২.০২ উদ্দাম জঙ্গলের ভেতর

উত্তর দিকে অনেকটা দূরে চাপ বাঁধা, ঝাপসা, উদ্দাম জঙ্গলের ভেতর ড্রামের আওয়াজ ক্রমশ আরও তীব্র হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে ভেসে আসছে বেশ কিছু মানুষের হইচই। তারা একসঙ্গে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছে, এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

অত দূরের ওই জঙ্গলে এত রাতে কারা ড্রাম পেটাচ্ছে, কিছুই আন্দাজ করতে পারল না বিনয়। অজানা শঙ্কায় তার বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল।

উত্তর দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিশ্বজিৎ। পলকহীন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বিনয়। নিচু গলায় জিগ্যেস করল, কারা ড্রাম বাজাচ্ছে?

বিশ্বজিৎ তার দিকে তাকালেন না। দুরে চোখ রেখে বললেন, বুশ পুলিশেরা।

ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। বিনয় জানতে চাইল, বুশ পুলিশ বলতে?

এবার চোখ ফেরালেন বিশ্বজিৎ। দুরের দুর্ভেদ্য বনভূমির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ওখানে পেরিমিটার রোড় রয়েছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে ওটা পুব দিকে চলে গেছে।

বিনয়ের কাছে ব্যাপারটা গুলিয়ে গেল। সে জিগ্যেস করে, এ জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা আছে নাকি?

না না—

 বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে দিলেন, পেরিমিটার রোড নামে রাস্তাটা পুরোপুরি কাল্পনিক। ওটা মোটামুটি ভেবে নেওয়া হয়েছে। জঙ্গলে সোজা একটা লাইন ধরে দেড়-দুশো গজ দূরে দূরে তিরিশ-চল্লিশ ফিট উঁচু উঁচু টঙ বানিয়ে দিনরাত পালা করে তিন শিফটে পুলিশের একটা দল পাহারা দেয়। কেননা পেরিমিটার রোডের ওধারে আরও গভীর অরণ্যে হিংস্র জারোয়ারা থাকে। মাঝে মাঝেই তারা এ ধারের পুরনো পেনাল কলোনি আর যেসব নতুন রিফিউজি সেটলমেন্ট বসছে, সেখানে হানা দেয়। ওরা হয়তো মনে করে আন্দামানের সব জঙ্গলের অধিকার একমাত্র তাদেরই। সেখানে অন্য কেউ এসে থাকুক, একেবারেই তা চায় না। এই সব। অনুপ্রবেশকারীকে তাড়াতেই তাদের অবিরত সশস্ত্র হানাদারি। ওদের গতিবিধির ওপর সর্বক্ষণ নজর রেখে চলেছে বুশ পুলিশ। তির-ধনুক বা অন্য ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যখনই তারা সেটলমেন্টগুলোর দিকে আসতে থাকে, ড্রাম পিটিয়ে, হল্লা করে বুশ পুলিশ সবাইকে সতর্ক করে দেয়। খুব সম্ভব আজ জারোয়াদের গতিবিধি লক্ষ করে তারা ড্রাম বাজিয়ে চলেছে।

ধনপত কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে বলল, আগে যা কর দেখুঙ্গা।

বিশ্বজিৎ বললেন, দেখ–

মশাল হাতে দু’জন সঙ্গীকে নিয়ে ধনপত তক্ষুনি উত্তর দিকে জোর জোরে পা চালিয়ে দিল।

নয়া সেটলমেন্টের খানিকটা অংশ বিশাল বিশাল গাছ কেটে, ঝোঁপঝাড় নির্মূল করে বন বিভাগের কর্মীরা সাফ করে রেখেছিল। সে আর কতটুকু এলাকা! তারপর আন্দামানের হাজার বছরের প্রাচীন অরণ্য অপার রহস্য আর ভয়াবহতা নিয়ে আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে।

ধনপতদের তিন জনের হাতে তিনটে মশাল। ফাঁকা জায়গাটা তারা সবে পেরিয়েছে, তখনই দেখা গেল আট-দশজন হট্টাকট্টা চেহারার বুশ পুলিশ, হাতে বন্দুক, জঙ্গল ভেদ করে ঊৰ্ধশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে বেরিয়ে এসে ধনপতদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের চোখেমুখে উত্তেজনা, ত্রাস। ধনপতদের সঙ্গে ওরা কিছুক্ষণ কথা বলল, তার একটা বর্ণও শুনতে পেল না বিনয়রা।

একটু পরেই দেখা গেল বুশ পুলিশের দলটাকে নিয়ে ধনপতরা ফিরে এল।

বুশ পুলিশরা প্রায় সবাই বিহারি আর পাঞ্জাবের লোক। চাকরি নিয়ে দুর্গম দ্বীপে চলে এসেছে।

বিশ্বজিৎ ওদের চেনেন। পুলিশের দলটাও তাকে খুব ভালো করেই চেনে। জিগ্যেস করলেন, ডিউটি ছেড়ে তোমরা পালিয়ে এলে কেন?

বিনয় লক্ষ করল, বিশ্বজিতের কপাল কুঁচকে গেছে। পুলিশরা। ঘাঁটি ছেড়ে চলে আসায় তিনি খুবই বিরক্ত।

পুলিশরা হাইমাই করে তড়বড়িয়ে একসঙ্গে বলতে শুরু করল, ফলে বিরাট এক হট্টগোলের সৃষ্টি হল।

গলা চড়িয়ে ধমকের সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, হল্লাগুল্লা মাত কর। এক সাথ নেহি– একজন সিপাহি শিখের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, তুম বোলো। আইস্তা আইস্তা। হড়বড়াকে নেহি।

শিখ জানাল, তারা পেরিমিটার রোডে টঙের মাথায় বসে। অন্যদিনের মতো জারোয়া এলাকার দিকে নজর রাখছিল। আচানক দেখতে পেল দূর থেকে জংলিরা তির-ধনুক ইত্যাদি মারাত্মক হাতিয়ার নিয়ে সেটলমেন্টের দিকে আসছে। নয়া আদমিরা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের উৎখাত মানুষেরা বনজঙ্গল কেটে এখানে কলোনি বসাতে এসেছে তা তারা টের পেয়ে গেছে। এই এলাকায় বাইরের লোকজন এসে পাকাপাকিভাবে থাকুক সেটা তাদের আদৌ পছন্দ নয়। তাই জারোয়াদের মতলব ছিল মধ্যরাতে হামলা চালিয়ে উদ্বাস্তুদের ভাগিয়ে দেবে।

বুশ পুলিশ জারোয়াদের দেখামাত্র ড্রাম পিটিয়ে হল্লা বাধিয়ে  সেলটমেন্টের সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়,  ড্রামের আওয়াজ-টাওয়াজ কেউ যদি শুনতে না পেয়ে থাকে তাই শিখেরা কয়েকজন এখানে দৌড়ে এসেছে।

এদিকে লম্বা লম্বা ব্যারাকগুলোতে উদ্বাস্তুরা মড়ার মতো অসাড়ে ঘুমচ্ছিল। হইচই শুনে তাদের চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। বাচ্চাকাচ্চা ছেলেবুড়ো সুদ্ধ শ’পাঁচেক মানুষ হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে আসে।  

বিনয় লক্ষ করল, মশালের আলোয় তাদের তিনদিক ঘিরে উদ্বিগ্ন মানুষের সারি সারি মুখ। ভিড়ের ভেতর থেকে হলধর সূত্রধর, মাখন রুদ্রপাল, এমনি কয়েকজন ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে আসে।

 দূরে বুশ পুলিশের টঙগুলো থেকে অবিরাম ড্রামের গম্ভীর, হাড়-কাঁপানো শব্দ ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে অরণ্য ভেদ করে আসছে হইচই।

 হলধর জিগ্যেস করে, মইদ্য রাইতে ঢাকের বাদ্যি ক্যান ছুটোবাবু? মেলা (অনেক) মাইনষে চিল্লাইতেও আছে।

মাখন রুদ্রপাল বলল, এই অচিন দ্যাশে ডরে বুক কাপে ছুটোবাবু। কুনো বিপদ কি ঘটল?

আচমকা বর্মি চেইনম্যানদের একজন বলে ওঠে, জারোয়া আতা হ্যায়। উসি লিয়ে হেঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। বহুকাল আন্দামানে থাকার কারণে সে এবং তার মতো সব বর্মি এবং ফারেন হিন্দুস্থানিটা রপ্ত করে ফেলেছে। আঠারোশো সাতান্নয় মহাবিদ্রোহের পর যুক্তপ্রদেশ থেকে যে বিপ্লবী সিপাহিদের আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল তখন থেকেই এখানকার মুখের বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দুস্থানি হিন্দি আর উর্দুর মিশেলেও এই ভাষাটা সবাই বলে থাকে–সে বর্মিই হোক বা কারেন, কিংবা বাঙালি তামিল অর্থাৎ মারাঠি–তফাৎ ভারতের সমস্ত প্রদেশের মানুষও।

 এতক্ষণ পাঁচশো মানুষের বিশাল জনতার মুখে চোখে ছিল উৎকণ্ঠা। লহমায় সেখানে আতঙ্ক ফুটে বেরুল। শোরগোল জুড়ে দিল তারা।

গরমেন (গভর্নমেন্ট) আমাগো মারতে লইয়া আইছে এই আন্ধারমান দ্বীপে।

সমুন্দুরে ঝড় তুফানে আছাড়িপিছাড়ি খাইছি। টেউগুলান আকাশে তুইলা পাতালে নামাইয়া আমাগো দুরমুশ করতে করতে হাড্ডিগুড্ডি চুর চুর কইরা ছাড়ছে। হের পরেও বাইচা আছিলাম। কিন্তু জারোর (জারোয়ার) হাত থিকা নিস্তার নাই। অরা আমাগো নিকাশ কইরা ছাড়ব।

হলধর কঁপা কাপ গলায় বিনয়কে বলল, ‘রস’ দ্বীপ থিকা ইস্টিমারে পুট বিলানে (পোর্ট ব্লেয়ারে) আসনের সোময় জারোগো কথা আপনেরে কইছিলাম। পাকিস্থানে রাজাকার, আর পশ্চিমা মুসলমানগো হাত থিকা কুনোরকমে বাপ-মায়ের দেওয়া পরান লইয়া ইন্ডিয়ায় আইছিলাম। আন্ধারমানে আমাগো নিঘঘাত মরণ। আপনের উপর ভরসা কইরা এই আমরা কই (কোথায়) আইলাম!

বিনয় বিব্রতভাবে কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, আচমকা ডান ধারে ভিড়ের শেষ মাথায় যে উদ্বাস্তুরা দাঁড়িয়ে ছিল, তুমুল হুলস্থূল বাধিয়ে দিল। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে উন্মাদের মতো বলতে লাগল, এইহানে আমরা থাকুম না। আমাগো এই যমের পুরী থিকা অন্য হানে লইয়া যান।

বয়স্ক পুরুষগুলোর হইচই শুনতে শুনতে নানা বয়সের মেয়েমানুষ এবং বাচ্চারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তারা ডাক ছেড়ে প্রচণ্ড কান্না জুড়ে দিল।

 চিৎকার এবং কান্নার একটানা শব্দ জেফ্রি পয়েন্টের পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে মাঝরাতের আবহাওয়াটাকে উতরোল ফুরে তোলে।

 ড্রামের আওয়াজে এবং জারোয়াদের হাতিয়ার হাতে দূরের ৮ জঙ্গল থেকে ধেয়ে আসার খবর শুনে বিশ্বজিৎরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। উদ্বাস্তুদের কান্না এবং চেঁচামেচিতে তারা একেবারে হকচকিয়ে যান।

হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে বিশ্বজিৎদের খানিকটা সময় লাগল। তারপর বিশ্বজিতের সঙ্গে পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা উদ্বাস্তুদের বোঝাতে লাগল, তাদের কোনও ভয় নেই। বুশ পুলিশ আছে, পুনর্বাসন এবং কাছাকাছি বন বিভাগের অগুনতি কর্মী আর ফরেস্ট গার্ড রয়েছে, তেমন বুঝলে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আরও পুলিশ আনা হবে। জায়োরারা উদ্বাস্তুদের চামড়ায় একটি আঁচড় কাটতে পারবে না। কিন্তু কে কার কথা শোনে! তাদের কান্না এবং চিৎকার ক্রমশ আরও উদ্দাম হয়ে উঠতে থাকে।

ধনপত বিশ্বজিতের খুব কাছে এসে চাপা গলায় বলে, এ আদমিলোক কোনও কথা শুনবে না। হুকুম দেন তো থামাতে কোসিস করি।

বিশ্বজিৎ বললেন, দেখ চেষ্টা করে।

ধনপত উদ্বাস্তুদের দিকে সরে গিয়ে গলার স্বর শেষ পর্দায় তুলে হুঙ্কার ছাড়ে, রিফুজলোগ বিলকুল চোপ। রোনা (কাঁদা), চিল্লানা বন্ধ কর। বিনয় আগেই শুনেছে উনিশ বছর আগে তিন তিনটি খুন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি হিসেবে কালাপানিতে সাজা খাটতে এসেছিল ধনপত। এই মধ্যরাতে তার ভেতর থেকে সেই দুর্ধর্ষ কয়েদিটি হঠাৎই বেরিয়ে এসেছে। তার হাঁকানিতে উদ্বাস্তুদের উতরোল কান্নাকাটি লহমায় মিইয়ে যায়। কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, জারো বাইর হইয়া আইছে। অহন আমাগো কী অইব?

ধনপত এবার নরম গলায় বলল, ডরো মাত। আমরা তো আছি। বারিকে (ব্যারাকে) চলে যাও। আমরা জংলি আদমিদের সামলাব।

উদ্বাস্তুরা আর দাঁড়ায় না; যে যার ব্যারাকে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ত্রাস তাদের যতটা, কৌতূহল তার চেয়ে লেশমাত্র কম নয়। ব্যারাকে ঢুকলেও দরজা সামান্য ফাঁক করে অনেকে রুদ্ধশ্বসে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সশস্ত্র জারোয়ারা সেটলমেন্ট পর্যন্ত এসে পড়বে কি না তাই নিয়ে তাদের প্রচণ্ড শঙ্কা।

ওদিকে অদৃশ্য পেরিমিটার রোড থেকে বনভূমি, আকাশ, পাহাড় খান খান করে যেন ড্রামের আওয়াজ আরও আরও প্রবল হয়ে উঠছে। আন্দাজ করা যাচ্ছে জারোয়ারা নিশ্চয়ই গভীর অরণ্যে তাদের বাসস্থানে ফিরে যায়নি।

বিশ্বজিৎ থেকে চেইনম্যান ধনপত, ক’জন বুশ পুলিশ থেকে পরিতোষ, নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের সব কর্মী সেটলমেন্টের ফাঁকা এলাকাটার ওধারে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন। প্রায় দমবন্ধ করে নিঃশব্দে।

আচমকা চোখে পড়ল সাফ করা জায়গার ওধারের জঙ্গল থেকে আবছা ছায়ামূর্তির মতো একদল আধা উলঙ্গ কালো মানুষ বেরিয়ে এল। আফ্রিকার নিগ্রোয়েডদের মতো কালো কালো চেহারা, পাঁচ ফিটের মতো হাইট, হাতে তির-ধনুক এবং অন্য সব আদিম অস্ত্র।

অনেকগুলো মশাল জ্বলছিল ঠিকই কিন্তু তার আলো অতদূর অবধি পৌঁছায়নি। তবু কুয়াশা থেকে চুঁইয়ে আসা ঝাপসা আলোয় তাদের মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই জারোয়া।

এর আগে কখনও জারোয়া দেখেনি বিনয়। তাদের কথা শুনেছে মাত্র। সামনাসামনি তাদের আসতে দেখে বুকের ভেতর। ঠান্ডা শিহরন খেলে যায় তার।

জারোয়াদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দক্ষিণ আন্দামানের এই অঞ্চলে উড়ে আসা আগন্তুকদের তাড়াবার জন্য, তারা মাঝরাতে হানা দিয়েছে।

বিশ্বজিৎ সকলকে সতর্ক করে দিলেন, খুব সাবধান। জারোয়ারা যেন এখানে আসতে না পারে।

একজন বুশ পুলিশ বলল, জরুর জংলি লোগোকো রুখ দুঙ্গা

 সেই শিখ পুলিশটি বলল, সাহাব, আপকো হুকুম হো যায় তো, ফায়ার করে দিই। দো-চার জংলি মর যায়গা, ব্যস কাম ফতে। ও হারামিরা আর কভি ইহা আনেকো ভরসা নেহি পায়েগা। ফায়ার করু?

বুশ পুলিশটি গুলি বন্দুক ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। এদিকে সরকার থেকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ভারতবর্ষের পাহাড়বাসী জনজাতি, আদিবাসী, কারও গায়ে একটি আঁচড় কাটা চলবে না। নিজস্ব পরিবেশে তাদের নিজের মতো করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কত ধরনের মানুষ রয়েছে এই সুবিপুল ভূখণ্ডে। তাদের যেভাবেই হোক সংরক্ষণ করতে হবে। এই সব ছোট বড় অসংখ্য জনগোষ্ঠী নিয়েই তো দেশ। অন্য সবার মতো তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এরা শেষ হয়ে গেলে বহুবর্ণময়। বহুভাষাভাষী ভারতবর্ষের জনজীবন তার সুবিশাল মহিমা হারিয়ে ফেলবে। যে যেভাবে আছে সে সেইভাবেই থাকুক, এই হল সরকারের ঘোষিত নীতি। পূর্ব পাকিস্তানের আগন্তুকদের জন্য বনবাসী জারোয়ারা উৎখাত হয়ে যাক–এটা কোনওভাবেই কাম্য নয়। সম্পূর্ণ বেআইনিও।

বিশ্বজিৎ আঁতকে উঠলেন, না না, ওদের গায়ে গুলি চালানো চলবে না।

শিখ জিগ্যেস করল, তাহলে জংলিদের রুখব কী করে?

একটু চিন্তা করে বিশ্বজিৎ বললেন, আকাশের দিকে বন্দুক তুলে তোমরা কয়েকবার ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার কর। মনে হয় ফাঁকা আওয়াজে কাজ হবে।

শুধু শিখটিই নয়, যে ক’জন বুশ পুলিশ নয়া সেটলমেন্ট অবধি চলে এসেছিল তারা সবাই মাথার ওপর বন্দুক উঁচিয়ে পর পর ফায়ার করতে লাগল।

লহমায় ম্যাজিকের মতো কাজ হল। জেফ্রি পয়েন্টের আকাশ এবং বনভূমির নিরেট স্তব্ধতাকে চৌচির করে মুহুর্মুহু যে শব্দ হতে জঙ্গলের আদিম বাসিন্দারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, খুব সম্ভব অরণ্যের গোপন অন্তঃপুরে থাকলেও বন্দুকের মহিমা তারা জানে।

কালো কালো ঝাপসা যে মূর্তিগুলো দেখা গিয়েছিল, লহমায় জঙ্গলের ভেতর তারা উধাও হয়ে যায়। এক ফোঁটা রক্তপাত হল না, কিন্তু কৌশলে কাজ হাসিল হয়ে গেল।

বুশ পুলিশের দলটা জানতে চাইল পেরিমিটার রোডের টঙে তারা ফিরে যাবে কি না।

বিশ্বজিৎ বললেন, আরও কিছুক্ষণ থাকো। জাবোয়ারা ভীষণ একরোখা। তেমনি হিংস্র। খুব সহজে এখানে সেলটমেন্ট বসাতে দেবে না। বার বার এসে তারা হামলা চালাতে চাইবে।

আরও ঘন্টাখানেক স্নায়ু টান টান করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বিশ্বজিৎরা। তারপর সবাইকে হুঁশিয়ার থাকতে বলে বুশ পুলিশের দলটাকে পেরিমিটার রোডে পাঠিয়ে বিভাস, নিরঞ্জন, পরিতোষ, ধনপত এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের জিগ্যেস করেন, তোমাদের এখানে ক্যানেস্তারা আছে?

পরিতোষ জেফ্রি পয়েন্টের কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সি এ বিভাস নিরঞ্জনরা আট-দশ দিনের বেশি এখানে থাকবে না। তাদের পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে যেতে হবে। কিছুদিন পর ফের তারা উদ্বাস্তু আনতে কলকাতায় যাবে। মুখের কথা খসালেই তো মেনল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তু আনা যায় না। তার জন্য অনেক তোড়জোড় করতে হয়। জেফ্রি পয়েন্টের সব ঝক্কি সামলাতে হবে পরিতোষকে। অবশ্য তার সঙ্গে ধনপতের মতো জবরদস্ত একজন কর্মী ছাড়াও রিহ্যাবিলিটেশনের আরও অনেকেই রয়েছে। তবু জারোয়াদের জন্য দুশ্চিন্তাটা থেকেই যাচ্ছে বিশ্বজিতের।

পরিতোষ বলল, না স্যার

যত তাড়াতাড়ি পার, ইনডেন্ট করে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে কুড়ি-পঁচিশটা ক্যানেস্তারা আনিয়ে নিও। জারোয়ারা এদিকে আসুক বা না-আসুক, সন্ধের পর থেকে কয়েক বার ৮ ক্যানেস্তারাগুলো পিটিয়ে আওয়াজ করবে। ওদিকে বুশ পুলিশ আর তাদের ভ্রাম তো রয়েছেই। বেশি আওয়াজ হলে জারোয়ারা সহজে এদিকে ঘেঁষবে না।

পরিতোষ ঘাড় কাত করে জানায়, বিশ্বজিৎ যা বলেছেন অবিলম্বে তা করা হবে।

যাও, এবার গিয়ে শুয়ে পড়। আশা করি, আজ রাত্তিরে আর কোনও উৎপাত হবে না।

সবাই যে যার আস্তানায় চলে গেল। বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে লক্ষ করলেন, উদ্বাস্তুরা কেউ তাদের লম্বা লম্বা ব্যারাকে শুয়ে পড়েনি। বন্ধ দরজার তলা দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। তার মানে ভেতরে লণ্ঠন জ্বলছে।

অনেকের চাপা গলার স্বর ব্যারাকগুলোতে শোনা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে জারোয়াদের এই অতর্কিত হামলাটা তাদের হতচকিত এবং সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। নির্ঘাত তাই নিয়ে তাদের কথাবার্তা চলছে। বাকি রাতটা নিশ্চয়ই ওরা ঘুমবে না। ভয়ে, উত্তেজনায় কাটিয়ে দেবে।

উদ্বাস্তুদের কথাবার্তা শোনার ভীষণ আগ্রহ ছিল বিনয়ের। কিন্তু সে সুযোগ পাওয়া গেল না। বিশ্বজিৎ তাকে দাঁড়াতে দিলেন না। সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, শুয়ে পড়ুন। ভোর। হতে দু-আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় নেই। ঘুমন। নইলে শরীর খারাপ হবে।

বিনয় শুয়ে পড়ল ঠিকই। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। একটা প্রবল দুর্ভাবনা তার মাথায় চেপে বসেছে যেন।

এই যে ছিন্নমূল মানুষের দলটা কাল এস এস মহারাজা’ জাহাজে আন্দামানে এখানে এসে পৌঁছেছে, সেটা পুরোপুরি স্বেচ্ছায় নয়। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল তাদের মনে। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো মিছিলে স্লোগানে অবিরল চিৎকার করে গেছে, উদ্বাস্তুরা যেন আন্দামানে না আসে, পশ্চিমবঙ্গেই পুনর্বাসনের দাবিতে অনড় থাকে।

সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের রিহ্যাবিলিটেশন দপ্তর এবং পশ্চিমবাংলার ত্রাণ বিভাগের অফিসাররা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের অনেকটা নরম করেছিলেন। জানিয়েছিলেন উদ্বাস্তুদের জন্য বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে সোনায় মোড়া ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা যা ফেলে এসেছে তার বিশগুণ পাওয়া যাবে এখানে এলে।

এই বোঝনোর কাজটা বিনয়ও কম করেনি। সেও উদ্বাস্তুদের প্রচুর ভরসা দিয়েছিল। তাই এদের, বিশেষ করে কাল যারা এসেছে তাদের সম্বন্ধে কিছু দায় তারও রয়েছে। অন্তত সেটাই সে মনে করে।

রস আইল্যান্ড থেকে লঞ্চে পোর্ট ব্লেয়ারে আসার সময় হলধর সূত্রধর, মাখন রুদ্রপালরা এভাবে তাকে জারোয়াদের কথা বলেছিল। বিনয় তাদের অনবরত সাহস জুগিয়ে গেছে। জারোয়ারা তাদের মতো জঙ্গলে থাকে। হয়তো নতুন লোক দেখলে ছুটকো-ছাটকা ঝঞ্ঝাটও বাধাতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোকেরা আছে। যত হিংস্রই হোক, জঙ্গলের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এসে জারোয়ারা তাদের লেশমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না।

কিন্তু আসলে কী দাঁড়াল? আজ বিকেলে উদ্বাস্তুরা জেফ্রি পয়েন্টে সেটলমেন্ট বানাতে এসেছে, আর আজই মধ্যরাতে কিনা জারোয়ারা হানা দিয়ে বসল।

ত্রাণ শিবিরে বা শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে দিনের পর দিন কাটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উচ্ছেদ হয়ে আসা মানুষগুলোর জীবনশক্তি ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে এসেছে; মনোবল গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। আর প্রথম দিনই সশস্ত্র, তিরন্দাজ জারোয়াদের হামলায় তারা নিশ্চয়ই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। জেফ্রি পয়েন্টে এমন একটা অভ্যর্থনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ভয়ে, আতঙ্কে তারা একেবারে বিস্ত।

ধনপত এই মানুষগুলোকে ধমকে ধামকে ব্যারাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আজকের রাতটা কাটলে তারা কী করে বসবে, সেই চিন্তাটা কাটার মতো বিঁধে বিনয়ের মাথায় বিঁধে রইল।

অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ খেয়াল হল পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা, সব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বুশ পুলিশের ভ্রামগুলো এখন আর বাজছে না। কোথাও কোনও শব্দ নেই। তার মানে জারোয়ারা দুর্গম বনভূমিতে তাদের বাসস্থানে ফিরে গেছে।

আর ঠিক এই সময় দু’চোখ জুড়ে আসতে লাগল বিনয়ের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *