২.০৩ বহু মানুষের হইচই

বহু মানুষের হইচই আর উতরোল কান্নার আওয়াজে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল বিনয়ের। প্রথমটা সে বুঝে উঠতে পারল না, কোথায় আছে। মাথাটা সামান্য তুলতেই চোখে পড়ল, সারা ঘর ঝকঝকে রোদে ভরে গেছে। শিয়রের দিকে জানালার বাইরে লাইন দিয়ে পাহাড়ের সারি, আর নিবিড় জঙ্গল। এখন জোরালো হাওয়া বইছে, কাছাকাছি কোথাও সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

চকিতে সমস্ত মনে পড়ে গেল বিনয়ের। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। নিজের অজান্তেই তার নজর চলে যায় পাশের খাটটার দিকে। বিছানা খালি। বিশ্বজিৎ কখন উঠে বাইরে বেরিয়ে গেছেন, টের পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভব বিনয় ঘুমচ্ছে দেখে তাকে আর ডাকেননি।

ক্ষিপ্র হাতে মশারি সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল বিনয়। ঘরের বাইরে যেতেই দেখতে পেল কাল যে উদ্বাস্তুরা এখানে এসেছিল–বুড়ো-ধুড়ো, বাচ্চা কাচ্চা, যুবক-যুবতী, আধবয়সি নারী-পুরুষ–তাঁরা সবাই ব্যারাকগুলোর সামনের ফাঁকা জায়গাটায় উন্মাদের মতো কেঁদে চলেছে আর একসঙ্গে জড়ানো জড়ানো গলায় কী সব বলে চলেছে। এদেরই কান্না আর হইচইতে তার চোখ থেকে ঘুম ছুটে গিয়েছিল। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বজিৎ, নিরঞ্জন, বিভাস, ধনপত এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। তারা হাত নেড়ে নেড়ে অবিরল উদ্বাস্তুদের কী বুঝিয়ে চলেছেন।

ছিন্নমূল মানুষগুলোর তুমুল কান্নাকাটি আর প্রচণ্ড অস্থিরতার কারণটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিল বিনয়। পায়ে পায়ে সে জটলাটার কাছে চলে এল। চমকে উঠে লক্ষ্য করল উদ্বাস্তুরা যে যার মালপত্রটিনের বাক্স, বিছানা এবং টুকিটাকি নানা মালপত্র বাঁধাছাদা করে ব্যারাক থেকে বার করে এনে বাইরে জড়ো করেছে।

সবাই মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সমানে বলে চলেছে, আমরা এই জঙ্গলে থাকুম না।

কিছুতেই থাকুম না।

এহানে থাকলে জারোর হাতে হগলটির (সকলের) মরণ।

আমরা ঠিক কইরা ফালাইছি, কইলকাতায় ফিরা, যামু। আন্ধারমানে থাকুম না।

নানা বয়সের পুরুষেরা সমানে শোরগোল করছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁদছে বাচ্চাকাচ্চার দল আর মেয়েরা।

বিনয়ের ধারণা, কাল রাত্তিরে ধনপতের হাঁকডাকে উদ্বাস্তুরা ব্যারাকে ঢুকে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু চুপচাপ শুয়ে পড়েনি। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্দামানের এই মৃত্যুপুরীতে তারা আর এক লহমাও থাকবে না।

কাল রাতের মতো ধমক-ধামক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতে চাইছিল ধনপত কিন্তু বিশ্বজিৎ ধীর, স্থির, অভিজ্ঞ তো বটেই, অত্যন্ত বুদ্ধিমান অফিসার। তিনি জানেন যারা মরিয়া হয়ে উঠেছে, লটবহর গুছিয়ে নিয়ে যারা চলে যাবার জন্য প্রস্তুত, হুঙ্কার ছেড়ে তাদের দমিয়ে রাখা যাবে না। সব সময় একই স্ট্র্যাটেজিতে কাজ হয় না। নানা সমস্যা সামলাতে নানা কৌশল দরকার।

বিশ্বজিতের ধৈর্যের সীমা পরিসীমা নেই। তিনি ধনপতকে টু শব্দটি করতে না দিয়ে সমানে বুঝিয়ে চলেছেন। জারোয়ারা হঠাৎই কাল সেটলমেন্টে চলে এসেছিল। আর যাতে এদিকে না আসতে পারে তার জন্য আরও জোরদার বন্দোবস্ত করা হবে। বুশ পুলিশের সংখ্যা চার-পাঁচগুণ বাড়িয়ে দেবেন। তা ছাড়া পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা দিনের বেলায় তো বটেই, পালা করে রাত জেগে। জেগে দূরের জঙ্গলের দিকে নজর রাখবে। উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তায় লেশমাত্র ত্রুটি রাখা হবে না।

কিন্তু কে কার কথা শোনে। বিশ্বজিতের এত ঢালাও প্রতিশ্রুতি উদ্বাস্তুদের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি এবং কান্নার মাত্রাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে।

বিশ্বজিতের সহিষ্ণুতার শেষ নেই। তিনি জিগ্যেস করেন, আপনারা তো এখানে থাকতে চাইছেন না। কী করতে চান তাহলে?

ছিন্নমূল মানুষগুলোর ভেতর থেকে মাখন রুদ্রপাল সামনে এগিয়ে আসে। হাতজোড় করে বলে, আমরা কইলকাতায় ফিরা। যামু।

বিশ্বজিৎ বলেন, ফিরে তো যাবেন কিন্তু বলামাত্রই এখান থেকে ফেরা যায় না।

ক্যান যাইব না? কাল বিকেলে যে সব ট্রাক চেপে উদ্বাস্তুরা এখানে এসেছিল সেটলমেন্ট এলাকা থেকে একটু দূরে একটা টিলার মাথায় চেটালো মতো জায়গায় লাইন দিয়ে সেগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে মাখন রুদ্রপাল বলল, উই তো গাড়িগুলান খাড়ইয়া রইছে। উইগুলানে চাপাইয়া আমাগো পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ারে) লইয়া যান। হেইহান থিকা কইলকাতার জাহাজে উঠাইয়া দিবেন।

বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে বললেন, সরকারি পুনর্বাসন দপ্তরের নথিতে উদ্বাস্তুদের নাম পাকাপাকিভাবে তুলে আন্দামানে পাঠানো হয়েছে। তাদের জন্য এখানে জমির ব্যবস্থাও করা হয়ে গেছে। নথি থেকে নাম খারিজ করিয়ে এদের কলকাতায় ফেরত পাঠানো সহজ নয়। প্রক্রিয়াটি কার্যকর হতে অনেক সময় লাগবে। কমপক্ষে পাঁচ-ছ’মাস। একবার নাম কাটানোর আর্জি জানালে সরকার মাখন রুদ্রপালদের কোনওরকম দায়িত্ব নেবে না। তারা খাবে কী? থাকবে কোথায়? সরকারি দপ্তরের ব্যবস্থায় উদ্বাস্তুরা এখানে আসতে পেরেছিল। তারাই তাদের আদরযত্ন করে আন্দামানে নিয়ে এসেছিল। ফিরে যেতে হলে নিজেদের পয়সায় জাহাজের টিকেট কাটতে হবে। তত পয়সা কি মাখনদের আছে?

আরও একটা সমস্যা, কলকাতা থেকে জাহাজ এলে সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে যায় না। একটানা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর এস এস মহারাজা’ তিন সপ্তাহ এখানে নোঙর ফেলে থাকে। তারপর। ফেরার প্রশ্ন। এই তিনটে সপ্তাহ উদ্বাস্তুদের চলবে কী করে?

মাখন ভীষণ দমে যায়। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।

তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল ঢ্যাঙা, ক্ষয়টে চেহারার আধ বুড়ো একটা লোক। তার নাম লক্ষ্মণ দাস। আদি বাড়ি ছিল পালং থানার তাহেরপুর গ্রামে। সে বলল, সার (স্যার) অন্য কারোরে বুজি (বুঝি) না, আপনেই আমাগো কাছে সরকার। গরমেনের (গভর্নমেন্টের) কাগজে আমাগো নামনুম যা আছে আপনেই কাইটা দ্যান।

বিশ্বজিৎ হয়তো একটু আমোদ বোধ করেন। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, অত ক্ষমতা আমার নেই।

আচে, আচে, হেয়া আমরা জানি।

বিশ্বজিৎ যে ওদের কাছে ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। হাজারবার অস্বীকার করলেও এই ধারণাটা পালটাবে না। বৃথা চেষ্টা না করে তিনি বললেন, নাম না হয় কাটা গেল। তারপর?

লক্ষ্মণ দাস বলল, জাহাজের টিকিট কাটতে তো শুনছি মেলা (অনেক) ট্যাহা লাগে। অত ট্যাহা আমাগো নাই। তয়।

তবে কী?

অল্প-স্বল্প কিছু পহা (পয়সা) আছে। তিন হপ্তা হইল একইশ দিন। অতদিন পর পর কইলকাতার জাহাজ ছাড়ে। অত সোমায় (সময়) এহানে থাকন যাইব না। আপনে দয়া কইরা ফেরনের ব্যবোস্তা কইরা দ্যান।

বিশ্বজিৎ হতভম্বের মতো কয়েক লহমা তাকিয়ে থাকেন। তারপর জিগ্যেস করেন, আমি কী ব্যবস্থা করব?

আমাগো খান চাল্লিশেক নাও ঠিক কইরা দ্যান। যাগো নাও হেরা (তারা) দুইজন কইরা পিতিটি (প্রতিটি) নাওয়ে যাইব। কইলকাতায় পৌঁছাইলে হেরা তাগো নাও লইয়া আন্ধারমানে। ফিরা আইব।

লক্ষ্মণ দাস এক নিশ্বাসে বলে যেতে লাগল, নাও আমরাই বাইয়া লইয়া যামু। নাওয়ের মালিকগো কিছুই করণ লাগব না। হেরা খালি বইয়া থাকব।

বলে কী লোকটা? স্তম্ভিত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে খানিকটা সময় লাগল বিশ্বজিতের। তারপর তিনি বললেন, আপনারা নৌকোয় করে সমুদ্র পাড়ি দিতে চান!

লক্ষ্মণ দাস বলে, হ। আমরা পদ্মা-মাঘনার দ্যাশের মানুষ। দশ-বারো বচ্ছর বস (বয়স) থিকা আলিসান আলিসান গাঙ পাড়ি দিয়া এত বড় হইচি। পারুম না ক্যান?

এতক্ষণ বিশ্বজিতের পাশে দাঁড়িয়ে হতবাক শুনে যাচ্ছিল বিনয়। এবার মুখ খুলল সে, আপনাদের মাথাগুলোই খারাপ হয়ে গেছে। পদ্মা-মেঘনা আর সমুদ্র এক হল?

লক্ষ্মণের গা ঘেঁষে আরও অনেকেই রয়েছে। তাদের একজন হল রসময় শীল। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ষাটের ওপরে। সে বলে, সমুন্দুর আর কত বড় হইব? পদ্মা-মঘনা-ধলেশ্বরী থিকা দুই গুণ কি তিন গুণ হইব। হের বেশি না। আমরা ঠিকই পাড়ি দিয়া চইলা যাইতে পারুম। আপনেরা খালি নাও জুটাইয়া দ্যান।

নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। নিরঞ্জন বলে উঠল, পোলাপানের লাখান (মতো) কথা কইয়েন না দাস মশয়। যে উদ্বাস্তুরা জেফ্রি পয়েন্টে এসেছে তাদের সবাইকে সে তো চেনেই, তাদের নামও জানে। বলতে লাগল, পদ্মা-ম্যাঘনাকালাবদর-ধলেশ্বরী-আইডল খাঁ, এমুন হাজার হাজার নদী এক লগে করলেও সমুদ্রের এক কোনার সমানও হইব না। হেয়া (তা) ছাড়া আন্দামানে আহনের সোমায় ঝড়তুফানের মুখে পড়ছিলেন, মনে নাই? তিন মাইল চাইর মাইল জুইড়া একেকখান ঢেউ আকাশ তরি (পর্যন্ত) উইঠা যায়। অত বড় মহারাজা জাহাজখানরে মোচার খোলার লাখান (মতো) নাচাইয়া ছাড়ছিল। তাইলে (তাহলে) ছোট ছোট নাওয়ের (নৌকোর) কী হাল হইব ভাইবা দ্যাখছেন? ঝড়তুফান লাগব না, এমনেই সমুদ্রে যে ঢেউ থাকে, আন্দামান থিকা পাঁচশো হাত দূরেও যাইতে হইব, হেই ঢেউ নাওগুলারে আছাড় মাইরা ডুবাইয়া দিব। এই সমুদ্রে লাখে লাখে হাঙ্গর ঘুরতে আছে। সিধা এতগুলান মানুষ তাগো ফলার হইয়া যাইবেন।একটু থেমে কী খেয়াল হওয়ায় ফের বলে, আরে আসল কথাখানই তো মাথায় আছিল না। আন্দামানে নাও পাইবেন কই?

লক্ষ্মণ অবাক বিস্ময়ে জিগ্যেস করে, ক্যান, এই হানে নাও নাই?

না। সমুদ্রে নাও ভাসাইয়া ঘুরাফিরার কথা উন্মাদেও ভাবে না। এহানে হুদা (শুধু) লঞ্চ, স্টিমার, মোটর বোট কি জাহাজ। দাস মশয়, আপনেরা নাওয়ে কইরা কইলকাতায় ফিরনের চিন্তা ছাড়েন। পাগলেও এমুনডা ভাবে না।

লক্ষ্মণ দাস যখন নৌকোয় সমুদ্র পাড়ি দেবার কথা বলছিল সেই সময় বাচ্চাগুলো এবং মেয়েমানুষদের কান্নাকাটি থেমে গিয়েছিল। ক্ষয়া ক্ষয়া উদ্বাস্তু পুরুষগুলোও শোরগোল করছিল না। আশায় আশায় সবাই বিশ্বজিৎদের কাছে এসে জড়ো হয়েছিল। যখন জানা গেল নৌকো পাওয়া যাবে না, কলকাতায় ফিরে যাবার ভাবনাটা নেহাতই দুরাশা, তারা একেবারে মুষড়ে পড়ে।

মাখন রুদ্রপালের কণ্ঠমণিটা ঘন ঘন ওঠানামা করছিল। সে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, তাইলে কি এই জঙ্গলে জারোগা (জারোয়াদের) হাতেই আমাগো মরণ লিখা আছে? বলে বিনয়ের দিকে তাকায় সে। –’আপনে কী ক’ন ছুটোবাবু?

এতক্ষণ সামান্য দু-একটা কথা বলা ছাড়া প্রায় নীরবেই থেকেছে বিনয়। সরকারি আমলা এবং কর্মীরা যখন উদ্বাস্তুদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করছে সেখানে তার মতো একজনের মুখ খোলা ঠিক নয়। কিন্তু হলধর, মাখনের মতো উদ্বাস্তুরা, যাদের সঙ্গে সে কাল আন্দামানে এসেছে তার ওপর। ওদের অনেক আশা-ভরসা। মাখন রুদ্রপাল যখন তাকেই সরাসরি প্রশ্নটা করেছে তখন তার জবাব দেওয়াটা খুবই জরুরি।

বিনয় যা বলল,তা এইরকম। রাজাকার, মুসলিম লিগ আর। পশ্চিমা মুসলমানদের অবিরল উৎপাতে আতঙ্কগ্রস্ত মাখনরা চোদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবার পর কলকাতায় চলে আসে। প্রথমে শিয়ালদা স্টেশনে, পরে ত্রাণ শিবিরের দমবন্ধ করা নরককুণ্ডে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আশাহীন, ভবিষ্যৎহীন, অদ্ভুত এক জীবন। বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে লেশমাত্র তফাত ছিল না।

হঠাৎ আন্দামানে একটা সুযোগ এসে গেছে। এখানে পরিবার পিছু সাত একর করে জমি মিলবে। যতদিন না জমি থেকে ফসল উঠছে সরকার থেকে ক্যাশ ডোল পাওয়া যাবে। এখানে স্কুল বসবে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠবে। পূর্ব পাকিস্তানে যা যা হারিয়ে এসেছে মাখন হলধররা, এখানে তার পুরোটা না হলেও অনেকটাই পাওয়া যাবে। কলকাতায় পচে গলে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে মরে যাওয়ার চেয়ে সেটা কি কাম্য নয়? যে চরম ক্ষতি তাদের হয়ে গেছে তার অনেকটাই বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে পূরণ হয়ে যাবে।

তা ছাড়া, আরও একটা বিরাট সমস্যাও রয়েছে। ধরা যাক আন্দামানে পুনর্বাসনের তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে পরের জাহাজে কি তার পরের জাহাজে জেদ ধরে হলধররা চলে গেল। যদিও সেই আশা নেই বললেই হয়। কেননা জাহাজের টিকিট কাটার পয়সা তাদের নেই। তবু কোনও রকমে চলে গেল। কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকবে কোথায়? যে রিলিফ ক্যাম্পগুলো থেকে তারা চলে এসেছে সেসব কি এখনও ফাঁকা পড়ে আছে? পূর্ব পাকিস্তান থেকে তো বটেই, আসাম থেকেও তাড়া খেয়ে হাজারে হাজারে ছিন্নমূল মানুষ চলে আসছে কলকাতায়। হলধরদের রিলিফ ক্যাম্পগুলো এতদিনে বোঝাই হয়ে গেছে। জারোয়াদের হামলার ভয়ে তারা যদি চলে যায় তাদের এদিকও যাবে, ওদিকও যাবে। সরকারি কর্তারা মিথ্যে স্তোক দেননি; জারোয়ারা যাতে তাদের গায়ে আঁচড় কাটতে না পারে, তার ব্যবস্থা তো হয়েই যাচ্ছে। আতঙ্কের কোনও কারণ নেই।

উত্তেজনায় ত্রাসে কিছুক্ষণ আগেও উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদছিল উদ্বাস্তুরা, চিৎকার করছিল। এখন একেবারে চুপ হয়ে গেছে। প্রথমে বিশ্বজিৎ, তারপর নিরঞ্জন, তারও পর বিনয় একে একে সবাই যেভাবে সমস্ত পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিয়েছে তাতে নতুন করে তারা ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছে। সত্যিই তো, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যখন তারা এসেই পড়েছে এখন আর এখান থেকে বেরুবার উপায় নেই। নৌকোয় কালাপানি পাড়ি দেবার চিন্তা নেহাতই পাগলামি। তা ছাড়া নৌকোই মিলবে না। সরকার টিকিট না কাটলে জাহাজেই উঠতে দেবে না। পয়সাই নেই যে টিকিট কাটতে পারবে। ডাঙা নয় যে লটবহর মাথায় চাপিয়ে বউ-ছেলেমেয়ের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে কলকাতায় ফিরে যাবে।

মাখন রুদ্রপাল বলল, আপনেগো হগল কথা হোনলাম (শুনলাম)। যা যা কইলেন হেগুলান (সেগুলো) উড়াইয়া দেওন যায় না। জবর সোমস্যাই। তভু

দ্বিধা এবং ত্রাস যে এখনও পুরোপুরি মাখনরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। তবে আগের সেই জেদ আর নেই, অনেকটাই নরম হয়েছে তারা। এখান থেকে ফিরে যাবার যে প্রচুর সমস্যা, ফিরে গেলে যে সমস্যা শতগুণ বেড়ে যাবে সেসব তাদের মাথায় ঢুকতে শুরু করেছে।

বিনয় উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন, তবু কী?

মাখন বলল, আমরা নিজেগো মইদ্যে ইট্ট পরামশ্য কইরা লই সায়েব। হগলে কী কয় শুইনা আপনেগো কাছে আমাগো মত জানাইয়া দিতে আছি।

তাই জানান–’

মাখন হলধর এবং আরও কয়েকজন বয়স্ক উদ্বাস্তুকে সঙ্গে করে খানিক দূরে ডালপালাওলা বিশাল একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে গিয়ে বসল। প্রায় ঘণ্টাখানেক নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলল। তারপর ফিরে এল।

বিশ্বজিৎরা সবাই ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন। তারা যেন ঠিকই করে ফেলেছেন যে সংকট দেখা দিয়েছে সেটার সুরাহা না হওয়া অবধি এক পাও নড়বেন না।

মাখন বলল, আমরা ভাইবা দ্যাখলাম, কালাপানি ছাইড়া যখন যাইতেই পারুম না তহন আর কী করণ? এহানেই থাইকা যামু। আমাগো বলভরসা আপনেরাই। যেয়াতে (যাতে) বাইচা থাকতে পারি হেইটা দেইখেন সারেরা।

গভীর সহানুভূতির সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে আছি। থাকবও।

সেই সকাল থেকে যে তুমুল বিপত্তি শুরু হয়েছিল, আপাতত তার অবসান। একটানা কয়েক ঘণ্টা টান টান উত্তেজনার পর অনেকটাই স্বস্তি। বিশ্বজিৎরা বেশ আরামই বোধ করলেন।

সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছিল। এই দ্বীপপুঞ্জে রোদ, বাতাস সবই অপর্যাপ্ত। এবং প্রবলও। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। নোনা জলের উত্তাল ঢেউয়ের মাথা থেকে তেজি রোদ ছুরির ফলার মতো ঠিকরে ঠিকরে উঠে আসছে। তাকালে চোখ ঝলসে যায়।

কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ পায়ে পায়ে বিশ্বজিতের কাছে এসে দাঁড়ায়। নিচু গলায় বলে, স্যার, একহান কথা জিগাই

জারোয়াদের নিয়ে যে ঝাটটা তৈরি হয়েছিল সেটা থেকে মুক্ত হয়ে বেশ হালকা লাগছিল বিশ্বজিতের। লঘু সুরে বললেন, জিগাও

সকালের খাওনেরটা (খাবারটা) ভোরেই বানান (তৈরি) অইয়া গেছিল। জারোয়াগো তাফালে কারোরই খাওয়া হয় নাই। অহন কী করা?

উদ্বাস্তুরা, পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মী এবং অফিসাররা, কারও পেটে যে এত বেলা অবধি এক ফোঁটা জলও পড়েনি, সেটা খেয়াল ছিল না বিশ্বজিতের। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই তো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, পৌনে একটা বাজে। এখন আর সকালের খাবার দিয়ে কী হবে? দুপুরের জন্য রান্নাবান্নার কিছু ব্যবস্থা হয়েছে? না কি তোমরা এখানেই সেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছ?

না স্যার, আমি রান্ধনের লোকজনরে পাঠাইয়া দিচ্ছি। মাঝে মইদ্যে গিয়া দেইখাও আইছি। আর আধা ঘণ্টার ভিতরে পাক (রান্না) শ্যাষ হইয়া যাইব।

পরিতোষকে খুব একটা কাজের মানুষ বলে মনে করতেন না বিশ্বজিৎ। তার কর্মকুশলতা সম্পর্কে তার ধারণা তেমন উঁচু ছিল না। সেটা এখন অনেকটাই বদলে গেল। নাঃ, এত ঝামেলা-ঝক্ষাটের মধ্যেও সে আসল কাজটা ভোলেনি। বিশ্বজিৎ খুশি হলেন। বললেন, ঠিক আছে। তারপর বিভাস নিরঞ্জনদের দিকে তাকালেন।–তোমরা রিফিউজিদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সমুদ্র থেকে স্নান করিয়ে আনন। দেখো, কেউ যেন বেশি দূরে। চলে না যায়, বিচের কাছাকাছিই স্নানটা সারে। আসলে পাড়ের কাছে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে জল খুব বেশি হলে কোমরসমান। তারপর থেকে সমুদ্র গম্ভীর হতে শুরু করেছে। সেখানে হাঙরের দঙ্গল হন্যে হয়ে ঘুরছে। রিফিউজিদের নাগালে পেলে ছিঁড়ে খাবে। তাই বিশ্বজিতের এই হুঁশিয়ারি।

নিরঞ্জন বলল, আমার খেয়াল আছে। কাইলও রিফিউজিগো দূরে যাইতে দেই নাই। কিনারের কাছে লামাইয়া (নামিয়ে) ছান (স্নান) করাইয়া আনছি। বলে বিভাস এবং অন্য কয়েকজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে উদ্বাস্তুরা যেখানে জটলা করছিল সেখানে গিয়ে তাড়া লাগায়। –গামছা গুমছা লইয়া হগলটি (সকলে) সমুন্দুরে চলেন। পাক (রান্না) হইয়া গ্যাছে।

এদিকে বিশ্বজিৎ বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে। নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, হইচই শুনে সেই ভোরবেলা রিফিউজিদের কাছে চলে এসেছিলাম। মুখটুখ ধোওয়া হয়নি। এতক্ষণ প্রচণ্ড এক্সাইটমেন্টের মধ্যে ছিলাম। খিদেতেষ্টা কিছুই টের পাইনি। এখন মনে হচ্ছে পেটে হুতাশন জ্বলছে। চলুন, ব্রাশ-ট্রাশ করে স্নান সেরে খেয়ে নিই।

বিনয়ও টের পাচ্ছিল, খিদেটা তার পেটের ভেতর অনবরত ছুঁচ ফুটিয়ে চলেছে। সে হাসল। পরক্ষণে কী মনে পড়তে ব্যগ্রভাবে বলে ওঠে, আসল কাজটাই কিন্তু আজ করা হল না।

আগ্রহের সুরে বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন, কী বলুন তো?

আজ থেকে রিফিউজিদের জমি মেপে বিলি করার কথা ছিল না?

 ছিল তো। কিন্তু কাল রাত্তির থেকে যে হুজ্জত গেছে তাতে আজ জমি বিলির প্রক্রিয়াটা শুরু করা একেবারেই সম্ভব ছিল না। { ইন ফ্যাক্ট ব্যাপারটা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আজকের বাকি দিনটা আর রাত্তিরটা যদি ভালোয় ভালোয় কাটে, কাল থেকে জমি দেওয়া হবে।

একটু চুপচাপ।

তারপর বিশ্বজিৎ বললেন, ভেবেছিলাম, আজ পিসফুলি যদি জমি ডিস্ট্রিবিউশনটা আরম্ভ করা যেত, কাল সকালে পোর্ট ব্লেয়ারে? ফিরতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও দু-একদিন এখানে থেকে যেতে হবে। ওদিকে পোর্ট ব্লেয়ারে অনেক কেস পেন্ডিং রয়েছে। আমি না গেলে সেগুলোর হিয়ারিং বা জাজমেন্ট সব বন্ধ থাকবে। কিন্তু কী আর করা। এখানকার ব্যাপারটা ভীষণ আর্জেন্ট। এটাকে টপ প্রায়োরিটি দিতে হবে।

বিশ্বজিৎ রাহা যে শুধু আন্দামানের রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের সর্বেসর্বাই নন, এখানকার একজন ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটও সেটা বিনয় ভালো করেই জানে। বিশ্বজিৎ এই জেফ্রি পয়েন্টের সেটলমেন্টে আরও কটা দিন থাকবেন, তার সঙ্গ; পাওয়া যাবে, এতে খুশিই হল বিনয়। সে উত্তর দিল না।

বিশ্বজিৎ একটু ভেবে এবার বললেন, আমার একটা অনুরোধ আছে।

মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল বিনয়।–বলুন

জারোয়ারা যে কাল রিফিউজিদের ওপর হামলা করতে এসেছিল, কাইন্ডলি আপনার রিপোর্টে এটা লিখবেন না। বুঝতেই পারছেন যে রিফিউজিরা মেন ল্যান্ডে রয়েছে, এই আইল্যান্ডে তারা আসতে চায় না। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো তাদের সমানে উসকে চলেছে। জারোয়াদের খবরটা বেরলে একটা রিফিউজিকেও আন্দামানের জাহাজে তোলা যাবে না। পার্টিগুলো এই নিয়ে সারা ওয়েস্ট বেঙ্গল, বিশেষ করে কলকাতা তোলপাড় করে ফেলবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বিনয়। তারপর দ্বিধার সুরে বলে,

তার দ্বিধা বা অস্বস্তির কারণটা আন্দাজ করতে পারছিলেন বিশ্বজিৎ। বললেন, একজন অনেস্ট সাংবাদিক হিসেবে যা ঘটেছে। সেটা পাঠককে আপনার জানানো দরকার। কিন্তু

 বিনয় উদগ্রীব তাকিয়ে থাকে। কোনও প্রশ্ন করে না।

বিশ্বজিৎ বললেন, আন্দামানের সঙ্গে বাঙালি উদ্বাস্তুদের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। কাইন্ডলি এমন কিছু লিখবেন না যাতে এই আইল্যান্ডগুলো তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এখানকার জমি খুবই ফার্টাইল। প্রত্যেকটা ফ্যামিলি সাত একর করে জমি পাবে। সেটা কি সহজ ব্যাপার?

বিনয় এবারও কিছু বলে না। নীরবে শুনতে থাকে।

বিশ্বজিৎ থামেননি। –ওয়েস্ট বেঙ্গলে সরকারি রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে যারা রয়েছে তাদের প্রতি মাসে কিছু কিছু ক্যাশলে দেওয়া হয়। ক্যাশড়োল তো এক রকম ভিক্ষেই। ভিক্ষের ওপর এত মানুষ সারা জীবন বেঁচে থাকতে পারে? সেটা কি অ্যাট অল সম্মানজনক? তা ছাড়া সারা জীবন তো ডোল পাওয়া যাবে না। একদিন না একদিন গভর্নমেন্ট তা বন্ধ করে দেবে! রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে চিরকাল থাকতেও দেবেনা। তখন কী হবে এদের? কী ভবিষ্যৎ অদের ছেলেমেয়েদের? তাই বলছিলাম আন্দামানে রিফিউজিদের আসা যাতে বন্ধ না হয় সেটা দেখা দরকার। মানে-

বিনয় জিগ্যেস করল, মানে?

একটা সম্পূর্ণ নতুন, অচেনা জায়গায় সেটেলমেন্ট গড়ে তোলার কাজ চলছে। ছোটখাট কিছু প্রবলেম তো দেখা দেবেই। বড় স্বার্থের জন্যে সেসব নিয়ে বেশি হইচই না করাই ভালো। ইগনোর করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

বিনয় জানে, বিশ্বজিৎ মনেপ্রাণে চান আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ বাঙালিদের দ্বিতীয় স্বদেশ হয়ে উঠুক। সীমান্তের ওপারে অবারিত নীলাকাশ, শত জলধারায় বহমান অজস্র নদী, সোনালি শস্যে ভরা আদিগন্ত ধানের খেত, ফুল পাখি বৃক্ষলতা ইত্যাদি মিলিয়ে স্বপ্নের মতো যে মায়াবী ভূখণ্ডটি ফেলে তাদের চলে আসতে হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে ঠিক তেমনটিই তারা নিজেদের হাতে সৃষ্টি করুক। এখানকার সেটলমেন্টগুলোর সঙ্গে গভীর আবেগে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন।

বিশ্বজিৎকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে বিনয়, ততই তার শ্রদ্ধা বেড়ে চলেছে। ইচ্ছা করলে তিনি হিল্লি-দিল্লি কলকাতা বা মুম্বইতে পোস্টিং নিতে পারতেন। বিশাল বিশাল মেট্রোপলিসের অঢেল আরাম বা স্বাচ্ছন্দ্যের কথা তিনি ভাবেননি। সর্বস্ব খুইয়ে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলোর জন্য এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপপুঞ্জে পড়ে আছেন।

বিনয় গাভীর গলায় বলল, জারোয়ারা মাঝরাতে হানা দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কারও তো কোনও ক্ষতি হয়নি। সবাই বেঁচে আছে। আমার রিপোর্টে এই ঘটনাটা সম্বন্ধে একটা লাইনও লিখব না।

বিশ্বজিতের মুখটা আলো হয়ে উঠল। তিনি সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্ত। আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় কোনও রকম বাধা হলে সেটা যেন তার নিজস্ব পরাজয়।

এক সময় দুজনে তাদের ঘরে চলে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *