৩. পোয়ারো লাফিয়ে উঠল

১০.

(ক)

 সব শুনে পোয়ারো লাফিয়ে উঠল। সাবাস! এই রকমই চেয়েছিলাম, আমি চেয়েছি, তুমি নিজেই বিশ্লেষণ করে সত্য উদ্ধার করো।

তাহলে বন্ধু ঠিক বিশ্লেষণ করেছি? এটাও তোমার সেই এক্স নামীয় ব্যক্তিটি দ্বারা সংঘটিত আরো একটি ঘটনা!

প্রশ্নাতীত ভাবে সত্য! নির্দ্বিধায় পোয়ারো বলে গেল।

এই হত্যার উদ্দেশ্য কি, তাহলে?

 কিছুই কি তোমার মাথায় ঢুকছে না?

নাঃ!

একটা ধারণা আমি করতে পারছি, সব ঘটনাগুলোর মধ্যে কি সেই একই যোগসূত্র?

ঠিক তাই।

কী সেই যোগসূত্র? অধীর হলাম আমি। হঠাৎ সে প্রথম দিনের পোয়ারোর মত খোলসে ঢুকে গিয়ে বলল, ভালো হয়, যদি তুমি এখনই না জানো।

অস্ফুট চিৎকার করে বলি, না–আমায় এখনই জানতে হবে। আমায় ভুল বুঝো না। শুধু জেনে রাখো তোমার বিশ্লেষণ মিথ্যে নয়।

থ্রাইটিসে কষ্ট পাচ্ছ, পঙ্গু শরীর তবু একা লড়ে যেতে চাও। তোমাকে শোধরানো যাবে না।

ভুল-ভুল। প্রিয়বন্ধু আমার। তুমি তো আমার হয়ে লড়ে যাচ্ছে। আমি তো তোমার চোখে, তোমার কানেই দেখছি, শুনছি। শুধুমাত্র সেই কথাটা বলে একটা বিপদ ডেকে আনতে চাই।

বিপদ। কার? আমার?

 হত্যাকারীর।

আশ্চর্য। তুমি তাকে ধরতে চাও কিন্তু ধরা দাও না। অথবা, তুমি এখনও ভাবছো এমন আমি দুর্বল যে নিজেকে রক্ষা করতেই পারব না।

মনে রাখবে একটা কথা হেস্টিংস যে একবার খুন করেছে, প্রয়োজনে সে দ্বিতীয়, তৃতীয়, …..অজস্র খুন করতে পারে।

হুঁ, গুম হয়ে বলি, কিন্তু আরেকটা হত্যার ঘটনা ঘটতে পারেনি এখানে, নিশানা ব্যর্থ হয়েছে।

হ্যাঁ, খুব সৌভাগ্য, এসব ব্যাপার আগে থেকে আঁচ করা যায় না। তাই তো আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

ওর সকরুণ কণ্ঠ আমার ব্যথিত করল। তবে একথা বলতে পারি, আগের পোয়ারো এখন থাকলেও, পোয়ারোর বর্তমানের উপস্থিতিই হত্যাকারীর হৃদ কম্পন বাড়িয়ে তুলেছে নিশ্চয়ই।

বিষণ্ণ মনে পোয়ারোর ঘর ছাড়লুম, কে সেই এক্স? একটু অস্পষ্ট সন্দেহ আমার মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই সময় জুডিথকে পাকড়াও করলাম।

গত সন্ধ্যায় এলারটনের সঙ্গে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

জানতাম ও একটা চোখা কোনো উত্তর দেবে যার জন্য আমাকে প্রশ্ন থেকে শত দূরে ছিটকে ফেলে দেবে। তাই হল…..। ঝাজের সঙ্গে উত্তর এল, সত্যি বাবা, বুঝে পাই না তোমরা অত আমাদের পেছনে লেগে থাকো কেন?

না- মানে কেবল জানতে চাইলাম।

কিন্তু কেন? কেন এসব প্রশ্ন করে আমাকে তুমি খোঁচাও?

আমি ওর কাছে এলারটনের খোঁজ পেতে চেয়েছিলাম। তাই ঠান্ডা মেজাজে বললাম, বললাম, রাগ কোরো না জুডিথ। এই সামান্য উত্তর পাওয়ার অধিকারটাও কি আমার নেই?

বুঝি না, কেন এসব জানতে চাও।

আসলে আমিও তো সবকিছু জানি না, তাই একটু জানার আগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম। তুমি তো একেবারেই নিস্পৃহ, দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে।

মিসেস লাটরেলের দুর্ঘটনার কথা বলছ, সে তো শুনেছি। আমি তো তখন গ্রামের বাইরে স্ট্যাম্প আনতে গিয়েছিলাম। শান্ত গলায় জুডিথ উত্তর দিল।

মেজর এলারটন তোমার সঙ্গে ছিলেন না?

না। গতকাল রাতে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার দু-তিন মিনিট আগে আমরা একসাথে হয়েছিলাম। এবার হলো তো? কোথায় কার সঙ্গে কখন যাব, এসব জানতে চেয়ে আমাকে বিরক্ত করো না। আমি আমার মতন চলব।

তা, ঠিক। এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে। মেজাজ না হারিয়ে বললাম।

লক্ষ্য করলাম ওর একগুঁয়েমি ভাবটা কাটছে।

শুনে খুশি হলাম। সবসময় ঐ রকম হেডটিচারের মতন শাসন করবে না তো।

 ঠিক এমন সময় ডঃ ফ্রাঙ্কলিন এসে উপস্থিত হলেন।

বলে জুডিথ, আমাদের এর মধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

ফ্রাঙ্কলিনের কথাগুলো শুনে মনে হল উনি যেন ওর অভিভাবক। জুডিথ ওঁর সেক্রেটারী হলেন, হুকুম চালাবার তো একটা শালীনতা থাকা দরকার। এ বরদাস্ত করা যায় না। তবে ফ্রাঙ্কলিনের বিদ্যের বোঝা দেখে সবসময় নিশ্চয়ই মেয়েরা কাত হয়ে পড়বে না। এলারটন ও ফ্রাঙ্কলিনের মধ্যে তফাৎটা বড্ড বেশি প্রকট হয়ে উঠল। জুডিথের জন্য কষ্ট হল। বেচারা, দু-নৌকায় পা দিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবুও এলারটনকে ও পরিত্যাগ করুক–এটা আমি চাই না।

জুডিথ স্ট্যাম্প কিনতে গিয়েছিল, তাহলে এলারটন কোথায় ছিল? যদি ধরি ও গুলি ছুঁড়েছে, তাহলে উদ্দেশ্যবিহীন এই গুলি ছোঁড়ার কারণ কী? এলারটনের তো মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়নি, কি জানি ওর মধ্যে কি দেখেছে জুডিথ।

.

 ()

জুডিথের সুখ-দুঃখ আমায় আহত করে। কিন্তু যখনই অদৃশ্য এক্স-এর ঘোরাফেরা এবং একটা হত্যাকান্ড ঘটতে চলেছে–এরূপ একটা চিন্তা আমায় তাড়া করে, তখন যে ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো বা জুডিথের কাছ থেকে আমায় অনেক দূরে টেনে নিয়ে যায়।

সে আঘাত এসে গেলেও সৌভাগ্য ক্রমে তা মারাত্মক হয়নি। মনে পড়ে ক্যারিংটনের উচ্ছ্বাসের বসে বলে ফেলা একটি ঘটনার কথা। এলারটনেরও স্ত্রী বর্তমান। বয়েড খোঁজ খবর রাখেন। হয়তো জুডিথের জন্যই এলারটনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চুলচেরা বিচার করতে শুরু করেছি।

বয়েডের কাছে জেনেছি এলারটনের স্ত্রী একজন খোঁড়া রোমান ক্যাথলিক। তাই ওদের ডিভোর্স হয়নি। একজন অসূয়া কন্যার পিতার কাছে এ সুখবর বটে।….।

পরের কয়েকটি দিনে সেরকম কিছু ঘটেনি। কর্নেলও বেশিরভাগ সময় তার স্ত্রীর পাশেই কাটান। তার জন্য এখন নতুন নার্স নিয়োগ করার ফলে ক্লাভেন তার নিজের জায়গায় ফিরে গেছে।

এর মধ্যে একদিনের কথা বলা যাক–

পোয়ারোকে মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের ঘরে পেলাম। ওর নির্দেশ মতই কারটিস মাঝেমাঝে পোয়ারোকে ওখানে নিয়ে যায়। ওদের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।

পোয়ারোকে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন তার সুখ-দুঃখের কথা শোনাচ্ছিলেন। তিনি কাতর ভাবে বলছিলেন, নিজের শরীর নিয়ে আমি ভীষণ বিব্রত, সেজন্য নিজেরই ভীষণ লজ্জা হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এইরকম ভাবে অন্যের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকাটা অপরাধ। এর চেয়ে পৃথিবীর থেকে বিদায় নেওয়া ভালো।

উঁহু ম্যাডাম, এ আপনার ভুল ধারণা, একটা সুন্দর ফুলকে বাঁচাতে হলে আচ্ছাদনের প্রয়োজন কিন্তু বনফুলের বেলায় তার প্রয়োজন হয় না। আমার বলতে গেলে কারোর কাছেই মূল্য নেই, অথচ বেছে থাকার কী অপরিসীম আগ্রহ।

মিসেস ফ্রাঙ্কলিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার কথা আলাদা। কারোর জন্য আপনাকে দুশ্চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু আমার জনের জন্য চিন্তা হয়। একটা বোঝা হয়ে আছি।

তিনি কি হাবভাবে সেরকম কিছু প্রকাশ করেছেন?

না-না। মুখেও নয়, হাবভাবেও নয়। কিন্তু ওর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি ও কত অসুখী। আরো ভয়ের কারণ হচ্ছে ও ভীষণ বেপরোয়া।

বেপরোয়া? না ম্যাডাম এ ব্যাপারে আপনার সাথে একমত হতে পারছি না।

না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ আমি যতটা ওকে চিনি, আপনি ততটা নয়। বুঝি যে আমি না থাকলে ওর জীবন আরো স্বচ্ছন্দময় হয়ে উঠবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মাঝে মাঝে মনে হয় আমার চলে যাওয়াই ভালো।

এ আপনার অসুস্থ মনের চিন্তা, একদম এ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। পোয়ারো কথাগুলো মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে বলে উঠলেন। মিসেস ফ্রাঙ্কলিন কিন্তু গম্ভীর হতাশার সঙ্গে বলে চললেন, এ সংসারে আমি কার উপকারে লাগব? কার জন্য বেঁচে থাকব?

সেদিন ক্লাভেনের সঙ্গে কথা বলার সময় সে বলছিল, জানেন মিঃ হেস্টিংস, যারা বলে আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাই, জানবেন সেটা ওদের মনের কথা নয়।

হায় সংসার, কী বিচিত্র তার গতি প্রকৃতি!…

এই মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে একদিন অন্য চেহারায় দেখলাম।

সেদিন ভোরে কারটিস ভোরের মুক্ত বাতাস সেবনের জন্য পোয়ারোকে বাগানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আমি সেখানে পৌঁছলাম। সদ্য ফোঁটা ফুলের মত হাসতে হাসতে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওনার স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। এমনটি আর কখন চোখে পড়েনি।

আহ! মঁসিয়ে পোয়ারো! সাদা ঝকঝকে দাঁতে হাসি ছড়িয়ে বললেন, বয়েডের সঙ্গে ও বাড়ি যাচ্ছি। জানালা দরজায় পর্দা পছন্দ করে সাজিয়ে দিয়ে আসব।

তারপর পোয়ারোর পাশে একচেয়ারে বসে বললেন, গতকাল জনের ল্যাবে দস্তানাটা ফেলে গিয়েছিলাম। শুনলাম ও আর জুডিথ ল্যাবরেটরির জন্য কি কেমিকেল কিনতে বেরিয়েছে। তারপর একটা হাওয়া ফুসফুস ভর্তি করে নিয়ে বললেন, ভাগ্যিস বিজ্ঞানী হইনি, নইলে ভোরের এই মুক্ত বাতাস সেবন করতে পারতাম না।

পোয়ারো রসিকতা করে বললেন, দেখবেন ম্যাডাম সব বিজ্ঞানীরা যেন আপনার কথা না শুনে ফেলে।

নিশ্চয়ই না। আপনি ভাববেন না যে আমার স্বামীর প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। ওর মত এমন সাধনা কজনের থাকে বলুন তো?

হঠাৎ নার্স ক্লাভেনের কথা মনে পড়তে মনে হল মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের পতিভক্তি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ছে না?

মিসেস ফ্রাঙ্কলিন পোয়ারোকে বললেন, জানেন জর্জ আসলে এত ভালো মানুষ তার জন্যই ওকে নিয়ে বেশি ভয়। মানুষের উপকারে লাগবার জন্য যে কোনো কাজের ঝুঁকি নিতে উনি প্রস্তুত।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, সে কথা বলতে

কিন্তু এসব কথা কেউ বোঝেন না জানেন। কোনোদিন না নিজের উপরে গবেষণা করে বসেন।

বললুম। তখন নিশ্চয়ই নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি সজাগ থাকবেন।

ম্লান হেসে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন, একবার এক বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে কি কাণ্ডটাই না বাঁধিয়ে দিলেন কী বলব।

তাই নাকি?

তবে আর বলছি কী। দুঃখের সঙ্গে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন। ওকে একটা ট্যাঙ্কের মধ্যে বসিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা ধরে মানুষের দেহে ঐ গ্যাসের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তার পরীক্ষা করেছিলেন। উনি তো মারাও যেতে পারতেন। একজন প্রফেসরের মুখে আমি এসব কথা শুনেছি। সাহস থাকা ভালো কিন্তু বেপরোয়া হওয়া ভালো নয়। আমি হলে তোত পারতামই না।

পোয়ারো ধীর স্থির গলায় বললেন, এর জন্য প্রয়োজন অত্যাধিক সাহস ও মনসংযোগ যা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে কল্পনা করাই অসম্ভব।

তাহলেই বলুন আমার ভয় থাকবে না। ঐ গিনিপিগ, ইঁদুর ওদের উপর পরীক্ষা চালাবার একটা সীমা আছে। যার পর আর কাজ হয় না। তখন প্রয়োজন হয় মানুষের দেহে তার প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা। জন হয়তো নিজেরই উপরই কোনোদিন সে পরীক্ষা করে বসবে।

সেই মুহূর্তেই বয়েডের আবির্ভাব ঘটল।

আমি প্রস্তুত আছি। বারবার বলে উঠল।

 বয়েড তৎক্ষণাৎ বললেন, আশাকরি তোমার কোনো কষ্ট হবে না।

মোটেই না। বরং অন্যদিনের চেয়ে আমি অনেক বেশি সুস্থ। তারপর দুজনে চলে গেলেন। পোয়রো গভীরভাবে বললেন, তাহলে ফ্রাঙ্কলিন আমাদের আধুনিক সন্ন্যাসী, কী বল বন্ধু?

একটু ভেবে বললাম, তাই দেখছি। কিন্তু আমার মনে হয় ভদ্রমহিলা এই রকম—

কোনোরকম?

নাটকীয় চরিত্র বলতে যেরকম, সেরকম। একদিন প্রত্যাখ্যাতা স্ত্রীর চরিত্র, কখনও ভুল বোঝাবুঝির জন্য ক্ষিপ্ত, অন্য সময় আত্মপ্রত্যয়ের চরম পরকাষ্ঠার প্রতীক। আজ দেখলাম,বীর পূজায় আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে পারে এমন এক মহীয়সী নারীর জমিদার। তবে কী, সব কিছুতেই নাটকীয়তা থেকে যাচ্ছে।

তোমার কি মনে হয় না হেস্টিংস আসলে উনি যেভাবে নিজেকে জাহির করতে চান, বরং সেরকম নয়, একটু নির্বোধ প্রকৃতির মহিলা।

নির্বোধ কিনা বলতে পারি না, তবে চালাক নয়–

আমার মত? সে আবার কী?

আহ! চোখ বুজে দেখবেন আকাশের পরীরা এসে কানে কানে গান শুনিয়ে যাচ্ছে।

আমি বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠতে গিয়েছিলাম। কিন্তু নার্স ক্লাভেন আসতে থামতে হল। আমাদের দেখে হেসে ল্যাবরেটরিতে ঢুকেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা হাত ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দস্তানা নিয়ে গেছেন। হঠাৎ মনে পড়েছে হাত ব্যাগটা ফেলে গেছেন। যাই ওরা অপেক্ষা করছেন।

হঠাৎ ক্লাভেনের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হল, হয়তো এভাবে জীবন কাটাতে কাটাতে উনি ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তাই মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের এদিকে একটু নজর রাখা ভালো।

হুম। চোখ বুজিয়েই পোয়ারো বলল, তার আবার সোনালী সুন্দর কেশদাম–

আমি একুট অবাক হয়েই তাকালাম। কেনই বা এই মুহূর্তে ওর কেবল চুলের কথা মনে পড়ল বুঝলাম না। তাই উত্তর খুঁজে না পাওয়াতে চুপ করেই রইলাম।

.

১১.

 যতদূর মনে পড়ল পরের দিন কিন্তু আলোচনা আমার মনের প্রশান্তি নষ্ট করছিল।

আমি, জুডিথ, বয়েড ও নরটন চারজনে ছিলাম। বিষয় বস্তু ছিল অদ্ভুত। রোগে ভুগে ভুগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে যে মানুষ, তার যন্ত্রণাবিহীন উপশমের ব্যবস্থা করার ডাক্তারি শাস্ত্রের নাম উইথ্যানেজিয়া। কেন এরকম বিষয়বস্তু এসে পড়েছিল বলতে পারি না। তবে আমরা দুজন পক্ষে ও দুজন বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছিলাম। বয়েড ক্যারিংটন বক্তা, নরটন আগ্রহী শ্রোতা, জুডিথ নির্ভর যোগ্যহীনভাবে ভীষণ মনোযোগী।

আমি এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারলেও, এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারছিলাম না। তখন ভাবপ্রবণতার বশে রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা যেমন খুশী তেমন ব্যবহার করবেন।

আমার যুক্তিতে নরটনেরও সায় ছিল। শুধু সে বলল, যদি অবশ্য রুগীর মত থাকে তবেই এরকম কিছু করা যেতে পারে।

ক্যারিংটন বলে উঠল, কেউ তো আর স্বইচ্ছায় জীবন ত্যাগ করতে চায় না। এরপর তিনি শোনালেন যে একজন ক্যান্সার রোগী ভীষণ ভাবে ভুগলেও শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন ত্যাগ করতে পারেনি। তিনি শুধু ডাক্তারকে ডেকে বলেছিলেন এমন কোনো ব্যবস্থা কি করা যায় না, যাতে পৃথিবী থেকে নীরবে চলে যাওয়া যায়? ডাক্তার বলেছিলেন তা সম্ভব নয়। ডাক্তারও জানতো তার বাঁচার থেকে মরে যাওয়াই ভালো। তাই তিনি কৌশল করে টেবিলে মরফিন বেশি করে রেখে দিয়ে বলেছিলেন, খুব কষ্ট হলে খেতে। তাহলে প্রকারান্তরে ডাক্তার তাকে মারণাস্ত্র দিয়ে গেছেন। কিন্তু রোগী সব জেনে তো নিজের মৃত্যুর ব্যবস্থা নিজে করতে পারেনি।

তাই বয়েড বলছিলেন কেউ নিজেকে মারতে পারে না।

এবার জুডিথ বলে উঠল, তিনি অসুস্থ বলে রোগীর ভালোমন্দ ভাববার দায়িত্ব অন্যদের। এ সিদ্ধান্তের ভার রোগীর ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। আসলে এই সব রোগীদের তাদেরই নিতে হবে, যারা এর মঙ্গল চায়। কাউকে চিরকালের জন্য শাস্তি দিতে গেলে একাজ তো কাউকে না কাউকেই করতে হবে।

বয়েড বললেন, যদি এর জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবেও?

তা কেন? আমি যদি ভালবেসে কারোর জন্য একাজ করি, তাহলে এ ঝুঁকি নিতে নিশ্চয়ই পিছপা হব না।

বয়েড বলল, অত সহজ নয় যেখানে বাঁচা মরার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে, আইন সেখানে হাতে নেওয়া কঠিন।

নরটন বলে, ছেলেমানুষ বলে হয়তো জুডিথ একথা বলছে।

মোটেই নয়। আসলে আপনারা ভাবছেন ওভাবে কাউকে মেরে ফেলা যায় না, কিন্তু আমি বলছি তা নয়, আমি তার মঙ্গল চাই, আমি তো হত্যা করার উদ্দেশ্যে কাউকে মুক্তি দিতে চাইছি না।

কিন্তু আসল ঘটনার সময় দেখবে কেউ তোমাকে ছাড়ছে না। নরটন তর্ক করে চলতে লাগল।

কে বলল? আমি জীবনে আপনাদের মত মহত্ত্বর বা অপরিহার্য ভাবিনি যার জন্য একজন অসুস্থ, পঙ্গু মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করব। এতে আমার কিছু মাত্র হাত কাপবে না।

সত্যি একথা যে, যারা সমাজকে কিছু দিতে পারবে তাদেরই বেঁচে থাকা উচিৎ।

তাহলে আপনারা সমাজের জন্য এ ঝুঁকি নেবেন না কেন?

হয়তো পারবো, প্রয়োজন হলে, বয়েড উত্তর করলেন।

কিন্তু নরটন বললেন, যা খাতার পাতায় লেখা তা কখন হাতে কলমে করা যায় না।

বয়েড বলে উঠলেন, ভুল করছেন নরটন। জুডিথ আসলে ততটা দুর্বল নয়, ওরকম পরীক্ষা ওকে কখনই দিতে হবে না।

বাড়ির ভেতর থেকে ঘণ্টার আওয়াজ আসতেই জুডিথ দাঁড়িয়ে নরটনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সম্বন্ধে আসলে কোনো ধারণাই আপনাদের নেই। প্রয়োজন হলে আমি ভীষণ কঠোরও হতে পারি। বয়েড বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে যাব, দাঁড়াও, বলেই দুজনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।

হয়তো আমার দীর্ঘশ্বাস ফেলা দেখে নরটন বুঝেছেন আমি কতটা আঘাত পেয়েছি। আমাকে বললেন, অত কাতর হবেন না, আসলে ওগুলো জুডিথের মনের কথাই নয়। যৌবনের ধর্ম।

নরটনের কথা জুডিথের কানে যেতেই ও কটাক্ষপাত করে চলে গেল। নরটন গলার স্বর নিচু করে বললেন, স্যার এই এলারটন সম্পর্কে আপনার ধারণা কতটুকু?

এলারটন? চমকে উঠলাম।

কিছু মনে করবেন না স্যার। ওর সাথে জুডিথের মেলামেশা দেখলে ভয় হয়। একটা মেয়ের কথা বলি, শেষ পর্যন্ত তার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথই তার ছিল না।

শিউরে উঠলাম। একজন অনূঢ়া কন্যার পিতার কাছে এযে কী দুঃসংবাদ তা কী আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয়। লাঞ্চে বসেও সুখ পেলাম না।

.

১২.

সেদিন বিকালে পোয়ারো আমায় জিজ্ঞেস করল, প্রিয় বন্ধু কোনো কিছু কি তোমার মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে?

কোনো উত্তর না দিয়ে সরে গিয়েছিলাম। এই দুঃখ আমাকেই বহন করে চলতে হবে। কিন্তু আমার কন্যা সে ব্যথা বুঝল না…।

সেই স্টাইলস, সেই পুরনো স্মৃতি, কিন্তু কেন যেন ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে। কোনো এক অশরীরী আত্মা যেন এখানকার আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার রূপ একজন হত্যাকারীর। অবয়ব একটা নিষ্ঠুর ঘাতকের। আর যখন জুডিথের জন্য মন পীড়িত হয়, তখন মনে হয়, সেই ঘাতক বা হত্যাকারীর রূপ, এলারটনের রূপ ধারণ করছে। এ যেন মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে বেশি।

সেদিন ক্যারিংটনের এত নিদানের কথাটা মনে পড়ল, কিন্তু জুডিথের মত একটা মেয়ে থাকলে, এই যন্ত্রণা বুঝতে পারতেন, আমি আমার মেয়ের অধঃপতন চোখের সামনে দেখছি। যদি ওর মা বেঁচে থাকত? কিন্তু না–

একটা কিছু তো করতেই হবে। কিন্তু যখন আমার প্রতি মেয়ের চোখে ঘৃণা দেখি, তখনই যেন কেমন অসাড় হয়ে পড়ি।

ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বাগানে এসে উপস্থিত হয়েছি বুঝতে পারিনি। সম্বিত ফিরতে দেখি, মেয়েটা আমার মনমরা হয়ে বসে আছে। সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে?

জুডিথ সোজা হয়ে বসে বলে, কখন এলে? এই মাতৃহীনা কন্যার বিষণ্ণতায় ভেতরটা যেন টনটন করে ওঠে। বেদনাঘন কণ্ঠে বলি, এই ভদ্রলোক তোমার উপযুক্ত নয়। আমার উপর ভরসা, বিশ্বাস রাখো।

অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল চেপে বলল, তুমি কী তা ঠিক জানেনা বাবা

জানি, আমি তোর পিতা। আমি কি তোর দুঃখের কথা বুঝতে পারব না?

সে যেন আপন মনেই বলল, তুমি যেমন তাকে জানো, বোধহয় আমিও ততটাই জানি

কিছুতেই তুমি সব জানো না। তুমি সংসারের কিছুই দেখনি। জানো, এলারটন বিবাহিত? ওর স্ত্রী বর্তমান, এইরকম কোনো ভদ্রলোককে বিয়ে করে কোনো মেয়ে সুখী হতে পারে? একে বিয়ে করে ভবিষ্যতে দুদিনে সব রঙ ফিকে হয়ে যাবে।

হঠাৎ হেসে বলল, দেখছি তুমি সব জেনে বসে আছে।

নিশ্চয়ই

না।

 ছেলেমানুষী কোরো না, এখনও সময় আছে।

আবার আগের মতন ভয়ঙ্করী, প্রলয়ংকরী হয়ে জুডিথ বলল, তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলিয়ো না। আমি কায়মনবাক্যে ওকে প্রার্থনা করি। ও আমার হৃদয়ের কামনাবাসনা। তুমি এখান থেকে চলে যাও, তোমার এই বিচ্ছিরি ঘটনাকে আমি ঘৃণা করি–আমায় উঠতে হল না, জুডিথই চলে গেল।

কতক্ষণ পাথরের মত বসে ছিলাম জানি না। নরটন ও এলিজাবেথ কেলি এসে আমার সম্বিত ফিরিয়ে আনল। হয়তো জুডিথকে দেখে বা আমাদের কোনো কথা শুনেই আমার দুঃখের কারণ বুঝতে পেরেছে। তাই শালীনতা বজায় রেখে হৈ হৈ করে প্রসঙ্গ বদল করতে চাইল।

ওদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আমি কিছুটা হাল্কা বোধ করছিলাম। হঠাৎ একটা দূরবীন নাকের খাঁজে আটকে আমাদের দিকে তাকিয়ে করুণস্বরে বললেন, ভেবেছিলাম বুঝি কাঠ-ঠোকরা পাখি-না, তা নয়।

তার ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলাম কিছু একটা তিনি লুকোতে চাইছেন। কেন তিনি এরকম আচরণ করলেন? হঠাৎ জেদের বশে বললাম, দেখি, দূরবীনটা আমায় দিন।

নরটন একলাফে দূরে সরে গিয়ে বললেন, না কিছু নয়। তার এই একগুয়েমী দেখে মনে হল সে যা দেখছে তা আমাকে দেখাতে চায় না। তিনি অন্য কিছু দেখেছেন। তিনি ঐ ঘন ঝোঁপটার দিকে নিশানা করেছিলেন। সেজন্য আরো উৎকণ্ঠিত হলাম।

তাকে বাধা দেবার সুযোগ না করে দিয়েই দূরবীনটা কেড়ে নিলাম। কিন্তু নরটন হাত পা ছুঁড়ে বললেন, পাখি উড়ে গেছে, মিছে চেষ্টা করছেন।

সত্যিই পাখি উড়ে গেছে। প্রখর আলোয় ওড়নার মত মেয়েদের স্কার্টের অংশ বিশেষ দেখতে আমার ভুল হয়নি।

দুজনকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল ভেবে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

যখন বাড়ির কাছাকাছি এলাম তখন বারবারা ও ফ্রাঙ্কলিনরাও এসে পড়লেন। শুনলাম জিনিসপত্র কিনতে টেড কাস্টার পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।

যখন গাড়ি থেকে সমস্ত জিনিসপত্র নামানো হচ্ছিল তখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের চোখে মুখে উত্তেজিত আনন্দ লক্ষ্য করলাম। বয়েডের হাতে একটা শৌখিন প্যাকেট দিয়ে ওপরে পাঠিয়ে দিলেন। আমরাও জিনিসপত্র নামাতে ওদের সাহায্য করলাম।

উত্তেজনা বজায় রেখে ক্লান্ত ভাবে বারবারা বললে, উফ কী গরম! একপশলা বৃষ্টি হয়তো স্বস্তি আনতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মিস কেলিকে পাকড়াও করে বললেন, জনের কি খবর? শুনলাম ওর মাথা যন্ত্রণা হচ্ছিল? সারা দিনরাত মাথাগুঁজে বসে থাকলে হবে না, তার পরেই নরটনকে বললেন, কী ব্যাপার ভূতটুত দেখেছেন নাকি? অমন পাচার মতন মুখ করে বসে আছেন?

না-আসলে অন্য কথা ভাবছিলাম।

কারটিসের সঙ্গে পোয়ারো এসে উপস্থিত হল। আমার থমথমে মুখ দেখে উদগ্রীব হয়ে বললেন, কী ব্যাপার সবাই এত গম্ভীর, কোনো অঘটন ঘটেনি তো?

আমি কিছু বলার পূর্বেই বারবারা বলে উঠল, না, ওসব কিছু নয়। হয়তো ঝড়ের পূর্বাভাস।

ভালো–ভালো, বলেই চলে গেল।

বারবারা আমাকে একটু সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। ওপরে ওনার পিছন পিছন আসতেই ঘরের দরজা খুলে দেখি ঘরের এক প্রান্তে বয়েড ক্যারিংটন ও তার পাশে দাঁড়িয়ে নার্স ক্লাভেন।

ক্যারিংটন মুখ তুলে বললেন, নার্স ক্লাভেন হাত দেখতে জানেন।

তাই নাকি?–একটা বাঁকা হাসি হেসে বললেন, এখন হাত দেখা ছেড়ে এই জিনিসপত্রগুলোয় একটু হাত লাগান।

ক্লাভেন দ্রুত কাজ করতে চলে গেল।

বয়েড বলে উঠল, সত্যি তোমাকে দিয়ে বড় বেশি পরিশ্রম করিয়ে নিলাম, আমার উচিৎ হয়নি হয়তো।

অত ভেবো না বয়েড।

খুব ভালো, বিশ্রাম কর। অনুতাপের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল যে, আমার বারবারার শরীরের দিকে নজর রাখা উচিত ছিল।

বললাম, ও কিছু নয়, বিশ্রাম পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

পোয়ারোর ঘরে যাওয়ার পথেই এলারটনের ঘর, অজান্তেই কখন ওর ঘরের সামনে থেমে পড়ি, ভেতর থেকে কথোপকথন ভেসে আসছিল। হঠাৎ জুডিথ বেরিয়ে এসে আমাকে ভূত দেখার মতন লাফিয়ে ওঠে। ওকে কোনো বাধা না দিয়েই আমার ঘরে একেবারে টেনে আনি।

ঘরে ঢুকেই ও চেঁচিয়ে ওঠে। ওর সঙ্গে এত মাখামাখি কেন? অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।

জুডিথ আমায় ঠান্ডা গলায় বলে, তোমার মন এতটা নোংরা জানা ছিল না।

আচ্ছা আমি বাজে, নোংরা, পাজি। কিন্তু আমাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য আছে তো।

ও-এই কথা!

হা-এই আমার বক্তব্য, তুমি কি অস্বীকার করতে পারো যে তুমি লোকটির প্রেমে পড়োনি?

না।

ওর অতীত ইতিহাস জানিয়ে দিয়ে বলি, বুঝেছ লোকটা কত ধুরন্ধর, শয়তান?

 হ্যাঁ। আমি ওকে সাধু বলে ভাবিনি, এটা জেনে রাখো।

এভাবে তুমি তোমার নিজের সম্মান নষ্ট কোরো না।

আমি কখনও অত তলিয়ে দেখিনি।

আমার ব্যাপারে তুমি নাক গলিয়ো না।–শান্ত ভাবে বলেই ঘর থেকে ও বেরিয়ে গেল।

 কীভাবে এই অবাধ্য সন্তানকে রক্ষা করব ভেবে পেলাম না।

আমি যথা সম্ভব আমার ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্ট, পারিবারিক হীনতা লুকিয়ে রেখে আমার মনের মধ্যে, সর্ব সম্মুখে এমন মুখের ভাব দেখালাম যাতে ভদ্র মহোদয়গণই শুধু নয়, জুডিথও অবাক হয়ে গেল। কিভাবে এতটা আমি সহজ হলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি জুডিথের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।

এর পরেই একটা ঘটনা ঘটল। রাতে খাওয়ার পরই আমরা সবাই বাগানে জটলা হই বা পায়চারি করি। হঠাৎ বাগানে সেদিন জুডিথ, যেদিকটা গোলাপ ফুলের ঝাড়, সেদিকে চলে গেল। এলারটনও তার পিছু পিছু গেল। ওদের সাহস দেখে আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম।

হয়তো আমার অবস্থা আঁচ করতে পেরে নরটন আমাকে বললেন, উত্তেজিত হবেন না, বাধা দেবেন না, ওদের নিজের পথে চলতে দিন। বাধা দিলেই বাঁধ ভাঙবে। সত্যকে মেনে নিলে শান্তি পাবেন।

কোথায় শান্তি। সে বহুকাল আগে স্টাইলস ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। নরটনকে ফেলেই আমি ঝোঁপের দিকে উন্মাদের মত ছুটে গেলাম। আড়াল থেকে যা দেখলাম তাতে লজ্জায়, ক্ষোভে আমার মুখ লাল হয়ে উঠল।

উহঃ, কি দুঃসাহস, কপোত-কপোতির মত ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে গাছের লতার মত। বাধা দেবার শক্তি হারিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। এলারটনের উত্তেজিত কথা কানে আসতেই সম্বিত পেলাম।

তাহলে ও কথাই ঠিক রইল প্রিয়তমা। দুজনে কাল লণ্ডনে মিলিত হচ্ছি। লাঞ্চ সারছি আমার বাসায়। দেখবে কেউ যেন জানতে না পারে। যাহোক কোনো অজুহাতে এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে।

হঠাৎ পেছন থেকে কোনো কথা না বলে নরটন আমায় টেনে নিয়ে গেলেন।

যেতে যেতে বিকারগ্রস্ত রোগীর মত বললাম, ভয় নেই নরটন। এই আমাদের জীবন। জন্মদাতা পিতারও অধিকার নেই নিজের সন্তানের উপর। এবার আমার কী কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছি।

চুপিচুপি এলারটনের ঘরে চোরের মতন থামলাম। কাছাকাছি কেউ আছে কিনা দেখে নিলাম। এতকাল পোয়ারোর সঙ্গে থেকে কোথায় কী সাবধনতা অবলম্বন করতে হবে জেনেছি। এখন আমার কাজ হল এলারটনকে কিছুতেই বেরিয়ে যেতে না দেওয়া এবং কাজটা যে পারব তা ভাবতে পারিনি।

বেশ কিছু অ্যাসপিরিন বড়ি সঙ্গে এনেছি। আমি জানি ওর ক্লান্তি হয় সেই স্লাম্বারিনের শিশি কোথায় থাকে। টেবিলের ওপর থেকে বোতলটা তুলে দেখি লেখা আছে। নির্দেশিত মাত্রার বেশি সেবন নিষিদ্ধ। আঙুলের ছাপ যাতে না থাকে, তাই রুমাল দিয়ে চেপে শিশির মুখটা খুললাম, আটটা বড়ি তুলে নিয়ে সমপরিমাণ অ্যাসপিরিনের বড়ি শিশির মধ্যে ফেলে দিলাম। তারপর শিশি রেখে চটপট করে নিজের ঘরে চলে এলাম।

এরপর ঠিক করলাম ঘুমাতে যাওয়ার আগে হুইস্কির প্রস্তাব দেব এলারটনকে, ও অরাজি না হয়ে খেলেই আর ঘুম ভাঙবে না।

এখন শুধু অপেক্ষা। হঠাৎ কারটিস ঘরে ঢুকল। চমকে উঠলাম। কি ব্যাপার সারাদিনে একবারও বন্ধুর কথা মনে পড়েনি–ওর কথায় লজ্জিত হলাম। ছুটে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে।

কৃত্রিম অভিমানে পোয়ারো আমাকে বলল, এই তোমার বন্ধু প্রীতি? তোমার সাহচর্য পাওয়ার জন্য ডেকে আনলাম আর আমায়ই ভুলে গেলে

ভুল বুঝো না বন্ধু, শরীরটা আসলে ভালো যাচ্ছে না।

এই বয়সে অত রোদে ঘুরলে শরীরের আর দোষ কী। নিশ্চয়ই মাথারও যন্ত্রণা হচ্ছে?

হা তাও হচ্ছে।

কারটিসকে ডেকে আমাকে কয়েকটি অ্যাসপিরিন দিতে বলল।

খেয়েছি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি, বলে উঠি।

 হুঁ, তাহলে দুটো মিশিয়ে সেই চকোলেট দাও।

 চকোলেট! সে আবার কী? এই প্রশ্ন করার মতন মানসিক অবস্থা নেই, কারণ, তখন মাথায় এলারটন ঘুরছে, বিনাবাক্যে বিশ্রী দুর্গন্ধ যুক্ত দুধটা খেয়ে নিলাম।

যাও, আর ঘোরাঘুরি কোরো না, শুয়ে পড়। পোয়ারো আমায় নির্দেশ দিল।

ঘরে এসে দরজা একটু ফাঁক করে রেখে এলারটনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।

একা বসে থাকলেই আমার স্ত্রী সিণ্ডারস-এর কথা মনে পড়ে। আমাদের সন্তানকে বাঁচাতেই হবে প্রিয়তমা, আমাকে ক্ষমা করো…..

হঠাৎ মনে হয় অন্ধকারে আমার স্ত্রী–আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিড় বিড় করে বলি…. সিণ্ডারস.সিণ্ডার…সিণ্ডা…..সি-ই-ই।

.

১৩.

পাখির কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভাঙে। কোথায় একটা রোমহর্ষক মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারতো, তা নয় একটা রোদ ঝলমলে দিন। ছি ছি! এই কি পিতার প্রতিভা? নিজের ওপর ধিক্কার এসে যায়।

পরক্ষণেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সত্যিই তো আমি কি করতে যাচ্ছিলাম! ঠান্ডা মাথায় একজনকে খুন করতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ টেবিলের ওপর হুইস্কির গ্লাস ও বোতল চোখে পড়তেই ওগুলো বেসিনে ফেলে দিয়ে আসি। তারপর পরিপাটি হয়ে পোয়ারোর ঘরের দিকে যাই।

সব শুনে পোয়ারো বলেন, কি কাণ্ডটাই না তুমি করতে যাচ্ছিলে বন্ধু, কাল রাতে কেন আমায় জানালে না?

অন্যায় হয়েছে পোয়ারো।

আমি নিঃসন্দেহে তোমায় বাধা দিতাম। ভেবে দেখো, ঐ ইতর শ্রেণীর লোকটার জন্য তোমায় ফাঁসির কাঠে তো আমি ঝুলতে দিতাম না।

না, তা হত না, কারণ আমি সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম, আচ্ছা বন্ধু তুমি কি সত্যিই অতটা বুদ্ধিমান হতে পেরেছো? পোয়ারো আমায় জিজ্ঞেস করল।

কেন নয়? আমি তো আঙুলের ছাপ যদি না পড়ে তার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।

আচ্ছা, তা নয় নিয়েছিলে, ভাবো যদি এলারটন মারা যেতো তাহলে কি কি হতে পারতো। পুলিশ ময়না তদন্ত করে জানতে পারলো স্লাম্বারিনের কারণে মৃত্যু হয়েছে। তখন ওটি দুর্ঘটনা না ইচ্ছাকৃত এটা প্রমাণ হত। তাহলে এখানে প্রশ্ন উঠত যদি এলারটন আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে ওকে কে শিশিটা এনে দিল? কারণ শিশিতে তো কারুর আঙুলের ছাপ নেই।

মিনমিনে গলায় বললাম, অনেকে তো মৃত্যুর পূর্বেও আঙুলের ছাপ মুছে ফেলে।

হুঁ, রাখে। কিন্তু অনেকেরই এখানে তেমন কোনো বিবাহযোগ্য কন্যা নেই যার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য এলারটন ঘুর ঘুর করছে, কারণ এ নিয়ে তুমি কালই জুডিথের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। ক্যারিংটন, নরটন এরা জানেন তুমি তোমার মেয়ের জন্য সহ্য করতে পারতে না ওকে। তখন সন্দেহ পড়ত তোমার কাজকর্ম কেউ লুকিয়ে দেখে ফেলেছে। না, তা সম্ভব নয়।

হয়তো কেউ ও পাশের ঝুলন্ত বারান্দায় লুকিয়ে থেকে দরজার চাবির ফুটো থেকে লক্ষ্য রাখতে পারে।

কারো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ওকাজ করবে।

না হলেই ভালো। তবে তোমাকে বলে রাখি ওই দরজার চাবির ওপর এখানে অনেকেরই নেক নজর আছে। কারটিসও ঘরের পাশেই থাকে।

গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলি, তোমার কী মনে হয় না, এখানে সেই বহুপূর্বের হত্যার বীজ প্রোথিত আছে।

আসলে তুমি বলতে চাও সংক্রামক রোগের মতন হত্যার ব্যাপারটা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

হা এ বাড়ির একটা বদনাম রয়ে গেছে। হা তা অস্বীকার করা যায় না। আচ্ছা, এখন জুডিথ ও এলারটনকে আসবার একটা বুদ্ধি দাও।

৬৬২

চুপ করে থেকে পোয়ারো বলল, এখন তার কোনো দরকার নেই।

নেই?

ভুলে যেও না জুডিথ নাবালিকা ও নিজে রোজগার করে। আমি যতটা জানি এলারটন লোকটা অসম্ভব ধূর্ত ও শয়তান, তোমার মতন নির্বোধ পিতাদের পাঠিয়ে ও মজা দেখে। আর জুডিথকেও তুমি বাগে আনতে পারবে না। তার থেকে এখন চুপ করে থাকাই ভালো। আমি এখন পঙ্গু, তাই অতটা ঝুঁকি তুমি এখন নিতে যেও না। বিপদ বেশি দূরে নয়, ধীরে ধীরে হত্যাকারী তার জাল গুটিয়ে আনছে। সাবধান হেস্টিংস।

অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

গতকাল রাতের টুকরো ভেসে আসা কথাতেই বুঝতে পারলাম বিপদ ঘনিয়ে আসছে। পোয়ারো জুডিথের উপর আস্থা রাখতে বলছে। হঠাৎ জুডিথের ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে মনসংযোগ আমাকে কিছুটা শান্তি দেয়। এলারটন কিন্তু প্রাতঃরাশের পরই লণ্ডনের পথে রওনা হয়ে যায়।

হয়তো জুডিথের সঙ্গে মিলনের আশা নিয়ে। দেখে মনে মনে হাসলাম।

বয়েড ক্যারিংটন আমার মুখ চোখ দেখে বললেন, আপনাকে ভীষণ খুশী মনে হচ্ছে, কী ব্যাপার? নার্স ক্লাভেন আসাতে আমাদের কথোপকথনে বাধা পড়ল। সে আমাদের জানালো মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের শরীর আবার বেশ খারাপ হয়েছে। শুধু এটা-ওটা চাইছিলেন। উদ্বিগ্ন হলেও বয়েডের মুখ দেখে তা বোঝা গেল না। বয়েড তবুও তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

এই ফাঁকে ক্লাভেন আমাকে জানাল, বুঝলেন না এসবই একরকমের চাল। স্বামীকে পাশে পাশে রাখা। এর মধ্যেই ডক্টর এসে গেছেন।

কিন্তু দেহের উত্তাপ?

আমি দেখেছি, নাড়ির গতি স্বাচ্ছন্দ্য, দেহও স্বাভাবিক নিরুত্তাপ, আসলে কারোর মুখ উনি সহ্য করতে পারেন না।

বেলা একটা নাগাদ ফ্রাঙ্কলিন ও জুডিথ এল। জুডিথকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাই ও সোজা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। হয়তো স্ত্রীর শরীরের অবনতির কারণে ফ্রাঙ্কলিন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। নরটন এক বাক্স চকলেট নিয়ে বসেছিলেন, হঠাৎ উঠতে গিয়ে তিনি নরটনের সব চকলেট মেঝেয় ফেলে দেন। তারপর ওগুলো কুড়োতে কুড়োতে বলেন, দুঃখিত, খুবই দুঃখিত।

নরটন ভুরু কুঁচকে বলেন, আপনাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

 হুঁ। তা বলতে পারেন। আসলে একটা পরীক্ষা ঠিক ভাবে শেষ করতে পারলাম না।

বিকেল বেলা একটু যেন সুখের পরশ এল। মিঃ ও মিসেস লাটরেল দুজনেই বেশ আনন্দিত বলে মনে হল, ব্রিজ খেলার প্রস্তাব করলেন হঠাৎ।

নরটন কিন্তু দ্বিখণ্ডিত হয়ে বলে, এতটা ধকল তোমার সইবে কি?

উনি বললেন, একবার খেলব। আর জর্জকে আমি মোটেই জ্বালাতন করব না।

ডেইজি-তুমি তো জানো আমি ব্রিজে কতটা কাঁচা

ভালোই তো, তোমার ঐ হেরে যাওয়া মুখটা দেখে আমি মজা পাব। বলেই হেসে ফেললেন।

বিকেলে লাটরেলরা বাদে আমরা সবাই বাগানে বসেছিলাম। কথায় কথায় স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতার প্রসঙ্গ উঠল। মনে হল যতদিন সিণ্ডারস বেঁচে ছিল, আমারও সুখ ছিল।

নরটন বলে, খুব দেরিতে এটা বুঝতে পারলাম।

তাই নাকি? বয়েড একেবারে ভুরু কুঁচকে বলে। একেবারে প্রাণের কথা?

ঠিক এই সময় মিস কেলি এলেন। নরটনের দিকে ওর চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হল, গোপনে ওদের মন-দেওয়া নেওয়া চলছে। এর মধ্যেই হৈ হৈ করে জুডিথ এসে পড়ল। এসে ঘোষণা করল, এখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বেশ সুস্থ। তিনি সবাইকে ঘরে কফি খেতে ডাকছেন।

আমরা সবাই আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে গেলাম।

মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের বিভিন্ন সময়ের গতি প্রকৃতির সঙ্গে এখনকার কোনো মিল নেই। হয়তো নার্সের সঠিক মূল্যায়নের ফল এটি। ঘরের মধ্যে ফ্রাঙ্কলিন একটু দূরে চেয়ারে বসে। বয়েড দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের পাশেই। আর মিস কেলি ও নরটন পাশাপাশি জোড়া পায়রার মত বসে। নার্স ক্লাভেন বিছানার এক প্রান্তে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি দ্য টাইমস কাগজটা পড়ছিলাম। হঠাৎ সবার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম। এখানে একটা বাঁধা দিয়েছে। টেনিসনের একটা পংক্তি। বলছি শুনুন প্রতিধ্বনি যেভাবেই উঠুক, তার একটি মাত্র উত্তর শেষ শব্দটা নেই। কী হবে বলুন তো?

মিসেস ফ্রাঙ্কলিন কিছু না ভেবেই বললেন, ওখানে হবে কোথায়।

মিস কেলি বললেন, লাইনটা এরকম–প্রতিধ্বনি যেভাবে উঠুক তার একটি মাত্রই উত্তর মৃত্যু।

ঠিক আছে। এবার বলুন তোকে বলেছে–ঈর্ষা একটি হরিৎ চক্ষু দানব-ক্যারিংটন বলেন –শেক্সপীয়র।

মিসেস ফ্রাঙ্কলিন সঙ্গে সঙ্গে বলেন এর সঙ্গে বলতে হবে এটা কোনো চরিত্রের সংলাপ।

ইয়াগো।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ওথেলো।

না। আমি বললাম ওটা রোমিও বলেছে জুলিয়টকে। হঠাৎ বাচ্চা মেয়ের মতন জুডিথ বারান্দা থেকে বলল, দেখুন, কী সুন্দর একটা ধূমকেতু।

সবাই দেখতে গেলাম। বয়েড হঠাৎ বারবারাকে কোল পাঁজা করে নিয়ে বারান্দার দিকে গেলেন। আমি শুধু উঠলাম না। একটু পরেই সবাই ফিরে এল, শুধু এলিজাবেথ ও নরটন কফি শেষ করে বিদায় নিল।

কফি শেষ করেই মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন, আমার ওষুধ, বাথরুমে রেখেছিলাম

জুডিথ-বাথরুম থেকে এনে দিল। ফ্রাঙ্কলিন উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। আর সেজন্য হঠাৎ টেবিলে ধাক্কা খেলেন।

বারবারা চিৎকার করে ওঠে–কী হচ্ছে কী?

লজ্জিত হয়ে, বাগান থেকে একটু বেরিয়ে আসি, বলেই বেরিয়ে গেলেন। জুডিথও চলে গেল। বয়েড বলল একহাত তাস খেললে কেমন হয়?

চমৎকার!

বারান্দায় শুনতে পেলাম ফ্রাঙ্কলিন জুডিথকে বলছে একটু বাগানে বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু জুডিথ ভীষণ ক্লান্ত বলে যেতে অস্বীকার করাতে ফ্রাঙ্কলিন একাই চলে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত খুশী দেখাচ্ছে আপনাকে–

ফ্রাঙ্কলিন তখন বললেন, আসলে অনেক দিন আগের একটা কাজ শেষ করতে পেরেছি।

পোয়ারোর ঘরে দেখি জুডিথ বসে। ঘরে ঢুকতেই পোয়ারো আমাকে বলল, দেখ, ও ঐ রকম মেয়েই নয়, তোমায় আগেই বলেছি, ও তোমায় ক্ষমা করেছে।

তাই নাকি?

বাবা তুমি আঙ্কল পোয়ারোর কথায় কিছু মনে কোরো না, আসলে তুমিই আমায় ক্ষমা কর। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। আমি কিছু বলার আগেই ও ঘর থেকে চলে গেল।

এবার পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল-ওহে হেস্টিংস বিকেলের ব্যাপারটাও তো আমার জানতে ইচ্ছে করে।

বললাম, নতুন কোনো সংবাদ নেই। মনে হচ্ছে কোনো অঘটন এখানে ঘটছে না।

কিন্তু রাতেই যে অঘটন ঘটল তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। মিসেস ফ্রাঙ্কলিন হঠাৎ শেষ রাতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত দুজন ডাক্তারও তাকে বাঁচাতে পারেনি, এবং চব্বিশ ঘন্টা পরে জানতে পারলাম বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে, এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।