৩.০৪ চোখে ঘুমের ঘোর

চোখে ঘুমের ঘোর লেগে আছে। বিনয় প্রথমটা বুঝতে পারল না কান্নার আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। একটু খেয়াল করতেই সবটা স্পষ্ট হয়ে এল। এই বাংলোতেই কেউ কাঁদছে। কোনও বয়স্ক মেয়েমানুষ।

কাল রাতে সেলুলার জেলের হাসপাতাল থেকে মোহনবাঁশির স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা হয়েছিল। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর কান্না। এই সকালবেলায় কী এমন ঘটতে পারে যে সে কেঁদে চলেছে।

বিছানা থেকে বাইরে নেমে এল বিনয়। ভেতর দিকের দরজা খোলা রয়েছে। সেটা পেরিয়ে বিশাল ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল-এ আসতেই দেখা গেল মেঝের একধারে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে চলেছে মোহনবাশির বউ। তার গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে ছেলে-মেয়েরা। তারা অবশ্য কাঁদছে না। কেমন যেন জড়সড়, ভয়াতুর।

ওদিকে বিশ্বজিৎ এবং শেখরনাথও তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভুবন কার্তিক আর গোপালকেও দেখা যাচ্ছে।

বিনয় বিশ্বজিতের কাছে চলে এল। কৌতূহলের চেয়ে উৎকণ্ঠাই হচ্ছে তার বেশি। নিচু গলায় জিগ্যেস করল, কী হয়েছে, মহিলা এত কাঁদছে কেন? হাসপাতাল থেকে কোনও খারাপ খবর এসেছে?

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়লেন।–না তো

তাহলে?

কী জানি–।

বিশ্বজিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই শেখরনাথ মোহনবাঁশির স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। জানতে চাইলেন। কী হল তোমার? কেঁদো না, কেঁদো না।

কাঁপা কাঁপা হাতে মুখ থেকে শাড়ির আঁচল সরাল মোহনবাঁশির বউ। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, লাল, জলে ভর্তি। বোঝা যায় অনেকক্ষণ কাঁদছে সে।

শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, কান্নার কী হল?

ধরা ধরা, ভারী গলায় মোহনবাঁশির বউ বলল, আমার মনে জবর কু-ডাক ডাকতে আছে। সারা রাইত কাইল ঘুম হয় নাই। হ্যায় (সেটা) কি অহনও বাইচা রইছে?

তেমন কিছু হলে হাসপাতাল থেকে তোক চলে আসত। চিন্তা কোরো না। নরম, সহানুভূতির সুরে বললেন শেখরনাথ।

ব্যাকুলভাবে মোহনবাঁশির বউ বলল, আমাগো হাসপাতলে লইয়া চলেন

কিছুক্ষণ পরেই যাব। তোমরা চানটান করে খেয়ে নাও। আজ সারাদিন হাসপাতালেই থাকতে হবে।

.

ঘণ্টাখানেক বাদে মোহনবাঁশির বউছেলেমেয়ে এবং বিনয়কে নিয়ে একটা গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেন শেখরনাথ। বিশ্বজিতের পক্ষে এবেলা যাওয়া সম্ভব নয়। পুনর্বাসন দপ্তরের অনেকটা দায়িত্ব তার কাঁধে। তা ছাড়া তিনি একজন ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটও তার কোর্টে নানারকম মামলা লেগেই থাকে। আজ একটা জটিল কেসের শুনানি আছে। সেসব ঝক্কি সামলাতে সামলাতে তিনটে বেজে যাবে। তারপর আদালত থেকে সোজা হাসপাতালে যাবেন।

সাড়ে নটার মতো বাজে। দিনটা বেশ ঝলমলে। ভোরের দিকে যে কুয়াশা পড়েছিল তা কেটে গিয়ে উজ্জ্বল রোদে ভেসে যাচ্ছে শহর পোর্টব্লেয়ার। রোদটা খুব একটা তেজি নয়, বেশ আরামদায়ক। কোথাও ছিটেফোঁটা মেঘও নেই। পরিষ্কার, ঝকঝকে নীলাকাশ। উপকূলের কিনার ঘেঁষে অজস্র পাখি উড়ছে। সবই সি-গাল।

কোনও দিকে লক্ষ ছিল না বিনয়ের। চড়াই-উতরাই ভেঙে যতই গাড়িটা হাসপাতালের দিকে এগচ্ছে ততই উৎকণ্ঠার মাত্রাটা বেড়েই চলেছে। নিকোবর থেকে সেই দুই ডাক্তার কি ফিরে আসতে পেরেছেন? চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ কাল জানিয়েছিলেন, এঁরা না এলে মোহনবাঁশির অপারেশন করাটা খুবই কঠিন হয়ে উঠবে। হয়তো করা সম্ভবই হবে না। তখন কী হবে?

গাড়িটা সেলুলার জেলের প্রকাণ্ড গেট পার হয়ে সোজা হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল।

দোতলায় উঠতেই দেখা গেল, এর মধ্যেই বেশ ভিড় জমেছে। নতুন রোগী তো আছেই, পুরানো রোগীদের সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়ির লোকজনও হাজির।

লম্বা প্যাসেজে ভিজিটরদের জন্য যে সারি সারি বেঞ্চ পাতা রয়েছে সেখানে মোহনবাঁশির বউছেলেমেয়েদের বসিয়ে বিনয়কে সঙ্গে করে ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারে চলে এলেন শেখরনাথ।

ডাক্তার চট্টরাজ একাই রয়েছেন। কোনও পেশেন্টের এক্স-রে প্লেট খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। শেখরনাথদের বসার জন্য হাতের ইশারা করলেন।

প্লেটটা দেখা হলে সেটা টেবিলের একধারে নামিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, ভীষণ মুশকিল হয়ে গেল কাকা। তাকে বেশ চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে।

শেখরনাথ সামনের দিকে একটু ঝুঁকে জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার, নিকোবর থেকে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনরা কি এখনও আসেনি?

আস্তে মাথা নাড়লেন ডক্টর চট্টরাজ।

শেখরনাথের দুই চোখে উদ্বেগ ফুটে বেরয় জিগ্যেস করলেন, মোহনবাঁশির কন্ডিশন আজ কেমন? আরও ডেটারিওরেট করেছে?

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, মনে হয় না। তবে রাত্তিরে অনেক চেষ্টা করেও জ্ঞান ফেরানো যায়নি৷ আসলে ফুসফুস থেকে তিরটা বার করা দরকার। ওটা বেশিক্ষণ বিধে থাকলে বিপদ হবে।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

 তারপর ডাক্তার চট্টরাজই ফের শুরু করলেন, ইন্টার আইল্যান্ড শিপ সারভিসের যে জাহাজটা দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়ায় এখন সেটা নিকোবরে যাবার কথা নয়। কদিন আগে সুকুমার আর তাপস ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জাহাজে গিয়েছিল। আজ। সকালে সেই জাহাজেই তাদের ফেরার কথা। ঘড়ি দেখে বললেন, দশটা বেজে গেল! কেন জাহাজটা আসছে না, বুঝতে পারছি না।

যে বিপ্লবী একদিন অসীম দুঃসাহসে বন্দুক-রিভলবার হাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন, তার কাছে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে লেশমাত্র প্রভেদ ছিল না, একজন তুচ্ছ উদ্বাস্তুর জন্য তাকে এই মুহূর্তে ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছে। বললেন ধরা যাক, ওদের আসতে আরও দেরি হল, তখন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, না করে থেমে গেলেন।

ডাক্তার চট্টরাজ আগে থেকেই খুব সম্ভব সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। তখুনি উত্তর দিলেন, আর-এক ঘণ্টা দেখব। তারপর আমি একাই অপারেশনটা করব। হয়তো একটু রিস্ক নেওয়া হবে কিন্তু কিছু করার নেই।

বিনয় চুপচাপ বসে দুজনের কথা শুনছিল। লক্ষ করেছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে ডান পাশের জোড়া জানলার বাইরে বারবার তাকাচ্ছেন। দূরে, উতরাইয়ের নিচের দিকে সিসোস্ট্রেস বের এপারে একটা ছোট জেটি রয়েছে। একদিন এই জেটিতে নেমেই রস আইল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে মোটর বোট থেকে। ওখানে এসেই নেমেছিল সে। বনবিভাগের জাহাজ ওখানে এসে ভেড়ার কথা। কিন্তু না, জেটিটা একেবারে শুনশান। তিনটে লোক জেটির ওপর বসে বসে হাতপাখা নেড়ে গল্প করছে। খুব সম্ভব ওরা জাহাজ দপ্তরের খালাসি জাতীয় কর্মী। অলস সময়টা তারা এই ভাবেই খোশমেজাজে উড়িয়ে দিচ্ছে।

এগারোটা বাজতে যখন মিনিট কুড়ি বাকি, সেই সময় একজন। সিনিয়র ওটি নার্সকে ডাকিয়ে আনলেন ডাক্তার চট্টরাজ। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, সেই সময় দুই যুবক প্রায় উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে চেম্বারে এসে ঢুকল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এসেছে, তাই একটু পাচ্ছিল।

ডাক্তার চট্টরাজের কপাল কুঁচকে গেল।– কী ব্যপার, তোমাদের এত দেরি হল? খবর পাঠালাম একটা ক্রিটিকাল কেস এসেছে। ইমিডিয়েট অপারেশন করতে হবে। একটু দায়িত্ববোধ থাকা উচিত।

বিনয় আন্দাজ করে নিল, এই দুজন ডাক্তার চট্টরাজের সহকারী। কঁচমাচু মুখে তারা জানাল, বনবিভাগের জাহাজ ঠিক সময়েই নিকোবর থেকে রওনা হয়েছিল। কিন্তু সিসোস্ট্রেস বের জেটিতে না ভিড়ে অনেকটা ঘুরে চ্যাথাম জেটিতে চলে যায়। তারা বারবার বলেছিল, তাদের যেন সিসেষ্ট্রেস বেতে নামিয়ে দেয়। কিন্তু জাহাজে কনজারভেটর অব ফরেস্টস ব্রজদুলাল মণ্ডল ছিলেন। নিকোবরে একটা জরুরি কাজে তাকে যেতে হয়েছিল। এদিকে আজই পোর্টব্লেয়ারে বেলা দশটায় তাদের একটা কনফারেন্স আছে। চ্যাথাম হয়ে গেলে ঠিক সময়ে তার কনফারেন্সে পৌঁছাতে সুবিধা হয়। তাই সেসোস্ট্রেস বেতে ওদের জাহাজ থামেনি। যাদের জাহাজ তাদের মর্জিমতো তো চলতে হবে।

ডাক্তার চট্টরাজ ওদের যুক্তিটা মেনে নিলেন। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন না করে বললেন, অনেকটা পথ জাহাজে এসেছ কিন্তু এখন রেস্টের সময় নেই। ভেতরে গিয়ে তৈরি হয়ে নাও। পেশেন্টের নাম মোহনবাঁশি কর্মকার। তার ব্লাড, সুগার সব টেস্ট করা আছে। সিস্টার স্টেলার কাছে রিপোর্টগুলো আছে; দেখে নেবে। কেস হিস্ট্রিও লেখা আছে; পড়ে নিও। আমি এদিকের একটা কাজ সেরে আসছি।

দুই জুনিয়র ডাক্তার চলে গেল। ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, কাকা, অপারেশনের জন্যে মোহনবাঁশি কর্মকারের স্ত্রীর কনসেন্ট চাই। তাকে বন্ডে সই করতে হবে। লিখতে না জানলে তার টিপসই লাগবে।

শেখরনাথ অবাক। বললেন, তার কনসেন্ট লাগবে কেন?

এটা মারাত্মক ধরনের ক্রিটিকাল কেস। অপারেশনটা খুব ০১ ঝুঁকির ব্যাপার। পেশেন্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, এখানে স্ত্রী, তাকে। বন্ডে সই বা টিপসই দিতে হয়। এটাই নিয়ম। বলে একটু থামলেন ডাক্তার। তারপর ফের শুরু করলেন, মোহনবাঁশির স্ত্রী বন্ডে সই না করলে অপারেশন করা যাবে না।

তাহলে ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে।

হ্যাঁ।

একটু চিন্তা করে শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, তুমি ঝুঁকির কথা বললে। আমি ডাক্তার নই, তবু সেটা আন্দাজ করতে পারছি। জানতে চাইছি অপারেশন করলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, আমরা সব রকম প্রি-কশনারি ব্যবস্থা করেই অপারেশন করব। কিন্তু সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হল তিরটা যদি ফুসফুসের অনেকটা ভেতরে ঢুকে থাকে, আর সেটা খুলতে গিয়ে যদি রক্তপাত হয় অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম দেখা দেবে।

সেটা কী?

প্রচণ্ড শ্বাসজনিত কষ্ট। এমনকী শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ব্রিটিশ ভারতের প্রাক্তন বিপ্লবীটিকে বিচলিত দেখাল। তিনি বললেন, তার মানে তো মৃত্যু।

অস্পষ্টভাবে ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, হ্যাঁ। তারপর গলার স্বরটা পরিষ্কার করে নিলেন।–এই কথাগুলো পেশেন্টের স্ত্রীকে ভালো করে বোঝাতে হবে। তার রাজি হওয়া না-হওয়ার ওপর অপারেশন নির্ভর করছে।

তাকে বোঝাবে কে?

প্রাইমারি দায়িত্ব আমার। তবে আপনিও সঙ্গে থাকবেন। আন্দামানের সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করে, বিশ্বাস করে। বলে ঘড়ি দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ডাক্তার চট্টরাজ।-এগারোটা বেজে গেছে। আর দেরি করা যাবে না। মোহনবাঁশির স্ত্রীকে এখানে ডাকা দরকার। আমি লোক পাঠাচ্ছি।

না না, কারওকে পাঠাতে হবে না। আমি ওকে নিয়ে আসছি। শেখরনাথ উঠে পড়লেন। একটু পরে মোহনবাঁশির বউকে সঙ্গে করে ফিরে এলেন। ছেলেমেয়েগুলো সঙ্গে এসেছিল। তারা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, তোমার নাম কী? ডাক্তারের চেম্বারে তার ডাক পড়বে, ভাবতে পারেনি মেয়েমানুষটি। কেমন যেন হতচকিত সে। কোনওরকমে বলতে পারল, জোছছনা–

জ্যোৎস্না?

আস্তে মাথা নাড়ল শেখরনাথের বউ।

শেখরনাথ একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, বোসো

জ্যোৎস্না বসল না; শেখরনাথদের সামনে চেয়ারে বসতে তার সংকোচ হচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে জিগ্যেস করল, আমারে আনলেন ক্যান? মানুষটার কি কিছুহইচে? বাইচা আছে তো?

কিছু হয়নি। বেঁচে আছে। ডাক্তারবাবু তোমার সঙ্গে মোহনবাঁশির অপারেশনের ব্যাপারে কথা বলবেন। মন দিয়ে শোনো।

টেবিলের একটা কোন ধরে দাঁড়িয়ে রইল জ্যোৎস্না।

অপারেশন সম্পর্কে খানিক আগে ডাক্তার চট্টরাজ শেখরনাথকে যা যা বলেছিলেন, সে সব জানিয়ে দিলেন। জ্যোৎস্নাকে।

কিছুক্ষণ বিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইল জ্যোৎস্না। তারপর শেখরনাথের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। সারা শরীর তার কাঁপছে। ভাঙা। ভাঙা ভয়ার্ত সুরে সে বলল, কাটান ছিড়ান (কাটাছেঁড়া অর্থাৎ অপারেশন) কইরাও যদিন হেরে (তাকে) বাঁচান না যায়, হেইটা। (সেটা) কইরা কী অইব বাবা? শেখরনাথকে সে বাবা বলল।

বলেই দুহাত মুখ ঢেকে মেঝের ওপর আছড়ে পড়ল জ্যোৎস্না। সমানে কেঁদে চলেছে সে। কান্নাটা তার বুকের ভেতর থেকে যেন উথলে উথলে বেরিয়ে আসছে। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে একটানা বলে চলেছে সে, মানুষটার মরণ অইব, আর আমি টিপসই দিমু? কিছুতেই না, কিছুতেই না। হের (তার) থিকা আপনেরা আমারে মাইরা ফেলান, মাইরা ফেলান

বন্ডে টিপসই দেবার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়াটা এমন হবে, ভাবা যায়নি। চেম্বারের সবাই হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে।

কয়েক লহমা মাত্র। তারপর চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েন শেখরনাথ। দুহাতে জ্যোৎস্নাকে টেনে তুলে একরকম জোর করেই চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন, কাঁদবে না, কাঁদবে না। আমার কথা শোনো। আমাকে বাবা বলেছ তো? আমার ওপর ভরসা রাখো। তোমাদের এতটুকু ক্ষতি হয় তাই কখনও আমি করব না।

শান্ত হতে খানিকটা সময় লাগল জ্যোৎস্নার। তারপর চোখের জল মুছে ভারী গলায় বলল, কী কইবেন কন–

শেখরনাথ এবার যা বললেন, তা এইরকম। মোহনবাঁশির অপারেশন না হলে মৃত্যু অনিবার্য। হাসপাতালে তাকে রাখা হবে না; আজই জেফ্রি পয়েন্টে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন ডাক্তার চট্টরাজ। অপারেশন হলে বাঁচার সম্ভাবনা আছে; ষোলো আনার মধ্যে আট আনা; মৃত্যুর আশঙ্কাও আট আনা। এখন জ্যোৎস্নাকেই ঠিক করতে হবে সে কী করবে। তার টিপসই ছাড়া। কোনও ভাবেই অপারেশন করা যাবে না। এটাই হাসপাতালের। নিয়ম।

জ্যোৎস্না বলল, আপনে যা কইবেন হেইটাই করুম।

 না; আমি না। তোমাকেই ভাবতে হবে টিপসই দিতে রাজি আছ কিনা। তবে সময় কিন্তু হাতে বেশি নেই। যত দেরি করবে মোহনবাঁশির পক্ষে ততই ক্ষতি।

কিছুক্ষণ নতমুখে বসে রইল জ্যোৎস্না। বিনয় সারাক্ষণ এই চেম্বারে নীরব দর্শকের মতো সব শুনে যাচ্ছিল এবং দেখেও যাচ্ছে। সে লক্ষ করল জ্যোৎস্নার ভেতরে কোথাও যেন একটা যুদ্ধ চলছে। একসময় মুখ তুলে তাকাল সে৷ এই জ্যোৎস্না ভয়কাতর, ত্রস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত জ্যোৎস্না নয়। অন্য কেউ। দৃঢ়, নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। বোঝা যাচ্ছে, সে মনস্থির করে ফেলেছে। বলল, কুনহানে(কোথায়)টিপসই দিতে অইব, দেখাইয়া দ্যান

ডাক্তার চট্টরাজ ফর্মের নানা জায়গা পূরণ করে রেখেছিলেন। নিচের দিকের একটা ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে–  একটা কালির প্যাড তিনি জ্যোৎস্নার দিকে এগিয়ে দিলেন।

টিপসই হয়ে গেলে দ্রুত উঠে পড়লেন ডাক্তার চট্টরাজ। শেখরনাথকে বললেন, আমি ওটিতে চলে যাচ্ছি কাকা। যতক্ষণ অপারেশন শেষ না হচ্ছে বিনয়বাবু আর আপনি আমার চেম্বারে বসতে পারেন। জ্যোৎস্না কর্মকার বাইরের বেঞ্চে গিয়ে বসুক।

শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, অপারেশনে কতক্ষণ লাগবে?

অপারেশন করতে কতটা সময় লাগবে?

এখনই বলতে পারছি না। তবে তিন চার ঘণ্টার কম নয়।

শেখরনাথ বললেন, আমরা এখানে থাকব না। জ্যোৎস্নাদের সঙ্গেই থাকব।

তার মনোভাবটা বুঝতে পারল বিনয়। জ্যোৎস্না এবং তার ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি থাকলে ওরা ভরসা পাবে।

ডাক্তার চট্টরাজ আর কিছু বললেন না। অপারেশন থিয়েটার তেতলায়। চেম্বার থেকে বেরিয়ে তিনি সেখানে চলে গেলেন। শেখরনাথও বসে থাকলেন না; বিনয় এবং জ্যোৎস্নাকে সঙ্গে করে বাইরের প্যাসেজে বেঞ্চিতে এসে বসলেন।

সময় কাটতে থাকে। এদিকে হাসপাতালের চত্বরে নতুন নতুন রোগী আসছে। সঙ্গে তাদের বাড়ির লোকজন। চারিদিক এখন সরগরম।

সূর্য সেলুলার জেলের মাথা ডিঙিয়ে পশ্চিম দিকে খানিকটা নেমে গেছে। হাসপাতালের এই লম্বা প্যাসেজ থেকে সেসোস্ট্রেস বের অনেকটা অংশ চোখে পড়ে। তেজি রোদে উপসাগরের জল ফেনিয়ে উঠে পাড়ের দিকে ধেয়ে আসছে। অশান্ত, উত্তাল ঢেউয়ের অবিরল গজরানি শোনা যাচ্ছে। দূরে-কাছে যতদূর চোখ যায় জেলেদের ছোট ছোট বোট। মাঝে মাঝে দু-চারটে লঞ্চ। হাসপাতাল থেকে সেগুলোকে দম-দেওয়া খেলনা জলযানের মতো দেখায়। তবে সবচেয়ে বেশি করে যা চোখে পড়ে তা হল ঝাঁকে ঝাঁকে সী-গাল৷

জ্যোৎস্না উপসাগরের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। টিপসই দেবার আগের মুহূর্তে তার যে মনোবল দেখা গিয়েছিল তা ক্রমশ যেন ভেঙে পড়ছে। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে চাপা গলায় সে বলে যাচ্ছে, কী কুক্ষণে যে আন্দারমানে আইছিলাম। কত মাইনষে (মানুষ) নিষেধ করছিল যাইও না। পাট্টির বাবুরা আইয়া কইছিল যাইও না। তভু জমিন পামু এই ভরসায় চইলা আইলাম। অহন আমার সর্বস্ব যাইতে বইছে৷

পাশে বসে সমানে তাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন শেখরনাথ। ডাক্তার চট্টরাজ খুব বড় ডাক্তার। ধন্বন্তরি। কত মানুষ যে তিনি বাঁচিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তার কথা যেন শুনতেই পায় না জ্যোৎস্না।

মোহনবাঁশির ছেলেমেয়েরা বিশ্বজিতের বাংলো থেকে বেরোবার পর একটি কথাও বলেনি। চুপচাপ বোবার মতো তারা বসে আছে।

একসময় বিনয়কে নিয়ে উঠে পড়লেন শেখরনাথ। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে বললেন, সেই কখন ওরা দুটি ভাত খেয়ে এসেছে। বেলা হেলতে শুরু করেছে; নিশ্চয়ই ওদের খিদে পেয়ে গেছে। এক কাজ কর গাড়ি নিয়ে এবারডিন মার্কেটে চলে যাও। ওখানে অনেক হোটেল আর খাবারের দোকান আছে। তুমি সবার মতো রুটি তরকারি মিষ্টি নিয়ে এসো। পকেট থেকে টাকা বার করে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, আমি জ্যোৎস্নাদের কাছেই থাকি। দুজনে একসঙ্গে চলে গেলে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়বে।

যে গাড়িতে সবাই হাসপাতালে এসেছিল সেটা একধারে দাঁড়িয়ে আছে। বিনয় আধঘণ্টার ভেতর রুটি টুটি কিনে ফিরে এল।

মোহনবাঁশির ছেলেমেয়েরা তবু একটু আধটু খেল। কিন্তু জ্যোৎস্নাকে কোনওভাবেই খাওয়ানো গেল না।

শেখরনাথ বারবার বোঝাতে লাগলেন, না খেলে নাড়ি চুঁইয়ে যাবে। ডাক্তাররা তো মোহনবাঁশিকে দেখছেন। সে যাতে সুস্থহয়ে ওঠে সেই চেষ্টা করছেন। নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ তোমার?

ব্যাকুলভাবে জ্যোৎস্না বলতে লাগল, আমারে খাওনের কথা কইয়েন না বাবা। গলা দিয়া কিছু নামব না।

.

আরও ঘণ্টা দুই পর সূর্য যখন মাউন্ট হ্যারিয়েটের দিকে হেলতে শুরু করেছে, সেই সময় ডাক্তার চট্টরাজ তেতলা থেকে নেমে এলেন।

শেখরনাথের সঙ্গে বিনয় জ্যোৎস্নারাও ব্যগ্রভাবে উঠে দাঁড়াল। ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, অপারেশন হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *