২. ভৌতিক প্রতিচ্ছবি

ভৌতিক প্রতিচ্ছবি

কারোর চুরুট চাওয়ার পর আমি চকিতে লোকটার দিকে ফিরে তাকালাম। পরক্ষণেই আমি ওকে চিনতে পারলাম। বছর পঁয়ত্রিশ-এর ব্রিসবেন। মাথায় জফুটের মতো, হয়তো একটু বেশি হবে। বেশ দোহারা চেহারাটি, বেশ চওড়া কাঁধ। হাতের পেশী এত শক্ত যে বাদাম ভেঙে ফেলতে পারে। বুকটা ইস্পাতের মতো কঠিন। ভেতর থেকে খুবই শক্তিশালী। আয়ত নীল চোখ, খাড়া নাক এবং পাতলা গোঁফ, পরিষ্কার চিবুক, সব মিলিয়ে চেহারাটা পুরুষালী। ব্রিসবেন যখন কথা বলে তখন সবাই একমনে তার কথা শোনে।

সে বলছিল যে, সে সমুদ্র ভীষণ ভালোবাসে। সে একজন ভদ্রলোককে জানত যে বিশেষ একটা বাস ধরার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ব্রডওয়েতে অপেক্ষা করতো। সেও তার মতো আটলান্টিক পাড়ি দেবার জন্য একটা বিশেষ জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতো। সেটার নাম ছিল কামশ্চাকা। সেটা তেমনি বড় এক সুন্দর। নানা ধরনের সুযোগসুবিধা ও অসম্ভব দ্রুতগতির জন্য সেটা তার প্রিয় ছিল। জীবনে একবারই তার সঙ্গে কামশ্চাকা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তারপর থেকে আর তার ছায়া মাড়ায়নি।

গ্রীষ্মের এক উষ্ণ সকালে যে কোন কারণে দেরী করে ফেলে। তখন জাহাজ ছাড়তে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। আসন না থাকলেও পূর্ব পরিচয়ে সে একটা টিকিট জোগাড় করে। একজন পরিচিত স্টুয়ার্ট দেখে মাঝপথে ধরতে সে বলল, ১৩৫ নং বার্থ।

বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে স্টুয়ার্ট মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আমার পোর্টমানটা ও লম্বা কালো ওভারকোট আর কম্বলটা তুলে নিলো। তার মুখের অভিব্যক্তি সে কোনোদিন ভুলবে না। তাকে দেখে তার মনে হলো যে সে হয়তো কেঁদে ফেলবে নয়তো আমার হাত থেকে পোর্টমানটা ফেলে দেবে। কেঁদে ফেললে কিছু হবে না কিন্তু পোর্টমাল্টা ফেলে দিলে খুবই ক্ষতি হবে। কেননা ওর মধ্যে তার বন্ধু বান পিকিনসের দেওয়া দুবোতল শেরী আছে।

এগিয়ে ও নিচু গলায় বলল যে, আসুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। হারমিস যেন একটা নেশার ঝোঁকে রয়েছে। আমি নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করলাম, ১৩৫ নং বার্থটা জাহাজের পেছনে বাঁ-পাশে, অন্যান্য জাহাজের নিজস্ব বা নিভৃত কেবিনগুলো যেমন হয় এটা ঠিক সেই রকম। এতে উল্লেখযোগ্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

এটা নিচের বার্থ তাই চওড়া বেশি ওপরের বার্থের থেকে। এখানে বহুবার যাতায়াত করেছি, কখনও নিচের কেবিনে থাকতে হয়নি। আমার মনটা প্রথম থেকেই খিঁচড়ে ছিল, সমুদ্র ঝঝির সোঁদা গন্ধে আমার দম বন্ধ হচ্ছিল।

লটবহর নামিয়ে হারমিস এমন মুখ করে তাকিয়ে ছিল যেন তার খুব দরকারী কাজ আছে। আমি তাকে ভালো বকশিস দিতে সে বলল যে, সে ভালো বার্থের জন্য চেষ্টা করবে। মুদ্রাটা পকেটে পুরতে তার মুখটা এমন হলো যাতে আমি অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম যে হয়তো ওদের বকশিসের হার বেড়ে গেছে তাই ও সামান্য কটা টাকায় খুশী হয়নি। আমার মনে হলো মাল পেটে পড়লে ওর মেজাজটা ঠিক হবে। কিন্তু আমার অনুমান যে কত ভুল ওর প্রতি যে অবিচার আমি করেছিলাম।

সারাদিনে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটলো না। আমরা বন্দর ছেড়ে যাত্রা শুরু করি। আবহাওয়া ভারী চমৎকার ছিল। যাত্রার প্রথম দিন সবাই সমুদ্রকে ভালোবাসে এবং হালকা পায়ে ঘুরে বেড়ায়। টেবিলে আড্ডা বসেছিল আবার ফাঁকাও হলো। ফায়ার আইল্যাণ্ড পেরোবার পর ভারী চমৎকার একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বইছিল। চোখে পড়ছিল তিমি ও ভাসমান তুষার শিলা। কিন্তু যারা আটলান্টিক বহুবার পার করেছেন তাদের কাছে এসব কোনো নতুন মনে হবে না। তাদের কাছে সব চাইতে আনন্দদায়ক ডেকের কুর্সিতে গা এলিয়ে ধূমপান করা।

সেদিন ভীষণ ক্লান্তি বোধ করাতে নিচের কেবিনে আসতে আমার কেবিনে আর একজন সহযাত্রীর দেখা পেলাম, যার আমার মতো একটা পোর্টমানটা রয়েছে, ওপরের বার্থে সুন্দর করে গোছানো একটা ভাঁজ করা কম্বল, ছড়ি আর ছাতা। আমার স্বাধীনভাবে যাওয়া হবে না ভেবে দুঃখ পেলাম।

আমি ডাকলাম লোকটা কখন ঢুকল, এবং ঢুকলো যখন এত তাড়াতাড়ি কি করে ঘুমিয়ে পড়লো। দেখে মনে হলো যে লোকটা বেশ লম্বা, রোগা, ফ্যাকাশে চেহারা। বালি রঙের কটা চুল, ধূসর চোখ। পুরানো ধাঁচের একটু বেশি পোশাক পরা, সব মিলিয়ে ভদ্রলোকের উপস্থিতি যেন কেমন সন্ধিগ্ধ।

এইধরনের চরিত্রের বাস ওরাল কীটে, আঙ্গলাইসে যে একের পর এক শ্যাম্পেন উড়িয়ে চলেছে। এই ধরনের চরিত্রের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হবে ঘোড়দৌড়ের মাঠে, এধরনের দুটো-একটা চরিত্রকে আমি এড়িয়ে চলাই পছন্দ করি। আমি ওর আগে শোবো, এবং ওর পরে উঠবো বা তার বিপরীত কাজ করবো। কারণ ওর সঙ্গে আলাপ করার আমার প্রবৃত্তি নেই। দূর থেকে ওর কার্যবিধির ওপর নজর রাখব। তা করতে হয়নি কারণ প্রথম রাতের পর ১০৫ নং, ওকে দেখিনি।

বেশ গাঢ় ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ মাঝখানে এটা প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দ শুনে মনে হলো যে আমার সহযাত্রী ওপরের বার্থ থেকে মেঝেতে লাফিয়ে পড়েছে। পরক্ষণেই ছিটকিনি খোলার শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খোলার আওয়াজ। তারপর প্যাসেজে দ্রুত ছুটে যাওয়া পায়ের শব্দ কানে এলো। কেন জানি না জাহাজটা বেশ জোরে দুলছিল এবং প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। জাহাজের ক্যাচকেচে আওয়াজ আমাদের উত্যক্ত করে তুললো। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে আমি দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে আমি উঠলাম। যখন উঠলাম তখন বেশ অন্ধকার।

বেশ স্যাঁতসেতে আবহাওয়া–আমার শীত করতে লাগল। আমি ভাবলাম যে কাল ক্যাপ্টেনের কাছে প্রতিবাদ জানাব যে সমুদ্র ঝঝির গন্ধের জন্য। আমি সহযাত্রীর আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং তার জন্য আমি কিছু করলাম না কারণ আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম।

ঘুম ভাঙল পরের দিন ভোরে। জাহাজটা ভীষণ দুলছিল। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। কিন্তু জুন মাসে কেন যে এত শীত করছিল কে জানে। কম্বলের ভেতর দিয়ে পোর্টফোলিওর দিকে তাকাতে অবাক হয়ে গেলাম। ওটা খোলা ছিল। আমি বন্ধ করে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই ভদ্রলোক মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। আমি এই সুযোগে কেটে পড়তে চাইলাম। তাই আমি তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে ডেকে চলে এলাম। তখন সাতটা বাজে। দেখলাম, এক ডাক্তার রেলিং-এ ভর দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। যিনি জাতিতে আইরিশ। কালো চুল এবং টলটলে নীল দুটো চোখ।

তার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। আমি যখন বললাম ১০৫ নং বার্থের ওই স্যাঁতসেতে ঘরটা আমার; তখন তিনি যেভাবে দেখলেন সেটা একটা অদ্ভুত লাগল। ডাক্তার বললেন যে, নিচের ওই কেবিনটা সম্পর্কে অনেক অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। আমি বললাম এই নিয়ে আমারও অভিযোগ কম নয়। যে এইখানে আলো বাতাস অত্যন্ত কম। অবশ্য ডাক্তার আমাকে ভয় পাওয়াতে চাইছিলেন না। স্যাঁতসেতে কুয়াশায় আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না। ডাক্তার আমাকে সহযাত্রী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আমি বললাম যে, একজন ছিলেন, তবে তাকে ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছিল না। সে মাঝ-রাত্তিরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছিল।

ডাক্তার বললেন যে সে কি আবার ফিরে এসেছিল। আসলে আমি দেখিনি কেননা শীতে আমি কম্বলের নিচে ছিলাম। সকালে উঠে আমি পোর্টফোলিওটা খোলা দেখি।

ডাক্তার বললেন যে, সম্প্রতি নানাকারণে জাহাজটির দুর্নাম ঘটেছে এবং তিনি আমাকে তার কেবিনে যেতে অনুরোধ করলেন।

আমি অবাক হলাম জাহাজ সম্পর্কে ওভাবে বলাতে। আমি ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ জানালাম। আমার জানতে ইচ্ছে করছিল তিনি কেন জাহাজ সম্পর্কে এটা বললেন। তবে ঘর ঝাড়পোছ করে বাস করতে আমি আগ্রহী ছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম যে, কেন তিনি একথা বললেন?

তিনি বললেন যে, সমুদ্র মানুষকে সংস্কারবাদী হতে সাহায্য করে। এর আগে তিনজন যাত্রী তিনবার ১০৫ ঘরে ঘুরিয়ে থাকার পর আত্মহত্যা করেছে।

মনে মনে আমি একটু অবাক হলাম। কিন্তু তিনি ঠাট্টা করছিলেন না, বরং গভীর চিন্তায় ভরা মুখটা কাঁপছিল। আমি তার প্রস্তাবে আগ্রহী হলাম না। কেবিনে থেকে যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের থেকে যে আমি আলাদা এটা প্রমাণ করতে চাইছিলাম। ডাক্তার প্রতিবাদ না– করে প্রস্তাবটা একবার বিবেচনা করতে চাইলেন।

প্রাতঃরাশের সময় একটা বই নিয়ে আমার জন্য তিনি নিচের কেবিনে গেলেন। দেখলাম উপরে বার্থের পর্দাটা আগের মতো টাঙানো রয়েছে। কোনো শব্দ পাচ্ছিলাম না। আমি বইটা নিয়ে আসছিলাম, ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছেন ভেবে! জাহাজের ক্যাপ্টেনে আমায় ডেকে বললেন যে আমার সহযাত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হলো ভদ্রলোক সমুদ্রে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। এটা ক্যাপ্টেনকে বলতে তিনিও সহমত হলেন। কারণ এটা নিয়ে চারজন হলো। আমি আগের দিন রাত্রির ঘটনাটা তাকে বললাম। ক্যাপ্টেন বললে যে, তিনজনের মধ্যে যে দুজন যাত্রী আছে তাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন। ওরা মাঝ-রাত্তিরে দরজার ছিটকিনি খুলে প্যাসেজ দিয়ে ছুটতে শুরু করেন। জাহাজ থামিয়ে নৌকা থামিয়ে হদিশ পাওয়া যায়নি। গত রাত্তিরের ভদ্রলোক সম্পর্কে কেউ কিছু দেখতে বা শুনতে পায়নি। রবার্ট বা একটু আগে যে স্টুয়ার্টটি আমায় ডেকে আনল সে অত্যন্ত কুসংস্কারবাদী। তার ধারণা জাহাজে অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। সকালে নিচের কেবিনে পরিষ্কার করতে গিয়ে সে সেটা ফাঁকা দেখে। কিন্তু ওর ধারণা জাহাজে অদ্ভুত কিছু ঘটেছে যার জন্য লোকটি নেই।

ক্যাপ্টেন আমাকে বললেন যে, জাহাজ সম্পর্কে একটা গুজব রটেছে যে এই জাহাজে যাত্রীরা আত্মহত্যা করছে। কিন্তু আপনি এ ব্যপারটা কারোকে জানাবেন না। এই খবর শুনলে যাত্রীরা চঞ্চল হয়ে উঠবে। তাই আপনি জাহাজের কর্মচারী কেবিনে থাকতে পারেন, এরজন্য আপনাকে একটুও কুণ্ঠিত হতে হবে না।

ক্যাপ্টেনকে জানালাম, আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি বললাম যে, সহযাত্রীর জিনিষগুলো সরিয়ে যদি ঘরটা পরিষ্কার করা হয় তাহলে আমি স্বচ্ছন্দে এখানে থাকতে পারব। সহযাত্রীর কথা কারোকে বলব না।

অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আমি ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম না।

সন্ধেবেলায় ডাক্তার আমার মত না পাল্টানোর কথা শুনে খুশী হলেন না। আমি কেবিনে ঢুকে একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আমার সহযাত্রীর মুখটা যেন বারবার মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল খুঁজলে তাকে জাহাজের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি পোশাক পাল্টানোর সময় হঠাৎ পোর্টফোলিওটা খোলা দেখলাম। দেখে মেজাজ যেন সপ্তমে চড়ে গেল। তখন আমি স্টুয়ার্ট রবার্টের খোঁজে নিচে নামলাম। আমি তাকে ধিক্কার জানিয়ে বললাম যে, জাহাজ যদি রাত্রিতে একপাশে কাত হয়ে থাকে এবং প্রচণ্ড ঢেউয়ে যদি জল ঢুকতে থাকে তখন ১০টা লোক আপ্রাণ চেষ্টা করে এটা বন্ধ করতে পারবে না। আমি তোমার নামে ক্যাপ্টেনের কাছে নালিশ করব।

রবার্ট বলল যে এ জাহাজে কেউ এ পোর্টফোলিওটা রাত্তিরে বন্ধ করে রাখতে পারে না। পেতলের ভারি ছিটকিনি দিয়ে আটকালে?

রবার্ট বলল, আপনি নিজে দেখুন ঠিক আছে কিনা। রর্বাট বলল যে, রাত্রিতে এটা আপনা থেকে খুলে যায়।

আমি বললাম, তাই যদি হয় তাহলে আমি তাকে এক পাউণ্ড বকশিস দেব। আমি রবার্টের কথা বিশ্বাস করলাম না। ব্যাপারটা আমি ওর চালাকি বুঝলাম। মিনিটের মধ্যে পোশাক পাল্টে আমি শুয়ে পড়লাম। নানারকম চিন্তা আসছিল মাথায়–এফোড় ওফোঁড় হয়ে ভাবছি এবং প্রায়ই আমার চোখ পোর্টফোলিওর দিকে পড়ছে।

ঘন্টা-দেড় ঘন্টা নাগাদ একটা ঝিমুনির মতো এলো এবং একটা ঠান্ডা বাতাসে যেন উড়িয়ে দিল। আমার গায়ে সমুদ্রের জলের ছাট লাগল। চমকে উঠে বসতে গিয়ে লাফিয়ে নামতে যাব, হঠাৎ জোর আছাড় খেয়ে গদিমোড়া কুসিটায় পড়লাম, ওটা পোর্টফোলিওর নিচে ছিল। আমি দেখলাম পোর্টফোলিওটা খোলা।

কিছুটা শ্রান্তি জড়ানো থাকলেও ঘুম চোখ থেকে উধাও হয়েছিল। পরের দিন দেখলাম ব্যাপারটা ঠিক নয়। এটা খোলা দেখতে আমি ভয় পেলাম না অবাক হলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথায় ঢুকছিল না কিভাবে এটা খুলল। তাছাড়া কাঁচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম যে সফেদ ঢেউগুলো এমন কিছু উত্তাল নয় যে চাপে খুলে যাবে। জানালাটা খোলে কিনা দেখার জন্য চুপচাপ দাঁড়ালাম।

কিছুক্ষণ পর একটা অস্ফুট চাপা গোঙানি শুনতে পেলাম। চকিতে ঘুরে ওপারের বিছানার পর্দা সরিয়ে হাত বোলাতেই বুঝতে পারলাম কে যেন শুয়ে আছে। যেন হিমঘরের মতো হাতটা। সমুদ্র ঝঝির থেকে একটা আঁঝালো গন্ধ ভেসে এলো। মানুষের হাতের মতো জিনিষটা মসৃণ, বরফের মতো ঠান্ডা। হাতটা ধরে টানতেই পার্থিব শক্তিতে প্রচণ্ড জোরে লোকটা মেঝেতে আছড়ে ফেললো। ভয় পাবার আগে অচেনা লোকটা দরজা খুলে বিদ্যুৎবেগে ছুটতে শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে আমি ওকে অনুসরণ করলাম। ঠিক আগে জাহজের পেছন দিয়ে ছায়ামূর্তি ছুটে যাচ্ছে। পরক্ষণে ছায়াটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। শুনতে পেলাম না জলে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।

কোনোরকমে কেবিনে ফিরলাম। দেশলাই হাতড়ে হাতড়ে জ্বালিয়ে দেখলাম পোর্টফোলিওটা খোলা বুকের ভেতরের আতঙ্কে শরীরে কেঁপে উঠল। যেটা আগে কখনও অনুভব করিনি। বার্থটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করলাম। ভালো করে দেখার জন্য পর্দাটাকে টেনে সরালাম। বিছানা শুকনো হাড়ের মতো খটখটে ছিল। পোর্টফোলিওটা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগালাম এবং শক্ত ও কাঠের লাঠিটাকে পেতলের গর্তের মধ্যে গুঁজে দিলাম। সারা রাত আলো জ্বালিয়ে পাহারা দেবার ভঙ্গিতে বসে রইলাম। রাত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।

ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পোশাক পাল্টে ডেকে চলে এলাম। সমুদ্রের উপর ঠান্ডা বাতাস বুক ভরে নিলাম।

ডাক্তার আমার মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলেন যে রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। তাই তিনি আমায় ঔষধ দিতে চান। তিনি আমার কথা অবিশ্বাস করলেন না বরং আমি যে তার কথা বিশ্বাস করি এটা তিনি বললেন। তাকে আমি আমার কেবিনে থাকতে বললাম। সে বলল, ভূতের সঙ্গে লড়ার দুঃসাহস আমার নেই।

ডাক্তারবাবু বলতে চান জাহাজে এমন কেউ নেই যার সঙ্গে আমি আমার কেবিনে থাকতে পারব। আমি কিন্তু একটি রাত একা কাটাতে চাই। এরজন্য আমি ক্যাপ্টেনের শরণাপন্ন হলাম। তাকে বললাম যে যদি আলোগুলো তিনি জ্বালিয়ে রাখেন তাহলে আমি একাই চেষ্টা করব। ক্যাপ্টেন বললেন যে, তিনি সহযোগিতা করবেন। তার ধারণা কোনো বদমাইশ লোক নিচের কেবিন থেকে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাচ্ছে এবং যাত্রীদের মনে আতঙ্ক তৈরি করছে।

এই আন্তরিক সহযোগিতার জন্য ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি একটা ছুতোর দিয়ে বিছানাপত্তর খুলে কাঠের স্ক্র খুলে ভালো করে পরীক্ষা করলেন। কোন জায়গায় তক্তা খুলে গেছে, তাও পোলাম না। পোর্টফোলিওর কোথাও ত্রুটি নেই।

শর্তানুযায়ী রবার্ট টাকা দিল। ছুতোরটি আমায় বলল যে, চার-চারটে তাজা প্রাণ নষ্ট হয়ে গেছে। মিছিমিছি দেরি না করে যেন আমি অন্য কেবিনে যাই। আমি গণ্ডা তিনেক ভ্রু দিয়ে দরজা সেঁটে দিচ্ছি।

আমি এটা করব একটা রাত, বললাম। রাত দশটায় ক্যাপ্টেন আমার ঘরে এলেন। তিনি সবদিক নিরীক্ষণ করলেন এবং মউজ করে চুরুট জ্বালালেও, ভেতরে অন্ধকার থাকার জন্য দেওয়ালে লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখলাম। এখান থেকে কোনো মানুষের ঢোকা বা বেরুনো সম্ভব নয়, যদি তা ঘটে মনে হবে তা অতিপ্রাকৃতিক কিছু।

ক্যাপ্টেন বললেন যে এই কেবিনের ওপরের বার্থে যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি পাগল হয়ে যান। সারাদিন তিনি চুপচাপ থাকতেন। একদিন হঠাৎ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। আমরা জাহাজ থামিয়ে নৌকা নামিয়ে তার কোনো খোঁজ পেলাম না। ভদ্রলোক পাগল ছিলেন বলে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এর পর দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল। শোনা যায় পোর্ট জোন থেকে গলগল করে জল ঢুকছে। অনেক কষ্ট করে তা যদিও বন্ধ করা গেল গন্ধটাকে তাড়ানো গেল না।

আমি বললাম সকালে গন্ধটা ছিল না কিন্তু হঠাৎ আবার পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ লণ্ঠনটা নিভে গেল। তখন জাহাজটা দুলছে। হঠাৎ কি হলো আমরা দেখতে যাব। হঠাৎ আর্তনাদ করে পোর্টজোনের দিকে ছুটে গেলাম। ক্যাপ্টেনকে সাহায্য করার জন্য আমরা প্রাণপণ শক্তিতে পোর্টহোলকে ঠেলে রাখার চেষ্টা করলাম। প্রচণ্ড ধাক্কায় আমি কুর্সিটার উপর ছিটকে পড়ি এবং ক্যাপ্টেনকে দরজার গায়ে আছড়ে ফেলল যেন কেউ।

আমরা দেখলাম পোর্টহোলটা খোলা। উপরের বার্থে যেন কিছু দেখা যাচ্ছিল।

উপরের বার্থে দেখা গেল যেন দীর্ঘদিন জল ঢুকে থাকা ঠাণ্ডা ও মসৃণ। দুর্মর শক্তিতে পিছোল হাতটাকে আমি আঁকড়ে রাখলাম। পলকের জন্য ভয়ঙ্কর দুটো চোখ অন্ধকারে জ্বলে উঠল, অসহ্য যন্ত্রণায় আমি ঝাঁকিয়ে উঠলাম, একটা ছায়ামূর্তি দরজার দিকে গেল। ক্যাপ্টেনকে সরিয়ে দিয়ে, ক্যাপ্টেন আগে থেকে তৈরি থেকে তাকে একটা ঘুসি মারতেই তিনি শক্ত মেঝেতে পড়ে গেলেন।

আমি আঁৎকে উঠলাম, নিঃশব্দ, মনে হলো ছায়ামূর্তিটা দরজার সামনে দাঁড়ানো এবং পোর্টহোল দিয়ে বেরিয়ে গেল।

হাতটাতে যন্ত্রণা হচ্ছিল। কোনোরকমে আলো জ্বালোম। ক্যাপ্টেন আঘাতে খুব ভয় পেয়েছিলেন। তাকে জলের ঝাঁপটা দিয়ে সুস্থ করা হলো।

এর পরে ঘটনা সংক্ষিপ্ত। সমুদ্রযাত্রায় বাকি পথটা ডাক্তারের কেবিনে পাড়ি দিতে হলো। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে সারালেন এরপর জাহজের ১০৫ নং বার্থ সর্বকালের জন্য বুক করা হলো এই বলে যে আমরা দুঃখিত ওটা আগে থেকে ভর্তি হয়ে গেছে। বার্থটা জলে ডুবে আত্মহত্যা করা ওই বিদেহী আত্মার জন্য সুসংরক্ষিত। তবে আমি আর কখনও কামশ্চাকায় উঠিনি।