৫৯. জখম চাঁদের নিচে

হুরমতুল্লার মতিগতি ফুলজানের ভালো ঠেকে না। ভাগের ধান অনেকটা সে আছে বেচার তালে। মনে হয় মণ্ডলের গোলাতে সব ধান তুলে দিয়ে নগদানগদি টাকা নিয়ে বুড়া সোজা হাঁটা ধরবে সোনামুখির দিকে। নবিতনের শ্বশুরের হাতে দোকান সাজাবার টাকা মিটিয়ে দিয়ে পোড়াদহ মেলার সময় পেয়ারের বেটিকে নাইওর নিয়ে আসার অনুমতিটা আদায় করবে। ছোটো বোন ফালানিটা সেই কবে গেছে নবিতনের শ্বশুরবাড়ি, তাকে বাড়ি আনার ব্যাপারে বুড়া কিন্তু চুপচাপ। সেখানে নাকি সে মহা সুখে থাকে। তা তাদের এতো পয়সা, বৌয়ের বোনকেও রাখে দুধেভাতে, আর বৌয়ের বাপের কাছ থেকে বেটার দোকান সাজাবার খরচ রেয়াদ করে না। ইজ্জতের দামাদের দোকান সাজাবার ব্যবস্থা করলে কয়েকটা মাস যে গুষ্টিশুদ্ধ তাদের কাউনের চালের ভাত খেতে হবে, এমন কি মাসখানেক আধপেটা কাটাতে হবে সেদিকে হুরমতুল্লার কি কোনো খেয়াল আছে?

তা বাপ চাইলো আর ফুলজান তাই হতে দিলো? আজ তো তার জমিতে আসার কথাই ছিলো না। কিন্তু সারাটা দিন বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে হুরমতুল্লা মেলা আসিচ্ছে, বেটিটাক ঘরত আনবার পারমু না বলে বিলাপ করতে থাকলে ফুলজানের আর সহ্য হয় না। তাই এখন সে জমিতে এসেছে খন্দের পরিমাণ আন্দাজ করতে। তারপর দেখা যাবে বুড়া চুপচাপ ধান বেচে কী করে?

সন্ধ্যার ঠিক আগে ফুলজান এসে দেখে, মোষের দিঘির উঁচুপাড়ে তালগাছতলায়। উইটিবিটা পেছনে রেখে নামাজ পড়ছে হুরমতুল্লা। সেজদা দিয়ে অনেকক্ষণ সে মাথা না তুললে ফুলজানের বুক ঢিপঢিপ করে : বাপজান তার বেহুঁশ হয়ে গেলো না তো? আজ দুপুর থেকে তো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েই ছিলো, পেয়ারের বেটির জন্যে বিলাপ করার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার পেচ্ছাব করতে ওঠা ছাড়া আসরের ওকত পর্যন্ত তো সে শুয়েই কাটিয়েছে। বাপজানের আবার এদিক ওদিক কিছু হলো না তো?-কিন্তু সেজদা থেকে। উঠে হুরমতুল্লা ফের সেজদা দিলে বাপের শারীরিক সুস্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলে ফুলজানের গা জ্বলে : বুড়ার আবার নামাজ বন্দেগি কিসের? সেজদায় উপুড় হয়ে কি দোয়া পড়ে, না নবিতনের শ্বশুরের জন্যে টাকা জোগাড়ের ফন্দি আঁটে?

মোষের দিঘির উঁচুপাড়ে তালতলায় নামাজ পড়ে হুরমতুল্লা, আর জমির ধারে ধারে ঘোরে ফুলজান। পিছে পিছে হাঁটে তার বেটি। চারদিকে ধানজমি, পাকা আধপাকা আমনের খেত। প্রায় সব জমির ধানে পুরুষ্ট শীষ। দেখে দেখে চোখ ভরে যায়। তবে তাদের জমিতে খন্দের পরিমাণ আন্দাজ করতে হবে হুরমতুল্লার সঙ্গে, তার মুখ দিয়ে ধানের পরিমাণ কতো হতে পারে তা স্পষ্ট শুনে নিতে হবে। তবেই না বুড়া এদিক ওদিক করতে ভয় পাবে।

মেয়েকে কোলে তুলে আলের ওপর দিয়ে হেঁটে মোষের দিঘির ধারে গিয়ে দেখে, দিঘির পাড়ের ওপর হুরমতুল্লা নাই। নামাজ পড়ে সে এর মধ্যেই কোথায় গেলো? তার পাঁচুন পড়ে আছে দিঘির ঢালে পুবের জমির পাশে। তা হলে? বাপজান বোধহয় জিরাতে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবে।

জমির পাশে বসে জিরাতে ইচ্ছা করে ফুলজানেরও। শরীরটা বড়ো অস্থির লাগে। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। গায়ে এন্ডির চাদরটা জড়ালে গরম লাগে, আবার খুলে ফেললে ২ শীত শীত করে।

এর ওপর তার বেটির উৎপাত। মায়ের মাথায় ছোটো হাতের চাপ দিয়ে ভাত খাওয়ার লালচ জানাতে শুরু করেছে বেলা ড়ুতেই। চোখ গরম করে ফুলজান তার দিকে তাকালে সে বলে, ভাত খামো।

দুপুরে আজ ফুলজান কচুর শাক তুলেছে মেলা, কচুর শাকের ভেতর কাউন দিয়ে ঘাটি করেছে একটা। দুপুরে খেয়েছে, রাতের জন্যেও আছে। তা দুপুরে অনেকদিন পর কচুর শাকের নরম ঘাঁটি পেয়ে সবাই অনেক খেয়েছে, এত তাড়াতাড়ি তো খিদে পাওয়ার কথা নয়। বেটির ওপর ফুলজানের রাগ হয়। সে আর একবার ভাত খামো বলতেই ফুলজান তার পাছায় দুটো ও দুই গালে গোটা তিনেক চড় মারে। আরো চড় মারতে তার হাত উঠেছিলো, কিন্তু মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছোটে মোষের দিঘির উঁচু পাড়ের দিকে। এই বুঝি তালতলায় উইঢিবির দিকে চললো। ওখান থেকে হুঁড়িটা বুঝি পড়েই গেলো পুকুরের পানিতে। ফুলজানও ছুটলো চড়াই ভেঙে। বেটির তার কয়দিন হলো ঝোঁক হয়েছে ওই উইটিবির ওপর চড়ার। তাই কি কেউ পারে? ওর ওপর উঠতে গেলেই পা পিছলে পড়ে যাবে সামনের ছোটো জায়গাটায়, সেখান থেকে গড়িয়ে একেবারে দিঘির পানিতে। ফুলজান তাকে ধরে ফেললো ঊইটিবির নিচেই। এই একটুখানি সময় তাকে উৎকণ্ঠায় রাখার জন্যে তার রাগ উস্কে ওঠে এবং রাগটা ঝাড়ে বেটির পিঠে কষে কয়েকটা কিল মেরে। আরো মারার জন্যে হাত ওঠাচ্ছিলো, কিন্তু এবার তার হাত নেমে যায় বেটির নালিশ শুনে। কাঁদতে কাঁদতে নোনতা পানি জড়ানো গলায়, মারে! মারে! বলে সোজা উত্তরপশ্চিমে তাকিয়ে মেয়ে তার নালিশ করে কার কাছে?

কম-কথা-বলা বেটির তার নালিশ করার খাসলত তো একেবারেই নাই। তা হলে?

দেখো, মা মারে। শুনে বেটির নজর অনুসারে ফুলজান তাকায় সামনের দিকে। দিঘির ঠিক ওপারেই হুরমতুল্লার বর্গা করা ধানের জমি। তারপর বেশ কয়েক বিঘা ফাঁকা জমির পর বাঙালি নদীর রোগা স্রোত, দুই বছরে প্রায় কুঁজেই এসেছে। না, সেখানে তো কেউ নাই। তার একটু পশ্চিমে কালাহার বিলের উত্তর সিথান। সেখানে আসমান থেকে ঝোলে গোল চাঁদ। কালাহারের উত্তর সিথানে কোনো বড়ো গাছের বাধা না পেয়ে চাঁদ নেমে এসেছে একটু নিচে।

চাঁদের আজ এ কী হাল হয়েছে গো? পরশু না পূর্ণিমা ছিলো? যঁা, পরশুই তো। কি তার আগের দিন? এই কয়েকদিনে চাঁদের গতর একটু রোগা হয়েছে। তা পরশুও তো চাঁদের ঘন করে আওটানো দুধে সয়লাব হয়ে গিয়েছিলো মুলুকের আমন ধানের জমি। ওই দুধ চুমুক দিয়েই তো আমনের শীষে দুধ জমলো ঘন হয়ে। আর এই দুইদিনে চাঁদের এ কী ব্যারাম হলো গো? তার গায়ের রূপার বন্ন হয়ে গেছে কালচে লাল, গতর থেকে হলদেটে আভা মুছেই গেছে। চাঁদের সবটা গতরে কেমন কালচে লাল কালচে লাল দাগ। হায় আল্লা! চাঁদের এই হাল হলো কী করে গো? হরেন ডাক্তার, না হরেন। ডাক্তার নয়, প্রশান্ত কম্পাউনডার হলে মনে হয় ধরতে পারতো। না কি ওই কম্পাউনডারই শয়তানি করে ফুলজানের বেটার গায়ের ছোঁয়া বাঁচাতে তার বিমারি মুখটাকে ছুঁড়ে দিলো এই কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের দিকে না, তাই বা কী করে হয়? তার বেটার গালে কি এরকম শুকনা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ ছিলো?

তা হলে কি মণ্ডলের ছোটোবিবির ভয়টাই ঠিক? গা ছমছম করলেও ওই ভয়টাই ভর করে ফুলজানের মাথায়। তমিজ যদি সত্যি সত্যি পুলিসের গুলি খায়, তবে সে নিজে বৌকে ছেড়ে অতো ওপরে চড়ে বসে কোন আক্কেলে? তবে মাঝির বেটার দেমাকটা তো বেশি-শ্বশুরবাড়িতে দিনমান কাম করবে, শ্বশুরের জমির লোভ তার মোনলা আনার জায়গায় আঠারো আনা; কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে তার গোয়া কামড়াবে। তাহলে তার থাকার জায়গা আর কোথায়? মাঝিপাড়ায় গিয়ে সে উঠতে পারবে? ওই অপয়া ঘর ভেঙে কালাম মাঝি ওখানে পাকা মসজিদের ভিত দিয়েছে। মাঝিপাড়াতেই আরেকটা মসজিদ করার একটু কথা নাকি উঠেছিলো। তা কুলসুমকে বাঁচাতে গিয়ে কালাম মাঝির ওই যে জখমটা হলো, এরপর সে প্রায় নুলো হয়ে পড়েছে। হাতে ব্যথা নিয়ে হেঁটে হেঁটে মসজিদে যেতে তার ভারী কষ্ট। তার কষ্ট দেখে মাঝিপাড়ার মানুষ মন খারাপ করে। আর ওই কুফা ঘরটা ভেঙে মসজিদ করলে বরং মাঝিদেরই ভালো হবে। কালাম মাঝি বাড়িটিও পাকা করার আয়োজন করছে। কিন্তু আল্লার ঘর পাকা না করে তার নিজের বাড়িতে সে ইট বসায় কী করে?

কিন্তু তমিজ ওখানে গিয়ে উঠতে তো আর পারে না। তাই কি সে গুলি-খাওয়া মুখে এসে ঢুকে পড়েছে গোলগাল চাঁদের গতরে? তাই কি চাঁদটাকে এমন ভূতুড়ে দেখায়?

তমিজের ভাবনায় ফুলজানের ভয় একটু কাটে। ওই ডাকাবুকো মানুষটা, জেতা হোক মরা হোক, থাকলে বুকে একটু বল পাওয়া যায়।

চাঁদের নিচে বড়ো গাছ একটাও নাই। পাকুড়গাছ তো গেছে অনেকদিন আগেই, আর যেগুলো ছিলো সব পড়ে গেছে, বৈকুণ্ঠ মরলো, ওই ঝড়ের রাতে। এখন সেখানে খালি ঝোপ আর ছোটো ছোটো গাছড়া। উত্তর সিথান জুড়ে আর দেখা যায় আলো। মানুষ কয়, সন্ধ্যার পর পাকুড়তলায় এখন খালি আগুন জ্বলে। তবে এখন তো ফুলজানের ভয় খানিকটা কেটেছে, আলোর দিকে কিছুক্ষণ দেখেই বুঝতে পারে আসলে ওই ঝোপে আর গাছড়াগুলোতে জ্বলছে ঝক ঝক জোনাই পোকা। ঝোপের ওপরে, ছেড়ে-যাওয়া ইটখোলার পড়ে-থাকা নষ্ট ইটের সারিতে জোনাকি একবার জ্বলে, ফের নেভে। তারা নিভলে ফের জ্বলে ওঠে একটু নিচেকার জোনাকির ঝাঁক। ওপরের জোনাকি ফের আরো ওপরে উড়ে জুলে ওঠে দ্বিগুণ তেজে। মনে হয় এতো বড়ো জায়গা জুড়ে সমস্ত ঝোপঝাড় তারা নিজেদের আগুনের ডানায় ডানায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে অনেক ওপরে।

এখন ফুলজানের মনে হয় এখানে না থাকাই ভালো। কৃষ্ণপক্ষের এই রাত্রে মেয়েকে সামনে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোষের দিঘির অনেক উঁচু পাড়ে, আরো অনেক অনেক উঁচু একঠেঙে তালগাছের নিচে উইঢিবির সামনে। এখান থেকে উত্তরে, একটু উত্তর পশ্চিমে এসব কী দেখা যায়! একবার মনে হয় এসব তার চেনা, আবার গা শিরশির করে : আসলে কি সে কিছু ধরতে পারে-ও বাপজান বলে বুক ফাটিয়ে ডাকতে গেলে ফুলজান টের পায় তার সব আওয়াজ আটকে গেছে তার ঘ্যাগের মধ্যে, গলা পর্যন্ত স্বর আর আসে না। এখন তার বেটির কান্নাও থেমে গেছে, এখন ফেঁপানোটা শুধু সামলাতে পাচ্ছে না। নিয়মিত বিরতি দিয়ে তার ফোঁপানির আওয়াজেই ফুলজান এখনো দাঁড়িয়ে থাকার বল পাচ্ছে। বেটির ফোঁপানির শেষদিকের টানে ফুলজানের মনে পড়ে, তার বাপই একদিন বলেছিলো, বড়ো বড়ো গাছ সব না থাকায় ডালহারা, পাতাহারা, গাছহারা এবং বড় গাছের আন্ধার কোণাঘুপচিহারা সব জোনাকি এখন ছড়িয়ে পড়েছে ঘাসের ওপর, ঝোপেঝাড়ে আর ছোটো গাছড়ার নরম সরম ডালে।।

কিন্তু ফুঁপিয়ে সব কান্না বার করে দিয়ে বেটি তার চুপ হয়ে গেলে সব একেবারে। সুমসাম হয়ে যায়। ফুলজানের মনে হয়, বেটিও তার চুপ, এই সুযোগে জোনাকির ঝকের আলো অতোদূর থেকে তার নাড়ি টিপেটিপে তার ভয়ডর সন্দেহ সব ঠিক সনাক্ত করে ফেলছে। তার ডান হাতের কবজিতে সুড়সড়ি লাগে। . ফুলজানের বেটি হঠাৎ করে বলে, হেঁসেল জুলে। শুকনা অশ্রুর নুনের খারে তার। গলা রুখা শোনায়, মা, হেঁসেল জ্বলিচ্ছে।

ফুলজান তখন দেখতে পায় জোনাকির ঝাঁক পাখায় পাখায় আগুন নিয়ে গোটা পকুড়তলাটাকে একটু একটু করে তুলতে তুলতে নিয়ে যাচ্ছে ওই ভূতুড়ে চাঁদের দিকে। না-কি চাঁদটাই জোনাকির টানে নেমে এসেছে একটু নিচে? জোনাকির ঝাঁকের কাছাকাছি? জোনাকির তাপে তাপে, আঁচে আঁচে, এমন কি ধোঁয়ার ধোঁয়ায় চাঁদের গতর থেকে লালচে কালো ছোপ উঠে যাচ্ছে, সেখানে এখন খালি ঘন কালচে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। জোনাকির হেঁসেলের তাপে কি ওটা অঙ্গার হয়ে যাবে না তো?

মা, হেঁসেলেত ভাত চড়াছে। আধো বোল মুছে পরিষ্কার জবানে ফুলজানের বেটি বলে, ভাত রান্দে।

তাই তো, বেটি তার মিছে কথা কয় নি, চাঁদের নিচেই জোনাই পোকার জ্বালে জ্বালে চাঁদের ওপর সেদ্ধ হচ্ছে আউশের রাঙা চাল। পানসে লাল মাড় উপচে পড়তে না পড়তে আগুনের আলো হয়ে তাই গড়িয়ে পড়ছে কালাহারের উত্তর সিথানে। দেখে আর ফুলজানের বেটি নিশ্বাস নেয় জোরে জোরে। বেটি কি ভাতের বাসনা পায় নাকি গো? আল্লা, তাই যেন পায়! জোনাকির শিখায় চাঁদের ওপর সেদ্ধ আউশের চালের ভাতের গন্ধে সে পেট ভরাক। ভালো করে পেটটা ভরলে ঘরে ফিরে তাকে আর ভাত খেতে দিতে হয় না, আবার রাত না পোয়াতেই জেগে উঠে কিংবা ঘুমের মধ্যেই ভাতের জন্যে মাচার নিচে সে ঘুরঘুর করবে না। কচুপাতা দিয়ে ঘাঁটা কাউনের চালের ভাতটা থাকলে বরং কাল এক সন্ধ্যা চলে যাবে।

ও মা! কিছুক্ষণের মধ্যে ফুলজানের নাকমুখমাথাগলাঘ্যাগ সব ভরে ওঠে ভাতের গন্ধে। কেটা কয় মিছা কথা? আউশের চালের সেদ্ধ হবার ঘেরান চারদিক ম ম করে। আবার মনটা খুঁতখুঁতও করে, এই আউশের চালের ভাতের গন্ধ বুক ভরে নেওয়ায় কি পেট ভরে? খিদা কি তার দূর হবে? আর এই সুবাস একবার পাবার পর কচুর পাতার সঙ্গে কাউনের ঘাঁটি কি আর মুখে রুচবে? কিন্তু সেই গন্ধ শোঁকার আশ তো ফুলজানের মেটে না।

ভাত খামো। ভাত রান্দিচ্ছে, মা ভাত খামো।-এর মানে বেটির পেট তার খালিই রয়ে গেছে। কোনো ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়াই মেয়ের এই আবদার তার রুখা গলায় শোনায় দাবির মতো। খালি পেটে গলায় এতো তেজ ছুঁড়িটা পায় কোথায় গো? ফুলজানের জানটা কাঁপে। মানষে কয়, পাকুড়তলার চোরাবালির ভেতর তমিজের বাপ নাকি মাঝে মাঝে গা মোচড়ায়। ওই মানুষটাই এসব কারসাজি করছে না তো? বেটার ঘেগি বৌটাকে তার পছন্দ হোক চাই নাই হোক, নিজের বংশের একমাত্র নাতনিকে দেখার আশায়, ভাতের সুবাসে তার জিউটা ঠাণ্ডা করার জন্যে তমিজের বাপই হয়তো ঝক ঝক জোনাই পোকার বুকে ফুঁ দিয়ে হেঁসেল জ্বালিয়ে দিয়েছে। চোরাবালি থেকে নাতনিকে দেখতে দেখতে বেটার বৌকে নিশ্চয়ই সে দেখতে পায়। ফুলজান শরম পায় এবং তাড়াতাড়ি করে শাড়ির আঁচল তুলে দেয় মাথার ওপর, একটু বেশি করেই টানে। কী জানি, তাকে বেপর্দা দেখে শ্বশুর যদি ঘুমঘুম গলায় একটা শোলোক বলে তাকে শাসন করে! মুনসির শোলোক ফুলজান আগে অনেক শুনেছে। পোড়াদহ মেলায় মজনুর শোলোক, ভবানী সন্ন্যাসীর নামে কতো শোলোক শুনেছে। তা এসব তার মনে থাকে না, কোনোদিন নিজে নিজে আওড়ায় নি পর্যন্ত। তমিজ তাকে এতোসব কথা বলতো, কিন্তু শোলোক শোনায় নি কখনো। তার দুই চারটা শোনোক জানা থাকলে না হয় ফুলজান। তাই জপতো মনে মনে, তমিজের বাপ হয়তো তাতে একটু ঠাণ্ডা হতো।

কিন্তু বেটি তার এরকম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? এই ছটফটে মেয়েটা এতোক্ষণ ধরে এরকম স্থির চোখে তাকায় কী করে? নিজের মেয়ে তার দেখতে দেখতে সেয়ানা হয়ে যাচ্ছে নাকি? সত্যি তার বেটি তো? বেটিকে ভয় পেয়ে, তার অচেনা হয়ে যাওয়া ঠেকাতে এবং তাকে খানিকটা বশ করতেও বটে, নিজের হাঁটুজোড়া মাটিতে রেখে ফুলজান দুই হাতে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। মেয়ের ছোটো ঘাড়ে সে ঠেকায় নিজের ঘ্যাগ এবং তার ছোটো মাথায় রাখে নিজের চিবুক। চিবুকে শিরশির করে ওঠে বিজবিজ আওয়াজ। তমিজের বাপ নিশ্চয়ই তার ওপর আসর করে নাতনির মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে তার জানা অজানা মুনসির পাওনা-শোলোক।

ফুলজান আস্তে করে বলে, বাড়িত চল মা। ভাত খাবু না?

ভাত খাবার কথাতেও মেয়ে সাড়া দেয় না। তার ছোটো ছোটো কালো কুচকুচে পা দুটো সে শক্ত করে চেপে রাখে মাটির ওপর। বেজায় গোয়ার হুঁড়ি গো! হুরমতুল্লা যে বলে, মিছা কথা নয়, এই মাঝির বংশের মানুষ বড়ো একরোখা। মাছ ধরা হলো এদের কুলপেশা, মাছের মতোই ঝাক ধরে থাকে। নদীর স্রোতের সঙ্গে এদের খাতির, স্রোত যেদিকে চললো তো সবাই ছুটলো সেদিকেই। আবার স্রোতের সঙ্গে বিবাদ করতেও শালাদের বাধে না। কেমন?–না, স্রোতের উল্টাদিকে চলতেও এরা মাতে সমান তালে। উজানে তো উজানে, ভাটায় তো ভাটায়। বিলের ওপারে গিরিরডাঙার মাঝিরা একজোট হয়েছে কি আজ থেকে? এরা ছিলো সব মুনসির সাগরেদ। তারই পেয়ারের মানুষ। কোন সেপায়ের গুলিতে সেই মুনসি মরে ভূত হয়েছে, সে কি আজকের কথা? তখন এই তমিজ তো তমিজ, তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার দাদা বাঘাড় মাঝিরও জন্ম হয় নি, বাঘাড় মাঝির দাদা না-কি তারও দাদার জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও সে তখন গিরিরডাঙায় নতুন মাটি-ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন গোরা সেপায়ের বন্দুকের গুলিতে খুন হয়ে মুনসি তার গলার শেকল আর হাতের মাছের নকশা-আঁকা পান্টি নিয়ে উঠে পড়ে পাকুড়গাছের মাথায়। সে কি আজকের কথা? মাঝির গুষ্টির কুষ্টি জানতে বয়ে গেছে ফুলজানের! তবে লোকে বলে, সেই পাকুড়গাছ থেকে মুনসি নাকি বিল শাসন করছে সেই থেকে। রাতে তার পোষা গজারের ঝক তারই হুকুমে ভেড়ার পাল হয়ে হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কেটে বেড়ায় তামাম বিলের ওপর। তা পাকুড়গাছ হারিয়ে গেলে মুনসির আরস এখন কোথায় উধাও হয়েছে কে জানে? মুনসির জায়গা কি এখন দখল করেছে তমিজের বাপ। তবে কি-না, মানুষটা নাকি একটু হাভাতে কিসিমের। তার যেমন খাওয়ার লালচ, গজার মাছগুলোকে কেটেকুটে জোনাকির হেঁসেলে চড়িয়ে দিয়েছে হয়তো ওই মানুষটাই। আর গুলি-খাওয়া গতরটা মেলে দিয়ে গোল চাঁদটা কি রান্নার সুবিধা করে দিলো? ফুলজান নিশ্চিত হয়, তার বেটি এখন গজার মাছের মাখা-মাখা-করে-রাধা ঝাল সালুনের সুবাস পাচ্ছে। নইলে শুধু ভাতের গন্ধে এতোক্ষণ হাঁ করে নিশ্বাস নেওয়ার হুঁড়ি তো সে নয়।

এখন ভাতের গন্ধ আর মাছের গন্ধের কথা না হয় বোঝা গেলো, কিন্তু ফুলজানের বেটির মাথার ভেতরে বিজবিজ করে কী? তাহলে এর মাথার এই বিজবিজ আওয়াজ থেকে কথার কুশি বেরুবে, সেটাকে শোলোকে গেঁথে তুলবে কি এই সখিনাই? ভাত খাওয়া ছাড়া ছুঁড়ি আর বোঝে কী? এ কি আর শোলোক গাঁথতে পারবে? কে জানে! কী শোলোক গাঁথবে!

এখন মুনসি নাই, তার পাওনা-শোলকের কোনো টুকরাও কি আর সখিনার মাথায় গুণগুণ করতে পারবে? শোলাক গাথার ক্ষমতাও তো তমিজের বাপের ছিলো না।

এদিকে মোষের দিঘির ওপার থেকে, মনে হয় পাথারের ওপর দিয়ে শোনা যায় হুরমতুল্লার কাশিধসা গলার ডাক, ফুলজান, ও ফুঁ উ উল জা আ ন। ফুলজান একটু চমকে উঠলে তার নজর কাঁপে। দেখা যায়, বিলের ওপর ধীরে ধীরে ওড়ে মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের বকের ঝাঁক। হেঁসেলের আগুনের ভয়ে তারা ওদিকে ঘেঁষে না। কিন্তু বিলের ওপর দিয়ে তারা আস্তে আস্তে উড়াল দিতে থাকে এপারের দিকে। একটু ঘুরে : এই বুঝি তারা এসে পড়ে মোষের দিঘির ওপর। ভয়ে ফুলজান উঠে দাঁড়ায়, বেটির ঘাড় ধরে ঝাকায়, সখিনা, ও মা, চল। বাড়িত চল।

বকের ঝাঁক হুরমতুল্লার ঝাপসা চোখেও আবছা ছায়া ফেললেও ফেলতে পারে। লালচে কালো কুয়াশা ছুঁয়ে আসে তার ব্যাকুল ডাক, ও ফু উ উ লজা আ আ ন। ফুলজান।

ফুলজান সাড়া দেবে কী করে? মেয়েকে নড়াতে পারে না। মোষের দিঘির উঁচু পাড়ে লম্বা তালগাছের তলায় পুরনো ইটিবির সামনে খটখটে শক্ত মাটিতে পাজোড়া জোরে চেপে রেখে ঘাড়ের রগ টানটান করে মাথা যতোটা পারে উঁচু করে চোখের নজর শানাতে শানাতে সখিনা তাকিয়ে থাকে কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে জখম চাঁদের নিচে জ্বলতে-থাকা জোনাকির হেঁসেলের দিকে।।

Leave a Reply to মোঃ মেহেদী হাসান Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *