দি ডেথ গেম

দি ডেথ গেম – আগাথা ক্রিস্টি

আমি একদম সুস্থ ছিলাম না, যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় ক্রমশঃ মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে উঠেছিলাম। অবশেষে বসার আদেশ পেলাম, আমি বুঝতে পারলাম আমার বোধশক্তি সব হারিয়ে গেছে। একটা কথাই আমি শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম–দণ্ডাদেশ এসে গেছে–তা মৃত্যুর দণ্ডাদেশ।

তদন্তকারীদের সমস্ত কথাই তারপরে আমার কাছে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এক নির্দেশহীন, স্বপ্ন ভাবে নিবিষ্ট গুঞ্জনের মতো আমার মধ্যে ঘূর্ণনের ধারণা এনে দিল, চাকা ঘোরার সাথে তার মিলের জন্যই হয়তো।

তবে তা কিছুক্ষণের জন্যই মাত্র, কারণ এরপর থেকে আমি কিছুই শুনতে পাইনি। তবুও ক্ষণকালের জন্যে আমার দেখার শক্তি ছিল–তা যা দেখেছিলাম তাকে খুব ভয়াল অতিশয়োক্তি বলেই ধারণা হবে-কালো জামা পড়া বিচারকদের ঠোঁট নাড়াচাড়া আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কাছে তাদের ঠোঁট প্রচণ্ড সাদা বলে মনে হচ্ছিল।

–যে কাগজটাতে আমি লিখছি মনে হচ্ছিল তার চেয়েও সাদা,আর অদ্ভুত ধরনের। সিদ্ধান্তেই অনড় সেই অধরোষ্ঠ পাতলা কঠিন আর মানুষকে কষ্ট দেওয়ার প্রতি খুব বেশিমাত্রায় ঘৃণার প্রকাশ তাতে। আমার ভবিষ্যৎ ঠিক হবে যে দণ্ডাদেশের উপর তখনও তা সেই অধরোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে, এবং ভয়ঙ্কর কথার প্রকাশে যেন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সকল ঠোঁটের বিকৃতি আমার চোখ এড়ায়নি যখন আমার নাম উচ্চারিত হচ্ছিল কিন্তু কোনো কথাই আমার কানে ঢুকল না বলে আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম।

ভয়ার্ত প্রলাপের কিছু সময়ে আমি লক্ষ্য করলাম যে-সব কাপড় ঘরের দেওয়ালে আছে সেগুলো খুব আস্তে নড়ে উঠল, যেটা প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না, এরপরে টেবিলের উপরের মোমবাতি সাতটার ওপর আমার চোখ পড়ল। আগে তাদের মনে হয়েছিল দয়ার চিহ্ন হিসেবে, যেন ক্ষীণতনু দেবদূত আমাকে বাঁচাবে। তবে তারপরেই আমার মধ্যে এক ভীষণ আকারের বিভীষিকা জাগ্রত হলো আর সমস্ত শরীর এমন কেঁপে উঠল যেন বিদ্যুৎ-এর ছোঁয়া লেগেছে এবং দেবদূত বলে যাদের মনে হয়েছিল সেগুলো হয়ে পড়ল অর্থছাড়া বিভীষিকা, তাদের মাথায় আগুন।

বোঝা গেল যে, কোনো সাহায্যই ওদের কাছে থেকে পাওয়া যাবে না। পরক্ষণেই অপরূপ গানের মতো আমার মনে হলো, কবরের মাঝে অপরিমেয় শান্তি, আস্তে আস্তে কল্পনাটা গড়ে উঠল আর পুরোপুরি গড়ে উঠতে অনেক সময় নিল। আর যখন পুরোপুরি উপভোগ করতে পারলাম তখন সাথে সাথে বিচার করা ম্যাজিকের মতো উবে গেল। বড় বড় মোমবাতিগুলোর আলোও সব কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, অন্ধকারের কালিমায় সব জায়গা ঢেকে গেল। মাটির নিচে আত্মার মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সমস্ত অনুভব উমত্ত গতিতে নিম্নমুখী হলো। পরক্ষণেই শুধু নিস্তব্ধতা, নিথরতা, আর সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শুধুমাত্র রাত্রি আর রাত্রি।

আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম ঠিকই, তবুও আমি বলব আমার সমস্ত অনুভবই হারিয়ে গিয়েছিল। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার স্বরূপ প্রকাশের অথবা বর্ণনার চেষ্টা করব না,–বাকি ছিল কিছু কিছু। কিন্তু তা কি গভীর ঘুমের মধ্যে ছিল, না প্রলাপের মধ্যে, না জ্ঞান হারানো অবস্থায়? না, কারণ এমনকি কবরের ভেতরেও যে সবকিছুই উধাও হয়ে যায় তাও নয়, কারণ তা হলে মানুষের অমরত্ব বলে কিছু অবশিষ্ট থাকতো না। গভীর ঘুম থেকে উঠে আমরা কোনো স্বপ্নের সুতাতন্তু বিচ্ছিন্ন করি। আর পরক্ষণেই, সেই তন্তু যত ক্ষুদ্রই হোক, মনে হয় না যে স্বপ্ন দেখছিলাম। জ্ঞান হারাবার পর সংবিৎ ফিরে আসার পথে দুটো ধাপ আছে: এক– মানসিক বা আত্মিক, এবং দুই-দৈহিক। দুনম্বর ধাপে পৌঁছে যদি আমরা আগের ধাপের স্মৃতি স্মরণে রাখি তাহলে দেখবো এইসব স্মৃতি ওপারের স্মৃতিতে মধুর হয়ে আছে। তবে কী সেই স্মৃতি? কবরের স্মৃতি থেকে আমরা এই স্মৃতিকে কিভাবে আলাদা করে রাখব? প্রথম ধাপ বলে যাকে নাম দেওয়া হয়েছে তার স্মৃতি যদি অনেক দিন মনে না করা হয় তবে দীর্ঘদিন পরেও তখন তারা অনাহূত হয়েও স্মরণে আসে, আশ্চর্য হই তখন।

যে ব্যক্তি কখনও জ্ঞান হারায়নি তার চোখে কি জ্বলন্ত কয়লার মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত হৰ্ম আর ভুলে যাওয়া মানুষের ছবি প্রস্ফুটিত হয় না, শূন্য আকাশে সবকিছুই তার চোখে ধরা পড়ে, যা অন্য লোকে দেখতে পায় না? জানা নেই এমন ফুলের গন্ধ কি মনে পড়ে না, যে সকল গানের ছন্দ পূর্বে মনকে নাড়া দেয়নি তার প্রভাব কি তখন মস্তিষ্ককে তোলপাড় করে তোলে না?

আপাতদৃষ্টিতে যা অস্তিত্বহীন তার মধ্যে নিমজ্জিত আত্মার কিছু চিহ্ন মনে আনার চেষ্টার সময় কিছু কিছু সময় ফুটে ওঠে যখন সাফল্যের স্বপ্ন ফুটে ওঠে, অস্পষ্ট মনে হয় অতি অল্প সময়ের জন্যে, কিছু বিশাল আকৃতির মূর্তি নিস্তব্ধে আমাকে কোন পাতালে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কের প্রকাশ তাতে কিন্তু তা অস্পষ্ট, হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা যার কারণ, কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ সমস্ত কিছুর মাঝে এক স্থায়ীত্ব এসে পড়ে। মনে হয়, যারা আমাকে নিয়ে এসেছিল বয়ে তারা নামতে নামতে অবনমনের কোন অতলে পৌঁছে ক্লান্তি বিনোদনের জন্য সেখানে স্তব্ধ হয়েছে। তারপরেই মনে পড়ে শুধু উন্মত্ততা নিষেধিত বস্তুগুলির মাঝে চলাফেরা।

হঠাৎ যেন আমার হৃদয়ের একেবারে শেষে শব্দ ও স্পন্দনের অনুভব ফিরে এলো–এই স্পন্দন হলো আসলে হৃৎপিণ্ডের ঝড় ওঠা। পরক্ষণেই শুধু নিস্তব্ধতা আর শূন্যতা। কিন্তু আবার ফিরে এলো শব্দ আর স্পন্দন সাথে সাথে স্পর্শও। এক অদ্ভুত ধরনের শিহরণ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। চিন্তাশক্তি বিলোপ ঘটেছে শুধু অস্তিত্বের অনুভূতি পাচ্ছি। এধরনের অবস্থা বেশ অনেকক্ষণ ধরে রইলো। কিছুক্ষণ বাদেই হঠাৎ করেই মস্তিষ্কের কার্য শুরু হলো, চিন্তাশক্তিও পুনরায় ফিরে এলো। সাথে সাথে ভীষণ ভয়ে মন ভরপুর হয়ে গেল, বাস্তব অবস্থা উপভোগ করার চেষ্টা মনে জেগে উঠলো। পরক্ষণেই ভীষণ ইচ্ছে করল আবার অজ্ঞান হয়ে যেতে। কিন্তু তবুও পুনরায় সমস্ত অনুভব মনে জাগল,–বিচারসভা, বিচারকগণ, বিচারকক্ষ, বিচারক, দণ্ডাদেশ, অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সবকিছুই মনে পড়ে গেলো। তবে তার পরেই যা ঘটেছিল তা পুরোপুরি বিস্মৃতির আড়ালে থেকে গেল,অনেক পরে তা ফিরে এসেছে অনেক চেষ্টার পরে কিন্তু তা অস্পষ্ট ভাবে।

আমি চোখ বুজেছিলাম এতক্ষণ। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি বুঝতে পারলাম, শরীরে কোনো বন্ধন নেই। হাত বাড়িয়ে দিতে সেই হাত খুব ভারী হয়ে একটা ভেজা, কঠিন জিনিষের উপর পড়ে গেল। অনেকক্ষণ হাতটাকে একই ভাবে রেখে আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আমি কোথায়, আমি কী? চোখ মেলে দেখার ইচ্ছে হলো তবে ভরসা হলো না, চারপাশে প্রথমেই যে-সব জিনিষ চোখে পড়বে সেই সবকিছুকেই ভয়। কিন্তু এর মানে তা নয় যে ভয়ার্ত কিছুর সামনাসামনি হতে আমি ভয় পাই, ভয় হচ্ছে যদি আমি কোনো কিছু দেখতে না পাই। অবশেষে আমি খুব ভয়ে ভয়ে চোখ মেলোম। ঠিক ঐ মুহূর্তে যে ভয় আমার মনের মধ্যে ছিল তা সত্যি প্রমাণিত হলো। অনন্ত রাত্রির শূন্যতা আমায় আবিষ্ট করে রেখেছে, কষ্ট করে আমায় শ্বাস নিতে হচ্ছে, আমাকে চেপে ধরে আমায় মৃত্যুমুখে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে অন্ধকার যেন গুরুভার হয়ে। নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে থেকে আমি যুক্তি দাঁড় করাবার চেষ্টা করলাম। তদন্তের কথা স্মরণে এলো এবং তার থেকে সঠিক পরিস্থিতি উপভোগ করার জন্য সচেষ্ট হলাম। উচ্চারিত হলো দণ্ডাদেশ, আর তখন মনে হলো অনেকটা সময় চলে গেছে, তবু তা সত্ত্বেও এক সেকেণ্ডের জন্যও মনে আসেনি যে আমার মৃত্যু হয়েছে। উপন্যাস গল্পে যাই পড়ি না কেন এ ধরনের ধারণার সাথে বাস্তবের কোনো সম্বন্ধ নেই। কিন্তু আমি কোথায়, এবং কী অবস্থায় আছি? আমাকে কি তবে আবার বন্দীশালায় নিয়ে আসা হয়েছে? তবে এটা তো তা নয়, আমার খুবই পরিচিত সেই বন্দীশালা।

ঠিক সেইসময় আচমকা এক ভীষণ আতঙ্কে আমার রক্তস্রোত উন্মত্ততায় নেচে উঠলো আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পরক্ষণে কিছুটা সামলে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, সমস্ত শরীরে খুব ঝাঁকুনি লেগেছে। চারদিকে পাগলের মতো হাত ছোঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলাম। কোনো কিছুই হাতে লাগলো না তবুও একটা পা-ও এগিয়ে যেতে সাহস পেলাম না, যদি কোনো স্মৃতিস্তম্ভের দেওয়ালে ধাক্কা খাই। দেহের প্রতিটা লোমকূপ দিয়ে ঘাম ঝরছে, বড় বড় বিন্দুতে তা কপালে জমছে, উৎকণ্ঠিত সেই যন্ত্রণা অবশেষে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল,দুহাত বাড়িয়ে আমি সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম। যতটা সম্ভব চোখের দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ করলাম, আলো যদি কিছুটা দেখতে পাই। অনেক পা-ই এগোলাম, কিন্তু সেই অন্ধকার, সেই সীমাহীন শূন্যতাও। নিশ্বাস প্রশ্বাস একটু সহজ হলো, মনে হলো, তবে হয়তো সীমাহীন কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে না।

ঠিক একইরকম আস্তে আস্তে আমি এগোচ্ছি, টোলেডোর ধর্মোন্মাদদের আতঙ্ক সম্পর্কে যে সব গুজব অনেক শোনা গিয়েছিল তা সবকিছুই স্মরণে এলো। জেলখানার অত্যাচার সম্পর্কে অনেক ভয়ার্ত গল্প শুনেছিলাম, মনে করেছিলাম সেগুলো নিছকই গল্প,–অবিশ্বাস্য, অতিরঞ্জিত।

আমার ভাগ্যে কি তবে এই ভূগর্ভস্থ অন্ধকারের রাজ্যে অনাহারে মৃত্যু রয়েছে, তা না হলে কি এর থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে? মৃত্যুই যে আমার শেষ পরিণতি সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ, আর সেই মৃত্যু যে অত্যন্ত যন্ত্রণাকাতর হবে তা বিচারকদের দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই যন্ত্রণা কোন সময়ে আসবে আর তাকে দেখতেই বা কেমন হবে সেই ভেবেই আমি পাগলের মতো হয়ে উঠি।

অবশেষে আমার হাত একটা কঠিন কিছু স্পর্শ করলো। মনে হয় একটা দেয়াল যা পাথরের গাঁথনিতে তৈরি। মোলায়েম দেওয়ালটা খুব চটচটে আর কনকনে ঠান্ডা। সন্দিহানভাবে প্রতিটি পা ফেলে অত্যন্ত সন্তর্পণে সেই দেওয়াল ধরে এগোলাম। বুঝতে পারলাম না তবুও যে, আমার এই জেলখানার বিস্তৃতি কতটা? কারণ যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম দেওয়ালের চারপাশটা ঘুরে সেখানেই পৌঁছেছি কি না তা বুঝতে পারলাম না। পকেটে একটা ছুরি ছিল সেটার সন্ধান করলাম, কিন্তু সেটা কোথায়? আমার সমস্ত পোষাক খুলে নিয়ে মোটা ধরনের সার্জের পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছুরিটা যদি থাকতো তাহলে তার বাঁধানো ফলা দিয়ে দেওয়ালের কোথাও সঠিক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে চিহ্ন রাখতে পারলাম। তবে এই সমস্যার সমাধান খুব একটা কঠিন ছিল না।

কিন্তু সেই সময়ের বিকৃত কল্পনায় তা একেবারেই সম্ভব ছিল না। একটুখানি জামার কাপড় থেকে ছিঁড়ে সেটা লম্বালম্বি করে দেওয়ালের সঙ্গে সমকোণে রেখে পুনরায় দেওয়াল ধরে এগোতে থাকলাম, অবশেষে সেটা যখন ছুঁয়ে দেখলাম তখন মনে হলো একপাক ঘঘারা হয়ে গেছে। সেই সময়ে আমার এই ধারণাই হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কয়েদখানার আয়তন এবং আমার দুর্বলতা কোনোটাই গণনায় নিইনি। কয়েদখানার মেঝেটা ভেজা, পিছল। কিছুটা টলতে টলতে এগোবার পর আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম, সেইজন্য ঠিক ঐভাবেই খানিকক্ষণ রইলাম। আর পরক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম থেকে যখন উঠলাম। হাত বাড়িয়ে পাশে একখানা রুটি আর এক কলসি জল দেখতে পেলাম। তখনকার অবস্থা সম্বন্ধে ভাবনা চিন্তা কবার সময় ছিল না, লোভীর মতো খেতে শুরু করলাম। বেশ কিছু সময় পরে আবার পায়চারি শুরু করলাম। কয়েদখানা ঘিরে আর অনেকক্ষণ কসরৎ করার পর পুনরায় পোশাকের টুকরোটা পেয়ে গেলাম। হোঁচট খেয়ে যখন পড়ে গিয়েছিলাম তখন বাহান্ন পা হেঁটেছি, এরপরে আর আটচল্লিশ পা হাঁটলাম। এক গজ দুই পা হাঁটলে সেই হিসাব করে বোঝা গেল কয়েদখানার পরিধি পঞ্চাশ গজের মতো। কিন্তু দেওয়াল ধরে চলার সময় অনেক কোণ বুঝতে পেরেছিলাম, সেই কারণে দেওয়ালের আকার সম্পর্কে কোনো ধারণা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হলো।

এধরনের পরীক্ষায় আমার যে কোনো লক্ষ্য ছিল তা নয়,–তাছাড়া এর উপরে যে কোনো কিছু নির্ভরশীল ছিল তাও নয়, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবুও কোনো নির্দেশ ছাড়াই কৌতূহলবশতঃ আমি চলছিলাম। কিছুপরেই ঠিক করলাম দেওয়াল ছেড়ে দিয়ে বেষ্টনীর মধ্যে পরীক্ষা চালাবো। মেঝে শক্ত হলেও খুবই পেছল; পড়ে যাওয়ার ভয় আছে সেইকারণে প্রচণ্ড সতর্ক থেকেই প্রথমটায় পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছি। অবশেষে যাইহোক খুব শক্ত পায়ে এগিয়ে চললাম। উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব সোজা এগিয়ে যেতে পারি, দশ বারো পা এইরকম ভাবে এগোনোর পর হঠাৎ পোশাকের ছেঁড়া অংশটা আমার পায়ে জড়িয়ে গেলো, আর সাথে সাথে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম।

সেই সময় যখন পড়ে গেলাম, একটা বীভৎস ব্যাপার উপভোগ করতে পারিনি, কিন্তু একইভাবে কিছু সময় পড়ে থাকার পর তা আমার মনোযাগ আকর্ষণ করলো। কারণটা হলো এই : মেঝে ছুঁয়ে রয়েছে বটে তবে আমার থুতনি আর আমার ঠোঁট মাথার উপর দিক থুতনির থেকে উপরে হলেও কোনো কিছুই ছোঁয়নি, আর সেই সময় আমি যেন বুঝতে পারলাম আমার কপাল চটচটে একটা বাষ্পে ভিজে গেছে, একই সাথে পচা ছত্রাকের গন্ধও আমি পাচ্ছি। হাত প্রসারিত করে দিতে বুঝতে কষ্ট হলো না যে, এক গোলাকার গর্তের একেবারে মুখে আমি পৌঁছে গেছি,–গর্তের আয়তন কত ছিল সেই সময়ে আন্দাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, নিম্ন দিকে হাতড়াতে হাতড়াতে একটা গাঁথনি আমার হাতে চলে এলো। গাঁথনিটা আমি গর্তের মধ্যে ফেলে দিলাম। ঢিলটা গর্তের দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে নামছে আর তার প্রতিধ্বনি উঠছে, একের পর এক সময় কেটে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত। অবশেষে সেটার জলে পড়ার আওয়াজ আমার কানে এলো, কিছুক্ষণ বাদেই খুবই সজোরে তার প্রতিধ্বনি শোনা গেলো। একই সময়ে মাথার উপরের একটা দরজার খুব জোরে খোলার আর বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এলো, আর আচমকাই সেখান দিয়ে একটা আবছা ঝলক দেখা দিয়েই তখনি মিলিয়ে গেলো।

আমার জন্য যে ধরনের শাস্তি অপেক্ষা করছিল তা আমার চোখে অস্পষ্ট রইল না, আর নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানালাম যে, আমি সেই গহ্বরে পড়ে যাইনি। আর একটা পা যদি এগোতাম তাহলে আর আমার নিস্তার থাকত না। এই হাত সে ধরনের মৃত্যু বা ধর্মোন্মাদদের ব্যবহারের বীভৎসতম কাহিনী শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি তেমনি এক ভয়ঙ্কর পরিণতি। ওরা যারা সকলকে শাস্তি দিত তাদের কাছে মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার দুটো ভিন্ন রাস্তা ছিল: সোজাসুজি চরম শারীরিক যন্ত্রণা হলো একটা, আর অন্যটা বীভৎস মানসিক যন্ত্রণার। ঐ দ্বিতীয় রাস্তাটাই আমার জন্যে ঠিক হয়েছিল। অনেক দিন যন্ত্রণা ভোগের ফলে আমার স্নায়ুমণ্ডলী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল, নিজের গলার স্বরেই কেঁপে কেঁপে উঠছি।

একইভাবে কাঁপতে কাঁপতে আমি হাতড়াতে হাতড়াতে পুনরায় দেওয়ালে ফিরে গেলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম বরং সেখানেই মরব, কুঁয়োর ঐ বীভৎসতার মধ্যে তবুও যাবো না। আমি সাহসে ভর করে ঐ কুঁয়োর গর্তে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু বরণ করতাম যদি মনের অবস্থা অন্যরকম থাকতো। তবে সেই সময় আমি মনের সমস্ত সাহস হারিয়ে ভীষণ ভীতু হয়ে পড়েছিলাম, সেই কারণে সাহস হলো না। আর সেই গর্ত দেখে আমি যা বুঝেছিলাম তাও ভোলার নয়,ভুলিনি আমাকে যে ওরা হত্যা করার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছিল তার মাঝে আচমকা জীবননাশের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

মানসিক যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাগ্রত থাকার পর অবশেষে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর ঘুম থেকে উঠে এবারও পাউরুটি আর জল পেলাম। তৃষ্ণায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম, একবারেই জলটা শেষ করলাম। জল খাওয়ার সাথে সাথে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম, মনে হয় জলে কোনো ওষুধ ছিল! মৃত্যুর মতোই সেই ঘুম। কতক্ষণ যে ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। কিন্তু যখন চোখ মেলোম আশেপাশের জিনিষগুলো তখন চোখে পড়লো। কোথা থেকে যে ফসফরাসের আলো এসে পড়েছে জানি না। কয়েদখানাটা সেই আলোয় দেখতে পেলাম।

কয়েদখানাটার আয়তন সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল ছিল, দেওয়ালটার পরিধি বেশি হলেও পঁচিশ গজ। সেই মাপে অবশ্য কি আসে যায়? তবুও, সেই মাপের সম্বন্ধে কোথায় আমার ভুল ছিল তা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম, অবশেষে বুঝতেও পারলাম। বাহান্ন পা গিয়ে প্রথমবার পড়ে গিয়েছিলাম, আসল ব্যাপার হলো তখন পোশাকের টুকরোটা মাত্র দুএক গজ দূরে ছিল। আর ঘুম থেকে উঠে যখন হাঁটা শুরু করেছিলাম তখন যে দিক থেকে এগিয়েছিলাম আবার পুনরায় সেই দিকেই চলছিলাম। এই কারণে দূরত্বটা আমার ধারণায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। ভারাক্রান্ত মনের অবস্থা, আমি খেয়াল করিনি ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি বাঁ-হাতে দেওয়াল ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আর পরের বার ডান হাত দিয়ে দেওয়াল ধরে এগোচ্ছিলাম।

ঘরটার আকার সম্পর্কেও আমার ভুল ধারণা ছিল। আন্দাজে আন্দাজে দেওয়ালের যে সব জায়গা আমার কোণ বলে মনে হয়েছিল আদপে সেগুলো কোণ না, দেওয়ালের কয়েকটা খাঁজ বা কুলুঙ্গি; ঘরটা আসলে সম-চুতুষ্কোণই। ঘরের দেওয়াল পাথরের তৈরি নয়, লোহা অথবা অন্য কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, যেখানে যেখানে জোড় ছিল আমার সেগুলোকে কোণ বলে মনে হয়েছিল। ধর্মোন্মাদদের আঁকা দেওয়ালে সমস্ত ভয়ঙ্কর দৃশ্য সেই সব ছবি কঙ্কাল, পিশাচ, শয়তান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের। রঙ উঠে গেলেও এইসব দৃশ্যে দেহরেখা কিন্তু স্বচ্ছ। এতক্ষণ বাদে মেঝের দিকে দৃষ্টি পড়ল, সেটাও পাথরের, ঘরের মাঝখানে সেই গর্ত যার দেওয়াল থেকে অবশেষে আমি রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু একটিই গর্ত ঐ কয়েদখানার।

যা দৃষ্টিগোছের এলো তা সবই অস্পষ্ট আর অনেক চেষ্টার পরেই তা দেখেছিলাম, কারণ ঐ ঘুমের ফলে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছিল, আমি এখন লম্বালম্বিভাবে পিঠে ভর দিয়ে শুয়ে আছি, চামড়ার ফিতে দিয়ে খুব শক্ত করে একটা নিচু ফ্রেমের মধ্যে বাঁধা অবস্থায়। খুব শক্তপোক্ত ভাবেই বাঁধা, আমার মাথা আর বাঁ বাহুর একটা অংশ শুধু বাঁধা নেই কারণ যাতে আমি খুব চেষ্টা করে পাশেই রেখে দেওয়া মাটির পাত্রের খাবারটা খেতে পারি। আর প্রচণ্ড ভয়ের সঙ্গে দেখলাম জলের পাত্রটা আর নেই কিন্তু প্রচণ্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাকে যে মাংস খেতে দেওয়া হয়েছিল তা রান্না করা হয়েছিল এমন করে যাতে জলের তৃষ্ণা খুব ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে আর আমি যেন এই তৃষ্ণাকে ভালো ভাবে অনুভব করি।

কয়েদখানার ছাদের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুটের মতো তার উচ্চতা, দেওয়ালগুলোর মতো করেই সেটা তৈরি। আমার সব মনোযোগ আকর্ষণ করলো তার প্যানেলের একটা ছবি। মহাকালের ছবিটা, যেভাবে তার ছবি অঙ্কিত এটা সেই একইভাবে আঁকা–পার্থক্য শুধু এই যে, প্রথম দেখাতেই তার হাতে কাস্তের পরিবর্তে একটা বিরাট দোলক। পুরানো আমলের ঘড়িতে যে রকম দোলক থাকত, এমন একটা জিনিষ ছিল তার গঠনে। সেই জন্যেই আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে সেই বস্তুটা দেখতে লাগলাম, আমার মনে হলো সোজা সেটার দিকে তাকিয়ে যেন তা নড়ছে (সেটা আমার ঠিক উপরে ছিল) আর পরক্ষণেই তা সত্যি প্রমাণ পেল। অত্যন্ত আস্তে আস্তে অনেক সময় ধরে সেটা নড়ছিল। কিছুটা ভীত কিন্তু তার থেকেও প্রচুর বিস্ময় নিয়ে আমি কিছু সময় সেটা দেখলাম বটে। তার এই আস্তে আস্তে নড়াচড়া ভাব দেখে ক্লান্তিতে আমি শেষ পর্যন্ত চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

একটা অস্পষ্ট শব্দ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। দেখলাম মেঝেতে অনেকগুলো ধেড়ে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুঁয়োর ভেতর থেকে ইঁদুরগুলো বেরিয়ে এসেছে। আমার ডানদিকেই কুঁয়োটা একেবারে দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। তারা লোভী দৃষ্টিতে সেই অবস্থাতেই আমার চোখের সামনে এগিয়ে এলো। মাংসের লোভেই তারা এগিয়েছে। অনেক চেষ্টা করার পর তবেই তাদের তাড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো।

উপরে পুনরায় যখন চোখ ফেরালাম তার মাঝে আধঘণ্টা হয়তো-বা এক ঘণ্টা কেটে গেছে (সঠিক সময় সম্পর্কে ধারণা করা যায়নি)। যা দৃষ্টিগোচর হলো তাতে আশ্চর্য হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সম্ভবতঃ এক গজের মতো জায়গা নিয়ে দোলকটার দোলন যাচ্ছে আর স্বাভাবিকভাবেই তার গতিও বেড়েছে। যা দেখে বিশেষভাবে অস্বস্তিবোধ করলাম তা হলো, সেই দোলকটা ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমে আসছে। অসম্ভব ভয়ের সঙ্গে দেখলাম, দোলকটার নিচের দিকটা ঝলমলে ইস্পাতের তৈরী, প্রায় এক ফুটের মতো দূরত্ব হবে দুপ্রান্তের। সেই দোলকের প্রান্তভাগ ক্ষুরধার। প্রচণ্ড ভারী একটা পেলের পাতের সাথে সেটা দুলছে। দোলার জন্যে একটা হিসহিস শব্দ হচ্ছে।

যন্ত্রণা কষ্ট দেবার জন্য ধর্মোন্মাদরা যে এক নতুনত্ব পথ বেছে নিয়েছে সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই। গর্তটা যে আমি দেখেছি তা তারা জেনে গেছে,-যে গর্তের ভয়ার্ততাই আমার ভাগ্যলিপি, লোকমুখে যে গর্তটি নরকের চিহ্ন বহন করে আর শাস্তির চরম উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যথেষ্ট ভাগ্যের শক্তিতে তাদের এই মতলব ছিল না যে, আমাকে সেখানে ঠেলে ফেলে দেবে, অত্যন্ত হাল্কা ব্যবস্থাই ছিল আমার মৃত্যুর জন্যে; হা হাল্কাই বলা যায়, সেই ভারাক্রান্ত মনেও এই কথাটা মনে হওয়াতে আমার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

ইস্পাতনির্মিত সেই দোলকের দোলা শুনতে শুনতে যে ভীষণ ভয়ের মধ্যে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে কাটাতে হয়েছিল তা সহ্য করা যে কোনো মানুষের কাছেই সম্ভব ছিল না বলেই মনে হয় তবে তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে কী লাভ? সেটা নিচের এক ইঞ্চির মতো নেমে আসছে, আর তার নামার সময়টা আমার কাছে যেন অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছে। তবে তার নিয়ম অনুযায়ীই তা নেমে আসছে। একের পর এক দিন কেটে গেল অবশেষে আমার মনে হলো যে দোলকটার দোলার হাওয়াও যেন আমি বুঝতে পারছি, তীক্ষ্ণ ইস্পাতের গন্ধও আমি পেলাম। ভগবানকে আমি বারবার প্রার্থনা করতে লাগলাম যাতে সেটা তাড়াতাড়ি নেমে আসে। পাগলের মতো হয়ে গেলাম আমি, উঁচু হয়ে চেষ্টা করতে লাগলাম ঐ ভীষণ আকৃতির অস্ত্রের ছোঁয়া অনুভব করতে। সেই উজ্জ্বল মৃত্যুর নিচে শুয়ে হাসতে শুরু করলাম এমনভাবে যেন কোনো শিশু কোনো দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখছে।

আর কিছুক্ষণ সময় কেটে গেলো পুরোপুরি অসাড় অবস্থায়। কিন্তু বেশি সময় কাটেনি কারণ এর সাথে দোলকটার নেমে আসা অনুভব করার মতো হয়নি। তবে একথা খুব জোর দিয়ে বলা যায় না, হয়তো শয়তানরা আমাকে জ্ঞানহারা অবস্থায় দেখে দোলকের গতি কমিয়ে এনেছিল, হয়তো তারা চায় না যে, জ্ঞানহীন অবস্থাতেই আমার দেহ খণ্ডিত হয়ে যায়, তবে তো সে কষ্টের আশু উপশম হবে। জ্ঞান ফিরে এলেও আমি কত যে দুর্বল বোধ করছিলাম তা বলা সম্ভব নয়। অনেকদিন ধরে নিশ্চেষ্ট থাকার জন্যই এই দুর্বলতার সৃষ্টি। সেই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও শুধুমাত্র নিজের দেহের প্রয়োজনেই খাবারের আশায় ছিলাম। বাঁ হাতটা যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিয়ে ইঁদুরদের খাবার পর যতটুকু খাবার বেঁচেছিল তাই তুলে নিলাম। সেই খাবারটা খেতে যাব ঠিক সেইসময় আশার একটা আলো আমার মধ্যে ছুটে এলো। তবে কেন যে আমার মধ্যে আশার উদ্বেগ হবে? এধরনের আশার আলো প্রায় সময়ই মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে, তবে তা কিন্তু কোনোদিন বাস্তবায়িত হয় না। আমার মনে হলো তা আশা ও আনন্দের আর সেইসাথে আমি বুঝতে পারলাম যে তা দূর হয়ে গেছে। আবার সেই অনুভূতিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। আমার মনের জোর অনেক কমে গেছে, শুয়ে শুয়ে আমি একেবারে কর্মহীন হয়ে পড়েছি।

আমার দেহের কোণাকুণি ভাবে দোলকটা নেমে আসছে। বুঝতে পারলাম সেটা যেভাবে নিম্নে ধাবমান হচ্ছে যে তা আমার হৃৎপিণ্ডকে খণ্ডিত করবে। সর্বপ্রথমে পোশাকটা কাটবে তারপর পুনরায় কাটবে কাটতেই থাকবে। প্রায় ত্রিশ ফুট জায়গা ঘিরে হিসহিস শব্দ করে দোলকটা দুলছে। এই ঘরের দেওয়ালের লোহার পাত কাটারও শক্তি আছে তার, তবুও বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঐ দোলকটা শুধুমাত্র আমার পোশাকটাই ছিঁড়বে। এত অবধি আসার পর আমার চিন্তা ভাবনা আর এগোলো না।–এই চিন্তা থেকে মনটা সরালেই দোলকটার নেমে আসা বন্ধ হবে। দোলকটা আঘাত করলে যখন আমার পোশাক ছিঁড়ে যাবে তখন শব্দটা কিরকম হবে তা চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। দাঁতে দাঁত চেপে সমস্ত কথা ভাবছি।

আস্তে আস্তে দোলকটা নামছে নামছে। তার নেমে আসা আবার ওঠার এই দুটোর তুলনা করে এক উন্মত্ত আনন্দ আমার মনে জাগ্রত হলো। বাঁ দিক ডান দিকে সেটা দুলছে এবং অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো তা আওয়াজ করছে, আর কোনো শব্দ না করেই বাঘের মতো চুপিচুপি তা নেমে আসছে।

দোলকের গতিকে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, তা নামছেনামছে। আমার বুকের তিন ইঞ্চির মধ্যে এসে তা কাঁপছে। খুবই প্রচেষ্ট হলাম দুটো হাত বন্ধনমুক্ত করতে,–শুধুমাত্র তা কনুই পর্যন্তই খোলা ছিল। যাতে প্রচণ্ড চেষ্টার পর আমি হাতটা মুখ পর্যন্ত আনতে পারি, এর বেশি না। কিন্তু দোলকটার দোলন আমি থামাতে পারতাম যদি কুনুইয়ের ওপর দিককার বাঁধন খুলতে পারতাম,–তবে হিমানীপ্রপাত রোধেরই মতো সে চেষ্টা হতো।

অমোঘভাবে দুলতে দুলতে নেমে আসছে ক্রমশঃ নামছে। দোলার সাথে সাথে আমি হাঁপাচ্ছি। একেবারে গুটিয়ে যাচ্ছি, থরথরিয়ে কাঁপছি, এবং যখন নেমে আসছে তখনই প্রচণ্ড ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলছি–অবশ্য মৃত্যুকে কিন্তু আমি যথেষ্ট আহ্বান করছি।

বুঝতে পারলাম আর দশ বারো হাত নেমে এলেই দোলকটা আমার পোশাককে ছুঁতে পারবে। সাথে সাথে আচমকা একটা হতাশাগ্রস্ত শান্তিতে আমার মন ভরে উঠলো। অনেকদিন পরে–অনেক সময় পরে আমার চিন্তা করার শক্তি ফিরে এলো। বুঝলাম যেভাবে আমি বাঁধা আছি তার একটা বৈশিষ্ট্য হলো যে, আলাদা আলাদা দড়িতে আমি বাঁধা নেই, একটা দড়ি দিয়েই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। দোলকের প্রথম আঘাতটাতেই তা ছিঁড়ে যাবে ফলে তখন আমার কাছে বাঁ হাতের দ্বারা মুক্তি পাওয়া সহজ হবে। তবে পুনরায় দোলকের ফিরে আসার মধ্যে কি আমার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে? তবে পরক্ষণেই দেখলাম যে বুকের ঠিক যে স্থানে দোলকটা পড়বে সেখানে কোনো বাঁধন নেই। ফলে সেই আশাও ফলপ্রসূ হলো না।

মনটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। মাথাটা নামিয়ে নিলাম।

আমি যে স্থানে শুয়ে আছি সেখানে অনেক উঁদুর। তারা বন্য যেমন তেমনি সাহসীও। আর ঠিক তেমনই ক্ষুধার্ত। লাল চোখ মেলে তারা আমাকে দেখছে, আমার নড়াচড়া কখন স্তব্ধ হবে তার জন্যেই যেন অপেক্ষারত, আর সেই সময়েই আমি তাদের শিকারে পরিণত হব। তবে এখানে ওরা কি খাবার পায়?

আমার যথেষ্ট সাবধানতা সত্ত্বেও তারা আমার ডিসের মাংস খেয়ে খেয়ে খুব সামান্যই আমার জন্য রেখেছে। ইঁদুর তাড়াবার জন্য সবসময় হাত নাড়ান আমার অভ্যাস হয়ে গেছিল। আমার কাছ থেকে এভাবে বাধা পেয়ে মাঝে মধ্যেই ইঁদুররা আমার আঙুলে দাঁত বসিয়ে দিত।

মাংসের যে তেল তেল ঝোল অবশিষ্ট ছিল তা নিয়ে দড়ির যেখানে যেখানে হাত গেলো লাগাতে থাকতাম, এরপরে দম বন্ধ করে মাথা তুলে শুয়ে রইলাম।

এ ধরনের পরিবর্তন দেখে ইঁদুররা প্রথমে চমকে উঠেছিল–ভীতও হয়েছিল–নাড়াচড়া করছে না কেন লোকটা? তারা পেছনে সরে গেল, আবার অনেকে ছায়া দিয়ে নেমে গেলো। তবে ক্ষণকালের জন্যে,–আমি দেখছিলাম ওরা কতটা খাবার সম্বন্ধে লোভী। আমাকে নিথর ভাবে থাকতে দেখে দুটো-একটা ইঁদুর আমার বিছানায় উঠে এসেছিল, তারা গন্ধ নেবার চেষ্টা করলো। এটা মনে হয় কোনো কিছুর সঙ্কেত, কারণ সাথে সাথে দলে দলে ইঁদুর ছুটে এলো। তারা আমার ওপরে শয়ে শয়ে ঝাঁপ দিলো। দোলকের দোলন তাদের বাধা সৃষ্টি করলো না। আমার ঠোঁটে, শরীরে পর্যন্ত তারা মুখ দিল, আমার দম আটকে যাবার মতো অবস্থা হলো তাদের চাপে। ঘিন ঘিন করতে লাগল গা, ঠান্ডা হয়ে গেলো বুক। তবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সমস্ত চেষ্টার অবসান হবে কারণ বাঁধন থেকে আমি মুক্ত হয়ে যাচ্ছি তা আমি বুঝতে পারছিলাম। মনে হয় দু-এক জায়গায় তা কেটেও গেছে। প্রচণ্ড মানবসুলভ প্রচেষ্টায় আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।

আমার হিসেব সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল আর যে কষ্ট সহ্য করেছি তাও আমার ব্যর্থ যায়নি। আর কিছু না হোক, এখন আমি সম্পূর্ণ মুক্ত; আমার দেহটা যে কাপড়ে ঢাকা তা খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে, আবার দুবার নেমে এলো দোলকটা, প্রত্যেকটা গ্রন্থিতে যন্ত্রণার তীব্রতার অনুভূতি হলো। তবুও মুক্তির সময়টা এসে গেল, হাত নাড়াচড়া করতেই ইঁদুরটা তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে গেলো। খুব আস্তে আস্তে আমি বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দোলকের পরিধি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে এখন আমি মুক্তি পেলাম।

ভয়ের সেই বিছানা থেকে পাথরের মেঝেতে পা দিতে না দিতে দেখলাম ঐ বিশাল আকৃতির দোলকটার দোলা বন্ধ হয়েছে, সেটা টেনে ছাদের ভেতর দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কোন এক অদৃশ্য শক্তি। আমার সমস্ত নাড়াচাড়ারও যে দৃষ্টি আছে তা বুঝতে কোনই অসুবিধা হলো না। আমি এই ধরনের মৃত্যু থেকে যে মুক্তি পেলাম তা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাহলেও অন্য কোনো অথবা এর থেকে বীভৎস যন্ত্রণার মৃত্যু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। চারদিকে কিছুটা ভয়ে ভয়েই তাকালাম, একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন দৃষ্টিতে এল, যা এতক্ষণ আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না এবং তার অর্থ আমি এতক্ষণ বুঝতে পারিনি, এই প্রথম সেই আলোের আসল রূপটি উপলব্ধি করতে পারলাম। প্রত্যেকটা দেওয়ালের নিচে আধ ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা দিয়ে এই আলো আসছে। কিন্তু উঁকি মেরে কিছু দৃষ্টিগোচর হলো না।

সেখান থেকে ওঠার পরে সেই রূপান্তরের রহস্য আমার সামনে প্রকাশ পেল। দেখলাম দেওয়ালের যে সব দৃশ্যগুলো আবছা ছিল এখন সেগুলো খুবই স্পষ্টভাবে দেখা দিচ্ছে, যে সব বীভৎস ভয়ার্ত সিনারি ঐ ফটোতে দেখা যাচ্ছে তা আমার চেয়ে শক্তিমান স্নায়ুর অধিকারীকে কাঁপানোর জন্যে যথেষ্ট। অগুন্তি বীভৎস দৈত্যের ছবি সেই দেওয়ালে যেরকম ফুটে উঠছে সেগুলি বাস্তব বলেই ধরতে হবে।

অবাস্তব? আমার নাক যে গরম লোহার গন্ধ পাচ্ছে তাও নিশ্চয়ই অবাস্তব,–সেই ঘ্রাণে দম আটকে আসার উপক্রম। যে সমস্ত ছবি আমার অসহায় অবস্থা প্রত্যক্ষ করছে, তাদের চোখ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রক্তপাতময় ভয়ঙ্কর দৃশ্যে রক্তে রঙের মাত্রাও চোখে পড়লো। শ্বাস নিতে পারছি না, হাঁপাচ্ছি। বুঝলাম ওদেরই পরিকল্পনা। ওঃ কী মর্মান্তিক, কী বীভৎস শয়তানি। দেওয়ালের তাপ থেকে সরে আমি ঘরের মাঝখানে চলে যেতে বাধ্য হলাম, তাপে পুড়ে যাওয়ার থেকে কুঁয়োর ঠান্ডা ভাবই আমার কাছে ভালো লাগলো। কুঁয়োর কাছে তাড়াতাড়ি করে গেলাম। নিচের দিকে তাকালাম। ছাদের থেকে যে তাপের ঝলকানি নেমে এলো তাতে কূপের ভেতর পর্যন্ত স্বচ্ছ লাগছে। যা দৃষ্টিগোচরে এলো তার অর্থ বুঝতে কিছুক্ষণের জন্য আমি স্বীকার করলাম না। অবশেষে তবে মানতেই হলো, সেই অনুভব আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে পৌঁছে কাঁপুনির সঞ্চার করলো। হায়, আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি। কি মর্মন্তুদ আতঙ্ক–যে কোনো ভয়ঙ্কর আতঙ্ক এর থেকে আশাপ্রদ। তীব্র চিৎকার করে আমি কুয়োর মুখ থেকে দুহাতে মুখ ঢেকে সরে এলাম, অসহ্য কান্নায় চোখ ভাসিয়ে।

গরম ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে–আবার একবার মুখ তুলে তাকালাম, কাঁপতে কাঁপতে জরাগ্রস্তের মত। গর্তের মধ্যে আবার একটা রূপান্তর এসেছে, এবারকার রূপান্তর আকারগত। এবারও আমি আগের বারের মতো বুঝতে পারিনি কী ঘটনা ঘটতে চলেছে। কিন্তু বেশি সময় লাগল না বুঝতে। দুবার রক্ষা পেয়ে যাওয়ায় ওদের প্রতিশোধ নেবার আকাঙ্ক্ষা খুবই বেড়ে গেছে। তারা এবার আর এ ধরনের খেলা নিয়ে ব্যস্ত নয়। সমচতুষ্কোণ ছিল ঘরটা, এখন দৃষ্টি গেল তার দুটো কোনো সমকোণের থেকে সরু হয়ে গেছে, অন্য দুটো সমকোণের চেয়ে বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রমশই কোণগুলোর এই পার্থক্য বেড়ে যেতে লাগলো। তার সাথে সাথে একটা ক্ষীণ আওয়াজ কানে ঢুকলো আর অল্পক্ষণের মধ্যে ঘরটা একটা লনের আকৃতি ধারণ করলো। তবে তা এখানেই শেষ না, আর আমি তা চাইওনি। লাল টকটকে দেওয়ালটাকে আমি প্রচণ্ড শান্তির আস্তরণের মতো চেপে ধরতে পারতাম। নিজের মনেই ভাবলাম, ঐ গর্তে পড়ে মৃত্যুর চেয়ে যে কোন বীভৎস মৃত্যুও ভালো। বোকা, বোকা আমি! আমার বোঝা কি উচিত ছিল না, যে ওদের লক্ষ্যই হলো আমাকে বাধ্য করা ঐ গর্তে পড়তে, এই উত্তাপ আর চাপ সহ্য করা কি আমার পক্ষে অসম্ভব হবে? সেই লনের আকার এখন এমন তাড়াতাড়ি চ্যাপ্টা হতে থাকলো যে আমি আর চিন্তা করতে পারলাম না। এর মধ্যিখানটা, যা সবচেয়ে চওড়া, তা ঠিক গর্তের ব্যাদিত মুখ পর্যন্ত চলে গেলো। গুটিয়ে গেলাম আমি, তবে দেওয়ালগুলো ক্রমেই ছোট হতে হতে ভীষণ ক্ষমাহীন ভাবে আমাকে চাপ দিতে চাইলো, অবশেষে একটা অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, পা দেওয়ার পর্যন্ত এক ইঞ্চি জায়গাও রইল না। পুনরায় আর চেষ্টা করলাম না। নিরাশার তীব্র, দীর্ঘ, শেষ আর্ত চিৎকারে আর যন্ত্রণা প্রকাশ পেল। বুঝতে পারলাম আমি গর্তের মুখে গিয়ে টলছি–আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

আমার কানে মানুষের গলার আওয়াজ সুরহীন হয়ে একই সাথে যেন অনেকগুলো তুরী, ভেরী বেজে উঠলো, হাজারটা বিদ্যুৎ গর্জন করে উঠলো, আগুনে নিমগ্ন দেওয়ালগুলো পিছনে সরে যেতে শুরু করলো। আমি অজ্ঞান হয়ে গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলাম, একটা হাত আমাকে আঁকড়ে ধরলো। এই হাত জেনারেল লাসেনের ফার্সি ফৌজ টলেডোয় ঢুকেছে, তারা জয়যুক্ত হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *