১. প্রথম অঙ্ক–সন্দেহ

থ্রি অ্যাক্ট ট্রাজেডী (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি

প্রথম অঙ্ক-সন্দেহ

০১.

কুলায়

সমুদ্র তীর থেকে চোখে পড়া পাহাড়ের ওপর পাখির নীড়ের মতো ছোট্ট বাড়ি কুলায়। একটি পায়ে চলা পথ সমুদ্র তীর থেকে উঠে গেছে, কুলারের দিকে। ধূসর রঙের ফ্লানেল ট্রাউজার্স আর সোয়েটার পরিহিত এক সম্ভ্রান্ত সুদর্শন চেহারার ভদ্রলোক ঐ পথ ধরে উঠে আসছেন। তার চেহারার বাঁধুনির জন্য বয়স ধরা মুশকিল। প্রথম দর্শনে তাকে নৌ বাহিনীর অফিসার বলে মনে হয়। আসলে তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত অভিনেতা স্যার চার্লস কাটরাইট।

চার্লসের দুজন অতিথি কুলারের বারান্দায় বসে ছিলেন। শিল্প রসিক ও নাট্যমোদী শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট এবং নামজাদা ডাক্তার স্যার বার্থালমিউ স্ট্রেঞ্জ চড়াই বেয়ে উঠে আসা চার্লসকে তারা দেখলেন। তারা নিজেদের মধ্যে স্যার চার্লসের অভিনয় জগৎ থেকে ফিরে এসে এই নির্জন সমুদ্রতীরে বসবাস করার কথা আলোচনা করছিলেন। প্রথমে তাদের ধারণা ছিল, চার্লস তার মঞ্চের নেশা, জনতার প্রশংসা এই সব কিছু থেকে দূরে বেশি দিন থাকতে পারবেন না। অথচ দুবছর এখানে কাটিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে দিলো তাদের ধারণা ভুল।

চার্লস কার্টরাইট এসে হাজির হলেন–আপনারা কেবল বসে বসে গল্প করুন। আমি আমার ছোট্ট নৌকোটা নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে ছিলাম।

নিরুদ্দেশ যাত্রায় একাই গিয়েছিলেন, না কি সঙ্গে কেউ ছিলেন? ডাক্তার জানতে চাইলেন।

-না, সঙ্গে ঐ মেয়েটি, মানে শ্রীমতী লিটন গোর ছিলেন। জানো টলি, স্যার বার্থালমিউয়ের ডাকনাম হলো টলি, এই নির্জন জায়গাটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। সারাদিন নৌকো করে ঢেউয়ের ওপরে ঘুরে বেড়ানো। তারপর সূর্যাস্তে কুলায়-এ ফিরে আসা। কেমন সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা।

শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ভাবছিলেন, শুধু কি আকাশ, বাতাস, আর সমুদ্র তাকে আকর্ষণ করে? না কি ঐ কিশোরী মেয়েটির জন্য জায়গাটা তার এত পছন্দ?

শ্ৰীমতী মিলারি ঘরে এসে ঢুকলেন। চার্লসের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। কাগজটা দেখে নিয়ে সম্মতি জানিয়ে সেটা ফেরত দিলেন। খুশী মনে শ্রীমতী মিলারি চলে গেলেন।

বছর ছয়েক আগে শ্রীমতী মিলারি চার্লসের সেক্রেটারি হিসাবে কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে ঘর গৃহস্থালির যাবতীয় ভার তার ওপর। তবে উনি কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাবেন, কারণ তার মা নাকি অসুস্থ। অবশ্য গত ছ বছরের মধ্যে চার্লস তার মুখে মায়ের কথা একবারও শোনেননি।

–ওঁর চলে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। স্যার বার্থালমিউ-এর ঠোঁটে হাসি। দুয়ে দুয়ে যে চার হয় সেটা তুমি জানো ঠিকই।

–তুমি ভুল বলছো! ওর মুখের দিকে একবার তাকালে তৎক্ষণাৎ কামভাব মন থেকে উধাও হবে। প্রশংসনীয় তাঁর কর্মদক্ষতা, কিন্তু তাই বলে প্রেম চলে না।

শ্ৰীমতী মিলারি আবার এসে ঢুকলেন।

একটা কথা বলতে এলাম। আপনাদের সঙ্গে আমিও ডিনারে বসবো। কারণ অতিথির সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে তেরো। তেরো সংখ্যাটা অপয়া। তাই।

– বেশ, আপনি বসবেন।

শ্ৰীমতী মিলারি চলে গেলেন।

–আপনার অতিথি যারা আসছেন তারা কারা? শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট জানতে চাইলেন।

লণ্ডনের ব্রুক স্ট্রীটের বিখ্যাত পোশাকের দোকান অ্যামব্রোসাইন লিমিটেড-এর মালিক ক্যাপটেন ডেকার্স ও তার স্ত্রী। নাটক লেখিকা শ্রীমতী উইলস। শ্রীমতী এঞ্জেলার খাতিরে তাকে নিমন্ত্রণ করতে হয়েছে। স্থানীয় লোকদের মধ্যে আছেন যাজক শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন ও তার স্ত্রী। লেডি মেরি গোর ও তার কন্যাও আসছেন, এই মেয়েটির সঙ্গে আমি নৌকো করে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ম্যানডার্স নামে এক তরুণ সাংবাদিকও আসছে।

–সাংবাদিক?

–নিজেকে তাই বলে। লেডি মেরির বাড়িতে থাকে এবং তার কন্যার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেড়ায়। লেডি মেরি তাকে খুব স্নেহ করেন তবে তাঁর মেয়ে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।

শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বুঝতে পারলেন চার্লসের বিরূপতার কারণ। ঐ সাংবাদিক ছোকরাটি হলো চার্লসের প্রণয় প্রতিদ্বন্দ্বী! চার্লসের মত ছেলেটির কোনো কিছুই নেই। কিন্তু ছেলেটির আছে যৌবন, যেটি আর ফিরে পাবে না চার্লস। সেই জন্য চার্লসের মনের কোণে ব্যথা প্রকাশ পাচ্ছে।

–স্যার চার্লস, গুনতে আপনাদের মধ্যে যে কারো ভুল হয়েছে, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বললেন, অতিথির সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে বারো।

একটু ভেবে চার্লস বললেন–ভুলেই গিয়েছিলাম একজনের কথা বলতে। তিনি হচ্ছেন এরকুল পোয়ারো, বিখ্যাত গোয়েন্দা। জাতে বেলজীয়।

–বাড়িতে আবার সখ করে ডিটেকটিভকে ডাকা কেন বাপু। স্যার বাথালমিউ যে খুশী হতে পারেন নি বোঝা গেল। এক একটা মানুষ থাকে যাদের কপালে অঘটন ঘটেই আছে। এরকুল পোয়ারো মানুষটি ঠিক এইরকম। উনি যেখানে যাবেন সেখানেই একটা কাণ্ড ঘটবে। কি জানি বাপু, এখানেও কিছু ঘটবে বলে মনে হয়।

যত সব আজগুবি ধারণা। চার্লস বললেন।

তিনজনে হাসতে হাসতে ঘরে এসে ঢুকলেন।

.

 ০২.

দর্শকের ভূমিকায়

সন্ধ্যার সময় ছোট্ট নীড় সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। অতিথিরা একে একে আসছেন। তাদের পানীয় পরিবেশন করা হচ্ছে।

মানুষ দেখতে ভালোবাসেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। পুরুষ-স্ত্রী দুই-ই। তিনি দেখছিলেন শ্ৰীযুক্ত ডেকার্সকে যার মধ্যে প্যারিসের কেশবিন্যাসের আধুনিকতম রীতির ছাপ লক্ষণীয়।

অভিনেত্রী এঞ্জেনা সাট ক্লিফের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্যার চার্লস। এককালে এই জুটির নামে নাট্যমোদী জনতা পাগল হয়ে যেতো।

এঞ্জেলার বান্ধবী শ্রীমতী উইলস ঐদিকে বসে আছেন। এইসময়ে এসে ঢুকলেন সস্ত্রীক শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন লেডি মেরি গোর। তিনি এককালে সুন্দরী ছিলেন। প্রৌঢ়ত্বে হাজির হয়েও তার মুখের ঔজ্জ্বল্যের ঘাটতি হয়নি। মেয়ে হারমিয়োন যখন তিন বছরের তখন তিনি স্বামীকে হারান। তারপর তিনি চলে আসেন এইখানে।

হারমিয়োন সুন্দরী না হলেও আকর্ষণীয়া। সাংবাদিক অলিভার ম্যানডার্সের সঙ্গে সে তখন কথা বলছিলো।

ওদের দুজনকে আরো একজন লক্ষ্য করছিলেন। তিনি হলেন এরকুল পোয়ারো। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তার মুখ একটু বিষণ্ণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

লম্বা চওড়া সৌম্য শান্ত চেহারা আট বছরের রেভারেণ্ড স্টিফেন ব্যারিংটনের। কিন্তু শ্ৰীযুক্তা ব্যারিংটন সুন্দরী হলেও সাজসজ্জায় অগোছালো ভাব।

পরিচারিকা ট্রে নিয়ে এসে প্রত্যেকের সামনে পানীয়ের গ্লাস ধরলো। সকলেই একটি করে পাত্র তুলে নিলেন। শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন নিলেন না। স্ত্রীর অনুমতি না পেলে তিনি কোনো কাজই করেন না। অগত্যা শ্রীযুক্তা ব্যারিংটন স্বামীকে পানীয় নেওয়ার কথা বললেন। স্ত্রী আজ্ঞা শিরোধার্য করে শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন পানীয়ের গ্লাস হাতে তুলে নিলেন।

ওদিকে শ্রীমতী হারমিয়োন ম্যানডার্সের সঙ্গে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছে। টুকরো টুকরো কথা শোনা গেল।

–আমার মতো সাধারণ একটা মানুষের জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার অনেক জ্ঞানবৃদ্ধ বন্ধু আছেন, তাদের কাছে যাও।

জ্ঞান বৃদ্ধ। মানে জ্ঞানী এবং বৃদ্ধ। স্যার চার্লসের কথা বলছো?

–আমি কারো নাম করিনি।

করার প্রয়োজন নেই। তবে জেনে রেখো, ওঁর সঙ্গে তোমার তুলনা হয় না।

স্যাটার্থওয়েট ওদের দেখে খুব খুশী হলেন। হারমিয়োন মেয়েটি যে কি। এমন সুন্দর, শান্ত ছেলে ওর পছন্দ হয় না। আশ্চর্য, মেয়েদের মহিমা বোঝা যায়!

হঠাৎ একটা শব্দ শুনে স্যাটার্থওয়েট চমকে উঠলেন। শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন চেয়ারের ওপর ঢলে পড়েছেন।

শ্ৰীযুক্ত ব্যারিংটন, ডাক্তার, শিগগির এদিকে আসুন।

স্যার বার্থালমিউ ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখলেন শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের ধরে থাকা হাতটি। শ্ৰীযুক্তা ব্যারিংটনের দিকে বিষণ্ণ মুখে একবার তাকালেন। মুখ নিচু করে দ্বিধা কাটিয়ে বললেন। দুঃখিত। উনি মারা গেছেন।

–টলি, তুমি এইভাবে পায়চারি করছিলেন গাউনটা চাপিয়ে নিলেন

.

০৩.

 স্যার চার্লসের সংশয়

এর পর কেটে গেছে কয়েকটা ঘণ্টা।

অন্ধকার সমুদ্রতীর। অবসাদের শান্তি ঘিরে আছে শান্ত কুলায়কে। লেডি মেরি শোকগ্রস্তা ব্যারিংটনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। অতিথিরা সবাই যে যার ঘরে বসে আছেন।

শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের শুতে ভালো লাগছিল না। মন ভারাক্রান্ত। আকস্মিক মৃত্যুর দৃশ্য মনকে ভীষণ খারাপ করে দেয়। এই বয়সে মৃত্যুর দৃশ্য সহ্য হয় না।

এমন সময় দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন চার্লস।

– আসবেন একটু ও ঘরে। কথা আছে। টলিও ওখানে আছে।

–বেশ তো চলুন। স্যাটার্থওয়েট গায়ে ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে নিলেন।

অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন স্যার চার্লস।

— টলি, তুমি এইভাবে এত আকস্মিক ভাবে এত দ্রুত কাউকে মারা যেতে দেখেছো?

–আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু সন্দেহ করছেন স্যার চার্লস? জিজ্ঞেস করলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট।

স্যার চার্লসের হয়ে জবাব দিলেন স্যার বার্থালমিউচার্লসের ধারণা, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।

শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যুতে আমরাও কম দুঃখিত হইনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে আপনার যে ধারণা সেটা আর কারো কাছে বলবেন না। সেটা বিলকুল হতে পারে। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বললেন।

স্যার বার্থলমিউয়েরও একমত এ ব্যাপারে। –দেখো চার্লস, স্যার স্যাটার্থওয়েট ঠিক কথাই বলেছেন। তোমার এই কথাটা নানান জনের কানে কানে পৌঁছে এমন একটা আকার ধারণ করবে ফলে তোমার শান্তি বিঘ্নিত হবে। তুমি চুপ করে থাকো। পুলিস যা বলে বলুক।

–বেশ, তবে এইবার কি একটা সবিনয়ে নিবেদন করতে পারি?

নিশ্চয়ই।

–কথাটা হলো শ্রীযুক্ত এরকুল পোয়ারো অতিথি হিসাবে এখানে এসেছেন। স্যার চার্লস বলতে থাকেন। এখন শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে ওঁর মতামত জানতে চাইলে সেটা কি শিষ্টাচার সম্মত হবে?

–আমার মনে হয় না, সেটা ঠিক কাজ হবে। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বলে উঠলেন, এমন সময় দরজায় মৃদু আওয়াজ।

–আসতে পারি?

–আরে এরকুল পোয়ারো। আসুন, আসুন, আমরা আপনার কথাই আলোচনা করছিলাম।

–আপনাদের গল্পের মাঝখানে এসে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করলাম না তো?

–মোটেই না, বসুন।

–এবার সরাসরি কাজের কথায় আসা যাক। স্যার চার্লস বললেন, আজকের সন্ধ্যেবেলার ঘটনার মধ্যে কোনো গোলমাল আছে বলে কি আপনার মনে হয়?

পোয়ারো ভুরু কুঞ্চিত করলেন।

–আমার বন্ধুর ধারণা শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন খুন হয়েছেন। তাই চার্লসের ইচ্ছা গ্লাস পরীক্ষা করা হোক।

পোয়ারো একটু ভেবে বললেন হ্যাঁ, ভদ্রলোকের মৃত্যু আকস্মিকভাবে হয়েছিল। গ্লাস পরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভদ্রলোকের আত্মহত্যার সম্ভাবনা মোটেও ছিল না। আর যদি তার এমন ইচ্ছা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই এমন সুন্দর একটি পার্টি নষ্ট হতে দিতে চাইতেন না। ওঁর মতো অজাতশত্ৰু মানুষকে কেউ হত্যা করতেও চাইবে না।

.

০৪.

বিচিত্ররূপিণী

 শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের কাছে স্ত্রী চরিত্র আজও রহস্যের মধ্যে রয়ে গেছে। যৌবনে এজন্যে কম আপসোস তার ছিল না।

হারমিয়োন-এর মধ্যে তিনি চিরযুগের বিচিত্ররূপিণী নারীর আধুনিক রূপটি প্রত্যক্ষ করলেন। সে স্পষ্ট বক্তা, ছলাকলা জানে না। আধুনিকা। প্রয়োজনে অক্লেশে ব্যবহার করে বলশালী অপভাষা। অথচ ধর্মপ্রাণা ও সরল মনের অধিকারিণী। কিন্তু তা বলে সে কি কম আকর্ষণীয়া, না কম রহস্যময়ী।

সত্যি করে বলুন তো, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যুটা আপনার রহস্যময় বলে মনে হয় না? সমুদ্রের ধারে বসে হারমিয়োন শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট প্রশ্ন করছিল।

বয়েস হয়েছিলো তো…

সার সাটার্থওয়েটের কথা শেষ না হতেই হারমিয়োন বলে ওঠে–থামুন, যত সব বাজে কথা। ডাক্তারগুলোও হয়েছে ধাপ্পাবাজ। ওঁরা কি বলেছে তা আমি জানি। একথা বলার জন্য ডাক্তার হওয়ার দরকার কি ছিল শুনি?

শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট চুপ করে থাকেন।

জানেন, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। উনিও আমাকে স্নেহ করতেন। ওঁর স্ত্রীকেও আমি মায়ের মত দেখি। আর রীনের সঙ্গে ছেলেবেলায় খেলতাম। ওঁদের একমাত্র সন্তান, যুদ্ধের সময় মারা যায়। নিয়মিত বাইবেল পড়া শিখেছি আমি শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের কাছ থেকে। তিনি বলতেন, ধর্ম হলো মানুষের চিরন্তন আশ্রয়। ভাবতেও পারি না যে তিনি আজ নেই।

অনেকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।

–শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়, তুমি বুঝলে কি করে?

-ওটা হয়তো নিছক অনুমান। তবে একদিন আপনারা বুঝবেন যে আমরা ঠিকই বলেছিলাম।

আমরা মানে?

–আমি আর স্যার চার্লস। এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। স্যার চার্লস বিয়ে করেননি কেন?

–তা জানি না। মুখে বললেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। এদিকে মনে মনে বললেন, ফুলে ফুলে মধু খাওয়ার অফুরন্ত সুযোগ ছিল বলে।

আরো কিছু কথাবার্তা হওয়ার পর হারমিনে প্রায় জোর করে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে তাদের বাড়িতে নিয়ে এলো।

আসার সময় পথে হারমিয়োন একটি মাত্র কথা বললো–এরকুল পোয়ারোকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। বয়েস হয়েছে তো? ওঁর বুদ্ধির ধারা ভোতা হয়ে গেছে।

সাবেকি রুচিতে সাজানো ওদের বাড়ি। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের বেশ পছন্দ হলো।

লেডি মেরি এগিয়ে এলেন।

আমার মেয়ে নিশ্চয়ই আপনাকে খুব জ্বালিয়েছে?

না না। আপনার মেয়ে খুব ভালো।

–সেটা তো সব নয়। সহবত শিখতে হবে। সমাজে মেলামেশা করার যোগ্যতা লাভ করতে হবে। জানেন, ওকে দুবার লণ্ডনে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। তাই চলে এসেছে। কিন্তু এই বয়সে ওর দেশ দেখা উচিত, মানুষ চেনা উচিত। আর মানুষ চিনতে না পারলে জীবনে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক বিপদ হতে পারে। আমার কেবল চিন্তা, হারমিয়োন ওর পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের ভুল না করে বসে। হয়তো দেখা গেল, প্রথম যে ছেলেটি ওর কাছাকাছি আসবে, শুধু প্রথম বলেই ও তাকে বিয়ে করতে চাইবে।

–আপনি কি অলিভারের কথা ভাবছিলেন, লেডি মেরি?

–ঠিক অনুমান করেছেন আপনি।

–কিন্তু আপনার মেয়ে ওর বয়সের দ্বিগুণ বড়ো কাউকে যদি বিয়ে করে তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন?

–সেটাই বেশি নিরাপদ আমার কাছে। কারণ তার সম্পর্কে আশা করায় খুব বেশি যদি কিছু না-ও থাকে তবে আশংকা করার কিছু নেই।

লেডি মেরির জবাব শুনে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট তাজ্জব বনে গেলেন।

.

০৫.

সকাল

ঘরে উজ্জ্বল আলো। জানলার কাছে বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যার চার্লস। শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ঘরে ঢুকলেন।

–কি লেডি মেরির বাড়ি গিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, চমৎকার মানুষ ওঁরা।

 স্যার চার্লস চুপ করে রইলেন কয়েক মিনিট। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন–এখানে যদি না আসতাম তাহলে খুব ভালো হতো।

স্যার চার্লসের জন্য করুণা অনুভব করলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। এতদিন তিনি অনেকের হৃদয় হরণ করেছেন, আজ তিনি নিজের হৃদয় হারিয়েছেন, কিন্তু হারমিনে তা গ্রহণ করেনি।

এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট রিসিভার তুললেন। হারমিয়োনের ফোন–স্যার চার্লসকে জানিয়ে দেবেন, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে অলিভার আমাদের সাহায্য করুক। ডিনারের পর আমি ওকে নিয়ে আপনাদের ওখানে যাচ্ছি।

স্যার চার্লসকে জানাতে তিনি আপত্তি করলেন না বটে কিন্তু তার মুখে বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো, সেটা শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের দৃষ্টি এড়ালো না।

ডিনারের পর হারমিয়েন আর অলিভার এসে হাজির হলো। যেমন উৎসাহ নিয়ে হারমিয়োন এই কাজে নেমেছিল তেমন উৎসাহই কারো মধ্যে দেখতে পেলো না। বোঝা গেল, একরম জোর করে সে অলিভারকে এখানে নিয়ে এসেছে। স্যার চার্লসের দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ ওরা উঠলো। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ওদের বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

হারমিনে সমানে অলিভারের সঙ্গে বগড়া করে চলেছে! ঝগড়ার সুবিধার জন্য বোধ হয়, ওকে আরো নিজের কাছে টেনে আনলো! জোর করে অলিভারের মাথাটা নিজের দিকে নামিয়ে আনলো। অলিভার তার সাধ্যমত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট আবার ঘরে এসে ঢুকলেন।

–স্যাটার্থওয়েট, স্যার চার্লসের কণ্ঠে বেদনার সুর। আমি ঠিক করে ফেলেছি। কাল ভোর হওয়ার আগেই, এই কুলায় এই সমুদ্রতীর ছেড়ে চলে যাবো। আপাতত দক্ষিণ ফ্রান্সে যাবো। কিন্তু কেউ জানে না, আমার কতখানি এখানে রেখে গেলাম।

প্রথমে খুব বিস্মিত হলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। পরক্ষণে সেটা কাটিয়ে বললেন, তাহলে আমিও ভোরের গাড়িতে লণ্ডনে ফিরে যাই।

না, আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনি অন্ততঃ আর একটা দিন এখানে থাকুন! কুলায় ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আমার বিদায় জানাবার কেউ তো তাহলে থাকবে না। এ আমি ভাবতে পারি না বন্ধু।

কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছিলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট, বাড়ির মালিক না থাকলেও পরিচারিকারা ঠিক মত কাজ করে চলেছে। মনে মনে ভাবছিলেন, বিকেলের গাড়িতে লণ্ডন ফিরে যাবে। জামার হাতায় টান পড়তেই পেছন ফিরে তাকালেন। বিষণ্ণ মুখে হারমিয়োন দাঁড়িয়ে।

–স্যার চার্লস নাকি এখান থেকে চলে যাচ্ছেন? হারমিয়োন প্রশ্ন করলো।

উনি চলে গিয়েছেন এখান থেকে!

 অস্ফুটে একটা কাতরোক্তি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। পরক্ষণে সে খণ্ডিতা নায়িকায় অবতীর্ণ হলো।

–কোন কুত্তীটার সঙ্গে গেছে? সেই নাটক লিখিয়ে ধুমসীটার সঙ্গে না কি বেহায়া নটীটার?

 –কি যা তা রলছো? উনি চলে গেছেন তোমার জন্য হারমিয়োন।

–আমি! আমার জন্য উনি চলে গেছেন! স্পল্পজড়িত কণ্ঠে সে বলে উঠলো। তারপর নিজের মনে বলতে থাকে, এখন কি করবো আমি? চিঠি লিখবো? পুরুষ মানুষের মতিগতি আমরা আধুনিকারা একটুও বুঝি না। ওদের মনে প্রেম সৃষ্টি করতে গিয়ে ঈর্ষা সৃষ্টি করি। ব্যর্থ, আমরা ব্যর্থ।

সে বড় বড় চোখে তাকালো, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের দিকে।

–আপনার কথাই আমি ধরে নিচ্ছি। স্যার চার্লসের এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য আমি দায়ী। তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তাকে আমিই আবার এখানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। দেখবেন, আমার কথার খেলাপ হবে না।