেকে মস্ত লোহার হাতায় কালচে হলুদ রঙের থকথকে তরল জাতীয় পদার্থ তুলে কয়েদিদের থালায়। দিতে লাগল। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ দুহাত। সেটা কম নয়; থালা প্রায় বোঝাই হয়ে গেল। খাবার নিয়ে প্রতিটি কয়েদি পাশের টিল্ডাল বা পেটি অফিসারের কাছ থেকে জল নিয়ে এক ধারে # দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করল। কালকের মতো সেলে নিয়ে গেল না।

আমাদের লাইনের সামনের দিকের কয়েদিরা একের পর এক খাবার এবং জল নিয়ে পাশের দিকে সরে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমার পালা এল। অন্যদের মতো আমিও প্রকাণ্ড দুদলা থকথকে জিনিস আর জল হাতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। এক দৃষ্টে থালার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন খাদ্যবস্তু আগে আর কখনও চর্মচক্ষে দেখিনি। তবে সেটা বেশ গরম। অল্প অল্প ধোঁয়া উড়ছিল। দু-চারটে আলু আর কুমড়োর টুকরোও চোখে পড়ছে। শুঁকে দেখলাম গন্ধটা কেমন যেন উৎকট।

একটু পরেই বৈজু উৰ্ধশ্বাসে এসে হাজির। পাছে আমি খেয়ে ফেলি সেজন্য একরকম দৌড়ে এসেছে। খাবারের দিকে আঙুল বাড়িয়ে তাকে জিগ্যেস করলাম, এটাকে কী বলে?বৈজু বলল, কাঞ্জি। আমার নতুন প্রশ্ন। কী দিয়ে এটা তৈরি? বৈজু বুঝিয়ে দিল, বহু পুরনো চালের খুদ, ভাঙা ভাঙা নানা ধরনের ডাল, আলু, কুমড়ো এবং আরও কয়েক রকম সবজি এবং মরিচ একসঙ্গে ফুটিয়ে এই বস্তুটি বানানো হয়। খুদ আর ডাল গুদামে থাকে তো। তার সঙ্গে চুকা টাট্টি অর্থাৎ ইঁদুরের নাদিও যে থাকবে না, হলফ করে তা বলা যায় না। রোজ প্রায় হাজারখানেক কয়েদির জন্য এত কাঞ্জি বানাতে হয়, তাই কে আর ইঁদুরের নাদি বেছে ফেলে দেবে? শুনেই আমার পেটের ভেতরটা পাক দিয়ে উঠল।

বৈজু যেন একশো বছরের খিদে পেটে নিয়ে আমার থালাটার দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, ভাইসাব, আমার হিস্যাটা দিয়ে দিন। শুনে বেশ মজাই লাগল। কাল বিকেলে তার সঙ্গে প্রথম দেখা। কিন্তু এর মধ্যেই আমার খাবারের আধা-আধি ভাগের ওপর তার আইনসংগত অধিকার যেন জন্মে গেছে। ইচ্ছা হচ্ছিল, পুরো কাঞ্জিটাই ওর থালায় ঢেলে দিই। কিন্তু কাল দুপুরে জাহাজে শেষবারের মতো খেয়েছিলাম। তারপর পেটে এক ফোঁটা জলও পড়েনি। খিদেয় নাড়ি চুই চুই করছিল। কিছু তো একটা খেতে হবে। কাঞ্জি ছাড়া এখানে আর কিছু পাওয়ার উপায় নেই। আমার থালা থেকে অর্ধেকেরও বেশি ওর থালায় ঢেলে দিলাম। তারপর খুঁটে খুঁটে একটুআধটু মুখে দিতে লাগলাম। এখন থেকে এই বস্তুটি রোজ সকালে গলাদ্ধকরণ করতে হবে। ভাবতেই পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল।

খানিকটা দূর থেকে রাজনাথের গলা শোনা গেল। কেমন খাচ্ছিস রে শেখর? তাকে পালটা জিগ্যেস করলাম, তুই কেমন খাচ্ছিস? সে বলল, এমন ব্রেকফাস্ট চৌরঙ্গির গ্র্যান্ড হোটেলও তৈরি করতে পারবে না। যে বেঁধেছে, যদি কোনও দিন মুক্তি পাই, মেনল্যান্ডে ফেরার সময় তার পায়ের ধুলো নিয়ে যাব। কিন্তু কলকাতায় আর তার ফেরা হয়নি। কিন্তু সেসর পরের কথা।

আমি রাজনাথকে কী বলতে যাচ্ছিলাম, বলা হল না। তার আগেই কাল রাতের সেই করুণ, কাতর চিৎকার কানে এল। হো ভগোয়ান রামজি, মুঝে বঁচা দে।

চমকে সামনের দিকে তাকালাম। মাথায় ঝাকড়া চুল, মাঝারি হাইট, পরনে জেলের উর্দি, হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো, বয়স তিরিশের মতো একটা লোককে একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার এবং ছজন আর্মড পুলিশ আমাদের ব্লকের তেতলা থেকে নামিয়ে আনছে। এই কয়েদিটাই কাল অনেক রাত পর্যন্ত অবিরল কেঁদে কেঁদে ভোরের দিকে খুব সম্ভব থেমে গিয়েছিল। আবার এখন তার কান্না শুরু হয়েছে।

লক্ষ করলাম অন্য কয়েদিরাও তাকে দেখছে। কিন্তু সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। উদাসীন। তারা খেয়েই চলেছে। বৈজুও গোগ্রাসে। খাচ্ছিল। খেতে খেতে বলল, কুছ টেইম (টাইম) বাদ ওর ফাঁসি হবে। সেটা বুঝতেই পেরেছি। জিগ্যেস করলাম, ওর কী নাম? বৈজু বলল, হরগোবিন। বললাম, কেন ওকে ফাঁসি দেওয়া। হবে? কাল জাফর আলি টিল্ডালকে এই প্রশ্নই করেছিলাম। সে জবাবটা এড়িয়ে গেছে। বৈজু বলল, ওকে পুলিশ অফসর পাথর তোড়ার (পাথর ভাঙার) কাজ দিয়েছিল। ও রাজি হয়নি। তখন ওর খানা বন্ধ করে হাতে-পায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগিয়ে কুঠুরিতে ঢোকানো হয়েছিল। হরগোবিন দো রোজ ভুখা থেকে বেহোঁশ হয়ে পড়ে। তখন পুলিশ অফিসররা এসে জলটল দিয়ে হোঁশ ফেরায়। বলে আগে পাথর তোড়তে হবে, তবে খানা মিলবে। হরগোবিনের মাথার ঠিক ছিল না। সে হাতের হ্যান্ডকাফ এক পুলিশ অফসরের কানের ওপর শরীরের পুরা তাকত দিয়ে ঘা মারে। সেই চোটে অফিসার বিলকুল খতম। ইতনা বড়া কসুর জেলরসাব মাপ করেনি। হরগোবিনের ফাঁসির হুকুম হয়ে যায়।

আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনটা বিষাদে ভরে যায়। জিগ্যেস করলাম, দেশে ওর কে আছে? বৈজু একটা হাত ঘুরিয়ে বলল, কৌন জানে!

হরগোবিনকে পাহারা দিয়ে পুলিশবাহিনী সামনের ব্লকের পাশ দিয়ে ডান দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। হয়তো ওধারে কোথাও ফাঁসিঘর। হরগোবিনকে দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু তার চিৎকার সমানে ভেসে আসছে। হো রামজি, মুঝে বঁচা দে। কিন্তু সে হয়তো জানে না বঙ্গোপসাগরের এই কয়েদখানায় রামচন্দজিরও কিছুই করার নেই। এখানে তার প্রবেশ নিষেধ।

একটু পরে হরগোবিনের কান্না থেমে গেল। ফাঁসিতে তার মৃত্যুর খবর হয়তো তার মা বাপ বউ বাচ্চা (যদি কেউ থাকে) কোনও দিনই জানতে পারবে না।

বেলা চড়ছিল। পেটি অফিসার এবং টিন্ডালরা কর্কশ স্বরে হাঁকতে লাগল। যা কুত্তেলোগ। নাস্তা হো চুকা। আভি আপনা আপনা ডিপটিমে (ডিউটিতে) চলা যা

কয়েদিদের কীসের ডিউটি বুঝতে পারলাম না। ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ডে থাকার সময় শুনেছি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা নিয়ে যারা এখানে আসে তাদের ওই জেলখানার সেলে বন্দি থেকে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এছাড়া এই নির্বাসিতদের যে আর কিছু করার আছে বা থাকতে পারে, আদৌ তেমন ধারণা ছিল না।

লক্ষ করলাম, অন্য কয়েদিরা লাইন দিয়ে সামনের চত্বরে মাঝখানে যে লম্বা শেডটা রয়েছে একে একে তার ভেতর ঢুকতে লাগল। আর-একটা দলকে নিয়ে এক দঙ্গল আর্মড গার্ড আর কয়েকজন পুলিশ অফিসার জেল গেটের দিকে চলল।

আমরা তিন বিপ্লবী রাজনাথ, মুকুন্দ এবং আমি পরস্পরের কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমরাও কয়েদি। আমাদের কোনও ডিউটি দিতে হবে কিনা এবং সেই ডিউটিটা কী ধরনের কেউ বলে দেয়নি।

না, আমাদের ডিউটি দিতে হল না। একজন পুলিশ অফিসার আর কয়েকজন পুলিশ, তাদের হাতে রাইফেল—আমাদের পাহারা দিয়ে দিয়ে তিন নম্বর ব্লকে যার যার কুঠুরিতে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চলে গেল। সৌভাগ্যই বলতে হবে, আমাদের পায়ে এখন আর বেড়ি পরানো হল না। কিন্তু ঘণ্টা দুই তিন পর কী ঘটবে, তখন কি আর জানতাম!

আমার সেল থেকে আমাদের ব্লকের তিনটে ফ্লোরের অন্য কোনও সেলই দেখা যায় না। রাজনাথ আর মুকুন্দ কী করছে, জানি না। আমি জানলার গরাদ ধরে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। একদল কয়েদিকে কিছুক্ষণ আগে পুলিশ পাহারায় জেলখানার বিশাল গেটের দিকে যেতে দেখেছিলাম। এবার চোখ পড়ল তারা গেট পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় চলে গেছে। একটু পর তারা দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হঠাৎ আবার নিচের চত্বরে হইচই শুরু হল। চমকে সেদিকে তাকালাম। আমাদের ব্লকের ষাট-সত্তরটি কয়েদি ফিরে আসছে। তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ঢাউস-ঢাউস ভারী চটের বস্তা; হাতে [ কাঠের বেঁটে বেঁটে মোটা মুগুর। সামনের ব্লকের অনেক কয়েদিও বস্তা এবং মুগুর নিয়ে ওধারে যাচ্ছে। যথারীতি আর্মড গার্ড, টিন্ডাল আর পেটি অফিসাররা তো রয়েইছে।

আমাদের ব্লকের কয়েদিরা কেউ গেল তেতলায়, কেউ দোতলায়, কেউ বা একতলায়। দোতলায় যারা উঠেছে তাদের মধ্যে বৈজুকে দেখতে পেলাম কেন না সে আমার এবং তার সেলের মাঝামাঝি জায়গায় অলিন্দের রেলিং ঘেঁষে তার বস্তা আর মুগুর নামাল। পেটি অফিসার আসলাম খানকে তার পাশে দেখা গেল। আমাকে চোখের ইঙ্গিতে দেখিয়ে চাপা গলায় কিছু বললেন। তার শেষ দুএকটা শব্দ কানে এল। খোদা মাত্ করো, বলে এদিক সেদিক তাকিয়ে বড় করে হাঁ করল। তারপর গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে চোরা গর্ত থেকে একটা চামড়ার থলি বের করে সেটা থেকে। একটা সিকি নিয়ে আসলাম খানের হাতে দিয়ে ফের থলিটা গলায় ঢোকাল। দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চকিতে মনে পড়ে গেল। কাল রাতে টিল্ডাল জাফর আলি জিজ্ঞেস করেছিল, আমার গলায় পয়সার থলি আছে কি না।

সিকিটি নিয়ে আসলাম খান খুশি হল। চোখ কুঁচকে একটু। হেসে বলল, তোর ভাইসাবের জন্যে ফিকর মাত কর। আভি ডিপটি চালু কর দে।

বুঝতে পারলাম আমার জন্যে পেটি অফিসারকে এই সিকিটি ঘুষ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন? একটা কারণ, আমার খাবার থেকে তাকে ভাগ দিই। বাকিটা স্পষ্ট ধরা যাচ্ছে না। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।

আসলাম খান এবং অন্য পেটি অফিসার আর টিল্ডালরা অলিন্দের নানা দিক থেকে হাঁকতে লাগল, শালে লোগ, ডিপটিমে বৈঠ যা। আট বাজ গিয়া–

আগে লক্ষ করিনি, এবার দেখলাম অলিন্দের যে পাশে রেলিং তার গা ঘেঁষে সারি সারি চৌকো পাথর এক ফুটের মতো লম্বা, এক ফুটের মতো চওড়া এবং নদশ ইঞ্চি পুরু সারি সারি পাতা রয়েছে। বৈজু একটা পাথর টেনে সেটার সামনে থেবড়ে বসে পড়ল। তারপর বস্তার মুখ খুলে উপুড় করে দিতেই অজস্র নারকেল ছোবড়া বেরিয়ে পড়ল। সেগুলোকে একধারে পাকার করে রেখে একেকটা ছোবড়া পাথরের পাটার ওপর। রেখে মুগুর দিয়ে পিটতে শুরু করল। ধুপধাপ আওয়াজ উঠতে লাগল। অন্য কয়েদিদের দেখতে পাচ্ছি না, তবে সারা অলিন্দ জুড়ে একইরকম আওয়াজ হচ্ছে। একটানা, অবিরল।

দেখতে লাগলাম, বৈজু নারকেল ছোবড়া পিটিয়ে ঝুরো থেকে সরু সরু সুতোর মতো আঁশ বা কয়ার বের করে একধারে রাখছে। জিজ্ঞেস করলাম, এই তোমাদের ডিউটি? বৈজু ঘাড় ফিরিয়ে বলল, হ্যাঁ, ভাইসাব! সুবেহসে  সাম তক। দো সের সুতো বের করতে হবে। দুপহরকা খানাকে লিয়ে এক ঘণ্টা কাম বন্ধু। দো সের সুতো যদি না দিতে পারি, রাতের খানা মিলবে না; তার ওপর পেটি অফিসারদের ডান্ডা। জিজ্ঞেস করলাম, সব কয়েদিকেই কি ছোবড়া থেকে সুতো বের করতে হয়? বৈজু বলল, নেহি। চত্বরের লম্বা শেডটা দেখিয়ে। বলল, ওটার ভেতর ঘানি আছে। অনেকের ডিপটি পড়ে নারিয়েল (নারকেল) থেকে হাত দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে হর রোজ পন্দ্র (পনেরো) সের তেল বের করতে হয়। এক ছটাক কমতি নেহি। তা হলেই ডান্ডা। জানতে চাইলাম, কয়েদিদের জন্যে এই দুরকমেরই ডিউটি? বৈজু মুগুর চালাতে চালাতে জানালো, চার-পাঁচশো কয়েদিকে রোজ নাস্তা খাওয়ার পর সেলুলার জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা পাথর ভেঙে রাস্তা বানায়। বাড়িঘর তৈরিতে মজুরের কাজ করে; কেউ কেউ ফবিস-এ (ফরেস্ট) গিয়ে কাঠ কাটে। কারও-কারওকে নিয়ে যাওয়া হয় শিপিং ডিপার্টমেন্টের ডক-এর কাজে। সারাদিন কাজের পর তাদের সেলুলার জেলে এনে আবার যার যার কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই বন্দিশালা, পোর্টব্লেয়ার শহর, সবই আংরেজরা কয়েদিদের দিয়ে বানিয়েছে।

বৈজু বলতে লাগল, ভাইসাব, নয়া এসেছেন। দো-চার রোজ যাক, আপনাকে পুলিশ পেটি অফিসাররা এইসব ডিপটিতে লাগিয়ে দেবে। হাড্ডি-তৌড় (হাড়ভাঙা) মেহনত না করলে কালাপানিতে খানা মেলে না৷ চমকে উঠলাম, রাজবন্দিদের যে সেলুলার জেলে পায়ের ওপর পা তুলে আরামে দিন কাটাতে দেওয়া হয় না, সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার ঘটে আছে! কিন্তু নারকেল ছোবড় থেকে কয়ার বের করা, ঘানি টানা, রাস্তা ভাঙা–এই জাতীয় ডিউটিতে আমাদের জুড়ে দেওয়া হবে, কে ভাবতে পেরেছিল!

একসময় কথাবার্তা থামিয়ে নিজের কাজে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে বৈজু। সন্ধের আগে তাকে নারকেল ছোবড়া থেকে দুসের সরু তার বের করতে হবে। তার কি খোশ গল্প করার মতো সময় আছে?

আমার কোনও ডিউটি নেই; অন্তত আজকের দিনটার মতো। সময় আর কাটতে চায় না। সলিটারি সেলে বন্ধ দরজার গরাদ। ধরে দূরের সমুদ্র, আকাশ মাউন্ট হারিয়েটের চুড়ো, সামনের ব্লকের সারি সারি কুঠুরি,–এসব একঘেয়ে, ক্লান্তিকর দৃশ্য আর। কতক্ষণ দেখা যায়! আমার চোখে ব্যথা হচ্ছিল। মাথা টিপ টিপ করছে।

একবার ভাবলাম শুয়ে পড়ি। মেঝেতে তো অনন্ত শয্যা পাতাই রয়েছে। কিন্তু শোওয়া আর হল না। হঠাৎ অলিন্দ জুড়ে মুগুর পেটানোর অবিরাম ভোঁতা আওয়াজ ছাপিয়ে কয়েক জোড়া বুটের ভারী, কর্কশ শব্দ কানে এল। আমি চকিত হয়ে উঠলাম। একটু পরেই পেটি অফিসার আসলাম খান, একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার আর কয়েকটি বন্দুকধারী গার্ড আমার সেলের সামনে এসে দাঁড়াল।

আসলাম খান নিঃশব্দে সেলের দরজা খুলে আমার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বাইরে বের করে আনল।

পুলিশ অফিসারটির সাড়ে ছফিটের মতো হাইট, বিশাল। মাংসল শরীর। প্রকাণ্ড মাথা, চোখের তারা নীল। মুখ দেখেই টের পাওয়া যায় লোকটা ভয়ানক নিষ্ঠুর। পোর্টব্লেয়ারে নামার পর যে কজন পুলিশ অফিসার দেখেছি তাদের সবার চেহারা প্রায় একই রকম৷ হিংস্র, নির্মম, নৃশংস। খুব সম্ভব বেছে বেছে এই ধরনের অফিসারকে আন্দামানে পাঠানো হয়েছে।

আমার সামনে যে পুলিশ অফিসারটি দাঁড়িয়ে আছে সে পেটি অফিসার আসলাম খানকে বলল, ইস বাস্টার্ডকো হাতমে হ্যান্ডকাফ লাগাও এর আগেও অন্য এক অফিসার এইভাবে নোংরা গালাগাল দিয়েছিল। অসহ্য ক্রোধে শরীরের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠল। কপালের দুপাশে রগগুলো সমানে দপ দপ করছে। টের পাচ্ছি, চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে অফিসারের দিকে তাকালাম। ইচ্ছা হল, লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। অফিসার আমার মনোভাবটা হয়তো টের পেয়েছে। তার মুখ থেকে তেড়ে আরও কিছু বাছা বাছা কুৎসিত খিস্তি বেরিয়ে এল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো কিছু একটা করতে যাচ্ছিলাম, আসলাম খান আমাকে হাতকড়া পরাতে পরাতে খুব নিচু গলায় শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো হুঁশিয়ারি করে। দিল। টিরোরিস (টেরোরিস্ট) শির গরম কোর না। এ বহোৎ খতারনাক অফসর। জানমে মার ডালেগা। বৈজু যে আমার জন্য তাকে একটি সিকি দিয়েছে সেই কারণে হয়তো এই সতর্কবাণী।

আসলাম খান এই ব্রিটিশ অফিসারটাকে খতরনাক অর্থাৎ বিপজ্জনক বলেছে। এখন পর্যন্ত যাদের দর্শন পেয়েছি তাদের কে যে কম খতরনাক, এখনও বুঝতে পারিনি। হাত-বাঁধা অবস্থায় আমার পক্ষে কী-ই বা করা সম্ভব? প্রতিশোধের স্পৃহাটাকে মনের গোপন কোনও কুঠুরিতে পুরে রাখলাম। যদি কোনওদিন সুযোগ পাই

অফিসার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়ল। ইয়াদ রাখ, আমার নাম মাইকেল স্কট। ফির বেয়াদপি করোগে তো–কথাটা শেষ করে বলতে লাগল, ইয়ে সেলুলার জেল। ইহাকা কানুন আলাগা তোর মতো কুত্তা দো-চার টেরোরিস্টকে যখন ইচ্ছা খতম করে দিতে পারি।

লক্ষ করেছি, এখানকার সব ব্রিটিশ অফিসার হিন্দি-উর্দু মেশানো চোস্ত হিন্দুস্থানি বলতে পারে।

মাইকেল স্কট আসলাম খানকে বলল, হারামিকা বাচ্চেকো লে চল—

আমাকে মাঝখানে রেখে আসলাম খানরা অলিন্দ ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলল। চোখে পড়ল আরও দুজন পুলিশ অফিসার এবং সশস্ত্র পুলিশরা রাজনাথ এবং মুকুন্দকে নিয়ে একই কায়দায়, অর্থাৎ হাতকড়া লাগিয়ে একই দিকে যাচ্ছে।

নিচে তিন নম্বর, চার নম্বর এবং পাঁচ নম্বর ব্লক পার হয়ে ছনম্বর ব্লকের পেছনে নির্জন একটা এলাকায় আমাদের নিয়ে আসা হল। এখানে ডজনখানেক ত্রিভুজের মতো স্ট্যান্ড দাঁড় করানো রয়েছে। সেই আমার প্রথম টিকটিকি দর্শন। প্রতিটি স্ট্যান্ডের দুটো আট ফুটের মতো লম্বা কাঠের পায়া সামনের দিকে রয়েছে। পেছনে একটা পায়। সব মিলিয়ে জিওমেট্রির ত্রিভুজ। সামনের দুটো পায়ায় প্রায় সবটা জুড়ে কাঠের পুরু পাটাতন আটকানো। চোখে পড়ল, ডানপাশে সলিড ইটের দেওয়াল লম্বা কাঠের ব্র্যাকেটে সারি সারি হুক লাগানো। সেই হুকগুলো থেকে চাবুক ঝুলছে। এখানে টেনে আনার মতলবটা এতক্ষণে মোটামুটি টের পাওয়া যাচ্ছে।

যে তিন পুলিশ অফিসার এখানে রয়েছে, মাইকেল স্কট তাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। আরও দুজন পেটি অফিসারকেও দেখা গেল। শরীরের বিশাল কাঠামো আর দাড়ির জঙ্গল দেখে আন্দাজ করা যায় তারা পাঠান।

মাইকেল স্কট কোমরে দুই হাত রেখে গমগমে গলায় হুকুম দিল।–পেটি অফিসার, এ শালে তিন টেরোরিস্টকো হ্যান্ডকাফ খুলো, উর্দি হটাকে নাঙ্গা কর, আউর টিকটিকি পর চড়াও।

চোখের পলকে তিন পেটি অফিসার আমাদের তিনজনের হাতকড়া খুলে, উলঙ্গ করে, টিকটিকির সামনে নিয়ে এল। বুকটা কাঠের পাটাতনে ঠেকিয়ে দুই ফঁক করে দুই পায়াতে মোটা: দড়ি দিয়ে বেঁধে, হাতদুটো পাটাতনের পাশ দিয়ে পেছন দিকে নিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর তিনজনে তিনটে চাবুক এনে আমাদের তিনজনের পেছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল।

হুকুম সুচারুরূপে পালন করা হয়েছে কি না নিরীক্ষণ করার। পর মাইকেল স্কট বলল, শালে এই তিন টেরোরিস্ট কাল জেলর সাহেবের কাছে আজাদির কথা বলেছিল। আজাদির টেস্ট কেমন লাগে ওদের সমঝিয়ে দে। পন্দ্র (পনেরো) চাবুক।

কেন আমাদের টিকটিকিতে চড়ানো হয়েছে, এবার তার। কারণটা স্পষ্ট হয়ে গেল। চোখ বুজে পেশিগুলো পাথরের মতো। শক্ত করে রইলাম।

একটু পর খোলা পিঠে চাবুকের ঘা পড়ল। আসলাম আমাকে সজুত করে নিয়েছে। আঘাতটা তেমন জোড়াল মনে হল না। তবু বুঝতে পারলাম চামড়া কেটে গেছে। মুখটা টিকিটিকির ওপর চেপে রয়েছে এমনভাবে যে রাজনাথ আর মুকুন্দকে দেখতে পাচ্ছি না। সাঁই সাঁই আওয়াজে টের পাওয়া যাচ্ছে ওদের পিঠেও চাবুকের পর চাবুক পড়ছে। এর আগে কনফেশন আদায়ের জন্য আলিপুরে, দমদমে বা মেদিনীপুরের জেলে আমাদের ওপর কম নির্যাতন চালানো হয়নি। কিন্তু আমাদের মুখ দিয়ে টু শব্দটি বেরয়নি৷ সেটা যেন ইংরেজের কাছে এক ধরনের পরাজয়।সেলুলার জেলেও মুখ বুজে রইলাম৷

পনেরো ঘা চাবুকের হুকুম ছিল কিন্তু দশ পর্যন্ত গুনতে পেরেছি। তারপর চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। যখন জ্ঞান ফিরল দেখি একটা বেডে শুয়ে আছি। পাশাপাশি আরও দুটো বেডে রাজনাথ আর মুকুন্দ। তাদের তখনও জ্ঞান ফেরেনি। আমাদের তিনজনেরই বুকে পিঠে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা। পরে জানলাম ব্রিটিশ আমলে জেলখানার ভেতর একটা ছোট হাসপাতাল ছিল। চাবুক মারার পর রক্তাক্ত, বেহুশ হয়ে পড়লে আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।

দিন-চারেক বাদে আমাকে আবার আমার সেলে ফিরিয়ে আনা হয়। আমার পিঠের ঘা তখন শুকিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস বৈজু একটা চৌ-আনি ঘুষ দিয়েছিল আসলাম খানকে, তাই চাবুকটা তেমন জোরে হাঁকায়নি। কিন্তু রাজনাথ আর মুকুন্দ ফিরেছিল দশ-বারো দিন পর। ওদের ঘা শুকোতে আরও অনেকটা সময় লেগেছিল। এই কদিন ওদের তিনবেলার বরাদ্দ খাবার সেলেই দিয়ে যেত পেটি অফিসার, কী টিল্ডালরা।

ঘা পুরোপুরি শুকিয়ে এলে অন্য কয়েদিদের মতো আমাদেরও ডিউটিতে জুড়ে দেওয়া হল। প্রথম দিকে বৈজুদের মতো নারকেল ছোবড়া পিটিয়ে সরু সরু তার বের করার কাজ। দিনে দুসের। সকালে কাঞ্জি খেয়ে ছোবড়ার বস্তা নিয়ে আমরা তিন বিপ্লবী কাঁধে ছোবড়ার বস্তা, হাতে মুগুর নিয়ে যে যার কুঠুরির সামনে বসে গেলাম। অন্য কয়েদিরা তো চারপাশে রয়েইছে।

শক্ত ছোবড়ায় ঘা দিতেই প্রথম দিকে মুগুর ঠিকরে ঠিকরে উঠছে। ছোবড়া যেমনকে তেমন। বিকেল বেলায় দুসের তার কী করে বের করব জানি না। তখন আবার কী ধরনের জুলুম চালানো হবে, কে জানে।

আধ ঘণ্টা মুগুর চালাবার পর যে তার বের করতে পারলাম তার ওজন আধপোয়াও হবে না। গল গল করে ঘাম বেরিয়ে জেলের উর্দি ভিজে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় হাত যেন কাঁধ থেকে খসে পড়বে। কপালের দুপাশের শিরাগুলো দপ দপ করছে।

এদিকে পেটি অফিসার, টিন্ডাল আর ওয়ার্ডাররা মাঝে মাঝে এসে কয়েদিদের ডিপটি (ডিউটি) তদারক করে যাচ্ছে।

বৈজু আমার কাছাকাছি বসে ছোবড়া পিটছিল। চার বছর সে এই জেলে আছে। ছোবড়া থেকে তার বের করাটা তার কাছে জলভাত। হঠাৎ তার নজর এসে পড়ল আমার দিকে। আমার সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে আঁচ করে নিয়ে চাপা গলায় বলল, ফিকর মাত্ কর ভাইসাব। তোমার খানার আধা হিস্যা নিচ্ছি। তোমার দিকটা তো দেখতে হবে। সে হাত বাড়িয়ে আমার পাশে যে ছোবড়া পাকার হয়ে আছে, তা থেকে অনেকগুলো টেনে নিয়ে বলতে লাগল, রোজ তোমার জন্যে এক সের তার বের করে দেব। বাকিটা তুমি করবে।

বৈজু অকৃতজ্ঞ নয়। কিন্তু ভেবে অবাক হচ্ছিলাম, লোকটার গায়ে কী দানবিক শক্তিই না রয়েছে। নিজের দুসের তার বের করার সঙ্গে সঙ্গে আমার জন্য এক সের বের করে দেবে! সেদিন থেকে এটাই চালু হয়ে গেল।

আমার ডিউটি অর্ধেক হালকা হয়ে গেছে। কিন্তু সূর্যাস্তের আগে এক সের তার তো বের করতে হবে। সেটাও আমার বেঁচে থাকাটা বরবাদ করে ছাড়বে। আমি ফের মুগুর চালাতে শুরু করলাম।

হঠাৎ তীক্ষ্ণ, ক্রুদ্ধ চিৎকারে সামনের দিকে তাকাই। অলিন্দের মাঝামাঝি জায়গায় নিজের কুঠরির সামনে ছোবড়ার বস্তা এনে রাজনাথকে বসতে দেখেছিলাম। তারপর নিজের ছোবড়া নিয়ে প্রায় অন্ধকার দেখছিলাম। অন্য কোনও দিকে লক্ষ ছিল না।

আমাদের এই দোতলায় মোট তিনটে পেটি অফিসার। দুজন পাঠান, একজন জাঠ। আসলাম খান, মোবারক খান আর ধর্মা সিং। ধর্মা রাজনাথের সামনে দাঁড়িয়ে সেকেন্ডে মুখ থেকে বারো চোদ্দোটা করে কুৎসিত খিস্তি দিয়ে যাচ্ছে। –শালে কুত্তেকে বচ্চে কালাপানিতে তোকে আরাম করার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছে। বল্লা (মুগুর) উঠাকে লে। সামকো দো সের তার না পেলে তোর হাড়ি টিলা করে ছাড়ব।

লক্ষ করলাম, কোলে হাত রেখে নির্বিকার থেবড়ে বসে আছে রাজনাথ। এমনিতে তার মেজাজ খুব চড়া। আত্মসম্মানে এতটুকু ঘা লাগলে সে ফুঁসে ওঠে। কিন্তু এখন সে যেন সারা গায়ে পুরু এঁটে রয়েছে। বাপ-মা চোদ্দোপুরুষ তুলে ধৰ্মা সিং যে গালাগালের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে তা যেন শুনতেই পাচ্ছে না। খিস্তিগুলো তার গায়ে লেগে যেন ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ধর্মা সিং যতই বলে বল্লা (মুগুর) উঠা– সে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলে, না।

অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর যখন কাজ হল না, ধর্মা সিং দৌড়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। কয়েক মিনিট বাদে পুলিশ অফিসার মাইকেল স্কটকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। তাকে নিশ্চয়ই রাজনাথের বিরুদ্ধে নালিশ জানানো হয়েছিল। রাগে তার লালচে মুখ আগুনের মতো গন গন করছে। রাজনাথের দিকে আঙুল বাড়িয়ে সে গজরে উঠল, হারামি, ডিউটি দিচ্ছিস না কেন? পিক আপুদা ক্লাব–রাজনাথ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।–নেভার? একজন কালাপানি খাটতে আসা কয়েদির এতটা দুঃসাহস হতে পারে, বুঝিবা কল্পনা করতে পারেনি মাইকেল স্কট। তার আগুনের গোলার মতো চোখ দুটো স্থির হয়ে যায়। হিন্দুস্থানিতে জিজ্ঞেস করে, মতলব?

রাজনাথ বলল, আমি ছোবড়া পিটব না। আমরা অর্ডিনারি কয়েদি নই; পলিটিক্যাল প্রিজনার।

দাঁতে দাঁত চেপে মাইকেল স্কট বলল, একবার টিকটিকিতে আবার চড়ার ইচ্ছা আছে?

রাজনাথ বলল, একবার কেন, আমরা আন-আর্মড প্রিজনার, দশবার চড়াতে পার, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পার, কিন্তু নারকেল ছোবড়া থেকে তার বের করাতে পারবে না।

আমিও বলতে যাচ্ছিলাম, আমরা অর্ডিনারি কয়েদি নই, পেট্রিয়ট– কিন্তু বৈজু ত্রস্তভাবে হাত বাড়িয়ে আমার মুখ চেপে ধরল, কিছুতেই বলতে দিল না। আমার ওপর তার বোধহয় বেশ মায়া পড়ে গিয়েছিল। আমি যদি রাজনাথের মতো রুখে দাঁড়াই, মাইকেল স্কটের রোষ এসে পড়বে আমার ওপরেও। সেটা বৈজু চায় না।

ওদিকে রাজনাথের স্পর্ধায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে মাইকেল স্কট। সে অলিন্দের মেঝেতে প্রচণ্ড শব্দে বুট ঠুকতে ঠুকতে হুমকির পর হুমকি দিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু রাজনাথকে টলানো গেল না। এমন একজন ঠেটা বেয়াদব কয়েদিকে নিয়ে কী করবে, সে বুঝে উঠতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত পেটি অফিসার ধর্মা সিংকে বলল, এ শালেকো কুঠুরিতে ঘুসিয়ে তালা লাগাও। আজ ইসকো দুপহরকা খানা বন্ধ–

রাজনাথকে সেলে পুরে ফেলা হল। বুঝতে পারালাম, সেলুলার জেলে বেয়াড়া কয়েদিদের চিট করার জন্যে যতরকম মোক্ষম মুষ্টিযোগ আছে তার মধ্যে একটা হল খানা বন্ধ, অর্থাৎ খেতে না দিয়ে উপোস করিয়ে রাখা।

কিন্তু রাজনাথ অন্য ধাতুতে তৈরি। সেদিন দুপুরে কেন, রাতেও তাকে খাবার দেওয়া হল না। শুধু সেদিনই নয়, পর পর তিন দিন। তাতেও তাকে শায়েস্তা করা সম্ভব হল না। কিছুতেই সে ছোবড়া পিটিয়ে তার বের করবে না। অগত্যা তাকে পোর্ট ব্লেয়ারের কাছে ছোট ভাইপার আইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেও জেলখানা, ফাঁসিঘর আছে। অনেক পরে জেনেছিলাম, রাজনাথ ওখানে সলিটারি সেলে থেকে থেকে পাগল হয়ে যায়।

যাই হোক, দুতিন মাস ছোবড়া পেটানোর পর মুকুন্দ আর আমাকে চত্বরের একধারে যে ঘানিঘরের শেড রয়েছে, সেখানে ডিউটি দেওয়া হয়। হাতে ঘানি ঘুরিয়ে রোজ পনেরো সের তেল বের করতে হবে। দিনের শেষে সেই তেল মেপে নেবে মাইকেল স্কট। বৈজু খাবাবের বখরার জন্য আমার সঙ্গ ছাড়ছিল না। পেটি অফিসার আসলাম খানকে নগদ আট আনা ঘুষ দিয়ে ছোবড়া পেটানোর ডিউটি ছেড়ে ঘানি টানার ডিউটি নিয়েছিল। স্বীকার না করলে বেইমানি হবে, তাই বলছি, আমার অর্ধেক তেল সে-ই ঘানি টেনে বের করে দিত।

ঘানিঘরে এসে অন্য কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তারা হলেন ঢাকার ব্রজ চক্রবর্তী, ময়মনসিংয়ের রাখাল দত্ত, মেদিনীপুরের চিত্তরঞ্জন পাল এবং আরও চার পাঁচজন। এঁরা সবাই আমার আর মুকুন্দর চেয়ে বয়সে বড়। তাদের আমরা দাদা বলতাম। ওঁরা থাকতেন চার আর পাঁচ নম্বর ব্লকে। ব্রজদা ছিলেন খুবই মজাদার মানুষ। হাসিখুশি। প্রথম দিন আলাপ পরিচয়ের পর জিগ্যেস করলেন, আন্দামানের জেলে কতদিন কাঞ্জি নামে উপাদেয় লাপসি ভক্ষণ করছ? অর্থাৎ আমরা এখানে কতকাল আছি সেটাই তার জিজ্ঞাস্য। কেননা পাশাপাশি ব্লকে থাকলেও ঘানিঘরে ঢোকার আগে কারও সঙ্গে কারও দেখা হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সেলুলার জেলে পা দিয়েই শুনেছিলাম, আরও কয়েকজন কয়েদি এখানে আছেন। খুব সম্ভব খবরটা বৈজুই দিয়েছিল। ব্রজদাকে বললাম, কয়েক মাস খাচ্ছি। আপনারা? ব্রজদা বললেন, তিন বছর। তা এখানে কেমন লাগছে? আমার মুখে একটু হাসি ফুটেছিল। তাতেই উত্তরটা ছিল। ব্রজদা আমাকে চাঙ্গা করার জন্য বললেন, মোটেও মন খারাপ করবে না। ভাববে এটাই স্বর্গ সুখ।

রবিবার আমাদের ঘানি ঘোরাতে হত না। তবে সব কয়েদিকে চত্বরের কল থেকে বালতি বালতি জল টেনে এনে ব্লকের সেল, অলিন্দ ধুয়েমুছে ঝকঝকে তকতকে করে রাখতে হত। কোনও কোনও রবিবার জেলার কি জেল-সুপারিনটেনডেন্ট হঠাৎ হঠাৎ ইন্সপেকশনে আসতেন। সেজন্য এই ব্যবস্থা।

রবিবার বিকেলের দিকটা ছুটি। অন্য দিন ডিউটির সময়টা ঘানিঘরে কাটত, বাকি সময় সেলে। কিন্তু রবিবার বিকেলে কুঠুরিতে বন্দি থাকতে হত না। বিপ্লবীদের যার যার ফ্লোরের অলিন্দে ঘোরাঘুরির পারমিশন ছিল; কিন্তু তার বাইরে যাবার হুকুম ছিল না। তবে সাধারণ কয়েদিদের বেলায় কোনও বাধা নেই। তারা চত্বরে নেমে গিয়ে আড্ডা জমাত।

জেলখানার একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনে একবার অদ্ভুত দুটো বই হাতে এসেছিল৷ আলির সঙ্গে হনুমানের লড়াই আর সোনাভান বিবির কেচ্ছা। বাজে নিউজপ্রিন্টে ছাপা, এক বিঘত, মাপের চটি বুকলেট। কারা দিয়েছিল, কীভাবে জেলে এসেছিল, মনে নেই। আলির সঙ্গে হনুমানের যুদ্ধ-এ কে শ্রেষ্ঠ তা প্রমাণ করার চেষ্টা ছিল। আমি অবাক হয়ে গেছি।

এক ছুটির বিকেলে আমাদের দোতলার অলিন্দে রেলিংয়ে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পাশে বৈজু। হঠাৎ চোখে পড়ল এক শা-জোয়ান মুসলমান কয়েদি এবং এক হিন্দু কয়েদি কুস্তির তোড়জোড় করছে। দুজনকে ঘিরে অন্য কয়েদিরা গোলাকার সার্কল তৈরি করে বসে আছে। তাদের চোখেমুখে তীব্র উত্তেজনা।

সেলুলার জেলে আসা ইস্তক এমন বিচিত্র ঘটনা আগে আর চোখে পড়েনি। কী কারণে এই মল্লযুদ্ধ? দেখলাম বৈজু তা জানে। সে মুসলমান এবং হিন্দু দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েদিকে দেখিয়ে বলল, ওর নাম লিয়াকত আর ও হল ধনিরাম। ওদের মধ্যে বাজি দি হয়েছে। কী বাজি, না যে লড়াইয়ে জিতবে তাকে অন্যের ধর্ম নিতে হবে।

এমন উদ্ভট, আজগুবি পণের ব্যাপার আমার চোদ্দো পুরুষে কেউ কোনও দিন শোনেনি। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না।

ওদিকে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল। একে অন্যের মাথায় মাথা ঠেকিয়ে প্রবল মুষ্ঠিতে একে অন্যের হাত ধরে, হাঁটুতে শরীরের সবটুকু শক্তি জড়ো করে ঠেলছে। কেউ তিন পা পিছোচ্ছে, কেউ পাঁচ পা। এইভাবে ভিড়ের দিকে চলে যাচ্ছে। তারপর আবার ঠেলাঠেলি করতে করতে সার্কেলের মাঝখানে চলে আসছে। ঘামে দুজনেরই উর্দি ভিজে উঠেছে। কিন্তু কেউ হটতে রাজি নয়। দুজনেরই মরণপণ প্রতিজ্ঞা কোনওভাবেই হারবে না। প্রাণ গেলেও ওই যুদ্ধ জিততেই হবে।

চারপাশের দর্শকরা সমানে উন্মাদের মতো চিৎকার করে দুজনকেই উৎসাহ দিয়ে চলেছে। আমার চোখের পাতা পড়ছিল না। শেষ পর্যন্ত কী হত, জানি না। আচমকা এমন এক লড়াইয়ের খবর পেয়ে চত্বর কাঁপিয়ে দৌড়তে দৌড়তে পুলিশ অফিসার মাইকেল স্কট এসে হাজির। তাঁর পেছন পেছন এক দঙ্গল রাইফেলধারী পুলিশ।

ইংরেজি সিনেমার বুল ফাইটের দৃশ্যে যে ষাঁড়দের দেখা যায় তাদের মতোই অসীম শক্তি লোকটার শরীরে। চিৎকার করে ইংরেজি আর হিন্দিতে কিস্তি দিতে দিতে যারা থেবড়ে বসে লড়াই দেখছিল তাদের ভেদ করে মঞ্চে ঢুকে পড়ল।—হারামি, সন্স অফ বিচ- আওড়াতে আওড়াতে লিয়াকত আর ধনিরামের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুজনেরই চুলের গোছা ধরে ধাক্কা মারতে মারতে দুধারে সরিয়ে দিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলতে লাগল, গায়ে খুব তাকত হয়েছে? সেলুলার জেলের স্পেশাল পেনাল কোডে এই ধরনের অপরাধের শাস্তি কী হতে পারে, হয়তো লেখা নেই। তাই বলল, ফির এমন দেখলে ডান্ডাবেড়ি আর সাতরোজ খানা বন্ধু।

সেলুলার জেলে হরেক রকম নিগ্রহের নিখুঁত বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু খানা বন্ধ-এর চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই। সেটাই আপাতত প্রয়োগ করার ভয় দেখাল মাইকেল স্কট।

অন্য কয়েদি যারা অনন্ত কৌতূহল নিয়ে লড়াই দেখছিল, মাইকেল স্কট এসে পড়ায় যে যেদিকে পারে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল। ধনিরাম আর লিয়াকতও দাঁড়িয়ে থাকল না। একজন পালাল চার নম্বর ব্লকের দিকে। আরেকজন ঘানিঘরের পেছন দিকে। দুজনের ধর্মই রক্ষা হল।

পরের রবিবার দেখতে পেলাম ধনিরাম আর লিয়াকত পাশাপাশি বসে খুব গল্প করছে আর কী এক মজার কথায় একজন আরেক জনের গায়ে হেসে হেসে ঢলে পড়ছে। বিচিত্র এই সেলুলার জেল।

কত রকম কয়েদি যে দেখেছি তার লেখাজোখা নেই। তখন বার্মা ছিল ইন্ডিয়ার একটা প্রভিন্স। সেই সময়ের অখণ্ড বাংলাদেশে যত বাঙালি ছিল তার চারভাগের একভাগ বার্মায়। সেখান থেকে বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ কয়েদি আসত কালাপানিতে।

এক বর্মি কয়েদিকে দেখেছি ঘানিটানা, রাস্তার পাথর ভাঙা বা ছোবড়া পেটার ভয়ে সেলের ভেতর উলঙ্গ হয়ে সারা গায়ে কাঞ্জি মেখে বসে থাকত। যেন বদ্ধ পাগল। আরেকজন, কোন। প্রভিন্সের মনে নেই গায়ে বিষ্ঠা মেখে থাকত। দুর্গন্ধে টেকা দায়। এই ধরনের সেয়ানা পাগলরা কিন্তু কাজের কাজটি গুছিয়ে নিতে পারত। জেল অথরিটিকে ধোঁকা দিয়ে ডিউটি মকুব করিয়ে নেওয়ার ফন্দিটা তারা ভালোই বের করেছিল।

আরেক রবিবারের কথা মনে পড়ে। মুকুন্দ আর আমি বিকেল বেলায় অলিন্দে ঘুরছিলাম। আন্দামান নিকোবর ম্যানুয়েল অনুযায়ী এখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে পুরো পঁচিশ বছর কাটাতে হয়। সেই দণ্ডাদেশ দিয়েই আমাদের এখানে পাঠানো হয়েছে। তাই নিয়েই দুজনে কথা বলছিলাম। বৈজু ছুটির দিনের বিকেলটা আমার সঙ্গে কাটায়। আজ সে নেই। নিচের চত্বরে অন্য কয়েদিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেছে। ওপরের অলিন্দ থেকে তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

হঠাৎ নিচে হইচই শোনা গেল। কয়েদিদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। মুকুন্দ আর আমি অলিন্দের ধারে-রেলিংয়ের কাছে চলে এলাম। চোখে পড়ল, একটা কয়েদিকে কোমরে শিকল এবং হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে চত্বরের বাঁদিক থেকে ডাইনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার সামনে মাইকেল স্কট। পেছনে জনা ছয়েক রাইফেলধারী পুলিশ। এদেরই একজন কয়েদিটার কোমরে বাঁধা শেকলের একটা প্রান্ত ধরে আছে।

আন্দামানে আসার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এর ভেতর বহু কয়েদিকে চিনে গেছি। তাদের সঙ্গে আলাপসালাপও হয়েছে। কিন্তু এই কয়েদিটাকে আগে আর কখনও দেখিনি। এই ছুটির দিনে কেন, তাকে এভাবে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কী তার অপরাধ, কিছুই বুঝতে পারছি না। অবশ্য এই সৃষ্টিছাড়া জেলখানায় নিয়মকানুনই আলাদা। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই ডান্ডাবেড়ি, খানা বন্ধ ইত্যাদি।

আমরা অবাক, তাকিয়ে আছি। ওই কয়েদিটা ইন্ডিয়ার কোন প্রভিন্সের লোক বোঝা যাচ্ছে না। দাড়িটারি দেখে পাঠান এবং শিখদের চেনা যায়। এর গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকলেও সে শিখ বা পাঠান কোনওটাই নয়। বর্মিও না। তাদের মঙ্গোলিয়ান চেহারা। সে যেই হোক, মনটা খারাপ হয়ে গেল। শেকল হাতকড়া পরিয়ে যখন আনা হয়েছে তখন মাইকেল স্কট এর কী হাল করে ছাড়বে ভাবতেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।

অন্য কয়েদি যারা আমাদের অচেনা কয়েদিটাকে দেখে শোরগোল বাঁধিয়ে দিয়েছিল আচমকা তাদের জটলা থেকে বৈজু দৌড়ে আমাদের ব্লকের দিকে আসছে। কোনও চাঞ্চল্যকর খবর থাকলে বৈজু আমাকে জানাবেই জানাবে। তার মুখে সেলুলার জেল সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। নিশ্চয়ই সে আমাদের কাছে আসছে। আমরা উগ্রীব হয়ে রইলাম।

একটু পরেই হাফাতে হাফাতে উঠে এল বৈজু। প্রবল উত্তেজনার সুরে বলল, ভাইসাব, লছমন ধরা পড়েছে। আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম। ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ডে কেউ মারাত্মক ক্রাইম করে ধরা পড়লে এবং কঠোরতম সাজা হলে তবেই তাকে আন্দামানে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এখানে আবার ধরা পড়বে কী? ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। বৈজুকে জিগ্যেস করতে সে জটটা ছাড়িয়ে দিল। লছমন উত্তর প্রদেশের লোক। ইলাহাবাদের কাছে তার বাড়ি। ছবছর আগে দু দুটো খুন করে যাবজ্জীবন কালাপানির সাজা খাটতে সে আন্দামানে এসেছিল। প্রথমদিকে বেশ শান্তশিষ্ট ছিল সুবোধ বালকের মতো জেলখানার যাবতীয় নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলত। গোড়ায় গোড়ায় তাকে অন্য কয়েদিদের মতো ছোবড়া পিটে তার বের করতে বা ঘানি ঘুরিয়ে নারকেল তেল বের করতে হত। মুখ বুজে সে তাই করে যেত। বছর চারেক পর লছমনকে ফরিস (ফরেস্ট) ডিপার্টমেন্টে ডিপটি (ডিউটি) দেওয়া হয়। সকালে তাকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হত। সন্ধের আগে আগে জেলখানায় ফিরিয়ে আনা হত। পরে জঙ্গলেই বনবিভাগের সরকারি কর্মীদের সঙ্গে থাকত। অবশ্য তার মতো আরও কয়েকজন কয়েদিও আগে থেকে সেখানে ছিল। যারা জেলারের আস্থাভাজন, তিনি মনে করেন এরা কোনও গোলমাল পাকাবে না, তাদের জেলের বাইরে নানা ধরনের ডিউটি দিয়ে ব্যারাক বা তাবু খাটিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা ইত। আসল ব্যাপারটা হল, বর্মা থেকে নর্থওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স পর্যন্ত বিশাল দেশ থেকে তিন চার মাস পর পর জাহাজ ২ বোঝাই কয়েদিরা আন্দামানে আসত। সেলুলার জেলে এত কয়েদির থাকার মতো কুঠুরি কোথায়? তাদের জন্য তাহলে নতুন নতুন জেলখানা বানাতে হয়। যাই হোক, জঙ্গলে লছমন এবং অনেক কয়েদিকে বিরাট বিরাট গাছ কাটার ডিপটি দেওয়া হয়েছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটা করত সে। মাসছয়েক ঠিকঠাক চলছিল। তারপর আচমকা একদিন সে উধাও হয়ে যায়। জেলার সাহেব লছমনকে ভাগোয়া (পলাতক) কয়েদি হিসেবে ঘোষণা করেন। চারদিকে তোলপাড়। পুরো দক্ষিণ আন্দামানের কোণে কোণে লছমনের খোঁজ চলতে থাকে। কিন্তু সে বিলকুল বেপাত্তা। মাসের পর মাস কাটতে থাকে। সবাই আসা ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু জেলার সাহেব ভীষণ জেদি। একজন কয়েদি তাঁর হেফাজত থেকে পালিয়েছে, এটা একটা বে-ইজ্জতির ব্যাপার। পুলিশের ওপর চাপ বাড়তে লাগল, যেমন করে পার, যেখান থেকে পার লছমনকে ধরে আনো।

এক নিশ্বাসে সব জানিয়ে জোরে জোরে বারকয়েক শ্বাস টানল বৈজু। তারপর ফের শুরু করল, কাল ভাগোয়া (পলাতক) লছমনকে মিডল আন্দামান থেকে পুলিশ পাকড়ে এনেছে। রুদ্ধশ্বাসে মুকুন্দ আর আমি শুনে যাচ্ছিলাম। জিগ্যেস করলাম, এতদিন সে কোথায় ছিল! কী খেয়েছে? বৈজু বলল, কোথায় আর থাকবে? জঙ্গলে জঙ্গলে কাটিয়ে দিয়েছে। ভাইসাব, আন্দামানে লাখো লাখো নারিয়েল পেঁড় নারকেল গাছ), সমুন্দরে লাখো লাখো মছলি। খানার কি অভাব? নায়িয়েল পেড়ে, মছলি মেরে খেয়েছে। জানতে চাইলাম, লছমন পালিয়েছিল কেন, কিছু শুনেছ? বৈজু ঘাড় কাত করে বলল, শুনা হয়। ও একটা লম্বা নারিয়েল পেড় খুদে খুঁদে নাও (নৌকো) বানিয়ে ফেলেছিল। সেটায় চড়ে সমুন্দর পাড়ি দিয়ে হিন্দুস্থানে ভেঙ্গে পড়ার মতলব করেছিল। সেই সময় ধরা পড়ে যায়। আভি মাইকেল সাব ওর জীনা (বেঁচে থাকা) বরবাদ করে দেবে। মুকুন্দ আর আমি একেবারে থ। বলে কী বৈজু! একটা নারকেল গাছের ডোঙায় চড়ে বদ্ধ উন্মাদ না হলে কেউ সীমাহীন বঙ্গোপসাগর, যেখানে সর্বক্ষণ চার পাঁচ মাইল এলাকা জুড়ে একেকটা পাহাড়প্রমাণ ঢেউ উঠছে, পাড়ি দেবার কথা ভাবতে পারে। পাড় থেকে সিকি মাইল যেতে না-যেতেই তো ডোঙা উলটে যাবে।

বৈজু এবার বলল, ভাইসাব, লছমনের মতো আরও কেউ কেউ নাও বানিয়ে ভাগার কোশিশ করেছে। জিগ্যেস করলাম, তাদের কী হাল হয়েছে? বৈজু বলল, পতা নেহি। তবে কী আর হবে? নাও ডুবে গিয়ে ওই কয়েদিরা বদমাশ মচ্ছির (হাঙর) পেটে গেছে। বিস্ময়কর ঘটনা বটে!

লছমনের মতো কয়েদিদের বিচিত্র রোমহর্ষক কাহিনি শুনে, লিয়াকত এবং ধনিরামের মতো কয়েদিদের আজব কাণ্ডকারখানা দেখে, সেলুলার জেলের পরম উপাদেয় কাঞ্জি খেয়ে, চামড়ার মতো শক্ত চাপাটি চিবিয়ে ছোবড়া পিটে, ঘানি ঘুরিয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল। কয়েদখানার আলুনি, বিস্বাদ, একঘেয়ে জীবন একমাত্র ব্রজদাই মাঝে মাঝে রঙ্গ-তামাশা করে মোটামুটি গ্রহণীয় করে তুলেছিলেন।

গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত ঋতুচক্রে সময় পাক খেয়ে যাচ্ছিল। আন্দামানে আসার পর আমাদের দুটো বছর পার হল। একদিন সকালে কাঞ্জি খেয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল বের করছি, বৈজুও আমার কাছাকাছি অন্য একটা ঘানি টানছে, মাঝে মাঝে এসে আমারটাও টেনে দিচ্ছে, হঠাৎ একজন জুনিয়র পুলিশ অফিসার, লোকটা ভারতীয়, ঘানিঘরে এসে হাজির। দুবছরে সব অফিসার, সব কনস্টেবলকে চিনে গেছি। এই অফিসারটিকেও চিনি। নাম, হরীন্দ্র সিং। ছফুট হাইটের তাগড়া চেহারা। সে আঙুল নাচিয়ে বৈজুকে বলল, মেরা সাথ আ।

বৈজুকে দুবছর দেখছি। কখনও কোনওরকম ঝঞ্ঝাট বাঁধায়নি। জেলের আইনশৃঙ্খলা ভাঙেনি। আচমকা কেন তাকে তলব করা হল তার তলকূল পাচ্ছি না। রীতিমতো ঘাবড়েই গেলাম। অফিসারটাকে যে জিগ্যেস করব তেমন সাহস হচ্ছিল ন। লোকটা মহা বদমেজাজি। যে কজন অফিসার কয়েদিদের ওপর চরম নির্যাতন চালাতে পটু সে তাদের একজন। বিপ্লব মন্ত্রে– দীক্ষা নেবার পর লক্ষ করেছি, ভারতীয় পুলিশ অফিসাররা ব্রিটিশ অফিসারদের চেয়ে এতটুকু কম অত্যাচার চালায় না। বরং কোনও কোনও সময় ইংরেজদের ছাড়িয়েও যায়। প্রভুভক্ত এই কুকুরেরা তার বদলে পায় দু-চার টুকরো মাংস। কিছু ইনাম, এক আধটা প্রোমোশন, রিটায়ারমেন্টের পর কারও কারও বরাতে খেতাব জুটে যায়।

বৈজুরা চলে গেল। আমাদের মন ভীষণ খারাপ। কিন্তু আধ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই লাফাতে লাফাতে ফিরে এল সে। চোখমুখ থেকে খুশি উপচে পড়ছে।

বৈজু দুহাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে একটানা বলতে লাগল, ভগোয়ানকা পাস যো মাঙ্গা ও মিল গিয়া। ঘানিঘরে যারা ছিল তাদের কাছে গিয়ে জনে জনে একই কথা বলছে সে। তার গলার স্বরে কী যে উত্তেজনা!

লোকটা কি পাগল হয়ে গেল। জিগ্যেস করলাম, ভগবানের কাছে কী চেয়েছ? বৈজু বলল, শাদিকা টিকট। মানে বিয়ের টিকিট। আমি অবাক তাকিয়ে থাকি। জিগ্যেস করি, সেটা কী জিনিস।বৈজু একটুকরো চৌকো পেতলের পাত দেখাল। তাতে খোদাই করা রয়েছে: ম্যারেজ সার্টিফিকেট। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমি অবাক তাকিয়ে থাকি। এবার বৈজু বুঝিয়ে বলল, সেলুলার জেলে ছবছর নিয়মশৃঙ্খলা মেনে শান্তশিষ্ট হয়ে থাকলে বিয়ের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। জেলের কর্তারা সেই বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে কারওকে আর সেলুলার জেলের কুঠুরিতে থাকতে হয় না। সে তখন বিয়াহি আওরতকে (বিবাহিত স্ত্রী) নিয়ে শাদিপুরে চলে যায়। যারই বিয়ে হোক তাকে সেখানে যেতে হয়। শাদিপুর পোর্টব্লেয়ারের একটা মহল্লা। বিবাহিতদের আর জেলের ঘানি ঘোরাতে বা ছোবড়া পিটতে হয় না। জেলের বাইরে তাদের নানা রকম সরকারি কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেজন্য তলব (মাইনে) মেলে। সেই টাকায় নিজের নিজের সংসার চালাতে হয়।

আমার বিস্ময় শতগুণ বেড়ে যায়। জানতে চাই, শাদি যে করবে, মেয়ে পাবে কোথায়? বৈজু বলল, এখানে জেনানা ফাটক আছে না? আংরেজরা সেটাকে বলে সাউথ পয়েন (পয়েন্ট) জেল। কয়েদিরা বলে রেন্ডিবারিক জেল।

পোর্ট ব্লেয়ারে আসার পর সাউথ পয়েন্ট জেলের কথা ভাসা ভাসা শুনেছিলাম। কিন্তু সেটা কোথায় এবং কারা সেখানে থাকে, কিছুই জানতাম না। বৈজু বলতে লাগল, তামাম হিন্দুস্থান পর বর্মা মুল্লুক থেকে স্রিফ মরদ কয়েদিরা আসে না। দো-চারঠো খুন করেছে এমন জেনানা কয়েদিরাও কালাপানির সাজা খাটতে আসে। মরদদের বেলায় ছে (ছয়) সাল আর আওরত বেলায় দো সাল। দো সাল যদি তারা ঠিকঠাক থাকে, শাদির টিকট পায়।

জিগ্যেস করলাম, সাউথ পয়েন্ট জেলটা ঠিক কোন জায়গায়? বৈজু বুঝিয়ে দিল সিসোস্ট্রেস উপসাগরের এক মাথায় পাহাড়ের মাথায় সেলুলার জেল, আর উপসাগর যেখানে ডান দিকে অনেকটা এগিয়ে ঘুরে ডান পাশে গেছে সেই বাঁকের মুখে সাউথ পয়েন্ট জেল।

পরের দিনই সেই পুলিশ অফিসার হরীন্দর সিং এবং দুজন আর্মড পুলিশ এসে বৈজুকে নিয়ে গেল। আর সে সেলুলার জেলে ফিরে আসেনি। বহু বছর বাদে, স্বাধীনতার পর আবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কীভাবে তার বিয়ে হয়েছে সেদিন জানতে পারলাম। কিন্তু তা অন্য কাহিনি।

***

পুরনো দিনের স্মৃতির ভেতর ডুবে গেলেও সময় সম্পর্কে পুরোপুরি খেয়াল থাকে শেখরনাথের। বিনয় লক্ষ করেছে দুপুর হলে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। আজও তেমনটাই দেখা গেল। মুখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেল। এবারডিন মার্কেট থেকে দুপুরে খাবার কিনে হাসপাতালে ফিরতে হবে। মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে।

বিনয় উত্তর দিল না। সে যেন আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে। শেখরনাথের বলার ভঙ্গিটা এমন চমৎকার যে পরাধীন আমলের সেলুলার জেলের নানা বিচিত্র ঘটনা, আজব সব কয়েদি, পুলিশ অফিসার, আর্মড গার্ডরা ছবির মতো চোখের সামনে ফুটে উঠছিল। প্রাক্তন বিপ্লবীর বর্ণনার গুণে সব যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে।

কিন্তু সকলকে ছাপিয়ে বৈজুই বার বার চোখের সামনে এসে পড়ছে। হঠাৎ মনে পড়ল, কিছুদিন আগে জেফ্রি পয়েন্টের উদ্বাস্তু কলোনির সৃষ্টিধরের গর্ভবতী বউকে প্রসব করানোর জন্য দাই। জোগাড় করতে শেখরনাথের সঙ্গে অনেকটা দূরের আরেকটা রিফিউজি কলোনিতে গিয়েছিল বিনয়। সেই কলোনিটার গা ঘেঁষে রয়েছে ব্রিটিশদের বসানো পেনাল সেটলমেন্ট। সেখানে রঘুবীর সিং এবং তার বর্মি বউ মা পোয়ের পরিচয় হয়েছিল। তারাও জেল খাটতে আন্দামানে এসেছিল বহুকাল আগে। ম্যারেজ সার্টিফিকেট পেয়ে নিশ্চয়ই তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু আন্দামানের জেলে কোন পদ্ধতিতে ওদের বিয়ে হয়েছে, শোনা হয়নি। আজও শেখরনাথ বৈজুর বিয়ের ব্যাপারে খুঁটিনাটি কিছুই জানাননি। কেননা তিনি তখন সেলুলার জেলে, সেই সময় তার পক্ষে সব জানা সম্ভব ছিল না। পরে অবশ্যই জেনেছেন। কিন্তু দুপুর হয়ে যাওয়ায় তা বলা হয়নি।

বিনয় ঠিক করে ফেলল, শেখরনাথকে আর কিছু জিগ্যেস করবে না। মোহনবাঁশি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি তো শাদিপুরে বৈজুদের বাড়িতে যাচ্ছেনই। বিনয়কেও নিয়ে যাবেন বলেছেন। যারা নিজেরা বিয়ে করেছে তাদের মুখ থেকে শোনা আর তৃতীয় পক্ষের কাছে শোনার মধ্যে প্রচুর তফাত। অনেক কিছু বাদ পড়ে যায়। বিনয় বৈজুদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত জেনে নেবে।

আন্দামানে ব্রিটিশ আমলে পুরুষ এবং মেয়ে কয়েদিদের মধ্যে কীভাবে বিয়ে হত তা নিয়ে একটা চমকে দেবার মতো লেখা তৈরি করা যায়। তাতে নতুন ভারত-এর পাঠকরা নিশ্চয়ই খুশি হবে। বিস্ময়কর অজানা তথ্যগুলোকে গুছিয়ে গুছিয়ে গল্পের আকার দেওয়া দরকার।

লেখাটি বেরোলে নতুন ভারত সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাবে। শেখরনাথের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল বিনয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *