৩.০২ এবারডিন মার্কেট

জিপটা সেলুলার জেলের বিশাল চত্বর পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। খানিকটা এগিয়ে টিলার ঢাল বেয়ে নিচে নেমে সোজা এবারডিন মার্কেট। মার্কেটের দোকানপাট বেশ রাত অবধি খোলা থাকে। এখন তো সবে সন্ধে পেরিয়েছে। চারিদিকে আলো জ্বলছে। ইলেকট্রিক লাইট ছাড়াও রয়েছে গ্যাসের আলোও। লোকজনও প্রচুর চোখে পড়ছে। বিকিকিনি চলছে। পুরোদমে।

জিপ চালাচ্ছিল বিশ্বজিৎ রাহার ড্রাইভার কালীপদ। ফ্রন্ট সিটে তার পাশে বসে আছে বিনয় এবং শেখরনাথ। পেছনের মুখোমুখি দুটো লম্বা সিটে মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা উদ্বাস্তুরা সেটেলমেন্ট থেকে কোনও কারণে পোর্টব্লেয়ারে এলে এবারডিন মার্কেটের পাশে পুনর্বাসন দপ্তরের ভাড়া করা বাড়িতে রাখা হয়। কিন্তু মোহনবাঁশির পরিবারের লোকজন এতটাই কাতর, এতটাই উৎকণ্ঠিত যে রিহ্যাবিলিটেশনের কর্মীরা ওদের সামলাতে পারবে না; তাই শেখরনাথ বিশ্বজিতের বাংলোয় নিয়ে চলেছেন। খুব সম্ভব এই নিয়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। যে কদিন মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা পোর্টব্লেয়ারে আছে, বিশ্বজিতের বাংলোতেই থাকবে। ওদের চোখে চোখে রাখা একান্ত দরকার।

এবারডিন মার্কেট এবং তার চারপাশের এলাকাটা খুব ভালোই চেনে বিনয়। এই তো সেদিন উদ্বাস্তুদের সঙ্গে রস আইল্যান্ড থেকে মোটরবোটে পোর্টব্লেয়ারে নেমে এবারডিন মার্কেটের জিমখানা ময়দানে এসেছিল। সেখান থেকে বিশ্বজিতের সঙ্গে তার বাংলোয়।

মার্কেটের জমজমাট চৌহদ্দি পেছনে ফেলে পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরল জিপটা। উঁচু-নিচু টিলা পেরিয়ে সেটা চলেছে তো চলেছেই। দুধারে পরিচিত দৃশ্য। রাস্তার নিচের ঢালু জমিতে ধানখেত; দূরে দূরে ছাড়া ছাড়া ভাবে বাড়ি-ঘর। কাঠের বাড়িই বেশি; ক্কচিৎ দু-চারটে পাকা দালান।

এক সময় ফুঙ্গি চাউং বা বুদ্ধমন্দিরের কাছে এসে বাঁক ঘুরে জিপটা ডাইনে দৌড় শুরু করল। সামনে পাহাড়; তার ওধারের ঢালের মাঝামাঝি মিডল পয়েন্টে বিশ্বজিৎ রাহার বাংলো।

কদিন আগেই পূর্ণিমা ছিল। আকাশে ছিল পূর্ণ চাঁদের মায়া। সেই চাঁদ অনেকটা ক্ষয়ে গেলেও যেটুকু জ্যোৎস্না ঢালছে তাতে চরাচর যেন কোনও অপার্থিব রহস্যে ভরে আছে।

জিপের সবাই চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বলছিল না। শুধু পেছনের সিট থেকে মোহনবাঁশির স্ত্রীর চাপা কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

এক সময় পাহাড় পেরিয়ে বিশ্বজিতের বাংলোর সামনে এসে জিপ থামল। বিনয়কে নিয়ে শেখরনাথ নেমে পড়লেন। তারপর মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নামিয়ে আনলেন। –এসো এসো আমার সঙ্গে।

কাঠের দোতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে শেখরনাথ গলার স্বর উঁচুতে তুললেন। গোপাল, কার্তিক, ভুবন–আমরা এসে গেছি।

বিনয় জানে ওই তিনজন বিশ্বজিতের কাজের লোক। ওদের আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল। তারা দৌড়ে দোতলার সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল।

শেখরনাথ কার্তিককে জিগ্যেস করলেন, একটা ঘরে চারজনের মতো বিছানা-টিছানা ঠিক করে রাখতে বলেছিলাম। রেখেছিস তো?।

বাড়ি সাফ করা, ঘর গুছানো, বিছানা পাতা–এইসব কাজ কার্তিক করে। গোপাল তার সঙ্গে হাত লাগায়, তা ছাড়া নানা ফাইফরমাশও খাটে। কার্তিক বলল, হা, কাকা।

বিনয় আগেই লক্ষ করেছে যার সঙ্গেই শেখরনাথের দেখা হয়েছে, বাঙালি হলে তারা কাকা বলেছে, বাকিরা চাচা। এমনকী এই বাংলোর কাজের লোকেরাও তাই। বিশ্বজিতের কাকা, সেই সুবাদে তিনি আন্দামানের সব বাসিন্দারই কাকা।

শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, বিশু এসেছে?

না।

বিনয় আন্দাজ করে নিল চিফ কমিশনারের বাংলোয় মিটিং সারতে বিশ্বজিতের দেরি হচ্ছে। তাই এখনও তিনি ফিরতে পারেননি।

সবাই দোতলায় উঠে এল। এখানে বেতের সোফা-টোফা দিয়ে সাজানো মস্ত ড্রইং-রুমের তিন দিকে পাঁচখানা শোওয়ার। ঘর। এই বাংলোয় এক রাত কাটিয়ে গেছে বিনয়। এসব তার চেনা।

শেখরনাথ বললেন, কোন ঘরে ব্যবস্থা হয়েছে।

বাঁ পাশের কোণের ঘরটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল কার্তিক।

শেখরনাথ বললেন, ওটার লাগোয়া বাথরুম আছে। ওদের ওখানে নিয়ে যা। গরম জল করে দিস। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে ওরা চান-টান সেরে নিক ভুবনকে বললেন, তোর রান্নাবান্না হয়ে গেছে?

ভুবন জানাল, দু-একটা পদ বাকি আছে।

তাড়াহুড়ো করতে হবে না। হাসপাতালে ওরা রুটি-তরকারি খেয়ে এসেছে। এই তো সন্ধে পার হল৷ কটা আর বাজে! ঘণ্টা দেড়-দুই পরে ওদের ভাত দিস।

কার্তিক মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোণের ঘরে চলে গেল। শেখরনাথ বিনয়কে সঙ্গে করে ড্রইংরুমের সোফায় গিয়ে বসলেন। ওঁরা আজকের সারাদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে এলোমেলোভাবে কথা বলতে লাগলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে বিশ্বজিৎ ফিরে এলেন। তাঁর জিপে বিনয়রা হাসপাতাল থেকে এসেছিল। তিনি অন্য একটা গাড়িতে এসেছেন।

বিশ্বজিৎ সোজা বিনয়দের কাছে এসে বসলেন। জিগ্যেস করলেন, কাকা, মোহনবাঁশি কর্মকারের লেটেস্ট খবর কী? আমার অফিস থেকে হাসপাতালে গিয়ে কেমন দেখলেন?

শেখরনাথ যে ঘরটায় মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের পাঠানো হয়েছে সতর্কভাবে একবার সেদিকে তাকালেন। গলার স্বর যাতে সেখানে না পৌঁছায় সেভাবে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, দেখতে আর দিল কোথায়? ওকে এমার্জেন্সিতে রাখা হয়েছে। তারপর ডাক্তার চট্টরাজের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে, সব জানিয়ে দিলেন।

দুর্ভাবনার রেখাগুলো ফুটে ওঠে বিশ্বজিতের চোখে-মুখে।

-খুব সমস্যা হল কাকা। লোকটাকে যদি বাঁচানো না যায়, জেফ্রি পয়েন্টে সেটলমেন্টে তার ভীষণ খারাপ রি-অ্যাকশন হবে। কিছুদিন আগে জারোয়ারা একবার হানা দেওয়ার পর উদ্বাস্তুরা এত ভয় পেয়ে যায় যে কিছুতেই আন্দামানে থাকতে চাইছিল না। তখন কেউ খুন-জখম হয়নি। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের রাখতে পারা গিয়েছিল। কিন্তু মোহনবাঁশির মৃত্যু হলে ওরা কী যে করবে ভেবে পাচ্ছি না। দেখা যাক, কার নিকোবর থেকে দুই সার্জন ফিরে আসার পর কী হয়। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

শেখরনাথের হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল। –দ্যাখ বিশু, জেফ্রি পয়েন্টের উত্তর দিকটায় জারোয়ারা থাকে। আমার ধারণা, ওধারের জঙ্গল কাটা পড়ছে বলে ওরা খেপে গেছে। ওদের তাড়িয়ে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন করাটা ঠিক হচ্ছে না।

একটু নীরবতা।

তারপর শেখরনাথই ফের শুরু করলেন, উত্তর দিকটা বাদ দিয়ে তারা বরং পুব দিকের জঙ্গলগুলো আরও বেশি করে রিক্লেম কর।

বিশ্বজিৎ চকিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু

কী হল?

গভর্নমেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, উত্তর আর পুবের জঙ্গল সাফ করতে হবে। নইলে এত ভি পি ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া যাবে কী করে?

শেখরনাথ বললেন, আমি কিন্তু তোর লোকেদের উত্তর দিকের জঙ্গল কাটতে বারণ করে এসেছি।

সে কী! কয়েক লহমা হতবাক তাকিয়ে থাকেন বিশ্বজিৎ। তারপর ভয়ে ভয়ে বললেন, এটা কিন্তু ঠিক করেননি কাকা।

তার মানে? বেশ রেগেই গেলেন শেখরনাথ। যারা ওখানকার আদি বাসিন্দা, জঙ্গল কেটে তাদের এলাকা ছোট করে দেওয়া হচ্ছে, এটা কি ঠিক কাজ? তোরা জানিস না অনেকটা জায়গা জুড়ে জারোয়ারা ঘুরে বেড়ায়?

ঢোক গিলে বিশ্বজিৎ বললেন, গভর্নমেন্ট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের পক্ষে এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয় কাকা। ওপর থেকে যে নিয়ম বেঁধে দেবে সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমাদের তা না মেনে উপায় নেই।

এর ফলে জারোয়ারা কিন্তু আরও বেশি হোস্টাইল হয়ে উঠবে। ওদের ডিসটার্ব করা উচিত নয়।

বিশ্বজিৎ চুপ করে রইলেন।

 স্থির দৃষ্টিতে ভাইপোকে লক্ষ করতে করতে শেখরনাথ বললেন, তোরা যে নিরুপায় তা বুঝতে পারছি। তোদের ওপর যে হুকুম জারি করা হয়েছে সেটা তামিল করতে তোরা বাধ্য। কিন্তু আমি গভর্নমেন্টের চাকর নই। আন্দামান-নিকোবরের হর্তাকর্তা বিধাতা হলেন চিফ কমিশনার। আমি দু-একদিনের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করে বলব, জেফ্রি পয়েন্টের উত্তর দিকের জঙ্গল কাটা বন্ধ করা হোক।

বিশ্বজিৎ তাঁর বিপ্লবী কাকাটিকে খুব ভালোই চেনেন। ভীষণ একরোখা। প্রচণ্ড জেদি। কোনও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেন না। যা সংগত মনে করেন সেটাই করবেন। একবার যখন গো ধরেছেন চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করবেন, তাকে কোনওভাবেই ঠেকানো যাবে না। চিফ কমিশনার ওঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করেন কিন্তু তাঁর কথা কতটা মানবেন, বিশ্বজিৎ সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। বরং যথেষ্ট সন্দিহান। কেননা একবার সরকারি স্তরে অনেক বিচার-বিবেচনা আর ভাবনা-চিন্তার পর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা মুশকিল। বিশ্বজিৎ বললেন, আপনার যখন মনে হয়েছে, দেখা করুন।

এবার শেখরনাথ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তোর সঙ্গে আরেকটা খুব জরুরি কথা আছে।

উৎসুক চোখে তাকালেন বিশ্বজিৎ।

জেফ্রি পয়েন্টের উদ্বাস্তু সৃষ্টিধরের বউয়ের বাচ্চা হওয়ার উদ্বেগজনক ঘটনাটার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে শেখরনাথ বললেন, আমি ওখানে ছিলাম তাই সমস্যাটার মোটামুটি সুরাহা হয়েছে। ডাক্তার নেই, ওষুধ-বিষুধ নেই, নার্স নেই। জেফ্রি পয়েন্ট থেকে তিনটে পাহাড় পেরিয়ে যে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসানো হয়েছে সেখান থেকে একজন দাইকে নিয়ে এসে ব্যাপারটা সামাল দেওয়া গেছে। এভাবে তো চলতে পারে না। এতগুলো মানুষকে তোরা জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেছিস। তাদের অসুখ-বিসুখ আছে, অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে, বিষাক্ত কানখাজুরা যে কোনও সময় কামড়াতে পারে। এদের জন্যে ইমিডিয়েটলি ওখানে একটা হেন্থ সেন্টার খোলা দরকার। চবিশ ঘন্টার জন্যে ডাক্তার, কমপাউন্ডার থাকা চাই। নইলে রোগীদের চিকিৎসার জন্যে পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে পোর্টব্লেয়ারে আনতে হলে অনেকে রাস্তাতেই পরপারে চলে যাবে।

বিশ্বজিৎ বললেন, কাছাকাছি দু-তিনটে সেটলমেন্টের জন্যে একটা করে হেলথ সেন্টার খোলার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এখনও ফান্ডের ব্যবস্থা হয়নি।

তামাশা নাকি! এতগুলো মানুষকে ঘোর জঙ্গলে এনে ফেলে। দিলাম। তারপর মরলে মর, বাঁচলে বাঁচো। এতগুলো মানুষের লাইফ নিয়ে ছেলেখেলা! গনগনে মুখে বললেন শেখরনাথ।

একেবারে কাচুমাচু হয়ে গেলেন বিশ্বজিৎ। কাকা, আপনি ভাববেন না, খুব তাড়াতাড়িই সব হয়ে যাবে।

দেখা যাক। শেখরনাথ বলতে লাগলেন, সারা ভারতবর্ষ আজ যে স্বাধীনতার সুখ-ভোগ করছে তা এই মানুষগুলোর চরম স্যাক্রিফাইসের জন্যে। এটা সব সময় মনে রাখিস। ওয়েস্ট বেঙ্গলে, ত্রিপুরায়, আসামে বা অন্য কোথায় রিফিউজিদের জন্যে কী করা হচ্ছে, আমার পক্ষে নিজের চোখে তা দেখা সম্ভব নয়। শুনছি সর্বস্ব খুইয়ে যে লোকগুলো এপারে চলে এসেছে ওই সব জায়গায় তাদের হাল খুব শোচনীয়। সে যাক, আন্দামানে এদের জন্যে দায়সারা কিছু করে হাত ধুয়ে ফেললে আমি কিন্তু ছাড়ব না। তোমাদের চিফ কমিশনারকে জানিয়ে দিও, এই পোর্টব্লেয়ার শহরে তার অফিসের সামনে মুভমেন্ট শুরু করে দেব।

বিশ্বজিৎ চমকে উঠলেন। না না কাকা, মুভমেন্টের কথা একদম ভাববেন না। তাতে আন্দামান সেটলমেন্টের ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। এই দ্বীপে রিফিউজিরা আসতেই চাইবে না। একটু থেমে বললেন, এত বড় রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ এই দ্বীপে কেন, সারা দেশেই আগে কখনও হয়নি। শুরুতে অনেক ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। আমরা সব ঠিক করে নেব।

শেখরনাথ একটু নরম হলেন। দেখা যাক। তারপর জিগ্যেস। করলেন, চিফ কমিশনারের বাংলোয় রিফিউজিদের নিয়ে কী মিটিং হল তোদের?

আপনি তো আগেই শুনেছেন, মাস দেড়েকের ভেতর আরও আড়াইশো ভি পি ফ্যামিলিকে আন্দামানে নিয়ে আসা। হবে। তাদের বেশির ভাগকেই পাঠানো হবে মিডল আন্দামানে। একশোর মতো ফ্যামিলিকে নিয়ে যাওয়া হবে জেফ্রি পয়েন্টে। বিশ্বজিৎ জানাতে লাগলেন, এতগুলো পরিবারকে সাত একর করে দিতে হলে সাড়ে সতেরোশো একর জমি দরকার। মিডল আন্দামানে জঙ্গল কেটে সাতশো একরের মতো জমি বার করা হয়েছে। সেখানে আরও জমি দরকার। তাই জঙ্গল কাটা থেমে নেই। জেফ্রি পয়েন্টে যে জমি আছে তার ওপর অরণ্য নির্মূল করে আরও তিনশো সাড়ে তিনশো একর জমি চাই। মিটিংয়ে এইসব জমি সম্বন্ধে সবিস্তার জানতে চেয়েছেন চিফ কমিশনার। কীভাবে তা ডিস্ট্রিবিউট করা হবে তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।

শেখরনাথ কোনও প্রশ্ন করলেন না।

বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, তবে একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার আছে কাকা।

কী?

স্বাধীনতার পর আন্দামানে রিহ্যাবিলিটেশন প্রোজেক্ট শুধুমাত্র বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু যে উদ্বাস্তুরা কলকাতা থেকে আসতে চাইবে না তাদের জন্যে ঠিক করে রাখা জমি অনন্তকাল ফেলে রাখা হবে না। কিছুদিন। অপেক্ষা করে সে সব মোপলাদের দেওয়ার কথা ভাবা হবে। আসল ব্যাপারটা অন্য জায়গায়।

কীরকম।

 পশ্চিমবাংলার বাইরে এটা সেকেন্ড বেঙ্গল হয়ে উঠুক চিফ কমিশনর খুব সম্ভব তা চান না।

চকিতে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। রস আইল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে এবারডিন মার্কেটের সামনের মাঠে চলে এসেছিল বিভাস আর নিরঞ্জন। সঙ্গে ছিল বিনয় আর বিশ্বজিৎও। সেখানে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে চিফ কমিশনারকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তিনি তাদের আন্দামানে স্বাগত জানিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। তার মুখ থেকে অবিরল। মধু ঝরে পড়ছিল। শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল বিনয়। মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধাও হয়েছিল খুব। পরে এই নিয়ে যখন বিশ্বজিতের সঙ্গে কথা হয়, রহস্যময় হেসে তিনি বলেছেন, লোকটার দুটো মুখ। আজ বোঝা গেল একটা মুখ দিয়ে তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য অপার সহানুভূতি ঢেলে দেন। কিন্তু আড়ালে যে। মুখটা রয়েছে সেটা ভীষণ চতুর। ফন্দিবাজ। উদ্বাস্তুরা হাজারে হাজারে এলে এই বিশাল দ্বীপপুঞ্জ বাঙালিদের দখলে চলে যাবে। সেটা তার কাম্য নয়। এই দ্বিতীয় মুখটা সম্পর্কে সেদিন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ।

এদিকে রীতিমতো চিন্তিত দেখাল শেখরনাথকে। বললেন, এটা ভীষণ দুর্ভাবনার কথা। মোপলাদের সম্বন্ধে আমার কোনওরকম বিদ্বেষ নেই। কিন্তু প্রায়োরিটি অবশ্যই বাঙালি উদ্বাস্তুদের রিহ্যাবিলিটেশন। ওয়েস্ট বেঙ্গল তো উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ বা বম্বে প্রেসিডেন্সির মতো বিশাল স্টেট নয়। এত উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন দেওয়ার মতো জমি-জায়গা সেখানে কোথায়? আন্দামান হাতছাড়া হয়ে গেলে মহা সর্বনাশ।

বিশ্বজিৎ উত্তর দিলেন না।

বিপ্লবী কাকা এবং আন্দামানের বড় অফিসার তার ভাইপোর কথা নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। প্রচুর অর্থ ঢেলে অরণ্য নির্মূল করে যে জমি পাওয়া যাচ্ছে, উদ্বাস্তুরা না এলে তার একটা ব্যবস্থা যে করা হবে এমন জনরব কিছুদিন ধরে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেভাবে কান দেয়নি বিনয়। কিন্তু স্বয়ং চিফ কমিশনার আজ যখন মোপলাদের কথা বিশ্বজিৎকে বলেছেন, তাতে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে বিনয়। চিফ কমিশনার হলেন। আন্দামান-নিকোবরের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তিনি যদি মনে করেন, ফাঁকা জায়গায় মোপলাদের বসাবেন, কেন্দ্রীয়। সরকার তার প্রস্তাব উড়িয় দেবে না; যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শুনবে।

শেখরনাথের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা-ক্ষোভ-অসন্তোষ ফুটে উঠছিল। তিনি থামেননি। আমি তো দু-চারদিনের মধ্যে চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তাকে জাবোয়াদের কথা তো বলবই, মোপলাদের প্রসঙ্গও তুলব। বলব, এখানকার তিনটে বড় দ্বীপ সাউথ, নর্থ আর মিডল আন্দামানে শুধু বাঙালি রিফিউজিদের রিহ্যাবিলেটেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রোজেক্টে কিছুতেই অন্য কারুকে বসানো চলবে না। আন্দামানে আরও দুশোরও বেশি দ্বীপ আছে। তার কয়েকটায় সুইট ওয়াটার পাওয়া যায়, জমিও ফার্টাইল। গভর্নমেন্ট ইচ্ছা করলে মোপলাদের সেসব জায়গায় নিয়ে বসাক।

শুনতে শুনতে আঁতকে উঠলেন বিশ্বজিৎ। না না কাকা, চিফ কমিশনারকে মোপলাদের কথা একেবারেই বলবেন না। এ বাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। চিফ কমিশনার তার মনোভাব জানিয়েছেন শুধু। যদি তাকে এসব বলতে যান। ডেফিনিটলি ভাববেন আমিই আপনাকে এসব বলেছি। একজন সাব-অর্ডিনেট অফিসার হিসেবে এটা মারাত্মক বিশ্বাসভঙ্গ। এরপর হয়তো আমাকে কোনও গোপন মিটিংয়ে ডাকবেন না। উদ্বাস্তুদের জন্যে স্বাধীনভাবে যে কাজটুকু করতে পারছি তাও করতে দেবেন না; আমার ক্ষমতা ছেটে পেটোয়া অন্য কারুকে। দায়িত্ব দিয়ে দেবেন। রিফিউজিদের সম্পর্কে তার কতটা সহানুভূতি থাকবে কে জানে। এই প্রোজেক্ট তো লোহালক্কড়, মেশিন-টেশিন নিয়ে নয়। এর র মেটিরিয়াল হল উৎখাত হয়ে আসা, বিপন্ন মানুষ। জীবনে তাদের দাঁড় করিয়ে দিতে হলে ভালোবাসা, সহানুভূতি দরকার।

বিশ্বজিতের কথাগুলো যুক্তিসংগত মনে হল শেখরনাথের। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, ঠিক আছে, মোপলাদের কথা তুলব না।

হঠাৎ বিনয় বলে উঠল, কাকা, আমার কিছু বলার আছে।

শেখরনাথ তার দিকে ঘুরে বসলেন। –বেশ তো। বল—

 এখানকার সেটলমেন্টের ব্যাপারে অন্য দিকেও কিন্তু ভীষণ প্রবলেম রয়েছে।

কীরকম?

কলকাতায় সরকার বিরোধী পার্টিগুলো উদ্বাস্তুদের নিয়ে, আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমেছে। রোজই সেখানে গোলমাল হচ্ছে। পুলিশের লাঠি, গুলি-টুলিও চলছে।

হ্যাঁ, জানি। শেখরনাথ বললেন, মেনল্যান্ড থেকে কাগজগুলো আসে, তার মধ্যে তোমাদের নতুন ভারতও আছে, সেগুলোতে এসব খবর থাকে। আত্মঘাতী মুভমেন্ট। এই হঠকারী পলিটিকসের দাম কিন্তু একদিন দিতে হবে।

এরপর কেউ আর কিছু বলল না। ড্রইংরুমের আবহাওয়া কেমন এক নৈরাশ্য এবং উৎকণ্ঠায় ভরে যেতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *