২. মিরেলি

০৬. মিরেলি

শ্বশুরের ঘর থেকে ফিরে এসে ড্রেক ক্যাথারিন-এর মনে ভেতরে ঝড় বইছে। মিঃ আলডিন-এর কথাগুলো তার মনটাকে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। রাগে অপমানে তার মনটা একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল। উনি কোটি কোটি পাউণ্ডের মালিক, আমার তাতে কি! আমি কি ওকে তোয়াক্কা করি নাকি! বাবাকেই পাত্তা দিলাম না আর উনি তো শ্বশুর।

ভাবতে ভাবতে মাতালের মত চলতে চলতে একটা মেয়ের গায়ের ওপর গিয়ে পড়ে। মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি কি অন্ধ নাকি?

খুব লজ্জিত হলো ক্যাথারিন, ক্ষমা করবেন। অন্যমনস্ক ছিলাম তাই আপনাকে দেখতে পাইনি। ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না।

ক্যাথারিন-এর বিনীত ব্যবহারে মেয়েটি নরম হলো। না না, আমি কিছু মনে করিনি, আচ্ছা চলি।

মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আপন মনেই বলল–কে গো তুমি সুন্দরী। ক্যাথারিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিফট-এর দিকে এগিয়ে গেল।

রাস্তায় নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা মিরেলির হোটেলের দরজায় গেল। মিরেলির ঘরে গিয়ে দেখে সে চোখ বুজে গা এলিয়ে বিশ্রাম করছে।

ক্যাথারিন তার পাশে বসে আলতো ভাবে একটা চুমু খেল, কিগো আরামে ঘুমিয়ে পড়লে?

ক্যাথারিন-এর প্রশ্নে সে চোখ খুলল, না ঘুমোইনি। এতক্ষণ চোখ বুজে একটা নতুন নাচের মহলা দিচ্ছিলাম। অ্যাসব্রোচ এসেছিল। তার পরবর্তী অপেরার যে নাচটি হবে আমাকে বোঝাচ্ছিল। নাচটা দেখে দর্শকদের মাথা ঘুরে যাবে।

-তোমার নাচের কথা রেখে এবার আমার কথাটা শোনো।

–তোমার কথা মানে? কি হয়েছে তোমার?

–আমার মাননীয় শ্বশুর মহাশয় তার মেয়েকে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

–কি গেরো! কিন্তু তোমার শ্বশুর বা তার মেয়ের এত রাগ কেন তোমার ওপরে? কি তোমার অপরাধ?

–অপরাধ অনেক। প্রথম অপরাধ তোমার সঙ্গে মেলামেশা।

–তুমি তাহলে কি করবে ঠিক করেছ?

–কি আর করবো? আমি ভাবছি অন্য কথা।

–কি?

–ভাবছি, মামলাটা দায়ের হওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই পাওনাদারের দল আমাকে ঘিরে ধরবে। আর তুমি তখন আমাকে বিদায় করবে।

একথা তুমি ভাবলে কি করে? তোমার সঙ্গে কি আমার টাকার সম্পর্ক? টাকাই আমার কাম্য হলে টাকা দেবার লোকের অভাব হতো না আমার। তোমার কাছে টাকার প্রত্যাশা আগেও করিনি আর করব না। তোমার বিপদে-আপদে সব সময়েই আমি তোমার পাশে থাকবো।

-তোমার কথা শুনে আমার মনের বল বাড়লো।

আজ আমি নতুন করে বুঝলাম যে সত্যিই তুমি আমাকে ভালোবাস। কিন্তু এবার কি করা যায় বলতো?

আমি বলি কি, তুমি তোমার বউ-এর সঙ্গে একটা মিটমাট করে নাও সে যাতে মামলার পথে না যায় তার জন্যে তাকে খুশী রাখতে চেষ্টা করো।

-না, তা হবার নয়। আমার শ্বশুরের জেদ তুমি জান না। আর তাছাড়া বর্তমান সভ্য জগতে টাকার জোরে অনেক কিছু করা যায়।

তা হয়তো যায়, কিন্তু ডিভোর্সের মামলাটা আর তিনি রুজু করলে চলবে না। এটা করতে হবে তোমার বউকে দিয়ে। সে নারাজ থাকলে শ্বশুর কিছুই করতে পারবে না। তাই তোমার বউয়ের সঙ্গে মিটমাট কর।

-না, তা আমি পারব না। সে চায় আমাকে তার ভেড়ুয়া করে রাখতে সে আমি পারব না। তাছাড়া আমার স্ত্রী বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় তাকে শুনতেই হবে। ওর বাবার মতো ধনকুবের খুব কমই আছে। এই তো তিনি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ হার্ট অফ ফায়ার কিনে ফেলেছেন।

-বলো কি?

–হ্যাঁ তাই-ই। লক্ষাধিক পাউণ্ড ব্যয় করে ওই অমূল্য-রত্নটি কিনেছেন। আমার ধারণা এটা উনি ওর মেয়ের জন্যেই কিনেছেন।

–তোমার বউ কি তার একমাত্র সন্তান?

–হ্যাঁ।

–তাহলে বাবার মৃত্যুর পর সেই-ই হবে তার সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী?

–হ্যাঁ তাই হবে।

–তোমার বউ-এর নিজস্ব টাকাকড়ি এখন কি আছে?

–তা ধর ত্রিশ লক্ষ পাউণ্ড। ব্যাঙ্কেই তো আছে কুড়ি লক্ষ পাউণ্ডেরও বেশি।

–এত টাকার মালিক তোমার বউ!

 –হ্যাঁ, তাই।

 –আচ্ছা হঠাৎ যদি কোনো কারণে তার মৃত্যু হয় তাহলে তার ওয়ারিশ কে হবে?

-তোমার কথা আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু ওর মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ ও রীতিমত স্বাস্থ্যবতী।

-স্বাস্থ্যবতী মেয়েরা কি মরে না? কোনোরকম আকস্মিক দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণেও তো মৃত্যু হতে পারে।

মিরেলির দিকে বিস্মৃত দৃষ্টিতে তাকাল ড্রেক। মিরেলি বলল, তাই বলে ভেবো না আমি তোমার বউ-এর মৃত্যু কামনা করছি। যাক গে, তুমি বরং তার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করে নাও যাতে ও মামলায় সাক্ষী না হয়, সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।

–সে যদি আমার কথা না শোনে?

–আমার মনে হয় সে শুনবে। খবরের কাগজে তার চরিত্র নিয়ে আলোচনা সে নিশ্চয়ই চাইবে না।

তার মানে?

–তোমার বউ সম্পর্কে অনেক কথাই জানি সে সব তোমার না শোনাই ভালো।

 –কি জানো তুমি ওর সম্বন্ধে?

–বললাম তো, অনেক কিছুই জানি।

–তোমাকে বলতে হবে সে কথা।

–নিতান্তই শুনবে? তোমার বউ কাউন্ট দ্য লা রোচীর উপপত্নী; বিয়ের আগে থেকেই তার সঙ্গে নয় ছয় ছিল। এখন তোমার বউ প্যারীতে গিয়ে ওর সঙ্গে রাত কাটায়।

–একথা আমি বিশ্বাস করি না।

–বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। আমার কথার সত্যতা তুমি যাচাই করে দেখতে পারো। তোমাকে আর একটা খবর দিতে পারি।

–কি খবর?

–সামনের চোদ্দ তারিখে তোমার বউ রিভিয়ারয়ে কাউন্টের সঙ্গে কটা দিন স্ফুর্তি করার জন্যে যাচ্ছে।

–এসব কথা তুমি কেমন করে জানলে?

-আমি প্যারীর মেয়ে সে কথা ভুলে গেলে। প্যারীতে আমার এমন অনেক বন্ধু আছে যারা কাউন্টের বিশেষ বন্ধু।

যাকগে ওসব কথা নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না। মনে রেখো অপরিমিত অর্থ বলে বলীয়ান লোকের সঙ্গে তোমার মোকাবিলা করতে হবে। অতএব, তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে তার মেয়েকে কজা করতে হবে।

–থাম। আর কিছু শুনতে চাই না। আমার মাথার ভেতরে তুমি আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছ?

 একবার মিরেলির দিকে তাকিয়ে দ্রুত পদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ক্যাথারিন।

ক্যাথারিন চলে যেতেই মিরেলির ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।

.

০৭.

মিসেস স্যামুয়েল হারফিল্ডএর চিঠি

মিসেস ক্যাথারিন গ্রে বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়েছে। সম্পত্তিটা এম্মা হারফিল্ডের। দীর্ঘ বার বছর ধরে এই নিঃসন্তান ধনবতাঁকে সেবা করেছে ক্যাথারিন। তাই মৃত্যুর পূর্বে উইল করে তিনি তার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এবং সেন্ট মেরী মিড়-এর বিশাল বাড়িটি ক্যাথারিনকে দিয়ে গেছেন।

সেন্ট মেরী মিড পল্লীর সবাই এতে খুশী হয়েছে। দীর্ঘ বার বছর তারা ক্যাথারিনের ব্যবহারে এবং সুসংযত চালচলনে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই মুগ্ধ।

কিন্তু স্থানীয় নরনারী খুশী হলেও মিসেস হারফিল্ডের দেওর মিঃ স্যামুয়েল হারফিল্ড এতে খুশী নন। তার ধারণা ছিল যে এম্মা হারফিল্ড-এর মৃত্যুর পর সেই হবে তার বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তাই মনে হয় সে একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাথারিন-এর ওপর।

এ ব্যাপারে তার স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বেশি রেগে যায়। ভদ্রমহিলা রীতিমত কুটবুদ্ধি সম্পন্না। তার এই কুটবুদ্ধির জন্য তার স্বামীও তাকে রীতিমত সমীহ করে চলে এবং সব ব্যাপারেই তার পরামর্শ নেয়।

কয়েকদিন ধরে দুজনে পরামর্শ করে ঠিক হল স্যামুয়েল-এর বউ একখানা চিঠি দেবে ক্যাথারিনকে এবং চিঠিতে তাকে জানিয়ে দেওয়া হবে যে আইন অনুসারে এম্মা হারফিল্ড-এর উইলের কোনো মূল্যই নেই। আদালতে ওই উইল সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য হবে।

অনেকবার কাটাকাটির পর চিঠির বয়ানটা স্বামী স্ত্রীর মন মতো তৈরি হলো। তারা মনে করলো যে, চিঠিটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথারিন ছুটে আসবে। চিঠিটা লেখা শেষ করে আবার পড়ে দেখল দুজনে।

কল্যাণীয়া ক্যাথারিন,

আমার স্বামীর ভ্রাতৃবধূকে তুমি এতদিন যেভাবে সেবা-যত্ন করেছ তার জন্য আমি এবং আমার স্বামী তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু কৃতজ্ঞতা জানিয়েই আমরা আমাদের কর্তব্য শেষ করবো না। তোমার ভবিষ্যৎ জীবন যাতে সুখে কাটে সে ব্যবস্থাও আমরা নিশ্চয়ই করব।

এম্মার মৃত্যুতে আমরা শোকে একেবারে মুহ্যমান হয়ে পড়েছি। আমরা জানি যে মৃত্যুর পূর্বে তার মাথাটা একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। অতএব বিকৃত মস্তিষ্কে তিনি যে উইল করেছেন তা আইন সম্মত হয়নি। আদালতে গেলে সে উইল অগ্রাহ্য হবে।

তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। হারফিল্ড-এর উইলের ব্যাপারে যাতে আমাদের আদালতে যেতে হয় সে ব্যবস্থা তুমি নিশ্চয়ই করবে। আমাদের মনে হয় আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এটা সবচেয়ে ভালো হবে।

তোমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও আমরা চিন্তা করেছি। তোমাকে একটা ভালো চাকরি যোগাড় করে দেব তাছাড়া এম্মা হারফিল্ডকে যেভাবে যত্ন করেছ তার পুরস্কার হিসাবে তোমাকে মোটা টাকা দেব স্থির করেছি। আশা করি আমাদের স্নেহের দান তুমি গ্রহণ করবে।

শুভাকাক্ষিণী অ্যা
নি হারফিল্ড।

পরদিন সকালের ডাকেই চিঠিখানা ক্যাথারিন-এর হস্তগত হলো। চিঠিখানা পড়ে নিজের মনেই একটু হাসল-এখন দেখছি দরদ উথলে পড়েছে। এম্মা বেঁচে থাকতে তো একদিনও বাড়ির খোঁজ নাওনি!

কিন্তু ওরা যে লিখছে তা কি ঠিক। না, আমাকে কালই লণ্ডনে সলিসিটার-এর সঙ্গে দেখা করে সব কিছু জানতেই হবে।

তখুনি ডক্টর হ্যারিসন এসে হাজির। ক্যাথারিনকে খুবই স্নেহ করেন তিনি। সময় পেলে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যান।

–তোমাকে খুব চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে যেন!

–হ্যাঁ–মিসেস স্যামুয়েল হারফিল্ড আমাকে একটা চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠির কথাই ভাবছিলাম।

-কি লিখেছেন তিনি? কথাটা বলেই উনি লজ্জিত সুরে আবার বললেন। মানে, তোমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে দরকার নেই।

-না আপত্তি থাকবে কেন? আপনি পড়ুন। তিনি চিঠিটা পড়ে ক্যাথারিনকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, রাবিশ!

ওরা হয়তো ভেবেছে যে এই চিঠি পেলেই তুমি ওদের কাছে ছুটে যাবে।

–কিন্তু ওরা যা লিখেছে তা কি ঠিক?

-কখনও নয়। ওরা বলতে চায় মিসেস হারফিল্ড অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় উইলটি করেছেন। একথা যে কত বড় মিথ্যে তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমি জানি তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, সুস্থ শরীর এবং স্বেচ্ছায় ওই উইলটি করেছেন তাছাড়া আমি আর মিসেস হারফিল্ডের সলিসিটার ছাড়া আর কেউ জানত না।

–আপনি তো উইলের সাক্ষী ছিলেন। সম্পত্তির মূল্য সম্বন্ধে আপনার একটা ধারণা নিশ্চয়ই আছে, তাই না?

–তা আছে বৈকি, আমার ধারণা ওর সম্পত্তির মূল্য এক লক্ষ পাউণ্ডের কাছাকাছি।

–না, আপনার ধারণা ঠিক নয়। ওঁর সম্পত্তির মূল্য আরও অনেক অনেক বেশি।

এই বলে ক্যাথারিন তার হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে একখানা বড় আকারের খাম বের করে ডক্টর হ্যারিসন-এর হাতে দিয়ে বলল, এর ভেতরে একটা স্টেটমেন্ট আছে। ওটা একবার পড়ে দেখুন আপনি।

স্টেটমেন্ট পড়ে একেবারে অবাক ডক্টর হ্যারিসন। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, এ যে দেখছি উপন্যাসের মত ঘটনা। মিসেস হারফিল্ড যে এত বড় প্রতিষ্ঠানের পার্টনার ছিলেন তা আমরা কোনো দিনই জানি না।

–স্টেটমেন্টের তলায় টাকাকড়ির হিসেবটা দেখেছেন কি!

-হ্যাঁ। প্রতি বছর আট হাজার থেকে দশ হাজার পাউণ্ড-এর হিসেবে জমা হয়েছে এবং দীর্ঘ ত্রিশ বছর যাবৎ এই লভ্যাংশ জমা হতে হতে ওটা এখন ত্রিশ লাখ পাউণ্ডের কাছাকাছি এসে গেছে।

-হ্যাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু এছাড়াও ব্যাঙ্কে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং ফিক্সড় ডিপোজিটে ওর নামে যে টাকা জমা আছে তার পরিমাণও এক লাখ পাউণ্ডেরও বেশি। এছাড়া স্থাবর সম্পত্তি এবং জুয়েলারী যা আছে তার মূল্যও প্রায় দশ লাখ পাউণ্ড।

-অর্থাৎ, ওর মোট সম্পত্তির মূল্য প্রায় চল্লিশ লাখ পাউণ্ড। অথচ উনি এমন সাধারণভাবে থাকতেন যে, আমরা কোনোদিন ভাবতেই পারিনি উনি অত টাকার মালিক।

–ঠিকই বলছেন ডক্টর। আমি নিজের চোখেই দেখেছি যে, ওনার বার্ষিক আয় দশহাজার পাউণ্ড থাকা সত্ত্বেও উনি চার হাজার পাউণ্ডের বেশি খরচ করতেন না।

তার মানে, এদিক থেকেও তবে বেশ কিছু জমেছে।

 –হ্যাঁ, তাই-ই। এই বাড়তি টাকা দিয়ে উনি বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনতেন। আমার মনে হয়, ওঁর নামে যে শেয়ারগুলো আছে তার মূল্য কয়েক লাখ পাউণ্ড।

-মনে হয় বলছ কেন?

-বলছি, তার কারণ হলো ওগুলো এখনও ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিট ভল্ট-এ আছে। ভল্ট-এর চাবিটাও আমার কাছেই আছে। তাই আমি লণ্ডনে গিয়ে শিগগিরই ব্যাঙ্কের হিসেবগুলো দেখে নেব।

ক্যাথারিন-এর কথা শুনে ডক্টর হ্যারিসন মৃদু হাসলেন। আজ বুঝতে পারছি, মিসেস হারফিল্ড তোমাকে তেমনি ভালোবাসতেন।

–তিনি আগাগোড়াই আমাকে ভালোবাসতেন। তবে, তিনি তার যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি আমাকে দেবেন সেটা কিন্তু ভাবিনি। বার বছর আগে ওর কাছে আমি এসেছিলাম সামান্য একজন সেবিকা হয়ে আর আমি তার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। কিন্তু একি। আপনি এখুনি চলে যাবেন না কি।

–হ্যাঁ ক্যাথারিন। এখুনি একটা কলে-এ যেতে হবে। যাবার আগে আবার বলছি মিসেস স্যামুয়েল-এর চিঠি সম্বন্ধে চিন্তার কিছু নেই। এ চিঠির কোনো মূল্য নেই।

–সত্যিই কি কোনো মূল্য নেই? আমার মনে হয় ওরা ও ব্যাপারে হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। তাছাড়া…..

তাছাড়া কি?

–বলছিলাম আমি যদি উড়ে এসে জুড়ে না বসতাম তাহলে ওরাই তো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতেন। আমি তাই ভাবছি সম্পত্তির একটা অংশ ওদের দিয়ে দেব। ওদের দীর্ঘনিশ্বাস পড়বে সেটা চাই না, ডক্টর।

–তার মানে, তুমি মনে করছ যে সম্পত্তিটা তুমি বৈধ ভাবে পাওনি, মিসেস হারফিল্ডকে যে লোক ভুলেও একবার দেখতে আসেনি, আগেই পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ করে নিয়ে আলাদা বাস করছে, সেই-ই হবে বৈধ দাবিদার আর তুমি মেয়ের মত হারফিল্ডকে সেবা যত্ন করেছ আর তুমিই যদি ওনার মেয়ে হতে তাহলে কি তোমার একথা মনে হতো?

-না তা হোত না কিন্তু……

-না ক্যাথারিন, এর মধ্যে কোনো কিন্তু নয়। তুমি ওর মেয়ের চেয়েও বেশি ছিলে। আজ তুমি যদি সম্পত্তির অংশ অন্য লোককে দান করো তবে ওর মৃত আত্মাকে অসম্মান করা হবে।

ডক্টর হ্যারিসন খুশী মনে বিদায় নিলেন।

সেইদিন বিকেলে মিসেস হ্যারিসন এলেন। ক্যাথারিনের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন– কয়েকদিন থেকেই আসব ভাবছি কিন্তু আর হচ্ছে না। আজ তাই তাড়াতাড়ি কাজকর্ম ছেড়ে চলে এসেছি।

-আপনি আসায় আমি খুশী হয়েছি। এবার জনির খবর বলুন। কি করছে সে?

জনি এখন নেভীতে চাকরি করছে। ভালোই আছে সে। শুনলাম আপনি নাকি বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন?

-হ্যাঁ কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসি।

–কোথায় যাবেন তা ঠিক করেছেন কি?

–না; তা এখনও ঠিক করিনি। তবে যেখানেই যাইনা কেন বেশিদিন থাকবো না, জোর মাস দুয়েক। আজ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের বাইরে যাবার সুযোগ হয়নি আমার। এখন যখন সুযোগ এসেছে দু-চারটে দেশ দেখে আসব মনে করেছি।

-তা ভালো। দেশভ্রমণে একদিকে যেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় অন্যদিকে মনের প্রসারতাও বাড়ে। আমারও বাইরে যেতে খুব ইচ্ছে হয় কিন্তু সংসারের চাপে এমন জড়িয়ে গেছি যে সম্ভব হয় না।

–একদিক দিয়ে সংসারটা যেমন ঝামেলা ঠিক, কিন্তু তবুও তো সবাই সংসার করছে।

— হ্যাঁ, তা করছে। এবং ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু একটা কথা দিল্লী কা লাড়ু যো খায়া উয়ো ভি পস্তায়া। ঔর যো নেহি খায়া উয়ো ভি পস্তায়া। সংসার জিনিসটা প্রায় সেই দিল্লীর লাড়ুর মতো।

–আপনি বুঝি খুব বই পড়েন?

-হ্যাঁ, তা পড়ি। ওটা আমার একটা নেশা। নানা আলাপ আলোচনার পর বেলা চারটের সময় মিসেস্ হ্যারিসন বিদায় নিলেন।

পরদিন ক্যাথারিন সেন্ট মেরী সিড-এর বর্ষীয়ান মহিলা ডিনার সঙ্গে দেখা করতে গেল।

ক্যাথারিনকে দেখে খুশী হয়ে ডিনার বললেন, শুনলাম তুমি নাকি বিদেশ যাচ্ছ?

-হ্যাঁ, কিছুদিনের জন্য এখান থেকে চলে যাচ্ছি, তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

–বেশ করেছ। তা, কোথায় কোথায়, যাচ্ছ?

–তা এখনো ঠিক করিনি। তবে বেশিদিন থাকব না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরব।

–বাড়ি ঘরের কি ব্যবস্থা করে যাচ্ছ?

–সেই জন্যেই তো আপনার কাছে এলাম। আমার অনুপস্থিতিতে আপনাকেই সব কিছু দেখাশুনা করতে অনুরোধ করছি।

–সেজন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। তবে, একা বাইরে যাচ্ছ, একটু সাবধানে থেকো।

.

সেদিন সকালে লেডী টাম্পলিন তার বাড়ির প্রশস্ত দোতলার বারান্দার ওপর একখানা গদি মোড়া চেয়ারে বসে চা পান করতে করতে সেদিনের খবরের কাগজখানা দেখছিলেন।

তার পাশেই ছিল তার মেয়ে মাদামোয়জেল লেন। সে তখন উত্তাল তরঙ্গ-সঙ্কুল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ মায়ের কথায় চমক ভাঙল। খবরের কাগজ বাঁ হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল এই খবরটা পড়ে দেখ লিনা।

-কি খবর, মা?

–পড়েই দেখ না।

–কোনো খবরটার কথা বলছ, মা?

মিসেস হারফিল্ডের মৃত্যুর সংবাদটার কথা বলছি। সংবাদটা পড়ে লেন বলল, এ-রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কে এক প্রৌঢ়া বিধবা অনেক টাকার সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন। এতে আর নতুনত্ব কি আছে?

নতুনত্ব আছে বৈকি! দেখছ না, মৃত্যুর পূর্বে সে তার সেবিকা ক্যাথারিন গ্রেকে উইল করে দিয়ে গেছেন।

–তাতে আমাদের কি আসে যায়?

–কিছুটা আসে যায় বৈকি! যে মেয়েটি ঐ বিশাল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছে সে আমার নিকট আত্মীয়া।

-তাই নাকি! কে হয় সে তোমার?

ও আমার মামাতো বোন। একসময় ওর সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি ওর চেয়ে বয়সে বড় হলেও আমরা একসঙ্গে বন্ধুর মতো খেলাধূলা করতাম। আমি ভাবছি, আজই ওকে একটা চিঠি লিখব। ওকে এখানে আসার জন্যে অনুরোধ করবো।

–তাতে তোমার কিছু লাভ হবে কি?

–আমি কি সবকাজ লাভের জন্য করি নাকি।

তাছাড়া আবার কি?

–দেখো লিনা, দিন দিন তুমি বড় ভেঁপো হচ্ছ। দিদি হয়ে ছোট বোনকে আসতে লিখব। তাতে তুমি ছিদ্র বের করার চেষ্টা করছ। তোমার স্বভাবটা বদলাতে চেষ্টা কর।

এবার বুঝতে পেরে সে লজ্জিত হলো। সে তখন মাকে খুশী করার জন্যে বলল, বেশ, তাহলে আজই চিঠি লিখে দাও, মা। কিন্তু আমাদের সমাজে সে খাপ খাবে তো?

-আমিও তাই ভাবছি। এতদিন সে মিসেস হারফিল্ডের সেবিকা হয়ে কাজ করেছে। অভিজাত সমাজে মেলামেশা করার সুযোগ পায়নি। তার চালচলন যদি ছোটলোকের মত হয় তাহলে…..

–অত যখন চিন্তা, তাহলে দরকার নেই তাকে লিখে।

-না, মিসেস হারফিল্ডকে আমি চিনতাম। তার বাড়িতেও অনেক বিখ্যাত লোক আসতেন। অতএব ক্যাথারিনকে সমাজে মেশবার পক্ষে অযোগ্য হবে মনে হয় না। বহুদিন দেখিনি আজ কাগজে নামটা দেখেই তাকে দেখতে ইচ্ছে করল।

–বেশ তাহলে আসতেই লিখে দাও।

–হ্যাঁ, তাই ভালো। আমি চিঠিখানা এখুনি লিখছি। তোমার কাজ থাকলে সেরে নাও।

.

মিস ডিনা-এর সঙ্গে দেখা করার পরদিনই ক্যাথারিন লণ্ডনে রওনা হল। এর আগে লণ্ডনে গিয়ে সে স্যাভয় হোটেলে উঠেছে। তাই এবারও সে স্যাভয় হোটেলেই উঠল।

হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সে গেল সলিসিটারের অফিসে। সলিসিটার তাকে দেখেই খুশী হয়ে বললেন, তোমার চিঠি আমি আজই পেলাম। এবার বলো তুমি কি বিষয়ে জানতে চাও?

ক্যাথারিন তার হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে মিসেস হারফিল্ডের চিঠিখানা দিলেন। এই চিঠিটা পড়ে দেখুন।

চিঠিখানা মনোযোগ সহকারে পড়ে তিনি বললেন, আইনের চোখে এই চিঠির কোনো মূল্য নেই। মিসেস এম্মা হারফিল্ড সুস্থ শরীরে, স্বেচ্ছায় এই উইল সম্পাদন করেছেন। তাছাড়া উইলের প্রোবেটও নেওয়া হয়ে গেছে। এখন থেকে তুমিই মিসেস হারফিল্ডের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী।

–আমি তাহলে খুশিমত ব্যয় করতে পারি?

–নিশ্চয়ই পার। তবে হ্যাঁ ব্যাঙ্কে একবার তোমাকে যেতে হবে। আমি অবশ্যই আগেই জানিয়েছি। তুমি ব্যাঙ্কে গিয়ে তোমার স্পেসিমেন সিগনেচার রেকর্ড করিয়ে নিলেই কাজ হবে।

–আমি একা গেলেই কাজ হবে কি?

–না, একজন সনাক্তকারীকে দরকার হবে। ও কাজটা দেখছি আমাকেই করতে হবে। চলো এখুনি ব্যাঙ্কে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিচ্ছি।

ব্যাঙ্ক থেকে কাজ সেরে ক্যাথারিন একটা নাম করা পোশাকের অর্ডার দিল। দোকানের মালিক একজন ফরাসী মহিলা। ক্যাথারিন তার সঙ্গে দেখা করে বলল, সবচেয়ে দামী আর মানানসই পোশাক তৈরি করাতে চাই। তাছাড়া কাটছাটও যেন আধুনিক রুচিসম্মত হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।

ফরাসী মহিলা হেসে বললেন, বেশ তাই হবে। আজ থেকে সাতদিন পরে পোশাকগুলো

ডেলিভারী পাবেন। হা, ভালো কথা, কাপড় পছন্দ করে দেবেন কি?

-না, ও ব্যাপারটা আপনার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি।

–বেশ, তাই হবে। আপনি আগামী সোমবার বেলা এগারোটায় ডেলিভারী পাবেন।

একজন সহকারিণীকে ডেকে ক্যাথারিনের মাপ নিতে বলল। মাপ নেওয়া হলে ক্যাথারিন খুশী মনে দোকান থেকে চলে গেল।

পরদিন সকালের ডাকে লেডী টাম্পলিন-এর চিঠিখানা ক্যাথারিন-এর হস্তগত হলো। চিঠিখানা সেন্ট মেরী মিড থেকে রি-ডাইরেক্ট হয়ে এসেছে।

চিঠিখানা পড়ে ক্যাথারিন-এর মুখে হাসি ফুটে উঠল। এতদিন পরে মামাতো বোনের কথা মনে পড়েছে।

লেডী টাম্পলিন ক্যাথারিনকে বারবার অনুরোধ করেছে তার বাড়িতে যাবার জন্যে। ক্যাথারিনও বাইরে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিল কিন্তু যাবার জায়গা ঠিক করতে পারছিল না। চিঠিখানা পেয়ে মনে মনে স্থির করল সে যাবে।

টমাস কুক-এর অফিসে ফোন করে ক্যাথারিন জানতে পারলো নিস-এ যাবার সবচেয়ে ভালো যানবাহন হলো ব্লু ট্রেন, ওটা ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে ছাড়ে। কুক কোম্পানীর কর্মচারীরা তাকে জানালো যে ঐ ব্লু ট্রেনে কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করতে হলে অন্ততঃ তিন দিন আগে করতে হবে।

টেলিফোন ছেড়ে ক্যাথারিন মনে মনে হিসাব করে দেখল যে সে তার পোষাকগুলি ডেলিভারী পাচ্ছে বারো তারিখে। তাই তাকে তেরো কিংবা চোদ্দ তারিখে রওনা হতে হবে। কিন্তু তেরো তারিখটা তার কাছে আনলাকি নাম্বার তাই সে চোদ্দ তারিখেই রওনা হবে।

১০ই জানুয়ারি বেলা এগারোটায় টমাস কুক-এর অফিসে গেল ক্যাথারিন। ওখানে। যেতেই সে দেখল কিছুদিন আগে স্যাভয় হোটেলের করিডরে যে লোকটি তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সে দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারের সামনে। সেও লক্ষ্য করল ক্যাথারিনকে।

ক্যাথারিনের কেন যেন মনে হলো যে সে শীগগিরই কোনো বিপদের জালে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে বুঝতে পারল না।

এদিকে ক্যাথারিন যখন টিকিট কিনে কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করার জন্যে কাউন্টার ক্লার্কের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, ততক্ষণে সে কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেছে।

.

০৮.

শ্বশুর জামাই সংবাদ

পৃথিবীতে এমন কিছু লোক আছে যারা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও মেজাজ ঠান্ডা রাখতে পারে।

মিঃ ক্যাথারিনও এই রকমের লোক তাই দেনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং আসন্ন ডাইভোর্সের সম্মুখীন হয়েও সে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেননি।

মিরেলির কথা শুনে সেদিন যদিও সে সাময়িক উত্তেজিত হয়েছিল তবুও কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা ঠান্ডা করতে সে সক্ষম হলো।

কয়েকদিন বাদে সেন্ট জেমস স্ট্রীট ধরে হেঁটে যেতে যেতে পিকাডেলি সার্কাস পেরিয়ে যাবার পর হঠাৎ তার নজরে পড়লো টমাক কুক অ্যাণ্ড কোং-এর সাইন বোর্ডের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, সামনের চোদ্দ তারিখে তার স্ত্রী রিভিয়ারায় তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছে। ক্যাথারিন স্থির করল, সেও ওই তারিখে রিভিয়ারা রওনা হবে এবং তার স্ত্রীর মত সেও ব্লু ট্রেনের যাত্রী হবে। ট্রেনে আত্মগোপন করে থেকে সে তার স্ত্রীর ওপরে নজর রাখবে।

সেদিন ছিল দশ তারিখ। সেদিন টিকিট না কাটলে ব্লু ট্রেনে জায়গা পাওয়া যাবে না। তাই কুক কোম্পানীর অফিসে গেল ক্যাথারিন। একজন কেরাণীকে জিজ্ঞেস করল : ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে নিস পর্যন্ত একটা বার্থ রিজার্ভ টিকিট আমার চাই। চোদ্দ তারিখে ব্লু ট্রেনে রওনা হবো।

–বেশ, নাম ঠিকানা বলুন।

–লিখুন, প্যাভেট হচিনস্। ২৮ নং জারমিন স্ট্রিট।

 –ঠিক আছে। একটু দাঁড়ান, আমি এখুনি সব ব্যবস্থা করছি।

–না, এখুনি দরকার নেই। আপনি সব ঠিক করে রেখে দিন। ঘণ্টাখানেক বাদে আমার চাকরের হাতে টাকা পাঠিয়ে দেব। এখন আমার সঙ্গে টাকা নেই, তাই তাকেই টিকিটখানা দিয়ে দেবেন।

–বেশ, তাই হবে। তার হাতে একখানা লেটার অব অথরিটি পাঠাবেন।

-ঠিক আছে। আমি তাহলে এখন যাচ্ছি। চলে যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াতেই ক্যাথারিন দেখতে পেল স্যাভয় হোটেলের করিডরে যে মেয়েটির গায়ের ওপরে গিয়ে পড়েছিল, সেই মেয়েটি ওখানে। মনে হলো মেয়েটি তাকে লক্ষ্য করেনি তাই সেও কথা বলল না। চলে গেল সেখান থেকে। বাড়িতে ফিরে এসেই প্যাভেটকে ডাকল ক্যাথারিন। প্যাভেট এসে দাঁড়াতেই বলল, শোন প্যাভেট–তুমি এখুনি একবার টমাস কুক-এর অফিসে যাও। সেখানে তোমার নামে নিস-এর একখানা টিকিট বুক করে এসেছি। একটা বার্থ রিজার্ভ করতে বলেছি। তুমি সেই টিকিটখানা আর বার্থ রিজার্ভেশন-এর স্লিপটা নিয়ে এসো।

একখানা একশো পাউণ্ডের নোট বের করে সে প্যাভেট-এর হাতে দিল। এই চিঠিখানা আর নোটখানা কাউন্টার ক্লার্ককে দিলেই টিকিট তার স্লিপখানা পেয়ে যাবে, ফেরত টাকা হিসেব করে গুণে দেখে নিও।

চিঠি আর নোট নিয়ে প্যাভেট তক্ষুণি বেরিয়ে গেল। ক্যাথারিন তার আসন্ন বিপর্যয়ের কথা ভাবছে যখন তখনই দরজায় নক করার শব্দ। কে?

–ভেতরে আসতে পারি কি স্যার?

–আসুন।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরে মিঃ কিংটন। তাকে দেখে ক্যাথারিন বিস্মিত স্বরে বলল, মিঃ কিংটন যে! কি খবর?

–খবর আছে, স্যার। আমি আপনার শ্বশুর মশাইয়ের বার্তাবহ হয়ে এসেছি আজ।

–তা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। এবার বলুন কি বার্তা বহন করে এনেছেন।

মিঃ আলডিন একটি প্রস্তাব করেছেন আপনার কাছে।

–কি প্রস্তাব? 

–প্রস্তাবটা বলতে একটু সংকোচবোধ করল কিংটন। আমার যদি কোনো অপরাধ হয় ক্ষমা করবেন। জানেন তো, বেতনভুক কর্মচারীকে মনিবের কথামতো চলতে হয়।

–আপনার সংকুচিত হবার কোন কারণ নেই। শ্বশুরমশাই যা বলেছেন আপনি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন।

এবার অনেকটা সহজ হয়ে কিংটান বলল, মিঃ আলডিন বলেছেন, আপনি যদি ডিভোর্সের মামলাটা কনটেস্ট না করেন তাহলে উনি আপনাকে এক লাখ পাউণ্ড দিতে রাজী আছেন।

টাকার অঙ্কটা ভালোই। এতে আমার সমস্ত দেনা শোধ হয়ে আরও কিছু হাতে থাকবে। একটু চিন্তা করেই ক্যাথারিন স্থির করে ফেলল, মাননীয় শ্বশুরমশাইকে বলবেন যে ড্রেক ক্যাথারিন তার এই ঘুষ দেবার প্রস্তাবটাকে প্রত্যাখান করেছে।

-ধন্যবাদ, মিঃ ক্যামারিন। আপনার বক্তব্য শুনে আমার মনিব হয়তো খুশী হবেন না কিন্তু আমি এতে সত্যি খুব খুশী হয়েছি। আচ্ছা, এবার তাহলে আসি, স্যার। গুড় ইভনিং।

.

০৯.

ব্লু ট্রেন

স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসেছিল। ট্রেন ছাড়তে তখনও কিছু দেরি ছিল। হঠাৎ মিঃ আলডিনকে দেখে রুথ খুশী হয়ে বলল, বাবা তুমি যে স্টেশনে আসবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। তুমি বলেছিলে যে আজ সকালে একটা কনফারেন্স আছে।

–ঠিকই বলেছিলাম। কনফারেন্স সেরেই এলাম। তোমার সঙ্গে দেখা না করে কি আমি থাকতে পারি?

তুমি এত পরশ্রিম কর কেন বাবা? কি দরকার তোমার এত পরিশ্রম করার? তোমার কি আরও টাকার দরকার?

মিঃ আলডিন বললেন, টাকা রোজগারটা কেমন যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছে আমায়। আমি জানি, আমার মতো ধনী পৃথিবীতে কমই আছে তবুও কেন যেন চুপ করে বসে থাকতে পারি না।

রুথ বুঝল যে, অজ্ঞাতে সে বাবার দুর্বল স্থানে আঘাত করেছে। তাই সে কথাটা ঘুরিয়ে বলল, তুমি আসাতে আমার এত ভালো লাগছে যে তোমাকে তা বোঝাতে পারবো না। আরও ভালো লাগতো যদি তুমি আমার সাথে যেতে। কথাটা বলেই ভাবলো যে, বাবা সঙ্গে গেলে তো মুস্কিল তাই বাবার মনের কথা জানার জন্যে, তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও, বাবা?

–গেলে মন্দ হতো না। কয়েকটা দিন বিশ্রাম হতো।

–রুথ তার মনের ভাব চেপে রেখে এমন ভাব দেখাল যে, সে যেন খুব খুশিই হয়েছে; তাহলে তো খুবই ভালো হয়। কিন্তু……

-”কিন্তু কি রুথ?

–তোমার ব্যাগ স্যুটকেশ তো দেখছি না!

আলডিন হেসে বললেন, না রুথ, আমার পক্ষে এখন লণ্ডন ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার এখন অনেক কাজ পড়ে আছে। আর সেগুলো অন্যকে দিয়ে হবে না। চলো ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে গেলো, এবার ট্রেনে উঠে বসা যাক।

–হ্যাঁ তাই ভালো চলো।

প্ল্যাটফর্মে এসে আলডিন বললেন, তোমার কামরাটা দেখে নিয়েছ তো?

–না, এখনও দেখিনি, তবে সেজন্য অসুবিধা হবে না। মিস ম্যাসনকে বলেছি সে যেন আমার কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেনের করিডোরে ঢুকেই কামরাটা দেখতে পেল রুথ। সে বাবাকে নিয়ে কামরায় ঢুকে পড়লো।

মিস ম্যাসন বললো, আপনার ড্রেসিং কেসটা সীটের নিচে রেখেছি। র‍্যাগের দরকার হবে কি?

-না, না এখন র‍্যাগের দরকার হবে না। তুমি গিয়ে বরং তোমার কামরাটা ঠিক করে নাও।

মিঃ আলডিন তার এ্যাটাচি কেস থেকে একখানা মাসিক পত্রিকা বার করে রুথ-এর সামনে রেখে বললেন, সময় কাটাবার জন্যে নিশয়ই কিছু আনোনি?

-তোমার দেখছি সব দিকেই নজর আছে, বাবা। সত্যিই আজ আমি কিছুই আনিনি।

–তুমি ফিরছ কবে?

–ফেরবার তারিখ ঠিক করিনি। তবে আশা করি মাস খানেকের মধ্যেই ফিরে আসবো।

–হ্যাঁ, তাই এসো। তুমি এলেই মামালাটা রুজু করা হবে। ও, আর একটা কথা, রুবীটা সেফ ডিপজিট ভল্ট-এ রেখে এসেছ তো?

-হ্যাঁ।

–ভালো করেছ। ও জিনিস নিয়ে ট্রাভেল করা উচিৎ নয়।

 রুথ কিন্তু মিথ্যে বলল বাবাকে। আসলে সে রুবীটাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে এমন একটা কারণে, যা সে বাবাকে কিছুতেই বলতে পারবে না।

হঠাৎ এই সময় রুথ-এর বয়সী একটা মেয়েকে কামরার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে আলডিন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে স্যাভয় হোটেলে দেখেছি মনে হচ্ছে?

-হ্যাঁ, লণ্ডনে এলে আমি ওখানেই উঠি।

–তুমিও কি রিভিয়ারার যাত্রী?

–হ্যাঁ।

–তাহলে দয়া করে একবার ভেতরে এস আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই।

মিঃ আলডিন-এর কথায় মেয়েটি দ্বিরুক্তি না করে কামরায় ঢুকে পড়ল। রুথ উঠে মেয়েটির হাত ধরে তার পাশে বসাল।

-এই আমার মেয়ে রুথ, মানে রুথ ক্যাথারিন।

–আর… আমার না ক্যাথারিন গ্রে।

আপনি কি রিভিয়ারায় বেড়াতে যাচ্ছেন?

–হ্যাঁ, একরকম তাই-ই। আমার এক পিসতুত দিদি আছেন ওখানে। তার বাড়িতেই যাচ্ছি আমি।

–এই প্রথম যাচ্ছেন, না আগেও গেছেন?

–এই প্রথম যাচ্ছি। দিদি আমাকে তার বাড়িতে যাবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছেন। আপনিও কি প্রথম যাচ্ছেন নাকি?

–না, ওখানে আমি আরও কয়েকবার গেছি।

–তাহলে হয়তো আমার দিদিকে চিনতেও পারেন। তার নাম লেডী টাম্পলিন।

–লেডী টাম্পলিন আপনার পিসতুত দিদি? তার সঙ্গে তো আমার ভালো পরিচয় আছে।

এই সময় মিঃ আলডিন বললেন, লেডী টাম্পলিন-এর নাম আমিও শুনেছি, তবে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচয় করবার সুযোগ হয়নি আমার।

তার কথা শেষ হতে না হতেই ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা পড়লো। তিনি রুথ আর ক্যাথারিনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নেমে এলেন।

ট্রেন ছেড়ে দিল। রুথ জানালা দিয়ে মুখ বার করে রুমাল নাড়লো আর মিঃ আলডিনও রুমাল নেড়ে বিদায় অভিনন্দন জানালেন মেয়েকে। একসময় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দূরে মিলিয়ে গেল ট্রেন।

–আমি এবার উঠি মিসেস ক্যাথারিন। আবার দেখা হবে।

নিশ্চয়ই, আজ আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খাব, কেমন?

–বেশ, তাই হবে। গুড বাই।

–গুড বাই।

ক্যানে স্টেশন থেকে ট্রেনটা ছাড়তেই লাঞ্চের ঘণ্টা বেজে উঠল। যাত্রীরা সবাই ডাইনিং কোচ-এর দিকে গেল। রুথ আর ক্যাথারিন একটা টেবিলে মুখোমুখি বসল। খেতে খেতে দুজনের কথাবার্তা চললো।

রুথ বলল–আচ্ছা, আমাকে দেখে কি রকম মনে হয় আপনার?

-তার মানে?

-মানে, প্রথম দর্শনেই কাউকে ভালো আবার কাউকে খারাপ লোক বলে মনে হয়। তাই আমাকে দেখে কি রকম মেয়ে বলে মনে হয়?

-আমাকে কি থট রীডার মনে করলেন নাকি?

–না থট রীডার মনে করিনি। তবু কথাটা জানতে ইচ্ছে করছে আমার।

–বেশ, আপনি যখন এতই ইচ্ছুক তবে শুনুন। আপনার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে যে, আপনি কোনো দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।

-আপনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। আমার মনের কথাগুলো যদি আপনাকে বলতে পারতাম তাহলে হালকা হতো আমার মনটা।

-বেশ, আপনার মন যদি হালকা হয় বলতে পারেন।

-না, এখানে নয়। লাঞ্চের পরে আপনাকে আমার কামরায় নিয়ে গিয়ে সব কথা বলব। লাঞ্চ শেষ হলে দুজনে রুথের কামরায় গিয়ে বসলেন–পাশাপাশি।

-এবার শুনুন আমার কথাগুলি।

–বলুন, আমি শুনছি।

অনেক আগে থেকেই। কিন্তু আমাকে জোর করে সরিয়ে আনা হয়। আমার বাবার মতো ধনীলোক পৃথিবীতে খুব কমই আছেন। বাবা জানতে পেরে জোর করে লর্ড-এর ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেন। কিন্তু আমি এ বিয়েতে খুশী হইনি।

-তারপর?

–এখনও, মানে আমি রিভিয়ারায় যাচ্ছি তার সঙ্গে মেলবার জন্যে। কিন্তু এদিকে বাবা চাইছেন আমার স্বামীর চালচলনে অসন্তুষ্ট হয়ে আমাকে ডিভোর্সের মামলা করাতে। বাবার ইচ্ছে রিভিয়ারা থেকে ফিরেই আমি যেন মামলাটা দায়ের করি। কিন্তু……

-কিন্তু কি?

–আমি যে একজন পর পুরুষের সঙ্গে মিলতে যাচ্ছি তা বাবা জানেন না। আমি-মানে-আমি ঠিক বুঝতে….

কথাটা শেষ না করেই রুথ থেমে গেল। ক্যাথারিন দেখল যে, সে থরথর করে কাঁপছে। তার অবস্থা দেখে মায়া হলো।

-আমি বুঝতে পারছি যে, এ ব্যাপারটা আপনার মনে ঝড় তুলেছে।

–ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এখন আমার আর পিছবার উপায় নেই।

–কেন?

–আমি যদি এখন পিছিয়ে যাই আমার বন্ধুর মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

-মানুষের মন অতটা ভঙ্গুর নয় যে, কারো সঙ্গে দেখা না হলে মনটা ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে। আপনি কি শুধু সাহস দেখাবার জন্যে এ কাজ করেছেন? কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না নিজেই একবার ভেবে দেখুন না।

–আমি–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে শীগগিরই আমার একটা বিপদ হবে। আপনি হয়তো ভাববেন আমি পাগলামি করছি। কিন্তু কেন যেন বারবার ঐ কথাই মনে হচ্ছে শুধু।-কেন বলুন তো?

–আপনার মনে হয়, আপনি যদি প্যারীতে নেমে আপনার বাবাকে টেলিগ্রাম করে নিয়ে আসেন তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। তিনি এসে পড়লে আপনার কোনো বিপদ হবে না।

–ঠিক বলছেন। আপনার কথা মতোই কাজ করব আমি।

ক্যাথারিন-এর মনে হলো এই মহিলার এখন একা থাকা দরকার।–আমি তাহলে এখন আসি। ডিনার খেতে ডাইনিং কোচে যাবেন তো?

-ইচ্ছে তো আছে। আবার হয়তো ডিনার বাস্কেটও নিতে পারি।

রুথ-এর কামরা থেকে করিডরে পা দিতেই ক্যাথারিন লক্ষ্য করল যে পাশের কামরার দরজাটা খুলে রুথ-এর মেইড কামরা থেকে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু ক্যাথারিনকে দেখেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, মনে হলো কোনো কিছু দেখে সে চমকে উঠেছে। তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে সে পেছনের দিকে তাকালো কিন্তু কিছুই নজরে পড়লো না। এদিকে রুথ-এর মেইড দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে।

ক্যাথারিন এবার তার কামরার দিকে যেতেই দেখল, একটা কামরার দরজা খুলে একটি মেয়ে ক্যাথারিনের দিকে লক্ষ্য করছে। সে তাকাতেই তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু মুখটা দেখে মনে হল চেনা কিন্তু মনে করতে পারল না কোথায় দেখেছে।

নিজের কামরায় ঢোকবার পরেও ওই সিল্ক কোট পরা মেয়েটির কথা মনে হচ্ছিল। সীটের ওপরে বসে একটা কুশন টেনে নিয়ে তাতে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল সে।

ট্রেনটা গেয়ার দ্য লায়ন স্টেশনে থামল। সঙ্গে সঙ্গে কামরা থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল ক্যাথারিন। বাইরের ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ ভালো লাগলো তার।

হঠাৎ সে দেখল যে তার পূর্ব পরিচিত বান্ধবী জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডিনার বাস্কেট নিচ্ছে।

ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে তাড়াতাড়ি নিজের কামরায় চলে এল। মিনিট কয়েক বাদেই ডিনারের ঘণ্টা বাজল। ক্যাথারিন একখানা ডিটেকটিভ উপন্যাস হাতে নিয়ে ডিনার কোচে গিয়ে দেখল, একটি টেবিলে একটি চেয়ারই শুধু খালি আছে। আর টেবিলের দ্বিতীয় চেয়ারে বসেছেন লম্বা গোঁফওয়ালা একজন ছোটখাটো লোক। বাধ্য হয়েই সেই খালি চেয়ারে বসলো ক্যাথারিন। ভদ্রলোকটি হেসে বললেন, আপনি বুঝি খুব ডিটেকটিভ বই পড়েন?

-হ্যাঁ, এগুলো আমার ভালো লাগে।

-এই ধরনের বই-এর চাহিদা খুব বেশি শুনেছি। কিন্তু কেন এগুলির অত চাহিদা বলতে পারেন কি?

রহস্যজনক এবং রোমাঞ্চকর কাহিনী পড়ে মনে একটা উত্তেজনা জাগে। আমার মনে হয় এই কারণেই লোকে বেশি পড়ে।

-হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই বলেছেন। এতে যেসব রোমাঞ্চকর ঘটনা থাকে সেগুলি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।

–কিন্তু আমার ধারণা বাস্তব জগতের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই।

–না মাদমোয়াজেল আপনার ধারণা ভুল। এরকম অনেক ঘটনা বাস্তবেও ঘটে।

–বলেন কি?

–ঠিকই বলছি। এমনও হতে পারে, আপনিও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারেন।

-না, আমার তা মনে হয় না। আমার জীবনে এরকম কোনো ঘটনা কোনোদিনই ঘটেনি।

–অতীতে না ঘটলেও ভবিষ্যতে যে ঘটবে না তা কে বলতে পারে।

–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আছে।

–তা আছে। এবং এ ধরণের ঘটনায় নিজেকে জড়িত করাটা অপছন্দ করি না আমি। জীবনে যে অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করেছি তা হলো, লোকে যা চায় তা অনেক ক্ষেত্রেই পেয়ে যায়। আপনিও হয়তো যা চাইছেন তা পেয়ে যাবেন।

–আপনি কি ভবিষ্যৎ বক্তা না কি?

–না, আমি যা বলি তা আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলি।

এই ধরণের কথাবার্তার ভিতর দিয়ে ডিনার শেষ করে ভদ্রলোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ক্যাথারিন ডাইনিং কোচ থেকে রুথ-এর কামরার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখল রুথ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর ট্রেনের কণ্ডাক্টার সীটের ওপরে বিছানা পেতে দিচ্ছে। সে আরও লক্ষ্য করল, পাশের ছোট কামরায় কতগুলো কম্বল এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে কিন্তু রুথ-এর সহকারিণী মেয়েটি সেখানে নেই।

নিজের কামরায় ঢুকে ক্যাথারিন দেখল যে, তার বিছানা পেতে দেওয়া হয়েছে। রাত সাড়ে নটা, সে তখন তার কামরায় আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

অঘোরে ঘুমোচ্ছিল ক্যাথারিন। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়ি দেখতে গিয়ে দেখল তার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। কি মনে করে বিছানা ছেড়ে কামরা থেকে বেরিয়ে ট্রেনের কণ্ডাক্টরের কাছে সময় জেনে ঘড়িটা মিলিয়ে নেবার জন্যে কণ্ডাক্টরের সীটের দিকে গেল।

ক্যাথারিন করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুটা যেতেই দেখল কণ্ডাক্টরের সীটটা খালি। সে তখন উল্টো দিকে গেল। রুথ ক্যাথারিন-এর কামরার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল ক্যাথারিন। দেখল একটি নোক সেই কামরার দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

লোকটি করিডোরের দিকে পেছন ফিরে ছিল বলে ক্যাথারিন তার মুখটা দেখতে পেল না কিন্তু বুঝতে পারলো যে লোকটির বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের বেশি নয়।

হঠাৎ লোকটি ঘুরে দাঁড়াতেই ক্যাথারিন তাকে চিনতে পারল। এতো সেই লোকটি যে স্যাভয় হোটেলের করিডোরে তার গায়ের উপর পড়েছিল–তাছাড়া টমাক কুক-এর অফিসেও তাকে দেখেছিল।

তবে কি এই লোকটির কথাই রুথ বলেছিল। এর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই কি রিভিয়ারায় যাওয়া।

পরক্ষণেই মনে হলো সে হয়তো কামরাটা ভুল করেছে। ওটা হয়তো ওই ভদ্রলোকের কামরা হবে।

এই কথা মনে হতেই সে নিজের কামরায় চলে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদেই ট্রেনের গতিবেগ কমে গেল। তার পরেই ট্রেন এসে থামল লায়ন স্টেশনে।

.

১০.

হত্যাকাণ্ড

 খুব ভোরেই ক্যাথারিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই সে দেখল, চারিদিক বেশ ফর্সা হয়েছে।

তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে সে ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং কোচে গেল। কিন্তু সেখানে তার পূর্ব পরিচিত কাউকে দেখল না।

ব্রেকফাস্ট সেরে নিজের কামরায় এসে দেখে কণ্ডাক্টর তার বিছানা গুটিয়ে দিচ্ছে।

ক্যাথারিনকে দেখে তাকে সুপ্রভাত জানাল, আপনার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কারণ আকাশে আজ সূর্য দেখা দিচ্ছে। অন্যান্য দিন এ সময় বাইরে কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে।

কণ্ডাক্টরের কথার উত্তর দিল না, ক্যাথারিন বলল, ট্রেন লেট হয়নি তো?

–হ্যাঁ। কিছুটা লেট হয়েছে বৈকি। এতক্ষণ নিস-এ পৌঁছে যাবার কথা।

–নিস-এ পৌঁছতে আর কত দেরি?

–আর বেশি দেরি নেই। এসে গেলাম বলে। এরপর কেন, তারপরেই নিস। আপনি বিশ্রাম করুন, নিস-এর কাছাকাছি এলেই আমি এসে খবর দেব। কণ্ডাক্টর চলে গেল।

ক্যাথারিন বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে লাগল। দূরে পামগাছের সারি। সেই গাছের সারির ভেতর দিয়ে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি দেখা যাচ্ছে। আকাশটাও বেশ পরিষ্কার। দৃশ্যটা খুবই ভালো লাগল ক্যাথারিনের।

কয়েক মিনিট পরেই ট্রেনটা কেন স্টেশনে এলো। ক্যাথারিন পুরু ওভারকোট গায়ে দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ তার নতুন বন্ধুটির কথা মনে পড়ল। ঘণ্টাখানেক কথা হয়েছে তার সঙ্গে। কিন্তু এই অল্প সময়েই তাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে ক্যাথারিন।

রুথ ক্যাথারিন-এর কথা মনে হতেই কামরার দিকে তাকিয়ে দেখল সব জানালাগুলি বন্ধ। তবে কি ওর ঘুম ভাঙ্গেনি এখনও! কিন্তু তার সঙ্গে মেইড রয়েছে, তারও কি ঘুম ভাঙ্গেনি! কে জানে? হবেও বা!

ট্রেন ছাড়বার ঘন্টা পড়লেই সে তার কামরায় উঠে পড়ল। ট্রেন ছাড়বার মিনিট কয়েক পরে কণ্ডাক্টর এসে জানিয়ে গেল যে, আর পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই ট্রেন নিস-এ পৌঁছে যাবে।

ক্যাথারিন তার হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে এক পাউণ্ডের একখানা নোট বার করে কণ্ডাক্টরের হাতে দিল, এটা তোমায় বকসিস দিলাম।

নোটখানা পকেটে ভরে সে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হল সে যেন কিছু বলতে চায়। ক্যাথারিন বিরক্ত হলো। আশ্চর্য! লোকটা এক পাউণ্ড বকসিস পেয়েও খুশী হয়নি।

বিরক্তির সুরে বলল, কি ব্যাপার! তুমি কি কিছু বলতে চাও?

-হ্যাঁ, মানে… গত কাল আপনি যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছিলেন, তার সঙ্গে আপনার কত দিনের পরিচয়?

–একথা আমাকে জিজ্ঞেস করার অর্থ কি?–বেশ একটু ঝাঁঝিয়ে কথাটা বলল ক্যাথারিন।

তাকে রেগে যেতে দেখে আমতা আমতা করে বলল, না, মানে সেই মহিলাটি….

কথাটা শেষ না করেই কণ্ডাক্টর তার কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেল ক্যাথারিনের কামরা থেকে।

মিনিট পাঁচেক পরেই ট্রেন পৌঁছে গেল নিস স্টেশনে। ক্যাথারিন প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে রিসিভ করতে এসেছে কিনা।

একটু পরে একজন সুশ্রী যুবক তার সামনে এসে দাঁড়াল, ক্ষমা করবেন। আপনি কি মিস গ্রে?

-হা কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না।

–আমার নাম চ্যাব্বি। আপনার পিসতুত দিদি মানে লেডী টাম্পলিন আমার স্ত্রী। আপনার জিনিসপত্রগুলো দেখিয়ে দিন। কাস্টমস-এর ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে হবে।

দুটি স্যুটকেশ আর বিছানা ছাড়া ক্যাথারিন-এর সঙ্গে কিছুই ছিল না। চ্যাব্বিকে সেগুলো দেখিয়ে দিতেই তিনি হাঁকডাক করে একজন কুলি ডেকে সেগুলো মাথায় চাপিয়ে দিলেন।

আসুন মিস গ্রে। এবার কাস্টমস্ অফিসে যেতে হবে। কাস্টমস্-এর ঝামেলা মেটবার পর ক্যাথারিন আর চ্যাব্বি দরজার দিকে পা বাড়াতেই একজন পুলিশ-অফিসার ক্যাথারিনের সামনে এগিয়ে বলল, আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, মাদমোয়াজেল!

-কেন বলুন তো?

–কোনো বিশেষ একটা ঘটনা সম্বন্ধে আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে।

–কোনো ঘটনা? তাছাড়া আপনিই বা কে?

–আমি নিস-এর কমিশনার অব পুলিশ।

 –আপনি কি আমার পাশপোর্ট দেখতে চান?

–না, আমি আপনার কাছে কয়েকটা খবর জানতে চাই।

–খবর কি বিষয়ে?

–একজন মহিলার সম্বন্ধে। আমি জানতে পেরেছি আপনি গতকাল তার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছেন এবং লাঞ্চের পরেও অনেকক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করেছিলেন।

-কারো সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া বা গল্প করা অপরাধ নাকি?

-না। তা নয়, তবে ওই মহিলাটির সম্বন্ধে আমরা যাবতীয় খবর জানতে চাই বলেই আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার।

–দেখুন মঁসিয়ে কমিশনার, কোথাকার কোনো মহিলার খবর জানাবার জন্যে আমার মোটেই মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া এভাবে কোনো মেয়েকে বিরক্ত করাটাও বোধহয় আইনসম্মত নয়।

–ফরাসী পুলিশ অকারণে কোনো কিছু করে না। মাদমোয়াজেল কারণ একটা অবশ্যই আছে।

–কারণটা দয়া করে বলবেন কি?

নিশ্চয়ই বলব। যে মহিলাটির সম্বন্ধে আমরা খবরাখবর জানতে চাইছি, তিনি গত রাত্রে মারা গেছেন।

মারা গেছেন! বলেন কি?

 –মারা গেছেন বললে ঠিক হয় না। তিনি নিহত হয়েছেন অর্থাৎ কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে।

–কি সর্বনাশ; মিসেস ক্যাথারিন খুন হয়েছেন।

এবার তাহলে বুঝতে পারছেন কেন আমরা আপনাকে যেতে দিচ্ছি না। চলুন আমরা ট্রেনের কামরায় যাই।

–তা না হয় যাচ্ছি। কিন্তু আমার কাছ থেকে বিশেষ কোনো খবর আপনি পাবেন না। কারণ তার সম্বন্ধে আমি একেবারে কিছুই জানি না বললেই হয়। আমার মনে হয়, তার মেইডের কাছ থেকে সব খবর জানতে পারবেন।

-মেইড পালিয়েছে।

–বলেন কি!

–ঠিকই বলছি। সেইজন্যেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। কারণ ট্রেনের যাত্রীদের ভেতরে শুধু মাত্র আপনার সঙ্গেই তার কথাবার্তা হয়েছিল।

-বেশ, তাহলে চলুন কোথায় যেতে চান।

 এই সময় চ্যাব্বি বলল, আমি কি ওর সঙ্গে যেতে পারি?

–আপনি কে? প্রশ্ন করে কমিশনার।

–আমি হলাম ওর দিদির, মানে লেডী টাম্পলিনের স্বামী। আমি ওকে স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে এসেছি।

-আপনাকে একটু বাইরে অপেক্ষা করতে হবে মঁসিয়ে। মনে হয়, আধ ঘণ্টার মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শেষ করতে পারব। এই সময়টা আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।

চ্যাব্বিকে বলার পর কমিশনার ক্যাথারিনকে সঙ্গে করে একটা কামরায় গিয়ে ঢুকলেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকজন ঢুকে পড়ল সেখানে।

তাকে দেখে কমিশনার খুশী হয়ে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো যে! আপনাকে পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।

উনি মৃদু হেসে বললেন, ভাগাড়ে মড়া পড়লেই শকুন এসে হাজির হয়, তাই না?

–এটা কি বলছেন মঁসিয়ে, বিশ্ববিখ্যাত ডিটেকটিভ মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোকে এখানে পেয়ে আমি যে কত নিশ্চিন্ত হয়েছি সে কথা মুখে বলে বোঝাতে পারব না। আপনি দয়া করে বসুন মঁসিয়ে, মাদমোয়াজেল গ্রে-কে আপনার সামনেই জিজ্ঞাসা করছি। ওঁর সঙ্গে নিহত মহিলাটির পরিচয় হয়েছিল, কিছু কথাবার্তাও হয়েছিল ওঁদের ভেতরে।

মঁসিয়ে পোয়ারো তখন ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, কেমন মাদমোয়াজেল, বলেছিলাম না, আপনি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো একটা রোমাঞ্চকর ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারেন, কাথাটা খেটে গেল তো?

–হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।

এইসময় কমিশনার বললেন, আপনাকে আর বেশিক্ষণ আটকে রাখব না। এবারে আপনি বলুন, মৃত মহিলাটির সঙ্গে আপনার কি কি কথা হয়েছিল।

কমিশনারের প্রশ্নের উত্তরে ক্যাথারিন সব কথা খুলে বলল তাকে। রুথ ক্যাথারিন-এর সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে তাদের ভেতরে যা যা কথা হয়েছিল সেগুলো প্রায় হুবহু বলে গেল সে। এমন কি, রুথ যে তার বাবাকে গোপন করে লাভারের কাছে যাচ্ছিল সে কথাও বলল কমিশনারকে।

সব কথা শোনবার পর মঁসিয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে কমিশনার বললেন, ওনার মনে হয় ওই লোকটাই হয়তো…..

তার কথায় বাধা দিয়ে ক্যাথারিন বলল, ব্যাপারটা তো আত্মহত্যাও হতে পারে।

-না, আত্মহত্যার ঘটনা এটা নয়। কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে নিজের গলায় ফাঁস লাগান না।

–কি বললেন। গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুন করা হয়েছে।

–শুধু তাই নয়, কোনো ভোতা জিনিস দিয়ে আঘাত করে তার মুখটা বিকৃত করা হয়েছে।

-কী ভয়ানক!

সত্যিই ভয়ানক। হত্যাকারী যেই হোক, সে যে মহাপাষণ্ড এতে কোনোই ভুল নেই। যাই হোক, আপনাকে আর একটু কষ্ট দেব আমি। আমাদের সঙ্গে সেই মহিলাটির কামরায় একবার যেতে হবে।

কেন বলুন তো?

-মৃতদেহটা একবার দেখবেন। এখনও সনাক্ত হয়নি মৃতদেহটা। আমার মনে হয় আপনি হয়তো সনাক্ত করতে পারবেন।

-বেশ তাহলে চলুন।

 এইসময় পোয়ারো বললেন, আমি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি কি?

–একথা জিজ্ঞেস না করলেও চলতো মঁসিয়ে। আপনি নিশ্চয়ই যাবেন।

রুথ ক্যাথারিনকে সীটের ওপরে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তার বিকৃত মুখখানা দেখে ক্যাথারিন শিউরে উঠেছিল। গতকালের সেই হাসিখুশী মুখের সঙ্গে আজকের এই মুখের কত তফাৎ। রুথের অত সুন্দর মুখখানার বীভৎস পরিণতি দেখে ক্যাথারিন-এর চোখে জল এল।

কমিশনার বললেন, আপনি একে চিনতে পারছেন তো?

–হ্যাঁ, পারছি। মুখ দেখে চেনার উপায় না থাকলেও ওর গায়ের ওই সিল্ক কোট আর ডান হাতের কব্জির ওপর তিল চিহ্ন দেখে আমি ওকে চিনতে পেরেছি।

পোয়ারো বললেন, মাদমোয়াজেল-এর সাক্ষ্যটা খুবই মূল্যবান হবে মঁসিয়ে কক্স। কিন্তু এখনও খুনীর উদ্দেশ্যটা জানা যায়নি।

–আমার মনে হয় ওকে রব করবার জন্য হত্যা করেছে।

–তাই যদি হয়, তাহলে হত্যাকারী ওর মুখখানাকে ওভাবে বিকৃত করবে কেন?

–তাও তো বটে। আচ্ছা আপনার কি মনে হয়?

–কিছুই মনে হয় না। তদন্ত না করে এবং ঘটনাবলী বিশ্লেষণ না করে এ ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না। তবে এটা ঠিক যে এটা রবারী কেস নয়।

এই সময় ক্যাথারিন বলল, আমাকে আর কতক্ষণ আটকিয়ে রাখবেন মঁসিয়ে?

-না, আর বেশিক্ষণ নয়। এবার পাশের কামরাটা একটু দেখেই আপনাকে ছেড়ে দেব। ক্যাথারিন ও পোয়ারোকে নিয়ে কমিশনার পাশের কামরায় ঢুকেই দেখে যে, কামরার ভেতরে তিন-চার খানা কম্বল এলোমেলো ভাবে জড়ো হয়ে পড়ে আছে।

কম্বলগুলো তুলে একটা একটা করে পরীক্ষা করতে লাগলেন পোয়ারো। কমিশনার কয়েকটা পরীক্ষা করলেন।

সীটের পাশে একটা টুপি রাখার বাক্স এবং দুটো স্যুটকেশ দেখতে পাওয়া গেল।

জিনিসগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কমিশনার ক্যাথারিন-এর দিকে তাকালেন। এখান থেকে কোনো কিছু খোয়া গেছে কিনা দেখুন তো, মাদমোয়াজেল।

কমিশনারের কথা শুনে ক্যাথারিন ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখে বলল, একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি না।

–কি জিনিস?

–বেগুনি রং-এর একটা ভেলভেটের বাক্স। ওটাকে আমি মেইডের হাতে দেখেছিলাম।

–বাক্সটার ভেতরে কি ছিল জানেন কি?

-না, তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম, বাক্সটার ওপরে আর. কে. (R. K.) এই অক্ষর দুটি এমব্রস করা ছিল। আমার মনে হয় মেইড এটা নিয়ে সরে পড়েছে।

ক্যাথারিন-এর কথার উত্তরে কমিশনার বললেন, না। আপনার অনুমান ঠিক নয়। মেইডটি প্যারী স্টেশনে নেমেছেন।

কমিশনার যখন কথা বলছিলেন পোয়ারো কিন্তু তখনও কম্বলগুলো পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ একটা কম্বলের ভাঁজের ভেতরে দুগোছা সোনালী রঙের পরচুল দেখতে পেলেন তিনি।

চুলের গোছা দুটো হাতে তুলে কমিশনারের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জিনিসটা একবার দেখুন মঁসিয়ে কক্স।

–এতো দুগোছা চুল। এর কি কোনো গুরুত্ব আছে।

-কিসের গুরুত্ব আছে আর কিসের নেই সেটা আগে থেকে বলা যায় না। আমাদের প্রতিটি বিষয়ের দিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। আপাতত কোনো কিছু অকেজো মনে হলেও সেটাও নোট করতে হবে। এই বলে চুলের গোছা দুটো একটা কাগজে মুড়ে পকেটে রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন, কণ্ডাক্টরকে একবার ডেকে পাঠান মঁসিয়ে কক্স। তার বক্তব্যটা বিশেষভাবে শোনা দরকার।

কমিশনার ডেকে পাঠানোর দুমিনিটের মধ্যেই কণ্ডাক্টর এসে হাজির হলো। কমিশনার বললেন, আপনার নাম?

–পিয়ের মিচেল।

–আপনি আমাকে যে সব কথা বলেছিলেন সেগুলো আরেকবার এই ভদ্রলোককে বলুন। পিয়ের মিচেল বলতে শুরু করল, আমাদের ট্রেনটা গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশন থেকে ছাড়বার পর আমি বিছানা ঠিক করে দেবার জন্য মাদামের কামরায় আসি। কামরায় ঢোকবার আগে আমি ভাবছিলাম যে মাদাম হয়তো ডিনার খেতে ডাইনিং কোচে গেছেন। কিন্তু কামরায় ঢুকে দেখি যে তিনি ডিনার বাস্কেট নিয়েছেন। আমি তার মেইডের কথা জিজ্ঞাসা করলে বলেন যে তিনি তাকে প্যারীতে নামিয়ে দিয়েছেন। আমাকে তিনি একটি মাত্র বিছানা পাততে বলেন। বিছানা পাতা হয়ে গেলে তিনি আমাকে বলেন যে তাকে যেন সকালে ঘুম ভাঙ্গানো না হয়। আমি তাকে বলি তার কথা মতই কাজ হবে। তারপর তিনি আমাকে  গুড-নাইট জানান, আমিও তাকে গুড-নাইট জানিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যাই।

–আপনি মেইডের কামরায় ঢুকেছিলেন কি?–প্রশ্ন করলেন পোয়ারো।

–না মঁসিয়ে।

 –মেইডকে আপনি দেখেছিলেন?

 –ট্রেন প্যারীতে আসবার আগে একবার দেখেছিলাম।

তার কাছে কোনো ভেলভেটের বাক্স দেখেছিলেন কি?

–না।

 –আচ্ছা মেইডের কামরায় কোনো পরপুরুষ আছে বলে আপনার সন্দেহ হয়েছিল কি?

–সন্দেহ নয়, সত্যিই ঐ কামরায় একটা লোক ছিল। দরজাটা পুরোপুরি খোলা না থাকায় আমি তার মুখটা দেখতে পাইনি। তবে সে যে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল এতে কোনো ভুল নেই।

–আপনি আর কিছু লক্ষ্য করেছিলেন কি?

-না মঁসিয়ে। আর বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিনি।

–ভোর হবার পর আপনি ওদের এদিকে এসেছিলেন কি?

–হ্যাঁ, এসেছিলাম কিন্তু উনি ঘুম ভাঙাতে নিষেধ করেছেন বলে মাদামের কামরায় ঢুকিনি।

-তারপর? কি করলেন?

–কেন্স স্টেশন আসবার আগে আর একবার এই কামরার সামনে অত বেলায় তখনও দরজা বন্ধ দেখে আমি দরজায় করাঘাত করি কিন্তু ভেতরে কোনো সাড়া পাই না। আমি তখন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করি। মাদামকে দেখে মনে হলো তখনও ঘুমিয়ে আছেন। তাই আমি তাকে জাগিয়ে দেবার জন্য তার মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দিই। তারপরেই…

-তারপরই আপনি দেখতে পান যে মহিলাটিকে হত্যা করা হয়েছে তাই না?

-হ্যাঁ, ঠিক তাই। ব্লু ট্রেনে যে এই রকম একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে আমার ধারণার বাইরে। এটা সত্যই ভয়ানক। কিন্তু আমি জ্ঞানত আমার কর্তব্য কর্মে অবহেলা করিনি।

কমিশনার বললেন, না, আপনার কর্তব্য কর্মে ত্রুটি হয়নি। এ ব্যাপারে আপনার কোনো চিন্তা নেই।

কমিশনারের কথায় আশ্বস্ত হয়ে কণ্ডাক্টর বলল, মঁসিয়ে যদি দয়া করে কর্তৃপক্ষকে আমার সম্বন্ধে একটু বলেন তাহলে বড় ভাল হয়।

–ঠিক আছে। রেল কর্তৃপক্ষকে আপনার কথা বলব। কণ্ডাক্টর সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে চলে গেল।

কমিশনার বললেন, ডাক্তারের কথা মেনে নিলে ধরতে হয় মহিলাটিকে হত্যা করা হয়েছিল। গেয়ার দ্য নয়েন এবং নয়েন স্টেশনের মধ্যে। কিন্তু কে এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক। মাদমোয়াজেল-এর কথায় বোঝা যায় যে মহিলাটি তার লাভারের সঙ্গে দেখা করতে রিভিয়ারায় যাচ্ছিলেন। তবে কি লোকটা প্যারীতে এর সঙ্গে দেখা করেছিল? আমার মনে হয় দেখা করেছিল এবং এই মহিলাটি তাকে পাশের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল। এরপর মহিলাটি হয়তো তাকে জানায় যে তিনি আর তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। এবং এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে কলহের দরুণ ওকে হত্যা করে সে নয়েন স্টেশনে নেমে যায়।

পোয়ারো বললেন, অথবা সে নিস স্টেশনেও আসতে পারে।

-তা পারে, কিন্তু সেটা তার পক্ষে চরম দুঃসাহসের কাজ হবে।

–এটা তো ডাকাতদের কাজও হতে পারে।

–হ্যাঁ, তাও হতে পারে। কিন্তু সেই মেইডটির খোঁজ না পাওয়া অবধি সঠিক কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ভেলভেটের বাক্সটি যদি তার কাছে পাওয়া যায় তাহলে এটা রেল-ডাকাতদের কাজ নয়। শুধু তাই নয়। বাক্সটার সন্ধান পওয়া গেলে নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে এটা প্রেমঘটিত ব্যাপার। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা ট্রেন-ডাকাতদেরই কাজ। আজকাল ওরা ভয়ানক দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে।

এই সময় ক্যাথারিন বলল, আমাকে আর কতক্ষণ আটকে রাখতে চান আপনারা?

কমিশনার বললেন, না, আর আপনাকে আটকে রাখব না। এবার আপনি যেতে পারেন আর যাবার আগে আপনার ঠিকানাটা দিয়ে যান।

–লিখে নিন। ক্যাথারিন গ্রে, কেয়ার অব লেডী টাম্পলিন, মার্গারেট ভিলা, নিস। ঠিকানাটা দিয়েই সে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল।